সিন্দাবাদের প্রথম সমুদ্র-যাত্রা
খলিফা হারুন অল রসিদের সময়ে বাগদাতে সিন্দবাদ নামে দরিদ্র কুলি বাস করতো। অন্যের মোট বয়ে কোনক্রমে তার দিন যেতো।
একদিন সে দারুণ গ্রীষ্মের খরতাপে দগ্ধ হয়ে পোল্লাইভরি মোট মাথায় করে নিয়ে চলছিলো। ঘামে সারা শরীর নেয়ে যাচ্ছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে এক বিরাট সওদাগরের বাড়ির ফটকের সামনে এসে থামালো। পা আর চলতে চায় না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কাছেই একটা রোয়কের ওপর মোটটা নামিয়ে সে বসে পড়লো।
মনে হয় একটু আগেই ফটকের সামনেটায় কেউ গোলাপ জল ঢেলে দিয়ে গেছে। মৃদুমন্দ হাওয়ায় গোলাপ জলের মনমাতানো সুবাস বড় মধুর লাগে। সিন্দাবাদের সকল ক্লাস্তি কেটে যায়। প্ৰাণ ভরে সে গোলাপের গন্ধ আত্মাণ করতে থাকে।
কান পাতলে শোনা যায়, সওদাগরের বাড়ির অন্দর থেকে অপূর্ব মিষ্টি গানের কলি ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে তানপুরার সুমধুর তান। সিন্দবাদ ফটকের ফাঁকে মাথাটা ঝুকিয়ে দৃষ্টিপাত করে। একটা বাগিচা। ঝকঝকে তকতকে। কত বিচিত্র নানা বর্ণের বাহারী সব ফুল। দুচোখ জুড়িয়ে যায়। এমন সাজানো গোছানো বাগান সে বড় একটা দেখেনি। সাধারণ লোকের কথা দূর থাক, অনেক সুলতান বাদশাহের বাগিচাও এমন সুন্দর হয় না।
এতক্ষণে সে বুঝতে পারলো, গুলাবের সুবাস কোথা থেকে আসছে। মৃদুমন্দ সমীরণে চারদিক সুগন্ধে মদির হয়ে গেছে। সিন্দবাদ এই প্রথম অনুভব করতে পারে, জীবনে কত গান আছে, কত ফুল আছে, কত রূপ আছে কত গন্ধ আছে। কিন্তু সে-সব তার জন্য নয়। এই গান এই ফুল, এই গন্ধ তাদের মতো দরিদ্রের জন্য নয়। ধনীর দুলাল হয়ে জন্মালে তবেই এই সব ভোগ করার অধিকার থাকে। সিন্দবাদ ভাবতে থাকে, প্রতিদিন প্রতি নিয়ত আমি ধনীর মোট বয়ে বেড়াই। কত সোনা দানা হীরে জহিরৎ বয়ে নিয়ে যাই বিত্তবানেরবাড়ি কিন্তু, হায় আমার নসীব, কয়েকটা দিরহাম ছাড়া, সে-সব আমি চোখেও দেখতে পাই না। সেইসব ধনরত্ন বিলাসের সামগ্ৰী যারা ভোগ করে তারা তো ভিন্ন গোত্রের মানুষ। বিলাস ব্যসন তাদের জন্মগত অধিকার। আমি মোট বয়ে চলি।
এই তো, আজও, যে মোটের অত্যধিক ভারে আমি ঘর্মািক্ত ক্লান্ত এবং নুজ্য হয়ে এখানে বসে পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম, জানি, এর মধ্যে যে আনন্দ বিলাসের উপকরণ আছে, তাতে বহুজন বিত্তের বিবিধ বিনোদন হতে পারবে।
মনের দুঃখে গান ধরে। সে-গানে হৃদয়ের সকল ব্যথা বঞ্চনা গলে গলে ঝরতে থাকে। অনেকক্ষণ জিরিয়ে শরীর এবং মন বেশ জুড়িয়ে গেছে। মোটটা মাথায় তুলে আবার সে যাত্রা করতে উদ্যত হয়েছে—এমন সময় ফটকটা খুলে গেলো। একটি ছোট্ট বান্দা বেরিয়ে এলো। মুখে বেশ মিষ্টি হাসি। কোন রকম ভূমিকা না করে সিন্দাবাদের একটা হাত ধরে সে টানে, আমার মালিক তোমাকে ডাকছে, চলো।
সিন্দবাদ অবাক হয়, ভয়ও পায়। না যাওয়ার ছুতো খুঁজতে থাকে। যাহোক একটা কিছু বলে ছেলেটাকে বোঝাতে হবে তো। কিন্তু ভেবে পায় না, কি বলবে। ছেলেটা আবার হাত ধরে টানে, চলো না, আমার মালিক তোমার সঙ্গে কথা বলবে।
ছেলেটি একেবারে নাছোড় বান্দা। সিন্দবাদ বলে, কিন্তু আমার এই মোট? এটা কোথায় রেখে যাবো?
ছেলেটি বলে, সে তুমি কিছু ভেবো না। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ফটকে পাহারা আছে না? পাহারাওলার কাছে রেখে, চলো। ভয় নাই, কেউ কিছু নেবে না।
পাহারাওলার কাছে মোটটা গচ্ছিত রেখে সিন্দবাদ খুদে বান্দাটার পিছনে পিছনে চলে।
সুরম্য ইমারৎ। ঝকঝকে তকতাকে সাজানো গোছানো। ছেলেটি তাকে এক বিশাল কক্ষে নিয়ে গেলো। খানদানী ঘরের অতিথি অভ্যাগত সমবেত হয়েছে। ঘরময় হরেক রকম নাম-না-জানা ফুলের সেকি সমারোহ-প্ৰাণমন ভরে যায়। আর আতর গোলাপজলের মিষ্টি গন্ধে মাতাল করে হৃদয়। বিরাট লম্বা মেজ-এ চিকনের কাজ করা দুগ্ধ ফেননিভ চাঁদর বিছানো। তার ওপর থরে থরে সাজানো খানাপিন-পেস্তার বরফী, গাজরের শাহী হালওয়া, দুষ্প্রাপ্য ফল, ইত্যাদি। অসংখ্য রূপের রেকবীতে ভরা ঝলসানো দুম্বার মাংস, মুরগীর দৌপিয়াজী, বটি কাবাব, টিকিয়া ইত্যাদি। আর একাধারে সরাবাদানীতে ভরা দামী আঙ্গুরের মন্দ। একদল বান্দারা সেজেগুজে অপেক্ষমান। আর এক দিকে সুন্দরী বাঁদীরা নানারকম বাদ্য-যন্ত্র হাতে নিয়ে বসে আছে।
সিন্দবাদ মুগ্ধ বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এযে একেবারে বেহেস্ত। এখানে যারা সমবেত তারা নাকি এই দুনিয়ার কোন নরনারী, না-বেহেস্তের জীন পরী? উপস্থিত সকলে তাকে স্বাগত জানায়। সিন্দবাদ এক পাশে গিয়ে মাথা হোঁট করে দাঁড়িয়ে থাকে।
সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ একজন তাকে কাছে ডাকে। আদর করে পাশে বসায়।
বান্দাদের একজনকে খানা দিতে বলে। সিন্দাবাদের সামনে রেকগবী ভর্তি খাবার সাজিয়ে দেওয়া হয়। বৃদ্ধ বলে, হাত-মুখ ধুয়ে আগে খানা সেরে নাও, তারপর তোমার সঙ্গে কথা হবে।
সিন্দবাদ সুবোধ বালকের মতো খানাপিনী সারে। বৃদ্ধ সন্তুষ্ট হয়ে বলে, একটু আয়েস করে বস। আচ্ছা বেটা, তোমার নাম কী? কী কর তুমি?
—আমার নাম সিন্দবাদ কুলি। আমি ভারি ভারি মোট বয়ে রুটির পয়সা রোজগার করি।
বৃদ্ধ হাসলেন। শিশুর মতো সরল হাসি। বললেন, আরে, কী আশ্চর্য, তোমার নাম আর আমার নাম যে এক। তুমি সিন্দবাদ কুলি, আর আমার নাম সিন্দবাদ নাবিক…আমি তোমাকে ডেকেছি তোমার সুন্দর মিষ্টি গান শুনে। আমার ইচ্ছা, এখানে তুমি আমাদের দু-একখানা গান শোনাও।
সিন্দবাদ কেমন সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। —আল্লাহর দোহাই, আমার ঐ দুঃখের গান শুনে আমাকে দোষারোপ করবেন না।
সিন্দবাদ নাবিক বললো, কেন, দোষারোপ করবো কেন? আর তোমারও কুষ্ঠিত হওয়ার কোনও কারণ নাই। গলা ছেড়ে প্রাণ খুলে গাইবে। তাতে কার কী মনে করার থাকতে পারে। এখানে তোমার লজ্জা সঙ্কোচ করার কিছু দরকার নাই। তুমি আমার ছোট ভাই-এর মতো। ঐ যে গানগুলো গাইছিলে না? সেইগুলোই আবার শোনাও।
সিন্দবাদ আবার গাইলো গানগুলো। সিন্দবাদ নাবিক তো মহাখুশি। আমার ভাগ্যও বড় বিচিত্র। তোমাকে বলবো সেই কাহিনী। তাহলে বুঝতে পারবে, কী নিদারুণ উত্থান পতন আর অগ্নি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আজ আমি এই অতুল ঐশ্বর্যের মালিক হয়েছি। কী অমানুষিক কঠোর পরিশ্রম ধৈর্য তিতিক্ষার ফলশ্রুতি এই বিত্ত তা আমার কাহিনী না শুনলে উপলব্ধি করতে পারবে না। কত বিপর্যয় কত দুৰ্ভাগ্য। আর কত দুঃসাহসিকতা জড়িয়ে আছে এই সাফল্যের পিছনে তা কল্পনা করতে পারবে না। আমি পরপর, সাতবার অসাধারণ সমুদ্রযাত্রা করেছি–তার যে-কোন একটা কাহিনী শুনলে মানুষ হতবাক হয়ে যাবে। তোমাকে আমি সবগুলোই শোনাব।
বৃদ্ধ সিন্দবাদ নাবিক বলতে শুরু করে :
এখানে, আমার মহামান্য মেহেমানরা, –যাঁরা উপস্থিত আছেন, এবং আমার এই নতুন মিতা—সবাই শুনুন। আমার বাবা ছিলেন এক সন্ত্রান্ত সওদাগর। গরীবদের প্রতি তার দরদ ছিলো অসীম। দু’হাতে তাদের জন্য খরচ করতেন। তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর আমি যথেষ্টই পেলাম। টাকা-পয়সা, জমি-জমা-প্রচুর রেখে গিয়েছিলেন তিনি। আমি তখন নাবালক। সুতরাং আছি হিসাবে আমার এক আত্মীয় আমার বিষয় আশয় দেখাশুনা করতো।
যখন আমি সাবালক হলাম, আমার বিষয় সম্পত্তি আমি নিজের হাতে ফিরে পেলাম। হঠাৎ কাঁচা বয়সে প্রচুর পয়সা হাতে পেয়ে আমার ভোগ বিলাসের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো।ইয়ার বন্ধুদের সংখ্যাও দিনদিনই বাড়তে লাগলো। প্রতিদিন দামী দামী মদ আর মাংসের মহোৎসব চলতে থাকলো। মূল্যবান সাজপোশাক পরে ফূর্তি মেরে আর কাব্য করে দিন কটাই। এইভাবে অনেক দিনই চললো। তারপর হঠাৎ একদিন দেখলাম, বিষয়সম্পত্তি বলতে আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট নাই আমার যা আছে, বলতে গেলে, নগণ্য। আমি ভয়ে শিউরে উঠলাম। জীবনে বাকী দিনগুলো কি নিদারুণ কষ্টেই আমার কাটবে। পয়গম্বর সুলেমান ইবন দাউদ-এর এটা বাণী মনে পড়লো। —আমার বাবা প্রায়ই এই কথাগুলো আওড়াতেন : ‘জন্মের মুহূর্তর চেয়ে মৃত্যুর মুহূর্ত অনেক ভালো। জীয়ন্ত কুকুর মৃত সিংহের চেয়ে সেরা। দারিদ্র্যের চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়।’
সুতরাং আর কোল বিলম্ব না করে আমার যা কিছু কিঞ্চিৎ বিষয়সম্পত্তি তখনও অবশিষ্ট ছিলো কোনদিকে দৃকপাত না করে প্রায় জলের দরেই বেচে দিলাম। সর্বসাকুল্যে মাত্র তিন হাজার দিরহাম পেলাম।
এই সময়ে রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
দুশো বিরানব্বই রজনীতে আবার সে বলতে থাকে :
বৃদ্ধ সিন্দবাদ নাবিক তার কাহিনী বলছেঃ
এই মাত্র তিন হাজার দিরহাম সম্বল করে আমি বিদেশ যাত্রা করবো মনস্থ করলাম।
বাজারে গিয়ে নানা ধরনের বাহারী জিনিসপত্র সওদা করে একটি গাঁটরী বঁধলাম। নিজেই মাথায় করে বন্দরে নিয়ে গেলাম। ঐ সময়ই একখানা জাহাজ ছাড়ছিলো—আর কোনও কিছু না ভেবে জাহাজে চেপে বসালম। দেখলাম, আরও অনেক সওদাগর চলেছে সেই জাহাজে। আমাদের জাহাজ বাগদাদের বন্দর ছেড়ে বসরোহর দিকে এগিয়ে চললো।
বাসরাহ ছেড়ে আবার জাহাজ চলতে থাকে। দিনের পর দিন সমুদ্র যাত্রা করে চলেছি আমরা। এক এক করে অনেক দ্বীপ আসে। তাদের পিছনে ফেলে আমরা আবার এগিয়ে চলি। ক্লান্তিহীন বিরামহীন আমাদের এই সমুদ্র যাত্রা। কবে শেষ হবে কে জানে। প্রতি বন্দরেই জাহাজের ভিড়ে আমরা সওদা ফিরি করে ফিরি। কিছু কিছু বিক্রিও হয়।
কয়েক সপ্তাহ ধরে একটানা সমুদ্র যাত্রার পর একদিন এক দ্বীপের নিশানা দেখতে পেলাম। গাছপালায় ভর্তি, শস্য শ্যামল প্রান্তর-শুধু সবুজের মেলা! কি মনোহর দৃশ্যাবলী—বেহেস্তের উদ্যানের শোভার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কপ্তেন এই দ্বীপে জাহাজ নোঙর করলো। যাত্রীরা সকলে নেমে পড়লো।
আমরা সব সওদাগরই এক সঙ্গে নামলাম। খানা পাকবার সাজসরঞ্জাম এবং ডাল আটা ঘি সঙ্গে নিলাম। একটা গাছের তলায় উনুন জ্বালানো হলো। কেউ তরকারি কাটে, কেউ বাটনা বাটে, কেউ বা কাপড় পরিষ্কার করতে লেগে গেলো। কেউ বা এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। কেউ বা গাছতলায় পড়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমায়। আমার কিন্তু নাওয়া খাওয়ার দিকে ভ্রূক্ষেপ নাই। আমি শুধু প্রকৃতির মনোহর শোভা দেখে আকুল। চোখ আর ফেরাতে পারি না। কি অপূর্ব বনরাজিলীলা।
সবাই আমরা যখন শত কর্মেরত, এমন সময় হঠাৎ সারা দ্বীপটি ভীষণ আন্দোলিত হয়ে কেঁপে উঠলো। কে কোথায় যে কীভাবে ছিটকে পড়লো বুঝতে পারলাম না। শুধু শুনতে পেলাম, কপ্তেনের চিৎকার।–যে যেখানে আছ, জাহাজে ফিরে এসো। এটা কোনও দ্বীপ নয়। বিরাট একটা তিমি মাছের পিঠ। বহু যুগ ধরে সে এই সমুদ্রের মাঝখানে ঘুমাচ্ছে। তাই কালক্রমে তার পিঠে পলি জমেছে। আর এই পলি মাটিতে গজিয়েছে লতাগুল্ম বৃক্ষ। তোমরা আগুন জ্বলিয়ে তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছ। আগুনের উত্তাপে যন্ত্রণা পেয়েছে, তাই মোচড় দিয়ে উঠেছে সে। এবার সে চলতে শুরু করেছে। তোমরা আর দেরি করো না—শিগ্গির জাহাজে পালিয়ে এসো। এখুনি হয়তো ডুব দিয়ে সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাবে।
কাপ্তেনের চিৎকারে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে হাঁডিকুড়ি বাসন, খানাপিনা জামা-কাপড় সব ফেলে রেখে জাহাজের দিকে ছুটে এলো সবাই। কাপ্তেন ততক্ষণে নোঙর তোলার হুকুম দিয়ে দিয়েছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই জাহাজ ছেড়ে দেওয়া হলো। ঐ সময়ের মধ্যে যারা পারলো, হুড়পাড় করে জাহাজের পাটাতনে উঠে পড়লো, আর যারা দেরি করলো, তারা আর সে সুযোগ পেলো না। তিমিটা ততক্ষণে আড়মোড়া ভেঙ্গে তিনেক প্রচণ্ড ঝাঁকানি দিয়ে সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে গেলো।
যে সব হতভাগ্যরা সময়মতো জাহাজে উঠতে পারলো না আমি তাদের একজন। কিন্তু আল্লা আমাকে সমুদ্রের গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করলেন। ভাসমান এক খণ্ড ফাঁপা কাঠের গুডি সামনে দেখে আঁকড়ে ধরলাম। এই কাঠের পাটে কিছুক্ষণ আগে আমার সহযাত্রীরা তাদের কাপড়-চোপড় আছাড় দিয়ে কাচছিলো। বহু কায়ক্লেশে, অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করার পর, গুডিটার উপরে উঠে বসতে পারলাম। ভারসাম্য যাতে বজায় থাকে সেইভাবে গুডির মাঝখানে নিজের দেহটাকে ঠিক করে বসিয়ে দুই পা জলে ডুবিয়ে দাঁড় কাটতে থাকলাম। এইভাবে কিছুদূর হয়তো অতিক্রম করা গেলো। কিন্তু হঠাৎ একটা উত্তাল ঢেউ এসে আবার আমাকে কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো কিছুই হদিস পেলাম না।
এদিকে, তখন বেশ দেখতে পাচ্ছি, আমাদের জাহাজে পাল তোলা হচ্ছে। আমি চিৎকার করতে থাকলাম। কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর অতদূর অবধি পৌঁছলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই পালে হাওয়া লাগলো। নিমেষে আমার নজর থেকে জাহাজখানা অদৃশ্য হয়ে গেলো। এদিকে রাত্রির কালো ছায়া নেমে আসে। ঐ নিঃসীম নির্জন নীল সমুদ্রের অন্ধকার কারাগারে আমি তখন এক প্রাণদণ্ডের আসামী। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। তিনিই একমাত্র ভরসা ভেবে সেই কাঠের পাটাতনে পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে বসে রাত্রি আর মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকলাম। কিন্তু না, মরিনি। অন্ধকার কেটে গেলো, সকাল হলো, সূর্যোদয়ের পূর্বাভাষে সমুদ্র সন্নিহিত নীলাকাশ রক্তবর্ণ ধারণ করলো। আমি তার উদ্দেশে প্রণতি জানালাম।
আবার শুরু হলো আমার পদ-সঞ্চালন। পায়ের দাঁড়ে জল কেটে পাডি জমাবার সে-এক দুরন্ত ছেলেমানুষী প্রয়াস। ঘটি ঘটি জল তুলে সমুদ্র শোষণ করা—আর কি! যাইহোক, আমার আকুল আকুতি বুঝি তিনি বুঝেছিলেন। তাই, বেলা বাড়তেই বায়ুবেগও বাড়তে থাকলো। হাওয়ার ঠেলায় আর ঢেউ-এর ধাক্কায় তরতর করে তীরের দিকে ভেসে চললাম আমি।
অবশেষে তীর পাওয়া গেলো। কিন্তু না, তীর না, সে এক সমুদ্রদ্বীপের দুর্লঙ্ঘ্য পর্বত-পাদদেশ। পাহাড় পর্বত সঙ্কুল এই দ্বীপটির কাছে এসে আমি হতাশ হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকলাম। সমুদ্রের তলদেশ থেকে খাড়াই উঠে গেছে একটি পাহাড়। সারা পাহাড়ময় লতাগুল্ম বৃক্ষ। সবুজের সমারোহ। কিন্তু উপরে উঠবার উপায় নাই। এমন একটা স্থানও দেখতে পেলাম না যেখানে পা রেখে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে ওপরে ওঠা যায়। এদিক ওদিক দেখছি। কিন্তু কোনও কায়দা করতে পারছি না। হঠাৎ নজরে পড়লো, একটা পাহাড়ী বটের ডাল থেকে ঝুরি ঝুলে পড়েছে সমুদ্রের জলে। পা দিয়ে দাঁড় কাটতে কাটতে গুডিটাকে নিয়ে গেলাম সেখানে। লতানে ঝুরিটা আঁকড়ে ধরে প্রাণপণ চেষ্টায় উঠে এলাম গাছের ডালে।
এইভাবে অনেক কষ্টে এক সময় পাহাড়ের চুড়ায় উঠে এলাম আমি। এবার মনে কিছুটা বল ফিরে পেলাম। নিজের সারা শরীরটার দিকে ভালো করে লক্ষ্য করার ফুরসৎ হলো। পা দুটো সামুদ্রিক মাছের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। দুৰ্গম পাহাড়ের ঘষায় বুকে পিঠের ছাল-চামড়া ছড়ে গেছে। এসব নজর করার আগে অবধি কোন জ্বালা যন্ত্রণা ব্যথা আমি অনুভব করতে পারছিলাম না। এবার কাতর হয়ে পড়লাম। সারা শরীর টনটন করতে লাগুলো। একটা জায়গায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়লাম। তারপর আমার আর কিছু স্মরণ নাই। কতক্ষণ ঐভাবে অজ্ঞান অচৈতন্য অবস্থায় পড়েছিলাম জানি না, যখন চোখ খুললাম, দেখি আবার সকাল হয়েছে। সূর্যের ঝলমলে রোদ এসে পড়েছে আমার মুখে। উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। পা দুটো ব্যথায় অসাড় হয়ে গেছে। আবার মাটিতে পড়ে গেলাম।
কিছুক্ষণ পরে বুকে হেঁটে, হামাগুডি দিতে দিতে সামনের সমতল ভূমির দিকে এগোতে লাগলাম। এইভাবে এক সময় সেই ঝর্ণা আকুল শ্যামল সমতটে নেমে আসতে পারলাম। চারদিক ফুলে ফলে ভরা।
এখানে আমি গাছের ফল আর ঝর্ণার জল খেয়ে অনেকদিন কাটালাম। ধীরে ধীরে দেহের ক্ষত শুকিয়ে এলো, বল ফিরে আসতে লাগলো। কিন্তু মাটিতে পা ফেলে তখনও হাঁটতে পারি। না। দু’খানা কাঠের ডাণ্ডায় ভর দিয়ে কোনও রকমে চলাফেরা করি।
একদিন এইভাবে সমুদ্র সৈকতে—এসে বসেছিলাম। হঠাৎ কী যেন একটা অদ্ভুত বস্তু দেখলাম। ঠিক বর্ণনা করতে পারবো না, মনে হলো, কোনও জংলী জানোয়ার অথবা সামুদ্রিক দানব। অদম্য কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম। ভয়েও বুক দুরু দুরু করছে। কি জানি, যদি কোনও বিপদ হয়। যাইহোক, কাছে যেতেই বুঝতে পারলাম। না, তেমন কোনও হিংস্ব কোনও কিছু নয়। আমাদের দেশের শাস্ত নিরীহ মাদী ঘোড়া জাতীয় একটি প্রাণী। সমুদ্রের ধারে একটা গাছের গুডিতে বাঁধা। লোভ হলো, জানোয়ারটার পিঠে চেপে বেড়ানো যেতে পারে। একেবারে ওর সামনে এসে দাঁড়ালাম। হঠাৎ একটি মানুষের চিৎকারে আমি হতচকিত হয়ে পড়ি। একটি লোক ছুটতে ছুটতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। রাগে সে ফুসছে। হুঙ্কার ছেড়ে বললো, কে তুমি? কোথেকে এসেছ, এ জায়গায় আসার সাহসই বা তোমার হলো কী করে?
আমি ভীত চকিত হয়ে বললাম, মালিক, আমার অপরাধ নেবেন না, আমি বিদেশী। জাহাজে করে সমুদ্র পাডি দিচ্ছিলাম। কিন্তু পথের মধ্যে বিপর্যয় ঘটে। আমার সঙ্গে আরও অনেকে সমুদ্রের জলে ভেসে যাই। তারা কে কোথায় গেছে, বেঁচে আছে কি নাই জানি না। আমি, আল্লাহর মেহেরবানীতে, একটা কাঠের গুডি ধরে প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছি। নিজের ইচ্ছায় নয়, ঢেউ-এর তালে তালে। আমি ভেসে এসেছি। এই দ্বীপে।
লোকটি আমার একখানা হাত ধরে বললো, এসো, আমার সঙ্গে এসো। আমি তার পিছনে পিছনে চলতে থাকি। সে আমাকে পাহাড়ের নিচে একটা গুহায় নিয়ে আসে। ভিতরে ঢুকে চোখ জুড়িয়ে গেলো। বিরাট প্রশস্ত একটি ঘর। আমাকে আদর করে বসালো। খানাপিনা দিলো খেতে। খেলাম। কতকাল এই সব খানা খাইনি। বড় ভালো লাগলো। প্ৰাণ ভরে চেটেপুটে খেলাম সব। খুশিতে ভরে উঠলো মন। লোকটি তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আমার নামধাম পরিচয়। আমি সব বললাম তাকে। কেন আমার এই সমুদ্রযাত্রা সে কাহিনীও শোনালাম।
লোকটি মুগ্ধ বিস্ময়ে সব শুনলো। এবার আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা মালিক, আপনিই বা এই নির্জন দ্বীপে কেন? কি করেই বা এই পর্বতগুহায় বাসা বাধলেন। আর আপনার ঐ মাদী ঘোড়াটা-ওকেই বা পেলেন কোথায়? সমুদ্রের ধারে ওকে বেঁধেই বা রেখেছেন কেন? কী ব্যাপার কিছুই অনুমান করতে পারছি না।
এমন সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
দু’শো তিরানব্বইতম রজনীতে আবার সে শুরু করে :
লোকটি বলে। এই দ্বীপে আমার মতো আরও অনেকেই আছে। আমি এক নই। সুলতান মিরজানের আজ্ঞাবহ দাস আমরা। দ্বীপের চারপাশে পাহারারত আছি। প্রতি মাসে প্রথম চাঁদ দেখা দিলে আমরা সবাই সমুদ্রের ধারে একটা করে মাদী ঘোড়া বেঁধে রেখে গুহার মধ্যে লুকিয়ে ই থাকি। মাদী ঘোড়ার গায়ের গন্ধ পেয়ে সমূদ্র থেকে সিন্ধুঘোটক উঠে এসে উপগত হয়। তারপর তাকে সঙ্গে করে ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সে কিন্তু আমাদের ঘোড়াগুলো সেয়ানা। কিছুতেই তার সঙ্গে যেতে চায় না। চিহিহি করে ওঠে। সেই শব্দে আমরা বুঝতে পারি, কাজ খতম হয়ে গেছে। তখন ছুটে গিয়ে সিন্ধুঘোটকটাকে তাডিয়ে দিয়ে মাদী ঘোড়াটাকে নিয়ে আসি। এরপর কিছুদিন বাদে সে বাচ্চা প্রসব করে। এই বাচ্চা কালে তাগড়াই জাঁদরেল ঘোড়া হয়। বিদেশের বাজারে সেইসব ঘোড়ার চড়া দাম পাওয়া যায়। আমাদের সুলতানের এই করেই এত ধনদৌলত।
আজ সিন্ধুঘোটকের ওঠার দিন। তুমি অপেক্ষা কর, কাজ শেষ হয়ে গেলে, তোমাকে নিয়ে আমাদের সুলতানের কাছে যাবো। আমাদের দেশটাও ঘুরিয়ে দেখাবো। আল্লাহর দয়াতেই আমার সঙ্গে তোমার আজ দেখা হয়ে গেলো। তা না হলে হাজার চেষ্টা করেও এই দ্বীপের গণ্ডী ছেড়ে তোমার নিজের দেশে ফিরে যেতে পারতে না।
কৃতজ্ঞতায় ভরে গেলো আমার মন। আমরা বসে কথা বলছি, এমন সময় হঠাৎ সিন্ধুঘোটক জল থেকে উঠে এসে মাদী ঘোড়ার ওপর চড়াও হওয়ার আওয়াজ শোনা গেলো। আমরা গুহা। থেকে বেরিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে মাদী ঘোড়াটার পাল-খাওয়া দেখতে লাগলাম। কাজকর্ম শেষ হয়ে গেলে, সিন্ধুঘোটকটা ঘোড়াটাকে তার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীডি করতে লাগলো। কিন্তু সে যেতে নারাজ।
এই সময় আমার বন্ধুটি তারস্বরে চিৎকার করতে থাকলো, হেই, কে আছ, ছুটে এসো। হেই, কে আছ, ছুটে এসো।
পলকের মধ্যে লাঠি-সোটা বর্শ তীর ধনুক নিয়ে তার অনেক সঙ্গী সাখী জড়ো হয়ে গেলো। তাদের আক্রমণে সিন্ধুঘোটকটা শঙ্কিত হয়ে সমুদ্রের জলে ঝাপ দিয়ে পালিয়ে গেলো।
এবার সকলে হৈ-হৈ করতে করতে মাদী ঘোড়াটাকে সঙ্গে করে গুহার সামনে হাজির হয়। আমার বন্ধুটি আমার সঙ্গে তাঁর সঙ্গীসাথীদের আলাপ পরিচয় করিয়ে দেয়। আমাকে পেয়ে তারা তো মহাখুশি। নানা রকম ফলমূল খানাপিনা দিয়ে তারা আমাকে আদর-আপ্যায়ন করলো। একটা ভালো দেখে ঘোড়া এনে দিলো আমাকে। বললো, ওঠ দোস্ত, ঘোড়ায় চাপে, তোমাকে আমাদের সুলতানের কাছে নিয়ে যাবো। তুমি আমাদের মেহেমান।
ঘোড়ায় চেপে ওদের সঙ্গে সুলতানের প্রাসাদে গেলাম। সুলতান মিরজান আমাকে দারুণ আদর অভ্যর্থনা করে তীর পাশে বসালেন। আমার সমুদ্রযাত্রার কারণ এবং ভাগ্য বিড়ম্বনার সবিস্তার বিবরণ আগাগোড়া খুলে বললাম, তাকে। তিনি মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনলেন সব। বললেন, বেটা, উপরে আল্লাহ আছেন, নিয়তির লিখন কেউ এড়াতে পারে না। তোমার নসীবে যা লেখা আছে তা ঘটবেই। তিনি তোমার ইন্তেকালও তোমার কপালে লিখে রেখেছেন, তার আগে তোমার মৃত্যু কিছুতেই হতে পারে না। তোমার যা দুর্ভোগ, দুঃখ, কষ্ট, সুখ, আনন্দ সবই লিপিবদ্ধ করা আছে—তার কোনওটাই এড়াতে পারবে না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ, তিনিই সব বিপদ উদ্ধার করে দেবেন। সুলতান শুধু আমাকে উপদেশই দিলেন না, তার উজির আমিরদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাকে বন্দরের প্রধান পরিদর্শকের পদে বহাল করলেন।
আমার এই চাকরীর কাজ তেমন কিছু কঠিন নয়। কচিৎ কখনও জাহাজ আসে বা ছাড়ে। সুতরাং কাজের তেমন চাপও ছিলো না। সাধারণত সুলতানের দরবায়েই আমার বেশিরভাগ সময় কাটে। মাঝে মধ্যে বন্দরে গিয়ে এক পাক ঘুরে আসি।
প্রায় সব সময় সুলতানের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে থাকার ফলে তিনি প্রায় প্রতি বিষয়েই আমার সঙ্গে পরামর্শ করতেন। আমার বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায়, তিনি কেন, দরবারের সকলেই খুব হিংসা করতেন। প্রজারাও উপকৃত হতে লাগলো। দুহাত তুলে তারা সুলতানের গুণগান করতে থাকলো। ফলে এমন অবস্থা দাঁড়ালো, আমার কথা ছাড়া সুলতান আর কোনও কাজই করেন না।
আমার কিন্তু কিছুতেই মন বসে না। সুলতানের এত আদর যত্ন ভালোবাসা—তবু মন ভরে না। শুধু এক চিন্তা-কবে দেশে ফিরে যাবো।
হা পিত্যেশ করে বন্দরে বসে থাকি। দূরে-বহুদূরে সমুদ্রের শূন্যতায় শুধু খুঁজে মরি জাহাজের মাস্তুল। যদি কোন নাবিক, এই পথে পাডি দেয়। তাকে শুধাবো, তুমি কি জান বন্ধু, কোন পথে যেতে হয় বাগদাদ-আমার জন্মভূমি?
প্রতীক্ষায় বসে থাকতে থাকতে একদিন হয়তো একখানা জাহাজ এসে ভিড়ে। আমি ছুটে যাই। কাপ্তেনকে জিজ্ঞেস করি, সাহেব, আপনি বলতে পারেন, বাগদাদ এখান থেকে কতদিনের পথ। কোন দিকে যেতে হবে?
কাপ্তেন অজ্ঞতার কথা শোনায়। শুনেছি বটে বাগদাদ বলে একটা শহর আছে। জাহাজও ভিড়তে পারে তার বন্দরে। কিন্তু আমি কখনও যাইনি, বলতেও পারবো না, কোন পথে যাওয়া যায়–কতদিন লাগে।
আমি হতাশা নিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসি। জাহাজের নাবিকই যদি বলতে না পারে। তবে কে আমাকে সন্ধান দেবে?
সুতরাং আরও অনেককোল আমাকে সেই সুলতান মিরজানের দ্বীপেই কাটাতে হয়। এই প্রবাস কালে কতকগুলো অদ্ভুত বিস্ময়কর বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিলো। তার দু-একটা এখানে আমি শোনাবো :
একদিন সুলতান মিরজান, আমি তখন তার দরবারে বলেছিলাম, কয়েকজন হিন্দুস্তানীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কোথা থেকে আসছেন? কোথায় আপনাদের দেশ?
—সেখানকার অধিবাসীরা কোন ধর্মের লোক?
—হিন্দু। আমরা, হিন্দুরা, বহু বর্ণে বিভক্ত। তার মধ্যে ক্ষত্রিয় এবং ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠ বর্ণ। ক্ষত্রিয়েরা উচ্চ বংশ কুলোদ্ভব, সাহসী, বীর, যোদ্ধা। কখনও অন্যায় করে না—অন্যায় প্রশ্রয় দেয় না। শত্রুর দমন এবং শিষ্টের পালনই তাদের ধর্ম। আর যাঁরা ব্ৰাহ্মণ তারা পুত পবিত্র। পূজা উপাসনা, ধর্মগ্রন্থ পাঠ, রচনা তাদের জীবনের ব্বত। কখনও তারা মদ্যপান করে না। আচার বিনয় বিদ্যা তাদের সহজাত ধর্ম। কাব্য সাহিত্য দর্শন শিল্প, সঙ্গীত চর্চা করে তারা সহজ, সরল, অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে। এই ক্ষত্রিয় এবং ব্রাহ্মণ ছাড়া আরও বাহাত্তর রকমের নিম্নবর্ণের মানুষ সেখানে বাস করে। এদের জীবন যাত্রার প্রণালী অবশ্য একেবারে ভিন্ন ধরনের।
ওদের এইসব অদ্ভুত কথা শুনে আমি তো তাজ্জব বনে গেলাম। একই দেশে একই ধর্মে এত ভাগ? আমি কখনও হিন্দুস্তানে যাইনি। কিন্তু তার পাশের দেশ আমাদের সুলতানের সালতানিয়ৎ কাবুলে একবার গিয়েছিলাম।
একদিন আমি সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়েছিলাম, হঠাৎ দেখি, একখানা বিরাট জাহাজ আসছে বন্দরের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে জাহাজখানা এসে নোঙর করলো। মালপত্র কি কি আছে দেখার জন্য আমি জাহাজে উঠে গেলাম। কাপ্তেন আমাকে এক এক করে সমস্ত সওদাপত্ব বের করে দেখালো। আমি সব পরীক্ষা করে দেখতে থাকলাম। কাপ্তেনকে জিজ্ঞেস করলাম, আর কিছু নাই? কাপ্তেন বলে, আছে। কিন্তু সে-সব সামান পত্রের মালিক জাহাজে নাই। তাই, পরের জিনিস, ওগুলো বিক্রি করতে পারবো না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন, তারা কোথায় গেছে?
কাপ্তেন বললো, পথের মধ্যে তারা জলে ডুবে গেছে। আল্লাহ জানেন, তাদের কে বেঁচে আছে অথবা কেউই বেঁচে নাই। যাইহোক, আমাদের দেশ বাগদাদে ফিরে গিয়ে তাদের ওয়ারিশের কাছে ফেরৎ দিয়ে দেব।
আমার সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। বুকের মধ্যে কাঁপতে থাকে। প্রশ্ন করি, তাদের কী কী নাম?
কাপ্তেন বলে, একজনের নাম সিন্দবাদ—
কাপ্তেন আর কি বললো আমি আর শুনতে পেলাম না। মাথাটা কেমন বৌ করে ঘুরে গেলো। কিন্তু একটুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে ভালো করে কাপ্তেনের দিকে লক্ষ্য করলাম। হাঁ, আমাদের জাহাজের সেই কাপ্তেনই বটে। আমি প্রায় চিৎকার করেই বললাম, আমি-আমিই সেই সিন্দবাদ। তিমি মাছের পিঠের উপর নেমেছিলাম আমরা। তারপর সে আড়মোড়া ভেঙ্গে গা ঝাড়া দিতেই কে কোথায় ছিটকে পড়েছিলাম। প্রায় সবাই জাহাজে উঠতে পেরেছিলো। কিন্তু আমি পারিনি। তিমিটা জলের তলায় তলিয়ে গেলো। আমি একটা কাঠের গুডি আঁকড়ে ধরে কোনওক্রমে প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছি।
তারপর কিভাবে কত কষ্ট করে এই দ্বীপে এসে পৌঁছেছি।–সবই সবিস্তারে বললাম তাকে।
—এখন আমি এখানকার সুলতান মিরজানের খুব পেয়ারের লোক। আমাকে তিনি জাহাজ পরিদর্শকের কাজে বহাল করেছেন।
এই সময় রাত্রি শেষ হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
দুশো চুরানব্বইতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :
আমার কথা শুনে কাপ্তেন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নাই। তিনিই একমাত্র সত্যি। কিন্তু সাহেব, তোমার মতো এতবড় মিথ্যেবাদী তো আমি জীবনে দেখিনি। নিজের চোখে আমি দেখেছি, যারা জাহাজে সময়মতো উঠে আসতে পারেনি। তারা সবাই সমুদ্রের নিচে তলিয়ে গেছে! আর তুমি কিনা বোঝাতে চাইছ, তুমি বেঁচে গেছ! গাঁজাখুরি গল্প মারবার আর জায়গা পেলে না?
আমি মুহূর্তের জন্য মুষড়ে পড়লাম। এ-কিন্তু-কিন্তু আমি যে সেই সিন্দবাদ তার প্রমাণ দিতে পারি। আপনাকে।
-কী প্রমাণ দেবে?
আমি বললাম, জাহাজে আমার যারা সহযাত্রী ছিলো তারা তো আছেন। তাদের সবাইকে এখানে ডাকুন। তাহলেই প্রমাণ হয়ে যাবে, আমি কে।
কাপ্তেন সওদাগরদের সকলকে বাইরে আসতে বলতেই তার সহযাত্রীরা বাইরে এসে আমাকে দেখা মাত্র জড়িয়ে ধরে হৈ-হৈ কাণ্ড বাধিয়ে তুললো। তাদের চোখে মুখে আনন্দ আর ধরে না।
কাপ্তেনকে আর কিছু বোঝাতে হলো না। সে নিজেই বুঝলো আমিই সেই সিন্দবাদ।
আমার সহযাত্রীরা বলে, আমরা তো ভেবেছিলাম তুমি কোথায় তলিয়ে গেছ। সামুদ্রিক জন্তু-জানোয়ারের ফলার হয়েছ। তা কি করে বাঁচলে ভাই?
আমি তখন আবার আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনী বললাম তাদের। তারা আসমানের দিকে দু-হাত তুলে খোদাতালার উদ্দেশে প্রণাম জানালো। এর থেকেই বোঝা যায়, দুনিয়াতে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোনও কিছু নাই। তা না হলে যে অবিশ্বাস্য কাহিনী শোনালে, তাকি কখনও সম্ভব হয়? এতো তোমার দ্বিতীয় জন্ম হয়েছে!
কাপ্তেন আমার যাবতীয় সওদাপত্র আমাকে বের করে দিলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম, যা যা ছিলো সবই যথাযথ ঠিক আছে।
বাজারে নিয়ে গিয়ে বেশিরভাগ সওদাই বেশ চড়া দামেই বেচলাম; সবচেয়ে বাহারী কয়েকটা জিনিস উপহার দিলাম সুলতান মিরজানকে।
আমাদের জাহাজ বন্দরে নোঙর করেছে শুনে সুলতান মিরজান আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন।—যাক এতদিনে আল্লাহ মুখ তুলে চাইলেন।
নানা ধরনের সুন্দর সুন্দর উপহার উপটৌকনে আমাকে ভরে দিলেন তিনি। এত জিনিস নিয়ে আমি কী করবো। আমার সহযাত্রীদের কাছে ভালো দামে বেচে দিলাম খানিকটা। সুলতান মিরজান যে আমাকে কতখানি ভালোবেসে ফেলেছিলেন তা বুঝলাম যেদিন আমি তার কাছে বিদায় নিতে গেলাম।
আমাদের জাহাজ ছাড়বে। এবং এই জাহাজেই আমি স্বদেশে ফিরে টম যাবো। সবই সুলতান জানতেন, তবু বিদায় বেলায় তাঁর চোখ ছলছল করে উঠেছিলো, কথা বলতে গলা ভারি হয়ে এসেছিলো।
আমিও বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম।–যাচ্ছি। অনেক সুখ স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি, জাঁহাপনা। জীবনে হয়তো আর দেখা হবে না। কিন্তু আমার স্মৃতির আকাশে চিরকাল ধ্রুব তারার মতো জুলবেন আপনি। সুলতান মিরজান আমার মাথায় হাত রাখলেন, বেটা, মায়া মহব্বৎ বহুৎ খারাপ চিজ! দিল-কলিজা বাবরা করে দেয়।
তারপর নিজের দেহ থেকে খুলে খুলে মহামূল্যবান সব সাজ-পোশাক, রত্নহার। আমার হাতে তুলে দিলেন।
—এই সব যখন দেখবে, আমাকে মনে পড়বে তোমার।
সে-গুলো আমি প্ৰাণে ধরে বিক্রি করে দিতে পারিনি। ঐ যে দেখ, এই ঘরেই সেগুলো সব সাজানো আছে। এখনও ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে যাই, ঐ সাজ-পোশাক, ঐ রত্নহার পরে তিনি যেন সেই সিংহাসনেই বসে আছেন। কিন্তু শুধু স্মৃতিটুকুই পড়ে আছে, ভার মুক্ত সে তো আজ নাই।
যথা সময়ে হাওয়া সাধ দিলো। পাল তুলে হাল খুলে আমরা জাহাজ ছেড়ে দিলাম।
একটানা অনেক দিন অনেক রাত্রি অতিবাহিত করার পর একদিন আমরা বসরা হয় এসে পৌঁছলাম। এবার মন নেচে উঠলো, বাগদাদ আর বেশি দূর নয়। বাঁধাছাদার তোড়জোড় পড়ে গেল। দু-এক দিনের মধ্যেই আমাদের জাহাজ বাগদাদের বন্দরে এসে ভিড়লো।
অনেক টাকা পয়সা মূল্যবান উপহার উপটৌকন সঙ্গে নিয়ে আমিবাড়ি এলাম। আত্মীয় পরিজনরা, অনেকদিন পরে আমাকে পেয়ে, খুশিতে ডগমগ হলো। দেখলাম, তারাও সবাই বহাল তবিয়াতে রয়েছে।
এরপর খুশিতে ভরে উঠলো আমার সংসার। দাসদাসী-বাদী সওদা-সামান-পত্ব কিনে এনেবাড়ি ভরে ফেললাম। আবার সেই, আমার বাবার আমলে যেমনটি ছিলো, আগের মতো ধনদৌলত-এ সমৃদ্ধ হয়ে উঠলো আমার ঘর।
আবার সব হারানো বন্ধুদের ফিরে পেলাম। আমার দারিদ্র্যের সঙ্গে সঙ্গে তারাও একদিন বিদায় নিয়েছিলো। মধুর সন্ধান পেয়ে আবার তারা গুন গুন করে জড়ো হতে থাকলো। খানাপিনা হাসি গানে মেতে উঠলাম আমি।
এই হলো আমার প্রথম সমুদ্র যাত্রার কাহিনী। এরপরে দ্বিতীয় অভিযানের বিচিত্র কাহিনী শোনাবো তোমাদের। তার আগে এসো, আমরা খানাপিনা সেরে নিই। সিন্দবাদ কুলিকেও বললো, তুমিও আমাদের সঙ্গে খাবে কিন্তু।
খানাপিনা শেষ হলে সিন্দবাদ নাবিক একশোটা স্বর্ণমুদ্রা সিন্দবাদ কুলির হাতে দিয়ে বললো, এটা রাখে। কাল সকলে আবার আসবে, আমার কাহিনী শোনাবো, কেমন?
সিন্দবাদ কুলি কুষ্ঠিতভাবে বলে, তা আসবো। কিন্তু এই মোহরগুলো কি জন্যে?
—তোমার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে আমি দিচ্ছি, নাও।
—আপনার ইনাম আমি মাথা পেতে নিলাম। ঠিক আছে, কাল সকলে আবার আসবো।
সেদিনের রাত্রিটা সুখ-স্বপ্নে কাটলো তার।
রাত্রির অন্ধকার কাটছে, শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
দু’শো পচানব্বইতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয় :
সকালে উঠে সিন্দবাদ কুলি সিন্দবাদ নাবিকের প্রাসাদে চলে আসে। তাকে দেখে বৃদ্ধ তো মহাখুশি —এসো, এসো, মিতা! তোমার জন্যেই বসে আছি। আরে, অত লজ্জা সঙ্কোচের কি আছে, এসো; আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে বসো দিকিনি। মনে কর না কেন, এ তোমার নিজের ঘর।
সিন্দবাদ কুলি বৃদ্ধের হাত জড়িয়ে ধরে চুম্বন করে।
বৃদ্ধ বলে, আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন।
কিছুক্ষণের মধ্যে অন্যান্য অভ্যাগতরাও এসে পড়লো। মেজ-এ থরে থরে সাজানো ছিলো সকালবেলার নাস্তা। বাঁদীরা গানবাজনা শুরু করে। সুমধুর সঙ্গীতের সুরে অবগাহন করতে করতে নাস্তাপর্ব সমাধা হয়।
তারপর এক সময় গানবাজনা থেমে যায়। কারো মুখে কোন শব্দ নাই। সকলেই প্রতীক্ষণ করছে, এবার বৃদ্ধ সিন্দবাদ তার কাহিনী শুরু করবে।
আলিফ লায়লা তয় ও চতুর্থ তম পর্ব চাই।।।