২৪. কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল

কিছু জিনিসপত্র কেনার ছিল। একেবারে বেশ কয়েকমাসের জন্যে কলকাতা ছেড়ে যাওয়া। টাকা পয়সা এখন প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে।

মায়ার মা অসুস্থ। তিন দিনে শ্রাদ্ধ করার পরে তিনি একদম ভেঙে পড়েছেন। এখন। বিছানায় পড়ে থাকেন বেশির ভাগ সময় কথা বললে উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হয়। যে ভদ্রমহিলা দার্জিলিং-এ গিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে এই আচরণের বিস্তর তফাত। জলপাইগুড়ি থেকে ফিরে এসে আর একটি নতুন অভিজ্ঞতা হল দীপাবলীর। সুদীপ এ বাড়িতে রোজ আসছে। সাধারণত সকালের দিকেই আসে। মাসীমার পাশে চুপচাপ বসে থাকে। ওষুধপত্তরের খোঁজ খবর নেয়। প্রতিদিনই হাতে কিছু না কিছু ফল থাকে। স্ত্রী বেঁচে থাকতে এ বাড়িতে যাকে প্রায় দেখাই যেত না তার নিয়মিত আসা নিশ্চয়ই অনেকের চোখে লাগছে। সুদীপের এ ব্যাপারে ভূক্ষেপ নেই। মাঝেমাঝে সন্ধ্যাবেলায় আসছে। এখানে পৌঁছে কথাটা কানে এসেছিল, এখন নিজের চোখে দেখল। মাসীমার কিন্তু সুদীপের নিয়মিত আসা এবং তাঁর বিছানার পাশে বসে সময় কাটানো পছন্দ হচ্ছে না। কথাটা তিনি দীপাবলীকে বলেছেন অথচ মুখেরওপরজামাইকে নিষেধ করতে পারছেন না। সুদীপের এই কাজের যে ব্যাখ্যা হওয়া উচিত তা সুদীপ বলেই দীপাবলী মানতে পারছে না। তার এখনও বিশ্বাস সুদীপ মায়ার দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দার্জিলিং-এ গিয়েছিল সেরেফ কর্তব্যের তাগিদে। না যাওয়াটা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু হবে সেটাই বোধ হয় মনে ছিল। তাই এখন মাসীমার কাছে নিত্য আসার পেছনে কোন টান কাজ করছে তা সে-ই জানে!

সুদীপের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করেছে, কবে যাচ্ছ?

এই তো, পরশু। চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল দীপাবলী। কথা খুঁজে পায়নি। একই অবস্থা সম্ভবত সুদীপের, মুখ নিচু করে সরে গিয়েছিল সে।

আজ সকালের কাগজে বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। মুক্ত অঙ্গনে শমিতদের নাটক আজ। তার মানে শমিত এখন কলকাতায়। বিজ্ঞাপন দেখে প্রথমে খুব খারাপ লেগেছিল। তারপর মনে হল শমিতের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। ওর মত নাটকসর্বস্ব মানুষ কোন কিছুর সঙ্গে আপপাস করে না। এমন কি নিজের অন্য আবেগের সঙ্গেও না। সন্তান মারা যাওয়ার পরে অভিনয় করে তাকে দাহ করতে যেতে পারে শমিতরা। সাধারণ মানুষের জীবন দিয়ে ওকে বিচার করতে যাওয়া বোকামি।

দার্জিলিং-এ শমিতের যে আচরণ দেখেছে সে, তাতে আর কেউ না বুঝক দীপাবলী জানে মায়া সবসময় শমিতের বুকের ক্ষরণ জাগিয়ে রাখবে। ও রঙ মেখে যখন অভিনয় করবে তখনও। সুদীপ কিন্তু খুব দ্রুত নিজেকে বাস্তবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে। কিছুদিন বাদেই এই বাড়িতে আসা যাওয়া বন্ধ হবে। তারপর পরিচিত কোন মহিলা যার মধ্যে মায়ার সামান্য মিল সে দেখতে পাবে তাকেই বিয়ে করতে পারে। সুদীপ ঠেকা দিয়ে থাকতে ভালবাসে। এটাই ওর স্বভাব। তাই বেশিদিন একা থাকা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। হয়তো নিজের এবং দলের প্রয়োজনে ও ঠিক কোন মহিলাকে খুঁজে বের করতে পারবে। দুজনের মধ্যে এটাই পার্থক্য।

ভাল শীতবস্ত্র দরকার। যে সব পোশাক কলকাতায় ব্যবহার করা যায় তা পশ্চিমের শীতে চলবে না। তা ছাড়া সেগুলো জীর্ণ হয়ে এসেছে। সেইসঙ্গে কিছু দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিস। ট্রামে চেপে নিউমার্কেটে চলে এল দীপাবলী। যে কোন ঋতুতে একমাত্র এখানেই ভাল শীতবস্ত্র পাওয়া যায়। দীপাবলী অবাক হয়ে দেখল সকাল পেরোনো এই সময়েই নিউমার্কেটের গলিতে মেয়েদের বেশ ভিড়। এই ধরনের বাজার করতে কলকাতার কিছু বিত্তবান পরিবারের মহিলারা খুব ভালবাসেন কিন্তু তাই বলে এই সময়ে!

দীপাবলী খুব আড়ষ্ট হয়ে দোকান দেখছিল। কোন দোকানের শো-কেসেই সে শীতবস্ত্র। দেখতে পাচ্ছে না। মাঝে মাঝে সেলসম্যানরা যেচে তাকে জিজ্ঞাসা করছে কি চাই দিদি? সে জবাবে মাথা নেড়ে না বলছে। শেষ পর্যন্ত একটি ভাল কার্ডিগান পেয়ে গেল সে। অসময় বলে দাম খুব বেশি নয়। কিন্তু তার পক্ষে এটাই অনেক। প্যাকেটটা নিয়ে গলিতে দাঁড়িয়ে সে ঠিক করল টুকিটাকি জিনিসগুলো শ্যামবাজার থেকেই কিনে নেবে। এখানে বড্ড দাদরি করতে হয়। একটু আগে দোকানে দাঁড়িয়ে একই জিনিস দুজনকে দুরকম দামে কিনতে দেখেছে সে।

আরে! কেমন আছেন?

চমকে মুখ ফেরাল দীপাবলী। মধ্যবয়স্ক একটি লোক তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

লোকটিকে কোথায় দেখেছে সে মনে করতে পারল না। চাকরী জীবনে অনেকের সঙ্গে একটু আধটু আলাপ হয়েছে, এ তাদের কেউ মনে করে সে বলল, ভাল।

লোকটি আর একটু ঘনিষ্ঠ হল, কেনাকাটা শেষ?

দীপাবলী মাথা নেড়ে যা বলে হাঁটা শুরু করল। লোকটি সঙ্গে সঙ্গে বলল, অনেকক্ষণ ধরে আপনাকে দেখছিলাম। হাতে কোন কাজ আছে?

মানে? দীপাবলী চকিতে মুখ ফেরাল।

না, ইয়ে, তাহলে কোথাও বসে চা খাওয়া যেত। লোকটি হাসল।

কিছু মনে করবেন না, আপনাকে আমি চিনতে পারছি না।

ও! ঠিক আছে, বসলে ওসব হয়ে যাবে।

দীপাবলী দাঁড়িয়ে পড়ল, আপনি কি চান বলুন তো?

লোকটি মুখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে নিল। ভিড় তেমন নেই এখানে। তারপর বলল, কিছু না। আপনাকে রোজ পাড়ায় দেখি তাই।

আপনি আমাদের পাড়ায় থাকেন? দীপাবলীর গলা বেশ চড়ায়। আমি নই, আপনি আমাদের পাড়ায় থাকেন। মেয়েদের দেখলে গায়ে পড়ে কথা বলার অভ্যেস কতদিনের? সব মেয়েকে বলি না। আপনি একা থাকেন, কোন বন্ধুটন্ধু আছে বলে মনে হয় না, তাই— আচ্ছা রাগ করছেন কেন, আমি খুব খারাপ লোক নই।

দীপাবলী উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। সে দেখল দুটো লপেটা মার্কা ছেলে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে তাদের দেখছে। সে গলা তুলেই বলল, আপনি চলে যান, এভাবে বিরক্ত করবেন না। নইলে আমি পুলিশ ডাকব।

যাঃ। এটুকুতেই এই! আপনার মত একা মেয়েছেলে এসময়ে নিউমার্কেটে কোন ধান্ধায় আসে আমি জানি না। নাকি পাড়ার লোক শুনে খাপ গুটিয়ে নিচ্ছেন।

দীপাবলী আর দাঁড়াল না। হন হন করে এগিয়ে গেল লিন্ডসে স্ট্রিটের দিকে। শেষ পর্যন্ত একবার মুখ ঘুরিয়ে দেখল লোকটার সঙ্গে ছেলেদুটো কথা বলছে। রাগে উত্তেজনায় সে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। লাইটহাউসের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সে একটু দাঁড়িয়ে গেল।–লোকটাকে দেখে ভদ্রলোকই মনে হবে। এইসময় একজন ওই বয়সী মানুষ সব কাজ ফেলে নিউমার্কেটে ঘোরাফেরা করে গায়ে পড়ে মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করবে বলে! ভাবা যায়? এতটা দুঃসাহস কলকাতার মানুষ ছাড়া আর কার হবে! এখানে কেউ কাউকে চেনে না তাই ঝুঁকি কমে যায়। দীপাবলী আবার চলতে শুরু করল। আর তখনই তার দুপাশে সেই দুটি লপেটা প্রায় সেঁটে হাঁটতে লাগল। একজন ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করল, কেতনা দেনে পড়েগা? হাউ মাচ?

দীপাবলী থমকে দাঁড়াল, মানে?

ছেলেদুটো কিন্তু দাঁড়াল না। যেমন হাঁটছিল তেমনিভাবে নির্বিকার মুখ করে এগিয়ে গেল জ্যোতি সিনেমার দিকে। অপমানে ঘেন্নায় দিশেহারা দীপাবলী। এরকম অভিজ্ঞতা তার আগে হয়নি। শ্যামবাজার বা গড়িয়াহাটে কোন কোন তরুণ পিছু নেয় বটে একলা মেয়েকে দেখলে কিন্তু তাদের মনে ভয় থাকে, নিরাপদ দূরত্ব রেখে ফলো করে তারা। কিন্তু এসপ্লানেড পাড়ায় তো একেবারে গায়ে পড়ে দর জানতে চাইছে। অথচ এখানে সেই একই কলকাতার মানুষেরাই ঘোরাফেরা করছে।

লাইটহাউসের সামনে একটা ট্যাক্সি খালি হতেই দীপাবলী তাতে উঠে বসল। বেশি খরচ হবে কিন্তু এ ছাড়া উপায় নেই। কানের কাছে ওইসব গা গুলানো শব্দ আর যদি উচ্চারণ করে কেউ তাহলে তার বমি হয়ে যাবে। সে কিছুই করতে পারে না এদের। শারীরিক শক্তিতে পেরে উঠবে না, তাকে প্রতিবাদ করতে দেখলে অন্য পুরুষেরা দূর থেকে দাঁত বের করবে। হঠাৎ তার মনে হল একদল যৌন-অভুক্ত মানুষ হায়েনার মত দিনদুপুরেই এসপ্লানেডে চরে বেড়াচ্ছে। কোন কোন মেয়ে হয়তো পয়সার প্রয়োজনে এখানে একা আসে বলে ওরা উৎসাহ পায়। কিন্তু এদের কথা এই এলাকার পুলিশের না জানার কথা নয়। ভারতবর্ষের প্রশাসন যেমন অনেক ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে থাকতে পছন্দ করে তেমনি বাঙালি পুরুষ যতক্ষণ নিজের গায়ে আঁচ না লাগছে ততক্ষণ শামুকের মত গঁড়। গুটিয়ে থাকতে ভালবাসে। পুরো পথটা সে চোখ বন্ধ করে বসে রইল। পাড়ায় ঢাকামাত্র তার মনে পড়ল লোকটার কথা। এতদূর থেকে সে এসপ্ল্যানেডে চরতে বেরিয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্যে কিন্তু তার চেয়েও যেটা জরুরী সেটা হল তার গতিবিধির খবর লোকটা জানে। লোকটার জানা মানে আরও অনেকের নজর আছে তার ওপরে। সে একলা থাকে এটা যেন অনেকের চোয়ালে লালা নিয়ে আসে। শুধু ভেতরে ভেতরে গজরানো ছাড়া এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেবার উপায় নেই।

বিকেলে বাক্স প্যাঁটরা বাঁধা হয়ে গেলে হঠাৎ সুদীপ এল। মাসীমা আজ তার ছাদের ঘরে এসেছেন। এসে তালপাশের ওপর চুপ করে বসেছিলেন। দীপাবলীর চলে যাওয়াটা তাঁকে মানতে হচ্ছে। নিজের মেয়ের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া যাঁকে মানতে নিয়তি বাধ্য করে তাঁর কাছে এটা কিছুই নয়। এইসময় সুদীপ দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, ও আপনি এখানে? নিচের দরজা হাট করে খোলা ছিল।

মাসীমা মুখ তুলে তাকে দেখলেন একবার, কিছু বললেন না।

দীপাবলী বলল, ভেতরে এসে বসো।

সুদীপ ঘরে ঢুকে চেয়ার টেনে বসে পড়ল, তাহলে আজ যাওয়া হচ্ছে?

হ্যাঁ। শেষ পর্যন্ত আমার একটা হিল্লে হল।

হিল্লে বলছ কেন? তুমি যে চাকরি পেয়েছ তা ভারতবর্ষের সমস্ত ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রদের স্বপ্ন। কতদিনের জন্যে যাচ্ছ?

জানি না। আমি কিছুই জানি না। মুসৌরিতে কয়েকমাস ট্রেনিং তারপর নাগপুরে যেতে হবে। সেখানকার ট্রেনিং শেষ হলে কোথায় পোস্টিং দেবে তা ওরাই জানে। পশ্চিমবাংলায় দেওয়াই অবশ্য স্বাভাবিক।

কলকাতায় পোস্টেড হলে নিশ্চয়ই তুমি এ ঘরে থাকবে না।

দীপাবলী হাসল। মুখে কিছু বলতে পারল না। এই ঘরে থাকার ব্যবস্থা মায়া তাকে করে দিয়েছিল। দু দুবার। সেই মায়া আজ নেই। এখন এখানে থাকতে তার খুবই খারাপ লাগছে। আর একবার চলে গেলে যে এখানে উঠবে না সে ব্যাপারে মন স্থির করেই নিয়েছে। মাসীমার সামনে আলোচনা করতে ইচ্ছে করছিল না।

মাসীমা হঠাৎ কথা বললেন, আমি এই বাড়ি বিক্রী করে দেব সুদীপ।

সেকি? কেন?

আমার আর এখানে থাকতে ভাল লাগছে না।

কোথায় যাবেন বাড়ি বিক্রী করে?

দেখি।

সুদীপ কিছু বলল না। দীপাবলী মাসীমার পাশে এসে বসল। তিনি ওর হাতে হাত রাখলেন, আমার মেয়ে শুরু করেছিল ভাল, শেষ রক্ষা করতে পারল না। হয়তো এর আবেগ বেশি ছিল, তাই। তুমি এককালে আমার কাছে বাঙালি মেয়েদের লড়াইএর গল্প শুনতে। এখন পর্যন্ত তোমার পথটা ঠিক আছে। ঠিক থেকো।

হঠাৎ গলায় বাষ্প জমে গেল। দীপাবলী কোনমতে বলল, আপনি আশীর্বাদ করুন।

মাসীমা ওর হাত আঁকড়ে ধরলেন, মায়েদের আশীর্বাদ সবসময় মেয়েদের সঙ্গে থাকে। কিন্তু শরীরের যত্ন নিও। এক মেয়ের শরীর যদি বিকল হয় তাহলে তার বিপদের শেষ থাকে না। দীপাবলী চুপ করে রইল। একটা বড় নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল মাসীমার বুক থেকে। হঠাৎ বললেন, তোমাকে একটা কথা বলি। বিয়ে যদি কাউকে করো তাহলে ভাল করে যাচাই করে নিও। নিজের সঙ্গে কথা বলবে পরিষ্কার করে। পরিষ্কার না হলে একা থেকো। তাও বরং ভাল।

মুখ নামাতে নামাতে দীপাবলী আড়চোখে সুদীপকে দেখে নিল। সুদীপ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে আছে। মাসীমা কি নিজের মেয়ের অভিজ্ঞতা থেকে কথাগুলো বললেন? এবং তাঁর মনের অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে জামাই-এর উপস্থিতিকে গ্রাহ্য করছেন না?

বোধ হয় সেটা ওঁর মনে এসেছিল। কথাবার্তার গতি তাই অন্যদিকে গেল। দীপাবলী কি কি জিনিস নিচ্ছে, কি কি নেওয়া উচিত ছিল তাই আলোচনায় এল। সুদীপ চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎ বলল, তোমার কিন্তু এবারে বেরুনো উচিত।

দীপাবলীর খেয়াল হল। মাসীমা উঠে দাঁড়ালেন, তুমি তৈরি হয়ে নাও। আমরা নিচে যাচ্ছি। কাউকে দিয়ে ট্যাক্সি ডাকাচ্ছি। পয়সাকড়ি সঙ্গে ঠিকঠাক আছে তো?

হ্যাঁ, মাসীমা।

ওঁরা নেমে যাওয়ার পর দীপাবলী ঘরে একা। বুকের ভেতরটা খুব ভারী বলে মনে হচ্ছিল। জীবন অন্যদিকে বাঁক নিতে যাচ্ছে। একটা খোলস ছেড়ে আর একটা খোলস পরতে হবে। এইটুকু বয়সে কত কি দেখল সে, কতকাল বাঁচতে হবে, দেখার কোন শেষ থাকবে না। কিন্তু সব ছাপিয়ে আজকাল বড় বেশি করে নিজেকে একা বলে মনে হয়। এবার চাবাগান থেকে আসার সময় মনে হয়েছিল চেনা গণ্ডী থেকে অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ মাসীমার এই ঘরে আসা, ওসব কথা শোনার পর সেই একই অনুভূতি হচ্ছে।

তৈরি হয়ে জিনিসপত্র দুহাতে নিয়ে নিচে নেমে দেখল সুদীপ আর মাসীমা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। মাসীমা সুদীপকে বললেন, কিছু মনে করা না তুমি।

সুদীপ মাথা নাড়ল, না, না। আমি আপনাকে বুঝতে পারছি। তারপর সে দীপাবলীর দিকে হাত বাড়াল, দাও ট্যাক্সি এসে গিয়েছে।

দীপাবলী আপত্তি করল, না, না। আমি নিয়ে যেতে পারব। তোমাকে তো পুরোটা পথ নিয়ে যেতে হবেই। এখন তো দাও। প্রায় জোর করেই তার হাত থেকে নিয়ে এগিয়ে গেল সে দরজার দিকে।

দীপাবলী মাসীমাকে প্রণাম করল। ভদ্রমহিলা খুব আস্তে বললেন, ভাল থেকো। দীপাবলীর হঠাৎ কান্ন পেল। নিজেকে ধরে রাখতেই সে দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে ট্যাক্সিতে জিনিসপত্র রেখে সুদীপ দরজা খুলে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে বলল, চটপট ওঠো। পোস্তায় জ্যাম পেলে মুশকিল হয়ে যাবে।

দীপাবলী উঠল। উঠে দেখল সুদীপ তার পাশে বসে দরজা বন্ধ করছে। সে বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

তোমায় সি-অফ করতে। কলকাতা শহর থেকে বিদায় নিতে চাইছ যখন তখন সেটা আমিই দিয়ে আসি। সুদীপ গম্ভীর মুখে বলল।

তুমি স্টেশন পর্যন্ত যাবে কিন্তু বাকি পথটা আমাকে একাই যেতে হবে। তাই এর কোন দরকার ছিল না, কি দরকার কষ্ট করার?

সুদীপ মুখ ফেরাল, তুমি আমাকে পছন্দ করো না, না?

ঠিক তা নয়। আর এক্ষেত্রে পছন্দ অপছন্দের কথা উঠছেই বা কেন?

বেশ, তোমার আপত্তি থাকলে আমি নেমে যাচ্ছি। আজ মায়ার মা আমাকে নিষেধ করলেন ও বাড়িতে যেতে। সম্পর্কগুলো তো এভাবেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।

দীপাবলী চুপ করে রইল। মানুষের হতাশা নিয়ে তর্ক করার কোন মানে হয় না।

সুদীপ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে চিৎপুরের দিকে। সে এবার বলল, তোমাকে কয়েকটা কথা বলছি। এ জীবনে আর কাউকে এসব কথা বলা ঠিক হবে না সুযোগও পাববা না। কিংবা আমিই চাইব না এই বিষয়ে কথা বলতে। আজ সকালে মনে হল তোমাকে বলা উচিত। ও বাড়িতে বসে বলা সম্ভব ছিল না।

কি বিষয়ে? দীপাবলীর অস্বস্তি হচ্ছিল।

মায়া। ও নেই এখন। মৃত মানুষকে নিয়ে আমরা সাধারণত বিরূপ কথাবার্তা বলি না। ওর সম্পর্কে কোন খারাপ আলোচনাও করতে চাই না। কিন্তু তোমার জানা দরকার আমার কাছ থেকে এ বাড়িতে চলে আসা পর্যন্ত মায়ার কাছে আমি প্ৰতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। সেই প্ৰতিজ্ঞা আমি রাখতে পারিনি বলেই ও চলে এসেছিল।

কি প্রতিজ্ঞা?

আমাদের বিয়ের আগেই মায়া স্পষ্ট বলেছিল শমিতকে ও ওর মত ভালবেসে যাবে। আমাকে বিয়ে করছে বটে কিন্তু আমি কখনও ওই ভালবাসা নিয়ে যেন কথা না বলি। আমি মেনে নিয়েছিলাম। সেইসময় ওকে পাওয়ার জন্যে আমি সব শর্ত মেনে নিতে পারতাম। আমি তখন ওর পাশে না দাঁড়ালে ও মনের দিক থেকে নিঃস্ব হয়ে যেত। কিন্তু আমি একজন মানুষ। আমার পক্ষে কতদিন উদার হয়ে থাকা সম্ভব? যখন আমি জানতে পারছি ও শমিতের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে। আমি একবার ডিভোর্সের কথা বলেছিলাম। সেইসময় শমিত ফট করে বিয়ে করে ফেলল। তুমি ভাবো, আমার স্ত্রী তার প্রেমিক বিয়ে করেছে বলে কষ্ট পাচ্ছে। এই দৃশ্যও আমাকে দেখতে হয়েছে। এবার আর পারিনি। ওকে বলেছিলাম আমার সন্তান চাই। তার আগে শমিতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করতে হবে। ও মানতে পারেনি, তাই চলে এসেছিল। হয়তো ওভাবে না বললে মায়া চলে আসত না। এইসব ফিল্ম করতে দার্জিলিং-এ যেত না। ও অন্তত বেঁচে থাকত পৃথিবীতে। সুদীপের গলার স্বর থমথমে হয়ে গেল। দীপাবলী চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। মনে পড়ল চাকরি ছেড়ে কলকাতায় বাসস্থানের জন্যে সে যেদিন মায়া-সুদীপের বাড়িতে গিয়েছিল সেদিন তাকে পৌঁছাতে মায়া বাসস্ট্যাণ্ড পর্যন্ত এসেছিল। কিছুক্ষণ শুনে সে মায়াকে প্রশ্ন করেছিল কেন সুদীপের সঙ্গে আছে? মায়া অদ্ভুত হেসেছিল। ছেড়ে যেতে পারা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছিল। এ নিয়ে আর আলোচনা হয়নি। যাকে ভালবাসে না তাকে কেন ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয় এই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যে মায়া আজ বেঁচে নেই।

হাওড়া স্টেশন এসে গেল। ট্যাক্সি থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে সুদীপ কুলি ডাকল। সে ট্যাক্সির ভাড়া দেবার চেষ্টা করেনি বলে খুশি হল দীপাবলী। স্টেশনে ঢুকে সুদীপ জানতে চাইল, সব তো শুনলে, কিছু বললে না তো?

দীপাবলী মাথা নাড়ল, কিছু বলার নেই। যাত্রীদের ভিড়, প্লাটফর্ম খোঁজা কামরা এবং নম্বর মিলিয়ে আসন বের করে জিনিসপত্র নামিয়ে সুদীপ বলল, কুলির ভাড়াটাও নিশ্চয়ই দিতে দেবে না।

ভাড়া মিটিয়ে দীপাবলী বলল, তুমি আমার কত বড় উপকার করেছ একসময় এই ছোট ব্যাপারে তোমাকে কেন জড়াতে যাব?

আমি তোমার উপকার করেছি? সুদীপের গলায় বিস্ময়।

বাঃ, গড়িয়াহাটায় তোমার সঙ্গে দেখা না হলে আমি এতদিন নিশ্চিন্তে কলকাতায় থেকে পরীক্ষা দিতে পারতাম?

ও। কিন্তু সেই ব্যবস্থা তো তোমার বন্ধু করে দিয়েছিল।

হ্যাঁ, আর তুমি আমাকে সেদিন বলেছিলে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে।

যাক, আমি অন্তত কাঠবিড়ালি হলাম।

সুদীপ, তুমি জানো আজ শমিতের শো আছে।

জানি। সুদীপ মুখ ফেরাল, এটা শমিতই পারে।

একটা কথা বলব?

নিশ্চয়ই।

পৃথিবীতে এমন দুজন মানুষ কোথাও খুঁজে পাবে না যারা পরস্পরের সম্পর্ক নিয়ে একই কথা বলছে। সুখের সময় নয়, ইমোশনে আঘাত লাগলে একই ঘটনার চেহারা দুজনের কাছে দুরকম হয়ে যায়। আজ তুমি যা বললে তা তোমার কাছে খুবই সত্যি। কিন্তু ধর, তুমি নেই আর মায়া বেঁচে আছে, তাহলে মায়া যা বলত তা তোমার সঙ্গে কিছুই মিলত না। আমরা কেউ কাউকে নিতে পারি না মন থেকে মেনে নিই। এই মেনে নেওয়া যদ্দিন চলে তদ্দিন বিরোধটা কেউ দেখতে পায় না। আমি জানি এর কোন সুরাহা নেই।

তুমি ঠিকই বলেছ। নিঃশ্বাস ফেলল সুদীপ তাহলে চললে?

হ্যাঁ। এবার তুমি ফিরে যাও।

কলকাতায় এলে যোগাযোগ করো।

নিশ্চয়ই। বলতে বলতে হঠাৎ উত্তেজিত হল দীপাবলী, এই সুদীপ, ওই যে ভদ্রলোক এগিয়ে যাচ্ছেন ওকে ডাকো তো? প্লিজ!

সুদীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কোন ভদ্রলোক?

ওই যে, স্যুট পরা। বলতে বলতেই মনে পলি জমল, আচ্ছা, থাক, ডাকতে হবে না। সুদীপ এগোতে যাচ্ছিল, এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ভদ্রলোক কে?

দীপাবলী মাথা নাড়ল, আমার পরিচিত। এর আগেরবার দিল্লীতে আলাপ হয়েছিল।

আরে। দাঁড়াও। উনি মনে হচ্ছে এই ট্রেনে যাচ্ছেন। একেবারে একা যাওয়ার চেয়ে পরিচিত কারো সঙ্গে যাওয়া ঢের ভাল।

না। উনি আলাদা কম্পার্টমেন্টে যাচ্ছেন। এখানে তো ইচ্ছে করলেই সিট বদলানো যায় না। ঠিক আছে, আমি এবার উঠি।

দীপাবলী জানালার ধারে নিজের আসনে বসল। এর মধ্যে ভরে গিয়েছে কামরা। সে স্বস্তির সঙ্গে দেখল তার আশপাশে সবাই অবাঙালি। কিছুটা নিশ্চিন্তে যাওয়া যাবে। বাঙালির কৌতূহলের সামনে তাকে এ যাত্রায় পড়তে হচ্ছে না।

ট্রেন ছাড়ল। সুদীপ হাত নাড়ল। ট্রেন তাকে একই জায়গায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। সুদীপ চোখের আড়ালে চলে গেল। হঠাৎ দীপাবলীর মনে হল ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা হলে ও একটা প্রস্তাব দিত। তিনি মানুষকে অকাতরে দুঃখ যন্ত্রণা দিয়ে গেছেন। সুখ দেওয়া মাত্র মনে হয়েছে বেশি দেওয়া হয়ে গেল, তাড়াতাড়ি সুখ কেড়ে নিয়েছেন। তাই মানুষের একটু পাওনা থেকে যায়ই তাঁর কাছে। এই পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময়টা মানুষ যেন কিছু আগে জানতে পারে। এই ভাবে হাত নেড়ে আপাতত থেকে যাওয়া মানুষেরা তাকে বিদায় জানাবে।

চোখ বন্ধ করল দীপাবলী। সঙ্গে সঙ্গে কাঁপনি এল। এতক্ষণ কথায় কথায় ভেতরে ভেতরে যে নির্লিপ্তির পাঁচিল তুলেছিল তা ভেঙে পড়ল হুড়মুড় করে। সে কলকাতায় পশ্চিমবাংলা ছেড়ে একদম একা অনিশ্চিতের পথে চলে যাচ্ছে। এই যাওয়ার জন্যে কত চেষ্টা ছিল। কিন্তু যাওয়ার সময় নিজেকে ভীষণ নিঃস্ব লাগছে। মনের এত শেকড় এখানকার মাটিতে ছড়ানো ছিল? চোখ উপছে জল গড়ালল।

আপনার চোখে কি কয়লা গিয়েছে?

চমকে মুখ ফিরিয়ে দীপাবলী দেখল উল্টোদিকের সিটে বসা এক অবাঙালি বৃদ্ধ সস্নেহে তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন। তাঁর পাশে বসা একজন বললেন, কয়লা কাঁহাসে আয়েগা, ইয়ে তো ডিজেল ইঞ্জিন হ্যায়।

ও, ভুল গিয়া থা। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন।

চোখ মুছল দীপাবলী। তারপর ছুটন্ত গাছপালা বাংলাদেশের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল। অথচ সে কিছুই দেখছিল না। কি নিঃসঙ্গ, শূন্যতায় তার চারপাশ তিরতির করে কাঁপছিল। অথচ সে এসব নিয়ে কখনও ভাবেনি। বুকের ভেতর জমা সমস্ত আলো যেন অকস্মাৎ উধাও!

সহযাত্রীরা মোটামুটি ভদ্র এবং মিশুকে। বিশেষ করে বৃদ্ধ ভদ্রলোক। রাত্রে শাওয়ার আগে তিনি তাঁর সঞ্চয় থেকে কিছু খাবার এগিয়ে দিলেন। বিকেল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। ট্রেনে যে লোকটা খাবারের অর্ডার নিতে আসে তাকেও সে দেখতে পায়নি। খিদে ছিল প্রচণ্ড। কিন্তু একেবারে অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে খাবার নিতে কখনই অভ্যস্ত নয় সে। তাই মাথা নেড়ে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ভদ্রলোক হেসে হিন্দীতে বলেছিলেন, আরে বেটি, তুমারা জরুর ভুখ লাগা। ট্রেনে উঠে তুমি কাঁদলে। এতক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলে। সঙ্গে খাবার আনোনি। আর এত বড় রাতটায় পেটে কিছু না দিলে চোখে, ঘুম আসবে না।

দীপাবলী হেসে ফেলল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু—

নাও ধরো। বৃদ্ধ পরোটা আর তরকারি এগিয়ে দিলেন একটা প্লাস্টিকের প্লেটে রেখে। অগত্যা খেতে হল। একদম অচেনা স্বাদ। পরোটায় একধরনের রুক্ষতা থাকলেও বেশ স্বাদু। সঙ্গে জলের পাত্রও নেই। বৃদ্ধ সেটাও দিলেন, শোনো বেটি, তুমি মেয়ে, একা যখন ট্রেনে চাপবে তখন খাবার আর জল সবসময় সঙ্গে রাখবে। ছেলেদের মত প্ল্যাটফর্মে নেমে জলখাবার খেতে তো তোমরা পারো না।

কেন পারব না?

তোমরা লজ্জা পাবে। অল্প সময়ে ছোটাছুটি করতে হবে।

নিজের জন্যে কিছু করা যখন প্রয়োজন তখন লজ্জা হবে কেন?

হয়তো। আমি বুঝি না। অনেক বয়স হয়েছে তো। যৌবনে মেয়েদের কখনও একা ট্রেনে চাপতে দেখিনি। এখন দিন পাল্টাচ্ছে।

আপনার বাড়ির মেয়েরা কখনও প্রয়োজনে একা ট্রেনে চাপেনি?

না বেটি। তাদের বিয়ে হয়ে যায় যোল বছরের মধ্যেই। তখন তারা থাকে বাবার আশ্রয়ে। তারপর তো স্বামী শ্বশুরের ছায়ায়। প্রয়োজন হয় না।

অত অল্প বয়সে বিয়ে দিচ্ছেন কেন? ওরা স্বাবলম্বী হবার সুযোগ পায় না।

বৃদ্ধ হাসলেন, আমি যা বলব তা তোমার পছন্দ হবে না।

বলুন না। যুক্তি থাকলে অপছন্দ হবে কেন?

যুক্তি? পৃথিবীর অর্ধেক কাজ যুক্তি দিয়ে হয় না। নিজেকে নিঃস্ব করেও অনেক ছেলে বাপমায়ের সেবা করে কোন যুক্তিতে বলতে পারো। বৃদ্ধ বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকালেন, আমরা সবসময় সংসারের শান্তিকে গুরুত্ব দিই। যে মেয়ে ছেলের বউ হয়ে এল তার ওপর অনেক দায়িত্ব। তাকে সংসারের একজন হতে হবে। এটা যদি সে না ভাবতে পারে তাহলে সংসারে শান্তি আসবে না। সে যদি বাপের সংসারে পরিণত হয়ে আসে তাহলে স্বামীর সংসারের নিয়মকানুন মানতে নাও পারতে পারে। পাখির বোল একবার ফুটে গেলে সে কি আর নতুন কথা শেখে? বৃদ্ধ হাসলেন।

আমি এটা মানছি না। এসব ছেলেরা নিজেদের সুবিধে করার জন্যে বলে।

বউ আনে কিন্তু ছেলের মায়েরা। তারা মেয়ে।

তর্ক চলতে পারত। কিন্তু দীপাবলী ক্লান্তি বোধ করল। সে কি করে এই বৃদ্ধকে বোঝাবে শুধু একজন পুরুষের পাশে পাশে তার সন্তানের মা হয়ে সেই সংসারের শান্তি বজায় রাখার জন্যে কোন মেয়ের জন্ম হতে পারে না। ভালো না লাগলেও একটা লোলাকের সঙ্গে সারাজীবন থাকো, তার ছেলেপুলের মা হও আর নিজের সমস্ত ভাল খারাপগুলো একে একে বিসর্জন দাও। পৃথিবীর সমস্ত সভ্য দেশের মেয়ে এই ব্যবস্থা থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে মুক্ত করেছে। বাংলাদেশের মেয়েদের মনে এমন উপলব্ধি যখন তীব্র হয়ে বসবে। তখনই ছবিটা পাল্টে যাবে। ততদিন অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই।

নিজের বাকে শুয়ে এতক্ষণ যেটাকে ভুলে থাকতে চাইছিল তা আর পারল না। দীপাবলী। সুদীপকে শেষ সময়ে থামিয়ে দিয়ে খুবই ভাল করেছে সে। কি দরকার গায়ে পড়ে আলাপ করার। দিল্লী থেকে কলকাতায় এসেও যদি কেউ নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকে তাহলে তাকে তাই থাকতে দেওয়া উচিত।

অথচ পরের দিন সকালে ট্রেন যখন মোগলসরাই-এ থেমেছে তখন সহযাত্ৰী বৃদ্ধকে। দেখাবার জন্যেই দীপাবলী প্ল্যাটফর্মে নামল। চায়ের স্টলের সামনে বেশ ভিড়। প্রভাতী চায়ের জন্যে যাত্রীরা ব্যর্থ হয়ে উঠেছে। ভাঁড়ের চায়ের থেকে স্টলের কাপের চায়ে দিনের প্রথম বারে ঠোট ছোঁয়াতে আগ্রহী সবাই। সেই ভিড় ঠেলে সামনে এগোতে ইতস্তত করল সে। কিন্তু পরক্ষণেই বৃদ্ধের কথা মনে পড়তে সে পা বাড়াল। অনেক চেষ্টার পরে কাউন্টারের সামনে পৌঁছে সে বলতে পারল, দু কাপ চা। তার মনে হল সে এগিয়েছে বটে কিন্তু লোকে যে জায়গাটুকু ছেড়েছে তা মেয়ে না হলে ছাড়ত না। ভাবনাটা ভাবতে মোটেই ভাল লাগছিল না তার।

দাম মিটিয়ে চায়ের কাপ নিয়ে ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে আসতেই সে অলোককে দেখতে পেল। দেখামাত্র ছুটে এল অলোক, আরে আপনি? এখানে?

আপাতত দিল্লী যাচ্ছি। দুহাতে দুটো কাপ ধরে কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল।

তা তো দেখছি। কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো? আপনাদের বাড়িতে গিয়ে শুনলাম কারো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে আর সবাই মিলে দার্জিলিং চলে গিয়েছেন। কার কি হয়েছে?

নড়ে উঠল দীপাবলী, আমার বন্ধুর।

যাক, আপনার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত দেখা হল। সঙ্গে কেউ আছে? কোথায় সিট?

ও পাশে। একাই যাচ্ছি।

তাহলে চলে আসুন আমার কামরায়। একদম খালি।

লোভ হল খুব। কিন্তু সে মাথা নাড়ল, থাক। আমি ওখানে খুব খারাপ নেই। এই দেখুন একজনের জন্যে চা নিয়ে যাচ্ছি। দীপাবলী এগোল। অলোক সঙ্গে এল। বৃদ্ধ বসেছিলেন জানলায়। তাঁর দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে আসছে দেখে তিনি খুব অবাক। দীপাবলী বলল, নিন। আমি কিন্তু ভিড় ঠেলে চা নিয়ে এলাম।

বৃদ্ধ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত কাপ ধরতে গেলেন। জানলার শিক গলে কাপ ভেতরে ঢুকছিল না। অনেক চেষ্টার পর প্লেট থেকে কাপ আলাদা করে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বৃদ্ধ বললেন, আমি কখনও চা খাইনি। খাব না ভেবেছিলাম। কিন্তু আজ খাব বেটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *