২.১ অভয়ের বিয়ে

দ্বিতীয় খণ্ড

০১.

বড় বিচিত্র অভয়ের এই বিয়ে, বড় বিচিত্র এই ফুলশয্যা। ভয়ঙ্কর বোবা যন্ত্রণা পাক খায় অভয়ের মস্তিষ্কে। সে সারারাত্রি জেগে থাকে, বউ তার ঘুমোয়। জীবনের এ অধ্যায় যে এমন ভাবে শুরু হবে, কাল নিমির সঙ্গে কথা বলার এক মুহূর্ত আগেও টের পায়নি।

এখন সন্দেহ হয়, সে দুঃস্বপ্ন দেখেছে সারা রাত। সন্দেহ হয়, নিমি তার সঙ্গে খুনসুটি করেছে শুধু, ছলনা করেছে। অভয়কে রাগিয়ে সে খেলা দেখেছে। নইলে, এখন নিমি এমন নিশ্চিন্তে ও সুখে ঘুমোচ্ছে কেমন করে? এত সুন্দর কেন দেখাচ্ছে তাকে। ঠোঁটের কোণে তার এমন মিষ্টি হাসি কেন ঝিকিমিকি করে? রাত্রে যখন অভয় তার অন্ধ নির্দয় আসুরিক আলিঙ্গন শিথিল করেছিল, মনে করেছিল, এইবার নিমি চিৎকার করবে, ডাকাডাকি করে লোক জড়ো করবে ঘরে। কেলেঙ্কারির একশেষ হবে। তার জন্যেও প্রস্তুত ছিল অভয়। মনে মনে বলেছিল, তাই হোক, তাই হোক। কেন না, রাগে ও ঘৃণায় তখনও দপদপ করছিল তার বুক।

কিন্তু মুখ ফিরিয়ে পড়েছিল নিমি। ঠিক যেমন করে ফেলে রেখেছিল তাকে অভয়, তেমনি দলিত মথিত হয়ে, বেশবাস আলুথালু করে চুলের কাঁটা ছড়িয়ে, সিঁদুরের দাগ সারা মুখে মেখে। সেও যেন এক ভয়ঙ্কর নির্লজ্জ বিদ্রোহ।

একবার বুঝি ভয় হয়েছিল অভয়ের, নিমির চৈতন্য নেই। একবার যেন মনে হয়েছিল, নিমি বুঝি কাঁদছে। তবু শক্ত হয়ে বসে অভয় হু হু করে বিড়ি টেনেছিল শুধু। খানিকক্ষণ পরেই ঘুমন্ত দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে ফিরে দেখেছিল নিমি পাশ ফিরছে। গাঢ় ঘুমে সে মগ্ন।

এখনও ঘুমোচ্ছে। এটা ছলনা নয়। মানুষের সবই কী বিচিত্র।

তবু, কাল রাত্রের কথা তো ভুলতে পারে না অভয়। শুধু দুঃস্বপ্ন বলে পারে না উড়িয়ে দিতে। সে যে কাল অন্ধ আক্রোশে ফুঁসেছিল, দারুণ ঘৃণা করেছিল নিমিকে, তবু এক দুর্জয় বাসনায় নিমির প্রতি অঙ্গ নিষ্পেষিত করার জন্যে, রক্তে তার পাগলা বান ডেকেছিল। মনের একী কারসাজি! সংসারে সবই বিচিত্র। অভয়ও যে বড় বিচিত্র। একই সঙ্গে তার রাগ ঘৃণা, তার উন্মত্ত বাসনা নিষ্ঠুর ভাবে পীড়ন করেছে নিমিকে।

জীবনে অভয়ের এই প্রথম পাওয়াকে, তার প্রথম ভালবাসাকে, তার বউকে সে জোর করে আলিঙ্গন করেছে। যদি নিমি নিস্তেজ না হয়ে পড়ত, তা হলে অভয় তাকে মারত নিষ্ঠুর ভাবে।

মনে হওয়া মাত্র উঠে দাঁড়ায় অভয়। একটু পরেই ঘুম ভাঙবে নিমির। চোখ খুলবে সে। আর সেই চোখের সঙ্গে চোখাচোখি হবে অভয়ের, ভাবতেও কেমন করে ওঠে তার বুকের মধ্যে। সে যে বড় লজ্জা। বড় লজ্জা!

বাইরে কাকপক্ষী ডাক দিয়েছে অনেকক্ষণ। মিলের প্রথম বাঁশি বেজে উঠল, আশেপাশে লোকজনের গলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। জাগছে সবাই।

অভয় তাড়াতাড়ি তার দলা মোচড়ানো জামাটা তুলে গায় দিল। ফিরে তাকাল একবার নিমির দিকে। অগোছাল বেশবাস দেখে থমকাল একটু। কিন্তু গায়ে হাত দিয়ে কাপড় গুছিয়ে দিতে গেলে জেগে যেতে পারে। নিঃশব্দে ও সাবধানে দরজা খুলে, বাইরে এল অভয়। আবার ঠেলে ভেজিয়ে দিল ভাল করে। দেখল, উঠোনের ওপরেই, বাতাবি তলায় মড়ার মতো ঘুমোচ্ছে শৈলবালা। পুকুরের উঁচু পাড় ঘেঁষে, রান্নাঘরের দাওয়ায় পাড়ারই দু তিনটে মেয়েমানুষও ঘুমোচ্ছ। তারা সকলেই শৈলবালারই সই। সকলেরই নেশার ঘুম। সহজে ভাঙবে না।

আয়নায় নিজের মুখ দেখেনি অভয়। দেখলে, দেখতে পেত, তাকেও নেশাখোরের মতোই দেখাচ্ছে। রক্তবর্ণ চোখের দুই কোণে সুগভীর গর্ত। ভুর পাশেও চিবুকে কেটে যাওয়া ক্ষতের মতো সিঁদুরের দাগ। কিন্তু কোনওদিকে না তাকিয়ে, এ গলি সে গলি করে, বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াল সে। সরকারি অফিস আদালত জেলখানার পাশ দিয়ে একেবারে কারখানায় এসে উঠল সে।

আজ অভয়ের ছুটির দিন। আগামীকালও তার ছুটি। তবুও আর কোথাও সে যাবার জায়গা। খুঁজে পেল না। অনাথখুড়োর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে সে।

প্রথমে দেখা হল একজন চেনা মিস্তিরির সঙ্গে। সে অভয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠতে গিয়ে থেমে গেল। তাড়াতাড়ি অভয়ের হাত ধরে বলল, আরে খুড়ো, এসো এসো, চলো ডিপার্টমেন্টে।

ডিপার্টমেন্টে নিয়ে, সবাইকে ডাক দিল সে। সবাই জড়ো হয়ে টিপে টিপে হেসে খানিকক্ষণ। দেখলে অভয়কে। তারপর সবাই ফেটে পড়ল হাসিতে। একজন কোত্থেকে একটি ফাটা আয়না নিয়ে এসে ধরল অভয়ের সামনে।

হরি মিস্তিরি বলল, একেবারে পেতক্ষ্য দাগ লিয়ে এসেছ বাবা! বাহবা! আর একজন বলল, শালার চোখ দেখ না। এখনও খোয়াড়ি কাটেনি।

–নতুন নেশা, খোয়ারি কি এখুনি কাটবে। খোয়ারি কাটতে এখন ঝাড়া তিন মাস।

বছরও ঘুরে যেতে পারে।

কথায় বলে চটকলের মিস্তিরির মুখ। কাজে আর খারাপ কথায় সমান দড়ো। অভয়কে নিয়ে সবাই মাছির মতো ভ্যানভেনিয়ে উঠল!

বুড়ো হরি মিস্তিরি অভয়ের চিবুক ছুঁয়ে বলল, জোট বেঁধেছে তা হলে ভাল।

অভয় হাসল একটু। বোকা বোকা হাসি।

এদিকে সব শেষের ভোঁ বেজে গিয়েছে। সকলের কাজে হাত দেবার সময় হল, এমন সময় এল অনাথ। অভয় ততক্ষণে ঘষে ঘষে মুখের দাগ তুলেছে।

একটু অবাক হয়ে বলল, কী গো, খুড়ো, এত সকাল সকাল যে? অভয় হাসবার চেষ্টা করে বলল, চলে এলুম।

–কেন?

 –কেন, আসতে নেই?

 –আছে বইকী! তা বলে ফুলশয্যের রাত পোয়াতে না পোয়াতে কারখানায় আসে কে?

বলে অনাথ কয়েক মুহূর্ত অভয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বল তো?

অভয় বলল, কিছু নয়। ভাল লাগছে না, তাই তোমার কাছে চলে এলুম।

বটে!

অনাথ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আর একবার তাকে দেখে, চিৎকার করে একজনকে বলল, এই নিমে, আমি আসছি। বড় সায়েব এলে বলিস, লেবার অফিসে গেছি।

বলে, অভয়ের হাত ধরে কারখানার বাইরে, চায়ের দোকানে এসে বসল। বলল, বল তো, কী হয়েছে? নিমি কিছু বলেছে নাকি?

বলেছে। কিন্তু সে-বলা যে নিমির শুধুই ছেলেখেলা নয়, তা কে জানে। ফুলশয্যের রাত না পোয়াতে, নিমির নামে নালিশ করতে বাধল অভয়ের। বলল, না।

–তবে?

 অভয় বলল, জীবনখানা কেমন হবে তাই ভাবছি।

 অনাথ বলল, সারারাত কি এই সব ভেবেছিস নাকি?

-না। রাত পোয়াতে মনে হল, তাই ভাবলুম। খুড়ো, মনে লয়, নিমিকে পাওয়ার বড় সুখ।

অনাথের ধাঁধাঁ লাগে মনে। ঠিক যেন বুঝতে পারে না অভয়ের কথা। বলল, তা সে সুখ তো পেয়েছিস, না, কী?

অভয় আবার হাসল। আবার একটু ইঙ্গিতমূলক খোঁচা দিয়ে অনাথ শব্দ করল, অ্যাঁ?

অভয় জোরে হেসে উঠল, অনাথও হেসে উঠল। দু জনের এই উচ্ছ্বসিত হাসির শব্দে দোকানের সবাই ফিরে তাকাল তাদের দিকে।

অনাথ হাসতে হাসতেই বলল, পাগলা কোথাকার। তাই তো, পাগল না অভয়? নিমিকে পাওয়ার যদি বড় সুখ, তবে নিমির ঘুম ভাঙিয়ে আদর করে আসেনি কেন সে? কী দুটো কথা বলেছে, তার জন্যে কী বিশ্রী পাগলামিই না করে এসেছে অভয়। ছি! সুখ সে পেয়েছে। মিথ্যে কেন বলবে? রক্তে তার বড় সুখের ঢেউ, উথালি পাথালি করে মেরেছে তাকে। তবু বুক জ্বলেছে। সে কিছু নয়। এখন বরং, নিমির জন্যে কষ্ট হচ্ছে মনে মনে।

নিজেকে নিজেই যেন স্তোক দেয় অভয়। বুকের ভিতরে কুণ্ডলী পাকানো ত্রাসটাকে যেন চোখ টিপে রাখে।

অনাথ আবার বলে, কবি নিয়ে কী জ্বালা! দু গেলাস চা দিতে বলে, অনাথ আবার বলে অভয়কে, কোথায় ভাবলুম গান-টান বেঁধে এনেছে মনের ফুর্তিতে। তা নয়, বলে, জীবনখানা কেমন হবে।

অভয় যেন অবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে অনাথের দিকে।

অনাথ বলল, কী হল?

গানের কথা বলছিলে?

 –হ্যাঁ।

অভয় যেন সুপ্তোত্থিতের মতো বলল, শোনো তালে, এখুনি বেঁধে শোনাচ্ছি।

বলে, প্রথমে কথায় বল অভয়, গোলকধামের গোলকধাঁধা খুড়ো।

 কোন ছক থেকে কোন্ ছকে যাবে, কখন তুমি কাঁদবে আর কখন তুমি হাসবে, তুমি জান না।

ভালবাসা যায় না চেনা।
সে কখন থাকে, কখন থাকে না।
অধম অভয়ে তা বলতে পারে না।
 ভালবাসা যায় না চেনা।
সে যে কখন জ্বালায়, কখন কাঁদায়
কখন ভাসায়, কখন হাসায়
ভাল না বাসার মানুষ তা বলতে পারে না।

 অভয় থামলে পরে অনাথ বলল, এ কেমন গান হল খুড়ো? এর মধ্যে তো ফুর্তির মেজাজ পাচ্ছিনে?

অভয় বলল, আছে খুড়ো, খুঁজে দেখতে হবে। নিধুমশায়ের টপ্পা শোনননি,

ভালবাসিবে বলে ভাল তো বাসিনে,
আমার স্বভাব এই, আমি তোমা বৈ জানিনে।

এইটি হল খাঁটি কথা খুড়ো। ভালবাসাবাসি কেমন তা জানি না। ভালবেসে যাব, এই ভেবে নিজের সুখ।

অনাথ ধরতে পারল না অভয়ের কথা, মনটা তার সহজ হল না। কিন্তু সময় ছিল না তার। বলল, এবার আমি যাই, কিন্তু তোমার মনের কথা তো ধরতে পারলুম না। অভয় বলল, ধরবার কিছু নেই, মন আমার ভাল আছে খুড়ো।

বিকেলবেলা যাবে বলে অনাথ চলে গেল।

অভয় এল গঙ্গার ধারে। সত্যি তার মনটা ভাল হয়ে উঠেছে। সব গ্লানি যেন কেটে গিয়েছে। গঙ্গার ধারে বসে, অনেকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে গাইল, ভালবাসিবে বলে ভাল তো বাসিনে।

প্রতি মুহূর্তেই তার নিমির মুখ মনে পড়তে লাগল। একটা তীব্র উল্লাস আবর্তিত হয়ে উঠতে লাগল তার রক্তে। প্রচণ্ড আকর্ষণে তাকে টানতে লাগল চুম্বকের মতো। গতকাল রাত্রের সমস্ত গ্লানি ও মনের অন্ধকারটাকে কিছু নয় কিছু নয় বলে সে ছুড়ে ছুড়ে দিল জলে। বিদেয় করে দিতে চাইল স্রোতের টানে।

গঙ্গার ধার থেকে উঠে এল সুরীনের বাড়িতে। ভামিনী তাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, কোথায় গেছলে তোর ঠেঙে?

অভয় হাসি চেপে বলল, কেন?

-কেন আবার? সবাই যে খোঁজাখুঁজি করে মরছে। রাত থাকতে নাকি উঠে বেরিয়ে গেছ?

অভয় বলল, রাত থাকতে কেন যাব। রাত পোয়াতে গেছলুম এটটু কারখানায়।

ভামিনী হেসে উঠল মুখে আঁচল চেপে। বলল, আ পোড়াকপাল আমার রাতের বিত্তান্ত বন্ধুদের বলতে আর তর সইল না বুঝি? এসো, বসো। চা খাবে?

চা কেন এত বেলায়? ভাত খাব না খুড়ি! ভামিনী ভু কুঁচকে বলল, ভাত কি এখেনে খাবে নাকি? তোমার শাশুড়ি যে বেঁধে বসে আছে।

ভুলেই গিয়েছে অভয় শৈলবালার বাড়িই তার বাড়ি। ওইখানেই তার সংসার। বলল, তাও তো বটে। তবে দাও চা-ই দাও একটুখানি।

ভামিনী ডেকে বলল, তবে এসো রান্নাঘরে।

 রান্নাঘরে যেতে ভামিনী তার দিকে তাকিয়ে বলল, খুব তো খুশি খুশি দেখছি। খুব জমেছে বুঝি?

অভয় হেসে উঠল। ভামিনী বলল, তা বুয়েচি। তবে, চা কেন, খুড়োর কালকের বোতলে এখনও আছে, দেব?

হ্যাঁ, অভয়ের যেন নেশাই লেগেছে। বললে, দাও।

ভামিনী খিলখিল করে হেসে উঠল। এগিয়ে দিল বোতল। অভয় চোখ বুজে বোতলের মদ ঢেলে দিল গলায়।

ভামিনী চমকে উঠে, ত্রাসে বলে উঠল, ওমা ছি, অমন কাঁচা খেতে আছে? অভ্যেস নেই, তার ওপরে বিনা জলে

অভয় হাসল। বলল, এই বেশ লাগছে খুড়ি। তা খুড়ি জানলে, তোমাদের নিমি বড় সোন্দর মেয়েমানুষ।

ভামিনী বলল, তা ডাগর হয়েছে, যৈবনকাল।

অভয় বলল, হ্যাঁ, মেয়েটার তোমাদের সারা গায়ে যৈবন গো খুড়ি। আমি পাগল হয়ে যাব!

ভামিনী হা হা করে হাসল। কিন্তু অভয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি হল তার। এ যেন সেই অভয় নয়, আর কেউ। তা হতে পারে। মনের মতো মেয়েমানুষ পেলে, পুরুষে কী কথা না বলে? বোবার মুখেও কথা ফুটে যায়। অনেক দেখেছে ভামিনী তার জীবনে।

হেসে বলল, রাতের নেশাই তালে কাটেনি এখনও?

–না খুড়ি, নেশা কাটে নাই।

বলে হো হো করে হেসে উঠল অভয়। উঠে বলল, চলি, বাড়ি যাই!

কোনওদিকে না তাকিয়ে অভয় চলে গেল। ভামিনীর ভূ জোড়া কুঁচকে উঠল একবার। তারপর আপন মনেই হাসল আবার। মনে মনে বলল, ছোঁড়া একেবারে মজেছে।

শৈলবালা চেঁচিয়ে উঠল অভয়কে দেখে। বেড়াতে বেরিয়েছিল শুনে, বকাঝকা করল জামাইকে।

কিন্তু খেয়ে দেয়ে সেই যে অভয় শুল, ঘুম ভাঙল একেবারে সন্ধ্যা পেরিয়ে। অন্ধকার হয়ে গেছে। ঘরেও আলো জ্বলেনি। রান্নাঘরে বোধহয় রান্না হচ্ছে। কড়াখুন্তির শব্দে তাই মনে হয়।

কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ বসে রইল অভয়। অনেকখানি হালকা মনে হচ্ছে এখন নিজেকে।

এমন সময় হ্যারিকেন নিয়ে ঘরে ঢুকল নিমি। কালেকের মতো না হলেও, আজও সেজেছে। সে। কিন্তু বাতি নিয়ে ঘরে ঢুকে, অভয়কে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল। বাতি রেখে চলে গেল বাইরে।

অভয়ের ইচ্ছে হয়েছিল, উঠে গিয়ে হাত ধরে নিমির। সেই অবসর পায়নি।

.

০২.

সন্ধ্যারাত্রে প্রতিবেশী মেয়ে পুরুষেরা আজও আসর করে বসল শৈলর বাড়িতে। হাসি মস্করা করল অনেক।

অভয় সকলের সঙ্গে কথা বলল, কিন্তু মনটা ছটফট করতে লাগল তার। সকলের সামনে নিমি খেতে দিল তাকে মুখ বুজে। ঘোমটা ছিল তার মাথায়। সেই ঘোমটা ঢাকা মূর্তি দেখে মন আরও উচাটন হয়ে উঠল। ঘোমটা ঢাকা নিমিকে আরও সুন্দর, আরও আকর্ষণীয় লাগল তার।

কিন্তু আজও গত রাত্রেরই পুনরাবৃত্তি ঘটল। বরং গত রাত্রের চেয়েও কুৎসিত এবং ভয়াবহ। অভয়ের রক্তধারায় আবার সেই আত্মক্ষয়ী পীড়ন শুরু হল।

নিমি যেন মায়াবিনী। চোখে ও ঠোঁটে তার কী এক সর্বনাশের হাসি চমকাতে লাগল ধারালো। ছুরির মতো। শিকারীর নিশ্চিত সাফল্যের মতো সেই হাসি, আপন মনে একরোখা হয়ে তার ফাঁদ বিছিয়ে চলেছে। নিপুণ সেই ফাঁদ, অব্যর্থ। শুধু ফাঁদে-পড়া শিকার সেটা তিলে তিলে মৃত্যুর মতো। অনুভব করছিল। অভয় দেখল, খাওয়ার পাট চুকিয়ে, পান মুখে দিয়ে, ঠোঁট রাঙিয়ে শৈলবালা আর। তার সঙ্গিনীদের সঙ্গে খানিকক্ষণ গজালি করল নিমি। তারপর শৈলবালার সঙ্গিনীরা বিদায় নিল। শুতে যাচ্ছিল শৈলবালা। নিমি নেমে গেল উঠোনে।

শৈলবালা জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছিস?

নিমি বলল, আসছি, তুই শো।

শৈলবালার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। বলল, আসছি মানে? কোথায় যাচ্ছিস এ রাত্তিরবেলা?

শৈলবালার গলায় ক্ষোভ ও সন্দেহের আভাস। নিমি বলল, এই পাশেই একটু ময়নাদের বাড়ি। ও বসে আছে আমার জন্যে। একটা কথা আছে।

শৈলবালা বলল, আদিখ্যেতা দেখে বাঁচিনে। পোহর রাতে উনি চললেন এখন সইয়ের সঙ্গে গুপ্ত কথা বলতে।

গলা নামিয়ে বলল, জামাইকে ঘরে রেখে, কোন আক্কেলে এখন তুই চললি?

নিমিও মুখঝামটা দিল, চললুম কি একেবারে নশো পঞ্চাশ মাইল নাকি? এই তো যাব আর আসব। তুই শো না।

কয়েক নিমেষ চুপচাপ। তাতে শৈলবালার অস্বস্তিটুকু ধরা পড়ল। নিমি চলে গেল। শৈলবালা বলল, ঢং।

কিন্তু অভয়ের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। বুকের মধ্যে জ্বলছে তার। কী অপরাধ করেছে সে? কীসের প্রতিশোধ নিচ্ছে নিমি এমন করে? এ শুধু কষ্ট দেওয়া নয়, অপমানও বটে। সে যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, নিমির সেই হাসি মুখ। বলছে, কেমন? কেমন মজা? কেন এই মজা দেখাচ্ছে নিমি? সে যখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে নিমির জন্য, তখন সে কেন আসছে না? কেন বাইরে বাইরে ঘুরছে?

নিমির খিলখিল হাসি শোনা গেল। ময়নাদের বাড়ি কাছেই, উঠোনে উঠোনে ঘেঁষাঘেষি প্রায়। বোঝা গেল দুজনে বাইরে দাঁড়িয়ে চুপিচুপি কথা বলছে। আর সেই কথারই আধা-অর্থ ওই হাসিতে ফুটে উঠছে।

শোনা গেল, ময়না বলছে হাসতে হাসতে, দৃর মুখপুড়ি!

নিমির গলা শোনা গেল, সত্যি, মাইরি বলছি।

আবার খানিকক্ষণ চুপচাপ। বোধহয় চাপা গলায় কথা হচ্ছে। তারপরেই আবার হাসি।

এই হাসি যেন অভয়েরই উদ্দেশে। অভয়েরই বুকে বিঁধছে তীক্ষ্ণ খোঁচার মতো। তার সুবিশাল শরীর শক্ত আড়ষ্ট। যেন আঘাত সহ্য করার জন্যে দাঁতে দাঁত পিষে, শক্ত হয়ে পড়ে আছে সে। ফাঁদে পড়া পতঙ্গটাকে, হুলের খোঁচায় খোঁচায় মরণ যন্ত্রণাটাকে বাড়াচ্ছে। সারা গায়ের পেশি পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে, ফুলছে ফুঁসছে যেন সাপের মতো। ঘামছে দরদর করে।

সেই ভয়াবহ কালরাত্রিই কোন অদৃশ্য থেকে পিলপিল করে এসে ঘিরে ফেলল অভয়কে। সারাদিনের কথা ভুলে গেল সে। দিনের সেই প্রসন্নতা, গতকাল রাত্রের নিজের পাশবিক আচরণের অনুশোচনা, নিমির ভালবাসার নেশায় মশগুল হতে চাওয়ার বাসনা হারিয়ে গেছে কোথায়। তার ভিতরের সেই অন্ধ বিকৃত পশুটা জাগছে আবার।

একটি খেলা-ই জানে নিমি। পশুকে খুঁচিয়ে, জাগিয়ে ভোলা। হয়তো, অভয়কে নিরঙ্কুশ পাওয়ার জন্য, এইটিই তার ভূমিকা। কারণ অভয়কে নিয়ে তার প্রাণে সংশয় ও সন্দেহের বিষ ঢুকেছে।

নিমির প্রাণে এ সংশয় ধরিয়ে দিয়েছে ভামিনী প্রথম থেকেই। সেই সংশয় থেকে নিঃসংশয় হওয়ার এইটি কষ্টিপাথর নিমির। এই কষ্টিপাথরে ঘষে ঘষে পরখ করছে সে অভয়কে। এই বিচিত্র কষ্টিপাথরের পরখ এমনি প্রতিশোধেরই মূর্তি ধরে আসে। আগুন নয়, সাপ নয়, এ যে মানুষের রক্ত ও মন নিয়ে খেলা, এই ভয়ংকর কথাটা জানে না নিমি। আগুন, সাপ সবই ভয়ংকর, কিন্তু মানুষের রক্ত ও মন তার চেয়েও ভয়ংকর। তার দাহ্য শক্তি এবং বিষক্রিয়া আরও বেশি।

না-জেনে, নিজের মনের পুরোপুরি পাওনাগণ্ডা আদায়ের লোভে, এই ভয়ংকর প্রতিশোধের লীলাখেলা খেলছে নিমি।

অভয় জীবনকে সহজ ভাবে নিতে গিয়ে, ধাক্কা খেয়ে অসহজ হচ্ছে। সে রাগছে, ফুঁসছে, জ্বলছে। সারাদিন ধরে, যেটাকে সে মিটে গেছে বলে মনে করেছিল, এখন দেখছে, আসল আগুন উসকে ওঠার আগে, এ শুধু ধোঁয়ার কুণ্ডলী। নিজেকে তার অভিশপ্ত, শরাহত পশু বলে মনে হচ্ছে। এর যেন শেষ নেই, এ মিটবে না বুঝি কোনওদিন।

গ্রামে জারজ ক্রীতদাসের জীবনে এ রকম আঁকাবাঁকা ঘোরপ্যাঁচ কিছু ছিল না। দুটি খেতে পাওয়া বড় কঠিন ছিল। সেই কঠিনতার প্রাত্যহিক অবসানে, ঘৃণা কিংবা ভালর আবেগে দুটো গান বেঁধে ও গেয়ে দিন চলার মতো সরল প্রাণ ছটফট করে মরতে লাগল এই বেড়াজালে।

সেখানে সরকারি বাবুরা মানুষ গুনতে এসে, তার নামের পাশে লিখেছিল ভূমিহীন কৃষক। এখন সে যন্ত্রের অন্ধিসন্ধি শিখছে, সে মিস্তিরি। জীবন যখন নতুন পথে শক্ত পা ফেলে এগিয়ে চলছে, তখনই এ গণ্ডগোল। তার মনের, শরীরের মধ্যে যে একটি দানবীয় শক্তি আছে, সেই শক্তি দাপাদাপি করছে, মাথা খুঁড়ছে।

কারণ সে ভালবেসেছে। আর ভালবাসাটা ফাঁদের মতো জড়িয়ে মারছে তাকে। তাই তার সহজ প্রাণে প্রথম প্রতিক্রিয়া শুধু পশুরই রূপ ধরেছে। বোধহয় এটাও জীবনের ধর্ম।

কিন্তু রাত বাড়ছে, ঝিঁঝির ডাক প্রখর হচ্ছে, বড় রাস্তার গাড়ি যাতায়াতের শব্দ কমছে, মানুষের কোলাহল চাপা পড়ে যাচ্ছে ঘরে ঘরে, তবু নিমির সখী-আলাপ শেষ হয় না। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সংকল্প নিতে পারে না অভয়। শুয়ে থাকার যন্ত্রণা ও অপমান সহ্য হয় না। অন্ধ জোঁকের মতো সে যেন ক্রমেই এলোপাথাড়ি অর্থহীন ভাবনায় রক্তলোলুপ হয়ে উঠতে থাকে।

হাসির শব্দ কমে গেছে নিমির। হয়তো ময়না নেই, সে একলাই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে আর হাসছে এই ঘরের দিকে তাকিয়ে।

পুকুরের উত্তর পশ্চিমের ঘাটে জল ঘাঁটার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ওটা বারোবাসর পাড়ার ঘাট—সেই ছুঁচিবাই মেয়েটা বোধহয় এল চান করতে। যত রাত্রিই হোক, দেহ-পণ্য সেরে, রোজ না নাইলে নাকি ওর চলে না। তারপর নাকি আবার ঠাকুর পুজোও করে আর প্রসাদ খেয়ে শোয়।

অভয়ের মন যখন ঘৃণায় ও রাগে জ্বলতে জ্বলতেও ক্লান্ত হয়ে এসেছে, সেই সময় এসে নিমি ঢুকল ঘরে।

অভয়ের বুকের মধ্যে যেন কাড়ানাকাড়া বাজতে লাগল। সে শান্ত করতে চায় নিজেকে। শান্ত করতে চায়, ভালবাসতে চায়, হাসতে চায়। সারা রাত নিমিকে বুকের কাছে নিয়ে নতুন নতুন গান বাঁধতে চায় সে।

নিমি ঘটি থেকে জল খেতে খেতে একবার আড়চোখে দেখল অভয়ের আড়ষ্ট শরীর। বলল, বাতিটা নিভিয়ে শুতে কী হয়েছিল? মিছিমিছি তেল পুড়ছে।

অভয় না উঠেই বলল, তুমি আসবে, তাই।

নিমি বিছানায় উঠে বসল। কিন্তু অভয়ের চোখের দিকে তাকালে বোধহয় আর মুখ খুলত না। বলল, তারপর পিরিতের খুড়ি কী বলল আজ দুপুরে?

–কিচ্ছু না।

কিছুটি না?

বিদ্রূপ ঘনাল আবার ঠোঁটের বাঁকে। বলল, শুধু কয়েক ঢোক মাল খাইয়ে ছেড়ে দিলে? একবার সুবলির কাছেও নিয়ে যেতে চাইল না? নিদেন পেয়ারের সাতকেলে ভাসুর পোকে নিয়ে

মুখ ফিরিয়ে স্তব্ধ হল নিমি। দেখল, তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে মোষের মতো কালো মূর্তি। চোখ রক্তবর্ণ, ধৰ্ধক্ করে জ্বলছে। কালকেও ঠিক এমনি মূর্তিই দেখেছিল নিমি। কিন্তু তার মধ্যে অনেকখানি বিহ্বলতা ছিল। আজ সে বিহ্বলতা নেই, প্রচণ্ড ঘৃণার তরল আগুন যেন গলে পড়ছে চোখ থেকে। কালকেও ভয় পেয়েছিল নিমি, আজকে তার চেয়ে বেশি ভয় তার বুকের মধ্যে শিউরে উঠতে লাগল। তবু সে বাঁকা হাসি ধরে রাখতে চাইল তাম্বুলরঞ্জিত লাল ঠোঁটে। বলল, এ আবার কী?

অভয় যেন দম বন্ধ করে বলল, কীসের কী?

–এই থেটারি ঢং?

–থেটারি ঢং?

 বলছে অভয় আর দেখছে নিমিকে। ঘৃণা হচ্ছে তার। নিমির পানপাতার ছাঁচকাটা সুন্দর মুখ। কটা মুখ, হিমানী পাউডার মাথা, লাল টকটকে ঠোঁট, একটু স্কুল ফুলো ফুলো। ঘৃণা করছে, তবু তীব্র পিপাসা অনুভব করছে ওই ঠোঁটের জন্য। ঘৃণা করছে, নিমির উঁচু নিচু নিটুট পুষ্ট শরীরকে। তবু কানা রক্ত দহে পড়ে পাক খাচ্ছে, পশুশক্তি নিস্পিষ্ট করতে চাইছে এই শরীর।

নিমির ভয়, তবু বিদ্রূপ হেসেই বলল, একে থেটারি ঢং বলে না তো আর কী বলে?

অভয় বলল, তাই বুঝি? তবে বলো, শুনি আর কী বলবে?

নিমিও যেন শক্ত হতে চাইল। বলল, আবার কি? ওই ছিনাল খুড়ির বাড়িতে

কী?

–হ্যাঁ, ওখেনে আর ভাসুর-পো-গিরি করতে যাওয়া চলবে না।

কথা শেষ হবার আগেই, নিমির মনে হল, প্রচণ্ড একটা ভারী কিছু ঠাস্ করে পড়ল তার মুখের ওপর। সে চিৎকার করে উঠতে গেল, কিন্তু আরও, আরও ভারী কিছু তাকে যেন নিমেষে তল করে দিল। খাস রুদ্ধ হয়ে এল তার। চোখ ফেটে জল এল, তবু কি এক বিচিত্র সুখ-স্বপ্নের মধ্যে হারিয়ে যেতে লাগল সে।

তারপর যখন সংবিৎ ফিরে এল অভয়ের, সে কালকেরই মতো আবার দেখল, ঘুমের কোলে ঢলে পড়ছে নিমি। অথচ, অভয়ের মনে হল, তার বুক থেকে কী একটা কঠিন বস্তু ঠেলে উঠে আসছে। চাইছে। চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসছে যেন। মনে হল, সে হয়তো চিৎকার করে উঠবে। চিৎকার। করে ডাকবে, হে ভগবান, ভগবান!

কিন্তু দু হাতে মুখ চেপে ধরল সে। তীব্র ধিক্কারে নিজেকে সে বিভীষিকার মতো ঘৃণা করছে। নিজেকে পাপী মনে হচ্ছে। একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন যেন নিজেকে তার নরকের প্রেতের মতো মনে হচ্ছে।

তার পুরানো জীবনে সে সারাদিন মাঠে কাজ করেছে তবু খেতে পায়নি। দারুণ ক্ষুধায় সে ঘৃণা করেছে, অভিশাপ দিয়েছে। যখন সহ্য হয়নি, তখন পালিয়ে গেছে গ্রাম ছেড়ে শহরে! কুলির কাজ করেছে, গান বাজনা শুনেছে, গাড়িঘোড়া দেখেছে, আবার ফিরে এসেছে গ্রামে। এই যাওয়া আসার মাঝখানে দেখেছে সে, সংসারে অনেক দুঃখ। মানুষ বড় দুঃখী। সে হাসে, কাঁদে। কিন্তু জীবনের কোথায় কতগুলি অ-দেখা বেড়া ঘিরে রেখেছে মানুষকে। মানুষ মুক্তি চায়।

মুক্তি, মুক্তি! এই কথা মনে হতেই, কথা তার আপনি যুগিয়ে উঠেছে মুখে। সে গান বেঁধে ফেলেছে। মুক্তির সেই অর্থ তার অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য।

দুঃখকে অভয় ভয় করেনি। করতে নেই, করলে বাঁচা যায় না। কিন্তু একি জীবন? নিমি তাকে দুঃখ দেয়। কিন্তু সে কেন নির্দয় হয়? জানোয়ার হয় কেন সে? সাঁতরা কবিয়ালকে মেরে প্রাণে তার দুঃখ থাকে না। নিমির মার-খাওয়া ফুলে-ওঠা রক্ত-জমা নীল ঠোঁট দেখে বুক তার ফেটে যায় কেন তবে? এখনও যে জল জমে আছে নিমির চোখের কোণে। নিজের বিবাহিতা স্ত্রীকে ধর্ষণ। করেছে সে। মনের এই ভয়াবহ বেড়াজাল থেকে মুক্তি চায় অভয়। মুক্তি চায়, তাই ক্ষমা চাইবার। জন্য দু হাত বাড়িয়ে সে নিমিকে ধরে ডাক দেয়, নিমি, নিমি।

নিমি চোখের পাতা খোলে। গাঢ় রক্তাভ ঘুমন্ত আচ্ছন্ন দৃষ্টি।

অভয় আবার ডাকে, নিমি।

এ মেয়ে, সে মেয়েই নয় যেন। বলে, কী?

অভয় বলে, বড় অন্যায় হয়ে গেছে ভাই।

এবার যেন নিমির চোখে দৃষ্টি ফিরে এল। পরমুহূর্তেই আবার ঘুমে ঢলে পড়ে বলল, ছাড়ো। রাত করে আদিখ্যেতা আমার ভাল লাগে না।

আবার ঘুমিয়ে পড়ল নিমি। অভয় তার একটি ঘুমন্ত শিথিল হাত নিজের হাতে নিয়ে, চুপ করে বসে রইল অন্ধকারে। এই গভীর অন্ধকারের ওপারে কী আছে, কে জানে।

.

০৩.

কিন্তু কম আর বেশি, জীবন একই ধারায় বয়ে চলল। হয়তো নিমির কথার হুল কমে, প্রতিদিনের জীবনে বিদ্রূপ ও উত্তেজনা চাপা পড়ে যায় অনেক। কিন্তু চরিত্র বদলায় না সহজে।

অভয় হয়তো প্রতিদিনই রুদ্র হয়ে ওঠে না, ভয়ংকর মূর্তি ধারণ করে না। কিন্তু সে দেখল, জীবনের পথ বড় বাঁকা। তার সাধ কখনও পুরোপুরি মেটে না। পিপাসা মেটে না কখনও আকণ্ঠ ভাবে। জীবনে শুধু বাধা, বাধা। ঘরে, কারখানায়, মনের মধ্যে কত রকমের বাধা। নদীর টানা স্রোতে হঠাৎ ঘূর্ণির মতো।

কতদিন কারখানার ছুটির শেষে, সন্ধ্যাবেলায় গঙ্গার পারে, মধ্যরাত্রে উঠোনে দাঁড়িয়ে বিশ্বসংসারের সঙ্গে একলা একলা কথা বলতে চায় সে। মনের মধ্যে আবোল তাবোল কথা আসে। তাকেই সুর করে বলে। গ্রামে থাকতেও, এ সংসারের নিষ্ঠুরতায় এমন একলা একলা অনেক কথা সুর করে বলেছে। যত বলা যায়, ততই যেন বুকের রন্ধ্রে জমা বিষবাষ্প উপে যায়, হালকা হয়। সব কিছু সহজ হয়ে আসে। সহজ ভাবেই মনে হয়, মন গুণে ধন, দেয় কোন জন? এ তো কোনওদিনই। ভরবে না, কোনওদিন না।

ভামিনী খুড়ির কাছেও সে ঠিকই যায়। পথে পড়লে সুবালার সঙ্গেও কথা বলে। যদিও সুবালার ঘরে যায় না, গান করে না। তবু সুবালা যখন তার গানের প্রশংসা করে, তখন তার মনে একটি যুগপৎ ব্যথা ও আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। ঠিক আগেরই মতো। যদিও নিমি আছে, নিমির মন। আছে এবং মনে মনে একটি পরাজয় বোধে সে জ্বলে, বিদ্রূপ করে, তবু অভয় ঠিক তার নিজের মতোই চলে। নিমির কাছে নিমির মতো করে সঁপে দিতে পারে না। নিমি তার নিজে থেকে যতটুকু দেয় ভালবেসে কিংবা ঘৃণা করে, ততটুকু নিয়েই অবিচলিত থাকতে চেষ্টা করে।

মন নিজের কাছে যে-জায়গাটায় মাথা কুটে মরে, যেখানে সে দু হাত বাড়িয়ে আছে বাকিটুকুর জন্যে সেখানকার হাহাকার চাপা পড়ে থাকে নিজের কাছেই।

কেবল অনাথ খুড়ো তার জীবনটাকে মাঝে মাঝে কষে নাড়া দেয়। কারখানার প্রতিদিনের জীবনে সে যত বেশি লিপ্ত হয়, অনাথ খুড়োর সঙ্গে যতই কথা বলে, ততই এক নতুন দিগন্ত ভেসে ওঠে তার চোখে। তার জন্ম, তার সুদীর্ঘ জীবনের সব ভার, বেদনা ও অপমান যেন একটা বিরাট পাথর নড়ে ওঠার মতো টলমল করে ওঠে।

পাড়া ঘরে এ কথা কারুরই অজানা রইল না, নিমির সঙ্গে অভয়ের মিশ খায়নি। নানান জনে। নানান রকম তার ব্যাখ্যা করলে।

কেউ বললে, ডাগর মেয়ে, পাকা ঝিকুট। কোনও রাশ ছিল না। এখন ও মেয়ে এত সহজে বাগ মানবে কেন? কেউ কেউ বিশুর সঙ্গে নিমিকে জড়িয়েও অনেক কথা বললে। বিশুর বউ হয়তো কিছু মনে করত না। নিমির হাবভাব দেখে, তার সন্দেহ দৃঢ় হল, তবে বুঝি শিকড় অনেক গভীরে। তাই সেও তাল দিলে সকলের সঙ্গে।

আর মানুষের মন এমনি বিচিত্র, যে মুহূর্তে সকলেই জানল, সুবালাকে নিয়েই নাকি নিমির যত জ্বলুনি, সেই মুহূর্ত থেকে তাদের পবিত্র কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল–অভয়কে সুবালার দরজায় পাহারা দেওয়া। কিন্তু সেখানে ঘটনা বলে কিছু নেই। কারণ, অভয় সুবালার কাছে যায় না।

না-ই বা গেল। অমুকে নাকি দেখেছে অভয়কে সুবলির কাছে যেতে, পোহর ভর বসে বসে রঙ্গ রস করতে নাকি দেখেছে। অমুক শব্দটার সবচেয়ে বড় সুবিধে, তার অস্তিত্বের কোনও প্রয়োজন হয় না। অমুকের স্থান নেই, কাল নেই, পাত্র হিসেবে সে ব্রহ্মের মতো সর্বত্র বিরাজিত। অমুকের পাখায় চড়ে, অমুকের মুখ দিয়ে মানুষ সত্যি মিথ্যে সব কথাই বলতে পারে, সব রকম রটনা করতে পারে। তার কোনও প্রমাণপত্রের দরকার হয় না। আইন অমুকের নাগাল পায় না কখনও।

এই অমুক মানুষের মনের বিচিত্র এক কথাশিল্পী। কল্পনায় তার জুড়ি মেলা ভার, কথার আঁটসাট বাঁধুনিতে সাহিত্য সম্রাট হার মানে।

সেই অমুকের দেখা নানান কাহিনী নানানখানা হয়ে আলোচিত হয়। উদ্দেশ্যটা, নিমির কানে কথাগুলি তুলে দেওয়া।

নিমি বিশ্বাস করে না, অবিশ্বাসও করে না। সংশয়েই জ্বলে মরে।

কারণ, বিকেল পাঁচটায় যখন কারখানার ছুটির বাঁশি বাজে, তার কিছুক্ষণ আগে থেকেই, ঘড়ি না দেখেও নিমির মন আনচান করে। তারপর যখন বাঁশি বাজে, তখন সে নানান অছিলায় বাইরে উঁকিঝুঁকি মারে। উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে, চুল বাঁধতে বাঁধতে রাস্তার দিকে চোখ রাখে। পুকুরে গা ধুতে গিয়েও চোখ রাখে রাস্তার দিকে। তখন চোখে পড়ে, পাড়ার লোক, যারা কারখানায় কাজ করে, তারা ফিরে আসছে একে একে।

আইবুড়ো কালের তার প্রেমের ছেড়া সুতো জোড়া লাগাবার জন্যে বিশুর এই সময়টুকুই একমাত্র হাতে থাকে। কারণ সেও জানে, অভয় এখন বাড়ি ফিরবে না। নিমি এখন একলা। শৈলবালার সঙ্গে দেখা করবার ছল করে, বাড়িতে আসে সে।

নিমি হয়তো তখন গা ধোয়ার শেষে, শুধু সায়া ব্লাউজ পরেই, ঘরের দরজায় নিশ্চিন্তে বসে আলতা পরে পায়ে। ধোয়া মুখ ঘষে, হিমানী মাখে। চাঁপা ফুলের সুবাসিত কুমকুমের টিপ দেয় কপালে। দিতে গিয়ে চমকে ওঠে উঠোনের ঝাঁপ খোলার শব্দে।

বিশু জিজ্ঞেস করে, মাসি আছে?

অর্থাৎ শৈলবালা। নিমি উদাস বেশবাস সামলায় না। খুব সহজ ভাবেই জবাব দেয়, না।

মিথ্যে নয়, একদিন এই বিশুর সঙ্গে প্রেম হয়েছিল নিমির। তখন বিশুকে ভালও লাগত। আসরে যাত্রা করার সময় বিশু যে রকম ঢং-এ পার্ট বলে, সেই ঢং-এ প্রেমের কথা বলত। শুনতে ভাল লাগত নিমির। বিশুর কাছে তখন নিজেকে সঁপে দিয়ে খুশি হত। আরও প্রতিদ্বন্দ্বিনী ছিল নিমির। কিন্তু নিমি বিশুর একেশ্বরী ছিল।

এখন আর বিশুকে ভাল লাগে না। শুধু ভাল লাগে না নয়, কেমন যেন ঘৃণাও হয়। বিশুর বউ ছেলেমেয়ে থাকা সত্ত্বেও নিমির ভাল লেগেছিল তাকে। কারণ বিশু ভালবাসতে জানত। তার আবেগ ছিল। নিমির ছায়া দেখলে, চকিত হত। চোখ মুখের ভাব যেত বদলে। আর নিমির জন্য বিশু যেন সকলের মাথায় পা দিয়ে দাঁড়াতে পারত।

কিন্তু যে অভয়কে নিয়ে নিমির এত অশান্তি, সেই অভয়ের সামনে বিশুকে এখন যেন নিষ্প্রভ লাগে। পুরুষ যে শুধুই পুরুষ নয়, মানুষ হিসেবে তাদের মধ্যে অনেক তারতম্য। সেই কথাটি প্রথম অনুভব করছে অভয় বিশুকে দিয়ে। মানুষ হিসেবে বিশু যেন ছোট। তার বুক আর তেমন উদ্ধত মনে হয় না। যাত্রার সং বলেই মনে হয় এখন। চোখের চাউনির আবেগে শুধু একটি স্বার্থপর। লোভ দেখা যায়। নিমিকে হারাবার ব্যথা নেই বিশুর মুখে, শুধু ক্ষুব্ধ আফশোস। এ বিশু এখন। লুকিয়ে আসে, মাথা নিচু করে। সুযোগ বুঝে, পকেটে হাত দিয়ে, পকেট কেটে কিছু হাতিয়ে নেবার। মতলবে যেন তার হাত নিশপিশ করে।

তবু, পুরনো প্রেমের কথা একেবারে চট করে ভোলা যায় না। বিশুকে মুখের ওপর কোনও কথা বলে না নিমি।

শুধু বিশু ভেবে পায় না, নিমি এমন নির্বিকার হল কেমন করে। একদিনের অধিকার নিয়ে, এখন তাই তার রাগ হয়। সে রাগটুকু নিমি টের পায়, তাতে তার ঘৃণা যেন আরও বাড়ে। বিশুও তাই চিরকালের ভীরু আর হতাশ পুরুষের মতো নিজের মনে মনে বাণী দেয়, মেয়েমানুষকে বিশ্বাস করতে নেই।

শৈলবালা নেই জেনেও বিশুর ফিরে যাবার তাড়া থাকে না। দাঁড়িয়ে সে পা ঘষটায়। মনের রাগ ঘৃণা হয়ে ওঠে, আর সেটুকুও বিশু চাপতে পারে না ঠিকমতো। বলে, কেমন আছ নিমি?

আয়নায় মুখ দেখতে দেখতেই জবাব দেয় নিমি, মরতে বাকি আছে।

 কিন্তু বিশু বুঝতে পারে, মরার বাসনায় নিমি নিশ্চয়ই সাজতে বসেনি। সে শুধু তাকিয়ে থাকে। কথা জোগায় না মুখে।

কথা বললে তবু ভাল লাগে। কিন্তু লোভ ও রাগ নিয়ে শুধু এমন নীরবে চেয়ে থাকা দেখে নিমিরও রাগ হয়। বলে, এখন যাও। মা গেছে পাড়ায় কোথায়। পরে এসো।

বিশু বলে, এসেই বা লাভ কী?

নিমি বলে, লোকসান দিতে এসো না তালে?

অভয়কে নিয়ে নিমির প্রাণের জ্বলুনিতে বিশু দুঃখ পায় না বরং রাগে এবং বিদ্রুপে তার মুখ কুৎসিত হয়ে ওঠে। বলে, এদিকে তো শুনছি, গায়ক অন্য জায়গায় টোপ ফেলছে।

নিমিরও চোখ দপিয়ে ওঠে। বলে, তাই বুঝি তুমি পুরনো চার ঘেঁটে দেখতে এসেছ? তবে এই মুরাদে আর হবে না। তোমাকেও চিনে নেওয়া হয়েছে।

-সত্যি?

–নয় তো?

কী চিনলি?

–চিনলুম আবার কি? দেখলুম, নিমির জন্যে তোমার পেরান পুড়ছে। তবে জেনে রেখো, আমি তোমার ফাউয়ের মাছ নই।

কথাগুলি যত তীক্ষ্ণ, সুর অবশ্য তেমন তীব্র নয়।

বিশু চলে যায়।

এ রকম কথা কাটাকাটি প্রায়ই হয়। বিশু যেটা বোঝে না, সেটা হল, যে জিনিস না হলে মেয়েমানুষই হোক আর পুরুষ মানুষই হোক, তার মন পাওয়া যায় না, সে জিনিস সে কখনও নিমিকে দেয়নি। তাই আজ কারুর জন্যেই কারুর বাজে না। একজনের থাকে শুধু লোভ আর বিদ্বেষ। আর একজনের মনের মতো না পাওয়ার জ্বালা ও সুহৃদহীন জীবন। যে সুহৃদ হবার কথা ছিল একমাত্র বিশুরই।

কিন্তু নিমির প্রতীক্ষার মধ্যে সংশয়ের আগুনই শুধু জ্বেলে দিয়ে যায় বিশু। তবু নিমি শাড়ি পরে ঝঝকে পিতলের কলসি নিয়ে রাস্তার ধারের জলকলে যায়। একটু অন্ধকার হলে জল আনতে যাওয়াই নিমির অভ্যাস। কিন্তু তর সয় না। জল ভরার ছল করে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিটি মানুষের। মুখ আড় চোখে লক্ষ করে।

চেনা অচেনা অনেক মানুষ আসে। অভয় আসে না।

রোজ রোজ না হলেও, সন্ধ্যার ঘোর ঘোর অন্ধকারে, মাথায় ঘোমটা টেনে নিমি মালিপাড়ার মধ্যেও ঢুকে যায়। অভয় আসছে কি না সেটুকুই শুধু নয়, সুবালার দোরগোড়ায় যদি একদিনও আবিষ্কার করা যায় অভয়কে।

অভয় আজকাল অনেক দেরি করে বাড়ি ফেরে। সত্যি মিথ্যে নানান রকম শোনা যায়। অভয় কোথায় যায়, কোথায় সময় কাটায়, তার সঠিক সংবাদ নিমি পায় না। অভয় নিজেও সে কথা বলে না নিমিকে। যদিও এখন প্রতিদিনের বিবাদের সূত্রপাত, কথাবন্ধ, উপোস দেওয়া ব্যাপারগুলি এই বাড়ি ফেরার ঘটনা দিয়েই শুরু হয়।

কিন্তু এই উপদ্রবে অভয় নির্বিকার থাকবার চেষ্টা করে। মহাভারত, রামায়ণ, তালাচাবির কারিগরী, নানা রকমের বই ছাড়াও, আরও অনেক বই আজকাল নিয়ে আসে অভয়। নিমি সে সব বইয়ের নাম জানে না, পড়তেও পারে না। তাদের সমাজে ও পরিবেশে বই মুখে দিয়ে বসে থাকার এমন অনাসৃষ্টি মানুষ ও কাণ্ড সে কখনও দেখেনি। তাই বইগুলির প্রতি তার অসীম ঘৃণা। প্রায় প্রত্যক্ষ সতীনের মতো। পাড়ায় পুরুষেরা যাত্রা করে, বই পড়ে পড়ে পাট বলে দেবার জন্য একজন লেখাপড়া জানা লোক আসে। লোকে তাকে বলে মাস্টের। কিন্তু এই অসুর-সমাজে অভয়ের এ কেমন ধারা প্রহ্লাদ-পনা? জজ-ম্যাজিস্টর হবার মুরোদ নিশ্চয়ই নেই। তবে? বইগুলিতে বোধহয় যাদু শেখার কথা লেখা আছে। নয়তো গুনিনের মন্তর-তন্তর তুক-ফুক বশীকরণের ব্যাখ্যা আছে নিশ্চয়। আর ও সব যারা শেখে, তারা যে কী চরিত্রের মানুষ হয়, সে কথাও নিমি জানে।

কিন্তু কাকে বশীকরণ করতে চায় অভয়, কাকে ওষুধ করতে চায়?

বইগুলি আছড়ে ফেললেও, মনের ঝাল মেটাবার জন্য ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে সাহস হয় না নিমির। আর বইগুলির কথা সারাদিন তার মনে থাকে না। অভয় রাত্রি জেগে বিড়বিড় করে বানান। করে করে যখন পড়ে, নিমির দিকে ফিরেও তাকায় না, তখন নিমির রাগ হয়।

নিমির সঙ্গে কি শুধু একটি-ই মাত্র সম্পর্ক? শুধু একটি ধর্ম পালন করলেই কি সব ফুরিয়ে যায়? তার পরেও কি এ ঘরে নিমির অস্তিত্ব থাকে না?

নিমি দু চোখ ভরে ঘৃণা নিয়ে, বই ও তার পাঠকের দিকে তাকায়।

নিমির ঘুম আসে না।

হ্যারিকেনের আলো যতই আড়াল করুক, অভয় যতই অন্ধকার করে দিক নিমির দিকে, তার ঘুম আসে না। যতক্ষণ পর্যন্ত বই বন্ধ না করে ততক্ষণ পর্যন্ত জেগে থাকে সে। নিঃশব্দে নয়, সশব্দেই জেগে থাকে। কথা নয়, কথার চেয়েও তীব্র কতকগুলি শব্দ আছে। চরিত্র ও পরিবেশ অনুযায়ী সেই শব্দগুলি আশ্চর্য রকম কার্যকরী।

থেকে থেকে নিমি হঠাৎ এক একটা দীর্ঘ হুঁ দিয়ে ওঠে। যার মধ্যে অনেক না বলা বিদ্রূপ ও বিরক্তি ওঠে ফুটে। কখনও কখনও তার সহসা ককানি শুনে মনে হয়, কী কষ্ট যেন হচ্ছে নিমির। সে যেন কাঁদছে, ছটফট করছে।

আবার কখনও কখনও নিঃশব্দে অভয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকে। ভেবে ভেবে যেন কূল-কিনারা পায় না।

কূল-কিনারা পায় না বলেই, তার নিজের দিকে নৈতিক সমর্থনের অভাব হয়ে পড়ে। চোখের সামনে দেখা দেয় অভয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবেরা, যারা প্রায়ই এ বাড়িতে যাতায়াত করে। অনাথ মিস্ত্রি তাদের মধ্যে একজন, যাকে সকলে ভালবাসে, ভক্তিও করে।

সেই অনাথ অভয়ের নামে অজ্ঞান। অভয়ের ভাল বাখানে পঞ্চমুখ। মন্দ বাখানে রা নেই।

কিন্তু অনাথদের সঙ্গে নিমিদের মিল কোথায়। অনাথের নামের সঙ্গে ভয় মিশিয়ে আছে। জেল খাটতে, গুলি খেতে যার ভয় নেই, সে অনাথ। যার চার পাশে, অদৃশ্য ওতপাতা বাঘের মতো পুলিশি ত্রাস বিরাজ করছে, সে হল অভয়ের গুরু। যে অনাথ ওই এক কাজে বউ ছেলে মেয়ে সব হারিয়েছে। যে মানুষ আগে কোনও বাধা রাখেনি, পিছনে রাখেনি কোনও টান।

সুবালার কম্পিত কুহকী মায়ায় যত সর্বনাশের ভয় নিমির, অনাথের সঙ্গে ঘোরাফেরায় তার চেয়ে কোনও অংশে কম ভয় নয় তার।

ভালবাসার কী বিড়ম্বনা নিমির। ভয় তাকে কখনও ছেড়ে যায় না। অকূল ভাবনায় তার ছোট মনটিতে যে কত উদ্বেগ ভরে ওঠে, সংসারে সে কথাটা কেউ জানে না। জানতে চায় না। নিমিরও যে বড় দিশেহারা লাগে নিজেকে, চোখ মেলে সেটুকু দেখবার সময় নেই কারুর। চোখও নেই।

এ সব কথা ভেবে, নিমিরও যে কান্না উথলে ওঠে, তা কেউ শুনতে পায় না।

.

০৪.

অভয়ও টের পায়, নিমি ঘুমোয় না। মিথ্যে নয়, নিমির নানান রকম শব্দগুলি তার মনোযোগের ব্যাঘাত করে। মিথ্যে নয়, বইগুলির সঙ্গে অনাথ খুড়োর চাক্ষুষ যোগাযোগ আছে।

কিন্তু প্রথমে প্রথমে নিমি যেমন করে অভয়ের মনকে কুলুপকাটি এঁটে, যখন খুশি ভোলা বন্ধ করতে পারত, আজ আর তা পারে না। নতুন নতুন বিস্ময়ের দরজা তার চোখের সামনে খুলে দেবার যাদুটা শিখিয়ে দিয়েছে অনাথ। সেই বিচিত্রের মাঝে, নিমির ঢোকবার কোনও দরজা নেই।

অভয়ের চেয়ে অনাথ কিছু বেশি পণ্ডিত নয়। কিন্তু অভিজ্ঞতা আছে। রামায়ণ, মহাভারত, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কারিগরী শিক্ষা ছাড়াও, মজুরি ও পুঁজি নামে বইয়ের কপালে মাথা কোটে অভয়। বইটি তাকে অনাথই দিয়েছে। বানান করে করে অভয় যেটুকু উদ্ধার করে, বাক্য হিসেবে সেটুকু পড়ার মতো হয়। কিন্তু মানে বুঝতে গিয়ে গুরু শিষ্যের প্রায় একই দশা। সহজ হিসেবের এত যে গরমিল, কে জানত। টিপসই দিয়ে হপ্তা নেবার বেলায়, কোনওদিন মনে হয় না, এই মজুরির সঙ্গে, সমুদ্রের মতো অতল রহস্যময় পুঁজির কোনও যোগসাজস আছে, তার সঙ্গে আছে আরও ভারী ভারী কথা। উৎপাদন পণ্য ক্রয় ও বিক্রয় সমাজ ব্যবস্থা ধন বণ্টন ইত্যাদি কথাগুলি বানান করে পড়ে অভয়ের নিজেরই মনে হয়, বাঁদরের মুঠিতে যেন কেউ মুক্তো ভরে দিয়েছে। আড়ষ্ট জিহ্বার কোলে, কতগুলি অর্থহীন শব্দ প্রলাপের মতো।

তবু, কুয়াশা ঢাকা দিগন্তের মতো কী একটি অস্পষ্ট আলোকের রেখা যেন চিকচিক করে ওঠে অভয়ের চোখের সামনে। তার কোনও স্পষ্ট মূর্তি নেই। তার দীপ্ত হাসি ও প্রখর তাপ ফুটে ওঠে না মেঘ-চাপা দিকচক্রবালে। রক্তাভ সুগোল অবয়ব নিয়ে তার রথ হয়তো দেখা যায় না।

কিন্তু সে আছে। অনেক কুয়াশা ও মেঘের আড়ালে সে যেমন আছেই আছে, তেমনি অর্থহীন অস্পষ্ট কঠিন কথাগুলির মধ্যেও অনাবিষ্কৃত মানে যেন ঠাহর করা যায়। শুধু বোঝা যায় না।

অভয়ের তাই সব কিছুতেই বড় বিস্ময়। গান গেয়ে সে যেমন বলে, এক থেকে ডাইনে গেলে, শত সহস্র অযুতে কোটিতে তুমি যেতে পারো। কিন্তু বাঁয়ে? এককে কোটিতে নিয়ে যাওয়া যায়। বাঁয়ে যে অসীম ও অনন্ত বিন্দু, তার হদিস কোথায়?

তখন মনে হয়, সবই ওর জটিল ও কঠিন।

অনাথ বলে, অত কথার খোলস না হয় না ভাঙতে পারলুম। জীবনটার দিকে তাকিয়ে দেখো না কেন? ওই প্যাঁচানো পাকানো কুচুটে কথাগুলোনের মানে জলের মতন সহজ হয়ে রয়েছে সবখানে।

কেমন?

জীবনটা। অবিচার আর অনাচারের ছড়াছড়ি। ঘরে যাও, ঘরে, পথে যাও, পথে ; সবখানে। খাওয়া, পরা, বাস, যেদিকে চোখ দেবে, বড় বড় সব কথার মানে একেবারে সাফ।

অভয়ের তখন মনে হয়, তাও তো বটে!

তবে? এই অবিচার আর অনাচারটাকে জগত ভরে চালাবার জন্যে অনেক বড় বড় মাথা খাটানো হয়েছে। সেই মাথা খাটানোচালাকিটা, আর একজন মাথা খাটিয়ে বইয়ে লিখেছে। বুদ্ধি দিয়ে না বুঝলেও, মন দিয়ে বোঝা যায়। চোখ মেলে দেখা যায়।

তবু বইয়ের বুকে মাথা কুটে মরে অভয়। যদিও বই তার কাছে পাথরের সামিল। কী যেন আছে, কী যেন নিঃশব্দে বলছে সেই পাথর। সেই কথাগুলি শুনতে চায় সে। কিন্তু সেখানে সমাজের কথা আছে। সমাজের কথা জানতে গেলে, ইতিহাস আছে। ইতিহাস জানতে গিয়ে একটা কঠিন দুর্বোধ্য মস্ত গল্পের মতো মনে হয়। আশ্চর্য অদ্ভুত গল্প। অভয়ের সামনে নানান পোশাক-পরিচ্ছদ পরা, নানান ধরনের মানুষের মূর্তি ভেসে ওঠে। বিচিত্র সব কল্পনায় পেয়ে বসে তাকে। সে যেন ইতিহাসকে দেখতে পায়। কিন্তু তাকে বুঝতে পারে না।

তবু মনের একটি জায়গা কখনও ভরতে চায় না। সেখানে শুধু নিমির কঠিন মুখ ও বিদ্রূপ চাহনি।

মানুষের অনেক সাধ। নিজেকে ছাড়িয়ে যাবারও তার বড় সাধ। বুঝি সাধনাও।

মাঝে মাঝে ছোটখাটো কারণে এই আড়ষ্ট জটিলতা কেটে যায়।

ইতিমধ্যে পাড়ার যাত্রার দল যাত্রা করেছে। অভয় বিবেক সেজে গান করেছে। বিশু ছাড়া –সুখ্যাতি করেছে সবাই। রতন ঠাকুর, যাত্রা গানের কেলাবের মাস্টার। সে বলেছে, এতদিনে একটা খাঁটি বিবেক পাওয়া গেছে দলে। একা এই বিবেক দিয়ে এখন কলকাতা ঘুরে আসা যায়।

যাত্রার আসর শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু গানের পালা শেষ হয়নি। এ বাড়ি ও বাড়ি পাড়ায় চায়ের দোকানে কারখানায় আরও অনেকবার গাইতে হয়েছে। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে বিবেকের গান।

বাজারের মাছের কারবারি গান শুনে মেডেল দিয়েছে। রুপোর জল লাগানো লোহা নয়। এক ভরি ওজনের খাঁটি রুপোর মেডেল। লাল সিলকের ফিতেয় বাঁধা নিজে ঝুলিয়ে দিয়েছে বুকে।

মালিপাড়ারই বারোয়ারি তলায় যাত্রা হয়েছে। নিমি গিয়েছিল। পাড়ার মেয়েরা কেউ বাকি ছিল না। নিমি দেখেছিল সুবালাও এসেছে।

মাছের কারবারি শরত দাস যখন মেডেল দেয়, তখন নিমির দিকে কেউ তাকিয়ে দেখেনি। তার দুই চোখে যেন খুশির বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছিল কেউ। আশেপাশের মেয়েদের চাউনির জ্বালায় মুখখানিকে গম্ভীর করে, মাথা নিচু করে রেখেছিল।

কিন্তু মেয়েদের আসরের মধ্যে, খিলখিল হাসি ও নির্লজ্জ হাততালি শুনে, চমকে দেখেছিল নিমি, সুবালা। সুবালার পাশে বসে, গিরিবালা সিগারেট টানছিল। সে বলেছিল, এই ঠুড়ি হাততালি দিচ্ছিস কেন লো মুখপুড়ি? মুখপোড়া মিনসেরা যে সব এদিকে তাকে রয়েছে।

সুবালা বলেছিল, থাকগে। লোকটা মাইরি জবর গায় গিরিদিদি।

এই পর্যন্তই এসেছিল নিমির কানে। তারপরেই চোখাচোখি হয়েছিল গিরিবালার সঙ্গে। চোখাচোখি না হলে গিরিবালা যে কথাটি বলত, সেটা তার মুখেই চাপা পড়ে গিয়েছিল। গিরিবালা বলতে চেয়েছিল সুবালাকে, জবর গানের গাইয়ে তো তোর ঘরের গাইয়ে।

তাতেও বোধহয় আপত্তি ছিল না নিমির। সে দেখছিল সুবালার অপলক চোখের আর পলক পড়ছে না অভয়ের ওপর থেকে। যতই দেখছিল ততই নিমির মুখের সব আলোটুকু আসরের বিজলি আলোও ধরে রাখতে পারেনি। খুশির দীপ্তি নিভে গিয়েছিল একটু একটু করে। একটু একটু করে, স্বামীর জন্যে সব অহঙ্কার উবে গিয়েছিল।

দলের মধ্যে বিশু ডেকে কথা বলেনি। ঘরে নিমি মুখ ফুটে বলেনি কিছু আগে। অভয়ই জিজ্ঞেস করেছে। হেসে অনেক আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, বিবেকের গান কেমন লাগল?

নিমি জবাব দিয়েছে, যার ভাল লেগেছে, সে তো আসরে দাঁড়িয়েই হাততালি মেরেছে। শুনতে পাওনি?

-না তো।

–তবে তোমার কপাল মন্দ। রাত পোহালে যেয়ো তার কাছে। বুকের কাছে দাঁড়িয়ে শুনিয়ে দেবেখনি।

এর বেশি আর বলতে হয়নি। বুঝতে বাকিও থাকেনি অভয়ের।

তবু, কয়েকটা দিন যেন তার জীবনের বন্ধ দরজা খুলে গিয়েছিল। যেই ঝোঁকের মাথাতেই অনাথ খুড়ো ধরে বসল তাকে। ধরল এমন বেকায়দায়, একেবারে সভার মধ্যখানে। কারখানার মজুরদের সভা। হাজার হাজার লোক। তার ওপরে লোক এসেছেন কলকাতা থেকে বক্তৃতা দেবার জন্যে। সকলে উঠে দাঁড়িয়ে, হাততালি দিয়ে তাঁদের সম্মান জানায়।

অনাথ খুডোরও সেখানে খুব মান। যন্ত্রের চোঙাটার কাছে দাঁড়িয়ে, অনাথ খুড়ো বেমালুম চেঁচিয়ে বলে দিল, আমাদের রিপেয়ারিং ডিপার্টের কবিয়াল অভয়চরণ আজ গান গাইবেন। নিজের তৈরি গান।

অভয় থ। রিপেয়ারিং-এর মিস্ত্রিরা হাততালি দিয়ে চিৎকার করে উঠল। জনাকয়েক প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে দিয়ে গেল তাকে যন্ত্রটার সামনে।

অত বড় ষণ্ডার মতো মানুষটা অভয়। যন্ত্রটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল, সে বুঝি চিৎকার করে কেঁদে উঠবে। এ কী করলে খুড়ো?

অনাথ বলল, ঠিক করেছি। প্যাঁচার মতো দিন রাত্তির থম্ ধরে বসে থাকলেই হবে? লোকে তোমাকে আমার স্যাকরেদ বলে। ও সবে আমার লোভ নেই। তোমাকে বক্তিমে দিতে হবে না, কিন্তু তোমার মধ্যে মাল যা আছে, তা ছাড়তে হবে। নে, আরম্ভ কর।

অভয় আবার বলল অসহায় ভাবে, কী আরম্ভ করব অনাথখুড়ো, বলে দাও।

অনাথ বলল, তা আমি কী জানি।

কলকাতা থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের একজন বললেন, আপনি যা পারেন, তাই গেয়ে দিন একখানা।

কিন্তু সভার চিৎকার থামছে না।

অভয় গিয়ে দাঁড়াল সকলের সামনে। মাইকের স্পিকার পড়ে আছে তার বুকের কাছে। সে আসর বোঝে, বাসর বোঝে, কিন্তু এ রকম সভায় সে কোনও দিন দাঁড়ায়নি। এ রকম সভায় যে-সব। গান হয়ে থাকে, তাও সে জানে না।

অভয় যেন পাথর হয়ে রইল। চিৎকার বাড়তে লাগল। ইতিমধ্যে একজন এসে, মাইকের স্পিকারটা তুলে দিয়ে গেল তার মুখের সামনে।

অনাথ বলল, ধর, ধরে ফ্যাল খুড়ো।

অভয় শব্দ তুলে অবাক হয়ে গেল। মাঠের চারিদিকে তার গলা। সহসা তার নজরে পড়ে গেল হরি মিস্ত্রিকে। তার হাতের কাজের গুরু। চেঁচিয়ে বলল, কী গাইব?

শুনে সবাই হেসে মরে গেল।

হরি চেঁচিয়ে বলল, সেই সেইটা, যত ময়লা গাদা…

অভয় চোখ বুজে চিৎকার করে উঠল, আমি গান গাইতে পারি না। আমাকে মাফ করেন সকলে।

কয়েক মুহূর্ত সকলেই নীরব। পর মুহূর্তেই হাসি ও চিকারের একটা ধুম পড়ে গেল।

অনাথের চোখে কোনওদিন তার প্রতি রাগ বা বিরক্তি দেখেনি অভয়। আজ চোখাচোখি করবার সাহস পর্যন্ত হল না তার। সে শুধু দেখল, তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে, অনাথ চিৎকার করে বলছে, বন্ধুগণ, আমরা আমাদের সভা শুরু করছি। জলালউদ্দীন তার আগে আপনাদের একখানি গান গেয়ে শোনাবে।

অভয় লজ্জায় ও অপমানে তাড়াতাড়ি নেমে এল মঞ্চ থেকে। তারপরে ভিড়ের মধ্যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল, কেউ ফিরেও দেখল না!

অভয় মনে করেছিল, তার অসহায় দুরবস্থা বুঝে, অনাথ খুড়ো আবার তার সঙ্গে হেসে কথা বলবে। ডেকে নেবে কাছে। পিঠে চাপড় মেরে হাসবে হা-হা করে।

কিন্তু তা হল না। কারখানায় গিয়ে অভয় যখন দাঁড়াল অনাথের কাছে, সে প্রথমে ফিরে তাকায়নি। তারপরে বলেছে, যা, নিজের কাজ দেখগে যা।

অভয় বলেছে, অন্যায় হয়ে গেছে খুড়ো।

অনাথ ধমক দিয়েছে, থাক, আর খুড়ো খুড়ো করতে হবে না। খুড়ো ডাকলে তার মান রাখতে হয়।

অভয় বলেছে বোকা বোকা করুণ মুখে, তা আমি কি তোমার মান রাখি না?

অনাথ মুখ ভেংচে বলেছে, রাখো বইকী। একশো গণ্ডা লোকের সামনে খুড়োকে মিথ্যুক করে দিয়েছিস, বলেছিস গান গাইতে পারি না। মান রেখেছিস বইকী। ও সব বর্ধমানি ন্যাকামো করিস না, যা কাজে যা।

অভয় বর্ধমানের ছেলে। অনাথের ভাষায় সেই জন্য অভয়ের ন্যাকামো বর্ধমানি ন্যাকামো হয়েছে।

অভয় বলেছে মুখ চুন করে, তা কী করব বলল। লাজ-লজ্জা ভয় বলে জিনিস তো থাকে। আমি বে-ওপায় হয়ে বলে ফেলে দিয়েছি।

অনাথ খিঁচিয়ে উঠেছে, তবে আর কি, আমার মাথা কিনেছিস। কেন, এত লাজ-লজ্জা ভয় কীসের? শরীলটা তো এ্যাত্তখানি। কাছা নেই পাছায়।

অনাথ খুড়োর খোঁচা বড় তীক্ষ্ণ। জ্বালাটা লেগেছে অভয়ের। বলেছে, একটা জানান টানান দেয়া নেই। বেমক্কা খাড়া করে দিলে অতগুলান লোকের সামনে। তা কী করব আমি?

এর পরে অনাথের আক্রমণ আর একটু কড়া হয়ে উঠেছে। বলেছে, হ্যাঁ, মস্ত গাইয়ে তুমি। দশ দিন আগে তোমাকে পত্তর দিয়ে নেমন্তন্ন করতে লাগবে, আপনি আজ্ঞে করে নিয়ে আসতে হবে, তবে না! যা ভাগ এখন।

আর কথা বলতে পারেনি অভয়। গানের খোটা বড় খোটা। অভয়ের মানে লেগে গিয়েছে। কষ্টও হয়েছে প্রাণে। তা বলে এত কথা, এমন কথা বলবে খুড়ো? বড় বড় ঠ্যাং ফেলে সে নিজের ডিপার্টে চলে এসেছে। কারুর সঙ্গে ভাল করে কথাও বলেনি।

দু একজন ঠাট্টা ইয়ার্কি করতে গিয়ে, অভয়ের গরম মেজাজ দেখে, আর মুখ খারাপ শুনে অবাক হয়ে গিয়েছে। মেজাজ গরমটা যদিও বা মানতে পেরেছিল সবাই, অভয়ের মুখ খারাপ করা শুনে সবাই থ। আর মজাও পেয়েছে। তার মুখ খারাপ শোনার জন্যেও উস্কে দিয়েছে অনেকে।

শেষে মনের কথাটা বলেছে অভয় হরি মিস্ত্রির কাছে।

হরি মিস্তিরি ফোগলা দাঁতে, গোঁফ ফুলিয়ে হেসেই বাঁচে না। বলেছে, অনাথ রাগ করেছে তোমার পরে, তাতে আবার তুমি মন খারাপ করেছ?

অভয় বড় যে কিটিয়ে কিটিয়ে বলেছে সে।

 অনাথের নাম নেয়নি অভয়।

হরি মিস্তিরি যেন ভারী মজা পেয়েছে। বলেছে, আরে ধুর! অনাথের রাগ, তাও আবার তোমার পরে। ওটা রাগ নয়-রে খুড়ো, রাগ নয়। তোর ওপরে অভিমান হয়েছে।

–অভিমান করে, অমন অপমান করলে?

–হ্যাঁরে। তোকে যে বড় ভালবাসে গো। অনাথের সত্যিকারের রাগ কি ওরকম নাকি? আরে বাবা ও সত্যি সত্যি রাগ করলে, মিলের ম্যানেজার ওপরশিয়ের সায়েব পর্যন্ত পেরমাদ গোনে না? সে তো আর যেমন তেমন রাগ নয়। মহাদেবের মতন?

–মহাদেবের মতন?

–হ্যাঁ। গেল ছেচল্লিশ সালে সেও রাগ দেখেছিলাম আমরা। অনাথের এক শাকরেদ, ব্যাচাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল মিলের দারোয়ানেরা। তখন কলকাতায়ও খুব গুলিগোলা চলছিল। অনাথ কারখানার বাইরে খাড়া হয়ে আমাদের ডাক দিলে। বললে, সব বেইরে এসো। আমরা সব বেইরে এলুম। এসে দেখলুম, অনাথ নয়, আগুনের শিস। সেই আগুন আমাদের গায়েও লাগল। অনাথ বললে, দারোয়ানেরা লেবার অফিসারের চর। শলা-পরামর্শ ওখেনেই হয়েছে। লেবার অফিসারটাকে আমরা ছারখার করে ফেলব। মেরে ফেলব অফিসারটাকে। আর দারোয়ানদের কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেব গঙ্গায়।

–তাই হল?

–তক্ষুনি। আমরাও রেগে গেছলুম। অনাথের কথা শোনা মাত্তর লেবার অফিসটাকে একেবারে ভেঙে ফেললুম আমরা। কিন্তু লেবার অফিসার পালিয়ে গেছল আগেই। মার খেয়ে মরেছিল শুধু শুধু বাবুরা। দারোয়ানরা সারা তল্লাটে ছিল না। অনাথ আমাদের বললে, সায়েবদের কুটি ঘিরে ফেল! ঘিরে ফেললুম। মেমসায়েবরা চেঁচামেচি চিৎকার জুড়ে দিলে। অনাথ বললে, কুটি তল্লাশি করে দ্যাখ, দারোয়ানরা কোথায় আছে। আমরা তল্লাশি করলুম। পেলুম না কাউকে। ম্যানেজার সায়েব থরথর করে কাঁপছিল। শালার পাতলুম খারাপ হয়ে যাবার দাখিল। অনাথ বললে ম্যানেজারকে, দারোয়ানদের বার করে দাও, নইলে তোমার কারখানা তুলে ফেলে দেব গঙ্গার জলে। ম্যানেজারের মুখ চুন। তবু অনাথের কাছে এসে বললে, অনাথ আমি ইংরাজের বাচ্চা, ঝুট কথা কভি বোলে না! দারোয়ানের খবর আমার জানা নেই। তা অনাথ কুটির ওই চকচকে মেঝেয় থুথু করে থুথু ফেলে বললে, থুক দিই তোমার মতো ইংরাজের বাচ্চাকে। অনাথের মতো আমরাও রেগে গেছলুম। আমরাও থুথু ফেলেছিলুম। অনাথ বললে, ঝুটার কারবারি আবার বড়াই দেখাচ্ছিস। কোনও কথা শুনব না। ব্যাচার খুনিদের চাই। তখন একে একে সব সায়েবরা এল। এসে বললে, ইমানসে বলছি, আমরা জানি না। দারোয়ানরা ভাগ গয়া। কথা দিচ্ছি, সমস্ত দারোয়ানের নোকরি খতম। তাদের আমরা আর ত্রিসীমানায় আসতে দেব না। আমরা ব্যাচার মড়া নিয়ে মিছিল বার করলুম। ও জায়গার সমস্ত কারখানার হরতাল হয়ে গেল। আর যত কারখানা ছিল, সব কারখানার দারোয়ানেরা একেবারে মুল্লুক। কিছুদিন দারোয়ান বলে কেউ ছিল না। কিন্তু মাসখানেক বাদেই, সেই পেরথম পুলিশ চুরি করে নে গেল অনাথকে।

চুরি করে?

–হাঁ, চুরি করে রাত দুটোয় চুপিচুপি এসে নে গেছল। নইলে যে হল্লা হয়ে যেত, ধরে নিয়ে যেতে পারত না। তা অনাথকে ধরে নে গেল, আমরা ভয় পেয়ে গেলুম। আমরা চুপসে গেলুম, ঠিক শেয়ালের মতন। পুলিশ যেন আমাদের সাহসটাও চুরি করে নে গেল। বাংলা দেশের তাবৎ চটকল আমাদের মিলকে বলে, লড়িয়ে মিল। কেন? না লড়াই আমরা শুরু করি আগে। এই তোমার শস্তা র‍্যাশান বললো, মাগগিভাতা বলো, আর ছুটি বলো, আমরা আগে রব তুলেছি। আমরা। রব তুলেছি কার কথায়? অনাথ। অনাথের কথায়। অবিশ্যি অনাথেরও গুরু আছে। সে সব গুরুরা সব লেখাপড়া জানা মস্ত দিগগজ। তারাও খুব জেল খাটে। কিন্তু সত্যিকারের দুঃখী হল। অনাথ। নিজের জন্যে সে কিছুটি রাখেনি। আমরাও বেইমান। অনাথ দু দুবার জেল খেটেছে। আমরা তার বউ বাচ্চাকে খাওয়াতে পারিনি। রোগে ডাক্তার দেখাতে পারিনি। সব মরে গেছে। শুধু তাই? তার গুরু যাঁরা, সেই সব দিগগজদের সঙ্গে মতান্তর হয়ে গেল অনাথের। তাঁনারা বললেন, সাতচল্লিশ সালে আমরা স্বাধীনতা পাইনিকো। অনাথ বলল, হ্যাঁ পেয়েছি। গরমেন্টটা আমাদের গরমেন্ট। হুঁ, কথার ওপরে কথা? অনাথকে দিলে দল থেকে তাড়িয়ে। আর বলে দিলে, অনাথ লোক খারাপ, দালাল। সেই যে শক্ খেলা, আজো তার ঘা শুকোল না। বউ ছেলে-মেয়ে ঘর, সব গেছে! এখন একেবারে ন্যাংটা। তবে, দলের লোকেরা আবার ডেকে নে গেছে। অনাথকে। বলেছে, তোমার কথাও সত্যি অনাথ। গরমেন্টটা এ দেশের স্বাধীন গরমেন্ট। তখন অনাথ বললে, হাঁ, স্বাধীন গরমেন্ট, কিন্তুন বড়লোকের গরমেন্ট। কেন বললে? না, দেশের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো। অনাথের ওই এক কথা। যা বলবে, দেশের দিকে তাকিয়ে বলো।

বলতে বলতে হরি মিস্তিরির বুড়ো চোখ দুটি আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। আপন মনে বলেছে, কিন্তু আর তেমন করে কথা বলে না অনাথ। জানিনেকে আবার কবে ও রেগে উঠবে। ও তো পাগল।

বলে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।

অভয়ের সামনে অর্থহীন অথচ বিস্মিত চোখের সামনে ভেসেছে অনাথের মুখখানি। বলেছে, আবার কোনওদিন রাগবে?

হরি বলেছে, তা জানিনেকো। দুবার তিনবার রেগেছে অনাথ। তা সব জিনিসের তো একটা সময় আছে। আবার যখন সময় আসবে, তখন রাগবে। কিন্তু তখন হয়তো আমি আর সমসারে থাকব নাকো।

অভয়ের মনটা ছাঁৎ ছাঁৎ করে উঠেছে। বলেছে, কেন? থাকবে না কেন?

হরি ফোগলা দাঁতে হেসে বলেছে, জন্মালে মরতে হবে না? কিন্তু অনাথের কাছে যে কথাগুলোন শুনেছি, মরবার কালে সেই কথা মনে হবে। আর ওর মুখখানিও মনে পড়বে।

–কোন কথা খুড়ো?

হরি মিস্তিরির বুড়ো মুখের লোলরেখা টান টান হয়ে উঠেছে। চোখ দুটি উঠেছে চিকচিকিয়ে। বলেছে ফিসফিস করে, ওই যে, সেই কথা গো। সব সময় যা বলে পাগলাটা, আমরা একদিন ভাল ভাবে মানুষের মতো বাঁচব। সকলে সমান হয়ে যাবে সমসারে।

বহুবার শোনা কথাটা হরি মিস্তিরির চোখে ও কপালের প্রায় শতাব্দীর সর্পিল রেখায় এখনও বিস্ময় জাগায়। বলে, কী আশ্চর্য কথা! অনাথ বললে যে অবিশ্বেস করতে পারিনেকো। আর কদ্দিন বা বাঁচব। ছেলে লাতিরা রইল, তারা দেখবে। মাথার ওপরে ভগবান তো রয়েছেন। একদিন নিশ্চয় অনাথের কথাটা ফলবে।

এক কথায় কত কথা উঠে গিয়েছে। রাগারাগির কথা ভুলেই গিয়েছে অভয়। অনাথেরই গুরুগিরিতে শেখা জীবনতত্ত্বের কথাগুলি যেন নতুন গুরুত্ব নিয়ে দেখা দিল তার সামনে। নতুন করে যেন পরিচয় পাওয়া গেল অনাথ খুড়োর।

কিন্তু তবু অভয় থেকে যেতে পারল না অনাথের কাছে। রাগ করে বা মান করে নয়। অনাথ। যদি নিজের থেকে ডেকে না নেয় কাছে–তবে অভয় যায় কেমন করে?

.

০৫.

তিন দিন পরে বাজারের মহাজন শরত দাস এসে ধরল অভয়কে। সঙ্গে সুরীনের ওকালতি। অভয়কে বাজারে গাইতে হবে।

যে কোনও বৃহস্পতিবারে পূর্ণিমা পড়লে, বাজারে বারোয়ারি গান বাজনা কিছু না কিছু হয়ই। কোজাগরি লক্ষ্মী পুজোয় সবচেয়ে বেশি গানবাজনার আসর বসে। কয়েকদিন ধরে যাত্রা, কবিগান, কীর্তন চলে। কয়েক বছর ধরে টাকা খরচ করে, কলকাতার রেকর্ড-রেডিয়োর গাইয়েদেরও আনা হচ্ছে। সেইটাই রেওয়াজ দাঁড়িয়েছে আজকাল।

অভয় রাজি হল না প্রথমে। মন ভাল নেই। কে শুনবে তার গান? অনাথ খুড়ো তো আসবে না। মুখ ফুটে সে কথা বলল না অভয়।

সুরীন কাকুতি মিনতি করল। শৈলবালাও পীড়াপীড়ি করল জামাইকে। একলা শরত দাস নয়। বাজারের আরও আরও মহাজনরা এসে ধরল। তারা কোনও কথা শুনবে না। জামাই কবিয়ালের কেরামতিটা তারা একবার দেখতে চায়।

ভামিনী খুড়িও পুকুরঘাট থেকে চেঁচিয়ে দিব্যি দিলে অভয়কে। না গাইলে খুড়ি বড় দুঃখ পাবে। শৈলবালার বাড়িতে সে আসবে না, তাই ঘাট থেকেই বলতে হল তাকে।

নিমি তো মুখ ফুটে কখনও কিছু বলবে না। তার ইচ্ছা অনিচ্ছা বোঝবার উপায় নেই।

কিন্তু শুধু যে অভয়ের মনটাই খারাপ তা নয়। ভয়ও তো আছে। কতটুকু সে জানে। কোন সাহসে দাঁড়াবে আসরে? প্রথমবারের অভিজ্ঞতা বড় তিক্ত। এই দূর দেশে সে রকম দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কম।

কিন্তু প্রতিপক্ষ বয়স্ক, অভিজ্ঞ ঘাগি লোচন ঘোষ। নামে ডাকে যার গগন ফাটে। কলকাতার রেডিয়োতে লোচন কবি গান করে। আলাপ পরিচয় আছে অভয়ের সঙ্গে। প্রথম পরিচয় পেয়ে, অভয় পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিল লোচন ঘোষকে। গুণে নয়, চেহারায়ও পায়ে হাত দেবার মতো মানুষ। ছোটখাট মানুষটি। মুখখানি এই বুড়ো বয়সেও ছেলেমানুষের মতো। আর সাজতে পারে ভাল। লুটনো কোঁচা, সাদা ধবধবে আদ্দির পাঞ্জাবি, ঘাড় অবধি বড় বড় চুল। যদিও মাঝখানে এখন টাক পড়ে গিয়েছে। আর চোখ দুটিতে সব সময়েই হাসি। একটু অস্বস্তি হয় হাসি দেখে। যেন সবটাই ঠাট্টা, সবটাই শ্লেষ। দুটি মুদিখানা আছে নিজের। বসতবাটি আছে ভাল। আর কায়স্থ সমাজে সম্মানও আছে। কবিগান ছাড়াও, আর একটি গুণ, ভাল পাথোয়াজ বাজাতে পারে।

এ অঞ্চলে লোচন ঘোষের জমাটি-প্রতিপক্ষ সুবালাদের বাড়িওয়ালী রাজুবালা দাসী। আগে আগে রাজু-লোচনের লড়াই যেমন উপভোগ করেছে লোকে, তেমনি আবার দুজনের পিরিত নিয়েও কম কথা হয়নি। আসরে দুজনে ঘোর শত্রু। অন্দরে গলাগলি। সেইটিই লোকের ভাল লাগত।

রাজু-লোচন আলাদা আলাদা কবিয়ালের সঙ্গে গাইলে, সে আসর জমত না। এ অঞ্চলের লোকেরা উঠে চলে যেত। বলত, এ আসর মরা। প্রাণ নেই।

জোয়ার আসে। ভাঁটা যায়। একদিন জোয়ার এসেছিল। এখন ভাঁটা যাচ্ছে। সেদিনকার যৌবন আর নেই। কালের পা দাগ ফেলেছে তাতে। শুধু গায়ক গায়িকার নয়। সেই সব। শ্রোতাদের যৌবন গতায়ু। রাজু এখন গান ছেড়ে দিয়েছে। লোচনও সচরাচর গায় না। মাসে দু মাসে রেডিয়োতে কবি গায়। পাখোয়াজ বাজাবার আমন্ত্রণ পায় কখনও কখনও।

সেই লোচন ঘোষের সঙ্গে গান করা কি চাট্টিখানি কথা?

 কিন্তু বাতাসের আগে খবর গেল কারখানায়। হরি মিস্তিরিরা সবাই উৎসাহ দিলে। শুধু অনাথ কিছু বললে না। কিন্তু এতগুলি লোকের কথা ঠেলাই বা যায় কেমন করে?

সুরীনকে বলল অভয়, ঘোষ মশায়ের সঙ্গে গাইতে আমার সাহসে কুলোয় না খুড়ো।

সুরীন গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, মন্দ হলেও তোমার মান যাবে না বাবা। ঘোষ অনেক বড়। এখানে হারলে তোমার লজ্জার কিছু নেই। কেউ তোমাকে দুয়ো দেবে না।

.

আসর বসল।

পাড়াগাঁ নয়। মফস্বল শহরের বাজার। বিজলিবাতি ঝলমলিয়ে উঠল আসরে। বাজারের আসরে ভদ্রলোকদের আগমন কমই হয়। দোকানি ফড়ে পাইকের মহাজনদের ভিড়। আর মালিপাড়ার গেরস্থ, আধাগেরস্থ, দেহোপজীবিনীরা দল বেঁধে আসবেই। বারোবাসর-পাড়ার। মেয়েমানুষদের শহরের অন্য আসরে যাবার সুযোগ নেই, যেতেও চায় না কেউ। বাজারের আসরটা তাদের নিজেদের হয়ে গিয়েছে। বরং তারা না থাকলে বাজারের আসর জমে না।

তবে ভদ্রপাড়ার মেয়েমানুষেরাই শুধু আসে না। পুরুষেরা কামাই দেয় না।

লোচনের হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে অভয়ের বুকের মধ্যে টিপ টিপ করতে লাগল। কোনওরকমে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল সে লোচনকে।

লোচন চুপিচুপি বলল অভয়কে, মনে জোর আছে তা হলে বলো?

অভয় চমকে উঠে বলল, আজ্ঞে কেন?

লোচন বলল, মনে বল না থাকে তো চুপচাপ বসে থাকতে গো। নমস্কার করতে আসতে কি?

অভয় বলল, আজ্ঞে আপনি গুরুজন, গুণী।

লোচন তেমনি নিঃশব্দে হাসল মিটিমিটি। মনটা দমে যেতে লাগল অভয়ের।

অভয় মার্কিন কাপড়ের পাঞ্জাবি পরেছে। মিলের ধোয়া ধুতি পরেছে কোঁচা দিয়ে। কিন্তু মিলের ধূতি কখনও তার পায়ের পাতা ছাড়িয়ে নীচে নামে না। কারণ কুলোয় না। গলায় একখানি চাদর জড়িয়েছে। একটু বেশি নীল হয়ে গেছে চাদরখানি। বাড়িতে কাঁচা নীল দেওয়া হয়েছে, তাই।

লোচনের লুটনো কোঁচা আর আদ্দির গিলে করা পাঞ্জাবির কাছে ও সব চোখেই পড়ে না। তার ওপরে সোনার বোতামের চকচকানি।

মেয়েদের বসবার জায়গায়, রাজুবালা সকলের আগে বসেছে। চির-সধবার বেশ রাজুদের। বৈধব্য তাদের কপালে লেখা নেই। লালপাড় শাড়ির ওপরে, মুগার পাতলা চাদর জড়িয়ে, কপালে সিঁদুর পরে বেশ ঘরোয়ানা হয়ে এসেছে।

লোচন ঘোষ গিয়ে যখন তার কাছে দাঁড়াল, বয়স্কদের সকলের চোখ গিয়ে পড়ল সেদিকে। স্বপ্ন নেমে এল সকলের চোখে। আর একবার তারা তাদের হারানো যৌবনকে প্রত্যক্ষ করছে।

লোচন বলল, দ্যাখো দিখিনি কী কাণ্ড। এই বুড়ো বয়সেও রেহাই পেলুম না।

রাজু তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি, বয়সের গাঢ় ছায়া-ভরা চোখ দুটি দিয়ে তাকিয়ে হাসল। বলল, ভালই তো! তোমার যে বড় সৌভাগ্য ঘোষ মশায়।

লোচন বলল, আর কি সেদিন আছে রাজু। ছোকরার কাছে হেরে গিয়ে আমার মাথা হেঁট হবে।

রাজু অবিশ্বাসের হাসি হাসল দাঁতহীন ঠোঁটে। অপাঙ্গে তাকিয়ে চিরকালের সেই স্নেহ মুখে ঝামটা না দিয়ে পারল না, নাও আর আদিখ্যেতা কোরো না বাপু।

অর্থাৎ লোচনের পরাজয় যে কোনওকালেই সম্ভব নয় তা জানে রাজু। কারণ ঘোষের কপালে সে দুভোগ কোনও দিনই ঘটেনি।

রাজু আবার বলল, ছোঁড়াটার গলা ভাল। এদিকে লড়বে কেমন, বলতে পারিনে। কোনওদিন তো আসরে নামেনি।

কথাটা যেন কেমন? সান্ত্বনা দিচ্ছে লোচন ঘোষকে? লোচন তাকাল রাজু বুড়ির চোখের দিকে।

লোচনের চাউনির অর্থ বুঝে রাজু বলল, আহা! অমন তাকিয়ে আছ কেন!

অভয়ও এল রাজুর সামনে। অভয়কে দেখে, রাজুবালার দু চোখে ঈর্ষা ফুটে উঠল। ভাঁজ-পড়া ঠোঁটে দেখা দিল বিদ্রূপ।

অভয় বলল, আশীবাদ করো গো মাসি।

রাজু বলল, তাই করছি। ঘোষের কাছে হারলেও তোমার সেটা জয় হবে, মনে রেখো।

যেন অভয়ের পরাজয় চায় রাজু। লোচনের সঙ্গে লড়াই যে আজ তার সঙ্গে লড়াইয়েরই সামিল।

মেয়েদের আসরে সুবালা ছিল একদিকে। তাদের বারোবাসরপাড়ার দলের সঙ্গে। মালিপাড়ার গেরস্থ দলের সঙ্গে, নিমি আর একদিকে।

সুবালা ডেকে বলল অভয়কে, এই, এই যে গো?

সুবালার দিকে চোখ তুলতে গিয়ে, অভয় অনুভব করল তার সর্বাঙ্গে নিমির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বিঁধেছে।

সুবালা বলল, লড়াই যা হবে তা তো বুঝতেই পারছি। সেই সাতকেলে রামায়ণ আর মহাভারত শোনাবে দুজনে। ঘেন্না ধরে গেছে শুনে শুনে। একটু ভাল পদ বানিয়ো। শুনে যেন ভাল লাগে।

কথাটা লোচনের কানে যেতে সে একটু অবাক হয়ে তাকাল সুবালার দিকে। অভয় জবাব দিল, সাতকাল গেলে আর এককাল থাকবে। তারপরেই বলল হরি হরি।

সবাই হেসে উঠল।

অভয় ঘুরে গিয়ে দাঁড়াল নিমিদের সামনে। না, নিমির মুখে রাগের ছাপ পড়েনি।

তবে খুব খুশি-খুশিও নয়। বিশুর বউ বলল, হারলে পাড়ায় ঢুকতে দেব না কিন্তু।

তারপরেই ঢাকে কাঠি পড়ল। কাঁসি তাল দিল, কাঁই নাঁই কাঁই নাই।

 শরত দাস এসে ফুলের মালা পরিয়ে দিল আগে লোচনকে। পরে অভয়কে।

আসর বেশ জমে উঠেছে।

 লোচন দেবদেবীর পরে গুরুর বন্দনা করল। তারপর হাত জোড় করে, সকলের দিকে তাকিয়ে গাইল লোচন,

অনেক দিন পরে
বাজারের চত্বরে
গাইতে এলুম কবি গান ॥
(বন্ধুরা মাপ করিবেন)

হেসে উঠে গাইল,

সঙ্গে গাইবেন অভয়
তিনি দিয়েছেন অভয়
রাখিবেন লোচনের মান ॥
(বন্ধুরা মাপ করিবেন)

ঠাট্টাচ্ছলে আরও খানিকটা ভনিতা করে, আসর জমিয়ে নিল লোচন। অভয় মাথা নিচু করে, ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ খুটছে।

লোচন হঠাৎ একবার কোমর ঘোরাল, আর শব্দ করল একটা জোরে। ঢুলিও ওস্তাদ। হাত দিয়ে ঢোলকের বাঁ দিকে এমন ডলা দিয়েছে, প্রায় লোচনেরই গলার স্বরের মতো একটা আওয়াজ করে উঠল।

লোচন গাইল।

ভাই সাতকেলে নয় চিরকেলে
 রামায়ণ আর মহাভারত পেলে
এখনও বুকে ধরে রাখি।
(বন্ধুরা মাপ করিবেন)

সুবালার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। তাকে চিমটি কাটল গিরিবালা।–মর মুখপুড়ি, আর বলতে যাবি?

নিমিও হাসল ঠোঁট উলটে। অভয়ও হাসল ঘাড় দুলিয়ে। লোচন গেয়ে চলেছে,

আমাদের বাপ ঠাকুরের পরিচয়
 রামায়ণ মহাভারতের কয়
আদি ইতিহাসের কোথাও নাই বাকি।
 (বন্ধুরা মাপ করিবেন)।
পূরাণ ছাড়া নতুন নাই।
জবাব দিয়ো হে অভয় ভাই
 কোন ভগবতী স্বামী থাকতে চির বিধবা।
(ধুয়া)
দিতি ও অদিতি কথা
 বিনতার কহ বার্তা
কী যাতনায় চিতা জ্বেলে মরেন দেবী অম্বা।
(ধুয়া)

লোচনের প্রশ্নাবলীতে সবাই বিস্মিত। এই চিরকালের শোনা কথাগুলি লোকে বারে বারে ভুলে যায়, আবার শুনলে নতুন করে অবাক হয়। সকলেরই চোখ গিয়ে পড়ছে বারে বারে অভয়ের ওপর।

অভয় নত মস্তক। পাথরের মতো স্তব্ধ।

লোচন একে একে পনেরোটি প্রশ্নের পর, শেষ প্রশ্ন করল,

অসুরো ঠাকুরো শুক্র
 কার কাছে হলেন টুকরো
কাহার যৌবন বীজ ধারণ করিলেন।

লোচনের শেষ প্রশ্নে হরিধ্বনি দিয়ে উঠল সকলে। হরিধ্বনির সঙ্গে একটা খুশির আমেজও ছিল। ভাষায় না হলেও লোচনের ভঙ্গির মধ্যে ছিল একটি রহস্যময় মাদকতা। একটি বিশেষ ভঙ্গি। যা দেখে মনে হয়, এখনও আসল তূণে টান পড়েনি। আসল তীর ছোঁড়া হয়নি। যে তীর আসল রসের পাত্রকে বিদ্ধ করবে। আর রস জরজর হয়ে সবাই হল্লা করে উঠবে।

বিদায় নেবার আগে, গানে গানে বলল লোচন, অভয় যেন সবিস্তারে সব কথার জবাব দেয়। সভার লোকজন যেন সব পরিষ্কার বুঝতে পারে।

ঢোলক বাজল ডুডুম ডুম। আসর দেখলে বোঝা যায়, লোচনের পক্ষে তোক বেশি। আসর ভরে তারই মহিমা।

সুরীন বিড়ি খেতেও ভুলে গিয়েছে। লোচনের কাছে হারলেও হার নয় বটে অভয়ের। তবু সে হাঁ করে চেয়ে আছে নত-মাথা অভয়ের দিকে। ভামিনীর মন আরও খারাপ। অভয়ের ভাব-সাব দেখে, আসর ছেড়ে পালাতে ইচ্ছে করছে তার।

সবচেয়ে বিচিত্র নিমির মনের অবস্থা। অভয় জিতুক, এই আশায় বুক ভরে উঠতে চায়। কিন্তু আর একটা মন বললে, অভয় পরাজিত হোক, অহঙ্কার মরুক একটু। যেন সেই পরাজয় অভয়কে। তার কাছেও নত করে দেবে।

সুবালার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, তাদের বাড়িরই একটি মেয়ে, তোর গাইয়ে যে মুখ তোলে লো সুবলি।

সুবালা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, আমার সাতকেলে ঘরের গাইয়ে।

কিন্তু ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, সুবালার মন বিমর্ষ হয়ে উঠছিল। ভামিনীর মতো তারও মনে হচ্ছিল, চলে যাওয়াই ভাল। কারণ, অভয়ের ভাবভঙ্গি দেখে তার রাগ হচ্ছিল।

আরও একজন অভয়ের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে বসেছিল। সে অনাথ! কারখানার সকলের সঙ্গেই বসেছে সে। কিন্তু কথা বলছে না একটিও।

.

০৬.

অভয় দাঁড়াল। প্রকাণ্ড চেহারা দেখলে মনে হয়, পাড়াগাঁয়ের চাষি মানুষ, ভদ্রলোক হবার আপ্রাণ চেষ্টায় সেজে এসে দাঁড়িয়েছে। গলার মালাখানিও মানুষ অনুপাতে ছোট হয়ে গিয়েছে। গলা খুলল অভূয়। সুর ভাঁজল খানিকক্ষণ কানে হাত দিয়ে। তারপর, জনে জনের নাম না করে, এক কথায় বন্দনা সারল। অভয় গাইল

গুরু আমার সবাই
 সকলের পায়ে পরণাম জানাই।
 গুরু মানেই গুরুজন।
বলে গেছেন মহাজন।
 গুরুই হলেন ভগমান।
গুরু হলেন আপন প্রাণ।
গুরু আমার আপনারা সবাই
আপনাদের পায়ে পরণাম জানাই ৷

বলে, চারদিকে ঘুরে ফিরে নমস্কার করল অভয়।

লোচন ঘোষ বলল, বাঃ বেশ বাবা, বেশ!

চেঁচিয়ে বলল, কিন্তু বউ-মা রয়েছেন যে আসরে, তোমার পরিবার?

আসরে হাসির ধুম পড়ে গেল। কিন্তু অভয়ও হাসছে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে। চিৎকার করে বলল, আজ্ঞে ঠিকই বলেছেন। একবার দয়া করে শোনেন।

তারপর হাত জোড় করে সুর দিয়ে বলল,

শ্রীকৃষ্ণের প্রেমের গুরু শ্রীরাধিকা
কে না জানে ভাই।
শিবের আরাধ্যা দেবী মা চণ্ডিকা
কেন–জানেন না ঘোষ মশাই ॥

আসরের এক কোণ থেকে হরি মিস্তিরি লাফিয়ে উঠল, বাঃ, বেঁচে থাকো ভাই।

 লোচন ঘোষও চিৎকার করে উঠল, সুন্দর, সুন্দর।

গুলতানি চলল খানিকক্ষণ। মহাজন দাস মশায় হাত তুলে ধমক দিল, আঃ চুপ করো, গাইতে দাও।

রাজুবালা ভুরু কুঁচকে, বিমর্ষ হেসে বলল, ছোঁড়ার থলেয় মাল আছে দেখছি।

নিমি তার বান্ধবীদের চিমটি খেয়ে বলল, কথা জানে কাঁড়ি কাঁড়ি।

সুবালা বলল তার সঙ্গিনীদের, লোচন ঘোষের জবাব করুক আগে। নিজে কথা বলুক, তারপরে বোঝা যাবে কেরামতি।

সেই কথাই ভেবেছে এতক্ষণ অভয়। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করেছে। চুপ করে বসেছিল মাথাটি খুঁজে। এ যে গুরুমশায়ের কথা শোনা, একটি কথা ভুললে চলবে না। কান পেতে শুনতে হবে। মনে রাখতে হবে। জবাব দিতে হবে একটি একটি করে।

অভয় প্রথমে ধুয়া তৈরি করে নিল। বলল, তার বুদ্ধি অল্প। জ্ঞানের বড় অভাব। পুরাণ চিরকালের। সে কথা বলবার হক থাক লোচন ঘোষ মশাইয়ের। সে হালের কথা বলবে। নতুনই কালে কালে পুরানো হয়। ছোঁড়ার কথায় যদি বিশ্বাস না হয়, তবে

এবার চেয়ে দেখ নিজের দিকে।
আপনার অঙ্গ
মহাকালের কত রঙ্গ
কান পেতে কালের কথা শোন আপন বুকে ॥ (ধুয়া)
ও ভাই, হায় দিন চলে যায়।
কান পেতে কালের কথা শোন আপন বুকে (ধুয়া)

বলে, সরাসরি লোচনের জবাবে চলে এল অভয়। গান গেয়ে গেয়েই বলল, শিব থাকতে গৌরী দেবী হলেন বিধবা। কেন? না, মা আমার ক্ষিদের জ্বালা সইতে না পেরে, স্বামীকেই খেয়ে বসলেন। মহাদেব বললেন, পার্বতী ঠাকরুণ, আমায় খেয়ে যে তুমি বিধবা হয়ে গেলে? তখন দেবীর শোক আর ধরে না। দেবীর দুঃখ দেখে মহাদেব বললেন, বিধবার বেশেও তুমি দেবী থাকবে। নাম হল তোমার ধূমাবতী। ওই নামেই তুমি পুজো পাবে জগতে।

জবাব দিয়ে অভয় মন্তব্য করল, পূরাণ বলেই রক্ষে। বিধবা হয়েও তিনি পুজো পান, মানুষ হলেই মাগি ডাইনি। শুধু কি তাই?

মাগো, তোমরা খুদার জ্বালায় স্বামী খেলে
পুলিশ আসিবে পলে
পুজোর বদলে ফাঁসির দড়ি, ঝুলিবে গলে।

হাসির রোল পড়ল চারদিকে। বাহবা বাহবা উঠল আসরে। অভয় কোমর দুলিয়ে নাচতে নাচতে নমস্কার করল নত হয়ে।

লোচন ঘোষও বাহবা দিল। কিন্তু তার চোখে যেন কীসের ছায়া। বিস্ময়ের ঘোরও আছে।

পুরাণের কাহিনী আষ্টেপৃষ্টে মুখস্থ করেছে অভয় গাঁয়ের গুরু নিতাই ভটচাযের কাছে। কবিগানের ওইটি বোধহয় প্রাথমিক। রামায়ণ মহাভারত ছাড়াও, যেখানে যে কথা শুনবে, মনে করে রাখবে। হিন্দু ধর্ম বলো, মুসলমান ধর্ম বলো, আর খ্রিস্টানদের ধর্ম বলো, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে রাখতে হবে। যত শোনা যায়, তত শেখা যায়। সংসারের কাউকে ছোট জ্ঞান করো না। নিতাই ভটচাযের সঙ্গে গাঁয়ে একবার লড়াই হয়েছিল মামুদের। মামুদ নামকরা গাইয়ে। ভটচায তাকে আসরে জিজ্ঞেস করেছিল, হিন্দু মেয়েরা সিঁদুর কেন পরে। সিঁদুরের উৎপত্তি কেন? মামুদ জবাব দিয়েছিল অব্যর্থ। দিয়ে, ভটচাযকে জিজ্ঞেস করেছিল, মুসলমানদের নামাজের পাঁচ ওক্ত কী?

সবাই ঘাবড়ে গিয়েছিল ভটচাযের জন্য। কিন্তু ভটচায আরও গভীরের মানুষ। মামুদের সঙ্গে গাইবার আগে তৈরি হয়ে এসেছিল সে। অভয়ের গুরু ফ্যালনা নয়।

একে একে লোচন ঘোষের সব কথার জবাব দিল অভয়। দেবমাতা অদিতি, অসুরমাতা দিতি, আর উচ্চৈঃশ্রবা ও গরুড়ের মাতা বিনতার জীবন ব্যাখ্যা করল। কাশীরাজের কন্যা অম্বাকে হরণ করেছিল ভীষ্ম, কিন্তু বিয়ে করেনি। তাই নিজে চিতা জ্বেলে মরেছিল সে। পরজন্মে ভীষ্মের শমন শিখণ্ডী হয়ে জন্ম নিয়েছিল। তারপরে বলল, মহাদেবের যৌবনবীজ শুক্র। বলে, সকলের দিকে হাত জোড় করে, হেসে হেসে দুলে দুলে বলল, কিন্তু মানুষ মহাদেবেরা একটু সাবধান থাকবেন। কারণ,

শুক্র এক চোখো, কা–না।
তানার পাপ পুণ্যে নাই মানা।
সংসারে করেন ছিষ্টি অনাচ্ছিষ্টি
এক চোখে এক বগগা দিষ্টি
এক ছাড়া তার দো নাই জানা।

আবার কলরোল উঠল হাসির। বাহবা দিল তারা, যারা কথার অন্তর্নিহিত মানে বুঝতে পেরেছে। মেয়েদের আসরে কথাবার্তা একটু কম শোনা গেল। অনেকে বুঝতে পারেনি।

অনাথ দেখল, হরি মিস্তিরির মুখে কথা পর্যন্ত নেই। অনাথ বলল, খুড়ো?

হরি যেন চমকে উঠল, অ্যাঁ?

অনাথ বলল, ব্যাপার কী? হরি চোখ গোল করে বলল, আমিও তো সেই কথাই বলছি। অভয়ের কথা বলছিস তো?

অনাথ বলল, হ্যাঁ। দেখে মনে হয় ভাজার মাছটি উল্টে খেতে জানে না। কিন্তু কী গাইছে। একবার শুনেছ?

হরি বলল, শুনিনি? শুনেছি বলেই তো থ মেরে গেছি। অবিশ্যি আমি জানতুম।

–জানতে।

–জানতুম না? সেই একদিন যখন আমাকে শোনালে, একের ডাইনে কোটি কোটি, বাঁয়ের বিন্দু তা হলে কত? বাঁয়ের বিন্দু থেকেই তো তুমি সব তুলে নিয়ে এয়েছ–যাকে শূন্য বলা হয়। তখুনি বুয়েছি, ভেতরে মাল আছে।

অভয় ততক্ষণে লোচনের প্রতি তার প্রশ্ন তুলে ধরেছে।

অবশ্য লোচনের প্রতি প্রশ্ন তুলে ধরার আগে একটু ভনিতা করে নিল অভয়। ঘোষ মশায়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যে তার ধৃষ্টতা, তা সে জানে। তিনি যেন নিজগুণে ক্ষমা করেন। অবাচীনের প্রলাপে যেন বিরক্ত না হন। ছেলের কপচানিতে বাপ ভগবানের মতো হাসেন।

লোচন ঘোষ হেসে বললে, গাইতে এসে শেষে পরের ছেলের বাপ হতে হবে? সবাইকে শুনিয়ে বলা নয়। তা হলে হাসির রোল পড়ে যেত। কোন একজন চেঁচিয়ে বলল, কপচানিটা শুরু হোক,

তা-পরে বোঝা যাবে ছেলে এখনও কপচায়, না বচন দেয়।

অভয় ধুয়া ধরল,

একবার চেয়ে দেখ নিজের দিকে
আপনার অঙ্গ
মহাকালের কত রঙ্গ
ও ভাই, হায় দিন চলে যায়
কান পেতে কালের কথা শোনো আপন বুকে।

ধূমাবতী আর দিতি অদিতির কথা, শুধুই কথা। পুরাণের কথা। কিন্তু সেকাল তত আর কোনওদিন ফিরে আসবে না। কাল নিরবধি। মহাকালেরই চোখের মণি। সে বিধান ঠেকানো যায় না। সে সুন্দর, অপরূপ। কিন্তু পাষাণ কঠিন। ধন্বন্তরির মান রাখতে শমনের হাতধরা প্রাণীও একেবারে বুঝি থমকে দাঁড়িয়ে যায়। আর কাল? তার বুকে মাথা খুঁড়লেও সে এক পলক দাঁড়াবে না। তাই, সেই জন্যেই বলেছি, আপনার অঙ্গ, মহাকালের কত রঙ্গ। একবার আপনারা চেয়ে দেখেন নিজেদের দিকে।

আজ যে-নয়নের বাণে পিরিতের আগুন ঝরে
কাল সে নয়নে কেন ছানি পড়ে গো।
যে-চাঁদ মুখে আজ রূপের হাট।
কালে তা করলে লোপাট
কাহারও কলমে কালো রেখা পড়ে গো।
মুকুতারো ঝিকিমিকি মুকুতাররা দাঁতে
হায় সে মুকুতা হাসি কে হরণ করে গো।
একবার চেয়ে দেখে নিজের দিকে।

 নিঃশব্দ আসর। অভয় গলা সরু করে টেনে টেনে গাইছে। ঢোলক কাঁসি বাজছে আস্তে আস্তে। রাজুবালা কিছুতেই চোখের জল চাপতে পারল না। অনেকেরই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের বাষ্প উঠেছে। জমে। লোচনের বুকটাও যেন টনটনিয়ে উঠছে। ছোকরা কাকে বলছে এ সব কথা!

লোচন ঘোষকে নাকি? কই, সেই বিদ্বেষের ছায়া তো নেই অভয়ের মুখে। কিন্তু, শুধু কবিয়াল হিসেবে নয়, সব মিলিয়ে লোচনের প্রৌঢ় বুকে হঠাৎ একটা ফিক্‌ ব্যথায় কেমন যেন আড়ষ্ট লাগছে। সাধুবাদ দিতে গিয়ে টের পেল লোচন, তার গলার স্বর যেন ভাঙা। হেসে হেসে ঢলে ঢলে, অভয় যেন নির্দয় কালেরই মতো কথায় সুর দিয়ে চলেছে। নোচনের মনে হল, এই শ্রোতার আসরে নয়, অন্তরের আসরে তার পরাজয়ের পালা যেন শুরু হয়ে গিয়েছে অনেক দিন। তার বড় সাধ হল একবার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিনী রাজুবালার দিকে ফিরে তাকাবার। সাহস হল না। কিন্তু রাজুবালা তাকিয়েছিল তার দিকেই। মনে মনে বলছিল, সত্যিই তো। এত আলো, কিন্তু কই, ঘোষকে তো আমি পষ্ট দেখতে পাচ্ছিনে।

শৈলবালারও দু চোখ ভেসে গিয়েছে। সে ফিসফিস করে বলছে, ঠিক বলেছ বাবা। যথার্থ কথা বলেছ।

সুবালার চোখে জল নেই। তার চাঁদমুখে এখনও রূপের হাট। চোখে অনেক আগুন। তবু সারা মুখে তার স্তব্ধ বিস্ময়। সে মুখের দিকে তাকিয়ে গিরিবালার চোখ ঘুমে ঢলে আসছে।

নিমির মন খারাপ। সংসারে বুঝি আর কথা নেই? কত কালের বুড়ো মানুষটি তুমি যে, কেবল। তত্ত্ব কথা চালিয়েছ? মানুষ একটু হাসতে ঢলতে এসেছে। তা নয়, যত বাজে কথা বলে মানুষের। মন খারাপ করে দেওয়া কেন? মন খারাপ তো আছেই! গান শুনে মন খারাপ করার চেয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকা ভাল।

মহাজন শরত দাস কখন শহরের মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ভবানী চৌধুরীকে রাস্তা থেকে ধরে এনে বসিয়েছে। তিনি ভাল করে গুছিয়ে বসে বললেন, ছেলেটি ভাল গায় তো হে। থাকে। কোথায়? মালিপাড়ায়? শৈলবালার জামাই? কে শৈলবালা? যাকগে, চিনিনে। কিন্তু এ তো চালাক কবিয়ালের রীতি নয়। প্রথমেই কাঁদানো ভাল নয়। দীর্ঘশ্বাস তোলানো উচিত নয়। আসর জুড়িয়ে যাবার ভয় আছে। একবার হাই উঠতে আরম্ভ করলে, সকলেরই হাই উঠতে থাকবে।

তবে এখনও সে অবস্থা নয়। চারদিক থেকে সবাই সাধুবাদ দিয়ে উঠল। অভয় আবার গলার স্বর চড়িয়ে গান গানেই বলল, ভাই এসো, আজকের কথাই বলি। আজকের মানুষের খালি এক কথা শুনতে পাই।

জীবনের জ্বালা নাহি যায়।
জীবনের ভাব বোঝা দায়।

 কিন্তু কেন? না ,

অ ভাই, অনাদায়ে ভাবের তবিল খালি থেকে যায়।
 ভাব দিয়ে ভাব করে আদায়।
জীবনের রঙ্গ বোঝা যায়।

ভবানীবাবু তাঁর মোটা লেন্সের চশমায় অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন, বাঃ।

অভয় গেয়েই চলল, জীবনের ভাব বুঝতে গেলে, বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে এ জীবনের কথা। প্রশ্ন নয়, ঘোষ মশায়ের কাছে শিখতে চাই, সংসারে সব চেয়ে কী দামি? সব চেয়ে শস্তা কী? খাঁটি মানুষ বলে কাকে? শরত দাস মশায় রয়েছেন, ক্ষমা করবেন অভয়কে। কাকে বলে। মহাজন? আর জগতে সবাই ভোগ করতে এসেছেন। একশো জনের একজন ভোগ করেন সুখ, নিরানব্বই জনে দুঃখ। কেন?

মায়ের জাতি বলে ডাকলি যারে
আবার রাতে গিয়ে পয়সা দিয়ে কিনলি তারে।

 কেন? প্রশ্ন নয়। শিখতে চায় অভয় লোচন ঘোষের কাছে। তার পোড়া মনে জেগেছে এ সব কথা। তার মন হদিস খুঁজে মরছে। কী সেই বস্তু, যা দিয়ে জয় হবে এই সংসারে।

আসরে গুলতানি শুরু হয়ে গিয়েছে। এ সব কথা কবি গানের অঙ্গ হওয়া উচিত কি না তাই নিয়ে তর্ক লেগে গিয়েছে কারুর কারুর মধ্যে। কারুর কারুর মুখে একটু অস্বস্তির ভাব উঠেছে ফুটে। কিন্তু লোচনের জবাব শোনার কৌতূহল আসর ত্যাগ করতে দিচ্ছে না। অভয়ের কথার মধ্যে কিছু নতুনত্ব আছে! এ সব কথা বড় একটা ওঠে না। আর তর্কেতে কিছুই যায় আসে না। কারণ কবি গানের বিষয়বস্তুতে মহাজনেরা কোনও রীতিকরণ করে যাননি। নতুন নতুন কথা বলে সবাই কবি গানের ক্ষেত্র বড় করেছেন। পৌরসভার ভোটের সময় এই লোচন ঘোষ ভোটের কথা। গেয়েছে। এখানে আগে কেউ গায়নি।

লোচন ঘোষের মুখে আর সেই সহজ হাসিটি নেই। সেই অপরাজেয় হাসি। যে হাসি দেখলে প্রতিপক্ষের বুক কাঁপে। তবু সে স্বভাবসুলভ হাসিটি বজায় রাখতে চেষ্টা করে প্রথমে সাধুবাদ দিল অভয়কে। যদিও সেই সাধুবাদের মধ্যে কিছু শ্লেষের ছোঁয়া আছে। কিন্তু তাতে তেমন ধার নেই। লোকে হাসল না প্রাণ খুলে। লোচন গেয়ে বলল, কথার জবাব নানা রকম হয়। বিচারের ভার শ্রোতাদের ওপর।

শ্রোতাদের ওপর ভর দিয়ে লোচন সুবিধে করল না। জবাব দিতে গিয়ে ধর্মের কথা টেনে আনল সে। কিন্তু আসরে কোনও উল্লাস উঠল না। উলটে তাকে পুরাণেরই আশ্রয় নিতে হল।

তা ছাড়া অভয়ের পরে লোচনের গলার স্বর যেন চাপা পড়ে গিয়েছে অনেকখানি। লোচনের স্বর মিষ্টি, কিন্তু তার ধার নাই। তেমন জোরালো নয়। তার স্বরে হারমোনিয়মের সুরের আবেশ আছে। অভয়ের গলায় আছে টান-টান-চামড়া ঢোলকের কড়া চাঁটির তীব্রতা।

লোচন ঘোষের উদ্দেশে কে যেন চিৎকার করে বলে উঠল–ঘোষের গায়ে একখানি নামাবলি চাপিয়ে দিলে হত। নাম গান জমত ভাল।

ঘোষের ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে গেল। আসর নেতিয়ে গিয়েছে একেবারে। অভয়ের গানেও আসর খুব উত্তেজিত হয়নি, কিন্তু দোলানি ছিল একটি। ঘোষের অপেক্ষায় ছিল সবাই। কিন্তু উলটো বুঝে লোচন নিছক ধর্মের কথা বলে জবাব দিল। আসর গেল জুড়িয়ে। ফাঁকে ফাঁকে অন্যান্য কথা বলে, রঙ্গ রসিকতা করে গরম করার চেষ্টা করল। লোকে মানল না। লোচন ঘোষের নিজের এলাকায় এই প্রথম পরাজয়।

অভয়ের নিজেরই লজ্জা করতে লাগল। লোকচরিত্রের শিক্ষা পায় মানুষ এমনি করে। ভাল লাগলে লোকে মাথায় করে। মন্দ লাগলে ঝেড়ে ফেলে দেয়। এই নিয়ম সংসারের। আর এই নিয়মের অধীনে মানুষ নিষ্ঠুর।

ঘোষ বসে পড়ল। রাজুবালার মনে হল আসরটা যেন চারিদিক বন্ধ ঘেরাটোপ। বাতাস নেই, আলো নেই। অন্ধকার আর দমবন্ধ গুমশোনি। দেহোপজীবিনী বুড়ি রাজুবালার প্রাণে জীবনের কিছু ছিটেফোঁটা অনুভূতি ছিল। পয়সা দিয়ে কোনওদিন ঘোষের সঙ্গে কেনাবেচার সম্পর্ক ছিল না। যৌবনে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে একটি খেলার সম্পর্ক ছিল। ঘোষকে সে চিরদিন নিজের থেকে বড় মনে করত। কিন্তু তা প্রেম নয়। লোকে মনে করত। বয়সে একটু পাখসাট সবাই দেয়। তবু লোচন পুরোপুরি গৃহস্থ। সম্পন্ন করেছে নিজেকে খেটেখুটে।

বন্ধুর জন্য, অনেক শ্রদ্ধার ভালবাসার বন্ধুর জন্য রাজুবালার বুকে বড় কষ্ট। এত লোকের মধ্যে একলা তারই কষ্ট! শুধু তারই মন ব্যাকুল হয়ে উঠল, আহা! ঘোষকে কেউ একটু পাখার বাতাস করে না কেন? আজকে আর কেউ তার পাশে বসবার জন্য ছটফট করে না? ঘোষ যেন একঘরের মতো একলা বসে আছে।

ভবানীবাবু বলছিলেন তখন শরত দাসকে–লোচনের বয়স হয়েছে, আর পারে না আজকাল।

লোচনের সারা মুখের রেখাগুলি যেন কিলবিলিয়ে উঠল।

প্রতিপক্ষের পরাজয়ে যে-আনন্দ হওয়ার কথা, অভয়ের সে আনন্দ হল না। লোচন ঘোষের জবাব তার মনঃপূত হয়নি। পুরনো, সেকেলে, যান্ত্রিক একঘেয়ে কথা বলেছে ঘোষ। খারাপই লেগেছে তাতে অভয়ের। কিন্তু কবিওয়ালার মেজাজ যে তার নয়, বোঝা গেল। সে উল্লাস তার নেই।

বরং লোকের ছিল। ঘোষ নাকি শক্ত হাতে পড়েছে, তাই নতুন কথায় নতুন জবাব শোনবার জন্য, সকলেই খুশি।

অভয়কে উঠতে হল। ঘোষের পরাজয়ে তার আনন্দ নেই, নিজের কথার জবাব নিজে দেবার একটি চাপা ভাব তার মনে। কারণ, অভয় কথাকার। নিজের রচিত কথা শোনবার খুশি সে চাপবে কেমন করে।

অভয় উঠল। সাড়া দিল ঢোলক কাঁসি। অভয় কানে হাত দিয়ে, চড়া গলায় সুর তুলল।

আ-আ-হা! ও ভাই বসে আছেন যাঁরা।
অভয়েরো কথার বিচার করিবেন তাঁরা ॥

সে কথা বলতে হবে না। এখন ধরো দিকিনি বাপু। মুগুর আছে, দরকার হলে পড়বে। তোমাকে তা বলতে হবে না।

অভয় নিজের কথার জবাব নিজে গাইল।

লোকে বলে, সোনা দামি, হীরা দামি
আর দামি জহরত
 এতে সংসার মেনেছে বশ
সর্বজনার মতো।
তবে একবার চেয়ে দেখ নিজের দিকে।
কান পেতে কালের কথা শোন হে বুকে

ঢোলকের তালে, অভয় সাপের মতো নাচতে লাগল দুলে দুলে। হাসতে লাগল মিটি মিটি। তারপর আঙুল তুলে তুলে গাইল, তবে তো ভাই–

থাকলে ট্যাঁকে কড়ি কিনতে পার দুনিয়াখানি
আর কী দিয়ে কিনতে পার মানুষ একখানি?
মানুষের মতো মানুষের চেয়ে দামি কিছু নাই।
সবার উপরে মানুষ সত্য, তার উপরে নাই।
তাই, একবার চেয়ে দেখ নিজের দিকে। …।

 হাততালি দেবার কথা এ সব নয়। তাই চেঁচামেচি হুল্লোড় লাগল না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটি তারিফের সাড়া লাগল। অভয় থামল না, গেয়ে চলল।

আবার দেখ মজার সংসার, হায় হরি হরি।
 সবার চেয়ে মানুষ শস্তা, দাম নাই কানাকড়ি।
 সে মরে বাঁচে হাজে পচে, পথে গড়াগড়ি।
হে ভগবান নরনারাণ তোমারে গড় করি।
একবার চেয়ে দেখ নিজের দিকে।

এবার বেশ কলবর করেই হরিধ্বনি উঠল। ভবানী চৌধুরী নিজে এগিয়ে এসে, পকেট থেকে দুটি টাকা নিয়ে বাড়িয়ে দিতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই শরত দাস এসে টাকা গুঁজে দিল অভয়ের। হাতে। নইলে মহাজনের মান থাকে না। দুজনের কাছেই অভয় আভূমি প্রণত হয়ে টাকা গ্রহণ করল। চৌধুরীমশাই ক্ষুণ্ণ হননি তাতে। ফোগলা দাঁতে হাসলেন।

এ যেন অকূল সাগরে ভাসন্ত নেয়েদের তীরের অন্ধিসন্ধি খুঁজে পাওয়ার উল্লাস। একবার সে উল্লাস উঠলে, পালে শেষবারের বাতাস লাগলে, তার জয়ধ্বনি সহজে থামতে চায় না। অভয়ের আসরের সেই অবস্থা হল। সে যা বলে, তারই দাম। যা গায়, তাতেই জয়ধ্বনি।

অভয়ের নেশা লেগেছে। তার মনে হল, সে আর নিজের মধ্যে নেই। দেহে তার অনুভূতি নেই। সে যেন নিজে গাইছে না। আর কেউ গাইছে তার ভিতরে বসে। আর কেউ নাচছে তার অঙ্গে অঙ্গে। সে গাঁথছে ছন্দে ছন্দে।

ভগবান সহজ পাত্তর নন
খোলা আছে ত্রিনয়ন।

 তাঁর খেলাটাকে বিধান মনে করে সুখে আছে অনেকে। নরনারায়ণকে তিনি ভাগাড়ের মরা গরু করেছেন। লোভীকে করেছেন উল্লাসমত্ত শকুন। শকুনের ভাঁড়ামি দেখছেন, সে আবার কেমন দরিদ্রনারায়ণের ছিচরণে পুজো দেয়। কিন্তু বিবেক বুদ্ধি হরণ করেননি সংসার থেকে। মিনি মাগনা ছড়ানো আছে হেথাহোথা। যে নিতে পারো নাও! না নিতে পারো, সুখ লুটতে থাকো।

যুগ যুগান্তর ধরে ভগবান দেখিয়ে আসছেন এই অমিলের খেলা। মানুষের এই ক্ষমতার দম্ভ। সুখের দাপাদাপি!

কিন্তু জেনে রাখো, বিধান আসছে। দরিদ্রনারায়ণ তার বেশ বদল করছে। এবার আর ক্ষমা নাই। এবার আর ভিক্ষাপাত্র নয়। এবার গদা সুদর্শন চক্র। খেলা সাঙ্গ হবে এবার, শিয়রে বিধান।

এ সবই অভয় গান গেয়ে গেয়ে বলল। কেউ তাকে বলে দেয়নি, কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। হাত দিয়ে তোলেনি। মন তার বাহু মেলে তুলে নিয়েছে। ছকে গেঁথেছে। সুর দিয়ে সুন্দর করেছে। যার শেষ ভাল, তার সব ভাল। যার গলা ভাল, তার গান সব সময় ভাল। এই সম্পদটি আছে অভয়ের পুরোপুরি।

তারপর চারদিকে আঙুল দেখিয়ে গাইল,

ও ভাই একবার চেয়ে দেখ নিজের দিকে।
হে নর—নারা–য়ণ! ।
মার খেয়েছ অনেক এবার ওঠ হে হেঁকে।

আসরের মন বদল হয়ে গেছে। চরিত্র বদলে গেছে তার। কথায় বলে, মন গুনে ধন, দেয় কোন জন। যন্ত্র নয়, মন বদলায়। রূপ তার এক নয়, অনেক। যে রসের লোভে জুটেছিল রসিকেরা, সে কথা তারা ভুলে গেছে। তারা নরনারায়ণ হয়ে কলকণ্ঠে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল। দরিদ্র-নারায়ণের ফুটো পয়সা ঝংকৃত হয়ে উঠল অভয়ের পায়ের কাছে।

অভয় বারে বারে নমস্কার করল।

নমস্কার করতে পারল না হরি মিস্তিরিকে। সে এসে জড়িয়ে ধরল। পকেটে যা ছিল, সব উজাড় করে দিল। চেনাশোনা মিস্তিরি যত ছিল, তাদের দাবি বেশি। তারা কাছে এসে হাতে গুঁজে দিল। পয়সা।

কেবল অনাথ অভয়ের কাছে আসতে ভুলে গেল। খুশিতে তার দু চোখ উদ্দীপ্ত। বিস্ময়ে সে অবশ। মানুষের মধ্যে মানুষ লুকিয়ে থাকে। লুকিয়ে থাকা মানুষটি অন্য মানুষ। সে সহজে বেরোয় না। অকারণ দেখা দেয় না। এ অভয় পুরোপুরি চেনা নয় অনাথের। এর ছিটেফোঁটা চেনা ছিল। তাই অনেক আশা ছিল।

কিন্তু সে যে এমনি করে মানুষকে মাতাবে, কোনওদিন ভাবতে পারেনি। আর এ মাতানো সাধারণ মাতানো নয়। গোটা আসরের মন বদলে দেওয়া। মানুষ নিয়ে অনাথের কারবার। ক্ষণভঙ্গুর নিস্তেজ শীতল মানুষ নিয়ে অনাথকে চিরদিন হিমসিম খেতে হয়। সহজে যাদের মনের সংশয়ের জগদ্দল পাথর সরানো যায় না, সেই সব মানুষদের আসরকে দেখল অনাথ। তারা এসেছিল এক মন নিয়ে। পেল আর এক মন। দিন-যাপনের গ্লানির ওপরে একটু ফুর্তির প্রলেপ নয়। যে রস সবাই চেটেপুটে খেয়ে, হাসতে হাসতে, খিস্তি করতে করতে ফিরে যাবে। এ অন্য জিনিস।

অভয় জাদু করেছে তাদের। এখনও করছে। থামতে চাইলে, আর তাকে কে থামতে দিচ্ছে। চালিয়ে যাও ভাই। চালিয়ে যাও। বাতাস উঠে গেছে। পালে লেগে গেছে। জানা গেছে তীরের সন্ধান। আর তো তোমায় এখন ছাড়া যাবে না।

ভবানীবাবু রয়েছেন, তাই মান্যগণ্য আরও দু চারজন এসেছেন। শরত দাসের জায়গায় অসঙ্কুলান। মানীদের আপ্যায়ন করতে হচ্ছে তাকে।

ভবানীবাবু বাড়ি ফিরতে পারলেন না। নাকে দলাখানেক নস্য গুঁজে, প্রায় সুরেলা গলায় বললেন, শরত, ছেলেটি কি রাজনীতি করে?

শরত অবাক হয়ে বলল, রাজনীতি?

কড়ি গোনা মহাজন। বুঝতে পারেনি। ভবানীবাবু বললেন, রাজনীতি হে রাজনীতি। দলটল করে নাকি তোমাদের শৈলীর জামাই? যাকে বলে আন্দোলন?

বুঝতে পেরেছে শরত দাস। আজকালকার দিনে ও কথাটা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগে না কারুর। বলল, আজ্ঞে তা তো জানিনে। তবে, ওই অনাথদের কলে কাজ করে। ওদের সঙ্গে মেশামেশি আছে দেখেছি।

–হুঁ। ভাল কথা। খুব ভাল কথা। নতুন করে আবার কবিগান শুনবে হয়তো লোকে। তবে–

ভবানীবাবুর রেখাবহুল চামড়ায় আরও কয়েকটি নতুন রেখাপাত হল। এই শহরের, এই দেশেরই সমাজ ও রাজনীতি ভবানীবাবুর নখদর্পণে। সারাটা জীবন তো এই করেছেন। রাজনীতি, জেল, গোলা গুলি। আজও ছাড়া পাননি। এই শহরে, এখনও মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুললে, হাততালি পড়ে সকলের। বললেন, দল ভাল, কিন্তু রাহুর গ্রাস ভাল নয়। দল যদি ছেলেটাকে ভালবাসে, গ্রাস না করে, তবে কিছু গাইতে পারবে। দেবে কিছু মনে হচ্ছে।

শরত দাস বুঝল না। বলল, আজ্ঞে!

অভয় তখন ছন্দে বেঁধে গাইছে।

 ভাই পণ্ডিতেরা কি মিছে কথা বলেন? না স্বার্থপরে মিছে কথা বলে? পণ্ডিতে বলেন, মানুষ এক জাত। আর একদল বলে, মানুষের নানান জাত। কোনটা মানব আমরা?

খাঁটি মানুষের কোন জাতাজাত নাই। ।
জগতের মানুষকূল একে পরের ভাই।

তবে সুখ-দুঃখের এই ভাগাভাগিটা কেন? এই অঘটন যে ঘটিয়েছে, নিয়মের নিক্তি তার ঠিক নেই। সবাই একবার চিন্তা করে অঘটনটা দেখো, নইলে নিস্তার নাই। কাল যদি না বদলাবে, তবে মহাভারতের কাল কেন আর নাই? কালকে কালে খায়। কালের এই নিয়ম। আজ যারা কালকে নিজের মনে করেছ, জেনে রাখো, তারও কাল আসছে।

কান পেতে কালের কথা শোন আপন বুকে।

তারপরে সে গাইল, যে মায়ের জাতি, সেই আমার ঘরের বউ, বোন। তার কাছে আমরা প্রেম যাচি। কিন্তু তাকে বাইরে ফেলে রেখে, তার প্রেম কিনতে যাই আমি পয়সা দিয়ে। তবে কোটিপতিই প্রেমের রাজা! আমি তুমি কিছু না। যার টাকা, তারই প্রেম।

স্বাভাবিক ভাবেই বারোবাসরের পাড়ার মেয়েদের মধ্যে কিছু অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। তারা মুখ তাকাতাকি করছে একে অপরের। আ মলো! ছোঁড়া আর গান খুঁজে পেল না। আবার এদিক নিয়ে পড়ল কেন?

অভয় তখন গাইছে, বুকে হাত দিয়ে বল ভাই সবে, টাকা দিয়ে কে প্রেম পেয়েছ? কেউ পাওনি। ঘৃণা পেয়েছ। যাদের প্রাণ আছে, তারা ঘরের জিনিস ঘরে তুলে নাও। প্রেম দিয়ে প্রেম কেনা যায়।

দেহোপজীবিনী মেয়েদের মধ্যে যেটা অস্বাভাবিক, সেইটাই দেখা দিল। তাদের চোখে কুণ্ঠা, মুখে লজ্জা, আসরে বিষণ্ণতা।

ভাবের ভাবীরা জয়ধ্বনি দিল। আর কে যেন শিস্ দিয়ে উঠল। বলে উঠল, শালা উপদেশ দিচ্ছে রে!

সুরীনের কাছে শৈলবালা ছিল। শৈলবালার কেন যেন বুকটা বড় অস্থির অস্থির করছে।

 সুরীন বলল, একটু ঠাণ্ডা হও শৈলদি, অমন করে না।

–পারছিনে ভাই। পারছিনে। এ আমার নতুন রোগ দেখা দিয়েছে। আমার বুকের মধ্যে দম আটকে আসে। হাত পা অবশ হয়ে যায়।

সুরীনের আসর ছেড়ে যাবার ইচ্ছে নেই। হাত বাড়িয়ে, শৈলর পিঠে হাত বোলাতে লাগল। বলল, একটু ঠাণ্ডা হয়ে বসো। না হয় শোও।

নিমির বুকে বুঝি তার অদৃশ্য স্ত্রীত্ব অমৃতের ফোয়ারাই তুলেছিল। মেয়েরা যে অধিকাংশই তার দিকে তাকাচ্ছিল বারে বারে। এ নায়ক যে তার। তারই ঘরের পুরুষ, দেহের পুরুষ। আর বিচিত্র বিদ্বেষের মধ্যেও অভয় যে তার মনেরও পুরুষ।

কিন্তু ভয়েই বুঝি তিক্ততা বাড়ে। তার অমৃতের ফোয়ারার নিচু তলার গভীরে কেন বিষের আবর্ত। সেখানে কেন কূট বিষের যন্ত্রণা।

সে যে অভয়ের গান শুনে হাসতে পারেনি। হাততালি দিতে পারেনি। কেন তত্ত্বকথা? কেন ভালবাসাবাসি, মান অভিমান, রাগ অনুরাগের গান নয়, যার মধ্যে নিমি দেখতে পাবে নিজেকে। ফুলের মতো ফুটবে সরোবরের বুকে। কেন এত গম্ভীর গম্ভীর দুঃখ যন্ত্রণার ইতিহাস। কেন তুমি। নিমির নাগালের বাইরে। তোমার দেহের নাগালটুকু ছাড়া, কেন আমি নিঃসঙ্গ।

কেন আমি দেখি, কুলটা সুবালা তোমাকে দেবতার মতো দর্শন করছে। দয়িতের কাছে যেন লুটিয়ে পড়তে চাইছে।

নিমি যত দেখছে সুবালাকে, ততই তার চোখ আরক্ত হচ্ছে। সন্দেহ আর ঈর্ষা এমনি করেই বুঝি প্রেম হারায়। মন্দিরের ঠাট বাড়ায়, ঠাকুর থাকে না। সে দেখল, সুবালাকে ডেকেও গিরিবালা সাড়া পাচ্ছে না। সে কবিয়ালকে দেখছে।

সত্যি দেখছে। সুবালার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। ওই উদ্দীপ্ত আত্মভোলা গায়ক তার দরজায় দীনের মতো বসেছিল একদিন। হাত তুলে মারতে গিয়েছিল মাতালকে।

গিরিবালা এবার চিমটি কাটল জোরে–এই মুখপুড়ি।

সুবালা ব্যথায় আর্তনাদ করে ফিরে তাকাল। বলল, কী? বলছিস কী?

গিরিবালা আবার একটা চিমটি কেটে বলল, অই দ্যাখ, তোর সেই ওপারের নাগর এসেছে। তোর দিকেই হাঁ করে তাকে ছিল। ও তো জানে না, তুই ইদিকে ভগবান পেয়ে গেছিস। আমার চোখে চোখ পড়তেই তোকে ইশারায় ডেকে দিতে বলল। ওদিকে আবার ভদ্দর লোক নাগর তো, লোকজনের সামনে আসতে পারবে না।

–থাকুক গে যে খুশি।

বলে ফিরতে গিয়েও সুবালার দু চোখে হঠাৎ আলোর ঝিলিক দিয়ে উঠল। চকিতে আবার ফিরে উৎসুক গলায় বলে উঠল, কই, কোথায় লো সেই মিনসে?

–ওই তো, উ-ই দেখা যায়।

 বাজারের বাইরে যাবার গলির মোড়ের ভিড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে দিল। সুবালা ফিরে তাকাতেই চোখাচোখি হল তার সঙ্গে।

বয়স বেশি নয়। কোন এক ডাক্তারের ছেলে নাকি গঙ্গার ওপারের। বিয়েও নাকি করেছে মাস ছয়েক। নিজেও ডাক্তারি পড়েছে। পাশ করতে পারেনি। এর মধ্যেই বারোবাসরে যাওয়া আসা ধরেছে। সুবালার দিকেই নজরটা বেশি। সপ্তাহে দু তিন দিন প্রায় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চোখের ইশারা করে সুবালা লোকটিকে বাজারের পিছন দিকে ইঙ্গিত করল। তারপর সে নিজেও উঠে, বাজারের পিছন দিকে চলে গেল।

কেবল গিরিবালা মুখ বাঁকিয়ে বলল, ছুঁড়ির ঢং বোঝা যায় না। যাব না তো আবার গেলি কেন তবে?

পিছন দিকে একটু অন্ধকার ও নিরালার অবকাশ রয়েছে। সুবালার আগেই, সেই লোকটিই উপস্থিত সেখানে। সুবালা আসতেই সে হাত টেনে ধরল। সুবালা বাধা দিল না। প্রায় গায়ের উপর এসে পড়ল তার।

লোকটি বিরক্তিভরা গলায় বলল, কী সব ছাইপাঁশ শুনছ বসে বসে। চলো, ঘরে চলো।

 সুবালা বলল, যাব। আগে পাঁচটা টাকা দাও দিকিনি।

–যাঃ বাবা। এখনি টাকা কীসের?

হতাশার সুর লোকটার গলায়।

সুবালা হাতের ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, দাও না তাড়াতাড়ি, আমার দরকার।

লোকটা অসবুর। অন্ধকারে চোখ জ্বলছে ধ্বকধ্বক করে। নিশ্বাসে আগুনের ভাপ। সুবালাকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে বলল, পাঁচ টাকাই অগ্রিম নেবে?

সুবালা মনে মনে ছটফট করছিল। তবু বাধা দিল না। বাধা দিল না লোকটার বিছের মতো সারা গায়ে বেয়ে বেড়ানো হাতটাকে। বলল, দাও এখন, তোমাকে পুষিয়ে দেব পরে। ৫৭৪

–আর আজ?

–আজ একটু পরেই যাচ্ছি। তুমি এখেনে থাকতে পারো। নইলে, বাড়ি যাও। ঘণ্টাবুড়িকে গিয়ে বলল, আমি আমার ঘরের দরজা খুলে দিতে বলেছি। সেখানে গিয়ে বসো।

লোকটা পকেট থেকে টাকা নিয়ে দিল সুবালার হাতে। আর সঙ্গে সঙ্গেই ছিনে জোঁকের মতো ঠোঁট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

সুবালা গাল মুছে, ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। লোকটা চাপা অস্পষ্ট গলায় ছুড়ে দিল–দেখো, রাত কাবার কর না যেন। বাড়ি ফিরতে হবে।

সুবালা ততক্ষণ আলোর সীমানায়, আসরে। কিন্তু চোখের ভাব তার বদলে গেছে। মুখের সেই মুগ্ধ মন্ত্র যেন শুষে নিয়েছে কেউ। দু খণ্ড অঙ্গার যেন কেউ বসিয়ে দিয়েছে চোখে।

আসরে ঢুকতে গিয়ে তার নজরে পড়ল বাজারেরই একটি চেনা ফড়েকে। সুবালা তাকে ধরল। বলল, এই যে, শোনো।

কী বলছ?

সুবালা তার হাত ধরে টাকা কটা দিয়ে বলল, ওই গাইয়েকে টাকা কটা দিয়ে এসো না ভাই।

 ফড়ে লোকটি তীক্ষ্ণ চোখে একবার তাকাল সুবালার দিকে। বলল, তুমি নিজে যাবে না?

না! গাইয়েটার মাথায় আবার একটু ছিট আছে। না নেয় যদি? কিছু বলল না যেন।

ফড়ে আর কোনও কথা না বলে, এগিয়ে গিয়ে টাকা পাঁচটি তুলে দিল অভয়ের হাতে। অভয় হাত পেতে নিয়ে নমস্কার করল।

সুবালার মনে হল, একবার যেন অভয় তাকাল এদিকে। যেন তার চোখে চোরা চাউনি আর মিটি মিটি হাসি দেখা গেল।

কিন্তু আসলে কিছুই দেখছিল না অভয়। সুবালা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল। কী যেন ঠেলে আসছিল বুক থেকে। তার চোখের দৃষ্টি হারিয়ে যেতে চাইছিল অকারণ।

পর মুহূর্তেই যেন চকিতে নিজেকে কঠিন করে, ফিরে গেল সে। অন্ধকারের দিকে অগ্রসর হয়ে চাবুকের শিস দেওয়া সুরে ডাকল লোকটাকে, এসো!

ঘটনাটা দেখল দু জন। একজনের চোখের আগুন সুবালার থেকে কিছু কম নয়। মুখ তার চেয়েও কঠিন। আর একজন বিরক্ত অথচ বিষণ্ণভাবে হাসল। মনে মনে বলল, কিন্তু ঘুড়িটাকে আমি কোনও দোষ দিতে পারিনে।

একজন নিমি। আর একজন রাজুবালা।

আসর ভাঙল অভয়ের জয়জয়কার দিয়ে। কিন্তু বাড়ি পালাবার উপায় নেই। শরত দাস বাজারের পক্ষ থেকে রাজভোগ খাওয়ালে লোচন ঘোষ আর অভয়কে। ভবানীবাবু শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। নিজে অভয়ের কাঁধে হাত দিয়ে বাড়ি যাবার নিমন্ত্রণ করে গেলেন। বললেন, ভাল হয়েছে, গান তোমার কালোপযোগী হয়েছে। এক দিন এসো আমার ওখানে, আলাপ করব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *