সাহিত্য পরিষদের প্রকাণ্ড সাহিত্যসভা হবে, এখন যেখানে গোখেল মেমোরিয়াল স্কুল সেইখানে। এই প্রথম আমি স্বরচিত গদ্য প্রবন্ধ পড়ব—বিষয়বস্তু সুন্দরের স্থান কোথায়? সুন্দর কি বাইরে আছে? না মানুষের মনে? কথাটা নিয়ে এত ঘোরপ্যাচের দরকার কি? সুন্দর তো বহিবস্তু হতেই পারে না, মানুষই সুন্দর দেখে তার চোখে অর্থাৎ মনে নীলাঞ্জন মায়া। এই প্রবন্ধের জন্য আমি রীতিমত পরিশ্রম করছি—যা লিখছি বাবার পছন্দ হচ্ছে না—যা হোক শেষ পর্যন্ত খাড়া হয়েছে। এখন একটা পরীক্ষা সামনে। ঐ সভায় রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্ব করবার কথা ছিল কিন্তু তিনি আসতে পারবেন না, হায়দ্রাবাদে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এই নিয়ে অকুস্থলে অর্থাৎ সাহিত্যসভায় খুব নিন্দা হবে তার। রবীন্দ্রনাথকে দু-কথা শোনাতে কেউ ছাড়ে না এদেশে। আমি অবাক হয়ে দেখি তার সঙ্গে একটু কথা বলতে, তার কাছে একবার যেতে সবাই উদগ্রীব, সামনে গেলে তো বিগলিত কিন্তু আড়ালে নিন্দা করতে সহস্রমুখ। ওঁর সম্বন্ধে বাবারও অনেকটা এরকম ভাব আছে। বাবা এত পড়েছেন রবীন্দ্রকাব্য, এত আলোচনা করেছেন, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আকর্ষণেরও অন্ত নেই, অথচ সমালোচনা চলে নিরবচ্ছিন্ন, বিশেষ করে আমাকে বিধিয়ে বিধিয়ে শোনানো হয়, যেম আমি তাঁর ‘স্বলন-পতন-ত্রুটির’ জন্য দায়ী।
সভাক্ষেত্রে হলও তাই। নানা অপ্রীতিকর মন্তব্য হল—আমার মনটা বিষণ্ণ, যদিও ঐ দিন আমি খুবই পুরস্কৃত হয়েছি—এতবড় সভায় এর আগে আমি কখনো গদ্য প্রবন্ধ পড়ি নি। কবিতা অবশ্য পড়েছি অনেক, সেনেট হলেও। সেদিন আমিই কনিষ্ঠ সাহিত্যিক, জ্যেষ্ঠা ছিলেন মানকুমারী বসু-মধুসূদনের ভাইঝি। বিধবার থান বাংলা করে পরে খালি পায়ে তিনি সভাস্থ মঞ্চে কবিতা পড়লেন। দুই যুগের কী পরিবর্তন! আমি ভাবলাম মির্চা এ রেভলিউশনটা দেখলে বুঝত।
বাড়ি ফিরে দেখি সে চুপচাপ বসে আছে। এখানে ও একা, বন্ধুবান্ধব নেই আমরা ছাড়া। তাই ওকে বললাম চল বারান্দায় বসে গল্প করা যাবে।
নানা কথার মধ্যে মির্চা হঠাৎ আমায় জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি এত বিষণ্ণ কেন?”
আমি ওকে বললাম সভায় যা যা হয়েছে—সভায় কিভাবে তাকে নিন্দা করা হয়েছে, তিনি কথা রাখতে পারেন নি বলে। এবার বিষণ্ণ হবার পালা ওর। দু-একটা কথার পর বলল—“একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধ মানুষকে তুমি এইটুকু মেয়ে এত ভালোবাস কি করে?”
রাগে আমার কান ঝা ঝা করছে, “কেন? বেশি বয়স হলে মানুষ ভালোবাসা পাবার অযোগ্য হয়ে যায় নাকি?”
ও একটু উত্তেজিত, “দেখো অমৃতা—হয় তুমি নিজেকে চেন না, নয় তুমি নিজেকে ঠকাও, কারণ সত্যকে দেখবার সাহস তোমার নেই, কিম্বা জেনেও মিথ্যা কথা বলছ।”
“মির্চা, আমার অসম্ভব মাথা ধরেছে তুমি একটু চুপ কর।”
বাবা বলেছেন, “রু, তুমি মির্চার কাছে একটু ফ্রেঞ্চ শেখ, ফ্রেঞ্চ না শিখলে একমপ্লিশমেন্ট পূর্ণ হয় না।” বাবা আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। অনাদি দস্তিদার বাড়িতে আসেন গান শেখাতে, রমেন চক্রবর্তী আসেন ছবি আঁকা শেখাতে, একজন গোয়ানিজ মাস্টার ভায়োলীন বাজান শেখাতে! এত বিদ্যা সামলানই আমার দায় হয়েছে, এদিকে আমার কিছু ভালো লাগে না এসব করতে, আমার কোনো অধ্যবসায় নেই কবিতার বই হাতে নিয়ে জানালার ধারে বসে—মন ভেসে যায় কোন সুদুর। যাক, মির্চা আমার কাছে বাংলা শিখবে, আমি ওর কাছে ফ্রেঞ্চ। খুব সাধু সংকল্প নিয়ে পড়তে বসা হয়, পড়া আর এগোয় না। কেন যে এগোয় না কে জানে! ওর ঘরেই আমরা পড়তে বসি, মাঝখানে একটা বাতি জ্বলে, স্ট্যাণ্ডিং ল্যাম্প, কতদিন কত রাত হয়ে যায় বলাকার কবিতা পড়ি আমি, ও শুনতে ভালোবাসে কিন্তু অন্য ভাষায় ঐ কবিতা বোঝানো কি আমার সাধ্য—একটা কবিতা ও বুঝতে পেরেছে, ওর খুব ভালো লেগেছে–
“পাখিরে দিয়েছ গান পাখি গায় গান।
তার বেশি করে না সে দান।
আমারে দিয়েছ স্বর আমি তারও বেশি করি দান
আমি গাই গান।”
মানুষ যা পেয়েছে শুধু সেইটুকুতে সন্তুষ্ট নয়, সে যে সৃষ্টিকর্তা। দুঃখকে আনন্দ করবার ভার তার হাতে।
“দুঃখখানি দিলে মোর তপ্তভালে থুয়ে
অশ্রুজলে তারে ধুয়ে ধুয়ে
আনন্দ করিয়া তারে ফিরায়ে আনিয়া দিই হাতে—
দিনশেষে মিলনের রাতে।”
এ কবিতা আমি পড়ি তবু এর তাৎপর্য বোঝবার বয়স আমার নয়। তবে আনন্দ আর দুঃখ যে মিলে মিশে যায় এটুকু আমি বুঝতে পারছি।
একেক দিন অনেক রাত অবধি আমরা পড়ি; ন’টা দশটা, কেউ কিছু বলেন না বাবা মা কিছু বলেন না কিন্তু আমার নিজের একটা সঙ্কোচ অস্বস্তি হয়, কেউ যদি কিছু ভাবে! আমি দেখেছি ভৃত্যকুলের চোখে কৌতূহল আর আমার এগারো বছরের ছোট বোনের চোখে একটা সন্দেহ ও তীক্ষ্ণতা। মিষ্টি মেয়ে সাবি কিন্তু ওর সব সময় দুঃখ এবং অভিযোগ ওকে কেউ ভালোবাসে না, দিদিকেই সবাই ভালোবাসে। এখন মির্চা ইউক্লিডও সেই দিকে যাচ্ছে এটা ও বুঝতে পারে, তাই সাবি বলছে সেও ওকে বাংলা পড়াবে। ভালোই। ওর কাছে পড়লে তবু বিদ্যা হতে পারে—আমাদের পড়াশুনো তো বিশেষ এগুচ্ছে না। তবু মাস্টারমশাইয়ের কাছে সংস্কৃত পড়া হয়। মির্চা খুব ধাতুরূপ মুখস্থ করছে, ও আমায় হারিয়ে দেবে। ওর মতো অধ্যবসায় আমার নেই।
আমাদের বাড়িতে অনেক লোক একসঙ্গে বাস করি। এরা কেউ ঘনিষ্ঠ আত্মীয় নয়। তবে সেটা আমরা জানি না। সকলেই আপন। ও এটা ঠিকমতো বোঝে না। ওদের দেশে ‘কাজিন’ আর ‘ভাই দুটো কথা। যার সঙ্গে সম্পর্কও নেই সেও যে আমাদের ভাইয়ের মতোই আপন হতে পারে এটা ও বোঝে না। আমাদের যে বসুধৈব কুটুম্বকম্। তাই তো ওকে, সম্পূর্ণ বিদেশী হলেও বাড়ির সকলে এত আপন করে নিয়েছে।
কাকা আমাকে খুব স্নেহ করেন। আমরা যখন মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ি তখন কাকা এসে গল্প জুড়ে দেন। মাস্টারমশাই গৌরমোহন ঘোষকে কাকা খুব ক্ষেপান। একদিন সকালে মাস্টারমশাই কপালে একটা চন্দনের টিপ পরে এসেছেন। গঙ্গাস্নান করে টিপ পরে তাকে বেশ পবিত্র দেখাচ্ছে। কাকা এসে ঝুপ করে হাঁটু গেড়ে বসে কৃতাঞ্জলি হতে বলতে লাগলন, “মাস্টারমশাই আমি বড় পাতকী, একটু পদরেণু”–মাস্টারমশাই বিব্রত হয়ে পা সরিয়ে নিচ্ছেন—“আঃ শ্রীশবাবু কি ছেলেমানুষী হচ্ছে।”
“মাস্টারমশাই পাপীতাপীকে ত্রাণ করবেন না?” কী করুণ আকুতি! আর আমরা দুই ছাত্রছাত্রী হেসে হেসে হয়রান হয়ে যাচ্ছি।
উপরে যেতে আমার মেজমাসী আমার দিকে ভূকুটি করে চাইলেন। উনি গতকাল এসেছেন। গতকাল থেকেই ওর সন্দিগ্ধ দৃষ্টি দেখছি আমি। বিরক্তিকর। মাসী বললেন, “ওই সাহেব ঘোড়াটার সঙ্গে অত কী হি হি করছিলি?”
আমিও দমবার পাত্রী নই। “সাহেব ছোড়া আবার কী? ওর নাম নেই নাকি!”
“এ্যাঃ নাম? একটু বেশি ধিঙ্গি হয়ে পড়েছ। নরেনবাবু মাথায় তুলে সর্বনাশ করছেন।”
মরুকগে, আমি আর এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে চাই না। ওর সঙ্গে তর্ক করে একটা বিশ্রী ব্যাপারও করতে চাই না। পালানই ভালো।
মির্চার ঘরের সামনের সরু গলিটা দিয়ে বেরিয়ে যে বারান্দা সেইখানে ‘চিঠির বাক্স’—ডাকওলা চিঠি দিয়ে যায় বাক্সটা চাবি বন্ধ, চাবিটা আমার কাছে থাকে—আমি দিনে দু-তিনবার ঐ বাক্সটা খুলে চিঠি সংগ্রহ করি। যদিও ডাকের তো একটা বিশেষ সময় আছে, যখন তখন বাক্স খোলার দরকার কি! কিন্তু আমি পারি না, দিনের মধ্যে অনেকবার মনে হয় যাই দেখে আসি চিঠি আছে কিনা। বিশেষত দুপুরবেলায় বাড়ি যখন শান্ত অর্ধস্তিমিত, অবশ্য নিদ্রিত নয়, আমাদের বাড়িতে কেউ দুপুরে ঘুমায় না, সবাই পড়ে, ৩খনই আমার ইচ্ছে করে চিঠির সন্ধানে যেতে। আমি জানি আমি কেন চিঠি দেখতে যাই, আমার তো বুদ্ধি আছে। নিজেকে আর কত ফঁাকি দেব? যদিও মির্চা বলেছে যে হয় আমি বোকা, নয় মিথ্যেবাদী। আমি জানি আমি কোনটাই নয়। আজকে দুপুরবেলা এমাগত মনে হচ্ছে চিঠি এসেছে কি না দেখে আসিবঙ্কিমচন্দ্রের গল্পের সুমতি কুমতির ঝগড়া চলেছে মনের মধ্যে—সুমতি বলছে, কখনো নয়, তুমি চিঠি দেখতে নয়, মির্চাকে দেখতে যেতে চাইছ—সত্যি কথা বল না কেন? আর কুমতি, মিথ্যেবাদী কুমতি বলছে, “পুর তা কেন, একটা চিঠি কারুর আসতেও তো পারে।
আমি উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম খিল লাগিয়ে। খাটের উপর বসলাম—নিজেকে আমার রক্ষা করতে হবে নিজের কাছ থেকেই। মহুয়াটা খুলে বসেছি—
“দূর মন্দিরে সিন্ধুকিনারে পথে চলিয়াছ তুমি–
আমি তরু, মোর ছায়া দিয়ে তারে
মৃত্তিকা তার চুমি,
হে তীর্থগামী তব সাধনার
অংশ কিছু বা রহিল আমার
পথ পাশে আমি তব যাত্রার
রহিব সাক্ষীরূপে–
তোমার পূজায় মোর কিছু যায়
ফুলের গন্ধ ধুপে।”
…এ আমার কথা নয়, এ আমার মার কথা। মা এই রকম ছায়া মেলে আছেন বাবার জীবনের উপরে, সন্তাপহরণ। নিজের জন্য কিছু চান না কিন্তু কি ভালোবাসা, কি ত্যাগ, কি অজস্র সেবা দিয়ে তাঁকে ঘিরে রেখেছেন। বাবার তীর্থযাত্রায় মার দান নিশ্চয় অনেক। মার জীবন উন্নত। স্বার্থহীন দানে পূর্ণ। কিন্তু আমি এটা চাই না। এ জীবন আমার কাম্য নয়। সবলা কবিতা আমার কথা বলেছে। নিজে নিজের ভাগ্যকে জয় করব। ইস্ কি বল—একটুও বল নেই, শক্তি নেই, বুদ্ধি নেই, আমি তো পরাজিত। হঠাৎ আমার কান্না পাচ্ছে—খাটের উপর পড়ে আমি কাঁদছি—“বল দাও মোরে বল দাও, প্রাণে দাও মোর শকতি…তব কাজ শিরে বহিতে সংসারতাপ সহিতে…’ সংসারতাপটা কি? এই যে আগুনের ঝাঁপট আমার শরীরে মনে লাগছে এটাই কি? তাহলে লাগুক লাগুক উত্তাপ—আমি চাই এই উষ্ণতা…‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…’
হঠাৎ কখন নিচে নেমে এসেছি জানি না। দেখি পর্দা তুলে মির্চা দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে, “কি চিঠি পেলে?”।
“নাঃ এল না, কি হতাশ যে লাগছে।”
“কার চিঠির অপেক্ষা কর?”
“কোনো অজানা জনের।”
“সে কে?”
“জানি না, তাকে চিনি না বলেই অপেক্ষা এত মধুর।”
আমি ‘ডাকঘরের কথা বলছি-ও বুঝতে পারছে না, সূকুটি করছে। কি হবে! এক সঙ্গে যদি সারাজীবন থাকতে হয়? অর্ধেক কথা না বলা থাকবে আর ক্রমাগত ডিকশনারী দেখতে হবে। এ আবার কি কথা মনে এল? এর সঙ্গে সারাজীবন থাকব কি করে? এতো কদিন পরেই চলে যাবে। আমারও বিয়ে হয়ে যাবে। কোথায় বিয়ে হবে কে জানে—একটা লোকও মনে করতে পারছি না, যার সঙ্গে সারাজীবন বাস করা সম্ভব।
“ভিতরে আসবে না অমৃতা? তোমার জন্য নট হামসুনের ‘হাঙ্গার’ বইটা এনেছি।
এই প্রথম ও আমাকে একটা কিছু উপহার দিল। আমি ওর হাত থেকে বইটা নিলাম। বইটাতে আমার নাম লিখেছে আর ফরাসীতে একটা কথা ‘আমিতিয়ে—
আমি দাঁড়িয়ে আছি। বসতে আমার সাহস হচ্ছে না। কেন কে জানে? সেও দাঁড়িয়ে আছে—আমি না বসলে তো বসবে না। আমি ওর দিকে পিছন ফিরে পিয়ানোর ডালাটা খুলে দাঁড়িয়ে আছি। আমি কি কিছুর জন্য অপেক্ষা করছি, একটা অসম্ভব কোনো ঘটনা কি ঘটবে? আমি কি তা চাই? ও আমার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আমাকে স্পর্শ করেনি। আমার পিঠে ও হাত রাখতে পারে কিন্তু রাখেনি। মাঝখানে একটুখানি আকাশ আছে, আমরা দাঁড়িয়েই আছি—আমার সর্বাঙ্গে আমি ওকে অনুভব করছি, মনের মধ্যে ওর অস্তিত্বের স্পর্শ লাগছে, এ কি ব্যাপার! আকাশ তো শূন্য নয়, ঈথারে পূর্ণ, ঈথার কি বস্তু আমি জানি না বটে তবু সে-ই নিশ্চয় অদৃশ্য হাতে এ সংযোগ করছে—আমার চারিদিক ওর নিশ্বাসের সুগন্ধে সুগন্ধি বায়ুমণ্ডল—
“সায়ন্তনের ক্লান্ত ফুলের গন্ধ হাওয়ার পরে,
অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ ভরে।”
উপর থেকে কে ডাকলো “রু রু রু——”
“যাচ্ছি”…
মির্চার বয়স তেইশ আর আমার ষোল। কিন্তু বয়সের পক্ষে আমরা দুজনেই একটু বেশী রকম তত্ত্বজ্ঞানী–বাবা আমাকে বলেন, “জ্যেষ্ঠতাত”। তা আমায় ‘জ্যেষ্ঠতাত’ বানাচ্ছে কে? বাবাই তো। আর ওকেও তাই বানাচ্ছেন, সব সময় অষ্টাঙ্গযোগের কথা হচ্ছে।
আর তন্ত্র সম্বন্ধে তো এ বাড়ির সবাই পণ্ডিত। কাকা যখন ওর সঙ্গে তন্ত্র নিয়ে আলোচনা জোড়েন গম্ভীর মুখে ‘হে বজ্রর’ রহস্য বিষয়ে, আমার রাগ হয়ে যায়। আমি তো জানি আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা এর চেয়ে অনেক হালকা সুরে কথা বলে। আমারও খুব পণ্ডিত হ’তে শখ ছিল। কিন্তু এখন কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে মির্চার তত্ত্বে রুচি এত বেড়ে গেছে বলেই। দেখা হলেই বিশ্বসাহিত্য আমায় পড়িয়ে ফেলবে। কাল সারাক্ষণ একটা অদ্ভুত অলৌকিক গল্প আমায় বলেছে যার কোনো মানেই বুঝলাম না। একটা লোকের ফাসির হুকুম হয়, সে যে মেয়েকে ভালোবাসত সে অনেক দূরে থাকে। ফাসির মুহূর্তে তার সেই মেয়েটিকে মনে পড়ল। তারপর দশমাস পরে সেই মেয়েটির একটি ছেলে হল সে ঠিক ঐ লোকটার মত দেখতে। এ গল্পের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। আমার ইচ্ছা একটু স্বাভাবিক গল্প করুক, একটু খোসামোদ করলেই বা দোষ কি? যেমন অন্যরা করে। তা হবার তো নয়ই, উল্টে কাল আমায় খুব রাগিয়ে দিয়েছে, বলে কি, “তোমার কি ধারণা তুমি খুব সুন্দর দেখতে?”
“আমার ধারণা হতে যাবে কেন? আরো অনেকেরই ধারণা।”
“কার কার?”
“চল না আমর সঙ্গে রাস্তায়, দুধারে লোকেরা কিরকম তাকিয়ে থাকে দেখবে।”
“ও সে তো থাকবেই—তোমাদের দেশে যে রাস্তায় মেয়ে দেখাই যায় না। জানো ইউরোপ থেকে এসে সব চেয়ে কি আশ্চর্য লাগে—মনে হয় এদেশে কি মেয়ে নেই?”
“মেয়ে থাকবে না কেন? তারা ফিটন গাড়ি করে যায়—পাল্কী গাড়ি করে যায়—যাদের মোটর আছে মোটরে যায়, হেঁটে হেঁটে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে নাকি?”
“অন্য দেশে ঘোরে।”
“ঘুরুক। তুমি বুঝতে পার না আমি কালো কি ফর্সা? বাবা আমি সাবি মিলু মা সব এক? ঝড়ও আমার মতো?”
“আমি কোনো রঙের তফাৎ বুঝতে পারি না।”
“বেশ আমি চললাম।”
“বসো বসো লক্ষ্মীটি, আমি তোমাকে ভালো করে দেখি, বুঝতে পারি কি না।”
“ইস্ মাইক্রোসকোপ দিয়ে দেখতে হবে আমি সুন্দর কি না।”
“আমি তোমার বাইরেটা তো দেখি না, তোমার আত্মাকে দেখতে চাই।”
এবার আমার ব্রহ্মরন্ধ্র জ্বলে গেছে, জ্যেষ্ঠতাত, এবার জীবাত্মা পরমাত্মার বিতর্ক নিয়ে
আসে। আমি রাগ করে চলে গেলাম। আমার খুবই মন খারাপ হয়ে গেল। আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি, বুঝতেই পারছি না—সত্যই আমি সুন্দর কিনা। আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে—সমস্ত খুঁতগুলো চোখে পড়ছে। মীলু এসে বললে, “কি দেখছিস অত?”
“শোন ভাই আমাদের ভারতবর্ষে কত রকম পোশাক আছে—আমরা সব সময় এক রকম পোশাক পরি কেন? সেই এক হব করে শাড়ি পরা কিংবা বাংলা করে?”
“সত্যিই রাজপুতানীদের ঘাগরা সুন্দর, মারাঠীদের মতো বড় শাড়িও মন্দ নয়।”
মীলু আর আমি কিছুদিন থেকে গয়নার ডিজাইন নিয়ে পড়েছি। আমাদের সময়ে সাধারণত যেসব গয়না তৈরী হতো তা বিলাতী নকশা থেকে খুব কঁচা, অনুকরণ। তার সৌন্দর্য সৌকর্য কিছুই ছিল না। ঠিক সেই সময়টা অর্থাৎ আমাদের দু-তিন পুরুষ আগে থেকে শিল্পরুচির অধঃপতন হয়েছিল। ঠাকুরবাড়িতে তার পুনরুদ্ধার চলছিল। গৃহসজ্জায় বা দেহসজ্জায় খুঁজে খুঁজে পুরানো নকশার জিনিসপত্র, পুরানো ঘঁদের গয়নার চলন হচ্ছিল। তাকে বলা হতো ‘ওরিয়েন্টাল’। এ বিষয়ে স্টেলা ক্ৰামরিশ বিদগ্ধা—আমি আর মীলু সামান্যা নারী, আমরাও কিন্তু পুরানো রাজপুত রূপার গয়না থেকে নকশা নিয়ে, উড়িষ্যার রূপার গয়না থেকে নকশা নিয়ে, গয়না বানাতাম। খুব গয়না বানাতাম আমরা। কিই বা সোনার দাম ছিল, ১৮ টাকা ভরি! তারপর আমরা ঠিক করলাম রূপার গয়নাই বা পরব না কেন? সে সময়ে নিম্নবিত্ত মেয়েরা ছাড়া রূপার গয়না কেউ পরত না। আমরাই শুরু করেছিলাম, পরে খুব চলেছিল। গায়ের খাড়র সঙ্গে মখমলের চটি জুড়ে আমরা জুতো বানিয়েছিলাম, সেই ‘বকচ্ছপ’ বস্তুটি যে খুব চমৎকার হয়েছিল তা নয়, তবে লোকে তাকিয়ে থাকত ঠিকই। সেদিন আমরা ঠিক করলাম উড়িষ্যার মেয়েদের মতো সাজ করা যাক। শাড়ি খাটো করে অনেক গয়না পরা হল, আমার মার একটা সিঁথি ছিল। সিঁথির তিনটে ভাগ। সীমন্তের উপর দিয়ে একটা, আর দুপাশে দুটো হার, চলে গেছে—মাঝখানে একটা লকেট-কপালের উপর ঝোলে। বিয়ের সময় মাকে ঐ সিঁথি পরে দেখে বাবার এমন চোখে লেগেছিল যে সিঁথি সম্বন্ধে তাঁর মোহ ঘুচত না। মা তো আর পরতেন না, কিন্তু কোনো ছুতোয় আমায় ওটা পরাতে পারলে বাবা খুব খুশি হতেন। সেদিন আমি সিঁথি পরেছি, উড়িষ্যার শাড়ি পরেছি খাটো করে। কানের পাশ দিয়ে কদমফুল ঝুলিয়ে দিয়েছি। আর কদমফুলের রেণু আমরা মুখে মেখেছি। আমরা তো আজকাল সাবান মাখি না বিলিতি দ্রব্য ত্যাগ করেছি। মুখে মাখা হতো হেজলিন, আর জনসনের ট্যালকাম পাউডার। তাও আর স্পর্শ করা যাচ্ছে না। আপাতত কদমফুল পাওয়া গেছে, এ বেশ হয়েছে কিন্তু এ তো বেশি দিন থাকবে না।
“ভাই রু, সাবান মাখা ছেড়ে ভালোই হয়েছে-মশুরীর ডাল বাটা মেখে রঙ অনেক ফর্সা হয়েছে তোর।”
“যা যা বাজে কথা বলিস না। তোরা আমার রঙ আর চেহারা নিয়ে কিছু বলবি না। ভীষণ ভুল ধারণা হয়ে যায় আমার। তাতে ক্ষতি হয়।”
“তাই নাকি? আচ্ছা শোন্ পাউডার না হয় নাই মাখলাম—ঠোঁটে একটু আলতা লাগালে মন্দ হতো না।”
“ওরে বাবা, সাহস নেই বন্ধু, সাহস নেই।”
আমি সিঁথিটা পরছি ঠিক করে, আর মেঘদূত আওড়াচ্ছি—
“ভাই মীলু, একটা পদ্ম পেলে সাজটা পুরোপুরি হত।”
“কেন, পদ্ম কি করবি?”
“আরে যে সে পদ্ম নয়, লীলাকমল।”
মীলু মেঘদূত জানে না। “শোন বলছি—
হস্তে লীলাকমলমলকে বালকুন্দানুবিদ্ধং
নীতা লোর্ধপ্রসবরজসা পাণ্ডুমাননে শ্রীঃ
চূড়াপাশে নবকুরুবকং কর্ণে চারু শিরীষং
সীমন্তে চ ত্বদুপগমজং যত্র নীপং বধূনামা্–”
“আচ্ছা কুরুবক কি ফুল রে?”
“বক ফুল বোধ হয়।”
“দুর দুর, তা কখনো হয়। বক ফুল ভেজে খায়, তা নিয়ে কখনো কবিতা হয়?”
“কেন ভেজে খেলে তা নিয়ে কবিতা হবে না কেন?”
“শরৎচন্দ্র ও রবিঠাকুরের বিতর্কটা পড়ো না কেন? যা প্রয়োজনের বস্তু তা নিয়ে কবিতা হবে না।”
“তাই নাকি? সব ফুলই প্রয়োজনে লাগে।”
“যেমন?”
“ফল ধরাবার প্রয়োজন বন্ধু—ফল ধরাবার প্রয়োজন। এই যে তুমি ফুলের মতো…”
‘অ’ ঘরে ঢুকলো–‘অ’ আমার মা’র সম্পর্কিত ভাই কিন্তু বয়সে আমাদেরই কাছাকাছি, তাই আমাদের সঙ্গেও ভাইয়ের মতন সম্পর্ক। ওকে আমরা খুব ভালোবাসি-খুব মিষ্টি স্বভাব, মনোহরণ বাঁশি বাজায়। বাশিটি দোলাতে দোলাতে ঘরে ঢুকে আমাদের সাজ দেখে তার চক্ষুস্থির।
“ব্যাপার কি, চলেছ কোথায়?”
“কেন, বাড়িতে কি একটু সুন্দর হয়ে থাকা যায় না?”
“যায় বৈকি। এখন বলো, সুন্দরের স্থান কোথায়?”
ও আমার প্রবন্ধটার কথা বলছে। তারপর ঘুরে ঘুরে আমায় দেখছে—“এ্যাঃ, সিঁথি পরা হয়েছে।”
মোতিম হারে বেশ বনাদে, সিঁথি লগাদে ভালে—
উরহি বিলম্বিত লোল চিকুর মম বাঁধহ চম্পক মালে।
গানটা করতে করতে ‘অ’ আমার খোঁপা ধরে টান দিল, “খুলে ফেল খোঁপা—” আর সমস্ত কাধ বুক ঢেকে ‘লোল চিকুর মম’ ছড়িয়ে পড়ল। সেই মুহূর্তে আমরা তিন জনে আয়নার মধ্যে দেখলাম—চমৎকৃত তাকিয়ে আছি আমরা–। সন্দেহ নেই, জ্যেষ্ঠতাত ভয় দেখিয়েছে আমায়।
একটার পর একটা ঘটনার মধ্যে আমি আবার কি করে প্রবেশ করছি-কি করে এই কাহিনী লিখতে পারছি–তেতাল্লিশ বছর আগের কথা। দশ বছর আগে কি পারতাম? পনের বছর আগে? কুড়ি বছর আগে? কখনই না, তা হলে তো আমার জীবনই বদলে যেত। এতদিন আমি জানতামই না যে একটা বিয়োগান্ত উপন্যাস আমার সারা জীবনের মধ্যে ধীরে ধীরে অদৃশ্য কালিতে, অব্যক্ত ভাষায়, অশ্রুত স্পন্দনে লেখা হচ্ছিল। জীবনের বেয়াল্লিশটা বছর কেটে গেল, এ দৃশ্যগুলো বন্ধ ছিল। একেবারে গালামোহর লাগিয়ে তালাবন্ধ। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক ধাক্কা লেগে বুঝতে পেরেছি ভিতরে কিছু জমা আছে, তার বেশি নয়। সেদিন হঠাৎ সেরগেই-এর মুখের একটি কথা— Mircea, Mircea, Mircea, I have told my mother that you have only kissed me on my forehead”—একটি ভীত বালিকার মিথ্যাভাষণ একটা সোনার চাবি হয়ে সেই দুর্গম গুহার দরজা খুলে দিয়েছে—ভৈরব বেরিয়ে এসেছেন—আমি মহাকালের পায়ের শব্দ পাচ্ছিনটরাজ নাচছেন। তার এক পা অতীতে, এক পা বর্তমানে। তা তা থৈ থৈ’—আমার হীরা-পান্না ছড়িয়ে পড়ছে। হাসিকান্নার তরঙ্গ দুলছে—আমার বুকের হাড় গুঁড়িয়ে গেল, এ অসহ্য যন্ত্রণা। নটরাজ, তোমার নৃত্য থামাও, তুমি পা মুড়ে দাঁড়াও, কেশব হয়ে যাও, সব সন্তাপহারী শঙ্খ-চক্র–গদাপদ্মধারী, কিংবা বামনরূপে এস, তোমার তৃতীয় পা আমার মাথার উপর রাখ, আমি ঐ পশুর মতো তোমার পায়ের তলায় দলিত পিষ্ট হয়ে যাই! সকল কলুষ তামসহর সদয়হৃদয় বুদ্ধ হতে পার না? আমার দাহ জুড়িয়ে দিয়ে মোহাঞ্জন মুছিয়ে দিয়ে কেশবধৃতবুদ্ধশরীর, মুক্তি দাও আমায়, আমি আর ওকে দেখতে চাই না। আমি ঘুম ভেঙে আমার প্রতিদিনের সাজানো সংসারে আমার স্বামীর বুকে সন্তানদের কোলে, আমার আপনজনের মধ্যে জেগে উঠতে চাই।
ঐ তো মির্চা হেঁট হয়ে গ্যাস রিং-এ কফি বানাচ্ছে, খাবার ঘরের একপাশে গ্যাস রিং। রান্নাঘরের দরজার সামনে ঝড় দাঁড়িয়ে আছে, ঝড় আমাদের বাবুর্চি, ভীষণ কালো গোলগাল চেহারা, বুকে কেঁকড়া কোকড়া কালো লোম, ক্ষুদ্র একটি বনমানুষ। কিছুতে জামা গায় দেবে না—ওকে সভ্য করা গেল না। ও চিনি এগিয়ে দিচ্ছে। কফির ওপর ঘন ফেনা হলে তবে ওর ভালো লাগে, একে বলে টার্কিশ কফি, রোজ দুবেলা খাবার পরে ওর চাই। আমি ওকে দেখতে পাচ্ছি, ও পকেট থেকে রুমাল বের করে সসপ্যানের ডাণ্ডাটা ধরেছে, অন্য হাতে পেয়ালা। চিনি নিয়ে ঝড় পিছন পিছন আসছে। ওর ফর্সা মুখে, কালো চশমার ফ্রেমে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ওটা কফির বাষ্প। মির্চা খাবার ঘরের টেবিলের কাছে চেয়ার টেনে বসল। আর ঠিক তখনই–
“নৃত্য পাগল নটরাজ যেন দুই হাতে দিয়ে তাল
দেখিনি আমরা তখনই সেখানে ঢুকেছিল মহাকাল
দেখব কি করে? আমরা তখন পরস্পরেরই দিদৃক্ষু
পতঙ্গ যেন বহ্নিমুখং বিবিক্ষু।
ভবানীপুরের খাবার ঘরের
টেবিলে সাজান চা
তুলে নিল কাল মহা অনন্তে
অব্যয় মহিমা!”
লাইব্রেরীতে ঢুকতে ঢুকতে আবার আমাদের ঝগড়া শুরু হল, শেষ হল উপরের বারান্দায়—মির্চা বললে, “কি, কথা বলবে না?”
“না, তুমি যদি ওরকম কর তাহলে একেবারে কথা বলব না, তোমারই বা বলবার দরকার কি—আমি তো আর ভালো নই।”
“আমি তোমাকে খারাপ বলেছি?”
“নিষ্ঠুর হৃদয়হীন, একেবারে ভদ্রতা পর্যন্ত জানি না, এ যদি খারাপ নয় তবে কি?”
“তুমি কাল অমন করলে কেন?”
“কি করলাম?”
“অ’র সঙ্গে মীলু আর তুমি বেশ গলা জড়াজড়ি করে চলে গেলে, আর আমি তোমার একটু কাছে সঁড়াতেই তুমি সরে যাও।”
“কী আশ্চর্য, ও যে আমাদের আত্মীয়, তুমি তো আত্মীয় নও।”
আমার মার উপদেশ মনে পড়ছে, আমি যখন বেশ ছোট অর্থাৎ বার বছর বয়স হবে তখনও ফ্রক পরি। আমাদের বাড়ি মায়ের এক আত্মীয় আসতেন। মার চেয়ে অনেক বড় তিনি। তার বয়স কত জানি না, অত ছোটরা বড়দের বয়স বুঝতে পারে না। তবে তিনি অনেকের উপকার করতেন, সকলেই তাকে পছন্দ করত। বাড়ি এলে খুব হৈচৈ করে জমিয়ে তুলতেন আর আমাকে হাঁটুর উপর বসাতেন। আমি তো ফ্রক পরা একটা ছোট মেয়ে, কেউ কিছু মনে করত না—কিন্তু তিনি এক অদ্ভুত ব্যাপার শুরু করতেন–। হঠাৎ হঠাৎ আমার সদ্যোদ্ভিন্ন বক্ষ স্পর্শ করতেন। প্রথম দিন বুঝতে পারি নি। দ্বিতীয় দিনে মাকে বলে দিলাম। মা তো শুনে মাথায় হাত দিয়েছেন, “হা কপাল! বিয়ে করেও ওর স্বভাব শোধরাল না, হারামজাদাকে আর এমুখো হতে দিচ্ছি না।” মা কখনো এত অশ্লীল কথা বলেন না, আমাদের বাড়িতে মার জন্যই কেউ কোনো বিশ্রী কথা বলে না। অন্যদের বাড়িতে শুনেছি ‘হারামজাদা’, ‘শালা’, ইত্যাদি যথেচ্ছ ব্যবহার হয়, আমাদের বাড়িতে হয় না। আমাদের কানে গেলেও অসহ্য লাগে। মাকে প্রথম এই রকম একটা ভয়ানক কথা ব্যবহার করতে শুনলাম। এত রেগে গিয়েছিলেন যে, কোন সভ্য গাল খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তারপর মা আমায় বললেন, “রু, এরকম যদি আর কেউ কখনো করে, তখুনি এসে বলে দেবে। কখনো কোনো অনাত্মীয় পুরুষকে ছোঁবে না, ছুঁতে দেবে না। তাতে ফল খুব খারাপ হতে পারে। শরীর তো খারাপ হবেই, মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।”
কথাটা আমার ঠিক বিশ্বাস হয়নি, “মৃত্যু কি করে হবে?”
“অত সব তোমায় এখন বলতে পারছি না, কিন্তু যা বলছি শোনো, খুব সাবধানে থাকতে হয় মেয়েদের।”
একথা ঠিকই যে অনেক লোকই অতি অদ্ভুত ব্যবহার করে। যত দিন যাচ্ছে আমি অনেক বড় বড় লোকের চোখেও লোলুপ দৃষ্টি দেখেছি। গা ঘিন্ ঘিন্ করে, বিশ্রী লাগে। এই যেমন কমলবাবু অত শিক্ষিত, যাকে কালচার্ড বলা হয়ে থাকে, এলিটও, রীতিমত রবীন্দ্রভক্ত, বহু কবিতা ওর মুখস্থ, এলেই আমায় বিরক্ত করবে। সেদিন আমি বসবার ঘরে কোমরে কাপড় জড়িয়ে ঝুল ঝাড়ছি, এমন সময় তিনি এসে উপস্থিত। আমায় ঐ অবস্থায় দেখে কবিতা আবৃত্তি শুরু করেছে-“রাজমহিমারে যে করপরশে তব পার করিবারে দ্বিগুণ মহিমান্বিত, সে সুন্দর করে ধুলি ঝট দাও তুমি আপনার ঘরে—” কবিতা শুনলেই আমার ভালো লাগে তাই আমিও আবৃত্তি করছি—হঠাৎ ভদ্রলোক আমাকে পিছন। থেকে জড়িয়ে ধরলেন। মনে হল যেন সাপ ছোবল মারতে উদ্যত, আমি কোনো রকমে নিজেকে ছাড়িয়ে পালালাম। মা শুনে বললেন, “বাহারে পাঞ্জাবী আর নাগরাই পরলেই ভদ্র হয় না।” মার কথা এখন আমি বুঝতে পারি। আমি জানি এ সবের পিছনে অদৃশ্য একটা গোপন জগৎ আছে, সেখানকার সবটা খবর আমি জানি না। মার কথা শুনে শুনে আমার খুব পাপবোধ জন্মাচ্ছে। ঠিকই কথা। অ’কেও আমার গলা জড়াতে দেওয়া ঠিক হয় নি। হলই বা দাদার মতো। আমার মনে মনে দ্রুত নানা কথা চলে যাচ্ছে—হঠাৎ দেখি মির্চা আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে—
“ক্ষমা কর”–এই বলে দুহাত দিয়ে সে আমার দুহাত ধরে করপল্লব চুম্বন করলে।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি চিত্রার্পিত। ও আমার হাত ছাড়ছে না। আমার হাতের পাতা দুটো ওর হাতের মধ্যে নিপীড়িত। গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। ও তার উপর মুখ রাখছে—অনন্ত সময় চলে যাচ্ছে। কতক্ষণ কে জানে, ও ছাড়ছে না, আমি হাত ছাড়াবার চেষ্টা করছি, পারছি না—আমি ঊর্ধ্বমুখে প্রার্থনা করবার চেষ্টা করছি। নিজের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করবার চেষ্টা করছি, কারণ আমি তো এখন ছুটে পালাতে চাইছি না চাইছি ও ভুবন্ধন। কিন্তু ও আমাকে আর একটুও কাছে টানে নি, আমাদের মধ্যে অনেক ব্যবধান, ও জানে আমি বাধা দিচ্ছি—“ছাড় ছাড় মির্চা, তুমি আমার হাত গুঁড়িয়ে দিয়েছ, একেবারে মেরে ফেলেছ আমায়।”
মির্চা মুখ তুলল। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে আছি, আমার একটুও সরে যেতে ইচ্ছে করছে না। শরীরের মধ্যে ঘুঙুর বাজছে—একে কখনো শরীর খারাপ হওয়া বলে না। আমার দুধারে যেন প্রজাপতি পাখা মেলেছে—আমি উড়ে যেতে পারি। আমার হাতের উপর মির্চা আবার তার মুখ রাখছে—আকাশ নেমে এসেছে, রৌদ্রতপ্ত নীলাকাশ যেন মাটির উপর পড়ে গিয়েছে। ‘নীল অম্বর চুম্বন নত হয়ে স্থির হয়ে আছে আমার হাতের উপর।
সেদিন রাত্রিটা একটা আশ্চর্য রাত্রি। চারিদিক জ্যোৎস্না আলোছায়া মেলে কলকাতার ঐ রাস্তাটাকে ইন্দ্রপুরী করে তুলেছে। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি—ঘড়িতে বাজছে একটা, দুটো, ঢং ঢং—চাঁদ এদিক থেকে উঠে ওদিকে চলেছে—চলেছে কালপুরুষ— আমি দাঁড়িয়ে আছি বারান্দায় একা, আমার চুল বাধা হয়নি, চুল উড়ছে, আমার ছায়া পড়েছে পাশের দেওয়ালে—আমি নার্সিসাসের মতো নিজের ছায়ার দিকে চেয়ে আছি, ‘পূর্ণ চাদের মায়া জড়ানো আমার ঐ তম্বী দেহ-ছায়া আমাকে আশ্চর্য করে দিচ্ছে। ঐ শরীরে যে মন বাস করে সে কেমন? আমি তার সন্ধানে আছি—মির্চা আমার আত্মাকে দেখতে চায়—শঙ্কর বলেছেন আত্মা ছাড়া জগৎ মিথ্যা—সবই ঐ ছায়াটার মতন। কিন্তু ঐ ছায়াটাও তো মিথ্যা নয়—ওর পাশে ঐ যে মাধবীলতাটা দুলছে ওটাও সত্য, জ্যোতির্ময় সত্য।
আমার ভালো লাগছে, কি আশ্চর্য সুখে আমার দেহ মন ভরে রয়েছে—‘আনন্দসাগরে ভাসা’ কথাটা শুনেছিলাম, এই প্রথম বুঝলাম তার ঠিক অর্থটা কি। আমার মন ঐ জ্যোৎস্নার মতো হয়ে গেছে—সোমপায়ীদের মতো আমি জ্যোৎস্না পান করে আকাশগঙ্গায় ভাসছি-আমার হাতে তারার প্রদীপ, গলায় তারার মালা, উপরে লাল রঙের ব্রহ্মহৃদয়। জ্বলছে, ঐ তো আমার টিপ—আমার পায়ে তারার ঘুঙুর বাজছে— রুমুক ঝুমুক রিমি ঝিম্-ওটা ঘুঙুর নয়, নিচে মির্চা পিয়ানো বাজাচ্ছে-ও নিশ্চয় অনেক রাত অবধি বাজাবে। ও ঘুমোতে পারবে না, আমিও যেমন পারছি না, আমি জানি ও কি চায়। অজ্ঞাত রহস্যলোকের পর্দাটা সরে যাচ্ছে—আমি বুঝতে পারছি তার ওপাশে কি আছে, আমার মার কথায় আমার অচল বিশ্বাস ছিল কিন্তু সে বিশ্বাস কমে যাচ্ছে—এখানে পাপ কিছু নেই, তাহলে তো আমি চিনতে পারতাম যেমন বহুবার চিনেছি উদ্যত সর্পকে, কিন্তু এ তো জ্যোৎস্নার বাগান, এ তো পদ্মের সরোবর কিংবা কবি যে লিখেছেন রূপসাগর—এই কি সে রূপসাগর? কোনো কিছু ভাবতে গেলেই আমার কবিতা মনে আসে, কবিতা মনে এলেই কবিকেও মনে পড়ে। কতদিন আমি তাকে দেখি নি, কিন্তু সেজন্য আমার কষ্ট হচ্ছে না, এটা কি অন্যায়? এটা কি সত্যভঙ্গ? আমি কি কোনো প্রত্যুষে প্রথম সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম—ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা প্রভু তোমার পানে, তোমার পানে’,—আমি আর কিছুকে আর কাউকে তোমার চেয়ে বড় হতে দেব না—আমি কি সে সত্যচ্যুত? কয়েকদিন থেকে এই কথাটা আমার মনে যাওয়া আসা করছে, আমি উত্তর পাইনি—আজ আমি উত্তর পাচ্ছি—আজ উত্তর আনন্দের সিঁড়ি বেয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সত্য থেকে কি কেউ চ্যুত হতে পারে? সত্য সবাইকে ধারণ করে রাখে। আমার মনের সমস্ত তারগুলি তো তারই সুরে বাধা, তিনিই বাজাচ্ছেন এই গান—আমার দেহ-মন জুড়ে সুরের তরঙ্গ তুলেছেন তিনিই তো তার গানের ভিতর দিয়েই আমার মন এই আশ্চর্য রহস্যলোকের ভিতর ঢুকছে—ঠিক যেমন লিখেছেন—তোমার গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি, তখন তারে চিনি আমি তখন তারে জানি উনি ঈশ্বর সম্বন্ধে লিখেছেন আমি মানুষ সম্বন্ধে ভাবছি, আমি একটা ছোট্ট মেয়ে, মানুষই যথেষ্ট আমার পক্ষেঈশ্বরের দরকার নেই।
শান্তি আধঘুমে অপেক্ষা করে আছে ঘরের মধ্যে, এবার সে ডাকল—“রু, শুতে আসবে ভাই।”
“যাচ্ছি ভাই যাচ্ছি।”
আমার ঘরে আমার এগার বছরের বোন সাবি আর শান্তি শোয়। শান্তি মাটিতে শুয়ে আছে—আমি আর সাবি খাটে শোব। কোনো কোনো দিন আমি মাটিতে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে থাকি, আমার ভালো লাগে। সাবি ঘুমোচ্ছে। আমি ওর পাশে বসে ওর গায়ের চাদরটা ঠিক করে দিলাম। কোকড়া কোকড়া চুলে ঘেরা ওর সুন্দর মুখের ওপর জ্যোৎস্না এসে পড়েছে। কি সরল নিস্পাপ ওর আলোয় ধোয়া মুখ। কিন্তু মানুষ কি সত্যই কখনো সরল থাকে? আজ সকালে লাইব্রেরী থেকে যখন বেরিয়ে এলাম ও সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিল, তখন আমি ওর উজ্জ্বল চোখে একটা তীক্ষ্ণতা দেখেছিলাম। সেটা কি? কথাটা মনে করে আমার গায়ে কাটা দিল। একটা অজ্ঞাত অশুভ আশঙ্কা আমার আনন্দসাগরকে চঞ্চল করে তুলল। আমি হাত জোড় করে প্রার্থনা করতে চাইলাম। কার কাছে প্রার্থনা করব জানি না। মানুষের কান শব্দের তরঙ্গ ছাড়া শুনতে পায় না। একটু দূরেই তা পৌঁছয় না। কিন্তু এমন কি কোনো কান আছে যা দূরেও থাকে কাছেও থাকে? যেখানে সব পৌঁছয়? কে তুমি আমার গুরুর হাতে পরশপাথর দিয়েছ আমাকে জাগাবে বলে? কে তুমি এই আনন্দ সাগরকে বইয়ে এনেছ? যদি তেমন কেউ থাকো তবে দিও, আমার হাতে অরূপরতন দিও—আমায় শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিও না। আমার ঘুম আসছে—মির্চা আমার হাতের উপর ছোট্ট একটা ক্ষত করে দিয়েছিল, আমি তাতে হাত বুলাচ্ছি আর সেটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে, আমার বুকের উপর ছড়িয়ে পড়ছে—আমি দেখছি আমি পড়ে আছি আহত—সে চলে গেছে।
বাবা বলেছেন, “মির্চা যদি কিছুটা সময় করতে পারে তাহলে সে আর তুমি বইয়ের ক্যাটালগ কর নূতন করে।” অনেক বই বাবার লাইব্রেরীতে। কয়েক হাজার, কত কে জানে—সাত-আট হাজার হবে। একটা বড় চৌকো কাঠের বাক্সে খোপ খোপ করা আছে, আর কার্ড তৈরী করা হয়েছে-“আমরা প্রত্যেক দিন চার-পাঁচ ঘন্টা এক সঙ্গে কাজ করি। তারপর বিকেলে সবাই একসঙ্গে গাড়ি করে বেড়াতে যাই। মোটের উপর সাত-আট ঘণ্টা আমরা একসঙ্গে থাকি দিনের মধ্যে। তবু দুপুরে যেটুকু সময় উপরে যাই আমার অস্থির লাগে ওর কাছে আসবার জন্য। যেন একটা অদৃশ্য দড়ি দিয়ে ওর সঙ্গে কে আমায় বঁধছে। এ বাধন কি ছিড়তে পারে? তাহলে আমি বাঁচবই না। কিন্তু এ কথাটা ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলি নি। মীলুকেও না। ও বুঝতে পারবে না। ও আমাকে খারাপ ভাববে। কিন্তু আমি জানি আমি খারাপ নয়, কখনই নয়।
আমি মির্চাকেও বলিনি আমার মনের অবস্থাটা কি, ও তো সন্দেহে ভরপুর। আমার উপর ওর একেবারে আস্থা নেই বলেই মনে হয়।
যখনই আমরা একসঙ্গে থাকি–কোনো বইয়ের গল্প হয় কিংবা কবিতার। ‘হাঙ্গার’ বইটা পড়েছি, আমার ভালো লাগে নি। একটা বিশেষ কারণে ভালো লাগে নি। সে আমি ওকে বলতে পারব না। ওখানে একটা দৃশ্যের বর্ণনা আছে সেটা সম্বন্ধে জুগুপ্সা মিশ্রিত কৌতূহল আমার ভালো না লাগার কারণ। তাছাড়া ‘হাঙ্গার’ অর্থাৎ একটা লোক দিনের পর দিন অনাহারে আছে এ কষ্টটা আমি বুঝব কি করে? আমি কোনো দিন হাঙ্গারের পীড়ন জানি না। একদিনও অনাহারে থাকিনি। সর্বদা ভালো ভালো খাবার নিয়ে মা সাধাসাধি করছেন, দেহের অন্য হাঙ্গারের কথাও ওখানে আছে—আমি এখনও তার কোনো পীড়নে পীড়িত নয়। ঐ জগন্টা অপরিচিত আমার। আর মনের হাঙ্গার তো জানিই নারূপে রসে বর্ণে গন্ধে তো তা পূর্ণ করবার আয়োজন রয়েছে। আমি ওকে বললাম, “আমি হাঙ্গার বইটা বুঝতে পারি নি।”
ও বললে, “কৈ দেখি?” আমি বইটা এগিয়ে দিতে গেলে ও আমার কটি বেষ্টন করে কাছে টেনে নিল আর আমি বোধ হয় যুগান্তরের সংস্কারের তাড়নায় বাহাতে ওকে ধরে থেকেও ডানহাত দিয়ে ওর ফর্সা গালের উপর—ছি ছি এখনও ভাবতে আমার লজ্জা হয়—একটা চড় মারলাম—বেশ জোরেই। ওর গালটা লাল হল। ও অবাক হয়ে চেয়ে আছে। আমার ডান হাতের কর্জিটা জোর করে ধরে ও আস্তে আস্তে বলল, “তুমি আমায় মারলে!”
“কী করব।”
“জানো তুমি, আমাদের দেশে কোনো মেয়ে যদি এরকম করে তাহলে সেটা অসম্ভব অপমান? ওকে জিল্ট করা বলে।”
“এটা তো তোমাদের দেশ না।”
“বেশ আমি কালকেই চলে যাব, আর কোনো দিনও আসব না।”
ভয়ে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেছে, কি হবে, যদি সত্যি সত্যি চলে যায়।
“ক্ষমা কর মির্চা, ক্ষমা কর। আমি ইচ্ছে করে করি নি।”
“ইচ্ছে করে কর নি?” ও বিস্মিত।
“সত্যি বলছি তোমায় কি করে যে কি হল জানি না। হাতটাই অসভ্যতা করেছে আমি করি নি।”
অবস্থাটা স্বাভাবিক হতে বেশিক্ষণ লাগল না। আমি অনুতপ্ত, খুবই নরম। মনের ভাবটা, আর একবার করে দেখ, কিছু বলব না। ও কিন্তু সাবধানে আছে, খুব সাবধানে।
আমাদের ঝগড়া মিটে গেছে, আমি অনেক ভেবে দেখেছি ও যখন আমাকে এত চায়, তখন একটা কিছু করতেই হবে। স্ত্রীপুরুষের সম্পর্ক সম্বন্ধে আমার ধারণাটা খুবই অস্পষ্ট, কিন্তু কুয়াশার ভিতর থেকে একটু একটু স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আমি বুঝতে পারছি বুদ্ধি দিয়ে নয়, অনুভূতি দিয়ে। ফুলের উপর আলো পড়ে, তার পাপড়িগুলি যখন খোলে তখন ফুল তো জানে না ফল ফলাবার নির্দেশ আসছে কোন অলক্ষ্য থেকে। তেমনি প্রেম, সূর্যের আলোর মতোই উজ্জ্বল উত্তপ্ত প্রেম আমার শরীরে প্রবিষ্ট হয়ে তাকে উন্মুখ করে তুলেছে। আমি জানি না তার নির্দেশ কিসের দিকে। শারীরিক শুচিতা সম্বন্ধে ভারতীয় মেয়েদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নানা বদ্ধমূল ধারণা আছে, আমিও তা থেকে মুক্ত নই। স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষকে তারা ভালোবাসে নাবাসতে পারে না, ছুঁতে তো পারেই না। অন্য পুরুষ হচ্ছে পরপুরুষ। কোনো কোনো মেয়ে সে রকম করে, তারা হচ্ছে স্বৈরিণী। এই পরিভাষাগুলো আমি শুনেছি। যেমন ‘চোখের বালি’র বিনোদিনী হচ্ছে। স্বৈরিণী। ইতিমধ্যে চরিত্রহীন’ও আমি ‘নৌকাডুবি’র মলাটের মধ্যে রেখে পড়ে ফেলেছি। ‘চরিত্রহীন’-এর ঐ দুষ্টু বৌটার সঙ্গে ‘হাঙ্গার’ বইয়ের লোকটার বেশ মিল আছে—ঐ তরুণী বিধবা বৌটা বলছে, “যে তৃষ্ণায় মানুষ নর্দমার কালো জল অঞ্জলি ভরে পান করে আমার ছিল সেই পিপাসা।’ এ তৃষ্ণাটা কি? সত্যি তো আর জলের নয়। কারণ ওরা যতই গরীব হোক ওদের বাড়িতে কল ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু এই বইগুলি বিশ্রী। আমার মনে গুনগুনিয়ে গান আসছে—
‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা,
তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।‘
রবিঠাকুরের মতো সুন্দর করে আর কোথাও কোনো লেখক মনের কথা বলতে পারে না।
ভালোমন্দের দ্বন্দ্বে আমার বুকের ভিতরটা কাঁপছে। তবু আমি কতকগুলি ধারণা নিজেই তৈরী করে নিয়েছি, শরীরের কোন্ কোন্ অংশ স্পৃষ্ট হলে পাপ স্পর্শ হতে পারে। যেমন খাবার টেবিলে বসে ও যে ক্রমাগত আমার পায়ের উপর পা রাখে সেটা কখনো পাপ নয়। পাদস্পর্শ করলে পাপ হবে কি করে? এই হচ্ছে অকাট্য যুক্তি। হাতেও নিশ্চয় পাপ হবে না, হতেই পারে না, সর্বদা হ্যাণ্ডশেক করা হয়। তাই একদিন আমি লাইব্রেরীতে ওকে বললাম, “মির্চা তুমি আমার হাতটা নিতে পার।” এই বলে আমি আমার হাতটা তুলে ধরে ওর দিকে মেলে ধরলাম। ও দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার হাতটা ধরল। আমার হঠাৎ মনে হল এইবারে বুঝলাম কেন হাতকে মৃণালের সঙ্গে তুলনা করা হয়। বৃন্তের উপর করপল্লব পদ্মের মতো দেখায়করকমল— আমার হাতের উপর ওর হাতটা কত ফর্সাঈষৎ ঈর্ষামিশ্রিত চোখে তাকিয়ে আছি, ও দুই লুব্ধ হাতে আমার হাতটা টেনে নিল-হাতের উপর মাথা রাখল, মুখ রাখল কাঁধের উপরে। সমস্ত হাতে ও পল্লবে আমি ক্ষণে ক্ষণে ওর অধরের স্পর্শ পেতে লাগলাম—ক্রমে ক্রমে আমার হাতটা আমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল—কিংবা হাতটাই আমি হয়ে গেলাম। আমার সমস্ত অনুভূতি ঐখানে একত্র হয়েছে—আমার একাগ্র সত্তা ঐখানে স্পন্দিত। কতক্ষণ জানি না, কতক্ষণ ও আমার হাতের পল্লব ওর বুকের উপর রেখেছে, ওর শরীর ওর গলা আমার কনুই-এর উপরে, কাঁধের কাছে ওর মুখ। ও স্থির থাকছে না, ক্রমাগত নড়ছে। ক্রমে ক্রমে আমার হাত আর যেন রক্তমাংসের পদার্থ রইল না—ওর থেকে স্কুল বস্তু উধাও হয়ে গেল। আকাশজোড়া বিদ্যুৎ লেখার মতো চমকিত হতে লাগল—ওর ভিতরের অণু পরমাণু বিশ্লিষ্ট হয়ে গেছে—তারা ঘূর্ণমান, নৰ্তিত গ্রহ নক্ষত্রের মতো ঘুরছে তারা—‘গ্রহতারকা চন্দ্র তপন ব্যাকুল দ্রুত বেগে’—আমি চোখ বুজে আছি—আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে—“মির্চা—একি, একি, একি!”
চোখের জলে আমার বালিশ ভিজে গেছে—আমি তো ভবানীপুরের লাইব্রেরীতে নেই—আমি বালিগঞ্জের বাড়িতে আমার খাটে শুয়ে আছি, কিন্তু কি আশ্চর্য আমার হাতটা এখনও আমি হয়ে আছে। আমার শরীর অসাড়—আমি পাশ ফিরতে চেষ্টা করছি, দেখি আমার স্বামী কনুই-এর উপর ভর করে ঈষৎ উত্থিত হয়ে আমার দিকে চেয়ে আছেন-“তোমার কি হয়েছে আমায় বলবে না।”
আমার আটত্রিশ বছর বিয়ে হয়েছে। আমি খুব নিপুণ সংসার করেছি, কোনো ত্রুটি নেই। আমি হাত বাড়িয়ে আমার স্বামীর হাতটা ধরবার চেষ্টা করলাম। ছি, ছি, এতদিন পরে কেন এসব চিন্তা, কোথায় বা মির্চা! তখনই এক বুকভাঙ্গা নিঃশ্বাস পড়ল—সে যেন বলল—এই তো আমি! তোমার জীবনবায়ুতে প্রবিষ্ট। এতদিন ভুলেছিল কেন, কেন, কেন?
কিছুদিন থেকে আমাদের বাড়িতে একটা বেশ বড় রকমের গোলমাল শুরু হয়েছে, আমাদের খুব নিকট আত্মীয়া একটি মেয়েকে নিয়ে দিদিমা এ বাড়িতে এসেছেন। মেয়েটির নাম আরাধনা। সে আমার চেয়ে ছয় বছরের বড়—তবু আমরা বন্ধুর মতো। আরাধনা অপূর্ব সুন্দরী। ওদের বাড়িতে থেকে যতীন বলে একটি দরিদ্র ছেলে পড়াশুনো করত। পড়াশুনোয় খুব ভালো, দেখতে সুন্দর এবং অনুগত ছিল বলে আরাধনার বাবা ঠিক করলেন যে তার সঙ্গে যতীনের বিয়ে দেবেন। আরাধনার যখন বার বছর বয়স, তখন থেকেই এই বিয়ে স্থির। বড় হলে বিয়ে হবে। ওরা এক বাড়িতেই থাকে, ওদের দেখা-শোনা হয়, কিন্তু আরাধনা যতীনকে দু চোখে দেখতে পারে না। যতীন যদি ঘরে ঢোকে তবে আরাধনা তৎক্ষণাৎ উঠে চলে যায়। যতীন যদি ওকে চিঠি লেখে ও ছিঁড়ে ফেলে দেয়, না পড়েই। সে সময়ে নিজের বিয়ে নিয়ে মা বাবার সঙ্গে কেউ কথা বলত না। তবুও ও বার বার ওর মাকে, বাবাকে, দিদিকে কেঁদে কেঁদে বলেছে, আমি ওকে বিয়ে করব না। ওকে আমার একটুও ভালো লাগে না। ওর মা বাবা-দিদিরা তো অবাক। এ আবার কি কথা, অমন সোনার চাঁদ ছেলে ভালো না লাগবে কেন? বেশি বেশি আহ্লাদীপনা! ওর দিদিরা বললেন, ‘ওর তোকে অত পছন্দ, তোর কেন নয়? তুই বা কি এমন রাজেন্দ্রাণী যে সাধা সম্বন্ধ ফিরিয়ে দেব আমরা?
অতএব আরাধনার যখন চৌদ্দ বছর বয়স তখন যতীনের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়ে গেছে, ওদের একটি ছেলেও হয়েছে। এখন আরাধনার বয়স তেইশ, ওর স্বামী ওকে খুব খোশামোদ করে, সর্বক্ষণ ওর পায়ে পড়ে আছে বললেই হয়। কিন্তু আরাধনা বলে ওর জীবনটা বিরাট এক ডোজ কুইনাইন মিক্সচার। মুখ থেকে তেতো আর যাচ্ছেই না। “ভাই রু ঐ লোকটার সঙ্গে থাকতে যে আমার কি কষ্ট, কি বলব তোকে!”
“কেন ভাই যতীনমেসসা তো খুব ভালোবাসেন তোমায়!”
“রাখ, রাখ, ও সব ন্যাকামো।”
কিন্তু একদিন এই কুইনাইনের তেতো ওর মুখ থেকে চলে গেল—মুখে মধুর আস্বাদ পেল আরাধনা। ওদের পাশের বাড়িতে একটি তরুণ প্রফেসর, ওরই বয়সী, এলেন। ওদের সঙ্গে আলাপ হল। আরাধনা জানতে পারল কার প্রতীক্ষায় এতদিন তার শরীর-মন কুইনাইন মুখে নিয়েও বেঁচে ছিল।
কিন্তু ঐ তরুণ প্রফেসর, তার নাম সৌমেন, তিনিও তো ভারতীয় নারীর কোলে জন্মেছেন, আমার মায়ের মতন তারও মা তাকে ভালোমন্দ চিনতে শিখিয়েছেন, এদেশের যুগ-যুগের আদর্শ অনুসারে। যদিও সে আদর্শ পুরুষের জন্য ছিল না; কিন্তু সৌমেন তো শুধু ভারতীয় নয়, সে আবার আধুনিকও তাই নীতির ক্ষেত্রে সে স্ত্রী-পুরুষের তফাৎ করে না। সৌমেনের ভালোবাসা আরাধনার চেয়েও অনেক গভীর, সারাজীবন দিয়ে সে তার প্রমাণ দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তবু সে ওকে বলেছে তাদের দেখাশোনা না হওয়াই ভালো। স্বামীর প্রতি আরাধনার কর্তব্যচ্যুতি সে চায় না। হিন্দুরা তো বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারে না, তবে? তবে কি হবে এর পরিণাম? কাজেই দেখাশোনা আর সে করবে না। আরাধনার কিন্তু অত নীতিজ্ঞান নেই, বলে—দেখাশোনা হবে না কেন? দ্রৌপদীর যদি পঞ্চপতি থাকতে পারে আমার না হয় দুটোই রইল! কিন্তু এটা ঠাট্টা। সৌমেন নিজের মন নিয়ে। অস্থির হয়ে গেছে—ছটফট করছে, ঠিক করতে পারছে না কর্তব্য। শেষ পর্যন্ত আরাধনাকে একটি চিঠি লিখে পতিব্রতা হতে অনুরোধ জানিয়ে সে ক্রিশ্চানদের পেনিটেনশিয়ারীতে বন্ধ হয়ে আছে। নিজেই নিজেকে বন্ধ করেছে। কিন্তু আরাধনার প্রতিজ্ঞা ওর ব্রতভঙ্গ করবেই। একদিন আরাধনা আমায় বলল, “ভাই রু, তুই তো খুব ভালো লিখতে পারিস, আমায় একটা চিঠি লিখে দে না, বেশ কবিতা-টবিতা দিয়ে।”
“কি করে পাঠাবে ঐ মঠে?”
“সে আমার উপায় আছে। তুই লেখ, যেমন বলি লেখ, সৌমেন আবার খুব বিদ্বান কিনা বানান ভুল হলে ওর খারাপ লাগবে, তাই তোকে বলছি; নৈলে আমি কি আর লিখতে পারি না।
আমি তো বেশ গর্বিত। জীবনে প্রেমপত্র লেখার সুযোেগ এই প্রথম। প্রেমপত্র লেখবার জন্য আরাধনা চয়নিকা নামিয়েছে; মহা মুশকিল, রবিবাবুর প্রেমের কবিতা আর ঈশ্বরের কবিতার তফাৎ বোঝা যায় না। যা হোক ‘গুপ্তপ্রেম’ ও ‘ব্যক্তপ্রেম’ এ দুটো খুব স্পষ্ট। আরাধনা খুঁজে বের করেছে—পরাণে ভালোবাসা কেন গো দিলে রূপ না দিলে যদি বিধি হে—এই লাইনটা নাকি ঢোকাতেই হবে। আমি বললাম, “তুমি এত সুন্দর দেখতে এ কবিতা তোমার পক্ষে খাটবে না তো।” আরাধনা চিন্তিত, সে খুঁত খুঁত করতে লাগল, “তাই তো কি হবে, কবিতাটা খুব ভালো ছিল কিন্তু।”
যা হোক, শেষ পর্যন্ত আটাশ পাতা প্রেমপত্র লেখা হল এবং অব্যর্থভাবে তা লক্ষ্যসন্ধান করল। সেই শব্দভেদী বাণ যথাস্থানে পৌঁছতে বাণবিদ্ধ সৌমেন স্বরচিত কারাগার ছেড়ে এসে উপস্থিত হল। সম্ভবত সেটা আমার পত্রের গুণে নয়–সে নিজেই একটা ছুতোর অপেক্ষায় ছিল। এর পরে সে একদিন সপুত্ৰক আরাধনাকে নিয়ে আগ্রায় পালিয়ে গেল। তারপরের ব্যাপারটাই হচ্ছে আমার বর্তমান উদ্বেগের কারণ। আরাধনাকে নিয়ে যে সৌমেন চলে গেল এই ঘটনার একটা পরিভাষা আছে, সেটা না বললে বোঝা যায় না কাজটা কত খারাপ। ঘরের বৌকে বের করে নিয়ে যাওয়া। এই ভয়ানক পাপ সৌমেন করেছে রোজ শুনছি। যেন আরাধনা করে নি। আমি তো জানি আরাধনাই সৌমেনকে মঠের কারাগার থেকে বের করে এনেছে, এবং আমি তাকে সাহায্য করেছি কিন্তু আমি সত্যিই জানতাম না যে এর ফলে এতবড় পাপ ঘটবে।
যতীন লিখেছে যে সে পাগল হয়ে গেছে—তাই আরাধনার বাবা ছুটেছেন মেয়েকে ফিরিয়ে বা ছিনিয়ে আনতে এবং এনেছেনও। ঐ নির্বোধ কাণ্ডজ্ঞানহীন ছেলেমেয়ে দুটোকে যথোপযুক্ত সাজা দেবার ব্যবস্থাও হচ্ছে। আমার বাবা ওর বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি দেবেন, দিলেই সৌমেনের চাকরী চলে যাবে। এই সব ঘটনার মধ্যে ভয়ে কাঁপছি আমি। যদি কোনো রকমে বেরিয়ে পড়ে ঐ ঐতিহাসিক প্রেমপত্রটির রচয়িতা আমি, তাহলে কি হবে। মা তাহলে কি করতে পারেন আমি ভাবতেই পারি না। মা যে কতখানি দুঃখ পাবেন তার মাপই হয় না। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলবেন, “এ্যা, তুমি আমার মেয়ে হয়ে এতো জঘন্য কাজ করেছ? লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হচ্ছে, এই শিক্ষা দিয়েছি তোমায়?” মা, হয়তো দোতলা থেকে লাফ দিয়েও মরে যেতে পারেন। আর বাবা! বাবা যদি শোনেন তাহলে যে ধমকটা খেতে হবে সেটা ভেবে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হচ্ছে, “এ্যাতো আঁচড়ে পেকেছ! পড়াশুনোয় তো অষ্টরম্ভা। কোথায়, ণিজন্ত প্রকরণ মুখস্থ হয়েছে? ষত্ব-ণত্ব জ্ঞান হয়নি, আটাশ পাতা প্রেমপত্র লিখেছ?” এমন চিৎকার করে ধমক দেবেন যে ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ় নাম শুনে ‘হ য ব র ল’তে যেমন বাড়িটা পড়ে গিয়েছিল সেই রকম এই বকুলবাগানের বাড়িটা পড়ে যাবে চুরমার হয়ে। দু’দিন ধরে আমি ভয়ে কাঁপছি, আমার একমাত্র ভরসা, আরাধনার নিশ্চয় এটুকু অহঙ্কার আছে যে বলে দেবে না তার প্রেমপত্রটা অন্য কেউ লিখে দিয়েছে।
এ কয়দিন ক্যাটালগও করা হয়নি। মির্চা কত কি মাথামুণ্ডু ভাবছে কে জানে। আমি বেশ বুঝতে পারি ও আমাকে একটুও বিশ্বাস করে না। এই যেমন ওকে আমি সেদিন বললাম—আমার ছাতিম গাছ’ কবিতাটা কল্লোল’-এ পাঠিয়েছিলাম, সেখান থেকে কবি–বাবু একটা খুব সুন্দর চিঠি লিখেছেন। কথাটা ওর ভালো লাগে নি। আচ্ছা একজন কবি কি করে একজন কবিকে একটা চিঠিও লিখতে পারে না? আমি জানি কেন মির্চা এত অনিশ্চিত—আমি তো ওকে একবারও বলি নি আমি ওকে ভালোবাসি কিনা যদিও ও বহুবার বলেছে। আমি কি করে বলব? আমি তো জানি না আমার যে এই কষ্ট মেশান আনন্দ হচ্ছে, আমার যে কেবল ওর কাছে যেতে ইচ্ছে করছে এটাই ভালোবাসা কিনা। আমাকে জানতে হবে এটা সত্যি কি। আমার এত যে বন্ধু মীলু তাকেও আমি বলি নি। বলব কি করে, আর বলে কোনো লাভ নেই, ও জানবেই বা কি করে, ও তো কাউকে ভালোবাসে নি। আমাকে খুশি করবার জন্য যা তোক একটা কিছু বলে দেবে।… একজনকেই শুধু আমি বলতে পারি, তাকেই আমি বলব। কারণ তিনিই আমার বন্ধু। বয়স দিয়ে কি আর বন্ধু হয়! বাবা বলেন বন্ধুর সংজ্ঞা হচ্ছে-অত্যাগসহনো বন্ধুঃ-যার ত্যাগ বা বিচ্ছেদ সহ্য করা যায় না। আমি তো তার সঙ্গে বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারি না। তাই নাকি? এ কথাটা ঠিক নয়। কতদিন আমি তাঁকে দেখি নি, কই আমার তো যেতেও ইচ্ছে হয় নি, কেন? কেন? কেন? তা কি আর জানি না—মির্চাকে ছেড়ে একদিনও কোথাও যেতে চাই না তাই।।
হঠাৎ আমার তার জন্য খুব মন কেমন করতে লাগল—আমি কাঁদতে লাগলাম—চির পথের সঙ্গী আমার চির জনম হে।’…মীলু এসে ঘরে ঢুকল। “রু, ইউক্লিড জিজ্ঞাসা করছে আজ ক্যাটালগ করা হবে না?”
“হবে, নিশ্চয় হবে।” আমি নিচে যাবার জন্য তৈরী হলাম। চুল ঠিক করলাম, টিপ পরলাম। আর তো আমাদের সাজসরঞ্জাম নেই। সেন্ট মাখাও হচ্ছে না, সে তো বিলাতী জিনিস তাই আমরা গোলাপজল, কেওড়া, কখনো কখনো আতর ব্যবহার করি। মা বলেন। আমার ও সব দরকার নেই, আমি পদ্মিনী কন্যা, আমার জামায় অমনি সুগন্ধ হয়। তবে কেন আমি সুগন্ধ মাখছি? তা কি আর জানি না! আমি ওকে ধোকা দিচ্ছি। বেচারা ভাবছে আমি ওকে ঠেলে দিচ্ছি কিন্তু সেটা ঠিক নয়। আমি ওকে কাছেই চাই।
সিঁড়ি দিয়ে নামছি আর আমার শরীর শির শির করছে—এটা ঘটল ঠিক সেই দিন কিনা আমি বলতে পারব না। কারণ আমার তো কোনো জার্নাল নেই। বেয়াল্লিশ বছর আগের কথা আমি লিখছি, ডায়রী থেকেও নয়, স্মৃতি থেকেও নয়। ঘটনাগুলো তাই পরপর লেখা হচ্ছে কিনা তা আমি জানি না।
‘পর পর অর্থাৎ তখন যা পর পর মনে হয়েছিল, এখন এর আগেও নেই পরেও নেই—এখন ঐ দিনগুলো একই সময়ে বর্তমান, কথাটা আমি বোঝাতে পারছি না। বোঝান শক্তই বা কি? শ্রীকৃষ্ণের ব্যাদিত আস্যের মধ্যে অর্জুন তো একই সঙ্গে জগৎ দেখেছিলেন। আমিও আজ তাই দেখছি। পার্বতী ও গৌতমী, তোমাদের বিশ্বাস করতে হবে—এটা স্মৃতি নয়, বর্তমান, আমি ক্ষণে ক্ষণে ১৯৩০ সালে প্রবিষ্ট হচ্ছি। আমাকে স্পর্শ করে আছে ১৯৩০ সাল। তাই আমি লিখেছি—
সময়ের সমুদ্র পারায়ে
যে জীবন গিয়েছে হারায়ে
যদি সে ফিরেই ফের আসে
আলো হয়ে মনের আকাশে
চন্দ্রতারকার সাথে
বসে একাসনে
সে সূর্যস্বরূপ–
আমাকে দেখাবে বিশ্বরূপ—
তখন আর অন্য পন্থা নাই
প্রণিধায় কায়ং প্রসন্নতা চাই।…
আমি তাই তোমাদের বলেছি—প্রসীদ, প্রসীদ, প্রসন্ন হও–আমার সমস্ত জীবন— ভুল-ভ্রান্তি অপরাধ ও ত্রুটি সব নিয়ে তোমাদের কাছে, মানুষের কাছে, নিবেদন করছি—অন্য ঈশ্বর আমি জানি না।
কিন্তু আমি অর্জুনের মতো এই রূপ সংহরণ করতে বলব না। আমি দেখতে চাই। আমি আবার দেখতে চাই। আমি দুই হাতে ওকে ধরতে চাই।…অলৌকিক প্রত্যাশা এসে আমার বুদ্ধির কেন্দ্রটা শিথিল করে দিয়েছে, আমি প্রার্থনা করছি, যদি সত্যই কোথাও কেউ থাক আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তা, তবে এই চল্লিশটা বছর পার করে নিয়ে যাও। ওর মুখের রেখাগুলো আমার চোখে পড়ছে না, শুধু ওর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিটা ছাড়া মুখের আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না এখন—কেবল সব সময়ে ওর ফর্সা গলাটা দেখি আর শার্টের ফাক দিয়ে মুখ বের করে থাকা বুকের একটু অংশ। আমি ঐখানে কাত পেতে শুনতে চাই—গভীরে খুব গভীরে জন্মান্তরের মতো বিচ্ছিন্ন অথচ যুক্ত সেই আশ্চর্য সুরটা এখনো কোথাও বাজছে কিনা। সেই প্রথম আলোর চরণধ্বনি’, সেই প্রথম প্রেমের কল্লোল।
আমরা বই সাজাচ্ছিনাম লেখা হচ্ছে কার্ডে-বাক্সে কার্ড ফেলা হচ্ছে। আমরা কাজ করে যাচ্ছি, নীরবে। আমি আড়চোখে ওকে দেখছি—ওর হাতটা একটু একটু কাঁপছে—ওর ভিতরে কি হচ্ছে কে জানে। তারপরে? তারপরেই কি? জানি না কোন দিন। কোথায়? কোন ঘরে আমি দেখতে পাচ্ছি না, আমি দেখছি একটা গরাদ দেওয়া বড় জানালা—আর তার সামনে আমরা—আমি হঠাৎ দেখলাম আমি ওর ভুজবন্ধনে আর ওর মুখ আমার মুখের উপর নেমে আসছে—আমি চেষ্টা করছি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে; যুদ্ধ করছি, কেন যুদ্ধ করছি কে জানে? জানি না, পরাজিত হবার জন্যই নিশ্চয়। শুচিতা রক্ষা করবার জন্য নয়, কখনো নয়। আমি পরাজিত হলাম। মির্চা আমার মুখের উপর তার মুখ রাখল। নরম মধুর স্পর্শে আমার মুখটা খুলে গেল, আমি মুখের ভিতর তার মুখের স্পর্শ পেলাম। আমার সারা শরীর গান গেয়ে উঠেছে তবু আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে, আমার ঐ রকমই—কোনটা যে হৰ্ষ কোনটা বিষাদ বোঝা যায় না।
ও কোথা থেকে এত আনন্দ নিয়ে আসতে পারে? কি করে এরকম হয়? আমি যা শুনেছিলাম, আরাধনা আমায় যা বলেছিল, এ তার থেকে অনেক ভালো। অবশ্য শুনে কিছুই বোঝা যায় না। পড়েও না। এরকম সবাই জানে কি—এইসব প্রশ্ন আমার মনে আসছে, মন কানায় কানায় ভরে গেছে—একটুও পাপবোধ নেই—আর আমার পাপ হবেই বা কেন? আমি তো কিছু করিনি—আমি তো বাধা দিয়েছি—মির্চার পাপ হয় তোক। ওদের দেশে এতে পাপ হয় না। ও যে সব গল্প করেছে তাতে আমি বুঝতে পেরেছি। ও আমায় ছেড়ে দিয়েছে, আমি চুল ঠিক করে নিচ্ছি, বিস্রস্ত আঁচল গুছিয়ে নিচ্ছি। মনের ভিতর গুনগুন করছে—“আমার প্রাণের ভিতর সুধা আছে চাও কি?
“রু রু রু—”
“যাচ্ছি মা–”
আমার শরীর হালকা হয়ে গেছে, আমি হাঁটতে পারছি না, উড়ে যাচ্ছি—দুধারে আমার বিস্রস্ত কেশভার ডানার মতো হয়ে গেছে—মনের ময়ূর নাচছে। আমি সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছি—-“উল্লাস উতরোল বেণুবন কল্লোল, কম্পিত কিশলয়ে মলয়ের চুম্বন।’…
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, সিঁড়ির উপর শান্তি আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, সে চোখে ঈর্ষা নয়, না-না, নিন্দাও নয়, আছে শুধু সন্ প্রত্যয় জ্ঞা ধাতুর উত্তর জিজ্ঞাসা, জিজ্ঞাসা, জ্ঞানের ইচ্ছা। কিন্তু ভয়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা, ‘কম্পিত কিশলয়’ স্তম্ভিত হয়ে গেছে—‘মলয়ের চুম্বন’-ও মলয় বাতাসে কোন গর-ঠিকানায় চলে গেছে কে জানে। কিন্তু সাহস দরকার, ভয় পেলেই বিপদ। তাই নির্বিকার মুখে বললাম, “কি দেখছিস হাঁ করে?”
“হাঁ করে কি দেখছি? কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”
চোরের মার বড় গলা। আমি খুব দর্পিত ভঙ্গিতে বললাম, “তুমি জান না? ক্যাটালগ করছি না?”
শান্তি স্থির চেয়ে রইল—এবার আর জিজ্ঞাসা নয়, কেমন যেমন উদাস, ওর চোখে কি জল?
শান্তি আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়, আমি যোল পূর্ণ হয়ে সতরতে পড়ব, ও তাহলে একুশ পূর্ণ হয়ে বাইশে। ও দেখতে ওর দাদা খোকারই মতো, ওর’মুখ চওড়া—নাকও তাই, বিশেষ কিছু সুন্দর নয়—শুধু ওর দুটি উজ্জ্বল চোখের উপরে বাকা ধনুকের মতো দুখানি ভুরুর রেখা ছাড়া। ও খুব কথা বলে, হাসি খুশি মেয়ে। ওরা বরাবর গরীব। খুবই গরীব। ওর দাদা আর ও দুজনেই আমাদের বাড়িতেই থাকে। লেখাপড়া সামান্যই জানে—শেখবার সুযোগ পেল কোথায়? নয় বছর বয়সে তো বিয়েই হয়ে গেল পূর্ববঙ্গের কোনো গ্রামের একটি উনিশ বছরের ছেলের সঙ্গে। ছেলেটির নাম রমেন। উনিশ বছরের ছেলে এক বছর পরেই কুড়ি হল, আর এক বছর পরেই একুশ, তখন তার পূর্ণ যৌবন। কিন্তু শান্তি তো দু বছরে মাত্র এগার বছরের হয়েছে। তাও খুব ছোটখাট ছেলেমানুষ ছিল। কাকা বলেন, রমেন ভেবেছিল ঘুম ভেঙেই দেখবে তার বৌ একটি প্রমাণ সাইজের মেয়ে হয়ে গেছে—তা যখন সে হতে পারে নি তখন সেটা তার বৌয়েরই দোষ! সেই মহা অপরাধের সাজা দেবার জন্য রমেন একটি প্রমাণ সাইজের মেয়ে বিয়ে করে আনল। এ মেয়েটি শুধু বড় নয়, সুন্দরীও। কাজেই শান্তি তার স্বামীর বাড়িতে দাসী হয়ে গেল। ওর কাজ ছিল শুধু ঐ দুজনের সেবা করা। ওর স্বামীর খাট থেকে নেমে ওকে মাটিতে শুতে হল। ওরা দুজনে মশারী ফেলে শুয়ে থাকবে আর শান্তি বেচারা বসে তাদের পা টিপে দেবে। একটু এদিক ওদিক হলে ওরা লাথি মারবে। শান্তি বলে, “পা টিপতে তত আপত্তি ছিল না, না হয় স্বামীর পা টিপলুমই কিন্তু ভাই ফরিদপুরের গ্রামের মশার কামড়!” এরকম আর কতদিন চলে, কতই বা মানুষ সহ্য করতে পারে। অবশেষে শান্তি একদিন বিষ খেল, অবশ্য মরল না। ওদের প্রতিবেশীরা খবর দিতে থোকা ওকে গিয়ে নিয়ে এসেছে। শান্তির মা, যিনি আঠারটি সন্তানের জননী, তিনি শান্তিকে তাঁর সেই দুবৃত্ত স্বামীর ঘরেই ফেরৎ পাঠাতে চান। বলেন, শত হোক স্বামীর ঘরই মেয়েমানুষের ঘর। আমার মা এই শুনে তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে এসেছেন। শান্তির মা বলেন, “বৌঠান তুমি যে ওকে স্বামীর ঘরে যেতে দিচ্ছ না, যুবতী মেয়ে একলা থাকবে কোথায়? সারাজীবন ওর ভরণপোষণই বা করবে কে?” মা বলেছেন, “চিন্তার কোনো কারণ নেই, ও আমাদের বাড়িতে থেকে নার্সিং পড়বে। ওকে আমি নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দেবই।”
পরের বিপদে সাহায্য করার ব্যাপারে মা একলাই একটা ইনস্টিট্যুশন। কত লোককে সাহায্য করেছেন তার কোন হিসেব নেই। খোকাও এ বাড়িতে থেকে টাইপিং শিখছে কিন্তু শান্তি আর খোকা এক নয়। শান্তি উদয়-অস্ত পরিশ্রম করে তার অন্নের ঋণ শোধ করে। সকলেই ওর উপর হুকুম করে, আমিও। “শান্তি এক গ্লাস জল দে তো” বলতে কারু লাগে কি কোনো বাধা? কিন্তু খোকা? ও হাসাতে পারে। তাছাড়া কোন কাজ ওকে দিয়ে হবার জো নেই। বাবা ওকে দুচোখে দেখতে পারেন না। ও পারতপক্ষে বাবার সামনে আসে না। বাবা যদি পারেন তবে ওকে বাড়ি থেকে এখনই বের করে দেন কিন্তু মার জন্য পারেন না। মা কাউকে তাড়াবেন না। আর এ সংসারে নিঃসন্দেহে তিনিই কী। শান্তি বেচারীকে স্বামী থেকেও বিধবার জীবন যাপন করতে হবে। সেজন্য মার খুব দুঃখ। তবে পুরোপুরি বিধবা নয়, ও সিঁদুর পরতে পারে, পাড়ওয়ালা কাপড় পরতে পারে, দুবেলা ভাত তো খেতে পারেই, মাছও খেতে পারে। কিন্তু বিয়ে আর ওর হবে না। হিন্দুর মেয়ের স্বামী মরলেই বিধবা হয় না। তো স্বামী থাকতে। কিন্তু মা যদি পারেন তবে ওর বিয়ে দেন। মা বলেন, “যদি কোনো উপায় থাকত তবে আমি শান্তির বিয়ে দিতাম-“ও তো কুমারীই—কিন্তু উপায় তো নেই।” বে-আইনি কাজ করলে রমেন এখানে এসে ধুন্ধুমার লাগিয়ে দেবে, অর্থাৎ ধুন্ধু দানবকে হত্যা করবার সময় যে রকম কোলাহল হয়েছিল সেইরকম কোলাহল করবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। লোক জড়ো করবে, থানায় যাবে, এসব সে পারে—এবং দু একবার সামান্য কারণে করেছে।
কিন্তু শান্তি একজনকে ভালোবাসে—সে ওর মার বাড়ির কাছেই থাকে—তার পায়ের শব্দের জন্য শান্তি কান পেতে থাকে। কিন্তু সে এ বাড়িতে আসে না। মা কিছুতেই এটা বরদাস্ত করবেন না। তার স্ত্রী আছে, সে বিবাহিত। শান্তির জীবনের এ সমস্যার কোনো সমাধান নেই।
তাই আমি ভাবছি, শান্তির চোখে জল দেখলাম কেন? ও এত কষ্ট পেয়েছে যে ওর চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে। একটা শঙ্কা আমার বুকের ভিতর গুরগুর করে উঠল। আর তখুনি গুনগুন করল একটা গানের কলি—‘শঙ্কিত চিত্ত মোর, পাছে ভাঙ্গে বৃন্ত ডোর…আচ্ছা রবিঠাকুর এত জানলেন কি করে? তারও নিশ্চয় এরকম হয়েছিল—এরকম মানে—মির্চার মতো, আমার মতো নয়, আমি তো মেয়ে—! বাঃ! এ তো মেয়েদেরই, কথা, শরম রক্তরাগে, তার গোপন স্বপ্ন জাগে’—এ তো ছেলের কথা নয়, ‘শরম’ ‘ভরম’ এসব তো মেয়েদেরই ব্যাপার। তাহলে কোনো মেয়ে ওকে বলেছিল, কে সে হতে পারে? বইগুলো খুঁজে খুঁজে দেখতে হবে। ছিঃ, গুরুজন সম্বন্ধে বাজে কথা ভাবতে নেই।
আমি আয়নার সমানে দাঁড়িয়েছি, আমার আঁচল খসে গেছে—আমার নাচতে ইচ্ছে করছে। আমি হাততালি দিয়ে দিয়ে ঘুরছি—
যৌবন সরসী নীরে, মিলন শতদল,
কোন চঞ্চল বন্যায়, টলমল টলমল—
এই গানটা কিছুদিন আগে প্রেসিডেন্সী কলেজে সুশীল দে-কে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতে শুনেছিলাম। কী ভালো লেগেছিল! কতবার ভেবেছি ঐ ভদ্রলোকের কাছে আর একবার শুনলে হতো, তা কি করে হবে? বাবাকে কি বলা যায় তোমার ছাত্রের কাছে ঐ গানটা শুনতে চাই আমি। অবশ্য বললে কি হতো? কিছুই হতো না। বাবা বেশ গর্বভরেই বলতেন, “ও সুশীল, আমার মেয়ে তোমার কাছে একটা গান শুনতে চায় তুমি একবার আমাদের বাড়ি এস!” যা হোক আমি তা বলি নি। আর তাছাড়া গানটা তখন ভালো করে বুঝিই নি। এখন বুঝছি, প্রত্যেক দিন এক একটা গান বা কবিতা আমার মনে বা শরীরে অর্থবান হচ্ছে। শরীরেও? শরীর কি গানের অর্থ বোঝে? নিশ্চয়ই। এই গানটা তো আমার শরীরেই অর্থ পাচ্ছে। তাই তো আমার নাচতে ইচ্ছে করছে টলমল, টলমল, টলমল—আমি ঘুরছি, ঘুরছি, ঘুরছি। শান্তি ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে টুলটায় বসল। ওর সুন্দর বাকা যুগল ভুরুর মাঝখানে সিঁদুরের টিপ জ্বল জ্বল করছে, আমার সিঁদুর পরতে ইচ্ছে করছে। আমি ওর মুখটা আমার দুহাতে ধরে গান করলাম—
“তারই গন্ধ কেশর মাঝে একবিন্দু নয়ন জল টলমল টলমল,—ও শান্তি যৌবন সরসী নীরে মিলন শতদল কি তা তুই জানিস?”
“ক্ষেপে গেলে নাকি?”
“আমার নাচ শিখতে ইচ্ছে করছে। শান্তিনিকেতনে রবিঠাকুর মেয়েদের নাচ শেখাচ্ছেন।”
“যাও না শেখ।”
“তাহলেই হয়েছে।” বাবা আমাকে ছাড়বেন? বাবা আমাকে কোথাও যেতে দেবেন। আমি এখানে বন্দী, অবশ্য স্নেহে বন্দী কিন্তু কোনো বন্দীদশাই সুখের নয়। একবার রবীন্দ্রনাথ আমাকে বলেছিলেন, “তোমার বাবার কাছ থেকে তোমাকে আমি কয়েক মাসের জন্য ধার নেব। আমি মালিনী নাটকের জন্য কাউকে খুঁজছি। তুমি পারবে। মালিনীর মতো তোমার মনের আকাশ আছে।”
“মনের আকাশ” এমন একটা কথা এই প্রথম শুনলাম, এর আগে আকাশ আকাশেই ছিল, ঐ কথাটা শোনা মাত্র তা মনে নেমে এল, তার সমস্ত নীল রঙ নিয়ে ছড়িয়ে গেল। কি যে এক অনির্বচনীয় আনন্দে মন ভরে গেল। উনি কথার যাদুকর, কথা দিয়েই উনি আকাশে মেঘ জড়ো করে অলকানন্দা নামাতে পারেন, মল্লারের দরকারই হয় না। কিন্তু বাবা আমাকে ছাড়লেন? তিনি বললেন, “নাটক থিয়েটার করেই জীবনটা কাটাও আর কি। ছাত্ৰানাম্ অধ্যয়নং তপঃ।”
“দেখ শান্তি, আমার যখন বিয়ে হবে, আমি যখন স্বাধীন হব তখন আমি সাবিকে আমার বাড়ি নিয়ে নাচ শেখাব। কেউ আটকাতে পারবে না।”
আমার ধারণা বিয়ে হলেই সবাই স্বাধীন হয়। অবশ্য শান্তির মত বিয়ে হলে নয়। কিন্তু কে স্বাধীন? আমার মা কি স্বাধীন? একটুও নয়। আচ্ছা আমার কি রকম বিয়ে হবে? মির্চা! মির্চা! না, না, কখনো হবে না। বৃন্তডোর ভাঙ্গবেই। আমি শান্তির গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। ও খুব অবাক হয়ে গেছে, “কাদছ কেন ভাই, নাচ শিখে কি হবে? নাই বা শিখলে?”
“সে জন্য নয়, আমার মন কেমন করছে। ভীষণ মন কেমন করছে।”