১৯. দিল্লী শহরে

দিল্লী শহরে পরিচিত কোন মানুষ নেই। এবং তখনই তার মনে পড়ল অসীমের কথা। অসীমের সেখানে পরিচিত জন আছেন। কিন্তু শুধু থাকার সুবিধে পাওয়ার জন্যে অসীমের। দ্বারস্থ হবার মত সুবিধেবাদী হওয়ার কোন মানে হয় না। এই বয়সে দীপাবলী জেনে গিয়েছে কারও কাছে থেকে কোনও সুবিধে নিলে তাকে সীমানার বাইরে বেরিয়ে আসতে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করা হয়। অতএব তাকে একাই যেতে হবে এবং কোন হোটেলে উঠতে হবে। ইন্টারভিউয়ের চিঠিতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার কোন আশ্বাস কর্তৃপক্ষ দেননি। সর্বভারতীয় পরীক্ষার লিখিত উত্তরগুলোর ভিত্তিতে নিশ্চয়ই কয়েক হাজার প্রার্থীকে ডেকেছেন তাঁরা।

প্রথম ধাপ পেরোনোয় একটা আনন্দ আছে। অথচ সেই আনন্দ অন্য কারো সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মানুষ নেই, এইটেই কষ্টের। মায়া এখন এই বাড়িতেই আছে। মাসীমা মুখে কিছু বলছেন না কিন্তু তাঁর মনমেজাজ খুবই খারাপ। অপ্রয়োজনে নিজের মেয়ের সঙ্গেই। কথা বলেন না। সেক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে তাঁকে খবরটা দিতে চায়নি দীপাবলী। মায়াও কেমন পাল্টে গিয়েছে। আজকাল খুব কমই ও ওপরে আসে। বাড়ি ফেরে বেশী রাত করে।

কিন্তু বলতে হল। টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছিল আগেই। যাওয়ার দিন সকালে সে নেমে এল দোতলায়। মায়ার মা ঘর ঝাঁট দিচ্ছিলেন, দেখতে পেয়ে বললেন, ও ঘরে আছে।

দীপাবলী হাসল, আমি আপনার কাছে এসেছি।

ও। ঝাঁটাটা নিচে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন প্রৌঢ়া।

আমাকে আজ দিল্লীতে যেতে হচ্ছে। দিন পাঁচেক থাকব না।

দিল্লী! কেন?

আমি কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ওরা ইন্টারভিউতে ডেকেছে।

বাঃ! এ তো ভাল খবর, এতদিন বলনি কেন?

ইন্টারভিউয়ে ডাকা মানেই তো চাকরি পাওয়া নয়।

ওইসময় মায়া বেরিয়ে এল পাশের ঘর থেকে, তুই তো চিরদিনই আমাদের পর ভাবিস।

মানে? ও, বলব বলব করে বলা হয়নি।

বুঝলাম! তবু কনগ্রাচুলেশন জানাচ্ছি। মায়া খুব কেটে কেটে বলল।

মায়ার মা এক পা এগিয়ে এলেন, কিন্তু দিল্লীতে কোথায় গিয়ে উঠবে?

মাথা নাড়ল দীপাবলী, ঠিক নেই। ওখানে তো কাউকে চিনি না।

মায়ার মা একটু ভাবলেন, দাঁড়াও। মায়ার এক খুড়তুতো দাদা দিল্লীর হনুমান রোডে থাকে। ওখানে নাকি বাঙালির থাকার জন্যে কি সব ব্যবস্থা করেছে। কালীবাড়ি আছে বলে শুনেছি। এখন তো চিঠি পৌঁছবার আগেই তুমি পৌঁছে যাবে। আমি ঠিকানা লিখে দেব, গিয়ে দেখা করে আমার চিঠি দিলেই ও ব্যবস্থা করবে।

খুব ভাল হয় মাসীমা। আমি তো কখনও একা হোটলে থাকিনি। তাই অস্বস্তি হচ্ছিল।

এবার মায়া বলল, ভারতবর্ষের কোন হোটেলে একা ভারতীয় মেয়েকে থাকতে দেয় না। তুই দিল্লীতে গিয়ে মুশকিলে পড়তিস।

নিয়মটা শুনেছি কলকাতায় চলে, দিল্লীতেও মানা হয় নাকি?

দিল্লী ভারতবর্ষের বাইরে নয়।

শেষ দুপুরের ট্রেনে দিল্লী যাত্রা করল দীপাবলী। স্টেশন পর্যন্ত মায়া এসেছিল সঙ্গে। বলতে হয়নি, নিজেই সঙ্গী হয়েছিল। স্টেশনে কেউ একজন সঙ্গে থাকলে ভাল লাগে। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা কামরা খুঁজে জায়গায় ওঠে সহজ হয়। ট্রেন ছাড়ার আগে নিচে নেমে জানালার কাছে এল মায়া, আশা করছি এই ইন্টারভিউতে পাস করবি। এতদিনের চাওয়া যেন পূর্ণ হয়।

দীপাবলী কথা বলতে পারল না। হাত বাড়িয়ে মায়াকে স্পর্শ করল। চারপাশের আওয়াজ, মানুষের ব্যস্ত চলাফেরা, ট্রেনের হুইল এমন একটা পরিবেশ তৈরী করেছিল যে দীপাবলীকে কথা বলতে হল না। কিন্তু মায়া বলল। ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্তে সে কাছে এসে বলল, কাল আমার ছবির কাজ শুরু হচ্ছে।

চমকে উঠল দীপাবলী, তাই নাকি! বাঃ, বলিসনি তো?

কাঁধ নাচিয়ে হাসল মায়া, কাউকেই বলিনি দুটো ছবির কাজ পেয়েছি। তুই দেখিস, দু বছরের মধ্যে আমি লাইমলাইটে আসবই। কেউ আমাকে ঠেকাতে পারবে না।

ট্রেন ছাড়ল। দীপাবলী দেখল ক্রমশ মায়া পেছনে সরে যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের মানুষেরা। তাদের প্রিয়জনকে বিদায় জানাতে হাত নাড়ছে। ক্ৰমশ স্টেশন আড়ালে চলে গেল। কলকাতা ছেড়ে দিল্লীর উদ্দেশ্যে চাকা ঘুরছে। দীপাবলী চোখ বন্ধ করল। সেই কবে চাবাগান ছেড়ে জলপাইগুড়ি শহরে, জলপাইগুড়ি ছেড়ে কলকাতায় পড়তে এসেছিল। কুয়ো থেকে পুকুর, পুকুর থেকে দিঘি, এখন দিঘি ছেড়ে হ্রদে যাওয়ার সময় সেই যাত্ৰী মনের পোশাক পাল্টে নিয়েছে তাল মিলিয়ে। এখন আর কিছুতেই ভয় আসে না।

দীর্ঘ যাত্রাপথে শুধু চুপচাপ বসে থাকা, কোন সহযাত্রীর সঙ্গে আলাপ নয়, শুধু স্মৃতি হাতড়ে যাওয়া। যে দুটো মুখ মনের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকে, জীবনযাপনের সময় যাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না এই রকম সময়ে তারা আচমকা উঠে আসে। অমরনাথ এবং সত্যসাধনবাবু। একজন যদি বন্ধুর মত স্বস্তি দেন অন্যজন উৎসাহিত করেন এগিয়ে যেতে। কেমন ভরাট লাগে এই সব সময়। নিজেকে আর একলা মনে হয় না। পৃথিবী থেকে কোন মানুষ চলে গেলেই তার অস্তিত্ব মুছে যায় না। সেক্ষেত্রে বেঁচে থেকেও এই পৃথিবীর অনেক মানুষের অস্তিত্ব আমাদের কাছে মৃত। এখন অঞ্জলির সঙ্গে তার দেখাই হয়। না, মনেও আসে না। জীবিত এবং মৃতের মধ্যে অঞ্জলির ক্ষেত্রে বোধের কোন ফারাক নেই। কিন্তু মৃত্যুর পরও অমরনাথ এবং সত্যসাধন অদ্ভুতভাবে তার কাছে বেঁচে আছেন। এইটেই সত্যি, শেষ কথা।

দুটো রাত কাটিয়ে দীপাবলী যখন ভারতবর্ষের রাজধানীতে পৌঁছল তখন সকাল। প্ল্যাটফর্মে পা দিয়েই সে বিস্মিত। তার দেখা স্টেশনগুলো থেকে একদম আলাদা। এত বিশাল, এবং ঝকঝকে যে নিজেকে এখন ভীষণ একলা লাগছিল।

প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে চারপাশে তাকাল সে। এখানে কিছু দালাল হোটলের জন্যে যাত্রী ধরতে এসেছে। তাদের কেউ তার দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না। কোন মেয়ে একা হোটেলে উঠতে পারে বলে তাদের ধারণাই নেই। অথচ পুরুষ যাত্রীদের কাছে জনে জনে গিয়ে হোটল হোটেল করছে। এই সময় এক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে বাংলায় কথা বলা দালালকে দেখতে পেল। লোকটা বোঝাচ্ছে কি দারুণ ঘর, চমৎকার খাওয়াদাওয়া অথচ এত শস্তা দাম যা দিল্লীতে মাথা খুঁড়লেও পাওয়া যাবে না। পরিবারটির প্রয়োজন না থাকায় বেরিয়ে গেল। দীপাবলী এগিয়ে গেল পোকটির কাছে, আপনাদের হোটেল কতদূরে?

বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল লোকটা হঠাৎ জেগে উঠল যেন, এই তো কাছেই। এখান থেকে পনের মিনিট লাগবে দিদি। আপনারা কজন আছে?

আমি একাই থাকব। দীপাবলী লোকটিকে স্পষ্ট বলল।

একা! আপনি! মানে, কোন ব্যাটাছেলে সঙ্গে নেই?

না। মাথা নাড়ল দীপাবলী। এই রে! মুশকিল হয়ে গেল তাহলে।

মুশকিল কেন?

আসলে পুলিশ থেকে মালিককে বলে দিয়েছে কোন মেয়েকে একা ঘর না দিতে। যারা হোটেলের খাতায় নাম লেখায় তাদের নাম পুলিশকে জানাতে হয়।

একা মেয়েকে ঘর দিতে নিষেধ করেছে কেন?

আসলে, খারাপ মেয়ে তো দিল্লীতে কম নেই, তাই।

আমি একটা সরকারি কাজে এসেছি। প্রমাণ দেখাতে পারি।

অ! তা এখানে আপনার কেউ নেই?

থাকলে হোটেল খুঁজতাম না। লোকটি কিছু ভাবল। তারপর বলল, ঠিক আছে, আপনি এখানে দাঁড়ান। আমি আর একটু ব্যবসা করার চেষ্টা করি। তারপর আপনাকে নিয়ে গিয়ে মালিকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। তিনি যা ব্যবস্থা করার করবেন। লোকটি ছুটে গেল দুরে দাঁড়ান এক পরিবারের দিকে। দীপাবলীর মনে হল লোকটি জালিয়াতি টাইপের নয়। কিন্তু এই নিয়মটা তাকে যেমন রাগিয়ে দিয়েছিল তেমনি সে অসহায় হয়ে পড়েছিল। যদি হোটেলে তাকে জায়গা না দেওয়া হয় তাহলে মায়ার মায়ের চিঠির ওপর ভরসা না করে উপায় নেই। অথচ সে সেটা করতে চাইছে না। খামোকা অচেনা মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে যাওয়া মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। মিনিট দশেক বাদে সেই দালালটি ফিরে এল, এবার চলুন। আজ শালা, কপালটাই মন্দ। আবার স্টেশনে আসতে হবে। প্যাসেঞ্জার না পেলে আমার রোজগার। বন্ধ। এই করেই তো খাই, বুঝলেন না!

লোকটির সঙ্গে স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এল সে। একটা অটো রিকশাকে ডাকল লোকটা। তারপরেই কিছু মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গীতে ঘুরে দাঁড়াল, আচ্ছা, দিদি, আপনি এক কাজ করুন, সোজা কালীবাড়িতে চলে যান।

কালীবাড়ি?

হ্যাঁ। এখানকার কালীবাড়িতে থাকার ব্যবস্থা আছে। বেশী চার্জও না।

যদি ওখানে ঘর পেয়ে যান তার থেকে আর ভাল কিছু নেই। আসলে হোটেলে চারপাশে নানান মতলবের ব্যাটাছেলে পাবেন, কোন নিয়মকানুন নেই তো–!

কালীবাড়ির কথা মায়ার মা বলেছিলেন। সেখানে জায়গা দেওয়ার জন্যে সুপারিশ করা। চিঠিও লিখেছেন। কিন্তু সুপারিশ ছাড়া যদি জায়গা পাওয়া যায়–। দীপাবলী রাজী হল। দালালটি যেন বেঁচে গেল।

অটো রিকশায় দিল্লীর পথে যেতে যেতে দীপাবলী মুগ্ধ। বারংবার কলকাতার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। এত নির্জন, এত পরিষ্কার শহর কি কলকাতা কোনকালে ছিল, সেই যখন জোব চার্নক শহর গড়েছিলেন তখন কি শুধুই জঙ্গল আর বাদা ছিল। তখনও কি এমন ছিমছাম ছিল না কলকাতা! চওড়া রাস্তা, নিয়ন্ত্রিত যানবাহন দেখে তার কষ্ট হচ্ছিল কলকাতার জন্যে। একসময় তারা পৌঁছে গেল কালীবাড়িতে।

জায়গা পেতে একটু ঝামেলা হয়েছিল। ইন্টারভিউয়ে চিঠি দেখাতে হয়েছিল। ব্যক্তিগত পরিচয় দিতে হয়েছিল। কিন্তু জায়গা পাওয়ার পর দীপাবলীর মনে হয়েছিল তার সাধ্যের মধ্যে এর চেয়ে ভাল কিছু আর হতে পারে না। কালীবাড়ির পরিচালনা সমিতির এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক সন্ধ্যায় এলেন দেখা করতে। কোন বাঙালি মেয়ে একা কলকাতা থেকে। এমন সর্বভারতীয় পরীক্ষা দিতে দিল্লীতে এসেছে তা যেন ভদ্রলোক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বললেন, অনেক বছর কলকাতায় যাইনি ভাই। সেখানে মেয়েদের মধ্যে এমন পরিবর্তন এসেছে তাও কেউ আমাকে বলেনি। বড় আনন্দ হচ্ছে আজ।

আপনি অনেককাল এখানে আছেন?

হ্যাঁ ভাই। নাইনটিন ফর্টি ফাইভে চলে আসি। কলকাতার আত্মীয়স্বজনেরা এখন এত দূরের যে যাওয়ার প্রয়োজন বলে মনে করি না। বৃদ্ধ হাসলেন, তা তোমাকে যাঁরা ইন্টারভিউ নেবেন সেই বোর্ডে কারা আছেন জানো?

না। মাথা নাড়ল দীপাবলী।

আচ্ছা, দেখি আমি খোঁজ করে। আমি তো এককালে সরকারি চাকরি করতাম। অনেককেই চিনি। খাতির করে সবাই।

খোঁজ নিয়ে কি হবে?

দরকার। বাঙালিকে কোণঠাসা করতে এদের তো জুড়ি নেই। ওখানে তোমাকে সাহায্য করবে এমন লোকের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

না। আমি কারো সাহায্য চাই না। পরে সেইটে মনে খচখচ করবে।

বৃদ্ধ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, বাঃ! এমন জেদ তো আজকাল চোখে পড়ে না। কিছু মনে করো না, তুমি এত বড় একটা কাজে দিল্লীতে একা এসেছে অথচ পরিচয় দিয়েছ বিবাহিত বলে, এই একা আসাটাও কি জেদের বশে?

দীপাবলী এক মুহূর্ত ভাবল। বৃদ্ধকে দেখে তার কখনই মতলবাজ বলে মনে হয়নি। এইরকম প্রশ্ন উটকো লোকের মুখে শুনলে সে কি করত জানে না কিন্তু এখন জবাব না দিয়ে পারল না, না। আমার সঙ্গে আসার মত কেউ ছিলেন না। বাবা মারা গিয়েছেন অনেকদিন, যার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার মৃত্যু হয়েছে আমি স্কুলে পড়ার সময়েই। আমি একাই কলকাতায় এসে পড়াশুনা করেছি, কিছুদিন চাকরিও করেছি। একা এখানে। আসতে কোন অসুবিধে হয়নি। শুধু থাকার জায়গা পাওয়া নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। আমি জানি না, ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী যদি কোনদিন কোন মহিলা হন তবে তাঁকেও কোন। হোটেলে একা গেলে থাকতে দেওয়া হবে কিনা?

বৃদ্ধ প্রথমে হতভম্ব। টুকটাক কিছু কথা বললেন তারপর। এবং একসময় বিদায় নিলেন। দীপাবলী ঘরেই বর্সেছিল। আগামীকালের ইন্টারভিউতে কোন ধরাবাঁধা বিষয় নেই যে তার ওপর নির্ভর করে সে তৈরী হতে পারে। কাল সকালে খবরের কাগজটা দরকার। রাত্রের খাবার নেওয়ার সময় সে জিজ্ঞাসা করবে কি করে কাগজ পাওয়া যায়। চুপচাপ ওয়েছিল সে। চোখ বন্ধ করতেই ফেলে আসা দিনগুলোর নানান স্মৃতি গলাগলি করে উঠে আসে চোখের সামনে। আশ্চর্য কোথাও এক ফোঁটা সুখ নেই। শুধু চা বাগানের। দিনগুলো, চা বাগানের বুক চিরে চলে যাওয়া সরু পথে হেঁটে বেড়ানোর আনন্দ ছাড়া আর কিছু সম্পদ সঞ্চয়ে নেই। এই সময় তার মনে পড়ল শরবাবুর কথা। কলেজে বন্ধুবান্ধবরা হাসাহাসি করত। কেউ কেঁদে ভাসালে বলত শরৎবাবুর চরিত্র। কোন মেয়ে যদি অতিরিক্ত স্নেহপ্রবণ হত তাহলে তো কথাই নেই। শরৎচন্দ্রের বই টিপলেই নাকি জল বেরিয়ে আসে। আধুনিক মানুষের চোখে কান্না খুব খেলো বা লঘু ব্যাপার হয়ে যেতে পারে কিন্তু দীপাবলীর মনে হল শরৎচন্দ্র বেঁচে থাকলে তাকে নিয়ে আর একটা দারুশ উপন্যাস লিখতে পারতেন। এমন জীবন ঈশ্বর তাকে দিয়েছেন যা কেবল শরৎচন্দ্রের কলমেই জীবন্ত হত। কিন্তু যে নিজে চোখের জল ফেলে না অথচ ভেতরে ভেতরে রক্তাক্ত হয় তার কথা–!

এই সময় ভেজানো দরজায় শব্দ হল। দীপাবলী উঠে বসে জানতে চাইল কে?

বাইরে থেকে মহিলা কণ্ঠ ভেসে এল, ভেতরে আসব?

খাট থেকে নেমে দাঁড়াল দীপাবলী। এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলল। এক বৃদ্ধা এবং একটি কিশোরী দাঁড়িয়ে। বৃদ্ধাকে দেখেই বোঝা যায় খুব বর্ধিষ্ণু পরিবারে আছেন। হেসে বললেন, তোমার নাম দীপাবলী?

খুব অবাক হল দীপাবলী, হ্যাঁ! আপনি?

আমাকে তুমি চিনবে না। তার আগে বল তুমি কি পড়াশুনা করছিলে? তাহলে আর ভেতরে ঢুকব না। বরং কাল আসব। বৃদ্ধা হাসলেন। দ্রুত মাথা নাড়ল দীপাবলী, না, না। আমি এমনি শুয়েছিলাম। আসুন ভেতরে আসুন।

ঘরে একটি চেয়ার টেবিল এবং তক্তাপোশ ঘরে ঢুকে বৃদ্ধা মেয়েটিকে বললেন, তুই ওই চেয়ারে বস। এসসা আমরা খাটেই বসি।

পাশাপাশি বসে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন তিনি। দীপাবলীর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। দিল্লীতে তার চেনাজানা কেউ নেই। আর থাকলেও তার অজানা। এবং এখানে আসার খবর কারো পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়। এই সময় বৃদ্ধা বললেন, না, এবার মানতে হল। সারাজীবন তোমার মেসোমশাই যা বলেছেন তার সঙ্গে আমি কখনই একমত হইনি। পছন্দের ব্যাপারে তো কখনই নয়। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে হলাম। এই প্রথম ঠিক বললেন।

আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না।

বৃদ্ধা মেয়েটিকে বলল, এই তোর দাদুর নাম বল।

মেয়েটি বলল, শ্রীযুক্ত পরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

দীপাবলী মনে করতে চেষ্টা করে না পেরে জবাব দিল, বুঝতে পারছি না।

ও মা। তিনি যে বললেন তোমার সঙ্গে একটু আগে কথা বলে গিয়েছেন।

ও হ্যাঁ। নিজেকে আহাম্মক বলে মনে হল দীপাবলীর। সেই বৃদ্ধের স্ত্রী ইনি? অতক্ষণ কথা বলে গেলেন তিনি অথচ একবারও তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করার কথা খেয়াল হয়নি।

দীপাবলী লজ্জিত হল, এবার বুঝতে পেরেছি। আপনি কিছু মনে করবেন না।

তোমাকে নিজের নাম বলেনি বুঝি?

দীপাবলী হেসে মাথা নাড়ল। বৃদ্ধা বললো, ওই তো কাজের ধরন। আর বাড়িতে গিয়ে আমাকে এমন শোনাল যেন তোমার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেছে। যাক গে। তুমি তো কাল পরীক্ষা দেবে?

হ্যাঁ। তোমার কিন্তু খুব সাহস। আমরা ভাবতেও পারতাম না। মা আছেন তো?

একটু থতমত হল দীপাবলী। তারপর সত্যি কথাটাই বলল, আমাকে জন্ম দিয়েই তিনি মারা যান। মাসীর কাছে মানুষ হয়েছি, তাকেই মা বলি।

ও। মেসোমশাই মাসীমা কোথায় আছেন?

আচমকা অমরনাথের মুখ মনে পড়ল। জ্ঞান হবার পর একটি বারের জন্যেও সে অমরনাথকে মেসোমশাই বলে ডাকেনি মনেও হয়নি। অমরনাথ তার বাবা। অথচ আজ বলতে হল, তিনি কিছুদিন আগে মারা গিয়েছেন। জলপাইগুড়ির চাবাগানে থাকতেন।

ওহো। আমি এত কথা বলছি বলে কিছু মনে করছ না তো?

না, না। কিন্তু কেন জিজ্ঞাসা করছেন জানতে পারছি না।

বলব। আজ নয়। মন দিয়ে পরীক্ষা দাও। আচ্ছা, যদি তুমি পাস করে তাহলে কি সত্যি সত্যি চাকরি করবে?

হেসে ফেলল দীপাবলী, কি অশ্চর্য! এই জন্যেই তো এসেছি। জানেন, ছেলেবেলা থেকেই আমার ইচ্ছে এমন একটা চাকরি করার যা ছেলেদের চেয়ে কম নয়। মেয়ে হয়ে শুধুমাথা নিচু করে থাকতে রাজী নই আমি। মানুষের সব ইচ্ছে তো পূর্ণ হয় না। আমাদের দেশে মেয়েরা তো আবার দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ। শুধু ওই পরীক্ষাগুলো এখন পর্যন্ত দরজা খোলা রেখেছে এগিয়ে যাওয়ার। জানি না কি হবে!

বৃদ্ধা উঠে দাঁড়ালেন, আজ উঠি। কিন্তু তোমাকে একটা অনুরোধ রাখতে হবে।

বলুন।

কাল বিকেলে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব তোমাকে। চা খাবে।

আমি তো কালকেই ফিরে যাব কলকাতায়।

ও। কখন ট্রেন তোমার?

রাত্রে।

তাহলে তো বিকেল বিকেল গিয়ে আমাদের ওখান থেকেই স্টেশনে চলে যেতে পার। এখানে তো দুপুরে ঘর ছেড়ে না দিলে আবার একদিনের টাকা নেবে। তুমি সকালে বলবে দুপুরেই ঘর ছেড়ে দেবে। জিনিসপত্র অফিসে রেখে দিও। পাঁচটা নাগাদ গাড়ি পাঠিয়ে তোমাকে নিয়ে যাব। কেমন?

দীপাবলী দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল, কিন্তু আপনারা এত স্নেহ করছেন কেন–

যে বুড়ো মানুষটা তোমার কাছে এসেছিলেন তাঁর কোন মেয়ে নেই। তোমাকে দেখে তাঁর খুব ভাল লেগেছে। হাতে যদি কোন কাজ না থাকে তাহলে ওই ভাল লাগাটার জন্যে কিছু সময় না হয় নষ্ট করলে। আমি শুধু বলতে পারি তোমার খুব খারাপ লাগবে না। হেসে একবার হাত বাড়িয়ে চিবুক ছুঁয়ে বৃদ্ধা নাতনীকে নিয়ে চলে গেলেন। আর দীপাবলীর মন আচমকা স্নিগ্ধতায় ভরে গেল। মনের ওপর চন্দনের প্রলেপ পড়ল যেন। খানিক আগে একা শুয়ে যে কষ্টটাকে ফণা তুলতে সাহায্য করছিল সেটা এখন একেবারে উধাও। এই অচেনা প্রবাসী পরিবারের সঙ্গ পেয়ে নিজেকে কৃতার্থ বলে মনে হচ্ছিল। পৃথিবীর সব মানুষ দুঃখ দেবার জন্যে জন্মায় না।

 

সকালের কাগজে বড় খবর ছিল না। কিন্তু বেরুবার আগে সেটাকে খুঁটিয়ে পড়ল সে। দিল্লীর কাগজের এক কোনায় কলকাতার ছাত্র আন্দোলনের খবর ছাপা হয়েছে। গতকাল কলেজ স্ট্রিটে টিয়ার গ্যাস ফেটেছে, ছাত্ররা ইটপাটকেল ছুড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। কেন, কি কারণ, তার বিশদ কাগজটি লেখেনি।

নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই অটো রিকশায় চেপে দীপাবলী হাজির হয়ে গেল। তাকে যেখানে অপেক্ষা করতে বলা হল সেখানে আরও কিছু তরুণ তরুণী আছে। তবে তরুণীদের সংখ্যা তাকে নিয়ে চারজন। বাকি তিনজনই ভিন্ন প্রদেশী। প্রত্যেকেই ধোপদুরস্ত। ইন্টারভিউ দেবার জন্যে বাইরে ভেতরে তৈরী। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না। আপাত উদাসীন চোখে তাকিয়ে আছে অথচ প্রতিটি ইন্দ্ৰিয় সজাগ। দীপাবলী অপেক্ষা করতে লাগল। তার মনে হল এইসব ছেলেমেয়েরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে সেরা ফল করে এসেছে। এদের হাতেই আগামীকালের ভারতবর্ষের দায়িত্ব। আর সেই সঙ্গে নিজেকে এদের একজন ভাবতে ভারি ভাল লাগছিল। হঠাৎ পাশে বসা ছেলেটিকে উশখুশ করতে দেখে সে তাকাল। ছেলেটি ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, ইউ আর ফ্রম? জিজ্ঞাসা করার সময় একটা বোকাবোকা ভঙ্গী ছিল।

ওয়েস্টবেঙ্গল। দীপাবলী শব্দটা উচ্চারণ করেই ঠিক করল এবার থেকে পশ্চিমবাংলা বলবে। মধ্যপ্রদেশ বা উত্তর প্রদেশ যদি বলা যেতে পারে তাহলে ইংরেজির শরণাপন্ন হতে হবে কেন? ছেলেটা বলল, আই অ্যাম ফ্রম কেরল।

দীপাবলী মাথা নেড়ে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। তাদের কথা বলতে দেখে অনেকেই এদিকে তাকিয়েছে। ছেলেটি যে শুধু নার্ভাসনেস থেকেই কথা বলেছে এবং কথা শুধু বলার জন্যেই তা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়।

ডাক এল দুপুরের পর।

দীপাবলী করিডোর পেরিয়ে একটি ঘর ডিঙিয়ে ভেজানো দরজা ঠেলে বড় হল টাইপের একটি ঘরে ঢুকে নমস্কার করতেই টেবিলের ওপাশে বসা মানুষগুলোর মধ্যমণি ইংরেজিতে বলে উঠলেন, নমস্কার। দয়া করে আসন গ্রহণ করুন।

এবং তখনই দীপাবলীর শরীর ঝিমঝিম করতে লাগল। দুটো হাঁটুতে যেন কোন জোর নেই। তার নিঃশ্বাস ভারি হল। কোনরকম ব্যবধানটুকু ঘুচিয়ে সে টেবিলের উল্টো দিকের খালি চেয়ারে নিজেকে ছেড়ে দিতে পারল। তারপরই মনে হল নাকে ঘাম জমছে। এবং এর মধ্যে সে কলের পুতুলের মত একবার বসতে বলার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে ফেলেছে।

টেবিলের ওপাশে যে কজন মানুষ বসে আছেন তাদের প্রত্যেকেরই বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। এদের মধ্যে যেমন সরকারি অফিসার আছেন তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে নিযুক্ত করা হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ চাকরির জন্যে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই করতে। মধ্যমণি ভদ্রলোক সম্ভবত উপাচার্য যিনি এই মুহূর্তে দীপাবলীর ফাইল দেখছেন। হঠাৎ মুখ তুলে বললেন তিনি, অবশ্যই ইংরেজিতে, তোমার বায়োডাটা বলছে তুমি চা বাগানে জন্মছ। ওখানকার মেয়েরা কি পড়াশুনার ভাল সুযোগ পেয়েছ?

এখন পর্য পায়নি। হাইস্কুল খুব অল্পই আছে।

সঙ্গে সঙ্গে আর একজন জানতে চাইলেন, তাহলে তুমি আমাদের সামনে এলে কি করে?

আমি ব্যতিক্রম। কারণ আমি শহরে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম।

এবার মধ্যমণি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি বিধবা হয়েছে কবে?

বিয়ের কয়েক দিনের মধ্যে। বারো বছর বয়সে আমার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্যদের মুখ থেকে বিস্ময়সূচক শব্দ ছিটকে এল।

মধ্যমণি জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু মনে করবেন না, সেই স্মৃতি আপনার আছে?

না। আমি সব ভুলে গিয়েছি।

সঙ্গে সঙ্গে আর একজন জিজ্ঞাসা করলেন, চা বাগানে এখনও কি উনবিংশ শতাব্দীর জীবনধারা চলছে? আমি তো জানতাম বাঙালির এত অল্প বয়সে বিয়ে হয় না।

দীপাবলী জবাব দিল, যেখানে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে উনবিংশ বা অষ্টাদশ শতাব্দীর মানসিকতা এখনও এঁটে বসে আছে সেখানে পশ্চিমবাংলায় তার কিছু প্রভাব তো থাকবেই। তবে এখন এই সময় এমন ঘটনা কদাচিৎ ঘটছে।

মধ্যমণি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কলকাতায় কলেজে পড়তেন। ওখানকার ছাত্ররা যে রাজনীতি করে তা কি আপনি সমর্থন করেন?

দীপাবলী একটুও না ভেবে বলল, যখন সেটা কোন বিশেষ দলের প্রচার হয় তখন আমি একেবারেই সমর্থন করি না। ছাত্ররা যদি তাদের নিজস্ব ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করে তাহলে একজন ছাত্র হিসেবে আমার সমর্থন পাবে।

নিজস্ব ইস্যু বলতে?

ব্যাপারটা যখন ছাত্র রাজনীতি তখন ইস্যু তৈরী হবে পড়াশুনাকে কেন্দ্র করে। কলেজের দুরবস্থা বা শিক্ষানীতির অব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন করা অবশ্যই কর্তব্য। কিংবা যে সব ঘটনা একটি মানুষ হিসেবে সহ্য করা পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে এবং তা যদি পড়াশুনার বাইরে জগতেও ঘটে তাহলে ছাত্ররা তাদের ক্ষোভ নিশ্চয়ই জানাবে।

তৃতীয়জন জিজ্ঞাসা করলেন, ছাত্রদের রাজনীতি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

রাজনীতি শব্দটিতে আমার আপত্তি আছে। মানুষের সুস্থ মত প্রকাশের প্রক্রিয়াকে রাজনীতি বলা হবে কেন?

ইন্টারেস্টিং। মধ্যমণি বললেন, তাহলে রাজনীতি কি?

রাজনীতির মধ্যে যেহেতু রাজা বা রাজ্য জড়িয়ে আছে তাই তা দেশের শাসন ব্যবস্থার দিকে আঙুল তোলে। আমার বাড়িতে যদি আমি অন্যদের ওপর অত্যাচার করি, কোন পিতা যদি তার সন্তানদের খাবার না দেয় এবং তাই তারা যদি প্রতিবাদ করে তাহলে কি বলব সেই বাড়িতে রাজনীতি চলছে? ছাত্ররা সুস্থ সমর্থন বা প্রতিবাদ করতে পারে। কিন্তু তারা যখন কোন রাজনৈতিক দলের পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্মসূচী নেয় যা আখেরে সেই দলকেই সুবিধেজনক অবস্থায় এনে দেবে তখন তাকে রাজনীতি বলতে আপত্তি নেই।

কারণ?

কারণ সেই দল ছাত্রদের ব্যবহার করে দেশের ক্ষমতা অধিকার করার পথে এগিয়ে যাবে এবং মুষ্টিমেয় কিছু ছাত্র জেনে আর অধিকাংশই না জেনে তাকে সাহায্য করবে।

কলকাতার ছাত্ররা বামপন্থীদের সমর্থন করে কেন?

কারণ বামপন্থীরা ক্ষমতায় নেই, তাই।

একটু বিশদ করুন।

কলকাতায় এখন মুখ্যমন্ত্ৰী প্ৰফুল্ল সেনের কংগ্রেস সরকার রাজত্ব করছে। ছাত্রদের সমস্ত দাবিদাওয়া তিনি পূর্ণ করতে পারছেন না। ফলে তার বিরোধিতা করতে হচ্ছে। বামপন্থীরা ছাত্রদের সমর্থন করছেন। যদি বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসেন এবং একইভাবে ছাত্রদের বঞ্চিত রাখেন তাহলে দেখব দক্ষিণপন্থীরা ছাত্রদের সমর্থন করছেন। আসলে ক্ষমতায় যে থাকে তার বিরোধিতা করাই যৌবনের ধর্ম।

আপনি কিছুকাল ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে ছিলেন। কেন চাকরি ছাড়লেন?

কাজ করার সুযোগ ছিল না বলে।

বিশদ করুন।

আমাকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল প্রচণ্ড খরায় শুকিয়ে থাকা এক ব্লকে যেখানে সরকারি আর্থিক সাহায্য বরাদ্দ ছিল না। ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসেছিলাম। আমার ওপরওয়ালারা সেসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তাঁরা চাকরি করতে চাইতেন, কাজ নয়। দেশের নির মানুষের মধ্যে দায়িত্ব নিয়েও হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া আমি আরও বড় দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার কথা ভাবতাম। ডব্লু বি সি এসের ফল কোন কারণে খারাপ হওয়ায় ওই চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। তাই এবার আমি নতুন করে সুযোগ চাইছি। আমি কাজ করতে চাই।

আপনি একজন নারী। আই এ এস বা আই পি এস হিসেবে কাজ করতে কি আপনার অসুবিধে হবে বলে মনে করেন?

দীপাবলী তাকাল। যিনি প্রশ্ন করলেন তাঁর শরীর বেশ রোগা, উচ্চতাও কম। দেখলেই বোঝা যায় কোন ক্ৰনিক অসুখে ভুগছেন। সে দ্বিধা করল না, আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনি একজন পুরুষ। কিন্তু আপনি কি স্টেশনের কুলিদের মত ভারী মোট বইতে পারবেন? অথবা আপনি কি সারাদিন মাঠে কোদাল চালাতে পারবেন? মনে হয় আপনি যা যা পারবেন আমার পক্ষে তার সবই পারা সম্ভব। আমি নারী বলে যে প্রশ্ন করলেন সেই ধারণা অষ্টাদশ বা উনবিংশ শতাব্দীর মানুষের ছিল। অথচ আমাদের পুরাণ বা মহাকাব্যে কিন্তু অন্য ধারণা দেখা গেছে। আমার মনে হয় এবার ধারণার বদল হওয়া উচিত। আমাদের সেই পূর্বপুরুষদের থেকে আমরা কেন ভাবনায় এত পিছিয়ে থাকব।

হঠাৎ অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল ঘরে। দীপাবলী অস্বস্তিতে পড়ল। সে কি বেশি বলে ফেলেছে। এরা তাকে কোন জেনারেল নলেজের প্রশ্ন করেননি। তারই মুখ থেকে কথা বের করে তাকেই প্রশ্ন করে গেছেন। এই জবাবগুলোয় কি বেশি ঔদ্ধত্য ছিল। এরপরে তার পকে ইন্টারভিউতে পাশ করা আদৌ সম্ভব হবে! এই ভারতবর্ষে!

এই সময় মধ্যমণি বললেন, ঠিক আছে, আপনি এবার যেতে পারেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *