২৪. শ্রাবণমাসের প্রথম সপ্তাহে

চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ

শ্রাবণমাসের প্রথম সপ্তাহে তুলির দ্বিতীয় পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করিল। কাজল আশা করিয়াছিল এবার মেয়ে হইবে। তুলির কাছে একদিন সেকথা বলিতে তুলি বলিল–না, আমার মেয়ে ভালো লাগে না। তুমি যেন কী!

-কেন, মেয়ে হলে কেমন সাজিয়ে মজা! ভালো ভালো ফ্রক, শাড়ি, ফিতে, স্নাে-পাউডার, গয়না সব কিনে দেব। ভালো করে লেখাপড়া শেখাব। তাছাড়া মেয়েরা বাপ-মায়ের যেমন সেবা করে ছেলেরা তেমন পারে না–

তুলি অবুঝ জেদের গলায় বলিল—না, মেয়ে না। আমি ছেলে চাই–

কাজল জিনিসটাকে মেয়েদের স্বাভাবিক পুত্রসন্তান কামনা মনে করিয়া কী একটা রসিকতা করিতে যাইতেছিল। হঠাৎ তাহার চোখ পড়িল স্ত্রীর দিকে। তুলি বিবর্ণমুখে কেমন যেন শক্ত হইয়া বসিয়া আছে। সচরাচর যে কোন বিষয়ে জেদ করে না, তাহার স্বভাবে তিক্ততাও নাই। সে এমন স্বরে কথা বলিতেছে কেন?

হঠাৎ সে বুঝিতে পারিল।

নিজের বঞ্চিতা মায়ের কষ্ট, অপমান আর পরাধীনতার কথা তুলির মনে পড়িয়াছে। সে নিজে মেয়ে, বিবাহিত জীবনে সে সুখীও বটে, কিন্তু তবু তুলি কন্যাসন্তান চায় না।

বাংলাদেশের চিরকালের অভিশাপ। তবে দিন বদলাইতেছে। বদল সব যেমন ভালো নয় আবার সব খারাপও নয়। নারী পূর্ণ মর্যাদা পাইবে এমন দিন আসিতেছে। সবটা সে দেখিয়া যাইতে পারিবে না। তাহার ছেলেরা দেখিবে।

অপুর খ্যাতি ক্রমে পাঠকদের মধ্যে সকালের আলোর মতো ছড়াইয়া পড়িতেছে। বড়ো বড়ো সমালোচক, সম্পাদক আর অধ্যাপকেরা তাহাকে চিরকালের ধ্রুপদী সাহিত্যিক বলিয়া প্রবন্ধ লিখিতেছেন, ক্লাসে বক্তৃতা দিতেছেন! স্বাধীনতার পরে কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় সাহিত্যের প্রচারের জন্য সংস্থা করিয়াছেন, সেখান হইতে অপুর বই বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ হইয়া বাহির হইতেছে। স্কুলের, কলেজের আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে উঠিয়াছে। স্টপ গ্যাপে কখনও স্কুলে বাংলার ক্লাস লইতে গেলে ছাত্ররা বলে-স্যার, আপনার বাবার পিসটা পড়ান। পড়ানো শেষ হইলে বলে—বাবার গল্প বলুন স্যার, আমরা শুনবো-কাহারও সঙ্গে নতুন আলাপ হইলে মানুষ শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকায়।

কাজল মনে মনে হাসিয়া ভাবে আমি হলাম চাদের মতে, অন্য জ্যোতিষ্কের আলোয় উজ্জ্বল। লোকে আমাকে সম্মান দেয়, আমার বাবার খাতিরে। আমার বোধহয় আর কিছু হল না—

মনের মধ্যে একটু কষ্ট হয় কি? হয় বোধহয়। কিন্তু গৌরব আর আনন্দ তুলনায় এত বেশি। যে, বিষণ্ণতা সেখানে কোনো দাগ ফেলিতে পারে না।

বাবার প্রতি তাহার মনোভাব সে কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে পারিবে না। পারিবাহিক সম্পর্কের ঘনিষ্ট-মধুর অনুভূতি তো আছেই, কিন্তু তাহা অপেক্ষাও অনেক বড় কিছু মনকে পরিপূর্ণ করিয়া তোলে। বাবা কেবল শৈশবের জয়গান গায় নাই, কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নিমগ্ন থাকে নাই—যেমন অনেক পাঠক মনে করে। অস্তিত্ব আর জীবনের গৃঢ়তম রহস্যের দিকে বাবা পুলকিত বিস্ময় লইয়া তাকাইয়াছে। চেষ্টা করিয়াছে, তাহার সঙ্গে সকলকে সেই আনন্দময় জগতের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাইয়া দিতে। আগামী বহু শতাব্দীতেও তাহার বাবার মতো সাহিত্যিক আর আসিবে না।

গেলই না হয় একটা জীবন বড়ো একজন লেখকের ছায়ায় ছায়ায়। সে তাহার বলিবাব কথা লিখিয়া রাখিয়া যাইবে, সে পাঠকেরা গ্রহণ করুক আর নাই বুক। কিন্তু একথা সত্য যে, শত বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও জীবন বড় সুন্দর। বড় আনন্দের।

একদিন স্কুল হইতে ফিরিয়া কাজল দ্বিজেনবাবুর একখানা চিঠি পাইল। তিনি অবিলম্বে একবার দেখা করিতে বলিযাছেন। জরুবি প্রয়োজন।

পরের দিনই কাজল কলকাতায় গেল। বসু ও গুহ পাবলিশার্সের ঘরে আরামকেদাবায আজ প্রমথবাবু আসীন। পাশেব চেয়ারে দ্বিজেনবাবু বসিয়া সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। কাজল ঢুকিতে ঢুকিতে শুনিল দ্বিজেনবাবু বলিতেছেন–যাও না প্রমথ, কলেজ স্ট্রীট মার্কেটে কী কিনতে যাবে বলছিলে। দেরি না করে এইবেলা ঘুরে এস—

কথায় ভুলিয়া বন্ধু একবার বাহির হইলেই হয়! অমনি সন্ধ্যার মতো কেদারা দখল।

কিন্তু প্রমথবাবু বন্ধুকে আশৈশব চেনেন। তিনি উদাস গলায় বলিলেন—যাবখন। পবে যাব–

কৌশল বিফল হওয়ায় দ্বিজেনবাবু চটিয়া পা নাচাইতে লাগিলেন। ঠিক এই সমযেই কাজল ঘরে ঢুকিল। দ্বিজেনবাবু বলিলেন—এই যে তুমি এসেছ, আমার চিঠি পেয়েছ তো?

কাজল দুজনকে প্রণাম কবিযা বলিল—চিঠি পেয়েই তো আসছি। কী ব্যাপার কাকাবাবু?

–বোসো, বলছি। অপূর্ববাবুর দিনলিপির প্রোডাকশন কেমন লাগল?

–খুব ভালো কাকাবাবু। কভার, ছাপা সবই ভালো। কেমন চলছে বইখানা?

–ভালো। কিছুটা সেইজন্যই তোমাকে ডাকা। তোমার বাবাব ডায়েবি আমরা একটু দ্বিধা নিয়ে ছেপেছিলাম সেকথা স্বীকার করছি। প্রমথ ছাড়া সবাই ভয় দেখিয়েছিল। কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে। অপূর্ববাবু সম্বন্ধে আমাদের ধারণাই সঠিক।

কাজল চুপ করিয়া রহিল।

মাথার উপরে পুরানো ডিসি পাখাটা শব্দ করিয়া ঘুরিতেছে।

দ্বিজেনবাবু বলিলেন—আমরা তোমার বাবার রচনাবলী প্রকাশ করতে চাই।

কাজল অবাক হইয়া তাঁহার দিকে তাকাইল। সে ঠিক শুনিতেছে তো? রচনাবলী! তাহার বাবার! রচনাবলী তো রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র এঁদের বাহির হয়। মানে, যাঁদের ছবি ক্যালেন্ডারে থাকে। বাবা সেইখানে পৌঁছাইয়া গেল নাকি?

প্রমথবাবু বলিলেন—আমরা মোটামুটি একটা স্কীমও করে ফেলেছি। সমস্ত সেটটা দশ ভলমে কমপ্লিট হবে। তোমার মা রাজি হলেই আমরা গ্রাহকভুক্তির জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দেব

কাজল বলিল—বাবার রচনাবলী! দশ ভলমে। খুব আনন্দের কথা কাকাবাবু, কিন্তু জিনিসটা কমার্সিয়ালি ভায়েবল হবে তো? বাবার বই এমনিতে ভালোই বিক্রি হয় জানি, পাঠকেরা বাবাকে ভালোবাসে। কিন্তু রচনাবলী অন্য জিনিস। আপনারা কিন্তু ভেবে দেখুন—

দ্বিজেনবাবু বলিলেন—আমরা ভেবে দেখেছি। অপূর্বাবুকে আমরা ভালোবাসি ঠিকই কিন্তু এই ব্যবসাটাও আমাদের চালাতে হয়। বাজারে চলবে না এমন বই আমরা ছাপাই না। তোমার বাবার যুগ এসে গিয়েছে কাজল। আধুনিক লেখকদের মধ্যে ওঁরই প্রথম রচনাবলী হবে–

প্রমথবাবু বলিলেন—দশ খণ্ডে কী থাকবে তা আমরা ছকে ফেলেছি। দেখাচ্ছি তোমাকে–

দেয়ালের গায়ে বইয়ের তাকে রাখা ব্যাগ হইতে কাগজখানি বাহির করিবার জন্য তিনি উঠিতেই টুক করিয়া দ্বিজেনবাবু চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। কাগজ বাহির করিয়া পেছন ফিরিয়া প্রমথবাবু বলিলেন—এই যে, দেখ—উপন্যাসগুলো ক্রোনোলজি ফলো করে—এ কী! এ তো ভারি–যাঃ!

দ্বিজেনবাবু নির্বিকার। পৃথিবীতে কোথাও কোনো অশান্তি নাই। তিনি কাগজ পড়িতেছেন।

সমস্ত পরিকল্পনাটা কাজল বুঝিয়া লইল। মা কখনওই আপত্তি করিবে না। তবু সে বলিল মাকে জিজ্ঞাসা করিয়া সে সামনের সপ্তাহেই আবার আসিবে।

মাসখানেকের মধ্যে সমস্ত বাংলা সংবাদপত্র আর সাময়িকপত্রে অপূর্বকুমার রায়-এর রচনাবলীর বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হইল। সকলেই যে খুশি হইল এমন নহে, তবে কাজল পৃথিবীর আসল রূপ অনেকটা দেখিয়া ফেলিয়াছে, সে অবাক হইল না।

বিজ্ঞাপন বাহির হইবার কিছুদিন পরে কাজল বসু ও গুহ পাবলিশার্সে গেল। তাহাকে দেখিয়া দ্বিজেনবাবু খুশি হইয়া বলিলেন—এই যে, এসো এসো। আবার তোমাকে একটা চিঠি দেব ভাবছিলাম। তা তুমি এসেই পড়েছ

–কেন কাকাবাবু?

দ্বিজেনবাবু আনন্দের হাসি হাসিয়া বলিলেন—আমাদের ধারণাই ঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। সবাই বলেছিল অপুর্ববাবুর রচনাবলী ছাপছেন, আপনাদের কি পয়সা বেশি হয়েছে? কী দেখেছেন মশাই ও লেখকের মধ্যে? হ্যাঁ, একটা দুটো বই দাঁড়িয়ে গিয়েছে তা স্বীকার করি। কিন্তু তা বলে রচনাবলী? ও জিনিস বাজারে কাটবে না—

কাজল ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিল বিজ্ঞাপনের ফিডব্যাক কী রকম কাকাবাবু?

-ভালো। খুব ভালো। এর মধ্যেই আমরা পাঁচহাজার গ্রাহক পেয়েছি। শুধু মুখে নয়, রীতিমত টাকা জমা দিয়ে নাম লিখিয়েছে। প্রথম খণ্ড বেবুবার আগে আরও কিছু পাব আশা রাখি। এইবাব বুঝলে এই সবজান্তা পণ্ডিতেরা কত মূখ? দু একজন এসে গ্রাহকদের লাইন দেখে পালিয়ে গিয়েছে, আমাদের সঙ্গে আর দেখা করেনি।

অপুর রচনাবলীর প্রথম খণ্ড বাহির হইবার দিন বসু ও গুহ পাবলিশার্স একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করিলেন। বাংলা সাহিত্যের নামি লেখকেরা ছাড়াও অনেক সাধারণ পাঠকের দল আসিয়া ভিড় জমাইল। কাজল হৈমন্তী আর তুলিকেও সঙ্গে আনিয়াছিল। মানুষের ভিড় দেখিয়া তুলি চুপি চুপি স্বামীকে বলিল–উঃ! অনেক লোক হয়েছে, তাই না?

হৈমন্তীর চোখে জল। সে সভা দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছিল। এতটা সে আশা করে নাই।

অপুর একটা ভালো ছবি দ্বিজেনবাবু কাজলের কাছে চাহিয়া লইয়াছিলেন। সেটি বড়ো করিয়া বাঁধাইয়া মঞ্চে রাখা হইয়াছে। সভাপতি একজন প্রবীণ সাহিত্যিক, তিনি অর ছবিতে মালা দিয়া পাশে রাখা প্রদীপ জ্বালাইয়া সভার উদ্বোধন করিলেন।

কাজলের মনে হইল মালা পরিয়া বাবা যেন হাসিতেছে। কী সুন্দর দেখাইতেছে বাবাকে। কত লোক তো সে জীবনে দেখিল, তাহার বাবার মতো কি কেহ দেখিতে সুন্দর

একের পর এক বক্তা উঠিয়া অপুর সাহিত্য সম্বন্ধে বলিতেছেন। শনিতে শুনিতে কাজলের যেমন ভালো লাগিতেছিল, আবার এ কথাও মনে হইতেছিল-সবটা এরা ঠিক বুঝতে পারেন নি। বাবার ব্যক্তিগত জীবনকেও আলোচনার মধ্যে ধরতে হবে। এঁরা যা বলছেন বাবা তার চেয়েও অনেক বড়ো। যাক, একজন সাহিত্যিকের যথার্থ মূল্যায়ন হতে তো সময় লাগেই–

তবে এ কথা সে বুঝিল যে, বাংলা সাহিত্যের জগতে তাহার বাবার আসন পাকা হইয়া গিয়াছে। আলোচনা হয়তো অনেক হইবে, কিন্তু তাহার বাবার শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে কেহ প্রশ্ন তুলিবে না।

সভা শেষ হইলে লেখকেরা অনেকেই আসিয়া হৈমন্তীর সঙ্গে আলাপ করিলেন। দ্বিজেনবাবু বলিলেন—বৌদি, একটা কথা আপনাকে বলব ভাবছিলাম। আজ দেখা হয়ে ভালো হল। আপনি অপূর্ববাবুর একটা স্মৃতিকথা লিখুন না, সমালোচনা বা মূল্যায়ন নয়, কীভাবে আপনাদের পরিচয়, জীবনের ছোট ছোট ঘটনা—এই আর কী। অনেক খদ্দের কাউন্টারে জিজ্ঞাসা করে—অপূর্বকুমার রায়ের কোনো জীবনী পাওয়া যায় না? বাজার তৈরি আছে বৌদি, আপনি লিখুন—

হৈমন্তী বলিল–আমি কি পারব ঠাকুরপো? উনি অনেক বড়ো মানুষ ছিলেন–

—আপনিই পারবেন, আর কেউ এ কাজ পারবে না। পাঠক অধ্যাপকের তাত্ত্বিক আলোচনা চায় না, মানুষটার জীবনের গল্প জানতে চায়। সে আর আপনি ছাড়া কে পারবে?

অপুর জীবনী হৈমন্তী এমনিতেই একখানা লিখিতেছিল, এইবার উৎসাহ পাইয়া দ্রুত শেষ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। আগে সে গল্প-কবিতা লিখিয়াছে, লিখিয়া উপার্জনও করিয়াছে, কিন্তু নিজের সহজ বুদ্ধি প্রয়োগ করিয়া সে বুঝিতে পারিল এইবার কাজ অনেক কঠিন। যাহার জীবনকাহিনী সে লিখিতে বসিয়াছে তাহার কথা সম্ভবত আগামী অনেক শতাব্দী মনে রাখিবে। কিন্তু বাদ দিলে চলিবে না। যতই তুচ্ছ হোক, সবকিছু লিখিয়া রাখিতে হইবে। তাহার চাইতে ভালো করিয়া তাহার স্বামীকে কেহ চেনে না, একদিন হয়তো তাহার লেখা হইতেই গবেষকরা উপাদান সংগ্রহ করিবে।

সাদা পটভূমিতে হালকা জলরঙের কাজ যেমন একটু একটু করিয়া শিল্পীর তুলির স্পর্শে ফুটিয়া ওঠে, তেমনি হৈমন্তীর কলমে মূর্ত হইয়া উঠিল পেছনে ফেলিয়া আসা বাসন্তী দুপুর, দিনের কাজের ফাঁকে অকারণ চকিত চাহনি, ঘন বর্ষার দিনে জানালার পাশে চেয়ার পাতিয়া কবিতা পড়া, গান গাওয়া। লিখিতে লিখিতে মনে পড়িয়া গেল স্বামীর পাশে ঘুম ভাঙিয়া জানালার পাশে ছোট রাধাচূড়া গাছটার দিকে তাকাইয়া থাকিবার কথা। সূর্য ওঠে নাই, মেঘলা আকাশের পটে লাল ফুলের গুচ্ছ। তাকাইয়া থাকিতে থাকিতেই একটা টুনটুনি পাখি আসিয়া গাছের ডালে বসিয়াছিল। জানালার তিন হাতের মধ্যে গাছটা। অত কাছ হইতে সে আর কখনও টুনটুনি দেখে নাই। অসম্ভব রকমের ছোট আর ক্ষিপ্র পাখিটা। সকালবেলা জাগিয়া উঠিবার আনন্দে কী কবিবে ভাবিয়া পাইতেছে না।

কত–কতদিন হইয়া গেল তারপর। সে পাখি আর বাঁচিয়া নাই।

পথের ধারে ফুটিয়া থাকা হলুদ রঙের বুনোফুল তুলিয়া স্বামী তাহার চুলে পরাইয়া দিয়াছিল। পর্বতসানুর অরণ্যে জ্যোৎস্নারাত্রে দাঁড়াইয়া তাহাকে বলিযাছিল—শক্তিমতী হও, এই বিশ্ব, এই প্রকৃতির প্রসাদ তোমার অন্তরে নেমে আসুক। স্রষ্টাকে জানো, আদিত্যবর্ণ সেই পুরুষকে, অন্ধকারের পরপাবে যার স্থিতি, ত্বমেব বিদিত্বাতি মৃত্যুমেতি–

প্রতিদিনের আপাততুচ্ছতা দিয়া তৈরি জীবনের মহৎ স্থাপত্যের কথা সে বলিয়া যাইবে।

খুব জেদের সঙ্গে কোনো কাজ করিবার সময় মানুষ নিজেকে ভুলিয়া তাহা করে। হৈমন্তী অপুর জীবনী সেই জেদ লইয়া লিখিতেছিল। লেখা শেষ হইতে কাজল যেদিন পাণ্ডুলিপি দ্বিজেনবাবুর কাছে পৌঁছাইয়া দিয়া আসিল, তাহার দিন সাতেক পরেই হৈমন্তী গুরুতর অসুখে পড়িল। আগে হইতেই তাহার শরীর ভালো যাইতেছিল না, কেবল মনের জোরে সে আসন্ন অসুস্থতাকে ঠেকাইয়া রাখিয়াছিল। এবার সে শয্যা নিল। ক্ষুধা নাই, শরীরে শক্তি নাই, চোখে কেমন একটা উদাসীন নিস্পৃহ দৃষ্টি। কলিকাতা হইতে বড়ো ডাক্তার আসিয়াও দেখিলেন। বিশেষ কিছু উপকার হইল না। ডাক্তারকে কাজল জিজ্ঞাসা করিল—কেমন বুঝছেন ডাক্তারবাবু? কী হয়েছে মায়ের?

চিকিৎসক বলিলেন–ইন ফ্যাক্ট, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। ওঁর শরীরের যন্ত্রপাতি সবই ঠিকঠাক ফাংশান করছে। প্ৰেশার নেই, ব্লাড সুগার নেই, হার্ট এই বয়েসের তুলনায় মোটামুটি ভালো। আসলে আমার মনে হয় ওঁর বাঁচার ইচ্ছেটাই যেন কমে গিয়েছে। এ রকম হয়। ইনভলভূমেন্ট নেই, কিছুর সঙ্গে উনি আর তেমন যোগাযোগ অনুভব করছেন না–

-এর চিকিৎসা কী? কিছু নিশ্চয় করার আছে?

–পেসেন্টকে আনন্দে রাখুন, কাছে বসে গল্পগুজব করুন। আমি একটা বলকারক ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি, তাতে হয়তো কিছুটা কাজ হবে। অবশ্য আপনি আরও সিনিয়র কারও মত নিতেই পারেন–

বাহিরে আসিয়া কাজল বলিল—ডাক্তারবাবু, আপনার দক্ষিণা কত ঠিক জানি না। একটু যদি–

ডাক্তার বলিলেন—দক্ষিণা দিতে হবে না। আপনার বাবা আমাদের দেশের গর্ব। অপূর্ব রায়েব স্ত্রীর চিকিৎসা করে পয়সা নিতে পারব না। যে যাই বলুক, ডাক্তাররা একেবারে চামার নয়–

কাজলের চোখে জল আসিল। কত শ্রদ্ধা করে মানুষ তাহার বাবাকে! ধরা গলায় সে বলিল—ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু, অনেক ধন্যবাদ

ঘরে আসিয়া সে হৈমন্তীর পাশে বসিল। বলিল–মা, ডাক্তারবাবু তো বললেন তোমার কোনো অসুখই নেই। একটু দুর্বলতা আছে, তার জন্য ওষুধ দিয়েছেন, সেটা খেলে দুর্বলতা কেটে যাবে। এবার মনে জোর এনে উঠে পড় দেখি, আমাদের আর চিন্তায় রেখো না

হৈমন্তী ম্লানভাবে হাসিল। ছেলের গায়ে হাত বুলাইয়া বলিল—তুই কিন্তু বড়ো বোগা হয়ে যাচ্ছিস–

কাজল বলিল—মা না দেখলে ছেলে তো রোগা হবেই।

হৈমন্তী বলিল–তা কেন, মা কি কারও চিরদিন থাকে? কেমন লক্ষ্মীর মতো বৌমা এসেছে, বৌমার হাতে সব ভার দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি

—সে ছেলেমানুষ। তোমাকেই সব আবার বুঝে নিতে হবে। আমি বুঝতে পেবেছি, তোমার হচ্ছে আমার আর বৌমার ঘাড়ে কাজ চাপিয়ে দেবার ফন্দি। ওসব চলবে না, চটপট সেরে ওঠো–

হৈমন্তী কিছু না বলিয়া চুপ করিয়া তাকাইয়া থাকিল।

মায়ের বইখানা তাড়াতাড়ি প্রকাশ কবিবার জন্য কাজল খুব খাঁটিতে লাগিল। প্রায়দিনই বিকালে দ্বিজেনবাবুর দোকানে গিয়া প্রুফ দেখিয়া দেয়, প্রচ্ছদ সম্বন্ধে পরামর্শ করে। ছবি থাকিবে কী না সে বিষয়ে আলোচনা হয়।

সে ডাক্তার নয়, চিকিৎসাশাস্ত্রের কিছু বোঝেও না। কিন্তু মায়ের চোখের দিকে তাকাইয়া সে বুঝিতে পারিয়াছে মা আর বাঁচিবে না। সংসার হইতে মায়ের মন উঠিয়া গিয়াছে। বড় সাধের বই মায়ের, বইখানা যেন মা দেখিয়া যাইতে পারে–

বইখানা যেদিন প্রকাশ হইবার কথা সেদিন কাজল স্কুল কামাই করিয়া প্রায় সকাল হইতে দ্বিজেনবাবুর দোকানে গিয়া বসিয়া থাকিল। বেলা একটা কী দেড়টা নাগাদ দপ্তরীখানা হইতে প্রথম লট বাঁধাইয়া আসিল। দপ্তরীর লোক ঝাকাটা মাথা হইতে নামাইয়া রাখিতেই দ্বিজেনবাবু এককপি বই হাতে তুলিয়া লইয়া বলিলেন–বাঃ, বেশ হয়েছে। নাও, দেখ—

প্রখ্যাত এক শিল্পীর আঁকা অপুর ছবি দিয়া কভার ইয়াছে। বিস্কু রঙের জমির ওপর গাঢ় খয়েরি রঙ দিয়া আঁকা রেখাচিত্র। বেশ হইয়াছে বই।

পাঁচকপি বই লইয়া বিকালে কাজল বাড়ি ফিরিল। তাহার অপেক্ষায় তুলি বারান্দায় বসিয়াছিল, তাহাকে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল—কী হল? বেরিয়েছে বই? কই, দেখি—

তাহার পর দুইজনে হৈমন্তীর ঘরে গিয়া তাহার বিছানার পাশে দাঁড়াইল। কাজল বলিল—মা, এই দেখ, তোমার লেখা বই বেরিয়েছে। দেশ—

হৈমন্তী বইখানা হাতে লইল। কাজল গিয়া ঘরের আলো জ্বালিয়া দিল। তুলি একটু আগে ঘরে ধূপকাঠি জ্বালিয়া দিয়া গিয়াছে। মা চন্দন ধূপ ভালোবাসে। ঘরের বাতাসে চন্দনের মৃদু সৌরভ।

হৈমন্তী বইয়ের প্রচ্ছদের দিকে অনেকক্ষণ তাকাইয়া থাকিল। তারপর বই খুলিয়া উৎসর্গপত্রটা ভালো করিয়া পড়িল। জীবনের প্রথম এবং সম্ভবত শেষ বইখানি সে স্বামীকে উৎসর্গ করিয়াছে। যাহার জীবনী তাহাকেই।

বই মুড়িয়া বালিশের পাশে রাখিয়া হৈমন্তী বলিল–সুন্দর বই হয়েছে। মলাটে তোর বাবার ছবি কে এঁকেছে রে? আমার নাম করে বলিস—ছবি ঠিকঠাক আঁকা হয়েছে। বৌমা, ওকে কিছু খেতে দাও। সেই সকালে খেয়ে বেরিয়েছে—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *