৩৩. আমেরিকায় তৈরি

অধ্যায় ৩৩. আমেরিকায় তৈরি

১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন। এই বাক্যটি প্রস্তাব করছে যে, তিনি এটি খুঁজে না-পাওয়ার আগে কেউ জানত না এমন একটি মহাদেশের অস্তিত্ব আছে। এর অস্তিত্ব সম্বন্ধে ইউরোপের অধিবাসীরা অবশ্যই কিছু জানতেন না। যখন সেই ঐতিহাসিক সমুদ্র-অভিযানে তিনি বের হয়েছিলেন, কলম্বাস ইন্ডিয়া বা ভারত যাবার একটি রাস্তা খুঁজছিলেন। তিনি জানতেন ইউরোপের পূর্বে, আফ্রিকার দক্ষিণতম প্রান্ত ঘুরে ঘুরে একটি দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার শেষে ইন্ডিয়ার অবস্থান। কিন্তু তিনি আশা করেছিলেন, যদি পশ্চিমে আরো বহুদূরে যাওয়া যায়, তাহলে সেখানে পৌঁছানোর অন্য একটি দ্রুততর আর সহজ পথ তিনি হয়তো আবিষ্কার করতে পারবেন। আর যখন তিনি নতুন এই পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছিলেন, তিনি ভেবেছিলেন, তিনি ইন্ডিয়ায় এসে পড়েছেন। সুতরাং তিনি স্থানীয় অধিবাসীদের নাম দিয়েছিলেন ইন্ডিয়ান, যে নামটি এখনো এই এলাকার আদিবাসীদের সাথে যুক্ত হয়ে আছে।

এই আবিষ্কার হওয়াটি ‘ইন্ডিয়ান’ অর্থাৎ সেখানে বহু হাজার বছর ধরে বসবাসরত সেই আদিবাসীদের জন্যে খুব ভয়ংকর একটি বিপর্যয় ছিল। পরবর্তী চারশো বছরে শ্বেতাঙ্গ বসতিস্থাপনকারীরা তাদের পুরো দেশটি দখল করে নিয়েছিল এবং খ্রিস্টধর্মের বহু প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্করণ দিয়ে তারা এটি পুরোটাই আবৃত করেছিল। ধর্ম অনেক উদ্দেশ্যপূরণে ব্যবহৃত হয়, কিছু নিষ্ঠুর আর কিছু ক্ষতিকর নয়। এর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম কাজটি হচ্ছে অন্য কোনো জাতিকে প্রতিস্থাপন এবং নিজস্ব বাসভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করার ভয়ংকর অমানবিক কাজটির ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা। যেভাবে ইজরায়েলাইটরা প্যালেস্টাইনে তাদের প্রতিশ্রুত দেশ দখল করেছিল, নতুন ‘পাইওনিয়ার’ বা ঔপনিবেশিকরা, যারা উত্তর-আমেরিকার পশ্চিমদিক বরাবর ক্রমশ তাদের উপনিবেশের সীমানা অগ্রসর করছিলেন, তারা বিশ্বাস করেছিলেন, এমন কিছু করাটাই তাদের ঈশ্বর-নির্দেশিত নিয়তি। যে প্রটেস্টান্টবাদ তারা সাথে নিয়ে এসেছিলেন সেটি খুবই অস্থির একটি ধর্ম ছিল, যা আমেরিকার ওপর এর বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। এটি আসক্তি দ্বারা পরিচালিত একটি সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছিল, যা চিরন্তনভাবেই অসন্তুষ্ট আর নিরন্তরভাবে উচ্চাভিলাষী। জয় করার জন্যে সবসময়ই তারা নতুন সীমানা আবিষ্কার করা অব্যাহত রেখেছিল।

কিন্তু যে-দেশটি এই আগ্রাসনকারীরা দখল করেছিলেন সেটি ধর্মীয় কোনো শূন্যস্থান ছিল না। এর আদি বাসিন্দাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী আধ্যাত্মিক নানা আচার ছিল, যা সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল ভিনদেশিদের নিয়ে আসা চঞ্চল প্রটেস্টান্টবাদ থেকে, যে-ধর্মটি তাদের আক্রমণ করেছিল। আদিবাসী আমেরিকানরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে নয় বরং এটিকে অনুসরণ করেই তাদের জীবন কাটাতেন। যে-দেশটি তাদের লালন করেছিল, সেই দেশটির ভূমি আর প্রকৃতির সাথে তাদের পবিত্র একটি সম্পর্ক ছিল। তারা বিশ্বাস করতেন একটি গ্রেট স্পিরিট বা মহান আত্মা এর মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করেছে। আর এই ‘গ্রেট স্পিরিট’ শব্দটি হচ্ছে তাদের জন্যে ‘ঈশ্বর’ শব্দটির সমার্থক। এটি বিশেষভাবে সত্য ছিল ঘোড়সওয়ার সেই গোত্রগুলোর জন্যে, যারা মহাদেশটির ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত বিস্তৃত সমতলে বাস করতেন, যা পরিচিত ‘গ্রেট প্লেইনস’ নামে। তিন হাজার মাইল দীর্ঘ আর প্রায় সাতশো মাইল প্রশস্ত এই বিশাল সমতল ভূমিটি উত্তরে কানাডা থেকে দক্ষিণে মেক্সিকো অবধি প্রায় এক মিলিয়ন বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত ছিল।

আর এখানে ঘুরে বেড়াত অগণিত বাফেলো’র (উত্তর-আমেরিকার বাইসন) পাল, এখানে বসবাসকারী মানুষগুলোর–যাদের সাথে এই বিশাল ভূমি বসবাসের জন্য বাফেলোরা ভাগ করে নিয়েছিল –সব চাহিদা এটি পূরণ করত। এই আদিবাসীরা তাদের প্রকৃতিতে যাযাবর ছিলেন এবং বাফেলোর সাথে তাদের সম্পর্কটিকে তারা দেখতেন একধরনের কমিউনিয়ন বা অভিন্ন একটি ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে। তারা খুব সংযম আর পরিমিতিবোধের সাথেই এই পৃথিবীতে তাদের জীবন ধারণ করতেন। এবং যদিও ‘দ্য গ্রেট স্পিরিট’ সম্বন্ধে জানা, এটি সংজ্ঞায়িত বা নিয়ন্ত্রণ করার খুব সামান্যই ইচ্ছা ছিল তাদের, তবে তারা এর রহস্যময়তা আর আধ্যাত্মিক সিদ্ধিলাভ করার যে অনুভূতির অভিজ্ঞতা এটি তাদের মনে জাগিয়ে তুলত, সেটির প্রতি সম্পূর্ণভাবেই নিজেদের উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তাদেরও নবীরা ছিলেন, যারা মাঝে দৈবদৃশ্যের সন্ধানে অভিযানে যেতেন, মাদক আর আত্মক্ষত সৃষ্টি করার আচার-ব্যবহার করতেন এর শক্তির প্রতি তাদের নিজেদের উন্মুক্ত করতে। এবং তারা আবার তাদের গোত্রের মানুষদের কাছে ফিরে আসতেন, গ্রেট স্পিরিটের সাথে সংযোগ করার সময় তাদের যে অভিজ্ঞতাগুলো হয়েছিল, তারা মন্ত্র আর নাচের মাধ্যমে তার পুনরাবৃত্তি করতেন।

কিন্তু এটিকে একটি ‘ধর্ম’ হিসাবে দেখলে ভুল হবে, এমন কিছু যা-কিনা ‘ফেইথ’ বা ধর্মবিশ্বাস নামের একটি অংশ তাদের জীবনের বাকি অংশ থেকে পৃথক করে রেখেছে। সেই অর্থে তাদের কোনো ধর্ম নেই। তারা নিজেদেরকে জীবন্ত একটি রহস্য দিয়ে পরিবেষ্টিত ভাবতেন, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল তাদের পরিচিত এই পৃথিবী, বাফেলোদের পাল এবং সেই বাতাসও, যা সমতলের ঘাসগুলো আন্দোলিত করত। এটি যেমন ভঙ্গুর, তেমনি পলায়নপর; এটি টিকে থাকতে পারেনি সেখানে ইউরোপীয় বসতিস্থাপনকারীদের আগ্রাসন আর ব্যাপকভাবে বাফেলো-হত্যার কারণে, আদিবাসীদের অভুক্ত রেখে পিছু হটানোর। জন্যে যে-কৌশলটি উপনিবেশস্থাপনকারীরা পরিকল্পিতভাবে গ্রহণ করেছিলেন। তারা এইসব শুদ্ধিবাদী পিউরিটানদের মতো ছিলেন না, যারা তাদের ধর্মবিশ্বাসের জন্য নিজেদের দেশ ইংল্যান্ডে নির্যাতিত হয়েছিলেন, কিন্তু সেই ধর্মবিশ্বাসটি তারা সাথে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন, যখন তারা আটলান্টিক মহাসাগর অতিক্রম করেছিলেন। সমতলের ইন্ডিয়ানদের যখন তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, এবং যখন তারা দেখেছিলেন যে, বাফেলো বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। শিকার করে, তারা সবকিছুই হারিয়েছিলেন।

তাদের এই ট্র্যাজেডি মহাপ্রলয়বাদী উন্মাদনার প্রাদুর্ভাব প্ররোচিত করেছিল, যা স্মরণ করা খুবই হৃদয়বিদারক। প্রলয়বাদী আন্দোলনগুলো সাধারণত ক্রমশ দানা বাঁধে শোষিত মানুষের মধ্যে, দীর্ঘ সময় ধরে ঈশ্বর তাদের যন্ত্রণা উপেক্ষা করতে পারেন সেটি আর যারা আর বিশ্বাস করতে পারেন না। সুতরাং তারা সেই। স্বপ্নগুলো দেখেন, আবার নতুন করে সব শুরু হবে। অধিকারচ্যুত ইন্ডিয়ানদের মধ্যে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে একটি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল যার নাম ছিল ‘গোস্ট ড্যান্সিং’। যে নবী এটি ঘোষণা করেছিলেন, তিনি তাদের বলেছিলেন তারা যদি তার কথামতো চলেন, দীর্ঘ এবং অনেক কঠোর পরিশ্রম করে নাচেন, তাহলে শ্বেতাঙ্গরা চিরকালের জন্যে নতুন মাটির গভীর স্তরের তলে হারিয়ে যাবে। সব চলে যাবে! আগ্রাসনকারীরা ধ্বংস হবে। তারপর আবার বন্য ঘোড়া আর বাফেলোর পাল সমতলে ফিরে আসবে মর্মরধ্বনি করা ঘাসের মধ্যে। এবং সব ইন্ডিয়ানরা যারা কখনো জীবিত ছিলেন তারা সবাই জীবনে ফিরে আসবেন এবং এই স্বর্গে তাদের সাথে বাস করবেন।

লক্ষ করুন স্বর্গ কী ছিল। এটি আকাশের উপর কোনো স্বর্গ নয়, যেখানে তারা অকল্পনীয় সুখ উপভোগ করবেন। এটি ছিল শ্বেতাঙ্গ আগ্রাসনকারীরা এসে ধ্বংস করার আগে তাদের সেই জীবন। সুতরাং তারা নেচেছিলেন। কিন্তু সেই স্বর্গ আর আসেনি। তারা আরো পরিশ্রমের সাথে নেচেছেন। কেউ কেউ তাদের মৃত্যু অবধি। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ মানুষগুলোকে এই পৃথিবী গ্রাস করেনি, তাদের আর তাদের নিষ্ঠুরতাকে মাটি চাপা দেয়নি। বুনো ঘোড়ারা কেশরে সূর্যের আলো মেখে তাদের প্রিয় পাহাড়ের চূড়ায় ঘুরে বেড়ায়নি, বাফেলোরা উত্তর থেকে দল বেঁধে ঝড়ের বেগে নেমে আসেনি, তাদেরকে আহ্বান করেনি পিছু তাড়া করার সেই অভিন্ন উত্তেজনায় অংশগ্রহণ করতে। নিয়তির পরিহাস হচ্ছে, সাম্প্রতিক সংরক্ষণ নীতিমালার কারণে মহাসমতলে বাফেলোরা ফিরে এসেছে ঠিকই, কিন্তু ইন্ডিয়ানরা হারিয়ে গেছে চিরতরে।

মহাপ্রলয়বাদী আন্দোলনগুলো, যেমন, গোস্ট ড্যান্স, সব দুর্দশা আর কষ্ট শেষ হবার আকাঙ্ক্ষায় আর্তনাদ। আর সেই শেষ যে আসেনি, এই বাস্তবতাটি কিন্তু সেই কামনাটি হত্যা করতে পারেনি। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি নির্যাতিত জাতির ধর্মে এটি খুঁজে পাই, আফ্রিকান-আমেরিকান। সমুদ্র অতিক্রম করে বহু। হাজার মাইল দূরের জন্মভূমি থেকে যাদের অপহরণ করে নিয়ে আসা হয়েছিল, যেন তারা তাদের খ্রিস্টান মনিবদের প্রয়োজনে সেবা দিতে পারে। ধর্মের ইতিহাসে নিয়তি বক্রাঘাতগুলোর একটি হচ্ছে যে, দাসরা তাদের মনিবদের কাছ থেকে যে খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসটি গ্রহণ করেছিলেন, তাদের মনিবদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হতে পারে এর এমন যে-কোনো সংস্করণের চেয়ে সেটি আরো বেশি সত্য আর মূল ধর্মটির নিকটবর্তী ছিল।

দাসদের ধর্ম হিসাবে ইহুদিবাদ শুরু হয়েছিল। যে-কণ্ঠস্বরটি একটি জ্বলন্ত ঝোঁপ থেকে মোজেসের সাথে কথা বলেছিল, সেটি তাকে তার সন্তানদের মিশর থেকে মুক্ত করে প্রতিশ্রুত ভূমিতে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল। কীভাবে একজন দাস ‘মালিক’-এর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারে? কিন্তু কল্পনা করুন, আপনি একজন দাস’ আর এই গল্পটি প্রথমবারের মতো শুনছেন। আপনি কিন্তু আপনার নিজের গল্পই শুনছেন। এটি আপনাকে নিয়েই। আপনি এটি যেভাবে নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারবেন, আপনার পিঠে চাবুক কষানো সেই শ্বেতাঙ্গ-মালিকটি তা কখনোই বুঝতে পারবেন না, রোববারে তার নিজের চার্চে তিনি যতসংখ্যক স্তব সংগীতই গান না কেন। ইহুদিবাদ ছিল সেই মানুষদের জন্যে ধর্মবিশ্বাস, যারা দাসত্ব থেকে মুক্তির কামনা করেছিলেন। আফ্রিকান-আমেরিকান দাসরাও সেটি কামনা করেছিলেন। আর তারা সেটিকে তাদের নিজের মতো করে নিয়েছিলেন। এবং তারা সেই বিষয়ে গানও গেয়েছিলেন :

যাও, মোজেস,
মিশরে সেই দেশে তুমি যাও,
বৃদ্ধ ফারাওকে বলো,
আমার মানুষদের যেন সে চলে যেতে দেয়।

.

খ্রিস্টধর্মও শুরু হয়েছিল একটি স্বাধীনতার আন্দোলন হিসাবে। যিশু ছিলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি, যিনি এই পৃথিবীতে এমন একটি রাজত্ব নিয়ে আসবেন, যার মতো আর কোনোকিছুই ইতিহাসে কখনো দেখা যায়নি। এটি শক্তিশালী, ক্ষমতাবানদের তাদের আসনচ্যুত করবে, দরিদ্র আর সাধারণকে সম্মানিত করবে। শোষণ আর নির্যাতনকে এটি ন্যায়বিচার দিয়ে প্রতিস্থাপিত করবে। এটি অসুস্থদের নিরাময় করবে এবং বন্দিদের মুক্তি দেবে। এবং এটি নিয়ে আসবেন একজন মেসিয়াহ, যাকে বেত্রাঘাত করে রক্তাক্ত আর তিরস্কৃত করা হবে, যখন তিনি কালভারি অভিমুখে তার ভারী ক্রুশ বহন করে নিয়ে যাবেন।

এই শব্দগুলো শুনলে, কীভাবে একজন ক্রীতদাস এটিকে তার নিজের পরিস্থিতির একটি বিবরণ হিসাবে অনুভব করতে ব্যর্থ হবেন? তাদের মনিবদের। হয়তো সেই বই আছে যেখান থেকে শব্দগুলো এসেছে, কিন্তু এর অর্থের মূল মালিক ছিলেন তাদেরই দাসরা। খ্রিস্টধর্ম দাসদের জন্য একটি ধর্ম! দাসমালিকরা কীভাবে এটি বুঝতে পারবেন, আর সেই অনুযায়ী জীবন কাটানো তো আরো দূরের ব্যাপার? তাদের বিশেষ সুবিধাপূর্ণ জীবনে প্রতিদিনই এটি তারা অস্বীকার করেছেন। আর দাসরা প্রতিদিনই সেই জীবনটি কাটিয়েছে। তারা জানতেন এই ধর্মটি তাদের। তারা হয়তো এখনো বাইবেল পড়ে উঠতে পারেননি, কিন্তু তারা জানতেন কীভাবে সেই বাইবেল হওয়া যায়। মুক্তির জন্যে এর আকাঙ্ক্ষা ছিল তাদেরই আকাঙ্ক্ষা।

তারপর ভিন্ন কিছু ঘটতে শুরু করেছিল, যেভাবে তারা সেটি ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। বাইবেল তাদের স্বাধীন হবার আকাঙ্ক্ষার গান গেয়েছিল নিশ্চয়ই, এটি তাদের সেই ইচ্ছার প্রতিধ্বনি করেছিল, যে ইচ্ছা তাদের তখনো পূরণ হয়নি, হয়তো কখনোই পূরণ হবে না। কিন্তু তারা সেটি তাদের উপাসনায় ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন এমন একটি উপায়ে, তাদের বন্দি করে রাখা কাঠামোর মধ্যেই একধরনের স্বাধীনতা দিয়েছিল। তাদের যাজকরা শুধুমাত্র বাইবেলের গল্পগুলো নিয়েই ‘কথা’ বলেননি। তারা সেগুলোকে ‘বর্তমান’রূপে উপস্থাপন করেছিল, এগুলো এমন একটি উপায়ে তারা বাস্তব করে তুলেছিলেন, তাদের শ্রোতারা সেই গল্পে প্রবেশ ও অনুভব করতে পেরেছিলেন। আর সেটি করার মাধ্যমে তারা আমেরিকার শিল্পকলার শ্রেষ্ঠতম অভিব্যক্তিগুলোর একটি আবিষ্কার করেছিলেন। তাদের দুঃখ নিয়ে সংগীত নির্মাণের একটি উপায়, যা সেইসব দুঃখকে ম্লান করে দিয়েছিল, যা ছিল এই গানগুলোরই বিষয় –যদিও শুধুমাত্র এক বা দুই ঘণ্টার জন্য, দক্ষিণের কোনো খামারের কুটিরে কোনো রোববার সন্ধ্যায়। তারা চাবুক আর তিরস্কার থেকে পালিয়ে একটি পরমানন্দে প্রবেশ করতেন, যা তাদের অন্য একটি জগতে নিয়ে যেত।

পালিয়ে যাও, পালিয়ে যাও, পালিয়ে যাও যিশুর কাছে,
পালিয়ে যাও, পালিয়ে যাও ঘর থেকে…
এখানে বেশিদিন থাকার সময় আমার নেই।

এখানে তারা ধর্মের আরেকটি উদ্দেশ্যের উদাহরণ প্রদর্শন করেছিলেন, যারা অসহ্য দুঃখে আছেন তাদের সেই ভাগ্য সহ্য আর খানিকটা মধুর করে তুলতে ধর্মের সান্ত্বনা দেবার ক্ষমতা। ঊনবিংশ শতকের দার্শনিক কার্ল মার্কস, ধর্মের অন্যতম মহান একজন সমালোচক, ধর্মের এই দিকটির স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি পৃথিবী থেকে সব অন্যায় আর অবিচার নির্মল করতে চেয়েছিলেন যা সেই যন্ত্রণার কারণ, যা কিনা ধর্ম প্রশমিত করে। তিনি ধর্মকে ‘জনগণের জন্যে আফিম হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি এটিকে দেখেছিলেন একধরনের চেতনানাশক হিসাবে। কিন্তু কখনো কখনো সেই সময়গুলো আসে, যখন আমাদের একটি চেতনানাশকের দরকার হয়। আপনি যদি কোনো শল্যচিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যান, আপনি সেই ডাক্তারের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন যিনি আপনাকে কেটে উন্মুক্ত করার আগে আপনাকে চেতনানাশক ঔষধ দিয়ে অচেতন করে নিয়েছিলেন। ধর্ম সেই ঔষধ হতে পারে যা অস্তিত্বের সেই যন্ত্রণাকে প্রশমিত করতে পারে। শুধুমাত্র অনুদার কোনো মনই সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয় তাদের সাথে, যাদের দুর্দশা এভাবে খানিকটা সহনীয় হয়ে উঠতে পারে। কোনো পাথর-হৃদয়ের কেউ হয়তো উদাসীন হতে পারেন কোনো দাসদের এমন সভা দেখে, যারা তাদের স্বদেশে নিয়ে যাবার জন্য যিশুর দেওয়া প্রতিজ্ঞায় সান্ত্বনা খুঁজে পেতেন।

কিন্তু আফ্রিকান-আমেরিকানরা ইহুদিবাদ-খ্রিস্টান ধর্মের গল্পকে শুধুমাত্র এই একটি উপায়ে ব্যবহার করেননি। তারা আরো সরাসরি রাজনৈতিক কিছু করেছিলেন এর সাথে। তারা এর বার্তাটিকে বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার বর্ণবাদ আর অবিচারের প্রতি তাদের গণআন্দোলনে মন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। তাদের জন্যে আমেরিকা তখনো মিশর এবং তারা তখনো এর বন্দি দাস। তাদের নতুন মোজেস ছিলেন যাজক মার্টিন লুথার কিং, তিনি আবার একজন বৃদ্ধ ফারাওকে তার নিজের মানুষদের মুক্তি দিতে বলেছিলেন।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কিং জর্জিয়ার আটলান্টায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, দক্ষিণের বর্ণবৈষম্যের কারণে বিভাজ্য রাজ্যগুলোর প্রাণকেন্দ্র ছিল সেটি। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্যাপ্টিস্ট চার্চ, মন্টগোমারি, আলাবামায় একজন যাজক হয়েছিলেন, আর এখান থেকে তিনি আফ্রিকান-আমেরিকানদের জন্যে পূর্ণ নাগরিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে যেদিন তাকে এক আততায়ী হত্যা করেছিল, সেদিন মার্টিন লুথার কিং নিজের সাথে মোজেসের সদৃশ্যতার কথা বলেছিলেন, যিনি সেই প্রতিশ্রুত দেশটি দূর থেকে দেখেছেন, কিন্তু সেখানে প্রবেশ করার আগে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। আফ্রিকান আমেরিকানরা মিশর থেকে তাদের সেই পলায়নপর্ব শেষ করতে পেরেছিলেন, যখন ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়, কিন্তু আরো শতবছর পরেও তারা সেই প্রতিশ্রুত দেশ থেকেই বহু দূরেই ছিলেন, যেখানে তাদের জন্যে থাকবে পূর্ণ সমানাধিকার। আর তার মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরে তারা এখনো সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য থেকে বেশ দূরেই অবস্থান করছেন।

এই বইয়ে যেমন প্রায়শই আমরা দেখেছি, ধর্ম শুরু হয় অতিন্দ্রীয় রহস্যময় একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে, কিন্তু এটি সবসময়ই রাজনীতিতে প্রবেশ করে। এটি শুরু হয় কোনো অদৃশ্য কণ্ঠ শোনা নবীর হাত ধরে, যারা এর নির্বাচিত উপকরণ। আর তারা যা শোনেন, সবসময়ই সেটি কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে, যা মানুষের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে : রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে। কখনো এই রাজনীতি খারাপ। মানুষকে ভুল ধর্মবিশ্বাস অথবা ভুল কোনো কণ্ঠ শোনার জন্যে নির্যাতিত হতে হয়। অথবা তাদের বাধ্য করা হয় সেই বার্তাকে গ্রহণ করে নিয়ে যা সম্প্রতি কোনো নতুন নবী ঘোষণা করেছেন। আর সে-কারণে ধর্মের ইতিহাস নানা ধরনের অন্যায় নিপীড়ন নিয়ে একটি অধ্যয়ন।

কিন্তু কখনো রাজনীতি উত্তম। তখন এটি নির্যাতনের নয়, মূলত স্বাধীনতা অস্ত্র। আমরা ভালো রাজনীতি দেখেছিলাম যখন ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে পেনসিলভ্যানিয়ার কোয়েকাররা দাসপ্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। এছাড়া আফ্রিকান আমেরিকান চার্চে খ্রিস্টধর্মের রাজনীতি আজও স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করেই অব্যাহত আছে। এই পৃথিবীকে আরো উত্তম একটি স্থানে পরিণত করতে মোজেসের কৌশল আর যিশুর প্রতিশ্রুতিগুলো ব্যবহার করা হয়। ধর্মকে আর আফিমের মতো অবিচার আর অসমতার সেই দুর্দশার যন্ত্রণা ভোতা করার জন্যে ব্যবহার করা হয়, বরং সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় উত্তেজক হিসাবে এটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। আর সেটাই এখনো বহু মানুষকে এই ধর্মের খেলায় ধরে রেখেছে।

আর এটি এমন একটি খেলা যা আমেরিকানরা খেলতে ভালোবাসেন। ঊনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকটি নতুন ধর্মের আবির্ভাব হয়েছিল। পরের অধ্যায়গুলোয় তাদের কয়েকটি নিয়ে আমরা আলোচনা করব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *