অধ্যায় ৩০. মধ্যম পথ
আমি যখন ছাত্র ছিলাম, চার্চের ইতিহাস বিষয়ে আমার শিক্ষকদের একজন ছিলেন অ্যাবারডিনের বাসিন্দা, যার বেশ বর্ণিল একটি বাচনভঙ্গি ছিল। রিফরমেশন নিয়ে যখন ক্লাসে লেকচার দিতেন, তিনি একটি রূপক ব্যবহার করতেন, যা এখনো আমি মনে করতে পারি। এভাবে তিনি ষোড়শ শতাব্দীর সেই সংগ্রামের পর্ব থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন চার্চের পদ্ধতি নিয়ে আমাদের ভাবতে প্ররোচিত করেছিলেন।
তিনি বলতেন : ধরুন, আপনার হয়তো ছোট একটা ছেলে আছে এবং বন্ধুদের সাথে সে বাইরে খেলছিল। যখন রাতে শোবার সময় সে বাসায় ফিরেছিল, তার মুখ ছিল ময়লা, সারাদিন ধরে মাঠে ঘোরাঘুরির কারণে তার মুখে কাদা লেগে আছে। যখন আপনি তাকে এই অবস্থায় দেখতে পেলেন, আপনার তখন কী করা উচিত? আপনার তিনটি বিকল্প আছে। আপনি তাকে সেই অবস্থায় বিছানায় শুতে পাঠাতে পারেন, এবং সে আপনার পরিষ্কার বালিশের কভারের উপর সে তার ছোট ময়লা মাথাটি নিয়ে শুয়ে পড়বে। আপনি তার মাথা কেটে ফেলতে পারেন। এটি অবশ্যই কাদার সমস্যাটি সমাধান করবে, কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় আপনি তাকেও হত্যা করবেন, এবং আপনার আর কোনো পুত্র থাকবে না। অথবা আপনি তাকে একটি গোছল দিতে পারেন এবং রাতে বিছানায় শোবার আগে তাকে ভালো করে পরিষ্কার করে দিতে পারেন।
কিন্তু তিনি আসলে এর মাধ্যমে আমাদের কী বোঝাতে চাইছিলেন? রিফরমেশনের পরে দাঁড়িয়ে থাকা চার্চগুলোর অতীতের সাথে ধারাবাহিকতার ধারণাটি তিনি অনুসন্ধান করছিলেন। সেখানে উপস্থাপন করার মতো তিনটি মডেল ছিল, তিনি বলেছিলেন। কোনো পরিবর্তন ছাড়াই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল; অথবা ধারাবাহিকতা ছাড়াই পরিবর্তন ঘটেছিল, অথবা খানিকটা পরিবর্তনের সাথে ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। ক্যাথলিক চার্চ অতীতের সেই খ্রিস্টধর্মের সাথে এর ধারাবাহিতা অব্যাহত রেখেছিল, যা বিস্তৃত ছিল যিশুর সেই অ্যাপোস্টলদের সময় অবধি। কিন্তু ষোড়শ শতক নাগাদ সেই ছোট বালকটির মতো এটি একটি নোংরা মুখমণ্ডল অর্জন করেছিল, কিন্তু সেইসব কাদার নিচে এটি তেমনই ছিল, যা শুরু থেকেই ছিল। এটি খ্রিস্টধর্ম, তবে যার সংস্কার হয়নি।
কিন্তু গোঁড়া-সংস্কারবাদীদের মতে ক্যাথলিসিজম আর খ্রিস্টান ধর্ম ছিল না। পোপের শুধুমাত্র একটি পঙ্কিল মুখই নেই, তিনি খ্রিস্টবিরোধী একটি চরিত্রে রূপান্তরিত হয়েছিলেন, এমন কেউ যিনি যিশুর অনুসারী হবার ভান করছেন শুধু, কিন্তু মূলত তিনি খ্রিস্টের শক্র। যেন কোনো ভিনদেশি একজন গুপ্তচর সেই দেশটিকে ভিতর থেকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে অন্য একটি দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। ক্যাথলিসিজম অশুভ একটি রূপ ধারণ করেছে এবং শয়তানের পক্ষ নিয়েছে, সুতরাং এর অশুভ সেই মাথাটি কেটে ফেলতে হবে।
মাঝখানে ছিলেন সংস্কারবাদীরা, যারা বলেছিলেন, তারা শুধুমাত্র চার্চের মুখ থেকে সেই কাদা বা ময়লার চিহ্ন পরিষ্কার করে ধুয়ে দিচ্ছেন। তারা চার্চকে পুরোপুরি বাতিল করছেন না, শুধুমাত্র সেই পঙ্কিলতা, যা এটিকে বিকৃত করেছে, সেটিকে বাতিল করছেন। সংস্কার পর্বে যেসব চার্চগুলোর আবির্ভাব হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে যে-চার্চটির কাছে এই মধ্যম পথটি সবচেয়ে আরাধ্য ছিল, এবং যে-পথটিকে এটি নিজের বলে দাবি করেছিল, সেই চার্চটি ছিল ইংল্যান্ডের চার্চ (‘চার্চ ইন ইংল্যান্ড’)। বলা হয়ে থাকে এর সংঘর্ষটি আসলে আদৌ ক্যাথলিক চার্চের সাথে ছিল না। মূলত এর বিরোধটি হয়েছিল ক্যাথলিক চার্চের একজন বিশপের সাথে। যিনি ছিলেনে রোমের বিশপ (পোপ)। ইটালির একজন বিশপের আরেকটি জাতির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কী অধিকার থাকতে পারে? সারা পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে তার দাবি চার্চের মূল পরিচিতির অংশ ছিল না। তার এই ক্ষমতাদখলের চেষ্টা ইতিমধ্যে পূর্বের অর্থোডক্স চার্চ আর পশ্চিমের ক্যাথলিক চার্চের মধ্যে একটি মহাবিভাজনের কারণ হয়েছিল। যদি আবার তিনি তার পুরনো কৌশল অবলম্বন করার চেষ্টা করেন এবং সতর্ক না হন, তাহলে আরো বড় একটি বিভাজন ঘটবে।
কিন্তু এই কাহিনিটির আরেকটি দিক ছিল। সেটি রোমের বিশপের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে যতটা না, তার চেয়েও বেশি এটি ইংল্যান্ডের রাজার বৈবাহিক সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। সেই রাজার নাম ছিল অষ্টম হেনরি, তিনি তার ছয় স্ত্রীর জন্য বিখ্যাত। আর ঘটনাটি কী নিয়ে ছিল, সেটি বুঝতে হলে তার জন্মের চল্লিশ বছর আগের সময়ে ফিরে যাবার প্রয়োজন আছে।
১৪৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুন হেনরি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ইংল্যান্ডকে খণ্ডবিখণ্ড করা সাঁইত্রিশ বছর ধরে চলা ধারাবাহিক বেশকিছু যুদ্ধ সমাপ্ত হবার চার বছর পরে। যুদ্ধগুলোর সূচনা হয়েছিল ১৪৫৫ খ্রিস্টাব্দে, এবং এটি চলেছে বসওয়ার্থের যুদ্ধ অবধি, ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে, যে যুদ্ধে হেনরি টুডোর চূড়ান্তভাবে জয়লাভ করেছিলেন, এবং এই যুদ্ধটি দীর্ঘদিনের সংঘর্ষ থামিয়েছিল। এরপর তিনি রাজা সপ্তম হেনরি নাম নিয়ে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। অবশেষে শান্তি এসেছিল এই দ্বীপটিতে। কিন্তু মধ্যযুগীয় রাজারা কখনোই স্থায়ী শান্তির প্রত্যাশা করতে পারতেন না। বিখ্যাত ইংলিশ নাট্যকার ও রাজতন্ত্র পর্যবেক্ষণকারী শেক্সপিয়ার লিখেছিলেন : ‘অস্বস্তিতে থাকে সেই মাথা, যে মাথা রাজমুকুট পরে।
ভবিষ্যৎ অষ্টম হেনরি সেইসব সংগ্রামের গল্প শুনেই বড় হয়েছিলেন, যে সংগ্রামের কারণে একদিন তার পিতা ইংল্যান্ডের সিংহাসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। তিনি হয়তো শিখেছিলেন কীভাবে একজন রাজাকে তার সিংহাসনের বিরুদ্ধে এমনকি সামান্যতম হুমকির প্রতি সারাক্ষণই সতর্ক থাকতে হয়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তার জন্যে বিষয়টি এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কারণ তার একজন বড়ভাই ছিলেন, আর্থার, যিনি সপ্তম হেনরির পর সিংহাসনে বসবেন এমন কথাই ছিল। বুদ্ধিমান এবং শারীরিকভাবে সুগঠিত তরুণ হেনরির শুধুমাত্র পড়াশুনা আর খেলাধুলা করা ছাড়া আর কোনো কাজই ছিল না। কিন্তু যখন তার বয়স দশ, তার পরিস্থিতিতে আকস্মিক একটি পরিবর্তন এসেছিল। তার বড়ভাই, সিংহাসনের জন্য নির্দিষ্ট রাজকুমার আর্থার মৃত্যুবরণ করেছিলেন তার বিধবা স্ত্রীকে রেখে, যিনি ছিলেন একজন স্প্যানিশ রাজকুমারী, ক্যাথেরিন অব আরাগন। হেনরি এরপর তার পিতার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নির্বাচিত হয়েছিলেন, যে সিংহাসনকে নিরাপদ এবং তার ক্ষমতায় ধরে রাখতে তিনি দীর্ঘদিন কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। ১৫০৯ সালে যখন সপ্তম হেনরি মারা গিয়েছিলেন, তার সতেরো বছরের ছেলে হেনরি, রাজা অষ্টম হেনরি হিসাবে সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন এবং পরবর্তী আটত্রিশ বছর তিনি রাজত্ব করেছিলেন।
আমাদের জন্যে সেই গল্পটির প্রাসঙ্গিক অংশটির সূচনা হয়েছিল যখন ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহণ করার পর অষ্টম হেনরি তার ভাই আর্থারের বিধবা স্ত্রী, ক্যাথেরিন অব আরাগোনকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যিনি বয়সে হেনরির চেয়ে পাঁচ বছরের বড় ছিলেন। বিষয়টি খুবই ব্যতিক্রম একটি ঘটনা, কারণ বাইবেলে এধরনের বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। ওল্ড টেস্টামেন্টে লেভিটিকাসে সুস্পষ্টভাবে কোনো ব্যক্তির জন্যে তার ভাইয়ের বিধবাপত্নীকে বিয়ে করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে : যদি কেউ তার ভাইয়ের স্ত্রীকে বিবাহ করে, এই মিলন অপবিত্র হবে। তিনি তার ভাইয়ের নগ্নতা উন্মোচন করবেন, এবং তারপর সেখানে সতর্ক করতে আসলেই খারাপ বার্তাটি দেওয়া হয়েছিল, এবং এমন মিলন সন্তানহীন হবে। আর এই বিয়ের কাজটি সম্পন্ন করার জন্যে হেনরিকে পোপের কাছ থেকে বিশেষ ছাড়পত্রও সংগ্রহ করতে হয়েছিল। এবং তিনি সেটি সংগ্রহ করেছিলেন এবং ক্যাথেরিনকে বিয়ে করেছিলেন। এটি প্রদর্শন করছে যে, অন্তত সেই সময়ে হেনরি বেশ আনন্দের সাথেই মেনে নিয়েছিলেন, তার রাজ্য ইংল্যান্ডের ওপর পোপের কর্তৃত্ব আছে।
সমস্যাটি শুরু হয়েছিল যখন ক্যাথেরিন সিংহাসনের জন্যে পুরুষ উত্তরাধিকারীর জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। আর এটি হেনরির জন্যে সত্যিকারের একটি দুশ্চিন্তা ছিল, যে-কোনো মধ্যযুগীয় রাজার জন্যে যেমন এটি একটা বড় সমস্যা ছিল। সিংহাসনের জন্যে একজন পুরুষ-উত্তরাধিকারী নিশ্চিত করা আসলেই সেই সময়ের রানিদের কাছে প্রত্যাশিত একটি দায়িত্ব ছিল। ক্যাথেরিন সেই কাজে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাকে একটি কন্যাসন্তান দিয়েছিলেন, মেরি, তবে কোনো পুত্র নয়। কিন্তু এই সিংহাসন দখলের রাজনীতিতে পুত্রসন্তানই মূলত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হেনরি ভালোই বাইবেল জানতেন। বাস্তবিকভাবে, তিনি খানিকটা ধর্মতাত্ত্বিকও ছিলেন। তিনি ল্যাটিন আর গ্রিক পড়তে পারতেন এবং কঠোরভাবেই একজন ক্যাথলিক ছিলেন। তিনি রিফরমেশনের বার্তাগুলো ঘৃণা করতেন, ইউরোপ থেকে যে-ধারণাগুলো ইংল্যান্ডে প্রবেশ করেছিল। একটি ছোট পুস্তিকায় তিনি লুথারের ধর্মতত্ত্বকে আক্রমণ করেছিলেন, আর যার কারণে পোপ দশম লিও তাকে বিশ্বাসের রক্ষক হিসাবে বিশেষ খেতাবও দিয়েছিলেন, যে খেতাবটির ওপর এখনো যুক্তরাজ্যের রাজারা দাবি অব্যাহত রেখেছেন। আপনি যদি একটি পাউন্ড মুদ্রা লক্ষ করেন, আপনি রানির নামের পাশে F2 বর্ণদুটি লেখা দেখবেন, এটি হচ্ছে ‘Fidei Defensor’, ল্যাটিন এই বাক্যটির অর্থ ধর্মবিশ্বাসের সুরক্ষাকারী।
সুতরাং তিনি আর যা কিছুই হয়ে থাকুন না কেন, অবশ্যই অষ্টম হেনরি প্রটেস্টান্ট ছিলেন না। তিনি ইংল্যান্ডের জন্য বিশেষভাবে একটি নতুন চার্চ সৃষ্টি করতে চাননি। তিনি একজন স্ত্রী চেয়েছিলেন, যে-কিনা তাকে পুত্রসন্তান দিতে পারে। এই সমাধানটি খুব সরল ছিল। বাইবেলে নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও পোপ তাকে ক্যাথেরিনকে বিয়ে করার জন্যে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্যাথেরিন যে তাকে কোনো পুত্রসন্তান দিতে পারেনি সেই বাস্তব তথ্যটি প্রমাণ করেছিল, পোপের আসলেই এই বিয়েতে অনুমতি দেওয়া উচিত হয়নি। লেভিটিকাসের সেই অনুচ্ছেদটি কী বলেছিল? তারা সন্তানহীন থাকবে। যেহেতু কন্যারা ধর্তব্যের মধ্যে পড়েন না, হেনরি নিজেকে সন্তানহীন ভেবেছিলেন। এবং পোপের এই বিয়ে ‘বাতিল’ ঘোষণা করা উচিত, এর মানে তিনি ঘোষণা করবেন এই বিয়ে কখনোই ‘বৈধ’ ছিল না।
কিন্তু পোপের জন্যে এই কাজটি করা বেশ কঠিন ছিল। যদি তিনি এই বিয়ে নিষ্পত্তিতে হ্যাঁ বলেন, তাহলে তিনি ক্যাথেরিনের আত্মীয় স্পেনের ক্ষমতাবান সম্রাটের বিরাগভাজন হবেন। যদি তিনি না বলেন তাহলে তিনি ইংল্যান্ডের রাজাকে অসন্তুষ্ট করবেন। সুতরাং তিনি কিছুই করেননি, আশা করেছিলেন, এমন কিছু ঘটবে তাকে এই সিদ্ধান্ত নেবার ঝামেলা থেকে মুক্তি দেবে।
যা ঘটেছিল সেটি ছিল হেনরির জীবনে আরেকজন নারী এসেছিলেন। তিনি অ্যান বোয়েলিন, রানি ক্যাথেরিনের একজন লেডি ইন ওয়েটিং। নিজের মৃতভাইয়ের স্ত্রীকে বিয়ে করার কারণে অভিশপ্ত এমন দৃঢ়বিশ্বাস নিয়ে, এবং অ্যানের প্রেমে পড়ে, হেনরি ১৫৩৩ সালে গোপনে তাকে বিয়ে করেছিলেন। এবং ১৫৩৪ সালে তিনি তার উপদেষ্টাদের ইতিহাস থেকে এমন কোনো উদাহরণ খুঁজে বের করতে নির্দেশ দিয়ে নিজেকে চার্চ অব ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ গভর্নর হিসাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর চার্চের ওপর এই নতুন কর্তৃত্ব গ্রহণ করার পর, ক্যাথেরিনের সাথে তার বিয়ে নিষ্পত্তি করার মাধ্যমেই তিনি তার প্রথম ক্ষমতাটি ব্যবহার করেছিলেন। এর মাধ্যমে রোমের সাথে তার বিচ্ছেদটিও চূড়ান্ত হয়েছিল।
যে-বিষয়টি লক্ষ করতে হবে সেটি হচ্ছে এই বিভাজনের কারণ কিন্তু প্রটেস্টান্টদের নতুন কোনো চার্চ প্রতিষ্ঠার আহ্বান নয় বরং নতুন স্ত্রীর জন্যে ইংল্যান্ডের রাজার দাবি। ইংল্যান্ডে অবশ্যই প্রটেস্টান্টরা ছিলেন। তাদের একজন ছিলেন রাজার প্রধান মুশকিল-আসানকারী, থমাস ক্রমওয়েল, আর হেনরি ক্রমওয়েলের সমর্থন যে রিফরমেশনের দিকে ঝুঁকে আছে সেটি সম্ভবত জানতেন না। এই নানা জটিল পরিস্থিতি থেকে আবির্ভূত হয়েছিল চার্চ অব ইংল্যান্ড, যা নিজেকে ক্যাথলিক এবং সংস্কারপন্থি হিসাবে দাবি করেছিল। একই তবে তারপরও ভিন্ন। এটি বিশপ, যাজক, ডিকনদের আগের প্রাধান্যপরম্পরা অপরিবর্তিত রেখেছিল এবং তারপরও এটি অ্যাপোস্টলিক উত্তরাধিকারের মধ্যে অবস্থান করছে বলে দাবি করেছিল। তাদের কমন প্রেয়ার বা সাধারণ প্রার্থনার নতুন বইয়ে এটি পুরনো ক্যালেন্ডারের নানা ধর্মীয় আচারের দিন-তারিখে কোনো পরিবর্তন আনেনি, তবে এই নতুন বইটি ইংরেজদের তাদের নিজেদের ভাষার সুন্দর একটি সংস্করণে উপাসনা করার সুযোগ করে দিয়েছিল। এটি এমনকি নতুন কোনো চার্চ বা ভিন্নধরনের কোনো চার্চও ছিল না। এটি পুরনো ক্যাথলিক চার্চই ছিল, তবে এটি ঝকঝকে একটি নতুন চেহারা পেয়েছিল।
যাই হোক, এভাবে ইংল্যান্ডের চার্চ নিজের বর্ণনা দিতে চেয়েছে। কিন্তু এর উৎপত্তি অবশ্যই ঝকঝকে পরিষ্কার সেই ইমেজ থেকে বহু দূরবর্তী। ধর্মতাত্ত্বিক সংস্কার নয় বরং রাজার রাজনীতি প্রাচীন ক্যাথলিক চার্চ থেকে ইংল্যান্ডকে পৃথক করেছিল। কিন্তু এই ইংলিশ রিফরমেশন ধর্মের একটি দিককে নির্দেশ করে, যা নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত : মানব রাজনীতির সাথে যেভাবে ধর্ম অনিবার্যভাবেই পরস্পরগ্রন্থিত থাকে। রাজনীতি, পলিটিক্স, শব্দটির উৎসের গ্রিকশব্দটির অর্থ হচ্ছে শহর, এর সব টানাপড়েন আর মতানৈক্যসহ মানুষ যেভাবে তাদের বাহ্যিক জীবনটি সংগঠিত করে তারই অপর একটি নাম। রাজনীতি সবকিছুর মধ্যেই অনুপ্রবেশ করে, স্কুলের খেলার মাঠের গণ্ডগোল থেকে জাতিসংঘে বিতর্ক অবধি।
আর শুরু থেকেই ধর্ম রাজনীতির সংমিশ্রণের একটি অংশ ছিল। আমরা হয়তো এমনকি বলতে পারি, মানবতা আর ঈশ্বরের সম্পর্কটি মূলত একধরনের রাজনীতি, কারণ এর মূল বিষয় হচ্ছে কীভাবে আমরা অন্যদের সাথে সম্পর্কযুক্ত সেই বিষয়টি অনুসন্ধান করা, অর্থাৎ পারস্পরিক সম্পর্কগুলোর স্বরূপ বোঝার একটি উপায়। একেবারে সূচনালগ্ন থেকেই পার্থিব রাজনীতির অংশ ছিল ধর্ম। অবশ্যই ধর্মের মধ্যে রাজনীতি আছে, যেমন, কে ধর্মের নেতৃত্ব দেবেন, আর কীভাবেই বা তাদের নির্বাচন করা হবে, সেটি নিয়ে মতবিরোধ।
কিন্তু আসল ভয়ংকর ঘটনাগুলো ঘটে যখন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্বে ধর্ম একটি অস্ত্রে পরিণত হয়, বিতর্কের বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন, ঈশ্বর তাদের পক্ষে আছেন বলে যারা দাবি করে থাকেন। আর সে-কারণে আমাদের এই রিফরমেশন আন্দোলনটিকে দেখতে হবে এমনভাবে যেখানে ধর্ম থেকে সেই সময়ের রাজনীতিকে পৃথক করা অসম্ভব একটি বিষয় ছিল, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে। তার নিজের রাজ্যের নিরাপত্তার জন্যে হেনরির একটি তালাকের দরকার ছিল, এবং পোপ যদি সেটি করার অনুমতি তাকে না দিতে চান অথবা না দিতে পারেন, তাহলে এমন কাউকে তাকে খুঁজে বের করতে হবে যিনি সেটি দিতে পারবেন। সুতরাং তিনি রোম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। চার্চ অব ইংল্যান্ডের জন্ম হয়েছিল। আর এর সূচনা আর উৎপত্তি যতই বিতর্কিত থাকুক না কেন, এটি নিজেকে দুই চরমপন্থি অবস্থানের ব্যতিক্রম একটি মধ্যপন্থা হিসাবে দেখেছিল। এটি তখনো একটি ক্যাথলিক চার্চ তবে অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন একটি চেহারাসহ।
হেনরি তার তালাক নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন, কিন্তু সেটি তাকে সুখী করতে পারেনি। অ্যান বোয়েলিনও তার জন্যে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে পারেননি। যদিও তিনি একটি কন্যাশিশুর জন্ম দিয়েছিলেন। সুতরাং হেনরির জন্য সেই অভিশাপ অব্যাহত ছিল। মিথ্যা ব্যাভিচারের অভিযোগে হেনরি অ্যান বোয়েলিনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। এরপর তিনি জেন সেমুরকে বিয়ে করেছিলেন, যিনি তার আরাধ্য পুত্রসন্তানটির জন্ম দিয়েছিলেন, যার নাম দেওয়া হয়েছিল এডওয়ার্ড। এবং যখন ১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দে হেনরি মারা যান, নয় বছর বয়সী এডওয়ার্ড সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন।
এডওয়ার্ডের সংক্ষিপ্ত শাসনামলে চার্চ অব ইংল্যান্ডের সংস্কার এর চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছিল। এবং যখন তিনি ১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দে মারা যান, রাজ্যশাসনের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন ক্যাথেরিনের কন্যা মেরি, এবং ইংল্যান্ডের ধর্মীয় রাজনীতির চাকাটি বিপরীত দিকে ঘুরতে শুরু করেছিল। ক্যাথলিক চার্চ পুনর্বহাল করা হয়েছিল এবং যারা তার মা, অষ্টম হেনরির প্রথম স্ত্রী ক্যাথেরিনের জীবনে যন্ত্রণার কারণ হয়েছিলেন, মেরি তাদের উপর তার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। প্রটেস্টান্টদের উপর নির্যাতন পরিচালনায় তিনি খুবই উৎসাহী ছিলেন, যাদের অনেককেই তিনি তাদের ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে পুড়িয়ে হত্যা করেছিলেন এবং নিজেই সেই কুখ্যাত খেতাবটি জুটিয়েছিলেন, ‘ব্লাডি মেরি’।
১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে মেরির মৃত্যু হলে আবার পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিয়েছিল। মেরির পর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন অ্যান বোয়েলিনের কন্যা। এলিজাবেথ, যিনি ১৬০১ সাল অবধি শাসন করেছিলেন, এবং ইংল্যান্ডে সমৃদ্ধি আর শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন। নিয়তির পরিহাস হচ্ছে অষ্টম হেনরি যে-কন্যাকে চাননি, সেই কন্যাই ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে বিচক্ষণ একজন শাসক হিসাবে নিজেকে প্রমাণিত করেছিলেন। তিনি রাজ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনেছিলেন, এবং চার্চের সংস্কার পূর্ণাঙ্গভাবে সমাপ্ত করেন। কিন্তু তিনি তার বাবার মতোই নিষ্ঠুর হতে পারতেন। ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি তার জ্ঞাতিবোন মেরি কুইন অব স্কটকে ষড়যন্ত্রের কারণে শিরশ্চেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। মেরি শিরশ্চেদ করতে কুঠারের তিনটি আঘাত প্রয়োজন হয়েছিল, এটি দুঃখী জীবনের ভয়ংকর এক পরিণতি। আর কেন সেটি ঘটেছিল সে বুঝতে হলে এবার আমাদের উত্তরে স্কটল্যান্ডে যেতে হবে, যেখানে রিফরমেশনের এই সংস্কার-আন্দোলনটি খুব ভিন্নদিকে মোড় পরিবর্তন করেছিল।