২.২ শরত দাসের কাছ থেকে

০৭.

শরত দাসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাজারের বাইরে এসেই থমকে দাঁড়াল অভয়। অনাথ তার সেই ভাঙা দাঁতে হাসছে মিটি মিটি। দৃষ্টি অভয়ের দিকেই। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অভয় কী করবে, কিছু স্থির করতে পারল না।

অনাথ হাত বাড়িয়ে ডাকল, আয়।

অনাথের ওই হাসিটুকু অনেক দিন ধরে চেনা। হাসির সঙ্গে ওই ডাকের পরে পৃথিবীর কোনও বাধা আর ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। কাছে যেতে যেতে বলল সে, তুমি আজকের গান শুনেছ?

অনাথ দেখতে রোগা, কিন্তু গায়ে শক্তি ধরে। সমস্ত শক্তি দিয়ে সে দু হাতে জড়িয়ে ধরল অভয়কে। প্রায় চাপা গলায় যেন ফিসফিসিয়ে বলল, সাবাস! সাবাস খুড়ো। তুই আজ আমার সব গুমোর ভেঙে দিইচিস।

অত বড় মানুষটা অভয়, তারও যেন দম বন্ধ হয়ে এল অনাথের আলিঙ্গনে। বলল, তোমার ভাল লেগেছে খুড়ো?

অনাথের গলা কেঁপে উঠল প্রায়। বলল, ওরে, আমি কোন ছার। ভবানীদা তোকে সাট্টিপিকেট দিয়েছে, তুই কি যে সে লোক।

অভয় অনুভব করল, তার বুকের মধ্যে প্রবল আলোড়ন। অনাথ আবার বলল, আর মিটিং-এ দাঁড়িয়ে তুই বলিস, গান আমি গাইতে পারিনে!

সে কথার জবাব না দিয়ে অভয় বলল, চলো খুড়ো, গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি খানিক।

অনাথ বলল, তা কী করে হবে? তোমার শাউড়ি, সুরীনদা, ওরা বোধহয় সব গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে তোমার জন্যে।

অভয় বলল, থাক খুড়ো। চলো,একটু বসিগে ঘাটে। এখন ঘরে ফিরতে মন চাইছে না।

অন্ধকারে গঙ্গা চকচক করছে, ছলছলাচ্ছে। ওপারের আলোর অস্থির প্রতিবিম্বগুলি যেন স্থির থেকেও হারাচ্ছে নিমেষে। অদূরেই খেয়াঘাটে নৌকাগুলি বাঁধা। মাঝিরা ঘুমোচ্ছে। নদীর বুক শূন্য, নৌকা নেই। কাছে ও দৃরে জেটিগুলি ছকে-আঁটা জটিল অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও অস্পষ্ট গাধাবোটগুলি নোঙর করে রয়েছে সিন্ধবাদের সেই অতিকায় তিমি মাছের মতো।

আকাশের তারারা যেন নেমে এসেছে। মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত এইটুকু সময়, গঙ্গা কথা বলছে আকাশের সঙ্গে। মানুষেরা জেগে উঠলে আবার সে নিত্যপ্রবাহের কাজের যাওয়া-আসায় বইবে।

খেয়াঘাটের অদূরেই, ঘাসের ওপর বসল এসে দুজনে। অনাথের মনে বিস্ময়। আজ তার নতুন লাগছে অভয়কে। কী চায় অভয়, কেন এমন করছে। অনাথের হাত ছাড়েনি তখন থেকে। গঙ্গার ধারে এসে বসেও, অনাথের হাতটি ধরে রইল সে।

বসে, একটু পরে বলল অভয়, খুড়ো, জ্বর উঠতে লাগল, এ আর থামবে না। আমি টের পেয়েছি।

অনাথ সন্ত্রস্ত গলায় বলল, জ্বর?

অনাথ অভয়ের গায়ে হাত দিল। অভয় হাসল। নিঃশব্দে হেসে তাকাল গঙ্গার দিকে। বলল, গায়ে নয় খুড়ো, প্রাণে। এ বিষম জ্বর। এ আমাকে অনেকবার ধরব ধরব করেছে, পারে নাই।

এইবার ধরেছে, আর আমার ছাড়ান নাইকো।

অনাথের চোখের আঁধার কাটে না। বলল, একটু বুঝিয়ে বলল ভাই খুড়ো।

 অভয় বলল, খুড়ো, এ সব যে জ্বরের মতনই। সেই তোমার গান আছে না।

ও রাই, কী নাম জপে কী হল তোর
এ যে অবিরাম জ্বর।

আজকের আসরে আমার তেমনি জ্বর ধরিয়ে দিলে খুড়ো, এ আর সারবে না।

নদীর অন্ধকার স্রোতে যেমন সহসা চিকচিক করে ওঠে, তেমনি চিকচিকিয়ে উঠল অনাথের চোখ। সে বলল, সে তো খুব ভাল কথা রে খুড়ো? জ্বর? তাই বল, আমি বুঝতে পারিনি। হ্যাঁ, এ তো জ্বর-ই। এ তো ভাল, খুব ভাল। যত খুশি জ্বর চাপুক। এ জ্বর যত চাপে ততই ভাল।

কিন্তু খুড়ো, সামলাতে পারব তো?

এ যেন দুই পাগলের মিলন। জীবন নিয়ে ছিনিমিনি নয়, কিন্তু নিজের রক্ত উজাড় করে দিয়ে, সেই আরাধ্য মহাজীবনের পূজা, এই তো অনাথের জীবন সত্য। সে দু হাত বাড়িয়ে অভয়ের কাঁধ ধরে বলল, কীসের সামলানো। সামলাবি কীসের কী? মরবি। এই জ্বরেই মরবি, সেই তো সত্যি মরা।

অভয়ও দু হাতে অনাথের দুটি হাঁটু জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, এ্যাই এই খুড়ো তোমার কথা। এ কথাটা বলে দেবার লোক নাই সংসারে। এই জন্যে তোমাকে গুরু মেনেছি। আবেগে অনাথ সম্পর্ক ভুলে যায়। বলল, এই শালা তোর বাজে কথা।

-না, বাজে কথা নয়।

–হ্যাঁ, বাজে কথা।

বাজে কথা নয় খুড়ো, গুরুদক্ষিণা নিতে হবে তোমাকে।

–গুরুদক্ষিণা?

–হ্যাঁ।

দু পকেটে হাত দিয়ে, খুচরো পয়সা, আস্ত টাকা সব বার করে তুলে দিল অভয় অনাথের কোলে।

অনাথ এবার চেঁচিয়ে উঠল, এই খুড়ো, কী করছিস?

অভয় বলল, ঠিক করছি খুড়ো–ন্যায্য কাজ করছি। আমি তোমাকে দিলুম খুড়ো, তুমি ইউনিয়নে জমা করে দেবে। তুমি শিখিয়েছ, ইউনিয়নটা আমাদের মন্দিরের মতন। তুমি ভিক্ষে করো, আমিও ভিক্ষে করেছি। এ-তুমি নিয়ে যাও।

কয়েক মুহূর্ত কথা বেরুল না অনাথের মুখ দিয়ে। পয়সার দিকে ফিরে তাকাল না সে। জড়িয়ে ধরল না অভয়কে। যেন আকাশের দিকে মুখ করে, চুপি চুপি বলল, আমি জানি খুড়ো, তোকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।

কীসে ঠেকাতে পারবে না, কোথায় পারবে না, সে কথা কিছু বললে না অনাথ। তারপরেই পরিষ্কার গলায় বলল, কিন্তু কত আছে গুনেছিস?

অভয় বলল, ঢুলিকে দিয়ে-থুয়েও আছে গোটা ছাব্বিশ সাতাশ। শরত দাস গুনে দিয়েছে।

অনাথ গম্ভীর স্বরে বলল, বেশ, তবে আমার কথা মানো।

 বলে বেছে নোট গুনে তুলল অনাথ। একটি পাঁচ টাকার নোট বুক পকেটে গুঁজে দিয়ে বললে, এ টাকা দিয়ে শাউড়ির একটি থান কিনে দিবি। আর এই ধর আরও আটটি টাকা, নীচের পকেটে দিলাম। এ টাকা দিয়ে বউমাকে একখানা রঙিন শাড়ি কিনে দিবি। দিতে হয়, নইলে অধর্ম হবে। কারখানায় যে-টাকা পাস, সেটা হল মজুরি, এটা হল সম্মানী। দুয়েতে অনেক ফারাক। এ টাকা দিয়ে তাদের না দিলে অন্যায় হবে।

মাথা নত করল অভয়। যা হুকুম করো খুড়ো।

বলে একটি নিশ্বাস ফেলে, দূর গঙ্গার দিকে তাকাল সে। বলল, খুড়ো, একটা কথা।

-বল।

–জীবন ছোট না বড়?

 অনাথ বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখখানি।

বলল, অমন করে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করসিনে। আমি কি সব জানি?

–তবু বলো।

 –নিজের কথা বলতে পারি।

বলো।

অনাথ গলার স্বর নামিয়ে বলল, খুড়ো, বড় বিপদে ফেলেছিস। তুই আমার চে বয়সে অনেক ছোট, তবু সত্যি কতা বলব তোকে। জানিস তো, তোর একটা খুড়ি ছিল। সন্তান ছিল! জেল থেকে ফিরে এসে তাদের আর পেলাম না। শোক করিনে আর, কিন্তু তা কি যাবার? বুকটার মধ্যে যখন বড় বেশি কনকনিয়ে ওঠে, তখন খালি বলি, জীবনটা ছোট। কত ছোট, তাতেও মাপ হল না। হল তখন, যখন একদিন আর একটা গণ্ডগোল করে ফেললাম। ছেচল্লিশ সালে পুলিশের গুলিতে মরেছিল দীনু। আমাদের বন্ধু, দোস্ত। দীনুর বিধবা, নাম লক্ষ্মী। তখন ছিল কড়েরাঁড়ি, ছেলেপুলে হয়নি। মনের মধ্যে আমার শোক, তবু লক্ষ্মীর কাছে কেমন করে যেন ধরা পড়ে গেছি।

অনাথের এই অকপট স্বীকারোক্তি অভয় অবাক হয়ে শুনল। অনাথ একজন নামকরা লোক। তার নামে লোকে সহজে দুটি কথা বলতে পারে না।

অনাথ থেমে বলল, লক্ষ্মী ডাকলে যেতে পারিনে। কাছে গেলে দু দণ্ড থাকতে পারিনে। কেন? লোকে না বুঝুক, আমি তো বুঝি। কিন্তু লক্ষ্মী বোঝে না। রাত করে পালিয়ে আসে, দিনমানেও তার ব্যাভারের কিছু চাপাচাপি নেই। যা মুখে আসে, তাই বলে গাল দিয়ে যায়, কাঁদে। বলে, তোমাদের দেশের ভাল হোক, আমি গলায় দড়ি দেব। যিদিনে কাঁদতে এয়েছিলুম তোমার কাছে, সিদিনে দূর করে দাওনি কেন? আমি ডাকি, সাড়া দাও না। এলে দূর দূর কর।

অনাথ হাসল। অনাথের দুটি ভাঙা দাঁতের ফাঁকে যে হাসি দেখলে অভয়ের বুকের মধ্যে বড় টাটিয়ে ওঠে।

অনাথ হেসে বলল, সে থাকগে। যে কথা বলছিলাম। তা এও তোমার ধরাই পড়েছি বলতে হবে। যখন মনে হয়, তখন বলি, জীবন কী ছোট। কাজ করি, ইউনিয়ন করি, দল করি, দশজনকে নিয়ে আছি, সব সময় মনে হয় বড় ছোট জীবন। নাগাল পাইনে যা চাই। বড় ছোট এ জীবন।

বলে অনাথ চুপ করল। অভয়ও কথা বলল না। তাকিয়ে রইল দূরের অস্পষ্ট বাঁকের অন্ধকারে।

একটু পরে অনাথ বলল, কী খুড়ো, চুপ করে রইলে যে?

 অভয় হেসে বলল, মিল হল না খুড়ো তোমার সঙ্গে। তুমি যে ভুল বললে?

–ভুল?

–নয়? ওই যে বললে, যা চাই, তার নাগাল পাইনাকো। ওইটে না জীবন? যদি শুধু আপনাকে জীবন ভাবি, তবে জীবন ছোট। কিন্তু খুড়ো, যার নাগাল পাও না, সেইটেই না জীবন? জীবনের কি কুল আছে? তার কি সীমা আছে? আমি তার কূল-কিনারা পাই না। সে অকুল পাথার। আজ আমার পেত্যয় হল কি না, জীবন অনেক বড়। আমি দুটো কলি বেঁধেছি। সেইটে তোমায় শোনাব।

অনাথ বলল, শোনা।

অভয় গুনগুন করে গাইল ভৈরবী সুরে,

ওহে জীবন, আমি তোমারে বেড় পাই না।
কেঁদে কেঁদে মরি আমি।
খুঁজে বেড়াই দিন যামি।
এ কেমন রূপের অকূলপাথার মাপতে পারি না।

অনাথ গান শুনে, একটু যেন চিন্তিত সুরে বলল, আচ্ছা?

অভয় বলল, তাই না খুড়ো? জীবনকে কি মাপা যায়। খুড়িকে দিয়ে পর্ব শেষ করতে পারলে না, মনের মধ্যে নীঠাকরুণ এসে আসর জমিয়ে বসেছেন। খুড়ো, আরও কত কি বাকি আছে, কতটুকুনি জানি বলো? ছোট বলো না খুড়ো, জীবন বড়। তবে

বলেই আবার গেয়ে উঠল,

কাঁদে ছোট বলে
কেউ কাঁদে বড় বলে
তবু পাখির মতন ঠোঁটে করে নিতে যে হায় পারি না।

অনাথ বলল, এতক্ষণে পোষ্কার হল।

অভয় চঞ্চল আজ। এক কথায় বেশিক্ষণ থাকতে পারছে না। বলল, খুড়ো, আমি তানাকে একবারটি দেখব।

কাকে?

–তানাকে। একবারটি দেখতে মন করছে যে?

নামটা নিতেও যেন কত সংকোচ অনাথের। বলল–লক্ষ্মীকে?

অভয় বলল, যদি মনের মানুষ পাই, তার নাম কিছু নাই।

 চালাক চতুর অনাথ অন্ধকারে বোকার মতো হাসতে লাগল। তারপরে বুঝল, অভয়কে আজ সহজে নিবৃত্ত করা যাবে না। বলল, সে হবেখনি। এখন চল তত উঠি, আর নয়। রাত আর কতটুকুনি আছে? কাজে যেতে হবে খানিক পরেই। চল চল।

হাত ধরে টেনে তুলল সে অভয়কে। দুজনের দু দিকে রাস্তা। অনাথের দক্ষিণে, উত্তরে অভয়ের। অনাথ বলল, এত রাতে আর কোথাও যাসনে খুড়ো, বাড়ি যা। ভোরে মিলে যাবি তো?

অভয় বলল, মিলে না গেলে চলবে কেমন করে? খুড়ো, তোমাকে এগিয়ে দেব?

অনাথ হেসে বলল, আরে না, বোকা কোথাকার। তুই যা দিকিনি এবারে?

.

০৮.

অভয় গঙ্গার ধার দিয়ে এগিয়ে চলল। মালিপাড়ার সরু গলিতে ঢুকতেই কুকুর চিৎকার করে উঠল। তারপরে চেনা মানুষের গন্ধ পেয়ে থেমে গেল। এদিকটায় গৃহস্থদের আবাস। এখন অবশ্য সব আবাসই ঘুমন্ত, নিঃশব্দ।

অভয় দেখল, সদরের ঝাঁপ খোলা। আস্তে আস্তে ঢুকে বন্ধ করে দিল। কিন্তু ঘরের পিছনে, পুকুরঘাটের দিকে আলোর আভাস দেখে একটু অবাক হল। নিমির ঘরের দরজা বন্ধ বলেই মনে হল। শাশুড়ির ঘরটা খোলা পড়ে রয়েছে। পায়ে পায়ে সে পুকুরঘাটের দিকে গেল।

যা সন্দেহ করেছে তাই। শৈলবালা পুকুরে কোমর ডুবিয়ে বসে আছে। কয়েক মাস ধরেই এ রকম দেখা যাচ্ছে।

যৌবনে শৈলবালা যে কাল রোগ আয়ত্ত করেছে, রক্তের তেজে সে রোগ এতদিন ওষুধি লতার গন্ধে অবশ সাপের মতো জীবন্তে মরেছিল। রক্তের তেজ যত কমছে, ততই সে বিষধর কুণ্ডলমুক্ত হচ্ছে। এখন প্রতিদিন তার বিষের ছোবল বাড়ছে। শৈলবালার দেহের গর্তে ক্রমেই সে আরও বেশি গজাচ্ছে, ফুঁসছে, দংশনে দংশনে প্রাণ শেষ করছে। ব্যাধির প্রকোপে চোখের দৃষ্টি কম ছিল অনেকদিন থেকেই। ছানি নয়, একটি চোখের মণি ক্রমেই সাদা হয়ে যাচ্ছিল। ফুলছিল সে অনেকদিন থেকেই। যেন নতুন স্বাস্থ্যের মতে, একটা রক্তাভ দীপ্তি ফুটে উঠেছিল তার সর্বাঙ্গে। কয়েক মাস ধরে শৈলবালা দেহে জ্বালা অনুভব করছিল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পুকুরে নামলে, প্রথম প্রথম সে উঠতে একটু দেরি করত। বলত, জলে ডুবে থাকলে ভাল লাগে। দাউ দাউ করে যে আগুন জ্বলছে, একটু যেন ঠাণ্ডা থাকে।

ইদানীং আরও বেশি সময় সে জলে থাকছিল। সকালবেলা নেমে, নিমির মুখতাড়া খেয়ে বেলা দশটা বেজে যেত উঠতে। কঁকানি গোঙানি তো আছেই চলতে ফিরতে। নিয়মিত চিকিৎসা কখনও করে না সে। ডাক্তার বলেছে, ওই করে অসুখটাকে পাকাপাকি ভাবে বাধালে।

কিন্তু রাত থাকতে পুকুরে গিয়ে কোনওদিন ডোবেনি শৈলবালা।

হ্যারিকেনটা পুকুরের ওপরে। জলের ধারে আলো তেমন পৌঁছায়নি। দেখল, শৈলবালা গালে হাত দিয়ে জলে বসে আছে। গায়ে তার কাপড় নেই। গায়ের কাপড় ঘাটের তালের ডোঙার ওপর পড়ে রয়েছে। শৈল কঁকাচ্ছে।

অভয় ডাকল, মা।

শৈলবালা তাড়াতাড়ি কাপড়টা টেনে নিয়ে জবাব দিল, কে জামাই?

 অভয় দু পা এগিয়ে বলল, রাত করে জলে নেমেছ মা! এর ওপরে সর্দিজ্বর ধরলে—

শৈলবালা কাপড়খানি বুকে মাথায় ভুর করে ফেলে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল, কী করব বাবা। থাকতে পারলুম না। জ্বলে যাচ্ছে, জ্বলে যাচ্ছে। হে ভগবান, হে দেবতা, আমাকে নাও গো, এবার আমাকে নাও।

নিশুতি রাতের এই অন্ধকার পুকুরের স্থির জলে শৈলর চাপা কান্না যেন প্রেতিনীর গোঙানির মতো অদৃশ্যে ভাসতে লাগল।

অভয় বলল, আমি যাব, তুলে নে আসব তোমাকে?

 শৈলবালা তেমনি স্বরে বলল, না বাবা না, মেয়েটা জেগে বসে আছে, তুমি ঘরে যাও। আমি এখেনেই বসে থাকব। থাকব, এখেনেই থাকব, আমি আর উঠব না।

বলতে বলতে শৈলর যন্ত্রণাকাতর শব্দ যেন কান্নায় ভেঙে পড়ল। আবার বলল, তোমার গান শুনতে শুনতে মনটা কেমন করতে লাগল। আমার বুকটার মধ্যে বসে যেন কে নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছিল। বড় অবশ অবশ লাগছিল শরীলটা। সুরীনদাদা আমাকে চলে আসতে বলছিল–আমি তোমার সঙ্গে আসব বলে বসেছিলুম বাবা।

অভয়ের মনটা ব্যথায় অনুশোচনায় ভরে উঠল। আরও দু পা এগিয়ে এসে বলল, আমাকে ডাকলে না কেন মা?

–ছি! তা কি ডাকতে পারি? তোমাকে নে সব্বাই টানাটানি করছে দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। আর তো মরতে আমার অসাধ নেই। তবে? কেন সে নিচ্ছে না। বাবা অভয় তুমি একবারটি বলল, আমায় নিক, আমায় নিক এবার।

অভয়ের প্রকাণ্ড বুকটা যেন প্রচণ্ড ঝটকায় কেঁপে উঠল। গলার কাছে ঠেলে এল কী একটা। সে শুধু অস্ফুটে ডাকল, মা।

শৈলবালা সহসা পরিষ্কার গলায় বলল, মরব না বাবা, এখন মরব না। সব কিছুর তো শোধ আছে। তুমি যাও, ঘরে যাও। জানিনে, মেয়েটা এখনও খেয়েছে কি না। আমার জন্য কিছু ভেবো না।

অভয় আরও কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে, ফিরে এল ঘরে। দরজা খোলাই, ভেজানো রয়েছে। তা হলে ঘরের মানুষও হয়তো জেগেই আছে। জেগে আছে কিনা দেখা গেল না। ঘর অন্ধকার।

এটাই কি জীবনের নিয়ম? কিছুক্ষণ আগেও যেখানে অভয়ের মন জুড়ে প্রবল আলোড়ন, উচ্ছ্বাস ছিল ; যা দেখছিল সবই ভাল লাগছিল ; যা করছিল, সবই যেন মনের মতো মনে হচ্ছিল। সেটা যেন ফানুসের মতো চুপসে যেতে লাগল।

সে কথা বলবার আগেই নিমির গলার স্বর শোনা গেল, তক্তপোশের নীচে হ্যারিকেন কমিয়ে রেখেছি। বার করে উসূকে নাও।

অভয় জিজ্ঞেস করল, ভাত খেয়েছ?

কোনও জবাব নেই। আজকাল আগের মতো দাপিয়ে হুলস্থুল করে না নিমি। আগের মতো গলা শানিয়ে তোলে না। অনেক শান্ত হয়েছে। তবে আসল মূর্তিকে সম্পূর্ণ আড়াল করে রাখতে পারে না।

কিন্তু আজ নিমির বুকে আগুন অনেকক্ষণ ধরে ধোঁয়াচ্ছে। অনেক সংশয় সন্দেহের বাতাস অনেক সময় ধরে ওসকাচ্ছে।

নিমির জবাব না পেয়ে অভয় সেই আগুনের কিছুটা আঁচ পেল। বাতিটা নিয়ে উসকে দিল সে। কিন্তু নিমি উঠল না, তেমনি পড়ে রইল আলুথালু বেশে। কেবল বলল, ভাত ঢাকা দেয়া আছে, খেয়ে নাও। আমার আর উঠতে ইচ্ছে করছে না।

তা না হয় না-ই উঠতে ইচ্ছে করল। ভাত বেড়ে খাওয়াটাও কিছু নতুন নয়। কিন্তু আজ কি আর কিছু বলবে না নিমি? গানের আসরে তো সে গিয়েছিল, অভয় দেখেছে। সারা শহরের লোক বলেছে, ঘরে নিমি কিছুই বলবে না?

অন্যদিন হলে অভয় স্বাভাবিক নীরবতার সঙ্গেই হয়তো জামা খুলে খেতে বসে যেত।

কিন্তু মনের এমনি নিয়ম, কোনও কোনওদিন সে কষে বাঁধা তারের মতো টান টান হয়ে থাকে। আজ অভয়ের মনের তার তেমনি বাঁধা! আজ অল্প ঘায়ে সে হেসে উঠতে পারে, মাতাল হয়ে যেতে পারে। আবার রুদ্র হয়ে, আগুন জ্বালাতে পারে।

অভয় জামা না খুলেই উসকে দেওয়া হ্যারিকেনের দপে শিসটার দিকে অর্থহীন জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

অস্পষ্ট অন্ধকারে, বালিশে মুখ চেপে লুকিয়ে নিমি দেখছিল। শান্ত কিন্তু কেমন একটা জ্বালা ধরানো সুরে বলল, কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

অভয় হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল নিমির দিকে। বলল, কথা-ই যদি বলবে তো বিছানা ছেড়ে উঠো।

–নাঃ।

আলস্যভরে জবাব দিল নিমি। কোথায় ছিলে বললে না?

–যেখানে মন চাইছিল, সেখানেই ছিলুম।

নিমি খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, একটা মাগি তো দেখলুম, বাজারের ফড়ের হাত দে পাঁচটা টাকা পাঠিয়ে দিলে। সে-ই কি মন কিনলে নাকি?

অভয়ের হাত পা শক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু নিমি আশ্চর্য দ্রুত গতিতে উঠে একেবারে অভয়ের গায়ের ওপর এসে পড়ল। গলা জড়িয়ে ধরে, বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল, দেখি কত টাকা পেয়েছ?

উঠল মোটে একটি পাঁচ টাকার নোট। নিমির ভ্রূ কুঁচকে উঠল, ওমা, আর টাকা কোথায়?

অভয় বলল, অনাথ খুড়োকে দে দিইচি ইউনিয়নের চাঁদা বলে।

 নিমির চোখে এবার বুকের আগুন গিয়ে উঠল। বলল, শুধু সুবালার পাঁচ টাকার নোটখানি পান ধরে দিতে পারোনি?

অভয় সহসা সরে দাঁড়াল। একবার তাকাল নিমির দিকে। যেমন সাপ ছোবল মারার আগে ঘাড় কাত করে তাকায়। তারপরেই সে বাইরে বেরিয়ে গেল। টান মেরে ঝাঁপ খুলে ফেলল। এক মুহূর্তের জন্য যেন থমকে গেল সে। আবার এগিয়ে গেল অন্ধকার গলির মধ্যে। একেবারে সুবালার দরজায় এসে দাঁড়াল সে।

সারা বাড়িটা নিঝুম। অন্ধকার উঠোন, ঘরে ঘরে দরজা বন্ধ। কোথাও কোনও শব্দ নেই। কেবল দোতলায় ওঠবার সিঁড়ির পাশে শুয়ে রয়েছে একটি কুকুর। এ কুকুর ঘরের নয়। অচেনা মানুষ দেখলে ডেকে জানাবার দাসত্ব নেই তার। অপরিচিত মানুষ দেখতেই সে অভ্যস্ত।

অভয় দোতলায় উঠে এল। না, একেবারে নিঃসাড় নয়। কোন ঘরে যেন এখনও গোঙা জড়ানো-স্বরে কথা শোনা যাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে মেয়ে-গলায় চাপা স্বরের ধমক।

মদ খায়নি অভয় তবু মাতাল মনে হচ্ছে তার নিজেকে। যেন হাত পা তার নিজের আয়ত্তে নেই। চোখের দৃষ্টি নেই স্থির। সে পশ্চিমদিকের বারান্দায় এগিয়ে গেল। কিন্তু দরজা চিনতে পারছে না। কোন ঘরটা সুবালার। আবিষ্ট হলেও, ছবি একটি মনে আছে ঘরের সামনেটার।

আরও এগিয়ে গেল সে। চিনতে পারল ঘরটা। দরজা বন্ধ, কোনও সাড়া শব্দ নেই। হাত তুলে দরজা ধাক্কা দিতে গিয়ে থামল অভয়। কী চায়, কেন এসেছে সে এখানে?

তার বুকের ভিতর থেকে যেন কেউ হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে, চেপে চেপে বলে উঠল, বড় একলা লাগছে আমার। বিশ্রী, ভয়ংকর একা একা। আর কিছুতেই থাকতে পারিনে। এত তোক আমার চারপাশে। এত লোক থিক থিক করছে। কিন্তু সারা পৃথিবীর তোক এলেও, আমার এই একলা থাকা বুঝি ঘুচবে না। এখন শুধু একজনকে হলেই হয়। এমন একজনকে, যার কোনও দাবি নেই। যার কোনও ভয় নেই। মাটি আমাকে ফেলে দেয় না, বুক পেতে চলতে দেয়। জল ফিরিয়ে দেয় না। ঝাঁপ দিলে সে শুকিয়ে যায় না। মুখ তুলে তাকালে, আকাশ ডানা মেলে উড়ে যায় না কোথাও। তেমনি করে আমায় কেউ নিক তার বুক ভরে। তার সারা অঙ্গ জুড়ে, স্বাভাবিক আকর্ষণে। তার চুক্তিহীন স্নেহের দরিয়ায়। যুক্তি দিয়ে তৈরি মাপজোকা ভালবাসার কাটা-খালের ঢেউহীন ছোট যার বুক নয়। সে আমাকে একটু নিক।

এমন বুঝি হয় না সংসারে? না হলে এমন চিন্তা মনে এল কেন অভয়ের। মনে হল কেন সুবালার কথা। এমন একটু স্নেহ, এমন একটু ভালবাসার জন্য। কে তবে তাকে ছুটিয়ে নিয়ে এল এখানে।

সংসারে সবটাই কি কল্পনা? শুধু মন দিয়ে গড়া! যে বস্তু পৃথিবীতে নেই সে বস্তুর জন্য তবে বুক উথালিপাথালি করবে কেন? আছে। আছে বলেই করে। মন তৈরি করেছে এই পৃথিবী। প্রত্যক্ষের সীমায় আছে বলেই তো মনে কল্পনা আসে।

অভয় দরজায় ধাক্কা দিল আস্তে আস্তে। কোনও সাড়া নেই। আবার শব্দ করল। আগের চেয়ে জোরে শব্দ করে ধাক্কা দিল।

ভিতর থেকে ঘুম ভাঙার শব্দ পাওয়া গেল একটা। ঘুম ভেঙে যাবার বিরক্তিকর শব্দ। তার। চেয়েও বেশি বিরক্ত গলায় প্রশ্ন এল, কে?

সুবালারই ঘুম ভাঙা বিরক্ত গলা। অভয় বলল, আমি।

–এই রাত ভোরে আমি কে?

 সুবালার গলায় বিরক্তির ওপর রাগের মাত্রা চড়ছে। অভয়ের মনটা যেন দমে এল। সে আবার বলল, আমি, আমি।

এবার তীক্ষ্ণ গলায় ঝংকার দিয়ে উঠল সুবালা, আ মলো, খালি আমি আমি করে মরছে? নাম নেই নাকি? মাসিকে ডাকব?

অভয় বোধহয় ফিরতেই যাচ্ছিল। তবু বলল, আমি অভয়।

তারপর নিঃশব্দ এক মুহূর্ত। সুইচ টেপার শব্দ হল, দরজা জানালার ফাঁকে বিন্দু বিন্দু আলোর রেশ ফুটল। দরজা খুলে দাঁড়াল সুবালা। বলল, তুমি? কী মনে করে?

ঘরের উদ্ভাসিত আলোর সঙ্গে সুবালাও যেন একটি দ্যুতির মতো জ্বলে উঠল অভয়ের চোখের সামনে। শুধু সায়া আর বুকের সংক্ষিপ্ত অন্তবাস তার সারা গায়ে। সদ্য ঘুম ভাঙার চকিত আড়ষ্টতা তার ভঙ্গিতে। বোধহয় পোশাকের সংক্ষিপ্ততাতেই তার দেহ অকূল, উপছানো, খর মনে হচ্ছে। খোঁপা খুলে জোড়া বেণী গেছে লুটিয়ে। সোজা সিঁথিতে এসে পড়েছে এলো চুলের গুচ্ছ। কপালের টিপ গেছে বেঁকে। কাজল গেছে চোখের কোলে লেপটে। একটা দুঃস্বপ্নের স্মৃতি থেকে যেন তার দৃষ্টি এই মাত্র ফিরে এসেছে। আলোর ঝলকটা সইতে না পেরে হাত তুলে চোখে ছায়া ফেলেছে।

আবার বলল, তুমি এ সময়ে?

সুবালা ভয় পেল কি না কে জানে। সে দরজার কাছ থেকে দু পা সরে গেল।

অভয় বলল, তোমার কাছে এলুম।

বলতে বলতে অভয় ঘরের মধ্যে, সুবালার গায়ের কাছে ঘেঁষে এল।

সুবালা যেন চিনতে পারছে না অভয়কে। দেহোপজীবিনী মেয়ে, পুরুষের সান্নিধ্যে তার ভয় নেই। কিন্তু অভয়ের দিকে তীব্র দৃষ্টি রেখে, খাটের ধারে পিছিয়ে গেল সুবালা। নাকের পাটা –ফুলিয়ে সে গন্ধ নেবার চেষ্টা করল। অভয় মদ খেয়েছে কিনা বুঝতে চায়। কোঁচকানো ভ্রূ তার সোজা হল না। চোখ থেকে নামাল না হাত। বলল, আমার কাছে? কেন?

অভয় যেন চোখ ফেরাতে পারছে না সুবালার দিক থেকে। তার গাল কপাল গলা সব ঘামছে দরদর করে। সে সুবালার কাছে ঘেঁষে গেল আরও। কথা ঠিক জোগাচ্ছে না অভয়ের মুখে। সে প্রায় স্থলিত স্বরে বলল, এলুম! চলে এলুম তোমার কাছে। আসতে নেই?

বলতে বলতে সে সুবালার গায়ের ওপর এসে পড়ল। প্রকাণ্ড একটি লোহার চাংড়া যেন বেঁকে দুমড়ে এলিয়ে পড়তে উদ্যত হল সুবালার বুকের ওপরে। আবার বলল প্রায় চুপিচুপি গলায়, আমি তোমার কাছে চলে এলুম।

সুবালার স্মৃতিভ্রংশ হল কি না, কে জানে। তার মনে হল, এ লোকটিকে সে চেনে না। ঠিক এই মানুষটির সঙ্গে তার কোনও পরিচয় নেই যেন। সে দু হাত দিয়ে অভয়ের দু হাত সরিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল, এ রাত দুপুরে এ আবার কেমন ঢং। যাও এখন, আমার এ সব ভাল লাগছে না।

অভয় এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল। আড়ষ্ট হয়ে রইল টলে পড়ার ভঙ্গিতে! বিড় বিড় করে বলল, রাগ করলে? রাগ করলে তুমি?

পর মুহূর্তেই তার দু চোখ যেন ঘৃণায় ও রাগে দপদপিয়ে উঠল। প্রায় টলতে টলতে বেরিয়ে গেল সে।

সুবালা তখনও কেমন একটা দুঃস্বপ্নের ঘোরে। সে তখনও বিচলিত বিস্মিত চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে সিঁড়িতে অভয়ের ভারী পায়ের শব্দ শুনতে লাগল। তার পরেই শুনল কুকুরের ডাক। অভয়কে মাতাল ভেবে কুকুরটা এবার ডেকে উঠেছে, কারণ ওই রকম অবস্থাতেই লোকগুলি অনেকবার এ বাড়িতে তার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।

আর কোনও শব্দ নেই। শুধু ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্ছে বাইরে। সুবালার ভু দুটি সোজা হয়ে এল। আর চকিতে যেন তার সারা মুখ থেকে একটি ছায়া সরে গেল। দু চোখ ভরে ব্যাকুলতা নিয়ে ফিরে তাকাল সে। আপন মনেই বলল, সে নয়? সে-ই তো! হ্যাঁ

দ্রুত বেগে সে সিঁড়ি ভেঙে উঠোন পার হয়ে দরজার ধারে ছুটে গেল। দূরে আলো, আর সামনে। অন্ধকার। সুবালা ডাকল, কোথায় গেলে? কোথায় গো? শুনছ?

বলতে বলতে রাস্তায় এসে পড়ল সে। বড় রাস্তার দিকে যাবে না গলির ভিতর দিকে যাবে, কিছু স্থির করতে পারল না। একটি বিচিত্রবেশিনী পাগলির মতো মনে হল সুবালাকে।

আবার ডাকল। নাম ধরে ডাকতে গিয়ে, থমকে, আবার ডাকল, কই গো গাইয়ে, কোথায় গেলে।

কেউ জবাব দিল না। মালিপাড়ার গলিতে শেষ রাতের হালকা বাতাসে ফুলের গন্ধ বাসি হয়ে ভাসছে। সুবালা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল দরজায়। ছোট মেয়েটি যেন খেলতে খেলতে সাধের জিনিস হারিয়ে, সহসা হতাশায় ও ব্যথায় থতিয়ে গেছে।

.

অভয় ভিতর গলির দিকেই গেছে। কিন্তু বাড়ির দিকে নয়। মালিপাড়া গলির যে ফালিটা গেছে গৃহস্থপাড়ার দিকে, সেটা ডাইনে। বাঁয়ের রাস্তাটা গেছে গঙ্গার ধারে। খানিকটা বেঁকে। যেখানে ধাঙড় বস্তি শুরু হয়েছে। ডাইনে না গিয়ে, বাঁয়ের দিকেই ছুটে গেল অভয়। যেন সে পালিয়ে যাচ্ছে। তার দু চোখের সামনে ভাসছে শুধু সুবালার গিলটি করা-চুড়ি-পরা হাতের ঝটকা দেওয়ার অপমানকর ভঙ্গিটা। ঝটকাটা যেন তার মুখেই মারছে সুবালা। জোরে জোরে মারছে, কষ বেয়ে বুঝি রক্তও পড়ছে। আর নিমি হাসছে খিল খিল করে। হাততালি দিতে দিতে হাসছে।

একটা গুরুগম্ভীর গোঙানির শব্দে থামল অভয়। সে দেখল, কাছেই শুয়োরের খোঁয়াড়। গায়ে মুখে হাওয়া লাগল। সামনে অবারিত গঙ্গা। আজই কি এ গঙ্গার ধারে, অনাথের সঙ্গে অন্যখানে গিয়েছিল অভয়? সেটা যেন আজ নয়–অনেক, অনেকদিন আগের ঘটনা সেটা। তারপরে যেন একটি যুগ কেটে গেছে।

আবার শুয়োরের গোঙানি শোনা গেল। খোঁয়াড়ের ভিতরে বাইরে শুয়োরের পাল। অচেনা মানুষকে অসময়ে আসতে দেখে, সন্দেহ জানাচ্ছে কেউ কেউ। ওদিকটায় বাতি নেই। শুয়োরের আস্তানার ওপাশ থেকেই এবড়োখেবড়ো বস্তি ঘরগুলো দেখা যাচ্ছে। অভয় চেনে রাস্তা। গঙ্গার ধারের সরু পথটা দিয়ে সে হাঁটতে লাগল। সে থামতে চায় না, বসতে চায় না। পারবেও না। তার ছুটতে ইচ্ছে করছে। দাঁতে দাঁত চেপে, প্রাণপণে দৌড়তে ইচ্ছে করছে। দৌড়তে দৌড়তে তাদের সেই গ্রামে, সেই বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছে।

হঠাৎ পায়ে যেন কী ঠেকল। আর আর্তনাদের মতো শোনা গেল, আঃ আঃ…

 অভয় থমকে ফিরে তাকাল, কে?

লক্ষ পড়ল, মানুষ। আরও কাছে ফিরে এল অভয়। লোকটা কেমন যেন গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে। আর ফোঁস ফোঁস করে শব্দ করছে। কাঁদছে নাকি? বোধহয় কোনওরকম শোক পেয়েছে।

অভয় চলে যাবার আগে আর একবার জিজ্ঞেস করল, কে হে? এখানে এ ভাবে পড়ে কেন?

পড়ে-থাকা মানুষটির হাত যেন উঠে এল অভয়ের দিকে। আবার পড়ে গেল। ফিসফিস স্বরে ডাকল, জরা ই-ধার…

অভয়ের নাকে মদের গন্ধ গেল। মাতাল! ঘরের বাইরে এসে পড়ে আছে। অভয়ের মতো অবস্থা লোকটার। কোথাও কেউ নেই? বউ ভালবাসে না? ঘর থেকে তাই চলে এসেছে? লোকটা হাত তুলল। ডাকল, হে হে!

অল্পবয়সী ছেলের গলা বলে মনে হল এবার। অভয় নিচু হয়ে তার হাতটা ধরল। ধরতেই লোকটা তাকে আকর্ষণ করল। অভয় হাঁটু পেতে বসল। লোকটির আর একটি হাত এসে তার কোমর জড়িয়ে ধরল। আর ঠিক এই মুহূর্তে অভয় অনুভব করল, পুরুষ নয়। মানুষটি মেয়েমানুষ। এই শেষ রাত্রির অন্ধকার গঙ্গার ধারে তার হাতের কাঁচের চুড়ি বেজে উঠল একটি দুর্বোধ্য হাসির মতো। সে অভয়ের হাঁটুতে বুক চেপে, সাপের মতো সাপটে ধরল।

অভয় এক মুহূর্তে একেবারে নিশ্চল হয়ে গেল। তার নিজের দুর্গতির কথা ভুলে, সজাগ হয়ে উঠল সে। পরমুহূর্তেই মেয়েমানুষটির হাত ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে বলল সে, কে তুমি! ছাড়ো, ছেড়ে দাও আমাকে।

মেয়েলোকটি তাকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরল। এবার সে তার মদের গন্ধে ভরতি মুখটা তুলে। নিয়ে এল অভয়ের বুকের কাছে। পরিষ্কার বুঝতে পারল অভয়, মেয়েটির গায়ে জামা নেই। অনুমান হল, বয়সও খুব বেশি নয়। বোঝা গেল সে বাংলা বুলি বোঝে, বলতে পারে না। প্রায় চাপা আর্তনাদ করে বলল, নহি, ছোড়ব নহি তুহঁকো। পাকড়ো, হেই বাবু মেরি, ঘরে থোড়ি লেহি চল।

কোমর ছাড়িয়ে, কাঁধের ওপর উঠে এল মেয়েটির হাত। যেন একটা নাগিনী বেয়ে বেয়ে উঠছে। শক্তি আর কতটুকু তার। ইচ্ছে করলে অভয় তাকে ঠেলে ফেলে দিতে পারে। কিন্তু ফেলতে পারল না সে। মেয়েটা যেন বড় অসহায় হয়ে, এই অবলম্বনকে জড়িয়ে ধরেছে। পরম নির্ভয়ে ও ভরসায় যেন লুটিয়ে পড়ছে। গুটিয়ে আসছে বুকের মাঝখানে।

অভয় জিজ্ঞেস করল, কোথায় তোমার ঘর?

মেয়েটি মুখ তুলে দেখাল বস্তির দিকে। বলল, উহে।

তারপর থিতিয়ে আসা অন্ধকারে অভয় দেখল, মেয়েটি তার মুখ দেখার চেষ্টা করছে। যদিও চোখ তার পুরোপুরি মেলছে না। এখনও ঢুলু ঢুলু করছে। তার গরম নিশ্বাস লাগছে অভয়ের বুকে গলায়। কিন্তু মেয়েটার মুখে জায়গায় জায়গায় কালো দাগ। ডান দিকের জ্বর কোণটা যেন ফোলা ফোলা লাগছে।

মেয়েটি চাপা চাপা গলায় বলল, তু কমলার বাবু?

কলার বাবুটি কী এবং কে, বুঝতে পারল না অভয়। সে বলল, না!

অভয়ের বোঝবার কথা নয়। কমলার অর্থে কম্পাউন্ডারবাবু। মিউনিসিপালিটির যে বাবুটি তার চার পাশে অনেক পেখম বিস্তার করেছে, এমনি করে একদিন বুকে নেবার জন্যে, বাংলা বুলি শুনে, এখন এই ঘোরের মধ্যে মনে হচ্ছে, সেই বাবু বুঝি।

আপন দুর্গতির কথাটা চাপা পড়েছে অভয়ের। তার কোনও দুর্মতি উছলে ওঠেনি মেয়েটিকে বুকে করে। কিন্তু তার বিশাল দেহের রক্তস্রোতে একটি দূরাগত ধ্বনি যেন ক্রমেই নিকটবর্তী হচ্ছে। কিংবা তার পাকে-পড়া রুদ্ধ যন্ত্রণাটা একটা মুক্তির দরজা পেয়ে শোর তুলেছে।

মেয়েটি আবার বলল, নহি তো উঁ কে বা? ছোটা শোনাটরি সাহব বা কি?

 ছোটা সোনাটরি সাহব যে ছোট স্যানিটারি সাহেবের রূপান্তর মাত্র, অভয় এবারও তা বুঝল না। শুধু এইটুকু বুঝল, তার বুকের ওপর এই মেয়েমানুষটি হয় তো ঝাড়দারনী।

অভয় বলল, না না, আমি তোমার চেনা লোক নই বাপু?

–নহি? তবু উঁহকো রামজী ভেজে দেহলাইন হো বাবু?

 বলে মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অভয়ের কাঁধে মুখ দিয়ে। তার উত্তপ্ত ঠোঁট অভয়ের গলায় চেপে বসল।

অভয় যেন অসহায় বোধ করতে লাগল। অন্ধকার গঙ্গার বুকে ফিরে তাকাল সে। আকাশের দিকে দেখল। নক্ষত্রেরা তাকিয়ে আছে। যেন কী এক রহস্যের খেলা দেখছে তারা। আর গঙ্গা ছল ছল শব্দে চির রহস্যের দুবোধ বাণী গেয়ে চলেছে। শেষ রাত্রি দুলছে বাতাসে।

এই বিষম বিপাকে নিজেকে কঠোর করতে চাইল অভয়। কিন্তু মেয়েটির কান্নায় তার নিজের জমে থাকা পাথরের কান্নাটাও যেন গলতে লাগল। তার ইচ্ছে হল, সব কিছু দিয়ে সে এই অবহেলিতা ফেলে-দেওয়া জীবটিকে স্নেহ করে।

মেয়েটি বলেই চলল, আমি কো নাম ছে মাহুনি। মরদ সহদেও মাসিপালি কি ধাঙড়। হেই বাবু, মরদ হামিকো জবর পিটাহলে, ফেকো দেহলে দরিয়া কিনারে। হেই বাবু মেরি হামি কো তখা সব লেই লেইছে ও, পিয়ে ন দেহলে হামিকো, খায়ে না দেহলে, কপড়া ন দেহলে হামি কো খালি পিটালে, মাতোয়ালে মরদ, মহবত না দেহলে

অভয়ের মনে হল সে যেন, মাহুনির মরদ সহদেবের সঙ্গে কথা বলছে। কেন, সহদেব এমন করে ফেলে দিয়েছে মাহুনিকে। কেন মেরেছে?

সে বলল, চলো, কোথায় তোমার ঘর, দিয়ে আসি। চিনতে পারবে?

–হ বাবু।

অভয় মাহুনিকে ধরে তুলে দাঁড় করাল। না ধরলেও চলত। মাহুনি তাকে সাপটে আছে। সাপটে ধরে মাথাটা এলিয়ে দিয়েছে বুকের ওপর। আর, মাহুনি মোটেই হালকা নয়, ভারী আছে।

রক্ত স্রোতের ধ্বনিটা অভয়ের সারা অঙ্গে ঝাঁপ দিয়েছে বটে। কিন্তু তার মধ্যে কোনও অন্তরঙ্গ নেই। বরং একটি ব্যথিত প্রসন্নতা, স্নেহ এবং ভালবাসার একটি আবেগ অনুভব করছে সে। একে তার পাপ বলে বোধ হল না। যেন দুজনের কান্না এক হয়ে, সন্ধি-যুক্ত হয়ে এক অপরূপ বন্ধুত্বের মর্যাদা পেয়েছে। সে বলল, চলো মাহুনি, তোমাকে দিয়ে আসি।

মাহুনি তার বাড়ির টোকো গন্ধ ভরা মুখ তুলে বলল, চললো মেরি রামজি। থোড়ি কহদে ভগবান, আমি কোন পিটে।

অর্থাৎ সহদেবকে যেন অভয় বলে দেয় সে মাহুনিকে আর না মারে। অভয়ের বুকটা টাটিয়ে উঠল। বলল, বলব। ঘরটা আমাকে দেখাও।

মাহুনি ঢুলু ঢুলু চোখে তাকাল সামনের দিকে।

অনেকগুলি ঘর, এলোমলো। সারবন্দি লাইন নয়। সেটা আছে আর একটু উত্তরে, মিউনিসিপালিটির নিজস্ব তৈরি লাইন। অবশ্য বস্তির পুরো এলাকাটাই পৌরসভার জমি।

মাহুনি টলটলায়মান ঘাড় তুলে বিড়বিড় করতে লাগল, বটুয়া, ঝগড়, বিদেশি, পাহলোয়ান, লালু, এ, এহি…

ঘরগুলি পার হচ্ছিল সে এক একজনের নাম করে। একটি ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল সে। বলল, এ হি…

সেই ঘরে টিম টিম করে একটি আলো জ্বলছে। মাহুনির গলার শব্দেই, সেই টিমটিমে আলোয় একটি ছায়া উঠে এল। বলল, হেই, মাহুনি?

মাহুনি বলল, হঁ। খবরদার ফের পিটাহলে

-নহি নহি, হেই ভগবান।

 মাহুনি আবার বলল, এ বাবু হামিকো লে আইলান। বাবু রামজি ছে।

 বলতে বলতে মাহুনি অভয়ের পায়ের কাছে বসে পড়ল। দেখাদেখি সহদেবও অভয়ের পায়ের ওপর পড়ল হুমড়ি খেয়ে। সেও পুনরাবৃত্তি করল, হঁ রামজি ছে।

অভয় দুজনকেই টেনে তোলার চেষ্টা করল।

 মাহুনি বলল, তু হামকো খুন কইলে। ভগবান হামি কো বাঁহচাইলান।

 সহদেব অভয়ের দু পা আঁকড়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল, হে ভগবান, হে বাবা!

অভয় বুঝল সহদেব এখনও মাতাল আছে। তবে সে তার মাহুনির জন্য মাতাল অবস্থাতেও ঘুমোতে পারেনি। মাহুনিকে পেয়ে তার আবেগ কান্নায় ভরে উঠেছে। অভয় একটু হেসে বলল, মাহুনিকে ঘরে তুলে নাও সহদেব। ওকে আর মেরো না।

সহদেব ছুটে ঘরে গেল। বেরিয়ে এল একটা জংধরা জীর্ণ লোহার অস্ত্র নিয়ে। অভয়ের হাতে দিয়ে বলল, পিটো হামকো পিটো রামজি। হাম পাপ কইলা, হাম পাপী হে ভগবান।

অভয় দুজনকেই হাত ধরে ঘরে ঢুকিয়ে দিল। সে বিব্রত কিন্তু খুশি। তার বুকে একটা ব্যথা, তবু হাসি পাচ্ছে তার। তার ইচ্ছে করছে, সেও ওদের সঙ্গে অমনি মাতলামি করে। সে বলল, শুয়ে পড়ো তোমরা।

কিন্তু দুজনেই তাকে জাপটে ধরল। মাহুনি বলল, নহি বাবুজি, থোড়ি বইঠে যাহ।

তার চেয়েও বেশি আঁকড়ে ধরল সহদেব। বলল, হে ভগবান, খানা খা লো। পাপী কো উদ্ধার করো। মাহুনি, খানা দে রামজি কো ভোজন করব।

মাহুনি ছুটে গেল হাঁড়ি ডেয়ো ঢাকনা খুলতে। অভয় দেখল, দুটিকে শান্ত করাই মুশকিল। সে মাহুনিকে বলল, মাহুনি, আমি খাব না। তুমি সহদেবকে শান্ত করো।

সহদেব সেই ধরে আছে অভয়কে। মাহুনি তার কাছে এল। অভয় দেখল, সে যা ভেবেছিল, তাই। মাহুনির বয়স বেশি নয়। টিমটিমে আলোয় বোঝা যাচ্ছে, মাহুনি তাদের জাতের রং পার হয়ে কটা স্পর্শ পেয়েছে। মনে হল, কাজে অকাজে পথে সে তাকে অনেকবার দেখেছে।

পরমুহূর্তেই সহদেব যে কথা বলল, অভয়ের সর্বাঙ্গ পাথর হয়ে গেল যেন।

-হে ভগবান তুহোকে গোড় লাগি ভোজন কর লো। মাহুনি কো সাথ শুত যাহ। হেই, হেই মাহুনি—

–হাঁ।

ইধারে আ।

অভয় কিছু বলবার আগেই, মাহুনিকে সহদেব অভয়ের গায়ের ওপর ফেলে দিল। বলল, ভগবান কো সার্থ্য সেবা কর। ভোগ লেহ্ বাবা, ভোগ লেহ্।

মুহূর্তে রক্তে একটা তোলপাড় লেগে গেল অভয়ের। অবিশ্বাস্য মনে হল তার। শরীর শক্ত হয়ে উঠল। মাহুনি হেসে উঠল খিলখিল করে এবার। অভয় দেখল, মাহুনির মুখে রক্তের দাগ। কাঁধে, হাতে মারের কালশিরা। তবু যেন বিচিত্ররূপিণী উদ্ধত দেহিনী এক মেয়ে তাকে আমন্ত্রণ করছে হেসে হেসে। মাহুনির হাত অভয়ের গায়ে কিলবিল করছে। তার হাত অভয়ের ঠোঁটে মুখে হাতড়াচ্ছে।

অভয় একবার মাহুনির কাঁধে হাত দিল। তারপর তার চোখ ফেটে সহসা জল আসতে লাগল যেন। সে মাহুনিকে জড়িয়ে ধরে, সহদেবের বুকের ওপর দিয়ে বলল, ওকে নাও সহদেব, ওকে নাও, ও তোমার।

বলে সে মাহুনির হাত থেকে ছাড়িয়ে বাইরে চলে গেল। মাহুনি হাত তুলে ডাকল, মত যাইহো রামজি মত—

সহদেব চিৎকার করে ডাকল, হে ভগবান

অভয়কে তারা আর দেখতে পেল না।

মাহুনি বলল, চল গেইলান।

সহদেব বলল, চল গেইলান ভগবান। পূজা নহি লেইলান, ভোগ নহি লেইলান্ , চল গেইলান।

মাহুনি ফুপিয়ে উঠল আবার। বলল, মেরি কসুর।

সহদেব বলল, নহি, মেরা কসুর!

.

০৯.

অভয় গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়াল। ভোর হয়ে আসছে। ছলছলানি বাড়ছে জলের। ভাটার অন্তিমকাল চলেছে। তাই একটা স্তব্ধ আড়ষ্টতা গঙ্গার বুকে। জোয়ার আসবে এখুনি।

অভয়ের মনে হল, তার সব গ্লানির উত্তেজনা যেন স্তিমিত আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। তার যন্ত্রণা যেন কেমন এক দুবোধ প্রসন্ন ব্যথার স্রোতে ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে। রাত্রের যত কষ্ট অপমান অবহেলা সব যেন এক অশেষ মহাসমুদ্রের দিকে ধাবিত। তার এক বিচিত্র বিস্মিত মুগ্ধ দশা।

সূর্য ওঠেনি। লাল হয়ে উঠেছে পুবদিকের আকাশ। ওপারের কারখানা, বাড়ি, শহর একটি একটি করে ফুটছে আকাশের গায়ে। সে তাড়াতাড়ি ফিরে চলল।

উঠোনে ঢুকেই সে দেখল, শৈলবালা বসে আছে নিমিকে ধরে। নিমি ওয়াক তুলছে। বমিও করেছে কিছু। চোখ লাল।

কিন্তু শৈলবালার মুখে এখন অদ্ভুত খুশি খুশি ভাব কেন। তাকে যে সে অসুস্থ কাতর দেখে গিয়েছিল। শৈলবালা জিজ্ঞেস করল, কোথায় ছিলে বাবা?

-ঘাটে।

–কোন ঘাটে?

ধাঙড় বস্তির ঘাটে। ওর কী হয়েছে মা?

 অভয় কাছে এল। হাসতে হাসতে শৈলবালার চোখে জল দেখা গেল। বলল, ভয়ের কিছু নয় বাবা, এরকম হয়। মুখপুড়ি কি আমাকে কিছু বলে নাকি?

তবু অভয় অবুঝের মতো তাকিয়ে রইল।

শৈলবালা বলল, তোমার ছেলে হবে বাবা। আমার মেয়ের পেটে সন্তান এসেছে।

অভয়ের বুকে সহসা প্রচণ্ড ঢেউ আছড়ে পড়ল। একটা চকিত, একেবারে নতুন অনুভবের ঢেউ ভেঙে পড়ে, তার বুকের শুকনো বালুচর প্লাবিত করে দিল যেন। সে তাকাল নিমির দিকে।

নিমি কাপড় টানতে লাগল ঘোমটা টানবার জন্যে।

নিমির ঘোমটা টানার চেষ্টা দেখে শৈলবালা সস্নেহে ধমকে উঠল, হয়েছে, আর ঘোমটা টানতে হবে না এখন। আর বমি হবে?

নিমি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, না।

 মুখ ধুয়ে নিমি প্রায় টলতে টলতে ঘরে ঢুকল। কাত হয়ে এলিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়।

 অভয় না জিজ্ঞেস করে পারল না, কতদিন হয়েছে মা?

শৈলবালা বলল–হিসেব যা দিলে, তাতে তো তিন মাস উতরে যাবার সময় হল। মরণ! সে সব কি বোঝে নাকি ছুঁড়ি।

অভয়ের চোখের সামনে অদ্ভুত একটি মূর্তি ভাসতে লাগল।

 বিচিত্র কল্পনায় ও বিস্ময়ে সে অভিভূত হয়ে পড়ল। যেন জীবনে সে এই প্রথম বিশ্বাস করল, অবাক হয়ে প্রত্যক্ষ করল, মানুষ সত্যি মানুষ সৃষ্টি করে। কোথায় আছে সে এখন? কেমন করে আছে?

শাশুড়ির ব্যাধি যন্ত্রণার কথা জিজ্ঞেস করতেও ভুলে গেল সে। ঘরে ঢুকে গেল। শৈলবালা তার শারীরিক কষ্টের মধ্যে আর একবার আপন মনে না হেসে পারল না। এই লোকই আবার সারা রাত রাগ করে বাইরে কাটিয়ে এল?

সে কথা মনে নেই অভয়ের। সেই এসে তখন হাঁটু গেড়ে বসেছে তক্তপোশের পাশে নিমির কাছে। এক হাত রেখেছে নিমির মাথায়। আর এক হাত নিমির কোমরে। সে যেন নিমির চেনা শরীরের নানান অন্দিসন্ধি অন্ধকার আবর্তে চোখ দিয়ে খুঁজতে লাগল। কোথায় থাকে সে? কেমন করে কী ভাবে থাকে? একী আশ্চর্য!

নিমির মুখে যেটা ছড়িয়ে রয়েছে সেটা রুগ্নতা নয়। শারীরিক একটি অপ্রতিরোধ্য কষ্টের মধ্যে কিছু লজ্জা, সোহাগ, অভিমান, একটি নিশ্চিত সাফল্যের গরব।

অভয় তাকে টেনে নিয়ে এল আরও কাছে। নিমি যেন এখনও হাঁপাচ্ছে। ক্লান্তি তাকে একটি অপরূপ রূপের তীব্রতা দিয়েছে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে তার। রাগে নয়, শরীরের মধ্যে মনের একটি দুরন্ত শক্তি যেন হুড়োহুড়ি করছে।

সে বলল প্রায় ফিসফিস করে, কোথায় থাকা হয়েছিল সারা রাত? অভয় দেখল নিমির ঠোঁট ফুলে উঠছে কথা বলতে বলতে। কোলবসা চোখ দুটি ছল-ছলিয়ে উঠছে। আবেগে অভিমানে। তাকে যেন অন্য রকম লাগছে। অভয় তার সারা রাত্রির কাহিনী বলতে উদ্যত হয়ে থামল। না, প্রাণ খুলে মন খুলে সব কথা বলা যাবে না নিমিকে। ভুল বোঝাবুঝি হয়ে যাবে। অভয় নিজেই কি জানে, সে কেন সুবালার কাছে গিয়েছিল। যা জানে, তা কি বোঝানো যায়? সুবালা পর্যন্ত তাকে। তাড়িয়ে দিয়েছে। ভয় পেয়ে, ভুল বুঝে কিংবা সত্যি বুঝে তাড়িয়েছে, অভয় জানে না। কিন্তু তাড়িয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে যে যন্ত্রণায় সে ছটফটিয়ে মরেছে মধ্য রাত্রি থেকে ভোর রাত্রি পর্যন্ত, নিমিকে তার ভাগ দিয়ে লাভ নেই। কারণ, সে ভাগ নিমি নেবে না। নেয়নি বলেই তো জীবন ক্রমে জটিল হয়ে উঠছে। সে একা হয়ে যাচ্ছে। জীবনে তবে এমন কিছু কিছু জিনিস থাকে, যার ভাগ কেউ নেয় না। কাউকে দেওয়া যায় না।

কিন্তু এখনকার এই নিমি, স্ফুরিত ঠোঁটে যার পুরুষের প্রতি সহসা যেন এক নতুন সোহাগ ও অভিমান বড় আবেগময়ী করে তুলেছে, বিবাদ ঈর্ষা সংশয় সন্দেহ পার হয়ে যে নিমি এখন একেবারে আলাদা হয়ে উঠেছে, তার সামনে আপাতত তার সব গ্লানি ভেসে যাচ্ছে। এক নতুন তরঙ্গ যেন সব ধুয়ে মুছে অভয়কে এক বিচিত্র আনন্দে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। নিমি আজ সন্তানসম্ভবা। জীবনে বুঝি এই প্রথম নিমি এমনি চোখে তার দিকে তাকিয়েছে। এমনি করে জিজ্ঞেস করেছে তাকে। জিজ্ঞেস করে এমনি ভাবে জানতে দিয়েছে, সারা রাত নিমি অপেক্ষা করেছিল অভয়ের জন্য।

সুবালার কাছে যাওয়া ও বিতাড়িত হওয়ার কথা না বললে মিথ্যাচার হবে? হোক। কিন্তু নিমি-অভয়ের জীবনে ঠিক এমন একটি সকাল আর কোনওদিন আসে নি। আসবে কি না, তাই বা কে জানে। বরং সেই ধাঙর দম্পতির কথা বলা যায়। কিন্তু তাই বা কেন? কোনও কথা নয়।

অভয় বলল, ধাঙড় বস্তির ঘাটে বসেছিলাম।

 নিমি ফিসফিস করে বলল, রাগ করে তো যাওয়া হয়েছিল, এখন এত খুশি কেন?

অভয় আরও ঝুঁকে পড়ে বলল, আর কবে খুশি হব নিমি। আজ আর আমি মিলে যাব না।

কামাই করবে?

–হ্যাঁ, তোমার কাছে থাকব সারাদিন।

নিমির কোল বসা দু চোখে চিকুর হানা দ্যুতি। জিভ ভেংচে বলল, কেন, নিমি যে তোমার চক্ষুশুল?

অভয় নিমির এলিয়ে পড়া হাতের ডানায় তার থুতনি রেখে বলল, শূল নয় নিমি, তুমি আমার চোখের বালি।

-তাই খালি করকরিয়ে মরো দু চোখে।

–কিন্তুন জল কাটে।

নিমি হাত বাড়িয়ে অভয়ের বুকে রাখল। সহসা তার দু চোখ ছাপিয়ে জল এল। সে চাপা কান্নার স্বরে বলল, সারা রাত আমি ঘুমোইনিকো। কী যে কষ্ট হচ্ছিল। কী করব আমি? আমার মন খারাপ হয়ে যায়, আমি সামলাতে পারিনাকো। তোমাকে কষ্ট দি। আমারও কষ্ট হয়।

বলতে বলতে নিমি মুখ চেপে ধরল তক্তপোশে। অভয় সহসা কোনও কথা বলতে পারল না। সে দু হাত দিয়ে সাপটে ধরে নিমিকে আরও ঘন করে নিয়ে এল। কথা সে বলতে পারল না। কিন্তু বুকের মধ্যে টনটন করতে লাগল। একটি বুকচাপা স্বর তার বুকের মধ্যে যেন চেপে চেপে বলতে লাগল, নিমির ভালবাসা বুঝি এমনি করেই কখনও কখনও টের পাওয়া যায়। তবু, এত কাল কুটিল ছায়ারা কোথা থেকে এসে ভিড় করেছিল আমাদের মাঝখানে? কে আমাদের দুজনকে এমন অসহজ ওঁ দূর করে রাখে? এ বুঝি দিনের আলো, রাতের অন্ধকারের মতো অপ্রতিরোধ্য সব ব্যাপার। লোকে বলে নিয়তি।

কাঁদুক। নিমি কাঁদুক। এ কেমন স্বার্থপরতা, কে জানে। তবু এ কান্নায় যেন বড় স্বস্তি লাগছে। অভয়ের। একটি উষ্ণ আনন্দময় পরিচ্ছন্নতা যেন ধুয়ে ধুয়ে ফুটে উঠছে। যেন অন্ধকার গলে গলে কোন এক পিছল পথের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে।

কান্নার তরঙ্গ আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে এল নিমির। আস্তে আস্তে সে আবার মুখ ফেরাল অভয়ের দিকে। চোখের জলে ভেজা তার সারা মুখ। তার গাল ঠোঁট নাক। আর অবিন্যস্ত চুল ছড়িয়ে লেপটে রয়েছে সেই জলে। এখন জামা নেই নিমির গায়ে। অসঙ্কোচ-বিস্রস্ত শাড়ি মথিত, এলানো। ঘরের নিশ্চিন্ত নিরালায় অভয়ের মস্ত বড় থাবা নিমি তার ছোট হাতে টেনে নিল নিজের বুকে। যে সেতু তার গর্ভে ভিত পত্তন করেছে, বুঝি তাকে ছোঁয়াতে যায় অভয়ের হাত দিয়ে।

তারপর বলল চাপা চাপা স্বরে, সত্যি খুব খুশি হয়েছ?

সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে অভয় নিমির নোনা জলে ভেজা মুখের ওপর মুখ নামিয়ে নিয়ে এল। নিমির ঠোঁটে গালে নাকে চোখের সব লবণাক্ত স্বাদটুকু সে শুষে নিতে লাগল।

নিমির নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। তবু সে স্থির থাকতে পারল না। তার নিজের মধ্যেও অভয়ের মতো মত্ততা জেগে উঠতে লাগল।

একটু পরে অভয় বলল, আমি এমনি করে চিরদিন থাকতে চাই নিমি। নিমি বলল, আর আমি বুঝি চাই না? আচ্ছা বলো তো, কী হবে?

কীসের?

ছেলে না মেয়ে।

যা খুশি তাই হোক। যা পাব, আমার সবই এক।

না। ছেলে হলে ভাল হয়।

–কেন?

–সবাই বলে। আমারও ইচ্ছে করে, ছেলে হোক।

অভয় বলল, তোর মতো একটি মেয়ে হোক, সেই আমার ইচ্ছা।

-না, একটা ছেলে। বাপের মতো একটা ছেলে।

–এমন কালকুট্টে?

নিমির চোখে সেই দুর্জয় মেয়ের রঙ্গ ঈষৎ রক্তাভায় ঝকঝক করছে। স্ফুরিত নাসারন্ধ্রে তার আবর্তিত রক্তের উষ্ণতা ও এক বিচিত্র গন্ধ। সে গন্ধ যেন দূর বাগান থেকে ভেসে-আসা অনেক নাম-না-জানা ফুলের গন্ধের মতো। বলল, হ্যাঁ, এমনি কালো, এমনি হাত পা বুক। মাথায় বাপকেও ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু গান না গাইতে পারলে বাড়ি থেকে বের করে দেব ছেলেকে, হ্যাঁ তা বলে। দিলুম।

গান? নিমি চায় তার ছেলে বাপের মতোই গাইয়ে হবে? অভয়ের মতো? অভয়ের সারা মুখে বিস্মিত খুশি উত্তাল হয়ে উঠল। বলল, গাইয়ে ছেলে চাস তুই নিমি?

নিমি যেন আবার সহসা লজ্জায় মুখ ঢাকল। বলল, কাল রাতে তোমার গান আমার খুব ভাল লেগেছে। লোচন ঘোষের কাছে তুমি না জিতলেও আমার কিছু মনে হত না। কেমন করে সব তৈরি করো তুমি? ওই কথা গুলোন? সত্যি সত্যি ভেবে ভেবে তখুনি তখুনি গেয়ে দাও?

তা নয় তো কী?

–ওমা। এ বড় খারাপ বাবু। বানিয়ে বানিয়ে এত কথা যে বলতে পারে, তাকে কি বিশ্বাস করা যায়? কোন কথা বললে তার কী জবাব দিতে হয়, সব তুমি জানো।

অভয় হেসে উঠল। বলল, বাঃ! বানিয়ে বানিয়ে কি তা বলে মিছে কথা বলি নাকি? কবি গানে তো কখনো মিছের কারবার নেই। সাচ্চা মিছে যাচাইয়ের জন্যই তো কবিগান।

তা হলেও। বাবারে বাবা, অমন করে গেঁথে গেঁথে কথা সাজানো। আমাকেও যদি বলল, আমি তো কিছুটি টেরও পাব না।

অভয়ের দরাজ গলার হাসি এবার ফেটে পড়ল। সেই সঙ্গেই বেজে উঠল মিলের বাঁশি।

দুজনেই একটু থমকে গেল। নিমি উঠে বসল। কাপড় টেনে নিল বুকে। চুল সরিয়ে দিল মুখ থেকে।

অভয় তাড়াতাড়ি বলল, উঠলে কেন?

নিমি হেসে বলল, তবে কি শুয়ে থাকব নাকি? সোমসারে কাজকম্মো নেই? মার শরীল খারাপ। বাসি সব পড়ে আছে।

-তোমার শরীল খারাপ হবে না?

–ও শরীল খারাপ কিছু নয়। তুমি ওঠো দিকিনি। যাও, হাত মুখ ধুয়ে এসো। চা করে দিচ্ছি, খেয়ে কাজে যাও।

এ যেন এক নতুন চরিত্র নিমির। এ নির্দেশ বুঝি অমান্য করা যাবে না। অভয় অবাক হয়ে বলল, কাজে যাব না বললুম যে?

নিমি বলল, মিছিমিছি কাজ কামাইয়ের কী দরকার? আমার কাছে সারাদিন বসে থাকতে হবে। আমার অস্বস্তি হবে।

নির্দেশ মাত্র কাজ। যদিও আজ এক মুহূর্তও ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল না নিমিকে, তবু কাজে যাওয়াটাও যেন আজ নিমির সঙ্গে নতুন প্রেমের সন্ধির মতো। সে কাজে চলে গেল।

.

১০.

তিন দিন ধরে শৈলবালা আর বিছানা থেকে উঠল না। শৈলবালা চতুর্থ দিনের সকালবেলা সজ্ঞানে মারা গেল।

আগের দিন সারারাত্রি সে ঘুমোয়নি। শুধু একটি কথাই সারারাত্রি বলেছে শৈলবালা, নিমির ছেলেকে না দেখিয়ে আমাকে নে যাচ্ছ? মরতে আমার দুঃখ নেই, আর ছসাতটা মাস আমাকে থাকতে দাও। ওগো, তোরা আমাকে আর কটা মাস বাঁচিয়ে রাখ।

অভয় মিলের বড় ডাক্তারকে এনেছিল। তিনি নিদেন দিয়ে গেছেন। বলেছেন, পুরনো রোগ, ভিতরে সব পচে গেছে। গা ফেটে যদি ঘা হত আগে থেকে, তা হলে আশা ছিল।

এ যেন ঘরের মধ্যে গর্তে ঢাকা বিষাক্ত সাপের মতো। প্রথম থেকেই তার উপস্থিতি টের পেয়ে তাড়ালেই সে বাড়ে। বাড়তে বাড়তে একদিন সে নতুন খোলস ছেড়ে, ভিতরে ভিতরেই নিষ্কণ্ডল হয়ে বিষবায়ু ছড়িয়ে খুঁসতে থাকে। যেদিন সে গর্ত ছেড়ে বেরুবে, সেদিনই মৃত্যু।

মৃত্যুর আগে শৈলবালা গা থেকে সব ফেলে দিয়েছিল। তার সেই সর্বাঙ্গ-খোলা রক্তাভ স্ফীত শরীরে দাপিয়ে ছটফটিয়ে সে শুধু বলেছিল, জলে দিয়ে আয় আমাকে। জলে ডুবিয়ে দিয়ে আয়। জ্বলে গেল, আমার সব জ্বলে গেল।

তারপর, মরণের একেবারে শেষ মুহূর্তে, কয়েক মিনিট আগে শৈলবালা শান্ত হয়ে গিয়েছিল। তখন অভয়কে কাছে ডেকেছিল। অভয় মৃত্যুলীলা দেখছিল স্তব্ধ বিস্ময়ে বেদনায় ও ভয়ে।

অভয় কাছে যেতে, শান্ত স্তিমিত স্বরে বলেছিল, নিমিকে রক্ষা কোরো বাবা। আমার নিজের পেটের ছা, আমি জানি ও এক রকমের সাপ বাবা। অনেক কিছু দিয়ে ওকে অক্রূরেই শেষ করতে চেয়েছিলুম, পারিনিকো।

নিমি সামনেই ছিল। অভয় বলেছিল, এ কথা কেন বলছ মা?

শৈলবালা বলেছিল, বলে যেতে হয় বাবা। আমার মেয়ের যে তাতে ভাল হবে। ওকে নরমে নরমে পুষবে। বিষ বেশি হলেই, ভাঙবে। নইলে কোন আস্তাকুঁড়েতে গিয়ে মরে পড়ে থাকবে অন্যের মার খেয়ে। আমি তো জানি, আমার মেয়ে ও। দেখোনি, কেমন ক্ষেপে যায়? সোমসারে সব মেয়ে সমান নয়। ওকে রোজার চোখে দেখবে, নইলে কষ্ট পাবে।

তারপর নিমিকে ডেকে বলেছিল, ভয় কী তোর মুখপুড়ি, যে তুই ওকে কষ্ট দিতে যাস? ওকে খ্যাপাসনে, ও তোর চেয়ে অনেক বড়। ওকে খুশি রাখবি, ও তোর গোলাম হয়ে থাকবে, তাঁ বলে গেলুম। ও ভগবানের মতন। দে, একটু মিঠে জল দে দিনি।

জল আনতে আনতে দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। জল যখন দেওয়া যাচ্ছিল, তা আর ভিতরে যেতে পারেনি। কশ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছিল।

নিমি বলেছিল, ও মা, জল খেলিনে?

বলে দাপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল। অভয় তাকে বুকের কাছে জোর করে ধরে রেখে বলেছিল, মিঠে জল আর খাবে না মা।

নিমি একেবারে ভেঙে পড়েছে। খালি বলে, এ বাড়িতে আমি আর টিকতে পারছি নাকো। বাড়িটা যেন আমাকে অষ্টপোহর গিলতে আসে।

মা একদিন মারা যাবে, এ কথাটা কোনওদিন নিমি ভাবেনি। এ সংসারে জন্মে, চোখ ফোঁটার পর। সে দেখেছে মাকে। আর কাউকে নয়। বাবা বলো, অন্যান্য আপনজন বল, তার সব কিছু মা। এমনকী, খেলার সঙ্গিনীও। বাবা নিয়ে কোনওদিন কৌতূহলও ছিল না নিমির। জিজ্ঞেস করেনি, হ্যাঁ মা, আমার বাবা নেই? বরং, তার মায়ের কাছে যে সব পুরুষেরা তখন যাতায়াত করেছে, তারা কেউ আদর করতে এলে, ছুটে সে মায়ের আঁচলে গিয়ে লুকিয়েছে। সে ঘর জানত না, গাছের তলা জানত না। সে জানত, সংসারে মা আছে, তাই সব আছে। তাই সে শীতে মায়ের গায়ে ছায়া ফেলে রোদ পুইয়েছে। গরমে মায়ের ছায়ায় ঠাণ্ডা হয়েছে।

আমার নিমির বে দিয়ে একখানি সোন্দর জামাই আনব আমি।

শৈলবালা আদর করে বলেছে। নিমি ঠোঁট ফুলিয়ে, মাকে মেরে-ধরে কামড়ে খামচে দিয়েছে। জেদি গলায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলেছে, না, আমি তোকে বে করব।

–ওম্মা। মেয়েছেলে আবার মেয়েছেলেকে বে করে নাকি?

তা বললে হবে কেন? সেই এক জেদি চিৎকার, না, আমি কাউকে বে করব না। তোকে বে করব। ওমা, আমি তোকে বে করব।

শৈলবালা মেয়ের দৌরাত্ম্যে বেসামাল হয়েছে। তবু হেসে লুটিয়ে পড়েছে। পাড়ার লোক ডেকে বলেছে, অই শোন গো তোমরা, আমার মেয়ের কথা শোন। এ আমাকে ছাড়া কারুকে বে করবে না।

নিমির গাল টিপে দিয়ে সবাই বলেছে, আচ্ছা লো আচ্ছা, বড় হ, তখন দেখব, মাকে কেমন বে করিস। তখন যদি ব্যাটাছেলের দিকে রং করে তাকাবি, নোড়া দিয়ে ঘেঁতো করব।

তবু তারপরে মাকেই হার মানতে হয়েছে। বলতে হয়েছে, আচ্ছা তাই হবে। আমিই তোর বর হব, হয়েছে?

ছোট মেয়েটি আসলে সে দিন বিয়ে জানত না। তার অত যে বিদ্রোহ, অত যে প্রতিবাদ, সে শুধু ভয়ে। মাকে হারাবার ভয়।

তারপর বড় হয়েছে নিমি, ছেলেমানুষি গেছে। সমাজে আর পরিবেশে মানুষ হয়েছে। মায়ের শত সাবধান সত্ত্বেও, ছেলেদের সংস্পর্শে আসতে তার দেরি হয়নি। দশ পেরোতে না পেরোতে, জীবনের একদিকটা সব জেনে ফেলেছে সে। শুধু জেনে ফেলা নয়, অনুশীলনও করেছে। যেমন কাজের যেমন অনুশীলন।

নিমি প্রেম করতে শিখেছে। আজ পাড়ার এ ছেলেটাকে ভাল লাগে। কাল ও ছেলেটাকে। খুদে বীরেরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করেছে। নিমি মহারাণীর মতো সে লড়াইয়ের পরিণতি লক্ষ করেছে। যার জিত, বীর্যশুল্কার মালা তারই জন্যে। অনেকটা অরণ্যের নিয়ম ও শাসনের মতো। পুরুষেরা লড়ে। মেয়েরা উদাস হয়ে বনের সৌন্দর্য দেখতে থাকে। ওদিকে যে নখে দাঁতে ছেড়াছিড়ি খুনোখুনি চলছে, বন কাঁপিয়ে হুঙ্কার উঠছে, সে সব কিছুই নয়। ফিরে তাকাতেও নেই। কারণ, নারীকে নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে হবে। যে হোক, একজন জিতে আসবে, আর একজন মরবে, নয়তো ভয়ে ও লজ্জায় চিরদিনের জন্য সেই অরণ্য ছেড়ে পালাবে। রক্তস্নাত আহত বিজয়ীকে তখন নারী সারা গায়ে লেহন করবে, শুশ্রূষা করবে, পরিষ্কার করবে, সোহাগ করবে। তারপর দুহু দোঁহায় মধুচন্দ্রিমা যাপনে চলে যাবে অরণ্যের গভীর জটায়।

এ ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা প্রায় সেই রকমের। নিমিদের মালিপাড়ায় দেহ শুধু পণ্যের কারবারেই বিকোয় না। সভ্য সমাজের ঘেরাওয়ের মধ্যে শ্বাপদ আইনকানুনের অবশিষ্টও কিছু কিছু ছিল।

ফুল যদিও তখন ফোটেনি নিমির, প্রেমের বহর ফোঁটা ফুলের চেয়ে কিছু কম ছিল না। মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে, মালিপাড়ার গঙ্গার ধারের নির্জনে সে ছুটত প্রেমিকের সংকেতে। সময় অতি অল্প, সেটুকুও ত্রাসে উৎকণ্ঠায় পরিপূর্ণ। চুম্বন আলিঙ্গনই যদিও চূড়ান্ত, সেটুকুর আদানপ্রদানেই মনে হত, এই দুস্তর সময়ের মধ্যে বুঝি গঙ্গায় এক জোয়ার এক ভাঁটা যাওয়া আসা করে গেল।

নায়কের উক্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই : তুই ছুটতে ছুটতে আসিস, আর খালি যাই যাই করিস। এ আমার ভাল লাগে না।

নায়িকার জবাব : আর মা যখন ডেকে ডেকে খুঁজে পাবে না, তখন তুই গে মার খাবি? আমার পিঠের ছাল তুলে ফেলবে না?

–এখানে এলেই তোর মা খালি খোঁজে, না?

–এই দ্যাখ, ঝগড়া করবি তো চলে যাব।

এ প্রেমের যদিও আগা নেই গোড়াও নেই, তবু মালিপাড়ার অন্ধকার সমাজের এক বিচিত্র স্বপ্ন তার কল্পনার মায়া ছড়িয়ে দিত।

নায়ক–চল নিমি, খেয়া পেরিয়ে ওপারে যাই।

নায়িকা–না। চুমু খাবি তো খা, নইলে চলে যাই। এটা তো আর ঘর সোমসার নয়।

এ সব সোজা কথার ওপরে আর যুক্তি চলে না। নায়কও তো এমন কিছু হোমরা চোমরা পুরুষ নয়। কৈশোরেই এ সমাজ এবং পরিবেশ তাকে ঝিরকুট করে দিয়েছে। অনাগত যৌবনের সর্বগ্রাসী ক্ষুধাটা যদিও তাকে পুরোপুরি মেয়ে-শিকারী করে তোলেনি, তবু নিমির মতো তারও সবই জানা হয়ে গেছে। তাই সে ইঙ্গিত দিয়ে বলে, চল ওই জঙ্গলে যাই।

তাতে পিছ পা নয় নিমি। তা নইলে প্রেম হল কেমন করে? ঘরে এবং পাড়ায় যে বিষয় চোখ এবং কানের কোনও অপেক্ষা রাখেনি, তার একটা অত্যন্ত সরল, প্রায় মুদ্রাগত দৈহিক অভিনয় করে নায়িকা অন্তর্ধান করেছে।

কিন্তু মুশকিল ছিল, কোনওদিন এসব প্রেমাভিনয় গোপন করা যায়নি। কেউ না কেউ নির্ঘাত দেখেছে। এই নিয়ে গল্প হয়েছে পাড়ায়। শৈলবালা চ্যালা কাঠ দিয়ে মেরে আধমরা করেছে। নিমিকে।

মায়ের মার খেয়েছে, মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে তবু মা-ই খাইয়ে দিয়েছে, আবার কোলের কাছে। নিয়ে শুয়েছে।

নিমি জানত, জীবনে অনেক কিছু হয়। অনেক খারাপ, অনেক ভাল, অনেক মিথ্যে, অনেক সত্য, অনেক অকাজ, অনেক কুকাজ, কিন্তু মা আছে সব সময়। থাকবেও সব সময়।

জীবনে অনেক কিছু ঘটে। কেন ঘটে, তা নিমি জানত না। সেই জন্যই, জীবনে সবই ঘটনা। কিন্তু মা তো কোনও ঘটনা নয়। মা কোনও ছেলের শিস্ নয়, হাতছানির ইশারা নয়। মা কোনও পাড়ার বুড়ো মিনসের আদরের ছলে গায়ে হাত দিয়ে কষ্ট দেওয়া নয়, মা কোনও মারামারি নয়। গুলি খেলা নয়, চু কিৎ কিৎ ঝাঁপাঝাঁপি, গঙ্গায় সাঁতার কাটা নয়।

মা মন, মা প্রাণ। মা দুঃখ মা সুখ। মাথার ওপরে মা আকাশ। পায়ের নীচে মা মাটি। মা সোহাগ, মা প্রহার। মা সখী, মা শত্রু। মা শুদ্ধ রক্ত, মা দৃষিত রক্ত।

জীবনের অনেক পট পরিবর্তন হয়। বয়স বাড়ে, মনও বদলায়। তবু মা যেমন তেমনি থাকে নিমির কাছে। থাকবেও চিরদিন ধরে। এ বিশ্বাস নয়। বিশ্বাসের উর্ধে, নিশ্বাসের বাতাসে ও রক্তে মিশে থাকা মায়ের কথা সে জন্য কোনওদিন বিশেষ ভাবে চিন্তা করবারও অবসর আসেনি নিমির।

তারপরে বিয়ে। প্রায় প্রৌঢ়া ভামিনীর চোখের দিকে তাকিয়ে, প্রথম ঘা খেয়েছে নিমি অভয়ের জন্য। সেই তার প্রথম অবিশ্বাস। তারপরে সুবালা। সেই তার অক্ষয় সন্দেহ। কেমন করে সে নিজের মন দিয়ে এতখানি বাড়িয়ে ফেলেছে ব্যাপারটাকে, টেরও পায়নি। যে পুরুষকে সে প্রাণ ধরে চেয়েছে, তাকে নিয়ে তার সবচেয়ে বেশি জ্বালা।

কেন? না, সে জানে না, ছোটকাল থেকে পাওয়া এবং ভোগের ব্যাপারে তার কর্তৃত্ব আর। একচেটিয়া বৃত্তি চলে এসেছে। পুরুষকে নিরঙ্কুশ কুক্ষিগত করা তার ধর্ম। তার দুর্জয় আবেষ্টনীতে উদারতার, পাড়ায় ঘরে সামাজিকতার দাম নেই।

সে দুঃখ এবং যন্ত্রণা তার জীবনের একদিক। এই যে তার এমনি চরিত্র, এর পিছনেও তার মা। সে যে নিষ্ঠুর হত, রুদ্রাণী হত সে শুধু ওই ঘরের মধ্যে বেজায় ভিড়ের অনেক কোলাহলের মধ্যে ভুলে যাওয়া ঘড়িটার টিক টিক শব্দের মতো তার মায়ের অবস্থিতি। এ কথাটা সে নিজেও জানত না। কোনওদিন ভেবে-চিন্তে যাচাইয়ের প্রশ্ন ওঠেনি।

কিন্তু অন্তস্রোতের ধারায় চিরদিনই ছিল, আমার কিছু নেই? না থাক, আমার মা আছে। আমি যদি স্বামীর সঙ্গে রাগ করে শুতে না যাই মা আমাকে শুতে পাঠাবে। রাগ করে না খেলে, মা খাওয়াবে। আমি যদি চুল না বাঁধি, শাড়ি না পরি, যদি না হাসি, সব কিছুর জন্য আমার মা আছে।

সেই জন্যে অভয়ের সঙ্গে মাকে নিয়ে কোনওদিন তার মনে কে কতখানি আপন ও অনাত্মীয় সে বিচার উপস্থিত হয়নি। মা এক, অভয় আর এক। এ দুই দিক নিয়েই তার জীবন।

সেই মা যখন মারা গেল, নিমির সর্বাঙ্গ থেকে যেন চিরদিনের একটি চেনা রেশ কোথায় খসে গেল। আজন্ম তার একজনই ছিল, সে মা।

মা মারা গেল, নিমি যেন জীবনের চলার পথে থমকে দাঁড়াল সহসা। যেন এতদিনে তার চিন্তা করবার অবকাশ হল, কোথায় এসেছে সে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখবার সময় হল, সে কে ছিল। এতদিনে কেমন হয়েছে সে দেখতে।

যেন নিজেকে সে নতুন করে আবিষ্কার করল অভয়ের বাহুবন্ধনে। নতুন করে জানল, মা আর তার হাতে জল খাবে না। মাকে গঙ্গার ঘাটে পুড়িয়ে এসে, উঠোনে দাঁড়িয়ে সে আপন মনেই বলে ফেলল, ওমা, জল খেলিনে?

অভয় বুকে করে তুলে নিয়ে এল নিমিকে। বলল, মা আর জল খাবে না নিমি। ঘরে এসো।

নিমি চিৎকার করল না, দাপাল না। ও যা মেয়ে, সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ওর চোখ বেয়ে জল পড়ল, টুঁ শব্দটি করল না। যদি এক জায়গায় বসল তো, আর নড়ে না।

.

১১.

অভয়কে মিলে যেতেই হয়। বেশিদিন কাজ কামাই করা চলে না। নিমিকে তখন একলা থাকতে হয় বাড়িতে। প্রতিবেশীদের কাজ আছে, তারাই বা কতক্ষণ থাকে। সবাই শুনল, নিমি একলা উঠোনে দাঁড়িয়ে কথা বলে, ওমা জল খেলিনে?

একদিন দাওয়ায় বসে মাকে ডেকে বলল নিমি, ওমা, আমার ছেলে হবে, তুই দেখবিনে?

 কথাটি বলে সে আর সামলাতে পারেনি। মূর্ছা গেছে।

অভয় দেখল, নিমির একজন ছাড়া সংসারে কোনও কিছুই হারাবার ছিল না। সে ওর মা। সেই মাকে হারিয়ে, জীবনে এই প্রথম হারানো কী জিনিস, নিমি জানছে, টের পাচ্ছে। এর নাম শোক। নিমির জীবনে এই প্রথম শোক। সেই শোক নিমিকে পিষছে, মারছে। সামলাতে পারছে না।

অভয় গেল ভামিনীর কাছে। বলল, খুড়ি, ওকে একলা রেখে আমি যে কোথাও যেতে পারি না।

ভামিনীর রঙ্গ জীবনের শুভ সঙ্গও হয়ে উঠতে পারে। সুরীনের ঘর করায়, সেটুকুই তার অদৃশ্য জীবনায়ন। সে বলল, পা বাড়িয়ে আছি যাবার জন্যে। কিন্তু আমাকে কি ও সইবে?

অভয় বলল, সইবে খুড়ি, খুব সইবে। নিমি আর সেই নিমি নেই।

 ভামিনী বলল, আজই যাব, ভাবনা কী? শৈলদির মেয়ে, আমারও মেয়ে।

 ভামিনী এল। এসে বুকের কাছে টেনে নিতে গেল নিমিকে। নিমি শক্ত হয়ে একবার ফিরে তাকিয়ে দেখল ভামিনীকে।

ভামিনী করুণ ও বিব্রত হেসে বলল, আয় মা, একটু কাছে বোস।

 শুধু ওই কথাটুকু শুনে সহসা নিমি ভামিনীর কোলে মুখ গুঁজে ভেঙে পড়ল।

অভয়ের বুকের দু কূল ভাসিয়ে একটি বিচিত্র প্লাবনের স্রোত ভেসে আসতে লাগল। শাশুড়ি মারা গেল। নিমির পেটে সন্তান। জীবন মৃত্যুর এই বিচিত্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, সে হাত জোড় করে গুনগুনিয়ে উঠল—

জীবনে আমি তোমার কূল কেন পাই না গো ॥

জীবন অনেক বড়, তার কোনও কূল নাকি পেল না অভয়। তাই জীবন অকূল হয়েই দেখা দিল তার সামনে। যে অকূলতা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ; প্রচণ্ড তার বেগ। জটিল তার স্রোত ও আবর্ত। খানে খানে সর্বনাশী দহ।

এদিকে ভামিনী যেন পুরোপুরি শৈলবালার জায়গাটি দখল করে বসেছে। শৈলবালার চেয়েও তার শাসন কড়া। কথার ঝঙ্কার বেশি। কিন্তু যাকে বলে পোট খাওয়া, তাই খেয়ে গেছে নিমির সঙ্গে। একেবারে যদিও নিমির পক্ষে মাকে ভোলা সম্ভব নয়, তবু সর্বক্ষণ ভামিনী কাছে থাকার একটি ফল ফলেছে। অন্যমনস্ক হওয়ার সময় তার কম। একাকী মায়ের অভাবে রুদ্ধশ্বাস যন্ত্রণায় মুর্ছা যায় না সহসা।

গালে হাত দিয়ে একটু যদি বা বসেছে নিমি, ভামিনী বলে ওঠে, অমনি করে বসে থাকলেই হবে? উঠবি নে, চুলটুল বাঁধতে হবে না?

মনে মনে তলিয়ে যাওয়া আর হয় না। নিমি চমকে বলে, এই যে যাই।

–এই যে যাই নয়। ওঠ, উঠে চোখে মুখে একটু জল দে আয়। চুল বেঁধে দিই। জল নিয়ে আয়, ঘরের কাজকর্ম কর। বসে থাকতে দেব না আমি।

বসে থাকতে নেই গর্ভবতী অবস্থায়, তাই জানে ভামিনী। কাজ না করলে, শরীরকে সচল না রাখলে, প্রসবের সময় কষ্ট হবে। সেই সঙ্গে আর একটা খোঁটাও না দিয়ে পারে না, সাধ করে কি আর বড়লোকের বউদের হাসপাতালে ছুটতে হয়? ডাক্তার বদ্যি না হলে, কাটা ছেঁড়া না করলে, বিবিদের খালাস করানো দায়।

কাজ করায়, কিন্তু কোথাও একলা ছেড়ে দেয় না ভামিনী। নিজেও সঙ্গে সঙ্গে জল আনতে যায়। সর্বক্ষণ কাছে কাছে থাকে। নিজে বসে খাওয়াবে। পেট চেপে চেপে ভাত খাওয়াবে। আগুনের ধারে যেতে দেবে না। উপুড় হয়ে বসে, বাটনা বাটতে দেবে না।

ভামিনীর কথা শোনে নিমি। উঠতে উঠতে বলে, বাবা গো বাবা, উঠতে বললে আর তর সয় না।

কথা শুনলে বোঝা যায় নিমি অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। এ যেন অনেকটা শৈলবালার সঙ্গেই কথা বলার মতো।

ভামিনী জবাব দেয়, সইবে কেন? বেলা যায় না? সে লোকটা কল থেকে খেটে খুটে আসবে, তার সামনে একটু চা বাড়িয়ে দিয়ে এক পলক বসতে হবে না?

তারপরেই ভামিনী ঠোঁটের কোণে একটু হাসি নিয়ে বলে, সারাদিন বাদে এসে, ও চাঁদ মুখ না দেখলে থাকা যায়?

এ কথার পর ভামিনী আর শৈলবালা থাকে না। সখী হয়ে ওঠে। দুজনের মধ্যে একটি নতুন ভাবের জন্ম হয়।

নিমি হেসে বলে, চাঁদ মুখ না ছাই। তোমার ভাসুরপোর কত্তো চাঁদ মুখ আছে।

ভামিনী বলে, মিছে কথা বলিসনে নিমি। মুখে পোকা পড়বে।

নিমির কথায় বিতৃষ্ণা ও তিক্ততার ঝাঁজ নেই। তাই এ কথায় তেমন গুরুত্বও নেই। বরং সে। হাসে ভামিনীর রাগ দেখে। ভামিনীও তো আসলে রাগে না। সে হাস্যময়ী নিমিকে দেখে। . মায়ের শোকটুকু না থাকলে, না জানি নিমি আরও কত রূপসী হত। কথায় বলে, প্রথম পোয়াতির রূপ। সে রূপ দেখতে হলে, নিমিকে দেখতে হয়।

নিমির শরীরে যৌবনের জাদু ছিলই। কিন্তু চোখে মুখের প্রাখর্যে, প্রত্যহের জীবনধারণের ছায়ায়, সে রূপে একটি বিষের ধার ছিল। এমন স্নিগ্ধ, এমন ঢলঢল ভাবখানি কোনওদিন ছিল না। বিয়ের পরে তার শরীরে একটি ফুল ফুটেছিল। এখনকার মতো তা এমন করে তার দল মেলেনি। পরিপূর্ণ, বিস্তৃত, একটু বাতাস লাগলে তার পাপড়ি শিউরে ওঠে। খর চোখ দুটির কোলে একটু ছায়ার গাঢ়তা। একটু করুণ, ক্লান্তির আভাসে খর চোখে স্নিগ্ধতা দেখা দিয়েছে। গর্ভ সঞ্চারের প্রথম শুষ্কতার পর, হাতে পায়ে যেন নতুন ঢল নেমেছে। নিটোল হয়েছে, নতুন ভার নেমেছে। কোমরে। মন্থর গম্ভীর লয়ে সে গুরুভার নিম্নাংশে নতুন ছন্দের দোলা। কী এক নতুন স্রোতের আবর্তে যেন ক্রমেই আরও সুউচ্চ ঢেউ স্পর্ধিত হয়ে উঠছে তার বক্ষদেশে। গায়ের রঙে দেখা দিয়েছে নতুন দ্যুতি। বুঝি শোকেরই বিষণ্ণতা তার হাসিতে একটি বিচিত্র মাধুর্য দিয়েছে।

ভামিনীর তাকানো দেখলে লজ্জা করে নিমির। বলে, অমন তাকে তাকে কী দেখছ খুড়ি?

–তোকে দেখি।

 -কী দেখো?

ভামিনী হাতের মুদ্রায় একটি বিশেষ ভঙ্গি দেখিয়ে, ঠোঁট টিপে চোখ পাখিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গি করে। তারপর দু জনেই হেসে ওঠে।

নিমি বলে, মরণ দশা তোমার! ছি।

ভামিনী বলে, মরণ দশা হল আমার? মেয়েটি তুমি কেমন, ব্যাটাছেলের কেমন লাগে তোমাকে, সে কথাটা বলেছি। তুই পেটে ধরতে পারিস, আর আমি বলতে পারিনে?

কাজে কর্মে স্নেহে শাসনে ঠাট্টায় দু জনের সারাদিন কাটে। দু জনের ভাব বেশ জমজমাটি।

এমনটিই তো চেয়েছিল ভামিনী। মানুষের মন, তাকে কি ধরে বাঁধা যায়? নাড়ি ছেড়া একটি ধন, তাকে নিয়ে শোবে বসবে। এইটুকু ভামিনীর নেই বলেই, শৈলবালাকে তার বড় হিংসে হত। তারই ঘরের পুরুষ যে-ছেলেকে নিয়ে এল, সেও শৈলবালার ঘরে যাবে। জ্বলুনি ধরে বইকী। মন নষ্ট হয়। ভামিনীরও হয়েছিল। শৈলবালার সুখের ঘরে ফাটল ধরাতে চেয়েছিল তাই। নইলে আর মন বলেছে কী করতে?

তা বলে কি এখনও আর সে মন আছে? সর্বনাশ করার সুযোগ এখনই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু নিমি অভয়, দুজনকেই ভালবাসে সে। এ পাড়ায় আর কার জন্য তার পোড়ানি। অত বড় মিস্তিরির মেয়েমানুষ হয়ে, আর কার জন্য ঝি বাঁদিগিরি করা?

ভামিনীর নিজের বাড়ি খা খা। ফিরে গেলেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। সুরীন কারখানা থেকে সরাসরি এখানেই আসে। শৈলবালার দায়িত্বটা তারা দু জনে নিয়েছে। সুরীনের যেন এক নতুন উদ্দীপনা। বাজার করে আনা, খাওয়া বসা, সব এখানেই। রাত্রে সে একা শুতে যায়। বাড়িতে। জিনিসপত্র আছে কিছু ঘরে। না থাকলে চুরি হয়ে যাবে। নইলে এখানেই থাকত।

অভয় পরম নিশ্চিন্ত সংসারের ব্যাপারে। এক শৈলবালা গিয়ে, আরও দুটি বড় খুঁটি পেয়েছে সে। সুরীন যেখানে সংসারের দায়িত্ব নিয়েছে, সেখানে অভয় কোন ছার। সে আসে, চা খায়, অনাথদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। হপ্তার টাকা সরাসরি তুলে দেয় সুরীনের হাতে। তাতে নিমির কোনও অভিযোগ নেই। টাকা সে কোনও দিনই তেমন করে হাত পেতে নেয়নি। তার মা-ই। নিয়েছে। এখন নেয় সুরীন খুড়ো।

মিল থেকে এসে, চা খেয়ে রোজ বাজারে যায় সুরীন। যাবার আগে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিমিকে জিজ্ঞেস করবে, কী খাবি মা বলত?

–যা হয় এনো।

নিমির লজ্জা করে খুড়োর কথা শুনলে।

সুরীন বলে, তা বলে কি চলে? এখন তোমার কোনও অসাধ রাখতে নেই। তাতে আমাদের পাপ হবে যে?

নিমির সাধ অদ্ভুত। কোনও কোনও সময় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। কোনও দিন বলে, নোনা ইলিশ পাও তো এনো। উচ্ছে কি ওঠে? আম-আদা এনো দু পয়সার। জলপাই কবে উঠবে? পলতা পাতার বড়া খেতে ভারী ইচ্ছে করে। খোট্টা বুড়ির দোকান থেকে লঙ্কার আচার এনো। না, মিষ্টি এনো না। ইরামের দোকান থেকে টক দই এনো পোটাক।

এমন কিছু রাজভোগ্য জিনিসের দাবি নয়। কিন্তু ওই তুচ্ছ জিনিসগুলি, বাজারের তুচ্ছতায় প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে। সুরীনের মতো আচমকা খদ্দেরকে যোগান দিতে পারে না।

বাজার করে সুরীন সরাসরি রান্নাঘরেই ভামিনীর কাছে এসে বসে। নিমি এসে বসে কাছে। নিমির সাধের জিনিস নিমির হাতে তুলে দেয় সুরীন। নিমি হাসলে সুরীন হাসে। হেসে বলে, এর পরেও যদি জন্মের পর শালার মুখে নাল গড়ায় তো ওর থেতা মুখ আমি ভোঁতা করব।

তারপরে আবার সুরীনই বলে, আসলে, পোয়াতির সাধ কখনও মেটে না। ছেলের নাল চেরকালই গড়ায়। তা হোক, যতটা পারা যায়।

নিমি বলে, কী যে বকবক করো খুড়ো। দেখি দাও থলেটা, কুটনোগুলোন কুটে ফেলি।

নিমি কুটনো কোটে। ভামিনী এসে সোহাগিটির মতো বসে সুরীনের পাশে। সুরীন পকেট থেকে দেশি মদের বোতলটি বার করে। এ প্রায় প্রত্যহের ব্যাপার এ বাড়ি ও বাড়ি বলে কোনও ব্যতিক্রম নেই। দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। দু জনে দুটি পাত্র সাজিয়ে নিয়ে বসে। নিমির অবাক হবার কিছু নেই। জন্ম থেকে দেখা। তাদের সমাজে এটা মহাভারত অশুদ্ধ হওয়ার মতো এমন কিছু অপ্রচলিত ব্যাপার নয়। প্রায় সন্ধ্যাতেই তার মা শৈল যে না বলে কয়ে হঠাৎ উধাও হত, তার কারণ কিছু অজানা ছিল না নিমির। সে জানত, মা সুরীন-খুডোর ওখানে গেছে একটু খেতে। খাবে, দুটি সুখ-দুঃখের কথা বলবে। আবার চলে আসবে।

এখানেও তাই হয়। দু জনে খায়। খেতে খেতে গল্প করে। পাড়ার কথা, কারখানার কথা। নিজেদের জীবনের পুরনো কাহিনী। নিমিও থাকে। সেও কথায় যোগ দেয়। তার বেশ লাগে এ সময়ে খুড়ো আর খুড়িকে। সে দেখে, দু জনের চোখ দুটি আস্তে আস্তে কেমন চকচকিয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে গলার স্বর বাড়ে। যদিও সেটা চিৎকার নয়। কিন্তু দু জনেই আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। কোনও কোনও সময় সুরীনের হাত ভামিনীকে বেষ্টন করতে এগিয়ে যায়। ভামিনী ঝটকা দিয়ে সরিয়ে মুখ ঝামটা দেয়, আঃ! ওকী হচ্ছে? নেশা হয়ে গেল নাকি?

–অ্যাঁ?

 সুরীন চমকে ওঠে। টেপা ঠোঁটে হাসি নত মুখ নিমিকে উঠতে উদ্যত দেখে সুরীন চোখ বড় বড় করে বলে, অ! আচ্ছা, তা উঠছিস কেন মা। বোস বোস, লজ্জা করিস না। ও কিছু নয়।

পুরনো দিনের কথা উঠলেও সুরীনকে মুখ-থাবড়ি মারতে হয় ভামিনীর। সুরীনের মুখে তখন রাশ থাকে না।

কিন্তু কথা বেশি হয় অভয়ের সম্পর্কেই। নিমি তখন চুপ করে শোনে। সুরীন বলে, মিলে অভয়ের খাতির। সে তো শুধু আর ছেনি হাতুড়ি মারা মিস্তিরি নয়। সে কবি। সে গায়ক। কেরানি বাবুরা মাঝে মাঝে ধরে অভয়ের গান শোনার জন্য। হরির কাছে সব খবরই পায় সুরীন। তবে, মিলের লেবার-অফিসার খুব খুশি নয় অভয়ের ওপর। তার গান নাকি স্বদেশি গান, কুলি কামিন খ্যাপানো গান। বলে দিয়েছেন, এ সব গান যেন মিলে না হয়। মিলের ম্যানেজার নাকি একদিন অভয়কে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি মজুরদের খ্যাপাবার জন্য গান তৈরি করো? অভয় বলেছে, গানের আবার খ্যাপাখেপির কী আছে হুজুর।

হিন্দুস্থানি ভিনদেশি লোকগুলি পর্যন্ত অভয়ের গান শুনতে ভালবাসে। রোজ একবার ইউনিয়ন অফিসে অভয়ের গান না হলে, মিটিং জমে না। এখন তো অভয় রোজ সন্ধ্যাবেলা ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে বসে। কলকাতা থেকে অনাথদের ইউনিয়নের যে সব নেতারা আসেন, তাঁদের কাছে বড় খাতির অভয়ের। অভয় তখন, অভয়বাবু। অভয়কে তাঁরা কলকাতায় নিয়ে যাবেন। শিগগিরই নিয়ে যাবেন। খুব একটা বড় মিটিং নাকি হবে। সারা দেশের ইউনিয়নের সম্মেলন। সারা দেশ থেকে লোকজন আসবে। বিলেত থেকেও নাকি আসবে প্রতিনিধি। সেখানে আমাদের অভয়কে গাইতে হবে। ও মা! তোমরা জানো না? কলকাতার খবরের কাগজে যে অভয়ের নাম উঠেছে। সরকারি কাগজে নয়, অনাথদের দলের কাগজে। ও যে পথে পথে গান গেয়ে, সভায় সভায় গান গেয়ে অনেক টাকা তুলে দিয়েছে সম্মেলনের জন্য। সে জন্যে ওর নাম তুলে দিয়েছে কাগজে।

কেন, আমাদের এই শহরেই কি নাম কম? জীবন চৌধুরী মশাই তো অভয়ের নামে পাগল। ওই যে গোবর্ধন ডাক্তার, মস্ত বাড়ি গাড়ি বড়লোক মানুষ। তাঁর ছেলে গণেশবাবু তো অভয়কে হাত ধরে বাড়িতে নিয়ে যায়। খাটের ওপরে নিয়ে বসায়। অভয়কে বলে, আপনি আপনি, বলে, অভয়দা। এ মালিপাড়ার কোনও লোক কোনওদিন গোবর্ধন ডাক্তারের বাড়িতে খাতির পেয়েছে? না, অমন সম্মান পেয়েছে? কলের গান ফেলে সব অভয়ের গান শোনে।

সুরীন বলে, তবে জীবন চৌধুরী মশাই একটু অসন্তুষ্ট। সিদিনে আমাকে বলছেলেন, দ্যাখ সুরীন, ছেলেটির মাথা খাবে তোমাদের অই অনাথের দল। অভয় হল কবি মানুষ, তোমার আমার মতো মোটা বুদ্ধির মানুষ নয়, বুঝলে? সব যন্ত্র তো সমান নয়। ওকে দিয়ে অনাথেরা কেন খালি দলের গান গাইয়ে বেড়াচ্ছে? তাতে এখন দলের হয় তো লাভ হবে, কিন্তু ছেলেটির পরকাল যে নষ্ট হবে। বাংলা দেশে এত লোক থাকতে, দলের নেতাদের নামে গান বাঁধছে অভয়। সব সময় যেন খেপে আছে, অনাথ শাসাচ্ছে, আর মজুরদের ডেকে লড়াইয়ের ময়দানে হাজির হতে বলছে। এতটা বাড়াবাড়ি তো ভাল নয়। খালি রাগ আর রাগ, খ্যাপামি আর খ্যাপামি। অভয় দেশ কাল বুঝুক। দেশের মানুষের মন জানুক, ওদিকে কিছু বুঝুক। তারপরে আপনা থেকে যা ওর মনে আসবে গাইবে। কিন্তু এখন তো তা হচ্ছে না। গান বাঁধবার গুণটি আছে, তাই তার নিজের কাজ আদায় করে নিচ্ছে। অথচ সেদিন বাজারে যখন ইংরেজদের কথা গাইলে, বোঝা গেল, কোথায় ওর। জ্বালা। কিন্তু এখন দলের জন্য গাইছে, অভয় নিজে তাতে নেই। ওকে একটুও পাওয়া যায় না।

সুরীন আর এক ঢোক খায়। আবার বলে, কে জানে, জীবন চৌধুরী মশায়ের কথাও আমি সব বুঝতে পারি না। খাল এইটুকু বুঝছি, আমাদের অভয়কে নিয়ে এখন সকলের মাথা ব্যথা। হবেই। কে নিয়ে এসেছে দেখতে হবে তো।

সড়াৎ করে পাত্রের সব পানীয়টুকু সুরীন গলায় ঢেলে দেয়। ভামিনী হুতোশে বলে, ও আবার কী রকম খাওয়া? গলায় আটকাবে না?

–তুই থাম দিকিনি।

 প্রায় ধমকেই ওঠে সুরীন। এখন সে সহসা চুপ করবার পাত্র নয়। বলে, জানিস, ওর বাপের চেয়ে আমার গরব বেশি।

ভামিনী বলে, ওর বাপ আবার কে?

–যে-ই হোক, তাকে আমি মানি না। রাখতে পারলে ধরে ওই নিতেই ভটচায? তবে হ্যাঁ, আমি এ্যাটটা কথা বলব। বলবই। সে নিমি রাগ করুক আর যাই করুক। অভয়ও রাগ করতে পারে। তবু আমি বলব। অভয়ের এত কারখানা মজুর নিয়ে থাকা আমার ভাল লাগছে না। নয়া মেশিন বসবে শুনছি চটকলে, বিস্তর লোক ছাঁটাই হবে। এ্যাটটা ভারী গোলমালের লক্ষণ আমি দেখতে পাচ্ছি। আর অভয়ের দিকে এখন মালিকের বড় কড়া নজর। তা ছাড়া, অনাথেরা লোক খারাপ নয় বটে, কিন্তু জীবন চৌধুরী মশায়ের কথার এ্যাটা দাম দিতে হবে।

নিমির মুখ গম্ভীর হয়। বলে, কী হতে পারে তোমার ভাইপোর?

সুরীনের সংবিৎ ফেরে। বোঝে যে, সে নিমিকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। যদিও, আসল সত্যকে সে অনেকখানি চেপেই বলেছে। অভয়ের ওপর সম্প্রতি কর্তৃপক্ষের নজর আরও বেশিই বলা যায়।

সে বলে, কী আবার হবে। বেশি মাথা গরম তো ভাল নয়।

কিন্তু সুরীনের চাপাচাপির দরকার আর হল না। কয়েকদিন পরেই, এক রবিবারের ভোরে পুলিশ হানা দিল অভয়ের বাড়িতে। বিস্তর পুলিশের গাড়ি। সে এক ভয়ানক ব্যাপার। মালিপাড়ায় এর। আগেও পুলিশ এসেছে। চুরি, রাহাজানি অপহৃতার সন্ধানে কিংবা পাড়ার ভিতরে, বারোবাসরের মাতালদের দাঙ্গার ব্যাপারে।

কিন্তু পুলিশের এ নতুন ধরনের হানা তারা কোনওদিন দেখেনি মালিপাড়ায়। তারা অবাক হয়ে, চারিদিক থেকে ভয়ে ভয়ে দেখতে লাগল। দেখল, পুলিশ ঠিক চোর ডাকাতের মতো ব্যবহার করল। না অভয়ের সঙ্গে। অভয়কে আপনি বলছেন দারোগাবাবু। ঘর দ্বারের বাকস প্যাঁটরা সব তন্ন তন্ন করে খুঁজল। তক্তপোশের তলা থেকে, রান্নাঘর পর্যন্ত বাদ গেল না। শেষ পর্যন্ত দুটি বই পুলিশ নিয়ে গেল। আর সেই সঙ্গে অভয়কে।

লোহার জাল দিয়ে ঘেরা কালো গাড়িটা বাইরে অপেক্ষা করছিল। যাবার আগে, পুলিশ বিদায় নেবার সময় দিল অভয়কে।

অভয়ের মনে পড়ল, গণেশবাবুর কাল রাত্রের কথা। গণেশ বলেছিল, অভয়দা–আপনাকে বোধ হয় দু একদিন পরে বাড়ির বাইরে রাত কাটাতে হবে। খবর যা পাচ্ছি, তাতে মনে হচ্ছে, এ অঞ্চল থেকে কিছু লোককে পুলিশ সরিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু কারখানা থেকে কাউকেই পুলিশ ধরবে না। তাতে গণ্ডগোলের সম্ভাবনা বেশি, সেইজন্য বাড়ি থেকেই হয়তো রাতবিরেতে তুলে নিয়ে যাবে।

এ সব কথা আগেই আলোচনা হয়েছিল। চব্বিশ-পরগনা হুগলি–দুটি জেলার সমস্ত চটকলের একটিই সমস্যা। নয়া মেশিন আসছে। যে-মেশিনের উৎপাদনের ক্ষমতা অনেক বেশি, কিন্তু লোকের দরকার কমে যাবে। দুটি জেলায় প্রায় এক লক্ষ শ্রমিক ছাঁটাই হবে। তাকে প্রতিরোধ করবার জন্যে, প্রায় সমস্ত জায়গাতেই আঞ্চলিকভাবে সংগ্রাম কমিটির সৃষ্টি হয়েছে। কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এই সংগ্রাম কমিটিগুলির উপরেই। সমস্ত জায়গা থেকে এই সংগ্রাম কমিটিগুলিকে সময় মতো ছেকে তুলতে পারলেই সব গণ্ডগোল মিটে যাবে। যে গাড়ির ড্রাইভার নেই, সে গাড়ির নিটুট সতেজ যন্ত্র থাকলেও তা অচল। সংগ্রাম কমিটি হল কারখানার বাছা বাছা নেতৃস্থানীয় লোকের সমষ্টি, যারা ড্রাইভারের মতো সমস্ত জন-যন্ত্র পরিচালিত করবে। সুতরাং দরকার হলে, এই কমিটির সভ্যদের লুকিয়ে থাকতে হবে, তবু পুলিশের হাতে যাওয়া চলবে না।

কিন্তু নয়া মেশিনের অপরাধ? অভয় না জিজ্ঞেস করে পারেনি। প্রশ্ন শুনে অনাথ রেগে উঠেছিল অভয়ের উপর। তবু জবাব চাই। নয়া মেশিনের অপরাধ কী? কম খাটুনি, কিন্তু বেশি মাল তৈরি হবে। এ মেশিন কেন বসতে দেওয়া হবে না?

জবাব দিয়েছিল গোবর্ধন ডাক্তারের ছেলে গণেশ। বলেছিল, নয়া মেশিনের কোনও দোষ নেই? কিন্তু এক লক্ষ লোকের অপরাধ? এক লক্ষ লোকের পরিবার বেকার হয়ে পড়বে শুধু নয়া মেশিনের জন্য। কোম্পানি বেশি মাল তৈরি করুক। নয়া মেশিন কীসের জন্য? বেশি মাল তৈরির জন্যই তো। কিন্তু কোম্পানিগুলি বেশি মাল তৈরি করবে না। এখনও যা করছে, পরেও তাই করবে। শুধু তোক কমে যাবে, খরচ কমে যাবে তাই। কিন্তু কোম্পানির মুনাফা কোথাও ফাঁকি পড়বে না, বরং বাড়বে। এক লক্ষ লোকের মাইনেটা বাঁচবে। কোম্পানির স্বার্থ আছে। আর এতগুলি লোকের জীবনের কোনও দাম নাই?

আর বলতে হয়নি। অভয় গান বেঁধে ফেলেছিল। সে কোনও দিন বক্তৃতা দেয়নি। বক্তৃতা দেয় কেমন করে, তাও সে জানে না। কিন্তু কথা সে বাঁধতে পারে। গাইতে পারে সুর দিয়ে। কলকারখানার মানুষদের উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন, কেমন যেন একটি ঝড়ের বেগ এনে দিয়েছিল তার মধ্যে। সে যে কথা শোনে, মুখ দিয়ে তা বলতে গেলেই গান হয়ে ওঠে। তার সে গান যেন বাঁধভাঙা প্লাবনের মতো গর্জন করে ওঠে তার মোটা দরাজ গলায়। শ্রমিকেরা তাকে সম্মোহন করেছে কিংবা সে শ্রমিকদের সম্মোহন করেছে, কোনওদিন ভেবে দেখেনি। তার বুকের মধ্যে যেন। নিরন্তর আগুনের হলকা। সে আগুন মিথ্যে না সত্যি, কোনওদিন যাচাই করে দেখেনি মনে মনে। এ যে কেমন করে কবে থেকে হয়েছে, সে জানে না। জনতার সামনে সঙ্কোচ কেটে গেছে তার। চোখের লজ্জা কেটে গেছে। কেমন করে সে আরও গান শোনাবে, এ চিন্তা তাকে নিশি পাওয়ার মতো অষ্টপ্রহর আচ্ছন্ন করে রাখে।

অনাথ তাকে যেখানে নিয়ে যায়, সবাই তাকে এক ডাকে চিনতে পারে। নতুন নতুন মহল্লায় সবাই তাকে হাততালি দিয়ে অভ্যর্থনা করে। রোমাঞ্চিত শরীরের শিরায় শিরায় উত্তাল হয়ে উঠে। অভয়ের।

অহঙ্কার তাকে গ্রাস করেনি। কিন্তু সে মোহাচ্ছন্ন যে হয়নি, এমন কথা জোর করে বলা যায়। যেন ঢল-নামা একবগগা পাহাড়ি নদীর মতো। কোনও দিকে সে ফিরে তাকিয়ে দেখেনি। সে শুধু ডাক দিয়ে গেয়েছে—

ওরে তাই শোনরে মজুর দল!
হুজুরের ক্ষুধা নাকি লাখ খোরাকি
আমরা ক্ষুধার তরে হব তল।
বাঁচতে যদি চাস ময়দানে দাঁড়াস
 (ওদের) মুনাফা কল করতে হবে রসাতল।

গান শেষ হয়নি, হাততালি দিয়ে উঠেছে সবাই। মাথার উপরে সকলের আসন্ন বেকারির খড়গ। কার মাথা লক্ষ করে ঝুলছে, কেউ জানে না। তিন লক্ষ লোকের সংশয়। সবাই প্রতিবাদের সাহস চেয়েছে। সাহস পাবার মতো একটি কথা শুনলেও সকলেই যেন একটা প্রচণ্ড অন্ধ শক্তির মতো। কলরব করে উঠেছে।

আঞ্চলিক সংগ্রাম কমিটিতে তাই অভয়ের নাম কারুর প্রস্তাব করতে হয়নি। তার নাম সকলের আগে ছিল।

আজ এই রবিবারের ভোরবেলা, নিমির কাছ থেকে বিদায় নেবার মুহূর্তে, সহসা যেন অনেক দিনের নিরন্তর কলরব ও গর্জন থেমে গেল। গাঢ় স্তব্ধতা নেমে এল দু জনের মাঝখানে। কেমন একটি বিস্মিত শঙ্কা ও ব্যথা-ভরা অশুভ ছায়া ঘনিয়ে এল ঘরটার মধ্যে।

বাইরে প্রতিদিন সভা ও সংগ্রাম কমিটি–সব কাজ শেষে সে নিমির কাছে ফিরে এসেছে। অগাধ উত্তুঙ্গ বেগবান জলরাশি–তার পারাবারের দিক দিশাহীন খেলা যেন অমোঘ তীরের বুকে এসে। পড়েছে ঝাঁপ খেয়ে। যে তীরের সঙ্গে তার মাখামাখি লুটোপুটি খেলা। যে অকুলকে চিরদিন ধরে প্রকৃতির নিয়মে কোনও এক কূলে গিয়ে মুখ দিয়ে পড়তে হয়েছে। যে কুলে এসে সে শুধু অথইএর। আকাঙক্ষায় গর্জন করেনি। তার দূর অপারের কাহিনী গেয়েছে কলকলিয়ে, ছলছলিয়ে। এই তীরকে সে দু হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করেছে। তার প্রতি বিন্দু দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে, এ মাটির কোষে কোষে রস সঞ্চার করেছে। এই চেনা তীরের বুকে মাথা পেতে ঘুমিয়েছে সে। যদিও তার দূর গভীরে নিয়ত আবর্ত কখনও থামেনি।

আজ এই মুহূর্তে, পুলিশের তছনছ করা ঘরটার মাঝখানে অভয় থমকে দাঁড়াল নিমির মুখোমুখি। একটি নিশ্চুপ ভূতুড়ে স্তব্ধতা থমথম করছে। অভয় যেন ভুলে গেছে, কী গান সে গেয়েছে এতদিন, কী কারণে কোন উন্মাদনায়।

সুরীন বারান্দায়। ভামিনী দরজার পাশে বাইরে। উঠোনে নানান লোকের নানান কথার জটলা। মালিপাড়া বারোবাসরের সব ঘর খালি করে এসেছে মেয়েরা। কারণ অভয় তাদের জামাই। আজ তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে পুলিশের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

অভয় শুনতে পেল তাদের কথাবার্তা। দেখল, এখনও ঘরের মেঝেয় তার লেখা গানের কাগজ পড়ে আছে। বোধহয় নজর এড়িয়ে গেছে পুলিশের।

সে স্খলিত স্বরে ডাকল, নিমি।

নিমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কাল বিকেলের বাঁধা খোঁপা এলিয়ে পড়েছে। সিঁদুরের দাগ বুঝি অভয়ের গালেই লেগেছে। বাসি পানের দাগ এখনও তার ঠোঁটে। এখনও অভয়ের বুকে পড়ে-থাকা ঘুমের জড়িমা তার চোখে। কিন্তু স্থির দৃষ্টি তার মাটির দিকে। এক ফোঁটা জল নেই সেখানে।

অভয় কাছে এসে হাত ধরে ডাকল, নিমি, মুখ তোল একবার।

নিমি মুখ তুলল। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি দেখে কিছু বোঝা গেল না। বলল, কোথায় নিয়ে যাবে। তোমাকে?

অভয় বলল, জানি না। এখন বলছে থানায় যেতে হবে। তারপর

অভয় চুপ করল। নিমি তাকিয়ে রইল ঠায় অভয়ের চোখের দিকে।

অভয় বলল, কী হল নিমি, অমন করে তাকিয়ে কেন? আমি তো কোনও পাপ করি নাই।

 নিমি প্রায় চুপিচুপি বলল, কিন্তু, এ্যাদ্দিন ধরে আমাকে এক ফোঁটা ভালবাসনিকো?

অ্যা?

অভয় যেন মৃঢ় বিস্ময়ে থতিয়ে গেল।

নিমি বলল, আমার কথা কি তোমার একদণ্ডের তরে মনে পড়েনিকো? বে হওয়া ইস্তক, তোমার মন যা চেয়েছে, তাই করেছ। এত ঝগড়া এত বিবাদ, তবু নিজের খুশিতে তুমি সব করলে, আমার খুশিতে কোনওদিন কিছু করনি।

দু হাত দিয়ে নিমির বাসি মুখখানি জাপটে ধরে বলল অভয়, এ সব কী বলছিস এখন নিমি? তোর মাথার ঠিক নাই।

নিমির গলার স্বর আরও চেপে এল। বলল, আমার কথা যদিন একটু মনে রাখতে, তবে তোমার। বাইরের সোম্সারের সব বজায় রেখে, আমাকে এমন করে রাখতে? মন যদি না চেয়েছেল, তবে দূরে। কেন রাখোনি?

 উৎকণ্ঠিত যন্ত্রণায় অভয়ের বিশাল মুখখানি বিকৃত হয়ে উঠল। নিমিকে সে দু হাতে টেনে নিল। কাছে। শ্বাসরুদ্ধ চাপা গলায় বলল, এ সব কী যা তা মিছে বলছিস নিমি। এ কী কথা?

বাইরে থেকে মোটা গলার স্বর ভেসে এল, কই মশাই, আর দেরি করা চলে না। সাতটা বাজে, আসুন তাড়াতাড়ি।

সুরীন মুখ বাড়াল। ডাকল, অভয়, এনারা তাড়া দিচ্ছেন।

অভয় নিমিকে ছেড়ে দিয়ে সরে এল। কেউ চোখ থেকে চোখ নামাতে পারল না। কিন্তু নিমির চোখে তখন জল এসেছে। সে দেয়াল ধরে বসতে বসতে বলল, সোক্সারে আমি কিছু চাইনিকো। ছেলে নয় পিলে নয় পয়সা নয়, গয়না নয়, শুধু, শুধু

অভয়বাবু!

আবার অফিসারের ডাক।

অভয় মুখ ফেরাতে গিয়ে আবার বলল, নিমি, যাই। মিছে ভেবো না, সুরীনকাকা আর খুড়ি রইল। ওদের কাছে থেকো।

বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল অভয়। উঠোন ভরতি লোক। সবাই তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়ের সংখ্যাই বেশি। গোটা মালিপাড়ার পুরুষেরাও আছে। আজ কারুর কাজ নেই, রবিবার। সকলেই অভয়ের চেনা। কয়েকজন সেপাই এর মধ্যেই মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টি-নষ্টির চেষ্টায় রত। মরণ! কে যেন বলল। কে যেন সায় দিয়ে বলল, মুখে আগুন!

অভয়ের মনে হল, ভিড়ের মধ্যে এক জোড়া চোখের ঔৎসুক্য যেন সবাইকে ছাপিয়ে উঠেছে। সজনে তলায় সে চোখ দুটি সুবালার। চকিতে একবার সেই বিমুখ-মুহূর্ত রাত্রির কথা তার মনে পড়ল। পর মুহূর্তেই বোধহীন স্তব্ধতা, অথচ অস্থির মন নিয়ে সে ফিরে তাকাল। নিমি বেরোয়নি ঘর থেকে।

কে যেন বলে উঠল, গোবর্ধন ডাক্তারের ছেলেকেও পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। অনাথকে ধরেছে কাল রাত্রেই।

জাল-ঘেরা গাড়িটা পর্যন্ত সুরীন এল। খালি বলল, ভাবনা করো না কিছু। আমরা খুড়ো-খুড়ি রইলুম, তুমি ঘুরে এসো।

একটি মেয়ে-গলা শোনা গেল, মুরোদ বড় মান। যেন চেরকাল জেল পুলিশ দিয়েই সব কিছু ঠেকানো যাবে?

-কে? কে বলল কথাটা?

অফিসার ফিরে তাকালেন। গাড়ি ঘিরে-ধরা মেয়েপুরুষেরা সবাই মুখ চাওয়া-চায়ি করতে লাগল। অফিসারের আরক্ত চোখে ঘৃণা ফুটে উঠল। কী যেন বললেন বিড়বিড় করে। অভয় গাড়িতে উঠল। বন্দুকধারী সেপাইরা উঠল। তারপর গাড়ি চলে গেল। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সবাই।

ভামিনীর ত্রাস-ভরা ডাক ভেসে এল, মিস্তিরি! শিগগির এসো, ঘুড়ির বুঝি ফিট হল।

সুরীন দৌড়ল ঘরের দিকে। বলল, জল দে, জল দে একটু চোখে মুখে।

কে একটি মেয়ে বলে উঠল, বিচ্ছিরি। কেটে পড়ি বাবা। শৈলমাসির মতন যেন কোনওদিন। মেয়ে-জামাই নিয়ে ঘর করার ভূত না চাপে ঘাড়ে। বেশ আছি!

বলে সে গত রাত্রের খোয়ারিতে, প্রায় টলতে টলতে চলে গেল। বোধ হয় তাকে সায় দেবার জন্যই মালিপাড়ার কোনও জোয়ান ছেলে শিস দিয়ে উঠল।

মেয়েটি মুখ ফিরিয়ে বলল, দূর মুখপোড়া। কানের পর্দা ফাটবে যে?

চোখে কাজল-ল্যাবড়ানো একটি প্রৌঢ়া মেয়ে বলে উঠল, মরব, মিটে যাবে। খানকির জীবনে আবার পেছু টান? দূর! দূর! চোর ডাকাত যদি বা পুষি, সেও ভাল, ও সব স্বদেশি চলবে না।

কে যেন তাদের মাথার দিব্যি দিয়েছে এ সব কথা বলতে। তবু তারা বকবক না করে পারছে না।

তারপর রাজুবালার রক্ষিত পুরুষ, নামে বাড়িওয়ালা গদাই বলে উঠল, হ্যাঁ। যাও যাও, সব আপন আপন ঘরে যাও। আজ রোববার, সেটি মনে করো, দিন দুকুরের লাগরেরা এল বলে।

তা বটে। রবিবার দিনের বেলাও হাট জমজমাট। সংসারের উপরে নীচে কোথাও তার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হলে চলবে না। ঠাট্টা বিদ্রূপ হাসি সবই যেন তবু কেমন একটি হাঁফ-ধরা। আড়ষ্টতায় থমথমিয়ে রইল। সবাই চলে গেল। দাঁড়িয়ে রইল কেবল সুবালা। উঁকি দিয়ে দেখল, নিমির জ্ঞান হয়েছে কিনা। হয়েছে। অবিকৃত চোখ বোঁজা মুখ নিমির। কেবল দ্রুত নিশ্বাস-প্রশ্বাস বইছে। ভামিনী পাখা করছে। সুরীন যেন হাঁটু মুড়ে করজোড়ে বসে আছে।

সুবালা সরে এল। শনিবারের রাত্রির ভয়ংকর উন্মত্ততার হাত থেকে রেহাই পেয়ে ভোরের দিকে বুঝি একটু ঘুম এসেছিল তার। সকলের শোরগোল শুনে উঠে এসেছিল। কালিমাখা কোটরাগত চোখে তার এখন আগুন নেই। জামা-কাপড় একটু এলোমেলো। কত পুরনো কথা মনে পড়ল সুবালার। স্বামী সংসার শাশুড়ি ননদ জা ভাই বোন–সেই পুরনো ঘোলা আবর্তে পাক খাওয়া সংসার কী নিষ্ঠুর! নিমির মরণেও না জানি কত সুখ দিয়েছে সে।

.

১২.

মহকুমা জেলে পাঁচ দিন রইল অভয়। গণেশও ছিল সেখানে। অভয়ের কথা বলার একমাত্র মানুষ। অনাথকে নাকি সরাসরি আলিপুরের জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে। শুধু অভয় গণেশ অনাথ নয় ; আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে এ অঞ্চল থেকে। সারা জেলায়, যেখানে যেখানে চটকল আছে, প্রায় সর্বত্র এই একই ব্যাপার নাকি ঘটেছে। গণেশ বলেছে অভয়কে তাদের সমূহ মুক্তি পাবার। কোনও আশা নেই। কারণ আশি হাজার লোককে একদিনে বরখাস্ত করা হবে না। কয়েক মাস ধরে, ধীরে ধীরে, দলে দলে তাড়াবে। যতদিন ধরে এ বিতাড়ন পর্ব চলবে, যতদিন ধরে তার উত্তপ্ত প্রতিক্রিয়া চলবে ততদিন ধরেই সম্ভবত অভয়দের আটক করে রাখবে।

অভয় যদিও সব সময় প্রায় অন্যমনস্ক, তবু বলল, আমরা কিছুই করতে পারলুম না গণেশদা। মাঝখানে থেকে সব গোলমাল হয়ে গেল।

গণেশ বলল, তা হল। আমাদের যা করবার আমরা করছিলাম। সব কিছুতে তো আমাদের হাত নেই। এর পরে যদি কারখানার লোকেরা নিজেরাই লড়তে পারে, কিছু হবে। নইলে ছাঁটাই হবে। আপনার আমার কিছু করার নেই।

অভয় যেন দুঃস্বপ্ন দেখার মতো বলল, এখানে তা হলে করব কী গণেশদা?

গণেশ ঠিক ধরতে পারল না অভয়ের কথা। তার ঠোঁটের কোণে একটু হাসি দেখা গেল। বলল, কী আবার করবেন। খাবেন-দাবেন ঘুমোবেন।

অভয় অবাক হয়ে বলল, কেন, জেলে কোনও কাজকম্মো করতে হবে না? এমনি বসিয়ে রাখবে?

গণেশ হেসে ফেলল। বলল, তাইতো রাখবে। আপনি তো আটক আইনে বন্দি।

–মাটি কাটা, পাথর ভাঙা, ঘানি টানা কত কথা যে শুনেছি গণেশদা?

গণেশ হা হা করে হেসে উঠল। বলল, সে সবই আছে। কিন্তু আপনি চুরি করেছেন না ডাকাতি করেছেন যে, আপনাকে ও সব করতে হবে? আপনি আপনার রুজি-রোজগারের জন্য লড়ছিলেন। আপনি কেন ও সব করবেন?

অভয় একটু সঙ্কুচিত হল। তার মনে পড়ল অনাথের কথা। অনাথ কেমন ভাবে জেলে থাকত। কিন্তু উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ঠায় বসে থাকতে হবে? কাজকম্মো নেই, খালি খাওয়া আর ঘুমনো? আরে বাবা, পাগল হয়ে যাব যে গণেশদা? গণেশ হাসতে গিয়ে থমকে গেল। অভয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে লজ্জা করল তার। খেটে খাওয়া এই মানুষ কোনওদিন বসে। থাকার অলস বিলাসের আরাম জানেনি। জানতে নেই শুধু নয়, বসে থাকাটা রোগ শোক ব্যয়রামের পাপ ছাড়া আর কিছু নয়। কর্মহীন জীবন একটা মস্ত বিড়ম্বনা ছাড়া আর কিছু নয় তার কাছে।

গণেশ বলল, মিছিমিছি বসে থাকবেন কেন? সারা দিন রাত্রি পড়াশুনো করবেন। দেখুন আগে, আমাদের নিয়ে কী করে। কোথায় রাখে। আমরা এখনও বোধ হয় মাঝ পথে। এখানে যদি রাখে, তবে শিগগিরই ছাড়া পেয়ে যাব। নইলে অন্য কোনও জেলে পাঠাবে। সেখানে বই-পত্র পাওয়া যাবে নিশ্চয়।

শুধু বই-পত্র পড়েই বা দিনের পর দিন কাটানো যায় কেমন করে, অভয় জানে না। সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, কিন্তু কিছু হল না গণেশদা। আমরা খাব-দাব বসে থাকব, ওদিকে লোকগুলোনও বেকার হয়ে যাবে। আমরা কোনও খবর পাব?

না পাওয়ারই সম্ভাবনা।

এ সব চিন্তার পরেই, জেলখানার নিরন্তর অবসরের বিস্তৃত দীর্ঘ সময় ভরে শুধু নিমির কথা মনে পড়ে। সে কথা গণেশকে বলতে লজ্জা পায় অভয়। সন্ধ্যার পরেই নিশি-পাওয়া বাতাসে শোনা যায়, নিমির চুপিচুপি স্বর, তুমি আমাকে একটু ভালবাসনিকো?

মহকুমা জেলের সামনেই রেল স্টেশন। সারাদিন ধরে সেখানে রেলগাড়ির যাতায়াত স্পষ্ট শোনা যায়। বড় রাস্তার উপর দিয়ে মোটর গাড়ি যায়। সাইকেল রিকশার ভেঁপু বাজে। সাইকেলের ঘণ্টা শোনা যায়। অনেক সময়, রাস্তার মানুষের গলার স্বরও ভেসে আসে। তখন বড় খারাপ লাগে। এত কাছে, তবু কত দূরে। স্বপ্নের মতো। চোখের আড়ালে, ওই শব্দগুলি যেন সত্যি নয়। যেন অভয়ের কল্পনায় বাজে। গভীর রাত্রির বুকে শুধু বুটের শব্দ শোনা যায় খট-খট, খট-খট।

পাঁচ দিন পরে, অভয় আর গণেশকে নিয়ে আবার একটা জালে-ঘেরা গাড়ি কলকাতায় চলে। গেল।

কলকাতার এ জেলখানা অনেক বড়। পাঁচিল-ঘেরা অন্য এক রাজ্য। এ যেন কয়েদ-শহর। বড় অফিস ঘরের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা জেলের ভিতর দিকে গেছে, সে যে কত সর্পিল ও জটিল, কে জানে। অভয় তাদের বড় ওয়ার্ডঘরের জানালা দিয়ে কোনওদিন তার হদিস পায় না। কত যেন রহস্য, কত যেন আজব অজানা কাণ্ডকারখানা ঘটেছে এর ভিতরে। সামনের রাস্তাটায় সেই আজব অজানা রহস্যের দুর্বোধ্য প্রতাঁকের মতো শুধু রুল কিংবা খাতা হাতে ব্যস্ত সেপাইরা যাতায়াত করে। নানান পোশাকে নানান লোকের আনাগোনা। তারা শুধু জেলের অফিসার নয়। সাদা পোশাকের লোক আছে–জেলের মধ্যে যাদের বেমানান লাগে। সরু নীল ডোরাকাটা হাফ-হাতা জামা গায়ে দেওয়া কয়েদিরা চলাফেরা করে। যেন ওরা কয়েদি নয়, চটকলের সাহেবদের বেয়ারা-পিওনদের মতো ইউনিফর্ম পরে, ফাইল বয়ে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে ভারী বুটের ঐক্যতানে ওয়ার্ডাররা মার্চ করে যায়।

কিন্তু রেলগাড়ির শব্দ শোনা যায় না এখানে। এখানে কাছাকাছি রেলস্টেশন হয়তো নেই। কোনওদিন জিজ্ঞেস করে না অভয়। রাস্তার গাড়ি ঘোড়ার শব্দ পৌঁছয় না এখানে, মফস্বলের জেলের মতো। বাইরের লোকের গলার স্বর বোধহয় এ বড় পাঁচিল ডিঙোতে পারে না। জেলের ভিতরের রাস্তাটাও ওয়ার্ড থেকে দূরে। শব্দের চেয়ে চলমান ছবিটাই ধরা পড়ে শুধু। কথা শোনা যায় শুধু নিজেদের।

অভয়েরা নিজেরাও সংখ্যায় কিছু কম নয়! তাদের ওয়ার্ডেও প্রায় জনা সাতাশ আটাশ লোক আছে, যারা সকলেই চটকলের লোক, কিংবা চটকলে ট্রেড ইউনিয়ন করে। প্রায় একই সময়ে সকলে ধরা পড়েছে। কেউ এসেছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বজবজ অঞ্চল থেকে, কেউ পুব-দক্ষিণের বাউড়িয়া-চেঙ্গাইল থেকে। কেউ কেউ হুগলি আর বারাকপুর অঞ্চলের টিটাগড়-জগদ্দল এলাকা থেকে। কারুর কারুর পরিচয় ছিল আগেই। নতুন করে পরিচয় হয়েছে। অনেকের। মোটামুটি সকলের সঙ্গেই সকলের জানাশোনা। নীচের-তলা ওপর-তলার দুটি ওয়ার্ডে সকলের বাস। জেলের সেপাইরা ওয়ার্ড বলে না। বলে অমুক নম্বর খাতা। যদিও সেখানে আরও অনেক ঘর আছে। কিন্তু সে সব ঘরই প্রায়ই তালা বন্ধ।

এখানে অনাথ নেই। কেউ কেউ বলে, তাকে নাকি কলকাতার আর একটা বড় জেলে রাখা হয়েছে। সেখানেও এরকম অনেক আছে। দমদমের জেলেও নাকি চটকলের বন্দিরা আছে।

অনেক লোক এখানে, তারা নানা রকমের মানুষ! জেলখানার দূর-অভ্যন্তরের এ মহল সব সময়েই কলরব-মুখর। শনিবার সন্ধ্যা আর রবিবারের সারা বেলার ছুটির মতো। তাস খেলা, গান, গল্প আর ফালতুদের সঙ্গে মিশে রান্নার যজ্ঞ উৎসব। ফালতু হল সেই সব কয়েদিরা, যারা চোর পকেটমার প্রতারক। তাদের মধ্যে চাকর-বাকরের কাজ করে, তারা যেন হিসেবের উর্ধ্বে ফালতু। তারা সব কাজ করে। অভয়দের সব কিছু তারা করে দেয়। সকালবেলা আসে, সন্ধ্যাবেলায় চলে যায়। কোথায় তাদের নিয়ে যায় সেপাইরা, কে জানে। চোর ডাকাত পকেটমার বলে তাদের গায়ে লেখা থাকে না বটে। জেলখানার পোশাকে তাদের এক ভিন্ন জগতের মানুষ বলে মনে হয়। কিন্তু। তাদের কথা শুনলে কিছু বোঝা যায় না। তারাও হাসে, কথা বলে, কাজ করে। অনেকে ভাল কথা। বলে, বুদ্ধিমান মনে হয়। অভয়ের চেয়েও বেশি বই পড়তে পারে। সংসারে অনেক কিছু দেখা শোনা জানা অভিজ্ঞ লোক আছে তাদের মধ্যে। তারা যে নিজেদের কিছু ছোট জ্ঞান করে, এই আটক আইনে বন্দিদের ভক্তি করে কিংবা তাদের রান্না করে, কাজ করে কৃতার্থ হয়, তা মোটেও না। যদিও স্বয়ং গণেশবাবু এবং অভয়ের অন্যান্য সঙ্গীদের অনেকের সেই বিশ্বাস রয়েছে। অভয়ের মনে। হয়, জেলখানার শাস্তির ভয় না থাকলে, তারা কখনও এই চাকরবৃত্তি করত না। কেউ কেউ হয়তো। ভাল মন্দ খাবার জোটে বলে একটু খুশি। কিন্তু খুশির চেয়ে ঈর্ষা তাদের বেশি। তাদের ঠোঁটের কোণে কেমন একটা চাপা হাসির বাঁকা ছুরি সব সময় ঝলক দেয়। ঔদ্ধত্য চাপা থাকে না সব সময়। মাঝে মাঝে প্রকাশ হয়ে পড়ে। যেন আপন মনেই খেঁকিয়ে ওঠে, শালা, বাবাকেলে গোলাম পেয়েছে আমাদের। তা ছাড়া মুখ খারাপ তারা অনবরতই করে। চটকলের মিস্তিরিদের এ বিষয়ে বিশেষ খ্যাতি আছে। কিন্তু ফালতুরা খিস্তি খেউড়ে তাদেরও ছাড়িয়ে যায়। অবশ্য এদের মধ্যে গুরুগম্ভীর চুপচাপ লোকও আছে। হাসে না, কথা বলে না। শুধু কাজ করে। তাদের ব্যক্তিত্ব কেমন একটা সমীহ জাগায়।

অনেক লোক, অনেক কলরব। কিন্তু অভয়ের ভয় হয়, সে বুঝি একলা হয়ে যাচ্ছে। নিঃসঙ্গ-বিষণ্ণতা যেন তাকে সকলের কাছ থেকে দূরে রাখতে চায়। তার মনে হয়, জেলের মধ্যে একটি অদৃশ্য আত্মা আছে। যদিও সে অশরীরী, তবু তার আছে দুটি ক্রুর কিন্তু শ্লেষ-হাসি-ঝলকানো। চোখ। নিঃসঙ্গতা যখন মনের মধ্যে বাড়ে, রাত্রে যখন বাতি নিভে যায়, তখন সে আসে। সে ঘুমোতে দেয় না। অন্ধকারে, দিনের বেলায় আলোতেও সে আসে। সে তাকে নিঃসঙ্গ করে, শ্বাসরুদ্ধ করে টুটি টিপে মারতে আসে বুঝি।

অভয় জানে, এটা কিছুই নয়। এই অচেনা রাজ্যে নির্বাসনের ভয় ওটা। এই নির্বাসনে নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলি সবচেয়ে ভয়ংকর। সে জন্য সে প্রথম কিছুদিন সব সময় ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করে। খবরের কাগজ পড়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। যদিও খবরের কাগজগুলিতে তাদের সংবাদ একটুও থাকে না। চটকলগুলিতে কী ঘটেছে, কিছুই জানবার উপায় নেই। এত লোক যে গ্রেপ্তার হয়েছে, জেলবন্দি রয়েছে, খবরের কাগজগুলি পড়লে, সে সংবাদ একটুও জানা যায় না। কিন্তু ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সংবাদ থাকে। সংবাদ থাকে চেম্বার অব কমার্সের। নতুন মেশিনের গুণগান। আর ন্যাশনালাইজেশনের জন্য কর্তৃপক্ষ কতখানি চিন্তিত, সেই সংবাদ।

খবরের কাগজ পড়ে, কিন্তু ভাল লাগে না। গণেশ তাকে অনেক বই এনে দিয়েছে পড়বার জন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার বই। নজরুল, সত্যেন্দ্রনাথ, আরও অনেক কবির বই। গণেশ যেগুলি সংগ্রহ করে দেয়, তার সবই প্রায় দেশাত্মবোধক। অভয়ের ধারণা, এঁরা শুধু এ সবই লিখেছেন। এ সব কবিতার জন্যই এঁরা মহৎসাম্প্রতিক কবিদের কবিতা অভয় একটুও বুঝতে পারে না। শব্দ উচ্চারণ করেও গোলকধাঁধায় পড়ে যায়। আর অন্যান্য কবিতা, যেগুলি সে ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে পড়তে পারে, তাল দিতে পারে, তাও সব সময় বুঝতে পারে না। তবু যখন সে পড়ে, হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার। সমান-তখন তার গায়ের মধ্যে কাঁটা দিয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, নজরুল, এঁদের এক একটি কবিতা পড়া সাঙ্গ হয়। অভয়ের যেন নব নব জন্মলাভ ঘটে। প্রত্যেকটিই নতুন নতুন আবিষ্কার। নতুন উন্মাদনা, নতুন চাঞ্চল্য। ভাবে, এমন কি আমি কোনওদিন পারব? এত কথা মানুষ জানে? এমন করে লিখতে পারে? কিন্তু আমি তো লিখিনে। আমি বাঁধি ; আমি কথা বাঁধি। লেখা আর বাঁধা, কত তফাত।

গণেশ বলে, দেখবেন, পাগল হয়ে যাবেন না আবার ভাবতে ভাবতে। পড়তে পড়তে আপনিও একদিন পারবেন।

গণেশের মুখের দিকে তাকিয়ে কোনও আশ্বাস পায় না অভয়। সে বোঝে গণেশ তাকে শুধু সান্ত্বনা দেয়। টেবিলের ওপর মোটা মোটা বইয়ের আড়াল থেকে, গণেশবাবুর ঠোঁটে যে-হাসিটুকু। দেখা যায়, তার মধ্যে কোনও উচ্ছ্বাস নেই। কেমন একটি বিস্ময় যেন প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো লতিয়ে বেঁকে থাকে। সেটা অবিশ্বাস না সন্দেহ, বোঝা যায় না। অভয়ের অস্বস্তি হয়।

গণেশ আবার বলে, মানুষ সবই পারে। তা ছাড়া, আপনি তো কবি নন, কবিয়াল। আপনি ওঁদের মতো ভাষার কারিগরি করতে চাইবেন কেন?

অভয় বলে, ওটা ঠিক নয় গণেশদা। যিনি কেষ্ট, তিনিই শিব। আমার অত শিক্ষা নাই, তাই পারি না। কাজটা আসলে এক।

গণেশ বলে, রবীন্দ্রনাথের মতো আপনার গানের কথা হলে লোকে আর কবিগান শুনবে না। রবি ঠাকুরের গানই শুনবে।

গণেশের মুখের ওপর প্রতিবাদ করতে সাহস হয় না অভয়ের। কারণ, কী বলতে হবে, সে জানে না। কিন্তু প্রতিবাদ ফোটে তার চাউনিতে। তার নিঃশব্দ আড়ষ্টতায় চমকে থাকে অবিশ্বাস। অত বড় শিক্ষিত লোক গণেশবাবু। গোবর্ধন ডাক্তারবাবুর ছেলে। যা মুখে আসে, তাই কি বলা যায়? তাই সে একটু সঙ্কোচ করে বলে, কিন্তু গণেশদা, নামকরা কবিয়ালদের কথা কত সুন্দর হয়। এক এক সময় তাদের কথাও বড় বড় কবিদের মতন লাগে। কথা সুন্দর হলে সবই সুন্দর হয়।

গণেশ জোরে জোরে মাথা নাড়ে। বলে, উঁহু, তা হয় না। কবিগান সে কবিগান। তার সঙ্গে তানপুরা তবলা এস্রাজ হলে কি চলে? ঢোলক কাঁসিই বাজবে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা হলে চলবে না। ওই সেই গ্রাম্য কিংবা অশিক্ষিত লোকেদের আসরে

 কথাটা বলতে বলতে থেমে যায় গণেশ। সেও যেন কেমন একটু অস্বস্তি বোধ করে। কিন্তু তার আসল কথাটি চাপা থাকে না। বক্তব্য পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

অভয়ের কষ্ট হয়। ফিক ব্যথার মতো, তার বুকের মধ্যে গণেশের কথাগুলি বিধে থাকে। সে বোঝে, পংক্তি হিসেবে, অভয়দের বিশেষ একটি জায়গা নির্দেশ করে দেওয়া আছে। সে ঘেরাও থেকে যেন ভদ্রলোকদের সমাজ কোনওদিন মুক্তি দেবে না। রবীন্দ্রনাথদের সব সময় দূরে রাখবে। যেন অভয়েরা চেষ্টা না করে ওদিকে যাবার। কারণ, ওই জগৎ ভিন্ন, সেখানে অভয়দের প্রবেশাধিকার নেই।

অভয় বলে, এ জন্যেই লোকে আর কবিগান শুনতে চায় না গণেশদা।

কী জন্য?

–আমরা বড় বড় কবিদের মতন কথা বাঁধতে পারি না, তাই। আমরা শিখি না, বুঝি না। শিখলে বুঝলে, মনের মতন জিনিসটি দিলে সকলের টনক নড়ে।

গণেশ মাথা নেড়ে বলে, মানতে পারিনে। যাত্রা যাত্রা-ই। থিয়েটার থিয়েটার। যাত্রাকে কি থিয়েটার হলে চলে?

গণেশের কথায় ও ভাবে, এমন একটি তীক্ষ্ণ ধার থাকে–আর কথা বলতে পারে না অভয়। কথা বোঝাবার কথাও জোটে না। প্রতিবাদের কাঁটাটা ঠিক খোঁচা হয়ে থাকে মনের মধ্যে। সে চুপ করে, ভাবে। কিন্তু কতটুকু সময়? আস্তে আস্তে আবার সেই ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গতার কষ্ট যেন গুঁড়ি মেরে তার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। জড়িয়ে বাঁধতে থাকে পাকে পাকে। সে টের পায়, কোথাও তার যাবার জায়গা নেই। এখানেই তাকে আশেপাশে পাক খেয়ে মরতে হবে। আর সেই চোখ দুটি ভেসে উঠবে তার চোখের সামনে। জানাতে থাকবে, জেলখানা। এটা জেলখানা। তারপরেই সেই অসহ্য কষ্ট উপস্থিত হয়। সে দেখতে পায়, নিমি তার সামনে দাঁড়িয়ে। বাসি চুল, স্বলিত কাপড়! নিমির চোখে জল নেই, নিশ্বাস পড়ে না। ভারী অবাক হয়ে, বড় কষ্টে জিজ্ঞেস করছে–আমাকে তুমি একটুও ভালবাসনিকো?

অভয় সহসা হাত দিয়ে স্পর্শ করতে যায় নিমিকে। ফিসফিস করে বলে, এমন কথা বলিস তুই নিমি? নিমি! নিমি!

লুকিয়ে, চুরি করে যেন সে নিমিকে ডাকতে থাকে। তারপরে তার বুকের ভিতর থেকে, কথারা উঠে আসতে থাকে সুর সায়রে ডুব দিতে দিতে। সে গুনগুনিয়ে ওঠে। ৬০৪

আমি তোমা ছাড়া জানি না গো,
তুমি তা জান না।
হায় বাদীকে বিবাদী করে।
উল্টো সাজা দিলে মোরে।
আমার ব্যথা কেউ বোঝে না।

 কথাগুলি সে অনেকক্ষণ ধরে গুনগুন করে। সুরের কোনও ঠিক থাকে না। নানান সুরে গায়। আস্তে আস্তে তার মনে প্রসন্নতা আসে। কথা কয়টি তৈরি করে যেন তার বদ্ধ আবর্তিত মন মুক্তি পায়। সে সকলের সঙ্গে ডেকে কথা বলে। তাস খেলার আসরে গিয়ে বসে। গল্প গুজবে যোগ। দেয়। যদিও ও সবে তার মনে কোনও সাড়া জাগে না। চটকলের মিস্তিরি, তাঁতি, স্পিনার আর ট্রেড-ইউনিয়নের কর্মীরা ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজে, দাড়ি কামায়, সাবান দিয়ে চান করে, মাথায় গন্ধ তেল। মাখে। ঠোঁটে ঠোঁটে সিগারেট! ফালতুরা রান্না করে। বন্দিরা যেন এখানে বিশ্রাম করতে এসেছে। গা ঢেলে আরাম করছে। কাজ-কর্মহীন আয়েশে, যেন বেশ আছে। মুক্ত পাখিরা যে পিঞ্জরে আছে, দেখলে বোঝা যায় না। যদিও দুভাগে বিভক্ত হয়ে, সপ্তাহে তিন দিন ট্রেড ইউনিয়ন শিক্ষার আসর বসে। রাজনৈতিক আলোচনা হয়। প্রতিদিন কিছু পড়াশুনো করা বাধ্যতামূলক। তবু অভয়ের ভাল লাগে না। সব যেন কেমন প্রাণহীন। যন্ত্রের মতো। একই নিয়মে শুরু ও শেষ, একঘেয়ে, একই জিনিস, একই মাপ। দুই আর দুইয়ে চার। এই কবাট বন্ধ জেলখানায় তা কখনও সৃষ্টির মহিমায় পাঁচ হয়ে ওঠে না।

কথা তৈরির আনন্দ সুরের রেশ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। সময় এখানে অসীম সমুদ্রের মত। যে সমুদ্রে দিন রাত্রির আলোকালোর কোনও ছায়া পড়ে না। তীব্র নেশার পর, ঘুম ঘুম ভোয়ারির মতো। স্তব্ধ ও মৌন নয়, অস্ফুট, জড়ানো কষ্টকর গোঙা একটা স্বর যেন বাজতে থাকে।

কাজ যদি বা তৈরি করা যায়, ইচ্ছে করে না। দিনে দিনে তাই বই পড়া কমে আসে অভয়ের। ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস পড়ে থাকে বিছানায়। ধন বৈষম্যের গোড়ার কথা পড়ার বাধ্যবাধকতা তাকে বিদ্রোহী করে তোলে। একই জিনিস বারে বারে মুখস্থ করতে তার ভাল লাগে না। তার জানবার কৌতূহল, আগ্রহ, উৎসাহ, সব যেন বন্দি হয়ে আছে মনের কোনও চোর কুঠুরিতে। এই জেলখানায় তার নিজের কয়েদ হওয়ার মতোই। মনের এ বন্দিদশা ঘুচিয়ে গান তৈরি করতেও আর পারে না সে। যে ঝলক লেগে, কথা আপনি আপন উৎসে কলকলিয়ে ওঠে, সে ঝলক লাগে। না কখনও-সখনও সে ঝলকে ওঠে। ক্ষণিকের জন্য, বিষ-দরদ ঘুমঘরে। একবার চকিতে চোখ মেলে তাকাবার মতো। পর মুহূর্তেই আবার জেলের কুৎসিত ভয়াবহ নিস্তরঙ্গ অশেষ সময়ে হারিয়ে যায়।

একদিন সাপ্তাহিক ট্রেড ইউনিয়ন শিক্ষার আসরে অভয় জিজ্ঞেস করে, চটকলে তো আমরা কোম্পানির কাছে একখানি ন্যায্য দাবি করেছিলুম। সরকারের নয়। তবে সরকার কেন আমাদের। জেলে পুরল?

প্রশ্ন শুনে গণেশ খুব খুশি হল। সে প্রশংসা করল অভয়ের। এই হচ্ছে খাঁটি প্রশ্ন। চিন্তাশীল সংগ্রামী মানুষের জিজ্ঞাসা। সে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাখ্যা করল, সরকার ও মালিকের সম্পর্ক। মালিকের স্বার্থই শুধু সরকার দেখে। এইটিই এ সরকারের শ্রেণী-চরিত্র।

কিন্তু রাত্রে এ কথারই সূত্র ধরে গণেশ অভয়ের ভাবনার বৈষম্য ধরা পড়ে গেল। শুতে যাবার আগে, গণেশ এল অভয়ের কাছে। গণেশ বলল, বুঝলেন অভয়দা, সহজ প্রশ্নের সব জটিল দিকগুলো রয়ে গেছে। এ সবই হচ্ছে প্রাথমিক রাজনৈতিক চিন্তা। হঠাৎ আপনার মাথায় আজকেই এ চিন্তাটা ঢুকল কেমন করে?

অভয় তাকিয়েছিল বাইরের দিকে। জেলখানার মাঠ, মাঠের পরে পুকুর। সেখানে আলোর ছায়া কাঁপছে। হেমন্তের আকাশ ভরে তারা। অভয় মুখ না ফিরিয়েই জবাব দিল, ভাবতে ভাবতে।

গণেশ অবাক হয়ে বলল, কী ভাবতে ভাবতে?

অভয় বলল, এই জেলে থাকার কষ্ট।

গণেশ যেন হতাশ হল। বলল, শুধু কষ্ট অভয়দা? আমি ভেবেছিলাম আপনি রাজনৈতিক চিন্তা করে, এ প্রশ্ন করেছেন।

অভয় বলল, না। আমি আর এই কয়েদ-থাকার কষ্ট সইতে পারি না গণেশদা। তাই এ ভাবনাটা আমার মাথায় এল।

গণেশের ভ্রূ একটু কুঁচকে উঠল। বলল, দিন-রাত্রি এ কষ্টের কথাই ভাবেন বুঝি?

–হ্যাঁ!

–তবে আর অত গান তৈরি, শ্রমিক আন্দোলন, ও সব করতে এসেছিলেন কেন? দিন রাত্রি যদি কষ্টই হবে, সইতে পারবেন না, সব কি আপনি-আপনি হবে? এ সব হবেই, তা বলে এ কষ্টকে কষ্ট বলে মনে করলে চলবে না। মনকে শক্ত করুন। আপনি তো মাত্র কয়েক মাস এসেছেন। আর যারা বছরের পর বছর জেলে কাটিয়েছে তাদের কথা ভাবুন তো?

অভয় বলল, সইতে তো হচ্ছেই। কিন্তু কষ্ট যে হয় গণেশদা আমি কী করব?–মন থেকে ঝেড়ে ফেলবার জায়গা পাই না আমি। পারলে বুঝি আমি পালিয়ে যেতুম।

গণেশের ঠোঁট কোন শ্লেষে বেঁকে উঠল। বলল, বউয়ের কথা মনে পড়ে বুঝি?

শোনা মাত্র নিমিকে চোখের সামনে দেখতে পেল অভয়। সে যেন চাপা গলায় বলল, হ্যাঁ গণেশদা। বড় লজ্জা লাগে বলতে। নিমিকে বড় মনে পড়ে। নিমিকে মনে পড়লে বাড়ির কথা মনে পড়ে, শহরটার কথা মনে পড়ে। আমাদের গাঁয়ের কথা মনে পড়ে, মায়ের কথা মনে পড়ে। আমার ছোটকালের কথা মনে পড়ে। নিমির ছেলে হবে গণেশদা। কিন্তু নিজের জীবন, ছেলের জীবন, ও সবে কোনও মায়া দয়া নাই নিমির। ও মেয়েমানুষটা কেমন জানেন গণেশদা? মাটিতে শুধু শিকড়খানিই আছে, কিন্তু ও লতা মাটিতে খেলতে পারে না। মনের মতন গাছটাকে পেয়ে সে বাঁচে, না পেলে মরে। বড় ভালবাসার কাঙাল, তা নিয়ে ঝগড়া বিবাদেও পেছ-পা নয়। মনে করে আমি বুঝি কিছু রেখে ঢেকে দিই, তাই সাধ মেটে না। সত্যি-মিথ্যে জানি না, এক এক সময় ভাবি কী যে, সত্যি কি কিছু রেখে ঢেকে রেখেছি? তা কী কখনও হয়? আমি তো রাখা-ঢাকা জানি না।

গণেশ হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে বিতৃষ্ণা, ঠোঁটে বিদ্রূপ। বলল, বুঝেছি। আপনার কবিয়ালি করাই উচিত ছিল। এ সব পথে আসা উচিত হয়নি।

-কোন সব পথে গণেশদা?

–এই আন্দোলনের পথে।

বলে গণেশ চলে গেল।

.

 ১৩.

গণেশের কথাটা মেনে নিতে পারল না অভয়। আন্দোলনের পথে তো তাকে গণেশবাবু ডেকে আনেননি! সে নিজেই এসেছিল। অনাথ খুড়ো তাকে পথ দেখিয়েছিল। জীবনের যন্ত্রণা সব তো ভুলে যায়নি সে।

সে চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। মাঝে মাঝে প্রহরীদের রাত জাগানিয়া ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি শোনা যায়। এই ওয়ার্ডের বাইরে, বুটের খট খট শব্দ বাজে। দক্ষিণ দিকের বড় বট গাছে, আর ঘোড়া নিমের ঝুপসিতে পাখিরা ডেকে ওঠে মাঝে মাঝে।

অভয় শুয়ে পড়ে। সুরীনকাকাকে দেখা করবার অনুমতি দেয়নি জেল কর্তৃপক্ষ। নিমি আসন্ন-প্রসবা। তাই তার আসা সম্ভব নয়। অভয় চিঠি লেখে নিমিকে। নিমি লিখতে পারে না তাই জবাব আসে না।

তারপরেই, অন্ধকারে নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে, অভয় লোহার খাটিয়াটার মধ্যে নিজেকে নিজেই পিষ্ট করতে থাকে। তার মুখ বিকৃত হয়, ঘামতে থাকে। যেন একটি অসহায় পশুর মতো, চারদিকে দাবাগ্নি দেখে সে পালাবার পথ খোঁজে। রক্তের প্রতিটি কোষ যেন অন্ধ জোঁকের মতো শুড় বাড়িয়ে বাড়িয়ে, নিমির সর্বাঙ্গ খুঁজে মরে। যত খোঁজে, ততই ঘৃণা হয় নিজের ওপর। কাকে যেন গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে করে। ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে ইচ্ছে করে গলা ফাটিয়ে। কেন মনে পড়ে? কেন এ আসক্তির সাপটা তাকে জড়িয়ে ছোবলায়? এখানে এত লোক। আমি কি তাদের মতই মানুষ নই?

তাকে খাটিয়া ছেড়ে উঠতে হয়। নিশির ডাকের মতো অন্ধকারে, জানালায় গিয়ে বসে সে। খুব আস্তে আস্তে গুনগুন করে ওঠে,

ওগো মুক্তি দাও।
এ আঁধার সইতে পারি না।
ওগো জালের বাঁধন ছাড়িয়ে নাও
এ যেন বিষম জীব-যন্ত্রণা।

গান শেষ হয়ে যায়। সুর করে সে বলতে থাকে শুধু, মুক্তি দাও! মুক্তি দাও! তারপরে এক সময় তার ঘুম আসে। ভোররাত্রের বাতাসে শরীরটা ঠাণ্ডা বোধ হয়।

ঘণ্টা দুয়েক পরেই আবার ঘুম ভাঙে। সেই লোকটি গান আরম্ভ করে দু টুকরো লোহা বাজিয়ে বাজিয়ে। টুং ঠুং তালে তালে, মোটা গম্ভীর গলায়, ওয়ার্ডের বাইরে, ঘোড়া-নিমের গোড়ায় বসে গায় লোকটা। সাদা চুল, কালো রং, জগদ্দলের একজন শপঘরের মজুর। কখনও সে ভজন গায়। কখনও তুলসীদাসের রামায়ণ। অধিকাংশ সময়েই বিরহীর সুর ধরে, কথা সে তৈরি করে গায়।

বরষো যিতিনি চাহ হে।
আশমানমে সুরুজ হায় বারবার।
পাপকো ফির রোশনাই কা হো।
তেরা দিল-হাভেলীভর আন্ধার।

নাম ওর শোহর। আরও কয়েকবার জেল খেটেছে। স্ত্রীপুত্র কিছু নেই। খুব আমুদেও নয়। বরং একটু লোকজন এড়িয়েই থাকে ; অথচ কারখানায় কাজ করে যা পায়, খোরাকি পোশাকি খানিকটা নির্বিকার বলা যায়। মাস গেলে জেলের চল্লিশ টাকা হাত খরচা পায়। ওর খরচ কেবল একটি কাপড় কাঁচা সাবান, কিছু নিম কাটি। বাকি টাকা দিয়ে সবাইকে বই বিড়ি সিগারেট কিনে দেয়।

অভয়ের সঙ্গে তার ভাব হয়েছে প্রথম থেকেই। শোহর একদিন সন্ধ্যাবেলা টেনে টেনে শৈব্যা আর রোহিতাশ্বের উপাখ্যান গাইছিল। বোধহয় সে নিজেও কাঁদছিল, যখন সে বারে বারে বলছিল,

হায় জীয়ে ন বেটা
মেরি লাল রোহিতাস!

অভয় সামলাতে পারেনি। তার চোখে জল এসে পড়েছিল। সে শোহরের পাশে এসে বসেছিল। অন্ধকার ছিল সেখানে। বুড়ো শোহরের গান শুনতে শ্রোতার ভিড় ছিল না নিমগাছের গোড়ায়। সকলেই ওয়ার্ডে ও কিচেনে ব্যস্ত ছিল।

গান শেষে শোহর গায়ে হাত দিয়েছিল অভয়ের। অভয় তার হাত ধরে বলেছিল, তুমি সত্যিকারের গায়েন শোহর ভাই। তুমি মানুষকে হাসাতে কাঁদাতে পারো।

শোহর বলেছিল, উসসে বড়া উ আদমি, গানা শুনকর যো আদমি কে দিল আপনে হি রোতা, আপনে হি হাসতা। কাঁহে? না, উনকে দিল সাচ্চা।

অভয় বলেছিল, কথায় হার মানলাম ভাই শোহর। তুমি আমার চেয়ে বড় কবিয়াল। শাকরেদ করে নাও আমাকে।

শোহর বলেছিল, হম দুনো দুনো কি শাকরেদ। মগর, এ মরদ, তুমতো গলে মে দুখ আওয়াজ দেতেঁ হ্যায়। ক্যায়া, কিসিকো ছোড়কে আয়া?

–হ্যাঁ, ভাই শোহর। এখানে সবাই তো ছেড়ে এসেছে।

শোহর বলেছিল, দেখো ভাই বাঙালি কবি, তুম জানতে হ্যায় কি, দুনিয়া মে এয়সা কারণ ভি হোতি হ্যায়, জিস কো কানুন সে ভাগ নহি কিয়া যাতা। হ্যায় না? বাত ঠিক, সব কোই ছোড়কে আয়া, তুম ভি ছোড়কে আয়া। মগর তুমকো দেখকর মালুম হোত, তুম জঙ্গলা কি হরিণা। তুমকো দুখ এঁহা কোই ন সমঝেগা। কাহে? না, সবকোই বহু বালবাচ্চা ছোড়কে আয়া। অর তুম হরিণা আয়া হ্যায় জঙ্গল ছোড়কে। মছলি গিরা ডাঙে পর।

দোনো মে ফারাক হ্যায় ভাই। জিনকো দিল চায়ে, ভজো। মহব্বত কি আন্ধার ভজন মে ছুটতি। হরতাল শ আদমি মানাতা, দিলকে সাথ মোকবিলা একলা হি করনে হোতা!

এই শোহর বুড়ো ছাড়া অভয়ের মনের মানুষ নেই। তাকে সে তার মনের কথা বলে। রাত্রের সেই রক্ত-খেকো কানা জোঁকটার কথাও বলে। শোহর বলে, সেটা পাপ নয়, ওটাই প্রেমের রীতি। আরও বলে, প্রেম যে দুঃখ। সেই দুঃখকেই তুমি ভজ, সে আনন্দ হয়ে উঠবে বলে, এ তো দুশমনের সঙ্গে লড়াই নয়! প্রেম করলে সবাইকেই কাঁদতে হয়! আর তা ছাড়া তোমাকে আমাকে কে কাঁদাবে?

ঘুম ভেঙে শোহরের কাছে গিয়ে বসে। কথা হয় না। দৃষ্টি ও হাসি বিনিময় হয়। গান শেষ হলে শোহর বেশ রসিয়ে ঠাট্টা করে, নিমি বেটি তুমকো বহুত জখম করতা। এক রোজ উনকো পুরা কজা মিটানে হোগি।

বলে হো হো করে হাসে।

চার মাস শেষ হল। একদিন দুপুরে একটি চিঠি এল সুরীনখুড়োর কাছ থেকে। নিজের হাতে লেখা নয়। কাউকে দিয়ে লেখানো। শুধু দু লাইন লেখা, নিমির একটি ছেলে হইয়াছে। কোনও চিন্তার কারণ নাই। তোমার চিঠি নিমি পাইয়া থাকে।

 অভয়কে সবাই ধরল, খাওয়াতে হবে। হাত খরচের টাকাটা তখনও কিছু ছিল। বিকেলে জেলের কনট্রাক্টরের দোকান থেকে বিস্কুট, লজেন্স কিনে আনা হল। সবাইকে সিগারেট খাওয়াল।

শোহর তার লোহার টুকরো বাজিয়ে বাজিয়ে গাইল,

বনবাস মে বনফুল উজারা দুনো,
নাম লব কুশ
হাই রাম! পিতা কো নয়ন গোচরে ন হো।

অভয়ের বুকের মধ্যে টনটন করে উঠল গান শুনে। নিমির শেষ কথা তার মনে পড়ল, আমাকে একটুও ভালসনিকো? আমি কি বনবাস দিয়ে এসেছি নিমিকে? সংসারে জীবন মরণের প্রশ্ন নেই? আমার বসে থাকবার উপায় ছিল না। জীবন আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তাতে আমারও কষ্ট। নিমিকে বা আমি বনবাস দেব কেন?

অভয়ও গান গেয়ে উঠল—

তুমি তো অন্ধ নও হে জীবন।
আমি জানি না কোথা আছে শমন মরণ।
জীবন, আমি তোমাকে ঘিরে মরি হে।

দিনে দিনে, একটু একটু করে, মনের মধ্যে একটি প্রতীক্ষার ধৈর্য এল অভয়ের। মনের মধ্যে একটি ব্যথিত শান্ত স্নিগ্ধ মৌনতা এল–তার অস্থির যন্ত্রণার স্থানে।

কিন্তু গণেশের সঙ্গে একটা বিশেষ দূরত্ব দেখা দিল। বিশেষ করে দু একটি ঘটনায়। একদিন নিমগাছের গোড়ায় বসে, শোহর বলল–জানো, জেলের এই গাছতলায়, এখানে মহাত্মা গান্ধীও বসতেন।

সত্যি? অভয়ের চোখের সামনে পত্রিকায় দেখা একটি ছবি ভেসে উঠল। গান্ধী হাত কপালে ছুঁইয়ে নমস্কার করছেন। নীচে লেখা ছিল, দরিদ্র নারায়ণ কো শ্রীচরণোমে।

সে একটু চুপ করে থেকে সহসা গেয়ে উঠল—

ধন্য আমি, তোমার পায়ের ধূলা পেলাম হে।
কোটি কোটি পোরণাম তোমার শ্রীচরণো মে।
হে মহাত্মা ভারত-পিতা তোমার ছায়ায় বসি হে।

গণেশ হো হো করে হাসল, কিন্তু কথা বলল না। এক সময়ে আড়ালে পেয়ে অভয়কে জিজ্ঞাসা করল, গান্ধীকে ভারত-পিতা বললেন কেন? এটা কি আপনার বিশ্বাস?

অভয় বলল, তা তো ভাবি নাই গণেশদা। কথাটা ভাল লাগল, বসিয়ে দিলাম।

গণেশ বলল, বড় অর্বাচীন শুনতে লাগে।

অভয় অবাচীন কথাটার মানে অস্পষ্টভাবে জানে। বলল, অর্বাচীন কী?

–এই আপনাদের সব কিছুই। মানে স্কুল। সব সময় নয়, মাঝে মাঝে। আপনাদের আবেগ একবার উথলে উঠলে আর সামলাতে পারেন না। আপনি কি গান্ধীর মত বিশ্বাস করেন? আপনি তো জাতীয় আন্দোলন আর শ্রমিক আন্দোলনের বই পড়েছেন। আপনার সঙ্গে গান্ধীর মেলে কি?

অভয় বলল, তা মেলে না। ছেলে সেয়ানা হলে, মায়ের সঙ্গে মতে মিলে না। তবু মায়ের কথা

গণেশ তীব্র হেসে ফিরে যেতে যেতে বলল, সেই আপনাদের এক কবিয়ালি ঢঙ।

অভয় বোঝে, এর বেশি তর্ক গণেশ করবে না। কিন্তু গান্ধীকে নিয়ে গান করলে কি অন্যায় হয়? অভয় থমকে গেল। সত্যি তাকে অসহায় আর অর্বাচীন মনে হতে লাগল! আর তার চোখের সামনে দরিদ্র নায়ারণকে প্রণামের মূর্তিটা ভাসতে লাগল।

আর একদিন। মেদিনীপুরবাসী এক জেল-ওয়ার্ডারের সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল অভয়ের। ওয়াডার ডিউটি ফাঁকি দিয়ে চলে যায় এক কোণে। অভয়ও সেখানে যায়। তারপর দুজনে কী যে কথা হয়, কেউ জানে না।

আসলে, লোকটি অভয়ের গান শোনে। অভয়কে সে গল্প বলে বাড়িতে তার বুড়ো বাপ-মায়ের কথা। তাদের জমি জিরেতের কথা, গরু বাছুরের কথা। আর আসল গল্প হল, বউয়ের কথা। বিয়ের পরে একবার মাত্র বউকে কাছে পেয়েছে সে। তারপরে এই জেলখানায়। বন্দির কুতা নয় বটে, তবে ওয়ার্ডারের এই ইউনিফর্মও এক রকমের বন্দির পোশাক। অল্প জমি, বছরের খোরাকি হয় না। নইলে সে কখনও এখানে আসত না।

অভয় তাকে গান শোনায়

বন্ধু, তোমার আমার একই দশা
জীবন-রাশির বাঁধা কষা।

কিন্তু একী! সকলেরই অশান্তি হতে থাকে। একজন ওয়ার্ডারের সঙ্গে একজন ডেটিনিউর এত ভাব কীসের? তাও আড়ালে আবডালে।

শেষ পর্যন্ত গণেশ সকলের সামনে, পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা জাহির করল অভয়ের ওপর। এমনকী, ওয়াডারটিকেও শাসিয়ে দিল, কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করবার ভয় দেখিয়ে।

অভয় অবাক, অবুঝ ব্যথায় চুপ করে রইল। শুধু শোহর বুড়োকে সে সব কথা বলল। শোহর তাকে বুঝিয়ে দিল। গণেশদের দোষ নেই। ওই সেপাইটা হয়তো ভালই। কিন্তু ও দুশমনের দলের লোক। আর সকলের মনে নানান চিন্তা হতে পারে।

মাস দশেক পরে অনেকেই ছাড়া পেয়ে গেল। গণেশও খালাস হয়ে গেল। গণেশ চলে যাওয়ায় অস্থিরতা দেখা দিল অভয়ের। শোহর চলে যাওয়ায় একেবারে নিঝুম হয়ে পড়ল সে। কিন্তু সে ভোগান্তি বেশি দিন ছিল না। বছর পূর্ণ হবার কয়েকদিন আগেই, খালাসের হুকুম এল অভয়ের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *