1 of 4

১.৪১ খুশ বাহার ও খুশ নাহারের কাহিনী

খুশ বাহার ও খুশ নাহারের কাহিনী

শাহরাজাদ একটানা বলতে বলতে কিছুটা বা ক্লান্ত। এক গেলাস শরবৎ খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলো। দুনিয়াজাদ লজ্জা জড়ানো কণ্ঠে বলে, দিদি, কি গল্পই তুমি শোনালে। সারা শরীর-এ আমার তুফান লেগে গিয়েছিলো। এ সব গল্প শুনলে কি নিজেকে ঠিক রাখা যায়, বলো? দিদি, এবার তুমি আল আল-দিন এর কাহিনীটা শোনাও!

শাহরাজাদ বললো, কিন্তু আলা অল-দিন তো একটা ছেলে! শাহরাজাদের কাহিনী তন্ময় হয়ে শুনেছে সুলতান শাহরিয়ার। শুনতে শুনতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।–কামার আল-জামানের সুখ-দুঃখের সায়রে। শাহরিয়ার বললো, সত্যিই শাহরাজাদ, তোমার কিসসা বলার কায়দা বড় অসাধারণ। বড় ভালো লেগেছে। আর একটা এই রকম গল্প শোনাও।

এই সময় রাত্ৰি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ বলে আজ আর সময় নাই, জাঁহাপনা, এবার বিশ্রাম করুন, কাল রাতে আবার নতুন কিস্‌সা শুরু করবো।

 

দুশো সাঁইত্রিশতম রজনীর দ্বিতীয় প্রহরে আবার সে শুরু করে :

কোনও এক সময়ে কুফা শহরে এক সওদাগর বাস করতো। তার নাম বাহার। যথাকলে শাদী করার এক সোল বাদে তার একটি পুত্র সন্তান হয়। আদর করে ছেলের সে নাম রাখলো, খুশ বাহার।

ছেলের জন্মের সাতদিন পরে বাহারবাদী বাজারে গেলো। উদ্দেশ্য-একটি কাজ-কাম করার জন্য বাঁদী কেনা। বিবির সদ্য বাচ্চা হয়েছে, তার সেবা যত্ন তথা ঘরের কাজ-কাম করানোর জন্য একটা লোক না হলে চলছে না। বাজারে ঢুকে সে পছন্দসই মেয়েছেলে খুঁজতে থাকে। নানা জাতের নানা বয়সের হরেক কিসিমের ছেলে-মেয়ে আনা হয় বিক্রী করতে। বাহার ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। দেখতে দেখতে একটা আধাবয়েসী মোটামুটি সুশ্ৰী মেয়েকে দেখে তার পছন্দ হয়। মেয়েটির পিঠে বাঁধা ছিলো একটা ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা মেয়ে! ওয়াদা হলো-যে তাকে কিনতে চাইবে ঐ বাচ্চা সুদ্ধই কিনতে হবে। দালালকে দাম জিজ্ঞেস করে বাহার। দালাল বলে, দরদরি নাই, বাচ্চা আর মেয়েটার জন্য পঞ্চাশ দিনার লাগবে।

বাহার বলে, ঠিক আছে, চুক্তিনামা তৈরি কর।

চুক্তিতে সই করে পঞ্চাশ দিনার দিয়ে মেয়ে আর মেয়ের মাকে ঘরে নিয়ে আসে সওদাগর।

বিবি দেখে খুশি হলো, কুণ্ঠিতভাবে বললো, কী দরকার ছিলো অতগুলো পয়সা খরচ করার। আমি তো আর রুগী হয়ে পড়িনি।আস্তে আস্তে আমিই সব কাজ চালিয়ে নিতে পারতাম। শুধু শুধু ফালতু একটা খরচের ফেরে পড়ার কী দরকার ছিলো।

সওদাগর বলে, আসল কথা কি জান, বিবিজান, ঐ বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে বড় মায়া হলো। দেখ না, কী সুন্দর সুরৎ। ওর ওই টলটলে মুখ, ড্যাবড্যাবে চোখ দুটো দেখে আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না। বড় হলে কী অপূর্ব সুন্দরী হবে ভাবো। আমার খুশ বাহারের সঙ্গে মানাবে কেমন বলো? ওরা দুটিতে একসঙ্গে হেসে খেলে মানুষ হবে। তারপর সময়কালে ওদের শাদী দিয়ে দেব। ভালো হবে না?

-সে তো খুবই ভালো হবে। কিন্তু ভালো করে মানুষ করতে পারলে তবে তো!

বাহার বলে, সে আমার কোনও কষ্ট হবে না। ওজন্যে তুমি ভেবো না বিবিজান। বড় হলে মেয়েটা তামাম আরব পারস্য তুরস্কের মধ্যে সেরা হবে, তুমি দেখে নিও।

সওদাগর বিবি জিজ্ঞেস করলো, হ্যাঁ গা বাছা, তোমার নাম কী?

মেয়েটি নম্র কণ্ঠে জবাব দেয়, আমার নাম হাফিজা।

—বাঃ, বেশ নাম তো। তা তোমার মেয়েটার কী নাম?

মেয়েটি জবাব দেয়, নসীবা।

—চমৎকার। তোমার নাম হাফিজা আর তোমার মেয়ের নাম নসীবা! তোমরা আমার ঘরে এলে-আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার ঘরে মঙ্গলবাতি জ্বলতে থাকবে। আমাদের নসীব ফিরে যাবে-এই কামনা করি।

তারপর স্বামীর দিকে ফিরে বললো, কিন্তু ঘরে নতুন কোনও দাসী বাঁদী কিনে আনলে নামকরণ করতে হয়। আর সে নামকরণ ঘরের মালিকই করে। তাই ওদের পুরনো নামে তো চলবে না, নতুন নামকরণ করা তুমি।

সওদাগর বলে, না, তুমি ঘরের মালকিন, তুমিই নামকরণ কর।

—আমাকে যদি বলো আমি বাচ্চাটার নাম রাখবো, খুশ নাহার।

সওদাগর বলে, বাঃ চমৎকার, খুশ বাহার আর খুশ নাহার বেড়ে মিলিয়েছ তো!

খুশ বাহার আর খুশ নাহার একসঙ্গে মানুষ হতে থাকে। দিনে দিনে তারা বড় হয়। ঠিক যেন দুটি ফুটন্ত গুলাব। নাওয়া খাওয়া বেড়ান, খেলা-ধূলা সব সময়েই তারা এক আত্মা। লোকে দেখে বাহবা দেয়, কি সুন্দর দুই ভাই-বোন। খুশ বাহারও জানে খুশ নাহার তার বোন। ওদের মা বাবা কখনও দুটিকে আলাদা চোখে দেখে না।

খুশ বাহারের বয়স যখন পাঁচ, তার বাবা খুব ঘটা করে তার ছুন্নৎ করে দিলো। এই উৎসবে আত্মীয় বন্ধু পাড়াপাড়শীদের পেট পুরে ফলার খাওয়ালো সে। সবাই সবুজ পতাকা হাতে কুফা শহরের পথে পথে পরিক্রম করতে করতে সওদাগর সন্তানের শতায় কামনা করলো। একটা সুসজ্জিত খচ্চরের পিঠে বাদশাহী সাজে সাজানো হয়েছিলো। আর একটা খচ্চরে চেপে খুশ নাহার যাচ্ছিল তার পাশে পাশে। হাতে তার পাখা। খুশ বাহারকে সে হাওয়া করতে করতে চলছিলো। মেয়েদের উলুধ্বনি আর ছেলেদের আনন্দ উল্লাসে সেদিন সারা শহর উচ্চকিত হয়ে উঠেছিলো। রাস্তার দুধারে শতশত আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ভিড় করে দাঁড়িয়েছিলো এই ছুন্নৎমিছিল দেখার জন্য। সেদিন গর্বে বুক ফুলে উঠেছিলো সওদাগরের।

পথ পরিক্রমা শেষ করে আবার মিছিল ফিরে আসে সওদাগরের বাড়ির ফটকে। এবার যে যার মতো ঘরে ফিরে যায়! যাবার আগে সবাই কামনা করে সওদাগর সন্তানের সুখের জীবন।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

দুশো আটত্রিশতম রাত্রে আবার শুরু করে :

খুশ বাহারের বয়স যখন বার, তার বাবা একদিন বললো, বেটা, এবার তুমি বড় হয়েছ, এখন থেকে তুমি আর খুশ নাহারকে বোনের মতো দেখবে না। সে তোমার সহোদরা বোন নয়। আমাদের বাঁদী হাফিজার মেয়ে সে। কিন্তু বাদীর মেয়ে বলে তাকে তোমার চেয়ে কম আদরে মানুষ করা হয়নি। তার এখন দেহে যৌবন আসছে। আমরা ঠিক করেছি, তোমার বয়স কালে তার সঙ্গে তোমার শাদী দেব। তাই এখন থেকে তার সঙ্গে সহজভাবে মেলামেশা বন্ধ রাখতে হবে। খুশ নাহার বোরখা পরে পর্দানসিন হয়ে থাকবে।

সে রাতেই খুশ বাহার খুশ নাহারের সঙ্গে সহবাস করলো। এইভাবে আরও পাঁচটা বছর কেটে যায়। দিনে দিনে খুশ নাহারের দেহে যৌবনের ঢল নামে। সে-সময়ে কুফা শহরে তার মতো সুন্দরী মেয়ে আর একটাও ছিলো না। শুধু রূপসীই না, তার মতো নম্র বিনয়ী শিক্ষিতা মেয়ে খুব কমই দেখা যেত। অবসর সময়ে সে কেরান, সাহিত্য এবং নানা প্রকার বিজ্ঞান দর্শন পড়ে দিন কাটাতো। এছাড়া তার ছিলো গানের সাধনা। খুশ নাহারের মধুর সঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হোত সকলে।

খুশবাহার আর খুশ নাহার প্রতিদিন বাগিচায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিত। সেই নিরালা কুঞ্জবনে প্রাণ খুলে তারা মনের কথা বলতো। কখনও বা পুকুরের সান বাঁধানো সিডির ধাপে বসে তারা জল নিয়ে খেলা করতো। খিদে পেলে, সঙ্গে আনা তরমুজ, ভুট্টার খই, বাদাম পেস্তা খেত। বাগিচার গুলাব যুঁই-এর গন্ধে দুটি তরুণ হৃদয় মাতোয়ারা হয়ে উঠতো। বসন্তের ছোঁয়া লাগতো প্ৰাণে। অনর্গল আবৃত্তি করে কবির ভাষায় নিজেদের মনের ভােব ব্যক্ত করতো তারা। কখনও খুশ বাহার আব্দার ধরতো, এবার তোমার বেহালা শুনবো, সোনা।

এইভাবে তাদের প্রথম যৌবন-বসন্তের সুমধুর দিনগুলো প্রকৃতির শোভা দেখে আর গান গেয়ে গেয়ে কেটে যেতে থাকে।

কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন সুখ বেশি দিন কারো সয় না। আল্লাহ কারো ভাগ্যে বুঝি চিরকালের জন্য সুখ-ভোগ লিখে দেন না। তাই খুশবাহার আর খুশ নোহারের সুখের দিনও একদিন শেষ হয়ে যায়।

কুফার সুবাদার খুশ নাহারের রূপ আর গুণের কথা শুনে মনে মনে ঠিক করলো, এই পরমাসুন্দরী গুণবতী মেয়েটাকে যদি সে ভাগিয়ে এনে খলিফা আবদ-অল মালিক ইবন মারবানকে ভেট দিতে পারে তাহলে তার আখেরে অনেক উন্নতি হবে। একদিন সে এক বুড়িকে পাঠালো খুশ নাহারের কাছে। এই শয়তানী বুড়িটা মেয়ে পটানোর কাজে ওস্তাদ। সুবাদার বললো, দেখ বুড়ি, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।

—বলুন, হুজুর, কী-এমন কঠিন কাজ। জিন্দগীভর অনেক কঠিন কাজইতো দেখলাম। সবই আমার কাছে অতি সাধারণ মনে হয়েছে।

সুবাদার বলে, কিন্তু এবারের কাজটা অত সহজ নাও হতে পারে। সওদাগর বাহার-কে জান? খুব জানি, হুজুর।

—তার বাঁদী হাফিজার একটা পরমা সুন্দরী লেড়কী আছে—খুশ নাহার।

বুড়ি ঘাড় নাড়ে, তাও জানি হুজুর। কী আমার জানা নাই, তামাম কুফা শহরটা আমার নখ দর্পণে। কার ঘরে কি জিনিস আছে তা কি আমার জানতে বাকী আছে। খুশ নাহার যে খালি দেখতেই সুন্দরী তাই না, তার মতো নাচ গান লেখা পড়া জানা মেয়ে সারা তল্লাটে কোথাও খুঁজে পাবেন না, হুজুর।

সুবাদার বলে, বাঃ, তুমি তো সবই জান, দেখছি। ঠিক আছে এখন তোমার কাজ হলো, যেন তেন প্রকারে ঐ মেয়েটাকে আমার কাছে হাজির করতে হবে। আমি খলিফাকে ভেট দেব।

বুড়ি বলে, আর বলতে হবে না, হুজুর। আমি সব বুঝতে পেরেছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, কাজ আমি হাসিল করে দেবই।

পরদিন সকালে শয়তানীটা কিম্ভূতকিমাকার বেশে সাজলো। গায়ে চাপালো একটা মোট পশমের আলখাল্লা। গলায় পরলো একটা অজানুলম্বিত হাড়ের মালা। হাতে নিলো ইয়া বড় একখানা চিমটি। তারপর রওনা হলো সওদাগর বাহারের বাড়ির পথে।

বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে সে পাড়া কাঁপয়ে আওয়াজ তুললো, খোদা হাফেজ। আল্লাহ মেহেরবান। আল্লাহ ছাড়া কোনও গতি নাই।’ এই রকম নানা ধ্বনি তুলতে তুলতে সে এগোতে থাকে। রাস্তার দু-পাশে লোকজন জড়ো হতে লাগলো। সবারই কৌতূহল, হয়তো কোন পীর পয়গম্বর এসেছে, বাড়ির দরজা খুলে সবাই বেরিয়ে এলো। এইভাবে সে সওদাগরের বাড়ির দরজার সামনে এসে থামে। মুখে তখনও বলে চলেছে, খোদা হাফেজ, খোদা মেহেরবান।

সওদাগরের ছেলে খুশ বাহার বেরিয়ে এসে দেখলো, এক ধর্মাত্মা বৃদ্ধা তার দরজায় দাঁড়িয়ে পড়েছে।

—আপনি কী চান বুড়ি মা?

নামাজটা সেরে নিতে চাই।

—এতো খুবই আনন্দের কথা বুড়িমা? আসুন ভিতরে আসুন। হাত-মুখ ধুয়ে রুজু করে নিন। আমি আপনার নামাজের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

বুড়িটাকে সঙ্গে করে খুশ বাহার বাড়ির অন্দরে নিয়ে আসে। খুশ নাহারের ঘরে এনে বসায়। বুড়ি খুশ নাহারকে দেখে হাসে—আশীর্বাদের ঢংএ হাত তুলে বলে, খোদা তোমার ভালো করবেন, বেটি।

খুশ নাহার বুড়িকে দেখে শ্রদ্ধাবনতা হয়ে বলে, আপনি একটু জিরিয়ে নিন বুড়ি মা। আমি আপনার শোবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

—না মা, থাক। এখন নামাজের সময়, আগে নামাজ সারাতে দাও আমাকে।

আর কথাটি না বলে—শয়তানীটা মক্কার দিকে মুখ করে হাঁটু গেড়ে বসে ঢিব ঢিব করে মাটিতে মাথা ঠুকতে লাগলো।

নামাজের ভন্ডামী শেষ হলো। বুড়ি যাবার নাম করে না। খুশ বাহার এবং খুশ নাহার ধর্মাত্মা বৃদ্ধার অবস্থানে খুশিই হয়। খুশ নাহার বলে, বুড়ি মা, আপনি আজকের দিনটা এখানেই বিশ্রাম করুন।

বুড়িটা বলে, মা, বিশ্রাম কাকে বলে আমি জানি না। সংসারের দুঃখ তাপে যারা কাতর তারাই বিশ্রাম চায়। কিন্তু আমি তার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছি। ক্লান্তি আমাকে ছুঁতে পারে না। একবার যে আল্লাহর পায়ে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে সে বেহেস্তের আনন্দ পায়।

বৃদ্ধার মুখে ধৰ্মকথা শুনে নাহার মুগ্ধ হয়।—আমাদের ইচ্ছা আজ রাতে আপনি আমাদের সঙ্গে একটু কিছু খানা পিনা করুন।

–কিন্তু মা, তা তো হবে না। আমি তো এখন রোজা করছি। রোজা করলে আত্মার শুদ্ধি হয়। তুমি তোমার স্বামীকে নিয়ে খানা পিনা কর, আমি দেখেই আনন্দ পাবো।

আল্লার পয়গম্বর এসেছেন। তুমি তাকে আদর যত্ন করে এখানেই রেখে দাও। আমাদের মঙ্গল হবে।

খুশ বাহার বললো, সে কথা আমি আগেই ভেবেছি নাহার। তার জন্যে—ঐ পাশের ঘরটায় সব বন্দোবস্ত করে রেখেছি। তার থাকা খাওয়া, নামাজের যাতে কোনও রকম অসুবিধে না হয়। তার সব ব্যবস্থাই আমি করেছি। সে-ঘরে কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারবে না-সেদিকে আমি নজর রাখবো।

সারারাত ধরে বুড়িটা নামাজের ভণ্ডামী করে আর তারস্বরে কোরান পড়ে কাটালো। খুব সকালে হাতমুখ ধুয়ে খুশ বাহারকে সে বললো, এবার তা হলে চলি, বাবা। আল্লাহ তোমাদের ভালো করবেন।

খুশ নাহার বললো, কিন্তু বুড়ি মা, আপনি এই ভাবে আমাদের ফেলে চলে যাবেন? আমরা চেয়েছিলাম, আমাদের এই গরীব খানাতেই বরাবরের জন্য থাকুন। আপনাকে পেয়ে আমরা বড় খুশি হয়েছি। সেই জন্যে আমাদের সব চাইতে ভালো ঘরখানা আপনার থাকার উপযোগী করে সাজিয়ে গুজিয়ে দিয়েছি। আমাদের প্রার্থনা মঞ্জর করুন বুড়ি মা। আপনি এখানেই থাকুন।

—আল্লাহর দেয়া সব সময়েই তোমরা পাবে বাছা। আদৎ মুসলমানের প্রকৃত গুণের অধিকারী হয়েছ তোমরা। দয়া ধর্মই তোমাদের অন্তর জুড়ে আছে, আমি তা বুঝতে পেরেছি। সেই জন্যেই আমি তোমাদের আশ্রয় গ্রহণ করেছিলাম। এর পরে যখন আসবো, তোমাদের আশ্রয়েই উঠবো! কিন্তু এখন আমাকে যেতে হবে। কুফার ধর্মস্থান গুলো ঘুরে ঘুরে দেখবো। তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো বাছা। আমি সদাই তোমাদের ভালোর জন্যে তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাবো। সব দরগা মসজিদগুলো দেখা শেষ হলে আবার আমি তোমাদের আশ্রয়েই ফিরে আসবো। কিন্তু এখন আমাকে যেতে দাও, বাছা।

হায় রে বোকা মেয়ে খুশ নাহার, তুমি চিনতে পারলে না। এই শয়তানীকে। বুঝতে পারলে না। তার বদমাইশী? সে যে তোমার সর্বনাশ করার ফিকিরে ঘুরছে। তোমাদের সুখের সংসার সে ছারখার করতে এসেছে। কিন্তু তুমি সরল মেয়ে, কি করে বুঝবে এই কুটিলতা! আর তাছাড়া তোমার নসীবের লেখাই বা তুমি এড়াবে কি করে? কোনও মানুষই তার অজ্ঞাত ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না।

শয়তান বুড়িটা সোজা সুবাদারের কাছে আসে। বুড়িকে দেখে সুবাদারের চোখ নেচে ওঠে, কি গো, খবর কী? ভালো তো?

বুড়ি বলে, খবর খারাপ হবে কেন হুজুর?

–তা কি রকম দেখলে, মাল কেমন?

—আহা, কি করে তার আমন রূপের বর্ণনা দিই। এমন রূপসী মেয়ে এর আগে কখনও দেখিনি, হুজুর। যেন একেবারে বেহেস্তের ডানা কাটা হুরী।

সুবাদার আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, ইয়া আল্লাহ। তারপর বলো, বলো বুড়ি। আর কি দেখলে?

—তার সুরেলা কষ্ঠের কথা যদি একবার শুনতেন, হুজুর, একেবারে মধু-ঢালা। কথা তো নয়, যেন ঝরনার কলকল আওয়াজ। আর কী তার হরিণীর মতো কাজল কালো আনত চোখ!

সুবাদার বলে, বহুৎ আচ্ছা, তোমাকে তো বলেছি বুড়ি, খলিফাকে ভেট দেব, যেমন করেই পোর তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আনতেই হবে।

বুড়ি বলে, কাজ আমি হাসিল করে দেব, হুজুর। কিন্তু মাসখানেক সময় লাগবে। হুট করে। বললেই তো আর তাকে ঘরের বাইরে আনতে পারি না। তার জন্যে নিত্যি আমাকে সেখানে যাতায়াত করতে হবে। আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে মেলামেশা করতে হবে। আমাকে তারা যথেষ্টই শ্রদ্ধাভক্তি দেখিয়েছে। তবুও সেটা আরও দাঁড় করতে হবে। তাদের মনে বিশ্বাস জন্মাতে হবে যাতে খুশ নাহার আমার সঙ্গে বাইরে বেরুতে কোনও রকম ইতস্ততঃ না করে।

সুবাদার বললো, তা ঠিক। তাড়াহুড়া করতে গেলে গোটা ব্যাপারটাই হয়তো কেঁচে যেতে পারে। এই নাও, হাজার খানেক দিনার রাখে। কাজ হয়ে গেলে আরও দেবো।

দিনারগুলো কোমরে বেঁধে বুড়িটা বলে, যাই, আর দেরি করবো না।

প্রতিদিন সে খুশ বাহারেরবাড়ি যায়। নামাজের ভড়ং করে। কোরান পাঠের ঢং করে। বড় বড় বুলি আওড়ায়। বাণী দেয়। এই ভাবে গোটা একটা মাস কেটে যায়। বুড়িটা একদিন নাহারকে বললো, কৃফার সুবাদারকে জান, মা? আল্লাহর পয়গম্বর-অমান পুণ্যাত্ম মহাপুরুষ জন্মায় না। তাঁর কাছে দুদণ্ড বসলে জীবন জুড়িয়ে যায়। আল্লাহর গুণগানে তিনি সদাই ব্যাকুল। তাঁকে দেখার জন্য কত দূর দেশ থেকে মানুষজন আসছে। তুমি যদি চাও মা, আমি তোমাকে তাঁর দর্শন করিয়ে আসতে পারি। একবার তার দেয়া পেলে, জীবনে অনেক শান্তি পাবে।

খুশ নাহার বলে, কিন্তু আমার স্বামী এখন ঘরে নাই। তাকে না বলে যাই কি করে। সে ফিরে আসুক, তার কাছ থেকে মত নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে যাবো, বুড়ি মা।

শয়তান বুড়ি বলে, তোমার শাশুডিকে বলে চলো, তাহলেই হবে। তাছাড়া, এই তো যাবো আর আসবো। আমরা তো সেখানে বসবো না। শুধু একবার দর্শন করেই চলে আসবো। তোমার স্বামী ফেরার আগেই আমরা আবার ফিরে আসবো।

খুশ নাহার শাশুডির কাছে গিয়ে বলে, মা, এখানকার সুবাদার নাকি আল্লাহর পয়গম্বর। তাকে দেখার জন্যে সারা দেশের লোক ভেঙ্গে পড়েছে। বুড়ি মা আমাকে দর্শন করাতে নিয়ে যেতে চান। আপনি যদি মত করেন। তবে যেতে পারি।

—কিন্তু বাছা, খুশবাহার বাড়িতে নাই। সে যদি ফিরে এসে দেখে তুমি ঘরে নাই, বড় আঘাত পাবে। তার চেয়ে বরং অপেক্ষা কর-সে। আসুক তার মত নিয়েই যাওয়া ভালো।

শয়তান বুড়িটা এগিয়ে এসে বলে, তুমি মা নিশ্চিন্ত থাক, ওর স্বামী ফেরার অনেক আগেই তাকে ফিরিয়ে দিয়ে যাবো।

খুশ বাহারের মা আর আপত্তি করতে পারে না-ঠিক আছে যাও। বেশি দেরি করো না। সকাল-সকাল ফিরে এসো।

খুশ নাহারকে সঙ্গে নিয়ে বুড়িটা সুবাদারের প্রাসাদ সন্নিহিত নিরালা বাগিচার একপ্রান্তে এসে দাঁড়ায়। বুড়িটা বলে, তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি আসছি।

হন হন করে সে প্রাসাদের অন্দরে ঢুকে সুবাদারকে খবর দেয়, মাল হাজির, হুজুর।

সুবাদার বাইরে এসে নাহারকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে। মনে মনে সে তার একটা ছবি এঁকেছিলো। কিন্তু সে কল্পচিত্রের সঙ্গে এ মেয়ের রূপের জৌলুসের অনেক ফারাক। এ যেন কল্পলোকের হুরী।

এই সময় রাত্রির অবসান হয়। শাহরাজাদ চুপ করে বসে থাকে।

 

দুশো একচল্লিশতম রজনী :

আবার সে শুরু করে। খুশ নাহার বদখদ চেহারার এই লোকটাকে এগিয়ে আসতে দেখে তাড়াতাডি নাকাবে মুখ ঢেকে জড়সড় হয়ে পড়ে। সেই বুড়িটা কিন্তু আর ফিরে আসে না। ধীরে ধীরে তার সামনে সব পরিষ্কার হয়ে ওঠে। শয়তান বুড়িটা তাকে ধোঁকা দিয়ে তুলিয়ে এনেছে এই বাঘের খাঁচায়। এখান থেকে তো পালাবার আর পথ নাই। কান্নায় কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে তার।

সুবাদার-এর চোখ খুশিতে নেচে ওঠে। নাহারকে বলে, ভিতরে এসো।

কলের পুতুলের মতো নাহার প্রাসাদের অন্দরে যায়। সুবাদার কাগজ কলম নিয়ে খলিফা আবদ-আল মালিক ইবন মারবানকে একখানা চিঠি লেখে। প্রহরীদের প্রধান সর্দারকে ডেকে বলে, এই লেড়কীকে দামাসকাসে খলিফার কাছে নিয়ে যেতে হবে। এই নাও খৎ, তাক দিয়ে বলবে, আমি পাঠিয়েছি।

—জো হুকুম হুজুর।

সর্দার সেলাম ঠুকে নাহারকে নিয়ে চলে যায়। জোর জবরদস্তি করে ঘোড়ার পিঠে চাপায়। সামনে পিছে আরও ছ’জন জাঁদরেল ঘোড়সওয়ার চলে পাহারায়।

সারাটা পথ নীরবে চোখের জল ফেলতে থাকে নাহার। দামাসকাসে পৌঁছে প্রহরী সর্দার চিঠিখানা আর নাহারকে জমা করে দেয় খলিফার একান্ত সচিবের হাতে। সচিবের কাছ থেকে রসিদ নিয়ে আবার সে ফিরে যায় কৃফায়।

পরদিন সকালে খলিফা হারেমে আসে। বেগম আর বোনকে বলে, কুফার সুবাদার একটি খুবসুরৎ বাঁদী পাঠিয়েছে। সে এক সওদাগরের কাছ থেকে কিনেছে আমার জন্য। দূর দেশের কোন এক সুলতানের নাকি মেয়ে।

বেগম উচ্ছসিত কষ্ঠে বলে, খোদা আপনাকে আনন্দে রাখুন। কী নাম তার? দেখতে কেমন? কালো না ফর্সা?

খলিফা বললো, আমি এখনও তাকে চোখে দেখিনি।

খলিফার বোনের নাম দাঁহিয়া। বললো, কোথায় তাকে রাখা হয়েছে, দাদা? চলো তো গিয়ে দেখি, কেমন সে সুন্দরী।

প্রাসাদেরই একটা কামরায় নাহারকে তোলা হয়েছে। দহিয়া দেখলো, মেয়েটি বয়সে কচি, সত্যিই অপরূপ সুন্দরী। পথের ধাকলে সে বড় কাহিল হয়ে পড়েছে। দারুণ গ্ৰীষ্মের খরতাপে চোখমুখ ঝলসে তামাটে হয়ে গেছে। পালঙ্কের এক পাশে বসে অঝোের নয়নে কাঁদছিলো। দাহিয়া অবাক হয়। কাছে এগিয়ে আসে। নাহারের মাথায় হাত রেখে বলে, কাঁদছো কেন বোন? কেউ তোমাকে তাকলিফ দিয়েছে?

নাহার কথা বলে না, শুধু ঘাড় নেড়ে জানায়-না।

তবে কান্নার কী আছে। জান তুমি এখন কোথায় এসেছ?

নাহার এবারও ঘাড় নেড়ে জানায়—হ্যাঁ সে জানে।

দাহিয়া আরও অবাক হয়, তুমি এখন খলিফার পিয়ারের বাঁদী হতে চলেছি। যে-কোনও মেয়ের কাছে এটা কত সৌভাগ্যের ব্যাপার। আর তুমি কাঁদছো? কেন, কীসের দুঃখ তোমার? এখানে তুমি যে রকম সুখ বিলাসের মধ্যে থাকবে তা পেলে যে কোনও মেয়েই বর্তে যায়। আমি বুঝতে পারছিনা বোন, কেন তুমি কাঁদছো? এই ভাগ্য হলে অন্য যে কোনও সুন্দরী মেয়েরই মুখে হাসির খৈ ফুটতো।

এবার খুশ নাহার তার আয়ত চোখ মেলে তাকায়। —মালকিন, এ শহরটার নাম কী?

দহিয়া বলে, দামাসকাস। কেন, সওদাগর তোমাকে বলেনি, কোথায় কার বাঁদী করে। তোমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? খলিফা আবদ-আল মলিক-ইবন মারবানের ভোগবিলাসের জন্য তোমাকে কেনা হয়েছে—সে কথা তো তোমাকে তার জানানো উচিত ছিলো! এখন তুমি আমার বড় ভাই খলিফার সম্পত্তি। উচিৎ দাম দিয়ে তোমাকে কেনা হয়েছে। সুতরাং চোখের জল মোছ বোন। কী করে খলিফার মুখে হাসি ফোটাতে পারবে–সেই হবে তোমার একমাত্র কাজ। তোমার নাম কী–?

—বাড়িতে আমাকে সবাই খুশ নাহার বলে ডাকে।

এই সময়ে খলিফা ঘরে ঢুকলো। সঙ্গে সঙ্গে নাহার নাকাবে মুখ ঢাকে। হাসি মুখে সে নাকাবের পাশে এগিয়ে এসে বললো, আহা, লজ্জা কেন, নাকাবি তোলো, তোমার সুরৎ দেখবো বলেই তো এলাম।

কিন্তু নাকাব সরানো দূরে থাক। বোরখাখানা আরো টেনেন্টুনে নিজেকে আরও গুটিয়ে নিল নাহার।

খলিফা রুষ্ট হলো না, বরং উচ্চৈস্বরে হো হো করে হেসে উঠলো। বোনের দিকে তাকিয়ে বললো, লেড়কীকে তোমার হেপাজতে রেখে যাচ্ছি বোন। দিন কয়েকের মধ্যে ঠিক মতো তালিম দিয়ে একে তৈরি করে দেবে। এই রকম জবুথবু হয়ে থাকলে তো চলবে না।

খলিফা আর একবার বোরখায় জড়ানো পাকানো নোহারের দেহটা লক্ষ্য করে। কিন্তু শুধুমাত্র তার শশাঙ্ক শুভ্র হাতের দু-খানা কব্জী ছাড়া আর কিছুই নজরে আসে না। দেখতে না পাওয়ার অদম্য কৌতূহল বুকের মধ্যে দাপাদাপি করতে থাকে। মনের যন্ত্রণা মনেই চেপে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় খলিফা।

দাহিয়া নাহারকে সঙ্গে করে হামামে নিয়ে যায়। ভালো করে ঘষে মেজে তাকে গোসল করতে বলে।

স্নান সমাপন করে যখন সে দামী সাজ পোশাকে সেজে গুজে বাইরে আসে দাঁহিয়ার দেখে তাক লেগে যায়। আহা মারি মরিা-একি রূপ! যেন আশমানের বিজলী বাধা পড়ে গেছে ধরায়।

নাহারের গলায়, কানে, মাথায় মুক্ত হীরা চুনী পান্নার জড়োয়া গহনা ঝলমল করতে থাকে। পাতলা ফিনফিনে হালকা পোশাকের তলায় চাপার কলির মতো তার নিরুত্তাপ শরীরের স্বৰ্ণাভা যে কোনও পুরুষের বুকে তুফান তুলতে পারে। দাহিয়া মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে নাহারকে দেখতে থাকে।

এমন সুন্দর সাজ পোশাকে সেজে দামী দামী অলঙ্কার পরেও কিন্তু নাহারের মুখে হাসি ফোটে না। বরং কান্না আরো বেড়ে যায়। চোখের জলে বুক ভাসতে থাকে। দাঁহিয়ার মনে সন্দেহ জাগে। এই কান্নার কোনও হদিশ করতে পারে না সে।

ঘরের নিরালা কোণে বসে নাহার তার অদৃষ্টের কথা ভাবে। নিজের নীড়ে এতকাল সুখের সায়রে ডুবে ছিলো সে। কিন্তু বিধাতা বুঝি তার এত সুখ সহ্য করতে পারলেন না। নাহার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। না জানি তার নসীবে কি লেখা আছে। খুশ বাহারের জন্য তার মনটা পুড়ে যেতে থাকে। দিন রাত শুধু তার সোহাগ ভরা চাঁদের মতো মুখখানাই ভেসে ওঠে তার চোখের সামনে। খানা পিনা বন্ধ করে নিঃসঙ্গ ঘরে সে দিন কটায়। চিন্তা জীয়ন্ত মানুষকে দহন করে। খুশ নাহার শয্যা আশ্রয় করে, দিনে দিনে তার শরীর অবসন্ন হতে থাকে। প্রথমে ঘুস ঘুসে কিন্তু কয়েকদিন পর হাড় কাঁপয়ে জ্বর এলো তার। সারা দামাসকাসের নামজাদা হেকিমকে ডাকা হলো। পুরোদমে চিকিৎসা পত্র চলতে থাকলো। কিন্তু জ্বর আর ছাড়ে না।

এদিকে সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে খুশ বাহার এ ঘর ও ঘর খুঁজতে থাকে-নাহার গেলো কোথায়। নাহার-নাহার বলে দু তিন বার ডাকে। কিন্তু কেউ সাড়া দেয় না। খুশ বাহার ভাবে নাহার বোধ হয় তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় মেতেছে। আবার ডাকে, নাহার সোনা, কোথায় লুকিয়ে আছে, বেরিয়ে এসো, মানিক।

কিন্তু সাত রাজার ধন মানিক তখন ঘরে থাকলে তো সাড়া দেবে! খুশ বাহারের আর ধৈর্য মানে না। মা-এর কাছে ছুটে যায়, মা-মাগো নাহার কোথায়?

মা এতক্ষণ একলা ঘরে বসে প্রাণপণে কান্না চাপার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আর সে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। হাউমাউ করে কাঁদতেকাঁদতে  বলে, এখন খোদাই একমাত্র ভরসা বাছা, তাকে বোধ হয়। আর ফিরে পাবো না। রোজাকার মতো সেই বুড়িটা আজও এসেছিলো। নাহারকে সঙ্গে নিয়ে সে সুবাদারের কাছে গেছে। যাবে আর ফিরে আসবে এই ওয়াদা করে সে নাহারকে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। সে ফিরলো না। সেই থেকে আমি তোর অপেক্ষায় বসে আছি, বাবা। যা একবার গিয়ে খোঁজ কর। বুড়িটা কোথায় নিয়ে গেলো তাকে কিছুই বুঝতে পারছিনা।

খুশ বাহার আর তিলমাত্র অপেক্ষা করে না। প্রায় দৌড়তে দীেড়তে গিয়ে পৌঁছায় সুবাদারের প্রাসাদে। কোনও রকম আদব কায়দা না দেখিয়ে সে সোজা সুবাদার-এর সামনে এসে বলে, আমার নাহার কোথায়? কোথায় সেই বুড়ি?

—নাহার? বুড়ি? তারা কে? এখানে আসবে কেন?

খুস বাহার আরও গলা চড়িয়ে বলে, নাহার আমার বিবি। আর বুড়িটাকে ভেবেছিলাম আমরা সাধুসন্ত মানুষ! পরাণে মোটা পশমের আলখাল্লা আছে। গলায় একটা হাড়ের মালা, আর হাতে একখানা মস্ত বড় চিমটি আছে তার। আপনার কাছে আসবে বলে সে আমার বিবিকে নিয়ে বেরিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, ঐ পীরের ছদ্মবেশে বুড়িটা মহা শয়তান।

সুবাদার যেন আকাশ থেকে পড়ে, তাই নাকি! আহা-হা রে, ঐ সব শয়তান বদমাইশদের বাড়ির অন্দরে ঢুকতে দিতে আছে কখনও?

—আপনি দেখলে আপনার মনেও ভক্তি আসবে। এমনি তার সাজের ভড়ং। প্রহরে প্রহরে নামাজ পড়ে। কোরান-এর পাতা থেকে মুখ তোলেনা। যেন সাক্ষাৎ আল্লাহর পয়গম্বর।

সুবাদার বলে, তোমার বাবা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু লোক। আমার পক্ষে যতখানি করা সম্ভব আমি নিশ্চয়ই করবো। তুমি এক কাজ কর বাবা, আমার কোতোয়ালের সঙ্গে দেখা করে সব খুলে বলো তাকে। সে নিশ্চয়ই খুঁজে বের করে দেবে তোমার বিবিকে। আর ঐ বুড়িটাকে পেলে আমার কাছে নিয়ে আসতে বলবে। কি করে ধোলাই দিতে হয় আমি বুঝিয়ে দেব তাকে হাড়ে হাড়ে।

খুশ বাহার কোতোয়ালের কাছে যায়। তখন সে ইয়ার বক্সী নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে মৌজ করে চরস টানছিলো। হঠাৎ এই অসময়ে আচমকা ঘরের ভিতরে খুশ বাহারকে ঢুকতে দেখে ভক্ত দুটো কপালে তুলে কোতোয়াল প্রশ্ন করে, কী চাই?

খুশ বাহার বলে, আজ সকালে আমারবাড়ি থেকে আমার বিবিকে ভুলিয়ে নিয়ে গেছে একটা বুড়ি।

বুড়িটার চেহারা এবং বেশভূষায় যথাসাধ্য বর্ণনা দিতে চেষ্টা করলো সে।

কোতোয়াল ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বলে, তাতো বুঝলাম। তারা গেছে কোন পথে?

—বুড়িটা বলে গেছে, সে সুবাদারের প্রাসাদেই তাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু সুবাদার সাহেব বললেন, ধাপ্লাবাজরা কখনও সত্যি কথা বলে না।

কোতোয়াল বললো, তা হলে, এই এতবড় শহরটায় কোথায় খুঁজবো তাদের? আমাকে যদি নিশানা বলে দিতে পার, আমি সেই মতো লোক পাঠাতে পারি।

–নিশানা কি করে বলবো আমি। আমি তো জানিনা কোন পথে তাকে নিয়ে গেছে সে।

—তবে? আমিই বা জানবো কি করে? আমি তো আর হাত গুণতে জানিনা। যাদুবিদ্যাও আমার জানা নাই। যাও, এখন আর বিরক্ত করো না।

খুশ বাহার সুবাদারের কাছে এসে নালিশ জানায়, কোতোয়াল আমার কথা গ্রাহ্য করলো না, হুজুর। আমি বললাম, আপনি নিজে পাঠিয়েছেন আমাকে। তাতেও তার কোনও ভাব বৈলক্ষণ্য দেখা গেলো না। আমার কথা শুনে সে কি কথা বলে জানেন? আমি তো আর যাদু জানিনা যে মন্ত্রবলে তোমার বিবিকে উদ্ধার করে দেবো।

সুবাদার নকল গান্তীর্য মুখে টেনে বলে, হুম! দাঁড়াও, মজা দেখাচ্ছি। এই-কে আছিস, কোতোয়ালকে ডেকে নিয়ে আয়—এক্ষুণি।

সুবাদার গলাটা বেশ চড়িয়ে বলতে থাকে, শোনো কোতোয়াল, দেশের লোকের ধন সম্পত্তি রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। তুরি, ছিনতাই, রাহাজনী ধাপ্লাবাজি বন্ধ করার দায় তোমার। আমার দোস্ত সওদাগর বাহারের ছেলে। আজ সকালে একটা শয়তান বুড়ি এর বিবিকে ভুলিয়ে কোথায় নিয়ে গেছে। যেমন করেই হোক, তাদের খুঁজে বার করতেই হবে। আমার শহরে এই সব ইখ্যুতানী আমি কিছুতেই বরদাস্ত করবো না। তুমি আর দেরি করে না। দিকে দিকে ঘোড়সওয়ার পাঠাও। প্রতিটি সম্ভাব্য জায়গা তল্লাসী করে দেখা। আমার শহরের সব ঘোঁচ ঘাঁচ তো তোমার অজানা নাই-ধূর্ত শয়তানরা সেই সব গর্তের কোথাও না কোথাও লুকিয়ে থাকে। যদি সে এই শহরের মধ্যেই গা ঢাকা দিয়ে থাকে। তবে তোমার পক্ষে টেনে বের করা আদৌ অসম্ভব হবে না। কিন্তু সে-যদি শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চালান হয়ে যায় তা হলে তোমার করার কিছুই থাকবে না। যাই হোক, আর দেরি না করে চারদিকে লোক পাঠাও।

কোতোয়াল এতক্ষণ ঠিক বুঝতে পারছিলো না, সুবাদার সাহাব এ সব কি বলছেন! সে লেড়কী তো দামাসকাসের পথে চালান হয়ে গেছে। সুবাদার খুশ বাহারের অলক্ষ্যে কোতোয়ালকে ইশারা করে জানালো, ওসব কথায় কান দিও না। বলতে হয় বললাম। এবার কোতোয়াল ধাতস্থ হয়। সুবাদারের চালটা ধরতে পারে।

—ঠিক আছে, হুজুর, আপনি কিছু ভাববেন না হুজুর। শহরের যে গর্তেই তারা থাকুক টেনে বের করবোই। কিন্তু শহর ছেড়ে অন্য কোথাও সরিয়ে দিলে আমার কোনও হাত থাকবে না।

সুবাদার সাত্মনা দিয়ে বললো, তুমিবাড়ি যাও, বাবা। যা করার আমরা করছি। নসীব যদি সাধ দেয়। তবে তোমার বিবিকে ঠিকই ফিরে পাবে। তা না হলে খোদার নাম জপ কর।

রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

দুশো বিয়াল্লিশতম রাত্রে আবার সে শুরু করে :

খুশ বাহার বিষণ্ণ মনেবাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারে না। সারা রাত ধরে কুফার পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। যদি কোথাও নাহারের সন্ধান মেলে।

পরদিন সকালেবাড়ি ফিরে এসে শয্যা নেয়। দারুণ কাঁপয়ে জ্বর আসে। এক দিন দুই দিন—এই ভাবে অনেক কয়দিন কেটে যায়। জ্বর ক্রমশই বাড়তে থাকে। অনেক হেকিম বন্দ্যিকে ডাকা হলো। কিন্তু কেউই কিছু করতে পারলো না। সবাই বলে, এ রোগের একটাই দাওয়াই। বিবি ফিরে এলেই রোগ সেরে যাবে।

এই সময় কুফায় এক পারসী-সাহেব এলেন। তিনি রসায়ন এবং আয়ুৰ্বেদ শাস্ত্ৰে মহাপণ্ডিত। সওদাগর তার নামযশ শুনে ডেকে এনে ছেলেকে দেখালো। বললো, এই আমার এক মাত্র পুত্র, একে যদি আপনি সুস্থ করে তুলতে পারেন হেকিম সাহেব, আপনাকে আমি দু-হাত ভরে ইনাম দেব—যা চাইবেন তাই দেব। শুধু আমার বুকের কলিজা, আমার চোখের মনিকে সারিয়ে তুলুন।

পারসী সাহেব কোনও উচ্চবাচ্য করলেন না। গভীর ভাবে খুশ বাহারের নাড়ী পরীক্ষা করতে লাগলেন। একটু পরে স্মিত হেসে সওদাগরকে বললেন, অসুখ ওর দেহে নয়, অসুখ ওর দিল-এ। এবং কোনও আপনজনের বিরহেই তা ঘটেছে। ঠিক আছে, আমি মন্ত্রবলে জেনে নিচ্ছি, এখন সে কোথায় অবস্থান করছে।

এই বলে সেই পারসী-সাহেব মেঝের উপরে বসে সামনে কিছুটা বালি ছড়িয়ে দিলেন। বালির মাঝখানে সাজিয়ে দিলেন পাঁচখানা সাদা পাথরের নুডি, আর তিন খানা কালো পাথরের নুডি, দু’খানা কাঠি। আর একটা বাঘের মাথা। বেশ অনেকক্ষণ ধরে এইগুলো সাজাতে সাজাতে তিনি পারসী ভাষায় কি সব মন্ত্র তন্ত্র আওড়াতে থাকলেন। আরপর বললেন, আপনারা যারা এখানে হাজির আছেন, সবাই মন দিয়ে শুনুন, যার বিরহে এই ছেলে কাতর, তাকে পাওয়া যাবে। বসরা হয়-…না না, হলো না, হলো না। এই তিনটি নদীই আমার সব গোলমাল করে দিচ্ছে। হ্যাঁ হয়েছে—তাকে পাওয়া যাবে দামাসকাসের—সুলতানের প্রাসাদে। এবং তারও এই একই অবস্থা। সে-ও অসুখে শয্যাগত হয়ে আজ অনেকদিন।

সওদাগর আকুলভাবে জিজ্ঞেস করে, তাহলে কি উপায় হবে সাহেব? আপনি ছাড়া তো এর কোনও সুরাহার পথ জানা নাই আমার। মেহেরবানী করে আপনি না বাঁচালে ওরা কেউ বাঁচবে না, আমিও মরে যারো। আপনি যা চান, আমি দেব সাহেব। আপনি আমার ছেলেকে

পারসী সাহেব বলে, ধৈর্য ধরুন, শান্ত হোন। অধীর হলে চলবে না। তাড়াহুড়ার কাজ নয়। এটা। তবে আমি কথা দিচ্ছি, ওদের দুজনের মিলন ঘটিয়ে দেব! এখন আপনি আমাকে মাত্র চার হাজার দিনার দিন। তারপরে কাজ সমাধা হয়ে গেলে আপনার যা প্ৰাণ চায় দেবেন।

সওদাগর তৎক্ষণাৎ পাঁচ হাজার স্বর্ণমুদ্রা এনে পরসী সাহেবের হাতে দিলো।

পারসী সাহেব বললেন, বাস বাস, এই যথেষ্ট। এখন আমি দামাসকাসের পথে রওনা হয়ে যাচ্ছি। আপনার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যাবো। আল্লাহার কৃপায় আপনার ছেলের বিবিকে সঙ্গে নিয়েই ফিরবো।

তারপর তিনি খুশ বাহার-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, কি গো বাছা, তোমার নাম কী?

—খুশ বাহার।

–ঠিক আছে, এবার উঠে পড় বাবা, তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। তোমার বিবিকে সঙ্গে নিয়ে আবার আমরা ফিরে আসবো।

পারসী সাহেবের ভরসায় দেহ মনের অবসাদ অনেকখানি কেটে যায় তার। সাহস করে উঠে বসে। বাড়ির সবাই বলে, আর ভাবনা কি, উনি যখন কথা দিচ্ছেন, নিশ্চয়ই তাকে ফিরে পাবে। খানাপিনা কর। হাসো, কথা বলো, দেখো, দেহ মনে জোর পাবে।

পারসী সাহেব বললেন, আমি এক সপ্তাহ বাদে আসবো। এর মধ্যে খেয়ে দেয়ে শরীরটাকে চাঙ্গা করে নাও। তারপর দুজনে দামাসকাসের পথে বেরিয়ে পড়বো।

এই বলে তিনি সেদিনের মতো চলে গেলেন। এদিকে সওদাগর তার ছেলের যাত্রার তোড়জোড় করতে থাকলো।

সওদাগর তার ছেলের হাতে পাঁচহাজার দিনার দিলো। একটা ভালো দেখে উট কিনে আনলো। নানারকম সওদাগরী জিনিসপত্র চাপালো তার পিঠে। তার মধ্যে সব চেয়ে নামকরা কুফার রেশমী কাপড় দিলো অনেকগুলো।

সপ্তাহখানেক পরে খুশ বাহারের শরীর যখন মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলো তখন তারা দিনক্ষণ-দেখে একদিন রওনা হয়ে গেলো।

শাহরাজাদ বলতে থাকে, আপনার হয়তো খেয়াল আছে জাঁহাপনা, এই সময়ে কুশ বাহার সতেরয় পা দিয়েছে তখন তার দেহে সবে যৌবনের জোয়ার আসতে শুরু করেছে।

খুশবাহারের আদব কায়দা আচার বাহারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন পারসী সাহেব। সারাটা পথ তার যাতে কোন তকলিফ না হয়। সেই দিকেই পারসী সাহেবের চোখ। নিজের সুবিধা অসুবিধা গ্রাহ্যও করলেন না।

এইভাবে তারা একদিন নিরাপদেই দামাসকাসে এসে পৌছায়। প্রথমে একটা দোকান ঘর ভাড়া নিলেন পারসী সাহেব। দামাসকাসের বড়বাজারের দোকানটিকে তিনি মনোহর করে সাজালেন। নানা রকম বাহারী প্রসাধন সামগ্ৰী এবং সুন্দর সুন্দর ঘর সাজানো জিনিসে দোকান ঝলমল করতে লাগলো। একদিকে নানা রকম হেকিমি ওষুধপত্রও রাখলেন।

যথাযোগ্য সাজগোজ করে মাথায় একটা সাত প্যাচের পাগড়ী পরলেন। এবং খুশ বাহারকে পর্যালেন নীল রঙের রেশমী কামিজ তার উপর চাপালেন কাজকরা কাশ্মীরি কুর্তা। হাতের বন্ধে বেঁধে দিলেন একখানা গুলাব রঙের সোনার জরির কাজ করা রেশমী রুমাল। হাতে তুলে দিলেন একটা ওষুধের বাক্স। ঠিক যেন হেকিমের সাগরেদ। পারসী-সাহেব বললেন, এখন থেকে বেটা, তুমি আমাকে বাবা বলবে। আর আমি তোমার পরিচয় দেব ছেলে বলে।

দোকান খুলতেই নানা রকমের মেয়ে পুরুষ এসে ভিড় জমাতে লাগলো। কেউ বা দাওয়াই-এর জন্য আসতে লাগলো। আবার কেউ কেউ খুশ বাহারের রূপে মুগ্ধ হয়ে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে থাকলো। কয়েক দিনের মধ্যেই সারা শহরে ছড়িয়ে পড়লো তাদের নাম।

রুগীরা আসে। পারসী সাহেব রুগীর চোখের দিকে তাকান। তারপর একটা কঁচের বাটি সামনে ধরে বলেন, থুথু ফেলুন। রুগী থুথু ফেলে। বাটিটাকে তুলে ধরে কি যেন পরীক্ষা করেন। তিনি। তারপর রোগ বাৎলে দেন। রুগী অবাক হয়। কী আশ্চর্যক্ষমতা! নাড়ী না ধরে, বুক পিঠ না। দেখে শুধু থুথু পরীক্ষা করে রোগ দাওয়াই বাৎলে দিতে পারেন? এমন অদ্ভুত হেকিম তারা জীবনে দেখেনি কখনও। এমন ধন্বন্তরী মানুষ-এর কথা শোনেও নি তারা।

কয়েকদিনের মধ্যে পারসী সাহেবের নাম যশের খ্যাতি খলিফার কানে পৌঁছয়। একদিন সকালবেলা পারসী সাহেব দোকানে বসে আছেন, এমন সময় এক খানদানী বৃদ্ধা মহিলা সুসজ্জিত এক খচ্চরের পিঠে চেপে এসে সামনে দাঁড়ালো। বৃদ্ধ নামতে চায়। পারসী সাহেবকে সেইশারায় ডাকে। তাকে ধরে নামাতে বলে। পারসী সাহেব তাড়াতাডি উঠে গিয়ে বৃদ্ধাকে নামিয়ে দোকানের ভিতরে নিয়ে এসে বসতে অনুরোধ করেন। খুশ বাহার একখানা আসন এগিয়ে দেয়। বৃদ্ধ বসে। বোরখার ভেতর থেকে একটা বোতল বের করে। জলে ভরা। পারসী সাহেবের হাতে তুলে দিতে দিতে বলে, প্রস্রাব আছে। আচ্ছা সাহেব, আপনিই তো ইরাক থেকে এসে এখানে নতুন দাওয়াইখানা খুলেছেন?

—জী হ্যাঁ, আমিই আপনার সেই নফর।

—ও কথা বলতে নাই সাহেব, কেউ কারো নোকর নয় এ দুনিয়ায়। আমরা সবাই একজনেরই দাসানুদাস। তিনি পরম পিতা খোদাতালা। থাক ওসব কথা, আমি যে জন্যে এসেছি, বলি। এই বোতলে যে প্রস্ৰাব দেখছেন তা আমাদের খলিফার সদ্য কেনা বাদীর। অনেকদিন, এখানে আসার পর দিন থেকে তার জুর-কিছুতেই ছাড়ে না। আমাদের প্রাসাদের ডাক্তাররা দেখে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এখন আপনিই শেষ ভরসা। আপনার নাম যশ শুনে খলিফার বোন আমাকে পাঠালেন আপনার কাছে। এখন দেখুন। আপনি যদি সারাতে পারেন—

–তার নামটা না জানলে তো হবে না। আমি তো শুধু দাওয়াই দিয়েই রোগ সারাই না। ঝাড়ফুকও করি—প্রয়োজন হলে।

বৃদ্ধ বলে, তার নাম খুশ নাহার।

পারসী সাহেব একখণ্ড কাগজে এক নাগাড়ে অনেকগুলো সংখ্যা লিখে ফেলেন। কতকগুলো লিখলেন লাল কালিতে, কতকগুলো সবুজ কালিতে তারপর তিনি লালকালির সংখ্যাগুলোর সঙ্গে সবুজ কালীর সংখ্যাগুলো যোগ করলেন। সেই যোগফলের সঙ্গে আরও কিছু যোগ-বিয়োগ গুণ ভাগ করে কি সব হিসেব করলেন।

-শুনুন মালকিন, রোগ আমি ধরে ফেলেছি। বুকের ধড়ফড়ানিই তার একমাত্র রোগ।

বৃদ্ধা আঁৎকে ওঠে, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বটে। বুকের মধ্যেই তার যত রোগ। হরদম ধড়ফড় করে ব্যাথা করে।

পারসী সাহেব বলে, সুতরাং দাওয়াই ঠিক করার আগে রুগী সম্পর্কে আরও কিছু বিশদভাবে জানা দরকার। কোন দেশের মেয়ে সে? কোথা থেকে এসেছে? এটা জানা বিশেষ দরকার। কারণ সেখানকার জল হাওয়া আর এখানকার জল হাওয়ার সঙ্গে কতটা কি ফারাক আছে, বুঝতে হবে। তাছাড়া তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ধরণ-ধারণ বোঝার জন্য তার সঠিক বয়সটাও জানা দরকার। আর কতদিন হলো সে এ শহরে এসেছে?

বৃদ্ধ বলে, তার মুখ থেকে যা শুনেছি, তাতে মনে হয়, সে কুফাতেই জন্মেছে, সেখানেই মানুষ হয়েছে। তার বয়স এখন, আমি যতদূর জানি, বছর ষোল হবে। সেই যেবার কুফা শহরে আগুন লেগেছিলো সেই সালে তার জন্ম। সে আজ মাত্র কয়েক সপ্তাহ হলো দামাসকাসে এসেছে।

পারসী সাহেব খুশ বাহারের দিকে তাকায়। খুশবাহারের অবস্থা তখন কাহিল। বুক ধড়ফড় করতে শুরু করেছে। কপালে জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

–বেটা, সাত নম্বর দাওয়াই বানাও। ইবন সিনার সূত্র ধরে বানাতে হবে। খুব সাবধান, কোনও উল্টো পাল্টা যেন না হয়।

বৃদ্ধ ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে, যার জন্যে দাওয়াই নিচ্ছি সেও তোমার মতোই খুব সুরৎ। আচ্ছা হেকিম সাহেব, এটা আপনার লেড়কী?

—জী হাঁ, আমার বেটা, আপনার নফর।

বৃদ্ধ বিগলিত হয়ে গেলো। বললো, আপনার ধন্বন্তরী দাওয়াই-এর খ্যাতি আজ সারা দামাসকাসে ছড়িয়ে পড়েছে। আর আপনার ছেলের রূপ গুণের কথাও চাপা থাকবে না। কালে আপনার ছেলেও নামজাদা হেকিম হবে।

ওরা দুজনে যখন কথা বলতে ব্যস্ত সেই সময় খুশ বাহার দাওয়াই বানিয়ে কয়েকটা পুরিয়া তৈরি করলো। পুরিয়াগুলো একটা ছোট্ট বাক্সে ভরে বাক্সটার গায়ে কুফার স্থানীয় ভাষায় দুর্বোধ্য হরফে খুশ বাহারের নাম ঠিকানা লিখে বৃদ্ধার হাতে তুলে দিলো।

বটুয়া খুলে দশটা সোনার মোহর বের করে বৃদ্ধ পারসী সাহেবের হাতে দেয়। খোদা হাফেজ, এবার তা হলে আসি?

বৃদ্ধ আর তিলমাত্র দাঁড়ায় না। খচ্চরের পিঠে চেপে প্রাসাদের পথে রওনা হয়ে যায়।

খুশ নাহারের ঘরে ঢুকে দেখে অঝোর নয়নে কাঁদছে সে। কাছে এসে রুমাল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দেয়। বৃদ্ধা! বলে, ছিঃ কাঁদে না। এই দেখ, আমি তোমার জন্যে কি দাওয়াই এনেছি। একবারে ধন্বন্তরী। নির্ঘাৎসব অসুখ সেরে যাবে তোমার। যেমন হেকিম সাহেব, তেমনি তার খুব সুরৎ লোড়কা— দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। এই নাও তোমার দাওয়াই-এর বাক্স।

খুশ নাহার এই বৃদ্ধাকে চটাতে চায় না। যাই হোক, সারা প্রাসাদের মধ্যে এই একটি মাত্র মানুষই তার সঙ্গে দরদ দিয়ে কথা বলে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাত পেতে বাক্সটা নেয়। হঠাৎ বাক্সটার গায়ে লেখাটার ওপরে নজর পড়তেই পলকে মুখের চেহারা পালটে যায় তার। নাহার পরিষ্কার পড়তে পারে, ‘আমি খুশ বাহার। কুফার সওদাগরের পুত্র।’ নীহারের মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। বুক ঢ়িব ঢ়িব করে ওঠে। সব যেন কেমন তাল গোল পাকিয়ে যেতে থাকে। নিমেষেই সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কয়েক মুহূর্ত ঝিম মেরে পড়ে থাকার পর আবার সে চৈতন্য ফিরে পায়। ধীরে ধীরে মাথাটা তুলে একটু হেসে প্রশ্ন করে, সেই ছেলেটি সত্যিই কেমন দেখতে? খুব সুন্দর?

—খু—ব। তার রূপের বর্ণনা আমি দিতে পারবো না। তবে তার মতো সুন্দর নওজোয়ান আমি খুব কম দেখেছি। বঁ, তার চোখ, কী তার নাক, ইয়া আল্লাহ। তার মুখের বাঁদিকে একটা কালো তিল-ভারি সুন্দর লাগে দেখতে। আর যখন সে হাসে বড় সুন্দর টোল খায় তার ডান গালে।

তার এই সব বর্ণনা শুনে নাহারের আর বুঝতে বাকী থাকে না, ছেলেটি তার প্রাণ-প্রতিম ছাড়া আর কেউই নয়। বাক্সটা খুলে একটা পুরিয়া বের করে মুখের মধ্যে ঢেলে দেয়। পুরিয়ার কাগজখানার দিকে চোখ পড়তেই দেখে, একখানা চিঠি।

খুশ নাহার অনন্দে বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে, বুড়িমা, এ দাওয়া কোথায় পেলেন। আমার এতদিনের অসুখ এক পুরিয়াতেই সেরে গেলো। ওঃ, কী যে ভালো লাগছে, কী করে বোঝাবো। আজ একমাস আমি কিছু খাইনি, ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে–যাহোক কিছু খানা এনে দিন। আজ আমি পেট ভরে খাবো, আর প্রাণ-ভারে ঘুমাবো।

বারকোষে সাজিয়ে খাবার নিয়ে আসে। বৃদ্ধা। মাংসের চাপ, তন্দুরা রুটি, ফল এবং সরবৎ। তারপর খলিফার কাছে গিয়ে জানায়, খুশ নাহার-এর অসুখ বিলকুল সেরে গেছে। দামাসকাসে এক পারসী সাহেব এসে দাওয়াখানা খুলেছেন। তাঁর এক পুরিয়াতেই খুশ নাহার ভালো হয়ে গেছে।

খলিফা বললো, বাঃ দারুণ গুণী মানুষ তো! ঠিক আছে, এই এক হাজার দিনার নিয়ে যাও। তাকে দিয়ে এসো।

পারসী সাহেবের কাছে যাওয়ার আগে বৃদ্ধা খুশ নোহারের সঙ্গে দেখা করতে এলো। খুশ নাহার বললো, দাঁড়ান বুড়িমা, আমিও তাকে একটা উপহার পাঠাবো।

একটা ছোট বাক্সের মুখে মোহর করে বৃদ্ধার হাতে দিয়ে বলে, এই বাক্সটা দুৰ্থ তার হাতে দেবেন।

বৃদ্ধা দোকানে গিয়ে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা আর সেই বাক্সটা খুশ বাহারের হাতে তুলে দেয়।

খুশ বাহার বাক্সটা খুলে দেখে, একখানা চিঠি। কী করে কুফার সুবাদার খুশ নাহারকে ধোঁকা দিয়ে ভুলিয়ে এনে দামাসকাসে খলিফার ভোগের জন্য পাঠিয়েছে, তারই মৰ্মম্ভদ কাহিনী লিখে পাঠিয়েছে সে। চিঠিখানা পড়ে খুশ বাহার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

বৃদ্ধা অবাক হয়। —আপনার ছেলেকাঁদতে কাঁদতে  অজ্ঞান হয়ে পড়লো কেন, সাহেব?

পারসী সাহেব বলে, এছাড়া আর কী হতে পারে, মা? আপনি যাকে খলিফার বাঁদী ভাবছেন, আমার দাওয়াই খেয়ে যার অসুখ সেরে গেলো, আসলে সে এই ছেলের বড় পিয়ারের বিবি। কুফার শয়তান সুবাদার কারসাজী করে এক বুড়িকে দিয়ে তাকে ভাগিয়ে এনে এই দামাসকাসে চালান করে দিয়েছে-খলিফার ভোগের জন্য। মেয়েটির বিরহে এই ছেলেটির মৃতকল্প দশা দেখে আমি তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। এখানে। আপনি জানেন, ও আমার ছেলে। কিন্তু না, ওর সঙ্গে আমার কোনও রক্তের সম্পর্ক নাই। এই খুশ বাহার কুফার এক সভ্রান্ত সওদাগর বাহার সাহেবের পুত্র। দামাসকাসে আমরা কোনও ব্যবসাবাণিজ্য করতে বা রোজগারের ধান্দায় আসিনি, মা। আমার একটিমাত্র উদ্দেশ্য-ওর চোখের মণি বিবি খুশ নাহারকে উদ্ধার করা।

পারসী সাহেব একটু থেমে আবার বলেন, সবই তো শুনলনে, এখন আপনি আমাদের সাহায্য না করলে তাকে তো ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে না, মা! এই নিরপরাধ ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে এই উপকারটুকু আপনাকে করতেই হবে। খলিফা আমাকে সহস্ব মুদ্রা ইনাম পাঠিয়েছেন, আমি মাথায় ঠেকিয়ে আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি। এ টাকায় আমাদের কোনও দরকার নাই। এটা আপনিই রাখুন। আমাদের মনস্কামনা পূর্ণ হলে আমরা আপনাকেও খুশি করে যাবো, মা।

এই সময়ে রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

দুশো পয়তাল্লিশতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :

বৃদ্ধা বলে; আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন সাহেব, আমার তরফ থেকে যতটা করা সম্ভব আমি করবো। এরপর তাকে উদ্ধার করতে পারা-না-পারা আপনাদের নসীব আর আমার হাত-যশ।

এই বলে সে আর সেখানে দেরি না করে তাড়াতাডি প্রাসাদে ফিরে আসে। খুশ নাহার হাসি খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠেছে। তার আর মনে কোনও সংশয় নাই, এবার সে তার প্রিয়তমের কাছে ফিরে যাবে। বৃদ্ধ নাহারের কাছে এসে মাথায় হাত রাখে, মা, এই বুড়িটাকে বিশ্বাস করতে পারনি এতদিন, তাই না? তা না হলে আমার কাছে মনের গোপন কথা খুলে বলো নি কেন? আমাকে কি দেখে মনে হয়েছিলো, আমি তোমার কোনও অনিষ্ট করতে পারি? কেন যে তুমি দিন রাত ঐভাবে কান্নাকাটি করতে এখন বুঝতে পারছি। কিন্তু তখন যদি বলতে, তাহলে অনেক আগেই তোমার দুঃখ ঘুচিয়ে দিতাম।

খুশ নাহার বৃদ্ধার মুখের দিকে বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকে। বৃদ্ধ বলে, মা, তুমি আমার ওপর ভরসা রাখ, আমি তোমাকে ঠকাবো না। এক মা মেয়ের ভালোর জন্য যা করতে পারে, আমিও তোমার জন্য তাই করবো। আমি আল্লাহর নামে কসম খাচ্ছি, যেভাবেই হোক, হয় সে-ভি আচ্ছা। মন থেকে সব চিন্তাভাবনা মুছে ফেলো, মা। এই বুড়ি তোমার কি করে, একবার শুধু দেখ।

খুশ নাহার আনন্দে জড়িয়ে ধরে বৃদ্ধাকে। দু-চোখ জলে ভরে ওঠে। তার উষর মরুময় জীবনে এই বৃদ্ধ এক সুবজ বৃক্ষের আচ্ছাদন।

বৃদ্ধ আবার পারসী সাহেবের দোকানে আসে। কাপড়ে বাঁধা একটা পুটলি হাতে দিয়ে খুশ বাহারের কানে কানে ফিস ফিস করে কি যেন বলে। পুঁটলিটা নিয়ে বুড়িকে সঙ্গে করে খুশ বাহার পিছন দিকে পর্দার আড়ালে চলে যায়। খুশ বাহার পুঁটলিটা খুলে ফেলে। মেয়েছেলের বাহারী সাজ পোশাক, জড়োয়া গহনা, প্রসাধন ইত্যাদি নানারকম টুকিটাকি জিনিসপত্র। বৃদ্ধা নিজে হাতে তাকে মেয়েছেলের সাজে সাজায়। নিখাদ নিখুঁত ভাবে। পর্দার আড়াল থেকে যখন সে বেরিয়ে আসে পারসীসাহেব হাঁ করে চেয়ে থাকে। ভাবতে কষ্ট হয়, এই সেই খুশবাহার। দিব্যি এক পরমা সুন্দরী রমনী। কাজলটানা চোখ, আঁকা ভুরু। ঠোঁটে গালে লাল গুলাবী আভা। গলায় সাতনরী হার, হাতে বাজুবন্ধ, মাথায় টায়রা কপালে টিকলি, কানে দুল, নাকে নাকছবি কোমরে বিছা, পায়ে মল—একেবারে মোহিনী রূপা। মসুলের বিখ্যাত রেশমী বোরখায় দেহখানা ঢেকে নিয়ে খুশ বাহার বৃদ্ধাকে অনুসরণ করে পথ চলতে থাকে। যেতে যেতে কয়েকটি অল্পবয়েসী যুবতীকে দেখিয়ে বৃদ্ধা বলে, জোয়ান মেয়েরা কেমন করে পাছা দুলিয়ে চলছে একবার সামনের দিকে তাকিয়ে দেখ। ঠিক ওমনি ঢং-এ পা ফেলো। দেখবে, পাছাটা সুন্দর দুলতে থাকবে।

খুশ বাহার অল্পক্ষণের মধ্যেই মেয়েদের হাঁটার কায়দা রপ্ত করে ফেলে। বৃদ্ধা বাহবা দেয়, বাঃ, এই তো শিখে ফেলেছি। চমৎকার। এবার কী করে পুরুষের দিকে তাকাতে হবে। আর আধো-আধো নাকি সুরে কথা বলতে হবে-শিখিয়ে দিচ্ছি। তোমাকে। কখনও কোনও পুরুষের দিকে সোজাসুজি তাকাতে নাই। সব সময়ই একটু তেরছা চোখে তাকাবে। তাতে আরও সুন্দর দেখায়। লাস্যময়ী মনে হয়।

হারেমের সামনে এসে দাঁড়াতেই খোজা-সর্দার পথ রুখে দাঁড়ায়। বাইরের অচেনা কোন মেয়েছেলেকে সে ঢুকতে দেবে না। বলে, হুকুম নাই। যদি একে অন্দরে নিয়ে যেতে হয় খলিফার চিঠি চাই। না হলে ফিরে যেতে হবে। অথবা একে বাইরে রেখে তুমি এক ভিতরে যেতে পার।

বৃদ্ধ বলে, একি কথা বলছে গো, ভালো মানুষের পো। এতকাল আমি সুলতানের নোকরী করছি। আমাকে তোমার বিশ্বাস নাই?

—বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়, বুড়ি মা। সুলতানের কড়া হুকুম : —বাইরের কোনও মেয়েকে ঢুকতে দেব না।

–কিন্তু তুমি কি জান, এ মেয়েটি কে? সুলতানের বোন দাঁহিয়ার জন্য সদ্য কেনা হয়েছে এই বাঁদীকে। এখন তুমি যদি একে আটকাও তাহলে কি কাণ্ড হবে একবার ভেবে দেখ! রেগে-মোগে তিনি হয়তো তোমাকে শূলেই চাপাবেন! অথবা গলা ধাক্কা দিয়ে দূর করে দেবেন। এখন ভেবে চিন্তে বলো, কী করবে।

বৃদ্ধার কথায় খোজা-সর্দার থতিমত খেয়ে যায়। মুখে কথা সরে না। এই ফাঁকে বৃদ্ধ কুশ বাহারের হাত ধরে বলে, এসো বাছা, ভিতরে এসো। বুড়ো খোজা সর্দারের বাহাৰ্ত্তরে রোগ হয়েছে। ওর কথায় কিছু মনে করো না, মা।

খোজা-সর্দারকে আর কোনও বাধা দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে খুশ বাহারকে প্রায় টানতে টানতেই অন্দরে নিয়ে যায় সে। হারেমের নিরাপদ মহলে এসে বৃদ্ধ বলে, বাবা, এই হারেমে তোমার জন্য আলাদা একখানা কামরা আমি ঠিক করে রেখেছি। তোমাকে নিশানা বাৎলে দিচ্ছি, তুমি সোজা চলে যাও সেই ঘরে। আমি তোমার সঙ্গে যাবো না।

এই বলে বৃদ্ধ বোঝাতে থাকে, ঐ যে দরজাটা দেখছ, ঐ দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে যাও। দেখবে একটা লম্বা দৌড়তি বারান্দা। সেই বারান্দার শেষে গিয়ে বাঁদিকে ঘুরে যাবে। তারপর দেখবে পথটা ডানদিকে ঘুরে গেছে। তুমিও ঘুরে যেতে থাকবে। আবার ডানদিকে ঘুরতে হবে। এবার দেখবে পাশাপাশি অনেকগুলো দরজা। গুণে গুণে প্রথম পাঁচখানা ছেড়ে দিয়ে ছয়ের দরজাটা খুলবে। ঐখানেই তোমার ঘর। কী? মনে থাকবে তো? তুমি যাও, ঘরে বিশ্রাম করগে। আমি খুশ নাহারকে যথা সময়ে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবখন। তারপর সুযোগ মতো খোজা আর প্রহরীদের অলক্ষ্যে তোমাদের দুজনকে প্রাসাদ থেকে পাচার করে দেব এক সময়। তাহলে ঠিক আছে, এবার তুমি যাও, কেমন?

খুশ বাহার ঘাড় নেড়ে বলে, আচ্ছা।

দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই সে দেখে বিরাট লম্বা একটা বারান্দা। বারান্দাটার শেষ প্রান্তে এসে সব গুলিয়ে যায়। বাঁদিকেও একটা পথ ডান দিকেও একটা পথ। কোন দিকে বাকি নিতে হবে। কিছুতেই আর মনে পড়ে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবে। তারপর ডানদিকের পথ ধরে চলতে থাকে এবার পথটা বঁদিকে ঘুরে গেছে। খুশ বাহার মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই পথে চলে। যেতে যেতে দেখতে পায় পাশাপাশি অনেকগুলো দরজা, মুখে তার হাসি ফুটে ওঠে। যাক, বাবা, এতক্ষণে ধড়ে প্রাণ পাওয়া গেলো। গুণে গুণে প্রথম পাঁচটা দরজা ছেড়ে দিয়ে ছয়-এর দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়লো সে।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পরদিন দুশো ছেচল্লিশতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে।

সে দেখলো, বিরাট বিশাল একটা মহল-সদৃশ ঘর। মাথার ওপরে একটি ঘেরা-টোপ গম্বুজ। তার চারপাশে সূক্ষ্ম কাজ করা। নানা বর্ণের। নানা ঢং-এর দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে সোনার অক্ষরে বিখ্যাত সব সায়ের লেখা। চারপাশের দেওয়াল লালগুলাবী রেশম কাপড়ে মোড়া। জানলাগুলোয় জাফরীকাটা চিকানের পরদা। আর মেঝে জুড়ে অসংখ্য হিন্দুস্তানের কাশ্মীরি গালিচা। মেহগনি কাঠের টুলগুলোর ওপরে গামলা ভরা নানা জুতের মিষ্টি মিষ্টি ফল, হালওয়া, বরাকী ইত্যাদি। সারা ঘরময় দামী আতরের খুশবু। ঘরের যেদিকেই চোখ ফেরায় সে, সেরা শিল্পীর হাতের ছাপ নজরে পড়ে।

খুশ বাহার বুঝতে পারে সে ভুল ঘরে ঢুকে পড়েছে। এতবড় প্রকাণ্ড ঘর কেউ নিভৃত শুয়ন কক্ষ মনে করতে পারে না। ঘরে বসার মতো একটিই মাত্র আসন—মখমলের চাঁদরে ঢাকা একখানা সিংহাসন।

এ অবস্থায়, এত বড় প্রাসাদের হাজার হাজার ঘর দরজার মধ্যে কোথায় সে হাতড়ে বেড়াবে তার ঘর। বাইরের বারান্দায় ঘোরা-ফেরা করায় বিপদও থাকতে পারে। তাই সে আর অনর্থক সে-চেষ্টা না করে সিংহাসনের ওপরেই বসে পড়লো। ভাবলো, নসীবে যা আছে, হবে।

কিছুক্ষণ পরে খুশ বাহার কান খাড়া করে শোনে—কার যেন পায়ের চটির শব্দ ক্রমশ এই দিকেই এগিয়ে আসছে। বুকের মধ্যে ঢ়িব ঢ়িব করতে থাকে। পলকের মধ্যেই এক বৃদ্ধ মহিলা এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। এই মহিলা-দাঁহিয়া, সুলতানের বোন।

দহিয়া দেখতে পায়, একটি মেয়ে বোরখায় আপাদমস্তক ঢেকে সিংহাসনে বসে আছে। অবাক হয়ে সে কাছে এসে দাঁড়ালো। নরম গলায় খুশ বাহারকে জিজ্ঞেস করলো, হ্যাগো মেয়ে, কে তুমি? আর এই হারেমের মধ্যে বোরখা ঢাকা দিয়েই বা বসে আছ কেম? এখানে আর পরপুরুষ আসতে পারবে না কেন?

খুশ বাহার হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ভয়ে কাঁপতে থাকে। মুখে কথা সরে না।

দহিয়া বেশ নরম গলাতেই আবার জিজ্ঞেস করে, কি গো বাছা, কথা বলছে না কেন? শরম কিসের? নকবি তোলো, বোরখা খুলে ফেলো! আহা, কী সুন্দর কাজল কালো ডাগর তোমার চোখ। অমন করে ঢেকে রাখতে আছে?

তবু খুশ বাহার কথা বলে না।

দাহিয়া কিন্তু রাগ করে না। বরং আরও মোলায়েম কষ্ঠে বলে, তুমি সুলতানের বাঁদী? কোনও কারণে কী তিনি তোমার ওপর চটে গিয়ে বরখাস্ত করে দিয়েছেন তোমাকে? তা যদি হয়ে থাকে, তুমি কিছু চিন্তা করো না, খলিফাকে বলে আবার তোমাকে বহাল করে দেব আমি। আমি কে জান? আমার নাম দহিয়া-খলিফার সহোদরা বোন। আমার কোনও কথাই তিনি ঠেলতে পারেন না। সুতরাং কী হয়েছে, খুলে বলো দেখি, বাপু।

তথাপি খুশ বাহার নিরুত্তর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

দহিয়া ভাবে, এমন কোনও কথা সে বলতে চায়, যা অন্য কোনও দাসী চাকরানীর সামনে বলা যায় না। সঙ্গের দাসীটাকে চোখেরইশারা করতে সে ঘর থেকে কেরিয়ে গেলো। দহিয়া আশা করতে থাকে, এবার নিশ্চয়ই সে মুখ খুলবে। কিন্তু খুশ বাহার রাকাড়ে না। দাহিয়া আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে খুশবাহারের। এক রকম প্রায় জোর করেই টেনে বোরখা খুলে দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করে। খুশ বাহার প্রাণপণে শক্ত করে চেপে ধরে থাকে—বোরখা সে খুলতে দেবে না। দাহিয়ার সঙ্গে এক রকম ধস্তাধবস্তি করতে হয় তাকে।

দাহিয়ার ভুরু কুঁচকে ওঠে, জাপটা জাপটি করার সময় সে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে, তার বুকটা একেবারে ছেলেদের মতো সমান। এই বয়সের মেয়েদের বুক ডাঁসা ডালিমের মতো হয়। কিন্তু ডালিম দূরে থাক ডুমুরেরও চিহ্ন নাই।

দাহিয়া গম্ভীর হয়ে বলে, বোরখা খুলে ফেলো। তা না হলে খুব খারাপ হবে।

খুশ বাহার ভাবে, আর উপায় নাই। এবার সে চুপ করে থাকলে দাঁহিয়া তাকে ছেড়ে দেবে না। হয়ত খোজাকে ডেকে জোর করে খোলাবে। তখন সব জানাজানি হয়ে যাবে। খুশ বাহার। আর কালক্ষেপ না করে হাঁটু গেড়ে বসে দাহিয়ার পা দুটো জড়িয়ে ধরে, আপনি আমাকে বাঁচান।

—আহা-হা, ওঠ। আমি তো তোমাকে আগেই ভরসা দিয়েছি, বাছা, তোমার কোনও ভয় নাই। যাক, সব সত্যি কথা খুলে বলে দেখি, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ? এবং কেন?

খুশ বাহার কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, মালকিন, আমি মেয়ে নাই—আমার নাম খুশ বাহার। মেয়েছেলের ছদ্মবেশ না ধরলে হারেমে ঢুকতে পারবো না, তাই আমার এই সাজ।

—কিন্তু পর পুরুষ হয়ে হারেমে ঢোকার কি সাজা জান?

—জানি, প্রাণদণ্ড। কিন্তু এছাড়া আমার কোনও উপায় ছিলো না। তাই নিজের জান কবুল করতে হতে পারে জেনেও আমি এখানে এসেছি।

–কিন্তু কেন?

—আমার বিবি আমার চোখের মণি, বুকের কলিজা এই হারেমে বন্দী হয়ে আছে। তাকে উদ্ধার করতে না পারলে সেও বাঁচবে না, আমিও মরে যাবো।

দাহিয়া বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তাকায়, তার মানে?

খুশ বাহার কান্না বিজডিত কণ্ঠে বলতে থাকে, আমার বিবির নাম খুশ নাহার। আমার বাবা বাঁদীবাজার থেকে নাহার। আর তার মাকে কিনে এনেছিলেন। সে অনেক দিনের কথা—আমার সবে জন্ম হয়েছে, তখন নাহারও তার মা-এর কোলের সস্তান। ছোট থেকে আমরা এক সঙ্গে হেসে খেলে মানুষ হয়েছি। বাবা মা-র বাসনা ছিলো, বড় হলে আমাদের শাদী দিয়ে দেবেন। যখন আমার ‘বার বছর বয়স তখন আমাদের শাদী হয়।

নাহারের মতো সুন্দরী রূপসী সারা কুফাতে আর দুটি নাই। বোধহয় এই জন্যেই সুলতানের সুবাদারের ‘সুনজর’ পড়েছিলো তার উপর। ছলে কৌশলে সে তাকে চুরি করে দামাসকাসে চালান করে দেয়। এখন সে খলিফার এই হারামে বন্দী হয়ে আছে। সুবাদার ভেট হিসাবে নাহারকে পাঠিয়েছে খলিফার কাছে। লোকটা এমনই মিথ্যেবাদী, খলিফাকে মিথ্যে করে জানিয়েছে, নাহারকে সে এক সওদাগরের কাছ থেকে নায্য দামে কিনেছে। নাহার নাকি কোনও শাহ বাদশাহর ঘরের মেয়ে। সব বুন্টু!

—হাতে তুডি বাজাতেই সেই দাসীটা দাহিয়ার পাশে এসে দাড়ায়।–জলদি, ছুটে যা, খুশ নাহারের কামরায়। গিয়ে বলো, আমি ডাকছি, সে যেন এক্ষুণি এসে দেখা করে।

এই সময়ে রাত্রি শেষ হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

দুশো সাতচল্লিশতম রজনী :

দ্বিতীয় প্রহরে আবার সে বলতে শুরু করে।

দাহিয়া রোরুদ্যমান খুশ বাহারের মাথায় হাত রেখে বলে, চোখের পানি মুছে ফেল, বেটা। আমি যতক্ষণ জিন্দা আছি, তোমার কোনও ডর নাই। সব আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার বিবিকে তুমি ফিরে পাবে। আমার ভাই খলিফা, তিনি ধর্মপ্রাণ সুলতান। এতবড় অধৰ্ম তিনি সইবেন না। অন্যের বিবি বোন তিনি কেড়ে এনে ভোগ করেন না। এত বড় অপবাদ তাকে কেউ কোনও দিন দিতে পারেন নি। আজ যদি কুফার সুবাদারের শয়তানীর জন্য তার নাম যশে এতটুকু আঘাত লাগে, আমি বলে দিচ্ছি বাছা, সে-সব তিনি বরদাস্ত করবেন না।

এদিকে যখন এই সব কাণ্ড চলছে বৃদ্ধা তখন খুশ নাহারকে বলছে আমার সঙ্গে চলো, বেটা। তোমার চোখের মণিকে আমি হারেমের অন্দরে এনে একটা ঘরে লুকিয়ে রেখেছি। দেখবে চলো।

খুশ নোহারের আর তার সয় না। আনন্দে দিশাহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু খুশ বাহারের জন্য যথানির্দিষ্ট কামরায় গিয়ে যখন দেখে, সে-ঘরে সে নাই ভয়ে শিউরে ওঠে।

বৃদ্ধ বলে, সর্বনাশ-নিশ্চয়ই সে নিশানা ভুলে গেছে। হয়তো সারা হারেমে চরকীর মতো ঘুরপাক খাচ্ছে! এখন কী হবে? এত বড় মহল—কী করে তাকে খুঁজে বের করা যাবে? তুমি বাছা ঘরে ফিরে যাও। আমি দেখছি, কোথায় গেলো। সে।

দারুণ উৎকণ্ঠ নিয়ে খুশ নাহার আবার ঘরে ফিরে আসে। একটুক্ষণ পরে দাহিয়ার দাসী এসে বলে, শাহজাদী দহিয়া আপনাকে তলব করেছেন।

এবার সে আরও ভয় পায়। নিৰ্ঘাৎ খুশ বাহার দহিয়ার হাতে ধরা পড়েছে। আর রক্ষা নাই, তার গর্দান যাবে। যাই হোক, দাঁহিয়া ডেকেছেন, দেরি করা চলে না। খুশ নাহার অসংবৃত বেশবাস নিয়েই, খালি পায়ে, উদ্রান্তের মতো মেয়েটির পিছনে পিছনে অনুসরণ করে চললো! সেই প্রকাণ্ড ঘরটায় ঢুকতেই হাসতে হাসতে ছুটে এসে দাঁহিয়া খুশ নাহারকে জড়িয়ে ধরে। প্ৰায় হিডি হিডি করে টানতে টানতে সিংহাসনের পাশে নিয়ে গিয়ে বলে, কী? চিনতে পারছ?

খুশ নাহার। সলজ্জভাবে ঘাড় নাড়ে। দাহিয়া বলে, এইতো যুগলে মিলন ঘটিয়ে দিলাম, এবার মিঠাই খাওয়াও।

খুশ বাহারের মুখে হাসি ফোটে। দাহিয়া বলে, আমরা আর কেন পথের কাঁটা হয়ে থাকি। তোমরা এবার বিশ্রাম্ভালাপ কর। আমি এখন চলি!

দাসীকে সঙ্গে নিয়ে দাহিয়া বিদায় নিলো। সঙ্গে সঙ্গে খুশ নাহার খুশ বাহারের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দু’হাতে গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো। কাঁদিলো খুশ বাহারও। অনেকক্ষণ কেঁদে কেঁদে বুকের বোঝা হালকা করলো দু’জনে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে দাহিয়া ফিরে এসে দেখে দুজনে দুজনের কাঁধে মাথা রেখে গভীর আবেশে নিথর নিস্পন্দ হয়ে আছে। দুজনের গাল বেয়ে ঝরে পড়ছে আনন্দাশ্রধারা। দাহিয়া বললো, নাও, এবার একটু চাঙ্গা হয়ে নাও। তোমাদের জন্যে দামী সরাব এনেছি। খাও মৌজ কর। তোমাদের পুনর্মিলন সুখের হোক-আনন্দের হোক।

খুদে দাসীটা মদের পেয়ালা ভর্তি করে দুজনের হাতে তুলে দেয়।

দাহিয়া বলে, আজ শুধু খানা-পিনা আর গান বাজনা চলবে, কি বলো? তোমরা নিশ্চয়ই ভালোবাসার গান গাইতে জান?

দুজনেই ঘাড় নেড়ে জানালো, হ্যাঁ জানে। পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ওরা গুনগুন করে গান ধরে।

গানের মুর্ছনায় সকলেই বিভোর। কতক্ষণ কেটে গেছে খেয়াল নাই। আরও কতক্ষণ কাটতো তার ঠিক নাই—হঠাৎ দরজার পর্দা সরে গেলো, ঘরে ঢুকলো খলিফা। গান থেমে গেলো মুহূর্তে তিনজনেই তাড়াৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে আভুমি আনত হয়ে খলিফাকে কুর্নিশ জানাতে থাকলো।

সুলতান স্মিত মুখে সিংহাসনে বসে বললেন, বেশতো চলছিলো গান, থামালে কেন, সুন্দরীরা?

তারপর দাসীটিকে ইশারা করে বললেন, আমাকেও এক পেয়ালা দে। মদের আসরে মদ না খেয়ে মজা দেখতে নাই।

দাসী পেয়ালা পূর্ণ করে সুলতানের সামনে বাড়িয়ে দিলো। সুলতান সরাবের পেয়ালা ঠোঁটে স্পর্শ করে বললো, এতদিন বাদে আমার খুশ নাহার সেরে উঠেছে—সেই আনন্দে আজ আমি মৌজ করবো।

সুলতান ছোট ছোট চুমুকে কাপটা শূন্য করে দিলো। দাসী আবার পূর্ণ করে দেয়। এবার সুলতানের নজর পড়ে বোরখা-ঢাকা সুন্দরীর দিকে। নাকাবের ফিনফিনে পর্দার নিচে তার কুসুম পেলাব গাল, কাজল কালো ডাগর চোখ, আঙুরের মতো অধর পরিষ্কার দেখা যায়। দাহিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, মেয়েটি তো ভারী খুবসুরৎ! কে?

দাহিয়া বলে, খুশ নোহারের প্রাণের বন্ধু। ওরা কেউ কাউকে না দেখে দু-দণ্ড থাকতে পারে না। একজনের বিরহে দুজনেরই নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

সুলতান খুঁশ বাহার-এর মুখ থেকে নাকাব সরিয়ে দেয়। অদ্যাবধি তার দাড়ি গোঁফ ওঠেনি। মুখে মেয়েলী ভাবটা ষোল আনাই বজায় আছে। তার ওপরে প্রসাধনের প্রলেপ পড়েছে। সন্দেহের কোনোও অবকাশ নাই। আপনাদের হয়তো স্মরণ অ’ছে খুশ বাহারের বা গালে একটা তিল আছে। সারা মুখের গোলাপী আভার মধ্যে ঐ এক বিন্দু কালো তিল কী অপূর্ব সুন্দর-ই যে মনে হয় চোখে না দেখলে বোঝানো যায় না। সুলতান এক ভাবে খুশ বাহারের মুখের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে। নির্মেঘ নীল আকাশের গায়ে শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে ঐ বিন্দুসম কৃষ্ণকালো তিলটি।

ইয়া আল্লাহ, সুলতান উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, আজ থেকে এই নতুন বাঁদীকে আমার রক্ষিতা করলাম। খুশ নাহারের পাশে, ভালো করে সাজিয়ে একটা ঘরে ওর থাকার ব্যবস্থা করে দাও। এখন থেকে সে পাবে শাদী করা বেগমের মর্যাদা।

দাহিয়া বলে, বাঃ, চমৎকার। এর যা রূপের জৌলুস তাতে এই মর্যাদা দিয়ে তুমি সুবিচারই করেছ, ভাই জান।. এই ব্যাপারে তোমাকে একটা ছোট্ট কিসসা শোনাই, -গল্পটা পড়েছিলাম এক নামজাদা লেখকের কিতাবে।

গল্পটা কী, শুনি।

দাহিয়া বলতে শুরু করে :

শুনুন ধর্মাবতার, কুফা শহরে এক সন্ত্রান্ত সওদাগর বাস করতো—। তার একটি মাত্র পুত্র সন্তান-নাম খুশ বাহার। ছোট বেলা থেকে সে তাদের বাড়ীর বাঁদীর এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে খেলা-ধূলা করে মানুষ হতে থাকলো। এইভাবে একদিন তারা কৈশোর-কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিলো। এতদিনে খুশ বাহারের সাখীর দেহে যৌবনের ঢল নেমেছে। তার রূপের জেল্লায় কুফার সুবাদার লুব্ধ হয়ে এক বজ্জৎ বুড়িকে তার পিছনে লাগালো। ধূর্ত শয়তান বুড়িটা ছল চাতুরী করে মেয়েটিকে সুবাদারের প্রাসাদে নিয়ে আসতে পারলো। তারপর সেই বদমাইশ

সাথীকে হারাবার পর থেকে খুশ বাহার-এর নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগলো, সাথীকে খুঁজে পাওয়ার জন্য।

অবশেষে একদিন সে দামাসকাসে এসে সন্ধান পেলো তার প্রিয়তমা সুলতানের হারেমে বন্দী হয়ে দিন কাটাচ্ছে। নান ফিকির করে সে একদিন হারেমের মধ্যে ঢুকে পড়লো। তার ভালোবাসার সঙ্গে মিলনও হলো। দু’জনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে ওরা যখন আনন্দে আত্মহারা সেই সময় সুলতান খবর পেয়ে উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে ছুটে এসে এক কোপে দুজনেরই মাথা নামিয়ে দিলো। কোনও কথাই সে শুনতে চাইলো না, শুনলো না।

লেখক গল্পটা এখানেই শেষ করেছেন। কোনও মন্তব্য করেন নি। তাই ভাইজান, আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, ঐ অবস্থায় তুমি থাকলে, তোমার বিচারে তুমি কী করতে?

সুলতান আবদ আল মালিক ইবন মারবান বললো, এ ব্যাপাবে আমার কোন দ্বিধা নাই, সেই সুলতান ভীষণ অন্যায় কাজ করেছে। যে কোনও লোকেরই গর্দান নেবার আগে কতবার চিন্তা করা উচিৎ। কারণ প্রয়োজন হলে সহস্রবার চেষ্টা করেও আবার আমরা তার প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারি না। সুতরাং প্রাণ নেবার সময় অত তাড়াহুড়া করা তার সঙ্গত হয়নি। যদি ওদের বলার সুযোগ দিতেন, আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, তলোয়ারের বদলে ওদের গলায় পুষ্পহার পরিয়ে দিতেন। তিনি। প্রথমতঃ তারা আশৈশব গভীর প্রেমে আবদ্ধ। দ্বিতীয়ত তারা তখন তার প্রাসাদে মেহেমান। তৃতীয়তঃ সুলতান সব সময়ই স্থিতধী, বিচক্ষণ, ন্যায় বিচারক হবেন। এই সব কথা বিবেচনা করে আমি ঐ সুলতানকে অযোগ্য অপদাৰ্থ ছাড়া কিছুই বলতে পারি না।

শাহজাদী দহিয়া সুলতানের পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে। ধর্মাবতার, তুমি না জেনে, তোমার নিজের মামলার রায় তুমি আজ নিজেই দিয়ে দিলে! আমাদের পুণ্যাত্মা পিতার তুমি যোগ্য সন্তান—তোমার মুখেই এই সব কথা সাজে।

সুলতান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কী? কী ব্যাপার? কিছুই তো বুঝতে পারছি না বোন! ওঠ, কী হয়েছে, নিৰ্ভয়ে বলো, তুমি তো জানি, কোনও অন্যায় অবিচার আমি সইতে পারি না।

খুশ বাহারকে দেখিয়ে দাঁহিয়া বলতে থাকে, বোরখা ঢাকা এই মেয়েটি আসলে ছদ্মবেশী খুশ বাহার। প্রিয়তমার বিরহে উদ্রান্ত হয়ে নিজের জীবন তুচ্ছ করে দুর্ভেদ্য পাহারা পেরিয়ে সে এই হারেমের অন্দরে ঢুকে পড়েছে। জানে, ধরা পড়লে নিৰ্ঘাৎ মৃত্যু, তবু, ভালোবাসার টান এমনই বস্তু, কিছুই সে পরোয়া করেনি। কুফার শয়তান সুবাদার ইউসুফ অল থাফাকী খুস নাহারেকে চুরি করে তোমার কাছে ভেট পাঠিয়েছে। তার দুরাশা, তুমি তার ওপর সস্তুষ্ট হয়ে তাকে আরও উঁচু পদে বহাল করবে। লোকটা ডাহা মিথ্যেবাদী। সে তোমাকে লিখেছিলো, খুশ নাহারকে সে দশ হাজার দিনারে এক সওদাগরের কাছ থেকে কিনেছে। আমি চাই তুমি তাকে সমুচিৎ সাজা দিতে কসুর করবে না। আর এই বাছাদের ক্ষমা করে দেবে। এদের তো কোনও গুনাহ নাই, একটাই এদের অপরাধ, দুজনে দুজনকে গভীরভাবে ভালোবাসে এরা। যাই হোক, এখন এরা তোমার মেহেমান। তোমার আশ্রয়ে এসেছে।

খলিফা বললো, আমার জবান একটাই। তার কোনও নড়াচড় হয় না। খুশ নাহার, যা শুনলাম সব সত্যি? এই খুশ বাহার তোমার ভালোবাসা?

খুশ নাহার মাথা হোঁট করে ঘাড় নেড়ে বলে, এর চেয়ে বড় সত্যি আমার কাছে আর কিছুই নাই, জাঁহাপনা।

খলিফা চিৎকার করে উঠলেন সাবাসী! তোমাদের পুনর্মিলনে আমিই সবচেয়ে খুশি হলাম। যাও তোমরা মুক্ত।

তারপর খুশ বাহারের দিকে তাকিয়ে খলিফা বললো, আমি শুধু জানতে চাই, বাছা, কি করে তুমি হারেমের পাহারাদারদের চোখে ধুলো দিয়ে দুর্ভেদ্য হারেমের অন্দরে ঢুকতে পেরেছ। আর কি করে বা জানিলে, তোমার বিবি বন্দী হয়ে আছে। এই হারেমে?

খুশবাহার করজোড়ে বললো, আমি অকপটে সব কথাই আপনাকে খুলে বলছি, আমার গোস্তাকি মাফ করবেন, হুজুর।

এই বলে সে আদ্যোপোন্ত সব কথাই সবিস্তারে সুলতানকে খুলে বললো। বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হলো সুলতান। পারসী সাহেবের কাছে লোক পাঠালো। বললো, খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে কাড়া নাকাড়া বাজিয়ে বাদশাহী কেতায় তাকে এখানে নিয়ে এসো।

খুশ নাহার আর খুশ বাহারকে সাতটা দিন মহা আদর যত্নে প্রাসাদে রেখে নানা মূল্যবান উপহার উপটৌকন সঙ্গে দিয়ে কুফায় স্বদেশে পাঠিয়ে দিলো সুলতান। কুফার সুবোদরকে বরখাস্ত করে তার জায়গায় খুশ বাহারের বাবা সওদাগর বাহারকে বহাল করলো।

শাহরাজাদ চুপ করলো। সুলতান শাহরিয়ার মুগ্ধ হয়ে বলে, কী সুন্দর তোমার কিসসা, শাহরাজাদ। কিন্তু একটা জিনিস একটু খটকা লাগলো। ভালোবাসার সোহাগ অনুরাগের বিশদ বিবরণগুলো তুমি পাশ কাটিয়ে গিয়েছ। এবং তা ইচ্ছে করেই।

শাহরাজাদ স্মিত হাসে, পরের যে কাহিনীটা বলবো তার মধ্যে এসব মালমসলা পুরোদস্তুর পাবেন, জাঁহাপনা। যদি ধৈর্য ধরে শোনেন তবে এরপর আলা-আল-দিন আবু সামাতের কাহিনী শোনাবো। কিন্তু তাতে আপনার চোখ থেকে ঘুম বিদায় নেবে।

—তা হোক, তুমি বলো। অনিদ্রা রোগে ভুগে মরবো সে-ভি আচ্ছা, এমন মজাদার কিসসা আমি না শুনে ছাড়বো না।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ বলে, আজ আর নতুন কাহিনী শুরু করার সময় নাই। এখন ঘুমান। কাল রাতে শুরু করা যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *