৩৮. সুবর্ণলতার আরো একটা আত্মজা

বকুলের এ প্রশ্নের প্রতিধ্বনি উঠেছে সুবর্ণলতার আরো একটা আত্মজার কণ্ঠে।…কিন্তু এইটাই কি চেয়েছিলাম আমরা? আমি, তুমি, আমাদের মা দিদিমা, দেশের অসংখ্য বন্দিনী মেয়ে? এটাই কি সেই স্বাধীনতার রূপ? যে স্বাধীনতার জন্যে একদা পরাধীন মেয়েরা পাথরে মাথা কুটেছে, নিরুচ্চার আর্তনাদে বিধাতাকে অভিসম্পাত করেছে? এ কি সেই মুক্তির আলো, যে মুক্তির আশায় লোহার কারাগারে শৃঙ্খলিতা মেয়েরা তপস্যা করেছে, প্রতীক্ষা করেছে?..না বকুল, এ আমরা চাইনি।

বকুলের সামনে টেবিলের ওপর যে খোলা চিঠিটা পড়ে রয়েছে, তার উপর পৃষ্ঠার এই কটা লাইনের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রয়েছে বকুল। যেন অক্ষর গুনে গুনে পড়ছে।

তারপর কলমটা তুলে নিল, নিল প্যাডটা। লিখতে লাগল আস্তে আস্তে।

কে জানে ওই চিঠিটারই জবাব দিচ্ছে, না নিজের প্রশ্নেরই জবাব খুঁজছে।

কিন্তু আমাদের চাওয়া নিয়েই কি পৃথিবী চলবে? এই অনন্তকালের পৃথিবী কখনো কি কারুর চাওয়ার মুখ চেয়ে চলেছে, চলার পথ বদল করেছে, অবহিত হতে থমকে দাঁড়িয়েছে?…প্রকৃতি তার অফুরন্ত সম্পদের ডালি নিয়ে যে ঋতুচক্রে আবর্তিত হচ্ছে, সে কি কারো চাওয়ার ওপর নির্ভর করে?..জগতে যা কিছু ঘটে চলেছে, সে কার ইচ্ছায়? যা কিছু অসঙ্গতি, যা কিছু ভালমন্দ, কার তপস্যায়, কার মাথা কোটায়? কারুর নয়, কারুর নয়, মানুষের ভূমিকা কাটা সৈনিকের।

আমরা ভেবে মরছি–আমি করছি, তুমি করছছ, ওরা করছে, এরা করছে, কিন্তু সেটা কি সত্যি?

পৃথিবী তার আপন নিয়মে চলে, প্রকৃতি তার আপন নিয়মে চলে, সমাজও তার আপন নিয়মে চলে। মানুষ সেখানে নিমিত্ত মাত্র। তবু মানুষ বদ্ধপরিকর হয়ে সংকল্প করে, এটাকে আমি নিয়ন্ত্রণ করবো। তাই অহরহই তোড়জোড়, অহরহই তাল ঠোকা আর অহরহই মাথা ঠোকা। ওই তাল ঠোকার দল আপন বুদ্ধির অহঙ্কারে সমাজের একটা ছাঁচ গড়ে ফেলে সেটাকেই চালাতে চায়, আর না চললে আর্তনাদ করে মরে, গেল গেল, সব রসাতলে গেল। যেমন বন্যায় যখন গ্রাম, নগর, ফসলের ক্ষেত ডোবে, আর্তনাদ ওঠে–গেল, সব গেল! কিন্তু ও আর্তনাদে মহাকালের কিছু যায় আসে না, পৃথিবীর কোথাও কোনো ক্ষতচিহ্ন থাকে না।

যা ক্ষতি, সে ক্ষতি ব্যক্তি-মানুষের। যা লাভ-লোকসান সে জনাকয়েক লোকের। তারা যেমনটি চেয়েছিল পেল না, যে জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল সেটা হলো না, সেটা ভেঙে গুঁড়া হয়ে গেল। শুধু এই। তার বেশি কিছু নয়। সেই ধ্বংসের ওপর আবার নতুন ফসল ফলে, আবার নতুন গ্রাম শহর গড়ে ওঠে।

আমরা আপন কল্পনায় সমাজের একটা ছাঁচ গড়েছিলাম। আমাদের সর্বাঙ্গের শৃঙ্খল যেখানে যেখানে অসহনীয় যন্ত্রণায় পীড়িত করেছে, সেখানটায় বন্ধন শিথিল করতে চেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম এই শেকলে নাটবন্টু কা স্কু এগুলো একটু আলগা হোক, কিন্তু আমাদের চাওয়াই তো শেষ চাওয়া নয়। আরো চাওয়ার পথ ধরে ওই শুকজা, নাটবগুলো খুলে খুলে ছিটকে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে।…যাবেই। কারণ আর এক নতুন ছাঁচ জন্মাবার অপেক্ষায় রয়েছে।

এইভাবেই এই অনন্তকালের পৃথিবীর অফুরন্ত জীবজগৎ মহাকালের খাজনা যুগিয়ে যাচ্ছে। তারা ভাবছে চেষ্টা করছে, প্রত্যাশা করছে, তপস্যা করছে, লড়াই করছে, তারপর কোথায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

তাই এক যুগে যা নিভুল ছাঁচ-পরবর্তী যুগে তা ভুলে ভর্তি। ক চিন্তাবিদের চিন্তার ফল, বহু কল্যাণকামীয় কল্যাণ চেষ্টা, আর বহু তাপসের তপস্যার ফল যে সমাজব্যবস্থা, তাকে দেখে দেখে পরবর্তীকাল ব্যঙ্গ করে, বিক্রপ করে, অবজ্ঞা করে।

ভাবে কি বোকা ছিল ওরা! কী মুখ্যু!

তবু সমাজ চিরদিনই জীবন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যাবে। কারুর চাওয়ার ধার পারবে না।

চিঠিই হয়তো লিখছে বকুল। তার সেজদি পারুলের চিঠির জবাব।

না হলে সামনের খোলা চিঠির পাতা ওল্টানো কেন? ওপিঠে যা লিখেছে পারুল, সেটা আবার একবার দেখতে বসলো কেন?

ভুল করে হয়তো উল্টো পিঠটা উল্টেছে বকুল, তাই আগের কথাগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছে না।

পারুল সব সময় ধরে ধরে পরিষ্কার করে লেখে, এখনো এই উত্তাল প্রশ্নেও তার হাতের লেখায় দ্রুতোর ছাপ তেমন নেই, যেমন থাকে বকুলের লেখায়। অনামিকা দেবী হয়ে অনেক লিখতে হয় বকুলকে, তাই ও যখন বকুলের কথা লিখতে বসে, তখন দ্রুততা আর ব্যস্ততার ছাপ।

পারুলের বাইরের জীবন চিরদিনই শান্ত ছন্দে আবর্তিত। শুধু পারুলের ভিতরের জীবন চির-অশান্ত।

তবু পারুল মুক্তোর মত অক্ষর লিখতে পারে। লিখেছে—

একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেল কিছুদিন আগে। তোকে ছাড়া আর কাকে বলব!

হঠাৎ খবর পেলাম শোভনের ভয়ানক অসুখ, অফিসে হঠাৎ চৈতন্য হারিয়ে চেয়ারেই পড়ে গিয়েছিল, হসপিটালে নিয়ে গেছে। অফিসেরই একটি চেনা ছেলে, আমি যখন একবার গিয়েছিলাম, মাসিমা, মাসিমা করত, খবরটা সে-ই পাঠিয়েছে।

বুঝতেই পারছিস, কী অবস্থায় কী ভাবে ছুটে গিয়েছি!

গিয়ে দেখি হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এনেছে।

আর দেখলাম রেখা সেবা করছে।

খবরটা ওকেও দিয়েছিল।

আমার ছুটে চলে যাবার জন্যে তো সঙ্গী যোগাড় করতে হয়েছিল, তার জন্যে যেটুকু দেরি হয়েছিল, ওর তো তা হয়নি। ও নিজেই চলে গেছে।

মানের অগোচর পাপ নেই বকুল, সেই প্রায়-অচৈতন্য ছেলেটাকে দেখেও আমার মন বলে উঠল, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য করেন, এ কথাটা কোনোদিন বিশ্বাস করতাম না, আজ করলাম। শোভনের এই মৃত্যুতুল্য অসুখই শোভনকে আবার জীবনের স্বাদ ফিরিয়ে দিল। অসুখের বদলে আবার সুখ ফিরে পেল শোভন।

মাতৃহৃদয়ের আকুলতা নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু মাতৃ-অধিকারের দাবি নিয়ে ছেলের শিয়রে বসতে গেলাম না। বহিরাগতের মতই শুধু কাছে একটু বসলাম, শুধু বউকে জিজ্ঞেস করলাম, কী অবস্থা, কী ওষুধ খাচ্ছে, ডাক্তার কী বললে, আবার ডাক্তার কখন আমাবে। জিজ্ঞেস করলাম ক’দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। জিজ্ঞেস করিনি-তুমি কবে এলে, কখন এলে?

যেন ও আছে।

যেমন বরাবর ছিল।

ওর আসনে গিয়ে ও যখন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন আর কেন মনে পড়িয়ে দিই, একদিন তুমি স্বেচ্ছায় এ আসন ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলে!

শোভনের তৃষিত দৃষ্টি যে সব সময় বউকেই খুঁজছে, এ নিয়ে মনে কোনো অভিমান জমে ওঠেনি বকুল, জমে ওঠেনি কোনো ক্ষোভ।

মনে হয়েছিল, বাচলাম। আমি বাঁচলাম।

ভালবাসার সত্যি চেহারা দেখে বাচলাম। বাঁচলাম বউমাকে আবার চাকর-চাকরকে বকতে দেখে, বাড়ি অগোছালো করে রেখেছে কেন বলে। বাঁচলাম বৌমা আবার রান্নাঘরে ভাড়ারঘরের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে।

শোভনের যা কিছু খাওয়ার দরকার বউমাই করে, এবং এমন নিপুণ ভাবে করে যে স্বীকার করতে লজ্জা হয় না, আমার দ্বারা এর সিকিও হতো না।

আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছিল লোভন, ওর মুখে নতুন স্বাস্থ্যের ও লাবণ্যের সঙ্গে যে আশা আর আনন্দের লাবণ্য ফুটে উঠেছিল সেটা দেখে বর্তে যাচ্ছিলাম।

বুঝলাম, বউয়ের আসা, দুজনের মধ্যেকার ভুল-বোম্বাবুঝির অবসান, এটাই ওর পক্ষে মৃতসঞ্জীবনীর কাজ করেছে।

ভাবলাম এবার পালাই।

বেশী স্বাদ পাবার লোভে কাজ নেই। শুধু সেই হতভাগা ছেলেটাকে বোডিং থেকে আনবার কথা বলে যেতে পারলেই

সেদিন শোভন বেশ ভাল আছে, ভাবলাম এইবার বলি। যেতে গিয়ে দেখি বিছানায় বসে কাগজ পড়ছে শোভন, বউমা কাছে চেয়ারে বসে, শোভনেরই বোধ হয় জামার বোতাম বসাচ্ছে।

চলে এলাম।

ছন্দভঙ্গ করতে ইচ্ছা হল না। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম।

খানিক পরে এঘরে এসে দেখি বউমা শোভনের আলমারি খুলে যত পোশাক বার করে রোদে দিয়েছে, আলমারির দেরাজ খোলাটোলা।

আহ্লাদের চাঞ্চল্য বড় বেশী চাঞ্চল্য বকুল, সেই আহ্লাদটা যেন নিজের মধ্যে বইতে পারছি না

এই সময়ে বউমা এ ঘরে এলো।

বলে উঠলাম, এইবার একটা পিয়নটিয়ন কাউকে বলে আমায় পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর বউমা। শোভন তো এখন বেশ ভালই আছে।

বকুল রে, বোকা বনে গেলাম ওর জবাব শুনে!

পারুলবালা কখনো জীবনে এমন বোকা বনেনি!

অথচ ও খুব সহজ ভাবেই বললে, ভাল আছে, তবে এখনো তো কিছুটা দেখাশোনার দরকার আছে। আপনিও চলে যাবেন?

আমিও চলে যাব!

এ আবার কি ভাষা!

বোকার মত বলে ফেললাম, খুব বোকার মত বলে ফেললাম, আমিও মানে?

রেখা বলল, আমি তো কাল চলে যাচ্ছি। ছুটি ফুরিয়ে গেল।

তারপর একটু হেসে বলল, আপনার তো আর ছুটি ফুরনোর প্রশ্ন নেই। আরো কিছুদিন থাকলে ভাল হত।

তবু এখনো পুরোটা বুঝতে পারিনি বকুল।

হয়ত অবচেতন মনের ইচ্ছেটাই পারতে দেয়নি।

চোখের সামনে প্রিয়জনের মৃত্যু ঘটলে সেটা নিশ্চিত দেখেও যেমন বার বার মনে হয়, ওই বুঝি বুকটা নড়ছে, ওই বুঝি নিশ্বাসের শব্দ হচ্ছে, তেমনি অবোধ প্রত্যাশাতেই ভাবলাম, হয়তো হঠাৎ চলে এসেছে বলেই একেবারে পদত্যাগপত্র দিয়ে আসতে পারেনি, তাই ছুটি ফুরনোর প্রশ্ন। অথবা হয়তো, এমনি হঠাৎ ছুটে চলে এসেছিল সঙ্কটাপন্ন অসুখের খবর শুনে, এসে দেখেছে কী ভুল করে দূরে বসে আছি।

ভালবাসার ঘরে ভালবাসার জনের কাছে নতুন করে বন্দী হয়ে গিয়ে আটকে গেছে। তবু সেখানকার ঋণটা শোধ করতে একবারও তো যেতে হবে।

তাই বললাম, ওঃ! তা কদিনের জন্যে যেতে হবে? সে ক’দিন তাহলে থাকবো!

রেখা আমার থেকে অনেক বেশী অবাক হয়ে বললো, ক’দিনের জন্যে মানে? এবার তো চলেই যাব!

চলে যাবে? এখান থেকে আবার চলে যাবে?

রেখা হঠাৎ খুব হেসে উঠল।

হয়তো কান্নাটাকে হাসিতে রূপান্তরিত করে ফেলবার কৌশল ও শিখে ফেলেছে।

বোধ হয় সেই হাসিটাই হেসে বললে, ওমা! আপনি কি ভেবে রেখেছেন আমি চিরকালের জন্যে এখানে থাকতে এসেছি? হঠাৎ অসুখ শুনে–

বললাম, হঠাৎ অসুখ শুনে থাকতে না পেরে ছুটে চলে আসাই তো “চিরকাল থাকবার” ইশারা বউমা! একবার ভুল করেছে তোমরা, আর ভুল করো না। এটাই তোমার চিরকালের জায়গা, চিরকালই থাকবে।

ও আমার মুখের দিকে একটু তাকিয়ে বলল, কী যে বলেন।

বেশ অবলীলায়ই বললো।

আর কিছু বলে উঠতে পারলাম না বকুল। এই অবলীলার কাছে কী কাকুতি-মিনতি করবো! কোন্ ভাষায়!

শোভনের কাছে গিয়ে বসে পড়লাম।

বোধ হয় কেঁদে পড়লাম বললেই ঠিক বলা হতো। যা পারুলবালার জীবনে কখনো ঘটেনি।

বললাম, শোভন কী বলেছিস তুই বউমাকে?

তারপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম।

দেখে অবাক হয়ে গেলাম।

এই মুখটা আবার কোথায় ফিরে পেল ছেলেটা, যে মুখটা প্রথম দিন এসে দেখেছিলাম। এ যেন সেই মুখ। সেই কালি পড়া শুকনো। হঠাৎ পাওয়া লাবণ্যটুকু কোথায় গেল? এত আকস্মিক এমন চলে যেতে পারে?

ওর মুখের সামনে এখনো খবরের কাগজখানা।

প্রায় আড়াল থেকেই শুকনো গলায় বললো, আমি কি বলবো?

রেগে গেলাম। বললাম, সামনে থেকে আড়াল সরা! স্পষ্ট চোখে চেয়ে বল, কিছু বলিসনিই বা কেন? কেন বলিসনি, তোমার যাওয়া চলবে না?

শোভন বললো, যা হয় না, তা হওয়ার চেষ্টাটা পাগলামি!

এইটাই সুস্থতা? বললাম, তোর অসুখ শুনে রেখা কী ভাবে ছুটে এসেছিল তা দেখতে পেলি না তুই? তোর কি চোখ নেই? ভালবাসা চিনতে পারলি না?

ও কি বললো জানিস?

বললো, চিনতে পারলেই বা কি? সকালের ওপর হচ্ছে প্রেস্টিজ। যে জিনিসটা ভেঙে গেছে বলে সকলের সামনে ফেলে দিয়েছি, সেটাকে তো আর আবার সকলের সামনে তুলে নেওয়া যায় না!

কেন নেওয়া যায় না? শুধু ওই সকলের কাছে ধরা পড়ে যাওয়া–আমরা ভুল করেছিলাম, এই তো! আর কি? ওটা কে ক’দিন মনে রাখবে শোভন? কে কার কথা নিয়ে বেশিদিন মাথা ঘামায়? এই সকল দুদিন বাদে ভুলে যাবে। আমি বলছি শোভন, তুই ওই একটা মিথ্যে একটু ‘প্রেস্টিজে’র অহঙ্কারে আবার ভুল করিসনি। তুই ওকে বল!

শোভন আমার দিক শোকে চোখ সরিয়ে নিয়ে দেয়ালে চোখ রেখে বললো, প্রেস্টিজটা একা আমারই নয় মা। তবু বলেছিলাম।

বলেছিলি? শোভন, কী জবাব দিল ও?

শোভনও তখন একটু হেসে উঠল। হেসে বলল, জবাবই দিল। বললো, আর হয় না।

আর হয় না! আর হয় না!

মৃত্যুর কাছে যেমন অসহায়তা, যেমন নিরুপায়তা, এ যেন তেমনি। ওদের নিজের হাতের দণ্ডই ওদের কাছে মৃত্যুর মত অমোঘ।

অতএব রেখা এই সংসারকে গুছিয়ে দিয়ে যাবে, রেখা তার নিঃসঙ্গ স্বামীর কোথায় কী অসুবিধে সেটা নিরীক্ষণ কবে দেখে তার সাধ্যমত প্রতিকার করে যাবে, রেখা বাকি জীবনটা কান্নাকে হাসিতে রূপান্তরিত করে হেসে হেসে পৃথিবীতে বেড়াবে, আর শোভন নামের ছেলেটা অনুশোচনা নামের চাপা আগুনে তিল তিল করে পুড়ে তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যাবে, জীবনের সব আকর্ষণ হারাবে আর ত্যশাস্তু যণায় ছটফটাবে! তবু কেউ ভাববে না, এত নিৰুপায়তা কেন? উপায় তো আমাদের হাতেই ছিল। আমাদের হাতেই আছে! কারণ আমাদের ভালবাসাটা আছে। সেটা মরে যায়নি।

ভাবতে পারতো যদি ওদের সে সাহস থাকতে, থাকতো সে শক্তি! যে শক্তিতে ওই সকলের চোখকে অবহেলা করা যায়!

তার মানে কেউ কোথাও এগোয়নি বকুল, এগোচ্ছে না। আমরাও যেখানে ছিলাম, এরাও সেখানেই আছে।

রেখা চলে গেল। আমিও আর কয়েকদিন ছিলাম। বসে বসে ছেলেটার যন্ত্রণার মুখ দেখলাম, যে যন্ত্রণার ছায়া দেখেছি রেখার মুখেও।

এখন ফিরে এসেছি।

গঙ্গার এই তরঙ্গের সামনে বসে বসে ভাবছি, আমরা কি এই চেয়েছিলাম?

এই মুক্তি?

তুই তো জানিস আমাদের মাতামহী সত্যবতী দেবীর কথা!

তিনি নাকি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সংসারের গণ্ডি ছেড়েছিলেন, বিয়ে জিনিসটা ভাঙবার নয় কেন? তিনি কি এখন কোনোখানে বসে তার প্রশ্নের অনুকূল উত্তর পেয়ে খুব খুশী হয়ে উঠছেন? দেখছেন, ওটা ভাঙবার কিনা এই প্রশ্নটাই আজ হাস্যকর হয়ে গেছে!

হয়ত বহু পুরনো, বহু ব্যবহৃত ওই বিয়ে প্রথাটাই আর থাকবে না পৃথিবীতে। হয়তো বকুল এই চিঠির পৃষ্ঠাটা ঠেলে রেখে নিজের প্যাডে চোখ ফেললো।

আর অভ্যস্ত দ্রুততায় লিখে চললো, কিন্তু তাতে কী? এমন একটা কাল ছিল, যখন ও প্রথাটা ছিল না। এখনো এই পৃথিবীতেই এমন জগৎ আছে, যেখানে এখনো বিয়ে প্রথাটা নেই, তারা স্রেফ জীবজগতের নিয়মে চলে।

অবশ্য কোনো একটা নিয়ম মেনেই চলে। সে তো পশুপক্ষী কীটপতঙ্গও চলে। স্ত্রী-পুরুষের নিগূঢ় আকর্ষণের বন্ধনটা কেউ এড়াতে পারে না।

পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো সভ্যতাই এ বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের পথ বাতলাতে পারেনি। ওটা থাকবে, এবং দেশ কাল আর পাত্রের সুবিধা অনুযায়ী নতুন নতুন ব্যবস্থা তৈরী হবে। সৃষ্টি হবে নতুন নতুন সভ্যতা।

নতুন মানুষরা তাকেই অনুসরণ করে চলবে। বলবে এইটা নির্ভুল।

গৌরববোধ করবে তখনকার বর্তমানের সভ্যতা নিয়ে, শিল্প নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে, সমাজনীতি রাজনীতি নিয়ে।

বলবে, দেখো এ অমর! এ অবিনশ্বর!

মহাকাল অবশ্যই অলক্ষ্যে বসে হাসবেন। ওটাই যখন তার পেশা।

একদা এই মানুষ জাতটা গুহা থেকে বেরিয়ে পড়ে নানান চেষ্টা শুরু করেছিল, শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টা। আর কিছু না। শুধু ক্ষুধার নিবৃত্তি করে বেঁচে থাকা। ক্রমেই দেখল চেষ্টার অসাধ্য কাজ নেই। বড় খুশী হয়ে উঠলো। নিজের কৃতিত্বে মোহিত হলো মুগ্ধ হলো, অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে চললো। অবশেষে গুহা থেকে চাঁদে উঠলো।…আরো ছুটছে, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। টের পাচ্ছে না তাদের চলার পথটা আবার গুহামুখো হয়ে যাচ্ছে!

যাবেই। যেতে বাধ্য। পথটা যে বৃত্তপথ।

তবু কালের হাতের ছোট্ট পুতুল এই মানুষগুলো তাদের ক্ষণকালের জীবনের সম্বলটুকু নিয়েই সামনে এগোচ্ছি বলে ছুটবে।

ছুটবে, ছুটোছুটি করবে, লাফাবে, চেঁচাবে, মারবে, মরবে, লোভে ডুববে, হিংসায় উন্মত্ত হবে, স্বার্থে অন্ধ আর রাগে দিশেহারা হবে।

নিজের দুঃখের জন্যে অন্যকে দোষ দেবে, আর সম্পদের জন্যে আপন মহিমার অহঙ্কারে স্ফীত হবে।

যে জীবনটার জন্যে সামান্যতম প্রয়োজন, তার প্রয়োজনের সীমানা বাড়াতে বাড়াতে আরো অধিকের পিছনে অজ্ঞানের মত ছুটবে, যে সোনার কণামাত্রও নিয়ে যাবার উপায় নেই জানে, সেই সোনার পাহাড় গড়ে তুলতে জীবনের সমস্ত শ্রেয়গুলিকে জলাঞ্জলি দেবে।

এরই মধ্যে আবার কিছু মানুষ চিৎকার করে বলবে, চলবে না। চলবে না। এসব চলবে না।

তবু চলবে। কিছু মানুষ গম্ভীর গলায় বলবে, ওটা ঠিক নয়, ওটা অন্যায়, ওটা পাপ।

যেন পাপপুণ্যের মাপকাঠি তাদের হাতে। যেন আজ যা চরম পাপ, আগামী কাল তা পরম পুণ্য হয়ে সভায় এসে আসন নেবে না। তবু চেষ্টা চালিয়ে যাবে তারা। ভাববে তাদের হাতেই নির্ভুল ছাঁচ।

তা বলে কি কোথাও কিছু নেই।

আছে।

তবু কোথাও কিছু আছে।

তবু কোথাও কিছু থাকে।

থাকবে।

একান্ত তপস্যা কখনো একেবারে ব্যর্থ হয় না।

তাই সুবর্ণলতাদের সংসারে শম্পাদের আবির্ভাব সম্ভব হয়। যারা সর্বস্বের মূল্যে প্রেমকে প্রতিষ্ঠিত করে জীবন পাবার দুঃসাহস রাখে।

অতএব মস্ত লেখিকা অনামিকা দেবী এখনো কোনো কোনো দিন, যেদিন জীবনের সব কিছু নেহাৎ অর্থহীন লাগে, ছেলেমানুষের মত রাত্রির আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রকে খোঁজেন, আর আরো ছেলেমানুষের মত অসহায় গলায় বলেন, দেখো, যে লেখা আগামী কালই জলের আলপনার মত মিলিয়ে যাবে, সেই লেখাই লিখলাম জীবনভোর,

–শুধু বকুলের কথাটা আর লেখা হলো না…তোমার আর বকুলের কথা।

কী লিখব বলো? তারা তো হার মেনে মরেছে। হার মানার কথা কি লেখা যায়? সেই হার মানার মধ্যে যে পাওয়া, তার কথা বলতে গেলে লোকে হাসবে। বলবে, কী অকিঞ্চিৎকর ছিল ওরা! তবে?

প্রত্যক্ষে যারা জিতেছে, এখন তবে তাদের কথাই লিখতে হবে।…

এখন তাই শম্পার কথা লেখা হলো। যে শম্পা খেটে খেটে রোগা হয়ে যাওয়া মুখে মহোৎসাহের আলো মেখে বলে, আমার নতুন সংসার দেখতে গেলে না পিসি? যা গুছিয়েছি দেখে মোহিত হয়ে যাবে। দক্ষিণের বারান্দায় বেতের মোড়া পেতে ছেড়েছি। আর তোমার জাম্বুবানকে তো প্রায় মানুষ করে তুলেছি। চাকাগাড়ি চড়িয়েই একবার সেজপিসির কাছে নিয়ে যাবো ঠিক করেছি।

–: সমাপ্ত :–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *