০৫. রাজকুমার থেকে বুদ্ধ

অধ্যায় ৫. রাজকুমার থেকে বুদ্ধ

সেই আর্য ঘোড়সওয়ারদের ভারতে প্রবেশ আর জটিল আর বর্ণিল একটি ধর্মের বিবর্তন শুরু করবার পর যে ধর্মটিকে এখন আমরা হিন্দুধর্ম বলি-পনেরোশত বছর পরে একজন ব্যক্তি অশেষ পুনর্জন্মের এই মতবাদটির দিকে গম্ভীর হতাশা নিয়ে তাকিয়েছিলেন। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন, আসলেই কোন্ জিনিসটি আমাদের আত্মাকে ‘সামসারা’র চক্রে এভাবে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে। আর এই প্রশ্নের উত্তর থেকে একটি নতুন আধ্যাত্মিক আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। কমন এরা শুরু হবার ৫৮০ বছর আগে (খ্রিস্টপূর্ব) উত্তর-পূর্ব ভারতে হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার নাম ছিল সিদ্ধার্থ গৌতম এবং এটি তার কাহিনি।

সিদ্ধার্থ ছিলেন রাজা আর যোদ্ধাদের ক্ষত্রিয় বর্ণের একজন সদস্য। তার পিতা শুদ্ধোদনের, শাক্য রাজ্যের রাজা (শাক্য প্রজাতন্ত্রের নির্বাচিত প্রধান), বয়স যখন পঞ্চাশ, তখন তার স্ত্রী রানী মায়া (মায়াদেবী) তাদের এই পুত্রসন্তানটির জন্ম দিয়েছিলেন। একজন ধর্মপ্রাণ শিশু হিসাবে, সিদ্ধার্থ হিন্দুধর্মের পবিত্রতম গ্রন্থ বেদ অধ্যয়ন করেছিলেন। এবং যদিও তিনি রাজকুমার ছিলেন, যিনি কিনা বিশেষভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত বিলাসী একটি জীবন কাটাতেন, তার শিক্ষকরা কিন্তু তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, বহু জীবনের সেই জন্মজন্মান্তর চক্রের দীর্ঘ একটি যাত্রায় বাকি আর সবার মতোই তিনিও একজন যাত্রী। তার বয়স যখন ষোলো, তিনি রাজকুমারী যশোধরাকে বিয়ে করেছিলেন, এবং তাদের একটি পুত্রসন্তান হয়েছিল, রাহুল। উনত্রিশ বছর বয়স অবধি সিদ্ধার্থ সুরক্ষিত আর বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত একটি জীবন কাটিয়েছিলেন, তার প্রতিটি প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যে ছিল রাজভৃত্যদের একটি বিশাল বাহিনী। কিন্তু অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে ধারাবাহিকভাবে ঘটা কিছু ঘটনা চিরকালের জন্যে তার জীবনটাকে বদলে দিয়েছিল। সে-ঘটনাগুলো চার নিমিত্ত দর্শনের কাহিনি (স্টোরি অব ফোর সাইটস) হিসাবে পরে পরিচিতি পেয়েছিল।

প্রথম দিনে, দিনের শেষে শিকার থেকে ফেরার পথে, সিদ্ধার্থ একজন রোগজীর্ণ রুগ্ণ ব্যক্তিকে মাটিতে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখেছিলেন। তিনি তার দেহরক্ষী ও সারথি ছন্নকে (ছন্দক) জিজ্ঞাসা করছিলেন এই লোকটির কী হয়েছে। ‘লোকটি অসুস্থ’, এটাই ছিল উত্তর। রাজকুমার জিজ্ঞাসা করেন, ‘কেন সে অসুস্থ’? ‘রাজকুমার, এটাই জীবনের নিয়ম। সব মানুষই অসুস্থ হবে’। রাজকুমারকে দেখে মনে হয়েছিল তিনি কিছু ভাবছেন, কিন্তু আর কিছু বলেননি।

পরের দিন, ধনুকের মতো বাঁকা পিঠসহ একজন বৃদ্ধকে তিনি দেখেছিলেন, তার মাথা আর হাত ছিল কম্পমান। এমনকি দুটো লাঠির উপর ভর করেও তার জন্যে, হাঁটা স্পষ্টতই বেশ কষ্টকর অনুভূত হয়েছিল। ‘ঐ মানুষটাও কি অসুস্থ?’ রাজকুমার ছন্নকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। ‘না’, ছন্ন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘উনি বৃদ্ধ, বৃদ্ধবয়সে সব মানুষের সাথে এমনই হয়’। রাজকুমারকে দেখে মনে হয়েছিল তিনি কিছু ভাবছেন, কিন্তু আর কিছু তিনি বলেননি।

তৃতীয় দৃশ্য ছিল একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার যাত্রা। একজন মৃত মানুষকে শ্মশানে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল হিন্দুধর্মের নিয়মানুযায়ী, এবং মৃতের ক্রন্দনরত বিধবা স্ত্রী আর সন্তানরা সেটি অনুসরণ করছিলেন। সিদ্ধার্থ ছন্নকে প্রশ্ন করেছিলেন, কী হচ্ছে এখানে। ‘এটি সব রক্ত-মাংস দিয়ে গড়া মানুষের নিয়তি’। তিনি ব্যাখ্যা করেন, রাজকুমার কিংবা ভিক্ষুক, আমাদের সবার জন্যেই মৃত্যু আসবে। আবারও সিদ্ধার্থ কোনো উত্তর দিলেন না।

সিদ্ধার্থ অসুখ, বার্ধক্য আর মৃত্যুর দুঃখের সাক্ষী হয়েছিলেন। ‘এইসব দুঃখের কারণ কী?’ তিনি ভাবতে শুরু করেছিলেন। তিনি বেদ পড়েছিলেন, কিন্তু সেটি তাকে যা বলেছিল সেটি হচ্ছে, এটাই জীবনের নিয়ম, এটাই হচ্ছে কার্মা। যখন তিনি তার প্রাসাদে বসে এইসব রহস্যগুলো নিয়ে ভাবছিলেন, একটি গানের শব্দ জানালা দিয়ে তার কান অবধি ভেসে এসেছিল। কিন্তু সেটি তাকে আরো বিষণ্ণ করে তুলেছিল। আনন্দ সাময়িক, তিনি অনুধাবন করেছিলেন। এটি স্বস্তি দেয় কিন্তু মৃত্যুর ক্রমশ এগিয়ে আসাটিকে মন্থর করার জন্যে কিছুই করতে পারে না।

চতুর্থ দিনে তিনি একটি বাজারে গিয়েছিলেন, যথারীতি ছন্নও ছিল তার সাথে। দোকানি আর ব্যবসায়ীদের মধ্যে, যারা ক্রেতাদের সব প্রয়োজন পূরণ করেন, সিদ্ধার্থ মোটা কাপড়ের জামা পরা একজন সন্ন্যাসীকে দেখেছিলেন, যিনি খাদ্যের জন্যে সবার কাছে ভিক্ষা প্রার্থনা করছিলেন। তিনি বৃদ্ধ এবং স্পষ্টতই দরিদ্র, কিন্তু তারপরও তাকে দেখতে সুখী আর প্রশান্তিময় মনে হয়েছিল। ‘এটি কেমন ধরনের মানুষ’? তিনি ছন্নকে আবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন। ছন্ন ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘তিনি সেই মানুষগুলোর একজন, যারা গৃহত্যাগ করেছেন নিজস্ব কোনো সম্পদ আর মায়া ছাড়া বাঁচতে, সংসার যে মোহের সৃষ্টি করে সেটি থেকে মুক্তি পেতে।’

গভীর চিন্তা নিয়েই সিদ্ধার্থ তার প্রাসাদে স্বাচ্ছন্দ্যে ফিরে আসেন। সেই নিদ্রাহীন আর অস্থির রাতে একটি অনুধাবন তাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল, সেটি হচ্ছে আসলেই তৃষ্ণাই (কামনা কিংবা বাসনা) হচ্ছে সব মানব-দুঃখের মূল কারণ। নারী ও পুরুষ কখনোই কেউ তাদের ভাগ্য নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, কখনোই তারা শান্তিতে নেই। তারা সেটাই কামনা করে, যা তাদের নেই। কিন্তু যখনই তাদের সেই কাঙ্ক্ষিত দ্রব্যটি অর্জন করা হয়ে যাবে, সেই জায়গায় নতুন আরো একটি কামনাও জেগে উঠবে। আর বিষয়টি নিয়ে যতই তিনি ভাবছিলেন, ততই এই কামনাগুলো তার অসহ্য মনে হয়েছিল, তীব্র বিতৃষ্ণা তিনি অনুভব করেছিলেন। এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া প্রতিটি সত্তাকে আক্রান্ত করে এটি এমন একটি অসুখ, এই বাধ্যবাধকতা থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই। যদিও কামনা তাকে বিতৃষ্ণ করে তুলেছিল, কিন্তু সেই মানুষগুলোর প্রতি সহমর্মিতায় তার হৃদয় পূর্ণ। হয়েছিল, যাদের এটি নিরন্তর নিপীড়ন করছে। তখনই তিনি তাদের সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি তাদের জন্যে একটি উপায় খুঁজে বের করবেন, যেন তৃষ্ণার এই কারাগার থেকে তারা মুক্তি পেতে পারে, যেন তাদের আর এই দুঃখময় পৃথিবীতে কখনোই জন্ম নিতে না হয়। তিনি সেই জ্ঞানের অনুসন্ধান করবেন যা তাকে পুনর্জন্ম চক্রের অনন্ত ঘূর্ণন থেকে মুক্তি দেবে। তারপর তিনি অন্যদের তার সেই খুঁজে-পাওয়া পথটি প্রদর্শন করবেন।

এই সিদ্ধান্তটি নেবার পর তিনি তার বিছানা থেকে উঠে পড়েছিলেন, তার স্ত্রী আর পুত্রকে নীরবে বিদায় জানিয়ে তিনি ছন্নকে ডেকে পাঠান। সারথি ছন্নকে নিয়ে তার প্রিয় ঘোড়া কন্থকের টানা রথে তারা রাতের অন্ধকারে প্রাসাদের বাইরে বের হয়ে আসেন। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যখন তারা বনের প্রান্তে এসে পৌঁছান, সিদ্ধার্থ রথ থেকে নেমে তলোয়ার দিয়ে তার দীর্ঘ চুল কেটে মুণ্ডিতমস্তক হন। তিনি ছন্নকে তার চুলের গোছাটি দেন এবং তাকে প্রাসাদে ফেরত পাঠান, যেন সেটি সে প্রমাণ হিসাবে দেখাতে পারে, আজ থেকে তিনি একটি নতুন জীবনের পথে যাত্রা শুরু করেছেন। এরপর তিনি তার মূল্যবান রাজবস্ত্র একটি ভিখারির ছিন্নবস্ত্রের সাথে রদবদল করে নেন, এবং গৃহহীন এক তীর্থযাত্রী হিসাবে তার যাত্রা শুরু করেন। রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম যখন ভিক্ষুকের জীবন বেছে নিয়েছিলেন তখন তার বয়স ছিল উনত্রিশ। তার কাহিনির এই মুহূর্তটি পরিচিত মহাভিনিষ্ক্রমণ (দ্য গ্রেট রিনানসিয়েশন) নামে।

ছয় বছর তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, বোধিলাভ আর বাসনা থেকে মুক্তি পাবার শ্রেষ্ঠ উপায় অনুসন্ধান করে। তার সাথে দেখা হওয়া সাধুরা দুটি পথ প্রস্তাব করেছিলেন। একটি ছিল খুব কঠোর মানসিক অনুশীলন, যা পরিকল্পিত হয়েছে মনকে শৃঙ্খলাপূর্ণ এবং বাসনাগুলোকে স্থির করতে। সিদ্ধার্থ এই কৌশলটি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন এবং এগুলো সহায়ক এমন প্রমাণও পেয়েছিলেন। কিন্তু এটি তার সেই চূড়ান্ত মুক্তি বা বোধিলাভ যা তিনি অনুসন্ধান করছিলেন তা নিকটে আনতে পারেননি। সুতরাং তিনি ধ্যানে মগ্ন হয়ে থাকা সাধুদের ত্যাগ করে আবার তার যাত্রা শুরু করেন। এভাবে তিনি একদল সন্ন্যাসীর দেখা পান, যারা অনশন, শারীরিক নিপীড়ন ও কঠোর সাধনার তপস্যা করতেন। তারা তাকে বলেছিলেন, যত তীব্রতার সাথে তিনি তার শরীরকে ত্যাগস্বীকার করাতে পারবেন, ততই সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে তার মন। আপনি যদি আত্মার মুক্তি চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই অনশন করতে হবে, শরীরকে অভুক্ত রাখতে হবে। সিদ্ধার্থ আত্ম-অস্বীকৃতির এই আচার শুরু করেছিলেন, যা তাকে প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি নিয়ে এসেছিল। এই সময়ে তার নিজের সম্বন্ধে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন :

যখন আমি দিনে মাত্র একটি ফল খেয়ে বেঁচে ছিলাম আমার শরীর শীর্ণ আর রুগ্ণ হয়েছিল… আমার হাতপাগুলো পরিণত হয়েছিল যেন শুকনো কোনো লতাগাছের জটগুলো.. ভেঙে পড়া ছাদের কড়ি-বরগার রূপ নিয়ে ছিল আমার বুকের রুগ্ণ পাজর.. যদি আমি আমার পেটটা ছুঁতে যেতাম, হাতে ধরা পড়ত আমার মেরুদণ্ড।

তিনি আপন মনেই চিন্তা করেছিলেন : এই শারীরিক কৃচ্ছসাধনের তত্ত্ব যদি সত্য হয়, নিশ্চয়ই আমি ইতিমধ্যেই বোধিলাভ করে ফেলতাম, কারণ আমি প্রায় মৃত্যুর সীমানায় এসে উপস্থিত হয়েছি। এখন এতই দুর্বল যে, তিনি তার শরীর নিয়ে দাঁড়াতেও পারছিলেন না। এমনকি আর একবিন্দু তার শরীরটাকে টেনে নিয়ে যেতে পারছিলেন না। সিদ্ধার্থ জ্ঞান হারিয়েছিলেন। তার সতীর্থরা ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো আসন্ন মৃত্যুর মুখোমুখি, কিন্তু তিনি আরোগ্য লাভ করেছিলেন। এবং যখন তিনি তার স্বরূপে ফিরে এসেছিলেন, তখন সন্ন্যাসীদের বলেছিলেন, তিনি একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। ছয় বছরের তীব্র ধ্যান আর আত্ম-অস্বীকৃতি তার খুঁজে-বেড়ানো বোধির আদৌ কাছাকাছি তাকে নিয়ে আসতে পারেননি। সুতরাং তিনি এই অনশন আর আত্মনিপীড়ন বন্ধ করবেন। তার এই ঘোষণায় ব্যথিত হয়ে সন্ন্যাসীরা তাকে ত্যাগ করে চলে যান, এবং সিদ্ধার্থ একাই তার পথ চলতে শুরু করেন।

তিনি একটি বন্য অশ্বথগাছের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন, এর ছায়ায় বিশ্রাম নেবার সময় তিনি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যদি আমার চামড়া, স্নায় আর অস্থি ক্ষয় হয়েও যায়, আমার জীবন-রক্ত শুকিয়েও যায়, তারপরও যতক্ষণ-না আমি সত্যজ্ঞান লাভ করছি আমি এখানেই বসে থাকব। সাত দিন পর, তিনি হঠাৎ করেই অনুধাবন করেছিলেন, তার নিজের মধ্য থেকে তৃষ্ণা দূর করার তৃষ্ণাটিও একটি তৃষ্ণা। তিনি অনুধাবন করেছিলেন এই বাসনা থেকে মুক্তি পাবার বাসনাই তার নিজের বোধিলাভ করার পথের অন্তরায়। এবং যখন এই অন্তদৃষ্টির প্রকৃত অর্থ তার কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, তার মনের মধ্যে বিকশিত হয়েছিল, তিনি সচেতন হয়ে উঠেছিলেন যে, তিনি এখন সব বাসনাশূন্য, সব তৃষ্ণা থেকে মুক্ত। তিনি পরমানন্দময় একটি অবস্থায় প্রবেশ করেন, যেখানে ‘অজ্ঞতা ধ্বংস হয়েছিল, জ্ঞানের জন্ম হয়েছিল; অন্ধকার দূর হয়েছিল, আলোয় প্লাবিত হয়েছিল।’

তাৎক্ষণিকভাবে তিনি অনুধাবন করেছিলেন, ‘পুনর্জন্ম আর নয়। আমি সর্বোচ্চ জীবন কাটিয়েছি, আমার কাজ এখন শেষ, আর এখন আমি যা ছিলাম, সেটির আর কোনো অস্তিত্ব নেই।’ সামসারার চক্রের ঘূর্ণন আর পুনর্জন্ম তার জন্যে থেমে গিয়েছিল। আর তখন তিনি বুদ্ধে পরিণত হয়েছিলেন ‘যিনি পরম শাশ্বত বোধ বা জ্ঞান লাভ করেছেন।’ যেদিন সর্বতৃষ্ণার ক্ষয় সাধন করে তিনি বোধিজ্ঞান লাভ করে বুদ্ধ হয়েছিলেন, সেটি মহাপবিত্র রাত্রি নামে পরিচিত (বুদ্ধ পূর্ণিমা)। উনপঞ্চাশ দিন ধরে ধ্যান করার পর তিনি বোধিপ্রাপ্ত হন। এই সময় তিনি মানবজীবনে দুঃখ ও তার কারণ এবং দুঃখ নিবারণের উপায় সম্বন্ধে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন, যা ‘চতুরার্য সত্য’ নামে খ্যাত হয়। তার মতে এই সত্য সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করলে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ সম্ভব।

এরপর তিনি সেই সাধুদের খুঁজতে গিয়েছিলেন যাদের তিনি হতাশ করেছিলেন তাদের বোধিলাভের পথ অনুসরণ না করে। উত্তর-ভারতে গঙ্গার তীরে অবস্থিত একটি শহর বারানসীর একটি মৃগ-উদ্যানে তিনি তাদের খুঁজে পান। একসময় তাদের পরিত্যাগ করা সত্ত্বেও তারা তাকে সৌজন্যের সাথে স্বাগত জানিয়েছিলেন। বারানসীর নিকট ঋষিপতনের এই মৃগ-উদ্যানে যাত্রা করে তার সাধনার সময়ের পাঁচ প্রাক্তন সঙ্গীদের তিনি তার প্রথম শিক্ষা প্রদান করেন। এইভাবে তাদের নিয়ে ইতিহাসের প্রথম বৌদ্ধসংঘটি গঠিত হয়েছিল। তাদের নম্র অভিযোগ যে, কৃচ্ছসাধনের জীবন ত্যাগ করে তিনি বোধিলাভ করার সুযোগ হারিয়েছেন, এর উত্তরই ছিল বুদ্ধের প্রথম ধর্মশিক্ষা, যা বৌদ্ধ ঐতিহ্যে ‘ধর্মচক্রবর্তন’ নামে খ্যাত। (সার্সন অব দ্য টার্নিং অব দ্য হুইল)। এই শিক্ষা দেবার সময় তিনি আবার সেই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেছিলেন যা বোধিলাভের উদ্দেশ্যে তার গৃহত্যাগ করার মুহূর্ত থেকেই তার মনে সবসময়ই উপস্থিত ছিল। সামসারা’র এই ঘূর্ণায়মান চক্রকে থামাতে পারে কি, যার সাথে আমাদের তৃষ্ণাগুলো আমাদের শৃঙ্খলিত করে রেখেছে? প্রশ্নটির যে উত্তর তিনি দিয়েছিলেন সেটি হচ্ছে : এর থেকে বের হবার উপায় হচ্ছে দুই চূড়ান্ত উপায়ের মধ্যবর্তী পথটি। তিনি এটিকে বলেছিলেন মধ্যম পন্থা (দ্য মিডল পাথ)। তিনি সন্ন্যাসীদের বলেন : দুটি চূড়ান্ত পথ আমাদের এড়িয়ে চলতে হবে। একটি সুখানুভূতি অর্জনের জীবন, এবং এর কামনা, এটি অধঃপাত, এবং এখানে কোনো লক্ষ্য বা মুক্তি নেই। আরেকটি চূড়ান্ত প্রান্ত হচ্ছে আত্ম অস্বীকৃতির জীবন। এটি কষ্টকর, এখানেও কোনো মুক্তি নেই। এই দুটি চূড়ান্ত পথ এড়িয়ে যদি আমরা মধ্যম পন্থা অর্জন করি, এটি আমাদের বোধিলাভের দিকে নিয়ে যায়। এই মধ্যম পথের নির্দেশকগুলো হচ্ছে চারটি মহান সত্য, চতুরার্য সত্য (ফোর নোবেল ট্রুথ, চতুরার্য প্রধান জ্ঞান দর্শন। এই চারটি সত্য হল : দুঃখ, দুঃখ-সমুদয়, দুঃখ-নিরোধ ও দুঃখ-নিরোধ মার্গ। চতুরার্য সত্যের প্রথম সত্য হল দুঃখ। দ্বিতীয় সত্য হল দুঃখ সমুদয় বা দুঃখের কারণ হচ্ছে তৃষ্ণা বা আসক্তি। তৃষ্ণাকে দৃঢ়ভাবে সংযত করে ও ক্রমশ পরিত্যাগ করে বিনাশ করাকে গৌতম বুদ্ধ দুঃখ-নিরোধ বলেছেন। চতুরার্য সত্যের প্রথম তিনটি সত্য দুঃখের বৈশিষ্ট্য ও কারণকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, এর চতুর্থ সত্য দুঃখ-নিবারণের ব্যবহারিক উপায় দর্শায়। গৌতম বুদ্ধ দ্বারা বর্ণিত দুঃখ-নিরোধ মার্গ বা দুঃখ-নিরসনের উপায়কে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়। পুরো জীবনটাই পূর্ণ দুঃখে। আর দুঃখের কারণ হচ্ছে কামনা/তৃষ্ণা/আসক্তি। আর তৃষ্ণাকে নিরোধ বা বর্জন করা যেতে পারে। আর দুঃখ নিরসনের উপায় হচ্ছে তার অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করা (এইটফোন্ড পাথ বা অষ্টাঙ্গিক মার্গ : গৌতম বুদ্ধ দ্বারা বর্ণিত দুঃখ-নিরোধ মার্গ বা দুঃখ-নিরসনের উপায়। এটি বৌদ্ধধর্মের মূলকথা চতুরার্য সত্যের চতুর্থতম অংশ।)

বুদ্ধ প্রয়োগবুদ্ধিসম্পন্ন একজন ব্যক্তি ছিলেন, তিনি কর্মে বিশ্বাস করতেন। আর এই ধরনের মানুষদের বিশেষভাবে লক্ষণীয় একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা তালিকা তৈরি করতে পছন্দ করেন; যেমন, কী করতে হবে, কী মনে রাখতে হবে, বাজারে গেলে কী কী কিনতে হবে ইত্যাদি। আর বুদ্ধের অষ্টাঙ্গিক মার্গের তালিকাটি হচ্ছে দুঃখের, কারণ তৃষ্ণাকে দূর করার জন্যে যা-কিছু করতে হবে : সম্যক দৃষ্টি/বিশ্বাস, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রযত্ন, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। সম্যক বা সঠিক বিশ্বাস আর সঠিক সংকল্প হচ্ছে মধ্যম পথ খোঁজা এবং সেটি অনুসরণ করা। এরপরে হচ্ছে সেই সিদ্ধান্ত : কখনোই পরনিন্দা অথবা কটুবাক্য ব্যবহার না করা। এমনকি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোনোকিছু চুরি, হত্যা অথবা লজ্জাজনক কোনো কাজ করতে অস্বীকার করা, এবং সেইসব পেশা বর্জন করা, যা অন্যের ক্ষতি করে।

বৌদ্ধধর্ম হচ্ছে একটি অনুশীলন; এটি কোনো ধর্মীয় মতবিশ্বাস বা মতবাদ নয়। এখানে কোনোকিছু বিশ্বাস করার বিষয় নেই বরং কিছু করার বিষয় আছে। এর কার্যকারিতার মূল চাবিটি হচ্ছে ধ্যানের মাধ্যমে অস্থির সেই তৃষ্ণার্ত মনকে নিয়ন্ত্রণ করা। স্থির হয়ে বসে, এবং কীভাবে তারা শ্বাস নিচ্ছেন সেটি লক্ষ করে, কোনো একটি শব্দ আর একটি ফল নিয়ে ধ্যান করার মাধ্যমে এর অনুশীলনকারীরা সচেতনতার বিভিন্ন স্তরে অতিক্রম করে শান্ত ও সুস্থির হবেন, যা তাদের তৃষ্ণাকে হাস করে। বুদ্ধ হয়তো একমত হতেন সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসি চিন্তাশীল দার্শনিক ব্লেইজ পাসকলের সেই অন্তদৃষ্টির সাথে : ‘একটি ঘরে সুস্থির বসে থাকতে পারার অক্ষমতাই সব মানবিক অশুভ কর্মকাণ্ডের কারণ।’

বুদ্ধের মধ্যম পন্থার ব্যাখ্যায় প্রণোদিত হয়ে সেই সন্ন্যাসীরা তার অনুসারীতে পরিণত হয়েছিলেন; এবং সংঘ, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী আর সন্ন্যাসিনীদের সংগঠনটির জন্ম হয়েছিল। যদিও বুদ্ধের শিক্ষা কোনো ধর্মীয় মতবিশ্বাস এর অনুসারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়নি, তবে এর ভিত্তিতে আছে ভারতীয় ধর্মের দুটি প্রধান ধারণা : কার্মা এবং সামসারা; কর্মের সেই আইন যা বহু লক্ষবার পুনর্জন্মের কারণ, তিনি শিখিয়েছিলেন যে, পুনর্জন্মের এই চক্রটি বন্ধ করার সবচেয়ে দ্রুততম উপায় হচ্ছে সন্ন্যাস নেওয়া এবং শৃঙ্খলার অনুশাসন মেনে চলা যা এর অনুশীলনকারীকে বোধিলাভ করার পথে নিয়ে যাবে। কিন্তু যদি পরিস্থিতি এমন কিছু করা আপনার জন্যে অসম্ভব করে তোলে, সেক্ষেত্রে সবচেয়ে সেরা উপায়টি হচ্ছে একটি নৈতিক জীবন কাটানো, এমন আশায় যে, পরের বার যেন আপনি সেই অবস্থা অর্জন করতে পারেন, যেখানে সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনীর কমলা আলখাল্লা পরা আপনার জন্যে সম্ভব হতে পারে।

বেনারসে প্রথম ধর্মপ্রচারের পর পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে বুদ্ধ ভ্রমণ করেছিলেন, এবং তার সন্ন্যাসী আর সন্ন্যাসিনীদের সংঘটিকে আরো মজবুত করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। যখন তিনি মৃত্যুর কাছাকাছি উপস্থিত হয়েছিলেন, তিনি তার অনুসারীদের বলেছিলেন, তার এই মহাপরিনির্বাণ গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ তার শিক্ষা। রয়ে যাবে। এবং এই শিক্ষাগুলোই গুরুত্বপূর্ণ। রাজকুমার, যিনি বুদ্ধ হয়েছিলেন বেনারসের উত্তর-পূর্বে একটি শহরে, তার শেষ যাত্রাটি করেছিলেন মহাপরিনির্বাণের আগে (কুশীনগর)। অসুস্থতা অনুভব করে সেখানে তিনি দুটি শালবৃক্ষের মাঝে একটুকরো কাপড় বিছিয়ে তার উপর শুয়ে পড়েছিলেন, এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়েছিল। তখন তার বয়স হয়েছিল আশি। যে ধর্মটি সিদ্ধার্থ গৌতম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটি সারা এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং সময়ের একটি পর্যায়ে এটি বিশ্বধর্মে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু তার জন্মদেশে আজ এর অনুসারীর সংখ্যা বেশ কম, জৈনধর্মের ব্যতিক্রম, যাকে আর কোথাও পাওয়াই যায় না বললেই চলে। পরের অধ্যায়ে আমরা সেটি নিয়ে আলোচনা করব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *