বাইরে থেকে ঢুকতেই সামনের ঘরখানা বাইরের লোকের বসবার ঘর। বকুল ও-বাড়ি থেকে চলে এসে ঘরে পা দিয়েই সেকেণ্ড কয়েক প্রায় অভিভূতের মত তাকিয়ে রইলো।
বকুলের অভিভূত অবস্থার মধেই জলপাইগুড়ির নমিতা নমিত হয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বললো, আবার এলাম আপনার কাছে
নিচু হয়ে প্রণাম করার সময় নমিতাকে খুব আড়ষ্ট দেখতে লাগলো। কারণ নমিতা তার পরনের সাটিনের শাড়িটা আষ্টেপৃষ্ঠে ‘পিন’ মোরে এমন ভাবে গায়ে জিয়ছে যে কোনোখানে ভাজ রাখেনি। নিচু হবার পর উঠে দাঁড়াতেই মিতার কণাভরণের ঝাড় এমন ভাবে দুলে উঠলো যে সারা ঘরের দেওয়ালে যেন তার ঝিলিক খেলে গেল। ওই ঝাড়লণ্ঠনের মতো গহনাটার দোদুল্যমান পাথরগুলো নকল বলেই বোধ করি এতো ঝকমকে।
অনেকখানি গলাকাটা ব্লাউজের ওপরকার বিস্তৃত এলাকা জুড়ে নমিতা যে কণ্ঠাভরণখানি স্থাপিত করেছে তার দুতিতেও চোখ ঝলসায়। নমিতার মাথার উপর দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের গোপুরম সদৃশ একটি খোঁপা, নমিতার উগ্ৰ পেণ্ট করা মুখটায় একা ভাবলেশশূন্য ভাব, আর নমিতার লম্বা ছুঁচলো নখগুলো অদ্ভুত চকচকে একটা রঙে এনে করা।
বকুলের হঠাৎ একটা বাজে প্রশ্ন মনে এলো। জলপাইগুড়ি ছেড়েই কি নখ রাখতে শুরু করেছিল নমিতা, না হলে এতো বড় বড় হলো কী করে! নানা ছাদের নকল নখ যে বাজারে কিনতে মেলে, এটা বকুলের জানা ছিল না। বকুল চিরদিনই অলক্ষিত একটা জগতের রহস্য যবনিকা উন্মোচনের চেষ্টায় বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরছে, লক্ষিত জগতের হাটে যে কতো কী রহস্যের বেচাকেনা চলে, তার সন্ধানই রাখে না।
নমিতা বললো, অনেক দিন ধরেই ভাবছি, হয়ে উঠছে না। কতকটা সাহসের অভাবেও বটে।
নমিতার যা কিছু আড়ষ্টতা এখন বোধ করি শুধু পোশাকে গিয়েই আশ্রয় নিয়েছে, কথাবার্তার স্বরে লেশমাত্রও নেই।
বকুল চমৎকৃত না হয়ে পারে না।
বকুল তাই একটু চমৎকার হেসে বলে, কেন, সাহসের অভাব কেন?
অভাব হওয়াই তো উচিত। বললো নমিতা হাতের দামী ব্যাগটা মৃদু মৃদু দোলাতে দোলাতে।
বকুল বললো, বসো, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
তারপর বললো, উচিত কেন? এটা তো তোমার চেনা জায়গা। আমিও অপরিচিত নই।
নমিতা বসলো।
তারপর কাজলটানা চোখটা একটু তুলে বললো, তা ঠিক। আপনি আমার চেনা, কিন্তু আমি কি আপনার চেনা? আমাকে কি আপনার আর জলপাইগুড়ির নমিতা বলে মনে হচ্ছে?
বকুল হেসে ফেলে, তা অবশ্য ঠিক হচ্ছে না।
এটাই চেয়েছিলাম আমি, নমিতা বেশ দৃঢ় আর আত্মস্থ গলায় বলে ওঠে, চেয়েছিলাম আমার সেই দীনহীন পরিচয় মুছে ফেলতে। তাই আমার নিজের কাছ থেকেই অতীতটাকে মুছে ফেলেছি।
বকুল ওর মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকায় একটু। পেন্ট-এর প্রাণহীন সাদাটে রঙের নীচে থেকে একটা উত্তপ্ত রক্তোচ্ছাস ঠেলে উঠতে চাইছে যেন। তার মানে মুছে ফেলার নিশ্চিন্ততাটুকু নিতান্তই আত্মসন্তুষ্টি। ওই ঠুনকো খোলাটায় একটু টোকা দিয়ে দেখতে গেলেই হয়তো কাজলের গৌরব বিধ্বস্ত হয়ে যাবে।
বকুল সেই টোকা দেওয়ার দিকে গেল না
বকুল ঐ ঠুনকোটাকেই শক্ত খোলা বলে মেনে নেওয়ার ভঙ্গিতে বললো, তা ভালো। দুটো জীবনের ভার বহন করা বড় শক্ত। একটাকে ঝেড়ে ফেলতে পারলে বাকি ভারটা সহজ হয়ে যায়।
ঠিক বলেছেন আপনি, নমিতা যেন উল্লসিত গলায় বলে, আমিও ঠিক তাই ভেবেছিলাম। এখনো ভাবছি।
বকুল কৌতুকের গলায় বলে উঠতে যাচ্ছিল, মহাজনেরা একই পদ্ধতিতে ভাবেন কিন্তু থেমে গেল। এই মেয়েটার সঙ্গে এ কৌতুকই কৌতুককর।
বকুল খুব সাদাসিধে গলায় বললো, এখন আছো কোথায়?
খুব খারাপ জায়গায়–, নমিতা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বললো, সে আপনাকে বলা যায় না।
বকুল এবার একটু কঠিন হলো। বললো, থাকার জায়গাটা খারাপ হলেও তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে খারাপ নেই, বেশ ভালোই আছে।
হা, ভালো ভালো জামাকাপড় গহনা-টহনা পরেছি-নমিতা হঠাৎ বুনোর মতো বলে ওঠে, এটাই সংকল্প করেছি, যদি নামতেই হয় তত শেষ পর্যন্ত নেমে দেখবো। পাতাল থেকে যদি রসাতলেও যেতে হয় তাই যাবো।
বকুলের মনে হলো, নখটা না হয় নমিতা জলপাইগুড়ি ছেড়ে অবধিই রাখতে শুধু করেছে, কিন্তু কথাগুলোও কি সেই ছাড়া থেকে শিখতে শুরু করেছে? না দীর্ঘদিন ধরে শিখে শিখে পুঁজি করছিলো?
বকুল আর একটু কঠিন আর নির্লিপ্ত গলায় বললো, নিজের জীবন নিয়ে নিজস্ব সঙ্কল্পের অধিকার সকলেরই আছে, কিন্তু আমার কাছে এসেছ বলেই জিজ্ঞেস করছি নমিতা, তুমি কি নামবার সংকল্প নিয়েই তোমার দীনহীন পরিচয়ের আস্তানা থেকে বেরিয়ে চলে এসেছিলে?
নমিতা হঠাৎ যেন কেঁপে উঠলো।
তারপর আস্তে বলল, জানি না। এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি শুধু ওদের সকলকে দেখাতে চাই, শুধু দুটি খেতে-পরতে দেওয়ার বিনিময়ে যার মাথাটা কিনে রেখেছি ভেবেছিল, সে অতো মূল্যহীন নয়।..আর-আর আমার সেই স্বামীকেও দেখাতে চাই, উচিতমতো ট্যা-খাজনা না দিয়েও চিরকাল সম্পত্তিকে অধিকারে রাখা যায় না। সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যায়।
বকুল এই প্রগলভ কথার উত্তর দেবে কি দেবে না ভেবেও বলে ফেলে, তুমি তো দেখছি এই ক’দিনে অনেক কথা শিখে ফেলেছে।
নমিতা নড়েচড়ে বসে।
নমিতা হাতব্যাগের মুখটা একটু খুললো, ছোট্ট একটি রুমাল বার করে মুখটা একটু মুছে নিয়ে বেশ দৃঢ় গলায় বলে, এই ক’দিনে? মোটেই তা নয়, অনেক অনেক দিন ধরে এসব ভাবনা ভেবেছি, এসব কথা শিখেছি। তবু চেষ্টাও করে চলেছিলাম, যে গণ্ডির মধ্যে জন্মেছি, আছি, সেখানেই যাতে থাকতে পারি। কিন্তু হঠাৎ চোখটা খুলে গেল। মনে হলো–এই “ভালো থাকার” মানে কী? এই সৎ জীবনের মূল্য কী? একজন লক্ষ্মী বৌকে ওরা দাম দেয়? ‘আমি’ মানুষটাকে দাম দিচ্ছে? তখনই ঠিক করলাম নিজের দাম যাচাই করতে বেরোবো। ভয় ছিলো, লেখাপড়া শিখিনি, সহায়-সম্বল কেউ নেই, এই অচেনা পৃথিবীতে কোথায় হারিয়ে যাবো! হঠাৎ সে ভয়ও একদিন দূর হয়ে গেল। আমার বাপের বাড়ির আত্মীয়রা আবার যখন আমাকে জলপাইগুড়িতে ঠেলে দেবার চেষ্টা করলো, তখনই হঠাৎ মনে হলো, কাঁদের কাছ থেকে হারিয়ে যাবার ভয়? বাইরের জগতে মেয়েমানুষের দুটো ভয়। একটা যা সব মানুষেরই আছে, প্রাণের ভয়। সেটা আমার মতো মেয়ের পক্ষে বেশী নয়। আর একটা ভয়দুর্গতিতে পড়বার ভয়। তা মনে যদি সঙ্কল্প করে নিই যে কোনো দুর্গতিই আসুক লড়ে দেখবো, তাহলে আর ভয় কী রইলো? তারপর তো দেখছেনই।
তা তো দেখছিই। বকুল নমিতার প্রায় ফেটে-পড়া-মুখটার দিকে তাকিয়ে একটা আক্ষেপের অনুভূতিতে কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায়। সেই বিষণ্ণ গলাতেই বলে, আত্মীয়-সমাজের কাছে ছাড়াও আরো একটা হারানো দিক আছে নমিতা, সেটা হচ্ছে নিজের কাছে নিজেকে হারানো
নমিতা আরো একবার যেন কেঁপে উঠলো। তারপর বললো, আমি মুখসূখ একটু অতো কথা বুঝি না। আমি শুধু দেখাতে চাই আমি একেবারে ফেলনা ছিলাম না।
বকুল আর কথা বাড়ায় না।
বকুল আবার সাদাসিধে গলায় বলে, তা যাক, আজ হঠাৎ এসে পড়লে যে? এদিকে কোথাও এসেছিলে বুঝি?
না, আপনার কাছেই এসেছিলাম।
নমিতা ঈষৎ ক্ষুব্ধ গলায় বলে, আপনি আমায় মানুষ বলে গণ্য না করলেও আমি আপনাকে শ্রদ্ধাভক্তি করি। তাই জীবনে একটা নতুন কাজে নামবার আগে আপনাকে
বকুল লজ্জিত গলায় তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, একথা বলছো কেন নমিতা? “মানুষ” বলে গণ্য করি না এটা কেমন কথা? কী নতুন কাজে নামছে বলে শুনি।
নমিতা আবার দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে, কাল থেকে আমার ছবির সুটিং আরম্ভ, মানে একটা কন্ট্রাক্ট হয়েছে। নায়িকার রোলই দিচ্ছে।
শুনে খুশী হলাম, বকুল বলে, একটা কার্মজীবন পেয়েছে, এটা মঙ্গলের কথা।
মঙ্গলের কথা?
তা নিশ্চয়। হয়তো এর মধ্যে থেকেই তোমার ভিতরের শিল্পী-সত্তা আবিষ্কৃত হবে।
বলছেন? নমিতা যেন উৎসুক গলায় বলে, আপনার কি মনে হয় আমার মধ্যে কিছু। আছে?
বকুল মনে মনে বলে, আপাততঃ তো মনে হচ্ছে না! তুমি শিল্পকে ভালবেসে এখানে আসছো না বাপু, আসছে নিজের মূল্য যাচাই করতে! তবু বলা যায় না, কার মধ্যে কি থাকে।
মুখে বলে, সকলের মধ্যেই কিছু না কিছু থাকে নমিতা, পরিবেশে সেটার বিকাশ হয়। হয়তো তুমি একজন নামকরা জাস্টিই হবে ভবিষ্যতে। খুব ভাগ্যই বলতে হবে যে এতো। শীগগির পন্থা পেয়ে গেছ। প্রথমেই নায়িকার রোল সহজে কেউ পায় না।
নমিতা একটুক্ষণ স্থিরচোখে তাকিয়ে রইলো বকুলের চোখের দিকে। তারপর আস্তে বললো, আমাকে দেখে কি আপনার মনে হচ্ছে ‘সহজেই পেয়েছি?
এবার বকুলই বুঝি কেঁপে উঠলো।
জলপাইগুড়ির নমিতা যে এমন একটা প্রশ্ন করে বসতে পারে, তা যেন ধারণা ছিল না বকুলের।
বকুলও আস্তে বললো, তা হয়তো মনে হচ্ছে না। তবু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবো তোমার শিল্পী-জীবনটাই বড়ো হয়ে উঠুক। তীর্থযাত্রার পথেও তো কতো কাটা-খাঁচা থাকে, থাকে কাদালো!
নমিতার কাজলের গৌরব হঠাৎ ধূলিসাৎ হয়। নমিতা বোধ করি সেটা গোপন করতেই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে নীচু হয়ে সকলের পায়ের ধুলো নিয়ে বলে, আপনার আশীর্বাদ সার্থক হোক। যাই।
আরে সে কি!
বকুল আবহাওয়াটা হালকা করতেই হালকা গলায়, এক্ষুনি যাবে কি? এক মিষ্টিমুখ করে খেতে পাবে নাকি? এতোদিন পরে এলে!
না, আজ যাই—
বলে নমিতা তাড়াতাড়ি ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু তারপরই নমিতা আশ্চর্য এ কাণ্ড করে বসে!
নমিতা সারা শরীরে একটি বিশেষ ভঙ্গীতে হিল্লোল তুলে মোচড় খেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, জলপাইগুড়ির নমিতা একদিন আপনাকে তার জীবন নিয়ে গল্প লিখতে বলেছিল, তাই না? সে লেখার আর দরকার নেই, জলপাইগুড়ির নমিতা মরে গেছে; তার নতুন জন্মের নামটা আপনকে বলা হয়নি-~~-নাম হচ্ছে “রূপছন্দা”! বুঝলেন? রূপছন্দা। হয়তো ভবিষ্যতে তার কথা নিয়ে লেখবার জন্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে, সাক্ষাৎকারের জন্যে বাড়িতে ভিড় জমবে।…আচ্ছা চলি। ছবিটা রিলিজ করলে আপনাকে নেমন্তন্নর কার্ড দিয়ে যাবো।
আকস্মিক এই আঘাতটা হেনে নমিতা দ্রুত গিয়ে গাড়িতে ওঠে। রাস্তার ধারের ওই মস্ত গাড়িটা যে নমিতার, ও-বাড়ি থেকে আসবার সময় সেকথা স্বপ্নেও ভাবেনি বকুল। এখন দেখলো দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলো উর্দি পরা ড্রাইভার দরজা খুলে দাঁড়ালো, নমিতা উঠে পড়ালো।
বকুল একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
বকুলের বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস পড়লো। বকুলের অনেকদিন আগের পড়া একটা প্রবন্ধর কথা মনে পড়লো! বাজে প্রবন্ধ, লেখকও অখ্যাত, এবং ভাষাও ধারালো ছিল বলে মনে পড়ছে না, কিন্তু তার যুক্তিটা ছিল অত।
লেখকের বক্তব্য ছিল–ইহ-পৃথিবীতে আত্মপ্রতিষ্ঠার মূল্য দিতে আত্মবিক্রয় না করছে কে? অর্থোপার্জনের একমাত্র উপায়ই তো নিজেকে বিক্রি করা। কেউ মগজ বিক্রি করছে, কেউ অধীত বিদ্যা বিক্রি করছে, কেউ চিন্তাকল্পনা স্বপ্নসাধনা ইত্যাদি বিক্রি করছে, কেউবা স্রেফ কায়িক শ্রমটাকেই। মেয়েদের ক্ষেত্রেই বা তবে শরীর বিক্রিকে এমন মহাপাতক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে কেন? বহুক্ষেত্রেই তো তার একমাত্র সম্বল ওই দেহটাই।
লেখকের যুক্তি সমর্থনযোগ্য এমন কথা ভাবতে বসলো না বকুল, শুধু হঠাৎ সেটা মনে পড়লো।
কিন্তু এ কথাও তত জোর গলায় বলে উঠতে পারলো না ওর সামনে নমিতা, তোমার ওই রূপছন্দা হয়ে ওঠার কোনো দরকার ছিল না। জগতে বহু অখ্যাত অবজ্ঞাত অবহেলিত মানুষ আছে, থাকবে চিরকাল। তোমার সেই জলপাইগুড়ির “নমিতা বৌ” হয়ে থাকাই উচিত ছিল। তাতেই সভ্যতা বজায় থাকতো, থাকত সমাজের শৃঙ্খলা, আর তোমার ধর্ম।
পিছনে কখন ছোটবৌদি এসে দাঁড়িয়েছিল টের পায়নি বকুল। চমকে উঠলো তার কথায়।
মেয়েটা কে বকুল?
বকুলের কাছে যারা আসে-টাসে বা অনেকক্ষণ কথা বলে, বসে থাকে, চা খায়, তাদের সম্পর্কে ছোটবৌদির কৌতূহল এবং অগ্রাহ্য-সংমিশ্ৰিত মনোভাবের খবর বকুলের অজ্ঞাত নয়, অলক্ষ্য কোনো স্থান থেকে তিনি এদের দেখেন শোনেন এবং প্রয়োজন-মাফিক অবহেলা প্রকাশও করেন, কিন্তু এমনভাবে ধরা পড়েননি কোনোদিন। না, একে ধরা পড়া বলা যায় কি করে, বরং বলতে পারা যায় ধরা দেওয়া।
হঠাৎ নিজেকে ধরা দিতে এলেন কেন ইনি?
বকুল কারণটা ঠিক বুঝতে পারলো না। তাই আলগা গলায় বললো, এই একটা মেয়ে ইয়ে জলপাইগুড়িতে
ও কি সেই লক্ষ্মীছাড়ীর কোনো খবর এনেছিল?
আর একবার চমকে উঠতে হল বকুলকে।
বাঁধ ভেঙে গেলে বুঝি এমনিই ঘটে।
বকুল এই বাঁধভাঙা মূর্তির দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে। সেই নীচু মাথার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নীচু গলায় বলে, না তো! ও এমনি একটা মেয়ে। জলপাইগুড়িতে আলাপ হয়েছিল–
ও! অনেকক্ষণ কথা বলছিল কিনা, আমি ভাবলাম–ছোটবৌদি একটু থেমে বোধ করি নিজের দুর্বলতাটুকু ঢাকতেই এমনি হালকাভাবে বলবার মতো বলে ওঠে, বড়লোকের মেয়ে, না? বাবাঃ কী সাজ! যেন নেমন্তন্নয় এসেছে। কী বলছিল এতো?
বকুল মৃদু হেসে বলে, কী বলছিল? ও সিনেমায় নামছে, সেই খবরটা আমায় জানিয়ে প্রণাম করতে এসেছিল।
সিনেমায় নামছে? ভালো ঘরের মেয়ে?
বকুল হেসে ওঠে, কী যে বল ছোটবৌদি! ভালো ঘরের মেয়ে হবে না কেন? খুব ভালো ঘরের মেয়ে, ভালো ঘরের বৌ!
ছোটবৌদি বলে, তা বটে। এখন তো আর ওতে নিন্দে নেই। আগের মত নয়।
তারপর হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বলে ওঠে ঘোটবৌদি, লক্ষ্মীছাড়া যদি এরকমও কিছু করতে!
বকুল স্তব্ধ হয়ে যায়।
বকুলের মনে পড়ে না–এ কথার বিরুদ্ধে হাজারো প্রতিবাদ করবার আছে। বকুলকে তাই চুপ করে থাকতে হয়।
শম্পা নামের মেয়েটা হারিয়ে গিয়ে যেন এ সংসারের সবাইকে হারিয়ে দিয়ে গেছে। পরাজিতের মূর্তিতে বসে আছে সবাই। যখন সে নিজে তেজ করে চলে গিয়েছিল, তখন এদের মধ্যেও ছিল রাগ অভিমান তেজ। কিন্তু এখনকার পালা আলাদা, এখন সে এই ভয়ঙ্কর পৃথিবীর কোনো চক্রান্তে হারিয়ে গেছে, কে জানে চিরকালের জন্যেই মুছে যাবে কিনা শম্পা নামটা!
অথচ শম্পার মা আর বাবা কিছুদিন আগেও যদি তাদের তেজ অভিমান অহঙ্কারকে কিছুটা খর্ব করতো, হয়তো সব ঠিকঠাক হয়ে যেতো। শম্পার মার ভিতরের হাহাকার তাই শোকের থেকেও তীব্র। শোকের হাহাকার বাইরে প্রকাশ করা যায়, অনুতাপের হাহাকার শুধু ভিতরকে আছাড় মেরে মেরে ভেঙে গুঁড়ো করে।
শম্পার মা-বাপ যখন পারুলের ছেলের চিঠিতে জেনেছিল শম্পা পারুলের কাছে গিয়ে আড্ডা গেড়েছে, তখন কেন ছুটে চলে যায়নি তারা? কেন অভিমানিনী মেয়ের মান ভাঙিয়ে বলে ওঠেনি, রাগ করে একটা কথা বলেছি বলে সেটাই তোর কাছে এতো বড়ো হয়ে উঠলো?
তা তারা করেনি।
নিষ্কম্প বসে থেকে আস্ত সুস্থ মেয়েটাকে হারিয়ে যেতে দিয়েছে। তাদের বয়েস, বুদ্ধি, বিবেচনা, হিতাহিতজ্ঞান কিছুই কাজে লাগেনি। একটা অল্পবয়সী মেয়ের কাছ থেকে প্রত্যাশা করেছে সেই সব জিনিসগুলো–বুদ্ধি, বিবেচনা, হিতাহিতজ্ঞান।
ছোটবৌদি বকুলকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার নিজেই কথা বলে, মনটা খারাপ হয়ে থাকলেই যতো আবোল-তাবোল চিন্তা আসে, এই আর কি! ওই মেয়েটা আইবুড়ো না বিয়ে হওয়া?
বিয়ে-হওয়া। ওর স্বামী সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে গেছে, সেই রাগে ও ঘর ছেড়ে
সাধু হয়ে গেছে? সেই রাগে? কী কাণ্ড! এতো এতো অসাধু স্বামী নিয়ে ঘর করছে মেয়েরা, আর
বকুল হেসে ফেলে বলে, আহা সে তো তবু ঘর করছে! সাধু স্বামী যে ওইটিতেই বাদ সেধেছে। অথচ মেয়েরা জানে ঘর করতে পাওয়াই মেয়েদের জীবনে চরম পাওয়া
ছোটবৌদিও হেসে ফেলে, সবাই আর ভাবে কই সে-কথা?
এটা অবশ্য বকুলের প্রতি কটাক্ষপাত।
অবহাওয়াটা যে কিঞ্চিৎ হালকা হয়ে গেল এতে যেন ছোটবৌদির প্রতি কৃতজ্ঞ হয় বকুল। হেসে হেসে বলে, তা যে মেয়ের ভাগ্যে ঘর-বর না জোটে তার আর উপায় কী?
ওই এক ধাঁধা
ছোটবৌদি বলে, তোমার বাপ-ভাই বিয়ে দিলেন না, না তুমিই করলে না তা জানি না। আমি তো তখন তোমার দাদার চাকরির চাকায় বাধা হয়ে দিল্লী-সিমলে টানাপোড়েন করছি
এই সব কথা কোনদিন বলেনি বকুলের ছোঁটবৌদি। অদ্ভুত ভাবে বদলে গেছে মানুষটা। স্বল্পভাষীত্বের গৌরব নিয়েই এ সংসারে বিরাজিত ছিল সে। হঠাৎ যেন কথা বলার জন্যে পিপাসার্ত হয়ে উঠেছে।
তা বটে। বকুল কথায় সমাপ্তিরেখা টেনে দেয়।
চলো খেতে চলো–
বলেও আবার দাঁড়ায় শম্পার মা, বলে ওঠে, আমার পোড়ামুখে বলার মুখ নেই, তবু তুমি বলেই বলছি-ও-বাড়ির খবর জানো?
ও-বাড়ি!
ও-বাড়ি মানে তোমাদের পুরনো বাড়ি গো। তোমার কাকা-জ্যাঠার বাড়ি।
ওঃ! কী হয়েছে? কেউ মারা-টারা–
থেমে যায়। ঠিক যে কে কে আছে সেখানে তা ভাল করে জানে না বকুল। জ্যাঠামশাই এবং কাকারা এবং তাদের পত্নীরা যে কেউই অবশিষ্ট নেই তা জানে। না, বোধ করি ছোটখুড়ী ছিলেন অনেক দিন, আসা-যাওয়া বিরল হয়ে গেছে।
অতএব থেমেই যায়।
ছোটবৌদি মাথা নেড়ে বলে, না, মারা-টারা যাওয়া নয়, ও-বাড়ির জ্যাঠার নাতনী সাইকেলে বিশ্বপরিভ্রমণের দলে মিশে পাড়ি দিয়েছে। ছটা ছেলে আর তার সঙ্গে কিনা ওই একটা মেয়ে। মেয়েকে খুব আহ্লাদী করে মানুষ করেছেন আর কি!
বকুল একটু অবাক না হয়ে পারে না সত্যিই। দর্জিপাড়ার গলির তাদের ওই নিকট আত্মীয়দের কোনোদিনই ভাল করে তাকিয়ে দেখেনি। এইটুকুই শুধু ধারণা ছিল ওরা বেশ পিছিয়ে থাকা, ওদের গলি ভেদ করে সূর্য সহজে উঁকি মারতে পারে না। ওর জেঠতুতো দাদার বৌয়ের অনেকদিন আগের দেখা চেহারাটা মনে পড়লো, একগলা ঘোমটা, নরম-নরম গলা, বয়সে ছোট ছোট দ্যাওর-ননদদের পর্যন্ত ঠাকুরপো ঠাকুরঝি ডেকে কী সমীহ ভাবে কথা বলা! আর মনে পড়লো তার বা হাতখানা। অন্তত ডজন-দেড়েক লোহাপরা দেখেছে তার হাতে শাখা-চুড়ির সঙ্গে। কথার মাঝখানে কেন কে জানে, যখন-তখন সেই লোহাপরা হাতটা কপালে ঠেকাতেন আর দু’কানে হাত দিতেন! মনে হতো–সর্বদাই অপরাধের ভারে ভারাক্রান্ত।
সে কতোদিনের কথা? মেয়েটা কি তারই মেয়ে?
তবু এ সংবাদে কৌতুকই অনুভব করে বকুল। বলে, তা ভালো তো। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে থাকলেই বিপদের আশঙ্কা, এ ছ’জন একজনকে পাহারা দেবে।
পাহারা দেবে, না সদলবলেই আহার করবে কে জানে! ছোটবৌদি বলে, এই ভেবে অবাক হচ্ছি, তোমাদের সেই বাড়িতেও এত প্রগতির হাওয়া বইলো!
বাঃ, কাল বদলাবে না? যুগ কি বসে থাকবে?
ওদের বাড়িটা দেখলে তো মনে হতো বুৰি “বসেই আছে”! হঠাৎ একেবারে
বকুল অন্যমনস্ক গলায় বলে, হয়তো এমনিই হয়। ঘরে দরজা-জানলা না থাকলে, একদিন ঘরে আটকানো প্রাণী দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে নিঃশ্বাস নিতে চায়।
তা বলে বাপু এতোটা বাড়াবাড়ি–ছোটবৌদি বলে ওঠে, থাক, আমার কোনো কথা বলা শোভা পায় না।
বকুল ওর অপ্রতিভ ভাবটাকে না দেখতে পাওয়ার ভান করে বলে, তাড়াতাড়ি করতে গেলেই বাড়াবাড়ি করতে হয় ছোটবৌদি, হঠাৎ যখন খেয়াল হয় “ছি ছি, বড্ড পিছিয়ে আছি”, তখন মাত্রাজ্ঞাটা থাকে না।
হবে হয়তো বলে একটা নিঃশ্বাস ফেলে শম্পার মা। হয়তো এই কথায় তার নিজের মেয়ের কথাই মনে এসে যায়।
কিন্তু এমন কী দরজা-জানলা এটে রেখেছিল তারা? তাই তাদের মেয়ে দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে গেল? আমরা তো যা করেছি ওর ভালোর জন্যেই–তা আমরা ওকে বুঝিনি, ওই বা আমাদের বুঝবে কেন?
অদ্ভুতভাবে ভেঙে পড়েছে বলেই একটু বুঝতে পারছে শম্পার মা। আস্ত থাকলে কি বুঝতো? না বুঝতে চাইতো?
এই বাড়িতেই আর একটা অংশেও চলছিল একটা নাটকীয় দৃশ্য।
অলকা ঘর-বার করছিল, অলকা বার বার জানলার ধারে এসে দাঁড়াচ্ছিল, তবু অলকা তার মুখের রেখায় একটা যুদ্ধং দেহি ভাব ফুটিয়ে রাখছিল বিশেষ চেষ্টায়। কারণ কাঁচঘেরা বারান্দার একধারে ক্যাম্বিসের চেয়ারে উপবিষ্ট অপূর্বর মুখের দিকে মাঝে-মাঝেই কটাক্ষপাত করছি অল।
সে মুখ ক্রমশই কঠিন কঠোর আর কালচে হয়ে আসছে, আর তার আগুনজ্বলা চোখ দুটো বার বার বুককেসের উপর রাখা টাইমপীসটার উপর গিয়ে পড়ছে।
উঃ, লোকটা কী ধড়িবাজ! ভাবলো অলকা, সেই থেকে টেলিফোনটার গা ঘেঁষে বসে আছে, এক মিনিটের জন্য নড়ছে না। একবার বাথরুমে যাবারও দরকার পড়তে হতো না এতোক্ষণ সময়ের মধ্যে? অলকা তো তাহলে ওই টেলিফোনটার সহায়তায় ব্যাপারটা ম্যানেজ করে ফেলতে পারতো। বলে উঠতে পারতো, এই দ্যাখো কাণ্ড, এখন তোমার কন্যে ফোন করলেন, “ফিরতে একটু দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাপীকে ভাবনা করতে বারণ কোরো”।
তারপরই ব্যাপারটাকে লঘুতর করে ফেলবার জন্যে হেসে গড়িয়ে বলতে, বুঝছো। ব্যাপার? ‘মা তুমি ভেবো না’ নয়, “বাপীকে ভাবনা করতে বারণ কোরো।” জানে তার বাপীই সন্ধ্যেরাত্তির থেকেই ঘড়ির দিকে তাকাবে আর জানলার দিকে তাকাবে। আর জগতে যতরকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, মনে মনে তার হিসেব কষবে।…মা বেচারীও যে ভেবে অস্থির হতে পারে সে চিন্তা নেই মেয়ের।
হ্যাঁ, এইভাবেই কথার ফুলঝুরি ছিটিয়ে পরিস্থিতি হালকা করে নিতে পারতো অলকা, বরাবর যেমন নেয়। কতো ম্যানেজ করে আসছে এযাবৎ তার ঠিক আছে? মেয়ে বড় হয়ে ওঠার আগে থেকেই চলছে অলকার এসব কলাকৌশল।
ওই অপূর্ববাবুটি বাইরের লোকের কাছে যতই প্রগতিশীলের ভান করুক, আর উদারপন্থীর মুখোশ আঁটুক, ভিতরে কি তা তো জানতে বাকি নেই অলকার। মনোভাব সেই আদ্যিকালের পচা পুরনো মেয়েরা একটু সহজে স্বচ্ছন্দ জীবন পেতে চাইলেই সেই সেকালের সমাজপতিদের মত চোখ কপালে উঠে যায়। নেহাৎ নাকি এই আমি খুব শক্ত হাতে হাল ধরে বসে আছি, তাই আধুনিক যুগের সামনে মুখটা দেখাতে পারছি।
তবু শুধুই কি জোরজুলুম চালাতে পাই? কত রকমেই ম্যানেজ করতে হয়–সাজিয়ে বানিয়ে গুছিয়ে কথা বলে, রাতকে দিন আর দিনকে রাত করে।
এই এখুনি সামলে ফেলা যেতো, যদি লোকটা ওই টেলিফোনের টেবলটার গায়ে বসে না থাকতে।
মেয়ের ওপরও রাগে মাথা জ্বলে যায় অলকার। জানিস তো সব, তবে এত বাড়াবাড়ি কেন? যা বয়-সয় তাই ভালো।…বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকে গেছিস, বেশ করেছি, তাই বলে রাত এগারোটা বেজে যাবে-বাড়ি ফিরবি না? এতো রাত অবধি কেউ পিকনিকের মাঠে থাকে?
ভাবতে থাকে এসব, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের দিকে যুক্তি শক্ত করতে আপন মনে বলে ওঠে, বাবা জানেন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে কিনা!
‘বাবা’ অবশ্য সেই অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন গুরুদেব। অলকার পিত্রালয়ের সম্পর্কসূত্রে তিনি অলকারও গুরুদেব। শুধু অলকারই বা কেন, সত্যভামারও।
উদার প্রগতিবান সেই ‘বাবা’র মত এই মানুষ হচ্ছে সোনার জাত, ও কখনো অপবিত্র হয় না। তা ছাড়া এও বলেন, ভালমন, ভুল-ঠিক, এ সবের বিচার করবার তুই কে রে? মন হচ্ছে মহেশ্বর, সে যা চাইবে তা করতে দিতে হবে তাকে, ফলাফলের চিন্তার দরকার নেই, সব ফলাফল গুরুর চরণে সমর্পণ করে তুড়ি দিয়ে কাটিয়ে দিবি ব্যস।
এমন উদারপন্থী ‘বাবা’র শিষ্যশিষ্যার সংখ্যা যে অগুনতি হবে, তাতে আর সন্দেহ কি? অলকার পিতৃকুলের কি মাতৃকুলের কেউ একজন হয়তো আদি শিষ্যত্বের দাবি করতে পারেন, কিন্তু তারপর তিনকুলের কেউ আর বাকি নেই।
তবে অলকার এমনি কপাল, তরুণ মেয়েটাকেও ‘বাবা’র চরণে সপে দিতে পেরেছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত স্বামীটিকে নোওয়াতে পারলো না। অথচ ঘরে বাইরে সবাই বলে অলকার ভাগ্যে যেমন বশংবদ স্বামী, কটা মেয়ের ভাগ্যে তেমন জোটে?…আর শাশুড়ী ননদরা তো স্পষ্টাস্পষ্টি স্ত্রৈণই বলে।
হায়! যদি তারা জানতে পারতো, স্বামীকে কেবলমাত্র লোকচক্ষে ওই স্ত্রৈণরূপে প্রতিভাত করতেই কত কাঠখড় পোড়াতে হয় অলকাকে, কতখানি জীবনীশক্তি খরচ করতে হয়?
নেহাৎ নাকি গুরুবলে বলীয়ান বলেই পেরে চলছে অলকা।
এখনো তাই অবস্থাকে সেই হতভাগা মেয়ের অনুকূলে আনতে বলে ওঠে অলকা, বাবা জানেনে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে কিনা–
অগ্নিগর্ভ মানুষটা এতক্ষণকার স্তব্ধতা ভেঙে চাপা গলায় গর্জে ওঠে, দুর্ঘটনা!
প্রশ্ন না মন্তব্য? সমর্থন না প্রতিবাদ? কে জানে!
অলকার মনে হয় বোধ হয় অবস্থার হাতলটা চেপে ধরতে পারলো। তাই তেমনি উদ্বিগ্ন গলায় বলে, তাই ভাবছি! ‘‘বাই কারে” গেছে তো সব! ফেরার সময় গাড়িফাড়ি বিগড়ো্লো, না আরো কিছু ঘটলো, অলকা গলার স্বর আরো খাদে নামায়, বুকের মধ্যে কি যে করছে। আজকাল তো রাতদিনই আকসিডেন্ট!
আগুনের শিখা আর একবার ঝলসে ওঠে, তা যদি হয়ে থাকে তো বলবো তোমাদের ভগবান মারা গেছেন। এতোক্ষণ তো আমার ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছিলাম যেন অ্যাকসিডেন্টই হয়। এমন হয় যাতে তোমার ওই নাচিয়ে মেয়ের পা দু’খানা জম্মের মত খোঁড়া হয়ে যায়।
অলকা যথারীতি ঠিকরে উঠলো।
অলকা যখন ভাবছিল অবস্থা আয়ত্তে আসি-আসি করছে, তখন কিনা এই কথা! এতোখানি অপমান তো আর বরদাস্ত করা যায় না!
অলকা যথারীতি ঝঙ্কারে বলল, কী বললে?
যা বলেছি আবারও বলছি। প্রার্থনা করছি তোমার মেয়ে যেন ঠ্যাং ভেঙে বাড়ি ফেরে।
অলকা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়, তা ওইটুকুই বা আর রেখে-ঢেকে বলা কেন? বলল যে-প্রার্থনা করছি যেন আর বাড়ি না ফেরে। যেন গাড়ির তলায় পেষাই হয়ে যায়। আশ্চর্য প্রাণ বটে! তুমি না বাপ!
সেই তো, সেটাই তো অস্বীকার করার উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। যদি পেতাম।
ওঃ বটে! বলতে লজ্জা করছে না? বাড়ির আর একটি মেয়েও তো দেখলাম। মেয়ে বাপের নাকের সামনে দিয়ে তেজ করে বেরিয়ে গেল, আর বাড়ি ফিরলো না, অথচ কোন নিন্দে নেই। যত দোষ আমার মেয়ের।
নিন্দে নেই কে বললো? এই তো তুমিই নিন্দে করছে। তবে তুমিও জানো আর আমিও জানি, সে মেয়ে পাতালের সিঁড়িতে পা বাড়াবে না।
থামো থামো! মেয়েমানুষ একলা রাজরাস্তায় ঘুরে বেড়ালে কে তাকে স্বর্গের সিঁড়িতে তুলে দিতে আসে?…আমি বলছি
অলকা যে কি বলতো কে জানে, সত্যভামা এসে পড়লো হড়মুড়িয়ে, বলে উঠলো, বাপী খুব রাগ করছে তো? জানি করবেই। ওদের না বাপী, এত করে বললাম, সারাদিন এতো কাণ্ডের পর আবার নাইট শোর সিনেমা! বাপী বাড়ি ঢুকতে দেবে না। তা শুনলো না গো। …মেয়েগুলো কী পাজী জানো? বলে কি আমরা বুঝি একটা বাড়ির মেয়ে নয়? আমাদের বুঝি মা-বাপ নেই? তবু আমি শীলাকে ধরে বেঁধে তুলে নিয়ে ছবি শেষ হবার আগেই চলে এলাম। সবাই যা ঠাট্টা করলো!..ও বাপী, কথা বলছ না যে? বাপী—
বাপের গলা ধরে ঝুলে পড়ে সত্যভামা, আমি বলে বন্ধুদের কাছে মুখ হেঁট করে আগে আগে চলে এলাম, তুমি রেগে আছো বলে, আর তুমি কিনা হাঁড়ি-মুখ কবে–হাসো হাসো বলছি! ও বাপী! না হাসলে আমি দারুণ ভাবে কেঁদে ফেলবো–
বাপীকে নরম না করা পর্যন্ত থামবে না সে নিশ্চিত।