৩.২ সন্ধ্যাবেলা বন্ধুদের কাছে

০৭.

সন্ধ্যাবেলা বন্ধুদের কাছে যাওয়া বন্ধ করল অভয়। তার বন্ধুদের জমায়েত যেখানে হয়, সেই ইউনিয়ন অফিসে সে আর যেতে পারল না। কয়েক দিন আগে, অনাথের মুখের ওপর রূঢ় কঠিন কথাগুলি বলে, ইউনিয়ন অফিসকে তার দূর মনে হচ্ছে। শৈথিল্য অনুভব করছে আত্মীয়তায়।

শুধু অনাথকে রূঢ় কথা বলার জন্য নয়। কয়েক দিন আগের সেই দিনটি তাকে বিমুঢ় করেছে ভিতরে ভিতরে। একটি বিস্মিত স্তব্ধতায় সে যেন থমকে রয়েছে। অনাথের সঙ্গে কথা, আধো অন্ধকারের এক বিচিত্র, যেন শরীরহীন পরিবেশের মধ্যে জীবন চৌধুরীর সেই রোগক্লিষ্ট আশ্চর্য। কথামালা, আর সুবালার সান্নিধ্য। সব মিলিয়ে, একটি সন্ধ্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে, তার ভিতরে ভিতরে অনেক জায়গায় কেঁপে গেছে, চিড় খেয়েছে, ধ্বস নেমে গেছে।

অনাথকে কথাগুলি বলে সে অশান্তির হাত থেকে মুক্তি পেল না। জীবন চৌধুরীর কথায় তার আয়ত্ত হল না নিরহঙ্কার দুঃখদীর্ণ বিশ্বাসের অটলতা। সুবালা তাকে সব থেকে বেশি অসহায় করেছে। নিজের প্রতি আচ্ছন্ন সে সংশয়ে।

আপন জীবন-চিন্তায় যেখানে তার স্বাতন্ত্রের বিন্দুমাত্র ছায়া ছিল না, তারই প্রবেশ ঘটল, অদৃশ্য পাতালের রন্ধ্র চুইয়ে। কবি এবং গায়ক বলে, এত দিন বাইরের জগৎ তাকে যে স্বতন্ত্র রূপে দিয়েছিল, তাতে তার মধ্যে স্বতন্ত্র চিন্তার উদয় হয়নি। বাইরের জগতের কাছে যখন তার পরিচয় নিশ্চিত ভাবে অভয় কবি বলে চিহ্নিত হল, তখন, নিজের অজান্তে, সে প্রশ্ন করল, আমি কী চাই? আমার এ জীবন কী?

জবাবে, অন্ধকারের মধ্যে একটি জটিল আবর্ত নিঃশব্দে পাক খেতে লাগল। তার মধ্যে কতগুলি বিচ্ছিন্ন কথা শুনতে পেল সে। মানুষ সবাই খেয়ে পরে সুখে বাঁচুক, এই ভেবে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চেয়েছি। পরমুহূর্তেই আবার শুনল, এ কথা সত্য নয়। সত্য নয়, কারণ জীবন সে কোথাও উৎসর্গ করেনি। সত্য মিথ্যার ধন্দে সে কোনও উত্তর পেল না। তার ভয় হল। প্রশ্ন করে সে সরে এল। যেন অতল জলের শ্বাসরুদ্ধ অন্ধকার থেকে ভেসে উঠল সে। নিজের কাছ থেকে। জবাব আদায়ের ক্ষমতা নেই তার এবং অতল জলের ওপরে, সবচেয়ে কাছের সহজ মাটি আঁকড়ে ধরল সে। ছেলের প্রতি আরও যত্নশীল হল। আরও কাছে কাছে আরও বেশি সময় ধরে রইল ছেলে নিয়ে। কথায় কথায় নিমে নিমে বলে ডাকতে লাগল।

আরও বেশি নজর দিল দোকানের দিকে। কেনাবেচার হিসেবে আরও হিসেবি হয়ে উঠল। পাল্লার কাঁটার প্রতি নজর তীক্ষ্ণ করল আরও। নতুন গানের চিন্তায় ডুবিয়ে দিতে চাইল নিজেকে। নতুন গান, লোকশিল্প সম্মেলনে যাওয়ার জন্যে। সেজন্য সন্ধ্যাবেলাটা হাতে রাখতেই হল। কিন্তু ইউনিয়ন অফিসে নয়। মুচিপাড়ার বস্তিতে।

মালিপাড়ার শেষে যেটা কোনও এক কালে ছিল গঙ্গায় আসার খাল, কালক্রমে সেটা শহরের সুবৃহৎ নর্দমায় পরিণত হয়েছে। শহরের ময়লা মুক্তিদাত্রী নালা বিশেষ। সেই খালের ধারে মুচিপাড়ায় বাজনদার চুক্তি করতে গিয়ে, গানের মহড়া চলল সেখানেই।

পাড়া চেনা ছিল আগেই। অধিবাসীরাও সকলেই কম বেশি পরিচিত। মেলা মেশা ছিল না। এখন সন্ধ্যা হলেই অভয় মুচিপাড়ায় আসে। মুচিপাড়ার লোকেরাও খুশি। হারু বায়েনের বাড়িতেই। আসল বৈঠক। হারু-ই বাজাবে অভয়ের সঙ্গে। কলকাতায় যাবে, লোকশিল্প সম্মেলনে। কাঁসি। বাজাবে হারুর ছোট ভাই। সন্ধ্যা হলেই হারুর উঠোনে মুচিপাড়ার সকলের ভিড় লেগে যায়।

অভয় এলোমেলো যা খুশি তা গাইতে থাকে। সময়ে সময়ে কথা অর্থহীন হয়। মিল থাকে না। এ গান যে সম্মেলনের প্রস্তুতি, আসরের সবাই জানে না। অমিল এবং অর্থহীন কথার ত্রুটিও বোঝে না সব সময়। যখন ভাল লাগে, তারিফ করে। ভাল না লাগলে চুপ করে থাকে। আধঘুমন্ত অবস্থাতেও সবাই দোলে দুই বায়েন ভাইয়ের ঢোলক কাঁসির তালে তালে।

কথা খুঁজে খুঁজে, বাঁধতে বাঁধতে, এলোমেলো রাশি রাশি ভুলের জন্য, সেখানে কোনও সংকোচ হয় না অভয়ের। লজ্জা করে না।

কিন্তু ভিতরে ভিতরে আনমনা হয়ে ওঠে অভয়। সে যা ভাবতে চায় না তাই মনে হয়। অভয় হাল ছাড়ে না।

তার এ ভাবান্তরটা চোখে পড়ল সুরীনের। কিন্তু বলবার বিশেষ কিছু খুঁজে পেল না। কেবল এই ভেবে সে অবাক, যে দোকান নিয়ে অভয় আরও বেশি বজ্র আঁটন কষছে, সেই দোকানের লাভের খাতায় ক্রমে কেন ফসকা গেরোর সংখ্যা বাড়ে। আঁটন কষণ কিছুই না করে, সে যেমন দোকানের হিসাবে স্বচ্ছন্দ, অভয় তাতে শুধু গরমিল বাড়ায়। কথাও যেন কম বলছে অভয়। কেন? দোকানের ব্যাপারে, অভয় কি খুশি নয় সুরীনের ওপর? সুরীনের হিসেবের ওপরেও অভয় হিসেব করে। হঠাৎ সে এত উঠে পড়ে লেগেছে কেন? সুরীন খুড়োকে সে এত অবিশ্বাস করছে নাকি?

সুরীনের এই মনোভাব অভয় যদি এক বারটিও জানত? আসলে সে দোকান নিয়ে বেশি মাথা ঘামানোটা, পদে পদে নিজের কাছেই প্রমাণ করতে চাইছিল। বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে ভুল করছিল বেশি।

আর ভামিনীর চোখে পড়ল মুচিপাড়া যাওয়া-আসা। ওটা তার পছন্দ নয়। রাস্তা আর উঠোন যাদের শুয়োরের বিষ্ঠায় ভরতি, সেখানে গিয়ে বসতে, মাখামাখি করতে ঘেন্না করে না অভয়ের? জাত না হয় না-ই, মান গেল।

গিনি সেটাও মানতে রাজি নয়। জাত-ই বা মানবে না কেন অভয়। তার এই অল্প বয়সের গ্রামীণ অভিজ্ঞতায় সে জানে, মানুষ মাত্রেরই জাত আছে এবং থাকবেও। বায়েন মুচির বাড়িতে শুয়োরের খাঁচার পাশে বসে পোহর রাত অবধি কাটিয়ে আসাটা আবার কেমনতর কথা। মুচির ঘরে নাকি আবার খাওয়া যায়! ছি!

গিনি এখন প্রায় গিন্নি। হাসি মুখে হলেও অভয়কে তার শাসন মানতে হয়। ছেলে নির্মল, অর্থাৎ নিমে যদিও ভামিনীকে মা বলে জানে, গিনির অনুরক্ত সে বেশি। গিনিকে সে দাই দাই। (দিদি) বলে ডাকে বটে, হ্যাপা পোহাবার বেলায় মায়ের চেয়ে কম নয়। রান্নাবান্না থেকে, যাবৎ এখন গিনির মাথায়। তাই, সে মুচিপাড়ায় যাওয়া আটকাতে পারে না বটে, ধমক দিয়ে উঠোনে দাঁড় করিয়ে, গঙ্গাজলের ছিটা না দিয়ে ছাড়ে না।

অভয় একটুও জানে না, এ সংসারে গিনি কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। শুধু অভয় কেন, হয়তো সুরীনও লক্ষ করে না গিনির পরিবর্তন। একটি সংসারে নিয়মিত পরিশ্রম, নিয়মিত খাওয়া-পরা এবং মোটামুটি নিঃশঙ্ক জীবনযাত্রায় গিনির মধ্যে একটি স্বাভাবিক নারীর প্রকাশ ঘটেছে। সে ছেলে কোলে করে ঘুম পাড়ায়, ছেলে সাজায়, শাসন করে। বাড়ির প্রায় কতা গিন্নি, সুরীন ভামিনীকে খাইয়ে সে রাত্রির অন্ধকারে অভয়ের জন্য জেগে বসে থাকে। জেগে থেকে কষ্ট হলে, অভয়কে জানতে দিতে চায় না। যদিও মাঝে মাঝে প্রকাশ হয়ে পড়ে। রাগ প্রকাশ করা মুশকিল। কারণ অভয়ের ঢালাও হুকুম আছে, ভাত বেড়ে রেখে, খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়বে। কিন্তু, অভয়ের আগে গিনি খেয়ে শুয়ে পড়বে, ভাবতে পারে না। এ যে শুধু তার নারী চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, তা নয়। অভয়ের অধীন সে। তার রক্ষাকর্তা, এ কথাটি একেবারে ভুলতে পারে না। তার ধারণা সংসারে কতগুলি ভাল-মন্দ বলে জিনিস আছে। এ কি কখনও সম্ভব যে, অভয়ের আগে সে নিজের সব পাট মিটিয়ে, এলিয়ে আয়েশ করবে! তা ছাড়াও অভয়কে সে মানুষ হিসেবে অনেক বড় মনে করে। শ্রদ্ধা করে, ভক্তিও করে। অভয় তার কাছে থেকেও অনেক দূরের মানুষ। চেনার মধ্যেও অচেনা। কৌতূহল তার অনেক।

তাই, এ সংসারে, একজন মানুষের স্মৃতি গিনি নিশ্চিহ্ন করতে পারে না বটে, প্রত্যহের মধ্যে, সকলের সব অভাব ভুলিয়ে রাখতে কসুর করে না।

তবুও এক একটি সময় আসে, যখন কাজ নেই, যখন অন্ধকার ঘিরে আসতে থাকে চারিদিকে, যখন সবাই ঘুমায়, তখন অচেনা বাতাসের ঘূর্ণি ওঠে তার বুকে। তার স্বচ্ছন্দবিহারিণী জীবনের পাল ছিঁড়ে পড়তে চায় সেই বাতাসে। তার কষ্ট হয়। এ হেন অনিবার্য, তবু অবুঝ সেই কষ্টে, এক এক সময় তার কান্না পায় এবং কান্না পেলে নিজের ওপর সে বিরক্ত হয়। এর কোনওটাই তার কাছে, কোনও স্পষ্ট অর্থবহ হয়ে ওঠে না।

কোন এক আবদ্ধ স্তব্ধতা থেকে, তার দেহ আরও দৈর্ঘে বেড়েছে। সঙ্কুচিত মগ্নতা থেকে এক মৌন উল্লাসে সর্বাঙ্গ ঢল ঢল হয়ে উঠেছে। অন্ধকারের নির্জন একাকীত্ব তাকে এই দেহের দরজায় দাঁড় করিয়ে, তার অবোধ কষ্টকে রক্তে রক্তে অনুপ্রাণিত করে।

কিন্তু এ কষ্টের জন্য, সংসারে কাউকে সে দায়ী করে না। এ তার একলার। আর সব দিকে সে হেঁকে ডেকে, বকে ঝকে সংসার করে।

অভয় গিনির গঙ্গাজল মেনে নিয়েছে। ধমকধামকগুলি খেতেও আপত্তি করেনি। কিন্তু মুচিপাড়ায় যাওয়া তার ঠেকানো গেল না। হয়তো গিনির জাত বেজাতের বিশ্বাসের ওপর অভয় তাকে কিছু বলত। কিন্তু তার মনের সে অবস্থা নয়।

মালিপাড়ায় প্রস্তুতি পর্ব জমে উঠল। লোকশিল্প সম্মেলনে যাবার দিন এল ঘনিয়ে। ঠিক এমনি সময়েই, এক শনিবারের রাত্রে সুরীন জানাল, এবার সে তার নিজের ঘরে ফিরে যেতে চায়।

রাত্রি তখন প্রায় বারোটা। এত রাত্রে সুরীনকে জেগে বসে থাকতে দেখেই একটু অবাক হল অভয়। ভামিনী পাশেই, বারান্দায় শুয়েছিল। গিনির সঙ্গে গল্প করছিল সুরীন। গরমের সময় নয় যে, এত রাত অবধি বারান্দায় বসে গল্প করবে সবাই।

অভয় বলল, এখনো শোওনি কাকা?

সুরীন হাই তুলে বলল, এই এবার যাব। কাল রোববার, তাই একটু বসে আছি।

গিনি তাড়াতাড়ি উঠে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিল। অভয় যেন লক্ষ করেও করল না। ঘরের পিছনে ঘাটে নেমে গেল গামছা নিয়ে। হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসল। গিনিকে জিজ্ঞেস করল, সুরীনকাকা খেয়েছে?

গিনির মুখের অবস্থাও খুব স্বাভাবিক নয়। চুপচাপ, গম্ভীর। বলল, হ্যাঁ।

অভয় আর কিছু না বলে, খাওয়ায় মনোযোগ দিল। কিন্তু, যাকে ঘুমন্ত মনে হয়েছিল, সেই ভামিনীর গলা শোনা গেল বারান্দায়। ব্যাপারটা এমন কিছু অদ্ভুত নয়। কিন্তু, ভামিনী খুড়ি জেগে ছিল, অথচ বাড়িতে ঢোকার সময় একটি কথা বলল না, এমন তো হয় না। খেতে খেতে সে শোনবার চেষ্টা করল। কিন্তু ভামিনীর কথা বোঝা গেল না। অস্পষ্ট চুপিচুপি ভাব যেন। অভয় তাকাল গিনির দিকে। গিনি আজ তার স্বভাবের বাইরে, একেবারে নীরব।

খাওয়া শেষ করে বারান্দায় এল অভয়। সুরীন বলল, খেলে?

–হ্যাঁ।

 একটু চুপচাপ। তারপরে হঠাৎ যেন জোর করে উচ্চারণ করল সুরীন, বলছিলুম কী, বুঝলে অভয়, এবারে ভাবছি ও বাড়িতে ফিরে যাব।

অর্থাৎ সুরীনের নিজের বাড়িতে। অভয় জেলে যাওয়ার পর থেকে সুরীন ভামিনী এ বাড়িতেই আছে। এমন কিছু অদ্ভুত কথা নয়। তবু অভয় যেন অবাক হয়ে বলল, ফিরে যাবে?

–তা হ্যাঁ—ফিরে যেতে হবে না? অনেকদিন তো হল। বছর কাবার হয়ে গেছে কবে। ও বাড়ি তো পোড়ো হয়ে গেল প্রায়। এবার যাওয়া দরকার। তাই ভাবছি, তোমার খুড়িকে নিয়ে কালই যাব, বুঝলে?

খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু অভয়ের বুকের দু পাশে একটা যন্ত্রণা কেমন যেন স্তব্ধ করে রাখল তাকে। সে কেবল শব্দ করল, হুঁ।

ভামিনী উঠে বসল। নিজের গায়ে আঁচলটা চাপা দিয়ে বলল, অবিশ্যি গিনি থাকবে। সংসার দেখাশোনা গিনিই করবে। ওদিকে তোমাকে কোনওদিন কিছু দেখতে হবে না। পয়সা কড়ি ঠিক মতন পেলে, সব চালিয়ে নেবে। তা ছাড়া আমরা তো রয়েছিই।

অভয় বলে উঠল, তা বেশ তো, যেয়ো। আর সুরীনকাকা কি তা হলে আর সন্ধেয় দোকানে বসবে না কাল থেকে?

সুরীন ভেবে রেখেছিল সে রকম। কিন্তু অভয়ের ভাবভঙ্গি দেখে বলতে সাহস করল না। বলল, না দোকানে বসব বই কী। ও বাড়িতে ফিরে যাওয়াটা দরকার, সেইটাই—

অভয় বলল, তা তো যাবেই। আর কতদিন ঘর ছেড়ে থাকবে।

 কেউ আর কোনও কথা বলল না। সব চুপ। কেবল রান্নাঘরে ভাত বেড়ে নিয়ে হাত তুলে বসে। রইল গিনি। তার একমাত্র ভয়, অভয় বলবে, তবে গিনিকেও নিয়ে যাও তোমাদের কাছে।

কিন্তু পুকুরের পাড় থেকে কেবল ঝিঁঝির একটানা শব্দ আড়ষ্ট স্তব্ধতার গায়ে বৃথাই করাত চালাতে লাগল।

.

০৮.

এ জীবনে এত ভাবনা আসবে, কোনওদিন ভাবেনি অভয়। নিজে সে যত ব্যস্ত হল, তত চিন্তা বাড়ল, জটিল হল পরিবেশ। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল দুঃখ।

আজ তার সবচেয়ে দুঃসময়ে সুরীন কাকা, ভামিনী খুড়ি নিজেদের সংসারে ফিরে গেল। অথচ, তাকে কেউ ছেড়ে যাবে কিংবা তার কাছে কেউ আসবে, এটা কোনও সমস্যা ছিল না জীবনে। তার জীবনটা ছিল, কারুর ধরা এবং ছাড়ার বাইরে।

তারপর এসেছিল ধরা এবং ছাড়ার পালা। শুন্য আর ফাঁকি মনে হয়েছিল, আগের জীবনটা। আজ এল এমন দুঃসময়, যা চোখে দেখা যায় না। যে দুঃসময় তার ভিতরে ছায়া ফেলেছে। আক্রমণ করেছে মনের চারদিক ঘিরে। যখন তার আদর্শের সীমানা ও বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিঁড়ে গেল, নিমিহীন সংসারে যখন সে পুনবাসন খুঁজছে, সংসারকে নিমিময় করার একটা মহৎ আবেগের দৈন্য যখন রক্তের মধ্যে চাপা পড়া গুপ্ত রোগ, চামড়ায় ফুটে ওঠার মতো আচমকা জেগে উঠেছে। সুবালার সান্নিধ্যের রূপ ধরে, তখন সুরীন ভামিনী গেল। তাদের এ যাওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু যাওয়ার রকমটা তত স্বাভাবিক হয়নি। সিদ্ধান্ত মাত্রেই কাজে পরিণত করেছে। তার ভিতরে যে একটা খচখচানি ছিল, সেটা প্রত্যক্ষ প্রকাশ পেল না। কিন্তু খচখচানিটুকু আন্দাজ করল অভয়। তবু সে মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করল না। জিজ্ঞেস করল নিজেকে। সেখানে কিছু খুঁজে পেল না।

তাই অভিমান অভয়ের। একটা যন্ত্রণার স্তব্ধতাকে সে প্রত্যহের কলরোলে মুখরিত করে তুলতে পারল না। তার মনে হল, একে একে সবাই তাকে ছেড়ে যাচ্ছে। এই ছেড়ে যাওয়াটাই, তার দুঃসময়কে প্রমাণ করছে। তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে, তাকে নিয়ে কেউ খেলছে। অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে টানছে।

এ কথা ভাবতে ভয় হয়। আশৈশব দুঃখ তার কাছাকাছি জিনিস, প্রায় ছায়ার মতো। তাই ভয়ের হাত থেকে নিষ্কৃতির উপায় হিসেবে, দৈনন্দিনতাকে অব্যাহত রাখতে চাইল।

না পাওয়াটা একটা কথা। পেয়ে হারানোটা আর এক কথা। পেয়ে হারানোর যন্ত্রণাই বেশি। অভয়ের মনে হল, সে পেয়ে হারাচ্ছে। এর জন্যে কোথায় যে আপোসের প্রয়োজন, কোথায় হাত বাড়ানো উচিত ছিল, তা সে খুঁজে পেল না। এ সব কিছুকে সে মেনে নিয়ে চলতে চাইল।

আসন্ন সম্মেলনের মহড়া ঠিক চলতে লাগল মুচিপাড়ায়। সন্ধ্যাবেলায় সুরীন দোকানে যেমন বসছিল, তেমনি বসতে লাগল। নিমেকে ছেড়ে ভামিনীর দিন কাটে না। ভামিনী এসে নিয়ে যায়। নয়তো গিনি দিয়ে আসে। তা ছাড়া ভামিনীর নামে মাত্রই বাড়ি যাওয়া। তার অধিকাংশ সময় কাটে গিনির কাছেই। বিশেষ রাত্রের দিকে। কারণ গিনির পক্ষে একেবারে একলা অনেক রাত্রি অবধি থাকা একটু ভয়ের। যদিও গিনির কাছে আদৌ তা সমস্যা নয়।

আর একটা কথা উঠল খুব স্বাভাবিকভাবেই, কেবল অভয়কে বাঁচিয়ে। কথা উঠেই ছিল যে, ভামিনী গিনিকে নিমির জায়গায় বসাতে চায়। ভামিনী চলে যাবার পর, ব্যাপারটা অনেকে পাকাপাকি মনে করল। তাই কথাটা আর একবার উঠল। মালিপাড়ার অন্য কোনও লোকের বিষয় হলে, এ বিষয়ে একটা খোলাখুলি রসালোচনার আসর বসত। কিন্তু শৈলর জামাইয়ের বেলায়, অনেকে একটু সঙ্কোচের আড়ষ্টতায় থমকে রইল। আলোচনা অভয়ের আড়ালে আবডালেই চলতে লাগল। শোনানো চলল কখনও ভামিনীকে। কখনও গিনিকে। এ বিষয়ে ভামিনী যদিও মুখের ওপর ঝগড়া করতে কসুর করল না, গিনি একেবারে নীরব। ভামিনী তাতে অবাক হল। গিনি যে চোপা করতে জানে না, তা তো নয়।

সেদিন যখন পাড়ার জল-কল থেকে কলসি কাঁখে গিনি ফিরল, ভামিনী তখন নিমেকে নিয়ে। উঠোনে। দেখল গিনির চোখে জল।

ভামিনী বলল, কী হল?

গিনি কলসি নিয়ে রান্না ঘরে যেতে যেতে জবাব দিল, যা হয়। কলসিটা ভরবার উপায় নেই। তার মধ্যেই কত কথা শুনতে হয়।

ভামিনী বলে উঠল, তা তুই বা এত চুপচাপ কেন? মুখের মতন জবাব দিতে পারিস না? কাঁদছিস তুই?

রান্নাঘরে কলসি রেখে চোখ মুছল গিনি। ওখান থেকেই ভেজা গলায় বলল, কী জবাব দেব?

ভামিনী রুষ্ট হল। বলল, কী জবাব দিবি জানিস না? যা সত্যি, তাই বলবি আঁটকুড়ি মাগিদের মুখের ওপর।

গিনি বাইরে এল আর একটা শূন্য কলসি নিয়ে। বলল, সত্যি বলব কাদের কাছে মাসি? সত্যি কথার ধার ধারছে কেউ?

–কেউ না ধারুক, তুই তো ধারবি।

আপাত একটা যুক্তি থাকলেও, গিনি ঠিক ভাবে নিতে পারল না। এ বিষয় নিয়ে বাইরে কথা বলতে যে তার কোথায় বাধছে, তা সে ব্যাখ্যা করতে পারল না ভামিনীকে। কিন্তু বাধছে। বাইরের ও সব আলোচনা সে কেবলই এড়িয়ে যেতে চায়। যেন পালিয়ে আসে। এ রকমটা ঠিক গিনির মতো নয়। সে যে ঠিক তেজ ও দৰ্পের সঙ্গে, নীরব অবহেলায় সবাইকে এড়িয়ে যাচ্ছে, তা নয়। কেমন একটা ভয়ের ছায়া তার মুখে।

গিনি প্রতিবাদ করল না ভামিনীর কথার। কলসি নিয়ে আবার বাইরে চলে গেল। ভামিনী ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। মনের মধ্যে একটা সুদূর সন্দেহের ছায়া ঘনিয়ে আসতে চাইল। কিন্তু ভামিনীর অভিজ্ঞ চোখ ও মন সে সন্দেহকে ঘেঁসতে দিতে চাইল না। তবু একটা কাঁটা যেন খচখচ করতে লাগল কোথায়। তার সন্দেহ সত্যি হোক, এককালে সে তাই চেয়েছিল। আজও চায়। মিথ্যে দুর্নাম সে অভয়ের নামে সইবে কেমন করে।

অভয় এ সবের কিছুই জানল না। গিনির সম্পর্কে সে বিশেষ করে কোনওদিনই কিছু ভারেনি। ভাবেনি, তার কারণ গিনিকে সে সংসারের একটি স্বাভাবিক অঙ্গ হিসেবে জেনেছে। গিনি শুধু গিনি-ই। ভামিনী আর সুরীন চলে যাবার পর, প্রত্যহের সাংসারিক কথাবার্তা কিছু বেড়েছে। গিনি যে তার সংসারে আছে, অভয়কে দেখলে সেটা বোঝা যায় না। সে-ই যেন গিনির সংসারে আছে। সুতরাং গিনি যেমন আছে, ঠিক তেমনি করেই গিনিকে মেনে নিয়েছে সে। মুচিপাড়া থেকে ফেরার পর গঙ্গাজলের ছিটার মতোই, অনেক নিয়ম, সংসার চালানোর বিধি এবং ছেলে মানুষ করার ব্যবস্থা, সবই মেনে নিয়েছে।

ইতিমধ্যে লক্ষ করে দেখল না, গিনি গম্ভীর হয়ে উঠেছে। কথার জবাব কম দিচ্ছে। অভয় বেশি কাছে এলে, গিনি চোরা চোখে বাইরে তাকাচ্ছে। সরে সরে যাচ্ছে।

কখনও যদি একটু বিশেষ ভাবে অভয়ের কিছু চোখে পড়ে, তবে হয়তো বলে, গিনি ঠাকরুনকে যে একটু ভার ভার দেখছি! কী হল?

গিনি বলে, কই, কিছু না তো।

অভয় নিশ্চিন্ত গলায় বলে, তাই বলো। আমি ভাবি কী জানি, তোমার আবার হল কী।

 বলে সে নিমেকে নিয়ে মাতে এবং সম্প্রতি এক উপসর্গ হয়েছে, অভয় রাত করে এসে ঘুমন্ত নিমেকে জাগিয়ে দেয়। একেবারে ঘুম কাটিয়ে দেয় ছেলেটার। ছেলেও তেমনি, ঘুমটুকু কাটতে যা দেরি। আরম্ভ করবে হুডযুদ্ধ, দাপাদাপি, হাসাহাসি, তা থই তা থই নাচ। বাপ ব্যাটা সমান।

ঠিক দু দিন গিনি হেসে হেসে দেখল।

অভয় বলে, হাঁরে নিমে, কুরুক্ষেত্তরের লড়াইটা হয়ে কী হল বল দিকিনি।

নিমে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, হি।

–হি কী রে ব্যাটা?

নিমে এক মুহূর্ত বাপের দিকে তাকিয়ে, নতুন দাঁত দিয়ে মাড়ি চিবোয়। তারপর বলে ওঠে, বাতা।

অর্থাৎ ব্যাটা। অভয় বলে, দূর ব্যাটা, তুই কিছু জানিস না। হল না কিছুই। কিন্তু কলকাতায় যে লোকশিল্প না কি হবে, দেখিস, সেখানে কবিওয়ালা ঠিক ওই মহাভারত গাইবে। ও আর আমার ভাল লাগে না।

নিমে অমনি খিলখিল করে হেসে ওঠে।

–হাসছিস কী রে?

নিমে বলে হাত তুলে, গিঁঈ।

নিমের অঙ্গুলি সংকেত লক্ষ করে, অন্ধকারের ছায়ার মতো গিনিকে দেখতে পায় অভয়। কিন্তু মনোযোগ দেয় না। গান ধরে দেয়,

হুকুমে নৌকো চলে ডাঙ্গায়,
দেখি নতুন ভারতে।
বাজারে মাল বিকোয় দামে।
মানুষ পচে আড়তে।
 নতুন ব্যাসদেব লিখে যাবেন
নতুন মহাভারতে।

 গাইতে গাইতে অভয় নাচে। নিমেও তার অশক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে নাচবার চেষ্টা করে। আর খ্যালখ্যাল করে হাসে।

গিনি হাসি চাপতে পারে না। বলে, বাঃ বাঃ! বাপ ব্যাটা সমান।

 অভয় বলে, গিনি তুমিও নেমে পড়ো আসরে।

গিনি বলে, তা হলেই ষোলো কলা পূর্ণ হয়।

অনেকক্ষণ ধরে এই নাচ গানের পালা চলতে থাকে। এও অভয়ের এক রকম নতুন গানেরই মহড়া। তারপর বাবার সঙ্গে নিমের আর এক প্রস্থ খাওয়ার পালা। গিনির তাতে আপত্তি। এ রকম অনিয়মে নাকি অসুখ করে। কথাটা গম্ভীর ভাবে গিনি বললে, অভয়কে ছেলের হয়ে একটু খোশামোদ করতে হয় গিনিকে।

কিন্তু তৃতীয় দিন গিনি প্রস্তুত হয়ে রইল। নিমেকে এসে জাগাবার আগেই সে বাধা দিল। গঙ্গা জলের ছিটা দিয়ে বলল, থাক, ওকে আর জাগিয়ো না অভয়দা। রোজ রোজ রাত দুপুর পর্যন্ত লোকে কী বলবে? আর ছেলেটার শরীর খারাপ হবে না?

অভয় বলল, অ।

ঠিক রাগ নয়, বিরক্তিও নয়, অভয় যেন শূন্য মন নিয়ে বসে রইল। গিনির কথাগুলি তাকে মেনে নিতে হল। সে জিজ্ঞেস করল, খুড়ি চলে গেছে?

দূর অন্ধকার থেকে প্রায় অস্ফুট জবাব এল, হ্যাঁ।

রান্না হয়ে গেছে?

 জবাব এল না। অভয়ও আর জিজ্ঞেস করল না। তাকিয়ে দেখল না, গিনি কোথায় আছে। গিনি আছে কোথাও তার নিজের কাজে, এই তার ধারণা। সে চুপ করে বসে রইল দাওয়ায়। সে চুপ করে বসে রইল, কিন্তু তার ভিতরটা চুপ করে নেই। এ অন্ধকার নিস্তব্ধতা যেন তাকে যন্ত্রণা। দিচ্ছে। তাকে অস্থির করছে। তার দেহ ও মন, কিছু একটা করবার জন্যে যেন তাকে ধাক্কা দিচ্ছে। এই নিঃশব্দ রাত্রি ও সম্পূর্ণ আকাশ তাকে গ্রাস করে একটা শান্তির পারে নিয়ে যেতে পারছে না। একটা ঘর, একটি অস্বাভাবিক কান্না, মত্ত হাসি ও গান, বাঁধভাঙা উচ্ছঙ্খল একটি দেহ তার চোখের সামনে ভাসতে লাগল।

বহুকাল আগে শোনা একটি গানের কলি তার কানে বেজে উঠল।

আমি প্রেম-নৌকা ভাসায়েছি প্রেমের সাগরে
নীল জলে দেখি ঝিলিক মারে কাম-হাঙরে।

তারপর নিজের গলায় গুনগুনিয়ে উঠতে গিয়ে সে হঠাৎ চুপ করে গেল। কেমন একটা সঙ্কোচে তাড়াতাড়ি তাকিয়ে দেখল চারদিকে। ডেকে উঠল, গিনি, ও গিনি।

সাড়া পেল না। অভয় উঠোনে এসে দাঁড়াল। রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে ডাকল, ও গিনি, গিনি!

ডাকতে ডাকতে অভয় বাড়ির সীমানা চিতে বেড়ার কাছে চলে গেল। আগল বন্ধ দেখে, ফিরে, আবার ডাকবার উপক্রম করতেই, গিনির ভারী ও চাপা গলা শোনা গেল, চেঁচিয়ো না। কী বলছ!

অভয় বলল, বলব আর কি। চুপচাপ বসে আছি। ভাবলাম কোথায় গেলে আবার।

সে গিনির কাছে এসে দাঁড়াল। গিনি তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে, ঘরের দিকে এক পা এগিয়ে বলল, নিমেকে তুলে দেব?

–কেন? থাক না। এই তো বললে, পাড়ার লোকে ভাববে, ছেলেটার শরীর খারাপ করবে।

অভয় গিনির কাছে এগিয়ে গেল। বলল, তার চেয়ে বসো, তোমর সঙ্গেই কথা বলি। হ্যাঁ, দেখো, দোকানে ধারের কারবার বড্ড বেশি চলছে দেখছি। কী করা যায় বলো তো।

এবার গিনি ফিরে তাকাল। তার গলাও এবার হালকা হয়ে এসেছে। বলল, হাত মুখ ধুয়ে এসো। অনেক রাত হয়েছে। খেতে খেতে কথা হবে।

এবারে গিনির গাম্ভীর্য ধরা পড়ল অভয়ের কাছে। বলল, একা চুপচাপ থাকতে তোমার বড় কষ্ট হয়, না?

গিনির বুকের মধ্যে দুরু দুরু করে উঠল। বলল, মোটেই না। চুপচাপ বসে থাকতে আমার ভালই লাগে।

–অ। আমার আবার দম বন্ধ হয়ে আসে।

বলতে বলতে সে গামছা নিয়ে পুকুর ঘাটে চলে গেল। ফিরে এসে রান্নাঘরের লক্ষর আলোয় খেতে বসে, হঠাৎ বলল, শুনলাম, রাজুমাসির বাড়ির ওই মেয়েটা, কী যেন নাম?

গিনি বলল, সুবালা।

-হ্যাঁ হ্যাঁ সুবালা। মেয়েলোকটি নাকি পাগল হয়ে গেছে।

গিনি চোখ নামিয়ে বলল, শুনেছি।

অভয় বলল, মানুষ যে কী চায়, তা সে নিজেই জানে না।

গিনি নিশ্চুপ। কিন্তু অভয়ের চোখ সরল না গিনির ওপর থেকে। এদিকে বসে থাকা দায় হল গিনির। তার বুকের মধ্যে কেমন করছে।

অভয় হঠাৎ বলল, গিনি, তোমাকে আর ছোট মেয়েটি মনে হয় না। বেশ বড়সড় লাগছে।

 গিনি হাসবার চেষ্টা করে, গোছানো আঁচল আরও গোছাল।

অভয় মুখে ভাত তুলে বলল, এবার তোমার একটা বের দরকার, খুড়িকে আমি বলব। গিনি তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেল। অভয় বলল, কী হল? বাইরে থেকে জবাব এল, আসছি। অভয় অবাক হল। তারপর ভাবল, গিনি লজ্জা পেয়েছে।

.

০৯.

পরদিনই, ভামিনীর খচখচানি ও গিনির দুর্বোধ্য ভয়ের মুখে একটা প্রচণ্ড আঘাত করে ফিরল অভয়।

মুচিপাড়া থেকে রাত্রে বাড়ি ফিরছিল সে। পথেই পড়ে মালিপাড়ার যাত্রার আখড়া ঘর। প্রায়ই সেখানে জটলা চলে। পথ চলতি অভয়ের ডাক পড়ে প্রায়ই! দাঁড়িয়ে দু চার কথা বলে।

এই দিনও দাঁড়িয়ে দু এক কথা বলে তাড়াতাড়ি ফিরছিল অভয়। বিশু কোনওদিনই তার সঙ্গে ভাল করে কথা বলে না। নিমিকে বিয়ে করা নাকি তার অপরাধ হয়েছিল। বিশুর বিশ্বাস, নিমির ওপরে অধিকার নাকি ওরই ছিল। শুনেছে, নিমির সঙ্গে নাকি আইবুড়ো বেলায় ওর ভাব ভালবাসা ছিল। মনে করতে বুকের মধ্যে টাটায়। তাই ও-জায়গাটা পারতপক্ষে অভয় কোনওদিন ঘাঁটায় নি।

বিশু হঠাৎ বলে উঠল, আর তর সয় না দেখছি।

অভয় বলল, হ্যাঁ, আর দেরি করব না।

অন্ধকারে বিশুর জ্বলন্ত চোখ, নেকড়ের মতো ঝলসানো দাঁতের হাসি দেখতে পেল না সে। বিশু বলল, তা তো করবেই না। ঘরে অমন একখানি ডাঁসা ফল থাকলে

অভয় দাঁড়িয়ে পড়ল। –কী বললে?

 কে একজন বলে উঠল, এই বিশে, কাকে কী বলছিস? মাথা খারাপ নাকি?

কিন্তু বিশু নিজেকে সামলাতে পারল না। বলল, আমি ও সব মান-জ্ঞান বুঝি না বাপু। যা সত্যি, তাই বলছি।

অভয় দু পা এগিয়ে বলল, সত্যিটা কী, তা তো বুঝলাম না।

যদিও বুঝতে সত্যি বাকি ছিল না এবং বুকের আগুন এক মুহূর্তেই লেলিহান হয়ে মাথায় উঠেছে।

বিশু বলল, তোমার কপালটার কথা বলছিলাম। বেড়ে আছ। লোকে মিছে চেঁচিয়ে মরছে। তোমার কানে তুলল, পিঠে কুলো। দিব্যি লুটছ।

বিশু হেসে উঠল। কে যেন কী বলে বিশুকে বাধা দিতে চাইল। অভয়ের গলার স্বর ছুরির ফলার মতো বিধল, কী লুটছি?

বিশুর হিংস্রতা আর হাসির আবরণ রাখতে পারল না। ফুঁসে উঠল, কী আবার! বেওয়ারিশ আইবুড়ো হুঁড়ি।

কথাটা শেষ হবার আগেই, অভয়ের প্রকাণ্ড থাবাটা সপাটে গিয়ে পড়ল বিশুর গালে। বিশু গোটা মালিপাড়া জাগিয়ে চিৎকার করে উঠল, ওরে শালা, আবার গায়ে হাত! পাড়ার বসে তুই আইবুড়ো ঘুড়ি নিয়ে ঘর করবি, আবার

বিশু কথা শেষ করবার আগেই আক্রমণে উদ্যত হল। কিছু বিদ্রূপ করে, টিটকারি দিয়ে বহুকাল থেকে সে অভয়কে ধৈর্যের পরীক্ষা করেছিল এবং সার্থক হয়েছিল। অভয়কে যাত্রার আখড়া থেকে সরে পড়তে হয়েছিল। দৈহিক শক্তির পরীক্ষায় অগ্রসর হয়ে বিশু ভুল করল। যে হাত সে বাড়িয়েছিল, সেই হাতই মুচড়ে ধরে, অভয় অন্ধের মতো আঘাত করতে লাগল। চাপা গলায় গর্জে উঠল, অনেক দিন তোমার ওই মেয়ে-ন্যাকড়া ন্যাকা-ন্যাকা ইয়ার্কি শুনেছি। মনে করেছ, চিরদিন পার পেয়ে যাবে। লোচ্চা! তোর জিভ উপড়ে ফেলব আজ।

বলে সে সত্যি সত্যি সাঁড়াশির মতো হাত দিয়ে বিশুর গাল চেপে ধরল। প্রথমটা সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। এবার একযোগে সকলেই চিৎকার করে উঠল, জামাই ছেড়ে দাও জামাই, ছেড়ে দাও।

কয়েকজন তাকে ধরে ফেলল। ইতিমধ্যে হাতে হাতে বাতি নিয়ে, মেয়েরাও বেরিয়ে এল। বিশু তখনও সমানে চেঁচিয়ে চলেছে, কেন বলব না। যা সত্যি, তাই বলছি। আরও বলব। তোকে। বলতে হবে, গিনির সঙ্গে তোর কীসের সম্পর্ক? কে কবে এমনটা দেখেছে? আমি এখুনি পুলিশে যাব। তোমরা সবাই সাক্ষী ও আমাকে খুন করতে চেয়েছিল।

কথা উচ্চারণ হচ্ছে না বিশুর। প্রায় অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থা তার। ঠোঁটের কশ রক্তে ভেসে গেছে।

অভয় বলল, তাই যা, পুলিশের কাছেই যা। বলিস, তোকে খুন করে ফাঁসি গেলেও ক্ষতি নেই। তবু মালিপাড়ার একটা পাঁঠা বলি যাবে।

মেয়েরা হাঁকডাক শুরু করেছিল। জল আন, ন্যাকড়া আন। কিন্তু বিশুর বউয়ের নিঃশব্দ কান্নাটা হঠাৎ চোখে পড়ে অভয় থতিয়ে গেল। নিমির সে একদা বন্ধু ছিল। অভয়ের সঙ্গেও তার বড় ভাব।

বাকি মেয়েরা সবাই যেন যম দেখার মতো দেখছিল অভয়কে। তারা সর্বনাশ সর্বনাশ করে চিৎকার করছিল, কিন্তু অভয়কে কিছু বলতে পারছিল না। পুরুষদের মধ্যে কয়েকজন অভয়কে ঠেলে দিল। যাও যাও, জামাই তুমি বাড়ি যাও। ফয়সালা যা হয়, পরে হবে।

অভয় ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, কাল কেন, আজই হোক না। যদি অপরাধ করে থাকি, দশজনে মিলে আমাকে জুতো মারো। ওর কথা যদি সত্যি বলে মানো দশজনে মিলে আমাকে মারো। দশ জনের চেয়ে বেশি জোর নেই তো আমার।

কেউ কোনও কথা বলতে পারল না। সত্যের একটা শক্তি যেন কোথায় আছে। একজন বলল, তুমি বাড়ি যাও জামাই। তোমাকে কি আমরা চিনি না? তবে, বিশের মারটা একটু বেশি হয়ে। গেছে।

অভয়ের আবার চোখ পড়ল বিশুর ওপর। বউ আঁচল দিয়ে কশের রক্ত মোছাতে যাচ্ছিল। বিশু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল,হাত। আবার চিৎকার করে উঠল, কিন্তু তোকে ছাড়ব না।

একজন বলে উঠল, এই বিশে, থাম।

অভয়ের মনটা হঠাৎ যেন কেমন অবশ হয়ে এল। সে বাড়ির পথ ধরল। তখনও অনেকে আসছে ঘটনাস্থলে। সে অদূরেই দেখতে পেল, দু জন দুটি বাতি হাতে ফিরে যাচ্ছে। আর একজন তাদের সঙ্গে। সুরীন, ভামিনী আর গিনি। চিনতে পারল অভয়। বাড়ি ঢুকতে তার ইচ্ছে করছিল না। তবু, বাড়ি ফিরেই এল।

বাড়ি যেমন নিস্তব্ধ থাকে, তেমনি আছে। সুরীন আর ভামিনী উঠোনে দাঁড়িয়ে রয়েছে চুপচাপ। দাওয়ার ওপরে বাতি। নিমে নিদ্রিত। গিনি এই দৃশ্যপটের কোথাও নেই।

ভামিনী বলল, বড্ড বেশি মেরেছ নাকি?

অভয় দাওয়ায় বসে বলল, ওর আবার মার। মারে কিছু হয় না ওর। দেখগে, এখনও তড়পাচ্ছে।

সুরীন বলল, আবার একটা পুলিশ টুলিশের হাঙ্গামা

ভামিনী বাধা দিয়ে বলে উঠল, তুমি রাখো দিকিনি। হাঙ্গামা হয় হবে। ওদের অত বাড়াবাড়িই বা কীসের? কী বাড়ানোটাই বাড়িয়েছে কিছুদিন ধরে।

বোঝা গেল, ভামিনী খুশি হয়েছে। সে চাইছিল এমনি একটা কিছু। শোধ না নিলে তার শান্তি হচ্ছিল না।

সুরীন বলল, এই দেখ, মেয়েমানুষের বুদ্ধি দেখ। এখন একটা গোলমাল যে চলবে—

চলুক। গোলমাল কি চলছিল না?

অভয় বলল, আর এখন ভেবে কি হবে খুড়ো। সামলাতে যখন পারিনিকো, তখন যা হয় তা হবে।

–তা বটে। তবে

শান্তিপ্রিয় মানুষ সুরীনের অস্বস্তি গেল না। বলল, আচ্ছা, নাও, খেয়ে দেয়ে এখন শুয়ে পড়ো। কাল দেখা যাবে, কী হয়।

ভামিনী বলল, হবে ছাই। অত যদি ওদের চুলবুলোনি, রাতে এসে আড়ি পেতে দেখে গেলেই পারে? মুরোদ বড় মান।

বলে সে হ্যারিকেন তুলে নিল। বলল, কই লো গিনি, নে ভাত টাত দে অভয়কে। চলো যাই।

সুরীনকে নিয়ে সে চলে গেল। অভয় বসে রইল তবু। কেমন একটা চিন্তাশূন্য অবশ অবস্থা তার। মাঝে মাঝে খালি মনে পড়ছে পরশু তার কলকাতার লোকশিল্প সম্মেলনে যেতে হবে, কিন্তু গানগুলি তার মনে পড়ছে না।

এক সময়ে ঝিঁঝির ডাক তীব্র হয়ে উঠল। কোন একটা গাছে, পাখা ঝাপটা দিল পাখি। মুক্ত আগলটা বাতাসে কাচ কাচ করে উঠল।

অভয়ের সংবিৎ ফিরল। চারদিক স্তব্ধ। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে উঠে গিয়ে অর্গল বন্ধ করল। ফিরে এসে ঘুমন্ত নিমের দিকে তাকাল। তারপর বাতি নিয়ে ঘরে গেল। ঘর শূন্য। উঠোনের চারদিক দেখে, রান্নাঘরে উঁকি দিল। গিনিকে চোখে পড়ল না। রান্নাঘরের পিছনে গেল। পুকুরধারে খুঁজল। গিনি নেই কোনওখানে!

অভয় এবার না ডেকে পারল না, গিনি।

কোথা থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ এল, উ?

–কোথায়?

জবাব নেই। আবার ডাকল, গিনি।

–ঊ।

 অভয় রান্নাঘরে গেল। গিনি রান্নাঘরেই ছিল। অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়েছিল জড়োসড়ো হয়ে। ময়লা আঁচল মাটিতে লুটানো। কোনও কারণেই গিনির চুলবাঁধা বন্ধ থাকে না। আজ ওর সেই পরিপাটি খোঁপা অবিন্যস্ত। লক্ষ করলে অভয় দেখত, কিছুদিন ধরেই এমনি যাচ্ছে। বিস্রস্ত জামাটার জন্য, তার ঘাড় ও পিঠের অনেকখানি মুক্ত।

অভয় বলল, এখানে কী করছ?

 ভেজা গলায় বলল গিনি, এই যাচ্ছি।

 সে আঁচল তুলে, মুখ মুছতে লাগল।

অভয় বলল, এসব ঘোলানি বুঝি অনেকদিন থেকেই চলছে?

 মুখ না ফিরিয়েই জবাব দিল গিনি, ওই বিশু আমাকে দু বেলা বলে।

–এতদিন আমাকে বলোনি কেন?

 গিনি চুপচাপ।

–কেন বলোনি? গিনি ওর ভেজা লাল ভীরু চোখ দুটি তুলল। এই ভয় ও করেছিল। সেই দুর্বোধ্য ভয়। বলল, ভয়ে।

অভয় জিজ্ঞেস করল, কীসের ভয়?

আমি জানলে কী হবে?

সংশয়াতুর চোখে অভয়কে দেখল গিনি। তার চোখে জল এসে পড়ল। বলল, তোমার মিথ্যে দুনাম। এবার তুমি কী করবে?

কী করবে অভয়? সে হঠাৎ কোনও জবাব দিতে পারল না।

গিনি রুদ্ধ গলায় বলল আমাকে বিদায় করে দেবে, না?

করুণ আর অসহায় মেয়েটার কথা শুনে অভয়ের বুকের মধ্যে মোচড় লাগল। তার মনে পড়ল বিশুর কথা, তোকে বলতে হবে গিনির সঙ্গে তোর কীসের সম্পর্ক। সে বলল, গিনি, লোকে। লোকের সঙ্গে একটা সম্পর্ক না দেখলে খুশি হয় না। তোমার সঙ্গে আমার কীসের সম্পর্ক?

প্রশ্ন শুনে গিনির শেষ আশাটুকু যেন চূর্ণ হয়ে গেল। কষ্টে কান্না দমন করে বলল, আমি একটা দুঃখী মেয়ে, তোমার আশ্রয়ে আছি। সম্পর্কের কথা তো আমি কিছু জানি না।

অভয় সহসা কথা বলতে পারল না। তার বিশাল বুকের মধ্যে সব কথা একটা ব্যথায় থমকে রইল। খানিকক্ষণ তার নিশ্বাস পর্যন্ত পড়ল না। আজ তার বিস্ময়েরও অবধি রইল না। গিনি এ সংসারের অঙ্গ হিসেবে রাঁধে বাড়ে খেতে দেয়। চোপা করে, শাসন করে এবং তার মধ্যে কোনও জটিলতা কিংবা কীটের কামড় ছিল না। ওর বয়সের সঙ্গে সেটা একরকমের উপভোগ্য ব্যাপার বলেই মনে হত। কিন্তু আজকের গিনি ও তার কথা আর এক দিগন্ত মেলে ধরল।

যেন অনেক ভিতর থেকে আস্তে আস্তে বলল অভয়, এর ওপরে তো আর কোনও কথা নেই গিনি। তুমি দুঃখী কি সুখী জানি না। তবু আমার এই নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সংসার যদি তোমাকে রক্ষা করে, সেটাই আমাদের সম্পর্ক। কী বলো?

গিনি সহসা হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। নির্ভয়! নির্ভয় সে! সে যে তার সব থেকে বড় আশ্রয়ের সবার বড় অভয়বাণী শুনল।

অভয় গিনির মাথায় হাত দিল। পিঠে হাত রাখল।–কী হল গিনি।

 কান্নায় কথা শোনা গেল না। গিনি শুধু মাথা নাড়তে লাগল। কিছু নয়।

অভয় বলল, কেঁদো না গিনি।

 বলে গিনিকে টেনে তুলে দাঁড় করাল। আর সহসা হাত সরিয়ে নিয়ে, অভয় বলল গিনি। হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ব।

গিনি কান্নার মধ্যেই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। বলল, কেন, খাবে না কেন?

–ভাল লাগছে না। বিশুকে বড় মেরেছি। বিশুর বউ কাঁদছিল। আমার কিছু ভাল লাগছে না। তুমি খাও। আমি নিমেকে নিয়ে শুচ্ছি।

গিনি জোর করতে পারল না। কিন্তু বিশুর ব্যাপারে অভয়ের মন খারাপ ছিল ঠিকই। তবু মনের অন্ধকার ঝাঁপিতে যেন কিছু একটা নড়ে উঠতে দেখে অভয় ভয় পেয়েছে।

.

১০.

পশ্চিমবঙ্গ লোকশিল্প সম্মেলনের চতুর্থ দিনের অনুষ্ঠান। কবি-গানের আসর আজ। মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভয়ের বুকের মধ্যে থর থর করে কাঁপতে লাগল। প্রথমে অবিশ্বাস্য মনে হল। কলকাতা। শহরের হাজার হাজার নরনারী এসেছেন কবিগান শুনতে। তাও কি হয়!

তাই হয়েছে। চারদিকে নানান আলোকমালার মধ্যে শহরের চকচকে বিশাল জনতা। এই এক বিস্ময়। আর এক বিস্ময় বিজয়হরি পাল। সারা বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি-গায়ক। তিনি এসেছেন আজ গাইতে। জন্মের পর থেকে বিজয়হরি পালের নাম শুনেছে অভয়। বৃদ্ধ, সৌম্য, সাদা সাদা দাড়িতে ঢাকা মুখ। যেন কোন সাধক। এই মানুষের ছবিও দেখেছে অভয়। বিজয়হরির গানের ছাপা বই আছে।

আলাপ হওয়া মাত্র পায়ে পড়ে প্রণাম করল অভয়। বিজয়হরি বুকে জড়িয়ে ধরলেন। নাম জিজ্ঞেস করলেন। দূর রাঢ়ের ভাষায় বললেন, আই গ বাবা, আসা মাত্তর তোমার নাম শুনেছি। শুনলাম, খুব নাম করেছ।

অভয় বলল, না না।

–না কেন হ্যাঁ বলো। বড় খুশি হলাম বাবা। আজ তো তোমার আমার গান।

সেই এক দুশ্চিন্তা অভয়ের। শুধু গান নয়, সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের মনোগত ইচ্ছে যেন, লড়াইয়ের ভঙ্গিতে গান হয়। তেমন সাহস কোথায় অভয়ের যে, বিজয়হরি পালের সঙ্গে কথার লড়াই করবে।

তবুও অভয়ের বুকের তালে, ডুমডুম্ করে বেজে উঠল ঢোল কাসি! গলা শুকিয়ে উঠল অভয়ের। যদিও আগে বিজয়হরিরই পালা।

নির্ভয় কেবল হারু বায়েন। তার কোনও ভয় ডর নেই। মনে হল, কেটেকেটে যেন তবলা বাজাচ্ছে। বিজয়হরির বায়েনের গলায় গাদাখানেক মেডেল দেখে তার মেজাজ একটু খারাপ হয়েছে। তাই প্রথম চোটের প্রতিযোগিতার উত্তেজনাটা ওর মুখেই লেগেছে বেশি। বাজাচ্ছে, আবার অভয়কে ভু নাচিয়ে নাচিয়ে ইশারা করছে।

অভয়ের লজ্জা করল। বিজয়হরি বললেন, বাঃ হাতখানা বড় ভাল দেখছি বায়েনের।

হারু তাড়াতাড়ি হাত জোড় করে একবার নমস্কার করে নিল।

ঘোষণা এর আগেও হয়েছে। তাছাড়া ছাপানো ঘোষণাপত্রও ছিল। আবার শেষবার ঘোষিত হল গায়কদের নাম।

বিজয়হরি পাল উঠে দেবদেবী এবং গুরুবন্দনা করলেন, তারপরে গাইলেন।

পশ্চিমবঙ্গ লোকশিল্প সম্মেলন
আমারে করেছেন আনয়ন
সম্মেলনে বিজয়হরির ইহা চতুর্থ অয়ন
জানি না করিতে পারি কিনা মনোরঞ্জন।

তারপরে দেশ এবং পরিবারের দুর্দশার কথা গাইলেন একটু। বান বন্যা অভাব, সংসারে মৃত্যুশোক, নিজের জরার শোক। তার ওপরে,

বিনয়ে বিগলিত, রূপেতে কৃষ্ণকান্ত
নব্য কবি শ্রীমান অভয়।
বিনয়ে যত ভক্তি, দেখি তত শক্তি
তাহার কাছে মাগি নির্ভয়।

অভয় জোড় হস্তে মাথা নিচু করে বলল, ছি ছি ছি, আমি আপনার পায়ের ধুলোর যোগ্য নই।

কিন্তু যা ভেবেছিল অভয়, তাই হল। বিজয়হরি মহাভারত থেকে গাইলেন। অনেকের জন্মবৃত্তান্তই ওঁর জিজ্ঞাস্য। শেষবারে বললেন, এক কথায় মহাভারতের বাণী কী হবে?

অভয় দেবদেবী বন্দনা করল না। গুরু বন্দনা করল। বিজয়হরিকে বন্দনা করল। ভনিতা করল, কিছুই জানি না। জীবনে এত বড় পরীক্ষার সামনে দাঁড়াতে হবে ভাবিনি। কিন্তু,

যার বুক ভরা দুঃখ, পেট ভরা ক্ষুধা।
তার কি কোনও ভয় থাকে?
হারিয়ে যে সব হারা, শৃঙ্খল ছাড়া,
সাহসে বুক বাঁধতে হবে তাকে।

অতএব বিজয়হরি তাকে নির্ভয় দিল। সে জবাব দিচ্ছে। একে একে বিজয়হরির সব কথারই জবাব দিল সে। শেষ কথায় এসে গাইল, মহাভারতের একমাত্র বাণী, সত্যমেব জয়তে।

বিজয়হরি হাত তুলে সমর্থন করে বললেন, একেবারে যথার্থ গেয়েছ।

কিন্তু অভয় থামল না। সে গেয়ে চলল, সত্যের জয় হল। কিন্তু সেই আমাদের প্রথম জ্ঞাতি-বিবাদ মারামারির শুরু। চেয়ে দেখুন, শত বিধবা থান কাপড় পরে কাতারে দাঁড়িয়ে। ধৃতরাষ্ট্র বলেছেন, হে ব্রাহ্মণ, হে রাজন, এই শত বিধবাকে আপনারা ক্ষমা করুন। যুদ্ধ এদের সব নিয়েছে।

মহাভারতের শেষ লগ্নের শোক সন্তাপ ফুটে উঠল যেন অভয়ের গলায়। শ্রোতারা নিঃশব্দ। কলকাতাকেও নিপ মনে হল। বোঝা গেল রাত হয়েছে। অভয় নিজে প্রশ্ন আরম্ভ করল। পৃথিবীতে এই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধটা কোন ধর্মযুদ্ধ? শুনি ভীমরূপী জনতা অনেক দুঃশাসনের রক্ত পান করেছিল। কিন্তু আজ কী তার পরিণতি! কুরুক্ষেত্রের সঙ্গে ওর তফাত কী? কেন উৎপত্তি। এর। একমাত্র বাণী কী?

অনেকগুলি ক্যামেরা ফ্লাশ পর পর চমকে দিচ্ছিল অভয়কে। চারদিকে একটা চাপা গুলতানি। অভয়ের প্রতি সমর্থন সূচক উচ্ছ্বাস সেটা।

এবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম। বিজয়হরি গায়ে হাত দিয়ে প্রশংসা করলেন। বললেন, যথার্থ বলেছ। বড় ভাল ধরেছ।

ইতিমধ্যে এক প্রস্থ চা-বিস্কুট পরিবেশিত হল। মঞ্চের বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়ে অনেকে আলাপ করল অভয়ের সঙ্গে। কয়েকজন পর পর এসে, তার নাম ঠিকানা জন্মসাল ও স্থান, জীবিকা, তার গোটা জীবনটার কথা জেনে নিতে লাগল। টুকে নিল কাগজে।

অভয়ের মনে হল, তার জ্বর এসেছে। তার সর্বাঙ্গ, কান ঠোঁট পর্যন্ত দপ দপ করছে। তার কেমন যেন একটা ঘোর লাগছে। কলকাতার সে কিছু বোঝে না। চেনে না। কিন্তু কলকাতা তাকে একটা উত্তপ্ত অন্তরঙ্গ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, সে বুঝতে পারছে।

আর একজন এলেন। সঙ্গে তাঁর আরও কয়েকজন। ভদ্রলোকটিকে চিনতে পারল অভয়। উনি একজন নেতা। শ্রমিক নেতা। অনেকবার গিয়েছেন অভয়দের শহরে। বক্তৃতা দিয়েছেন। চটকল শ্রমিকদের সামনে। অনাথখুড়ো, গণেশবাবুরা যাকে দেবতার মতো দেখে, উনি সেই দিব্যেন্দু মিত্র। এসে হাত বাড়িয়ে অভয়ের হাত ধরলেন। বললেন, খুব ভাল করেছেন। সমস্ত জিনিসটার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। আর সেটা এমন পথে ঘুরিয়েছেন, দেশের লোকে যেটা ভাবছে।

তাঁর সঙ্গী কে একজন বলে উঠল, আপনার বক্তব্য শান্তি আন্দোলনের পথ বলে দিচ্ছে।

শান্তি আন্দোলন? কথাটা তার জানা। কিন্তু গানের সময় সে কথা তার মনে পড়েনি।

দিব্যেন্দু আবার জিজ্ঞেস করলেন, অনাথ, গণেশদের খবর ভাল?

অভয় বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ, খবর ভালই।

 দিব্যেন্দু বললেন, আপনার মতো কবি আছে ওদের হাতে, ওদের তো কোনও ভাবনাই নেই। ওখান থেকে শ্রমিকরা কলকাতায় এলেই আপনার কথা বলে।

অভয় বুঝল, উনি জানেন না, গণেশবাবুরা তাকে ত্যাগ করেছে। এমনকী অনাথখুড়োও। সাধারণ শ্রমিকরা তার নাম করে, কারণ তারা গান ভালবাসে। দলের বিচার করে না।

অথচ এখনও আসল পরীক্ষা বাকি। বিজয়হরি জবাব দেবেন, প্রশ্ন করবেন। শুরু হয়েছে। শেষরক্ষা বাকি। কিন্তু হারু বায়েন আর তার ভাই সম্মেলনের লোকদের অবাক করে দিয়ে, অনবরত চা সিগারেট খেয়ে চলেছে। ধমক দেবে, তেমন উপায় নেই অভয়ের।

আবার ঢোলক বাজল। কিন্তু আশ্চর্য ঘোর লেগেছে অভয়ের। সে নিজেকে বলছে, থাম অভয়, থাম। ভেতরটাকে চুপ করা। তোর আসল কথা ভাব, তোকে আজ অনেক কথা বলতে হবে। ঠিক মতো বলতে হবে!

রাত তিনটেয় কবি গানের আসর ভাঙল এবং জয়মাল্য শেষ পর্যন্ত অভয়ের গলায় এল। কিন্তু বিজয়হরির মুখের দিকে তাকিয়ে তার বুকে কোথাও ছায়ার সঞ্চার হল না। কারণ শেষ জয়টা তাঁরই ছিল। আসর শেষ করলেন তিনি। হেসে হেসে নেচে নেচে, অভয়ের প্রশস্তি গাইলেন কেবল। তাঁর নিজের গলার রুপোর মেডেলের হার পরিয়ে দিলেন অভয়ের গলায়।

সব যুদ্ধেরই কারণ এক। লোভ এবং মাৎসর্য। ব্যক্তির সুখের লালসা-ই যুদ্ধ টেনে আনে। কুরুক্ষেত্র থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত, পৃথিবীর সকল যুদ্ধ মানুষকে একই জায়গায় উপস্থিত করে। সুখকে মানুষ নিরন্তর করতে চেয়েছে, তাই বাসনা তাকে অসম্ভবের পথে ঠেলে দিয়ে উন্মত্ত করেছে। দুঃখ যে তার জীবনের আর এক সঙ্গী, এই সহজ সত্যকে ভয়ে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। তার সঙ্গে সহজ ভাবে, হাত মিলিয়ে, তাকে স্বীকার করতে পারে নি। সুখ দুঃখ মিলিয়ে যে মানুষের সহজ প্রসন্নতা, তার সাধনা চাই। অশান্ত প্রাণ শান্ত হোক, শান্ত হোক। লোভ হোক নিঃশেষ। লালসা লোলুপতা তোক নিশ্চিহ্ন।

মোটামুটি এই ভাবেই ব্যাখ্যা করেছিল অভয়।

 বিজয়হরি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধারাবাহিক নৃশংস কিছু চিত্রোপহার দিয়েছিলেন দর্শককে। অভয়ের বয়সী কবিয়াল যে শুধু সুখ দুঃখের কথা দিয়ে, এত বড় যুদ্ধটাকে ব্যাখ্যা করবে, ভাবেননি। বয়সের তুলনায় গভীর মনে হল তাঁর অভয়কে।

হারু বায়েন বলল, কিন্তু, অ জামাই, তুমি তো বাপু আমাদের বাড়িতে আজকের গানগুলান গাওনি এত দিন?

সত্যি তাই। এতদিন সে অন্য সব গান ভেবে রেখেছিল। বেঁধে রেখেছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সব অদল বদল হয়ে গেল। বিজয়হরির কুরুক্ষেত্র ও সত্যমেব জয়তে গানের মোড় দিয়েছিল ঘুরিয়ে। মহাভারত শুনলেই বর্তমান কালকে টেনে আনার পথ খোঁজে অভয়।

একটা আশ্চর্য ঘোর লেগেছে অভয়ের। এটা কীসের ঘোর সে জানে না। তার ভিতরে যেন একটা আগুনের শিখা দপদপ করে জ্বলছে এবং তারই সঙ্গে একটা শূন্যতা, একটা ব্যথা কোথায় চেপে বসছে। একবার মনে হল, নিমেটাকে নিয়ে এলে হত। একবারটি তাকে বুকে নিয়ে বসতাম।

উদ্যোক্তারা তাদের খাবার ব্যবস্থা করল, শোবার ব্যবস্থা করল, এবং তার পরদিনও বিশেষ নিমন্ত্রণ করল সম্মেলনে থাকবার জন্যে। পরদিন বাউল আর কীর্তন গানের আসর হবে।

অভয়ের আগে, হারু বায়েন বলে উঠল—তা থাকব না কেন। আপনারা নেমন্তন্ন করছেন। সারাদিন কলকেতাটিও একটু ঘুরে ফিরে দেখা হবে, কী বলো জামাই।

কথাটা মন্দ বলে নি হারু। তবে, কেমন যেন লোভীর মতো বলছে।

উদ্যোক্তারা বললে, বেশ তো, আমরাই চেষ্টা করব, আপনাদের কলকাতাটা ঘুরিয়ে দেখাতে।

হারু একেবারে আহ্লাদে আটখানা।

 বিজয়হরি পাশে নিয়ে শুলেন অভয়কে। শুনলেন তার জীবনবৃত্তান্ত। নিমন্ত্রণ করলেন তাঁর দেশ ইলামবাজারে। অনেক আলোচনার পর বললেন, তুমি অনেক লেখাপড়া করেছ বাবা।

অভয় একেবারে এতটুকু হয়ে গেল। বলল, বিশ্বাস করুন, লেখাপড়া কিছুই জানি না। পড়তে ইচ্ছা করে। সব বুঝি না।

–কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হয়, লেখাপড়া করেছ। যদি না করে থাকে, তা হলে বলব, চেষ্টা করবে। তোমার দরকার। এখন লেখাপড়া না শিখলে আর কিছু হবে না। রোজ খবরের কাগজ পড়বে। বড় বড় মানুষদের বই পড়বে।

তখন ভোর হয়ে এসেছে। কলকাতার গাড়ি ঘোড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে ইতিমধ্যেই। অভয়ের মনে হল, সে দৈববাণী শুনছে। বলল, পড়ব–নিশ্চয় পড়ব। এমন করে আর কেউ আমাকে বলেনি।

.

পরদিন সত্যি সত্যি উদ্যোক্তারা একটি বড় গাড়ির ব্যবস্থা করল। বিজয়হরি এবং অভয় উভয়ের দলকেই তারা কলকাতার অনেক জায়গা ঘুরিয়ে দেখাল। দুর্গ, বিধানসভা, যাদুঘর, চিড়িয়াখানা, ন্যাশনাল লাইব্রেরি।

হারু বায়েন একটা তেজি বাছুরের মতো লাফালাফি করল সারাটা দিন। একবার সামলাতে না পেরে, অভয়ের কানে কানে বলেছিল–গাড়ি চড়া, কলকেতা দেখা সবই হল, দু ভাঁড় মাল হলেই ষোলো কলা পূর্ণ হত, কী বলল জামাই, অ্যাঁ?

জামাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আর কথাটার পুনরুক্তি সম্ভব হয়নি হারুর। রাত্রে দর্শকদের আসনে বসে বাউল আর কীর্তন গান শুনল অভয়রা। তার যে একটা বিশেষ ঘোর লেগেছিল, বাউল আর কীর্তন গান তাকে আরও বাড়িয়ে দিল। কীর্তনের অনুরাগগীতি আর বাউলদের আনন্দদায়ক উদাসীনতা তার ভিতরের যেন একটা রহস্যময়তার সৃষ্টি করল। এই দুর্বোধ মন্ত্রের গুণে সে যেন আচ্ছন্ন।

পরদিন সকালবেলা, উদ্যোক্তারা অভয়ের হাতে এনে দিল খবরের কাগজ। সেদিন শুক্রবার। প্রায় সমস্ত পত্রিকাতেই, বিশেষ একটি পাতায়, অভয়ের ছবি বেরিয়েছে। অভয় নাচছে হাত তুলে, গান করছে। কেউ লিখেছে, কবি-গায়ক অভয়দাসের যুদ্ধ ও শান্তির পালা। সমাজ-সচেতন কবিগায়ক অভয় দাস। ইংরেজি কাগজগুলি সে পড়তে পারল না।

উদ্যোক্তারা আজও তাকে নিমন্ত্রণ করল। আজ রাঢ়ের ঝুমুর, পূর্ববঙ্গের জারি ও সারি। অভয় রাজি হল। তবে, হাওড়া থেকে রাত্রের লাস্ট ট্রেনটা ধরতে হবে। সেই রকমই ব্যবস্থা হল।

হারু বায়েন চুপিচুপি বলল, জামাই তোমার কল্যাণে মাইরি অনেক কিছু দেখা হল। দাও, খবরের কাগজগুলান দাও দিকিনি, ঝোলায় ভরি। বাড়িতে বেড়ায় এঁটে রাখব।

এবার অভয়ের একলা হবার প্রয়োজন হল। হারু বায়েন, লোকজন, সকলের কাছ থেকে আলাদা। হতে ইচ্ছে করল তার। কেন তার এ ইচ্ছা হল, সে জানে না। যেন মনে হল, সে একটু একলা। থাকতে চায়।

এক সময়ে একলা পথে বেরিয়ে পড়ল। কলকাতার বিশাল জনতার মাঝখানে, তার একাকীত্বে কোনও বাধা পড়ল না। প্রথমেই মনে পড়ল–তার নিমির কথা। আজ নিমি থাকলে কি অভয় সকলের আগে তার কাছে যেত? তাকে বুকে নিত? সত্যি যে বুকের মধ্যে একটা ঢেউ দুলছে। তাকে শান্ত করতে পারছে না অভয়। তার শূন্যতা যে ঘুচছে না। একজন অন্তরঙ্গ যে কাউকে চাই। সকলের কাছ থেকে পাওয়া সব প্রাপ্য নিয়ে একজনের কাছে সঁপে না দিলে যে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। সে যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খান খান হতে চাইছে।

কে আছে? কার কাছে যাবে অভয়?

এ মীমাংসা তার জীবনে বোধহয় আর সম্ভব নয়। কারণ সঁপে দেবার কথা ভাবলেই, তার ভিতর থেকে আর একটা বোধ তাকে ভয়ের বেশে তাড়া করে আসে। তাকে দুর্বল করে তোলে।

ঘুরতে ঘুরতে এক সময়ে সে সম্মেলনের তাঁবুতে ফিরে এল।

.

১১.

রাত্রি সাড়ে দশটার সময় হাওড়া স্টেশনে উদ্যোক্তারা তাদের পৌঁছে দিয়ে গেল। বিদায় নিল গাড়িতে তুলে দিয়ে। সারাটা পথ অভয় গুনগুন করতে লাগল। হারু বায়েনের অনেক কথার জবাব দিল। অনেক কথার দিল না, হাসতে লাগল। হারু বায়েন তার জন্য কোনও কৈফিয়ত চাইল না। জামাই একজন সাধক মানুষ। সে যে কখন কী ভাবছে, তা কি বোঝা যায়? সে কেন হাসছে, তা কি হারু বায়েনের বুঝবার ক্ষমতা আছে?

আসলে, অভয়ের বুকের ভিতর ঢেউ উপচে পড়ছে। চলকে চলকে পড়ছে। সে এখন আর নিজেকে বিচার করছে না। সে বলছে, এই তো আমার পাওয়ানা। আমি তো সঁপেই দিয়েছি নিজেকে। সকলের কাছে দিয়েছি।

প্রায় মধ্যরাত্রে যখন তারা তাদের স্টেশনে নামল, তখন শহরের চোখে ঘুম নেমেছে। চারিদিক স্তব্ধ। সাইকেল রিকশা দু চারখানি আছে। তার দরকার নেই। হেঁটে যাওয়াই সাব্যস্ত।

হারুর নজর প্রথমেই, শুড়িখানার দিকে। ঝাঁপ বন্ধ দোকানের। এ সময়ে খোলা থাকার কথা নয়। তবু বলল, পাঁচু দাদার বাড়িটা একটু ঘুরে যাই।

অর্থাৎ বে-আইনি চোলাইয়ের সন্ধানে। অভয় কিন্তু আপত্তি করল না। খালি বলল, তাড়াতাড়ি এসো, আমি আস্তে আস্তে হাঁটি। দেখো, কোনও গোলমাল বাধিয়ে বসো না।

–সে কী, তুমি খাবে না?

–না, ইচ্ছে করছে না হারুদা। তুমি খেয়ে এসো।

–এক যাত্রায় পেরথক ফল? বেশ, আমি একটু না খেলে পারব না বাপু।

ভাইকে বলল, তুই? ভাই পা বাড়িয়েছিল। বলল, চল।

দু ভাই চলে গেল। অভয় একলা ফিরে চলল। কাঁধে ব্যাগের মধ্যে পারিশ্রমিকের টাকা, বিজয়হরির দেওয়া মেডেলের হার। ইচ্ছে ছিল, নিমে আর গিনির জন্যে কিছু কিনে নিয়ে আসে। কিন্তু কেনা হয়নি। কাল কিনে দেবে এখান থেকে।

শীত এখনও আছে। দক্ষিণা বাতাস তার পুরো আসর পায়নি। রাস্তা একেবারে নিঝুম। বিজলি বাতিগুলি নিষ্প্রভ। শহর এখন ঝিঁঝির ডাকের তলায় আশ্রয় নিয়েছে।

বাজারের কাছে, মালিপাড়া প্রবেশের মুখে কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করে উঠল। পিছু নিল। তারপরে আপনা থেকেই চুপচাপ ফিরে গেল আবার।

বেড়ার আগল বাঁধা। বাড়ি অন্ধকার, নিশুপ। গিনি নিশ্চয় নিমেকে নিয়ে ঘুমোচ্ছে। আগলের বাঁধন খুলল অভয়। ঢুকে আবার বাঁধল। দাওয়ার এক কোণে আস্তে আস্তে হ্যারিকেনের ঘুমন্ত শিখা, একটু একটু করে জেগে উঠল। একটা সাপের ফণার মতো। আলোয় জেগে উঠল গিনির মুর্তি। আড়ষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করল, অভয়দা?

অভয় বলল, হ্যাঁ। ঘুমোওনি?

গিনি কোনও জবাব দিল না। বাতি নিয়ে ঘরে চলে গেল।

অভয় দাওয়ায় উঠে একেবারে গিনির কাছে এল। গিনির মাথা নত দেখে, জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে গিনি?

গিনি চোখ তুলল। চোখ ছলছল করছে। বলল, কাল সারা রাত বসেছিলাম। বলে যাওনি তো যে আসবে না।

–কেন, খুড়ি থাকেনি?

পরশু রাতে ছিল। আর এখন বসে বসে ভাবছিলাম—

গিনির গলার স্বর বন্ধ হল। মাথা নিচু করল। অভয় তার চিবুকে হাত দিয়ে মুখ তুলে ধরে বলল, কী ভাবছিলে?

গিনি বলল, আজও বোধহয় আসবে না।

–না এলে?

 -ভয় করে।

কিন্তু এখন আর ভয় নেই গিনির। অভয়কে দেখা মাত্র, এক মুহূর্তের জন্য অভিমান ক্ষুরিত হয়ে উঠেছিল। কাছে আসা মাত্র তা অন্তর্হিত হয়েছে। বলল, মাসি থাকতে চেয়েছিল। আমি পাঠিয়ে দিলাম। মেসোর সারারাত ঘুম হয় না। বুড়ো মানুষ।

পর মুহূর্তেই অপরূপ হাসিতে ভরে উঠল গিনির মুখ। বলল, সবাই বলছে, কলকাতায় তোমার খুব নাম হয়েছে। খবরের কাগজে তোমার নাম বেরিয়েছে।

গিনির উল্লসিত হাসি মুখখানি অভয়ের দৃষ্টি ধরে রাখল। তার বুকের ঢেউ বাড়তে লাগল। বলল, কে বললে।

গিনি বলল, সবাই।

–আর তুমি?

–আমি?

 গিনি যেন উপছে পড়তে লাগল। বলল, আমার খুব অহঙ্কার হল।

খুশির এমন প্রকাশ ও ভাষা কখনও শোনেনি অভয়। বলল, অহঙ্কার?

–হ্যাঁ। বলে না, অহঙ্কারে মাটিতে পা পড়ে না। আমার যেন সেরকম হল।

নিষ্পাপ পবিত্র উল্লাস ও লজ্জা, কথার মুনশিয়ানা জানে না। অভয় দেখল, গিনির চোখে কাজল আজ। পায়ে আলতা। কাঁচা কাপড়, ধোয়া জামা পরনে। লজ্জায় এবং আনন্দে নতমুখী গিনি আবার বলল, সারা পাড়াটা আজ ঘুরেছি, নিমেকে কোলে নিয়ে। তুমি একটা রুপোর মেডেলের মালা পেয়েছ, না? কাগজে লিখেছে নাকি।

–হ্যাঁ। দেখবে?

–দেখি।

ব্যাগটা খুলে দিল অভয়। গিনি নিজেই হাত ঢুকিয়ে বার করল। সত্যি সত্যি রুপোর। বেশ ভারী, ঝকঝকে, লাল ফিতেয় গাঁথা মেডেলগুলি। গিনি একবার দেখল অভয়ের দিকে। সাহস করে বলল, পরিয়ে দিই?

-দাও।

কিন্তু অভয়ের বুকের ঢেউ প্রবল হল। প্লাবন এল, ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাকে। যিনি মেডেলের হার পরিয়ে দিল অভয়কে। যেন এক প্রখর মন্ত্রের আচ্ছন্ন উত্তেজনায়, অভয় গিনির দুটি হাত নিজের হাতে তুলে নিল। তার বুকের অশেষ শূন্যতার মধ্যে জোরে চেপে ধরল।

গিনির বুকের মধ্যে ধকধক করতে লাগল। সে আর তাকাতে পারল না। চোখ নামিয়ে নিল। অভয়ের নিশ্বাস দ্রুত হল। কিন্তু গলার স্বর তলায় চাপা পড়ে গেল। বলল, গিনি আমি বড় একলা। আমার কষ্ট হয়।

গিনি আবার চোখ তুলতে চাইল। কিন্তু জলে ভেসে গেল চোখ। ফিসফিস করে বলে, জানি।

জানো?

অভয়ের বুকের সমস্ত শূন্যতা যেন অস্থির আবেগে ও পিপাসায়, দুহাত দিয়ে গিনিকে টেনে নিল। বুকের মধ্যে। বহু যুগ ধরে স্তব্ধ চুম্বনের সব আকাঙক্ষা যেন গিনির ওষ্ঠপুটে নিরলস ধারায় এল নেমে।

গিনি কেঁপে কেঁপে উঠল। দু হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রইল অভয়কে। যেন ভয় পেয়েছে। অভয়ের সমস্ত দ্বন্দ্বের যন্ত্রণাকে বুকের ঢেউ তার প্রবল বেগে সরিয়ে, কোনও এক অতীতের থেকে, সহসা সমস্ত ঋণমুক্তির দুর্জয় বেগ, রাশি রাশি তরঙ্গের মতো একটি নবযুবতীর নিটুট অঙ্গে অঙ্গে স্পর্শিত হল। যে-নারীর নাম সে ভুলে গেল এবং সমস্ত উচ্ছ্বাস নিয়ে ডাকতে গিয়ে থমকে গেল সে। তার ওষ্ঠাগ্রে এল প্রথম নাম, নিমি! কিন্তু ডাকা হল না। মুহূর্তের মধ্যে এই বিস্মৃত মেয়েটির মুখ সে দেখতে চাইল এবং সে আবার ডাক দিতে গেল। তার ঠোঁটের দুয়ারে ছুটে এল আর একটা নাম, সুবালা! আর সেই মুহূর্তে তার সমস্ত স্মৃতি, অশ্রু-ভাসানো চোখবোজা একটি মুখের ওপর। নিঃশব্দে চিৎকার করে উঠল, গিনি! গিনি!

সেই মুহূর্তে তার বুকের ঢেউ স্তব্ধ হল। প্লাবন সরে গেল। রুক্ষ এবং শুষ্ক বালিয়াড়ির ওপরে যেন খর জৈষ্ঠ্যের রৌদ্র আগুনের মতো গলে গলে পড়তে লাগল। সরে গেল অভয়। তার চোখে পড়ল, নিমে নিদ্রিত। সারা ঘরটা যেন গ্রাস করতে এল অভয়কে। সে ত্রাস-ভরা গলায় ডাকল, গিনি।

বুকের আলিঙ্গন থেকে নিরাশ্রিতা গিনি বিস্ময়ে, ব্যথায় নির্বাক। তার আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে অনুসন্ধিৎসা জাগছে। বলল, কী?

অভয় বলল, গিনি! এ কী করলাম? আমি এ কী করলাম?

বলতে বলতে শরবিদ্ধ এক বিশালকায় পশুর মতো টলতে টলতে সে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল। গিনি ডাকতে চাইল। তার গলায় শব্দ ফুটল না। উঠতে চাইল। কিন্তু বুকের ভিতর একটা অসহ্য কষ্ট ও যন্ত্রণা তাকে অবশ করে রাখল।

অভয় এই গভীর রাত্রিতেও লোকভয়ে বাইরে যেতে পারল না। ঘরের পিছনে, পুকুর পাড়ের অন্ধকারে, দু হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। –এই কি আমি? সম্মেলনের মঞ্চের, পরশু রাত্রের সেই অভয় কি আমি? যুদ্ধ ও শান্তির পালাদার, সমাজ-সচেতন কবি গায়ক, বিজয়হরির মালার সম্মান। গলায় দোলানো–সেই আমি কি এই আমি?

গলা থেকে মালাটি টান দিয়ে খুলে নিল অভয়। এই কি আমার সেই বুকের ঢেউ? এই কি আমার সেই ব্যথা! তবে আমি কেন বিশুকে মেরেছিলাম। কে আছে এই বিশাল অন্ধকারে। কার পায়ে ধরে আমি ক্ষমা চাইব। কার, কার! কে সে, এমন নিষ্ঠুর খেলা খেলছে আমাকে নিয়ে। কেন। শান্তি নেই আমার। আমি জানি, আমার বুকের মধ্যে এক অশান্ত শক্তি বাসা বেঁধেছে। কেন তাকে আমি তাড়াতে পারছি না। কেন স্থির হতে পারছি না?

.

ভোর রাত্রে প্রথম বাঁশি বেজে উঠল চটকলগুলিতে। অভয় একই ভাবে বসে আছে। চোখের তারা তেমনই উদ্দীপ্ত। সারা মুখে তেমনি ব্যাকুলতা।

গিনি এসে দাঁড়াল দূরে। ডাকল, অভয়দা।

ফিরে তাকাতে গিয়ে, মুখ নামিয়ে নিল অভয়। বলল, বলো।

গিনি বলল, পুকুর ঘাটে এখন লোকেরা আসবে। ঘরে এসো!

স্বভাব এবং নিয়মের সত্যগুলো কখনও ভুল হয় না ওদের। তাই বোধহয় মেয়েরা প্রকৃতির অনেক কাছাকাছি। অভয় উঠল। গিনির পিছনে পিছনে ঘরে এল। গিনি ফিরে দাঁড়াল মুখোমুখি। ওর চুল খোলা। রাত্রি জাগরণ চিন্তাক্লিষ্টতার ছাপ। কিন্তু অনেক স্বাভাবিক।

অভয় বলল, গিনি, তুমি আমার আশ্রয় চেয়েছিলে।

তাই তো।

গিনির গলায় কোনও আবেগের বাষ্প নেই।

–কিন্তু আমি তাকে নোংরা করলাম।

 -কোথায় নোংরা করলে?

করিনি?

–আমি তো জানি না।

–আমার ওপর তোমার ঘেন্না হয়নি? রাগ হয়নি?

 –না।

–দুঃখ?

 তুমি যে জন্যে ভাবছ সে জন্য নয়।

–তবে?

–তুমি কষ্ট পাচ্ছ, তাই। কিন্তু

কী?

–আমি বলছিলাম, তুমি একটু শোও, ঘুমোও।

অভয় আপন মনে বলতে লাগল, কিন্তু আমি তো এ সব ভাবিনি, আমি তো ভাবিনি। মানুষের মনের ভেতরটা কী সাংঘাতিক অন্ধকার। কিছু সে দেখতে পায় না। আবার আপন মনে বলে উঠল, তবে কেন আমি বিশুকে মারলাম, কেন?

গিনি চুপ করে, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। বলল, সেটা ঠিক করেছিলে।

–আর এটা?

-তোমার মন জানে অভয়দা।

স্পষ্ট আর সাবলীল শোনাল গিনির গলা।

 আমার মন! আমার মন! রাস্তার ধারে নিরাশ্রিত ভিক্ষুকের মতো, প্রকাণ্ড দেহটাকে জড়োসড়ো করে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল অভয়।

.

ঘুম তার অনেকক্ষণ আসেনি। সুরীন আর ভামিনীর গলা শুনতে পেয়েছে। নিমের কান্না এসেছে কানে। দোকান বন্ধ থাকবে আজও, সেই কথা সুরীনকাকা বলে গেল। ভামিনীকে বলতে শোনা গেল, তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন গিনি? চোখের কোল বসা, সাত সকালে চুল ভোলা।

গিনি কী বলেছে শুনতে পায়নি অভয়। নিমে মা মা করে ভামিনীকে জড়িয়ে ধরেছে শুনতে পেয়েছে।

অনেকক্ষণ পরে যখন তার চোখে ঘুম জড়িয়ে এল, সেই সময়েই শুনতে পেল রিকশার হর্ন। ডাক শোনা গেল, কই, অভয় কোথায়?

জীবন চৌধুরী মশায়। তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে অভয়। ছুটে গিয়ে দেখা করল, আসুন, আসুনবলে আজ পায়ের ধুলো নিল। আবার বলল, আপনি কেন এলেন এই শরীর নিয়ে। আমিই তো যেতাম আর একটু বেলায়।

জীবন চৌধুরী অভয়ের কাঁধে হাত রেখে, ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। হাঁপাচ্ছেন। শরীরও কাঁপছে যেন। বললেন, কাল গেলে না দেখে–আর তর সইল না অভয়।

অভয় বলল, আমি যে কাল শেষ রাতের গাড়িতে এসেছি।

–অ! তাই! ভাবলাম, অভয় একবারটি না এসে কখনও পারে?

বলে, মোটা লেন্সের ভিতর দিয়ে অভয়ের মুখের দিকে তাকালেন। হাত তার মুখে বুলিয়ে দিলেন। বললেন, বড় আনন্দ পেয়েছি বাবা। হয়তো বাংলাদেশ থেকে কবিগান তরজা সব উঠে যাবে একেবারে। কিন্তু সত্য তুই যেখানে দাঁড়িয়ে বলবি, তাকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।

এই প্রথম চৌধুরীমশায় অভয়কে তুই বললেন। কিন্তু তার বুকের ভিতরটায় ছুরি চলতে লাগল। চৌধুরীমশায় তো অভয়ের ভিতরের অন্ধকারটাকে চেনেন না। অভয় বলল, আসুন বসবেন।

–না, আজ আর বসতে বলিস না। দেরি হলে এখুনি বাড়ির লোকেরা ছুটে আসবে। তুই যাস।

–তবে এখন আমি সঙ্গে যাই?

কী দরকার। চেহারাটা তো দেখছি খারাপ, ঘুমটুম হয়নি। এখন আমি একলাই যেতে পারব।

বলে অভয়কে ধরে রিকশায় উঠে বললেন, গণেশদের দলের কাগজ কী লিখেছে দেখেছিস তত?

–না।

–লিখেছে, তোদের মতো লোকেরাই দেশকে জাগ্রত করতে পারে।

 চলে গেলেন জীবন চৌধুরী। নিমে টলতে টলতে এসে জড়িয়ে ধরল। তাকে বুকে তুলে নিল অভয়। না তাকিয়েও সে বুঝতে পারল, গিনি আশেপাশেই ঘোরাফেরা করে কাজ করছে।

অভয় দাওয়ায় বসা মাত্র গিনির গলার স্বর শোনা গেল, মুখটা ধুয়ে এসো, একটু চা দিই। তারপর একেবারে স্নান করে, খেয়ে শুয়ে পড়ো।

নিমে তার বাবার স্তব্ধতা ভাঙাতে অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু শুষ্ক হাসি ছাড়া কিছু পেল না। মুখ ধুয়ে এল সে। গিনি চা আর মুড়ি দিল–দিয়েও দাঁড়িয়ে রইল। অভয়ের চোখের ওপর তার বাসি আলতা পরা পা।

গিনি বলল, কাল সুবালাদি এসেছিল সকালে।

অভয় মাথা তুলতে গিয়েও পারল না। গিনি বলে গেল, তোমার দেখা না পেয়ে মন খারাপ করে চলে গেছে। বললে, তখনি জানি দেখা হবার ভাগ্যি করিনি। এ সময়ে রোজ গঙ্গায় চান করি, মাথাটা একটু ভাল থাকে, তাই এসেছিলাম। তবে, লোকটা আমাদের সকলের মাপের বাইরে। যেতে বলতে ঘেন্না করে। তবু বলিস গিনি, এসেছিলাম। ও যে, আমাদের চেনা, এ আমরাও ভাল করে জানি না।

বলে গিনি সরে গেল। অভয় চুপ করে বসে রইল অনেকক্ষণ। নিমে বকবক করে মুড়িগুলি নিজেই সাবাড় করল। তারপর অভয়ের গাল টেনে ধরে বলল, তা, তা।

অর্থাৎ চা। অভয় তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা চা এক নিমেষে খেয়ে, অবশিষ্ট নিমেকে দিল। দিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল।

রাস্তায় এসে, একেবারে বিশুর বাড়িতে গিয়ে উঠল। আশেপাশে যারা ছিল, তারা অবাক হয়ে। গেল। অভয় উঠোনে ঢুকে ডাকল, বিশুদা আছ নাকি?

বিশুর বউ বেরিয়ে, অবাক হয়ে বলল, না তো। ও তো কাজে বেরিয়ে গেছে। কেন?

 বিশুর বউয়ের চোখে সন্দেহ ঘনিয়ে উঠল।

অভয় বলল, তাও তো বটে, মনে ছিল না। তবে এখন যাই বউদি।

বিশুর বউ বলল, কী দরকার বলোই না।

অভয় বলল, অন্যায় করেছি, তাই মাপ চাইতে এসেছিলাম। মানুষের গায়ে হাত তুলব, এত বড় সাহস যেন আর কোনওদিন না করি, এই বলতে এসেছিলাম।

বিশুর বউ তাড়াতাড়ি কাছে এসে বলল, তা চলে যাচ্ছ কেন? দাদা নেই বলে বসতে নেই বুঝি? সেই জেল থেকে এসে তো এ বাড়িতে একদিনও পা দাওনি। বসো একটু।

তাড়াতাড়ি দাওয়ায় আসন পেতে দিল বিশুর বউ। কিন্তু অভয় পরিষ্কার বাতাবিলেবুতলায় বসে পড়ল।

–আহা মাটিতে কেন?

–মাটিই ভাল বউদি।

–তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন জামাই?

রাতভর ঘুম হয়নি। কিন্তু যে কথা বলতে এসেছিলাম, বউদি, তুমিও আমাকে মাপ করে দিয়ো। রাগলে মানুষ পশু।

ছি ছি, ও কী কথা। আমি তো তোমার ওপর রাগ করিনি। ঘরের মানুষকে তো আমি জানি। তবু, স্বামীর জন্য কার না অপমান হয়? দশজনের সামনে তখন খারাপ লেগেছিল।

বউদির চোখ ছলছলিয়ে উঠল। কিন্তু আমার এখন আর কিছু মনেতে নেই। তুমি নিজে এসেছ বলতে, সেই তো অনেক।

-না না, তা নয় বউদি।

তাই জামাই। আর তোমার সম্পর্কে ও সব বললেই হল? তোমাকে কে না চেনে?

অভয়ের চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা করল। বউদি আবার বলল, আমাদের মেয়েমানুষের চোখ জামাই। গিনিকে কি আমরা দেখে কিছু বুঝি না? কিছু ঘটলে আমরা আগেই বুঝতাম।

মানুষের কখন কী হয় বলা যায় না। যদি ঘটেই থাকে।

–ও তুমি গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে বললেও মানব না। আর যদি ঘটে, তবে তো ভালই। ভামিনীদি তো তাই চেয়েছিল। আমরাও মনে মনে চেয়েছি। কিন্তু গিনির সে কপাল কই?

কী অগাধ বিশ্বাস মানুষের। এই বিশ্বাসকে আঘাত করার প্রবৃত্তি তার কোন গুহায় লুকিয়েছিল? সে বলে উঠল, কিন্তু বউদি, হাত দুটো ঘেঁচে ফেলতে ইচ্ছে করে। কেন আমি অমন কাজ করলাম!

কিন্তু বউদি অবিচল। বলল, সে কি তুমি করেছ। তখন তুমি সইতে পারোনি। বসো জামাই, একটু চা খেয়ে যাও।

আপত্তি করল না অভয়। ভাল লাগছে তার এখানে বসে থাকতে।

চা আসতে আসতেই এল মালিপাড়ার এক প্রৌঢ়া বিধবা। বলল, ও বাবা জামাই, এই দেখ, মুসুপালটি লুটিশ দিয়েছে। এক মাসের মধ্যে খাজনা না দিলে, আমার ঘর নিলেম হয়ে যাবে। নোটিশখানি হাতে নিয়ে অভয় পড়ল। বলল, মাসি, তোমার যে দু বছরের খাজনা বাকি।

–তা বাকি আছে বাবা। তোমার মেসো যে এতদিন ব্যায়োয় পড়েছিল। এখন আমি কী করব?

অভয় একটু ভেবে বলল, এখন দিতে পারবে?

–সব তো এক সঙ্গে পারব না।

মাসে মাসে, কিস্তিতে কিস্তিতে?

–তা পারব।

–বেশ, আমি দরখাস্ত একখানি লিখে দিচ্ছি। তুমি দিয়ে এসো।

.

১২.

জীবনটা আবার একটা নতুন করে শুরু হল যেন।

নতুন করে ডাক আসতে লাগল গান গাইবার জন্যে। আরও দূর দূরান্তের ডাক। দোকান ঘরটা হয়ে উঠল দরখাস্ত লেখার অফিস ঘর। যদিও বাংলা দরখাস্তই সব। পাড়া-বেপাড়ার অনেকেরই ভিড়। দরখাস্ত অধিকাংশই পৌরসভার। তা ছাড়া জমিদারি উচ্ছেদের পর, বি.ডি.ও-র অফিসের। দরখাস্ত। জমিদারের খাজনা এখন সরকারের প্রাপ্য। সেখানেও নানান গোলমাল।

কাজের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব কিছু ছিল না। কিন্তু জীবনের নানান দিকে সে যেন বেড়া দিয়ে রেখেছে। জোর করে ধরে রেখেছে। লাগাম দিয়ে বেঁধে রাখার মতো।

অথচ গিনি স্বাভাবিক আছে। যেন কিছুই হয়নি। যেমন ছিল তেমনি সংসার করছে। স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। কিন্তু অভয় পারছে না। নিজেকে তার খাটো লাগছে। কখনও কখনও গিনির স্বাভাবিকতা স্পর্ধা বলে মনে হচ্ছে। যেন অভয়কে অশ্রদ্ধা করছে। মাঝে মাঝে বিরক্তি প্রকাশ হয়ে পড়ে অভয়ের। তাতে গিনির অবস্থা দেখে আবার বিমর্ষ হয়ে ওঠে।

কদিন ধরে বারেবারেই সুবালার কথা মনে পড়তে লাগল। আবার নিজেকে ভয়ও করতে লাগল। তারপর একদিন বিকেল বেলায় গিয়ে উপস্থিত হল। প্রথমেই রাজুবালার সঙ্গে দেখা। উঠোনে বসেছিল রাজু। একটি মেয়ে পা টিপে দিচ্ছিল। তাড়াতাড়ি উঠে বলল, এসেছ? বাব্বা! রোজ সুবালা তোমার নাম করে। আজও দুকুরে বলেছে, দেখবে মাসি আর সে এখন এখানে। আসবে না। এখন তার কত নাম ডাক। দয়া করে সেই কবে একদিন নাকি রাত্রে এসেছিল, তা। আমার খেয়ালও নেই। আর সে দয়া হবে না।

অভয় বলল, রাজুমাসি, অত সাহস আমার নেই যে, দয়া করব। কোথায় সুবালা?

 রাজুবালা বলল, দেখো তো, একটু আগে বোধহয় ঘুম থেকে উঠেছে। ঘরেই আছে।

 কিন্তু আবার সেই বুকের ঢেউ। গিনি যেন অনেকটা আকস্মিক। কিন্তু সুবালা যেন বহু দিন ধরে, বহু দূর থেকে একটি সুতোর সঙ্গে বাঁধা। মরে গেলে, ভুলে গেলেও, ওই বন্ধন শেষ হয়ে যায় না। তাই ভয় হয় সুবালার কাছে আসতে। অথচ, নিমির মৃত্যুর জন্যে এক রকমের দায়ী করে সুবালাকে সে ঘৃণা করতে চেয়েছিল। সেটা যে জোর করে আজ তা বুঝতে বাকি নেই।

ঘরের সামনে এসে দেখল দরজা খোলা। সুবালা মেঝেয় বসে আছে পা ছড়িয়ে। বোতল সামনেই। গেলাস নিয়ে সবে মুখে তুলতে যাচ্ছে। অভয়কে দেখে থমকে গেল। গেলাস রেখে উঠে দাঁড়াল। বলল, তুমি!

অভয় বলল, অসুবিধে করলাম নাকি?

–একটুও না। আশা করিনি তো যে আসবে। এই সবে মুখে তুলতে যাচ্ছিলাম। ভালই হয়েছে।

বলে বোতল গেলাস তাকে তুলে রাখল। ফিরে বলল, বসো।

অভয় মেঝেতেই বসল। সুবালা বললে, প্রথম দিন এসেও মেঝেতেই বসেছিলে। ইচ্ছে না থাকলে, বিছানায় বসতে বলব না।

অভয় দেখল, মুখ ফোলা সুবালার। বয়সেরও অকাল ছাপ পড়েছে যেন। চোখের কোল থলের মতো দেখাচ্ছে। শরীরের বাঁধুনি কোথাও শিথিল হয়নি। বলল, সেদিন আর থাকতে পারিনি, তোমার বাড়ি চলে গেছলাম।

–শুনেছি। কিন্তু থাকতে না পারার মতন—

–তা বলতে পারো। কী জানি। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল।

 বলেই একটা লম্বা হাই তুলে চোখ সরিয়ে নিল সুবালা। একটু ঝিমঝিম হাসি হেসে বলল, এ সময়ে একটু না খেলে, চোখ মেলতে পারি না।

অভয় বলল, তবে খাও একটু।

বলছ?

–হ্যাঁ। অসুবিধে করে লাভ কী?

চোখে চোখে তাকিয়ে, সুবালা বলল, হ্যাঁ, একটু খাই, নইলে কথা বলতে পারব না।

 বলে, গেলাসের সবটুকু চুমুক দিয়ে একেবারেই খেয়ে ফেলল। কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজে চুপ করে রইল। চোখ যখন মেলল, তখন লাল হয়ে উঠেছে। কিন্তু আবার খানিকটা ঢেলে নিল।

অভয় বলল, বড্ড খাচ্ছ আজকাল।

–হ্যাঁ। নইলে পারি না।

–কিন্তু শরীরটা—

শরীর!

কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিল সুবালা। অভয় আবার বলল, গান গাওয়া তো ছেড়ে দিয়েছ।

ভাল লাগে না।

 -কেন? কেন এরকম হল তোমার?

কী জানি। খালি রাগ হয়, ঘেন্না হয়।

কাকে?

–সবকিছুকে, সবাইকে।

চোখ ঘুরিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, তোমাকে নয়।

ঠাট্টা করছ?

–জ্ঞানে কোনওদিন তো করিনি।

বলে সুবালা গেলাসের মদটুকু এক চুমুকে খেয়ে নিল। সরিয়ে রাখল গেলাস।

 অভয় বলল, কেন রাগ কীসের? কী চাও?

–তা জানিনে বলেই তো রাগ হয়। কেবলই মনে হয়, কী করলাম! কী করলাম জীবনে।

সুবালার মুখ একটু একটু করে লাল হচ্ছে। চোখে ঈষৎ মত্ততার আভাস। হঠাৎ উপুড় হয়ে শুয়ে দু হাতের ওপর চিবুক রাখল। তার মাথা অভয়ের পায়ের কাছে এসে পড়ল। বলল, আমার মাথায় একটু হাতটা দাও না।

অভয়ের বুকের স্পন্দন বাড়ছে। কিন্তু সুবালার গলার স্বর শুনে সে আপত্তি করতে পারল না। সে সুবালার মাথায় হাত রাখল। যেন জ্বলন্ত কয়লা, এত গরম মাথাটি।

সুবালা বলতে লাগল, অথচ দেখো, সংসারে কতগুলি আজে বাজে দুঃখে পড়ে, বড় সুখের আশায় বেরিয়ে এসেছিলাম! সে সুখও পেলাম না। এখন ছাই, পালটা দুঃখ যে কী তাও বুঝতে পারি না। গান-বাজনা রান্না বান্না শিখেছিলাম। নভেল-টভেল পড়ার মতন বিদ্যে বুদ্ধিও ছিল। একটু বোধহয় বেশি ছিল, তাই কোথাও কোনও কাজে লাগল না।

চুপ করল। অভয় তার নিজের অজান্তেই সুবালার মাথা তার পায়ের ওপর টেনে নিল। তার কষ্ট হচ্ছে সুবালার জন্যে।

সুবালা আবার বলল, কেউ যদি নিয়ে গিয়ে আমাকে আটকে রাখত, খাটাত, কথা না শুনলে মার ধোর করত, তা হলেও বোধ হয় বেঁচে যেতাম।

বলে মুখ ফিরিয়ে অভয়ের দিকে তাকাল। অভয় দেখল, সুবালার মত্ত চোখে জল। কিন্তু হাসছে সে। অভয় সুবালার গালে হাত দিল।

সুবাল বলল, তুমি নেবে আমাকে?

অভয় প্রায় অস্ফুট গলায় বলল, তুমি যাবে?

সুবালা হাসল। বলল, দোহাই তা বলে যেন বলে বসো না, সত্যি নিয়ে যাবে। তবে, একটা সত্যি কথা বলব?

বলো।

–এ ঘরে অনেক বড় মানুষ এসেছে। বাইরেও অনেক মানুষ দেখেছি। তোমার মতন এমন সরল আর তেজি মানুষ দেখিনি।

–এমন বোলো না সুবালা।

-সত্যি যে! বিদ্যায় অর্থে নয়, আর কিছু, যা সংসারে সকলের থাকে না।

–এ সব কথা থাক সুবালা।

তবে থাক!

 থাক, কিন্তু বেদনার রূপ ধরে, এক বিচিত্র প্লাবন আবার ভাসিয়ে নিতে লাগল অভয়কে। সে সহসা নিচু হয়ে বলল, সুবালা, আমি তোমাকে ভালবাসি।

সুবালা চুপ করে পড়ে রইল। অভয় সুবালাকে টেনে নিজের দেহের ওপরে তুলে আনল। ডাকল, সুবালা।

সুবালা যেন হঠাৎ মাতালের মতো অচৈতন্য হয়ে লুটিয়ে পড়ল। বলল, ঊ?

অভয় নিচু রুদ্ধশ্বাস গলায় আবার বলল, সুবালা, তোমার কাছে আসবার কথা রোজ ভাবি।

সুবালা আচ্ছন্নের মতো জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, আমি জানি, সেই প্রথম দিন আসা আর এক রাতে ফিরে যাওয়া তোমার মধ্যে ঘুলোচ্ছে।

–সুবালা!

 প্রতিবাদে ও যন্ত্রণায় তীক্ষ্ণ শোনাল অভয়ের গলা। সরিয়ে বসিয়ে দিল সুবালাকে। সুবালা চমকে তাকাল। চকিতে হাত বাড়িয়ে অভয়ের হাত ধরল। বলল, বিশ্বাস করো, অন্য কিছু ভেবে বলিনি। আমি যে ওই দিনগুলো ভুলতে পারিনি, তাই বলেছি।

অভয় মন্ত্রাচ্ছন্নের মতো বিড় বিড় করে বলতে লাগল, সত্যি, সে যে সত্যিই, সত্যি বলেছ। সুবালা, তবু আমি লোকের কাছে ভাল সেজে থাকি।

সুবালা বলল, অভয়, তোমার কি ভগবান হবার পণ?

না না না। কিন্তু ও কথা বলে নিজেকে চাপা দিয়ে রাখা যায় না সুবালা।

 সুবালা বলল, চাপা দিয়ে রাখবে কেন।

বলতে বলতে সুবালা কাছে এল আরও। ইতিমধ্যে সন্ধ্যার পর অন্ধকার নেমে এসেছে ঘরে। দু হাতে সুবালা জড়িয়ে ধরল অভয়কে। বলল, তোমাকে তো আমি চিনি। তুমি তো অন্ধ নোক নও, রক্ত খেয়ে বেড়ানো তোমার স্বভাব নয়, বাঁচা মরাও নয়। এই নাও, আমাকে নাও, আজ ফিরে যেয়ো না। নিজেকে ফিরে পাবে তুমি।

-না সুবালা, না। এ আমার এক হঠাৎ কল, হঠাৎ বিকল অবস্থা। ছেড়ে দাও আমাকে।

 নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে সে বেরিয়ে এল। সুবালা ডাকল, অভয়, শোনো অভয়।

অভয় সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল তরতর করে। কোনওদিকে না তাকিয়ে একেবারে রাস্তায় এসে পড়ল। আঃ! কে আমাকে এমন বিড়ম্বিত করছে। কে এই নিষ্ঠুর উপহাসের খেলা খেলছে আমার ভিতরে বসে।

.

১৩.

আবার কলকাতায় ডাক পড়ল গানের। সবাই তাকে ডাকল, সব ডাকে সে সাড়া দিল। রেডিয়োতে কবি গান গাইবার ডাক পড়েছে তার। সঙ্গে সঙ্গে হারু বায়েনেরও নাম হয়েছে। কিন্তু অভয়ের ভিতরটা কোথায় বরফের মতো কঠিন ভাবে জমাট হয়ে রইল।

কেবল তাকে অবাক করল গিনি। ওর কি কোথাও কোনও পরিবর্তন হতে নেই। মাঝে কিছুদিন জ্বরে ভুগেছিল। তাও ভামিনীর কাছে প্রথম জানতে পারা গেছল, গিনি জ্বরে ভুগছে। আর পরিবর্তন শুধু চেহারায়। স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছিল।

অনাথখুড়ো আবার আসতে আরম্ভ করেছে। গণেশবাবুও দেখা হলে, ডেকে কথা বলেন। কিন্তু কোনও পক্ষেরই আগের সেই উচ্ছ্বাস আর নেই।

বাইরের যে বিরোধগুলিকে ভীষণ আর ভয়ংকর মনে হয়েছিল এক সময়, তা যেন আপনি আপনি দূর হয়ে গেল। শুধু সময়ের অপেক্ষায় ছিল।

জীবন চৌধুরীমশাই একেবারে শয্যা নিয়েছেন।

এদিকে দোকানটা উঠে যাবার অবস্থায় পৌচেছে।

এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন রেডিয়ো প্রোগ্রামে কবি গান গেয়ে এসে শুনল সুবালাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। রাজুবালার কাছ থেকে সব শুনল অভয়।

আজ বিকেলে সুবালা বড় রাস্তার দিকে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। কালীতারা বাড়িউলির বাড়িতে সম্প্রতি একটি নতুন মেয়ে এসেছে, নাম মালতী। দেখতে সুন্দর। তাকে সবাই বলে লাল মালতী। কারণ সে সব সময়েই লাল পাতলা শাড়ি, আর হাতকাটা লাল ব্লাউজ পরে থাকে। সুবালা রাস্তা দিয়ে মালতাঁকে হেঁটে যেতে দেখে ডেকেছে। মালতী শোনেনি। কারণ সে মালতী নয়। সে পিছন ফিরে ছিল।

সুবালা বলেছে, ওলো ও লাল মালতী। তোর যে কানে কথাই যায় না।

তখন রাস্তার সেই মেয়ে ফিরে তাকিয়েছে। চোখে তার আগুন। বলেছে, বড় বেশি বেড়ে উঠেছ না? রাস্তা দিয়ে তোমরা ছাড়া আর কেউ চলে না?

সুবালা বলেছে, চলে, অত বুঝতে পারিনি।

সেই মেয়ে বলেছে, কিন্তু বুঝতে হবে, সেটা মনে রেখো। না বুঝলে, ডাকবে না।

কিন্তু সুবালা কেমন মেয়ে, সকলেরই জানা। সে বলে উঠেছে, পোশাক দেখলে তো সব টের পাওয়া যায় না।

সেই মেয়ে বলেছে, তাই নাকি? আচ্ছা।

বলে, সঙ্গে সঙ্গে রিকশা ডেকে ফিরে গেছে। কে জানত, সেই মেয়ে আবার এ শহরের নতুন বড়। দারোগার মেয়ে। একটু পরেই পুলিশ বোঝাই গাড়ি নিয়ে, একেবারে পাড়ায় সেই মেয়ে এসে উপস্থিত। কালবিলম্ব না করে, রাজুবালার বাড়ির মধ্যে ঢুকে, সবাই দোতলায় ছুটে গেছে। যেন। একদল খ্যাপা নেকড়ের মতো ঢুকেছে গিয়ে সুবালার ঘরে। একজন এস-আই সঙ্গে ছিল। সে মেয়েটি পুলিশের হাত থেকে লাঠি নিয়ে বলেছে, পোশাক দেখে চিনতে পারো না; তাই চেনাতে এলাম।

বলে লাঠি দিয়ে এলোপাথাড়ি মেরেছে।

সুবালা চিৎকার করে বলেছে, দারোগার মেয়ে বলে আপনি মগের মুলুক পেয়েছেন! কেন মারবেন আপনি আমাকে?

সেই সুবালা! তার অসহায় অবস্থা কল্পনা করে অভয়ের বুকের মধ্যে টনটন করে উঠল।

তারপর পুলিশেরা তার চুলের মুঠি ধরে, আছড়ে মেঝেয় ফেলে মেরেছে। বলেছে, আবার বড় বড় কথা?

বলে রক্তাক্ত অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় চুল ধরে টেনে নিয়ে গেছে থানায়।

অভয় দেখল, সমস্ত পাড়াটা থমথম করছে। কেউ দরজায় দাঁড়ায়নি। লোক জন নেই একটিও। অভয় সোজা থানায় গেল। স্বয়ং ও. সি. বসেছিলেন। অভয় নমস্কার করল। ও. সি. মাথা নেড়ে বললেন, কী চাই?

অভয় বলল, আমি সুবালার জন্য এসেছি।

–সুবালা কে? সেই বেশ্যাটা?

–হ্যাঁ।

 –তুমি কে? তোমার রক্ষিতা?

–না। আমি প্রতিবেশী।

–মানে দালাল, অ্যাঁ?

না।

ও. সি. চিৎকার করে ধমকে উঠলেন, না মানে কী? নিশ্চয়ই তাই। তা নইলে এসেছ কেন তুমি?

অভয়ের চোখে রক্ত উঠে এসেছিল। সে বলল, সেটা আপনি বুঝতে পারবেন না বলেই, তখন থেকে আমাকে তুমি তুমি করে যা খুশি তাই বলছেন।

—বটে?

অভয়ের আপাদমস্তক দেখলেন ও.সি.। ডাকলেন, নিরঞ্জনবাবু, দেখুন তো একে চেনেন নাকি?

পাশের ঘর থেকে এস. আই. বেরিয়ে এলেন। ভদ্রলোক এ শহরের পুরনো মানুষ। বললেন, হ্যাঁ, চিনি বইকী। একজন নামকরা কবি-গায়ক।

ও.সি. বলে উঠলেন ও, সেই অভয়পদ দাস। জুট স্ট্রাইকে একবার জেল হয়েছিল, না?

 নিরঞ্জনবাবু বললেন, হ্যাঁ স্যার।

ও. সি. কিন্তু ওই বেশ্যাটার জন্যে এ কেন? এতে যে নিজেরই সম্মান যাবে।

অভয় নিজেই বলে উঠল, সে সম্মান থাকলে তো আসতামই না। ও তো আপনার আমার মতোই এ দেশের আইনত অধিবাসী আর ভোটার। মেয়েটিকে বেল দিতে পারার মতো কেস কি না, সেটা আমাকে বলুন।

ও. সি. তাঁর কাগজ থেকে মুখ তুলে একবার দেখলেন অভয়কে। বললেন, আজ সে-সব কিছুই বলতে পারব না। বেল দেবার কোনও প্রশ্নই নেই। শহরকে স্পয়েল করা আর ভদ্রলোকের মেয়েকে বেশ্যাবাড়িতে ডেকে নিয়ে যাবার কী সাজা হয়, তা আমি দেখাব।

অভিযোগের বিবরণ দিয়েই দিলেন ও. সি.। অর্থাৎ, তাঁর মেয়েকে সুবালা বেশ্যাবৃত্তিতে প্রলুব্ধ করার জন্যে ডেকেছিল।

অভয় বলল, ওর সঙ্গে একবার দেখা হতে পারে?

ও. সি. বললেন, না।

 তবু অভয় দাঁড়িয়ে রইল।

-কী হল?

অভয় বেরিয়ে এল আস্তে আস্তে। হাজতঘর অফিসের পিছনে, সে জানে অফিস না ডিঙিয়ে সেখানে যাবার উপায় নেই। কিন্তু কেমন আছে সুবালা! সেই সুবালা! যে দেশে সমাজের ভদ্রলোকদের জীবনেরই কোনও দাম নেই, সেখানে সুবালার মতো একজন দেহোপজীবিনীর প্রাণের কী মূল্য আছে। কিন্তু কার কাছে যাবে এখন অভয়। একমাত্র জীবন চৌধুরীর কথা মনে পড়ছে। কিন্তু তিনি অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী। এ সব শুনলে পরেও না জানি কী ভাববেন। গণেশবাবু আছেন। সেটা আরও খারাপ হবে। এমনিতেই তিনি চান অভয় যেন মালিপাড়া ছেড়ে একটা অন্য পাড়ায় বাসা নেয়।

তবে কী হবে সুবালার। কেমন আছে সে, কে জানে।

বাড়ি ফিরে এল অভয়। এসে চুপ করে বসে রইল দাওয়ায়। গিনি তাড়াতাড়ি কাছে এসে বলল, কেমন দেখে এলে সুবালাদিকে?

–দেখতে দেয়নি।

–কেন?

পুলিশের ইচ্ছে।

গিনি চুপ করে রইল। দূর অন্ধকারে সরে গেল।

অভয় পায়চারি করতে লাগল।

রাত গম্ভীর হয়ে এল। এই নিশীথের সুপ্তিমগ্নতার মধ্যে, সুবালার জন্যে কোথাও একটু দাগ পড়েনি। সুবালার জীবনটা সব দিক থেকেই যেন কেমন অপ্রকৃতিস্থ হয়ে উঠেছিল। সব কিছুকে। সে ঘৃণা করেছিল।

সহসা কে যেন বেড়ার কাছে এসে দাঁড়াল। ডাকল, জামাই।

অভয় তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল। কে?

আমি। রাজুমাসি পাঠালে। ওরা সুবালাকে দিয়ে গেছে। তুমি এসো।

মেয়েটি সুবালাদেরই সঙ্গিনী। অভয় বেরুতে গিয়ে একবার পিছন ফিরল। পিছনেই এসে দাঁড়িয়েছিল গিনি। সে বলল, ঘুরে এসো তুমি।

অভয় বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু মেয়েটিকে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস করল না। রাজুবালার বাড়িতে এসে যখন পৌঁছুল, তখন তার ভয়ই সত্যি হয়ে দেখা দিল। সুবালার অবস্থা খারাপ। উঠোনের ওপরে, একটা মাদুরে সে শোয়ানো। ডাক্তার দেখানোর কোনও চিহ্ন নেই। সর্বাঙ্গে আঘাতের দাগ। মাথায় মুখে রক্ত।

অভয় কাছে এসে বসল। সুবালা তাকিয়েছিল! আঙুলের ইশারায় কাছে ডাকল। অভয় ঝুঁকে পড়ল। সুবালার হাত ধরল। হিম ঠাণ্ডা হাত।

অভয় বলল, রাজুমাসি, একজন ডাক্তার ডাকা দরকার।

মাথা নড়ে উঠল সুবালার। অভয় ফিরে তাকাল। ঠোঁট নড়ল সুবালার। স্বর নেই। প্রায় ফিসফিস করে বলল, মরে যাচ্ছি।

মেয়েরা সব ঘিরে দাঁড়িয়েছে। রাজুবালা কেবল বলল, আশ্চর্য এই সুবালারও বাবা ছিল এক দারোগা।

অভয় অবাক হয়ে তাকাল রাজুবালার দিকে। রাজুবালা আপন মনে বলে গেল, ভদ্রলোকের মেয়ে, গুণী মেয়ে, বিয়ে হয়েছিল একটা ছাগলের সঙ্গে।…

সুবালা হঠাৎ বলল, প্রায় চুপিচুপি, না, মানুষই ছিল মাসি। আমি আর কাউকে খারাপ বলতে পারি না। শুধু আমি যা চেয়েছি, তা পাইনি।

সুবালার মুখটা একেবারে সাদা দেখাচ্ছে। রক্ত কালো হয়ে এসেছে। ডাকল, অভয়।

বলো।

 –হাতটা দাও।

 সুবালার ঠাণ্ডা হাতে হাত দিল অভয়। সুবালা বলল, এ নিয়ে যেন কোনও হই হুজ্জোত কোরোনা আর। এই মার খেয়ে মরা আমার ভাল হল।

হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল সুবালা। সবাই ঝুঁকে পড়ল। অভয় ডাকল, সুবালা।

চোখ বোজা অবস্থায়, সুবালা যেন হাসল। ডাকল, অভয়।

বল।

–আমি নিমির কাছে যাচ্ছি না।

অভয়ের বুকের মধ্যে কথা আটকে গেল।

 সুবালা আবার বলল, সে ছিল এক, আমি আর এক। নইলে তোমার কথা ওকে বলতাম! অভয়?

বলো।

 তুমি খুব বড় মানুষ।

সুবালা, তুমি এবার চুপ করো।

সুবালা বলল, করব। কিন্তু অভয়, তুমি ভেবেছ, বড়মানুষ দশজনের মতন হয় না।

–কেন সুবালা?

 –তুমি কাউকে একটু প্রাণ ধরে বুকে নিতে পারো না। ও সব মিথ্যে। অভয়!

বলো।

সুবালার চোখ ভেসে জল এল। ডাকল, অভয়।

অভয় বলল, বলল সুবালা।

সুবালা আবার ডাকল, অভয়।

অভয় আরও জোরে বলল, কী বলছ সুবালা।

 সুবালার ঠোঁট নড়তে লাগল, অভয় অভয়…।

 রাজুবালা বলল, অভয়, সুবালাকে জড়িয়ে ধরে রাখো। ও ভয় পাচ্ছে।

অভয় সুবালাকে জড়িয়ে ধরল। অভয়ের আলিঙ্গনের মধ্যে সুবালা মারা গেল।

.

এর পরে অনেকদিন অভয় কোথাও যায়নি। দোকানে মালপত্র প্রায় শূন্য। দরজা খুলে বসেনি সেখানে। গানের আমন্ত্রণ নেয়নি। সংসারের সঙ্গে গিনির সম্পর্ক, গিনিই জানে। আর গিনির জানার মধ্যে একমাত্র সুরীন ভামিনী।

কিন্তু অনাথ ছাড়ল না। সে অনেক বদলেছে। এখন নাকি গণেশবাবুই দলত্যাগে উদ্যত। অনাথ প্রায় রোজ আসে। টানাটানি করে বাইরে। তারপর জোর করেই অনাথ শহরের সদর পার্কের এক অনুষ্ঠানে, কবি-গানের আসর ডেকে বসল এবং জোর করেই ধরে নিয়ে গেল অভয়কে।

হারু বায়েনের ঢোলক শুনে রক্তে একটা ধ্বনি বাজল। কিন্তু চোখের সামনে ভাসতে লাগল সুবালার মুখ।

শেষ পর্যন্ত আসরে দাঁড়াল। সুবালার কাহিনী গাইল সে। সমস্ত কাহিনী, যেমনটি যা হয়েছিল। সুবালার মৃত্যু পর্যন্ত। এবং শেষ পর্যন্ত অভয় গাইল, গোটা দেশটা সুবালারই মতো অসহায়। ক্ষমতার দম্ভের কাছে, সকলেই বলির পশু।

সমস্ত শ্রোতা নতুন করে জানল সুবালার মৃত্যু কাহিনী। আসরের সবাই চিৎকার করে ধিক্কার দিল।

রাত্রে গান শেষ করে বাড়ি ফিরে অভয় অনেক দিন পরে আজ নাম ধরে ডাকল, গিনি।

দাওয়া থেকে সাড়া দিল গিনি। হ্যারিকেনের শিখাটা আস্তে আস্তে জেগে উঠল। গিনির মূর্তি জেগে উঠল আলোয়।

অভয় যেন চিনতে পারল না গিনিকে। শীর্ণ, ধুলিচ্ছিন্ন কাপড়। যেন অসুস্থ।

অভয় বলল, ঘুমোওনি।

না।

গিনির গলা সহজ। কিন্তু অনেক দিন বাদে সেও সহজ গলা শুনছে অভয়ের। তাই তার অসহজ হয়ে পড়ার ভয়।

অভয় কাছে এসে গিনির কাপড়টা হাতে তুলে দেখল। বলল, নেই বুঝি আর?

গিনি বলল, হাত-মুখ ধুয়ে এসো।

–ধোব, একটু বোসো গিনি।

 গিনি বসল। অভয় গিনির হাত টেনে নিল। নিয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল তার নত মুখের দিকে। তারপর বুকের ওপর হাতটি ধরে রেখে, সজনে গাছের ফাঁক দিয়ে, নক্ষত্র ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।

গিনি তাকাল আবার। বলল, খেতে দেব না?

অভয় সহজ আবেগে বলল, না। আমার কাছে একটু বোসো গিনি।

অভয় সহজ ভাবে বাহু দিয়ে বেষ্টন করল গিনিকে। তার মধ্যে আবেগ ছিল। উত্তেজনা ছিল না। একটি অসহায়তা ছিল। কোনও উন্মাদনা ছিল না।

গিনি নিঃশব্দ কান্নার বেগে কাঁপছে। অভয় বাধা দিল না, কিছু বলল না।

ওরা যেন পৃথিবীর সেই আদিম অন্ধকার যুগের প্রথম নরনারী। মূঢ় অন্ধ অসহায়। মানব জীবন বৃত্তান্ত যারা জানে না। যারা প্রশ্ন করতে শেখেনি। কেবল অপার বিস্ময়ে এই অপরিচিত বিশ্বের দিকে চেয়ে রয়েছে। যাদের অনুভূতির মধ্যে বিশ্বপ্রাণ আপন মনে বসে, এক বিচিত্র দুর্বোধ শব্দে তার। ভবিষ্যৎ উন্মেষের কলকাঠিগুলি নাড়ছে।

পাশেই নিমে নিদ্রিত। তার একটি নিশ্বাস পড়ল। অভয় এক হাত দিয়ে তাকে স্পর্শ করল।

অভয়ের মনে হল, তার কানে ঘর্ঘর শব্দ বাজছে। পরমুহূর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি ধাবমান বিশাল রথ। মানুষের দেহ দিয়ে সেই রথ তৈরি। জন্ম মৃত্যু সৃষ্টির বিচিত্র লীলায় তারা রত। মানুষ সেই রথ টানছে। শক্তিশালী বেগবান মানুষেরা। আর হাসি কান্না কোলাহলের প্রবল শব্দ উঠছে।

মুনি ঋষি মহৎ মানুষেরাও সেই রথের স্তম্ভে রয়েছেন। তাঁদের গম্ভীর কণ্ঠে বাণী উচ্চারিত হচ্ছে। এবং মুহূর্তে মুহূর্তে রক্ত ছিটকে উঠছে চাকা থেকে। দেহ শূন্যে পতিত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

সকল কোলাহল ছাপিয়ে কেবল একটি সুস্পষ্ট বজ্রকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, সময় নেই। এগিয়ে চলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *