ফেরার পথে পারুল ট্রেনের জানলায় মুখ রেখে বাইরের গভীর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভেবেছিল, ধারণা ছিল যুগের নিয়ম অনেকটা সিঁড়ির নিয়মের মত। সে ধাপে ধাপে পরিবর্তিত হতে হতে চলে…তা হলে কি আমার অন্যমনস্কতার অবকাশে একটা যুগ তার কাজ করে চলে গেছে, আমি খেয়াল করিনি?
নইলে সে যুগটা কোথায় গেল?
আমার যুগটা? আমি আমার মাকে দেখেছি।–দেখেছি জেঠিমা কাকিমা পিসিমাদের, দেখেছি, আমার শাশুড়ী খুড়শাশুড়ীদের। ওপরওয়ালার জাঁতার তলায় নিষ্পিষ্ট সেই জীবনগুলি শুধু অপচয়ের হিসেব রেখে চলে গেছে…আমরাও আমাদের বধূজীবনে সেই অপচয়ের জের টেনেই চলে এসেছি আর ভেবেছি আমাদের কাল আসতে বুঝি বাকি আছে এখনো। সেই আসার পদধ্বনির আশায় কান পেতে বসে থাকতে থাকতে দেখছি আমরা কখন যেন বাতিলের ঘরে আশ্রয় পেয়ে গেছি!
সে কাল টা তবে গেল কোথায়?
যেটার জন্যে আমাদের আশা ছিল, তপস্যা ছিল, স্বপ্ন ছিল?
এখন যাদের কাল তারা একেবারে নতুন, একেবারে অপরিচিত। তাদের কাছে গিয়ে খোঁজ করা যায় না, হাঁ গো সেই কালটা কোন ছিদ্র দিয়ে গলে পড়লো? দেখতে পাচ্ছি না তো? আমার তপস্যাটা তাহলে স্রেফ বাজে গেল?
আমরা মেয়েরা লড়াই করেছিলাম—
মনে মনে উচ্চারণ করেছিল পারুল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, উৎপীড়নের বিরুদ্ধে, অযথা শাসনের বিরুদ্ধে, পরাধীনতার বিরুদ্ধে-আমি, আমার পূর্বতনীরা।….
সেই লড়াইয়ে তবে জিত হয়েছে আমাদের।
সব শক্তি হাতে এসে গেছে মেয়েদের। সব অধিকার।
…শুধু প্রকৃতির অসতর্কতায় আমাদের ভাগটা পেলুম না। আমার যুগটা কখন স্খলিত হয়ে পড়ে গেছে।
তবে আর কী করবো?
প্রত্যাশার পাত্রটা আর বয়ে বেড়াবো কেন?
জানলাটা বন্ধ করে একখানা বই খুলে বসেছিল পারুল, তার মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠেছিল। ভেবেছিল, এ যুগের নাটকে তবে আমাদের ভূমিকা কি? কাটা সৈনিকের? স্টেজে আসবার আগেই যাদের মরে পড়ে থাকতে হয়?
কিন্তু ওসব তো অনেকদিন আগের কথা। তখন তো শোভনের ওই ডল পুতুলের মত মেয়েটা জন্মায়নি। যাকে নিয়ে এসে দেখিয়ে গেল সেবার শোভন আহ্লাদে গৌরবে জ্বল-জ্বল করতে করতে। কত বকবক করে গেল মেয়ের অলৌকিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে।
মেয়েটাকে দেখে সত্যিই বুক ভরে উঠেছিল পারুলের। মনে হয়েছিল এমন একটা অনিন্দ্যসুন্দর বস্তুর অধিকারী হতে পারা কী সৌভাগ্যের!
কিন্তু চলে যাবার সময় তো কই বলে ওঠেনি, আবার আনিস রে! চলে যাওয়ার পর এই এতোদিনের মধ্যে তো কই চিঠিতে অনুরোধ জানায়নি, আর একবার বড় দেখতে ইচ্ছে করছে রে!
শোভন নিজে ইচ্ছে করে মেয়ের নতুন নতুন অবস্থার আর বয়সের ফটো মাকে পাঠায়। তাই থেকেই জেনেছে পারুল মেয়েটা এখন ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যেতে শুরু করেছে!
সুখে থাক, ভাল থাক, তবু তো এই ভালবাসাটুকুও রেখেছে শোভন মার জন্যে।
পারুল ওদের কাছে কৃতজ্ঞ।
পারুল তার পরলোকগত স্বামীর প্রতিও কৃতজ্ঞ, এই বারান্দাটির জন্যে।
এইখানে
যখন পড়ন্ত বিকেলের আলো মুখে মেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিল কী আশ্চর্যের তুলনাই রেখে গেছেন কবি!
ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কুলে দিনের চিতা।
দিনের চিতা! কী অভাবনীয় মৌলিক!
আগে কী কেউ কখনো দেখেছিল এই চিতাকে?
বহুদিনের পড়া, মুখস্থ করা এই কবিতাটাই হঠাৎ যেন নতুন একটা অর্থ বহন করে এসে দাঁড়িয়েছে, পারুল সে অর্থকে কোথায় যেন মিলোচ্ছে, সেই সময় অনামিকা দেবীর চিঠিখানা এলো।
বকুলের স্কুলের খাতাটা আমি খুঁজে পাচ্ছি না, তুই খুঁজে দেখিস।
বকুলের সেজদিকে কিছু খুঁজে দেখতে হয় না।
সেজদির সিন্দুকে সব তোলা থাকে। কে জানে সিন্দুকটা সেজদির কত বড়!
সেজদির চিঠিটা হাতের মুঠোয় চেপে রেখে মনে মনে বললেন, আছে আমার কাছে তবে। সবটা নয়, অনেকটা। কিন্তু আমি সেটা বার করে কী করবো? আমি কি লিখতে পারি?
লিখতে পারেন না সেজদি।
কবিতা পারেন, গদ্য নয়।
তাই মনে মনে উচ্চারণ করেন, আমি খুঁজে পেয়ে কী করবো?
তারপর বলেন, বকুল বলেছিল নিজেদের কথা আগে বলতে নেই। আগে পিতামহী প্রপিতামহীর ঋণ শোধ করতে হয়।…সে ঋণ তবে শোধ করছে না কেন বকুল? না কি করেছে া কখন, সেও আমার অসতর্কতায় চোখ এড়িয়ে গেছে?