দরজা খুলতেই একটি অল্পবয়সী ছেলে জিজ্ঞাসা করল, এখানে দীপাবলী মুখার্জী থাকেন?
দীপাবলী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। ছেলেটির হাতে একটা খাম আর দুটো রঙিন কাগজের টুকরো। খামটা এগিয়ে দিয়ে বলল, চিঠি আছে। এ দুটোয় সই করে দিন।
দীপাবলী কলমের জন্যে ফিরছিল কিন্তু ছেলেটি তাকে সাহায্য করল। এই প্রথম সরকারি মাধ্যমের বাইরে তার হাতে চিঠি এল। দরজা বন্ধ করে খামের মুখ খুলে চিঠিতে চোখ রাখল সে। গতকাল চিঠিটা লেখা হয়েছে। দীপা, জরুরী কাজে কলকাতায় যাচ্ছি। থাকব তিনদিন। পৌঁছাবো আগামীকাল বিকেলে। তার আগেই যাতে খবরটা পাও তাই। বেসরকারি ব্যবস্থায় চিঠি পাঠাচ্ছি। আমি জানি খবরটার জন্যে তুমি আদৌ ব্যস্ত নও। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। এবার একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার বলে মনে করি। আমি উঠব গোলপার্ক গেস্টহাউসে। টেলিফোনের বই-এ নাম্বার পাবে। সময় দিতে পারলে কৃতার্থ হব। অলোক।
কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দীপাবলী। চিঠিটা দ্বিতীয়বার পড়ল। জরুরী কাজ থাকলে যে কেউ কলকাতায় আসতে পারে। কিন্তু তাকে চিঠি লেখার কি দরকার? অলোক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে মানে ডিভোর্স? দীপাবলী নিঃশ্বাস ফেলল। দিল্লী ছাড়ার আগে সে স্পষ্ট বলে এসেছিল যে অলোক যদি আইনগত বিচ্ছেদ চায় তাতে সে আপত্তি করবে। না। এক্ষেত্রে কাগজপত্র পাঠিয়ে দিলেই তো পারত।
দ্বিতীয় চিন্তায় মাথায় এল, অলোক সরাসরি এই ফ্ল্যাটে এসে উঠছে না। অন্তত এটুকু সম্মান সে তাকে দিচ্ছে। যদিও এই ফ্ল্যাট অলোকের সুপারিশেই পাওয়া তবু ও তার কথা রেখেছে। চিন্তাটা মাথায় এলেও দীপাবলী উৎফুল্ল হতে পারছিল না।
কিরে। এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস?
দীপাবলী মুখ ফিরিয়ে মনোরমাকে দেখল। মনোরমা দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন, কার চিঠি?
অলোকের। আলতো উচ্চারণ করল সে।
ওমা! জামাই আসছে নাকি?
জামাই শব্দটি কানে লাগল খট করে। তবু মাথা নাড়ল সে, হ্যাঁ।
কবে?
কাল। দীপাবলী পাশ কাটিয়ে ভেতরের ঘরে চলে এল।
পেছন পেছন এলেন মনোরমা, তুই এত গম্ভীর কেন?
গম্ভীর? কই, না তো!
আয়নায় মুখ দ্যাখ। আমি বাবা বুঝিনে। এতদিন বাদে বর আসছে আর তুই মুখ হাঁড়ি করে রেখেছি। যেন এলে খুব অসুবিধে হবে।
ও আসছে অফিসের কাজে। অফিসের গেস্টহাউসে থাকবে। আমার অসুবিধে কি?
কেন? অফিসের গেস্ট হাউসে থাকবে কেন? ওর বউ রয়েছে এখানে, দায়িত্ব বলেও তোে একটা কথা আছে। তাই লিখেছে নাকি?
হুঁ। ছেড়ে দাও এসব কথা। একটু শুই, বড় ঘুম পাচ্ছে।
চিঠিটিকে টেবিলে রাখতে গিয়েও পারল না দীপাবলী। একটি বই-এর মধ্যে খুঁজে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মনোরমা পাশে এসে বসলো। নাতনির মাথায় হাত বোলালেন, এই, সত্যি কথা বলতো, কি হয়েছে।
দীপাবলী কাঠ হল, কি আবার হবে।
ঝগড়াঝাঁটি করেছিস এরই মধ্যে?
এরই মধ্যে শব্দটা কানে লাগল। হ্যাঁ বললে অনেকগুলো প্রশ্ন বেরিয়ে আসবে হুড়মুড় করে। না বললে বৃদ্ধা বিশ্বাস করবেন না। এতদিন যখন একা ছিল তখন যা কিছু সমস্যা তা নিজের ছিল। চুপচাপ তাই বহন করতে হত। কষ্ট হলেও সেটা ছিল নিজের। কেউ সঙ্গে থাকলে অনেক ব্যাপারে খুব সুবিধে হয় ঠিক কিন্তু সমস্যারাও আর আগের মত নিজস্ব থাকে না। মনোরমা কৈফিয়ৎ চাইছেন না কিন্তু ওঁর কৌতূহল মেটানোর দায় থেকে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা করতে গেলে বিশদে বলতে হয়। যেটা সে একদমই পারবে না।
দীপাবলী পাশ ফিরল, ঝগড়াঝাঁটি কিছু হয়নি।
তাহলে?
কি তাহলে?
অলোক এ বাড়িতে একদমই আসবে না?
আমি তো ওর প্রোগ্রাম কিছু জানি না। সময় পেলে নিশ্চয়ই আসবে।
তুই ওকে এখানে এসে থাকতে বল!
বেশ, বলব।
তুই কি রে! আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
আমরা এইরকম। নিজেদেরই বুঝি না।
সম্ভবত মনোরমা আঁচ করলেন তিনি অনেকখানি কৌতূহল প্রকাশ করে ফেলেছেন। বার্ধক্য আসা সত্ত্বেও তিনি বিবেচনাবোধ হারাননি। তিনি সরে গেলেন সামনে থেকে। কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞ চোখ লক্ষ্য করল বিকেলে যখন দীপাবলী বাজারে গেল তখনও অনেকখানি আনমনা। অন্যদিনের মত ঝকমকিয়ে কথা বলছে না। রাত্রে শাওয়ার পরেও চুপচাপ রইল। মনোরমা আর প্রশ্ন করতে সাহসী হলেন না।
সকালে উঠেই দীপাবলীর মনে হচ্ছিল অলোক শহরে এসেছে। একই কলকাতায় ওরা আছে। ইচ্ছে করে ভাবনাটা সরিয়ে দিলেও সেটা বারংবার ফিরে আসছিল। সে যন্ত্রের মত কাজ করে গেল। ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাল। অলোক একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চায়। তাই হোক। কেউ যদি মন থেকে কিছু চায় তাহলে সেটা তার পাওয়া উচিত। টেলিফোন গাইড বের করে গেস্টহাউসের নাম্বার নিয়ে সে অপারেটরকে লাইনটা দিতে বলল। লাইন এনগেজউ।
সকালে যে ভদ্রলোকের কেস ছিল তিনি ভাবতে পারেননি যে এতসহজে দীপাবলী তাঁকে ছেড়ে দেবে। এই মহিলা অফিসারের খুঁতখুঁতানির যে গল্প তিনি শুনেছিলেন তার সঙ্গে আজকের আচরণের কোন মিল খুঁজে পেলেন না। সাড়ে বারোটা নাগাদ আই এ সি তাকে ডেকে পাঠালেন। খুবই জরুরী। দীপাবলী ওঁর ঘরে গিয়ে দেখল চারজন অচেনা লোক বসে আছেন সামনে। আই এ সিকে খুবই বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। সে জিজ্ঞাসা করল, ডেকেছেন?
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, এইসময় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারও ঘরে এলেন। আই এ সি বললেন, জেন্টলমেন, এঁরা দুজনেই আই আর এস। আপনারা যা করতে চলেছেন সেই ব্যাপারে নিঃসন্দেহ তো?
চারজন লোক উঠে দাঁড়ালেন। অবশ্যই। আপনারা আমাদের সঙ্গে আসুন। এঁদের একজন দীপাবলীদের দিকে তাকিয়ে বললেন। দীপাবলী বা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। আই এ সি বললেন, এরা যা চাইছেন তাই করুন, প্লিজ।
দীপাবলী সেই ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করল, আমাদের কোথায় যেতে হবে এবং কেন?
ভদ্রলোক বললেন, আমরা সি বি আই থেকে আসছি। এখানে একটা ছোট্ট অপারেশন আছে। আপনাদের সাক্ষী হিসেবে থাকতে হবে। আসুন। ঘড়ি দেখলেন ভদ্ৰলোক।
উত্তরের অপেক্ষা না করে ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দীপাবলীরা অনুসরণ করল। সামনেই করিডোর। তার দুপাশে অফিসারদের ঘর। ঘরের ওপরে হিন্দী বাংলায় অফিসারের নাম লেখা রয়েছে। দীপাবলী বিস্মিত হয়ে দেখল ওঁরা মিস্টার সিন্হার ঘরে ঢুকছেন। সেইসময় সিনহা তাঁর স্টেনোকে ডিকটেশন দিচ্ছিলেন। হঠাৎ এতগুলো লোককে ঢুকতে দেখে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার? আপনারা এখানে কেন? কি চাই?
চারজনের প্রধান জানতে চাইলেন, আপনি মিস্টার সিনহা?
ইয়েস।
আপনি একটু উঠে দাঁড়ান। এপাশে সরে আসুন। আমরা সার্চ করব। ভদ্রলোক তাঁর সরকারি পরিচয়পত্র দেখালেন। সিনহার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি দরজায় দাঁড়ানো দীপাবলী এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই চিৎকার করে উঠলেন, হোয়াট ইজ দিস? ইউ কান্ট ডু ইট। মিসেস মুখার্জী, টেল দেম, আই অ্যাম এ রেসপেক্টবল অফিসার।
এই সময় ফোন বেজে উঠল। সি বি আই অফিসার রিসিভার তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, কে বলছেন? ওহো, তুমি। এভরিথিং ওকে? গুড। হ্যাঁ দাও। রিসিভার নামিয়ে তিনি বললেন, আপনার ফোন, মিসেস সিনহা কথা বলবেন।
কাঁপা হাতে সিনহা ফোন নিল, হ্যালো? কি? বাড়িতেও রেইড হচ্ছে! ওহো। তোমরা কেন ঢুকতে দিলে? পুলিশ নিয়ে এসেছে তো কি হয়েছে? ঠিক আছে, কো-অপারেশন কর। আমি আসছি।
ততক্ষণে তিনজন সি বি আই কর্মী খোঁজা শুরু করে দিয়েছেন। ড্রয়ার, আলমারি, বিশেষ কয়েকটা ফাইল খুঁজে বের করার পর অফিসার বললেন, মিস্টার সিনহা, আপনার পকেটে যে দশ হাজার টাকার বান্ডিল আছে সেটা টেবিলের ওপরে রাখবেন?
টলে গেলেন সিনহা। হাউ ডু ইউ নো দ্যাট! এটা আমার টাকা।
রাখুন আগে।
ভদ্রলোকের গলার স্বরে একটু কেঁপে উঠলেন সিনহা। পকেট থেকে একশ টাকার বান্ডিল বের করে টেবিলে রাখলেন। অফিসার হাতের অ্যাটাচি কেস থেকে একটা কাগজ বের করে দীপাবলীদের ইঙ্গিত করলেন, এখানে একটা নোটের নাম্বার লেখা আছে। সব হান্ড্রেড রুপি নোট। আমরা এখনও ওই বান্ডিল দেখিনি। আপনারা বান্ডিল না ছুঁয়ে প্রথম নাম্বারটা দেখে এসে মিলিয়ে নিন।
দেখা গেল নম্বরদুটো আলাদা নয়। সিনহা তখন চেঁচাচ্ছেন, ইটস এ ড্রাপ। আমার কাছে যে নোট আছে তার নাম্বার কেউ জেনে আপনাদের ইনফর্ম করেছে।
নো স্যার। আজ আপনি যাঁর কাছ থেকে এগুলো নিয়েছেন তাঁকে আমরাই পাঠিয়েছিলাম। আপনার বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এই বান্ডিলটা আপনি ছাড়া আমরা কেউ ধরিনি। টেবিলের ওপর ঢাকা দেওয়া জলের গ্লাসটা তুলে তিনি দীপাবলীকে বললেন, অনুগ্রহ করে আপনার আঙুল এই গ্লাসের জলে ডোবাবেন?
দীপাবলী হতভম্ব, কেন?
আমাদের সাহায্য করা হবে।
দীপাবলী অনুরোধ রাখল। ইতিমধ্যে সমস্ত বিল্ডিং-এই রাষ্ট্র হয়ে গেছে সি সাহেবের ঘরে সিবিআই রেইড হচ্ছে। করিডোরে দারুণ ভীড় জলের দিকে তাকিয়ে অফিসার বললেন, লুক, জলের রঙ একই রইল। এবার মিস্টার সিনহা, আপনি আঙুল ভোবান?
সিনহা রাজী হচ্ছিলেন না। কিন্তু তাঁকে বাধ্য করা হল। দেখা গেল গ্লাসের জলের রঙ একটু একটু করে নীল হয়ে যাচ্ছে। সি বি আই অফিসার বললেন, তাহলে ওই নোটগুলোতে কেমিক্যাল মিশিয়ে দেওয়ার কাজটা নিশ্চয়ই আপনি করেননি?
মিস্টার সিনহা, আপনি পার্টিদের চাপ দিয়ে ঢাকা নেওয়ার সময় আজকাল এমন ডেসপারেট হয়ে গিয়েছিলেন যে কোন কিছুই বিবেচনা করেন না। গতকাল আমাদের এক লোক এসে আপনাকে একটি কেস করে দিতে অনুরোধ জানায়। কেসটি আপনার এক্তিয়ারে আছে কিনা, কেসের মেরিট কি এসব না জেনে শুধু টোটাল ইনকাম জিজ্ঞাসা করে আপনি দশ হাজার টাকা আজ নিয়ে আসতে বলেন। আমরা এই টাকাটা পাঠাই। আপনাকে জানাচ্ছি ওই নামের কোন ফাইল আপনার কাছে নেই।
মিস্টার সিনহাকে গ্রেপ্তার করা হল। টাকা এবং উপহার দিয়ে সবার মুখ বন্ধ রেখে যে ভদ্রলোক নিজেকে সম্রাটের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে মাথা নিচু করে অধস্তন কর্মচারীদের টিটকারি শুনতে শুনতে গাড়িতে উঠতে হল। দীপাবলী এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার তখনই নিস্কৃতি পেল না। সি বি আই অফিসাররা তাঁদের অফিসে গিয়ে রিপোর্ট তৈরী করার আগে দুজনের স্টেটমেন্ট নিয়ে নিল।
যখন দীপাবলী রাস্তায় পা দিল তখন ঘড়িতে চারটে। এতক্ষণ ঝড়ের মত সময় কেটেছিল। অফিস থেকে বেরুনোর সময় সে চলে এসেছিল ফাইলপত্র তুলে রাখতে। এখন আর ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। সিন্হার মুখটা একটু একটু করে কেমন চুপসে গেল। এই লোকটি এবার ছেলেমেয়ে স্ত্রীর সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন কি করে? ডিপার্টমেন্ট ওঁকে আপাতত সাসপেন্ড করবে। কিন্তু অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার বলছিলেন ঘুষ নেবার দায়ে ধরা পড়ে সাসপেন্ড হয়েছেন এমন অনেক কর্মচারী পরবর্তীকালে বেকসুর খালাস পেয়েছেন প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও। কেন পান কে জানে। হয়তো সিন্হা-ও দুই চার বছর বাদে ছাড়া পাবেন। কিন্তু যে সম্মান আজ হারালেন তা কি ফিরে পাবেন? অবশ্য এদেশের মানুষের মন থেকে আত্মসম্মানবোধ যে হারে উধাও হচ্ছে তাতে একদিন এনিয়ে হয়তো কেউ মাথা ঘামাবে না।
বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো মাত্র অলোকের মুখটা মনে এল। এতক্ষণ এই টালমাটালের মধ্যে পড়ে অলোক খানিকটা দূরে সরে ছিল ওর কাছে। দ্বিতীয়বার অলোককে টেলিফোন করার সুযোগ হয়নি। এমনও আশা করা যায় না কাজে এসে কোন লোক এই ভরবিকেলে গেস্টহাউসে বসে থাকবে। টেলিফোন নয়, দীপাবলী ঠিক করল গোলপার্কে গিয়ে গেস্টহাউস খুঁজে বের করে একটা নোট রেখে আসবে অলোকের জন্যে। ইচ্ছে করলে অলোক আগামীকাল তার অফিসে এসে দেখা করতে পারে।
গোলপার্কে নেমে গেস্টহাউস খুঁজে বের করতে বেশী সময় লাগল না। এই পথটুকু আসার সময় নিজের কথা ছাপিয়ে বারংবার সি তার চিন্তায় ঢুকে পড়ছিল। সিনহা ধরা পড়া প্রমাণ হল কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়। প্রত্যেককেই দাম দিতে হবে। একরা বাথরুম অথবা পুরো কাঁচের দেওয়ালের স্বাচ্ছন্দ্য যদি কালো টাকায় আসে তাহলে এভাবেই তা ভেঙে যায়। আগামীকাল নিশ্চয়ই খবরের কাগজে ছাপা হবে, ঘুষ নেবার দায়ে আয়কর অফিসার গ্রেপ্তার। আরও দৃঢ় হবে মানুষের চলতি ধারণা। কিন্তু আর একটা ছবি মনে পড়ল এইসঙ্গে। প্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার সময় সিনহাকে দেখে যাঁরা উল্লসিত হয়ে টিটকিরি দিচ্ছিলেন তাঁদের মুখগুলো ছিল খুব চকচকে। এরাই অফিসের পেশকারগিরি থেকে পিওনের কাজ করেন। সিনহা সাহেব ঘুষ নিতেন, আর বকশিস চাপ দিয়ে আদায় করেন এদের অনেকেই। তাহলে সিনহার ওই হেনস্থায় এরা কেন আনন্দিত হলেন? কেউ বেশী পাচ্ছে এবং আমি অল্প পাচ্ছি তাই বেশী পাওয়ার লোকটির প্রতি বিদ্বেষ? নাকি কাউকে অন্যায় করে শাস্তি পেতে দেখলে মানুষ নিজের অন্যায়ের কথা ভুলে যেতে পারলে খুশী হয়? উত্তরটা দীপাবলী জানে না।
গেস্টহাউসের দারোয়ান জানাল অলোক মুখার্জী নামে এক সাহেব কাল দিল্লী থেকে এসেছেন। দোতলার চার নম্বর ঘরে উঠেছেন। অলোক এখন আছেন কিনা দারোয়ান বলতে পারল না। ঘরে খোঁজ করে না পেলে মেসেজ দিয়ে গেলে সে অলোককে পৌঁছে দিতে পারে পরে। রিসেপশন বলে কিছু নেই। এই গেস্টহাউসের খবর অলোক পেল কি করে? দীপাবলী ভেতরে ঢুকে সিড়িতে পা দিল। তিনটে ছেলেমেয়ে চিৎকার করে নেমে আসছে ওপর থেকে। নামা না বলে লাফানো অনেকটা কাছাকাছি। দীপাবলী এক পাশে সরে দাঁড়াল। ওরা চেঁচাচ্ছে কোন নাটক বা সিনেমার সংলাপ আওড়াবার জন্যে এটা বুঝতে দেরি হল। হুড়মুড় করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল ওরা। দীপাবলীর হঠাৎ মনে হল তার নিজের শরীর ভারী হয়েছে। এইরকম ছটফটিয়ে নামতে পারবে না সে। তিনজনই বাঙালি কিন্তু কথা বলা চাল চলনে তা বোঝার উপায় নেই। শুধু শেষ সিড়িতে পাশের ছেলেটি বড় পাশে এসে গিয়েছিল বলে মেয়েটি সংলাপ থামিয়ে গায়ে পড়বি না বলে ধমকে উঠেছিল কিন্তু চলা থামায়নি। নিজেকে বয়স্কা ভাবতে গিয়ে দীপাবলীর মনে পড়ল ওই বয়সেও সে এমনভাবে নামতে পারত না।
চার নম্বর ঘরের দরজা খোলা। দীপাবলী এইটা আশা করেনি। খোলা দরজায় পর্দা ঝুলছে। সে যে এসে দাঁড়িয়েছে তা ভেতরের লোক বুঝবে না।ইতস্তত ভাবটাকাটিয়ে দীপাবলী এগিয়ে গেল। পদার আড়াল থেকেই দরজার খোলা পাল্লায় মৃদু আওয়াজ করল। ভেতর থেকে অলোকের গলা ভেসে এল, কে?
দীপাবলী পর্দা সরাল। অলোক শুয়ে আছে খাটে। মাঝারি ঘর। ওপাশের জানলা খোলা সত্ত্বেও মরে যাওয়া আলো তেমন আসছে না। ঘরের আলো জ্বালা হয়নি।
চোখাচোখি হওয়ামাত্র তড়াক করে খাট ছেড়ে নামল অলোক। স্বাভাবিক মুখে বলল, এসো। খুঁজে বের করতে অসুবিধে হয়নি তো?
দীপাবলী মনে মনে অবাক। অলোকের ভাবভঙ্গীতে মনে হচ্ছিল ঠিক এইসময় সে। আসবে তা ওর জানা ছিল, কোনও চমক নেই তাই। সে জবাব দিল, না, অসুবিধে আর কি!
অলোকই একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, বসো। চা খাবে?
খুব ইচ্ছে করল দীপাবলীর। সারাটা দিন যে উত্তেজনার মধ্যে কেটেছে তাতে চায়ের কথা মাথায় ছিল না। কিন্তু যে ছাড়াছাড়ি চূড়ান্ত করতে দিল্লী থেকে ছুটে এসেছে তারই দেওয়া চা খেতে রুচিতে বাধল। সে বলল, থাক।
অলোক জোর করল না। পরিবর্তনটা চোখে ঠেল। আগেকার অলোক এই অবস্থায় দুতিনবার অনুরোধ করত। সেই অনুরোধ যে সবসময় শুনতে ভাল লাগত তা নয় কিন্তু সেটাই অলোকের স্বভাব ছিল।
দ্বিতীয় চেয়ারটি টেনে নিয়ে অলোক জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ?
ভাল শব্দটি বলতে গিয়েও থেমে গেল দীপাবলী। সে যতই খারাপ থাকুক তাতে অলোকের যখন কিছু এসে যায় না তখন ভাল বলাটাই উচিত। ভাল সে থাকবেই বা না কেন? কিন্তু ভাল বললেই পুরনো অলোক বলতে পারে, তাতো থাকবেই। আমাকে ছাড়া থাকলেই তুমি ভাল থাক। দিব্যি চলে যাচ্ছে তোমার। এবং এই সূত্রে নানান কথার সূত্র।
সে মাথা নেড়ে বলল, আছি। কাল তোমার চিঠি পেলাম।
লোকে ভদ্রতা করে পাল্টা জিজ্ঞাসা করে অন্যের কুশল।
ভদ্রতাটা মোটা দাগের হলে সেটা আমার আসে না। যাক, লিখেছ কাজে এসেছ। অসময়ে গেস্টহাউসে শুয়ে কেন? বলতে আপত্তি থাকলে বলো না।
বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। আমি কি কাজে এসেছি তা নিশ্চয়ই লিখিনি।
নিশ্চয়ই অফিসের কাজ?
না। এটা একদম ব্যক্তিগত। তুমি কি আমাকে পাবে না ভেবে এসেছিলে?
হ্যাঁ। তাতে তোমার চিঠি দেওয়ার মত আমার আসাটাও সমান হয়ে যেত।
আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব বলেই এসেছি।
নতুন কোন কথা কি আছে আর? আমরা অনেক কথা বলে ফেলেছি এর মধ্যে। এখন বলতে গেলে যা মুখে আসে তা দুজনেই নিশ্চয়ই বলতে চাই না।দীপাবলী হাসার চেষ্টা করল, তাছাড়া আমি তোমাকে সমস্ত কিছু থেকেই মুক্তি দিয়ে এসেছিলাম। নিশ্চয়ই এতকাল তুমি বেশ আরামে আছ।
যদি বল দিল্লীতে ফিরে গিয়ে শুধু তোমার জন্যে কান্নাকাটি করেছি, কোন কাজকর্ম করিনি তাহলে মিথ্যে কথা বলা হবে। তুমিও নিশ্চয়ই তা আশা কর না।
না। ওটা বোকা বোকা ব্যাপার। বেশ, বলল, কি জন্যে এসেছ?
অলোক সামান্য চুপ করে রইল। তারপর বলল, ঠিক কিভাবে বললে স্পষ্ট বলা হবে তা বুঝতে পারছি না। আগামীকাল দেখা হতে পারে?
কিছু ভেবেই তো এতদূরে এসেছ। এখন পারছ না, আর একদিনে পারবে?
ওহো, তুমি বড্ড মাস্টারনি মাস্টারনি কথা বলছ!
দীপাবলি কোন কথা বলল না। তার চোখ অলোকের মুখের মুখের ওপর স্থির, যেন অলোক সঠিক উত্তরটা দেবে তাই সে অপেক্ষা করছে। অলোক সেটা বুঝতে পেরেই গলা পাল্টাল, দ্যাখো, তোমাকে আমার দরকার। আই নিড ইউ। দিল্লীতে থাকার সময় আমরা দুজনেই অনেক ভুল করেছি। সেগুলো আমার তরফে ঘটবে না এখন প্রমিশ করছি।
দীপাবলী সোজা হয়ে বসল, কেন তোমার আমাকে প্রয়োজন হল?
তুমি চলে আসার পর আমি বুঝতে পেরেছি, আসলে একসঙ্গে থাকলে অনেক সময় ঠিক বোঝা যায় না। অলোক অপরাধীর হাসি হাসল।
দীপাবলী বলল, এ ব্যাপারটাও কি একতরফা হচ্ছে না? তোমার মনে হল আমাকে দরকার তাই ছুটে এলে। মনে না হলে আসতে না। আর তোমার যেমনটি মনে হবে আমাকে ঠিক তেমনটি করতে হবে?
অলোক অবাক, তার মানে?
দীপাবলী মাথা নাড়ল, আমার তো মনেই হচ্ছে না তোমাকে আমার দরকার।
মানে?
এটাই সত্যি কথা অলোক।
তুমি, তুমি আমাকে ভালবাসোনা?
যদি বাসি তাহলে সেটা আমার নিজস্ব সমস্যা। তার সঙ্গে প্র্যাকটিকাল লাইফের কোন সম্পর্ক নেই।
দীপা! অলোকের ঠেটি থেকে অসাড়ে শব্দটি ঝরল।
অলোক, বিয়ের আগে আমরা নিজেদের যতটা চিনেছিলাম বিয়ের পর একটু একটু করে তার বিপরীত চেনাটা চিনেছি। আমাদের দুজনের জগৎ আলাদা, স্বভাব বিপরীত রকম। শুধু সংসার এবং শরীরের জন্যে একসঙ্গে থাকা ছাড়া আমাদের কোন কমন প্ল্যাটফর্ম নেই। এটাই সত্যি। আমি চলে আসার পরে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যাতে এই সত্যিটা বদলে। যেতে পারে। এক ভুল দুবার করা যায়, তিনবার নয়। আমি চলি। দীপাবলী উঠেদাঁড়াল।
অলোক সকাতর জিজ্ঞাসা করল, তুমি আমায় ক্ষমা করবে না?
ক্ষমা চাইছ কেন? তুমি তোমার মত আমি আমার মত চলেছি। এখন জোর করে এক করার চেষ্টা হলে সেটাই কাঁচের পাত্রের মত হবে। কিন্তু কেউ কোন অন্যায় করিনি যে ক্ষমা চাইতে হবে। দীপাবলী দরজার দিকে এগোল।
অলোক শেষবার চেষ্টা করল, তোমার কাছে স্মৃতির কোন মূল্য নেই?
স্মৃতি অবশ্যই মূল্যবান। কারণ সেটা অতীত। আমি কখনই অতীতকে সামনে টেনেআনতে চাই না। ভাল থেকো, এলাম। দীপাবলী ধীরে ধীরে সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে এল। ফুটপাতে পা দিয়ে সে অল্পক্ষণ গোলপার্কের ছুটন্ত গাড়িগুলোর দিকে তাকাল। এবং তখনই মনে পড়ল বাড়িতে বিস্কুট কমে এসেছে। ধীরে সুস্থে সংসারের টুকিটাকি জিনিসগুলো কিনে নিয়ে মিনিবাসের জন্য বাসস্ট্যান্ডে এল। একটু খালি বাস পেতে তাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল।
বাড়ির সামনে এসে চোখ তুলতেই নিজের ব্যালকনিতে মনোরমাকে দেখতে পেল সে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কলকাতার বুকে ভাল রাত। মনোরমা কি শুধু তার জন্যেই রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন?
ওপরে উঠে দীপাবলী দেখল ইতিমধ্যে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন মনোরমা। ঘরে ঢুকে সে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ?
ভাল। হাতমুখ ধুয়ে নে, চা বানাচ্ছি।
দীপাবলী স্নান করল। মনোরমা চা নিয়ে এলে সেটায় আরাম করে চুমুক দিল। একটু ইতস্তত করে মনোরমা জিজ্ঞাসা করলেন, জামাই-এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
দীপাবলী সহজ গলায় বলল, হ্যাঁ।
আসবে না?
না। আমি নিষেধ করেছি।
সেকি? কেন? মনোরমা চমকে উঠলেন।
দীপাবলী বৃদ্ধার দিকে তাকাল, অনেক বছর আগে ঠাকুদা আমাদের চা বাগানের বাড়িতে এলে তুমি তাকে চিনতেই অস্বীকার করেছিল। বাবা মা কেউ বুঝতে পারেনি কেন তুমি অমন কাজ করলে! আমি অবশ্য চিনেছি কিন্তু স্বীকার করে আর একটা ভুলের দিকে এগিয়ে যেতে চাই না।
মনোরমা আর কথা বাড়াননি। প্রতি রাত্রের কাজগুলো নিয়মমত সেরে দুজনে একসময় বিছানায় পাশাপাশি। কোলকাতার কোথায় কোন শব্দ থাকলেও এত ওপরের ফ্ল্যাটে তা পৌঁছাচ্ছে না। দীপাবলীর আজ হঠাই ঘুম আসছিল না। তার মনে হল মনোরও ঘুমাচ্ছেন না। সে মৃদু গলায় ডাকল, ঠাকুমা।
হঠাৎ মনোরমা পাশ ফিরে তার শীর্ণ হাত বাড়িয়ে নাতনিকে জড়িয়ে ধরলেন। লোমচর্ম শরীরেও যে উত্তাপ থাকে তা দীপাবলীকে আশ্বস্ত করল। তার মনে হল বাইরের পুরুষদের সঙ্গে লড়াই করলেই যা পাওয়া যায় না নিজের মনের অন্ধকার সরালে তা পাওয়ার পথ পরিষ্কার হয়। সে মনোরমাকে আঁকড়ে ধরল। দীর্ঘ বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও পরস্পর যেন একাত্ম।
।।সমাপ্ত।।