২.৩ দিনগুলি গড়িয়ে চলে

দিনগুলি গড়িয়ে চলে সকাল থেকে সন্ধ্যা একই নিয়মে—এক এক দিন ভাবি হঠাৎ যেভাবে আমার বিয়ে হল এটা উভয়ের প্রতিই অন্যায় করা হয়েছে। এ কথা যখন আমার মনে হয়, তখন আমি লজ্জা পাই—প্রশ্ন করি এটা আমার স্বামীর সম্বন্ধে বিরুদ্ধভাব নয় তো? কিন্তু তা নয়, ওর মহত্ব সত্ত্বেও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আমরা সম্পূর্ণ দুই জাতের মানুষ। এই জাতিভেদটা আমার স্বামীকে কোনো পীড়া দেয় কিনা আমি জানি, কারণ ওর তো কোনো ভাবেরই অভিব্যক্তি নেই, তা যদি থাকত তবে জাতিভেদের প্রশ্নই উঠত না। উনি আমাকে যে কতটা ভালোবাসেন তার পরিচয় আমি পাই, শুধু আমি কেন যে যেখানে আছে সকলেই জানে—আমি যদি পনের দিন কলকাতায় থাকি ওর জ্বর হয়ে যায়। আমিও বেশিদিন থাকি না, আমার মন কেমন করে, ওর জন্য চিন্তা হয়। ‘তবু’—তবু ঐ পাহাড়ের দিনগুলোর শূন্যতা আমায় চেপে ধরে। আমি যে কথা বলতে পারি না। আমার কথা বলার বড় প্রয়োজন। আমি মাঝে মাঝে নিজেক প্রশ্ন করি আমি যে জাতিভেদের কথা ভাবছি এর কি অন্য রকম কোনো উপায় ছিল? আমার যদি ফট করে চারদিনের মধ্যে এর সঙ্গে বিয়ে না হয়ে ঐ বাঙালী জাতির উন্নতিপ্রয়াসী ডাক্তারটির সঙ্গে বিয়ে হত, তাহলে কি হত? তার সঙ্গে কি জাত মিলত? সে তো সাংঘাতিক—যে মানুষ চেনে না, মানুষের মুখ দেখে না, মন, দেখে না, খালি শরীরের উচ্চতা দেখে! কাজেই ঠিকমতো জোড় কখনই মেলে না। তা নিয়ে আক্ষেপ করে কোন লাভ নেই। ‘তবু। তবু আমাকে ছাড়তে চায় না। যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করে কি তুমি পাও নি, স্বামীর ভালোবাসা, শ্বশুরবাড়িতে সম্মান, স্বাধীনতা? কোনটা পাওনি? আমায় মানতে হবে যে অভিযোগ করবার মত কিছু নেই। যদি আমি বলি, আর কিছুই নয়, গত মাসের প্রবাসীতে রবীন্দ্রনাথের যে কবিতাটা বের হয়েছে সেটা এক মাসের মধ্যে কারুর সঙ্গে পড়তে বা আলোচনা করতে পারলাম না, তাহলে কি কেউ আমার জন্য শোক করতে বসবে? তা কি হয়? হাসবে লোকে কিন্তু অনেক লোকেরই যা প্রয়োজন নেই আমার তা আছে। কোনো কোনো মানুষ আছে যাদের অঞ্জলি পূর্ণ হয় না কোনো পার্থিব বস্তুতে। যাদের আকাঙক্ষা ফুরাতে চায় না। যারা এই জগতে কোনো সূক্ষ্ম অনির্দিষ্ট জিনিস খুঁজে বেড়াচ্ছে যার কোনো বাস্তব মূল্য নেই।

আমাদের মনটাকে এমন করে তৈরী করল কে? কোনো কোনো লোকের যে অনেকের সঙ্গে জাতিভেদ হয়ে গেল এর জন্য দায়ী কে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আবার কে? আমরা যারা তার গানের ভিতর দিয়ে জগৎটাকে দেখছি আর যারা তা দেখে নি এদের জগৎ পৃথক হয়ে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই দুই জগতের চলার ছন্দ মেলে না।

আমি যদিও পাহাড়ে বাস করছি আমার জীবনের স্রোত পাহাড়ী নদীর মতোবেগবতী নয়—–উপলে লেগে তা উঞ্ছিত হচ্ছে না, তা একেবারে নিস্তরঙ্গ পুকুরের জল হয়ে যাচ্ছে। বহির্জগতের সঙ্গে যোগ নেই, সংসারের তরীটা ভাসিয়ে দিয়ে বসে আছি—এ, ঘোর এ। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তিনি যে কথা দিয়েছিলেন আসবেন—সে কথা রাখবেন তো?

 

সংসারটাকে আমি খুব ভালোবেসেছি। আমি ঘরবাড়ি সাজাতে ভালোবাসি—আমার মায়ের বাড়ির এলোমেলো কখনো ঠিক করে উঠতে পারতাম না—এই নিয়ে অষ্টপ্রহর খিটিমিটি লেগে থাকত—কেউ পর্দায় হাত মুছে ফেলল, দেওয়ালে আঁক কেটে বসল—কাগজ ছড়িয়ে ফেলল উপর থেকে উঠোনে। সোফার কাপড় পরিষ্কার করেছি, বাবার কোনো টুলো পণ্ডিত ভক্ত এসে তার উপর উবু হয়ে বসে পায়ের দাগ লাগিয়ে গেল, আবার কালই হয়ত ইয়োরোপের কোনো নামী ব্যক্তি আসবেন। এই নিয়ে আমি খেটে খেটে হয়রান হতাম। এখানে আমি অবাধ সুযোগ পাচ্ছি। আমার বাড়ি ঝকঝকে একটা গয়নার মতো। কাঠের মেঝে সপ্তাহে একদিন ঘষে ঘষে সুগন্ধি মোম দিয়ে পালিশ করা হয়। এত পালিশ হয় যে মেঝেতে মুখ দেখা যায়। কাচের জানালার কাচ মেথিলেটেড স্পিরিট দিয়ে চকচকে করে মোছা হয়। ফুলদানী ও কিউরিও তো বটেই, দরজার কজা ও হাতল ব্রাসো দিয়ে ঝকঝকে করা হয়। মাসে একবার বারান্দায় ফুলের টবগুলো রং করি। আমার রান্নাঘরে বাসনগুলো সোজা করে রাখা, কলঙ্কশূন্য। সবগুলি আলমারীর ভিতরে প্রত্যেকটি তাকে জিনিস স্বস্থানে থাকে। আমার কুড়ি বিঘা বাগানের গাছপালা ছিমছাম যত্নে ঘঁটা। খাবার টেবিলে কাটাচামচ ঝকঝক করে, ন্যাপকিন একেক দিন এক এক রকম করে ভাজ করা থাকে—মাখনদানিতে মাখনের ফুল কাটা। দুপুরে আমরা পাথরের থালায় খাই, রাত্রে ডিনারসেট ব্যবহার হয়।

ভোরবেলা বেয়ারা এসে দরজায় টোকা দেয়—তার মাথায় পাগড়ি বাধা, পরনে চাপকান সাদা ধপধপ করছে, ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে এসেছে—বেড়টি। কফি পারকুলেটারে সকাল বেলাতেই কফি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার সুগন্ধ সারা বাড়িতে ছড়িয়ে আছে—মালি ফুলের তূপ নিয়ে এসেছে, কোনোদিন বা আমিই মালির সঙ্গে কঁচি নিয়ে বেরিয়েছি, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি ও ফুল কাটছে। জাপানী ফুল সাজান আজকাল খুব দেখছি। আমার তত ভাল লাগে না, ওটা কৃত্রিম একটা খেলনার মতো। আর বাঙালীরা তো ফুল সাজাতে জানেই না। বৌবাজারে যে তোড়াগুলো বিক্রি হয় তা দেখেই বোঝা যায়। দেবদারুপাতা দিয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে চেপে ধরে তার দিয়ে বাধা। ফুলের প্রাণ কতক্ষণ এ অত্যাচারে বাঁচে? তা না হলে একটা টিকটিকে ফুলদানিতে দুটো চারটে করে খুঁজে দেওয়া। আমি এখানে ইংরেজ এক মহিলার ফুল সাজান দেখে চমৎকৃত। ঘরের কোণে একটা ফুলসুদ্ধ ডালই বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফুল রাখবার পাত্রগুলোও এমন হওয়া চাই যাতে ফুল পাতা ছড়িয়ে পড়ে। আমি দেখে দেখে শিখি, যা দেখেছি ঠাকুরবাড়িতে। ঠাকুরবাড়ির আসবাবেই দেখেছি স্বদেশী নকশা। এখানে নানারঙের কাঠ পাওয়া যায়, আমরা তাই দিয়ে নানা স্বদেশী নক্‌শার আসবাব বানাই, আমাদের পর্দা ও কুশন কিছুই বিলাতী ছিটের নয়—উড়িষ্যার গ্রাম থেকে উড়িয়া পুরোহিতেরা যে ধুতি পরে তার আঁচলটাই পুরো থান বুনিয়েছি। এ সময়ে দেশী নক্‌শার কোনো জিনিসই বাজারে সুলভ ছিল না। নানা প্রদেশের গ্রামের লোকদের কাছে লোকশিল্পের নমুনা পাওয়া যেত। তাতিকে যখন বললাম, এই আঁচলটাই দুটো থান বুনে দাও—তার চক্ষুস্থির। কিছুতে রাজি নয়। “তোমার ক্ষতি কি হবে? টাকা তো পাবে?” “এ রকম তো কখনো করি নি মা।” এ দেশের মানুষের বিপদ ঐ, যা কখনো করে নি তা করবে না—তা সে তাতিই হোক কি পণ্ডিতই হোক। ছোট ছোট অচলায়তন বসে আছে পদে পদে মন জুড়ে।

আমাদের বাড়িতে আমাদের ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে, লোকে বুঝতে পারে এটা তামাদেরই বাড়ি। কাজ শিখছি ইংরেজ মহিলাদের কাছেও—দের’ নয়, এখানে চার ঘর ইংরেজ আছেন তাদের মধ্যে একজন মহিলাই ঠিকমতো সংসার করেন। অন্যেরা? তাঁদের কথা আর বলে কাজ নেই। টেনিস খেলা, ব্রীজ, মদ্যপান ও বলনৃত্য, মাঝে মাঝে ফ্লার্টেশন—এছাড়া অন্য কিছু তারা জানে না। পুরুষগুলো মূখ এবং বেহেড মাতাল। ওদের ভিতরেও হয়ত লুকিয়ে কোথায় মনুষ্যত্ব থাকতে পারে কিন্তু সে দেখবার আমার চোখ নেই, মন নেই। মন বেশি সূক্ষ্ম হয়ে গেছে—এদের সংস্পর্শে সংকুচিত হয়ে যায়। আমি জানি এটা একটা ক্রটি।

এই ত্রুটিটি অবশ্য ওদের চোখে পড়ে অন্যভাবে—ওরা ইংরেজ, আমরা তুচ্ছ নেটিভ, ওরা যে দয়া করে আমাদের সঙ্গে মিশতে চায়, আমাদের বলড্যান্স করতে ডাকে, আমাদের বাড়িতে আসে তাতেই তো কৃতার্থ হওয়া উচিত—তা নয় সব কিছুতে আপত্তি! তাস খেললে কি চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে? তাস খেললে চরিত্র নষ্ট হয় না ঠিকই কিন্তু সময় নষ্ট হয়। একে তো মনের মত কাউকে পাই না, কারু সঙ্গে চিন্তার আদানপ্রদান হয় না। মনের যে-স্তরে আমার সঙ্গী দরকার সেখানটা দিগন্তহীন সাহারা হয়ে আছে, তার উপর যদি এদের সঙ্গে বেশি মিশি তাহলে আমার ব্যক্তিত্ব বদলে যাবে—সেই অল্পবয়সেই আমার একথা মনে হত। কারণ ওদের প্রাণােচ্ছ্বলতা দেখলে লোভ হয়, একেবারেই যে তা মনকে টানে না তা নয়। কিন্তু এ লোভ সংবরণ করতে হবে। আমি জানি সব দিক থেকে এক অসীম শূন্যতা আমায় ছেয়ে আছে, তাই আমি যদি খুব শক্ত হাতে নিজের হাল ধরে না থাকি আমিও বিভ্রান্ত হতে পারি। আমি জানি আমার স্বামী এমন মানুষ ওঁর কেউ ক্ষতি করতে পারবে না কিন্তু আমার হতে পারে, আমার মধ্যে নানারকম দুর্বলতা। আমি তাই নিজের মধ্যে পুলিশ বসিয়ে রেখেছি এতটুকু যেন নড়চড় না হয়, সেই রাধার গানটার মতো, ‘পাহারা রেখেছে, আমি পাছে পা হারাই বলে পাহারা রেখেছে!

মদ্যপান নিয়ে একটা বিরোধ ঘনিয়ে উঠেছে। কিন্তু এটাতে হার মানব না কারণ ঐ যা বললাম, ‘সংসর্গজা দোষগুণাঃ ভবন্তি’—এদের সঙ্গে থাকলে মনটাও শেষ পর্যন্ত ঐ পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। আমার জীবনের তার যে সুরে বেঁধেছি তা নেমে যাবে।

আজকাল হয়ত লোকে এটাকে গোড়ামী মনে করবে, তখনও করত কিন্তু সত্যি বলতে কি মদ্যপানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমাদের বেশ শক্তিক্ষয় হতে লাগল—আমি যদি এত জোর না করতাম তাহলে আমার স্বামী হয়ত নিজে না খেলেও ওদের জন্য ব্যবস্থা করতেনবস্তুত করেও ছিলেন অর্থাৎ দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, আমি তা হতে দিলাম না। একে আমরা বিলিতি জিনিস ছুঁই না। আমার বিয়েতে একটিও বিলিতি জিনিস কেনা হয় নি, কলম পর্যন্ত গুপ্তর ফাউনন্টেন পেন—“আর এদের বিলাতি মদ্য খাওয়াতে হবে?”

“ওরা তা না হলে আমাদের কৃপণ ভাববে।”

“কেন, সন্দেশ খাওয়াব?”

“সন্দেশ ওরা সন্ধ্যেবেলা খাবেই না” উনি হাসছেন, “তোমার যা ইচ্ছা কর, এটা তোমার সংসার তোমার দিতে ইচ্ছা দেবে না হয় দেবে না।”

আমার ইচ্ছা এবং মত দৃঢ় কিন্তু সেদিন আমি জানতাম না যে আমি ছোটখাট একটি যুদ্ধে নামলাম কারণ আমি ইংরেজদের বিরূপ করে দিলাম। আমি জানতাম না সময়মতো ওরা এর প্রতিশোধ নেবে। এ যুগে কি অবস্থা জানি না, তখন দেখতাম যারা মদ্যপান করে তারা যারা করে না তাদের উপর খুব রেগে যায়–কারণ তাদের মনে হয় এটা বুঝি তাদের চরিত্রের উপর কটাক্ষপাত করা! এ মনোভাব অবশ্য অস্বাভাবিক নয়। যে যাই, করুক অন্যের সমর্থনের লোভ ছাড়তে পারে না!

আমি বেয়ারাকে বললাম, “সবগুলো বোতল নিয়ে ঝরনার জলে ফেলে দাও–” সে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে—ঝরনার জলে উৎক্ষিপ্ত হবে এই ঝকঝকে বোতলের বিলাতি মদ্য! গুর্খাদের স্ত্রীপুরুষের এই বস্তুটির তৃষ্ণা তৃপ্ত করবার সাধ্য কারু নেই। পরের দিন সকালবেলা কুলীকামিনরা ঘাস কাটতে এসে বোতলগুলো পেল—সব ভাঙ্গে নি কিছু কিছু মাটিতে বসে গেছে—তখনকার দিনে গুর্খাদের সততা এতখানি ছিল যে ফেলে দেওয়া জিনিসও কেউ না বলে নেবে না। মাসের পর মাস ঘর খুলে রেখে যাও, ভেজান দরজা ঠেলে ঢুকে কেউ তোমার ঘড়িটা নিয়ে যাবে না। আমার দুঃখ এই যে এই মানুষদের দেখবার চোখ তৈরী হতে আমার দেরি হল। আমার চোখ অন্তর্মুখী ছিল। সেই গানের উল্টোটা ‘বাহির পানে চোখ মেলেছি আমার হৃদয় পানে চাই নি আমি চাই নি। এক্ষেত্রে বাইরেই দ্রষ্টব্য ছিল। বেয়ারা বলল, “ওগুলো তো আপনি ফেলেই দিয়েছেন, ওরা নেবে?” ওরা নিল। তারপর সেই বিশুদ্ধ স্কচ হুইস্কি উদকমিশ্রিত না হয়ে বোতলের পর বোতল উদরে পড়ার ফল যা হল তা বোঝা শক্ত নয়—স্ট্রেচারে করে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হল—এবং আমার কীর্তিও রটে গেল সাহেবকুলে। আজকের দিনে এই মনোভাব দুর্বোধ্য ঠেকবে যখন মদ্যের চেয়ে বহু বেশিগুণে প্রমত্তকারী বস্তুর আমদানী হয়েছে এবং গুণী সমাজে সমাদৃত হয়েছে।

এদের ডিনার পার্টিতে দূর দূর পাহাড় থেকে প্ল্যানটার সাহেবরা আসত-দেখতুম আস্তে আস্তে যত রাত গভীর হচ্ছে গেলাসের পর গেলাস মদ্যপান করে এরা তুরীয় হয়ে যাচ্ছে—যে গাইতে পারে না সে হঠাৎ হেঁড়ে গলায় গান জুড়ে দিল, কেউ বা ঢুলতে লাগল—কেউ যেখানে কোনো স্ত্রীলোক বসেছে তার ঘাড়ে গিয়ে পড়ল, কেউ বা ফট করে আমার পায়ের কাছে বসে কাঁদ কাঁদ গলায় বলল, “I shall be your dear”—deer শব্দটার উপর pun হচ্ছে কারণ আমি একটা হরিণ পুষেছিলাম। আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না মানুষ কি করে স্বেচ্ছায় বুদ্ধি হারায়। সুসজ্জিত ঘরে বসে চৰ্যচোষ্যলেহ্যপেয়ে আকণ্ঠ ভরে বয়স্ক লোকেরা ইচ্ছে করে পাগল হয়ে যাচ্ছে এই দেখে দেখে আমার মনের অবস্থা দুষ্মন্তের রাজপুরীতে সুখী লোকদের দেখে শারদ্বতের মতো হত, ‘স্নাত ব্যক্তির যেমন তৈলাক্তকে, শুচির যেমন অশুচিকে, জাগরিত ব্যক্তির যেমন প্রসুপ্তকে, মুক্ত ব্যক্তির যেমন বদ্ধকে দেখলে মনে হয়—তেমনি হয়েছিল শারদ্বতের অবস্থা।

 

গভীর রাত্রে আমরা স্বামী স্ত্রী নির্জন বনের ভিতর দিয়ে বাড়ি ফিরি। সামনে বেহারা লণ্ঠন ও লাঠি নিয়ে চলেছে। আমাদের পায়ের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই— নিঃশব্দ বনস্থলীতে দুধারে পাহাড়ে ধাক্কা লেগে সেই শব্দ মস্ মম্ করে নৈঃশব্দকেই প্রকাশ করছে—উপরে গাছের চন্দ্রাতপের ফাক দিয়ে জ্যোৎস্না গলে গলে পথের উপর আলোছায়ার চিত্রবিচিত্র করেছে। আমি জানি ঠিক কোন মোড়ে কি আছে—কোথায় জোনাকীদের রাজত্ব, কোথায় ফুলের গন্ধ পাব। একটা ফুল আছে ঠিক আতপ চালের গন্ধ। কেউ কেউ বলে কোনো সাপের গায়ে সুগন্ধি আতপের গন্ধ পাওয়া যায়। এখানে এত সাপ যে আমাদের আর সাপের ভয় নেই। ওরা মানুষ দেখলে বা শুনলে পালিয়ে যায়। কোবরাও পালিয়ে যায় কিন্তু অজগর পালায় না, পালাবে কি করে তার তো নড়তে চড়তে বছর কেটে যাবে। অবশ্য অজগরের ঘাড়ে না পড়লে কারু ভয় নেই—সে হাত বাড়িয়ে কাউকে ধরবে না। অথচ অজগর দেখেই সে লোকটা মরে গেল—গাছের তলায় কুণ্ডলীকৃত অজগরটা যেই মুখ তুলে চেয়েছে এই লোকটা তার চোখ দেখেই ছুটতে শুরু করেছে, অবশ্য বিপরীত দিকে, নৈলে সম্মোহিত হয়ে ওর আওতায় গিয়েই পড়বার কথা! অজগর হাত বাড়ায় না ঠিকই কিন্তু চোখ বাড়ায়, চোখ দিয়েই টেনে নেয়। লোকটা উপরের দিকে ছুটতে ছুটতে একেবারে দু মাইল দৌড়ে আমাদের বাড়ির কাছে এসে পড়ে গেল, পড়েই মরে গেল, শুধু ভয়েই মরে গেল। আমরা সচরাচর যে পথে চলাফেরা করি সেখানে ভাল্লুক বেরোয় না, ওদেরও তো প্রাণের ভয় আছে, কিন্তু বনের পথে পায়ে হেঁটে আঠার মাইল দূর থেকে যে লোকেরা শহর থেকে বাজার আনতে যায় তাদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। এক একদিন এক একটা কৌশল করে সবাই বাচে-একদিন তো খাবার ভর্তি পিঠের ঝুড়িটাকে ফেলে দিল, ঝুড়িটা ছিটকে পড়ে পাহাড় দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে, ভাল্লুক মানুষ ছেড়ে সেই চলমান বস্তুর পিছন পিছন দৌড়াল। রুটিওলা বেঁচে গেল। ওকে আমরা বলি রুটিওলা, কিন্তু শুধু রুটি নয়, যা কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস তা আঠার মাইল দূর থেকে আনে, মাছ, মাংস, ওষুধ, তরকারী কিছু এখানে পাওয়া যায় না। একটি জিনিস ভুলে গেলে তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে। চিতা, ভাল্লুক আর অজগরের কাণ্ড মিলে এখানকার ঘটনাগুলো ছোটদের গল্পের বইয়ের গল্পের মতো। আমি যে জীবন থেকে এসেছি তার চেয়ে কতই না অন্য রকম। তবু ধীরে ধীরে আমি এদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছি। আদিম প্রকৃতি, আদিম মানব আমার অন্তরে প্রবেশ করছে ধীরে, খুব ধীরে। কারণ সাহেবরা যে রকম করে আনন্দ করতে পারে আমরা তো তা জানিই না। ওরা ছুটির দিনে পিঠে বন্দুক ঝুলিয়ে হাতে ছিপ নিয়ে, ভারবাহী ভৃত্যকুলের কাঁধে খাদ্য ও মদের বোঝা চাপিয়ে শিকারে চলল—সেখানে মদ্যপান হবে, শিকার হবে এবং ইনি ওর স্ত্রীর সঙ্গে কিংবা কোনো অতিথি বালিকার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করবেন। ওদের কোনো অভাব বোধ নেই—জঙ্গলেও বেশ আছে। ওরা। আমরা পড়য়া মানুষ আমরা এ সব পারি? আমাদের নিরীহ হরিণ মারা ভালো লাগে না। আহত হরিণের চিৎকার বা করুণ দৃষ্টি আমাদের কাদিয়ে ছাড়ে। তবুও ক্রমে ক্রমে ওদের কাছ থেকে আমরা শিখতে লাগলাম। ওদের কাছেও শেখবার আছে। যে অবস্থাতেই পড়ক ওরা মানিয়ে নিতে পারে। অনেকটা মাড়োয়ারীদের মতো—তারাও বেশ পারে প্রতিকূল অবস্থায় মানিয়ে নিতে। হিমালয়ের গায়ে ছোট ছোট এমন গ্রাম আছে যেখানে পঁচিশ ত্রিশ মাইল হয় পায় হেঁটে নয় ঘোড়ায় ছাড়া পোঁছবার পথই নেই—সেখানেও মাড়োয়ারীরা দোকানপত্তর খুলে চাল, ডাল বিক্রী করে—ওদের জন্যই এখানে আমরা চাল, ডাল, তেল, মশলা পাই।

মদ্যপান ও হরিণ শিকার এই দুটি জিনিস বাদ দিয়ে আমিও চেষ্টা করলাম অরণ্যজীবনের আনন্দে প্রবেশ করতে। প্রত্যেক ছুটির দিনে আমি যাকে যাকে পারি যোগাড় করে সদলবলে বের হই বনভোজনে। বনের পথ দিয়ে চলে যাই অনেক দূরে, হয় কোনো নির্জনতর ঝরনার ধারে, নয়ত কোনো পার্বত্য নদীর তীরে—এ বনের গাছগুলো একেবারে সোজা সোজা, এরা আলোর প্রত্যাশী, তাই যেন দীর্ঘগ্রীবা উত্তোলন করে পাহাড় পার হয়ে আকাশে মুখ রাখতে চায়। ওই গাছের ছায়াচ্ছন্ন মৃত্তিকা শেওলার ভেজাগন্ধে চারিদিক ভরে রাখে—ঘোড়ার পায়ের নিচে ঘাসফুল আর বন্য ফার্ন দলিত হয়ে যায়, আমি অন্যমনস্ক হয়ে লাগাম ধরে থাকি, বনের মধ্যে চলতে চলতে মন হঠাৎ উদাস হয়ে যায়—সেই গৃহবিবাগী রাজার কথা মনে পড়ে—একাকী হয়মারুহ্য জগাম গহনং বনং’ কোথায় কাদের সঙ্গে চলেছি আমি। এরা সব ছায়ামূর্তি—এই জীবনটা কি চেয়েছিলাম? হা ঈশ্বর কীটপতঙ্গও সঙ্গী পায়, আমাকে একজন সঙ্গী দিলে না? অবসাদ কেটে যায় যখন বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে হঠাৎ পার্বত্যনদীকে দেখতে পাই উপলশয়না কলনিনাদিনী জলধারা-স্রোতের মাঝে মাঝে পাথরে আটকে হ্রদ হয়ে থাকে সেখানে ঝাপিয়ে পড়ে আমরা স্নান করি। “তিতাপতি’ বলে এক রকম সুগন্ধ পাতা আছে—পাথরে থেঁতলে জলে ফেলে দিলে সে জল পান করে মাছগুলো মত্ত হয়ে ওঠে—তখন সেই মাছ ধরা হয়। পাথরের চুলো তৈরী করে কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বেলে মাছ ভাজা হয়। বড় বড় পাথর নদীর মাঝে মাঝেই আছে তার পাশ দিয়ে জল ঘুরে ঘুরে ফেনা তুলে তুলে সাদা হয়ে যায় সেই পাথরের উপর বসে আমার ‘সাগরিকা’ কবিতাটি পড়তে ইচ্ছে করে—‘বসিয়াছিলে উপল উপকূলে–’

“ম্যাকডোনাল্ড, জাভা বলে একটা দ্বীপ আছে জানো?”

“জানি বৈকি, সেখানে চা-এর চাষ হয়–”

“ওঃ তাই জানো, সেখানে বহু আগে ভারতীয় সভ্যতা গিয়েছিল, গিয়েছিল শ্যামদেশেও তা জানো?”

“Never heard of such a thing”–ইংরেজ আসবার আগে ভারতীয় সভ্যতা বলতে কিছু ছিল কি?”

নাও ঠেলা! এদের সঙ্গে কি কথা বলবে? আমার স্বামী তো সহজে কোনো কথা বলতে চান না, বিতর্কে তো যাবেনই না তবু বাধ্য হয়ে তাকেও এক এক দিন দু একটা কথা বলতে হয়।

ম্যাকডোনাল্ড বলে, “তোমরা তো লেখাপড়া শিখেছ, তোমরা তো খুবই বুদ্ধিমান, তবে ক্রিশ্চান হচ্ছ না কেন? তোমরা saved হবে কি করে?”

উনি বললেন, “আমরা সংখ্যালঘু দলে যেতে চাই না”

“অর্থাৎ?” “পৃথিবীর জনসংখ্যা কত জানো?”

“না। কত?”

“দুই হাজার মিলিয়ন—এর মধ্যে ক্রিশ্চান কত বল তো?”

“জানি না। কত?”

“হয়ত ছয় শ মিলিয়ন হবে। তবেই বল মেজরিটির সঙ্গেই থাকা ভালো নয় কি?”

 

ক্রমে ক্রমে দু’চার জন করে তোক আসতে শুরু করেছে, আমি আত্মীয়স্বজনকে ক্রমাগত ডাকি—কেউ না কেউ ছুটি হলে আসেন। এ তল্লাটে কেউ এলে আমার অনুরোধে পড়ে আসতেই হয় আমাদের বাড়ি। কাজেও অনেকে আসেন। অতিথিরা আমার বাড়িতে এসে খুশী হয়। যদিও বাজার আসে আঠার মাইল দূর থেকে তবু খাদ্যবস্তুর অভাব রাখি না। সুসজ্জিত বাড়িতে অতিথিদের জন্য সুখাদ্য তৈরী করে আমি তৃপ্তি পাই। তাদের বিছানা চীনাংশুকে ঢাকা, বালিশে ল্যাভেণ্ডার দিই—চেষ্টা করি একবার যারা আমার বাড়িতে থেকে গেছে তারা যেন কখনো না ভোলে। তারা ঘুম ভেঙে বিছানার পাশে শৌখীন পাত্রে চা পায়—দরজার কাছে পালিশ করা জুতো, স্নানের ঘরে ইস্ত্রি করা কাপড় পায়। প্রথম দুতিন দিন সবাই খুব খুশি, “কি আনন্দেই আছ তোমরা!” একেবারে ফার্স্টক্লাস হোটেলে! তারপর এক সপ্তাহের মধ্যেই নির্জনতার অবসাদ বুঝতে পারে সবাই—তখনই পালাই পালাই।

একবার স্যার বি. এল. মিত্র এসেছেন কাজেই আমাকে দেখে প্রৌঢ় ভদ্রলোক একেবারেই অবাক হয়ে গেছেন—“তুমি এখানে থাকো! এ যে দেখি অশোকবনে সীতা!” কিন্তু উপমাটা ঠিক নয়—আমায় কেউ বন্দী করে নি। এখানে কোনো রাবণ নেই।

সংসারের কাজে আমার কর্মশক্তি ফুরাতে চায় না, সাহেবদের কাছে শিখেছি মুরগী পালন—সেই সময়ে বিলাতী মুরগী পালার বিশেষ পদ্ধতি শুরু হয়েছে। শিখেছি মৌমাছি পুষতে। মৌমাছিদের জীবনবৃত্তান্ত পড়ে পড়ে মুখস্থ হয়ে গেল। কত রকম বিচিত্র পতঙ্গ আছে তারা মানুষের কাজে লাগে না, তবে তাদেরও নিজের জীবন মূল্যবান—আশ্চর্য এক একটার রূপ, বিচিত্র তাদের ব্যবহার—পাহাড়ের যেখানটা গভীর জঙ্গল সেখানটা সর্বদা ভিজে সঁাতাতে কারণ সেখানে রোদ পড়ে না। সেখানে গাছের ডালে শ্যাওলা হয় যাকে বলে ‘মস’ (moss) লম্বা লম্বা মস ঝুলতে থাকে ঠিক যেন গাছের শাখা তার এলোচুল ঝুলিয়ে দিয়েছে। এখানে কোনো কোনো গাছ আছে যাতে আলো জ্বলে—‘ফসফরাসেন্ট’। আমার বাবা আমায় বলেছিলেন খুঁজে দেখতে পুরাণে যাকে দিব্যৌষধি বলা হয় তা আছে কিনা। দীপ্যমান এই দিব্যৌষধি দেখেছি। জোনাকির মতো কোনো কোনো পোকা আছে যার পিঠে ও দুপাশে মিলিয়ে তিরিশটা আলো—দশটা করে প্রত্যেক লাইনে এক অভাবনীয় জীব। আর প্রজাপতি? বড় ছোট বিচিত্র রঙে রঙীন—কোনটা বা মথরংশূন্য বড় বড় ভয়ঙ্কর চোখ, ধূসর দেহ।

ফুলের বাগানে প্রজাপতিরা ওড়ে, তাদের সঙ্গে ঠিক তাদের মত রঙীন আর একজন উড়ে উড়ে ছুটে চলে তাদের ধরবে বলে, ‘পজ্জাতি’ ‘পজ্জাতি’—সে আমার কন্যা—১৯৩৬ সালে সে আমাদের ঘরে এসেছে। সে যেন ঐ গানটাকে রূপ দিচ্ছে—“কি সুখে ঐ ডানা দুটি মেলেছ জোনাকি ও জোনাকি–”

 

এখানে আমার সবচেয়ে বড় কাজ ক্ষেতে নেমে সজীর চাষ। ছ’সাত বছর তো আলুর চাষই করেছি সমনোযোগে বীজের কুড়িগুণ ফসল হত আমার, কৃতিত্বের গৌরবে আমি আনন্দিত। আমার এই অধঃপতনে কেউ হয়ত হাসতে পারেন কিন্তু অবিশ্বাস্য ঠেকলেও বলি যে কোনো কবিও অবশ্যই আলুর চাষ থেকে আনন্দ পেতে পারেন। একটা ছোট বীজ পোতা হয়েছিল মাটির ভিতরে সে কি করে বর্ধিত হচ্ছে কে জানে? আমরা গোড়ায় মাটি তুলে দিচ্ছি, জল দিচ্ছি কিন্তু যখন ফসল তোলবার সময় মাটি সরিয়ে দেখা যায় সেই ক্ষুদ্রবীজটি শুষ্ক হয়ে রয়েছে আর তার থেকেই প্রাণ পেয়ে বড় রসাল ফল ফলে তাকে ঘিরে আছে তখন কম আশ্চর্য লাগে না—একটু একটু করে মাটি সরান হয়, একটা একটা করে আলু গড়িয়ে পড়ে। আমি সারা দুপুর ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলু সংগ্রহ করি মালীর সঙ্গে। ঝুড়িতে আলু তূপ হয়ে ওঠে, আমার মন এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে যায়‘বড় বিস্ময় মানি হেরি তোমারে— মনে হয় আমি যেন ভ্যানগগ-এর মতো ছবি আঁকলাম পোটেটো-ইটার্স। কোথায় বিস্ময় নেই, কোথায় আনন্দ নেই! ঐ যে পোকাটা একেবারে ডালিয়া পাতার মত দেখতে, পাতার সঙ্গে মিশে আছে, যতক্ষণ না নড়ছে বুঝতেই পারবে না যে ওটা প্রাণী, পাতা নয়। একটু নাড়া লাগাতেই ও পাতার মতই নিশ্চল হয়ে যাবে আত্মরক্ষার চেষ্টায়, ওই কি কম বিস্ময়কর। দেখলে বিশ্বাস হয় না যে একটা পোকার শরীর একটা পাতার এমন নিখুঁত অনুকরণে তৈরী হতে পারে। যখন পোকাটা মরে যায় পাতার মত শুকিয়ে দেটে হয়ে যায়—nature’s mimicry—একবার জ্যোতিপ্রকাশ সরকার ওমনি একটা পোকা কাগজের বাক্সে করে নিয়ে আসছিলেন বোস ইনস্টিটুটে দেখাবেন বলে, পোকাটা যখন মরে গেল তখনও একটা পাতাই শুধু, শুকনো পাতা, আর যখন তাতে পিপড়ে লাগল তখনই বোঝা গেল ওটা একটা প্রাণী।

এই রাজ্যে আমার দিন কাটছে, এখানে দেখবার অনেক কিছু আছে বর্ণ, গন্ধ, রূপের এক সমারোহ যা দেখবার চোখ আমার একটু একটু করে দিনে দিনে তৈরী হচ্ছে। তবু আমার সেই ‘তবু আমায় কোনোদিনও ছাড়ল না কখনো অধরাত্রে আমি উঠে আসি আমার স্বামীর শয্যা থেকে, বারান্দায় বসে থাকি, মনে মনে আমার পরিচিত লোকদের কথা ভাবি, ওরা নিশ্চয় ওদের অবস্থায় সন্তুষ্ট, আমি কেন নয়? আমি তো সবই পেয়েছি তবু আমার শূন্যতা কেন যায় না? আমি যা করতে এসেছি যেন তা করা হল না, আমি যা বলতে এসেছি তা যেন বলা হল না, আমি যা চেয়েছি তা যেন পাওয়া গেল না—এই অনির্দিষ্ট আকাঙক্ষায়, এই চির অতৃপ্তির কোনো নাম নেই, কারণ এটা বোধ হয় খুব স্বাভাবিক জিনিস নয়—এ যেন সুখে থাকতে অসুখ সৃষ্টি করা, তবু আমার ঐরকমই। মায়াকভস্কির একটা কবিতা পড়েছিলাম তাতে যেন আমার এই সময়কার মনের ভাবটা আছে—‘শোনো এখন! যদি আকাশে তারা জ্বলে তাহলে নিশ্চয় কেউ আছে যে সেগুলো দেখতে চায়, এমন কেউ আছে সে যেন বলে ওগুলো জ্বলুক, কেউ বলে ঐ ছোট বিন্দুটা কি, ওটা কি একটা রত্ন? মধ্যদিনের ধুলোর ঝড়ে আক্রান্ত হয়ে ঈশ্বরের প্রসারিত হস্ত চুম্বন করে সে বলে, তারাহীন হয়ে আমি বাঁচতে পারব না।

অন্ধকার একলা রাতের ঠাণ্ডা বাতাসে আমি এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি—একটি তারা দেখব বলে। আকাশভরা তারার মাঝে আমার তারা কই?

 

কেউ যদি মনে করেন যে কাহিনী দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম এ বেদনায় তারই স্মৃতি অনুসূত তাহলে ভুল হবে, একেবারে ভুল। আমার এই শূন্যতাবোধ কোনো একজন ব্যক্তির জন্য নয়, একেবারে নয়। এ শূন্যতার অর্থ আমি জানি আমি অন্য কাউকে নয় আমাকেই খুঁজছিলাম। আমার সত্তার যে অংশ নিজেকে অভিব্যক্ত করতে পারে নি তারই বেদনা। আমার বুকের মধ্যে মোচড় দিত। আমার অন্য অংশ হৃষ্টচিত্তে সংসারে লিপ্ত ছিল। যখন সন্ধ্যা নামতেই বেয়ারা জানালা বন্ধ করে ফায়ারপ্লেসে মোটা মোটা কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে যেত—আমি আগুন পোয়াতে পোয়াতে বসে উল বুনতাম আমার স্বামী একটা বইয়ের পাতা ওল্টাতেন, দুজনেই নীরব। তখন আমি কোনো সূক্ষ্ম জিনিস ভাবতাম না। কারুর জন্য আমার মন কেমনও করত না। স্বামীর চাকরীর উন্নতি, উপরওয়ালার অবিচার, কন্যার খাদ্যে অনীহা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তিত হতাম—কিংবা নূতন কোনো ফার্নিচারের নকশা ভাবতাম।

জীবনের কথা লিখতে গিয়ে ভাবছি এ জীবনটায় কোনো বৃত্তান্তই নেই–থাকবে কি করে? বৃত্তান্ত ঘটে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শে সংঘর্ষে বা কর্মবহুল জীবনের নানা ঘটনায় প্রকৃতি আর কি বৃত্তান্ত ঘটাবে? এখানে যা সব ঘটনা ঘটে তা মারাত্মক হলেও তা নিয়ে জীবনের গল্প হয় না। যেমন দাবানল জ্বলে প্রতি বছর। দাবানল’ কথাটা কাব্যে অনেকেই পড়েছে, দেখেছে ক’জন? গ্রীষ্মকালে গহন বনে পাতা শুকিয়ে শুকিয়ে ইন্ধন হয়ে থাকে তারপর হঠাৎ কোনো শুকনো ডালের ঘর্ষণে স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে কিংবা কোনো বনচারী অসাবধানে অগ্নিকণা ফেলে গেলে শুকনো পাতায় আগুন লাগে, ধীরে ধীরে ধুইয়ে ধুইয়ে সেই আগুন বাড়তে থাকে, তারপর যখন সমস্ত পাহাড়টা জ্বলে ওঠে বহুদূর থেকে দেখা যায়। গাছ থেকে গাছে, পাহাড় থেকে পাহাড়ে বুভুক্ষু অগ্নিদেব লাফিয়ে লাফিয়ে চলেন—পশুদের পালাবার পথ থাকে না, তাদের আর্তনাদ শোনা যায়। একবার দাবানল জ্বললে তা নেবান যায় না। একমাত্র উপায় একটি বৃত্ত করে গাছ কেটে দেওয়া যাতে আগুন ছড়িয়ে না যায়। এই বিপজ্জনক কাজে আমার স্বামীকেও এগিয়ে যেতে হয়, কারণ বুদ্ধিমান লোকের পরামর্শ প্রয়োজন। মানুষের বোকামী কতদূর পৌঁছতে পারে তা প্রায়ই এখানে দেখি। মাটি কাটা হচ্ছে রাস্তা চওড়া হবে, দুটো লোক কেটে যাচ্ছে কেটেই যাচ্ছে—উপরে বড় পাথর আছে নিচে মাটি কেটে কেটে পাথরটাকে আলগা করে ফেলেছে তারপর সেই বিরাট প্রস্তরখণ্ড তাদের উপর গড়িয়ে পড়ল, দুটো মানুষের জ্যান্ত কবর হয়ে গেল। আমার স্বামী ছুটলেন। শুনলাম তোক দুটো সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেছে, শুধু একজনের একখানা হাত বেরিয়ে আছে। ইনি তে চোখে দেখে এসেছেন আমি শুনে। শুনেও ঐ একখানা মৃত হাতের কথা ভুলতে পারলাম না অনেক দিন।।

আদিম অরণ্যের কথা বলছি—আদিম অর্থাৎ এখানে প্রথম যে গাছ জন্মেছিল সেই আছে—এখনও এখানে সেই সব গাছ আছে যা যে যুগে কয়লা হয়েছিল সেই যুগের গাছ-ট্রী-ফার্ন—ফার্ন গাছই কিন্তু বড় বড় খেজুর গাছের মতো। কোনো মানুষ কখনো। ঢোকে নি এরকম বন আছে, সেখানে এখন নূতন আবাদ হবে। হাতির পিঠে সেই খাড়াই পাহাড়ে উঠে আবাদের জন্য উপযুক্ত জমি বেছে নিলে সেইখানে গাছকাটা শুরু হবে, যন্ত্রপাতি কিছু নেই, বিরাট বিরাট বনস্পতি কুড়ল দিয়ে কাটা হচ্ছে। প্রায়ই দুর্ঘটনা। ঘটে—গুর্খাদের সহ্যশক্তি তুলনাহীন—বিনা এ্যানেসথেশিয়ায় ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে যদি হাড় কাটে হাতুড়ে ডাক্তার—এরা চুপ করে থাকতে পারে। কলকাতার শৌখীন পরিবেশ থেকে আমি এইখানে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা কাটাতে এসেছি।

 

এই গণ্ডগ্রামে টেলিফোন তো নেই, টেলিগ্রাফ অফিসও নেই—একটা খোড়ো ঘরের হাসপাতালে একটি হাতুড়ে ডাক্তার আছে—টেলিগ্রাফ অফিস পাহাড়তলিতে সাত আট মাইল দূরে। এই পাণ্ডববর্জিত দেশে আসতে হলে ছয় মাইল খাড়া পাহাড় খুব সরু পথ দিয়ে উঠতে হয়। গাড়িটা প্রায় সোজা হয়ে থাকে এবং খাদের দিকে দু’তিন ইঞ্চি জমি বাকি থাকে কোনো কোনো সরু বাকে।

কিন্তু আমার সাহস হচ্ছে, অনভিজ্ঞতার সাহস, আমি এই অগম্য স্থানে আসবার জন্য কবিকে ডাকছি, যদিও উনি অল্পদিন হয় দারুণ ইরিসিপ্লাস রোগে ভুগে উঠেছেন—আমার চিঠি পেয়ে তার ধারণা জন্মাচ্ছে যে আমি আমার প্রতিজ্ঞা রেখেছি এবার তাঁরটি রাখতে হবে। মার একটা চিঠি পেয়ে আমার উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। মা লিখেছেন, “আমরা চণ্ডালিকা দেখতে গিয়েছিলাম। নাচ শেষ হলে যখন কবিকে প্রণাম করতে গিয়েছি, তিনি বললেন,—অমৃতা আর এসব কিছু দেখতে পায় না—কোথায় যে তোমরা তাকে পাঠিয়ে দিলে সুধা।” মা আরো লিখেছেন, “আমার মনে হয় আমাদের দেখলে ওর তোর জন্য মন কেমন করে।”

চিঠিটা পেয়ে আমি আবার তাকে আসবার জন্য লিখলাম। আমি সাধারণত তাকে বেশি চিঠি লিখি না কারণ আমি জানি চিঠি দিলে উত্তর না দিয়ে তিনি পারেন না কিন্তু অত কাজের মধ্যে সহস্র জনের সহস্র আব্দারে উনি উদ্ৰব্যস্ত। আবার কেন আমি পরিশ্রম বাড়াব? কিন্তু এখন আমি লিখছি, এমন চিঠি লিখছি যাতে তিনি মনে করেন আমি একেবারে আনন্দের জোয়ারে ভাসছি।

আসবার কথা ঠিক হবার পর থেকে আসা পর্যন্ত দু’তিন মাসের সময়টা ঐ জোয়ারের তরঙ্গ উত্তাল হয়। এ পাহাড়ে দু’চার ঘর ও কাছাকাছি পাহাড়ে যে সব বাঙালী আছেন সকলেই চমৎকৃত। এখন আত্মীয়স্বজন অনেকেরই ইচ্ছা আমার বাড়িতেই এসে থাকে কিন্তু আমি এখন ভীড় চাই না।

আমরা সাজানো বাড়ি আবার সাজাচ্ছি-ঘষা মাজা চলছেই—ফুলের কেয়ারী ছাঁটা হচ্ছে, লনে ঘাস বাছা হচ্ছে, টবে রং হচ্ছে, পর্দা বদল হচ্ছে—আমি রেখেছি—রেখেছি কনক মন্দিরে কমলাসন পাতি’—আমার নির্জনতার অবসাদ কোথায় পালিয়ে গেছে, যে ঝরনাটা ঝরঝর শব্দে আমাকে হয়রান করে দিত এখন তার শব্দটা বদলে গেছে সেটা কুলকুল ধ্বনি হয়ে গেছে, আর ঐ যে ঝিঝি পোকার দল দিবারাত্র ঝি ঝি ঝি ঝি করে আমার মাথার মধ্যে ভ্রু-ড্রাইভার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঢোকাত হঠাৎ সেটা ঝিল্লীরব হয়ে গিয়েছে। সিলভার ফারের পাতার ভিতর দিয়ে ঝড়ের বাতাস সো সেঁ করে অরণ্যের দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আসত সেটাও স্বর্ণবীণার মত বাজতে লাগল—‘তুমি এস, হৃদে এস, হৃদিবল্লভ হৃদয়েশ—’

 

উনিশ শ’ আটত্রিশ সাল থেকে চল্লিশ এই তিন বছর হচ্ছে আমার জীবনে আলোকবর্ষ বা অ-লোক বর্ষ—আমি এই সময়কার কথা এখানে লিখছি না—শুধু আমার অন্তৰ্জীবনপ্রবাহের গতিটা চিহ্নিত করছি। সময়ের আপেক্ষিকত্ব আমি নানাভাবে বুঝছি। এই তিন বছরে যখন তিনি আসছেন বা ফিরে গিয়ে আবার আসবেন এই সময়ের মধ্যে কোনো ছেদ নেই—এটা একটা অখণ্ড সময় যা আমার সারাজীবনের চিরঅতৃপ্তির মাঝখানে অমৃতপাত্র হাতে অচঞ্চল আছে, আমার অকিঞ্চিৎক্তর জীবনকে মহৎ মূল্য দিয়েছে।

এই গার্হস্থ্য তাঁর ভালো লাগছে। আমি শেষ রাতে উঠে প্রস্তুত হই–যখন তিনি ভোরবেলায় পূর্বমুখী হয়ে ঘণ্টা দেড়েক বসে থাকেন তার চেয়ারের পাশে এসে বসি—এই ভাবে আমার দিন শুরু হয়, শেষ হয় যখন তাকে বিছানায় শুইয়ে গায়ে চাদর দিয়ে মশারী গুঁজে দিয়ে আসি তখন। ইনি বাড়িতে থাকা মানেই সর্বদা একটা রাজসূয় যজ্ঞ চলেছে—এত যে নির্জন জায়গা তাও ঝুপ করে সকাল দশটা এগারটায় এক গাড়ি লোক এসে উপস্থিত হবে পথ খুঁজে খুঁজে—আগে খবর দিয়ে আসবে তার উপায় নেই কারণ এখানে তো টেলিফোন নেই। তখন এই অতর্কিত আক্রমণে আমি পরাজিত হই না। তাদের মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা করি ভালোমতোই। নির্জনতা পালিয়ে গেছে এই পাহাড়ে গ্রাম থেকে বাড়িতে সর্বদা উৎসবের গান বাজছে শুধু আমার মনে নয় সকলেরই মনে। আমার স্বামীও আগের চেয়ে বেশি কথা বলছেন, তাঁর টিপ্পনীকাটা রসিকতাও সংখ্যায় বেড়েছে। চারিদিকে বাতাস যেন সুখে লঘু—আমরা উড়ছি, পৃথিবীর মাটি থেকে একটু উপরে উঠে আছি। আমি তার সব কাজগুলি নিজের হাতে করি, লেখা কপি করা থেকে শুরু করে টেবিল ঝাড়া, বিছানা করা রূপার থালা মাজা, পালিশ করা সব। ওদের বাড়ির ভৃত্যকুল এতে অবাক হয় কারণ তারা এমন কাণ্ড দেখে নি। যে ঘরটায় উনি বসে লেখেন সেই ঘরের পাশে ওর স্নানের ঘর, তারপরে শোবার ঘর। একদিন স্নানের ঘরে বসে ওর কাপড় কাচছি-বাগানের দিকের দরজাটা খোলা আছে, বাগানের পথ দিয়ে যেতে যেতে অবাবু হঠাৎ দেখতে পেয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এলেন—“একি ব্যাপার কি? আপনি কাপড় কাচছেন কেন? এতগুলো লোক রয়েছে কি করতে?”

আমি খুব বিপদগ্রস্ত মনে করছি, চুপচাপ তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নেবার চেষ্টা করছি।

“ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন-একি? এরা সব গেল কোথায়?”

“চলে যান অবাবু, আমি রোজ করি, আজও করব।”

“রোজ কাপড় কাচেন?”

“হ্যাঁ, তাতে আপনার কোনো ক্ষতি হয়?”

“উনি যদি জানতে পারেন খুব রাগ করবেন।”

“জানতে পারবেন কেন?”

“আমি বলে দেব তাই”—এই বলে অবাবু হঠাৎ লেখার ঘরের দিকের দরজাটা খুলে দিলেন। তারপর কবিকে লক্ষ্য করে বললেন, “দেখুন একবার অমৃতা দেবী আপনার কাপড় কাচছেন বসে বসে, কথা শুনছেন না—”

আমি তো অপ্রস্তুত। আমার কর্ণমূল ঝা ঝা করছে, আমি কাপড় ছেড়ে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছি। উনি চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা বই পড়ছিলেন। বইটা মুখের সামনে থেকে নামিয়ে এই দৃশ্য দেখে মৃদু মৃদু হাসছেন—“তুই থাম তো অ—তুই এ সবের কি বুঝিস? দরজাটা বন্ধ করে দে। তুমি তোমার কাজ কর অমৃতা, আমি তো তাই ভাবি আমার কাপড় এত ফর্সা হয় কি করে আজকাল!”

আসলে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই এর উল্টো হয়েছিল, আমি যে ওদের থেকে ভালো কাচতে পেরেছি তা কখনই নয় কিন্তু এটা পুরস্কার।

তিন বছরে চারবার এসেছিলেন কবি এই গণ্ডগ্রামে—পঞ্চমবার এখানে আসবার পথে কালিম্পং-এ অসুস্থ হওয়ায় আর আসা হল না। এই তিন বছরের পরিপূর্ণ দানে আমার সব ক্ষয়ক্ষতি ধুয়ে মুছে গেল—এই তিন বছরেই আমার সেই সত্তা তৈরী হয়েছে যে নিজেকে সময়সীমা অতিক্রম করে দেখতে শিখেছে।

আমি অনির্বচনীয়কে অনুভব করেছি-‘পেরিয়ে মরণ সে মোর সঙ্গে যাবে কেবল রসে কেবল সুরে কেবল অনুভাবে। এ দানের মহিমা তখন ঠিকমত বুঝতে পারি নি। এই দুর্গম স্থানে ঐ বিপজ্জনক পথ পার হয়ে আসা কি সহজ কথা! আমার নিকটতম আত্মীয়ের মধ্যেও তার চেয়ে অনেক কম বয়সেরও যারা ছিলেন তারা সাহস করতেন না। কিন্তু চিরতরুণ কবি বাইরের বাধাবিঘ্ন গ্রাহ্য করলেন না। আরো আমার আনন্দের কথা এই যা অ-বাবু প্রায়ই মনে করিয়ে দিতেন তা হচ্ছে এক জায়গায় ইতিপূর্বে উনি দু’বার যান নি।

এ নির্জন অরণ্যে বিশ্বকবির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বও এল, আমি পৃথিবীর মানুষের সঙ্গ পেলাম।। দেশবিদেশের গল্প শুনতাম। বার্গস, যার দর্শন পড়েছি যিনি একজন জীবিত মানুষ তা ভাবি নি কখনো তার কথা শুনলাম। বানার্ড শ’, রোমা রোলা, বাট্রাণ্ড রাসেল সব বইয়ের মলাটের নামগুলো নানা কথা বলতে লাগল। অজ্ঞাত বিশ্বের দৃশ্য দেখলাম। সবচেয়ে বেশি শুনতাম রাশিয়ার কথা। সেখানে যে নূতন পরীক্ষা চলেছে তার প্রতি তাঁর আগ্রহের অন্ত ছিল না। বৃহদাকার মস্কো নিউজ আমি সেই প্রথম দেখলাম—তিনটে প্রবন্ধ আমাকে দিয়ে অনুবাদ করালেন তিনি—সেগুলো বিভিন্ন পত্রিকায় গেল। সব দিক থেকে পূর্ণ হয়ে উঠছি আমি—আমাকে মানুষ করলেন তিনিবললেন, মানুষের ইতিহাসটা পড়ো-ছয় বছর ধরে মহাভারত পড়লাম, দু’বছর ঋগবেদ আর পাঁচ বছর ‘হিস্ট্রোরিয়ান্স হিস্ট্রি অফ দি ওয়ার্লড’—তারই নির্দেশে।

 

আমাদের এই সংসারটা সবসুদ্ধ তাঁর ভালো লেগেছে—-আমার স্বামীকে উনি বলেন পারফেক্ট জেন্টলম্যান। বাহিরে সুন্দর প্রকৃতি আর তার সহযোগী মানুষের সখ্য দুটো নিয়ে একটা সম্পূর্ণতা।

আমার স্বামীও এখন আগের চেয়ে অনেক কথা বলেন। আমি একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম-“আমি যে সর্বদা এঁকে নিয়ে এত মেতে আছি তাতে তোমার হিংসা হয় না? হাসচ কেন? বল না, বল না।”

“হিংসে হতে যাবে কেন? তুমি যা তুমি তা, অন্যরকম করতে চাইব কি আমি?”

“তবু হিংসে হওয়ার কথা কিন্তু।”

“কার সঙ্গে কথা? তুমি যদি মীরাবাঈ হতে আমি কি হিংসা করতুম!”

একদিন লেখার ঘরে কবি বসে আছেন লেখার টেবিলের পাশের চেয়ারে—আমি স্নান সেরে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছি—চারদিকে সেদিন রোদ ঝলমল করছে—দূরে মাছের জন্য একটা জলাশয় করেছি তারই পাড় ঘেঁষে ফুটেছে টাইগার লিলি— শ্রেণীবদ্ধ দীর্ঘ রঙীন রেখার দিকে উনি তাকিয়ে আছেন, বলছেন, “কি সুন্দর এই ফুলের সারি সাজিয়েছ-কে এই বিদেশিনী?”

“ওতো জংলি লিলি। এখন তো ফুল নেই,—শীতের সময়েই ফুলের সমারোহ।

“জানো অমৃতা, তোমরা খুব সুন্দর করে সংসার করছ—আমি জানতুম তুমি পারবে। যখন প্রথম এখানে আসার কথা হয় সকলে বললে, কি জানি কি রকম ব্যবস্থা হবে, আপনার কষ্ট হবে। আমি ভাবছি সে তো জানে আমার কি দরকার, নিশ্চয় অসুবিধা হবে না নৈলে ডাকবে কেন? সুন্দর তোমার সংসারটা ঐ ঝরনার মতো ঝর ঝর করে গান গেয়ে বয়ে চলেছে—সবচেয়ে আমার কি ভালো লাগে জানো, তোমরা দুজনে ঝগড়া কর না—দেখি তো ‘প’ আর ‘র’-কে কি ঝগড়াই করতে পারে, থামতেই চাই না, থামতেই চায় না, ‘প’ শেষ পর্যন্ত চুপ করে যায় কিন্তু ‘র’ আর থামে না, সাপের মতন ফিরে ফিরে আসে।”

“তা আপনি কিছু বলেন না?”

“কত বলি কিছু হয় না। সুন্দর সংসার সৃষ্টি করাও একটা সৃষ্টিকর্ম, একটা কাব্য। এই ফুলের রাজ্যে ফুলের মত শিশুটিকে নিয়ে তোমরা সুখে আছ—এতে আমি খুব খুশী হয়েছি অমৃতা, তাই তো বার বার আসছি”

চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে আমার শরীর মন নিস্পন্দ—সত্য কথা বলতে হবে আমায়, এখুনি বলতে হবে—আমার সারা জীবনটা কি মিথ্যা দিয়ে গড়ব?

“আপনি যতটা বলছেন তা ঠিক নয়, আপনাকে ঠকাচ্ছি আমি।”

“কি বলছ?” উনি পিছন দিকে হাতটা বাড়িয়ে টেনে আনলেন আমায় সামনের দিকে—“কও কি কন্যা? ঠকাচ্ছ কাকে?”

“সকলকে। কিছু করতে পারি নি আমি, সব বাইরের। অর্ধেক ভুয়া—আমার একলা রাতের কোনো সঙ্গী নেই।” আমি এখন প্রস্তুত, সম্পূর্ণ প্রস্তুত—উনি যদি কোনো ভর্ৎসনা করেন ভালো হয়।

“কেনো নিরর্থক আত্মপীড়ন করছ? আমি তোমাকে আগেও বলেছি আবারও বলছি মানুষ আপনাকে যা দিতে পারে তা দেশ, কাল, পাত্রে সীমাবদ্ধ—সবটা দেওয়া যায় না, পাওয়াও যায় না, তাই যা পাওয়া গেল না তার জন্য হা-হুতাশ করে লাভ কি? যা হয়েছে তাই কি যথেষ্ট নয়? ফুলের সারির দিকে হাত দেখিয়ে বললেন—“এই যা হয়েছে, এই যা করেছ এর জন্যই আমি grateful madam, grateful to you–”

এসব কথা সত্ত্বেও আমি বুঝতাম এই গভীর নির্জনতার কতখানি ভার আছে তা তিনি বুঝতেন—প্রত্যেকবারই যাবার সময় তাই আমাদের সঙ্গে সঙ্গে নামতে হত। আমরা শূন্য ঘরে বসে থাকব আর ওরা সদলবলে চলে যাবেন তাঁর করুণাদ্রব মন তা কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। যাবার কয়েকদিন আগে থেকেই তাই বলতে শুরু করতেন এর চেয়ে না এলেই ভালো হত—তোমাদের কষ্ট বাড়ানো—আমি আর আসব না!

একবার যাবার আগে গোছগাছ চলেছে, আমি বইগুলো স্যুটকেসে ভরছি হঠাৎ আমার ভীষণ মন কেমন করতে লাগল, উনি চেয়ারে হেলান দিয়ে বই পড়ছিলেন, আমি এসে ওর পায়ের কাছে বসে পড়ে ওর কোলের উপর মাথা রেখে কাঁদতে লাগলাম, ওর ডান হাতে বই ধরা ছিল সেটা বা হাতে নিয়ে ডান হাতটা আমার মাথার উপর রেখে বললেন, “কোনো ভয় নেই, কোনো ভয় নেই”—ঠিক তখুনি ‘সুবাবু ঘরে ঢুকলেন—ঢুকে আমায় ঐরকম ক্রন্দনরতা দেখে অপ্রস্তুত, আমি বুঝতে পারছি কবিও অপ্রস্তুত-আমার চুলের মধ্যে ওর চলমান আঙ্গুল গুলো থেমে গেছে। প্রকাশ্যে আবেগ দেখান ওর পছন্দ নয়। একটি মুহূর্ত মাত্র, তারপর উনি খুব সহজভাবে বললেন, “সু তুই আর এর সাক্ষী থেকে কি করবি বরং মীলুকে ডেকে দে”—মীলু এসেই আমার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল, “কি পাগলামি শুরু করেছ? ওকে এরকম করে জ্বালাতন করলে উনি আর কোনো দিনই আসবেন না”—কবি বলছেন, “তুমি যে দেখছি উল্টা বুঝলি রাম, আমি কি অমৃতার হাত থেকে রক্ষা করতে ডেকেছি তোমায়? আমি ডেকেছিলাম ‘সু’র হাত থেকে রক্ষা করতে!”

সেদিন সন্ধ্যেবেলা আমায় তিনি একটা কথা বলেছিলেন বহুমূল্য রত্নের মত সে কথাটা আমি হৃদয়ে ধারণ করে আছি। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, লম্বা লম্বা গাছগুলো অন্ধকার শুষে নিয়ে কালো কালো দীর্ঘদেহ প্রেতের মত দাঁড়িয়ে আছে। পরের দিন এঁরা চলে যাবেন—আমি চুপ করে ওর পায়ের কাছে বসে আছি। তখনো সবাই বেড়িয়ে ফেরেন নি, তাই চারদিক আরো নিঃশব্দ। হঠাৎ কবি বললেন, “আমি তোমায় একটা কথা বলছি অমৃতা, এতে যদি তোমার কোনো সান্ত্বনা হয়—জীবনে আমি অনেক পেয়েছি, তবু শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসার মিলিত যে অর্ঘ্য তুমি আমাকে দিয়েছ এরকম জিনিস আমিও বেশি পাই নি। বিদায়ের আগে এ আমারও দরকার ছিল নইলে বার বার আসতুম না।”

তিনি জানতেন আমার কর্মশক্তি যে পাহাড়ের কন্দরে আটকে আছে এটাই আমার সবচেয়ে ক্ষতি। এমনিতেই আমাদের দেশে তখন মেয়েদের কর্মক্ষেত্র ছিল সঙ্কীর্ণ—ওরকম একটা স্থানে তো কথাই নেই—আমার কর্মের পথও তিনি খুঁজছিলেন—

লেখার ঘর থেকে দেখা যায় একটা পার্বত্য পথ, সেখান দিয়ে চলাচল করে মালবাহী ঘোড়া নিয়ে মজুরের দল। সেই দিকে তাকিয়ে একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, “এখানে পাহাড়ীদের সংখ্যা কত?”

“চার পাঁচ হাজার হতে পারে!”

“তবে তোমরা একলা কেন? ওরা কি মানুষ নয়? ওদের তোমার ঘরে ডাক, ওদের কাছে যাও, মানুষের কত সমস্যা আছে, তাদের বন্ধু প্রয়োজন, ওদের বন্ধু হও না কেন?”

সেই জন্যই তার জন্মদিনে আমরা পাহাড়ীদের নিয়ে উৎসবের আয়োজন করলাম— এখানকার অর্থাৎ এ জেলার ইতিহাসে শুধু নয়, বোধ হয় সরকারী প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মচারীর বাড়িতে এই প্রথম মজুরেরা নিমন্ত্রিত হয়ে এল। চা বাগানের মতো এখানেও নিয়ম ছিল কোনো অফিসারের বাড়ির হাতায় কোনো মজুর জুতো পরে ঢুকবে না। কোনো মজুর ঘোড়া চড়ে চলেছে, অফিসারের সঙ্গে দেখা হলে তৎক্ষণাৎ নেমে পড়তে হবে। একজন নামে নি বলে রিচার্ডস তাকে বেত মেরেছিল। এই সমাজে আমি একটা নূতন কাজ পেলাম, নূতন পথের নিশানা। ক্রমে ক্রমে আমাদের ঘরের দরজা ওদের দিকে খুলে গেল।

উনিশ শ’ বেয়াল্লিশের দুর্ভিক্ষের সময় ইংরেজদের আসল মূর্তিটি দেখলাম–আমাদের উপর তো বিরুদ্ধতা ছিলই, চক্রান্ত করে গুর্খাদের রাগিয়ে তুলল এখানে যে কয় ঘর বাঙ্গালী আছে তাদের বিরুদ্ধে ও এ জেলার সমস্ত বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে। ইংরেজরা এই কাজে কত দড় তা সে সময় বুঝলাম। ওরা তো তখন হিন্দুমুসলমানের দাঙ্গায় উস্কানী দিয়ে দিয়ে বিভেদের গহ্বর খুঁড়ে খুঁড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে এই বিশাল দেশের চিত্তভূমি, এখন ওদের নূতন করে রাগের কারণ এই যে বাঙ্গালী মন্ত্রিসভা হয়েছে—ভারতীয়করণ চলেছে এবং বাঙ্গালীরা বিদ্যায় ওদের চেয়ে বড় হওয়ায় ওদের মাথার উপর চলে গেছে, যাচ্ছে–উচ্চপদ পাচ্ছে। অতএব আবার সেই একই অস্ত্রে শাণ দাও। ওরা মজুরদের ক্ষেপিয়ে তুলছে, বলছে, আগেও তো যুদ্ধ হয়েছিল তখন কি চালের দাম এতো হয়েছিল? এখন বাঙ্গালীর রাজত্ব হচ্ছে বলেই এই দশা, এরপরে যখন আমরা অর্থাৎ ইংরেজরা চলে যাব তখন তোমাদের গুর্খাদের কি হবে অবস্থা বুঝতে পারছ? কেউ আর চাকরী পাবে না, এরা বাঙ্গালী এনে এনে পাহাড়টা ভরিয়ে ফেলবে। অতএব ঠেঙ্গাও বাঙ্গালীদের, এরাই তো ইংরেজ তাড়াচ্ছে, অতএব শেষ কর এইবেলা এদের।

অথচ আমরা এ সব কিছু টের পাচ্ছি না। আমরা সরল ভালোমানুষ পড়য়া, রাজনীতির কিছু জানি না।

ভোরবেলা উঠে আমার স্বামী মিটিং-এ চলে গেছেন—চাল কেন পাওয়া যাচ্ছে না তার কৈফিয়ৎ দিতে হবে! দুপুরবেলা যখন ওকে নিয়ে এল তখন সারা শরীর রক্তে ভাসছে—উনি কিন্তু হাসছেন—“ভয় পাবার কিছু নেই—বিশেষ কিছু নয়–”

সেই সময়ে ভালো করে দেখলাম পুলিশের সঙ্গে যোগ রেখেই চক্রান্তটা হয়—নৈলে ব্যাপক দাঙ্গা হতেই পারে না। রটেছিল রাত্রে সমস্ত বাঙ্গালীদের পুড়িয়ে মারা হবে, দুটি শিশু নিয়ে আমি তো তারি অপেক্ষায় ছিলাম, তবুও সাহেব এস. পি এসে সাহেবদের সঙ্গেই কথা বলে চলে গেল। কিছুতেই থাকল না—তার স্ত্রী নাকি ডিনারে অপেক্ষা করছে। সে আবার স্বামী পাশে না থাকলে খেতেই পারে না। সেই সময়ে বুঝতে পেরেছিলাম, দাঙ্গাকারী যারা হাতে অস্ত্র নিয়ে মানুষ মারে তাদের দোষ নেই বললেই হয় কারণ তারা একটা কিছু করা উচিত মনে করে, তার জন্য নিজেরাও বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে—অপরপক্ষে যারা চক্রান্ত করছে তারা নিজে কোনো দায়িত্ব না নিয়ে অন্যকে বিভ্রান্ত করে নিজে ফলটা ভোগ করতে চাইছে। তারপর থেকে সর্বদাই এই দেখলাম মানুষকে হিংস্র করে তোলবার কাজে যারা হাত পাকাচ্ছে তারাই মুখে বড় বড় কথা বলে সেজেগুজে সভায় এসে বসে…আসলে এটা ইংরেজদের একচেটিয়া নয়। যে সুবিধা পাবে সেই করবে।

দাঙ্গার পরে উনি সুস্থ হয়ে ওঠার পর আমি কবির কথা ভাবতে লাগলাম ‘মানুষের দিকে চেয়ে দেখ। আমি ভাবছি এতবড় যে দুর্যোগ ঘটল এ দোষ আমাদের ছাড়া আর তো কারুর নয়। আমাদের পাশে থেকে যদি এতটা অসন্তোষ পঞ্জীভূত হয়ে থাকে আর আমরা টেরই না পাই তাহলে মূঢ়তা তো আমাদেরই। আমি তখন ভালো করে ওদের দিকে তাকালাম আর তখনই বুঝতে পারলাম যে, যে নির্জনতার দুঃখ আমায় এতদিন পীড়িত করেছে তার থেকে উদ্ধারের পথ ছিল, শুধু সে পথটা আমি চিনতে পারি নি।

আমি অন্তর্মুখী হয়ে বই নিয়ে বসে আছি—আমার শূন্যতা ভরবে কি করে?

সেখানে এ সময়ে পাহাড়িদের ঘরে দুর্ভিক্ষের বছরটা ছাড়া খাদ্যের অভাব ছিল না কিন্তু খাদ্য ছাড়াও মানুষের অন্য প্রয়োজন আছে, আমি তারই আয়োজন করলাম—আমাদের ঘরের দরজা প্রসারিত হতে লাগল। উৎসবে অনুষ্ঠানে ‘কুলি মজুরদের নিয়ে আমার পরের চৌদ্দ বছর পরিপূর্ণ হয়ে গেল।

ওপরওলা একজন আমার স্বামীকে বললেন, “আপনি কি লক্ষ্য করেছেন আপনার স্ত্রী মজুরদের সঙ্গে বেশি মিশছেন।”

“হ্যাঁ।”

“এরকম হলে ডিসিপ্লিন থাকবে কি করে?”

“ডিসিপ্লিনের অভাব আগে কিছু লক্ষ্য করেছি—এখন তো করছি না।”

“আপনি কি আপনার স্ত্রীকে নিষেধ করবেন?”

“না।”

“তাহলে আমি বলব?”

“না না, তাহলেই ডিসিপ্লিন ভঙ্গ হতে পারে।”

দেখলাম, সম্পূর্ণ অজ্ঞ অশিক্ষিত মানুষের মধ্যেও এমন লোক আছে যারা সূক্ষ্মভাবে বুঝতে পারে, যাদের মন গভীরের দিকে উন্মুখ, যাদের গলায় গান আছে, মনে কবিতা আছে, ছাই-ঢাকা আগুনের ফুলিঙ্গ যখন জ্বলতে দেখতাম, আনন্দে মন ভরে যেত। তাদের একজনের হাতে তৈরী একটি শিল্পনিদর্শন আজও আমার ঘরে বহুজনকে আনন্দ দেয়। সঙ্গী সর্বত্র পাওয়া যায়, মানুষই মানুষের সঙ্গী। পৃথিবীতে নানাজাতির, নানাশ্রেণীর সভ্য অসভ্য মানুষ দেখেছি কিন্তু সেই সময়কার গুর্খা জাতির মধ্যে যে সততা, সরলতা ও বিশ্বস্ততা দেখেছি তা পরে অন্য কোথাও দেখি নি। যখন ঐ দুর্গম নির্জন অরণ্যে বাস করতে যাই তখন যে শন্তা নিয়ে গিয়েছিলাম যখন ফিরে আসি তখন তার চিহ্নমাত্র ছিল না, একটি পরিপূর্ণ জীবন নিয়ে আমি ফিরেছি। স্নেহে, সখ্যে, মাধুর্যে তা পূর্ণ। বিনা এনেসথেশিয়ায় হাত কাটতে যাদের চোখে জল আসে না, আমাদের আসার সময় তাদের চোখে জলের অভিষেক আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টার সমাপ্তিকে গৌরবে ভরে দিয়েছিল।

 

উনিশ শ’ তিপ্পান্ন সালে আমার কন্যার বিবাহ হয়ে গিয়েছে। এদিকে তার দশ বছর আগে আমার মার সংসার উনিশ শ’ বেয়াল্লিশেই সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গিয়েছে-উনিশ শ’ একত্রিশ সালেই যে ভাঙ্গনের সূত্রপাত হয়েছিল দশ বছর ধরে একটু একটু করে তার কাজ এগিয়েছে এখন একটা পরিবার সম্পূর্ণ ধ্বংস। মা চারটি শিশু নিয়ে কপর্দকহীন অবস্থায় পৌঁছেছেন—আছে শুধু একখানি বাড়ি। এটিও যখন যায় যায় তখন আমি সিংহবাহিনী মূর্তি ধরলাম বাড়িটা রক্ষা করবার জন্য। আবার নিন্দার ঢেউ উত্তাল হল, এবার অন্যভাবে—-আগে বাবার নিন্দা করে করে যারা আমাদের সংসারটা উত্তপ্ত করে তুলেছিল এবার তারাই অন্যমুখে বলতে লাগত এত বিদ্বান লোকের স্ত্রী কন্যারা টাকা ছাড়া আর কিছু বোঝে না অতএব যোগ্য সঙ্গিনী তো দরকার ছিলই নির্দোষ শিশুগুলিকে যে পিতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হল, এমন কি তাদের বাচার ব্যবস্থাও করা হল না সেদিকে নিন্দাকারীদের লক্ষ্য নেই। যারা জীবনে নানা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে তারাই শুধু জানে, কোনো কোনো ঘটনা বাইরে থেকে যা দেখায় তাই তার যথার্থ রূপ নয়। একই ভালোবাসা যা মানুষকে স্বর্গের ছবি দেখায়, তার চারপাশ সৌরভে ভরে দেয়, তারই আবার এমন রূপ আছে যা মানুষকে চূর্ণবিচূর্ণ করে, সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারে। বাইরে থেকে দেখতে উভয়ের রূপ একই যেন দুই যমজ ভাই কিন্তু একজন প্রাণ দেয়, অন্যজন হরণ করে।

পতিপ্রাণা মা ছোট শিশুদের নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন—মানসিক কষ্ট তো আছেই কিন্তু আর্থিকটাও কম নয়। একটি বাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই, তা বাড়ির ইট তো আর ভেঙ্গে ভেঙ্গে খাওয়া যায় না। কলকাতার বিখ্যাত আইনজ্ঞ আমাদের পরম সুহৃদ শ্রীযুক্ত গুপ্ত আমাকে ডেকে পাঠালেন, “তোমার মা ইনশিওরেন্সের এসাইনি ছিলেন, তিনি নিজে না লিখে দিলে কেউ তা ফেরৎ নিতে পারত না দিলেন কেন?” মার উপরে রাগে আমার অস্থির লাগছে।

“মা ঐরকমই। আমি জানতাম না, তাহলে কিছুতে হতে পারত না।”

“দেখো অমৃতা, বাড়ি সম্বন্ধে কোনোকাগজে কিংবা সাদা কাগজেও যেন আর সই না করেন, মোটের উপর তোমার মা আর কিছু সই-ই করবেন না।”

“আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।”

“তাহলে আরো একটা কথা তোমায় বলি, বিষয়-সম্পত্তি এক পয়সা ছেড়ো না, যা পার ধরে রাখ, কিন্তু মানুষকে তোমরা ছেড়ে দাও।”

“মানুষকে ছেড়ে দাও, মানুষকে ছেড়ে দাও”, ক্রমে ক্রমে কথাটা বড় হতে লাগল যেন একটা কালো জমাট মেঘ আকাশ ঢেকেছিল সেটা ফুটো হয়ে গেল, ছোট-ছোট টুকরো-টুকরো হয়ে সাদা তুলোর মত ছড়িয়ে পড়ল, তার ফাক দিয়ে দিয়ে নীল রঙ দেখা গেল। আমি যেন একটা বন্ধ ঘরে আটকে ছিলাম, এখন খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নিলাম। ঠিকই তো, মানুষকে কে ধরে রাখবে? ‘জীবনেরে কে রাখিতে পারে? এতদিন আত্মীয়স্বজনের উপদেষ্টামণ্ডলী আমাদের কি উদ্ভ্রান্তই করেছে। এই ছিন্নপাল সংসারের তরণীটা একবার এর কথায় আবার ওর কথায় যেন একটা পাথরে লেগে লেগে ফুটো ফুটো হয়ে গেল। এ বিপদে কি যে-সে লোক পথ দেখাতে পারে। একটা জ্ঞানী লোকের কথা শুনলাম।

মাকে এসে বললাম—“মা এতদিনে পথ পেয়েছি” মা অবাক হয়ে গেছেন—শ্রীগুপ্তের কথা শুনে তার চক্ষুস্থির—“এই একটা উপদেশ হল? তুমি আবার তাই শতখান করে বলতে এসেছ? ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ, আমি স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে তাঁর টাকাপয়সা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকব? এরা লেখাপড়া শিখেছেন? আমার স্বামী আগুনে ঝাঁপ দেবেন, আমি তাকে ধরব না, না সিন্দুক গোছাব?” মা কাঁদছেন, আমার একটু মায়া হচ্ছে না—‘আগুনে ঝাঁপ দেবেন’ এখনও future tense-“তা তুমি কি করবে, রুখতে পারবে?”

“দ্যাখ রু, আমার বিরাট প্রতিভাধর স্বামীর দুর্বলতা আমি জানি, এই তো প্রথম নয়, বহুবার তাকে রক্ষা করেছি আমি, নৈলে এত বড় হতে পারতেন না, এবারও করব। তোর যদি আমার কথা ভালো না লাগে তবে চলে যা আমার সামনে থেকে।”

অতুল যশ ও মানের অধিকারী যিনি হতে পারতেন তার নিজের ও সমস্ত পরিবারবর্গের মাথা হেঁট করে, সম্মান সম্রম ও সুখ নষ্ট করে দশ বছর পর যখন তিনি সম্পূর্ণ নির্বান্ধব অবস্থায় মারা গেলেন তখন তিনি মার কাছে ফেরবার জন্য ব্যাকুল হয়েছিলেন, শুনেছি বার বার বলেছেন, “আমার কলকাতায় যেতে হবে আমার ক্ষমা চাইবার আছে সে খবর মার কাছে পৌঁছতে দেরী হয়ে গেল। এটাই আমার অশেষ পুণ্যবতী মাতা ও অসাধারণ ক্ষমতাশালী পুরুষ পিতার জীবনের চূড়ান্ত ট্র্যাজেডি।

 

এইসব নানা ঘটনার ভিতর দিয়ে আমার ক্ষুদ্র জীবনতরী কখনো স্রোতে ভাসছে, কখনো চড়ায় লাগছে। আমি আর এখন ছোট বালিকাটি নেই বাস্তব সংসারকে ভালোমতো চিনেছি। মনে কড়া পড়ে গেছে। সূক্ষ্ম অনুভূতির কোমল ত্বক ঘষে ঘষে শক্ত হয়ে গেছে। আমি কাজের মানুষ। নিতান্ত সংসারী। অবশ্য এটা ঠিক, সংসারের কাজে আমার শক্তি ফুরাতে চায় না। কলকাতায় ফিরে এসেও আমি তাই বিষঃ বোধ করি। পুরানো অতৃপ্তি আমার তাই ফিরে ফিরে আসছে সাহিত্যের জগৎ থেকে আমি দূরে চলে গেছি, এখন এখানে ভীড় ঠেলাঠেলি খুব। লেখার সুযোগ পাচ্ছি না আমি। আমার লেখক জীবনটা পথ হারিয়েছে, তাই যে কাজ সামনে পাই হাতে তুলে নিই। নিন্দা অপমান যেমন সইতে হয়েছে, সম্মান শ্রদ্ধাও পেলাম অনেক। সমস্ত মিলিয়ে জীবনটা এখন অসঙ্গত কোনো বেসুরো গান বাজাচ্ছে না।

উনিশ শ’ তিপ্পান্ন সালে আমার ছেলেমেয়েকে কলকাতায় রেখে আমার স্বামীর সঙ্গে ইউরোপ বেড়াতে গেলাম। মির্চার কথা এর আগে দীর্ঘ পনের বছরে একটিবারও আমার মনে পড়ে নি। অর্থাৎ মনে পড়বার মতো করে নয়। হয়তো কখনো মনে হয়েছে এমন। একটা বিশ্রী ব্যাপার না ঘটলে আমার জীবনটা পবিত্র থাকত। মনকে সান্ত্বনা দিয়েছি সেই ছোটবেলার সামান্য একটা ঘটনার অপরাধ কি আর আজ আমাকে স্পর্শ করতে পারে?

ইয়োরোপে দেখা হল হিরন্ময়ের সঙ্গে। বাবার ছাত্র, বিদেশে বিয়ে করে বসবাস করছে। একটা সভায় তাকে দেখে প্রথম চিনতেই পারি নি। একেবারে সাহেব হয়ে গেছে। সে হঠাৎ আমায় জিজ্ঞাসা করলে আপনার ইউক্লিডকে মনে আছে?” আমি ভাবছি এ উদ্ভট প্রশ্নটি করবার অর্থ কি হতে পারে। আমায় নিরুত্তর দেখে সে নিজেই বলছে, “সে আপনাকে একটা বই উৎসর্গ করেছে।”

“শুনে সুখী হলাম। আপনার ছেলেমেয়ে ক’টি?”

এ কথার এখানে শেষ হয়ে গেল। আমার মনে তা বিন্দুমাত্র দাগ কাটল না। সারা ইয়োরোপে চরকীর মত পাক দিচ্ছি আমরা। প্যারিসে এক অধ্যাপক ও তার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ হল তার নাম নিকোলাই স্তানেক্কু। কোথায় কি করে তাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সেকথা এখন আর কিছুতেই মনে করতে পারছি না—আমি শুধু দেখতে পাচ্ছি একটা বড় বৈঠকখানা ঘর। স্বল্প আসবাবে সজ্জিত। অধ্যাপক দম্পতি আমাদের চায়ের নিমন্ত্রণ করেছেন, এঁরা স্বদেশ থেকে বিতাড়িত। এঁরা মির্চার দেশের লোক। ওদের দেশের রেফিউজিতে প্যারিস ভরা—ওরা নিজেদের লাঞ্ছনার কথা বলছিলেন। নির্বাসিতের দুঃখ অনেক। শুনছিলাম যুদ্ধমত্ত ইয়োরোপে মানুষের দুর্দশার কাহিনী। শুনছি আর ভাবছি। মির্চার কি হল কে জানে! জিজ্ঞাসা করব কি? আবার ভাবছি যাই হোক আমার তাতে কি, মরুক আর বাচুক। তবে মরাটা আমি চাই না, আমার মনে আশা আছে এই বিপুল পৃথিবীতে একদিন না একদিন ওর সঙ্গে আমার দেখা হবে—এবং আমি সেদিন ওকে জিজ্ঞাসা করতে পারব আমার সঙ্গে এমন ছলনা করল কেন?

আমার মনের এক অংশে এ সম্বন্ধে সন্দেহ আছে, সে দিকে প্রশ্ন ওঠে ছলনা কি? বাবা তাড়িয়ে দিলেন ও কি করবে? যাবার সময় তার যন্ত্রণাকাতর মুখটা কি ছলনা হতে পারে? মনের অন্য অংশটা যেখানে অবিশ্বাসের অন্ধকার কালো হয়ে জমে আছে, সেখান থেকে উত্তর আসে ওরা ইয়োরোপের মৃগয়াপটু নাগরিক ওদের কাজই এই। কোনোমতে একটা চিঠি আমার কাছে পৌঁছতে পারত না? তাহলে আমি যা হয় করতাম। প্রত্যুত্তর আসে অন্য দিক থেকে, যদি ছলনাই হবে তবে পাহাড় জঙ্গলে ঘুরে বেড়াল কেন? অত কষ্ট করার দরকার কি ছিল? সারাজীবন ধরেই আমার মন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে মাঝে মাঝেই এই প্রশ্নোত্তর করে চলেছে। মানুষকে বিশ্বাস করতে পারলে শান্তি, অবিশ্বাসে যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার। হাতে আর পড়তে ইচ্ছা নেই এই মুহূর্তে। একটা স্যাণ্ডুইচ মুখে পুরে খুব নির্বিকারভাবে আমি শ্ৰীমতী স্তনেস্কুকে জিজ্ঞাসা করলাম—“ইউক্লিড নামে একজন লেখককে কি চেনেন?”

“চিনি বৈকি। তিনি ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে অনেক বই লিখেছেন। ভারতীয় সভ্যতা সম্বন্ধে তিনি অভিজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ।”

“তাই নাকি? তার কোনো বই আপনার কাছে আছে?”

“নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলা উঠে গিয়ে ‘যোগ’ সম্বন্ধে একটি বৃহদাকার গ্রন্থ এনে আমার হাতে দিলেন বইটা হাতে নিয়ে আমি দেখছি—পাতাটা খুলে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। বইটা আমার পিতাকে উৎসর্গ করা। লেখা আছে—“আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন গুরু—কে। তাহলে? এত কাণ্ডের পরও কি তার বাবার সঙ্গে যোগ ছিল? এ ত দেখছি কচই একেবারে, ক্যারিয়ারিস্ট। এতদিনে বুঝলাম কেন আমায় চিঠি লেখে নি, ওই বইটা লেখা যে আরো দরকার ছিল, দরকার ছিল ভারত সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ হবার। যশ, খ্যাতি, বিদ্যার গরিমা! ঘৃণ্য এই পাণ্ডিত্য, ওই কীর্তিলোভ, যশোলোভ। আমার ভিতরটা বহুকাল পরে জ্বলতে শুরু করেছে। আমার ঠোঁট কাঁপছে আমি সঁত দিয়ে চেপে আছি রক্ত বেরিয়ে আমার মুখ নোনতা হয়ে গেল। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি শ্রীমতী স্তনেস্কু আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন—তার চোখে কৌতূহল—তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার নাম কি অমৃতা?”

“হ্যাঁ। কেন?”

“ও আপনাকে তো চিনি। আপনিই ইউক্লিডের ফাস্ট ফ্লেইম?”

ভদ্রমহিলা হাসছেন। রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। মনে মনে বলছি ফ্লেইম না অ্যাশ। আড়চোখে চেয়ে দেখি আমার স্বামী অধ্যাপকের গল্প শুনছেন, এদিকের কথাবার্তা তাঁর কানে গেছে কিনা কে জানে! আমি আর ওর সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলাম না, যথেষ্ট হয়েছে, ঐ লোকের সম্বন্ধে আর কোনো খবরে দরকার নেই, ওর নামও মনে আনবার যোগ্য নয়। কুড়ি বছর পর ওর খবর পেলাম আর সেই খবরই আমার বুকটা গুঁড়িয়ে দিল।

 

আমরা ইটালিতে বেড়াচ্ছি, রোম, ফ্লোরেন্স, ভেনিস ঘুরে দক্ষিণ ফ্রান্স অর্থাৎ রিভিয়েরাতে এসেছি। অপূর্ব দেশ, আমরা স্বামীস্ত্রী খুব সুখে দেশ দেখে বেড়াচ্ছি। সংসারের ভাবনাচিন্তা নেই, চাকুরীস্থলের নানা উদ্বেগ নেই—শুধু মাঝে মাঝে ছোট ছেলেটার জন্য বড় মন কেমন করে এছাড়া এত আরামে বেড়িয়ে বেড়ান জীবনে কমই হয়েছে।

আবার প্যারিসে এসে একটা হোটেলে উঠলাম আমরা। সাঁ সে লিজের কাছেই দুদিন পরে বিল দিতে গিয়ে চক্ষুস্থির! এতু খরচ তো চালাতে পারব না আমরা। সত্যেনবাবুর কাছে খবর পেয়ে ল্যাটিন কোয়ার্টারে একটা হোটেলে এলাম—এদিকে অধ্যাপক ছাত্ররা থাকেন, খরচ অনেক কম। এই হোটেলে দশ দিন ছিলাম আমরা। আমাদের পাশের ঘরে একটি লোক থাকে, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে মাথা নেড়ে সম্ভাষণ জানায়, একটু একটু ইংরেজি বলে, আমি ভাবি ও জাতিতে ফরাসী। ওর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় ছাড়া এই দশদিনে অন্য কোনো কথা হয় নি। যদি হত তাহলে কে জানে এ কাহিনী হয়ত অন্যরকম লেখা হত।

যেদিন আমরা প্যারিস থেকে ইংল্যাণ্ড চলে যাব সেদিন ‘রিসেপশনে’ অর্থাৎ আপিসের সামনের সিঁড়ির তলে বসে আছি। টেবিল-কৌচ দিয়ে বসবার জায়গা, যারা যাতায়াতের পথে অপেক্ষা করবে তাদের জন্য সাজানো। আমাদের জিনিসপত্র এক জায়গায় জমা হয়েছে। আমার স্বামী সেগুলি একে একে নামিয়ে এনে রেখে হিসাবপত্র মিটাবার জন্য কর্মচারীর টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। এমন সময় সেই লোকটি নেমে এসে এদিক ওদিক করে গিয়ে আমাদের বাক্সগুলির কাছে দাঁড়াল—আমার বাক্সতে আমার নাম লেখা—আমি দেখছি লোকটা বাক্সর উপর নামটা পড়ছে আর আমার দিকে দেখছে। একটু ইতস্তত করে আমার কাছে এগিয়ে এল—সে বলল, “আমার নাম আইয়ন পোপেস্কু। আপনার নাম কি অমৃতা?” আমি চমকে উঠেছি আমার বুকের ভিতর হাতুড়ির ঘা পড়তে শুরু করেছে—“কেন বলুন তো?”

“আই পে ইউ মাই হোমেজ” সে বাকাচোরা উচ্চারণে বলে আমার কপল্লব চুম্বন করল, এবার আর সন্দেহ রইল না সে কোন দেশের লোক।

“ওঃ বুঝেছি”—এক মুহূর্তে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে-“আচ্ছা বলতে পারেন ঐ লেখক কোথায় থাকে?”

“এই প্যারিসেই, এখান থেকে দুটো ব্লক পরে।”

“দুটো ব্লক মাত্র ওদিকে?”

“হ্যাঁ” সে মুখ টিপে হাসছে। হা ঈশ্বর! এখুনি তো আমি এর সঙ্গে গিয়ে ধরতে পারি ওকে। বলতে পারি প্রবঞ্চক, অসত্যের মূল্যে বিদ্যা কিনেছ তুমি, তুমি পণ্ডিত হতে পার, জ্ঞানী হবে না। দৰ্ব্বী সূপরসা ইবকাঠের হাতা যেমন সূপরসে ডুবে থাকলেও তার আস্বাদ পায় না তেমনি যার জীবনে সত্য নেই সে অনেক জানতে পারে, জ্ঞানী হবে না, মির্চা তোমার জীবনে সত্য নেই তুমি বেঁচে গেছ, তোমাকে কষ্ট পেতে হল না কিন্তু আমার সত্য কেন মরতে চায় না!

লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে—“যাবে তুমি আমার সঙ্গে?”

“না। আমি যদি একটা চিঠি দিই পৌঁছে দেবে?”

“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই”, সে দৌড়ে কাগজ আর খাম নিয়ে এল।

আমি সংক্ষেপে যা লিখলাম তা মোটামুটি এই-মির্চা, বহুদিন পর তোমার খবর পেলাম। কেমন আছ তুমি? বিয়ে করেছ তো? আমি আমার স্বামীর সঙ্গে ইয়োরোপে বেড়াতে এসেছি আমার একটি মেয়ে একটি ছেলে। তোমার সঙ্গে একবার দেখা হলে খুব খুশী হতাম। এক্ষুণি আমরা চলে যাচ্ছি, ডোভার চ্যানেল পার হব একটু বাদেই। লণ্ডনে আমার ঠিকান দিলাম। চিঠি পেয়েই যদি একবার এসো তো খুবই খুশী হব। আসবে তো?

আমার স্বামী এগিয়ে এসেছেন কি একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে আমি তার হাতে চিঠিটা দিলাম, “আমি তোমাকে সেই যে বিদেশী ছেলেটির কথা বলেছিলাম না—সেই ভদ্রলোক এখানে আছেন—তাকে লণ্ডনে নিমন্ত্রণ করলাম।” চিঠিটা উনি চোখ বুলিয়ে আমার হাতে ফেরত দিলেন।

“ঠিক আছে তো?”

“নিশ্চয়। এলে তো খুব ভালো হয়।”

উনি আবার চলে গেলেন। সে লোকটি আমার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল আমার কাধের উপর সস্নেহ হাত রাখল, “Write a good letter madam, you are trembling all over”.

“I am not trembling, I am shivering. It is a cold day to-day”… আমি চিঠিটা খামে ভরছি সে আবার বললে, একটা ভালো করে চিঠি লিখলে না কেন? আমি তো বুঝি না তোমার চিঠি সেনসরড় হবার দরকার কি?”

“না না সেজন্য নয়—আমার স্বামীকে ইংরেজীটা দেখতে দিলাম। আমার এপ্রিয়েট প্রিপজিশন ঠিকই হয় না।”

“ওঃ তাই নাকি!” সে চোখ মটকাচ্ছে, এমন একটা কিছু করই না যেটা এপ্রিয়েট নয়!”

আমরা লণ্ডনে চলে গেলাম। ও চিঠির উত্তর দিল না। সাত আট দিন আমি অপেক্ষা করলাম। সাত আট দিন আমার চোখ দিয়ে জল পড়ল। আমার স্বামী ভাবলেন, ছেলের জন্য মন কেমন করছে। তারপর আমি ভুলে গেলাম।

 

উনিশ শ’ পঞ্চান্ন সালের মার্চ মাস থেকে আমরা কলকাতায় চলে এলাম। কুড়ি বাইশ বছর আগে যখন কলকাতা থেকে চলে যাই তখন এখানকার বিদ্বৎ সমাজের চেহারা অন্য রকম ছিল। এত ভীড় ছিল না। গুণী ব্যক্তির গুণ প্রকাশের সুযোগ ছিল, লেখকদের পত্রিকার আপিসে চাকরী নিতে হত না লেখা ছাপাবার জন্য। মহিলা লেখিকাদেরও সম্পাদকের সঙ্গে গল্প করবার জন্য পত্রিকার আপিসে ছুটতে হত না। শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত সর্বত্রই ভীড় কম তাই পথ সোজা। এই কুড়ি বছরে সব বদলে গেছে। এখন সাম্যবাদের প্রকোপে মুড়ি মিছরির সমান দর। বন্যার জলের মতো শিক্ষাক্ষেত্রে, সাহিত্যক্ষেত্রে, রাজনীতিতে মানুষ ঢুকছে যারা শিক্ষাকে শিক্ষার জন্যই, শিল্পকে শিল্পের জন্যই শ্রদ্ধা করতে শেখে নি, যাদের অন্তরে কবিতার ঝঙ্কার নেই তবু কবিতা লেখে, এই জগতে আমি বিচ্ছিন্ন বোধ করি কারণ আমি আগন্তুক। তবু আমায় লোকে চেনে জানে, আমি কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত, আমার কর্মজীবন প্রসারিত হচ্ছে বিছু সত্ত্বেও।

উনিশ শ’ ছাপ্পান্ন সালে আবার ইয়োরোপ গেলাম—এইবার আমি শেষ বারের মত ইয়োরোপে ওর কথা শুনলাম। একটা বিরাট সভাগৃহে আমি রোস্ট্রাম থেকে নেমে আসছি একটি অল্প বয়সী মেয়ে, কোকড়া চুলে ঘেরা সুন্দর মুখ, আমার দিকে এগিয়ে এল, “তুমিই অমৃতা?”

“আমার নামটা তো বেশ ভালোই উচ্চারণ করেছ!”

“হ্যাঁ তোমাকে তো জানি।”

“ও বুঝেছি। তুমি মির্চা ইউক্লিড নামে কোনো লেখককে চেন? বলতে পার সে কোথায়?”

“না তো। ও নামে কাউকে চিনি না।” তারপর একটু থেমে বলল, “ও হ্যাঁ সে মরে গেছে।”

অনেক সময় মৃত মানুষ জীবিতের চেয়ে সুখ দেয় কিন্তু আমার বুকের ভিতরটা ধ্বক ধ্বক করছে। মরেই গেল! একেবারে শেষ? মরার পর তো আর কিছু থাকে না, আমার তো একবার জিজ্ঞাসা করা হল না, আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কেন করল? আমি যে ভেবেছিলাম একদিন না একদিন তাকে আমি ধরবই।

যখনই আমি ওর কথা ভাবি আমার পার্থিব মনটা, যে মনে বুদ্ধিবৃত্তি কাজ করছে, যে মন সংসারে সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করছে, সেই সজাগ স্বার্থপীড়িত মন বলে, বিশ্বাসঘাতকতা নয় তো কি? ঢিলটি পড়লে সারমেয় যেমন দুই পায়ের মধ্যে লাঙ্গুল ঢুকিয়ে চলে যায় তেমনি বাবার একটি ধমক খেয়েই যে পালিয়েছে তার মনুষ্যত্ব আছে? ধিক্ তার বিদ্যাচর্চায়, পুঁথির উপর আমার শ্রদ্ধা নেই, মানুষ পুঁথির চেয়ে বড়। তারপরে আর একটু নিচে যে মন আছে সে বলে, রাগ করছ কেন, হয়ত তোমায় চিঠি লিখেছে তুমি পাও নি, আর হয়ত তোমার চিঠিও তার হাতে পৌঁছয় নি। আর তারও নিচে গভীরে গুহায়িত আর একটা মন আছে যাকে যুক্তি স্পর্শ করে না—সে বলে ঘটনা দিয়েই কি সবকিছু বোঝা যায়, তর্ক করে কি সত্যকে পাওয়া যায়, তুমি নির্বিচারে এই হৃদয়রাজ্যে কান পেতে শোনো সত্যের প্রতিধ্বনি বাজছে—সে কখনো ছলনা করে নি। ভেরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে—

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কি করে মরে গেল? ওর তো মরবার বয়স হয় নি।”

ভেরা বলল,“না ঠিক মরে নি, অর্থাৎ আমাদের কাছে মরে গেছে, ফ্যাশিস্ট হয়ে গেছে।”

ফ্যাশিস্ট হয়ে গেছে! হাসি পাচ্ছে আমার, ওকে দেখতে পাচ্ছি হিটলারের মতো গোফ রেখেছে। গ্যাস চেম্বারের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। খুব মানিয়েছে চিঠির উত্তর না দিয়ে দিয়ে ঐখানেই তো বার বার পাঠাচ্ছে আমায়। ফ্যাশিস্ট বৈকি!

 

ওর নাম আর শুনি নি অনেক দিন! উনিশ শ’ আটান্ন সালে কলকাতার বাইরে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে কাজ করছি। আমি একটা বই লিখবার জন্য পড়াশুনো করছি। আমি ভালো একটা কাজ পেয়েছি, আনন্দে আছি। কাজ না থাকলেই আমার মন ভেঙে যায়—কোথা থেকে যেন আকাশজোড়া হাহাকার নেমে আসে। তাই যা কাজ হাতের কাছে পাই হাত লাগাই। লেখার কাজ তো সর্বোৎকৃষ্ট। মাইল দুই দূরে আমার মা ও ভাই থাকেন, আমি সেখানে আছি কিছুদিনের জন্য।

একদিন আমি নিবিষ্ট মনে লিখছি, সত্যেনবাবু ঘরে ঢুকে একটা তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে বসলেন। প্যারিসে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সে কথা হল, তারপর হঠাৎ বললেন, “ইউক্লিডের লেখা বইটা আমি পড়েছি।” আমি চুপ করে আছি। ওর নামটা শুনলেই আমার যা হয় তা যারা কাঠিফড়িং দেখেছে তারা বুঝতে পারবে। পোকাটা বেশ ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে, হঠাৎ একটু যদি ছোয়া লাগে বা পাতাটা নড়ে যায় অর্থাৎ ও যেখানে আছে সেখানে যদি সামান্য স্পন্দন হয় তাহলে ওর হাত পা তৎক্ষণাৎ শক্ত হয়ে একটা শুকনো ডাল হয়ে ঠক করে পড়ে যাবে। আমার অবস্থা তাই হয়। ওর প্রসঙ্গ উঠলেই আমার রক্তমাংসের শরীর বদলে সহসা ঠিক সেই রকম হয়ে যায়। আমি একখণ্ড কাষ্ঠপুত্তলী হয়ে গেলাম। সত্যেনবাবু বলতে লাগলেন, “বইটা পড়ে বুঝতে পারলাম, আপনি রবিঠাকুরকে ভালোবাসতেন?” আমি নিরুত্তরে শুনে যাচ্ছি, ওটা ছিল মন্তব্য, এবারে তিনি একটা প্রশ্ন করলেন, “তাহলে বাবার উপরে রাগ করেছিলেন কেন?” আমি বইটা ভাজ করে উঠে পড়লাম। এই ব্যক্তিকে আমি অন্তরের সঙ্গে শ্রদ্ধা করতাম কিন্তু আজ আমি অবাক হয়ে গেছি।

“দেখুন সত্যেনবাবু, আপনি খুব পণ্ডিত ব্যক্তি, বোধ হয় সেই কারণেই মানুষকে অপ্রস্তুত করতে আনন্দ পান।”

আর একটুও সেখানে না দাঁড়িয়ে আমি বাড়ি ফিরলাম। সাইকেল-রিক্সতে দু’মাইল পথ ফিরছি, সন্ধ্যে হয়ে আসছে, ফিকে অন্ধকার ক্রমে গাঢ় হচ্ছে, অতীত ভাববার চেষ্টা করছি, কিছু মনে আসছে না, মনে হয় সমস্ত অতীত জীবনের উপর সন্ধ্যা নেমে আসছে। আমি ভাবি পথের প্রান্তে তো পৌঁছে গেলাম আর কেন পিছন দিকে তাকান, এ সংসারের জন্য, ভাইবোনদের জন্য আমার সাধ্যমতো, বুদ্ধিমতো যা করার ছিল করেছি, এখন যে যা বলে বলুক সামনের পথ প্রশস্ত হোক আমার, অনেক কাজ করব আমি, অন্যায়ের সঙ্গে, অবিচারের সঙ্গে লড়ব—কিন্তু কাজের সুযোগ কৈ? সর্বত্র বাধা, এত কাজ আছে কিন্তু কর্মক্ষেত্র কণ্টকময়। তবু অতীতের অসম্পূর্ণতা যেন ক্ষুন্ন না করে আমায়।।

বাড়ি ফিরে দেখি দরজার কাছে মা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। মাকে দেখেই আমার মাথার ভিতর রাগ দপ দপ করে উঠল, এই মহিলাটির জন্যই যত দুর্ভোগ। আমার জীবনটি নষ্ট করেছিলেন, কারণ ‘উনি’ কষ্ট পাবেন! উনি যা চাইবেন তাই করতে হবে, খোকার হাতে মোয়া দিতে হবে। অন্য লোকের দুঃখ সুখ কিছুই না। তারপর তাও সামলাতে পারলেন না। দশ বছর ধরে একটু একটু করে ঘর ভাঙলো, ইনি আগুনে আঁচল চাপা দিয়ে ভাবছেন সব ঠিক হয়ে যাবে। নিজের জীবন নষ্ট করলেন, বাবারও, সকলেরই, অকর্মণ্য! সংসারে বুদ্ধি করে যারা চলতে পারে না, যারা প্র্যাকটিক্যাল নয়—তাদের ভালোত্ব শ্রদ্ধনীয় নয়–।

এখন আবার ইনি গর্ব করেন আমার ভালো বিয়ে দিয়েছেন। কি ভালোই বিয়ে দিয়েছিলেন! যদি এই বিয়ের ভালো পরিণাম হয়ে থাকে তবে তার কৃতিত্ব আর যেই করুক মা দাবী করতে পারেন না। অথচ মা ক্রমাগত তাই করেন। সমস্ত জেনেশুনে কেবল স্বামীকে সন্তুষ্ট করবার জন্য আমাকে একটি বয়সে চৌদ্দ বছরের বড় নির্বাক ললাকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে নির্বাসনে পাঠিয়ে আমার সমস্ত সত্তার উপর পাথর চাপা দিয়েছিলেন এই ইনিই। আবার বলেন, “আমার জামাই মহাদেব যোগীপুরুষ, তোর কত জন্মের ভাগ্য এমন স্বামী পেয়েছিস—আবার ট্যাক্ ট্যাক্‌ কথা!’ হতে পারে যোগীপুরুষ। হতে পারে কেন নিশ্চয়ই, অন্য লোককে যে সব গুণ সাধনা করে পেতে হয় তা ওর অমনি পাওয়া, কিন্তু আমি তো গীতার সাধক চাই নি, রক্তমাংসের একটা মানুষ চেয়েছিলাম, একটা মানুষ।

এই সব ভাবছি আর ভিতরটা টম্ব করছে। মা বলেন, “এত দেরী যে।” আমি রেগে উঠলাম। বেচারা কাঁদ কাঁদ হয়ে বলতে লাগলেন, “কথায় কথায় এত রাগিস কেন? তোদের যত রাগ আমার উপর।”

রাত্রে শুয়ে আছি এক ঘরে আমরা, শীতকাল, কম্বল মুড়ি দিয়ে মশারির মধ্যে। রাত্রি অনেক হয়েছে, আমরা দুজনেই জেগে আছি। আমার কাছে বকুনি খেয়ে মার মনটা নিশ্চয় খারাপ হয়ে আছে। হঠাৎ মা বললেন, “রু কাঁদছিস নাকি?” আমি নিরুত্তর। মা মশারি তুলে বেরিয়ে এলেন, “রু কি হয়েছে মা, কাঁদছিস কেন, আমি কি এমন বললাম যে তুই কাঁদছিস?”

“সত্যেনবাবু আমায় অপমান করেছেন।”

“ও মা, সে কি, ভীমরতি নাকি, তোকে আবার কি অপমান করল বুড়ো?”

“না না, সে রকম নয়, আমাকে বললেন কি ইউক্লিডের বই পড়ে উনি বুঝতে পেরেছেন আমি রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসতাম।”

“শোন কথা একবার! যত পডে তত কি বোকা হয় এরা! এ খবর জানবার জন্য তার ইউক্লিডের বই পড়বার দরকার হল।”

আমায় সান্ত্বনা দিলেন মা গায়ে হাত বুলিয়ে। উনি আরো কি বললেন জানো, “তাহলে বাবার উপর রাগ করেছিলেন কেন?” মা চমকে উঠলেন। “বলিস কি? সত্যিই কি তাহলে বেশি পড়লে কেউ কেউ মূখ হয়ে যায়! তোর ঠাকুমা তোর বাবাকে বলতেন ‘পড়য়া পাঠা এও দেখছি তাই। এ দুটো কি এক জিনিস হল? ভালোবাসামাত্রই কি এক? তুই কি কারুর সংসার নষ্ট করেছিস, কারুর সম্পত্তি দখল করেছিস পরিবারকে বঞ্চিত করে, কারু মাথা হেঁট করেছিস সংসারের কাছে? যে ভালোবাসা এ সংসারের বস্তু নয়, তা মানুষকে উন্নত ও পবিত্রই করে! তা যদি না হত তোমার নিজের সংসারে কি তুমি রানী হয়ে থাকতে পারতে! হায় ভগবান এদের কি কিছু বুদ্ধি নেই।”

মা আমার গায়ে হাত বুলাচ্ছেন, “যাক এসব বাজে কথায় তুই কাঁদিসই বা কেন, তুই নিজে তো জানিস কোনটা কি!”

“মা আমি সে জন্য কাঁদছি না—কবির সম্বন্ধে যে যাই বলুক আমার তাতে একটুও লজ্জা হয় না। তার কথা বলে কি আমাকে কেউ অপমান করতে পারে? সে তো নিন্দা লজ্জার অতীত বস্তু। আমি তোমাকে শুধু বললাম।”

“তবে কাঁদছিস কেন?”

আমি তখন দীর্ঘ আঠাশ বছর পরে মার সামনে এই প্রথম ওর নাম উচ্চারণ করলাম। বালিশের থেকে মুখ তুলে উপরের দিকে চেয়ে আমি চিৎকার করে উঠলাম—‘মির্চা, মির্চা, মির্চা’—তারপর আমি কাঁদতেই লাগলাম। মা স্তম্ভিত হয়ে গেছেন, “কি বললি, কি বললি?” সম্ভবত ওর ডাক নামটা মার মনে পড়তেই দেরী হল। এ বাড়িতে সবাই ওকে ইউক্লিড বলেই উল্লেখ করত। মা আমার পিঠের উপর হাত রেখেছেন, “রু, তোর সঙ্গে ওর দেখা হয়েছে নাকি? এতবার যে বিদেশে গেলি, দেখা হয় নিশ্চয়।”

“না, মা, না, সেই যে ও চলে গেল, তুমি আমায় বারান্দায় দাঁড় করিয়ে দিলে, তারপর আর ওকে আমি দেখি নি।”

“তাহলে চিঠি পত্র লিখিস নিশ্চয়ই, যোগাযোগ আছে, সত্যি কথা বল?”

“না, না, না। আমি চিঠি লিখেছিলাম, ও উত্তর দেয় নি।”

মা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন, “সব তোর বাবার জন্য হল। ফ্রেঞ্চম্যান একটা বাড়ির মধ্যে এনে রাখবেন, তারপর আবার—”

আমার হাসি পাচ্ছে—মা কিছুতেই ফ্রেঞ্চম্যানের ধারণাটা ভুলতে পারছেন না।

“কবে চিঠি লিখেছিলি রু?”

“উনিশ শ’ তিপান্ন সালে, প্যারিসে।”

“তা উত্তরই বা দিল না কেন?”

“উত্তর দিলে ভালো হতো? তোমার তাতে আপত্তি নেই মা? তাতে দোষ হত না?”

মা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন—“এখন আর কিছুতেই দোষ নেই রু—তবে চিঠি না লিখে হয়ত মঙ্গল হয়েছে। ফ্রেঞ্চ হলেও খুবই সুবুদ্ধি ছেলে। পাছে তোর সংসারের ক্ষতি হয় তাই হয়ত লেখে নি। ইস্ তোর বাবার জন্য শুধু শুধু এই কষ্টটা পেলি। আর…আর কে জানে কিসে কি হয়, ঐ ছেলেটাকে তাড়িয়ে দিলাম আর ঠিক তার পরের বছর থেকেই কি আমার সংসারটা ভাঙতে শুরু হল!”

এর সাত বছর পরে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে রোগে জীর্ণ ও মনে ভগ্ন হয়ে সম্পূর্ণ চূর্ণবিচূর্ণসত্তা মা মারা গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *