১.২ অভয়ের চাকরি

০৭.

অভয়ের চাকরি পাওয়ার দিনটি সুরীনের কাছে একটি উৎসবের দিন হিসেবে অপেক্ষা করেছিল। অনাথ ও অভয়কে সাক্ষী রেখে ভামিনীকে বলেছিল, জানলি গো ভামিনী–অভয়ের যেদিন কাজ হবে সেদিনে আমি তাজা মদ খাব, তুই খাবি, অনাথ ভায়াকে খেতে হবে, অভয় বাবাজিকেও ছুঁতে হবে এটুখানি। আর বের দিনে আমি ধিতাং ধিতাং নাচব।

কাজ হওয়ার কথা শুনে সুরীন লাফাল, ঝাঁজালো মদ আনল। মদ যে সুরীন বাড়িতে খায় না, তা। নয়। হপ্তার দিনে বাড়িতে বসে মদ খায় প্রায়ই। অনাথ নাকি আগে খেত না। বড় বেশি নিটপিটে ছিল, ঘেন্নাও করত। তা ছাড়া স্বদেশি করত–লেখাপড়াজানা ভদ্রলোকদের সঙ্গে। তাঁরা মদের। নাম শুনলে মুছে যেতেন। অনাথও খেত না। এখন সেই ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা আর নেই। মাঝে মাঝে খায়। তবে নেশাখোর নয়, মাতালও নয়। ভামিনীও খায়। বরাবরই খেয়ে এসেছে। সুরীনের পাল্লায় পড়ে এখন রাশ টেনে চলে। সুরীন যেদিন বাড়িতে বসে খায়, সেইদিন ভামিনীরও একটু আধটু হয়। পুরনো জীবনের অভ্যাস। তখনকার জীবনে না খেলে ধকল সইত না। এখনও একেবারে না জুটলে কষ্ট হয় বইকী!

এ এমন কিছু ঘটনা নয়, বলার মতো বিষয়ও নয়। বিকারহীন স্বাভাবিক জীবনযাত্রারই অঙ্গ। সুরীদের কাছে এটা ভাল মন্দ বিচারের মাপ কাঠি নয়। কেউ বেশি বেলেল্লাপনা করলে নিজেরাই বিরক্ত হয়। মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে মারধোরও করে।

মদ আনল সুরীন আজ। অনাথ নিজেই বলে উঠল, নিয়ে এসো, ভাল করে নেশা করা যাক আজ একটু।

আরও দু একজন যারা আসে প্রতিদিনই–তারা খেল। সুরীন খেল। ভামিনীকে ডাকল। ভামিনীর যেন একটু বিরাগ ভাব। মুখ ভার করে বলল, না থাক। রান্নাবান্না সব পড়ে আছে।

বেসামাল হলে কে দেখবে সে-সব।

সুরীন বলল, আরে নে নে, বেসামাল তোকে হতে দিচ্ছে কে? আর হোস তো হবি, বাজারের কেনা খাবার দিয়ে চালিয়ে নোব।

মুখ ভার ছিল ভামিনীর। তবে পান ভোজনের ব্যাপারে আসলে তেমন বিরাগ ছিল না। পুরুষদের কাছ থেকে একটু ফারাকে বসে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে চুমুক দিল গেলাসে। অনাথ দিল অভয়কে, নাও বেরাদার মেজাজ খোলো।

অনাথ বলল, অভয় আপত্তি করল না। বরং খাবার আগেই তার কেমন যেন মাতাল মাতাল ভাব! বলল, আজ তবে খুব খুশির দিন খুড়ো না?

অনাথ বলল, নিশ্চয়।

 শৈলবালাও হাজির হল এসে। সে আজকাল যথেষ্ট সামলে চলে। মাতাল দেখে দেখে আর মাতালের খোয়ার সয়ে সয়ে, ঘেন্না বলে সাড়টুকুও ভোঁতা হয়ে গেছে। নিজে কোনওদিনই নেশাখোর হতে পারেনি। দশজনের মধ্যে না খেয়ে পারে না, বোধ হয় ইচ্ছেও করে। মেয়ে বড় হওয়ায় এখন সেটুকুও কালেভদ্রে। আজ একবার সাধতেই, ভামিনীর পাশে বসে পড়ল শৈলবালা। অভয়ের কাজ হয়েছে, সেই আনন্দে।

সকলেরই চোখ মুখের চেহারা বদলাল, স্বর বদলাল গলার। হাসাহাসি বকবকানি কম হল না। কিন্তু ওই সেই একই কথা, মন গুণে ধন, দেয় কোন জন। তার গতিবিধি অন্ধিসন্ধি নিজেরও কি পুরোপুরি জানা থাকে? নইলে এই আনন্দের দিনে সুরীনের মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল কেন? না, সে নিজের হাতে কাজ জোগাড় করে দিতে পারেনি অভয়কে।

তারপর কখন তাদের সবাইকে ঘিরে এখানে নেমে এল এক নিশিপাওয়া ঘোর। যেন তারা পৃথিবীর বাইরে, অন্য কোনও জগতের অন্ধকারে বসে আছে প্রেতের দল। মেয়ে পুরুষের গলা চেনা। যায় না।

কবে একদিন হরেকেষ্ট বলে একটি ছেলে এসেছিল, তিলকবালার মেয়েকে বিয়ে করেছিল এখানে। কবে আবার একদিন হরেকেষ্ট চলে গিয়েছিল, তিলকবালার মেয়ে যে-কে-সেই বারো ঘরের আঁস্তাকুড়ে। আগুনের মতো মেয়ে রম্ভা, বামুনের ছেলেকে বিয়ে করল, ভদ্রলোকেরা এসেছিল সেই বিয়েতে, কত ঢাক পেটানো হয়েছিল। খবরের কাগজেও উঠেছিল নাকি। তারপর কবে আবার সে সব ভেঙে গিয়েছিল। রম্ভা বারোবাসরের উঠোন ডিঙোতে পারেনি।

মালিপাড়ার বিচিত্র ভাঙা গড়ার কাহিনী রূপকথার মতো আওড়াতে লাগল তারা, কেন না, আজকে তারা তাদের আর একটি মেয়ের বিয়ে দেবে। ভয় তাদের, তাদের বড় সংশয়, নদীর কূলে মাটি, সে যে জলে ধুয়ে যায়। শক্ত মাটির ঠিকানা নিয়ে যুগ যুগ ধরে তারা রওনা হয়েছে। ঘুরে ফিরে আবার এসে পৌঁচেছে সেখানে।

অনাথ উঠে পড়ল। তার পিছনে পিছনে গেল অভয়। বলল, চলে যাচ্ছ খুড়ো?

অনাথ বলল, হ্যাঁ।

–ঘরে বুঝিন আমার খুড়ি বসে আছে?

অনাথ নিঃশব্দে হেসে উঠল। সামনের সেই দুটি দাঁত-হীন অন্ধকারের ভিতর থেকে হেসে বলল, মরে গেছে অনেকদিন।

–ছেলেপুলে?

–ছিল। এক মেয়ে, দুই ছেলে। মরে গেছে।

তবে ঘরে কে আর আছে?

–আমি, আর একটা ভূত।

–ভূত?

 –হ্যাঁ, ওই শালা আমাকে বড় জ্বালাতন করে।

 -কেমন করে?

আবার একটা খুড়ি আনতে বলে ঘরে। বলে, আবার একটা মেয়ে দুটো ছেলে না হলে সে ব্যাটা ভাগবে না।

বলে অনাথ আবার হাসল। বলল, আঠারো বছর বয়সে বউ ঘরে এনেছিলুম। বড় সাধ করে, অনেক লড়াই করে এনেছিলুম। তারপর কারখানার লড়াইয়ে জেলে গেছলুম। এসে শুনলুম, একে একে সব মরেছে। ভূতটা ভূত, শালা বোঝে না, ও ঘরে আর কোনওদিন ফাঁক ভরাট হবে না।

হাসতে হাসতে চলে গেল অনাথ।

অভয় আজ আর সামলাতে পারল না। উঠোনে ফিরে এসে সুরীনকে বলল, খুড়ো, এ্যাট্টা গান গাইব, কথা এসেছে মনে।

সবাই সায় দিল এক যোগে। গা টেপাটেপি করে চুপিচুপি হাসল সবাই। ভাবল অভয়ের নেশা হয়েছে।

অভয়ের কালো মুখ চকচক করছিল। সে গলা চেপে চড়া সুরে গাইল,

জগতের একটি আজব কল
তার তিন ভাগ জল, এক ভাগ থল,
বলেছে ভূ-গল।

টেনে টেনে টপ্পার সুরে গাইল অভয়। হাসাহাসি ভুলে সবাই স্তব্ধ হয়ে রইল।

কী যে দেখি মজার সোমসার
 তিন ভাগে দুখের পারাবার
আর এক ভাগে হাসি গড়া থল।
জগতের একটি আজব কল।

সুরীন ঘড়ঘড়ে গলায় বলে উঠল, যথার্থ বলেছ। তিন দুখ, এক সুখ, এই নিয়ম।

 অভয় আবার গাইল,

কাঁদিব না ভেবে কাঁদি
কাঁদিতে কাঁদিতে হাসি
আমাকে ঘিরে আছে আজব কল।

 মদের ঝোঁকে কি গানের আবেশে, কে জানে, শৈল ফোঁপাতে লাগল। সুরীন বলল, ঠিক বলেছ বাবা, ফুর্তি করতে গিয়ে দুখের ধন্দ লেগে গেল। হাসা বড় কঠিন কিনা।

কিন্তু ভামিনীর ভার ঘুচল না। তার মনের সেই বিড়ম্বনা না-ছোড়বান্দা হয়ে বুঝি লেগেই রইল।

.

০৮.

পরদিন দুপুরবেলা, না না করেও মনকে বোঝাতে পারল না ভামিনী। অভয়কে বলল, চলো একটু ঘুরে আসি।

দুপুরবেলা পাড়ায় যায় ভামিনী। কোনওদিন ডাকে না অভয়কে। অভয় বলল, কোথায় খুড়ি?

কোথায়, কোনও সর্বনাশের মধ্যে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে নাকি ভামিনী? থাক, পা বাড়িয়ে কাজ নেই। তবু ভামিনী সামলাতে পারল না। বলল, চলো, কাছে পিঠেই।

কয়েকটা বাড়ি ছাড়ালেই খাস মেয়ে-পাড়া। সেই পাড়ার মধ্য দিয়ে, বড় রাস্তার কাছাকাছি একটি দোতলা বড় বাড়িতে ঢুকল ভামিনী। অভয়কে বলল, এসো, একটু বেড়িয়ে যাই।

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই, দালানে মেয়েদের আড্ডা চোখে পড়ল। একটি বর্ষীয়সী মেয়েমানুষ মোটা গলায় বলে উঠল ভামিনীকে, কী ভাগ্যি, আমি এসেছিস্, আয় আয়। ওটি কে?

ভামিনী মুখ টিপে হেসে বলল, আমার ভাসুরপো।

 বর্ষীয়সী একমুহূর্ত তাকিয়ে কী ভাবল কে জানে! বলল, এসো বাবা, বোসো।

অভয় গোড়াতেই থমকে গিয়েছিল। গুটি চার পাঁচেক মেয়ে, বয়স সকলেরই ত্রিশের মধ্যে, বর্ষীয়সী ছাড়া। কেউ শুয়ে, কেউ আধশোয়া, বসে আছে কেউ। সকলেই অগোছাল, এলোমেলো বিস্রস্ত। বিশেষ নড়াচড়া করল না কেউ অভয়কে দেখে। পায়ের দিকে আর বুকের ওপরে কাপড় টেনে দিল দু একজন। অভয় কয়েক মুহূর্ত বিমূঢ় নত মুখে দাঁড়িয়ে, একটু দূরে বসল।

ভামিনী বলল, কই রাজুমাসি, তোমার গানের বাড়ি এমন চুপচাপ কেন?

 বর্ষীয়সী রাজুমাসি পানের ছিবড়ে হাতে নিয়ে বলল, ঝাঁটা মারো। গান শুনতে আজকাল আর কোনও শালা আসে নাকি? রেডিয়ো, কলের গান, সিনেমাতেই সে সব সাধ মিটে যায়। গান শোনার ভান করে আসে, আসলে মেয়েগুলোর জন্যেই আসে, কাজ মিটিয়ে চলে যায়। গানের বাড়ি আর নেই, যে-মেয়ে সে-মেয়ে বাড়িই আছে।

ভামিনী বলল, আমি যে সে-জন্যেই ভাসুরপোকে নিয়ে এলুম। গান বাজনার বড় ভক্ত, তাই।

রাজুমাসি তার ঢুলুঢুলু রক্তাভ চোখে সস্নেহ হেসে বলল, তাই বুঝি? এই ভর দুপুরে?

ভামিনী অভয়ের দিকে ফিরে বলল, জানলে খুব বড় গাইয়ে ছিল আমাদের রাজুমাসি। বয়সকালে এ তল্লাটের সবচেয়ে নাম করা কীর্তন-গাইয়ে ছিল। এখেনকার লোচন কবিয়ালের সঙ্গে গাইত।

রাজুবালা হেসে মুখ ঝামটা দিল, নে বাপু, আর পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটিস নে।

অভয় প্রথমে একটু থতিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভামিনী খুড়ির সঙ্গে এসেছে। সে কেন কুচিন্তা করে? তবু এতগুলি মেয়ের চোখের সামনে অস্বস্তি হল তার।

রাজুমাসি অবাক হলেও হেসে বলল, না না বাবা, ও সব কিছু নয়। কোনকালের কথা সব। আজকাল আর ও সব আছে নাকি? বেবুশ্যে বেবুশ্যেই। সেইজন্য আসে, তাই না কত। আবার গান শুনে টাকা দেবে?

বাকি মেয়েরা অভয়কে দেখে দেখে নিজেদের মধ্যে টিপে টিপে হাসছিল। একজন বলল, তোমার ভাসুরপোরই গান একখানি শোনাও না ভামিনীদি।

ভামিনী বলল, গাইবে, তোরা গা।

হেসে উঠে একজন বলল, আমরা আবার কবে গান করলুম।

–কেন, নাদু গা না।

বছর ত্রিশের নাদু, কাজল ধোঁয়া ঘুম জড়ানো চোখে হেসে বলল, ও সব পাট অনেকদিন চুকিয়েছি ভামিনীদি। হারমোনিয়া নিয়ে গান ধরলেই মিনসেরা ঘাড়ের ওপর পড়ে। বলে, গান থাক।

সকলেই হেসে উঠল খিলখিল করে।

নাদু আবার বলল, তবে সেদিন একটা রিকশাওয়ালা দু টাকা দিয়ে দুটো গান শুনে গেছে আমার, মাইরি। দুটো কেত্তন শুনেই চলে যাচ্ছে দেখে ব্যাটাকে হাত ধরে টানলুম। বললে, না, খালি গান। শুনতেই নাকি এসেছিল।

কথা শেষ হবার আগেই হেসে কুটিপাটি হল সবাই।

রাজুমাসি বলল, পারবি নাদু? পারলে গা না, বলছে ভামিনী।

নাদু নিশ্বাস ফেলে বলল, না মাসি, সত্যি পারব না, গাইতে গেলেই হাঁপ লাগে। জানো তো সবাই।

এবার আর কেউ হাসল না, সকলেই গম্ভীর হয়ে গেল। নাদু মুখ গুঁজে রইল।

রাজুমাসিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তা বটে, সত্যি রাতের ধকল কাটিয়ে গান আর আসে না।

ভামিনী বলল, আর সে কোথায়, তোমার মহারানি? শুনলুম, তাকে নিয়ে গোটা শহর জমে আছে।

রাজুমাসি বলল, সুবালা। সে এক হয়েছে আমার ওই শিষ্যি। গান জানে, গলা ভাল, গায়ও। বয়সও কাঁচা, দেখতেও ভাল, তবে ওই, বড় মেজাজ। ছোট দারোগাকে খেপিয়েছে।

কী করে?

কী করে আবার? বলেছে, গান শুনতে চান তো বসুন, নইলে পথ দেখুন। সে দারোগা মানুষ, শুনবে কেন? টানাটানি, জেদাজেদি, সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার।

-ওমা! শেষে?

–শেষে আবার কি, শাসিয়ে যাচ্ছে এসে রোজ রোজ। তা বাপু, শরীল বেচতে বসেছি, আমাদের কি চলে পুলিশের সঙ্গে বিবাদ? এখন জেদাজেদির ব্যাপার দাঁড়িয়েছে। সুবালারও জেদ, ওর সঙ্গে ঘরে থাকব না।

নাদু বলে উঠল, তবে বেশি দিন আর নয়, সুবলির জেদও ভাঙবে। আইন তো নেই খুশি মতো চলবে। খদ্দের কড়ি ফেলবে, খেয়াল মেটাবে।

কথা শেষ হবার আগেই সুবালা ঢুকল হাই তুলতে তুলতে। আঁচল লুটাচ্ছে মাটিতে, খোলা চুল ছড়ানো ঘাড়ে পিঠে। বয়স বোধ হয় বাইশ চব্বিশের ওপরে নয়। রং কটা-ই, তার ওপরেও পাউডার বুলানো আছে। পান খাওয়া ঠোঁট একটু বাড়াবাড়ি রকমের লাল। বলতে বলতেই ঢুকল, সুবলির আবার কী খোয়ার হচ্ছে শুনি?

নাদু বলল, তোমার গুণকেত্তন হচ্ছে।

ততক্ষণে ভামিনীকে পেরিয়ে সুবালার নজর পড়েছে অভয়ের ওপর। আঁচল তুলতে তুলতে। বলল, এ কে?

জবাব দিল ভামিনী, আমার ভাসুরপো।

–অ! ঠোঁট বাঁকিয়ে, অপাঙ্গে তাকিয়ে একবার দেখল সুবালা অভয়কে। অভয়ও তাকিয়েছিল, চোখ নামিয়ে নিয়েছে। রূপ আছে সুবালার, চাউনিটি খর, একটু যেন অ-ভক্তির আভাস, কথায়ও ধার। ভাবভঙ্গি ভাল লাগল না অভয়ের। যেন পালাতে পারলেই বাঁচে। খুড়ি আর জায়গা পেল না, এখানে এল।

ভামিনী বলল, অ আ নয়, একখানি গান শোনাতে হবে আমার ভাসুর-পোকে।

সুবালা বলল, তোমার ভাসুরপোর সখ আছে তালে খুব?

নাদুরা হেসে উঠল সবাই। ভামিনী বলল, সখ নয়, গুণী মানুষ, কবিয়াল, বুঝেছ? সেই জন্যে নিয়ে এসেছি।

অভয় তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না, ছি ছি, কী যে বলো তুমি খুড়ি।

অর্বাচীন ভঙ্গিটুকু দেখে বোধ হয় সুবালার আবার একটু ঠোঁট কোঁচকাল। হারমোনিয়াম নিয়ে এল একটি ঝি।

রাজুমাসি বলল, তবলা বাজাবার লোক নেই, নইলে—

গানের নামে সঙ্কোচ একটু আলগা হল অভয়ের। গাঁয়ে নিতাই ভটচাযের সঙ্গে সঙ্গত করে বিদ্যেটি একটু আয়ত্ত্ব করেছে অভয়। তার চেয়েও পাখোয়াজ ভাল আসে তার হাতে। বলে উঠল, থাকলে আনেন, এটটু ঠ্যাকা দিতে পারব।

রাজু বলল, খুব ভাল। যা নিয়ে আয় পুতুল বাঁয়া তবলাটা।

ভাব-ভঙ্গিতে বাঁকাচোরা বলে মনে হয় সুবালাকে, কিন্তু হারমোনিয়ম নিয়ে বসতে সাধাসাধি করতে হল না। রিডের ওপর তার আঙুল চালানো দেখে অভয় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। ওই বস্তুটি সে সুবিধে করতে পারে না।

কয়েক ফেরতা আঙুল চালিয়ে সুবালা, বিদ্যেধরী নই বাপু ভামিনীদি, ফরমায়েশ মতো গাইতে পারিনে। পারলে নাকি কলকাতার ভাল জায়গায় পাত্তা পাওয়া যেত।

নাদু বলল, মুখপুড়ি!

 বাকিরা হেসে উঠল। রাজুমাসি বলল, যা খুশি গা না একখানা।

অভয় বাঁয়া-তবলা এক আধটি ঠোকা দিয়ে মাথা নিচু করে আছে।

 সুবালা গজলের ঢং-এ গান ধরল,

হাসতে পার, হাসো বঁধু
মানা কিছু নাই গো
বিনা প্রেমে হাসির মধু
প্রাণে পরশ নাই গো।

নাদু-ই তুড়ি মেরে বলল, খাসা।

খাসা-ই। গলাটি সুবালার চাঁছাছোলা, চড়ানো কিন্তু মিষ্টি।

গান শেষ হতে অভয়ই আগে বলল, বাঃ, চমৎকার!

 নাদুই আবার বলল চোখ ঘুরিয়ে, দিব্যি গেলে বলছ তো?

 ভামিনী ধমকে উঠল, দূর ছুঁড়ি, বকিসনে।

সুবালা বলল অভয়কে, তোমার হাতটিও ভাল চলে দেখছি। এবার গানের পরখ হয়ে যাক।

অত বড় জোয়ান পুরুষটা। তাড়াতাড়ি ভামিনীর দিকে ফিরে বলল, খুড়ি এখেনে আমি গাইতে পারব না।

সুবালা একটু অবাক হয়ে তাকাল ভামিনীর দিকে। আশ্চর্য, ভামিনীও তার দিকেই তাকিয়েছিল। চোখাচোখি হতেই ইশারা করল, গাইতে বল।

সুবালা বলল, তা বললে শুনব না, শোধবোধ হোক।

 অভয় বলল, কিন্তু ও সব ঢঙের গান যে জানি নে। হারমোনিয়া বাজাতে পারিনে।

 রাজুমাসি বলল, যেমন ঢঙে তোমার আসে, তেমনই গাও। হারমোনিয়ার দরকারই বা কী?

অভয় মাটিতে আঙুলের আঁক কেটে বলল, পদাবলী শুনবেন?

–তাই হোক।

যে ভাবের ভাবী, তার এমনি দশা। গান শুনে অভয়ের সব আড়ষ্টতা গেল। সে গলা নামিয়ে গাইল,

সখি একি এ পীরিতি
নাহি জানি রীতি
পরাণ রাখিতে নারি।
আসে যদি কালা
তুষিবে অবলা
পরাণ ধরিতে পারি।

এবারেও নাদু-ই প্রথম অবাক হয়ে বলল, ওমা, এ যে ধুকড়ির মধ্যে খাসা চাল গো!

রাজুমাসি বলল, বাঃ! গলাটি তো বেশ। ভাব আছে খুব।

বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাজু। এককালে ওই সব গানেই তার খ্যাতি ছিল। তখন প্রতি বছর মাঘ মাসে ধুলোটের সময় যেত নবদ্বীপ। এই নাদুকেই কতবার নিয়ে গেছে। বড় বড় লেখাপড়া-জানা মহাজনদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে কত। বেবুশ্যে ছিল বলে তাঁরা গুণের অনাদর। করেননি কোনওদিন। কত কথা মনে পড়ছে।

সুবালাও অবাক হয়ে তাকিয়েছিল অভয়ের দিকে। কাছে উঠে এসে বলল, মাইরি, চমৎকার হয়েছে, এমন কেত্তন আমিও গাইতে পারিনে। আর একখানা হোক।

ইতিমধ্যে একটি লোক এসে দাঁড়াল সিঁড়ির মুখে। মুখে হাসি, ভাবে ভঙ্গিতে বিশেষ ব্যস্ত। বলল, কই গো নাদুমণি, তাড়াতাড়ি এসো, আমাকে আবার সাড়ে চারটের খেয়া ধরতে হবে।

বাড়ি ফিরে যাবার পথে যেন বিশেষ কাজে এসেছে। নাদু বলল মুখ ঝামটা দিয়ে, রোজ রোজ এক ফ্যাচাং। সময় মতো বউয়ের কাছে ফিরতে হবে, আবার এখেনেও পাক দিয়ে যেতে হবে, এতটা না হলেই নয়? সময় অসময় আছে তো। হাত মুখ ধোবার সময়

লোকটা বলল, এই দেখো, এক মিনিট কাটিয়ে দিলে, আর মাত্র সতর মিনিট সময় আছে, আমাকে আবার ঘাট অবধি যেতে হবে, এসো এসো।

রাজুবালা বলল বিরক্ত চাপা গলায়, যা বাপু যা, বাঁধা খদ্দের ফেরাসনি, মুখে হাসি রাখ।

অভয় অবাক হয়ে তাকিয়েছিল লোকটির দিকে। নাদু উঠে গেল। ভামিনী বলল চলো, যাই।

সুবালা ছাড়ল না। বলল, ইস, আর একটা গান শুনব বললুম যে?

 ভামিনী যেন একটু কেমন করে হাসে সুবালার দিকে চেয়ে। বলল, ভাল লাগল?

 সুবালা বলল, তবে?

তবে আজ আর নয়, বেলা পড়ে এল। ভাব করে দিয়ে গেলুম, পাঠিয়ে দেব, ঘরে বসে গান শুনো।

অভয় নীরব। ভামিনীর সঙ্গে সঙ্গে নেমে গেল নীচে। সুবালা আর পুতুলও এল পিছনে পিছনে। ভামিনী বলল, দারোগার সঙ্গে ভাব করে ফেলিস সুবলি।

সুবালা বলল, তা করব। আঁস্তাকুড়ের মাংস, কুকুরের সঙ্গে লড়াই চলে? কিন্তু তুমি আসছ তো আবার ভাসুরপোকে নিয়ে।

–আসব।

অভয়ের বড় অস্বস্তি। তার মনে হল, যেন সুবালার নজর খোঁচার মতো বিঁধে আছে তার গায়ে।

হঠাৎ আবার বলল ভামিনী, তবে কথা দিতে পারিনে। ভাসুরপো আমার শৈলদির মেয়ে নিমিকে বে করছে শিগগিরিই। তখন কি আর আসতে চাইবে?

সুবালা অভয়ের দিকে ফিরে বলল, জবাবটা তাহলে শুনেই রাখি।

কোমরে হাত দিয়ে, সুবালা চোখের মণি দুটি কোণে নিয়ে গেল।

অভয় অসঙ্কোচ সারল্যে বলল, আসব।

পুতুল হেসে বলল, মনে থাকে যেন।

.

০৯.

অনাথের সঙ্গে কারখানায় গেল অভয়। আগেই নিশ্চয় অনাথ আসর তৈরি করে রেখেছিল। কারখানার মতো একটি অপরিচিত জায়গায় এসেও কোনও অসুবিধা হল না তার। প্রথম দিনই আলাপ হয়ে গেল অনেকের সঙ্গে।

মেশিন ঘরে ঢুকে বলল অনাথ, কেমন লাগছে?

কথা শুনতে পেল না অভয়। মেশিনের তীব্র শব্দে কানে তালা লেগে যায়। এখানে ইশারায় কথা হয়। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল অনাথ, কেমন বুঝছ?

হেসে ঘাড় নাড়ল অভয়। এখনও কিছুই বোঝেনি সে।

অভয়ের নাকে যেন কেরোসিন তেলের গন্ধ লাগছে। মেঝেতেও পড়েছে তেল আর ফেঁসোর আস্তরণ। হাজিরা-বাবুর কাছ থেকে কাগজ নিয়ে লেবার অফিস ঘুরে এল অনাথ অভয়কে নিয়ে। হরি মিস্তিরির বয় হিসেবে কাজ পেল অভয়। মনোযোগ দিয়ে কাজ করলে, কালে পাকা মিস্তিরি হয়ে উঠতে পারবে।

বুড়ো হরি মিস্তিরি অভয়ের ঘাড়ে হাত দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ঘুষ দিতে হবে কিন্তু।

 অনাথ বলল, কী রকম ঘুষ, সেটা বলে দাও।

হরি বলল, গান। গান শোনাতে হবে কিন্তু আমাকে।

আরও কয়েকজন এল এদিক ওদিক থেকে। সভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দু তিনজন মেয়েমানুষও এসে দাঁড়াল। তার মধ্যে একজনই বাঙালি মেয়ে। মুখে পান, বয়স প্রায় ভামিনীর মতোই।

হরি তাকে উদ্দেশ করে বলল, নে, দেখে রাখ। এখনও ভাল আছে, চেষ্টা চরিত্তির করে দ্যাখ, খারাপ করা যায় কিনা।

তারা নিজেদের মধ্যেই চেঁচিয়ে ঠাট্টা তামাশা শুরু করল। সে-সব ঠাট্টা তামাশার কথা শুনলে কান ঝাঁ ঝাঁ করে। একজন তো সেই মেয়েমানুষটির গায়ে চিমটি কেটেই দিল। অনাথ বলে উঠল, এই দেখ, এখুনি সায়েব আসবে কি ওভারসিয়ার এসে পড়বে, এরা সব মেলা লাগিয়ে দিল। যা যা, সব কাজে যা। হরিদা, তা হলে রইল তোমার শাকরেদ। নিজের মতনটি করে নিয়ো।

নিজের মতনটিই করে নিল হরি। ভাল করে হাতে খড়ি দিল প্রথম কাজের। এটাকে কী বলে? রেঞ্চ। এটা? হাম্বর। ওটা? শাপটু (শ্যাফট)। মাপবে কী দিয়ে? গজ দিয়ে। গজ চেনায় হরি। অভয়কে। অর্থাৎ স্কেল। নইলে কোনওদিন পাকা মিস্তিরি হতে পারবে না। গান বাঁধতে হলে, কথার মিল চাই, মাত্রা চাই সুরের, নয়? এও সেইরকম। গোঁজামিলের ঠাঁই নেই এখানে। গানে গোঁজামিল দিলে কী হয়? ফাঁকি হয়।

রোজ বোঝায় হরি। দুয়ে দুয়ে কত হয়?

 চার।

উঁহু। চার নয়। ছেলেবয়েসে যখন কড় গুনবে, তখন চার, তারপরে পাঁচ। কেন? না, এত মাপ-জোক নিক্তির ওজন করে, কী করলে? পয়সা করলে। অর্থাৎ কি না, পাঁচ নম্বর এল তোমার হাতে। মাপ-জোক গোনাগাঁথা কি আর মিছিমিছি হয়? তা নয়, কলের জন্যে হয়। নইলে বুঝতে। হবে, গোঁজামিল আছে। যন্তরের ওইটি কাজ, মানুষের মতো। মানুষের একে আর একে কত হয়? তিন হয়। তবে, সেটা হল তত্ত্বের কথা। চেপে যাও সে কথা। দুয়ে আর দুয়ের মিলটা খাঁটি করো আগে, তবে তুমি পাকা মিস্তিরি। করতে পারলে, পাঁচ নম্বরের ফল আপনি হাতে এসে পড়বে। তাই রাগ করে বলতে হয়, হাতের পাঁচ বুঝি? মানে কথা হল গিয়ে, হাতের পাঁচ হাতেই আছে বটে, কিন্তু পাওয়া কি সহজ কথা?

অভয় অবাক মানে। যন্ত্রের কথা, শুনে মনে হয়, এখানে গান শোনাবে ঠাট্টার মতো। কিন্তু হরি মিস্তিরি যা বলে, সেও জীবের তত্ত্ব। গানের মতোই তার ছাঁদ ছন্দ আছে। গান বাঁধলেই হয়।

হরি মিস্তিরিও বোঝে, ছেলে চুম্বক। ঠিক জিনিসটি দিলেই টেনে নিতে পারে। হরি গজ মেপে দেখিয়ে বলে, একে বলে ডাইমেটার (ডায়ামেটার), ওকে বলে ডাইমেন (ডাইমেনশন)। এক ইঞ্চিকে একশো ভাগে ভাগ বোঝায়। হাজার ভাগও বোঝায়। বোঝায় নকশা দেখিয়ে দেখিয়ে। বুঝিয়ে জিজ্ঞেস করে, কেমন বুঝলে?

অভয় বলে, বুঝলুম, বেহিসেবি মরে।

বুড়ো হরি মিস্তিরির মুখের ভাঁজে ভাঁজে চাপা হাসি দেখা যায়। বলে, কী রকম?

অভয় বলে, কানি কাপড়ে কোঁচা হয় না। করতে গেলে, শরীলে বেড় পায় না, দিগম্বর হতে হয়।

–আচ্ছা? 

–নিয়মের লাজলজ্জা নেই। একটুখানি এদিক ওদিক হলে সব ভণ্ডুল করে দেয়।

 –হাঁ।

ইঞ্চির যখন হাজার ভাগ হয়, তখন

ভুবনের কোথাও ফাঁক নাই গো।
যারে বলে শূন্য
তার মধ্যেও আছেন গণ্য
বিন্দু মহাশয় গো।

হরি মিস্তিরি বলে মাথা দুলিয়ে, বহুত আচ্ছা ব্যাটা।

অভয় আবার গায়,

অভয় যেন সমঝে চলে।
ভাল মন্দ যা আছে তার
কিছুতে কিছু পাবে না পার
ফেলা কিছুই যাবে না গো।

হরি তার মেশিন ঘাঁটা থাবায় অভয়কে চাপড়ে বলে, আরে বাপরে বাপরে বাপ।

তাদের চিৎকার শুনে এদিক ওদিকের লোকেরাও ছুটে আসে। আসে মেয়ে-পুরুষ, দুই-ই। ডিপার্টমেন্টের সর্দারও আসে খেঁকিয়ে, এই শালারা কাজে ফাঁকি দিচ্ছিস।

কিন্তু সেও ভিড়ে যায়। অভয় তাদের নতুন আকর্ষণ হয়েছে।

অভয় ভেবে খুশি, সংসারে সব ভাল, সবাই ভাল। একদল মিস্তিরি ধরে বসে, তাদের আখড়ায় নিয়ে যাবে। যাত্রার দলের আখড়া। বিবেকের পার্টটা নিতে হবে অভয়কে। কেউ বলে এসে, কবি গানের আসর করবে। অভয়কে গাইতে হবে।

জবাব দেয় হরি, নয় তো অনাথ ; এখন নয়। দু দিন যাক।

ভোরবেলা আসে অভয়। বেলা এগারোটায় খেতে যায়। আবার আসে একটায়।

ওদিকে শৈলবালা আর সুরীন দিন ক্ষণ নিয়ে বড় ব্যস্ত। বিয়ের দিন। তবে পাকা মানুষ সুরীন। শৈলবালাকে বলেছে, বিয়ের আগেই শৈলদিদি নিমির নামে বাড়ি-ঘর লিখে পড়ে দিক। কেন না, মানুষের মন। কখন কোনদিকে যায়, বলা যায় না।

আপত্তি করেনি শৈল। মেয়েকে সব লিখে-পড়ে দিয়ে, অভয়কে এসে বলেছে, বাবা, সব তোমাদের জন্যে রেখে গেলুম। মলে দুটি কাঠ দিয়ে আমাকে একটু পুড়িয়ো, আর কিছু চাই নে।

ভামিনী শুধু দেখেছে। তার হ্যাঁ নেই, নাও নেই। সুবালার কাছে অভয়কে নিয়ে যাওয়ার বড় সাধ তার। কিন্তু সুযোগ পাওয়া যায় না। সন্ধ্যাবেলা যখন অভয় ফিরে আসে, তখন সুরীনেরও ফিরে আসার সময়। সুরীনের কারখানা দূরে, আসতে তার দেরি হয়। ভামিনী বলে অভয়কে, সুবালাদের ওখেনে একটু যেয়ো, অনেক করে বলেছে। তোমার গান শুনবে একটু।

কথা একেবারে মিথ্যে নয়, সুবালা বলেছে। এমনি, ভাল মনে বলেছে। ভামিনী তাকে তার মনের কথা বলতে পারেনি। কোনখানে দিয়ে কী কথা বেরিয়ে পড়বে, সুরীন আর আস্ত রাখবে। না। তবে এ সংসারের কোথায় ফাঁক, তার খবর একটু-আধটু জানা আছে ভামিনীর। তাই সুবালাকে গিয়ে বলেছে, আমার ভাসুরপোকে নিয়ে হয়েছে জ্বালা।

কেন?

না, সুবালাকে দেখে গিয়ে অবধি, ছেলেটার নাকি মন ফসফস্ করছে। বলে, খুড়ি, মেয়েটি দেখতে খাসা, গলাটি আরও খাসা।

অকপটে মিথ্যে বলে, খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ার ফাঁকে সুবালার মুখ দেখে নেয়। বেশ্যা হলেও, মেয়েমানুষের মন। জোয়ান পুরুষের প্রশংসায় মনে একটু ছোপ লাগে বইকী।

সুবালা চোখ ঘুরিয়ে বলে, পছন্দ যখন হয়েছে, আসতে বলো একদিন।

ভামিনী আরও রং চড়ায়, বলে, তোরসঙ্গে বসে নাকি তবলা সঙ্গত করতে ইচ্ছে করে। আর খালি বলে, তোমাদের সুবালা নিমির চেয়ে দেখতে ভাল, কী বলল খুড়ি?

হাসতে হাসতে আবার বলে, বুঝেছ তো, ছেলের আমার কোথায় ঘুন ধরেছে?

নিমির নিন্দে সুবালার কতখানি ভাল লেগেছে, বোঝা যায় না। হেসে বলে, নিমিরটা নিমিরই থাক, মেয়েটা ভাল।

ভামিনী ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, তুই আর ঘেন্না ধরাসনি বাপু। পাড়ার কোন ছোঁড়াকে বাকি রেখেছে, তা তো জানিনে।

সুবালা বলে, তা হোকগে দিদি, ওকথায় কাজ কী?

–না, এমনি। তুই বললি। আর ছোঁড়া দিন-রাত তোর কথা বলে।

সুবালা বলে, তা এখেনে দরজা আগলে তো বসে নেই কেউ, এলেই তো পারে। লোকটার গলা কিন্তু ভালই।

ভামিনী মনে মনে হেসেছে, সুবালার মতো মেয়েও যখন সরাসরি আসতে বলে, তখন কিছু না হোক, খেলা করবার ইচ্ছে একটু আছে। বলে, মুখপোড়া বলেই খালাস, সময় পেলে তো আসবে। কাজ হয়েছে যে।

সুবালা বলে, রাতে তো আর কাজ করে না।

–তোর যে তখন কাজের সময়? মাসি বিরক্ত হবে।

ঠোঁট কুঁচকে বলে সুবালা, তবে এসে কাজ নেই বাপু।

ভামিনী ভয় পেয়ে হেসে বলে, তাই না বটে! উঠি আজ।

উঠে পড়ে। একদিনের কথা তো নয়। প্রায়ই বলে থেকে থেকে। যে জ্বালা ভামিনীর জুড়োবার নয়, সিদ্ধিলাভের আশা নেই, অনর্থক পুড়ে মরে সেই আগুনে। সর্বনাশের মতো, তার ঝাঁপি থেকে ছেড়ে দেওয়া সাপ যে কোনখান দিয়ে কোথায় হাজির হতে পারে, নিজেও জানে না।

তারপর কথায় কথায় সুবালাকে বলেই ফেলে, একদিন গেলেও তো পারিস দুকুরের ঘোরে। ওই ছোঁড়ার জন্যে বলছিনে তা বলে। এমনি। এই তো ক-পা।

সুবালা বলে ঠোঁট উলটে, ঘেন্না করে বড়ডো, কিছু মনে কোরো না। গেরস্থদের সহ্য হয়, তারা গেরস্থ, তোমাদের পাড়ার হাফ-গেরস্থদের অত নজর কটকটানি সহ্য হয় না।

ভামিনী বলে, ঝাঁটা মারো অমন নজরের মুখে। নজর করবে তো করবে, ইয়ে দেখিয়ে চলে যাবি।

একদিন আসে সত্যি সত্যি সুবালা। কিন্তু তখন অভয় বেরিয়ে গেছে কারখানায়। ভামিনী যেন আশা পায়।

সুবালা বলে, কই, আমার পছন্দ করা নাগর কোথায় গো?

–আ পোড়াকপাল, সে যে বেরিয়ে গেল।

সুবালা বলে, ভালই হয়েছে। সজেবেলায় যেতে বলো। দু-ফেরতা না হয় বাঁয়া তবলায় হাত চালিয়ে আসবে। তাতে তো আর মাসির ক্ষতি নেই?

কারখানা থেকে ফিরে এসে অভয়ের মন কেমন করে। নিমিকে একটু দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু লজ্জা হয়, হট করে গিয়ে উঠতে পারে না।

ভামিনী খুড়ির অনুরোধে পা বাড়ায় মাঝে মাঝে সুবালাদের বাড়ির দিকে। নিজের মনকে তো ফাঁকি দিয়ে লাভ নেই। সুবালার গান শোনার বড় ইচ্ছে হয়।

কিন্তু মনটা আনচান করে নিমির জন্যেই বেশি। কিছু না হোক, বাড়ির কাছ দিয়ে একটু ঘুরে আসতেও যেন ভাল লাগে। ওই বাড়ির কাছেই, পাড়ার পুরুষদের যাত্রাগানের মহড়া দেবার ঘর। সেখানেও উঁকিঝুঁকি মারে অভয়। দু একজন বাদ দিলে, সবাই হেঁকে ডেকে ওঠে, আরে এসো এসো, জামাই এসো।

দু একজনের মধ্যে বিশু আর তার সাঙ্গপাঙ্গ। ঘরে ঢুকলেও, বিশু কথা বলে না। বরং ধমকে ওঠে সবাইকে, নাও, এখন হবুজামাইকে নিয়ে র‍্যালা করো, এদিকে সব পড়ে থাক। যত সব উটকো ঝামেলা এসে হাজির।

বিশুর ওজন আছে আখড়ায়। গলা কাঁপিয়ে পার্টও বলতে পারে ভাল, আর বড় বড় পার্ট করে। কিন্তু অভয়কে আমল দেয় না একেবারে। শৈলবালার বাড়িতে লোকটির অবাধ গতি। নিমির সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথাও বলতে দেখেছে।

ওখানে গেলে সবাই গান গাইতে বলে। ইচ্ছে থাকলেও গায় না। বিশুর সামনে গলা খুলতে চায় না তার। যে আশায় তবু যায় উঁকিঝুঁকি মারতে, তার উদ্দেশ্য আলাদা। মনে বেজায় রং লেগে গেছে, নিমিকে একবারটি দেখতে ইচ্ছে করে।

দেখা যে না হয় একেবারে, তা নয়। কিন্তু নিমি যেন তেমন নজর করে না।

কিন্তু না করার দিনও শেষ হয়ে এল। আর দেরি নেই। সেদিনও কি নিমি না তাকিয়ে পারবে?

.

১০.

মানুষ চিরদিন মনের অভাব মেটাতে চায় এবং সে চাওয়াটা তার নিজেরও অগোচরে থেকে যায়। নিমির দেখা পাওয়ার প্রত্যাশা যখন মিটছে না, সে সময়ে সুবালার আমন্ত্রণটা, অজান্তে সাড়া দিয়ে উঠল।

সুবালাদের বাড়ির দরজার কাছে এসে দাঁড়াল অভয়। ইতিমধ্যেই বারো বাসরের সদর দরজায় দুটি মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। অভয়ের সঙ্কোচ হল। একেবারে একলা কখনও আসেনি। এ সময়ে আসাটা উচিত হল কি না, সেটাও সংশয়।

একটি মেয়েই জিজ্ঞেস করল, কী হল নাগরের?

দ্বিতীয় মেয়েটি বলল, ভাবনায় পড়ে গেছে। আসবে, কি আসবে না—

দু জনেই হেসে উঠল।

অভয়ও হাসল। কাছে এসে বলল, ভাবাভাবি নয় গো ঠাকরুণ। তোমাদের সুবালার দেখা পাওয়া যাবে এখন?

দু জনেই চমকে হেসে উঠল। ওমা, এ সেই ভামিনীদিদির ভাসুরপো লো! একজন বলল, সন্ধেবেলাতেই ধোঁকা। আজকে আর জুটবে না কিছু।

আর একজন অভয়কে বলল কপট দীর্ঘশ্বাসে, ওপর তলার মানুষের কাছে এসেছ ভাই, চলে যাও সোজা সিঁড়ি দিয়ে।

অভয় উঠোন পার হয়ে সিঁড়িতে পা দিল। কথাবার্তা শোনা যায় না বিশেষ। সবই যেন একটু নিঝুম ভাব। ঘরে ঘরে বাতি আছে, মানুষও দেখা যায়। কিন্তু কলরব নেই। কেবল কোন ঘর থেকে মেয়েমানুষের মোটা গলায় গান শোনা যাচ্ছে। গান নয়, একঘেয়ে একটা সুর, কথাগুলি জড়ানো জড়ানো। হঠাৎ মনে হয়, একটা শোকমগ্ন নিঝুম বাড়ির কোনও অন্ধ কোণে বসে কে। কাঁদছে ইনিয়ে-বিনিয়ে।

ওপরে সারি সারি তিনটি ঘর একদিকে। একটা ঘরের দরজা বন্ধ। আর একটি ঘরে বাতি জ্বলছে, লোক নেই। তৃতীয় ঘরের বাইরের বারান্দায় একটি মেয়ে, তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। পায়ের শব্দে ফিরে তাকাল।

অভয় দেখল সুবালা। বাঁ হাতে তার ছোট একটি কাঁচের গেলাস। অভয়কে দেখে কাঁচের গেলাসের তরল পদার্থটুকু চুমুক দিয়ে শেষ করে গেলাসটি বাইরেই রেখে ঘরে ঢুকল।

এ সুবালা, অভয়ের সেদিনের দেখা দুপুরের সুবালা নয়। এ সুবালার মুখে রং, চোখে কাজল। বুকের অনেকখানি কাটা পাতলা লাল জামা, তার সঙ্গে মানানসই পাতলা লাল শাড়িতে রক্তাম্বরী সুবালা। বারো বাসরের চোখ পোড়াবার মতো আগুন তার সঙ্গে। হাতে গলায় গিল্টির অলঙ্কার। ঈষৎ আরক্ত চোখ চকচক করছে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। চাউনি যেন কেটে কেটে বসে।

অভয়কে দেখে একটু বুঝি লজ্জা পেল সুবালা। ঠোঁট মুছে হেসে বলল, দম নিয়ে নিচ্ছি। নইলে পারা যায় না। এসো, বস।

সুবালার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কথা জোগায় না অভয়ের মুখে। লজ্জা হয়, সঙ্কোচ হয়। মেয়েমানুষের রঙ্গিণী রূপ দেখে পুরুষের যে লজ্জা ও সঙ্কোচ কাটানো যায় না। তা ছাড়া কেমন একটু ভয় ভয়ও করে। অপরিচয়ের ভয়। ভামিনীর সঙ্গে সেদিন দুপুরের অবসরে কিছুটা ঘরোয়া পরিবেশ ছিল। যাত্রার আসরের আড়ালে সাজঘরের মতো যে যার নিজের পরিচয়ে মন খুলে কথা বলতে পেরেছিল সেখানে। এখানে এখন পুরোপুরি আসর, রং মেখে যে যার ভূমিকায় অবতীর্ণ। মিথ্যে দিয়ে সত্যকে জাহির করার মুনশিয়ানা যত, তত পুরস্কার আর হাততালি এখানে। দূরের গাঁয়ে গঞ্জে মেলায় যে এ সব দেখেনি অভয়, তা নয়। অনেক দেখেছে। কিন্তু শহরের বিজলি বাতি ঝলসানো দোতলা বাড়ির এমন সাজানো গোছানো ঘরে সুবালার মতো মেয়ে নয় তারা। ভয় করে বইকী। নির্ভয় ক্রেতা হিসেবেও কোনওদিন মেয়েমানুষের দিকে তাকিয়ে দেখেনি। এখানে অস্বস্তি। যাবে কেমন করে?

অভয় বলল, মনটা ভাল গাইছে না, অসময়ে এসে পড়েছি নাকি?

সুবালার গোটা শরীরে যেন তরল আগুনের ঢেউ খেলে যায়। হাসি নয়, তবু হাসির মতোই কী যে দপদপ করে দুই চোখে। বলল, ঘরে আসার এই তো সময় গো। অসময় দেখলে কোথা। কিন্তু অত ভক্তি করে কথা বলো না বাপু। আর আমার নাম ধরে ডেকো। দাঁড়িয়ে কেন, বসো।

–এই যে বসি।

সুবালা হাহা করে উঠল, না না, মাটিতে নয় বিছানায় উঠে বসো।

অভয় ততক্ষণে পরিষ্কার চকচকে মেঝের ওপর বসে পড়েছে। সাজানো ধবধবে সাদা বিছানার দিকে চেয়ে প্রায় সভয়ে বলল, ওখানে বসতে পারব না।

সুবালী খিলখিল করে হেসে উঠল। ক্রমে হাসিটা উঁচু পদায় উঠতে উঠতে একটি অস্বাভাবিক মত্ততায়, বিছানায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ল সুবালা।

পুতুল এল ছুটে—কী হল রে সুবলি?

হাসতে হাসতেই হাত নেড়ে জানাল সুবালা, কিছু হয়নি।

পুতুল অবাক হয়ে অভয়ের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, তা-ই ভাল। আমি ভাবলুম, লোক জন আসতে দেখলুম না, সুবলি তো মুখ গোমড়া করেই আছে সব সময়, তার আবার এত হাসি কীসের?

সুবালা হাসির দমকে দমকেই বলল, তা না হেসে কী করি বল? বিছানায় উঠে বসতে বললুম, বললে, পারবে না।

আর একচোট হেসে নিয়ে আবার বলল, ভয়ে, জানিস পুতুল, ভয়ে ভয়ে এ সব বলছে। যদি পায়ে পড়ে টানাটানি করি, সেই ভয়ে।

পুতুল তাকিয়েছিল বিব্রত অভয়ের দিকে। অভয় তার স্বভাবসিদ্ধ হাসি নিয়ে মাটিতে আঙুল ঘষতে ঘষতে বলল, না, মানে তা নয়। একটু গান শুনব বলে এয়েছি। আর শত হলেও নারী বলে কথা, মানে মেয়েমানুষ, তাদের একটা মান্যি আছে তো। তাই আর কি

সুবালা তখনও হাসছে। ইতিমধ্যেই দু চোখ তার কোকিলের মতো রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে। সমস্ত মুখে রক্তাভা, একটি অস্পষ্ট নেশার মত্ততা তার চোখে, ভাব ভঙ্গিতে। বলল, মান্যি করার অনেক মেয়েমানুষ পাবে, এই বেবুশ্যেকে কেন? নাও এবার গান ধর। দে তো পুতুল, হারমোনিয়মটা নামিয়ে দে।

পুতুল হারমোনিয়ম নামিয়ে দিল অভয়ের সামনে। অভয় বলল, আমি নয়, ওকেই দাও, আমি একটু বাঁয়া তবলা বাজাব। হারমোনিয়াম বাজাতে পারিনে।

সুবালা বিছানা থেকে নেমে বলল, তা বললে শুনব না। আগে তোমাকেই গাইতে হবে।

অভয় হাত জোড় করে বলল, জমবে না। তেমন গান তো আমি জানি না। তোমার গান শুনব বলেই আসা।

ভামিনীর কথা স্মরণ করেই বোধহয় সুবালা চোখ ঘুরিয়ে হেসে বলল, শুধু গান শুনতেই আসা? আর কিছু নয়? তা হলে সুবলি বেশ্যার দেমাকই থাকে না গো।

বলে আর মত্ত খিলখিল হাসিতে লুটিয়ে লুটিয়ে পড়ে সুবালা।  

পুতুল বলল, সন্ধে না হতেই চড়িয়ে মরেছিস বুঝি?

সুবালা বলল, চড়িয়ে মরি, না চড়িয়েও মরি। মরার আর বাকি কোথায় লো মুখপুড়ি। বলে সুবালা কোলের কাছে হারমোনিয়ম টেনে নিয়ে অভয়কে বলল, কিন্তু ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে না।

পুতুল বলল, আমি পালাচ্ছি।

সে চলে গেল। সুবালার আঙুল হারমোনিয়মের রিডের উপর দ্রুতগামী ইঁদুরের মতো পিলপিল করে খাদ থেকে চড়া, চড়া থেকে খাদে গেল নেমে।

কান খাড়া করে শুনতে লাগল অভয়, চোখে উদ্দীপনা। সুর যেন চেনা চেনা লাগে তার।

সুবালা গান ধরল,

আ বে প্রাণ! শুধু রূপে কি করে?
আমার মন মজেছে যারি সনে
(আমার) প্রাণো চায় তারে
কি করে তার কুলে শীলে
মন কি কারো রূপে ভোলে
আ বে প্রাণ! কমল কাঁদে কালো ভোমরার তরে ॥

সোমে এসে তাল শেষ করেই অভয় বলে উঠল, নিধু মশায়ের গান, তাই না?

সুবালা যেন স্রোতের টানে, তরঙ্গে চলেছে ভেসে। এক অস্বাভাবিক ছটা তার সর্বাঙ্গে। অভয়ের দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে বলল, ও বাবা, জান দেখছি সব কিছু।

অভয় বলল, তা নয়, গুরুদেবের কাছে শুনেছি কিনা গাঁয়ে। প্রাণটা মুচড়ে দেয়! আচ্ছা, সেই গানখানি জানো? সেই

গুনগুন করে গাইল অভয়,

ভালবেসে ভাল কাঁদল…
যদি মজিবে না মনে ছিল, কেন মজালে।

 ততক্ষণে সুবালার হাত চলেছে হারমোনিয়মের রিডের ওপর। পরের লাইন সে নিজেই গেয়ে উঠল টপ্পার সুরে,

তুমি যে পরেরি সোনা
(আমার) আগে তা ছিল না জানা
জানলে পরে পরের সোনা।
পরিতাম না কৰ্ণমূলে।
ভালবেসে ভাল কাঁদল। …

মদ না খেয়েও অভয়ের চোখে মুখে চাপা নেশার উত্তেজনা। সঙ্কোচের বালাই তার গেছে। সুবালা গানটি ধরার পর তবলা বাজাতে বাজাতে, পুরো গানটি সে মনে মনে গেয়েছে। মনটা তার কোথায় যেন একটু খুঁতখুঁত করছে। অতৃপ্তি বোধ করছে সে। সেটা সুবালার গলার জন্য। ক্রমেই যেন সুবালার গলা বেশি তীব্র, তীক্ষ্ণ, কর্কশ হয়ে উঠছে।

ইতিমধ্যে বারোবাসরে নিশাচর দু একজন এসে দাঁড়িয়েছে সুবালার দরজায়।

সুবালার থামবার নাম নেই। আরক্ত চোখ তুলে, দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে হাসছে অভয়ের দিকে চেয়ে, আর হারমোনিয়ম বাজিয়েই চলেছে। এবারকার সুর সহসা ধরা পড়ছে না অভয়ের কাছে।

সুবালা ঢুলু ঢুলু চোখে তাকিয়ে বলল, বাজাও। বল দিকিনি এবার, কার গান? বলে সে ধরল,

আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায় কে গো দরদী।
খুলে দাও রং মহলার তিমির দুয়ার ডাকিলে যদি।

বিস্মিত মোহাচ্ছন্ন গলায় বলে উঠল অভয়, আচ্ছা! এমন কথা তো এর আগে শুনিনি।

সুবালা বলল, দেখছ কী? বাজাও।

ঘাড় কাত করে সুর শুনে বলল, অভয়, কী বাজাব? ওই গাদা না গারবা, কী বলে, তাই?

 সবালা যেন গজলের রেলা-য় হেসে উঠল খিলখিল করে। বলল, সে আবার কী?

জবাবে অভয় তবলায় বোল তুলল।

সুবালা গাইল,

গোপনে চৈতী হাওয়ায় গুগিচায় পাঠালে লিপি
পাঠালে ঘূর্ণী দৃতী ঝড়কপোতী বৈশাখে সখী

অভয়ের তাল ঠিক মিলেছে।

সুবালা আবার হেসে উঠল। হারমোনিয়ম বাজাতে বাজাতেই বলল, ঠিকই তো বাজাচ্চ। তবে। ও সব গাবদা গারবা, কী বলছ? এ তো কাফা।

অভয় বলল, তা হবে। ও সব নামধাম মনে থাকে না।

সুবালা হেসে, বালিশের ওপর এলিয়ে পড়ল। বিস্ত হল কাপড় চোপড়।

অভয়ের রক্তে দোলা লাগছে। চির অবজ্ঞাত এক ক্রীতদাসের সামনে, একটি আলুথালু মেয়ে। এমন সে কোনওদিন দেখেনি। তার বুকে রক্ত দুলছে। কোনও ঢেউ ভাঙা বন্যায় তা উচ্ছিত নয়। কেমন যেন, ব্যাকুল ব্যথা ধরা এক নিশ্বাসের ঘায়ে রক্তে দোলিকা। নিমিকে মনে পড়ছে। সুবালার প্রতি অঙ্গে এক ভাবী বাসরের নায়িকাকে যেন দেখছে সে। বলল, সুবালা, থেমো না, আরও গাও।

গলার স্বর বদলেছে অভয়ের। কিন্তু অসম্মানীয় উচ্ছাস নেই। সুবালা বলল, শুধু গান গাইব? আর কিছু নয়?

সুবালার সারা শরীরে একটি আঁকাবাঁকা মোচড় লাগল। অভয়ের বলতে ইচ্ছা করল, নিমির কথা মনে পড়ছে। কিন্তু সে কথা বলতে তার লজ্জা করল। সুবালার শরীরের দিকে তাকিয়ে, নিশ্বাস আটকে যেতে লাগল তার। তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে বলল, আরও গান গাও।

সুবালা হেসে উঠে, হারমোনিয়মের ওপর লুটিয়ে পড়ল। নতুন সুর বেজে উঠল যন্ত্রে।

এমন সময়ে ধুতি পাঞ্জাবি পরা একটি লোক টলতে টলতে এসে পড়ল সুবালার বিছানায়। চিৎকার করে উঠল, জমদুর্গার, মাইরি বলছি।

অভয়ের হাত প্রায় থেমে এল। সুবালার মুখ গম্ভীর হল, কিন্তু গান চলল ঠিক। লোকটি এবার তার শিথিল মত্ত হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল সুলার গলা। তারপর অভয়ের দিকে ফিরে ধমকে উঠল, এই শালা, তুই জু কর।

সুবালা ঝটকা মেরে লোকটিকে সরিয়ে দিয়ে ঝামটা দিয়ে উঠল, সরে বস না, যম কোথাকার!

-না সরব না। ও তবচি শালাকে বেরিয়ে যেতে বল।

অভয় ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রকাণ্ড শরীরটি অপমানে শক্ত উত্তেজিত কিন্তু নত। বলল, গালাগাল দেবেন না মশায়, শুধু শুধু গালি দেবেন না। চলি।

সুবালাও উঠে এসেছে অভয়ের কাছে। দরজার কাছে যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা মজা দেখছিল তখনও।

কিন্তু লোকটি চিৎকার করে উঠল, আলবাত্ গালাগাল দেব। আমি যখন এসেছি, শালা তোকে কুকুরের মতো বেরিয়ে যেতে হবে, বুঝলি?

অভয়ের চোখ ধকধক করে জ্বলে উঠল। হঠাৎ দু পা এগিয়ে এসে, লোকটাকে এক হাতে খাট থেকে টেনে নামাল সে। হাত তুলতে যেতেই সুবালা তার হাত চেপে ধরল। অভয়ের নির্বাক কিন্তু রুদ্র মূর্তি দেখে সুবালার আরক্ত চোখও শান্ত হয়ে এসেছে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে, অভয় বেরিয়ে গেল তাড়াতাড়ি।

রাজুমাসি এল চিৎকার করতে করতে, কী হয়েছে কী?

সুবালা বলল মাতালটিকে দেখিয়ে, একে বার করার ব্যবস্থা করো মাসি, নইলে ঘরে ঢুকব না।

বলে সেও অভয়ের পিছনে পিছনে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এল। ডাকল, শোনো শোনো গো।

অভয় দাঁড়াল। সুবালা তার হাত ধরে বলল, বেবুশ্যের ঘরে এ রকম হয়, আমার ওপর রাগ কোরো না যেন।

অভয় বলল, না, তোমার ওপর রাগ করব কেন?

সুবালার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল সে। কিন্তু সুবালার দেহোপজীবিনী চোখের দৃষ্টি এক অবিশ্বাস্য মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন। তার সর্বাঙ্গ যেন এক বিশেষ প্রত্যাশায় অভয়ের বুকের কাছে সরে এল। অভয় দেখল সুবালার চোখ। কিন্তু অভয়ের সব আবেশ তখন কেটে গিয়েছে। সে বলল, আমি এবার যাই।

সুবালা বলল, আমি তোমাকে আসতে বলেছিলাম। এ সব শুনে ভামিনীদি রাগ করবে।

–না, রাগ করবে কেন। আমি বুঝিয়ে বলব।

 সুবালা বলল, আর আসবে না, না?

–আসব। আমি গান পাগল, মন চাইলেই আসব। তোমার মানা না থাকলেই হল।

সুবালা বলল, মানা থাকলে কি বাড়ি বয়ে ডাকতে যেতুম? মন চাইলে তুমি এখনও বোসো, আমি গান গাই।

–আজ আর বসব না, যাই।

অভয় বাইরে এল। আবার নিমির কথা মনে পড়ল তার। এই নিয়ম, একজনের সাধ কখনও আর একজনকে দিয়ে মিটতে পারে না।

কিন্তু মাতালের অপমানকর কথাগুলি তখনও কাঁটার মতো বিঁধে আছে বুকে। ছারপোকাগুলি শুধু কামড়াতেই জানে। আর জন্ম থেকে এ সবই সে তার সহজ পাওনা হিসেবে পেয়ে এসেছে। তবু মাথা পেতে নিতে পারেনি।

এটাও জীবনের নিয়ম কিনা সে জানে না। খুড়ো খুড়ি অনাথ, সকলে ভালবাসে অভয়কে। মন বলে, সে ভালবাসা নিমির অনাস্বাদিত ভালবাসার মতো ভালবাসা নয়। দুঃখের মধ্যেও নিজেকে কেমন যেন বেহায়া-বেহায়া লাগে। তবু নিমির অনাস্বাদিত ভালবাসার কাছেই নিজের যন্ত্রণাকে প্রকাশ করতে চায় অভয়। নিমির কাছে, নিমিকে বুকের কাছে নিয়ে ভাল বাসতে বাসতে জীবনের রীতিনীতির নামে নিষ্ঠুর অনিয়মের কথা বলতে চায় সে। দুঃখের জন্যেই ভালবাসা। ব্যথার কথা বলার জন্যে। নিমিদের বাড়ির কাছ দিয়ে চলে গেল অভয়। আশা, একটু বা নিমির গলা শুনতে পাবে। শুনতে পেল, নিমি হাসছে। আর কথা শোনা যাচ্ছে পুরুষের গলায়। বোধহয় বিশুর গলা।

সেখান থেকে বাড়ি ঢুকতে গিয়ে, ফিরে এল অভয়। অন্ধকার রাস্তা ধরে চলে গেল গঙ্গার ধারে।

.

১১.

সুরীনের বাড়িতে বরযাত্রার তোড়জোড়। অভয় আজ বিয়ে করতে যাবে। এ পাড়া ও পাড়ার ব্যাপার, কিন্তু তোড়জোড় কিছু কম নেই। কেবল নিরুচ্ছুস ভামিনীর।

দিনটি শনিবার। একবেলা কাজের দিন গেছে। তার ওপরে সুরীন সোম মঙ্গল দু দিন ছুটি নিয়েছে। বলেছে, কথায় বলে জম্মো মিত্যু বে–চাট্টিখানি কথা নয়।

সন্ধ্যাবেলাতেই কাপড়কাঁচা সাবান দিয়ে চান করেছে সুরীন। ধোপার বাড়িতে কাঁচা শার্টের গলার বোতামটি পর্যন্ত এঁটেছে কষে, চাদর বেঁধেছে কোমরে। তারপর নিজের হাতে সাজিয়েছে অভয়কে?

বড় নাকি আনন্দের দিন। অনেক দিন থেকে এঁচে রেখেছিল যেমনটি, তেমনটি ঠিক করেছে। দুপুরে পুরো দুটি এক নম্বর দেশি বোতল কিনে এনেছে নিজের হাতে। সেই থেকে ঢুকু ঢুকু চলেছে, কামাই যায়নি। তা ছাড়া বর-যাত্রীরা এসেছে। তাদের মধ্যে সুরীনের সমবয়স্করাও খেয়েছে একটু আধটু।

অভয়কে নিজে সে খেতে বলেনি। খেলে বোধহয় খুশিই হত। অভয় খায়নি। কিন্তু সাজিয়েছে নিজের হাতে। ভামিনীকে ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে, কয়েকবার মুখ খারাপ করেছে। তারপর সামলাতে না পেরে কষিয়েছে দু ঘা।

ভামিনীকে যেচে না দিলেও বোতলের পদার্থের উপর তার বড় টান। সে নিজেই লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়েছে। মেজাজ তারও বড় ভাল ছিল না।

এ অবস্থায় তা না না না লাগত ভালই। হরি আর অনাথ মিস্তিরি থামিয়েছে। সুরীনকেই বকেছে ধমকেছে তারা। ছি ছি, এমন একটা শুভদিনে সুরীনদার কি মাথা খারাপ হয়েছে?

অভয়ের কোরা ধুতির কোঁচা কুঁচোতে কুঁচোতে সুরীন অপরাধ স্বীকার করে বলেছে, মাথা এতে খারাপ না হয় কার? তুই কেন মাগি ফড়কে মরছিস। অ্যাঁ? এই সিদিনে পায়ে পা দিয়ে শৈলদিদির সঙ্গে ঝগড়া করেছে, পুকুর ঘাটে কাদা ছোড়াছুড়ি করেছে নিমিটার সঙ্গে। আজ সারাটা দিন একটা কথা পর্যন্ত বলেনি।

ভামিনীও ফুঁসে উঠেছে, শৈলীরই বা গায়ে পড়ে অত সোহাগ দেখাতে আসার কি আছে? ছেলে আমার, আমার বাড়িতে আছে, তাকে আমি কী বলছি না বলছি, তাতে সে মাগিরই বা টাটায় কেন?

সুরীন চিৎকার করে উঠেছে, আলবাত টাটাবে, তুই দোষ করেছিস।

অনাথ মাঝখান থেকে আবার উঠেছে চিৎকার করে, তা হলে আজ আর বেথার দরকার নেই, তোমরা মা-ভাতারে লড়ালড়ি করো, হারজিত দেখে আমরা বাড়ি যাই।

পাড়ার মেয়েরা যারা এসেছিল, তারা একবাক্যে বলেছে সবাই, তাই না বটে। এরা আরম্ভ করলে কী গো!

তারপরে থেমেছে দুটিতে। সুরীনকে সরিয়ে মেয়েরা এগিয়ে এসেছে অভয়কে সাজাতে। পাউডার মাখিয়েছে কালো মুখে, কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়েছে, চোখে পরিয়েছে কাজল। কিন্তু পাউডার মাখিয়ে অভয়ের কালো রংটির যে সর্বনাশ হয়েছে, কহতব্য নয়। কিন্তু বর যে!

এ পাড়ায় বিয়ে বড় একটা হয় না। সকলেই ঘর করে। বিয়ের অনুষ্ঠান হলে, সেটা প্রায় ঐতিহাসিকতার পর্যায়ে পড়ে। সকলেরই কিছু না কিছু ভূমিকা থাকে। মেয়েরা সকলেই বরের-পিসি কনের-মাসি। দু জায়গাতেই তাদের ছুটোছুটি। এই একটি ব্যাপারকে কেন্দ্র করেই অনেক দিন ধরে সকলে এ পাড়ার কত স্মৃতিকে স্মরণ করবে। নিজেদের জীবনের অনেক কথা তাদের মনে পড়বে।

মেয়েদের হাতে অভয়কে ছেড়ে দিয়ে, সুরীন তার অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হল। ইয়ারদের সবাইকে মদ খাওয়াল। চিৎকার চেঁচামেচির তো কথাই নেই। ভামিনীর অপেক্ষা না করে নিজেই সিলভারের হাঁড়িতে করে চায়ের জল দিল উনুনে চড়িয়ে। শুধু অভয়ের মনটার একদিকে আলো, আর একদিকে অন্ধকার। ভামিনী খুড়ি তাকে একবারও ডেকে কথা বলেনি সারাদিনে। সুবালার ওখানকার সংবাদটা চাপা থাকেনি। চাপা থাকবে কি প্রকাশ পাবে, তা নিয়ে কোনও ঘোঁট পাঁচালি হতে পারে, সে কথা ভাবেনি অভয় একবারো। দশজনকে লুকিয়ে যায়নি সে সেখানে। কিন্তু শৈলর কানে কথাটি ঢোকা মাত্র, ভামিনীকে ধরেছিল সে। কোন সাহসে ভামিনী ওই ছেলেকে সুবালার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। এই কি খুড়ির কাজ যে, ভাসুরপোকে নিয়ে সুবালার রংখানায় গানের আসর বসাতে হয়! ভয়ে বুক কেঁপেছে শৈলবালার। এ সবের অর্থ কী সে বোঝে না? কিন্তু শৈল ভামিনীর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে যে, সে ভাল মানুষ অভয়কে বেগড়াবার তালে আছে?

ভামিনীও ছাড়েনি। বলেছে, পৈতে পুড়িয়ে সব বামুন হয়েছে, রাঁড়ের আবার সতী-পনা। যা করেছে, বেশ করেছে ভামিনী।

সুরীন আর অভয় কারখানায় ছিল। ঝগড়া চলেছে সারাদিন ধরে। শৈলবালা যেখানে গেছে, সেখানেই পেড়ে বসেছে সেই বৃত্তান্ত। ফলে গোটা পাড়াটাই জড়িয়ে পড়েছে এই কথার মধ্যে। কেউ ভামিনীর, কেউ শৈলর পক্ষে।

শৈলদের ঘরকরা পাড়া আর বারোবাসর পাড়ার মাঝামাঝি আছে একটি বড় পুকুর। সবচেয়ে বড় রকমের আসর সেখানেই বসে। কাপড় কাঁচা, বাসন ধোয়া, চান করার জন্য সকলের দেখা শোনা সেখানেই হয়। শৈলবালা ভামিনীর সাক্ষাতে সেখানেও কথা তুলেছে। শৈল আর ভামিনীর যখন হাতাহাতি হবার উপক্রম, তখন নিমিও আর সহ্য করতে পারেনি। মায়ের হয়ে সে-ই ভামিনীর দিকে এগিয়ে এসেছে। সেই প্রথম পাঁক ছুড়ে মেরেছে ভামিনীর গায়ে মুখে। ভামিনীও ছাড়েনি।

তারপর সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরেছে সুরীন অভয়। শৈলবালা সেখানে এসে আর্জি করেছে। সেদিনও ভামিনী কয়েক ঘা খেয়েছে সুরীনের কাছে। মাঝখান থেকে নিজের কাছে অপরাধী হয়ে আছে অভয়। কিন্তু তাকে কেউই একটি কথাও বলেনি।

আজ সে বিয়ে করতে যাচ্ছে। অথচ ঝগড়াটা মেটেনি। এই ভেবে তার মনের এক দিকে অন্ধকার। আর এক দিকে আলো, নিমিকে সে বিয়ে করতে যাচ্ছে।

ও দিকে শৈলর বাড়ি থেকে তাড়া আসছে ঘন ঘন। ব্রাহ্মণ কৈলাস বরাবর এ পাড়ার সব কাজ করে থাকে। সেও তাড়া দিচ্ছে এসে। লগন নাকি বয়ে যায়।

হরি মিস্তিরি, অনাথ, সুরীন, আরও জনা দশ বারো কারখানার বন্ধু অভয়কে নিয়ে এল শৈলর বাড়িতে। শাঁখ বাজল মালি পাড়ার আকাশ ফাটিয়ে।

বিয়ে বাড়ির উঠোনে, বাতাবিলেবু গাছের ডালে ঝুলছে হ্যাজাক। এ দিকে ও দিকে আরও দু। দুটো কারবাইডের বাতি।

শৈলবালাই ডেকে বসাল সবাইকে। এসো ভাই সুরীনদাদা, অনাথদা এসো, হরিদাদা এসো। এসো, এসো, আমার অভয় বাবা এসো।

সুরীন বরকর্তা। কিন্তু অবস্থা তেমন সুবিধের নয়। চোখ রক্তবর্ণ, হাত পাও টলমল। প্রায় সমস্ত বুড়োবুড়িদের মুখেই ভুরভুর করছে মদের গন্ধ। শৈলবালাও বাদ যায়নি। গোটা পাড়ার মেয়েরা এসে জুটেছে। এমনকী সাঁঝবেলার আসর ছেড়ে বারো বাসরের মেয়েরাও অনেকে ছুটে এসেছে বিয়ে দেখতে।

বিয়ে! এই একটি শব্দ আজ এ পাড়া ও পাড়াকে সচকিত করে তুলেছে। যেন এমন বিস্ময়কর ব্যাপার তারা আর দেখেনি, শোনেনি কোনওদিন। কোন এক জগৎ থেকে যেন তারা আজ মানুষের জগতে খেলা দেখতে এসেছে।

যখন তারা মানুষ ছিল তখন হয়তো কারুর কারুর বিয়ে হয়েছিল, কারুর কারুর হয়নি। এখন সে জগতটা তাদের কাছে অস্পষ্ট ছায়ালোকের মতো। গত জন্মের স্মৃতির মতো।

কিছুক্ষণের জন্যে যেন সবাই হাসিমস্করা ভুলে যায়। গত জন্মের স্মৃতিটাকে হাতড়ে ফেরে সবাই।

কেবল পুরোহিত কৈলাসের অর্থহীন অনুস্বার বিসর্গযুক্ত মোটা উঁচু গলা তারস্বরে বাজতে থাকে। তারপরে এক সময়ে বর-কনের বাপের নাম জিজ্ঞেস করে সে।

অভয়ের পিতৃপরিচয় দেয় সুরীন নিজে। নিমির পিতৃপরিচয় দেয় শৈলবালা। দিতে গিয়ে কয়েকবার থতিয়ে যায় সে। দু-তিনটে নাম নিয়ে সে যেন হিসেব কষতে আরম্ভ করে। কৈলাসের তাড়া খেয়ে তাড়াতাড়ি একটি নাম বলে ফেলে, যাকে নিমি কোনওদিন দেখেনি, চেনে না। কিন্তু তা নিয়ে কোনওরকম বাকবিতণ্ডা হাসিমস্করা হল না।

কেবল অভয়ের প্রাণে কী এক অচিন রসের প্লাবন। নিমিকে দেখে সে প্রথম চিনতে পারেনি। টকটকে লাল শাড়ি, হাল ফ্যাশানের জামা, সোনার সরু একখানি হার, কানে দুল, হাতে কাঁচের সঙ্গে চারগাছি চুড়ি। নিমি, তার নিমি। বুকের কাছে নিয়ে, ভাল বাসতে বাসতে মনের কথা বলবে সে তাকে।

ছাঁদনাতলা থেকে বাসরে গেল বর কনে। শৈল সবাইকে খাইয়েছে মন্দ নয়। লুচি, ভাজা, ডাল, তরকারি, বোঁদে আর দই।

বারোবাসরের মেয়েরা ফিরে গেল। এই রাত্রের নগদ বেচাকেনার কারবারে বিয়ের কথাটা তাদের মনে রইল কি রইল না, সেটা খেয়াল থাকল না। সুরীনেরা বিদায় নিল। যাবার আগে দেখা করে গেল অভয়ের সঙ্গে। অভয় প্রণাম করল জনে জনে, কিন্তু মন যে তার অন্যখানে, সেটা চাপা থাকল না। নেশা ধরে গেছে তার।

হ্যাজাকটার রোশনাই কমে গেছে। বাতাবিলেবু গাছটার তলায় বসে, মস্তবড় ছায়া ফেলে শৈলবালা তাকিয়েছিল মেয়ে ভরতি বাসর ঘরের দিকে। জীবনের একটি বড় রকমের সাধ মিটিয়ে চোখ ফেটে তার জল এসেছে।

সুরীন বাড়ি এসে, অন্ধকার ঘরে হাতড়ে হাতড়ে ভামিনীকে তুলে নিয়েছে বুকে। মত্ততার পরে কেমন একটি বিষাদ অবসাদে বড় ভার ভার লাগছিল বুকটা। অন্ধকারে, ভামিনীর গালে হাত দিয়ে টের পেয়েছে, কাঁদছে সে। সুরীনের চোখদুটিও জ্বালা করে উঠেছে। বলেছে, কাঁদিস নে গো ভামিনী, তোর দুঃখু বুঝি।

এ ভামিনী আর সে ভামিনী নয়। সেও ফিসফিস করে বলল, ছাই বোঝ তুমি। ছেলে একটা আনলে ঘরে, তাকে দিয়ে এলে আর এক ঘরে। আমি কি ছেলে বউ নিয়ে ঘর করতে পারতুম না?

–পারতিস?

–তবে? তিন সন ধরে তোমার এই জমি ঘর মৌস হয়েছে। এসব আমরা কাকে দিয়ে যাব?

সুরীনের কিছুক্ষণ কথা সরে না মুখে। তারপর বলল, সোমসারে লোকের অভাব কী ভামিনী। কেউ না কেউ আসবে। বিয়েতে আজকে অভয়ের বাপ বলে পরিচয় দিয়ে এসেছি। আমার নাতি-নাতনিরা থাকবে। আমাদের ঘরে আসবার মতো ছেলের অভাব নেই এ দেশে। ভদ্রলোকদের ঘরে, হাসপাতালে, আস্তাকুড়ে কত পাওয়া যায়।

ভামিনী তবু সেই আগের দিনের মতো সোহাগি সুরে আবদার করে, তবু ছেলে বউকে এসে থাকতে হবে কদিন আমার ঘরে। শৈলীকে তুমি বলে দিয়ো।

সুরীন তাকে আদর করে বলল, তা দেব।

.

এ দিকে বাসর-জাগা জমেছে ভাল। নিমিই শুধু মুখ ঘুরিয়ে আছে। এত লজ্জা হওয়ার কথা নয় নিমির। তবু আজ সবাই বিশ্বাস করে নিয়েছে, লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে সে।

অভয়কে ধরেছে সবাই গানের জন্য। জানাশোনা গান নয়। নতুন গান বেঁধে গাইতে হবে।

 তাই গাইল অভয়। হাত নেড়ে নেড়ে, আড়চোখে নিমিকে দেখে দেখে গাইল,

হায় কমল ফুটেও কেন পাতায় ঢাকা
ভোমরে ডেকে মধু লুকিয়ে রাখা।
ভোমরার এ কি কপাল গো!

মেয়েরা হেসে গড়াগড়ি গেল।

কিন্তু নিমি ফিরেও তাকাল না। এমনকী হাসল না একবারও।

মেয়েরা চলে যাওয়ার পর শৈলবালা শুয়েছিল সেই ঘরে। আষাঢ়ের মেঘাচ্ছন্ন রাত্রি তখন প্রায় ভোর। নিমি অনেক দূরে শুয়েছিল মুখ ফিরিয়ে। বাকি রাতটুকুনি শুধু তার মুখ-ফেরানো মূর্তি দেখে কেটেছে অভয়ের।

পরদিন কালরাত্রি কাটিয়ে ফুলশয্যা হল শৈলর বাড়িতেই। ফুলশয্যার যাবৎ খরচ করল সুরীন নিজে। আজ ভামিনীও ছিল।

.

১২.

খাওয়া দাওয়ার পাট মিটেছে অনেকক্ষণ। বর কনে ঘরে গিয়েছে। বিদেয় হয়নি শুধু আড়ি পাতার দল।

দূর আকাশে মেঘ ডাকছিল গুরু গুরু। কলরবে কানে যায়নি কারুর। মালি পাড়ার আকাশে যখন তীব্র শব্দে ঝলকে উঠল তড়িৎলতা, তখন সবাই চমকাল। সাবধান হবার অবকাশ না দিয়েই, বৃষ্টি নামল ঝমঝমিয়ে।

সব নিঃশব্দ হল। গোটা মালিপাড়া থেকে সঞ্চিত কৃষ্ণকলি ফুলের গন্ধ আর রাত্রি এ বার সজাগ হল নিমি আর অভয়কে ঘিরে।

নিমির দিকে তাকিয়ে দেখল অভয়, সে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। আজ নীলাম্বরী পরেছে নিমি। নীল বলতে যা বোঝায়, তার চেয়ে গাঢ়। প্রায় যেন কালো, তবু কালো নয়। রূপোলি আঁশ পাড়। ঘোমটা খুলে গেছে কিংবা খুলে দিয়েছে নিমি নিজে। খোঁপায় রূপোবাঁধানো চিরুনি গোঁজা। অভয়ের চোখে তার চেয়ে সুন্দর লাগে, খোঁপায় জড়ানো আ-ফোঁটা টোপা টোপা বেলফুলের মালাখানি। আর ভাল লাগে গলায় জড়ানো ফুলের মালা।

পিতৃ পরিচয় জানা নেই অভয়ের। শুরু থেকে জীবনকে বড় কঠিন ও কুটিল বলে জেনেছে। তবু বেঁচে থাকা কী আশ্চর্য সুন্দর। ঠিক গান বাঁধার মতো। যেমন নাকি এই মালিপাড়ার মানুষেরা পাড়ার একটি মাত্র জলকলের ধারে রোজ লাইন দেয়। হাহাকার করে, ঝগড়া করে, মারামারি করে, কাঁদে, নিরাশ হয়, তবু হাসে ও বাঁচে সেই দুর্দশার ধন এক কলসি কিংবা এক বালতি জল ঘরে তুলে, তেমনি। মধু আছে জীবনে। সে মধুর নাম জানে না অভয়। সুন্দরকে ব্যক্ত করার ভাষা তার স্কুল ও অবাচীন। যে সুন্দরের অনুভূতি ওর বোবা আবেগের উজানে বহে, আসলে সে অনির্বচনীয়ের।

সেই অনির্বচনীয় এক বিচিত্র রূপ ধরে যেন তার সামনে বসে আছে নিমি। রক্তে দোলা লাগছে কতখানি, সে হিসেব জানে না। মন পাগল হয়েছে তার।

নিমির কি লজ্জা করছে। চোখে চোখ রাখেনি একবারো, ঠোঁট মুচকোয়নি বারেক। বাইরে ঝর ঝর ধারা। সেই শব্দ ছাপিয়ে, দূর থেকে বিশুর মত্ত গলা শোনা যাচ্ছে এখনও। শৈলবালার সুহৃদ বিশু, বুঝি নিমিরও। সারাটা দিন মাতলামি করেছে, সকলের সামনে নিজের বউটাকে, ছেলেমেয়েগুলিকে পিটেছে। ফুলশয্যের নিমন্ত্রণ খেতে বসে ধস্তাধস্তি করেছে অকারণ। এখনও চিৎকার করছে।

এই ঘরে, এখন সে সব তুচ্ছ লাগে। জীবন কোনও কোনওদিন প্রত্যহকে ছাড়িয়ে যায়। আজ ছাড়িয়ে গেছে।

আজকের এই দিন আর জুয়া-খেলা-জিতের মতো অভাবিত নয়, তবু বড় অভাবিত। নিমির মতো এমনি করে ঘুরিয়ে শাড়িপরা, অমন বিবির মতো জামা পরা মেয়ে ছিল চিরদিন অভয়ের অপরিচয়ের সংশয়।

পিছন থেকে নিমির পিঠে হাত দিয়ে ডাকল সে, ফিরে বসবে না?

নিমি নিশ্চল, নিরুত্তর। কেন? লজ্জা করে না বুঝি মেয়ের। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে এ বড় পুরুষটা অভয়, তারো পাগল পাগল মনের কোনও এক কোণে যেন লজ্জা লজ্জা করে।

অভয় উঠে, নিমির সামনে যেতে যেতে বলে, তবে আমি বসি সামনে। সামনে বসে, নিমির চিবুকে হাত দিয়ে বলল অভয়, মুখ তোলো।

কিন্তু নিমি তেমনি অনড়। ঘাড় শক্ত, চিবুক ধরে ঘাড় নাড়ানো যায় না। কেন? অবাক হয় অভয়, একটু যেন সঙ্কোচও হয়। লজ্জায় এত শক্ত কেন তার বউ।

মাটির দিকে স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ নিমির। ঠোঁট কিংবা গালের, সারা মুখের, শরীরের কোনও ভঙ্গিতে একটুও হাসির আভাস তো নেই। এ শুধু লজ্জা কিংবা, মেয়েমানুষের প্রেমের ছলনা, তা মনে হয় না। অভয়ের।

আবার নিমির চিবুকে হাত রেখে বলল সে কী হয়েছে, বলবে না?

সহসা যেন সাপিনীর মতো শুধু তীব্র নিশ্বাসের শব্দে, নিমির হঠাৎ নিশ্বাস পড়ল। তারপর চকিত চোখে তাকাল একবার অভয়ের দিকে। কাজল আঁকা সে-দৃষ্টিতে অভিমান ফুটে উঠল। স্পষ্ট গলায় বলল, আমার ভাল লাগছে না।

যেন মাঝ-দরিয়ার মাঝির অভয়-চোখে কালো মেঘের বিজলি হানল। সংসারের পথ এত বাঁকা, এমন করে মোড় ফেরে যে, পিছনের সবটুকু একেবারে নিরঙ্কুশ যায় ঢাকা পড়ে। ভয় করছে অভয়ের। বলল, কী ভাল লাগে না? আমাকে?

নিমি আবার তাকাল। বলল, জানি না।

অভয় হাত টেনে ধরে বলল, বলো নিমি বলো কী হয়েছে?

নিমি আবার তাকাল। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলল, সুবালা আমার চেয়ে সুন্দর।

অভয় হাসবে না কাঁদবে, ভেবে পেল না।

 সুবালার কথা বলে নিমিও। যে সুবালার রংখানা থেকে বেরিয়ে, যে নিমির কাছে যেতে চেয়েছে অভয়। কিন্তু সঙ্কোচে, অন্ধকার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুধু নিমির একটু হাসির রেশ, দুটি অস্ফুট কথা শুনে এসেছে লোভীর মতো। সেই নিমি বলে সুবালার কথা।

অভয় বলল, তুমিও এ কথা বলো? সুবালার কথা তুমি ভাব?

দূরবিদ্ধ দৃষ্টিতে নিমি তাকাল অভয়ের দিকে। বলল, ভাবালে কেন ভাবব না? সুবালা কি একটুও ভোলায়নি?

অভয় বলল, তুমি থাকতে আমি ভুলব কেন?

–মিথ্যে কথা। অভয় শিশুর মতো বলে উঠল, সত্যি বলছি, আমি ভুলিনি।

নিমির দূরবিদ্ধ দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ হল। বলল, সুবালার কত নাম ডাক গানে আর রূপে, তুমিও গাইয়ে মানুষ।

ভাবে কী নিমি?

নিমির শাড়ির আঁচল আলুলায়িত। হাল ফ্যাশানের জামায় তার নিটুট স্তনান্তরে বেলফুলের মালা দোলে। সুন্দর ঠোঁটে চোখে চকচক করে ঘৃণা। বলে, তাই তোমাদের ভাব।

অভয়ের বিশাল শরীরের পেশিতে পেশিতে প্রতিবাদ ফোটে। বলে, না নিমি, আমার কোনও ভাব নেই।

নিমি বুঝেছে নিমির মতো। তার একটা জীবন আছে, ধারণা ও বিশ্বাস আছে। এই পাড়ায়, এই পরিবেশে, এখানকার পুরুষদের আশেপাশে, মেয়েদের সঙ্গে সে মানুষ হয়েছে। সে জানে, পুরুষ কী চায় মেয়ে-মানুষের কাছে, আর মেয়েমানুষের কী দরকার পুরুষদের কাছে।

নিমি বলল, জানি আমি সব। ভামিনী মাসি তোমাদের ভাব করিয়ে দেবার জন্যে নিয়ে গেছল। আমার সঙ্গে তোমার বে হয়, সে চায়নি। তাই বে-তে আসেনি। পাড়ার সবাই এসেছে, কিন্তু সুবলি আসেনি। আমি সব বুঝি।

অভয় অসহায় গলায় বলল, কিন্তু আমি বুঝিনি নিমি।

নিমি বলল, পুরুষরা কোনওদিন বোঝে না। বলে সে চৌকির আর এক পাশে সরে গেল। টান দিয়ে খুলল খোঁপার ফুলের মালা। খুলতে লাগল চুলের কাঁটা। বলল, শুয়ে পড়ো তুমি।

অভয় বলল, আর তুমি?

নিমি বলল, তা বলব কেন?

পুরুষকে দেবার মতো সব চেয়ে বড় কঠিন শাস্তি যেন ঘোষণা করল নিমি।

এই কী সেই স্বপ্ন অভয়ের! সেই ভালবাসা!

নিমি মুখ ফিরিয়ে নিঃশব্দে হেসে উঠল। যেন এতক্ষণের সমস্ত বিরাগ ও অভিমান তার ছলনা শুধু।

অভয় বড় বড় চোখে নিমির সর্বাঙ্গ দেখতে থাকে। নতুন কিছু, ভীষণ কিছু দ্যাখে—আর তার চোখে কলকল করে রক্ত ওঠে। তবু যেন চাপা গলায় বলে, আমি কেমন করে এ ঘরে থাকব তবে?

নিমি হাসি লুকোতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। বলে, তার আমি কী জানি!

অনড় নিশ্চুপ থাকতে চায় অভয়। ঠিক তেমনি বিস্ময়ে, দুঃখে, যেমন করে মানুষ আঁতুড় ঘর দেখতে এসে শ্মশানে পৌঁছোয়, তেমনি।

কিন্তু তার মা প্রমীলার ঘরে, কবে কোনও এক ভেজা ভেজা অন্ধকার রাতে বুকে হেঁটে হেঁটে একটা পুরুষ এসেছিল, আর তার মাকে সাপের মতো আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর সুন্দর গায়ে, কুৎসিৎ অন্ধকারে, অভয়ের অস্তিত্বকে দিয়ে গিয়েছিল ছিটিয়ে। সেই অনুভূতিটা রক্তের মধ্যে দপদপিয়ে উঠল অভয়ের। সহসা যেন পিতৃরক্ত উত্তাল হল আজ। সে উঠে গিয়ে জড়িয়ে দৃ হাতে ধরল নিমিকে।

নিমি যেন ভয় পেল। ভ্রূ কুঁচকে বলল, বাঃ জবরদস্তি বুঝি?

 অভয় নিমির মুখের দিকে তাকাল। কথাহীন উন্মাদনা তার চোখে।

.

অসহায় আদিম মানুষ সে।

 হাসিটা আবার ধরা পড়ল নিমির। বলল, ছাড়ো। কিন্তু অভয় তার মুখ চেপে ধরল বুকে—কঠিন আলিঙ্গনে নিষ্পেষিত করল। কাছে এনে ফেলল বিস্রস্ত নিমিকে। নিমি হাসল কি কাঁদল, বোঝা গেল না। শুধু একটা বিস্ময়কর অন্ধকার ও গভীর ঘূর্ণিপাকের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলল সে।

.

ভোর হয়ে আসে। তবু যেন অন্ধকার গাঢ় হয়। নিমি আশ্চর্য শান্ত ভাবে ঘুমুচ্ছে। ঠোঁটের কোণে যেন চিকচিক করছে একটি তৃপ্তির হাসি।

অভয় সে মুখ সারা রাত্রি ধরে দেখছে। তার পলক পড়ছে না চোখের। বাইরে কখন বৃষ্টি থেমে গেছে। ঝি ঝি আর ব্যাঙের কলতান বাজছে।

অভয়ের বুকে একটা ব্যথা, কান্না এবং হাসির মিলিত অনুভূতি মোচড় দিয়ে উঠছে। সে নিমির মুখটি আবার টেনে নিল বুকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *