৩১. মায়ের চিঠি

মায়ের চিঠি চিরদিনই গভীর ভালবাসার বস্তু। যেদিন আসতো, সেদিন যেন শোভনের চোখেমুখে আহ্লাদের আলো জ্বলতো, আর ছোট্ট একটু চিঠি পড়তেই কতখানি যে সময় লাগতো!

পারুল হয়তো জানতো না এমন ঘটনা ঘটে। রেখা এই নিয়ে ঠাট্টা করতে ছাড়তো না, বলত, পড়ে পড়ে তো মুখস্থ হয়ে গেল, আর কতবার পড়বে?

শোভন অপ্রতিভভাবে বলতো, না, একটা জায়গা ঠিক পড়া যাচ্ছে না, অক্ষরটা কেমন জড়িয়ে গেছে।

রেখা চোস্ত গলায় বলতো, অক্ষর জড়িয়ে যাবার কোনো প্রশ্নই নেই। তোমার মার হাতের লেখা তো ছাপার অক্ষরের মত।

শোভন যে কেন অপ্রতিভ হতো তা শোভনই জানে। শোভন তো অনায়াসেই বলতে পারতো, তোমার মার চিঠিও তুমি কম বার পড়ো না।

কিন্তু ওই সহজ কাজটা পেরে উঠতো না শোভন, তাড়াতাড়ি চিঠিটা তুলে মেখে দিত।

অথচ পেরে উঠলে হয়তো জীবন এমন জটিলতার পথে গিয়ে পৌঁছত না। যতই তুমি ভদ্র হও, মার্জিত হও, মাঝে-মধ্যে প্রতিবাদে মুখর হবারও দরকার আছে।

অপ্রতিবাদ অন্যায় দুঃসাহসের জন্মদাতা।

এখন রেখা এখানে নেই, মায়ের চিঠি একশোবার পড়লেও কেউ ব্যঙ্গ হাসি হেসে উঠবে না, তবু একবার মাত্র পড়েই চিঠিখানা টেবিলে ফেলে রেখে পাথরের মত বসে আছে কেন শোভন?

মা তো তীব্র কোনো তিরস্কার করেনি চিঠির মাধ্যমে, কোনো ধিক্কার বাকাও পাঠায়নি! তবু ওই চিঠিটা জ্বলন্ত আগুনের মত লাগছে কেন তার? শুধু ওই চিঠিটার জন্যে? নাকি তার সঙ্গের ওই একটুকরো কাগজের এক লাইন লেখাটুকুই অগ্নিবাহী?

রাজাকে ভাবতে চেষ্টা করছে শোভন, ওই লেখাটার সঙ্গে মেলাতে পারছে না কিছুতেই। শোভন এখন রাজার জন্যে যা করবে, রাজা বড় হয়ে তার পাই-পয়সাটি পর্যন্ত শোধ করে দেবে, এখন থেকে বাপকে সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখলো রাজা!

অনেকবার ভাবতে চেষ্টা করলো, এটা কোনো ব্যাপারই নয়, একেবারেই ছেলেমানুষের ছেলেমানুষী। ওখানে যে থাকতে ভাল লাগছে না, এটা হয়তো ঠিক, অথচ এখানে আসার উপায়ও দেখতে পাচ্ছে না, তাই বোর্ডিঙের কথা মাথায় এসেছে।

আর ওই প্রতিশ্রুতিটা স্রেফ প্রস্তাবটাকে জোরালো করবার জন্যে। পাছে বাবা বলে বসে ও বাবা, বোর্ডিং? সে তো দেদার খরচের ব্যাপার! যা-তা জায়গায় তো দিতে পারবো না

তাই আগে থেকেই সে পথ বন্ধ করে দেবার চালাকিটি খেলেছে। কিন্তু চেষ্টা করে ভাবা ভাষাটাকে কি বিশ্বাসের ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করা যায়? না তার থেকে নিশ্চিন্ততার ফল মেলে?

ভাবনাটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, আর একটা অজানা ভয় যেন গ্রাস করতে আসছে শোভনকে। হ্যাঁ ভয়, ভয়ই।

চাঁদের টুকরোর মত এক টুকরো ছেলে রাজার হাতের এক টুকরো লেখা যেন শোভনের সর্বনাশের ইশারা বহন করে এনেছে।

অনেকক্ষণ পাথরের মত বসে থেকে মায়ের চিঠিখানা ত্যাবার তুলে নিল শোভন, নিয়ে পড়তে লাগলো। মা লিখেছে

শোভন, ছেলেটার যন্ত্রণা আর চোখে দেখতে পারছিলাম না। তাই মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি জেগেছিল। ভেবেছিলাম, আমার কপালে যা থাকে থাক, পরে তুই আমায় জেলেই দিস আর ফাঁসিই দিস, মার কাছ থেকে কেড়ে-আনা ছেলেটাকে চুপিচুপি আবার তার মার কাছেই ফেরত দিয়ে আসি। তুই তার স্বামী কেড়ে নিয়েছিস, সংসার কেড়ে নিয়েছিস, সামাজিক প্রতিষ্ঠা পরিচয় কেড়ে নিয়েছিস, আবার সন্তানটাকেও নিলি ভেবে বুকে বড় বাজছিল, কিন্তু দেখলাম, দুষ্ট বুদ্ধিটা মাঠে মারা গেল, আর উপায় নেই। ফেরত দেওয়া যাবে না।

তা বলে ভাবিস না জিনিসটা তোরই রয়ে গেল।

না, সে আশা করিস না শোভন।

ওর জগতে আর মাও নেই, বাপও নেই। একটা নির্দোষ নিশ্চিন্ত শিশুকে শুধু তোদের মতির খেয়ালে একসঙ্গে পিতৃমাতৃহীন করে ছেড়েছিস।

ওই কচি বাচ্চাটাকে এখন সেই ভয়ঙ্কর শূন্যতার আর ভয়ঙ্কর ভারী একটা পাথরের ভার নিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে রাখতে চলতে হবে।

ভগবানের হাতের মার তবু সহ্য হয়, মানুষের মারটা অসহ্য। কিংবা হয়তো সবটাই ভগবানের হাত থেকে আসে মানুষ নিমিত্তটার ভাগী হয় মাত্র!

যাক গে বাহুল্য কথা, ছেলেটাকে তুই দেখেশুনে একটা বোর্ডিঙেই ভর্তি করে দে, জবরদস্তি করে তোর ইচ্ছেটা ওর ওপর চাপাতে চেষ্টা করিস না, শেষরক্ষা হবে না।

এখন কি মনে হচ্ছে জানিস, তোর সেই পরলোকগত পিতৃদেব অমলবাবুর সঙ্গে তোর আসলে কোনোই তফাৎ নেই।

তিনিও লোক হিসেবে কিছু খারাপ ছিলেন না, ভদ্র মার্জিত সৎ। শুধু ভদ্রলোক তার স্ত্রী পুত্রকে নিজের তৈরী নক্সার ছাঁচে ঢালাই করতে চেয়েছিলেন, তারা যে আসলে মালমশলা নয়, রক্তে-মাংসের মানুষ–এটা খেয়াল করেননি…তুইও করলি না, করছিস না।

এখন আর তোর মনে আছে কিনা জানি না, কিন্তু আমার ওই স্মৃতিশক্তি জিনিসটা একটু বেয়াড়া রকমের বেশী, তাই সব মনে থাকে, মনে পড়ে!

তাই মনে পড়ছে, রেখা যখন তোর কাছে এলো, তখন রেখা গঙ্গামাটি দিয়ে শিব গড়ে পুজো করতো। ওর বাপের বাড়িতে ওসবের চল ছিল। ওর ওই শিবপুজো নিয়ে তুই এমন হাসি-ঠাট্টা শুরু করলি যে, ও বেচারী লজ্জাটজ্জা পেয়ে বন্ধ করে দিলো।–তারপর ঘর করতে এসে শোবার ঘরের আলমারির মাথায় লক্ষ্মীর পট আর ঘট বসিয়ে দু’বেলা শুধু একটু ধূপ জ্বালতো, সেও তোর হাসি-ঠাট্টার ঘায়ে একদিন উড়ে গেল।

সত্যি কথা বলতে বাধা নেই, আমিও এসব দেখে হেসেছি, কিন্তু সেটা মনে মনে। তুই মুখের ওপর হাসলি।–তার পর কলসীর মধ্যে থেকে দৈত্য বেরুলো।

তোর যত পদোন্নতি হতে থাকলো, ও তত মর্ডান হতে থাকলো। ক্রমশ গুরুমারা বিদ্যেয় পি এইচ ডি হয়ে গেল তোর বৌ। তুই ওর নাগাল পেলি না আর।

ওর এখনকার যা রূপ, সে তোরই সৃষ্টি। এখন তুই হঠাৎ ভারতীয় ভাবধারায় ভিজতে বসলি, সনাতনী হলি, আর সমুদ্রে-গিয়ে-পড়া নদীকে ফের পাহাড়ের গুহায় এনে ফেলবার বায়না ধরলি! যা হয় না তা হওয়াবার চেষ্টা করলে এমনই হয় শোভন! কাঁচা মাটিকে ছাঁচে ফেলে পুড়িয়ে শক্ত করার পর আর কি তাকে নতুন ছাঁচে ঢালা যায়? যায় না, শুধু তুই যা করেছিস তাই করা যায়, ভাঙা যায়। কেউ ভেতরে ভাঙে, কেউ বাইরে ভাঙে।

আশীর্বাদ নিস।
 –মা

শোভন তার সুন্দর কোয়ার্টার্সের বিরাট লনে বসেছিল–বাগানে পেতে বসার উপযুক্ত সুন্দর শৌখিন আসনে।

শোভনের পরনে দামী টেরিলিন ট্রাউজার হালকা ফাইন লাইনের বুশশার্ট, পায়ের চটিটাতে পর্যন্ত আভিজাত্যের ছাপ। শোভনের ওই কোয়ার্টার্সের মধ্যে ঢুকে গেলেও দেখা যাবে আগাগোড়াই সুন্দর শৌখিন আর সুরুচিমণ্ডিত। ঐশ্বর্যের সঙ্গে রুচির পরিচয়ও বহন করছে শোভানের সংসার।

শোভনের সংসার?

সেটা কী?

সে কি ওই বাড়িটা? ওই খাট আলমারি, সোফা ডিভান, ফ্রীজ, কুকিং-রেঞ্জ, ডিনার-সেট, ডাইনিং টেবল?…সংসার মানে বুককেসের ওপর সাজানো পিতলের বুদ্ধমূর্তি (নিত্য যাকে ব্রাসো ঘষে চকচকে রাখা হয়), দেয়ালে টাঙানো নেপালী ঢাল, বারান্দায় ঝোলানো অর্কিড, জানলায় বসানো ক্যাকটাসের বৈচিত্র্য?

তাহলে অবিশ্যি বলতেই হয়, শোভনের সংসার যথাযথই বজায় আছে। কারণ শোভনের সংসারে একাধিক সুদক্ষ ভৃত্য আছে, যাদের দক্ষতার শিক্ষা দিয়ে গেছে একদার সুদক্ষ গৃহিণী।

শোভন যদি এখন পূর্ব অভ্যাসে একটা পার্টি দেয়, তাহলে সুব্যবস্থায় এতটুকু চিড় খাবে না। তৎসত্ত্বেও যদি অতিথিরা মনে মনে ভাবে, শ্মশানের ভূমিতে নেমন্তন্ন খেতে এলাম কেন আমরা–তাহলে বলার কিছু নেই।

বসে থাকতে থাকতে একসময় বয় এস প্রশ্ন করল, সাহেবের চা-টা এখানেই আনা হবে কিনা।

কর্মস্থল থেকে ফিরে শোভন যে বেশ পরিবর্তন করেনি, এসেই লেটারবক্সের চাবি খুলেছে, সেটা সে দেখেছে।

ওদের মহলে ‘সাহেব’ এবং মেমসাহেবকে নিয়ে যে-সব আলোচনা হয়, ভাগ্যিস সাহেবের কর্ণগোচর হয় না।

শোভন বলল, না, ভিতরে যাচ্ছি।

তারপর একসময় ভিতরে এলো।

শোভনের কাছে একটা ফুলের মত মেয়ে আর দেবদূতের মত ছেলে ছুটে এলো না, বাপী আজ তোমার এত দেরি হলো কেন? বলে অনুযোগ করলো না, শুধু যেন সমস্ত পরিবেশটাই মৌন গভীর একটা অভিযোগের মূর্তিতে তাকিয়ে বসে আছে।

আজ বাতাসও কি অসহযোগিতা করছে? পর্দাগুলো উড়ছে না কেন? টেবল-ঢাকার কোণগুলো? ওগুলো এলোমেলো উড়লেও যেন মনে হয় কোথাও কোনোখানে প্রাণের স্পন্দন আছে।

দু-তিনটে ঘর চাবিবন্ধ আছে, মগনলাল খোলে, আবার ঝাড়মোছা করে বন্ধ করে রেখে দেয়। আচ্ছা, বাড়িটা কি হঠাৎ অনেক বড় হয়ে গেল! রেখা যে কেবলই বলতো, আর একখানা ঘর বেশী থাকলে বাড়িটা সত্যিই আইডিয়াল হতো!

তার মানে জায়গায় কিছু ঘাটতি পড়ছিল। শোভন সেটা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব না করলেও এমনি অনুভব করতো, সত্যি–সবটাই ভরা-ভর্তি। 

দু-একটা মাত্র মানুষের উপস্থিতি-অনুপস্থিতিতে এত বিরাট পার্থক্য ঘটে!

শোভন তো যে-সে কেরানীবাবু নয় যে, মন লাগছে না বলে কিছু না খেয়ে শুয়ে পড়ে থাকবে? শোভনকে ভৃত্যবর্গের কাছে সাহেবের সম্মানটা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।

চায়ের পর্ব মিটিয়ে শোভন সামনের একটা দরজা খুললো, পর্দা সরিয়ে দরজায় দাঁড়ালো। এটা ওদের দু ভাইবোনের খেলাঘর ছিল। দুজনের হলেও ঘরের বারো আনা অবশ্যই একজনের। তার দোলনা ঘোড়া, তার রেলগাড়ি মোটরগাড়ি উড়োজাহাজ, তার কুকুর খরগোস হাতী পাখি, আর বহু-বুর্ণের বহু-মাপের বহু-বৈচিত্র্যময় পুতুলের মেলা।

আচ্ছা, খুকুর ওই পুতুলগুলোকে নিয়ে যায়নি কেন রেখা? রেখা কী নির্মম? শোভন তো রাজার খেলবার বস্তুগুলো যতটা পেরেছে, তার সঙ্গে দিয়ে এসেছে!

যদিও সেগুলোয় ব্যবহারের হাত পড়ছে না, গঙ্গার ধারের সেই বাড়িখানার একটা ঘরে বোঝাই হয়ে আছে। তবু ওর চোখের সামনে তো আছে।

আর ওই পুতুলগুলো?

ওদের আবার চোখ রয়েছে। বড় বড় বিস্ফারিত সব চোখ।

ওই চোখগুলো মেলে ওরা শোভনের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

পুতুলের চোখে কি দৃষ্টি থাকে? সে দৃষ্টিতে ব্যঞ্জনা থাকে? ভর্ৎসনা থাকে? তীব্র? করুণ?

শোভনের মনে হল, রয়েছে। শোভন সেই তীব্রতার সামনে থেকে তাড়াতাড়ি সরে এলো।

শোভনের কোথায় যেন কী একটা অসহ্য হচ্ছিল, তাই শোভন ওই পুতুলের মালিককে চলে যেতে দিয়েছে। অথচ শোভন এগুলো সহ্য করে যাচ্ছে।

সহ্য করে যাচ্ছে, একটা মেয়ে-মনের ভালবাসায় তিল তিল করে গড়া এই সংসারটাকে, সহ্য করে যাচ্ছে প্রকাণ্ড ডিনার-টেবলটার. একধারে বসে একা খাওয়া, বসবার ঘরের একটা ডিভানে তুচ্ছ একটা বালিশ নিয়ে শুয়ে থাকা।

সহ্য করে যাচ্ছে, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে একটা নিঃশব্দ প্রেতপুরীর মাঝখানে অভ্যস্ত নিয়মে ঘুরেফিরে কাজের জায়গায় যাবার জন্যে প্রস্তুত হওয়া।

কদিন যেন একটা ঘোরে ছিল, ঠিক অনুভব করতে পারছিল না সত্যি কি ঘটে গেছে। আজ মায়ের চিঠি যেন প্রবল একটা নাড়া দিয়ে জানিয়ে গেল ঘটনার স্বরূপ কি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *