অধ্যায় ২৫. নরক
নরক কী? নরক হচ্ছে নিরন্তর যন্ত্রণা ভোগ করা একটি জায়গা, যেখানে যারা তাদের কৃতকর্মের জন্যে কোনো অনুশোচনা করেননি, মৃত্যুর পর তাদেরকে সেখানে প্রেরণ করা হয়। খ্রিস্টধর্ম আর ইসলামে যেভাবে নরকের ধারণাটি আবির্ভূত হয়েছে সেটি সম্বন্ধে যে পূর্ণ ধারণাটি পাওয়া যায় তা হলো, এটি এমন একটি জায়গা যেখান থেকে মুক্তি পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। যদি একবার সেখানে আপনি নিজেকে আবিষ্কার করেন, সেখানে অনন্তকাল আপনাকে থাকতে হবে। সেটাই হচ্ছে নরকের সবচেয়ে ভয়ংকরতম বৈশিষ্ট্য।
বেশ, তাহলে এটি কোথায়? এটি মানুষের মনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। অথবা, এটি মনের সেই অংশে যা ধর্মের বিভিন্ন জগৎগুলো সৃষ্টি করে। আর এটি বুঝতে হলে আমাদের অবশ্যই স্মরণ করতে হবে ধর্মীয় কল্পনা আসলে কীভাবে কাজ করে। এটি দুটি স্তরে কাজ করে। একটি হচ্ছে চিন্তা বা ভাবনার স্তর। জীবন নিয়ে না-ভেবে মানুষ থাকতে পারে না, তারা ভাবেন এর অর্থ কী। মানব ইতিহাসের শুরুতেই মৃতদের সাথে কী ঘটে সেটি নিয়ে তারা ভেবেছিলেন। এবং এই জীবনের পরে আরেকটি জীবন বা পরকালের অস্তিত্ব আছে এমন অনুমানও তারা করছিলেন। মানুষদের মধ্যে ভয়ানক অসাম্যতা নিয়েও তারা ভেবেছিলেন এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, যেহেতু কদাচিৎ এই জীবনে এর মীমাংসা হয়, যদি এই মহাবিশ্বে ন্যায়বিচার বলে কিছু থাকে, তাহলে পরকালে এই অবিচারগুলোর অবশ্যই মীমাংসা হবে। যখন তারা এইসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, অবশ্যই তখন তাদের কাছে পরকাল সম্বন্ধে কোনো বাস্তব তথ্য ছিল না। এটি শুধু অনুমান ছিল, অথবা শুধুমাত্র স্বচারিতা। কিন্তু খুব প্রাকৃতিকভাবেই এটি মানুষের মনের ভাবনা থেকে এসেছিল। আর সে-কারণেই ধর্মতাত্ত্বিকরা এটিকে বলেন ‘প্রাকৃতিক ধর্ম’।
এরপর মনে রিসিভিং বা গ্রাহক বিভাগ বিষয়টিকে তাদের আয়ত্তে নিয়েছিল। এটি মানবমনের সেই অংশটি, যা নানা দৈবদৃশ্য দেখে অথবা কণ্ঠ শোনে। এবং এটি দাবি করেছিল যে, পরকাল সম্বন্ধে এটি সরাসরি তথ্য পেয়েছে। আর সেকারণে এই ধর্মতত্ত্বের বিভাগটিকে বর্ণনা করা হয় রিভিলড রেলিজিয়ান বা স্রষ্টা-কতৃক সরাসরি ‘প্রেরিত’ ধর্ম হিসাবে। প্রাকৃতিক ধর্ম মৃত্যুর সেই পর্দার ওপারে কী আছে সেটা নিয়ে ভেবেছিল, কিন্তু প্রেরিত ধর্মগুলো দাবি করেছে। তারা সেটি দেখেছে। কিন্তু একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যদিও সব জায়গায় প্রশ্নগুলো একই রকম, এর উত্তর এলাকাভেদে ভিন্ন। সবচেয়ে বড় পার্থক্যটি হচ্ছে ভারতীয় ধর্ম আর খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে।
ভারতের ঋষিদের মতে আত্মা মৃত্যুর পর স্থায়ী কোনো অবস্থায় প্রবেশ করে। অন্য একটি জীবনে এর পুনর্জন্ম হয়, যার সামাজিক অবস্থান নির্ভর করবে ঠিক এর আগেই কাটানো জীবনে এর সঞ্চয় করা পুণ্যের পরিমাণ কী এটি বৃদ্ধি, নাকি হ্রাস করেছিল। হিন্দুধর্মে নরক আর স্বর্গের ধারণা আছে, কিন্তু সেগুলো চূড়ান্ত কোনো গন্তব্য নয়, বরং সেগুলো হচ্ছে যাত্রাবিরতির শিবিরের মতো। এই প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি পেতে হলে বহু মিলিয়ন জীবন হয়তো এভাবে একের-পর এক কাউকে কাটাতে হবে। কিন্তু সবসময়ই সেই আশাটি আছে, সবাই কোনো না-কোনো একসময় এই জন্ম-জন্মান্তরের চক্র থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন, অর্থাৎ মুক্তি পাবেন। এখানে চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাণে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।
আর যারা দূরে পশ্চিমে বাস করতেন তাদের প্রত্যাশা অস্তিত্বের বিশাল চক্র থেকে চূড়ান্তভাবে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আশার ওপর নির্ভরশীল কোনো ধারণা ছিল না, বরং মৃত্যুর পরে অব্যাহত জীবনের ভিন্ন একটি সংস্করণের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ‘হেল’ বা নরক শব্দটির একটি আদি আবির্ভাব, শব্দটির অর্থ কী হতে পারে সেই বিষয়ে একটি আভাস দেয়। ইংল্যান্ডের প্রাচীন অ্যাঙলো-স্যাক্সোন ভাষায় ‘হেল’ শব্দটির অর্থ ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ বা পাতালপুরী, যেখানে পরলোকগত আত্মাদের বসবাস। ওল্ড টেস্টামেন্টে এটিকে ‘শিওল’ নাম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এটি ভীতিকর কোনো জায়গা নয়। এটি শুধু বিষণ্ণ একটি এলাকা। যেমন করে হয়তো আমরা এখন বলতে পারি, এটা নরকের মতোই বিষণ্ণ। সেই মানুষগুলোর মতো, যারা খুব ভয়ানক কোনো রোগ থেকে কখনোই আরোগ্য লাভ করেন না, পাতালপুরীতে আত্মারা ছায়ামূর্তির মতো একসাথে অবস্থান করেন এমন কোনোকিছুর অপেক্ষায়, যা কখনোই আসে না।
কিন্তু ধর্মের ইতিহাসে কিছু কখনোই অপরিবর্তিত থাকে না, এবং এমনকি মৃত্যুপরবর্তী পরকালের ধারণাটিতেও পরিবর্তন এসেছিল। ব্যাবিলনে ইসরায়েলবাসীদের নির্বাসনের সময় পারস্যের কিছু ধারণা ইহুদি ধর্মের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। তাদের একটি ছিল, মৃত্যুর পর আত্মারা সেই নিরানন্দ রোগমুক্তির পর ধীরে আরোগ্যলাভ করার পাতালপুরীর হাসাপাতালের স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণত হন না। হয় তারা স্বর্গের পরমসুখে প্রবেশাধিকার জয় করেন, নয়তো নরকে অনন্ত যন্ত্রণাভোগ করার শাস্তি হয় তাদের। পরকালের এই সংস্করণটি ইহুদি ধর্মে কখনোই সম্পূর্ণরূপে সম্মতি আদায় করে নিতে পারেনি। কিন্তু প্রথম শতাব্দীতে এর কিছু সমর্থক ছিলেন, তাদের একজন ছিলেন যিশু। যদিও তিনি এটি নিয়ে বেশি কথা বলেননি, তবে তিনি নরকের অস্তিত্ব আছে এই ব্যাপারটিকে খুব স্বাভাবিক হিসাবেই মেনে নিয়েছিলেন। এবং যে-শব্দটি তিনি এর জন্যে ব্যবহার করেছিলেন, সেটি এটিকে নতুন আর ভীতিকর একটি অর্থ প্রদান করেছিল।
যিশু বলেছিলেন, যারা শিশুদের ঘৃণা ও কোনো ক্ষতি করেন, তাদেরকে ‘গেহেনায়’ নিক্ষেপ করা হবে, সেই ‘আগুনে, যার তৃষ্ণা অনিবারণযোগ্য’। কিছু পুরনো হিব্রু লেখায় ‘গেহেনা’ হচ্ছে এমন একটি জায়গা যেখানে শেষ-বিচারের (জাজমেন্ট ডে) পরে পাপীদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে। পরের কিছু বর্ণনা দাবি করেছিল, জেরুজালেমের ময়লা যেখানে ফেলা হতো, সেই জায়গাটির নাম ছিল এটি, যেখানে ময়লা পোড়ানো হতো, আর এটি সারাক্ষণই জ্বলত কারণ সেখানে নিরন্তর ময়লা ফেলা অব্যাহত থাকত। এখন বলা অসম্ভব, যিশুর আসলে মূল উদ্দেশ্যটি কী ছিল যখন তিনি নিরন্তর শাস্তির একটি রূপক হিসাবে এটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এমন একটি চুল্লি যা নিরন্তর জ্বলতে থাকে।
কিন্তু এমন একটি চুল্লি যা নিরন্তর জ্বলতে থাকে সেটি নরক-সংক্রান্ত বর্ণনায় অপরিহার্য যন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছিল। আরো ছয় শতাব্দী পর যখন কুর’আন লেখা হয়েছিল, যাদের অনন্তকালের শাস্তির জন্য দণ্ডিত করা হবে, তারা একটি চুল্লির নিশ্বাস শুনতে পাবেন, যখন এর দিকে তারা এগিয়ে যাবেন। এবং যখন তাদের আগুনের শিখায় নিক্ষেপ করা হবে, সেখানকার পাহারাদার তাদের জিজ্ঞাসা করবে : ‘সতর্ক করে দেবার মতো কেউ কি তোমাদের কাছে আসেনি?”
খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ থেকে নরকের বর্ণনায় কুরআন আরো বেশি বিস্তারিত। এবং এটি খুব ভালোভাবেই জানত এটি কী করছে যখন এটি খুঁটিনাটিসহ নরকের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিল। বার্তাটি ছিল, যদি মানুষ নবীর সতর্কবাণী উপেক্ষা করে তাহলে নরকের আগুনের শিখা শুধু তাদের টেনেই নেবে না, বাড়তি যন্ত্রণা হিসাবে তাদের মাথার উপর ফুটন্ত পানিও ঢালা হবে। নবীর সময়ে নরকের ব্যবস্থাপকরা মোটামুটি সব গুছিয়ে ফেলেছিলেন এবং তারা জানতেন কীভাবে কার্যকরী আর ভীতিকর একটি পদ্ধতি পরিচালনা করতে হয়। ভয় দেখিয়ে ধর্ম পালন করানো সবসময়ই একটি কার্যকরী কৌশল ছিল। খ্রিস্টধর্ম ইসলামের সাথে এর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যে অসুবিধার মুখোমুখি হয়েছিল, সেটি হচ্ছে কুরআন নিউ টেস্টামেন্টের চেয়ে অনেক বেশি ভীতিকর। সুতরাং এই প্রতিযোগিতায় আরো খানিকটা বেশি কৌশলী হতে খ্রিস্টধর্মও বাধ্য হয়েছিল। হয়তো চার্চের পবিত্র বইটি ভীতিপ্রদর্শনের ক্ষেত্রে কুর’আনকে হারাতে পারবে না ঠিকই, কিন্তু এর অস্ত্রভাণ্ডারে একটি অস্ত্র ছিল, যা মুসলমানদের কাছে ছিল না।
ইসলামের ব্যতিক্রম, ক্যাথলিক চার্চ ছবি বা কোনো চিত্র সৃষ্টি ও ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বাইবেলের দ্বিতীয় নির্দেশনাটির নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কখনোই খুব বেশি বিচলিত হয়নি। এটি বিশ্বাস করত ঈশ্বরের গুণকীর্তনে এবং খ্রিস্টীয় বার্তাটিকে সাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে শিল্পকলাকে এর সব রূপে ব্যবহার করা যেতে পারে। সুতরাং ক্যাথলিক চার্চ শিল্পীদের অন্যতম সেরা পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তাদের ধর্মবিশ্বাস প্রচার এবং উদযাপন করতে এটি সংগীত আর স্থাপত্য ব্যবহার করেছিল। কিন্তু সবধরনের শিল্পকলার মধ্যে, চিত্রকর্ম সৃষ্টি করতে এটি দারুণভাবে ভালোবাসত। এর মানে যখন মুসলমানরা শুধুমাত্র নরকের বর্ণনা দিতে শব্দের ব্যবহার করেছে, খ্রিস্টানরা সেটি চিত্রকর্মে জীবন্ত করে আঁকতে পারতেন। আর সবাই জানেন যে, একটি ছবি হাজার শব্দের সমান হতে পারে। সুতরাং নরক-সংক্রান্ত বার্তাটি দিয়ে যেন খুব স্পষ্টভাবে এর অনুসারীদের সাথে সংযোগ করা যায়, তারা চার্চের দেয়ালে নরকের বীভৎস যন্ত্রণার ভীতিকর সব চিত্র এঁকেছিলেন। এখানে যেমন একটি উদাহরণ।
থমাস বেকেটের নামে ইংলিশ শহর সালিসবুরিতে পঞ্চদশ শতাব্দীর একটি চার্চ আছে। বেকেট ছিলেন ক্যান্টারবুরির আর্চবিশপ, রাজা দ্বিতীয় হেনরীর নির্দেশে যাকে তার নিজের ক্যাথিড্রালেই ১১৭০ সালে ২৯ ডিসেম্বর নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তার নামের সম্মানে নির্মিত এই চার্চটি চমৎকার একটি পুরনো ভবনে অবস্থিত, যেখানে আলো খুব অনায়াসে ভিতরে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু যখন আপনি মাঝখানে সংকীর্ণ পথ বা আইল দিয়ে ভিতরে হেঁটে যাবেন এর চ্যান্সেল আর্চ যে আর্চ বা খিলানটি চার্চের বেদির আশেপাশের অংশ থেকে চার্চের মূল অংশ বা নেভ থেকে পৃথক করে রাখে) থেকে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে মধ্যযুগীয় একটি ‘ডুম’ চিত্রকর্ম। অ্যাঙলো-স্যাক্সোন ভাষায় এই ‘ডুম’ শব্দটির মানে ‘শেষ-বিচারের দিন’, কিয়ামত বা ডুমস ডে, যখন মৃতদের তাদের কবর থেকে জাগিয়ে তোলা হবে তাদের জীবন সম্বন্ধে ঈশ্বরের চূড়ান্ত রায় শোনাতে। ‘ডুম’ চিত্রকর্মগুলো সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র পরিকল্পিত হতো। কোনো সন্দেহ নেই এই চিত্রটি নিশ্চয়ই খুবই কার্যকরী ছিল।
১৪৭৫ সালে আঁকা চিত্রকর্মটি প্রদর্শন করছে, বিচারকের আসনে আসীন যিশু। তার ডানদিকে পুণ্যবান ব্যক্তিরা, যাদের স্বর্গে প্রেরণ করা হচ্ছে, যেখানে তাদের স্বাগত জানাচ্ছেন ফেরেশতারা। কিন্তু তার বামদিকে পাপীদের নরকে নিচে প্রেরণ করা হচ্ছে, যেখানে দানবরা তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে জাগনের জ্বলন্ত মুখের মতো প্রজ্বলিত নরককুণ্ডে। যে মানুষগুলো এই চিত্রকর্মের দিকে প্রথম তাকিয়েছিলেন, তারা হয়তো এটিকে আক্ষরিকভাবেই গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। তাদের মহাবিশ্ব ছিল তিনতলা একটি কেকের মতে, সবার উপর স্বর্গ, মাঝখানে পৃথিবী আর নিচে ছিল নরক। যখন আপনি মারা যাবেন, আপনি উপরে স্বর্গে যাবেন, নয়তো ‘নিচে’ নরকে প্রবেশ করবেন, পৃথিবীর একেবারে কেন্দ্রে যার অবস্থান বলে মনে করা হয়। যখন আগ্নেয়গিরিরা গলিত লাভা উগরে দিত, বিশ্বাসীরা ভাবতেন, ‘নরক তার মুখ হাঁ করেছে’, মৃত্যুর পর তাদের জন্য নিচে কী অপেক্ষা করছে পাপীদেরকে তাদের এর খানিকটা স্বাদ দিতে।
খ্রিস্টধর্ম এর চার্চের দেয়ালে শুধুমাত্র নরকের চিত্রই আঁকেনি, তাদের ধর্মীয় বক্তৃতায় এর ভয়াবহতার বিবরণ দেবার জন্যে যাজকরাও তাদের উর্বর কল্পনাশক্তি ব্যবহার করেছিলেন। তার আত্মজীবনীমূলক এ পোট্রেইট অব দ্য আর্টিস্ট অ্যাস এ ইয়ং ম্যান’ উপন্যাসটিতে আইরিশ লেখক জেমস জয়েস একই সামন বা ধর্মবক্তৃতা লিপিবদ্ধ করেছিলেন, যা তিনি তার শৈশবে শুনেছিলেন, যখন যাজক তার কিশোর শ্রোতাদের বলেছিলেন, নরকে জ্বলন্ত সালফিউরাস ব্রিমস্টোন এমনভাবে তৈরি, ‘গেহেনা’র শিখার মতোই, যেন এটি চিরন্তনভাবে জ্বলতে পারে। পার্থিব আগুন, যাজক গর্জন করে বলেছিলেন, ধ্বংস হয়ে যায় পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে। যতবেশি তীব্র হবে, তাপের স্থায়িত্ব হবে তত কম। কিন্তু নরকের আগুন যাদের পোড়ায় তাদের মেরে ফেলে না, আর সে-কারণে দহনের যন্ত্রণা কখনোই থেমে যায় না।
ভাবা হয়ে থাকে যে, নরকের অসীম যন্ত্রণার বিবরণ আপনাকে প্রভাবিত করবেই, এমনকি যদি আপনি সেটি বিশ্বাস নাও করেন। কল্পনার মাধ্যমে এমন কোনো ধারণা সৃষ্টি করার ক্ষমতা বিস্ময়করআর বহু শতাব্দী ধরেই মানুষ পরস্পরের সাথে অসহনীয় অশুভ আচরণ করেছে। এমনকি সবচেয়ে ভয়াবহ নিষ্ঠুরতম শাস্তিও একটি পর্যায় অবধি স্থায়ী হয়, এমনকি সেটি এর শিকারের মৃত্যুর কারণও যদি হয়ে থাকে। কিন্তু নরক ধারণাটির অশুভ প্রতিভা হচ্ছে, এই যন্ত্রণা কখনোই শেষ হয় না। এর বন্দিরা অনন্তকাল কাটায় একটি বর্তমানে যেখানে কোনো তারপর’ নেই, যার দিকে তাকিয়ে কোনো আশা করা যেতে পারে। সালিসবুরি ‘ডুম’ চিত্রকর্মে শিল্পী একটি স্ক্রল যুক্ত করেছিলেন ল্যাটিন মন্ত্রবাক্য দিয়ে, নুলা ইন রেডেম্পশিও’ অর্থাৎ কোনো পরিত্রাণ নেই। স্যালিসবুরির সেইন্ট থমাসের দেয়ালে অজ্ঞাত এক শিল্পীর ঐ শব্দগুলো আঁকার এক শতাব্দী আগে, দান্তে নামের একজন ইতালীয় কবি একটি বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন একটি বিষয়ে, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন, ইনফার্নো’। আর সেখানে তার নরকের দরজায় তিনি একটি সতর্কবাণী লিখে রেখেছিলেন, সবাই, যারা এখানে প্রবেশ করছেন, সব আশা পরিত্যাগ করুন।
এটি সেই একই বার্তা। নরক অশেষ এবং আশাহীন একটি জায়গা, সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম একটি নিয়তি যা-কিনা কোনো মানুষের ভাগ্যে ঘটতে পারে। একটি বিষয় স্মরণ করা লক্ষণীয় যে, সেইন্ট থমাস অ্যাকোয়াইনাস, ক্যাথলিক চার্চের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মতাত্ত্বিক–এবং একই সাথে যিনি দয়াল একজন মানুষ বলেছিলেন, স্বর্গের একটি বাড়তি আকর্ষণ হচ্ছে, এখানে সুবিধাজনক একটি বারান্দা থাকে, যেখান থেকে স্বর্গের বাসিন্দারা নিচে নরকে অভিশপ্তদের যন্ত্রণাভোগ দেখতে পারেন : যেন সাধুদের পরমানন্দ আরো বেশি সুখকর অনুভূত হয়, সে-কারণে অভিশপ্ত পাপীদের শাস্তি ভালোভাবে লক্ষ করার সুযোগ দেওয়া হয় তাদের। সুতরাং নরক হচ্ছে পাপীদের জন্য দুঃখ আর পরিত্রাণপ্রাপ্ত পুণ্যবানদের জন্যে পরমানন্দ।
যতটুকু আমরা দেখলাম, পুরোটাই ভয়াবহ একটি চিত্র। কিন্তু এর চরম শিক্ষাগুলো শনাক্ত এবং প্রয়োজনীয় মাত্রায় পরিবর্তন করার ধর্ম বেশ দক্ষতাও প্রদর্শন করে। আমরা দেখেছি মুসলিম পণ্ডিতরা প্রস্তাব করেছেন, অদৃষ্টবাদের মতবাদ, কুর’আনে যার বিবরণ আছে সেটি একজন পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহর সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। এমন কিছুই ঘটেছিল ক্যাথলিক চার্চের নরকের ধারণার সাথেও। সেখানে কি কোনো মধ্যম পথ থাকতে পারে না সেই মানুষগুলোর জন্যে, যারা মৃত্যুর পর স্বর্গে প্রবেশের জন্যে যেমন যথেষ্ট ভালো নয় আবার নরকে নিক্ষিপ্ত হবার জন্য যথেষ্ট খারাপও নয়? ব্যাপারটি কি চমৎকার হবে না, যদি আমরা একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করি, যেখানে পাপীদের নিবিড়ভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে, স্বর্গে প্রবেশের ভর্তি-পরীক্ষায় আবার বসার জন্যে প্রস্তুত করা যাবে?
এই প্রয়োজনীয়তাটি স্বীকৃতি পেয়েছিল এবং দ্বাদশ শতাব্দীতে একটি ‘জায়গা’ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল– ‘পারগেটরি’ নাম দেওয়া হয়েছিল সেটির। নরক আর পারগেটরির মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে পারগেটরির একটি বহির্গমন পথ আছে। সেইন্ট থমাস অ্যাকোয়াইনাস এটি কীভাবে কাজ করে সে-বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যদি কোনো ব্যক্তি মারা যায় তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত না করে, তারা পারগেটরিতে একটি দ্বিতীয় সুযোগ পাবে। সেই কাজটি সম্পন্ন করতে পারগেটরির সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হচ্ছে, এটি এমন একটি জায়গা, যেখানে আশা বেঁচে থাকে। এছাড়া নিশ্চয়ই, এটি যন্ত্রণারও একটি জায়গা, যারা এটি সহ্য করেছেন তারা জানেন এটি চিরস্থায়ী নয়, নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হলে, তাদের জন্যেও স্বর্গের দরজা খুলে যাবে।
পারগেটরি প্রতিষ্ঠা দয়াশীল একটি কাজ ছিল, যা মৃত্যু থেকে খানিকটা পরিমাণ ভয় অপসারণ করেছিল। কিন্তু চার্চ তার নিজের এই দয়াশীলতাকে কলুষিত করতে একটি উপায় খুঁজে বের করেছিল। আর এখানে সেটি ঘটেছিল। চার্চ পারগেটরিকে অর্থ উপার্জনের একটি কৌশলে পরিণত করেছিল, আর সেটি এতই ভয়ানকভাবে গর্হিত একটি কাজ ছিল যে, এটি ক্যাথলিক চার্চকে দ্বিখণ্ডিত করেছিল। কীভাবে এটি ঘটেছিল পরের অধ্যায়ে আমরা তার অনুসন্ধান শুরু করব।