বড় টেবিলল্যাম্পটা জ্বলছে, তার ঘেরাটা সাদা গোল একটা বড় পাত্রের মত। এক পাশে বেতের সোফাটার উপরে আমি হেলান দিয়ে বসেছি। অন্য পাশে খাটের উপর মির্চা বসেছে। ওর পাটা ছড়িয়ে দিয়েছে। এই ভঙ্গীতে ওর পাটাই আমার বার বার মনে পড়ে। আমার ওর পাটা একটু ছুঁতে ইচ্ছে করছে—পা দিয়ে নয় হাত দিয়ে। ইস্ ওর পায়ে আমি হাত দিতে যাব কেন? অত কিছু বড় নয়। আর তাছাড়া ওই তো আমার পায়ে ধরবে—আমি যদি রাধার মত মুখভার করে ঘাড় বঁকিয়ে বসি তাহলে ও আমার পায়ে ধরবে, ‘দেহি পদপল্লব-মুদার—এটা হলে বেশ হত! সত্যি সত্যি রাগ তো আর হচ্ছে না, ঐ কবিতাটার জন্যই ভাবছি। গীতগোবিন্দ পড়ে এই রকম একটা ছবি ভেসে ওঠে। রাধা ঘাড় ফিরিয়ে বসে আছে আর কৃষ্ণ পায়ের কাছে নত। কৃষ্ণের রঙ কালো নয়, সাদা। আমাদের বামুনঠাকুরণ গান করছেন—‘মান করে থাকা আর কি সাজে! এখন জয়দেব পড়ছি। নীল রঙের মলাটে পূর্ণ চক্রবর্তীর আঁকা ছবি দেওয়া বাংলা অনুবাদসহ একটা বই উপহার পেয়েছি। বাংলা অনুবাদটা পড়ি না অবশ্য, দরকার কি এমন কবিতা পড়ে? গীতগোবিন্দ অমনিই বোঝা যায়। যদিও সবটা বুঝি না। যেমন ‘স্মরগরলখণ্ডনং,—গরল কি? গরল আবার কোথায় প্রেমের মধ্যে?
সত্যি বলতে কি ‘মহুয়া’ও সবটা বুঝি না—মহুয়ার ‘মায়া’ কবিতাটির মধ্যে বাবা বলেন একটা গভীর দার্শনিক তত্ত্ব আছে, আমাকে বুঝিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু আমি এখন দার্শনিক তত্ত্বে মন দিতে পারছি না। কবিতা এখন আমি অন্যভাবে বুঝছি। এত ভালো করে কোনদিনও বুঝি নি। প্রতিদিন নূতন করে বুঝছি কিন্তু মহুয়ার ঐ কবিতাটা, ‘এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল’ আমি বুঝতে পারছি না। এই ক্ষণটুকু চিরকাল হতে যাবে কি দুঃখে? চিরকালই বা পাব না কেন? বরং এটা বুঝতে পারি আমরা দুজনা স্বর্গ খেলনা গড়িব না ধরণীতে’—সেদিন মির্চাকে শুনিয়েছি। ওর খুব ভালো লেগেছে।–
আমি ওর দিকে দেখছি—ওর মুখ চোখ কেমন যেন অন্যমনস্ক, কি ভাবছে কে জানে—আজ যদি ও আমাকে হুইটম্যান শোনাতে চায় শুনবই না। সেদিন তিনটে কবিতা শুনিয়েছে, কবিতা না চ্যালাকাঠ।
কিন্তু মির্চা আজ সাহিত্য ভাবছে না। বাংলা পড়বারও ইচ্ছে নেই। সিগারেটটা নিবিয়ে অ্যাশট্রেতে গুজে দিয়ে ও আমার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল। তারপর চশমাটা খুলে চশমা মুছল—আমি ওর চশমাবিহীন চোখ দেখতে পাচ্ছি। চশমা খুললে আমার ভারি ভয় করে, ওর দৃষ্টিটা বদলে যায়—অন্য লোক মনে হয়। “চশমা খুললে আমি সহ্য করতে পারি না কেন মির্চা?”
“আমার যে মাইওপিয়া।”
ওর চোখের জন্য আমার খুব ভয়, কি জানি অন্ধ হয়ে যাবে নাতো! ও বললে, “একটা কথা বলছি শোনো, তুমি আমায় বিয়ে করবে?”
আমার বেশ হাসি পাচ্ছে—একে প্রপোজ করা বলে–ইংরেজি গল্পের বইতে পড়েছি। অতদূরে বসে করে না মোটেই হাঁটু গেড়ে বসে হাত ধরে করতে হয়। যা কিছু হল না। সাত হাত দূরে বসে “তুমি আমায় বিয়ে করবে?” আহা রে!
এ-ঘরের সামনের দরজাটা তো বাড়িতে ঢুকবার পথের উপর খোলা। এখান দিয়ে সর্বদা লোক যাতায়াত করছে। পর্দা নামে একটা পদার্থ ঝুলছে বটে, তবে সেটা ন্যূনতম, সেটা থাকাও যা না থাকাও তাই কাজেই, নিরুপায়!
পিয়ানোর উপর ওর বোনের একটা ছবি আছে, সুন্দর মেয়ে—আমার ওর সঙ্গে ভাব করতে ইচ্ছে করছে। মির্চা ওর বোনকে সবচেয়ে ভালোবাসে। ও বললে, “আমি আমার মাকে বোনকে তোমার কথা সব লিখেছি—ওঁরা খুব খুশি হবেন। তোমার কোনো অসুবিধা হবে না আমার বাড়িতে।”
এইবারে আমার বুকের ভিতরটা কাঁপছে। একটা কাগজ আর পেনসিল পড়েছিল সেটা নিয়ে আমি হিজিবিজি লিখছি। আমি কি উত্তর দেব?
“বলো, বলো, আমায় বিয়ে করতে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো? কথা বলছ না কেন?”
“আমার কথায় কিছুই হবে না মির্চা, বাবা কখনো রাজি হবেন না?”
ও বিষম আশ্চর্য হয়ে গেছে! “ওরা রাজি হবেন না? ওরা তো রাজি আছেনই।”
“কি করে জানলে?”
“ওরা আমাকে এত ভালোবাসেন, এত আপন করে নিয়েছেন কেন তবে?”
“বাঃ তাতে কি হয়েছে, তাই বলে তোমার সঙ্গে বিয়ে দেবেন এমন কথা নেই।”
“অমৃতা, তোমার নিজের কথা বলো, ওদের কথা পরে হবে, তোমার বাধা কোথায় আমি শুনতে চাই।”
এই দ্যাখো আবার আমায় অবিশ্বাস করছে—আমি মনে মনে বলছি অবিশ্বাস করো না তুমি, এই মুহূর্তে নয়—“ত্বমসি মম জীবনং, ত্বমসি মম ভূষণং, ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নং’-মুখে বলতে পারছি না, কিছু বলতে পারছি না, না। আমি মাথা নিচু করে কাগজে লিখে যাচ্ছি হিজিবিজি—“শোনো অমৃতা, আমি তোমায় বলছি আমি তোমাকে তোমার প্রিয়জনের কাছ থেকে নিয়ে যাব না, আমি এখানেই থাকব। ইউনির্ভাসিটিতে একটা দেড়শ টাকা মাইনের লেকচারার-শিপ নেব—আর কিছুই চাই না—ওতেই বেশ চলে যাবে।”
“মির্চা আমার বাবা কখনো রাজি হবেন না, কখনো নয়।”
“কেন আমি ক্রিশ্চান বলে? আমার গায়ের রঙ সাদা বলে?”
“কেন তা জানি না, তবে তুমি বিদেশী বলেই নিশ্চয়।”
“তুমি কি বলতে চাও, প্রফেসর জাত মানেন? দার্শনিকের কাছে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃস্টান আছে?”
“খুব আছে।” আমি কাগজে লিখছি—তুমি আমর এত কাছে এলে কেন, কেন, কেন? কোথা থেকে এলে, কেন এলে?
ও বলছে, “তাই যদি হবে তাহলে ওরা তোমাকে আমার সঙ্গে এরকম ছেড়ে দিলেন কেন? সব সময় একসঙ্গে আছি—”
“তাতে কি হয়েছে? ভাইবোনের মত কি মেশা যায় না–? আমরা যে পারলাম না সে তো আমাদেরই দোষ।”
“সে কি!” ও বিস্মিত, মর্মাহত। যেন এমন কথা জন্মে শোনে নি। আমার রাগ হচ্ছে, ক্যাটালগ করতে দেওয়া মানেই কি বাগদান নাকি? ওঁর সঙ্গে মিশতে দেওয়ায় অন্যায়টা কি হল? ও বার বার আমায় জিজ্ঞাসা করছে আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি কিনা এবং কাকে প্রথম ভালোবেসেছিলাম।
“গাছকে, গাছকে একটা ছাতিমগাছকে।” এ আবার কি কথা! যদিও আগেও বলেছি তবু এরকম অদ্ভুত কবিত্ব ও বুঝতে পারে না। ও খুব গম্ভীর হয়ে গেছে। আমার হাতের কাগজটা হিজিবিজি লেখায় ভরে গিয়েছে। মহুয়ার মলাটে শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামটা লেখা ছিল—আমাদের তখন অভ্যাস ছিল ওর হাতের লেখা নকল করা। সবাই করত, আমিও করছি—ও উঠে দাঁড়িয়ে দেখল।
“তুমি এখানে এঁর নাম লিখছ কেন? এর কাছ থেকে মত আনতে হবে, তুমি আমায় ভালোবাসবে কিনা তার জন্য অন্যের অনুমতি চাই?”
“দেশসুদ্ধ লোক ওর হাতের লেখা নকল করে, তার মানে ও নয়।”
“দেশসুদ্ধ তোক একজন লোকের হাতের লেখা নকল করে? দেশসুদ্ধ লোক কি পাগল হয়ে গেছে!”
আমি উঠে পড়েছি, চলে যাই। আমার খুব ওর কাছে যেতে ইচ্ছে করছে ওর কাধে মাথা রাখতে ইচ্ছে করছে, তা যদি পারতাম তাহলে এই মুহূর্তে ওর মনে যে দুঃখটা হয়েছে তা চলে যেত। কিন্তু তা সম্ভব নয়। আমি চৌকাঠে পা দিয়েছি ও বললে, “অমৃতা আমার একটা কথা শোনো, একটা কথা, রবিঠাকুরকে ভুলে যাও।”
“সে কি কথা মির্চা, সূর্যকে কি কেউ ভুলতে পারে?”
“সূর্য! মানুষ কি করে সূর্য হবে?”
“তুমি যখন বাংলা ভাষাটা শিখবে তখন তুমিও বুঝবে মানুষ সূর্য হয় কিনা।”
আমি মনে মনে বলছি, তোমাকে আমি সূর্য দেখাবই—যদি তা পারি তবে আমরা দুজনে এক সঙ্গেই সূর্যোপাসক হব।
এখন দুটো কাজ নিয়ে আমরা খুব ব্যস্ত, কাকার বিয়ে হবে আর আমার বই ছাপা হবে। কাকা নিজেও খুব বিয়ের জন্য উদগ্রীব, মেয়ে দেখেই তার পছন্দ হয়েছে—যদিও মার হয়নি। তবু যাইহোক বিয়ে ওখানেই হচ্ছে। এই সময় থেকে মির্চা নিয়মিত ধুতি পাঞ্জাবী পরতে শুরু করেছে। ধুতী পাঞ্জাবী পরলে ওকে যে কি সুন্দর দেখায়। সে কথা অবশ্য আমি ওকে বলি নি। কেন বলব? সে যে বলে আমি সুন্দর কিনা তা বোঝে না। এটা একদম বাজে কথা নিশ্চয়ই, কারণ আমার হাতে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। এই যেমন মির্চা আসবার কিছুদিন আগে আমার মাসতুতো দিদি সীতার বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল এক জমিদার-নন্দনের সঙ্গে। আমাদের বাড়ি থেকে মেয়ে দেখান হল। ছেলের আত্মীয়স্বজন এসে মেয়ের চুল খুলে, রঙ পরীক্ষা করে দেখল, গানও শোনাতে হল। যদিও তার হারমনিয়াম পিটিয়ে গান শুনে তাদের পালানই উচিত ছিল, তা পালায় নি—তাদের পছন্দ হল। তারা বললে, সব যখন ঠিকই হয়ে গেছে এবার ছেলে এসে মেয়ে দেখুক। ছেলে আধুনিক, মেয়ের সঙ্গে আলাপ করতে চায়। মেয়ের মাও আধুনিক। তিনি বললেন, ছেলে আসুক, সকলের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হোক। আমাদের কি রকম কালচার্ড পরিবার তার পরিচয় পাক। ছেলে এল, তার নাম মৃগাঙ্ক। খুব ফর্সা, জমিদারপুত্রের উপযুক্ত নধর চিক্কণ চেহারা। সাধারণভাবে সুন্দর বলা চলে। মার ইচ্ছা ছিল না আমি তার সামনে বের হই— কিন্তু কনের মা বললেন তাতে কি হয়েছে, বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এখন শালী সম্পর্কিত মেয়েরা না বেরুলে জমবে কেন?
মা তো আর বলতে পারেন না তোমার মেয়ের চেয়ে আমার মেয়ে দেখতে ভালো, যদিই গোলমাল হয়ে যায়। কাজেই মৃগাঙ্ক এল! দুদিন খাওয়াদাওয়া সিনেমা দেখা হল। খুব হৈচৈ করলাম আমরা। আমি তো ধরেই নিয়েছি দিদির সঙ্গে তার বিবাহ হবে, তাই শ্যালীকাজনোচিত ব্যবহার করেছি, হেসেছি ও হাসিয়েছি। তারপর মৃগাঙ্ক উধাও হয়ে গেল। তার হোস্টেলে খোঁজ নিয়ে জানা গেল দেশে চলে গেছে। দেশ থেকে তার বাবা জানালেন মৃগাঙ্ক বিলেত যাচ্ছে ব্যারিস্টারী পড়তে, এখন কিছুতেই বিয়ে করতে রাজী হচ্ছে না। অনেক জল্পনা-কল্পনা চলেছিল যে হঠাৎ এরকম মত পরিবর্তনের কারণ কি হতে পারে। যাহোক মাসীমা বলেছিলেন, এরকম চঞ্চলমতি ছেলের সঙ্গে বিয়ে না হয়ে ভালোই হয়েছে। আর এখন শুনছি, কয়েকদিন আগে বাবার কাছে বিলেত থেকে সে প্রস্তাব পাঠিয়েছে আমায় বিয়ে করতে চায়। বাবা মা সকলেই অসন্তুষ্ট, তখনই দিদিকে বলেছিলাম—রু’কে বের করব না। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এরকম কখনো ভালো! বাবা বললেন, বেশী ফরওয়ার্ড হতে গেলে এমনি দশা হয়। আর দিদিমা বললেন, একজনকে দেখতে এসে আর একজনের দিকে অন্য দৃষ্টিতে যে দেখে সে চরিত্রহীন। তার সঙ্গে বিয়ে হতেই পারে না। চুকে গেল।
কিন্তু এই গল্পটা আজ যদি ওকে বলি তাহলে কি হয়?
হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ তাহলে কি হয়? ভীষণ মজা হয়। আমি খুব গম্ভীরভাবে ওকে বলতে পারি, “দ্যাখো তুমি তো দেখতে পাওনা আমি সুন্দর কিনা।” তখুনি ও কাতরভাবে তাকাবে, আমি লক্ষ্য করেছি কিছুদিন থেকে কথাটা ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করছে তা আমি হতেই দেব না, বলেছে একবার যখন হয়ে গেছে ব্যাস! তারপর আমি বলব “দেখ মৃগাঙ্ক দেখতে পায়!” গল্পটা শুনলে ওর কি হবে তা আমি জানি।
“কৈ তুমি কোন দিনও এর কথা আমায় বলনি?”
“ওমা, বলবার আবার কি আছে!”
“কি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলে?”
খুব উদাসভাবে বলব—“কি জানি অত মনে নেই।”
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ খুব মজা লাগছে। ওর ঈর্ষাটা আমার এতো ভালো লাগে। ঈর্ষা আবার ভালো নাকি! খুব খারাপ। ঈর্ষার কারণে তার বর্ণ হলো কালো কিংবা ‘ঈর্ষা বিষময়ী ভুজঙ্গিনী। আরে দুর এ সে রকম ঈর্ষা নয়। এটা প্রেম এটা ভালোবাসা। ঈর্ষার ছোট্ট পাখীটাই তো আমার ঘুম ভাঙ্গিয়েছে। সেই পাখীটা এক ডাল থেকে আর এক ডালে, একদিন থেকে অন্যদিনে ফুরুৎ ফুরুৎ করে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে আর আমায় ডাকছে, ‘সখী জাগো, সখী জাগো—মম যৌবন নিকুঞ্জে গাহে পাখী।’….
আচ্ছা আমার ঈর্ষা হয় না কেন? ওতো কত কিছু বলে—সেই যে রিপণ স্ত্রীটে ও থাকত, সেখানকার মেয়েরা ওকে কি রকম পছন্দ করে—ওর পিছনে লেগেই ছিল, ওকে একদিন বালিশ ছুঁড়ে মেরেছিল—কত কি, ও সব আমার এক কান দিয়ে ঢেকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। শুনতেই ইচ্ছা হয় না—অবশ্য ঈর্ষা হবে কি করে, ওতো ওদের ঘৃণা করে, সেই জন্যই তো পালিয়ে এসেছে, কাজেই আমার এমন কিছু মহত্ব নেই! ও অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের কথা যা বলে শুনে তো অবাক হয়ে যাই। ওদের সকলেরই ধারণা তারা ইংরেজ, আমাদের প্রভু এবং বাঙালীরা অত্যন্ত নিম্নস্তরের জীব। পশু বললেই হয়। গ্যাণ্ডির উপর ওদের ঘৃণা এবং রাগ খুবই। ওরা নিজেরা অত্যন্ত অশ্লীল এবং অসভ্য, কিন্তু ওরা বাঙালীদের অসভ্য মনে করে। মির্চার ওখানে থাকতে রীতিমত কষ্ট হয়েছিল। সন্ত বম্ হয়েছিল ‘বিবমিষা’।
কি আশ্চর্য আমরা তো এই জাতটাকে চিনিই না। ওরা কোথায় থাকে কি করে, কেমন ওদের রীতিনীতি কিছুই জানি না। এক দেশে থাকি আমরা অথচ কেউ কাউকে জানি না। ওরা আমাদের সঙ্গে এক দেশে বাস করছে এবং চিরকাল আমরা একসঙ্গে থাকব তবু কেউ কাউকে চিনতেই পারব না। ওরা আমাদের সম্বন্ধে কত কুৎসিত কথা ভেবে রেখেছে, আর আমরা? আমি তো ওদের অস্তিত্বই খেয়াল করি নি। ওরা যে আছে, আমাদের সম্বন্ধে কিছু ভাবছে, এই বা কে লক্ষ্য করেছে? মির্চা না বললে কোনো দিনও আমার মনে পড়ত না যে অ্যাংলোইণ্ডিয়ান বলে একটা জাত আছে। ওদের সঙ্গে দেখা হয় ট্রেনে যাতায়াত করবার সময়, আর দূর থেকে রেলওয়ে কোয়ার্টারে ওদের দেখি। আমার কিন্তু ওদের খারাপ লাগে না—ওদের জানালায় পর্দা কেমন টান টান করে টাঙ্গায় বাঙ্গালীরা পর্দা টান করে টাঙ্গাতে পারে না। ওরা জানালায় টবে ফুল রাখে, বাগান করে—বাঙ্গালীরা করতে পারে না তবে ওরা আমাদের ঘৃণা করে খুবই ঘৃণা করে, মির্চা বললেও জানি ওরা আমাদের সঙ্গে ট্রেনে এক কামরাতেও চড়বে না। আর আমরা কি ওদের ঘৃণা করি না? খুব করি! বর্ণসঙ্কর কথাটা কি ভালো? ওরা আমাদের জানে না, তাই যদি জানত তাহলে ঘৃণা করত না। আমি যদি ঐ মেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারতাম, তাহলে কখনো আমাকে ঘৃণা করত না। আজ পর্যন্ত আমায় কেউ ঘৃণা করে নি। ঐ যে ছেলেটা মাঝে মাঝে মির্চার কাছে আসে, একবার ওর সঙ্গে ভাব করে দেখি কেমন ঘৃণা করে। ইস্—ঘৃণা করলেই হল। আমি যদি বলি, মির্চা ওর সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দাও তো, ও আমায় ঘৃণা করে কি না পরীক্ষা করে দেখব। তাহলে কি হয়? হাঃ হাঃ হাঃ পাখী ডাকবে আবার—‘মম যৌবন নিকুঞ্জে গাহে পাখী।’…
মির্চা আজকাল রোজই বিকেলে ধুতি পাঞ্জাবী পরে—আর শুনছি ও আর্য হবে, হিন্দু হবে। ও তো হিন্দু শাস্ত্র পড়েছে, তাই বলেই ধর্ম ত্যাগ করবার দরকার কি? আমি জানি না ও কেন হিন্দু হতে চায়, এ বিষয়ে প্রধান উৎসাহী কাকা। এমন কি হতে পারে যে ও হিন্দু হলে আর কোন বাধা থাকবে না তাই ভাবছে? ভুল ভুল। ও আমাদের সমাজটাকে একেবারেই চেনে না। এখানে কৈানো কাজের যুক্তি নেইবাবা কি জানেন না যে তার ছাত্রদের মধ্যে মির্চা নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু তাতে কি? ও যে অন্য জাত—জাত কি এক রকম? একে ও অন্য দেশের মানুষ, তারপর খ্রীস্টান, তা যদি নাও হত—ও যদি। হিন্দু বাঙালীও হত, তাহলেও আমাদের জাত হওয়া চাই। তাতেই হবে না গোত্র পৃথক হওয়া চাই। হায় কত যে ‘ছোট বড় নিষেধের’ গ্রন্থি তা ও জানে না। জানে, সবই জানে, শুনছে তো অনবরত—আমাদের প্রথা সংস্কার সম্বন্ধে ওর জিজ্ঞাসার অন্ত নেই, কিন্তু ও জানে না এগুলো আমাদের বাড়িতেও কতটা মানা হয়। আর বাবা যিনি এত জানেন, যার অগাধ পাণ্ডিত্যের শেষ নেই তবুও তিনি জানেন না গোত্র বা জাত যাই হোক মানুষের সুখদুঃখ তার উপর নির্ভর করে না। আর আমি? আমি মানি না, এ-সব মানি না, মির্চার সঙ্গে আমার যদি বিয়ে নাও হয়—সারা জীবন দিয়ে প্রমাণ করব আমি মানি না। কোনো আচার বা প্রথা মানুষের চেয়ে কখনো বড় হবে না আমার কাছে। জাতের কথা দূরে থাক, আমি হিন্দু সমাজের কিছুই মানি না। পূজাই মানি না। দেশের বাড়িতে কি হয়েছিল পূজার সময়?
দুবছর আগে আমি দেশে গিয়েছিলাম, দেশ অর্থাৎ আমাদের পূর্ববঙ্গের গ্রামের বাড়ি। সে বাড়িতে সত্তর জন লোক একসঙ্গে বাস করেন। এরা সব জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো ভাই ও তাদের ছেলেমেয়ে। এ-ছাড়া থাকে পনের কুড়ি জন ছাত্র, তারা এই কবিরাজ বাড়িতে টোলে পড়ে। একসঙ্গে সকলের রান্না হয়। এই বাড়ির কর্তা যিনি, তিনি সকলের বড় ভাই। তারই সবচেয়ে রোজগার বেশি। অন্যেরা তার অন্নেই মোটামুটি প্রতিপালিত। তিনি দোর্দণ্ডপ্রতাপ, তার দুটি স্ত্রী। বড়র ছেলে হয় নি, তাই তিনি আবার বিয়ে করেছেন। এই কাজটির জন্য মা, কাকা এঁরা তার প্রতি বিমুখ। কিন্তু বাড়িতে অনেকেই আছে যারা বিমুখ নয় বা হলেও বলবার সাহস নেই, কারণ তিনিই প্রতিপালক।
পূজার সময় আমরা দু’চার দিনের জন্য বেড়াতে গিয়েছি—আমরা কলকাতায় থাকি, আমার বাবা খ্যাতিমান, বিত্তবান্ তাই আমাদের খুব আদর। পূর্ববঙ্গের এই রকম বর্ধিষ্ণুগৃহস্থ পরিবারে পূজার আয়োজন বিরাট-কতদিন থেকে প্রতিমা তৈরি হচ্ছে চণ্ডীমণ্ডপেনাড় বানানো হচ্ছে, খৈ ভাজা হচ্ছে, তিল কোটা হচ্ছে। গ্রামের জীবন বেশি দেখি নি, তাই আমি খুব উৎসাহিত এবং আমাদের সম্পর্কিত ভাই-বোনেরাও গর্বিত ও আনন্দিত, সিল্কের শাড়ি আর মখমলের চটিপরা একটি শহুরে ভগ্নী পেয়ে। যদিও দ্বিতীয় দিনই মখমলের চটি খুলে ফেলে আমি ওদের দলে ভিড়ে গিয়েছি। আমাদের বিরাট দল হয়েছে—আমরা ঘুরে ঘুরে বেড়াই। নৌকার দুধারে বাশবন, কোথাও বা বড় বড় বট অশ্বথের নিচু ডালগুলো লম্বা লম্বা জটার আঙ্গুল দিয়ে জল ছুয়ে থাকে—আমি যদিও এই প্রথম বড়িতে পূজা দেখছি এবং পূজা সম্বন্ধে কিছুই জানি না, তবু পূজার আয়োজন আমার খুব ভালো লাগছে। দিনগুলিকে যেন অলঙ্কার পরান হচ্ছে। কত রকম খুঁটিনাটি উৎসবের আয়োজন—“আনন্দময়ীর আগমনে আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে” সত্যি বলতে কি পূর্ববঙ্গের ঐ গ্রামের পূজামণ্ডপের সামনে আমি কোনো কাঙালিনী মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি নি। সকলেই খুশীতে ভরপুর।
প্রথম দিন যে-ঘটনার তাল কাটল সেটা এই–টোলের বারান্দায় অনেকে বসেছিলেন। আমি একে একে সকলকে প্রণাম করছি, একজন শ্বেতশ্মশ্রু সৌম্যদর্শন বৃদ্ধকে দেখে আমি তাঁকে প্রণাম করতে যেতে তিনি প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, এবং বাধা দিলেন তো বটেই, অন্যেরাও বললেন, “ওঁকে প্রণাম করতে হবে না, উনি মুসলমান।” আমি তো স্তম্ভিত, এত অভদ্রতা কেউ করতে পারে! জ্যাঠামশায় যেন আমার অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী, “ছেলেমানুষ কিনা, কিছু জানে না।” আমার সবচেয়ে দুঃখ হল যে বাবাও কিছু বললেন না। পরে একলা পেয়ে যখন বললাম—একি অভদ্রতাবাবা বললেন, “তুই ঠিকই করেছিলি, বয়োজ্যেষ্ঠকে প্রণাম করবি, জাত দিয়ে কি হবে?”
“তবে তুমি চুপ করে রইলে কেন?”
“বড়দাদা রয়েছেন–উনি বলছেন, তাই কি বলা যায়।”
এখন মির্চার কথা যত ভাবছি এসব মনে পড়ছে। বাবা যদি বুঝতেও পারেন কোন্ কাজটা ঠিক, বাবা পারবেন না করতে, এইসব আত্মীয়স্বজন যাদের সঙ্গে আমাদের কোন মনের যোগ নেই, যারা আমাদের অর্ধেক কথা বুঝতেই পারে না, তারাও প্রবল বাধা হয়ে উঠবে। মেজ জ্যাঠামশায় দেশ থেকে চলে আসবেন—“ও নরেন, এ মহাপাতক করিস ‘না, চৌদ্দ পুরুষ নরকস্থ করিস না, করিস না।”
প্রতিমার পিছনে চালচিত্র আঁকে নসু, একদিন দেখি, সে একটা মাঝারি গোছের মহিষ এনে গাছতলায় স্বাধছে।
“এটা কি হবে?” আমি যদিও বুঝতে পেরেছি, ভালোমতই বুঝতে পেরেছি কি হবে।
তবু জিজ্ঞাসা করছি, আমার কষ্ট হচ্ছে, বুকের ভিতরটা মোচড় দিচ্ছে।
“অষ্টমীর দিন মার কাছে বলি হবে, আটটা পঁঠা আর একটা মহিষ।”
“কে বলি দেবে?”
“আমি। আমি ছাড়া আর কে এক কোপে কাটতে পারবে?”
“নসু, তোমার লজ্জা করছে না একটা অসহায় জীবকে এক কোপে কাটবে, তার বড়াই করছ—এটা কখনো ধর্ম হতে পারে?”
“ওমা কও কি খুকি? মার পূজায় বলি হইব না?”
তারপর ভাইবোনেরা সব জড়ো হল, আমি ওজস্বিনী বক্তৃতা দিতে লাগলাম। আমাদের বয়সীরা অনেকেই আমার মতানুবর্তী হল। আমরা সদলবলে মেজ জ্যাঠামশাইয়ের কাছে গেলাম। তিনি সাদাসিদে ভালো লোক এবং স্নেহপ্রবণ, আর যদি কোনো কারণ নাও থাকে, তবু আমার প্রতি স্নেহবশতও তিনি রাজি হতে পারেন। তাকে আমার খুব ভালো লাগে একটা বিশেষ কারণে ছাত্ররা যখন খেতে বসে তিনি হুঁকো হাতে করে তদারক করেন, তারা যাতে ভালো মাছটি পায়। ওরা পরের ছেলে, ওদের যত্ন করতে হবে—বৌরা হয়ত নিজেদের ছেলের জন্য ভালোটা রেখে দেবে এই তাঁর ভয়। এরকম আর কোনো কর্তা ব্যক্তি করবে না এ বাড়িতে।
মেজ জ্যাঠামশায় ধর্মতত্ত্বের আলোচনায় যেতে রাজি নন। তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন যে তিনি তো বাড়ির কর্তা নন। বাড়ির কর্তা যিনি বড়, তার দ্বারস্থ হও। তিনি যা বলবেন তাই হবে। তার ঘরের কাছে পৌঁছে পিছন ফিরে দেখি ভাইবোনের দলটি অন্তর্হিত। তখন সেই ভয়ানক রণশিবিরে আমি একলাই প্রবেশ করলাম। দোর্দণ্ডপ্রতাপ কর্তা একটি রোগা ছোট্ট মানুষ। হুঁকো হাতে উবু হয়ে খাটের উপর বসেছিলেন। বয়স ষাটের কাছে, আর তাঁর তরুণী ভার্যা একটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে দুগ্ধ পান করাচ্ছিলেন। আমি যথেষ্ট গুছিয়ে আমার বক্তব্য পেশ করলাম। প্রধান প্রার্থনা হচ্ছে ঐ মহিষ এবং ছাগলগুলোকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। যদি প্রবৃত্তিকে বলি দেওয়াই প্রয়োজন হয় তবে বৈষ্ণবদের মতো লাউ বা কুমড়ো বলি দেওয়া যেতে পারে। তিনি হুঁকো টানতেই লাগলেন। তারপর মুখটি তুলে সংক্ষেপে বললেন, “আমরা শাক্ত।”
আমি খুব তর্ক করতে পারতাম। সমস্ত যুক্তি প্রয়োগ করলাম, শেষ পর্যন্ত নিরীশ্বরদের বিতর্ক ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তাও বললাম, যারা যজ্ঞকারী ব্রাহ্মণদের বলেছিল, যজ্ঞে বলি দিলে পশুটা যদি স্বর্গে যায় তবে তোর বুড়ো বাপকে এনে বলি দে না, স্বর্গে যাবার এই তো সোজা উপায়।
কিন্তু বৃদ্ধ অনড়। কিছুতে রাজি হলেন না। পরে শুনেছি তিনি বলেছেন, নরেনের এই মাইয়াডা কুতার্কিক।
তখন আমি আমার অনুগত ভ্রাতাভগ্নীদের বললাম, এই পূজায় আমরা যোগ দেব। সপ্তমী অষ্টমী নবমী দশমী এই চার দিন আমরা বাড়িতেই থাকব না। আমরা সকালবেলা চিড়ে মুড়ি নাড় মুড়কী কলা ইত্যাদি নিয়ে নৌকায় নৌকায় বেড়াতাম খালে বিলে, সন্ধ্যায় ফিরে এক দৌড়ে বিছানায়। বড়দের সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ। বেশ পিনিক হচ্ছিল, আমাদের কিছু খারাপ লাগে নি। কিন্তু বাড়িতে জেঠিমাদের মন ভেঙ্গে গেছে। পূজার সময় ছেলেমেয়েগুলো বাড়ি রইল না। পূজা দেখল না। শেষটায় তাদের অনুরোধে পড়ে আমরা বাড়ি ফিরলাম বিসর্জনে যোগ দিতে। আমি মনে মনে বলেছিলাম সত্যিই যদি প্রতিমায় কোনো শক্তি এসে থাকে তাহলে এ বেচারা মহিষটাকে বলি দেবার সময় একটা কিছু যেন হয়, কোনো নিষেধের নিদর্শন। কিছুই হল না, বেচার মহিষের রক্তে হাড়িকাঠ ভাসতে লাগল।
এই ব্যাপারে বাবা আমাকে স্বাধীনতা দিলেন, বকলেন না। আমি যে নিজে নিজে একটা কিছু করতে পারছি, মনের জোর দেখাচ্ছি, তাতে উনি খুশি। সরোজিনী নাইডু হবার প্রথম পদক্ষেপ হয়ত!
কিন্তু মির্চার ব্যাপারে এ-সমর্থন পাব? না, না, কখনো নয়। আর আমিই কি এত জোর দেখাতে পারব? তাও নয়। অন্যের জন্য কিছু করা আলাদা কথা, সে মহিষই হোক বা মানুষই হোক কিন্তু নিজের একথাটা আমি বলতে পারব না। লজ্জা সংকোচ অপরাধবোেধ
আমার মুখ চেপে ধরবে।
এ-বিষয়ে কিছু বলা যায় না। আমি বন্দী, আমি বন্দী, আমি বন্দী। কে আমাকে শক্তি দেবে? আমি মনে মনে বললাম তুমি হিন্দু হয়ো না, দ্যাখো হিন্দু হয়ে আমার কি লাভ হয়েছে? হিন্দুত্ব তোমায় কোনো শক্তি দেবে নাবন্দীই করবে।
“অয়ি প্রথম প্রণয়ভীতে, মন নন্দনঅটবীতে
পিক মুহু মুহু উঠে ডাকি—”
কি আশ্চর্য এই গানটা! ভয়ই তো, সত্যিই ভয়! আমি ওর ঘরে দাঁড়িয়ে আছি—গানটা গুন গুন করছে মনে, একটা কিছুর প্রত্যাশায় আমি বেপথুমতীও আমার পিছনে খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর একটা হাত আমার কটি বেষ্টন করে আছে, আর একটা হাত গলার উপর থেকে অসম্পূর্ণ হারের মত ঝুলছে। ওর মুখ আমার কানের কাছে, গালের উপরে ও আমার কানে ফিস্ ফিস্ করে কি বলছে, বোধহয় ওদের ভাষায়, আমি তার অর্থ বুঝতে পারছি না।
“মির্চা, আমার ভয় করছে বড় ভয় করছে।”
“কিসের ভয়, তোমার কিসের ভয়?”
আমি কাঁপছি—আমি জানি এখন কি হবে—হাঙ্গার বইটাতে যা আছে তাই হবে। ও আমাকে চেয়ারটাতে বসিয়ে দিয়েছে—আমার শরীর নিস্পন্দ্য—এখন দুপুরবেলা সারাবাড়ি আলস্যজড়িত হয়ে পড়ে আছে—আমি নীচে এসেছিলাম চিঠির বাক্সে চিঠি খুঁজতে। আমি মনে মনে ভাবছি উঠে চলে যাই কিন্তু ওর গলা বেষ্টন করে আছি, হাতটা সরিয়ে নেবার শক্তি নেই—আর আমার অনাবৃত বুকের উপর ও তার মুখ রাখছে। আমার শরীর শিথিল, আমার কিছু করবার ক্ষমতা নেই, ওর চুলের সুগন্ধে আমার নিঃশ্বাস ভরে গেছে। ও কি যেন বলছে অর্ধস্ফুটভাবে, বোধহয় গডেস্ গডেস্’—আমি বলছি আমাদের পাপ হচ্ছে মির্চা, পাপ হচ্ছে কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র, একটা শব্দ, কে দরজা খুলল, ও আমার ছেড়ে দিয়ে সরে গেছে। আমি সোজা হয়ে বসেছি—আমার বিস্রস্ত আঁচল ঠিক করে নিয়েছি, তিন-চার মিনিট সময়ও হবে না, এর মধ্যে যেন পৃথিবীটা আমার কাছে বদলে গেছে। আমার জীবনে যে এমন একটা ঘটনা ঘটতে পারে তা ভাবতেই পারি না। আমি মুখে বলছি পাপ হবে, কিন্তু পাপবোধ তো নেই—কোনো অনুশোচনাই নেই—ও আমার চুলগুলো কানের উপর দিয়ে উঠিয়ে দিল–
“আমি বলছি তোমায়, অমৃতা, কোনো পাপ নেই—এ তো ভালোবাসা পাপ কেন হবে? ভালোবাসা দিয়েছে কে আমাদের? ঈশ্বর—ভালোবাসাই ঈশ্বর।”
ঝড় উঠানে নেমে এসেছে, রান্নাঘরে ঢুকছে। কিছু দেখতে পায় নি, আমরা এখন অন্তত এক হাত দূরে আছি। আমি নির্বিকার, ওকে ডেকে বললাম—“ঝড় চা কর–” আচ্ছা এই যে আমি মিথ্যা আচরণ করলাম, এটা অন্যায়?—যদি দণ্ড সহিত হয় তবু মিথ্যা বাক্য নয়—’এ তো মিথ্যা আচরণ, নয় কি? কিন্তু একথা মির্চাকে বলে তো লাভই নেই। ভালোই তো যে ও পাপ মনে করে না। ও যদি পাপ মনে করে দূরে চলে যেত লাভটা কি হত আমার? তাহলে তো ওকে আর পেতামই না। আমি ওকে চাই।।
ওর দিকে তাকিয়ে দেখছি ও ঠোঁট চেপে আছে—ওর হাত একটু কাঁপছে। ওকে অধীর মনে হচ্ছে। ও ধৈর্য হারিয়েছে কেন? আমি পাপের কথা বলেছি বলে ও রাগ করল নাকি? আমার ইচ্ছে হচ্ছে ওর কাছে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সে তো। অসম্ভব, ঝডু উঠে পড়েছে না? আমার অন্য মন যেন ভূকুটি করছে, সে বলছে–না, না, না, এখানে আর এক মুহূর্তও থেকো না—পালাও, পালাও, পালাও। এখনই ওর কাছ থেকে চলে যাও। আমি উঠে পড়লাম—ওর দিকে আর তাকালামই না। অস্থির পায়ে দ্রুত উপরে চলে গেলাম।
সেদিন রাত্রে আর ঘুমই আসে না। অনেকক্ষণ পর্যন্ত ওর স্পর্শটা আমার গায়ে লেগে রইল। এরকম একটা অভিজ্ঞতা চেপে রেখে সুস্থ থাকা মুশকিল। আমি কিছু গোপন করতে অভ্যস্ত নই। তাই কি ভিতরটা এত অধীর? না অন্য কোন প্রত্যাশা আছে। কি প্রত্যাশা থাকতে পারে? আমার নিজের চোখ নিজের দিকে তাকিয়ে আছে। যেখানে এক অজ্ঞাত গুহার অন্ধকার সেই দিকে ফেরান সে চোখ বিরক্ত ও অনুসন্ধিৎসু।
আমি আজ মাটিতে মাদুরে শুয়ে আছি—ঠাণ্ডা পাথরের মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে ভাবছি—আচ্ছা, এ-অভিজ্ঞতাটা আমি কবিতায় লিখতে পারি? ওরে বাবা, কি হয় তাহলে?
মা বাবার চেয়েও আর একজনকে বেশি ভয়—সজনীকান্ত দাস–সেই ব্যক্তিকে আমি দেখি নি। কিন্তু তাঁর শনিবারের চিঠি! ওরে বাবা! ছেলেদের কলেজে কবিতা পড়ি বলেই আমাকে বকুল বনের পাখী’ বলে ইঙ্গিত করে কত কি সব লিখেছে— এই ঘটনার আভাস পেলে আমাকে শায়েস্তা করে দেবে! নিশ্চয়ই অনেক লোকই এসব বিষয় লিখেছে—এমন তো হতে পারে না শুধু আমারই মন এত বিস্ময়ে ভরে গেছে। তবে আমার আর লেখার দরকার কি। কড়ি ও কোমলে একটা কবিতা আছে,ওটা ভালো নয়, আমি ওটা পড়ি না, চাপা দিয়ে রাখি। এমন একটা কবিতা যে কেন মহাকবি লিখতে গেলেন? আমার সেই দুতিন মিনিট সময়টা ভাবতে ভালো লাগছে—আবার ভয়ও করছে। আমি আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছি, আমি জানি না—এই অনুভূতির উৎস কোথায় শরীরে না মনে—আর একজন আমার প্রিয় কবির কবিতা মনে পড়ছে— “words are but loads of chain in my flight of fire.I pant, I sink, I expire!” আমি ভাবছি ‘flight of fire, flight of fire আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে এই কথাটা—আমি ডুবে যাচ্ছি, ডুবে যাচ্ছি, আমার মাদুরটা পালকের বিছানা হয়ে গেছে।
কাকার বিয়ের জিনিসপত্র কিনে ঢুকছি ওর ঘরের দরজার সামনে, আমায় দেখে ও আমার হাত থেকে জিনিসগুলো নিয়ে নিল। আমার ভার লাঘব হল। এইগুলো ওদের দেশের নিয়ম। এ নিয়ম ভালো। আর কাকাকে দেখ না, আমার ঘাড়ে সব জিনিস চাপিয়ে তরতর করে চলে গেল সিঁড়ি বেয়ে। আর খোকা? আমি যদি ইটও বয়ে নিয়ে যাই, এগিয়ে আসবে না সাহায্য করতে। মেয়েরা ঘরে ঢুকলে ও উঠে পাঁড়ায়, না বসা পর্যন্ত বসে না, পর্দা তুলে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে—এ সব ইয়োরোপেরু আদবকায়দা—আমাদের বাড়ির মেয়েরা এসব খুব পছন্দ করে—এমন কি যে মাসী আমায় বকেছিলেন সাহেব হেঁড়াটার সঙ্গে হি-হি করছি বলে তিনিও সেদিন মাকে বলছেন, “মেজদি এই সাহেব ছেলেটি কিন্তু খুব ভালো। কি সুন্দর ডাল-ভাত হাত দিয়ে চেটেপুটে খেয়ে গেল। কে বলবে সাহেব! ঠিক যেন আমাদের ঘরের ছেলে।” আমার খুব হাসি পাচ্ছে-আমার সঙ্গে হাসছিল বলে ‘ছোড়াটা ছিল আর হাত দিয়ে ভাত খেল বলেই ‘ছেলেটি’ হয়ে গেল।
আমার মা বলেন, “অমন ছেলে হয়! যেমন পড়াশুনোয় ভালো, তেমনি ভদ্র। ‘মা’ বলে যখন ডাকে এত মিষ্টি লাগে।”
শান্তি বলল, “আর ধুতি পাঞ্জাবী পরলে গৌরাঙ্গ মনে হয়।”
কাকার বিয়েতে ও দেশ থেকে অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস এনে দিয়েছে কাকীমার জন্য, নানা রকম খেলনা, কাঠের উপর পোকারের কাজ করা আর জর্জেটের উপর এমব্রয়ডারি করা ড্রেসিং টেবিল সেট, রুমাল, কত কি জিনিসগুলো কি সুন্দর। আমার মন বেশ খারাপ হয়ে গেছে, ওদের বিয়ে হচ্ছে, দেবেই তো! তা আমাকেও কিছু দিতে পারত। একটা রুমালও দিল না। আমাকে ও কিছু দেয় না। না, না, বই দেয়। আমাকে দু’ভলম গ্যেটের জীবনী দিয়েছে। যেদিন ভূমিকম্প হল তার পরের দিন। মির্চার এখানে আসার স্থান-কাল ও অস্তিত্বের একমাত্র নিদর্শন—এই অসীম কালসমুদ্রে একটি ক্ষুদ্র দিকদর্শন ঐ বই দুখানি আমার কাছে এখনও অর্থাৎ ১৯৭২ সালেও আছে।
ভূমিকম্পের রাতটা ভারি সুন্দর। গভীর রাতে ভূমিকম্প হল, আমরা সবাই নিচে নেমে এলাম। কিছুক্ষণ বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিতরের উঠোনে সিঁড়ির উপরে বসলাম। মির্চা কফি বানাল। কি আশ্চর্য সুন্দর সেই তারা ভরা রাত। অত রাতে আমি আর কোনোদিন ওকে দেখি নি, আগেও না পরেও না। তাই সেই রাতটা দীর্ঘদিন পর্যন্ত একটা মৃদু সুগন্ধের মত মন ছেয়ে ছিল। রাতের একটা নিজস্ব রূপ আছে—আর মানুষের চোখেও তা একটা বিশেষ দৃষ্টি দেয় নিশ্চয়। এত রাতে আমি যে ওকে দেখলাম সেই সুখটা ও স্থায়ী করে দিল, পরের দিন ঐ বইখানা দিয়ে। তাতে আমার নাম লিখে ও লিখল, as a token of friendship after the earthquake of 28th July 1930-ও বললে ওদের দেশের নিয়ম ভূমিকম্পের পরে বন্ধুকে কিছু উপহার দিতে হয়। মির্চা আমার কাছে গ্যেটের জীবন সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছিল বইটা থেকেও শুনিয়েছিল সেই যে কবি যিনি আলো চেয়েছিলেন—“আলো আরো আলো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম এ সত্যিকারের আলোর আর মানুষের পরের দিন ঐ বই, এত রাতে আমি যে কথা নয় অর্থাৎ তার মৃত্যুআচ্ছন্ন চোখে সূর্যের আলোর প্রত্যাশা এ নয়। এ হচ্ছে প্রতীক দিয়ে বলা, যেমন জ্ঞানের আলো, বুদ্ধির আলো।
আমাদের কবিও লিখেছেন—কোথায় আলো কোথায় ওরে আলো, বিরহানলে জ্বালোরে তারে জ্বালো’–বিরহানলে! বিরহানলে আলো জ্বালিয়ে লাভটা কি, মিলনে কি আলো জ্বলে না? সব কাব্যে, সব দেশের কাব্যে খালি বিরহের জয়গান! কেন? বিরহ কি? যদি মির্চা চলে যায়, তাহলে আমার যে কষ্টটা হবে সেটা বিরহ। কি ভয়ানক। ও যখন নিচে আছে, আমি উপরে—তখনই আমার কষ্ট হয়—আর একেবারে চলে গেলে? তাই নিয়ে আবার আলো জ্বালানো? সে গাঢ় অন্ধকার আমি কল্পনাও করতে পারি না। ঐ কষ্ট পেয়েই তো মেঘদূতের যক্ষ বেচারা বিরহের আলো নিবিয়ে দিয়ে মিলনের স্বর্গের কথা ভেবেছিল। স্বর্গ? সেই তো স্বর্গ যেখানে আনন্দে ছাড়া চোখের জল পড়ে না। যেখানে প্রণয়কলহ ছাড়া বিরহ হয় না। যৌবন ছাড়া বয়স নেই। মেঘদূত মনে পড়ে আমার মনটা প্রসন্ন হয়ে গেছে—আমি আবৃত্তি করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি—
আনন্দোথং নয়নসলিলং যত্র নান্যৈনিমিত্তৈ
নান্যস্তাপঃ কুসুমশরজাদিষ্ট সংযোগসাধ্যাৎ
নাপ্যন্যস্মাৎ প্রণয়কলহাদ্বিয়োগোপপত্তি
বিশোনাং ন চ খলু বয়ো যৌবনাদন্যদস্তি!
বাবা বসবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন–“মেঘদূত বলছি ভালো করে উচ্চারণ কর আমার সঙ্গেল ইয়ত্রনান্যৈনিমিত্তৈঃ-—“ইয়’ ‘ইয়’ ‘জ’ নয়, শূদ্রের জিহ্বা কেন?”
“তুমি শুনতে পেলে কি করে?”
“কোনোখানে একবিন্দু সংস্কৃত উচ্চারণ হবে আমার কানের আওতায় আর আমি শুনতে পাব না, তাই কি হয়?
সারিকে নিয়ে একটা ভারি মুশকিল হয়েছে। ও এক মিনিট আমাদের সঙ্গ ছাড়ে না। কিছুদিন থেকে ও বলছে ও মির্চাকে বাংলা পড়াবে। মির্চাও বলে তাই ভালো, তাহলে বরং বাংলাটা শেখা হবে। কারণ আমিও ওকে যত বাংলা শেখাচ্ছি সেও ততো আমায় ফ্রেঞ্চ শেখাচ্ছে। এই দুই ভাষায় আমরা যে পারদর্শী হয়ে উঠব তার সম্ভাবনা কম। সবচেয়ে মুশকিল এই যে, মির্চা মনে করে সাবি একেবারে ছোট্ট সরল মেয়ে, কিছু বোঝে না। ওর সামনে আমরা অল্পবিস্তর প্রেমালাপ করতে পারি, ও আমার হাত ধরতে পারে—ইত্যাদি। কিন্তু এটা ভুল। আমি সোল পূর্ণ হয়ে সতেরোয় পড়ব, ও এগার পূর্ণ হয়ে বারোতে। বারো বছরের মেয়ে এত কিছু ছোট নয়। তাছাড়া ও তখন যৌবনে প্রবেশ করেছে। কিন্তু ও খুব ছেলেমানুষি করে কথা বলে—ওর যখন মাত্র ছয় বছর বয়স তখন আমাদের এক ব্রাহ্ম আত্মীয়ার বিবাহ বিচ্ছেদ হল। সেই অভাবনীয় ঘটনায় সারা বাংলাদেশ তোলপাড় হচ্ছিল, মহিলারা একত্র হলে আর কোনো কথা নেই— স্বামীত্যাগ ভালো কি মন্দ, এই বিতর্ক। আমার মা মাসীরা তখন সে-সব আলোচনা করতেন—ওকে চলে যেতে বললে যাবে না, বলে, “বলো না, আমার সামনে বলো, আমি ছেলেমানুষ কিছু বুঝব না!” তবে তখন সত্যিই বুঝত না, এখন বোঝে, নিশ্চয় বোঝে। ওর খুব কৌতূহল। কৌতূহল ভালোই, সেটা জিজ্ঞাসা, জিজ্ঞাসা না থাকলে মানুষ জানবে কি করে?
এছাড়াও একটা নূতন ব্যাপার ওর মধ্যে লক্ষ্য করছি। আমাকে নিয়ে বাবা যে এত বাড়াবাড়ি করেন, আমাকে রবিঠাকুর এত ভালোবাসেন কিম্বা আমিই তাকে বাসি ও সেখানে যাবার সুযোগ পাই, অতবড় একজন ব্যক্তি আমার এত আপন কিন্তু ও সেখানে পৌঁছতে পারছে না, এতে সে কষ্ট পাচ্ছে। এ কষ্টটা তীক্ষ্ণ এবং তীব্র কিন্তু এটাতে ওর দোষ নেই। কেউ যদি চোখের সামনে আর একজনকে অতটা পেতে দেখে, তাহলে তার কষ্ট হতে পারে। ওর যে এখনও সময় হয়নি, হলেই পাবে, তাতে ওর বোঝার বয়স হয়নি। ও ঠোঁট ফোলাচ্ছে, কাঁদছে, ‘দিদিকে সবাই ভালোবাসে, আমাকে কেউ ভালোবাসে না। ছোট্ট মেয়ের এই মিষ্টি কথায় সবাই হাসে কিন্তু তাতে ওর দুঃখটা তো যায় না।
আমি যখন দিল্লী গিয়েছিলাম, তখন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে ও একবার বলেছে—“দিদি না থাকলে তো এ বাড়িতে আসেনই না আপনি।” এখন ও মির্চাকে ধরেছে—ও বুঝতে পারছে মির্চার সঙ্গেও আমার একটা বিশেষ ভাব হয়েছে যেখানে সে নেই—আমার মনে হয় ও অনেকটাই বুঝতে পেরেছে এবং ওর মনে হচ্ছে আবার এই লোকটিও দিদিকে ভালোবাসবে। একথাটা নিয়ে আমি কারুর সঙ্গে আলোচনা করতে পারছি না। কার সঙ্গে করব? আমার বিশেষ ভয় মির্চা কিছু বুঝতে পারছে না বলে। কি জানি কখন ওর সামনে কি প্রকাশ করে ফেলে। একদিন সাবি বলেছেও, “তোমরা চোখে চোখে কি কথা বলেছ।” আমি মির্চাকে যখন বললাম, ও এর মধ্যে সাহিত্যরস খুঁজে পেল—খুব হাসছে—“চোখে চোখে কথা বলা, a good expression. Let us try it again.” আমি যত সাবিকে লক্ষ্য করছি একটা অজানা আশঙ্কায় বুকের ভিতরটা কাঁপছে এই সুখের স্বর্গ ও ভেঙ্গে দেবে না তো? ইচ্ছে করে না হলেও ওর ভিতরের জমা উত্তাপে? না না, ও ছেলেমানুষ কি করবে? কিন্তু রোজ এই দুশ্চিন্তা আমি ভোগ করছি। আমি জানি শান্তি সব জানে। খোকা জানে। ওদের অনুমোদন আছে। ওরা কখনো বলবে না। সম্ভবত কাকীমাও জানে, বলবে না। আমার ভয় শুধু ঐ পুঁচকে মেয়েটাকে। মাঝে মাঝে হাসিও পায়! ও কিছু নয়। ভয় তো থাকবেই। ভয় নিত্য জেগে আছে। প্রেমের শিয়র কাছে মিলন সুখের বক্ষ মাঝে। আনন্দের হৃদস্পন্দনে কাঁপিতেছে ক্ষণে ক্ষণে বেদনার রুদ্র দেবতা যে।
কবিতাটি ভয়ানক—গা ছম ছম করে।
আমরা রোজ শেলে গাড়ি করে বেড়াতে যাই–কখনো যশোর রোড দিয়ে, কখনো বারাকপুর রোড দিয়ে, কখনো টালিগঞ্জের নালার পাশ দিয়ে অর্থাৎ টালিগঞ্জ সার্কুলার রোড দিয়ে। গাড়িতে বাবা মা আমি মির্চা সাবি ও ছোট দুই ভাই। মির্চা সামনে বসে ভাইদের নিয়ে। এই বেড়ানর সময়টুকুই আমরা একটু গাছপালা দেখতে পাই। আমার খুব ইচ্ছা করে ওর সঙ্গে একলা বেড়াই। গাছপালার মধ্যে, জ্যোৎস্নায় বা অন্ধকারে তারার আলোতে বইতে তো কত পড়েছি—সে রকম আমাদের কখনো হবে না, কি করে হবে?
প্রফুল্ল ঘোষ ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক, তিনি ভালো শেক্সপীয়র পড়ান। বাবা মাঝে মাঝে তাকে ধরে আনতেন, এলেই তিনি শেক্সপীয়র শোনাতেন। একবার তাঁকে নিমন্ত্রণ করে এসেছেন রাত্রে খাবেন ও শেক্সপীয়র পড়বেন। তারপর আমরা বসে আছি আসেনই না, আসেনই না—যখন আমরা অধীর হয়ে উঠেছি, ঘুম পাচ্ছে, রাগ হচ্ছে তখন তিনি এলেন। খাওয়াদাওয়া হল। পুরো সব খেলেন—তারপর মুখ ধুতে ধুলে বললেন, “দেখুন, আজ প্রফেসরের উপযুক্ত কাজ করেছি—আমি নিমন্ত্রণের কথা একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম—খেয়েদেয়ে মুখ ধুতে ধুতে মনে পড়ল—’ওঃ আজ নেমন্তন্ন!’ এ যেন সেইরকম, ননদ-ভাজের গল্প—ননদ আর বৌ গেছে নদীতে বাসন ধুতেননদকে কুমীরে নিয়ে গেল—বৌ বাড়ি এসে সে কথা ভুলে গেল, কাউকে বলল না। খাওয়াদাওয়া করে আবার যখন ঘাটে গেছে তখন মনে পড়েছে, শাশুড়ীকে ডেকে বলে, ‘ভালো কথা মনে হল আঁচাতে আঁচাতে, ঠাকুরঝিকে নিয়ে গেল নাচাতে নাচাতে’—” ভদ্রলোক বিশাল বপু নিয়ে বেঁকে ঝেকে ছড়া বলছিলেন—“আমারও সেইরকম হল।” সেদিন উনি আমাদের মার্চেন্ট অব ভেনিস শুনিয়েছিলেন, সেখানে যে বর্ণনা আছে জেসিকো আর লরেন্সে পোর্শিয়ার বাড়ির বাগানে বেড়াচ্ছে—লরেন্সে বলছে—the moon shines bright in such a night as this sweet wind did gently kiss the trees’. ঘর ভরা লোক, আমরা শেক্সপীয়র শুনছি মির্চা আর আমি পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছি, একঘর লোকের মধ্যেও অবশ্য একলা হওয়া যায়। কিন্তু তার চেয়ে আরো ভালো সত্যি একলা হওয়া। আমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঐ লাইনগুলো মনে করতাম—আমরা কি কোনোদিন একলা বেড়াতে পারব? হয়ত কোনো জ্যোৎস্না রাতে বা জোনাকিজ্বলা সন্ধ্যায় আমরা হেঁটে বেড়াতে একটু দূরে গিয়েছি সাবি সঙ্গ ছাড়বে না—in such a night as this পাশাপাশি থেকেও বিরহ হচ্ছে। আবার দূরে দূরে থেকেও মিলন হয়। একেক সময় ও যে ঐ সামনের সীটে বসে আছে তাতেই আমার মন ভরে যায় আনন্দে। পাঞ্জাবীর রেখার উপর ওর গলার লাইনটা দেখা যাচ্ছে। ঐদিকে তাকিয়ে আমার শরীর শিহরিত হয়—আমি ভাবি আর কিছু দরকার নেই—ও দূরে থাকুক, দূরে থাকুক, ওকে একটু দেখলেই আমার যথেষ্ট হবে। একেক দিন আমি মনে মনে প্রার্থনা করতাম ও যেন গাড়ি থেকে আগে না নামে। তাহলে আমি নামবার সময় ওর গলাটা একটু ছুঁয়ে দিতে পারি। কিন্তু তা কি হয়? ও তো গাড়ি থেকে সবার আগে নামবে তারপর হাত ধরে ধরে সকলকে নামাবে–এই তো ওদের নিয়ম। ওকে কিন্তু আমি এসব কথা কখনো বলিনি—আমি ওকে কতটা ভালোবাসি তাও বলি নি। কারণ এখনও আমি নিশ্চিত নয় এ ব্যাপারটা কি, এটাই ভালোবাসা কিনা। আর তাছাড়া তাহলে ও নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে, ওর ঈর্ষাটা চলে যাবে। যেমন আমার ঈর্ষা নেই—ওর ঈর্ষাটাই আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। তাই আমি ইচ্ছে করেই এমন সব কাণ্ড করি যাতে ওর ঈর্ষা হয়। যেমন সেদিন লেখক ‘অ’বাবু ওর ঘরে বসেছিলেন, আমি তার সঙ্গে খুব গল্প জুড়ে দিলাম—দু’চারটে ইংরেজি কথা বলে বাংলাতেই গল্প করলাম—কেন, আমরা বাঙালী না? উনি আছেন বলে সব সময় ইংরেজি বলতে হবে নাকি? আমি একবার ওর দিকে তাকাইনি পর্যন্ত। সেদিন ওর মুখের ভাবটা, ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’র মত মেঘাচ্ছন্ন। ঈর্ষা হলে ও একটু নিষ্ঠুরও হয়—সেটাই সবচেয়ে ভালো লাগে। আমার এই মনের ভাবটা কি? ককেট্রি! ডিশেনারী দেখতে হবে।
কিছুদিন থেকে ওর সর্দারিটা খুব বেড়ে গেছে আমাকে ধরেই নিয়েছে যেন ওর সম্পত্তি। ওর ধারণা মা, বাবা এবং বাড়ির সকলেই এটা জানে এবং অনুমোদন করে। তবে আর কি? হয়েই গেল সব। আমার বেরিবেরি হয়েছিল তাই পা ফুলে থাকে সেজন্য পায়ে কবিরাজী তেল মালিশ করি—কিন্তু তার মানে এ নয় যে কখনো খালি পায়ে চলতে পারব, পাথরের ঠাণ্ডা মেঝের উপর পা রাখতে ভালো লাগে—ও তা দেবে না—চটি পরো। লঙ্কা খাবার সঙ্গে বেরিবেরির কোনো সম্পর্ক নেই—সর্ষের তেলে বেরিবেরি হয়—তা ও বুঝবে না—রোজ একবার করে বলবে লঙ্কা খাবে না।
সেদিন খাবার পরে আমি, কাকীমা ও মির্চা খাবার টেবিলেই বসে গল্প করছি। ও আমার উপর রেগে আছে, লঙ্কা খেয়েছি, ওর কথা শুনি নি বলে। ও কাকীমাকে বলছে, “কাকীমা, তোমার নূতন বিয়ে হয়েছে তোমার মাধুর্য প্রয়োজন, তুমি লঙ্কা খেয়ে না–ঝাঁঝাঁলো যে সব মেয়ে তারা যা খুশী করুক”—
আমি বললাম, “যে সব ছেলেরা বেশি মিষ্টি, যাদের সবাই বলে কি ভালো ছেলে, আসলে তাদের কোনো পৌরুষ নেই।”
“তার মানে? তার মানে আমি লঙ্কা খেতে পারি না ঝাল বলে? আমার সাহস নেই?”
এই বলে ও কাচা লঙ্কা ও লেবুসুষ্ঠু প্লেটটা এগিয়ে নিয়ে একটার পর একটা লঙ্কা তুলে চিবিয়ে খেতে লাগল শুধু মুখেই। কি সর্বনাশ! ডাকাত একেবারে!
“ফেলে দাও! ফেলে দাও!” বলে আমি উঠে পড়তে যাচ্ছি ও টেবিলের নিচে দুই পা বাড়িয়ে দিয়ে আমার পা দুটা বন্দী করে ফেলল—গায়ে কি জোর! বেশি টানাটানিও করতে পারি না, কাকীমা বুঝে ফেলবে আমি বন্দী।
ও পর পর দুটো তিনটে লঙ্কা খেয়ে ফেলেছে—ওর ঠোঁট ইতিমধ্যে ফুলে গেছে, থুতনী পর্যন্ত লাল হয়ে গেছে। ফর্সা মুখের এখানে-ওখানে লাল-ও কিন্তু অবিচলিত—আমি হাত বাড়িয়ে প্লেটটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করছি। কাকীমা নির্বিকার, হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। কাকীমা কিছু বুঝতে পারছে না, একটা লোক সামনে বসে আত্মহত্যা করছে। সাবি বুঝতে পেরেছে, ওর মন আর আমার মন তো একই ধাতুতে গড়া।
“মা, মা, দেখ দিদি ইউক্লিডদার সঙ্গে মারামারি করছে।” মা রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন—ও তৎক্ষণাৎ আমার পা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। মা স্তম্ভিত, চিত্রার্পিত। এমন একটা কাণ্ড ঐ শান্ত ছেলেটা করল?
“একি ইউক্লিড, কাচা লঙ্কা চিবিয়ে খাচ্ছ কেন?”
কাকীমা বললে, “ঐ রু কথা শোনে নি বলে?”
“রু কথা শোনে নি বলে! সে কি! সে কি!”
সেই প্রথম আমি মার চোখে সন্দেহের ছায়া দেখলাম। মা ওর দিকে এক চামচ মাখন এগিয়ে দিলেন। বাটিটা ওর হাতে দিয়ে বললেন, “মাখন খাও”। মির্চা বাটিটা নিয়ে মাথা নীচু করে ওর ঘরে চলে গেল।
মা এইবার খুবই রেগেছেন—“কখন খাওয়াদাওয়া হয়ে গেছে এখানে বসে বসে আড্ডা হচ্ছে কেন? তোমাদের কি কারু কোনো কাজ নেই?”
আমি খুব ভয় পেয়ে গেছি কিন্তু তৎক্ষণাৎ যেন কিছুই হয় নি এমন ভাব করে বললাম-“না মা আমি শুধু বলেছিলাম ঝাল খেতে সাহস লাগে। তাই বীরত্ব দেখাচ্ছিল, তাই না কাকীমা? আহাম্মক আর কাকে বলে? লঙ্কা কখনো শুধু শুধু খায়!”
আমার গলা নিরুত্তাপ—যেন কিছুই না। মা বিশ্বাস করে নিলেন, সন্দেহের মেঘ উড়ে গেল, কারণ মা উড়িয়ে দিতে চান, যাদের ভালোবাসেন তাদের সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ মনে স্থান দিতে চান না। অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি হবার সাহস মা’র নেই। অর্থাৎ তখন ছিল না শুধু নয়, কোনও দিনও হয়নি। যখন তার আঁচল থেকে তার স্বামীকে খুলে নিয়ে যাচ্ছিল অন্য কেউ, তখন মা ভাবছিলেন ও কিছু নয়-দশ বছর ধরে সেই খোলার প্রক্রিয়া চলছিল। মা ভালোমত খেয়ালই করলেন না। যখন তাঁর সর্বনাশ হয়ে গেছে, তখন হঠাৎ চমকে উঠলেন। তার ধারণা, আমি বিশ্বাস করেছি বলেই কি আমাকে ঠকাতে হবে? বিশ্বাস করা কি অন্যায়। সেই সোল বছরের মেয়েটাও সেদিন মাকে ঠকিয়ে দিল। ভয়ে। অবশ্য অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমার বুক দুরদুর করেছে। বেশ চালাকী করতে পারি তো আমি! মির্চার জন্যই এরকম মিথ্যাবাদী হয়ে যাচ্ছি। মোটেই না, মোটেই না, দুষ্মন্ত কি বলেছেন–? “স্ত্রীণাম্ অশিক্ষিত পটুত্বম্–”
মা উপরে যাচ্ছেন—খাবার টেবিল থেকে সিঁড়িটা দেখা যায়—আমি ভাবছি মার মনে যদি একটুও সন্দেহ লেগে থাকে সেটা কাটিয়ে দিতে হবে। উঠে গিয়ে মার গলা জড়িয়ে শুয়ে থাকব।
“কাকীমা, আমি উপরে মার কাছে শুতে যাচ্ছি, তুমি একটু মির্চাকে দেখ না ভাই—ওর কি হল।”
কাকীমা চোখ মটকে বললে, “আমার বয়ে গেছে।”
মার কাছে শুয়ে শুয়ে আমি যা ভাবতে লাগলুম মা তো তা শুনতে পেলেন না—যত কাছেরই মানুষ তোক, যত ভালোবাসাই থাক একজন আর একজনকে কত সহজে ঠকিয়ে দিতে পারে। কারণ মুখে না বললে তো কেউ কারু মনের কথা বুঝতে পারে না। যদি পারত? তাহলে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ইত্যাদি মহামূল্যবান জিনিসগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যেত।…মির্চা হঠাৎ এরকম একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল কেন, আমি কিছুই ভেবে পেলাম না—শুধুই কি আমি ওর কথা শুনি নি বলে বা বীরত্ব দেখাবার জন্য, না অন্য কোনো কারণ আছে, ওর মনে এতটা আঘাত লাগল কেন? নাকি প্রতিশোধ নেবার জন্য? যে কারণেই হোক, আমি এরকম করতে পারতাম না।
নিজেকে এত কষ্ট দেওয়া যায়? অনেকে পারে। যেমন ঠাকুরমা মৃত্যুর মুখেও তৃষ্ণা সংবরণ করতে পারতেন—দু’দিন তিনদিন তিনি উপবাস করতে পারতেন, আমি কি পারি? কিন্তু তার তো কোন কারণ থাকত, কোনো ব্রতপালন বা ঐ জাতীয় কিছু। এরকম শুধু শুধু করতেন না! হয়তো ওরও কারণ ছিল, ও আমার জন্য কতটা সহ্য করতে পারে তার পরীক্ষা দিচ্ছিল। ওর আত্মনিপীড়নের ক্ষমতা দেখে আমার নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। ও আমার চেয়ে অনেক শক্তি রাখে। আমি আর কখনো ওর সঙ্গে ওরকম করব না। এবার আমি বলব আমিও যে ওকে চাই সে কথা বলব। ও যে রকম করে বলছে সে রকম করে নয়, ওর খুব কাছে বসে ওর শঙ্খচিলের মত সাদা পায়ের উপর হাত রেখে বলব; পা রেখে নয়, পায় হাত দিলে কি হয়? ও তো আমার চেয়ে বড়ই। বয়সে, বিদ্যায় আর মনের জোরে অনেক বড়। আমি নিজেকে পরাজিত মনে করছিলাম—তাতে আমার কষ্ট নেই। আমি সুখী। আত্মপীড়নের শক্তি দেখিয়ে ও অনেক বড় হয়ে গেছে—দেহি পদপল্লবমুদার!
বাবার খুব ব্লাডপ্রেসার, তাই নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে কারণ তার চোখে রক্ত জমেছে এটা কঠিন অসুখ। কিন্তু কঠিন অসুখ হলেও বাবার একটু অসুখ হলেই তা কঠিন বলে মনে হয়। শুধু আমাদের নয় সব বাড়িতেই, বাড়ির কর্তা যে পুরুষ তিনিই পনের আনা, অন্য আর সকলে একত্র হয়ে এক আনা। অর্থাৎ তার সুখ-সুবিধে ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপরই সবকিছু নির্ভর করছে, অন্য লোকের সুখ-সুবিধা ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দাম নেই। এ ভাবটা আমাদের বাড়িতে খুব বেশি, কারণ এখানে তো তিনি বাড়ির কর্তা মাত্র নয়—অধিষ্ঠাত্ দেবতা। কাজেই তার অসুখ হওয়া মানে, বাড়ির সকলের অসুখ হওয়া অর্থাৎ আর কারু অন্য চিন্তা নেইমার তো নেইই। মা রাতের পর রাত জাগতে পারেন হাসিমুখে—এই অতন্দ্র সেবা অবশ্য বাবা গ্রহণ করেন প্রাপ্য হিসাবে। এটা সব বাড়ির কর্তাদেরই মনোভাব। স্ত্রীর দিকে এই সেবার মূল্য তার দানের আনন্দে, তৃপ্তিতে, হয়ত বা পুণ্যে, স্বামীর দিক থেকে কৃতজ্ঞতার কোনো প্রয়োজনও নেই। সে কথা কেউ মনে করে না। অসুখ না হলেও বাড়িতে যেটা শ্রেষ্ঠ খাদ্য সেটা কর্তার জন্য। তাঁর নিদ্রার সময় সমস্ত বাড়ির নীরবতা, কিন্তু অন্যের নিদ্রার সময় তিনি চীৎকার করতে পারেন! সেটা কেউ অন্যায় মনে করে না। বাড়ির কর্তাদের এমনও দেখেছি, ট্রেনে কোথাও যাবার সময় ফার্স্ট ক্লাসে গেলেন, বুড়ো মা ছেলেমেয়েদের ইন্টারে তুলে দিয়ে। খুব ভালো লোকেরাও এরকম করতেন, এতে কেউ তাদের নিন্দা করত না বা তাদের আত্মগ্লানি হত না। বাড়ির কর্তা অর্থাৎ যার রোজগারে বাড়ির অন্য সকলে প্রতিপালিত, তার অপ্রতিহত অধিকার অন্যের সুখ-দুঃখ ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে দলিত পিষ্ট করে সকলকে নিজের মতে চালনা করবার। এতে একটা বৃহৎ পরিবারের শৃঙ্খলা রক্ষা করবার হয়ত সুবিধা হয়, কিন্তু ঐ কর্তা ব্যক্তিটি একান্ত স্বার্থপর ও দাম্ভিক হয়ে ওঠবার সুযোগ পান। তার নিজের ধারণা জন্মায় যে এই বাড়িতে তিনি একজন ঈশ্বর। অথচ তিনি তো ঈশ্বর নন, ঐ বাড়ির দুঃস্থতম তুচ্ছতম আত্মীয়টির মতই তিনিও একজন ভুলভ্রান্তিযুক্ত সুখদুঃখকাতর সাধারণ মানুষ। একটি দেশের পক্ষে রাজা যেমন সে দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা, সংসারের কর্তাও তাই। তারপর কর্তাটি যদি বিশেষ অনেক গুণের অধিকারী হন, তবে তো কথাই নেই। বাবার গুণের বোধহয় পরিমাপ হয় না—বিশেষত বিদ্যার দিক থেকে। এমন কোনো বিষয় নেই যে বিষয়ে তিনি কিছু না কিছু জানেন–অমেয় তার জিজ্ঞাসা নিরন্তর বহুদিকে ধাবিত। দুরূহ সংস্কৃতে লেখা দর্শনশাস্ত্রের অর্থবোধ করবার জন্য কোনো দিন তার সাহায্য দরকার হয় নি। তার স্মৃতিশক্তি প্রখর। কেউ কেউ মনে করতেন, তিনি জাতিস্মর। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীও মনে করতেন যখন বাবার সাত বছর বয়স, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তাঁরা যে দুজনে গত জন্মে একত্র তপস্যা করেছিলেন কোনো এক নদীর তীরে সে কথা বাবার মনে আছে কিনা। বাবার অবশ্য মনে ছিল না। তখন বিজয়কৃষ্ণ বলেন যে, তোমার সেবারেও পতন হয়েছিল এবারও হবে–তোমায় আবার আসতে হবে। বাবা তাতে ভীত নন, এই উপভোগ্যা পৃথিবীতে আবার যদি আসতেই হয় তাতে তিনি কাতর হবেন কেন? দ্রুতপঠন ক্ষমতাও তার বিস্ময়কর! সাত-আট হাজার বইয়ের লাইব্রেরীর সমস্ত বই তার পড়া। তাছাড়া তার ব্যক্তিত্ব অসাধারণ, সেই ব্যক্তিত্বের আকর্ষণী শক্তিও প্রবল। বড় বড় পণ্ডিতরাও তার সমকক্ষ নন, তিনি তাদের প্রশ্নে প্রশ্নে ঠকিয়ে প্রমাণ করে দেন যে তাদের যত্ব-ণত্ব জ্ঞান নেই।
শুধু এদেশে নয়, বিদেশেও বাবাকে অনেকেই মান্য করে, ভালোবাসে। সেবা উনি আদায় করতে জানেন। ওর অধ্যাপক ম্যাকটাগার্টের গল্প শুনেছি—অত বিরাট পণ্ডিত ব্যক্তি তার এই বিদেশী আহ্লাদে ছাত্রটির রীতিমত সেবা করতেন—ঘরে তার চেম্বার-পট পর্যন্ত রেখে যেতেন! এ কথাটা বাবা বেশ গর্বের সঙ্গেই বলতেন। তখনকার দিনের ছাত্র ও অধ্যাপকদের সম্পর্কের মাধুর্য তাদের সম্পর্কের মধ্যে ছিল। বাবা তার পক্ষে যতটা ভালোবাসা সম্ভব ভালোও বাসতেন অধ্যাপক ম্যাটাগার্টকে। দার্শনিক পণ্ডিত ম্যাকটাগার্টের একটা দুর্বলতা ছিল, তিনি খুব মদ্যপান করতেন। তাঁর একটা গল্প প্রায়ই বলতেন বাবা। কোনো বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেয়ে ফিরবেন, একটা মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছতে হবে—বিরাট মাঠের মধ্যে কোথাও কিছু নেই, একটিমাত্র গাছ আছে। অধ্যাপক সোজা সেই গাছটির সামনে এসে দাঁড়ালেন কিন্তু সেটা কি করে পার হবেন ভেবে পেলেন না। তখন আবার বাড়িতে ফিরে গেলেন, ও আবার রওনা হয়ে ঠিক সেই অনতিক্রম্য গাছটির সামনে এসে পৌঁছলেন, এরকম অনেকবার করবার পর শ্রান্ত ক্লান্ত অধ্যাপক গাছতলাতে বসে পড়লেন—“I am lost in a dense forest.”
এই গল্পটা খুব উপভোগ্য ছিল। কিন্তু আমার মনে সব সময় একটা খটকা লেগে থাকত যে, বাবা যাকে এত শ্রদ্ধা করেন, এমন শ্রদ্ধনীয় বিদ্বান ব্যক্তি কি করে মদ্যপ হতে পারেন। মদ খাওয়া তো খারাপ, পাপই, তাহলে? আমরা কখনো একথা ভাবতে শিখি নি যে একজন মানুষের চরিত্রে দোষগুণ পাশাপাশি বাস করলেও সে শ্রদ্ধনীয় থাকতে পারে। সমাজের বিবিধ তিরস্কারে অভিভূত আমাদের দৃষ্টি মানুষের দুর্বলতা ও ত্রুটিবিচ্যুতিগুলিকে যথাযথ ‘পারসপেকটিভে’ দেখতে জানত না। যেমন আমার বাবার যে কোনো ত্রুটি থাকতে পারে, তা কখনো আমরা চিন্তাও করতে পারতাম না। তিনি সম্পূর্ণ দোষশূন্য দেবতাতুল্য—এই রকম একটা ধারণা গড়ে তোেলবার মূল হচ্ছেন মা। এর বিপদ কতখানি তা মা বুঝতেন না। শুধু আমার মা নয়, এই রকমই তখন রেওয়াজ ছিল। তারা মনে করতেন পিতামাতার, গুরুজনের কোনো বিচার করবার চেষ্টাই ক্ষতিকর। পিতা স্বর্গঃ, পিতা ধর্মঃ, পিতা হি পরমং তপঃ—সে যুগেই কোনো কোনো বাড়িতে এ মন্ত্রের প্রভাব শিথিল হচ্ছিল বটে, কিন্তু আমাদের বাড়িতে আমার পিতার অসামান্য প্রতিভার জন্যই তা হতে পারে নি। তবু সেই সময়ে আমার মনে একটু একটু সমালোচনার ভাব দেখা দিচ্ছিল, তার জন্য আমি লজ্জিত হলেও সেই ভাব সম্পূর্ণ দমন করতে পারছিলাম না। প্রথম আমার বাবার সঙ্গে মুখে মুখে উত্তর করবার স্পর্ধা হয়েছিল তার অসুখের সময়তেই–।
আমাদের বাড়িতে আমার ঠাকুমার আমল থেকে একটি মহিলা থাকতেন। আমার বাবার চেয়ে কিছু বড়—তাকে আমরা আত্মীয় বলেই জানতাম। আসলে তিনি পরিচারিকার কাজ করতেই এসেছিলেন কিন্তু ক্রমে বাড়ির লোকের মত হয়ে গিয়েছিলেন। তাকে আমরা অর্থাৎ ছেলেমেয়েরা সবাই খুব ভালোবাসতাম। তার খুব হাঁপানি হত, একজিমায় কষ্ট পেতেন। আমি দেখতাম, তার জন্য ডাক্তার ডাকা, ওষুধ আনায় বাবার একেবারে গরজ নেই-মা যতদূর পারেন চেষ্টা করেন কিন্তু টাকা তো বাবারই। একদিন দেখলাম, তিনি যন্ত্রণায় কাঁদছেন—আমি সোজা গিয়ে বাবাকে বললাম—“তোমার জন্য সব সময় এত ওষুধ আসছে, ডাক্তার আসছে, চাপাপিসির জন্য কেন আসবে না?” বাবা বিস্ময়বিমূঢ়—“আমার জন্য ডাক্তার আসছে, চাপার জন্য কেন আসছে না?” এত বিস্ময় ছিল তার প্রতিপ্রশ্নে যেন তিনি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না, তিনি আর ঐ দাসী এক হল আমার কাছে!’
আমি চুপ করে চলে গেলাম। আমার নিজেরই লজ্জা করতে লাগল। এমন একটা কথা আমি যে কি করে বলে ফেললাম। কিন্তু আমি জানি, আমার মনে ক্রমে ক্রমে বিদ্রোহ জমা হচ্ছে। বাবার মতের বিরুদ্ধে এতটুকু কাজ করবার আমাদের ক্ষমতা নেই। এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ তার অনিচ্ছায় একেবারে কিছু করতে পারবে না। তাহলে আমার ইচ্ছার দাম কি? কিছু না, কিছু না। সম্রাট যেমন ইচ্ছে করলে কাউকে হাতীর পায়ের তলায় ফেলতে পারেন, করুর মুণ্ডচ্ছেদ করতে পারেন, উনি সেরকম শরীরে মেরে ফেলতে পারেন না বটে কিন্তু মনে মনের উপর তার অধিকার সম্পূর্ণ। উনি যদি আমাদের কথা জানতে পারেন, এই মুহূর্তে আকবর যা করেছিলেন তাই করবেন—শরীরে নয়, কিন্তু মনে, মনে, মনে। প্রেমের এই আনারকলির উপর পাথর গড়িয়ে ফেলবেন। কেউ বাধা দিতে পারবে না! আর রবিঠাকুর? তিনি যদি আমার পিতা হতেন, তিনিও কি এরকম করতেন? যিনি লিখেছেন—দোলে প্রেমের দোলনচাপা হৃদয় আকাশে’–তিনি কি সেই চাপার কলি থেতলে দিতে পারেন? কখনই না। বলব তাঁকে? কি হবে বলে, তার তো আমার উপর কোনো অধিকার নেই। তিনি তো আমার কেউ নয়। কেউই নয়! কেউই নয়! কি অদ্ভুত কথা।
একদিন ও আমাকে জিজ্ঞাসা করল—“তুমি কোনারকের মূর্তি দেখেছ?”
“আমি কোনারক যাইই নি। কেন?”
“আমি আগে ভাবতুম মানুষ ওরকম দেখতে হতে পারে না।”
আমি ভাবছি মনে মনে ও কোনারক যেতে পারে কারণ সেটা পোড়ো মন্দির—’পুণ্যলোভীর নাই হল ভীড় শূন্য তোমার অঙ্গনে জীর্ণ হে তুমি দীৰ্ণ দেবতালয়’—কিন্তু পুরীর মন্দিরে বা ভুবনেশ্বরের মন্দিরে ওকে ঢুকতে দেবে না। ও ম্লেচ্ছ। ওরা রবীন্দ্রনাথকেও পুরীর মন্দিরে ঢুকতে দেয় নি। কী দুর্ভাগা এই দেশ! তাই তো অমন একটা কবিতা লিখেছিলেন, যা অভিশাপের মত শোনায়।
আমরা নীচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি—আমি রেলিঙে ঠেশ দিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে। পিছনে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলে ভরা মাধবীলতাটা দুলছে, মাঝে মাঝে আমার মাথায়, গালে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ও আমার সামনে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে, হঠাৎ আস্তে আস্তে বললে, “তোমাকে দেখতে মন্দিরের গায়ে মূর্তির মত।”
এই প্রথম ও আমার চেহারা সম্বন্ধে একটা প্রশংসার কথা বলল। তা এটা প্রশংসা কিনা তাই-ই জানি না। মূর্তির মত দেখতে হওয়া ভালো কি খারাপ কে জানে! আমি আরো অনেক মিষ্টি মিষ্টি রূপ বর্ণনা শুনতে চাই, কিন্তু অন্য লোকেরা যা এত বলে ও তা বলে না। ওদের দেশে বোধ হয় রূপ বর্ণনা করতেই জানে না আমাদের মত–
“তিল ফুল জিনি নাসা, সুধার সদৃশ ভাষা
মৃগপতি জিনি মধ্যদেশ
রাম রম্ভা জিনি উরু কামধনু নিন্দি ভুরু
মেঘসম ঘন কালো কেশ।”
তা নয়, মূর্তির মত দেখতে! যা কিছু হল না।
কিছুদিন থেকে আমার বই ছাপা হচ্ছে, কবিতার বই, বাবা অনেক আশা করে বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘ভাসিতা। বইটা প্রেসে যাবার আগে বেশির ভাগ মীলু কপি করেছে। মীলুর বানান সম্বন্ধে ধারণা বেশ নূতন রকম। “এ কি? যদি-তে ‘দ’-এ ঈকার দিয়েছিস কেন?”
“কি হয়েছে তাতে? নদীর পাশে তো ভালই দেখাচ্ছে।”
যত্ব-ত্বর তো কথাই নেই। আমারও যে বানান নির্ভুল তা নয়। বিশেষ ভুল বানানের সম্মুখীন হলে আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যাই। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় দেশবিশ্রুত সম্পাদক বলতেন, একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া তিনি আর কোনো কবি দেখেন নি যার বানান সম্পূর্ণ নির্ভুল।
প্রুফ দেখতে শিখে আমি রীতিমত বড় হয়ে গেছি। গম্ভীরভাবে প্রুফসংশোধন করতে করতে নিজেকে বেশ উন্নত মনে হয়। কিন্তু বানানের জন্য আমি ডিকশনারী দেখি না। আমি ‘চয়নিকা’, ‘বলাকা’ বা ‘মহুয়া’ থেকে বানানটা দেখে নিই—অর্থাৎ কোন শব্দটা কোন কবিতায় কোন পাতায় রয়েছে এটা বের করে নেওয়া আমার পক্ষে সহজ এবং আনন্দজনক। সেই সময়ে যদি রবীন্দ্রনাথের কবিতার উপর কনকরডেন্স করতে দেওয়া হত আমি বোধ হয় পারতাম।
বাবা ঠিক করেছেন আমার জন্মদিনের দিন ‘ভাসিতা’ উদ্ভাসিত হবে, সেই দিনের জন্মোৎসবে বাংলাদেশের সমস্ত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের নিমন্ত্রণ করবেন, একটা বিরাট আয়োজন করবেন। এ যেন বিলেতে যেমন মেয়ে বড় হলে তাকে রাজসভায় পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় তেমনি নূতন করিকে বিদ্বৎসমাজে পরিচয় করিয়ে দেবেন। এই যে একটা আয়োজন চলেছে আমাকে কেন্দ্র করে, বাবা মা দুজনেই তাদের প্রথমা কন্যাকে নিয়ে মেতে আছেন, এতে অন্যরা অনেকটাই আড়ালে পড়ে গেছে। অবশ্য ভাই দুটি তো ছোট, কিন্তু সাবি? সে তো ছোট নয়। সে অনাদৃত বোধ করছে এবং ঠোঁট ফোলাচ্ছে। তার শরীরও খারাপ হয়েছে, মনও। এই মনের অসুখটা আরো বেড়ে গেল যেদিন তাকে ফেলে আমরা উদয়শঙ্করের নাচ দেখতে গেলাম।
বেশ কিছুদিন আগে অ্যানা প্যাবলোভা এসেছিলেন কলকাতায়। মা আর বাবা তার নাচ দেখতে গিয়েছিলেন। প্যাবলোভার নৃত্য নিয়ে কলকাতার ‘এলিটরা মুখর হয়ে উঠেছিল। মা জীবনে সেই প্রথম এরকম নাচ দেখলেন। আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়নি কারণ আমি তখনও যথেষ্ট বড় নয়। এ সম্বন্ধে মা যখন অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করেন তখন আমি শুনেছি। নৃত্য সম্বন্ধে মা বিশেষজ্ঞ নন মোটেই। কিন্তু তাঁর শিল্পরুচি ও সৌন্দর্যবোধ বাবার চেয়ে অনেক বেশি। তাই মরালীর মৃত্যুর নৃত্যটি তাকে অভিভূত করেছিল। বেশ অনেকদিন পর্যন্ত একটা আবেশ লেগেছিল তার মনে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দ্বিধাও ছিল কম নয়। প্যাবলোভা তো মরালীনৃত্য করার সময় আপাদলম্বিত গাউন পরে ছিলেন না। তার পরনে কাপড়চোপড় মার চোখে ছিল না বললেই হয়। তাঁর ঊরু অনাবৃত ছিল, ঘাগরাও ঘুরছিল নিম্নাঙ্গের অনেকখানিই অনাবৃত করে। মার মতে এটা শিল্পের প্রয়োজনে মেনে নিলেও সমাজের পক্ষে তো ক্ষতিকর বটেই। নিউ এম্পায়ার থেকে বেরিয়ে আসবার সময় দূরে তার বোনপো তাকে দেখে সুরুৎ করে পালিয়ে গেল। বোনপোর বয়স কিছু কম নয়, এম, এ. পড়ে। কিন্তু তাকে ওখানে দেখে মা খুব চিন্তিত। দেবুও এ নাচ দেখল। আর দেবুও কম চিন্তিত নয় যে মাসী তাকে এমন একটা ‘নিষিদ্ধ’ জায়গায় দেখে ফেললেন।
যা হোক উনিশ’শ ত্রিশ সালে উদয়শঙ্কর কলকাতায় এলেন নিউ এম্পায়ার-এ নাচ দেখাতে। প্যাবলোভার শিষ্য, ভারতীয় নৃত্য দেখাবেন। এ দেশের চোখ তখন নাচ দেখতে অভ্যস্ত নয়। কখনো সখনো বিশেষ সমাজের দু-একজন বিশেষ ব্যক্তি দুচারটে ‘ব্যালে’ দেখে থাকবেন। স্বদেশী নাচ দেখা যায় শুধু মন্দিরে। আমরা পুরীতে ও ভুবনেশ্বরের মন্দিরে দেবদাসীর নাচ দেখেছি। সে নাচ অসংস্কৃত। আর বাইজীরা কোথায় নাচে সে আমরা সভ্য সমাজের লোকেরা জানিই না। আমাদের ধারণা দুশ্চরিত্র জমিদারেরা বাগানবাড়িতে তাদের কোনো রহস্যলোক থেকে নাচাতে নিয়ে আসে! কোন বিদগ্ধ ব্যক্তি সে নাচ দেখবার জন্য ব্যগ্র নয়। আর নাচে উপজাতিরা। সাঁওতাল, মুণ্ডা, গোণ্ড, এরা নানা উৎসবে নাচে। আমি খোঁপায় জবা ফুল গোজা সাঁওতাল মেয়েদের নাচ দেখেছি। লোকনৃত্যের মধ্যে মণিপুরী, গরবা ইত্যাদি সেই দেশের পালাপার্বণে হয়ে থাকে। বৃহত্তর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দুসমাজে কোনো রকম নাচের কথা আগে তো শুনি নি এক ব্রতচারী ছাড়া। আর শুনেছি ঠান্দিরা বাসরঘরে বরকে উত্যক্ত করার জন্য নাচে। ভদ্রলোকের ছেলে কিংবা মেয়ে স্টেজে নাচবে এ তো কল্পানাতীত ব্যাপার।
১৯২৬ কিংবা ১৯২৮ সালে শিলং গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে মণিপুরী লোকনৃত্য দেখে রবীন্দ্রনাথই প্রথম রঙ্গমঞ্চে দর্শকদের সামনে ভদ্রঘরের ছেলেমেয়েদের নৃত্য প্রবর্তন করলেন। দর্শকেরা টিকিট করে সে নাচ দেখতে গেল। বাঙালীর ঘরের মেয়ে সহস্র লোকের চোখের সামনে অঙ্গসঞ্চালন করবে একথা চিন্তা করে অনেকেরই রাত্রির নিদ্রা চলে গিয়েছিল। এ একরকম বিদ্রোহ-ঘোষণা। হয়ত রাজনৈতিক বিপ্লবের চেয়েও কঠিনতর। রবীন্দ্রনাথকে তাই সাবধানে চলতে হয়েছিল। প্রথম যে নাটকে এই নৃত্যযোজনা হল সে ‘নটীর পূজা’—কথা ও কাহিনীর ‘শ্রীমতী’ কবিতাটিকেই ঐ নাটকে রূপান্তরিত করা হয়েছে। নটীর পূজা অর্থাৎ নৃত্যটাও নৃত্যশিল্পীর পক্ষে পূজাই এই বিশেষ ব্যঞ্জনার দ্বারা নটীর কলঙ্কমোচন করা হয়েছিল খুব সূক্ষ্মভাবে। যে গানটির সঙ্গে নৃত্য করলে ‘শ্রীমতী’ নামে সে দাসী’ সে হচ্ছে, ‘আমায় ক্ষম হে ক্ষম’…নর্তকী ভগবান বুদ্ধকে বলছে ‘তোমার বন্দনা মোর ভঙ্গীতে আজ সঙ্গীতে বিরাজে’ কিংবা আমার সব চেতনা সব বেদনা রচিল এ যে কি আরাধনা’… সেই আরাধনার ভাবমূর্তি দেখে নিন্দুকেরা কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। আমি ‘নটীর পূজা’ দেখি নি। কারণ নাচ দেখবার তখন আমার বয়স হয় নি। সেই একই কারণে উদয়শঙ্করের নাচ দেখতে সাবিকেও নেওয়া হল না। দিদি গেল বলেই ও দুঃখ পেল, কারণ ওরও তখন বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে, ও যৌবনে প্রবেশ করছে।
বাবা কলেজ থেকে ফোন করে জানালেন একটিও সীট নেই, খালি বক্স আছে। বক্সের দাম অনেক বেশি, তাই মির্চাও কিছুটা দেবে, আমরা চারজন যাব। মা সেদিন রূপার পাতের চুমকি বসান ঈজিপশিয়ান চাদর পরেছিলেন, মাকে রানীর মত দেখাচ্ছিল। মির্চা ধুতি পাঞ্জাবী পরেছিল। কলকাতার সমগ্র বিদগ্ধসমাজ সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিল। কলকাতার এই বিদগ্ধসমাজের মধ্যে উচ্চমন্যতা রোগে ভোগেন ব্রাহ্মসমাজভুক্ত বিরাট এক গোষ্ঠী। সকলেই নয় অবশ্য, কিন্তু অনেকে। তারা আমাদের কোনোদিনই যথেষ্ট সভ্য বলে মনে করেন না—আমরা ক’পুরুষই বা কলকাতার এই উচ্চসমাজে মিশছি, তাছাড়া আমরা তো হিন্দু। খুব পরিচিত হলেও তাঁরা সব সময়ে আমাদের চিনতে পারেন না। এই শ্রেণীভুক্ত বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট এলিট সেদিন তাদের স্বাভাবিক তাচ্ছিল্যভাব তো কাটিয়ে ফেললেনই, দলে দলে আমাদের বক্সের নিচে এসে দাঁড়িয়ে, ডেকে ডেকে গল্প করতে লাগলেন। বাবার ভঙ্গীও কম দৃপ্ত নয়, পরমাসুন্দরী পত্নী, যথেষ্ট সুন্দরী (মির্চা যাই বলুক) কবিকন্যা ও বিদেশী ছাত্র এবং বক্স—সব নিয়ে যা কাণ্ডটা হয়েছিল তাতে ব্রাহ্ম-ব্রাহ্মিকাদের দর্প চূর্ণ-বিচূর্ণ।
উদয়শঙ্কর সেদিন অদ্ভুত নাচ দেখালেন—আমার মনে আছে তার ছায়াটা আমাকে যেন এক অলৌকিক জগতে নিয়ে গিয়েছিল তাঁর স্পন্দিত বাহু যেন জলের ঢেউ–সমস্ত শরীর তরল। পার্বতীরূপিনী সিমকী মনোহারিণী হলেও উদয়শঙ্কর যেন দেবলোক থেকে নেমে এসেছেন—মানুষের দেহের এমন ছন্দিত রূপ আমি তো দেখিই নি, সেদিন ওখানে উপস্থিত আর কেউ দেখেছেন কিনা সন্দেহ। মির্চার অবস্থা সুদাস মালীর মত-মুখে আর বাক্য নাহি সরে, ওর হাতে যদি সুদাসের মত পদ্ম থাকত তাহলে ও তখনি ‘পদ্মটি রাখিত ধরে’ উদয়শঙ্করের ‘চরণপদ্ম পরে’। সারারাত সে. পিয়ানো বাজাল, ঘুমাতে পারল না—আমাকেও ঘুমাতে দিল না, আমার ঘর ঠিক ওর ঘরের উপরেই। এর পর বহু দেশে বহুসময়ে নাচ দেখেছি কিন্তু সেদিনের অনুভূতি আর কখনো হয় নি। আমাদের দুজনেরই মন ছিল অনুকূল—সৃষ্টির বেদনা তাই তারা সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করেছিল। বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত আমাদের আর কোনো কথা ছিল না! মির্চা বলতে লাগল—“This is India! This is India!”
আমায় যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে ও আমাদের বাড়িতে কতদিন ছিল, ক’দিন ক’মাস বা ক’বছর—আমি বলতে পারব না। আমার এই ষাট বছরের জীবনে সবসুদ্ধ জাগতিক হিসাবে হয়ত ছয় সাত বছর আমি সত্যকারের বেঁচে আছি বাদ বাকি দিনগুলি পুনরাবৃত্তি মাত্র। মির্চার সঙ্গের দিনগুলি তার মধ্যে যদি এক বছর হয়ে থাকে তবে তা তিনশ’ পঁয়ষট্টি দিন মাত্র নয়, তার পরিমাপ করার কোনো যন্ত্রই আমার হাতে নেই। পৃথিবীর আবর্তনে তা ঘুরছে না, তা সূর্যের মত স্থির আছে। আমি তার মধ্যে এতদিন প্রবেশ করি নি, এখন করছি—যখন ইচ্ছা করছি প্রবেশ করছি সেই সময়ে, সেই আনন্দে, সেই বেদনায়। সেখানে আমি কাকে পাচ্ছি? শুধু কি ও আর আমি? তার মধ্যে সবাই আছে, শান্তি আছে, থোকা আছে, ঐ গোপাল আছে যে ওর দিকে ঈর্ষাভরে চায়, কারণ সে আমায় খুব ভালোবাসে। তারা সবাই উপস্থিত। আছে ঐ লাইব্রেরীর বইগুলো, এমন কি ক্যাটালগ করার বাক্স পর্যন্ত। আমার সত্তার চৈতন্যে মিশে সেই কালটি তার সমস্ত রূপসম্ভার নিয়ে অব্যয়।