২৮. মহাবিভাজন

অধ্যায় ২৮. মহাবিভাজন

যে অন্তদৃষ্টিটি মার্টিন লুথার অনুধাবন করেছিলেন, সেটি তাকে বলেছিল, তিনি মুক্তি পাবেন, তবে শুধুমাত্র ধর্মীয় কর্তব্য সম্পাদন করে কিংবা ইনডালজেন্স ক্রয় করার মাধ্যমে সেটি আসবে না, তার জন্য ঈশ্বরের ভালোবাসার কারণেই তিনি মুক্তি পাবেন। এটি এমন একটি ধারণা ছিল, যা খ্রিস্টধর্ম কখনোই পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করে নিতে পারেনি। লুথার নিজেও এর বৈপ্লবিক অর্থটি শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এছাড়া তিনি নিজেই অন্যদের সাথে তার সম্পর্ক আর আচরণে সে ধরনের মানদণ্ড বজায় রাখতে পারেননি। কিন্তু ধারণাটি তার কাছে এসেছিল এবং এটি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।

পণ্ডিতরা লুথারের এই অন্তর্দৃষ্টির যে কারিগরি নাম দিয়েছিলেন সেটি নিজেও একটি গল্প বলে। তারা এটিকে বলেছিল ‘জাস্টিফিকেশন বাই ফেইথ’ বা বিশ্বাসের দ্বারা সত্যতা প্রতিপাদন। আর ইঙ্গিতটা আছে এই ‘জাস্টিফিকেশন’ শব্দটির মধ্যে। সেই ধারণাটি ভুলে যান, যা বর্তমানে এর সাথে সংশ্লিষ্ট, যখন কিনা কেউ এমন কোনোকিছু বোঝাতে চেষ্টা করেন যার জন্যে তিনি লজ্জিত এবং যা নিয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। বরং এর পরিবর্তে ভাবুন, কোনো একটি অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে কেউ বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি জানেন যে, তিনি অপরাধী। এবং তিনি এটিও জানেন যে, বিচারক নিজেও সেটি জানেন। কিন্তু তারপরও তাকে বিস্মিত করে বিচারক তার নায্যতা প্রমাণ বা সত্যতা প্রতিপাদন করেন, এবং তাকে নিরপরাধ ঘোষণা করে মুক্ত করে দেন।

লুথার ঈশ্বরের সাথে মানবতার সম্পর্কটি বুঝতে একটি ভিন্ন উপায় লক্ষ করেছিলেন। ধর্ম মানুষকে এমন একটি ধারণা দেয় যে, ঈশ্বর যেন তাদের শাস্তি দেবার জন্যে অপেক্ষা করছেন। তাদের এমন একটি পরীক্ষার জন্যে নম্বর দেওয়া হচ্ছে, যার প্রশ্নগুলো তারা কখনোই দেখেননি। আর সে-কারণে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মগুলো পরস্পরের সাথে এত বেশি প্রতিদ্বন্দ্বীসুলভ আচরণ করে থাকে। শুধুমাত্র যেন তারাই জানেন পরীক্ষায় কী প্রশ্ন আসবে। সেই পরীক্ষার জন্যে শুধুমাত্র তারাই আপনাকে প্রশিক্ষণ দিতে পারবে, যে-পরীক্ষার জন্যে জন্মের সময় আপনি নিজের নাম নিবন্ধন করেছিলেন, যখন কোনোকিছু সম্বন্ধে আপনার কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু লুথার ভিন্নভাবে ঈশ্বরকে দেখার একটি পথের সন্ধান পেয়েছিলেন। আর তিনি দেখেছিলেন মূলত ভালোবাসা, যা কোনো আবশ্যিকতা অথবা কোনো শর্ত ছাড়াই পৃথিবীর জন্যে নিবেদন করা হয়েছে। আর যদি সেটি সত্য হয়, তার মানে মানুষ স্বাধীন আর আনন্দের সাথে বাঁচতে পারে, কোনো প্রতিশোধপরায়ণ ঈশ্বরের ভয়ে বারবার পেছনদিকে না তাকিয়ে, যার কাজ হচ্ছে তাদের শাস্তি দেওয়া।

আর লুথারের এই অন্তদৃষ্টির চমকটি কতটা বৈপ্লবিক ছিল, সেটি বুঝতে আমাদের মনে করতে হবে, প্রথাগতভাবে ধর্ম কীভাবে সাধারণত এর কাজ করে থাকে। ধর্মগুলোর মধ্যে পার্থক্য আছে ঠিকই, কিন্তু তাদের মধ্যে যা সাধারণ সেগুলো ধারণ করা যেতে পারে আবশ্যিক’ শব্দটি ব্যবহার করে। সবাইকে একটি ভয়াবহ নিয়তি থেকে বাঁচানো হচ্ছে ধর্মের কাজ। কিন্তু মুক্তি পেতে হলে তাদের অবশ্যই নির্দিষ্ট কিছু মতবাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে এবং ধর্মীয় আচার পালন করতে হবে। ধর্ম হচ্ছে সেই জিনিস, যাকে রোমানরা বলতেন একটি ‘কুইড প্রো কুও’ বা কোনোকিছুর বদলে অন্য কোনোকিছু। এটা বিশ্বাস করো, ঐ কাজটি করো, এবং ফলাফল আসবে। কখনো এই আবশ্যিকতা নেতিবাচক, যেমন, এটা বিশ্বাস কোরো না, ঐ কাজটা কোরো না। যদি আপনি চাহিদাপূর্ণ কোনো ঈশ্বরের ধারণা মেনে নেন, যার ওপর ভিত্তি করে এটি দাঁড়িয়ে আছে, সেটি অর্থবহ হয়। ধর্ম হচ্ছে একটি আদান-প্রদান, একটি চুক্তি বা একটি বীমা পলিসি। ইনডালজেন্স অবশ্যই তেমন কিছু ছিল। এটি কিনুন, আপনার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে। আর শুধুমাত্র ধর্মই নয়, এভাবে বহু ধরনের মানবিক আদান-প্রদান ঘটে থাকে, কোনো কিছু পাবার জন্যে আপনাকেও সেখানে কিছু বিনিয়োগ করতে হবে। এটি একটি ব্যবসা ছিল।

যেভাবে যিশুর মানবতার সাথে ঈশ্বরের সম্পর্কটিকে দেখেছিলেন, সেটি এমন ছিল না। কিন্তু তিনি যা কিছু বলে গিয়েছিলেন সেগুলো এতটাই ধাঁধার মতো ছিল যে, যারা পরে চার্চ পরিচালনা করেছিলেন, তারা কখনোই তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেননি। যিশু একবার একটি আঙুরক্ষেতের মালিকের গল্প বলেছিলেন, যতক্ষণই কেউ সেখানে কাজ করুক না কেন, তিনি তার সব শ্রমিককে দিনের শেষে একই বেতন দিতেন। মানবতার সাথে ঈশ্বরের সম্পর্ক কোনো চাকরির আইনের ওপর নির্ভর করে, নেই। তিনি বলেছিলেন, এই সম্পর্ক একক ব্যক্তির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, সেই ব্যক্তির বিশেষ প্রয়োজনের ভিত্তিতে এটি নিয়ন্ত্রিত হয়। আরো একটি অস্বস্তিকর কাহিনিতে তিনি বলেছিলেন, একজন তরুণ তার পিতার কাছে তার উত্তরাধিকারের সব সম্পদ দাবি করেছিলেন এবং উজ্জ্বল জীবন কাটিয়ে সেই অর্থ অপচয় করেছিলেন। তারপর তার পিতা বাড়িতে তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন তিরস্কারের একটি শব্দও উচ্চারণ না করে। ঈশ্বর এমনই, যিশু বলেছিলেন, আমরা যেভাবেই আচরণ করি না কেন, তিনি কখনোই আমাদের ভালোবাসা থামিয়ে দেবেন না। নিজেরা সেভাবে ভালোবাসার চেষ্টা করুন।

এসব পাগলামি! এভাবে পৃথিবী পরিচালিত হলে এর সব কাঠামো আর ধর্মসহ সব প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। কিন্তু তারপরও ভালোবাসার দ্বারা পরিচালিত একটি চার্চের সম্ভাবনা, ভিটেনবার্গে তার পড়ার ঘরে, যা লুথার সেই রাতে অনুধাবণ করেছিলেন। যেভাবে তার প্রিয় আদর্শ পল বলেছিলেন, ভালোবাসা সবকিছুর ভার বহন করে, সবকিছুই সহ্য করে। তার সন্তানের প্রতি ঈশ্বরের ভালোবাসাকে কোনোকিছুই পরাজিত করতে পারবে না, এমনকি তাদের নিজেদের বেআইনি কর্মকাণ্ডও। যতই অপরাধী তারা হোক না কেন, ঈশ্বর তাদের ভালোবাসা অব্যাহত রাখেন। ভয় কিংবা ভয়ের কারণে সৃষ্ট কোনো চুক্তি নয়, শুধুমাত্র ভালোবাসাই তাদের রক্ষা করবে।

কিন্তু চার্চ স্বর্গীয় দয়ায় উদ্ভাসিত একটি ধর্মকে মানব-নিষ্ঠুরতার একটি ধর্মে রূপান্তরিত হতে অনুমতি দিয়েছিল। আর সেটাই কনস্টান্টিন করেছিলেন যখন তিনি যিশুর ক্রুশের ব্যানারের নিচে তার শত্রুদের হত্যা করেছিলেন। আর সেটাই ক্রুসেডাররা করেছিলেন, যখন তারা পবিত্র শহরে মুসলমানদের হত্যা করতে যাত্রা শুরু করেছিলেন। ইনকুইজিশনও সেটাই করেছিল যখন এটি র‍্যাকের উপরে শুইয়ে ধর্মদ্রোহী অভিযুক্তদের হাত-পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। তারা সবাই ভেবেছিলেন যে, তাদের নিজস্ব সংস্করণের ঈশ্বর অনুসরণ করতে বাধ্য করানোর মধ্যে কোনো ভ্রান্তি নেই। আর এর কারণ তাদের সংস্করণের ঈশ্বর হচ্ছে তাদের নিজস্ব একটি সংস্করণ মাত্র।

লুথার মুহূর্তের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন এই সবকিছু কত বেশিমাত্রায় ভুল। এটি ক্যাথলিক চার্চের শক্তি আর লোভের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন একটি পরিবর্তনের আহ্বান জানাতে তাকে শক্তি দিয়েছিল। এভাবে প্রটেস্টান্ট (প্রতিবাদী) ধর্মের সূচনা হয়েছিল, এর নাম যা নির্দেশ করে, এটি কী সমর্থন করে তার চেয়ে বরং এটি কিসের বিরুদ্ধে সেটি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে প্রটেস্টান্টবাদ এর নিজেকে সংজ্ঞায়িত করেছিল। কিন্তু ক্ষমতার নিষ্ঠুরতার প্রতি এর বিরোধিতা ইউরোপীয় ইতিহাসে অমূল্য একটি উপাদান যুক্ত করেছিল। এবং সময়ে এটি একটি শক্তিতে পরিণত হয়েছিল, যা ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক নির্যাতনকে চ্যালেঞ্জ করেছিল।

আর যেভাবে সমাজ সেই সময় সংগঠিত ছিল, যদি স্থানীয় শাসকদের সমর্থন আর পৃষ্ঠপোষকতা না থাকত, প্রটেস্টান্ট আন্দোলনটি খুব বেশিদূর অগ্রসর হতে পারত না। ইউরোপ তখন গণতান্ত্রিক ছিল না। সুতরাং এই ‘রিফর্মড’ বা সংশোধিত চার্চগুলোর নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে রাজা এবং ডিউকদের পৃষ্ঠপোষকতার দরকার ছিল। শাসকদের সাথে জোট গঠন করা হয়েছিল এবং নতুন চার্চেরও আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর কিছু বিশ্বাসেও পার্থক্য ছিল। সুতরাং রোম থেকে বড় বিভাজনের পরে নতুন এই ‘বিশুদ্ধ’ চার্চের রূপ কেমন হওয়া উচিত, সেই বিষয়ে মতানৈক্যের কারণে প্রটেস্টান্টদের মধ্যেও ক্ষুদ্র বহুসংখ্যক বিভাজন এসেছিল। প্রটেস্টান্টবাদের প্রতিভা একই সাথে এর সবচেয়ে বড় দুর্বলতাও ছিল : এটি যা-কিছু অনুমোদন করে তার সাথে সমঝোতা করার ক্ষেত্রে এর অক্ষমতা।

রোমান চার্চের প্রতিভা ছিল খণ্ডিত হবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবার প্রতি এর প্রতিরোধ। এর এই একচিত্ততা আঠার মতো একই বিশ্বাসের বহু ভিন্নধরনের মানুষকে একসাথে ধরে রেখছিল। এমনকি মাস’ পরিচালনার সময় ল্যাটিনের ব্যবহারও ছিল এই একীকরণেরই একটি প্রক্রিয়া। শুধুমাত্র শিক্ষিতরা এটি বুঝতে পারতেন এবং সেই সময় খুব কমসংখ্যক মানুষই ল্যাটিন বোঝার মতো শিক্ষিত ছিল, এমনকি যাজকদের মধ্যেও সেই সংখ্যা ছিল খুব কম। সুতরাং যে মানুষগুলো ইউরোপজুড়ে মাসে’ যোগ দিতেন, বেদিতে দাঁড়িয়ে ধর্মবক্তৃতা দেওয়া যাজক কী বলছেন সেই বিষয়ে অজ্ঞতায় তারা একীভূত ছিলেন। কিন্তু আবার তারা একইভাবে একীভূত ছিলেন একটি পবিত্র রহস্যময়তায় তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে, যা সর্বত্র একই ছিল। এই সংস্কার বা রিফরমেশন আন্দোলনের শুরুতেই এই একতাটি ভেঙে গিয়েছিল চিরতরে, শুধুমাত্র ক্যাথলিক চার্চ এককভাবে সেটি ধরে রেখেছিল।

‘রিফরমেশন’ আন্দোলনের উত্তেজনার পর ক্যাথলিক চার্চ এর প্রত্যুত্তরে একটি নিজস্ব সংস্কার আন্দোলন সূচনা করেছিল, যা কাউন্টার-রিফরমেশন’ নামে পরিচিত। পোপ তৃতীয় পল ইটালির ট্রেন্টে একটি কাউন্সিল আহ্বান করেছিলেন, যা ১৫৪৫ থেকে ১৫৬৩ অবধি নিয়মিত সভা করেছিল। প্রত্যাশিতভাবেই, এটি মার্টিন লুথারের সব লেখাই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল তবে এটি ক্যাথলিক চার্চকেও সমালোচনা করেছিল, যার বিলাসিতা এবং বাড়াবাড়ি এই লেখাগুলো লিখতে তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

চার্চ যা নিজেকে তাদের দাবিকৃত প্রথম পোপ সেইন্ট পিটারের বার্ক’ বা নৌকা হিসাবে পরিচয় দিতে পছন্দ করত, সেটি রিফরমেশন ঝড়ের ঝাঁপটা সহ্য করে টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছিল, যা এটিকে প্রায় নিমজ্জিত করার ঝুঁকির মুখে ফেলেছিল। মাঝে মাঝে অকস্মাৎ তীব্র হাওয়া দিকভ্রষ্ট করলেও এটি ইতিহাসে আবার তার নিজের জায়গা করে নিয়েছিল, আর কখনোই এটিকে সত্যিকারের বড় কোনো হুমকির মুখোমুখি হতে হয়নি।

প্রটেস্টান্ট চার্চের ক্ষেত্রে সেই একই কথা বলা যাবে না। যদি আমরা সেই সমুদ্র আর নৌকার রূপকটা আরো কিছুটা সময় অব্যাহত রাখি, তাহলে বলা যাবে একটি জাতীয় পতাকার নিচে বড় কিছু জাহাজ থেকে, প্রটেস্টান্টবাদ খুব দ্রুত বহু পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার একটি বিশাল বহরে পরিণত হয়েছিল, যাদের কোনো কোনোটি ডিঙিনৌকার মতোই আকারে ক্ষুদ্র ছিল। আর দুটি নিয়ামক এই বহুবিভক্ত হবার প্রক্রিয়ায় মূল ভূমিকা রেখেছিল। প্রধান কারণটি ছিল, বাইবেল। একবার যখন আপনি কোনো একটি বইকে একক কর্তৃত্বের অধীন থেকে মুক্ত করেন, এটি বহু ধরনের ব্যাখ্যার বিষয়ে পরিণত হয়। বিশেষ করে যদি বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে, এটি ঈশ্বর-অনুপ্রাণিত একটি বই। বিশ্বাসের দ্বারা সত্যতা প্রতিপাদনের বিষয়টি লুথার বাইবেলেই আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু সেখানে আরো বহু জিনিসও পাওয়া যাবে, যেগুলো অধিকাংশই স্ববিরোধিতায় পূর্ণ। সর্বোপরি, বাইবেল হচ্ছে বইয়ের একটি লাইব্রেরি, বহু শতাব্দী ধরে যে-বইগুলো লিখেছিলেন এবং পুনর্লিখন করেছিলেন অজ্ঞাত বহু লেখক-সম্পাদক-লিপিকারকরা। সেখানে সবার জন্যে কিছু-না-কিছু আছে, যা নির্ভর করে সেই প্রয়োজনীয়তা আর ভয়ের ওপর, যা তাদের পরিচালিত করে। কিছু নতুন প্রটেস্টান্ট চার্চ নিউ টেস্টামেন্টের চেয়ে ওল্ড টেস্টামেন্টের দ্বারাই আরো বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছিল। আমরা সেই প্রভাবগুলো দেখব যেভাবে বিভিন্ন জাতির ওপর রিফরমেশন আন্দোলনটি তার চূড়ান্ত প্রভাব ফেলেছিল। আমরা আরো দেখব কীভাবে ধর্মে একটি চূড়ান্ত কর্তৃত্বের আদিম সেই চাহিদাটি অভ্রান্ত একজন পোপ থেকে অভ্রান্ত বাইবেলের ওপর সরে এসেছিল।

প্রটেস্টান্টদের মধ্যে বিভাজনের অন্য কারণগুলোর মধ্যে ছিল, যেভাবে এই সংস্কার-আন্দোলনটি একক ব্যক্তি মানুষকে মুক্ত করেছিল। গতানুগতিক ধর্ম সাধারণ মানুষকে খুব বেশি নির্বাচন করার স্বাধীনতা দেয়নি। চার্চের পরিচালনায় থাকা বিশপ আর যাজকরা তাদের যা কিছু বলেছেন তা নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। একক ব্যক্তি মানুষের সচেতন বিবেকের শক্তি আর ঈশ্বরের সাথে ব্যক্তিগত একটি সম্পর্কের ওপর তাদের অধিকারকে স্বীকার করার মাধ্যমে রিফরমেশন ঐ ধরনের সব কর্তৃত্ববাদিতাকে ধ্বংস করেছিল। একক ব্যক্তি মানুষ শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের মধ্যস্থতায় ঈশ্বরের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবেন- এমন ধারণা রিফরমেশন আন্দোলনটি প্রত্যাখ্যান করেছিল। অ্যাপোস্টলিক ধারাবাহিকতায় যাজক হিসাবে দীক্ষিত হয়েছেন শুধুমাত্র তারাই নয়, এটি সব বিশ্বাসীদের ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে সৃষ্ট একটি যাজক সংগঠনের ধারণার ওপর বিশ্বাস রেখেছিল। আর সে-কারণে একটি একক প্রতিষ্ঠানের অধীনে প্রটেস্টান্টবাদকে সংগঠিত করার কাজটি ছিল খুবই কঠিন। কারণ এধরনের সংগঠনে সবসময়ই কিছু বিদ্রোহী বিশ্বাসীরা থাকেন, যারা দায়িত্বে থাকা মানুষগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে থাকেন। আর যদি তাদের কথা শোনা না হয়, তারা সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন।

রিফরমেশন চার্চগুলোর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি কিন্তু ছিল, তারা কখনোই চ্যালেঞ্জ করেননি যেভাবে এর বিরোধীদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় এটি ব্যবহার করে কনস্টান্টিন খ্রিস্টধর্মকে কলুষিত করেছিলেন। লুথার ভালোবাসার পথ-সংক্রান্ত তার অন্তদৃষ্টিটির খানিকটা ঝলক অনুভব করেছিলেন, কিন্তু স্বর্গ আবার এর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। আর প্রতিপক্ষের সাথে বোঝাপড়ায় লুথার তাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ যে প্রতিপক্ষ, তাদের মতোই নিষ্ঠুর ছিলেন। তার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হলে, শক্তি প্রয়োগ করতে তিনি কখনোই দ্বিধাবোধ করেননি।

আর ঠিক সেটাই লুথার করেছিলেন যখন জার্মানির কৃষকরা, চার্চের শক্তির বিরুদ্ধে রিফরমেশনের চ্যালেঞ্জে অনুপ্রাণিত হয়ে, ভেবেছিলেন কেন তারা তাদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করা ভূস্বামীদের কাছ থেকে মুক্ত হতে পারবেন না। তারা পুরোপুরি দাস ছিলেন না, তবে তার খুব কাছাকাছি কিছু ছিলেন। তারা ছিলেন সার্ফ, কৃষিশ্রমিক–যাদের কোনো অধিকার ছিল না, এবং দারিদ্র্য থেকে নিজেদের মুক্ত করার কোনো উপায়ও তাদের ছিল না। বিশাল বাড়ি আর প্রাসাদের অভিজাতশ্রেণির জন্যে শ্রম দিয়ে জীবন দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো নিয়তি ছিল না। ঈশ্বরের নির্দেশবলে চার্চ এই ব্যবস্থাকে আশীর্বাদ করেছিল। ধনী ব্যক্তি তার দুর্গে, দরিদ্র তার দরজায়, ঈশ্বর তাদের অভিজাত আর সাধারণ বানিয়েছে, এবং তাদের ভাগ্যে নির্দেশনা দিয়েছে’, একটি জনপ্রিয় হিম বা স্তব সংগীত যেভাবে পরে এটি ব্যক্ত করেছিল। কিন্তু কৃষকরা বিষয়টি এভাবে আর দেখতে পারছিলেন না। এবং রিফরমেশন তাদের সাহস দিয়েছিল। যদি চার্চ বদলাতে পারে, তাহলে সমাজ কেন বদলাতে পারবে না? যদি মার্টিন লুথার মহাশক্তিশালী রোমান চার্চের ক্ষমতা খর্ব করতে পারে, কেন তারা জার্মান ভূস্বামীদের ক্ষমতা উৎখাত করতে পারবে না?

তাদের বিদ্রোহ, যা পরিচিত পিজান্ট (কৃষক) রিভোল্ট নামে, মাত্র এক বছর স্থায়ী হয়েছিল, ১৫২৪ থেকে ১৫২৫। লুথারের ক্ষুব্ধ আর উৎসাহী সমর্থনে, কর্তৃপক্ষ নৃশংসতার সাথে সেই বিদ্রোহ দমন করেছিল এবং এক লক্ষ মানুষ সেই বিদ্রোহে প্রাণ দিয়েছিলেন। যখন এটি শেষ হয়েছিল, বেঁচে থাকা বাকি কৃষকদের উপর নির্যাতন আর জীর্ণকুটির পুড়িয়ে তাদের গৃহহীন করে দিতে উৎসাহী গুণ্ডাদের দল গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছিল। এটি ছিল আরেকটি উদাহরণ, যেভাবে মানুষকে স্বর্গে নেবার জন্যে ধর্মের এই উন্মত্ততা, এটিকে কীভাবে এই পৃথিবীতে সবার সাথে মিলেমিশে থাকা যায় তার উত্তম কোনো উপায় খুঁজতে অনাগ্রহী করে রাখে। কৃষক-বিদ্রোহে লুথারের এই সংশ্লিষ্টতা হয়তো প্রথম প্রটেস্টান্ট ক্রুসেড হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। পরে আরো অনেকবারই ঘটেছিল, সাধারণত প্রটেস্টান্টদের বিরুদ্ধে প্রটেস্টান্টরাই যুদ্ধ করেছিল। সবকিছুই বদলে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরও সবকিছুই আগের মতোই ছিল।

ষোড়শ শতাব্দীর শেষ নাগাদ, আয়ারল্যান্ড ছাড়া, উত্তর-ইউরোপ পুরোপুরি ভাবে প্রটেস্টান্ট ছিল। তাদের নতুন চার্চগুলোও ভিন্নরূপ নিয়েছিল, প্রায়শই পরস্পরের সাথে সহিংস দ্বন্দ্বগুলো অব্যাহত ছিল। কিন্তু ধর্মীয় সংকটের শিকার হিসাবে ইউরোপই একমাত্র মহাদেশ ছিল না, এটি ভারতেও ঘটেছিল। সুতরাং ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডে রিফরমেশন পৌঁছালে সেখানে কী ঘটেছিল সেটি দেখার জন্যে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করার আগে, আমরা আরো একবার আঁকাবাঁকা পথ নেব ভারতে কী ঘটেছিল সেটি দেখতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *