আমি যখন সেই নির্জন গিরিবাসে এলাম তখন বর্ষাকাল—গভীর আদিম অরণ্য পার হয়ে যখন বাড়িতে, এসে পৌঁছলাম তখন সেই বাগানঘেরা বাড়িটা যেন আমার দিকে চেয়ে হেসে উঠল। শান্ত নির্জন বনভূমি—দূরে নীলাভ দিগন্তে বরফের সাদা রেখা। গৃহ সুসজ্জিত, ভৃত্যকুল পরিমার্জিত। আমাকে ‘ব্যাচিলারের’ এলোমেলো বাড়িতে আসতে হয় নি। আমরা যদিও এদের চেয়ে সঙ্গতিসম্পন্ন তবু সত্যি বলতে কি, এত আরামে পূর্বে থাকি নি। কিন্তু আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা নিন্দা করতেই লাগল—তারা বললে যথোপযুক্ত বিয়ে হয় নি, ইত্যাদি ইত্যাদি—বিশেষত আমার সমবয়সীরা আমার দুঃখে গলে যেতে লাগল—শেষ পর্যন্ত এই! আমার ভারি রাগ হত। গোপালের সঙ্গে তো আমার জন্মের মতো ঝগড়া হয়ে গেল। এক বান্ধবী মুখ টিপে বললেন-“পতিনিন্দা শুনি সতী হৈল অতি রোষবতী”—আর একজন বললেন, “তোর যখন পছন্দ হয়েছে আমাদের আর বলার কি আছে, তবে বলিহারি যাই তোর পছন্দে—”।
আমি যখন ওদের সঙ্গে তর্ক করতাম সেটা তোক দেখাবার জন্য নয় বা মান বাচানর জন্যও নয়, এবাড়ির পুরুষদের দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তারা কর্তৃত্ব করে না, সমস্ত মেয়েদের উপর ছেড়ে দিয়েছে—এ বাড়ির মেয়েরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। অন্য বাড়িতে যেমন দেখি বাড়ির কর্তার জন্য ভালো জিনিসটা তোলা রইল এখানে তা হতেই পারবে না–কর্তারা ফুলস্থুল বাধিয়ে দেবেন। স্ত্রী রাধতে বসলে কর্তা হয়তো পাখা নিয়ে তাকে বাতাস করতে গেলেন! সত্যি বলতে কি এক বাড়িতে এতগুলি কর্তব্যপরায়ণ, উদার ও সৎ লোক আমি পূর্বে দেখি নি।
আমি আমার সংসারযাত্রার পূর্ণ চিত্র এখানে আঁকতে বসি নি। এটা আমার জীবনী নয়—এটা আমার জীবনের একটা অংশ মাত্র, সেখানে নায়ক মির্চা কিন্তু এই গল্পটা সম্পূর্ণ করতে গেলেও আমার স্বামীর কথা কিছুটা বলতে হবে, কারণ তাঁকে বাদ দিয়ে তো আমি নয়। আমরা আটত্রিশ বছর ধরে একসঙ্গে যে সংসার রচনা করেছি তাতে কোনো খুঁত ছিল না, বলতে গেলে কখনো আমাদের বিরোধ হয় নি। আমরা প্রত্যেকটি ফার্নিচার তৈরী থেকে সন্তানপালন একসঙ্গে একমত হয়ে করেছি এবং এসব কাজ মোটামুটি সুসম্পন্ন হয়েছে। আমাদের সন্তানেরা বিরাট প্রতিভাধর না হলেও মানুষ হিসাবে তারা শ্রেষ্ঠ মানুষের শ্রেণীতে যেতে পেরেছে। যে শূন্যতা নিয়ে আমি জীবন শুরু করেছিলাম আমার সংসারের মধ্যে তা ফঁাকির বাঁশি বাজায় নি। বিবাহের পূর্বে আমার প্রধান আকাঙ্ক্ষা যা ছিল, স্বাধীনতা, তাও আমি পূর্ণমাত্রায় পেয়েছি। আমার ঘরে পা দিয়েই আমি বুঝতে পেরেছি, আমার শৃঙ্খল খুলে গেছে, আমি যা উচিত মনে করব তা করতে পারব। স্বাধীনতার অর্থ স্বেচ্ছাচারিতা নয়, আমার অফুরন্ত স্বাধীনতা আমি এমন কোনো কাজে লাগাই নি যা আমার যোগ্য নয়।
বিয়ের অল্প কিছুদিন পরে আমার মনে হল মির্চার ব্যাপারটা আমার স্বামীকে বলা প্রয়োজন—আমি একদিন শুরু করলাম—“আমাদের বাড়িতে একজন বিদেশী ছাত্র ছিল, সে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, বাবা দিলেন না, তখন সে হিমালয়ে চলে গেল!” একটি বাক্যে আমি সংক্ষেপে কাহিনীটা শুরু করলাম। আমার স্বামী বললেন, “ও তাই নাকি?”
ব্যস্ ফুরিয়ে গেল। ওর কোনো কৌতূহল নেই। কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো, কোনো দায়ে পড়ে দু-চারটে বেশি কথা বলতে হলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। খুব সংক্ষেপে একটা হাসির কথা বলে উনি বাক্যালাপ চুকিয়ে ফেলতে পারলে বাঁচেন। হিমালয়ে চলে গেল তো গেল, আমার কথাটি ফুরলো নটেগাছটি মুড়লো। তারপর আর কি? কাজেই সেদিন আর আমার কিছু বলা হল না। বেশ কিছুদিন পরে আমি আবার একদিন মনস্থির করে তোড়জোড় করে শুরু করলাম—আজ বলতেই হবে। না বলাটা খুব অন্যায় হচ্ছে, “আচ্ছা বাসরঘরে যখন আমি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম তোমার কি মনে হয়েছিল?” নীরবতা, নিচ্ছিদ্র নীরবতা।
“বল না বলতেই হবে তোমার খারাপ লেগেছিল কি না।”
নীরবতা দুর্ভেদ্য। আমিও স্থিরসংকল্প আজকে বলবই—
“কিছু নিশ্চয় মনে হয়েছিল, আমার ভাবভঙ্গী তো ঠিক সহজ ছিল না,”…বহু প্রশ্নের পর উত্তর এই, “তা সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন লোকের সঙ্গে হঠাৎ রাত্রে একঘরে থাকতে অসুবিধা তো লাগতেই পারে। খারাপও লাগতে পারে।”
“তোমার অসুবিধা বা খারাপ লাগে নি?”
“একটুও না।”
“ভালো লেগেছিল?”
“খুবই। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম তোমাকে দেখে।”
“তবে আমারই বা খারাপ লাগছে কেন তা তোমার মনে হয় নি?”
এই প্রকারে অশেষ প্রশ্নবাণে নির্যাতিত হবার পর বললেন—“আমার বন্ধু ভূপেশের কথা মনে হয়েছিল, তার মতো হল না তো?”
গল্পটা এই—ভূপেশের বিয়ে হল যেমন কথাবার্তা হয়ে বিয়ে হয়ে থাকে, ভূপেশও মেয়েটিকে আগে দেখে নি। বাসরঘরে মেয়েটি ভূপেশকে বললে, “দেখুন, আমি আপনার স্ত্রী নই, হতে পারি না, আমি একজনকে পতিত্বে বরণ করেছি, সেও আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আমার বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না। তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন আমি কি করি? আপনারও আমাকে বিয়ে করা উচিত নয়।”
ভূপেশ স্তম্ভিত। মেয়েটির কথা ঠিকই, যুক্তিযুক্ত। ভূপেশ সেই ছেলেটির নাম ঠিকানা নিল, তারপর বরবেশী ভূপেশ বাসরঘর থেকে, বিবাহ বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই পলাতক প্রেমিকের সন্ধানে রাত্রির অন্ধকারে যাত্রা করল। ওদের তখনও কুশণ্ডিকা হয় নি—শুধু সম্প্রদান হয়েছে অর্থাৎ বিবাহের আসল অংশ হয় নি। ঐ কন্যা ভূপেশের ধর্মপত্নী নয়, ওরা একসঙ্গে ধর্মানুষ্ঠান করে নি, সপ্তপদী করে নি, শুধু কন্যার পিতা অন্যান্য তৈজসপত্রের সঙ্গে সালঙ্কারা কন্যাটিকে ভূপেশকে সম্প্রদান করেছেন—তুভ্যঅহং সম্প্রদদে-সম্পত্তি হাত বদল হয়েছে মাত্র! এই কন্যা এখন ভূপেশের সম্পত্তি। ঠিকানা নিয়ে ভূপেশ সেই ভদ্রলোকের বাড়িতে উপস্থিত, “বেশ মানুষ তো আপনি, পড়ে পড়ে শোক করছেন, আপনার কর্তব্য কিছু নেই?”
ছেলেটিকে নিয়ে ভূপেশ বিবাহ বাড়িতে ফিরে এল। সে কর্তব্য স্থির করে ফেলেছে। মেয়ের বাপকে ঘুম ভাঙিয়ে বললে, “আপনি গর্হিত অন্যায় কাজ করেছেন। যাহোক আপনি তো আপনার কন্যাকে আমার হাতে সম্প্রদান করে দিয়েছেন, তার উপর আপনার আর কোনো অধিকার নেই…এখন আমি তাকে তার মনোনীত পাত্রের হাতে সম্প্রদান করে দিচ্ছি। ওদের বিবাহ হবে, আপনার বাধা দেবার কোনো অধিকার নেই।”
“তারপর?”
“তারপর ওদের বিয়ে হয়ে গেল।”
আমি মনে মনে ভাবছি, বাপ্ রে, এই মেয়ের মনে জোর আছে। “তারও পর আছে নাকি?”
“আছে। সেই ছেলেটি সেই রাত্রেই ঐ মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলেছিল, সে যেন কেমন হয়ে গেল—উদভ্রান্ত-মাঝে মাঝে ওদের বাড়ি যেত।” তারপর একদিন সে মরে গেল। তার ঘরে স্টোভে আগুন জ্বলছিল, খাট থেকে গড়িয়ে পড়ে আগুন লেগে গেল। পুড়ে মরল বেচারা। কেউ কেউ বলে আত্মহত্যা করেছিল।
“নিশ্চয়ই আত্মহত্যা।”
কী ভীষণ ব্যাপার, বঞ্চিত প্রেমের এই পরিণামে সৌন্দর্য তো নেই…সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্—শিবও নেই সুন্দরও নেই—সৌন্দর্য ছাড়া সত্যের রূপ ভয়ঙ্কর–প্রেমের মধ্যে যদি সৌন্দর্য ফুরিয়ে যায় তাহলে রইল কি? আমি মানসচক্ষে একটা দগ্ধ লোককে দেখতে পেলাম—তার গায়ের মাংস দগদগে, তার চুল পুড়ে গেছে, তার মুখ ঝলসে গেছে—সে গোঙাচ্ছে! কী ভয়ানক! আমাকে ভালোবেসে যদি কারু এই পরিণাম হয় তাহলে আমিও বাঁচতে পারব না। আমার ভয় করতে লাগল, এর বন্ধু যদি এই রকম তবে ইনিও এই। আর কোনো কথা বলে কাজ নেই, ওর মনে এতটুকু দুঃখ দিতে পারব না। মির্চা যদি এই মুহূর্তে এসে বলে ‘চল’ আমি কি যেতে পারি? কখনো না, আর হয় না। এই ভদ্র মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে কোনো স্বর্গ থেকে আমি সুখ পেড়ে আনতে পারব না। আমার এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে, আমি জানি সুখ বাহিরের কোনো অবস্থায় বা বস্তুতে নেই—অন্তরে তার আয়োজন সুসম্পূর্ণ থাকলে তবেই বাহিরের স্পর্শে তা উচ্ছ্বসিত হতে পারে। বিবেকের দহনে অন্তর যদি ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে, নিন্দায় কুবাক্যে ইতর জনের রসনায় যদি তা লেহ্যমান হয় তাহলে মির্চাকে জড়িয়ে ধরলেই কি আমি সুখ পাব? শরীর সুখ দিতে পারে না, সুখ দেয় মন, আমার মন অন্যকে দুঃখ দিয়ে সুখী হতে পারবে না, এটুকু আমি জানি।
অন্যকে দুঃখ দিয়ে সুখী হওয়া যায় না, অন্যকে বঞ্চিত করে সুখী হওয়া যায় না—এগুলো সোজা কথা, বার বার শুনেছি। আমি তো আবিষ্কার করি নি, সবাই জানে। জানে কি? তাহলে রমা এই মুহূর্তে আমার মাকে কেন তুষানলে দগ্ধ করছে। যাক, যার যা ইচ্ছে করুক। আমি এই নির্বিরোধী ভালোমানুষকে কখনো দুঃখ দেব না। এটা কি শুধু কর্তব্য? কখনই নয়, আমি তো এঁকে ভালোবাসছি, খুবই ভালোবাসছি। সেদিন সেটা বুঝতে পারলাম যেদিন রাত আটটা নাগাদ বেহারা বলল, “সাহেব যেখানে গেছেন সেখান থেকে আসতে পথ হারিয়ে ফেলতেও পারেন। সাহেব যদি ঘোড়ায় যেতেন পথ হারাতেন না, ঘোড়া ঠিক বাড়ি এনে হাজির করত। কিন্তু…” অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়ছে-নিচ্ছিদ্র অন্ধকার রাত্রি, কোনোখানে জনমানবের চিহ্ন নেই—ওরা বলাবলি করছিল ঐ রাস্তায় ভাল্লুক বেরোয়। আমি এত অস্থির হয়ে পড়েছিলাম যে ওরা যদি না যেত আমি নিজেই ম্যাকিন্টস চাপিয়ে, গামবুট পরে লণ্ঠন নিয়ে বেরুতাম—তা বাঘই থাক আর ভাল্লুকই থাক, এটা কি ভালোবাসা নয়? তবে, তবে আবার কি? কিছু তবে আছে নাকি? আছে আছে আছে—এই সাজানো সংসারের মধ্যে বসে আমার স্বামীর সস্নেহ ভালোবাসার আশ্রয়ে থেকেও আমার মন কেন এত শূন্যতায় ভরে থাকে কে বলবে? ‘শূন্য হাতে ফিরি হেনাথ-পথে পথে…।
আমাদের বিবাহিত জীবন মসৃণ পথে চলেছে, আত্মীয়স্বজন যাই বলুক, বন্ধুবান্ধবরা যা-ই ইঙ্গিত করুক, আমরা বেশ আছি। আমার স্বামীর সঙ্গে সবচেয়ে যে বিষয়ে আমার সঙ্গে মিলেছে তা হচ্ছে তারও কোনো সংস্কার নেই। তিনি কোনো আচারে বদ্ধ নন, তিনিও জাতিভেদ মানেন না, সামাজিক ব্যবস্থাগুলি যুক্তি দিয়ে বোঝেন। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম যেদিন শুনলাম যে তিনি প্রথম যে দিন মাংস খেলেন সেটা ছিল গোমাংস। আমিও চমকে উঠেছি। ইনি মাংস খেতেন না, প্রথম যে দিন পাহাড়ে এসে পৌঁছেছেন এক সাহেবের বাড়ি সেদিন খাবার ব্যবস্থা হয়েছে, তার মেম আবার দারুণ কৃপণ। অতিথি নিমন্ত্রণ করে একখানাই মাছভাজা রেখে বলে, একখানা মাছ খেতেই হবে। সেদিন সে মাছভাজা রাখে নি রেখেছিল বীফস্টেক।
“তুমি খেলে কেন?”
“আর তো কিছু ছিল না, ওরা অপ্রস্তুত হবে, মাংস যদি খেতেই হয় তো ছাগলই বা কি গরুই বা কি, বরং গরুই ভালো, একটা প্রাণী হত্যা করে অনেকটা মাংস পাওয়া যায়, হাতি আরো ভালো।”
অকাট্য যুক্তি। সেযুগে মধ্যবিত্ত ঘরের হিন্দু সন্তানের পক্ষে এটা কঠিন কাজ। কিন্তু এটা কোনো কঠিন কাজ করার মত করে করা নয়—উনি কোনো বিপ্লবী নন, আমি যে রকম জাতিভেদ ভাঙবার জন্য উদ্যত সে রকমও নয়—খুব সহজ স্বাভাবিকভাবে সত্যকে পাওয়া।
পরে যখন রবীন্দ্রনাথ, একে ভালোমতো চিনলেন তখন বলেছিলেন, “গল্পস্বল্পের ভালোমানুষ কবিতাটিতে এরই পরিচয় রেখে দিয়েছি–”
মনিরাম সত্যই স্যায়না
বাহিরের ধাক্কা সে নেয় না।
বেশি করে আপনারে দেখাতে
চায় যেন কোনোমতে ঠেকাতে–
যোগ্যতা থাকে যদি থাক না
ঢাকে তার চাপ দিয়ে ঢাকনা
আপনারে ঠেলে রেখে কোণেতে
তবে সে আরাম পায় মনেতে।
যেথা তারে নিতে চায় আগিয়ে
দূরে থাকে সে সভায় না গিয়ে
বলে না সে আরো দে বা খুবই দে
ঠেলা নাহি মারে পেলে সুবিধে।
যদি দেখে টানাটানি খাবারে
বলে কি যে পেট ভার বাবারে।
ব্যঞ্জনে মুন নেই খাবে তা
মুখ দেখে বোঝা নাহি যাবে তা।
যদি শোনে যা তা বলে লোকেরা
বলে, আহা ওরা ছেলে ছোকরা।
পাঁচু বই নিয়ে গেল না বলে
বলে খোঁটা দিও নাকো তা বলে।
বন্ধু ঠকায় যদি সইবে–
বলে হিসাবের ভুল দৈবে
ধার নিয়ে যার কোনো সাড়া নেই–
বলে তারে বিশেষ তো তাড়া নেই–
যত কেন যায় তারে ঘা মারি
বলে দোষ ছিল বুঝি আমারই!
এই কবিতার তত্ত্ববাণী গীতারই কথা—দুঃখে অনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখে বিগত স্পৃহঃ—সুখেদুঃখে অবিচলিত অনাসক্ত এবং নিরহঙ্কার এ সবগুলি গুণই আমার স্বামীর পূর্ণমাত্রায় আছে—এগুলো তাকে সাধনা করে উপার্জন করতে হয় নি। এ তাঁর স্বাভাবিক বিধিদত্ত গুণ। আমি তো উপার্জন করতে চেষ্টা করি, কিছুই পারি না। আমি উদ্বিগ্ন অসহিষ্ণু ও নানাবিধ দোষের আকর—জল যেমন মাছের আকর আমিও তেমনি দোষের আকর, আমার মধ্যে দোষগুলো কিলবিল করছে। সম্ভবত সেই জন্যই প্রায় সর্বদাই আমার মনের মধ্যে হু হু করে—এই যেমন একদিন সন্ধ্যেবেলা আমি বসে বসে ভাবছিলাম অর্থাৎ গুনছিলাম আমি সারা দিনে ক’টা কথা বলেছি—গুনে দেখলাম সাত-আটটার বেশি হবে না—সেগুলো এই রকম—আজ আধঘণ্টা দেরী কেন? বিকালে কি টেনিস আছে? পরশু কি অসবোর্নরা খেতে আসবে? সামশের বেয়ারা কি একা পারবে? আর কি কথা হবে? আমরা যে দুই জগতের মানুষ—উনি যা পড়েছেন আমি তা পড়ি নিতা নাই বা হল—আমি না হয় কেমিস্ট্রিই পড়তুম—যদি উনি পড়াতেন, আমার তাতে আপত্তি নেই—যে কোনো জ্ঞানের বিষয় থেকে আমি আনন্দ পেতে পারি কিন্তু উনি তা পারবেন না। অত কথা বলা ওর কর্ম নয়। আর আমি যা পড়েছি তা উনি পড়েন নি, পাঠ্যপুস্তক ছাড়া কোনো ভাষায় এক লাইন কবিতা উনি পড়েন নি। তা আমি তো ওকে শোনাতে পারি? তা কি হয়? কবিতা যে বোঝে না তাকে শোনান যায় না। যদিও আমি শোনালে উনি খুব সহিষ্ণুভাবে শুনবেন, কখনই সেই ভদ্রলোকের মতো করবেন না যার কথা আমি আমার এক আত্মীয়ার কাছে শুনেছিলাম। আমার কবিতারসিকা আত্মীয়া নববিবাহের পর স্বামীকে একটি ‘মহুয়া’র কবিতা শোনাবেন বলে বেশ গুছিয়ে বসেছেন। স্বামীও খুব উৎসাহ দেখিয়েছেন, কবিতাটি পড়তে শুরু করবার আগে তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন—একটু দেখি’, বইটা হাতে নিয়ে একটু দেখে ফেরৎ দিলেন। মেয়েটি অবাক হয়ে গেছে—“কি ‘দেখলে?”
“দেখলুম কবিতাটি কত বড়। আমার স্বামী এরকম কখনো করবেন না। আমি যদি টালি এডিশনের সমগ্র রচনাবলী তাঁকে শোনাই তিনি পরম ধৈর্যে শুনে যাবেন, বললেন, “খুবই তো ভালো।”
এক একদিন তা নয়, প্রায় প্রত্যেকদিনই নির্জনতা আমাকে চেপে ধরে। দুপুরবেলা আমি ঘুমোই না, পড়ব কি? এ তল্লাটে বই নেই। যে ক’খানা বই আছে বহুবার করে পড়া হয়ে গেছে। বই এত কিনবই বা কি করে? কেই বা বই পাঠাচ্ছে আমায়? তবু যখনই কলকাতায় যাই কিছু বই সংগ্রহ করে আনি। আমার স্বামী যে কথা বলতে একেবারেই ভালোবাসেন না তবুও তাঁরও এই নির্জনতা কষ্টকর বোধ হয়। একবার আমায় লিখেছিলেন, “দিন পনের আয়নায় ছাড়া আর কোন শিক্ষিত মানুষ দেখি নি।”
সন্ধ্যেবেলাটা যেন আরো নির্জন। বারান্দায় আমি আর আমার স্বামী বসে থাকি—আমি দু’চারটে কথা বলবার চেষ্টা করি। কিন্তু কোন ভাষায় কথা বলব? আমাদের ভাষাই যে পৃথক। তাই একটু পরেই দু’জনেই চুপ। এই মানবহীন দেশে শব্দগুলি যেন নির্জনতাকে আরো বাড়িয়ে তোলে—অন্ধকার বন থেকে একটা রাত-কো-চরা ডেকে ওঠে, একটা বাদুড় ঝুপ করে পড়ে যায়। ঝিঝি পোকা ডাকতে থাকে অবিশ্রান্ত ঝি ঝি ঝি—পাশের ঝরনাটাও তো থামে না, ঝর ঝর ঝর ঝর চলেইছে চলেইছে—এ শব্দগুলো মানুষের সঙ্গী নয়—এরা কেবল বলতে থাকে, তুমি একলা, তুমি একলা–আমি বুঝতে পারি, প্রত্যেকদিন বুঝতে পারি আমার জগৎটা হারিয়ে গেল। আমার লিখতেও আর ভালো লাগে নাকি লিখব? লেখা আমার এই জনহীন জগতে দিকভ্রান্ত হয়েছে। অনেকে মনে করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বোধ হয় লেখকের প্রেরণা জোগায়—ফুলের বাগানে বসে কবিতা লিখলে কবিতার গুণ বেড়ে ওঠে। যে জন্য শুনি শান্তিনিকেতনে আজকাল গাইডরা দেখায়, “ঐ গাছের নীচে বসে কবি ‘রক্তকরবী’ লিখেছিলেন, ঐ কুঞ্জের পাশে বসে ‘মহুয়া’ ইত্যাদি…মূঢ়তার যেন শেষ নেই। শান্তিনিকেতনের এই নির্জন প্রান্তরে বিশ্বের লোককে ডাক দিয়ে আনলেন কবি লেখারই প্রয়োজনে।
মানুষের সঙ্গে সংস্পর্শে সুখদুঃখের ঘাতপ্রতিঘাতে ভালোমন্দের দ্বন্দ্বে নিত্য মথিত হওয়াই লেখকের প্রেরণার উৎস। নিস্তরঙ্গ শান্ত অবস্থা, জনবিরল অরণ্য সাধুসন্ন্যাসীদের দরকার থাকতে পারে, আমার নয়। এই প্রকৃতি আমায় জীবন দিচ্ছে না বরং হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মানুষকে দরকার। অন্তত আমার দরকার। মির্চার বদলে একটা পুষ্পিত তরু হলে কি ভালো হত? হাঃ হাঃ হাঃ একটা কথা মনে পড়ে গেল—“প্রথম কাকে ভালোবেসেছিলে, বল বল”-“একটা গাছকে গো একটা গাছকে”—এখন থাক গাছে ঝুলে!
আমার বাইশ বছর অরণ্যবাসের তিনটি বছর স্মরণীয়—ঐ তিন বছরই আমরা বেঁচেছিলাম। বাকি দিনগুলি খালি পুনরাবৃত্তি। যখন আমার জীবনের সেই সুন্দরতম পর্ব শুরু হতে চলেছে যতদূর মনে পড়ে সেই সময়ে অর্থাৎ ১৯৩৮ সালে অল্পদিনের জন্য কলকাতায় এসেছি। বাবা আমাকে বললেন, “ইউক্লিড তোমাকে একটা বই উৎসর্গ করেছে, উৎসর্গপত্রে তোমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে।” কথাটা শোনবার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না—হৃৎপিণ্ড লাফাতে লাগল, বাধাই মানে না—আমি প্রস্তরীভূত দাঁড়িয়েই রইলাম, কিছু বললাম না। কয়েক মিনিট পর তিনি আবার বললেন, “পর্নগ্রাফি লেখার জন্য তার জেল হয়েছে।”পর্নগ্রাফি কথাটার অর্থ আমি জানতাম না। বাবাকে জিজ্ঞাসা করবার ইচ্ছা ছিল না। যা লিখলে জেল হয় তা নিশ্চয় কোনো সৎসাহিত্য নয়। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে প্রশ্নও না করে চলে গেলাম। ডিকশনারিতে ঐ শব্দটা দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। একি বিশ্রী ব্যাপার! আমাকে যে বইটা উৎসর্গ করেছে সেটাই ওরকম না তো! আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না আমাকে বই উৎসর্গ করবারই বা দরকার কি, ক্ষমা চাওয়ারই বা প্রয়োজন কি! বইটা সম্বন্ধে আমার কোনো কৌতূহল হল না। শুধু ঘৃণায় আমার মন সঙ্কুচিত হয়ে গেল, অপবিত্র বোধ হতে লাগল এবং এই রকম একজন লোকের সঙ্গে আমার এক দিন ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল এবং এর জন্য আমি এত আগ্রহী ছিলাম ভাবতেই আমি শিউরে উঠলাম। আমার এতই খারাপ লেগেছিল যে আমি ঐ বইটার কথা ভুলে গেলাম, অর্থাৎ মনেই আনতে চাইলাম না, তারপর থেকে প্রায় পনের বছর ওর নামটাও আমার মনে পড়ে নি। ঘৃণার একটা প্রকাণ্ড পাথর দিয়ে স্মৃতির সেই আলোকিত গুহাটার মুখ আমি নিচ্ছিদ্র বন্ধ করে দিলাম…করে দিলাম’ বলা ভুল হবে—এটা হয়ে গেল।
* * *