১.২ মির্চা ইউক্লিড আমাদের বাড়ি আসত

এই সব ঘটনা যখন চলছিল, তখন মির্চা ইউক্লিড আমাদের বাড়ি আসত কিন্তু সে সময়ে তাকে লক্ষ্য করি নি। আমার সঙ্গে কোনো কথা হয়েছে বলেও মনে পড়ে না। যেদিনের কথাটা মনে আছে সেটা একটা বিকেল। বাবা তার লেখবার টেবিলে বসেছিলেন। আর উল্টোদিকের একটা চেয়ারে বাবার দিকে মুখ করে সে বসেছিল। বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন—“এই আমার মেয়ে অমৃতা, এই আমার ছাত্র মির্চা ইউক্লিড”–সে উঠে দাঁড়াল। আমি ওকে একপলক দেখলাম। ওর চোখে পুরু চশমা, চুল হালকা, চোয়াল উঁচু, মুখ চৌকো। বিদেশীদের এই অভ্যাসটা আমার খুব ভাল লাগে, মেয়েদের দেখলে ওরা উঠে দাঁড়ায়। আর আমাদের ছেলেরা? হয় তো পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকবে, নয় তো ন্যাকামি করবে, বা এমন ভাব করবে যেন মেয়েদের উপস্থিতি টেরই পাচ্ছে না।

বাবা বললেন, “ইউক্লিড যেখানে থাকে সেখানে ওর খুব অসুবিধা হচ্ছে তাই আমি ওকে এখানে থাকতে বলছি, ওর জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দাও।”

এক মুহূর্তের জন্য আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল, আমি বললাম—“বাবা বাড়িতে আবার একজন ইংরেজ কেন?” বাবা আমার আপত্তিতে বেশ একটু বিরক্ত হলেও খুব সাবধানে বাংলায় বললেন—“এ ইংরেজ নয়, ইউরোপের একটা ছোট্ট দেশের মানুষ। আর ইংরেজ হলেই বা কি, এই তোমার শিক্ষা হল?”

এইবার আমি মির্চা ইউক্লিডের দিকে তাকালাম। বিদেশী নাম সম্বন্ধে আমার তখনও কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। নইলে হয়তো নাম শুনেই বুঝতাম যে ওটা অ্যাংলো–স্যাক্সন নাম নয়—যা হোক চেহারা দেখে বুঝলাম এ ইংরেজ নয়। রঙ যদিও সাদা, চুল কালোই, লালচে নয়,ব্যাকব্রাশ করা, কপালের দুধার দিয়ে উঠে গেছে। গালের হাড় উঁচু, একটু পাহাড়ীদের মতো। সে চকিতে একবার আমার দিকে চেয়ে চোখ সরিয়ে নিল।

আমার আপত্তি অবশ্য ঠিক ইংরেজ বলে ছিল না, কিন্তু এটা বলাই ভালো মনে করে বলেছিলাম। এ সময়ে বিদেশীদের যাতায়াত ও কলকাতার ‘এলিট’দের সঙ্গে মেলামেশার জন্য আমাদের বাড়ির সাজগোজ বদলান হচ্ছিল একটু একটু করে। এ বিষয়ে আমিই অগ্রণী ছিলাম, মা এসব একেবারেই পারতেন না। বাবা আর আমি এগবার্ট এজ নামে একটা নীলামের দোকান থেকে নিত্য নূতন আসবাব নিয়ে আসতাম। দিল্লী কানপুরের পিতলের জিনিস পালিশ করা, দরজার হাতল থেকে ছিটকিনি পর্যন্ত, আমাকেই করতে হতো। এই বাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ আমাদের মতো আধাসাহেবী বাড়িতে যথেষ্ট কষ্টকর ছিল। একে তো বাড়িতে অনেক লোক, তাছাড়া গ্রাম থেকে যখন তখন গ্রাম্য আত্মীয়স্বজন রোগের চিকিৎসা করাতে, গ্রহণের গঙ্গাস্নান করতে, কালীঘাটে পূজো দিতে উপস্থিত হতো সদলবলে। আমার মা কাউকে ফেরাতেন না। রোগ নিয়ে কেউ এলে মা সুপটু নার্সের মতো তাদের সেবা করতেন। মার নিজের কোনোদিন কালীঘাটে যাবার ইচ্ছা ছিল না। মার বাপের বাড়ি সম্পূর্ণ ব্রাহ্মভাবাপন্ন—কিন্তু গ্রামের কোনো বৃদ্ধা আত্মীয়া এলে আমাদের শেভরলে গাড়ি করে প্রতিদিন তাকে কালীঘাট পাঠাতেন—গাড়ি করে ঘড়া ঘড়া গঙ্গাজল আনতেন। মার দরজা সর্বদা সবার জন্য খোলা থাকত। কিন্তু এর ফলটা আমার পক্ষে খুব ভালো হতো না। কারণ আমি অল্প কিছুদিন হল একলার জন্য একটি ঘর পেয়েছি। অবশ্য সম্পূর্ণ একলা নয়—এ ঘরে আমার সঙ্গে রাত্রে শান্তি এবং আমার এগার বছরের ছোট বোন সাবিত্রী অর্থাৎ ‘সাবি’ শুততা। কিন্তু ঘরটা আমারই—আমি ঐ ঘর সুন্দর করে সাজিয়েছি। সব নিচু নিচু আসবাব করেছি—খাটের পা কেটে সেটা নীচু করা হয়েছে। আসবাব অবশ্য সামান্যই। সাদা কালো দাবার ছকের মতো পাথরের মেঝে, পালিশ করা। ধূপ আর ফুলে সর্বদা সুগন্ধি রাখতাম সে ঘর। যে কেউ আসত, বলত—ঘর তো নয়, মন্দির। মাঝখানের দেওয়ালে রবিঠাকুরের একটা ছবি ছিল—মাথায় টুপি পরা—সেই ছবিটা আমার ভারি আশ্চর্য লাগত, ঘরের যে কোণেই তুমি থাক, মনে হবে তোমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এড়াবার পথ নেই।

অবশ্য যখনই দেশ থেকে আত্মীয়স্বজন তাদের পোটলাপুটলি নিয়ে উপস্থিত হতো তখনই আমার ঘর ছেড়ে দিতে হতো, কারণ বাড়ির মধ্যে বাড়তি ঘর ঐ একটাই। তারা দেওয়ালে হাতের ছাপ লাগিয়ে, পর্দায় হাত মুছে, টেবিলে জলের দাগ করে, গ্রহণের স্নানপুণ্যে তৃপ্ত হয়ে যখন চলে যেত তখন আবার আমাকে নূতন করে কাজে লাগতে হতো। মার এ সবে কিছু এসে যায় না। বাহ্যবস্তুর দিকে তিনি তাকান না, মানুষই তার কাছে মূল্যবান। মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে ঘর সাজাতে হবে এটা তাঁর একেবারেই মনে আসে না।

কিন্তু আমার আসে যায়–আমি সাজানো গোছানো বাড়িতে বসে কবিতা পড়তে এবং লিখতে ভালোবাসি। আর ভালো লাগে কাকার কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধের গল্প শুনতে। যে যুদ্ধটা আমাদের চারপাশে চলেছে অথচ আমাদের গায়ে আঁচ লাগছে না। কাকা আমার বাবার জ্যাঠতুতো ভাই, ওদের বাড়িতেই একটু আধটু এদিকে ঝোক আছে। কাকার বড়দাদা জেলে আছেন সেটা আমার খুব গর্বের বিষয়। আমি সহপাঠীদের তার গল্প করি। কিন্তু আমাদের বাড়িতে এসব নেই, অর্থাৎ বাবা এসবের আমল দেন না। আজকে যখন পিছন দিকে তাকিয়ে ভাবি তখন বেশ মনে পড়ে বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষিত উচ্চবিত্ত ললাকেরা সে সময়ে স্বাধীনতার সম্ভাবনার কথা ভাবতেই পারতেন না। একটা কথা প্রায়ই শুনতাম—-“এই করে এরা ইংরেজ তাড়াবে। তাহলেই হয়েছে!” কি করে তাড়াবে সে সম্বন্ধে অবশ্য তাদের কোনো পরিকল্পনা শুনি নি। যাহোক অল্পবয়সীদের মনে এই সব দুঃসাহসিক ঘটনার বৃত্তান্ত মোহ সৃষ্টি করছিল—ডাণ্ডি মার্চ ও দপ্তরে ঢুকে সাহেব নিধনের নানা ঘটনাবলীর উত্তাপ পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়িয়ে আমাদের মনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেত। একটা কাজ আমরা করতে শুরু করেছিলাম, সম্পূর্ণভাবে বিলাতি দ্রব্য বর্জন।

তাই আমার মুখে ওকথাটা নেহাৎ বেমানান ছিল না—“বাড়িতে আবার একজন ইংরেজ কেন?” যদিও কিন্তু আমার আপত্তির আসল কারণ ছিল পাছে এর জন্যও আমার ঘরটি ছাড়তে হয়।

বাবা আমায় নিশ্চিন্ত করলেন, “একতলার সামনের ঘরে ও থাকতে পারবে, ঘরটাকে পার্টিশন করে দিলে সামনের দিকে লোকজন এসে বসতে পারে বা তোর কাকা থাকতে পারে আর ভিতরের দিকে ইউক্লিড থাকবে।”

সেই দিন সন্ধ্যেবেলা ‘ন্যাশনালিজম’ প্রবন্ধটা দিলেন বাবা, বললেন—“এ বইটা বড়। ইংরেজ হলেই কি সে শত্রু? এমন দিন একদিন আসবে যেদিন প্যাট্রিয়টিজম একটা অপরাধ বলে গণ্য হবে।” সেদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত আমি বইটা নাড়াচাড়া করলাম, ভালো করে কিছুই বুঝলাম না। বাবা সব সময় আমাকে এ রকম নাগালের বাইরের বই দিতেন। আমিও না বুঝেই পড়তে ভালোবাসতাম, এই বোঝা না-বোঝার আলোছায়াময় জগৎটা আমার সব সময় ভালো লাগতো। যেন বুঝতে পারছি অথচ পারছি না, অপার রহস্যময় ঘোমটা পরা এই বিশ্বের অধরা ছায়াই তখন আমার কবিতার প্রেরণা ছিল।

দু-তিন দিনের মধ্যেই সমস্ত ব্যবস্থা হয়ে গেল, পার্টিশন করেও ঘরটা খবু ছোট নয়, একটা ছোট খাট, টেবিল, চেয়ার, একটা বড় বেতের সোফা, একটা পিয়ানো ও টুল আর মাঝখানে একটা গোল টেবিলের পাশে দাড় করানো ল্যাম্প—গৃহসজ্জা মন্দ কি? পর্দাও টানিয়েছি একটা গলির দিকের দরজায়। এই ঘরটা আমার ঘরের ঠিক নিচে।

 

সকালবেলা খাবার টেবিলে মির্চা ইউক্লিডের সঙ্গে বাবা নানা বিষয়ে গল্প করতেন, ও কি পড়বে বলতেন। একদিন বাবা বললেন, “তোমরা দুজনে আমার কাছে শকুন্তলা পড়, ‘হিতোপদেশ থেকে সংস্কৃত শিখে লাভ নেই। একটা উপভোগ্য বই হলে ভালো লাগবে।” পরের দিন থেকে আমাদের একসঙ্গে পড়া শুরু হল। মাদুর পেতে মাটিতে বসে সাহেবের সঙ্গে সংস্কৃত পড়া দেখতে সেকালের মানুষদের কেমন লাগত কে জানে! আমি দেখেছি বাবার বাঙালী ছাত্রদের চোখে ঈর্ষামিশ্রিত বিস্ময়, আমি দেখেছি বর্ষীয়সী মাতৃস্থানীয়দের মুখে চোখে সন্দেহ ও আপত্তি আর সমবয়সীদের চোখে কৌতুক। বাবার কিন্তু ভূক্ষেপ ছিল না। মা ও বাবা দুজনেই খবু সহজভাবে ওর উপস্থিতি মেনে নিয়েছিলেন। সে ক্রমে ক্রমে বাড়ির একজন হয়ে যাচ্ছিল।

বাবার কাছে পড়বার সময় আমি ইচ্ছে করেই মাদুরে বসতাম। বাবা বসতেন আমাদের দুজনের মাঝখানে একটা সোফায়। আমি বুঝতাম মাদুরে বসতে মির্চার খবু ভালো লাগছে, একে নূতনত্ব তারপর আমাদের সঙ্গে একাত্ম হবার ইচ্ছা। ও প্রত্যেকটা জিনসি দেখে, খুঁটিয়ে দেখে। আমাদের সব কিছু জানতে চায় আর প্রত্যেকটা ব্যাপারে একটা অর্থ খুঁজে বের করে।

মা বলতেন, “ইউক্লিড খুব ভালো ছেলে, ভদ্র শান্ত বিনীত। তুমি আমায় মা বলো না কেন মির্চা, মিসেস সেন বলল কেন? মা বলবে।”

তারপর থেকে সে মা বলতো। কিন্তু সে আমায় বলেছিল ওদের দেশে এত অল্পবয়সী মেয়েদের কেউ মা বলে না, তারা রাগ করে। আমার মার বয়স তখন কতই বা, বত্রিশ কি তেত্রিশ হবে। কিন্তু লালপেড়ে শাড়ি, কপালে সিঁদুর আর পায়ে আলতা-পরা পরমাসুন্দরী আমাদের মা কেবলই মাতৃমূর্তি, তার বয়সের কথা কে ভাবে! কি জানি, ওদের দেশটা তো ভারি অদ্ভুত, মেয়েদের মা বললে রাগ করে! সেজন্য বয়সের হিসাবের দরকার কি!

সকালবেলা খাবার টেবিল থেকে সকলে উঠে চলে যেত। আমরা বসে বসে গল্প করতাম। তারপর আর একটু উঠে লাইব্রেরীর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে ঘণ্টা দুই কেটে যেত প্রায়ই, কেউ লক্ষ্যই করত না। তিনটে ঘর জুড়ে বাবার সাত-আট হাজার বইয়ের লাইব্রেরী—ঐখানেই আমাদের গল্প চলত। সিঁড়ি দিয়ে বাবা নেমে গেলেন, কিন্তু কিছুই বললেন না, এ রকম কত দিন হয়েছে। এমন কি, আজ্ঞা দিয়ে সময় নষ্ট করছ কেন—তাও নয়। যদি মীলুর সঙ্গে কিম্বা গোপালের সঙ্গে গল্প করতাম তাহলে ঠিকই বকুনি খেতাম। কিন্তু মির্চা ইউক্লিডের সঙ্গে নিশ্চয় শাস্ত্র আলোচনা করছি, পরস্পরের উন্নতি হচ্ছে!

বই হাতে করে আমি উপর থেকে নেমে আসছি মির্চা আমার পথের মাঝখানে ধরল—“তুমি নাকি কাল একটা দার্শনিক কবিতা লিখেছ?”

“হ্যাঁ”—আমার গতকালের কবিতাটি নিয়ে বাবা খুব উচ্ছ্বসিত। ওর মধ্যে একটা লাইন আছে—“কালের যবে হারিয়ে যাবে মুহূর্ত নিমেষ”, এ-লাইনটা বাবার খুব ভালো লেগেছে, এর মধ্যে একটা বিরাট তত্ত্ব সম্বন্ধে প্রশ্ন আছে—প্রশ্নটাই হচ্ছে তত্ত্ব। আমার বয়স যখন চৌদ্দ অর্থাৎ দুবছর আগে, পুরীর সমুদ্রের তীরে বসে আছি সন্ধ্যেবেলা, আমার হঠাৎ মনে হল এটা সকাল—একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল, সেটা আমি কবিতায় লিখেছিলাম-“লহ মোরে, লহ মোরে, মোরে চল লয়ে, আমার এ স্বপ্নস্রোতে যেথা গেল বয়ে। সে দেশটা কি রকম?–‘আশাহীন ভাষাহীন শেষ যেথা সব, পান্থহীন পথ পরে নাহি কলরব। জন্মহীন মৃত্যুহীন নাহি রবে কাল, নাহি রাত্রি নাহি দিন না হয় সকাল! বাবা বলেন ‘কাল’ সম্বন্ধে রু’র অনুসন্ধানী চিন্তা রীতিমত শাস্ত্রমুখী। কাল কি? বাবার এই উচ্ছ্বাসে আমি খুব গর্বিত! কিন্তু যখন বাবা আমাকে নির্দেশ দেন, তুমি এই রকম লিখে আন, তখন আমার ভালো লাগে না। কবিতার স্বাভাবিক গতি বন্ধ হয়ে যায়—একটা ডানা মেলা পাখি ডানা ভঁজ করে পায়ের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে। ভোগপাত্র’ কবিতাটি লিখে তাই আমি খুশী নই।

মির্চা মুচকি হেসে বললে, “তুমি কি দার্শনিক কবিতা লিখবে এতটুকু মেয়ে!”

“আমি মোটেই এতটুকু নই…তাছাড়া আমি তো দার্শনিক।”

“তুমি দার্শনিক?”

“নিশ্চয়ই। যে দেখে বা দেখতে চায় সেই দার্শনিক! আমি তো দেখি, দেখতে চাই।”

“আচ্ছা চল, তোমার কবিতা শোনাবে।”

আমি ওর ঘরে ঢুকলাম। আমি কয়েকদিন হল ওর ঘরে ঢুকছি, কেউ আমাকে বলেনি যে ওর ঘরে ঢোকা ঠিক নয়, তবু পায়ে একটু বাধা আসে। এটা কি? আমি বুঝতে পারি

এই ঈষৎ বাধা আর সংকোচটা কি। আমি স্বচ্ছন্দ নই তবু খুব স্বচ্ছন্দ ভাব দেখিয়ে বসলাম বড় বেতের চৌকিটাতে। মাঝখানে টেবিল তার ওপাশে হেলান দিয়ে ও ওর বিছানায় বসেছে।

“বোঝাও তোমার দার্শনিক কবিতা।”

“না না, আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা বলি শোনো–নতুন তার যে বইটা বেরিয়েছে ওটা তো উনি আমাকে উৎসর্গ করেছেন, সেই কবিতাটি শোন!”

“সে কি? তোমাকে উৎসর্গ করেছেন!”

“অত চমকে উঠলে কেন? পারেন না কি?”

আমি মনে মনে হাসছি, ও বিশ্বাস করেছে, সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেছে, ওকে ঠকাব। পরে কাকার কাছে জানতে পারে জানুক–

“তুমি কি শুনেছ মোর বাণী,
হৃদয়ে নিয়েছে তারে টানি,
জানি না তোমার নাম, তোমারেই সঁপিলাম
আমার ধ্যানের ধনখানি।”

থেমে থেমে অনুবাদ করলাম, অনুবাদ যে কি পদার্থ হল, বোঝা শক্ত নয়। ও ভূকুটি করে রইল। কথাটার ভিতরের অর্থ বোঝবার চেষ্টা করছে। আমি উঠে পড়লাম।

ও বললে, “জানি না তোমার নাম লিখলেন কেন?” ও বুঝতে পেরেছে আমি ধোকা দিয়েছি।

“ঐটাই তো গোপনীয়।”

এই রকম কথাবার্তা মির্চা ইউক্লিডকে বিভ্রান্ত করে, একে ভাষার বাধা তো আছেই দুপক্ষেই-তাছাড়া ভাবের বাধাও। আমরা ঠিক কি ভাবি, ও বোঝে না। সেই না-বোঝার অন্ধকারে ও হাতড়ে বেড়ায়, ওর চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, ওর গলার স্বর কাঁপে—‘ধরা দেবে

অধরা ছায়া…রচি গেল প্রাণে মোহিনী মায়া’—এর মধ্যেও মোহিনী মায়া নেমে আসছে কি? কি জানি!

 

“ঐ মালতী লতা দোলে-পিয়াল তরুর কোলে—” বাড়ির ভিতর থেকে বাইরে যেতে গেলে মির্চার ঘরের সামনের একটা সরু গলি দিয়ে যেতে হয়—ঐ গলির পূর্ব দিকে উঠোন। ঐ উঠোনের থেকে সিঁড়ি দিয়ে গলিতে উঠতে হয় আর খাবার ঘরেও। মির্চার ঘরের ঠিক উপরে আমার শোবার ঘর। বাইরের দিকে অর্থাৎ দক্ষিণের দিকে নিচেও একটা বারান্দা আছে, উপরেও একটা। নিচের বারান্দার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটা মালতী নয়, মাধবীলতা নিচ থেকে উপর পর্যন্ত উঠে গেছে। সেটা বারমাস ফুলে ভরে থাকে, সাদা লাল রঙের মঞ্জরী, আমি ঐ লতাকে দোলাই। ওর ঘরের সামনের গলিটা পেরিয়ে বারান্দার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে ঐ লতাটার আশ্রয়ে এসে পঁড়ালে আমি জানি একটু পরে মির্চা উঠে আসবে, পর্দার ফাক দিয়ে আমাকে আসতে ও দেখেছে। আমি যে ওর জন্য অপেক্ষা করে আছি, সেটা আমি স্পষ্ট করে জানি না, কারণ জানতে চাই না—তবু আমি উৎকর্ণও কেন আসছে না, দেখতে পায় নি কি? কি করা তাহলে, এখানে একটা গান গুনগুন করব, না, কবিতা? কী অন্যায়! কী অন্যায়! এমন তো হওয়া ভালো নয়–যা ভালো নয় তা কখনো করব না, আমি দার্শনিক হব। দার্শনিক যে সত্যাশ্রয়ী, সত্যসন্ধানী। সে কখনো লুকোচুরি করে না, তাই নয় কি? আমি লতাটা ধরে আছি—আমার ভিতরটা মৃদু মৃদু কাঁপছে আশায় ও আশঙ্কায়। এমন সময় রাস্তা থেকে সিঁড়ি দিয়ে খদ্দরের পাঞ্জাবী গায়ে, চটির বিশ্রী শব্দ করে ‘ম’বাবু উঠে এলেন। ‘ম’বাবু আমার এক নিকট আত্মীয়ার দেবর। আমি জানি ওর মনের ইচ্ছাটা কি—ওর সঙ্গে আমি কথা বলি, কারণ ও তো আমাদের একরকম আত্মীয়ই।

“এই যে নমস্কার”

“নমস্কার।”

“আমি সামনের মাসে ইংল্যাণ্ড যাচ্ছি।”

“ভালোই তো।”

“কি জানি কতদিন লাগবে ব্যারিস্টারী পাশ করতে।”

“মন দিয়ে পড়লে বেশিদিন তো লাগবার কথা নয়!”

“মন কি আর দিতে পারব?”

এই সেরেছে! এইবার শুরু হবে স্তবগান। এই সব প্যানপ্যানে খোসামুদে ছেলেগুলোকে দুচক্ষে দেখতে পারি না। এ-রকম বেশ কয়েকটি আছে। মীলু আর আমি খুব হাসি এদের নিয়ে। কিন্তু আজ আমার ভয় করছে। মির্চা যদি বেরিয়ে এসে একে দেখে তাহলে ভূকুটি করবে। মুখ অন্ধকার হবে। ও কি ভেবে নেবে কে জানে!

যা ভয় করেছি তাই। পর্দা সরিয়ে মির্চা বেরিয়ে এল, এক পা এগিয়ে ওকে দেখেই আবার ঘরে ঢুকে গেল। রীতিমত অভদ্রতা। ‘ম’ বাবু কি ভাবল! মহাবিপদ এদের নিয়ে, এরা সবাই সমান। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম, “যান না উপরে, মা উপরে আছেন, এখানে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ব্যাথা করবার দরকার কি?”

“আপনার পা ব্যাথা হয় না? না, কারু জন্য অপেক্ষা করছেন? আমি প্রতিবন্ধক?”

‘ম’ বাবু ভিতরে চলে গেল, আহত, বাণবিদ্ধ।

আমার কান্না পাচ্ছে, খুবই কান্না পাচ্ছে, এদের কথা আমার ভাববার দরকার কি! এরা কে কি ভাবল তাতে কি এসে যায়। আমার কি ভাববার কিছু নেই? কতদিন হয়ে গেল আমি শান্তিনিকেতনে যাইনি।

ওখানে না গেলে আমার মন শান্ত হবে না।’শান্তিনিকেতনে ছাতিমতলায় যে পাথরের ফলকে লেখা আছে—

“তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি।” মহর্ষিদেব ঈশ্বরকে চিনতেন, তিনিই তার প্রাণের আরাম ছিলেন—হবেও বা। আমি তো ঈশ্বরকে চিনি না। বাবা সেদিন থিয়লজিয়ানদের যুক্তি বোঝাচ্ছিলেন-কানের ভিতর যে যন্ত্রটা নিপুণভাবে তৈরী, যে হ্যামার আর এনভিল বসানো আছে, সে কি অমনি হয়েছে? কেউ তো করেছে, সে কে? এটাই একটা ঈশ্বরের অস্তিত্বের অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ। অমন করেও হয়তো ঈশ্বরের প্রমাণ হয়, কিন্তু সে ঈশ্বর কি প্রাণের আরাম হতে পারে? যাকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়,যাকে দেখলে বাতাস মধুর হয়—দূর ছাই, শ্রাদ্ধের মন্ত্র মনে আসে কেন কে জানে–আসলে এটা তো প্রেমের মন্ত্র। সেদিন স্টোর রোডের বড় লাল বাড়িটাতে আমরা গিয়েছিলাম, কলকাতার সব ‘এলিট’রা এসেছিলেন অতুলপ্রসাদ সেনের গান শুনতে, অতুলপ্রসাদ সেন হারমনিয়াম বাজিয়ে গাইছিলেন—“তুমি মধু, তুমি মধু, তুমি মধুর নিঝর, মধুর সায়র আমার পরাণ বঁধু-”উনি নিশ্চয় ঈশ্বরের কথা বলছিলেন। বৈষ্ণবসাহিত্যে বঁধু তো ঈশ্বর, শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর, রাধাও ঈশ্বর। সভায় সবাই চোখ বুজে বসে আছে, কারু কারু চোখ দিয়ে জল পড়ছে—কেন? ওরা কি ঈশ্বরকে বুঝতে পারছে? বাজে কথা, আমি তো জানি ‘এলিট’ হলে কি হবে, একেক জন কি মিথ্যাবাদী আর স্বার্থপর! আমার যতদূর ধারণা মিথ্যেবাদীদের সঙ্গে ঈশ্বরের যোগাযোগ নেই। আর মীলু? ওর কি দৌড় আমার জানা আছে। ঈশ্বর আমারও ধারে কাছে নেই, ওরও না। আমি চোখ বুজলাম—গানটা কিন্তু খবু সুন্দর গাইছেন। ভদ্রলোকের গলায় কি দরদ! দরদ’ কথাটা ভালো, ঠিক মানেটা বোঝায়— আমার কিন্তু ওর মুখের দিকে দেখবার ইচ্ছে নেই—আমিও চোখ বুজে আছি—কি চমৎকার গলা, সত্যিই “বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী” ঐ সুরের আলোয় আমার ভিতরটা উজ্জ্বল, আমি দেখতে পাচ্ছি অন্য একটা দেশ, নিচু একটা বারান্দার ছাতের এক পাশে উঠে গেছে নীলমণি লতা, তাতে গুচ্ছ গুচ্ছ নীল ফুল, ওর ইংরেজী নাম উইস্টেরিয়া—আর বারান্দার টেবিলের উপর ঝুঁকে একজন লিখছেন তার সাদা কোকড়া চুলের উপর ভোরের আলো পড়েছে—তিনি লিখছেন আর গুনগুন করে গান গাইছেন, সে গানটা অন্য, কিন্তু দুটো গান আমার মনের মধ্যে মিশে যাচ্ছে—“তখন অনলে অনিলে জলে, মধু প্রবাহিনী চলে, বলে মধুরং মধুরং।”

দেখ তো, কেন এদিনটা ভুলেছিলাম। আমার পক্ষে একজন মানুষ ছাড়া এমন শান্তির উৎস, প্রাণের আরাম আর কেউ নেই—থাকতে পারেনা, হওয়া উচিত নয়। আমার ভিতরটা কাঁপছে, মনে হচ্ছে নিজের কাছে যেন সত্যভঙ্গ করছি! কি সে সত্য? আমি জানি না, জানি না।

মির্চার কাণ্ড দেখেছ! অভদ্র, অভদ্র। ওর ঘরের সামনে দিয়ে ‘ম’ বাবু চলে গেল তবুও বেরিয়ে এল না—আমিও ওর ঘরে যাব না। আজ এ-প্রতিজ্ঞাটা রাখব, রাখবই রাখব। তাতে ওর সঙ্গে যদি একেবারে বরাবরের মতো কথা বন্ধ হয়ে যায় তাও ভালো। আমি অন্যমনস্ক হয়ে মাধবীলতা থেকে একটা বড় গুচ্ছ ছিড়ৈ নিয়ে উপরে যাব বলে এগিয়ে গেলাম। ওর ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে পর্দার ফাক দিয়ে দেখি তিনি নিবিষ্ট মনে বই পড়ছেন—কে সামনে দিয়ে এল বা গেল দেখতেই পাচ্ছেন না! আমি পর্দাটা ফাক করে ফুলটা ছুঁড়ে দিয়ে এগিয়ে চলেছি—পিছন থেকে ওর ডাক শুনতে পেলাম—“অমৃতা! অমৃতা!”

“মা…মা…মা…” ডাকটা যেন মহাসিন্ধুর ওপার থেকে ভেসে এল। মহাসিন্ধু নয়, মহাজগৎ থেকে, সামনে তাকিয়ে দেখি আমার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমার হাতটা টেলিফোনের উপর—টেলিফোন বাজছে—“মা তুমি টেলিফোনটা তুলছ না কেন?” বহু কষ্টে টেলিফোনটা তুললাম—আমার হাত অসাড়, আমি অস্থির, একই সঙ্গে একই মুহূর্তে এত দূরত্ব পার হওয়া যায়? আমি তো এখানে ছিলাম না, কখনই নয়।

এটা স্মৃতি নয়। আমার শরীর এইখানে চেয়ারে নিশ্চয় পড়েছিল কিন্তু আমি মহাকালে অনুপ্রবিষ্ট, যার সামনেও নেই পিছনেও নেই। যেখানে নাহি রাত্রি, নাহি দিন, না হয় সকাল’। এই শরীর ও মনের বিচ্ছেদ, এই একই সঙ্গে দুই সময়ে, অর্থাৎ আমরা যা দুই সময় বলে দেখতে অভ্যস্ত, সে-রকম দুই সময়ে উপস্থিতি নিশ্চয় শরীরকে আঘাত করে। তাই আমি অবসন্ন। আমার ছেলের বয়স ত্রিশ বছর, সে একজন বয়স্ক মানুষ, ছেলেমানুষ নয়, সে কি ভাবছে কি জানি কিন্তু ও ওর বাবার মতো, না বললে কিছুই জিজ্ঞাসা করবে না। আস্তে আস্তে ও ঘর থেকে চলে গেল। আমি ওর অপসৃয়মান মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছি! কে গেল, কোথায় গেল, এর পরে কি, বুঝতে পারছি না। লেখা এসে টেলিফোনটা তুলে নিল আমার হাত থেকে–ওপারে কেউ ছিল—তাকে বলল, “মা তো শুয়ে পড়েছেন, তার নম্বরটা নিল। এখন আমি সব বুঝতে পারছি—ঐ লোটার সঙ্গে কথা বলার দরকার, কিন্তু ভালোই হয়েছে। কি কথা বলব, যদি ভুল হয়। লেখা বললে, “মা আপনি শুয়ে পড়বেন চলুন। আমি আপনাকে বলছি, আপনি কারুর সঙ্গে কথা বলুন।”

“আমার কিছু হয়নি লেখা, কিছু না।”

“দেখি তুলে তার বুকের আচ্ছাদন,
সেখানে এখনও বাস করে কিনা মন,
হন্যমান এ শরীরের মাঝে যার
অজর অমর সত্তার সম্ভার
পদে পদে গায় অসম্ভবের গান,
তাই শুনতেই আজো পেতে আছি কান”

অসম্ভব, অসম্ভব। জীবন কী অসম্ভবের সম্ভাবনায় পূর্ণ—এত কাল পরে কি এমন করে সব মনে আসতে পারে—এত বেদনা নিয়ে, এত রক্তক্ষরণ হয়?…

“মা, কি বলছেন চোখ বুজে মন্ত্র জপ করছেন নাকি?”

“কবিতা, কবিতা, অনেক দিন পরে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছে—

শস্ত্র ঘেঁড়ে না, অগ্নি দহে না যারে
দেখব তারেই অশ্রুর পারাবারে
পাগলের মতো দু-হাত বাড়ায়ে ধরে–
অধরা প্রাণের আবার স্বয়ংবরে
চলো যাই দূরে যেখানে দাঁড়ায়ে কাল
ভেঙ্গে চুরে দিয়ে ঝেড়ে ফেলে জঞ্জাল
শুধু হাতে নিয়ে মুক্ত প্রাণের দীপ
নূতন বধূর কপালে পরাবে টিপ…
সেখানে যাবই যেখানে রয়েছে থেমে
বাসররাত্রি, অবিচল কারু প্রেমে…”

এতক্ষণে বুঝতে পারছি কেন আজ এক বছর ধরে আমার মনে মনে ক্রমে ক্রমে কোথাও যাবার ইচ্ছাটা এত প্রবল, এত দুর্দমনীয় হয়ে উঠছে। কেবল মনে হয় কোথাও যাই, কোথাও যাই, দূরে–অনেক দূরে—আর এখন মনে হচ্ছে এই বারান্দাটা দিয়ে বেরিয়ে আকাশে ভেসে কোথাও চলে যাই—

লেখা বলছে, “শুতে চলুন।”

আমি বলছি, “চলো যাই, চলো যাই, চলো যাই।”

আমি হাসছি। লেখাও হাসছে—“চলুন, শুয়ে পড়বেন চলুন।”

 

রাত্রি অনেক হয়েছে, আমার স্বামী ঘুমোন নি। সেপ্টেম্বর মাসে সেরগেই এসেছিল, আজ অক্টোবর শুরু। এই এক মাস পর উনি লক্ষ্য করেছেন আমি এখানে নেই। কি হয়েছে উনি জিজ্ঞাসা করতে পারছেন না। সেটা ওঁর স্বভাব নয়—এই দীর্ঘ আটত্রিশ বছর আমাদের বিবাহ হয়েছে, এর মধ্যে আমাদের যুক্ত জীবনে কোনো দ্বন্ধ নেই। উনি নিশ্চয় কোনো এক রকম করে জানেন যে এই সংসারে আমি একান্ত সংসারী গৃহিণী হয়েও আমার কিছুটা বাকি আছে—যার খবর উনি জানেন না। তাতে ওঁর কিছু আসে যায় না, কারণ উনি দিতেই জানেন, দাবী করতে জানেন না। আমি জানি ওকে সংশয়ে রাখা উচিত নয়। আমার কিছু বলা উচিত, কিন্তু এতদিন পরে আমি কি বলব? ওর বইটার কথা কি করে বলব? মির্চা, তুমি এত মিথ্যা কথা লিখলে কেন? যা সত্য ছিল তাই কি যথেষ্ট নয়? মিথ্যা কথা লেখা হয়েছে গল্প বাজারে কাটবে বলে। আজকাল তো দেখি অসভ্যতা করলে বইয়ের কদর হয় না—তোমাদের দেশ থেকেই তো রুচিবিকার আমদানি হয়েছে কদর্য, দেহবদ্ধ প্রেমের নির্লজ্জতা। হায় হায়! তুমি শেষটায় আমায় তার মধ্যে নামিয়েছ। সত্যের দায় আমি নিতে পারি, মিথ্যার দায় বইব কি করে? আমার ভবিষ্যৎ আছে, নামখ্যাতি আছে, ছেলেমেয়ে আছে, আমি ভারতীয় নারী, সুনাম নষ্ট হওয়া তো মৃত্যুর অধিক। অপমানে আমার সারা শরীর গরম হয়ে যায়—অমি মুখে চোখে জল দিয়ে আসি। আজ এক মাস হয়ে গেল, একটি রাতও আমি ঘুমোতে পারছি না। ক্রোধের দাহ জ্বলছে। সে জ্বালায় জ্বলছে অনেক কিছু। আজ চল্লিশ বছর ধরে আমার যে মান সম্মান সম্রম, সমস্ত নষ্ট হতে চলেছে—তোমার বইয়ের কুড়িটা এডিশন হয়েছে, বহুজনের সামনে তুমি আমায় বিবস্ত্র করেছ—একে ভালোবাসা বলে নাকি? বইটা আমি পড়িনি তবে যা শুনলাম তাতে তাই তো মনে হচ্ছে বইটা যোগাড় করে পড়তে হবে। কিন্তু পড়ে দেবে কে? ঐ ভাষা তো আমরা কেউ জানি না। আমি যন্ত্রণায় ছটফট করছি। ওর মুখটা মনে করবার চেষ্টা করছি, মুখই যদি মনে পড়ে তবে ঝগড়া করব কার সঙ্গে? আমার ওর মুখ ভালো করে মনে পড়ছে না—সে যে অনেক দিন হয়ে গেল—কেবল দেখি পার্টিশনে হেলান দিয়ে ও বসে আছে, ওর সেই বকের পালকের মতো সাদা পা দুটো।…আমি জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি। আজকাল জানালায় শিক থাকে না, থাকে গ্রীল—ওটা ধরে দাঁড়ান যায় না। উন্মুখ মন যখন জানালা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায় তখন গরাদ ধরে শক্তি পাওয়া যায়। নন্দলালের একটা ছবি আছে, রাত্রির অন্ধকারের আবছা মূর্তি বন্দিনী সীতা একটা গরাদ ধরে আছে—আমার নিজেকে তেমনি মনে হচ্ছে—এই গরাদ খুলে দাও—যাই, যাই, সময়ের সমুদ্র পেরিয়ে, আমার এই চল্লিশ বছরের সংসার ছেড়ে, আমার নাম খ্যাতি কর্তব্য ছেড়ে চলে যাই, চলো যাই, চলো যাই—মির্চা তোমায় একবার দেখতে চাই।

 

আমি বাবাকে বললাম, “রবীন্দ্রনাথ বিদেশে যাবার আগে আমরা কি একবার তার সঙ্গে দেখা করতে যাব না?”

“নিশ্চয়ই, ইউক্লিডও যেতে চায়। তাকে লেখা হল—যথারীতি একদিন পরই উত্তর এল—“তথাস্তু। সকন্যক, সশিষ্য, এসো।”

সে বারে আমরা বড় গেস্ট হাউসে উঠেছিলাম। সকালবেলা উত্তরায়ণে দেখা করতে যাব আমরা তিনজন, আমি মির্চা আর বাবা। আমি আর মির্চা একটু আগে বেরিয়ে পড়েছি, বাগানে টেনিস কোর্টের কাছে পায়চারী করছি, বাবা আর আসছেনই না, সম্ভবত পথে ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গে দেখা হয়েছে—ভালোই হয়েছে, তাতে আমরা ক্ষুন্ন নই। কি সুন্দর সকালটা কলকাতার পর, শান্তিনিকেতন আমাদের দুজনকে যেন আলিঙ্গন করছে, ‘তার আকাশ ভরা কোলে মোদের দোলে হৃদয় দোলে–।

বাবা এলেন, “চল”। আমি বললাম, “আমি পরে যাব, তোমরা যাও। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে আসি-” আমি ওদের সঙ্গে যাব না। আমার একলা কথা বলার আছে। আমি অবশ্য কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি না। এখানে আমার কোনো বন্ধু নেই—আমি দু-তিন দিনের জন্য আসি, তখন আবার কোন্ বন্ধুর সন্ধানে যাব? একটি যে আছেন একাই একশ! মাত্র একশ?

কবির কাছ থেকে এসে বাবা মির্চাকে নিয়ে লাইব্রেরী দেখাতে গেলেন। ও পুঁথির সংগ্রহ দেখবে। জ্ঞানের জন্য ওর আকণ্ঠ তৃষ্ণা। বাবা এই ছাত্র নিয়ে খুব গর্বিত। বাবার প্রদর্শনীতে আমরা দুজনেই দ্রষ্টব্য বস্তু।

কবি বড় জানালার কাছে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বাইরের দিকে চেয়েছিলেন, আমি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে পায়ের কাছে একগুচ্ছ ফুল রাখলাম। উনি হাত বাড়িয়ে দিলেন—“হাতে দাও।”

আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন! মৃদু মৃদু হাসছেন অর্থপূর্ণ হাসি—“কি গো, সাহেবের সঙ্গে কি গল্প হচ্ছিল? কত কথা বলছিলে? কথার ফুলঝুরি। আমি সাহেবকে বলেছি, মেয়েদের কথা খানিকটা বাদ দিয়ে বিশ্বাস করবে। যত পদচারণা তত বাক্যচারণা।”,

“আপনি কি করে দেখতে পেলেন?”

“কেন দেখতে দিতে চাও নি নাকি? তাহলে আর একটু সাবধান হতে হতো।”

আমি লক্ষ্য করলাম জানালা দিয়ে নিচের বাগানের হাতাটা দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ।

“আঃ আমার রাগ হচ্ছে।”

“তাতো হচ্ছেই, কি রকম রাগ?”

উনি আমার কাপড়ের আঁচলটা ধরে বললেন, “একি নীলাম্বরী?” তার পর গান করে, “পিনহ চারু নীল বাস, হৃদয়ে প্রণয় কুসুম রাশ” —আমার কান ঝাঝা করছে, বুক ধ্বক ধ্বক করছে, পরিহাসটা ভালো লাগছে কিন্তু সহ্য করতে পারছি না, মাথাটা সামনে ঝুঁকে পড়েছে, উনি আমার বিনুনীটা ধরে টান দিয়ে মুখটা ঊর্ধ্বমুখী করে দিলেন। আমি চোখ বুজে আছি। ওর চোখের দিকে তাকাবার আমার সাহস নেই—আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। এইবার উনি আমার বিনুনীটা ছেড়ে দিলেন—“দ্যাখো কাণ্ড! কাঁদে কেন?”

আমি যা যা বলব ভেবেছিলাম সব ভুলে গেলাম। কিছু আমার মনে পড়ছে না, আমি ওর হাঁটুর উপর মুখ রাখলাম। উনি আমার মাথায় তার অভয় হস্ত রেখে আস্তে আস্তে বলতে লাগলেন, “অমৃতা তোমার বয়স অল্প। মনটাকে নিয়ে এত নাড়াচাড়া করো না, সেটা স্বাস্থ্যকর নয়। মনটা স্বচ্ছ কাকচক্ষু সরোবরের মতো স্থির রাখ, তার নিচে বহুদূর গভীরতা, কিন্তু এখনই তাকে চঞ্চল করে উত্তাল করার দরকার নেই শান্ত হয়ে থাক। সে মনে বাইরের নানা ছায়া পড়বে সহজভাবে তা গ্রহণ কর, সেই যে আমি লিখেছি—“সত্যেরে লও সহজে’—তোমার নিজের ভিতরে যে মাধুরীলতা আছে দূরে নেমে যাবে তার মূল তার উপরে ফুল ফুটবে। অপেক্ষা কর। এখন উঠে বসো একটু গল্প করা যাক।… তোমার ছাতিমগাছটা কেমন আছে?”

“আমরা তো এখন আর সে বাড়িতে নেই।”

আমাদের আগের বাড়িতে একটা ছোট্ট ছাতিমগাছ ছিল। আমি সেই গাছটার উপর একটা কবিতা লিখেছিলাম, কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের ভালো লেগেছিল। মির্চা সেই কবিতা শুনে অবাক, বলে ‘প্যানথীঈজম’। প্যানথীঈজম, বস্তুটি কি তখন জানতাম না। গাছের সাথে একটি মেয়ের প্রেমের কথাটিকে এই লাইনটা ওকে ভাবিয়েছিল, এর অর্থ কি? এটা যে কোনো ইজম নয়, কেবল মাত্র কবিত্ব, তা ও বুঝতে পারে না।

সেদিন গেস্ট হাউসে ফিরে বাবার কাছে প্রচণ্ড বকুনী খেলাম, দেরী করেছি বলে—দেরী হওয়াতে কিন্তু কিছুই ক্ষতি হয় নি—ট্রেনও ফেল করব না, বা কারু কোনো বিপদও হচ্ছে না। তবু হঠাৎ চটে গেলেন। বাবা যখন রেগে যান তখন কোনো জ্ঞান থাকে না। আমাকে এত বকতে লাগলেন যে আমি অপদস্থ বিপর্যস্ত হয়ে গেলাম, মির্চাও করুণভাবে আমার অবস্থা দেখতে লাগল। সকালবেলার সুন্দর সুরটা কেটে গেল। সুর কাটতে, তাল ভাঙ্গতে, বাবার জুড়ি নেই—ইন্দ্রসভা হলে ওর মর্তে নির্বাসন হতো। কিন্তু এটা তো ইন্দ্রসভানয়—ওরই নিজের সংসার। এখানে সকলকেই মাথা নিচু করে সয়ে যেতে হয়।

সেদিন ট্রেনে উঠে বাবা ক্রমাগত শান্তিনিকেতনের নিন্দা করতে লাগলেন, ‘এ প্রতিষ্ঠান টিকবে না, টিকতে পারে না, কবি যেদিন চক্ষু বুঝবেন তার পরদিনই উঠে যাবে। মির্চা চুপ করে শুনছে, মাঝে মাঝে সায়ও দিচ্ছে। বাবা আরো বলে চলেছেন—এইবার প্রতিষ্ঠান ছেড়ে কাব্য নিয়ে পড়েছেন, প্রার্থনা কবিতার ঐ লাইনটা দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়, অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়’—ঐ চরিতার্থতা’ শব্দটা নাকি যথেষ্ট কাব্যগন্ধী নয়। ওটার প্রয়োগ একেবারে ভালো হয় নি। তা হতে পারে। আমি এখন কাব্যবিচার শুনতে চাই না। আমি রেলগাড়ির জানালায় মাথা রেখে ওদের দিকে পেছন ফিরে বসে দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে রয়েছি। রেলগাড়ির চাকা ধ্বধ্বক চলেছে। গাড়ির চাকা কথা বলে, গান করে। আমার মনে একটা গান গুন গুন করছে–কোন দূরের মানুষ যেন এল আজ কাছে…তিমির আড়ালে…এ…এ… নীরবে দাঁড়ায়ে আছে’—তখন রবীন্দ্রনাথের গান এত শোনা যেত না, ক’জন গাইত? হঠাৎ কখনো ওর গান শুনলে বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠত—এ গানটা মাত্র গত সপ্তাহে শুনেছি, কালিদাসবাবুর কাছে। কালিদাসবাবু খুব মিষ্টি গান করনে। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম, উনি সেকালের ঠাকুরবাড়ির গল্প করেন— আমি প্রায়ই বিকেলে ওখানে যাই। সেদিন তিনি ছিলেন না অপেক্ষা করে করে সন্ধ্যা হয়ে গেল, তাই কালিদাসবাবু আমায় পৌঁছে দিয়ে গেলেন। রমেশ মিত্র পার্কটা পার হতে হতে গুনগুন করে উনি গাইছিলেন—“বুকে দোলে তার বিরহব্যথার মালা গোপন মিলন অমৃত গন্ধ ঢালা’—আমার কানে সুরটা রয়েছে আমি গুনগুন করে গলায় তোলবার চেষ্টা করছি। তিমির আড়ালে…রেলের চাকা বলছে…নীরবে দাঁড়ায়ে আছে। বাবা উঠে বাথরুমে ঢুকলেন—মির্চা এসে আমার পিছনে দাঁড়াল,“অমৃতা”

“বলো—”

“এদিকে তাকাও”-“আমি ঘুরে বসে ওর দিকে তাকালাম—ও স্থির অপলক আমার দিকে চেয়ে রইল সম্মোহিত দৃষ্টি। আমি দেখতে পাচ্ছি ওকে, এখনও ঠিক তেমনি দেখতে। পাচ্ছি—ওপরের বাঙ্কের দড়িটা ধরে একটু ঝুঁকে আমার দিকে চেয়ে আছে। একটু পরে আমরা দুজনেই হেসে ফেললাম।

“কি ভাবছিলে এতক্ষণ?”

“একটা গান মনে করবার চেষ্টা করছিলাম।”

বাবা বেরিয়ে এলেন—“কি বলছিস তোরা?”

“বাবা ইউক্লিডকে ঐ গানটা অনুবাদ করে দাও না, আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল সঁঝে।”

“তুমি কর, তুমিই বা পারবে না কেন—” তারপর এ আমার অসাধ্য বুঝে বাবা বলতে লাগলেন, “আচ্ছা, ‘বুকে দোলে তার বিরহব্যথার মালা…গোপন মিলন অমৃত গন্ধ ঢালা’…বর্ষার বর্ণনায় বিরহের কথা আসতেই হবে বর্ষা বিরহীর মনকে সন্তপ্ত করে, পযুৎসুকী করে”বাবা মেঘদূতের কথা বলতে লাগলেন—“এদিকে বলা হচ্ছে, বিরহ ব্যথার মালা’, অন্যদিকে ‘গোপন মিলনের কথা! মিলন ও বিরহ এই দুই বিপরীত ভাব দিয়ে একটা সম্পূর্ণতা বোঝান হচ্ছে।” রবীন্দ্রকাব্য বিপরীতের প্রয়োগ সম্বন্ধে বাবা খুব ভালো করে বলতে লাগলেন।

কিন্তু আজকের দিনে এই দ্বিতীয়বার তাল কাটল। এত কথার দরকার কি—আজ যে মুহূর্তে মির্চা আমার চোখের দিকে তাকিয়েছে আমি বুঝতে পেরেছি বিরহ ও মিলন একসঙ্গে কি করে থাকে, আর তার ব্যাকুলতাই বা কি। আমি ওর ফর্সা গলার উপর সেই অদৃশ্য মালার সুগন্ধ পাচ্ছি…‘গোপন মিলন অমৃত গন্ধ ঢালা’…

 

মির্চা আমাদের বাড়ি আসবার কত পরে আমার ঠিক মনে নেই, ও প্রথম একটা কাণ্ড করল। খাবার টেবিলের এক মাথায় বাবা বসে আছেন, উল্টো মাথায় মা, মাঝখানে মুখোমুখি ও আর আমি। সে আস্তে আস্তে তার পা বাড়িয়ে দিয়ে আমার পায়ের উপর রাখল। আমি পা সরিয়ে নিলাম, আমি ভাবতে চাইলাম দৈবাৎ লেগে গিয়েছে—যদিও আমার শরীর-মন চমকে উঠল, কিন্তু কি আশ্চর্য সেই মুহূর্তে ওর দিকে চেয়ে আমার হঠাৎ মনে হল—এ চলে গেলে আমি বাঁচব কি করে? খাবার টেবিল থেকে সবাই উঠে গেলে আমি জিজ্ঞাসা করলাম—“তোমার পা কি হঠাৎ লেগে গিয়েছিল? তা তো নয়।”

“না, তা নয়।”

“কী স্পর্ধা! কী সাহস! যদি বাবার পায়ে লাগত কি হতো তাহলে?”

“কিছুই হতো না। আমি তৎক্ষণাৎ প্রণাম করতাম।”

“তুমি বুঝতে কি করে?”

“হাঃ, হাঃ, হাঃ, তোমার বাবার পা আর তোমার পা বুঝতে পারব না!” এই বলে সে তার পা দুটো বাড়িয়ে দিয়ে আবার আমার পায়ের উপর রাখল।

তেতাল্লিশ বছর আগের ঘটনা! কী আশ্চর্য! কী বিস্ময়! আমি সেই টেবিলে বসে আছি—আমি ওকে দেখতে পাচ্ছি। ও একটা পাঞ্জাবী পরেছে, ওর বুকটা খোলা, ওর ফর্সা গলাটা আমি দেখছি—ওর হাত দুটো টেবিলের উপর, আমার হাত ধরবার ওর সাহস নেই। আমি পা দুটো সরিয়ে নেবার চেষ্টা করছি—পারছি না, পারছি না, একি অন্যায়! একি পাপ? কি করি এখন? মা বলেছিলেন অনাত্মীয় কোনো পুরুষ মানুষকে ছোঁবে না, তাহলে শরীর খারাপ হয়ে যায়—কথাটা ঠিকই। আমার শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে কিন্তু ও পা সরাচ্ছে না—আমার পায়ের উপর তা দৃঢ়সংবদ্ধ, এখনও, এই এখানে, এইখানেই–

আমার কপালের উপর একটা ঠাণ্ডা হাত কে রাখল, আমি যুগান্তরের ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। পাশে দাঁড়িয়ে আছে লেখা। সে আস্তে আস্তে বললে, “মা আপনার এমন কেউ নেই, যাকে মনের কথা সব বলতে পারেন? বোনকে, মেয়েকে, বন্ধুদের? আপনার কি হয়েছে কাউকে না বললে তো হবে না।”

 

স্বাধীনতাযুদ্ধের নানা রকম হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে, হিংস্র এবং অহিংস দুই-ই। প্রেসিডেন্সি কলেজে হাঙ্গামা লেগেই আছে। একদিন ছেলেরা অধ্যক্ষ স্টেপলটনের রক্ত চেয়েছিল। আজকালকার মতো সে রকম ঘটনা তখন হামেশা ঘটত না। যদিও বাবার সাথে স্টেপলটনের শতা খুবই, তবুও সেদিন তিনি তাকে বাচিয়েছিলেন। কলেজের হাতার মধ্যে পুলিশের গুলিতে একটি ছেলে আহত হলে ক্রুদ্ধ ছাত্রের দল কলেজ ঘিরে ফেলে। তখন পুলিশ চলে গেছে, ছাত্রদের দাবী ঐ আহত ছেলেটির রক্তের সঙ্গে স্টেপলটুনের রক্ত মেশাতে হবে। তখন বাবা মধ্যস্থতা করেন যে স্টেপলটনকে নিরাপদে বের করে নিয়ে আসবেন যদি তিনি ঐ আহত ছেলেটির কাছে ক্ষমা চান। সে সময়ে ঐটুকুতেই হতো। স্টেপলটন রাজী হলেন, তারপর গাড়িতে উঠেই অন্য মূর্তি, বলেন কি আমি পরে ক্ষমা চাইব। বাবা তখন বললেন, “ঠিক আছে তাহলে আমি এখনই নেমে যাচ্ছি, তুমি ছাত্রদের সঙ্গে বোঝাঁপড়া কর।” স্টেপলটন বাবাকে কিছুতে ছাড়বেন না। উনিও নেমে যাবেনই, তখন তিনি তাঁর কোট ধরে ঝুলে পড়লেন, বাবা নিরুপায় হয়ে কোটটি খুলেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই কোট ধরে ঝোলার হাস্যকর ব্যাপারটি বাবা সেদিন খাবার টেবিলে সবিস্তারে বলে আমাদের খুব হাসিয়েছিলেন। মির্চা তখনই ঠিক করল যে পরের দিন রেভলিউশন’ দেখতে যাবে।

বলা নেই কওয়া নেই সকালে সে বেরিয়েছে, সারাদিন কেটে গেল, সবাই উদ্বিগ্ন। মা ঘরবাইর করছেন, পরের ছেলে বিপদে পড়ল কিনা। কাকা যখন পুলিশে খবর দিতে যাবেন এমন সময় মূর্তিমান এসে হাজির, ধূলি-ধূসরিত, সারাদিন ঘুরে উস্কোখুস্কো এবং নিরতিশয় হতাশ। যেখানে সেখানে পিকেটিং হচ্ছে ঘুরেছে, পথে পথে ঘুরেছে বিপদের সন্ধানে কিন্তু কোনো বিপদ হয়নি। উপরের জানালা দিয়ে কেউ একজন একটা দই-এর ভঁড় ফেলেছিল, সেটাও ওর গায়ে পড়ল না, পড়ল কিনা সামনে। এমন কিছু ঘটল না যাতে দেশে ফিরে গিয়ে কোন চিহ্ন দেখাতে পারে। ওর ভয়, দেশে সবাই বলবে, ভারতে যখন রেভলিউশন হচ্ছিল তখন তুমি কোন গর্তে লুকিয়েছিলে? সে যে ভারতে এসেছিল এটা নিজের দেশের লোককে কি করে বিশ্বাস করাবে এই ওর এক ভাবনা। কারণ ওর দেশ থেকে এই প্রথম কেউ ভারতে এসেছে। এদিকে চামড়াও যথেষ্ট রোদে পোড়া হচ্ছে না। তাই একদিন সকালে উঠে একটি মাদুর নিয়ে ছাতে চলে গেল, সেখানে মুখের উপর একটা ভোয়ালে চাপা দিয়ে বেলা দুপুর অবধি শুয়ে রইল। তারপর বিকেলবেলা তার সারা গায়ে ফোস্কা পড়ে গেল। আমরা ছোটরা খুব হাসছি, বিশেষ যে সহানুভূতি আছে। তা নয়। মা খুব উদ্বিগ্ন, এ ছেলে তো পাগলামি শুরু করেছে। ইয়োরোপের একটি দুরন্ত ছেলেকে সামলোনো কঠিন, বিশেষ করে ভাষাটাও তেমন রপ্ত নেই। চাঁদসীর মলম এল। মা দেখিয়ে দিলেন, কাকা লাগাতে লাগাতে মার ভর্ৎসনাগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ করতে লাগলেন।

বাবা পরে ওকে বোঝালেন, “দেখ মির্চা, তুমি যে ভারতে এসেছ তা তোমার কথা শুনেই সবাই বুঝতে পারবে, তোমার ভিতরেও পরিবর্তন আসবে। সেটাই তো আসল। গায়ের রং ব্রাউন তো অন্যত্রও রোদে শুয়ে থেকে করা যায় কিন্তু আসল পরিবর্তন করবে ভারতীয় দর্শন, তুমি যা পড়েছ তাতেই রূপান্তর হবে।

তাছাড়া রেভলিউশন? রেভলিউশন দেখার জন্য দৌড়াদৌড়ি করে লাভ নেই। ভারতে এখন সর্বত্র রেভলিউশন হচ্ছে। পিকেটিং আর কাঁদুনে গ্যাসই কি একমাত্র দ্রষ্টব্য বস্তু? এই যে তুমি আমাদের বাড়ি আছ, এটাই তো একটা রেভলিউশন-“আমার বাবার বাড়িতে কি থাকতে পারতে? তাহলে আমার স্ত্রী তোমার সামনে মুখ ঢেকে বেরুতেন, আর এই অমৃতা, ছেলেদের কলেজে গিয়ে কবিতা পড়ে, এ কখনো হতে পারত? তোমার বাসন আলাদা হতো, তুমি ছুঁয়ে দিলে ভাত ফেলা যেত—সে এক ব্যাপার, সে অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে আজ এই বাড়িই একটা রেভলিউশন।”

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *