হ্যাঁ, অকস্মাৎ একদিন সেই চিঠিটা এসে হাজির হয়েছিল। অবাক হয়ে গিয়েছিলেন অনামিকা দেবী। আশ্চর্য রকমের ছেলেমানুষ আছে তো মানুষটা? এখনো সেই গল্পটার কথা মনে রেখে বসে আছে? এখনো ভাবছে সেই গল্পটা ভালো লাগবে তার? শুধু একা বুঝে ফেলে পরম আনন্দে উপভোগ করবে?
অথবা পরম বেদনায় একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সে দীর্ঘশ্বাসকে মিশিয়ে দেবে অনন্তকালের বিরহী হিয়ার তপ্তশ্বাসের সঙ্গে!
ভগবান জানেন কী ভাবছে!
কিন্তু আশ্চর্য লাগে বৈকি!
আশ্চর্য লাগে এই ভেবে, অথচ মাধুরী-বৌকে ও প্রাণ তুল্য ভালবাসে। নিবিড় গভীর স্নেহসহানুভূতি-ভরা সেই ভালবাসার খবর বকুলের অজানা নয়। অজানা নয়, এই অনামিকা দেবীরও। তবু সেই অতীত কৈশোরকালের প্রথম-প্রেম নামক হাস্যকর মুঢ়তাটুকুকে আজও আঁকড়ে ধরে রেখেছে লোকটা!
আজও ওর প্রাণের মধ্যে গোপন গভীরে সেই মূঢ়তাটুকুর জন্যে হাহাকার!
হয়তে ওর এই ছেলেমানুষি মনটা বজায় থাকার মূলে রয়েছে মাধুরী-বৌয়ের আশ্চর্য হৃদয়ের অনাবিল ভালবাসার অবদান। মাধুরী-বৌ যদি সংসারের আরো অসংখ্য মেয়ের মত ঈর্ষাবিদ্বেষ, সন্দেহ আর অভিমানে ভরা একটা মেয়ে হতো, যদি মাধুরী-বৌ তার তীব্ৰ তীক্ষ্ণ অধিকারের ছুরিটা নিয়ে ওই অবোধ মানুষটার সেই মূঢ়তাটিকে দীৰ্ণবিদীর্ণ ছিন্নভিন্ন করে উৎপাটিত করে ফেলবার কাজে উৎসাহী হয়ে উঠতো, যদি ওকে বুঝিয়ে ছাড়ত এখনো তোমার ওই প্রথম প্রেমকে পরম প্রেমে লালন করাটা মহাপাতক তাহলে কী হতো বলা যায় না। হয়তো মূঢ় ছেলে মানুষটা সেই তীব্র শাসনবাণীতে কুণ্ঠিত হয়ে গুটিয়ে যেতো, সঙ্কুচিত করে ফেলতো নিজেকে।
কিন্তু মাধুরী-বৌ কোনো দিন তা করেনি।
মাধুরী-বৌ ওকে যেন মাতৃহৃদয় দিয়ে ভালবেসেছে। ভালবেসেছে বন্ধুর হৃদয় দিয়ে।
মাধুরী-বৌ ওর ওই প্রথম প্রেমের প্রতি নিষ্ঠাকে শ্রদ্ধা করে।
.
চিঠি মাধুরী-বৌও লিখতো বকুলকে।
অথবা বলতে পারা যায় মাধুরী-বৌই লিখতো। নির্মল তো মাত্ৰ দুবার। সেই অনেক দিন আগে ছোট্ট দু লাইনের একটা, কী যে তাতে বক্তব্য ছিল ভুলেই গেছেন অনামিকা দেবী। আর তারপর অনেক দিন পরে এই চিঠি।
যোগাযোগ রাখতো মাধুরী-বৌ।
কোথায় কোথায় বদলি হয়ে যাচ্ছে তারা, কেমন কোয়ার্টার্স পাচ্ছে, দেশটা কেমন, এমনি ছোটখাটো খবর দেওয়া চিঠি।
কিন্তু বকুল?
উত্তর দিতো নিয়মিত?
নাঃ, মোটেই না।
প্রথম দিকে ভদ্রতা করে দিয়েছিল উত্তর দুচারটে, তারপর আর নয়।
তারপর কি অভদ্র হয়ে গেল? নাকি অহঙ্কারী হয়ে গেল? অথবা অলস?
তা ঠিক নয়।
বকুল নিষেধাজ্ঞা পালন করতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তা এই নিষেধাজ্ঞা কি বকুলের বড়দার? না নির্মলের সেই বড় জেঠির?
সেই নিষেধাজ্ঞা পালন করেছিল বকুল?
নাঃ, তখন আর অতোটা হাস্যকর কোনো ঘটনা ঘটেনি।
নিষেধাজ্ঞা ছিল স্বয়ং পত্ৰদাত্রীর।
মাধুরী-বৌ নিজেই লিখেছিল, আমাদের খবরটা দিয়ে মাঝে মাঝে আমি তোমায় চিঠি দেব ভাই, তাতে তুমি খুশি হও না-হও, আমি খুশি হবো। তুমি কিন্তু ভাই উত্তরপত্রটি দিও না।…কী? ভাবছে নিশ্চয় এ আবার কোন ধরনের ভদ্রতা? তা তুমি ভাবলেও, এ অভদ্রতাটি করছি ভাই আমি। হয়তো এমন অদ্ভুত অভদ্রতা সংসারের আর কারো সঙ্গেই করতে পারতাম না, শুধু তুমি বলেই পাবলাম! জানি না এটা পারছি তুমি লেখিকা বলে, না আমার বরের প্রেমিকা বলে! যাই হোক, মোট কথা পারলাম। না পেরে উপায় কি বল? যেদিন তোমার চিঠি আসে, লোকটার আহারনিদ্রা যে প্রায় বন্ধ হবার যোগাড়!
খেতে বসে খিদে কম, শুতে গিয়ে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস। আবার এমনও সন্দেহ হয় আমায় বুঝি ঈর্ষাই করছে। যে বস্তু ওর কাছে দুর্লভ, সে বস্তু আমি এমন অনায়াসে লাভ করছি, এটা হিংসের বিষয়, হলেও হতে পারে তো?
অথচ বাবুর নিজে সাহস করে লেখার মুরোদ নেই; বলেছিলাম, আমার চিঠি পড়ছে কি জন্যে শুনি? ইচ্ছে হয় নিজে চিঠি লিখে উত্তর আনাও! আমার চিঠিতে তো আছে ঘোড়ার ডিম, তোমার চিঠিতে বরং রোমান্স-টোমান্স থাকবে!.. তা উচিতমত একটা জবাবই দিতে পারলো না। রেখে দিয়ে বললো, ঠিক আছে, পড়তে চাই না।
বোঝ ভাই!
এর পরে আবার মান খুইয়ে পড়তেও পারবে না, দীর্ঘশ্বাস আরো বাড়বে।
এই রকমই চিঠি লিখতো মাধুরী–বৌ।
একবার লিখেছিল, মাঝে মাঝে ভাবি, আশ্চৰ্য, তোমরা চিঠি লেখালিখিই বা করোনা কেন? চিঠির দ্বারা আর সমাজকে কতোটা রসাতলে দেওয়া যায়? আবার ভাবি, থাকগে, হয়তো এই-ই ভালো। লক্ষ্মীর কৌটোয় তুলে রাখা মোহর ভাঙাতে না বেরোনোই ভালো।
আর একবার লিখেছিল, উঃ বাবা, ক্ৰমে ক্রমে কী লেখিকাই হয়ে উঠছ! এখানে তো তোমার নামে ধন্য ধন্য। আমি বাবা মরে গেলেও ফাঁস করি না, এই বিখ্যাত লেখিকাটি আমার চেনা-জানা।…কী দরকার বলো? এনে তো দেখাতে পারবো না? তাছাড়া এও ভাবি, সত্যিই কি চেনা-জানা? যে তুমি-কে দেখি, গল্প করি হয়তো বা হতাশ প্রেমের নায়িকা বলে, মাঝে মাঝে করুণাও করে বসি, এই সব জটিল কুটিল ভয়ঙ্কর গল্পটল্প কি তারই লেখা? না আর কেউ লিখে দেয়? সত্যি ভাই, তোমার মুখের ভাষার সঙ্গে তোমার লেখার ভাষার আদৌ মিল নেই।… তবু মাঝে মাঝে ওই অভাগা লোকটার জন্যে মায়া হয়। এমন একখানি নিধি ঘরে তুলতে পারতো বেচারা, কিন্তু বিধি বাম হলো। তার বদলে কপালে এই রাঙামূলো।
শ্লেষ করে লিখতো না, অসূয়ার বশেও লিখতো না, মনটাই তো এমনি সহজ সরল মাধুরীবৌয়ের। মেয়েমানুষের মন এমন অসূয়াশূন্য, এটা বড় দুর্লভ।
মাধুরী-বৌ বলেছিল, লক্ষ্মীর কৌটোয় তুলে রাখা মোহর না ভাঙানোই ভালো।
তবু সেবার সে মোহর বার করে বসেছিল নির্মল। কে জানে মাধুরী-বৌকে জানিয়ে কি না-জানিয়ে!
হয়তো জানায়নি।
হয়তো অফিসে বসে লিখে পাঠিয়েছে, কই? কোথায় সেই গল্প? যে গল্প কেবল তুমি বুঝবে, আর আমি বুঝবো। আর কেউ বুঝবে না।…চিঠির উত্তর চাই না, গল্পটাই হবে উত্তর।
চিঠির উত্তর দিতে নির্মলও বারণ করেছিল।
পড়ে হেসে ফেলেছিলেন অনামিকা দেবী। তার ভাগ্যটা মন্দ নয়, লোকে চিঠি দিয়ে উত্তর দিতে বারণ করে!
কিন্তু উত্তর স্বরূপ যেটা চেয়েছিল?
যার জন্যে হয়তো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস প্রতীক্ষা করেছিল। সে গল্প কোথায়?.. সেই এক বিদারণ-রেখা টানা আছে।অনামিকা দেবীর জীবনে। সে গল্প লেখা হয়নি।
অথচ তারপর কতো গল্পই লিখলেন। এখনো লিখে চলেছেন।
কিন্তু একেবারেই কি লেখা হয়নি সে গল্প?
সেদিন মহাজাতি সদন থেকে ফিরে চুপিচুপি সেই প্রশ্নটাই করেছিলেন অনামিকা দেবী আকাশের কোন এক নক্ষত্ৰকে, একেবারেই কি লিখিনি তোমার আর আমার সেই গল্পটা? লিখেছি লিখেছি। লিখেছি নানা ছলে, নানা রঙে, নানা পরিবেশের মাধ্যমে। আমাদের গল্পটা রেণু রেণু করে মিশিয়ে দিয়েছি অনেক-দের গল্পের মধ্যে!
তবু—
তুমি জেনে রইলে, অনেক গল্প লিখলাম আমি, শুধু তোমার আর আমার সেই গল্পটা লিখলাম না কোনো দিন। তুমি অনেকবার বলেছ, তবু লিখিনি। তুমি প্রতীক্ষা করেছ ছেলেমানুষের মত, হতাশ হয়েছে ছেলেমানুষের মত, বুঝতেও পেরেছি সেকথা, তবু হয়ে ওঠেনি।
কেন হয়ে ওঠেনি, আমি নিজেই ভাল জানি না। হয়তো পেরে উঠিনি বলেই। তবু আজ আমার সে কথা ভেবে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। খুব যন্ত্রণা।
কিন্তু নক্ষত্রটা কি বিশ্বাস করেছিল সেকথা? বিশ্বাস করবার তো কথা নয়। সে তো সব কিছুই দেখেছিল আকাশের আসনে বসে।
দেখেছিল মহাজাতি সদনে মন্ত এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে, ভিড়ে ভেঙে পড়েছে হল, আলোয় ঝলমল করছে প্রবেশদ্বার।
মস্তবড় একখানা গাড়ি থেকে নামলেন অনুষ্ঠানের সভানেত্রী। এরাই পাঠিয়েছিল গাড়ি।
শান্ত প্ৰসন্ন চেহারা, ভদ্রমার্জিত সাজসজ্জা। উদ্যোক্তাদের আভূমি নমস্কারের বিনিময়ে নমস্কার করছেন। পাড়ার সেই একটা ছেলে, রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটের কোনো একখানে যার বাড়ি, অনামিকা দেবীকে ধরে কবে এই অনুষ্ঠানের প্রবেশপত্র একখানা যোগাড় করেছিল, সেই ছেলেটা কেমন করে যেন মহাজনবেষ্টিত সভানেত্রীর একেবারে কাছ ঘেঁষে খুব চাপা গলায় বললে, আপনিও বেরিয়ে এলেন, আর সঙ্গে সঙ্গেই আপনাদের পাশের বাড়ির একটা স্যাড ব্যাপার! বিরাট কান্নাকাটি!
ছেলেটা কাছ ঘেঁষে আসার চেষ্টা করায় অনামিকা দেবী ভাবছিলেন, তার সঙ্গ ধরে একেবারে প্রথম সারির চেয়ারে গিয়ে বসবার তাল করছে বোধ হয়।… পাড়ার ছেলেরা সুযোগ-সুবিধের তালটা খোঁজে, বাড়ির ছেলেরা কদাচ নয়। অনামিকা দেবীর ভাইপোরা কোনোদিন সামান্য একটা কৌতূহল প্রশ্নও করে না অনামিকা দেবীর গতিবিধি সম্পর্কে। কদাচ কখনো কোনো ভালো অনুষ্ঠানের প্রবেশপত্ৰ উপহার দিয়ে দেখেছেন, দেখতে যাবার সময় হয়নি ওদের; অথচ তার থেকে বাজে জিনিসও দেখতে গিয়েছে পয়সা খরচ করে। গিয়েছে হয়তো পরদিনই।
পাড়ার ছেলেরাই সুযোগ টুযোগের আশায় কাছে ঘেঁষে আসে।
অনামিকা দেবী ভাবলেন তাই আসছে। কিন্তু ছেলেটা হঠাৎ কাছ ঘেঁষে এসে পাশের বাড়ির খবর দিতে বসলো।
বললে, আপনিও যেই বেরিয়ে এলেন—
অনামিকা দেবী ঝাপসা ভাবে একবার তার বাড়ির এপাশ-ওপাশ স্মরণ করলেন!
তারাচরণবাবুর মা মারা গেলেন তা হলে! ভুগছিলেন অনেক দিন ধরে। বললেন, তাই নাকি? আমি তো–
এগিয়ে চলেছেন উদ্যোক্তারা ছেলেটাকে পাশ-ঠ্যালা করছেন তবু ছেলেটা যেন নাছোড়বান্দা।
হয়তো ও সেই স্বভাবের লোক যারা কার কাছে একটা দুঃসংবাদ পরিবেশন করব্বার সুযোগটাকে বেশ একটা প্রাপ্তিযোগী মনে করে, তাই সুযোগটাকে ফস্কাতে চায় না; সঙ্গে সঙ্গে এগোতে থাকে, হলের মধ্যে ঢুকে যায়, আর হঠাৎ একবার চান্স পেয়ে বলে নেয়, আপনি কি করে জানবেন? এক্ষুনি টেলিগ্রাম এলো। ওই যে আপনাদের পাশের বাড়ির সুনির্মলবাবু ছিলেন। বক্সারে থাকতেন–
কথাটা শেষ করতে পেলো না।
ততক্ষণে তো অনামিকা দেবীকে মঞ্চে তোলার জন্য গ্রীন রুমের দিকে নিয়ে চলে গেছে। এরা সর্বসমক্ষে দোদুল্যমান ভেলভেটর পর্দার ওদিকে সাজিয়ে বসিয়ে মাহেন্দ্রক্ষণে যবনিকা উত্তোলন করবে!
এখনো ভাবতে গেলে বিস্ময়ের কুল খুঁজে পান না অনামিকা দেবী!
বুঝতে পারেন না সত্যিসত্যিই সেই ঘটনাতা ঘতেছিল কি না। অথচ ঘটেছিল। যবনিকা উত্তোলিত হয়েছিল নাটকীয় ভঙ্গীতে, উৎসুক দর্শকের দল দেখতে পেয়েছিল সারি সারি চেয়ারে সভানেত্রী, প্ৰধান অতিথি এবং উদ্বোধক সমাসীন।
তারপর নাটকের দৃশ্যের মতই পর পর দেখতে পেয়েছিল, উদ্বোধন সঙ্গীত অন্তে তিন প্রধানকে মোটা গোড়ে মালা পরিয়ে দেওয়া হলো, সমিতি-সম্পাদক উদাত্ত ভাষায় তাদের লক্ষ্য, আদর্শ ইত্যাদি পেশ করলেন। তারপর একে একে উদ্বোধক, প্রধান অতিথি এবং সভানেত্রী ভাষণ দিলেন, তারপর যথারীতি সমাপ্তি সঙ্গীত হলো।
আর তারপর আসল ব্যাপার সংস্কৃতি অনুষ্ঠান শুরু হবার জন্যে পুনর্বার যবনিকা নামলো।
সভানেত্রীর ভাষণ হয়েছিল কি?
হয়েছিল বৈকি।
এমন জমজমাট অনুষ্ঠানের ত্রুটি হতে পারে কখনো?
তারপর যদি সভানেত্রী হঠাৎ অসুস্থতা বোধ করে বাড়ি চলে যান, তাতে অনুষ্ঠানে ত্রুটি হবার কথা নয়।
.
না, কোনো ত্রুটি হয়নি অনুষ্ঠানের।
সভানেত্রীর ভাষণেও নাকি ত্রুটির লেশ ছিল না। উদ্যোক্তাদেদর একজন এ অভিমতও প্রকাশ করলেন, এই রকম মৃদু সংক্ষিপ্ত এবং হৃদয়গ্রাহী ভাষণই তাঁরা চান। দীর্ঘ বক্তৃতা দুচক্ষের বিষ।
অতএব ধরা যেতে পারে সভা সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল। তাছাড়া কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, ধন্যবাদ, শুভেচ্ছাজ্ঞাপন ইত্যাদি সব কিছুই ঠিকমত সাজানো হয়েছিল।
আকাশের সেই নক্ষত্ৰখানি আকাশের জানলা দিয়ে সবই তো দেখেছিল তাকিয়ে।
কী করে তবে বিশ্বাস করবে সে, এই ভয়ানক যন্ত্রণাটা সত্যি। বিশ্বাস করেনি, নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেনি। হয়তো মৃদু হেসে নিঃশব্দ উচ্চারণে বলেছিল, এতোই যদি যন্ত্রণা তো ওই সব সাজানো-গোছানো কথাগুলি চালিয়ে এলে কী করে শুনি? শোনামাত্রই তো সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়তে পারতে তুমি। এরকম ক্ষেত্রে যেটা খুব স্বাভাবিক ছিল।
আকস্মিক সেই অসুস্থতাকে লোকে এমন কিছু অস্বাভাবিক বলেও মনে করতো না।
বলতো গরমে, বলতো অতিরিক্ত মাথার খাটুনিতে। অথবা বলতো, শরীর খারাপ নিয়ে এসেছিলেন বোধ হয়।
আর কী?
সভা পণ্ড হতো?
পাগল!
রাজা বিনে রাজ্য চলে, আর সভানেত্রী বিহনে সভা চলতো না?
কতো কতো জায়গায় তো এমনিতেই সভাপতির অন্তর্ধান ঘটে। এই আসছেন এখুনি আসছেন, আনতে গেছে বলতে বলতে কর্তৃপক্ষ হাল ছেড়ে দিয়ে আর কোনো কেষ্টবিষ্টুকে বসিয়ে দেন সভাপতির আসনে!
অনামিকা দেবী সেদিন হঠাৎ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাই হতো। তাছাড়া আর কী লোকসান?
অথচ ওই মূর্খ সভানেত্রী আপ্রাণ চেষ্টায় সেই সংজ্ঞাটাকেই ধরে রাখতে চেষ্টা করেছেন। সত্যিই তাই করেছিলেন অনামিকা। ওই পালিয়ে যেতে চেষ্টা করা বস্তুটাকে ধরে রাখবার জন্যে তখন যেন একটা লড়াইয়ের মনোভাব নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছিলেন।
হার মানবো না!
কিছুতেই হার মানবো না।
বুঝতে দেবো না কাউকে! জানতে দেবো না। আমার মধ্যে কী ঘটছে।
কিন্তু সম্ভব হয়েছিল তো!
বহুবার নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেছে বকুল, কী করে হলো সম্ভব?
তার মানে আসলে মন নামক লোকটার নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই? সে শুধু পরিবেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত!
ভগবান সম্পর্কে কখনোই খুব একটা চিন্তা ছিল না বকুলের। চলিত কথার নিয়মে ভগবান শব্দটা ব্যবহার করতে হয়তো। ভগবান খুব রক্ষে করেছেন। ভগবান জানেন কী ব্যাপার! খুব ভাগ্যি যে ভগবান অমুকটা করেননি।
এই রকম।
এ ছাড়া আর কই?
শুধু এই একটি জায়গায় ভগবানকে মুখোমুখি রেখে প্রশ্ন করেছে বকুল, এখনো করে, ভগবান! কী দরকার পড়েছিল তোমার ওই শান্ত সভ্য অবোধ মানুষটাকে তাড়াতাড়ি পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার? কী ক্ষতি হতো তোমার, যদি সেই মানুষটা পৃথিবীর একটুখানি কোণে সামান্য একটু জায়গা দখল করে থাকতো আরো কিছুদিন! তোমার ওই আকাশে তো নক্ষত্রের শেষ নেই, তবে কেন তাড়াতাড়ি আরো একটি বাড়াবার জন্যে এমন নির্লজ্জ চৌর্যবৃত্তি তোমার!
ভগবানকে উদ্দেশ করে কথা বলার অভ্যাস সেই প্ৰথম।
ভগবানের নির্লজ্জতায় স্তম্ভিত হয়ে, ভগবানের নিষ্ঠুরতায় স্তব্ধ হয়ে গিয়ে।
বকুলের খাতায় ছন্দের চরণধ্বনি উঠলেই সে ধ্বনি পৌঁছে যেতো সেজদির কাছে। এটাই ছিল বরাবরের নিয়ম।
শুধু সেই একসময়, মহাজাতি সদনে অনুষ্ঠিত ফাংশানের কদিন পরে বকুলের খাতায় ছন্দের পদপাত পড়েছিল, কিন্তু সেজদির কাছে পৌঁছয়নি। খাতার মধ্যেই সমাধিস্থ হয়ে আছে সে।
সেই খাতাটা, যার পাতার খাঁজে সেই চিঠিখানা ঘুমিয়ে আছে এখনো।
কই? কোথায়? আমাদের সেই গল্পটা?
না, সেজদির কাছে যায়নি খাতার সেই পৃষ্ঠাটা। গেলে হয়তো যত্নের ছাপ পড়তো তাতে। দেখা হতো ছন্দে কতটা ত্রুটি, শব্দচয়নে কতটা দক্ষতা।
আর হয়তো শেষ পর্যন্ত শেষও হতো। কোনো একখানা সমাপ্তির রেখা টানা হতো। কিন্তু ওটা যায়নি সেজদির কাছে। বকুলের অক্ষমতার সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে খাতার মধ্যে!
অথচ সেই রাত্রেই লেখেনি বকুল যে, অক্ষমতোটাকে ক্ষমা করা যাবে! লিখেছিল তো কদিন যেন পরে—
লিখেছিল–
রাত্রির আকাশে ওই বসে আছে যারা
স্থির
অচঞ্চল,
আলোক স্ফুলিঙ্গ সম
লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি তারা,
আমরা ওদের জানি।
পৃথিবী হতেও বড়ো বহু বড়ো
গ্ৰহ উপগ্রহ।
নাম-পরিচয়হীন
দূরান্তের পড়শী মোদের।
দুর্লঙ্ঘ্য নিয়মে
অহৰ্নিশি আবর্তিছে
আপন আপন
কক্ষে।
কিরণ বিকীর্ণ
করি।
বিজ্ঞানের জ্ঞানলোকে
ধরা পড়ে গেছে ওদের
স্বরূপ।
অনেক অঙ্কের আর অনেক
যুক্তির
সারালো
প্রমাণে
রাখেনি কোথাও সন্দেহের
অবকাশ।
ওরা সত্য, ওরা গ্রহদল।
তবু মনে
হয়–
জীবনের ঊষাকালে
মাতৃমুখ হতে
শুনেছি যা ভ্ৰান্তবাণী, শিখেছি যা
ভুল,
সব চেয়ে
সত্য সেই।
সত্য সব চেয়ে যুক্তিহীন বুদ্ধিহীন
সেই
মিথ্যা মোহ।
তাই স্তব্ধ
রাত্রিকালে,
নিঃসীম নিকষপটে
নির্নিমেষ দৃষ্টি মেলি
দেখি চেয়ে
চেয়ে–
অনেক তারার মাঝে
কোথা আছে
দুটি
আঁখিতারা।
যে দুটি তারকা কোটি কোটি
যোজনের
দূরলোকে
বসি
চেয়ে আছে
তন্দ্ৰাহীন।
চেয়ে আছে সকরুণ মৌন মহিমায়
মাটির পৃথিবী
পরে।
যেথা সে
একদা–
একটি নক্ষত্র হয়ে জ্বলিত
একাকী
আলোকিয়া
একখানি ঘর।
নিয়তির ক্রুর আকর্ষণে
যেথা হতে নিয়েছে বিদায়
প্রাণবৃন্তখানি হতে ছিঁড়ে
আপনারে।
লক্ষ ক্রোশ
দূর হতে–
হয়তো সে আছে
চেয়ে
সেই গৃহখানিপানে নতনেত্ৰ
মেলি।
হয়তো দেখিছে
খুঁজে–
দীপহীন দীপ্তিহীন সেই
ঘর হতে
দুটি নেত্ৰ আছে
কিনা জেগে
ঊর্ধ্ব
আকাশেতে চেয়ে।
কোটি
তারকার মাঝে
খুঁজিবারে
দুটি আঁখিতারা
সহসা একদা যদি–
না, আর লেখা হয়নি।
কতকাল হয়ে গেল, খাতার পাতার রংটা হলদেটে হয়ে গেছে, ওটা অসমাপ্তই রয়ে গেল। কি করে তবে বলা যায় মন নামক কোনো সত্যবস্তু আছে?
না নেই, মন নামক কোনো সত্য বস্তু নেই। অন্ততঃ অনামিকা দেবীর মধ্যে তো নেইই। থাকলে তারপর আরো অনেক অনেক গল্প লিখতে পারতেন না তিনি। থাকলে সেই চিঠিখানাই তাঁর কলমের মুখটা চেপে ধরতো। বলে উঠতো, থামো থামো, লজ্জা করছে না তোমার? ভুলে যাচ্ছে নক্ষত্রেরা অহনিশি তাকিয়ে থাকে?
কিন্তু সে সব কিছু হয়নি। সে কলম অব্যাহত গতিতে চলেছে। বরং দিনে দিনে নাকি আরো ধারালো আর জোরালো হচ্ছে। অন্ততঃ শম্পা তো তাই বলে। আর শম্পা নিজেকে এ যুগের পাঠক-পাঠিকা সমাজের মুখপাত্র বলেই বিশ্বাস রাখে।
শম্পা মাঝে মাঝেই এসে বলে, আচ্ছা পিসি, তুমি এমন ভিজেবেড়াল প্যাটার্নের কেন?
অনামিকা দেবী ওর কোনো কথাতেই বিস্ময়াহত হন না, তাই মৃদু হাসেন। অথবা বলেন, সে উত্তর সৃষ্টিকর্তার কাছে। তুই বা এমন বাঘিনী প্যাটার্নের কেন, সেটাও তো তাহলে একটা প্রশ্ন!
বাজে কথা রাখে। শম্পা উদ্দীপ্ত গলায় বলে, তোমায় দেখলে তো স্রেফ একটি ভোঁতা। পিসিমা মনে হয়, অথচ কলম থেকে লেখাগুলো এমন জব্বর বার করো কী করে বাছা?
আজও শম্পা উদ্দীপ্ত মূর্তিতেই এসে উদয় হলো, নাঃ, তোমার এই ভিজে বেড়াল নামটাই হচ্ছে আসল নাম!
অনামিকা দেবী বোঝেন তার সাম্প্রতিককালের কোনো একটা লেখা ওর বেদম পছন্দ হয়ে গেছে, উচ্ছাস তৎ-দরুন। মৃদু হেসে বলেন, সে কথা তো আগেই হয়ে গেছে।
গেছে, তবু কিছুটা সংশয় ছিল, আজ সেটা ঘুচলো।
বাঁচলাম।
তুমি তো বাঁচলে, মুশকিল আমারই! তোমার কাছে এসে বসলেই ভাবনা ধরবে ভিজে বেড়ালটির মতো চক্ষু মুদে বসে আছ, কিন্তু কোন ফাঁকে অন্তরের অন্তস্থল পর্যন্ত দেখে বসছো!
তাতে ভাবনাটা কী? অনামিকা হাসেন, তোর অন্তস্থলে তো আর কোন কালিঝুলি নেই।
সে না হয় আমার নেই। শম্পা অনায়াস মহিমার গলায় বলে, আমার ভেতরটা না হয় দেখেই ফেললে, বয়েই গেল আমার; কিন্তু অন্যদের? তাদের কথাও তো ভাবতে হবে।
তুইই ভাব। তারপর আমার কী কী শাস্তিবিধান করিস কর।
শাস্তি!
শম্পা উত্তাল গলায় বলে, শাস্তি কী গো? বল পুরস্কার! কী একখানা মারকাটারী গল্প লিখেছে এবারের উদয়নে, পড়ে তো আমার কলেজের বন্ধুরা একেবারে হাঁ! বলে, আচ্ছা তোর পিসিকে তো আমরা দেখেছি, দেখলে তো একেবারেই মনে হয় না উনি আমাদের, মানে আর কি আধুনিক মেয়েদের এমন বোঝেন। আশ্চৰ্য, কী করে উনি আধুনিক মেয়েদের একেবারে যাকে বলে গভীর গোপন ব্যথা-বেদনার কথা এমন করে প্রকাশ করেন? সত্যি পিসি, তোমায় দেখলে তো মনে হয় তুমি আধুনিকতা-টাধুনিকতা তেমন পছন্দ কর না!
অনামিকা দেবী ঈষৎ গম্ভীর গলায় বলেন, এমন কথা মনে করার হেতু?
কী মুশকিল! মনে করার আবার হেতু থাকে?
থাকে বৈকি। কার্য থাকলেই কারণ থাকবে, এটা তো অবধারিত সত্য। দেখা সে কারণ।
ওরে বাবা, অতো চেপে ধরো না। ওরাই তো বলে।
দ্যাখ বিচ্ছু তোর ওই ওদের যদি কখনো এ প্রশ্নের উত্তর দিতে চাস তো বলিস আধুনিকতা আর উচ্ছৃঙ্খলতা এক বস্তু নয়। আর- অনামিকা দেবী একটু হাসলেন, আর আধুনিক শব্দটার বিশেষ একটা অর্থ আছে, ওটা বয়েস দিয়ে মাপা যায় না। একজন অশীতিপর বৃদ্ধও আধুনিক হতে পারেন, একজন কুড়ি বছরের তরুণ যুবকও প্রাচীন হতে পারে। ওটা মনোভঙ্গী। কেবলমাত্র বয়সের টিকিটখানা হাতে নিয়ে যারা নিজেদের আধুনিক …ভেবে গরবে গৌরবে স্ফীত হয়, তারা জানে না ও টিকিটটা প্রতিমুহূর্তে বাসি হয়ে যাচ্ছে, অকেজো হয়ে যাচ্ছে। কুড়ি বছরটা পচিশ বছরের দিকে তাকিয়ে অনুকম্পার হাসি হাসবে। আমি একজনকে জানি, আজ যার বয়েস আশীর কম নয়, তবু তাকেই আমি আমার জানা জগতের সকলের থেকে বেশী আধুনিক মনে করি।
জানি নে বাবা! শম্পা দুই হাত উল্টে বলে, তোমার সেই আশী বছরের আধুনিকটিকে দেখিয়ে দিও একদিন, দেখে চক্ষু সার্থক করা যাবে। তবে তোমার ওই উদয়নের নবকন্যা পড়ে কলেজের মেয়েরা তোমায় ফুলচন্দন দিচ্ছে এই খবরটা জানিয়ে দিলাম। লিলি তো বলছিল, ইচ্ছে হচ্ছে গিয়ে পিসির পায়ের ধুলো নিয়ে আসি।…লেখক মশাইরা তো দেখতে পান শুধু যুগযন্ত্রণায় ছটফটিয়ে মরা ছেলেগুলিকেই, সে যন্ত্রণা যে মেয়েদের মধ্যেও আছে,–কে কবে খেয়াল করেছে? ওনারা জানেন কেবলমাত্ৰ দেহযন্ত্রণা ছাড়া মেয়েদের আর কোনো যন্ত্রণা নেই। ঘেন্না করে, লজ্জা করে, রাগে মাথা জ্বলে যায়। পিসিকে গিয়ে বলবো।–
অনামিকা দেবী কথায় বাধা দিয়ে বলেন, তা যেন বুঝলাম, কিন্তু পায়ের ধুলো নেওয়া!। তা যে বাপু বড় সেকেলে! এই তোর বন্ধু! সেকেলে গাইয়া! ছি!
তা বলো। ক্ষতি নেই।
শম্পা গেঁটিয়ে বিছানায় বসে গম্ভীর গলায় বলে, দ্যাখো পিসি, তোমায় আর আমি কী বুঝবো, তুমি কী না বোঝ! তবে আমি তো দেখছি আসলে প্রাণের মধ্যে যখন সত্যিকার আবেগ আসে তখন তোমার গিয়ে ওসব সেকেলে একেলে জ্ঞান থাকে না।
থাকে না বুঝি?
কই আর? নিজেকে দিয়েই তো দেখলাম, সাতজন্মেও ঠাকুর-দেবতার ধার ধারি না, ধারেকাছেও যাই না, যারা ওই সব ঠাকুর-টাকুর করে তাদের দিকে বরং কৃপার দৃষ্টিতে তাকাই। কিন্তু তোমার কাছে আর বলতে লজ্জা কি, জাম্বোর যেদিন হঠাৎ একেবারে একশো জ্বর উঠে বসলো চড়চড় করে, ডাক্তার মাথায় হাত দিয়ে পড়লো বলেই মনে হলো, সেদিন দুম করে ঠাকুরের কাছে মানত না কি যেন তাই করে বসলাম। বললাম, হে ঠাকুর ওর জ্বর ভালো করে দাও, তোমায় অনেক পুজো দেব। বোঝ ব্যাপার!
অনামিকা দেবী হেসে ফেলে বলেন, ব্যাপার তো বেশ বুঝলাম, জলের মতোই বুঝলাম, কিন্তু জাম্বোটি কী বস্তু তা তো বুঝলাম না!
জাম্বো কে জানো না?
শম্পা আকাশ থেকে পড়ে।
ওর নামটা তোমায় কোনোদিন বলিনি নাকি?
কার নাম?
আঃ, ইয়ে সেই ছেলেটার! মানে সেই মিস্ত্রীটার আর কি! যেটার বেশ বন্য বন্য ভাবের জন্যে এখনো রিজেক্ট করিনি!
তার নাম জাম্বো? আফ্রিকান বুঝি?
আহা আফ্রিকান হতে যাবে কেন? ওর চেহারাটার জনো ওর কাকা নাকি ওই নামেই ডাকতো। শুনে আমারও বেশ পছন্দ হয়ে গেল।
তা তো হবেই। তুমি নিজে যেমন। তোর নামও শম্পা না হয়ে হিড়িম্বা হওয়া উচিত ছিল। কেন, একটু সভ্য-ভব্য হতে পারিস না? বাড়িতে তো তোর বয়সী আরো একটা মেয়ে রয়েছে, তাকে দেখেও তো শিখতে পারিস?
কী শিখতে পারি? সভ্যতা? কাকে দেখে? তোমার ওই নাতনীটিকে দেখে? আমার দরকার নেই! শম্পা অবজ্ঞায় ঠোঁট উল্টোয়।
তারপর বলে, আমি নেহাৎ অশিক্ষিত অ-সভ্য বলেই ওর কীর্তিকলাপ মুখে আনতে চাই না, শুনলে না তুমি মোহিত হয়ে যেতে নাতনীর গুণাপনায়!
আহা লেখাপড়ায় হয়তো তেমন ইয়ে নয়, কিন্তু আর সব কিছুতে তো-
লেখাপড়ার জন্যে কে মরছে? শম্পা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, বর্ণপরিচয় না থাকলেও কোনো ক্ষতি নেই, কিন্তু আর সবটা কী শুনি?
কেন, নাচ গান, ছবি আঁকা, সূচের কাজ, টেবল ম্যানার্স, পার্টিতে যোগ দেবার ক্যাপাসিটি-
থামো পিসি, মাথায় আগুন জেলে দিও না। তোমার ওই বৌমাটি মেয়েটার ইহকাল পরকাল সব খেয়ে মেরে দিয়েছেন, বুঝেছো? ছবি আঁকে! হুঁ! যা দেখবে সবই জেনো ওর মাস্টারের আঁকা। সেলাই তো স্রেফ সমস্তই ওর মাতৃদেবীর—তবে হ্যাঁ, সাজতে-টাজতে ভালই শিখেছে। যাকগে মরুকগে, মহাপুরুষরা বলে থাকেন পরচর্চা মহাপাপ। তুমি যে দয়া করে তোমার ওই নাতনীটিকেই এ যুগের আধুনিকাদের প্রতিনিধি ভাবোনি এই ভালো! যাক লিলি যদি আসে, আর পায়ের ধুলোফুলো নিয়ে বসে, ওই নিয়ে কিছু বোলো না যেন।…আবেগের মাথায় আসবে তো! আর আবেগের মাথায়-হঠাৎ ঠাট্টা-টাট্টা শুনলে–
আচ্ছা আচ্ছা, তোর বন্ধুর ভারটা আমার ওপরই ছেড়ে দে। কিন্তু সেই যে জাম্বুবান না কার জন্যে যেন ঠাকুরের কাছে মানত করে বসেছিলি-পুজো দিয়েছিস? নাকি তার জ্বর ছেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তোরও ঘাড় থেকে ভগবানের ভূত ছেড়ে গেল!
শম্পা হেসে ফেলে। অপ্রতিভ-অপ্ৰতিভ হাসি।
বলে, ব্যাপারটা আমি নিজেই ঠিক বুঝতে পারছি না পিসি। ঠাকুর-টাকুর তো মানি না, হঠাৎ সেদিন কেনই যে মরতে— এখন ভেবে পাচ্ছি না কী করি? পুজো ফুজো দেওয়া মনে করলেই তো নিজের ওপর কৃপা আসছে, অথচ—
তবে আর অথচ কি? অনামিকা নির্লিপ্ত গলায় বলেন, ভেবে নে হঠাৎ একটা বোকামি করে ফেলেছিলি, তার জন্য আবার কিসের দায়?
তাই বলছো?
শম্পা প্ৰায় অসহায়-অসহায় মুখে বলে, আমিও তো ভাবছি সে কথা, মানে ভাবতে চেষ্টা করছি, কিন্তু কী যে একটা অস্বস্তি পেয়ে বসেছে! কাপড়ে চোরকাঁটা বিধে থাকলে যেমন হয়, প্ৰায় সেই রকম যেন! দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু-
তাহলে জিনিসটা চোরকাটাই। অনামিকা মুখ টিপে হেসে বলেন, চোরের কাঁটা। অলক্ষিত চোর চুপি চুপি সিঁদ কেটে—
পাগল! ক্ষেপেছো! শম্পা হৈ-চৈ করে ওঠে, তুমি ভাবছো এই অবকাশে আমার মধ্যে ঠাকুর ঢুকে বসে আছে? মাথা খারাপ! তবে আর কি, ওই অস্বস্তিটার জন্যই ভাবছিলাম-তুমি দিয়ে দিতে পারবে না?
দিয়ে দিতে? কী দিয়ে দিতে?
আহা বুঝছে না যেন! ন্যাকা সেজে কী হবে শুনি? ওই কিছু পুজোফুজো দিয়ে দিলেই–মানে সত্যরক্ষা আর কী! প্ৰতিজ্ঞাটা পালন করা দরকার।
অনামিকা ক্ষুব্ধ গলায় বলেন, কার কাছে প্ৰতিজ্ঞা? যাকে বিশ্বাস করিস না তার কাছে তো? সেখানে আবার সত্যরক্ষা কি? অনায়াসেই তো ভাবতে পারিস, দেব না, বয়ে গেল! ঠাকুর না হাতি!
চেষ্টা-করেছি—, শম্পা আরো একটু অপ্রতিভ হাসি হেসে বলে, সুবিধে হচ্ছে না। ও তুমি যা হয় একটা করে দিও বাবা।
আমি? আমি কী করে দেব?
আঃ বললাম তো, ওই পুজোটুজো যা হোক কিছু। তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়েই তো দিতে হতো।
অনামিকা কৌতুকের হাসি গোপন করে বলেন, সে আলাদা কথা। কিন্তু তুই কোন ঠাকুরের কাছে পুজো কবলালি, আমি তার কী জানি?
কোন ঠাকুর! শম্পা আবার আকাশ থেকে পড়ে, ঠাকুর আবার কোন ঠাকুর? এমনি ঠাকুর!
আহা, কোনো একটা মূর্তি তো ভেবেছিলি? কালী কি কেষ্ট, দুর্গা কি শিব-
না পিসি, ওসব কিছু ভাবি-টাবিনি। শম্পা এবার ধাতস্থ গলায় বলে, এমনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে মরেছি। মানে ওর টেম্পারেচারটাও যতো ওপর দিকে উঠে চলেছে, আমার চোখও তো ততো ওপর দিকে এগোচ্ছে। জ্বর যখন একশো ছয় ছড়িয়ে আরো চার পয়েন্ট, আমার চোখও তখন স্রেফ চড়কগাছ ছাড়িয়ে আকাশে। মূর্তি-টুর্তি কিছু ভাবিনি, শুধু ওই আকাশটাকেই বলেছি, ছোঁড়াটা তোমার এমন কী কাজে লাগবে বাপু যে টানাটানি শুরু করেছো? তোমার ওখানে তো অনেক তারা আছে, আরো একটা বাড়িয়ে তোমার লাভ কী? হঠাৎ জোরে হেসে ওঠে শম্পা, দেখেছো পিসি, কুসংস্কারের কী শক্তি? যেই না বিপদে পড়া, অমনি স্রেফ ছেলেমানুষের মতো ভাবতে শুরু করা-মৃত্যুর দূত আকাশ থেকে নেমে আসে, মরে গেলে মানুষরা সব আকাশের নক্ষত্র হয়ে যায়। এসব হচ্ছে ভুল শিক্ষার কুফল! …যাচ্চলে, ঘুমিয়েই পড়লে যে! বাবা তোমার আবার কবে থেকে আমার মাতৃদেবীর মতো ঘুমের বহর বাড়লো? মা তো-থাক বাবা, ঘুমোও। রাত জেগে জেগে লিখেই বুড়ী মলো!
নেমে যায় শম্পা।
বোজা চোখেই অনুভব করেন অনামিকা।
আর সেই মুদ্রিত পল্লবের নীচটা ভয়ানক যেন জ্বালা করতে থাকে।
ঠিক সেই সময় চোখ জ্বালা করছিল আর একজনের। সে চোখ শম্পার মা রমলার। তার মেয়ে যে কেবলই কেবলই তাকে ছাড়িয়ে, অথবা সত্যি বলতে তাকে এড়িয়ে কেবলই গুণবতী পিসির কাছে ছুটবে, এটা তার চক্ষুসুখকর হতেই পারে না। অথচ করারও কিছু নেই। শ্বশুর ঠাকুর বাড়িটি রেখে গেছেন, কিন্তু উঠানের মাঝখানে একটি বিষবৃক্ষ পুঁতে রেখে গেছেন।
হতে পারে ননদিনীটি তার পরম গুণাবতী, তার নিজেরই বোনেরা, ভাজেরা, ভাজের বোনেরা এবং বোনেদের জা ননদ ভাগ্নী ভাসুরঝি ইত্যাদি পরিচিতকুল সকলেই যে ওই গুণবতীর ভক্ত, তাও জানতে বাকী নেই শম্পার মার, এমন কি তিনি অনামিকা দেবীর সঙ্গে একই বাড়িতে বাস করার মতো পরম সৌভাগের অধিকারিণী বলে অনেকে ঈর্ষার ভানও করে থাকে, কিন্তু নিজে ত তিনি জানেন সর্বদাই হাড় জ্বলে যায় তার ননদিনীর বোল-বোলাও দেখে।
এদিকে তো ইউনিভার্সিটির ছাপও নেই একটা, অথচ বড় বড় পণ্ডিতজনেরা পর্যন্ত মান্য করে কথা বলতে আসে, খোসামোদ কয়ে ডেকে ডেকে নিয়ে যায় সভার শোভাবর্ধন করতে, এটা কি অসহ্যের পর্যায়ে পড়বার মতো নয়?
যাক গো মরুক গে, থাকুন না হয় আপন মান যশ অর্থ প্রতিষ্ঠার উচ্চ মঞ্চে বসে, শম্পার মার মেয়েটা কেন ওঁর পায়ে পায়ে ঘুরতে যায়? মেয়েকে যে তিনি হাতের মুঠোয় পুরে রাখতে পারলেন না, তার কারণ তো ওই গুণবতীটি!
না। সত্যি, সংসারের মধ্যে যদি কোনো একজন বিশেষ গুণসম্পন্ন হয়ে বসে, সে সংসারের অপর ব্যক্তিদের জ্বালার শেষ নেই। শুধু চোখই নয়, অহরহ সর্বাঙ্গ জ্বালা করে তাদের। প্রতিভা-ট্ৰতিভা ওসব দূর থেকেই দেখতে ভালো, কাছের লোকের থাকায় কোনো সুখ নেই। তা সংসারের কোনো একজন যদি সাধু-সন্ন্যাসীও হয় তাহলেও। আত্মজনের ভক্তজন এসে জুটলেই বাড়ির লোকের বিষ লাগতে বাধ্য।
অতএব শম্পার মাকে দোষ দেওয়া যায় না।
তবু পুরুষমানুষ হলেও বা সহ্য হয়, এ আবার মেয়েমানুষ!
তাছাড়া শম্পার মার কপালে ওই মেয়ের জ্বালা। বাড়িতে তো আরো মেয়ে আছে, আরো মেয়ে ছিল, যাদের বিয়ে হয়ে গেছে একে একে, কেউ তো তার ওই বেয়াড়া মেয়েটার মতো পিসিভক্ত নয়। আর বেয়াড়া যে হয়েছে সে তো শুধু ওই জন্যেই।
এই তো অলকা বৌমার মেয়ে, খুবই নাক-উঁচু ফ্যাশানি, মানুষকে যেন মানুষ বলে গণ্যই করে না, তবু দাখো তাকিয়ে, এই বয়সে মা-দিদিমাদের সঙ্গে গুরুদীক্ষা নিয়েছে। এদিকে যতই ফ্যাশান করুক আর নেচে বেড়াক, সপ্তাহে একদিন করে সেই আত্মাবাবার মঠে হাজিরা দিতে যাবেই যাবে। তবু তো একটা দিকেও উন্নতি হচ্ছে। তাছাড়া সেখানে —নাকি সমাজের যতো কেষ্ট-বিষ্টুরা এসে মাথা মুড়োন, কাজেই গুরুমন্ত্র বলে একটা লোকলজ্জাও নেই। কুলগুরুর কাছে দীক্ষা নেওয়ায় যে গ্রাম্যতা আছে, এদের কাছে দীক্ষা নেওয়ায় তো সেটা নেই। বরং ওতেই মানমর্যাদা, ওতেই আধুনিকতা।
ওসব জায়গায় আরো একটা মস্ত সুবিধে, বাবার যত কেষ্ট-বিষ্টু শিষ্যরা তো সপরিবারেই এসে ধর্না দেন, ভালো ভালো পাত্র-পাত্রীরও সন্ধান পাওয়া যায় সেই সুযোগে। বাবা নিজেও নাকি কতো শিষ্য-শিষ্যার ছেলেমেয়ের বিয়ে ঘটিয়ে দিয়েছেন।
শম্পার মার অবিশ্যি এসব শোনা কথা। ব্যাপারটা একবার দেখে আসবার জন্যে যতোই কেন না কৌতূহল থাকুক, মান খুইয়ে ভাশুরপো-বৌকে তো গিয়ে বলতে পারেন না, তোমার গুরুর কাছে আমায় একবার নিয়ে চল!
আর বললেই যে নিয়ে যাবে, তারই বা নিশ্চয়তা কি? এই তো ওর নিজের শাশুড়ীই তো বলেছিল একদিন। সেখানে ভীষণ ভিড়, সেখানে আপনার কষ্ট হবে, আপনি ব্লাড-প্রেসারের রোগী–সংকীর্তনের আওয়াজে আপনার প্রেসার বেড়ে যাবে বলে কেমন এড়িয়ে গেল। সোজা তো নয় বৌটি, ঘুঘু! তবু নিজের মেয়েটিকে কেমন নিজের মনের মতোটি করে গড়তে পেরেছে। ভাগ্য, ভাগ্য, সবই ভাগ্য! শম্পার মার ভাগ্যেই সব উল্টো।
মেয়েকে নামতে দেখেই শম্পার মা আটকালেন, কোথায় না কোথায় সারাদিন ঘুরে বাড়ি এসেই তো পিসির মন্দিরে গিয়ে ওঠা হয়েছিল, বলি সেখানে কি ডানহাতের ব্যাপারটা আছে? নাকি পিসির মুখ দেখেই পেট ভরে গেছে?
শম্পা দাঁড়িয়ে পড়ে কঠিন গলায় বলে, আর কোনো কথা আছে তোমার?
আমার আবার কী কথা থাকবে। শম্পার মা-ও ধাতব গলায় বলে ওঠেন, যতোক্ষণ আমার হেফাজতে আছ, ঠিকসময় খেতে দেওয়ার ডিউটিটা তো পালন করতে হবে আমায়। দয়া করে কিছু খাবে চল!
আমার খিদে নেই।
খিদে নেই? ওঃ, পিসি বুঝি ঘরে কড়াপাকের সন্দেশের বাক্স বসিয়ে রেখেছিল ভাইঝির জন্যে!
শম্পা একটু তীক্ষ্ণ হাসি হেসে বলে, না, কড়াপাকটা পিসির ভাজেরই একচেটে!
ওঃ বটে! বড় তোর কথা হয়েছে! কবে যে তোকে ভিন্ন গোত্র করে দিয়ে হাড় জুড়বো—
শম্পা আর একটু হেসে বলে, ওটার জন্যে তুমি আর মাথা ঘামিও না মা। ওই গোত্র বদলের কাজটা আমি নিজেই করে নিতে পারবো।
কী বললি? কী বললি শুনি?
যা বলেছি তা একবারেই বুঝেছো মা। আবার শুনে কেন রাগ বাড়াবে! বলে শম্পা একটা পাক খেয়ে ঘরে ঢুকে যায়।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে শম্পার বাবা প্রায় তার নিজের বাবার গলায় মেয়েকে বলে ওঠেন, দাঁড়াও। তোমার সঙ্গে কথা আছে।
বাপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লো শম্পা।
শম্পার বাবার বোনের মতো ভীরু ভঙ্গীতে নয়, দাঁড়ালে নিজের ভঙ্গীতেই। যে ভঙ্গীতে ভীরুতা তো নয়ই, বরং আছে কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণুতা। যেন ট্রেনের টিকিট কাটা আছে, যাবার সময় পার হয়ে যাচ্ছে, অতএব যা বলবে চটপট বলে নাও বাপু।
বাবা এই অসহনীয় ভঙ্গীটাকেও প্রায় সহ্য করে নিয়ে পাথুরে গলায় বলেন, ছেলেবেলা থেকেই তোমায় বার বার বলতে হয়েছে, তবু কোনোমতেই তোমায় বাধ্য বিনীত সভ্যতা জ্ঞানসম্পন্ন করে তোলা সম্ভব হয়নি! তুমি যে একটা ভদ্র বাড়ির মেয়ে, সেটা যেন খেয়ালেই রাখো না! কিন্তু মনে হচ্ছে সেটা এবার আমাকেই খেয়ালে রাখতে হবে। তোমার নামে অনেক কিছু রিপোর্ট পাচ্ছি কিছু দিন থেকে, এবং
কথার মাঝখানে বাবাকে তাজ্জব করে দিয়ে শম্পা টুক্ করে একটু হেসে ফেলে বলে, রিপোর্টারটি অবশ্যই আমাদের মা-জননী!
থামো! বাচালতা রাখে!
বাবা সেই তার নিজের ভুলে যাওয়া বাবার মতই গর্জে ওঠেন, আমি জানতে চাই সত্যবান দাস কে?
সত্যবান দাস১
শম্পা আকাশ থেকে পড়ে, সত্যবান দাস কে তা আমি কি করে জানব?
তুমি কি করে জানবে! ওঃ একটা গুণ ছিল না জানতাম, সেটাও হয়েছে তাহলে? মিথ্যে কথা বলতে শিখেছো? হবেই তো, যেমন সব বন্ধু-বান্ধব জুটছে। কলের মজুর, কারখানার কুলি
কারখানার কুলি! শম্পার মুখে হঠাৎ একচিলতে বিদ্যুৎ খেলে যায়।
জাম্বোর নাম যে আবার সত্যবান, তা তো ছাই মনেই থাকে না।
মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে হাসি লুকিয়ে বলে শম্পা, মিথ্যে কথা বলবার কিছু দরকার নেই, শুধু চট করে মনে পড়ছিল না। ডাকনামটাই মনে থাকে
ওঃ! শম্পার বাবা ফেটে পড়বার অবস্থাকেও আয়ত্তে এনে বলেন, ডাকনামে ডাকা টাকা চলছে তাহলে? কিন্তু আমি জানতে চাই কোন্ সাহসে তুমি একটা ছোটলোকের সঙ্গে মেশো?
শম্পা ফেরানো ঘাড় এদিকে ফিরিয়ে স্থির গলায় বলে, ছোট কাজ করলেই কেউ ছোট হয়ে যায় না বাবা!
থাক থাক, ওসব পচা পুরনো বুলি ঢের শুনেছি। আমি চাই না যে আমার মেয়ে একটা ইতরের সঙ্গে মেশে।
শম্পার সমস্ত চাপল্যের ভঙ্গী হঠাৎ একটা কঠিন রেখায় সীমায়িত হয়ে যায়। শম্পা তার বাবার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বলে, তোমার চাওয়ার আর আমার চাওয়ার মধ্যে যদি মিল না থাকে বাবা!
যদি মিল না থাকে?
শম্পার বাবা এই দুঃসাহসের দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত ফেটে পড়েন। বলে ওঠেন, তাহলে তোমার আর এ বাড়িতে জায়গা হবে না।
আচ্ছা, জানা রইল। শম্পা এবার আবার সেই আগের অসহিষ্ণু ভঙ্গীতে ফিরে আসে, আর কিছু বলবে? আমার একটু কাজ ছিল, বেরোতে হবে!
বেরোতে হবে? শম্পার বাবা ভুলে যান তিনি তার বাবার কালে আবদ্ধ নেই। শম্পার বাবার মনে পড়ে, এখন আর চার টাকা মণের চাল খান না তিনি, খান না আট আনা সেরের রুই মাছ। শম্পার বাবা তীব্র কণ্ঠে বলেন, এক পা বেরোনো হবে না তোমার। কলেজ ভিন্ন আর কোথাও যাবে না।
হঠাৎ বাবাকে থ করে দিয়ে ঝরঝরিয়ে হেসে ওঠে শম্পা।
হাসতে হাসতে বলে, তুমি ঠিক যেন সেই সেকালের রাজরাজড়াদের মত কথা বললে বাবা! যাঁরা আজ যাকে কেটে রক্তদর্শন করতেন, কাল আবার তাকে ডেকে আনতে বলতেন! এইমাত্র তো হুকুম হয়ে গেল, এ বাড়িতে জায়গা হবে না, আবার এখুনি হুকুম হচ্ছে বাড়ি থেকে বেরোনো হবে না–অদ্ভুত!
হঠাৎ কী হয়ে যায়!
শম্পার বাবা কাণ্ডজ্ঞানশূন্যভাবে মেয়ের সেই চুড়ো করে বাধা খোঁপাটা ধরে সজোরে নাড়া দিয়ে বলে ওঠেন, ওঃ আবার বড় বড় কথা! আস্পদ্দার শেষ নেই তোমার। তোমাকে আমি চাবি-বন্ধ করে রেখে দেব তা জানো, পাজী মেয়ে।
শম্পা নিতান্ত শান্তভাবে খোঁপা থেকে ঝরে পড়া পিনগুলো গোছাতে গোছাতে বলে, পারবে না, খামোকা আমার কষ্ট করে বাধা খোঁপাটাই নষ্ট করে দিলে! যাক গে মরুক গে, আচ্ছা যাচ্ছি তাহলে!
বলে দিব্যি চটিটা পায়ে গলিয়ে টানতে টানতে বাবার সামনে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। বাবার মুখ দিয়ে আর একটি কথাও বেরোয় না। হঠাৎ ওই চুলটা ধরার সঙ্গে সঙ্গেই কি নিজের ভুলটা চোখে পড়লো তার! মনে পড়ে গেল নিরুপায়তার পাত্র বদল হয়েছে!
তাই ওই চলে যাওয়ার দিকে স্তব্ধ-বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন? নাকি অধস্তনের ঔদ্ধত্য শক্তিহীন করে দিয়ে গেল তাকে?
হতে পারে।
চার টাকা মণের চালের ভাতে যাদের হাড়ের বনেদ, তাদের চিত্তজগৎ থেকে যে কিছুতেই ওই উধ্বতন-অধস্তন প্রভু-ভৃত্য গুরুজন-লঘুজন ইত্যাদি বিপরীতার্থক শব্দগুলো পুরনো অর্থ হারিয়ে বিপরীত অর্থবাহী হয়ে উঠতে চাইছে না! তাই না তাদের প্রতি পদে এত ভুল! যে ভুলের ফলে ক্রমাগত শক্তিহীনই হয়ে পড়ছে তারা!
অনিবার্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলেই তো শক্তির বৃথা অপচয়।
অনামিকা দেবী এসবের কিছুই জানতে পারেননি, অনামিকা তিনতলার ঘরে আপন পরিমণ্ডলে নিমগ্ন ছিলেন। ছোড়দার উচ্চ কণ্ঠস্বর যদিও বা একটু কানে এসে থাকে, সেটাকে গুরুত্ব দেননি। নানা কারণেই তো ওনার কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে উচ্চগ্রামে উঠে যায়, খবর নিতে গেলে দেখা যায় কারণটা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর।
অতএব স্বরটা কান থেকে মনে প্রবেশ করেনি। কিন্তু ঘটনাটাকে কি সত্যিই একটা ভয়াবহ ঘটনা বলে মনে হয়েছিল শম্পার মা-বাপের! ওঁরা শুধু মেয়ের দুঃসহ স্পর্ধা দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন!
তার মানে নিজের সন্তানকে আজ পর্যন্ত চেনেননি ওঁরা।
কেই বা চেনে?
কে পারে চিনতে?
সব থেকে অপরিচিত যদি কেউ থাকে, সে হচ্ছে আপন সন্তান। যাকে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসের মোড়ক দিয়ে মুড়ে রাখে মানুষ।
কাজেই সামান্য ওই কথা-কাটাকাটির সূত্রে কী ঘটে গেল, অনুধাবন করতে পারলেন না শম্পার মা-বাপ। ওঁরা ঠিক করলেন মেয়ে এলে কথা বলবেন না, বাক্যালাপ বন্ধই করে ফেলবেন।
অনামিকা দেবী লেখায় ইতি টেনে একটু টান-টান হয়ে বসলেন, আর তখনি চোখ পড়লো টেবিলের পাশের টুলটার ওপর, আজকের ডাকের চিঠিপত্রগুলো পড়ে রয়েছে।
বাচ্চা চাকরটা কখন যেন একবার ঢুকেছিল, রেখে গেছে। অনেকগুলো বইপত্তরের উপর একখানা পরিচিত হাতের লেখা পোস্টকার্ড।