দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
এ বছর ঘোর বর্ষা নামিয়াছিল। অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাতের বহর দেখিয়া সকলে মনে করিয়াছিল এবার বন্যা না হইয়া যায় না, দুর্গাপূজাও বোধহয় নিতান্তই মাটি হইল। কিন্তু পূজার দিনদশেক আগেই বর্ষা শেষ হইয়া ঝকঝকে শরতের আকাশ বাহির হইয়া পড়িল। সারাদিন সুনীল আকাশে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘ ভাসিয়া যাইতেছে, বাতাসে আসন্ন উৎসবের আনন্দময় স্পর্শ। কাজলের আর পাড়ায় পাড়ায় ঘুরিয়া ঠাকুর দেখিয়া বেড়াইবার বয়েস নাই, তবু তাহার মনে অদ্ভুত আনন্দ ছড়াইয়া পড়িল। ঘরের বাহির হইতেই হইবে তাহার কোনো মানে নাই, চারিদিকে ঢাকের শব্দ আর অনেক মানুষের আনন্দকোলাহলের মধ্যে ভালো একখানি বই হাতে জানালার পাশে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে মন্দ লাগে না।
মহালয়ার দিন সকালে স্নান করিয়া মায়ের পূজা করিবার শাড়িটি ধুতির মতো করিয়া পরিয়া কাজল ভিতরের বারান্দায় তৰ্পণ করিতে বসিল। পরলোক এবং আত্মার অবিনশ্বরতা ইত্যাদি বিষয়ে কাজল অন্যান্য সাধারণ মানুষেরই মতাবলম্বী—অর্থাৎ আগনস্টিক। তাহার বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনোটাই খুব প্রবল নহে, কিন্তু চিরাচরিত জাতীয় ঐতিহ্য পালন করিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালোই লাগে। কে জানে সত্যই মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্ব থাকে কিনা, কিন্তু তাহার জ্ঞানের সীমানার বাহিরেও তো জগৎটা অনেকখানি প্রসারিত। যদি কিছু থাকে, যদি সন্তানের উৎসর্গ করা জল সত্যই কোনোভাবে স্বৰ্গত, পিতার তৃষ্ণা নিবারণ করে—আর কিছু না হোক, অন্তত এইভাবে বৎসরে একদিন তো পূর্বপুরুষদের নাম সংসারে উচ্চারিত হইতেছে। তর্পণের মাধ্যমে পারিবারিক ইতিহাসের সহিত বর্তমানের সুন্দর একটা গৌরবময় সেতু প্রস্তুত হয়।
আর কী সুন্দর মন্ত্রগুলি! পিতা পিতামহ এবং পিতৃমাতৃকুলের সকল স্বৰ্গত মানুষেরা তো বটেই, তাহা ছাড়া পৃথিবীতে যেখানে যত বান্ধবহীন মানুষ মৃত্যুবরণ করিয়াছে, তৃষ্ণার্ত বা অগ্নিদগ্ধ হইয়া প্রাণবিসর্জন করিয়াছে, তাহারা সবাই যেন আমার প্রদত্ত এই জল পান করিয়া তৃপ্তিলাভ করে। জল প্রকৃতই কোথায় পৌঁছায় কে জানে, কিন্তু তাবৎ বিশ্বজনের সহিত আত্মীয়তা অনুভব করিবার জন্য অনুষ্ঠানটি সহায়তা করে।
কোথায় স-তিল গঙ্গাজল লইয়া বাবার নাম উচ্চারণ করিবার সময় যেমন উদার আনন্দ হয়, তেমনই একটা চাপা অভিমানে বুক ভরিয়া ওঠে। সে জানে, বাবা ইচ্ছা করিয়া অসময়ে চলিয়া যায় নাই। তবু বাবার উপর অবুঝের মতো রাগ হয়। প্রকৃতপক্ষে ইহা বিশ্বসংসারের দুর্দঘ্য নিয়মের প্রতি অসহায় আক্রোশ মাত্র।
দুপুরবেলা কাজল কী একখানা বই লইয়া নিজের ঘরে শুইয়া পড়িবার চেষ্টা করিতেছিল, এমন সময় বাহিরের দরজার কড়া নড়িয়া উঠিল।
কাজল একটু অবাক হইল। এখন বেলা আড়াইটা হইবে, এই সময়টা সাধারণত গৃহস্থবাড়িতে অতিথি আসে না। তবে পিওন হইতে পারে।
একান্ত বিস্ময়ের কিছু ঘটিলে মানুষের মস্তিষ্কে জোর ঝাকুনি লাগে, সামনে যাহা ঘটিতেছে তাহা চোখে দেখিলেও তাহার মর্মার্থ হৃদয়ে প্রবেশ করিতে সময় লাগে। দরজা খুলিয়া কাজলেরও ঠিক তাই হইল।
অপালা আসিয়াছে।
কিছুক্ষণ বিহুলভাবে তাকাইয়া থাকিবার পর কাজল বলিল—তুমি! আমার বাড়ির ঠিকানা পেলে কী করে? আগে কোনো খবর দাওনি তো!
অপালা হাসিয়া বলিল—ইচ্ছে করেই দিইনি। কেমন সারপ্রাইজ হল, বলুন তো?
কাজল কিছুটা সামলাইয়া বলিল—এসো এসো, ভেতরে এসো–
হৈমন্তী নিজের ঘরে ঘুমাইতেছে। ইদানীং তাহার শরীর ভালো যাইতেছে না। দুপুরে খাইবার পর একটা বই লইয়া শুইলে আপনিই চোখের পাতা খুঁজিয়া আসে। নিতান্ত প্রয়োজন না হইলে কাজল এই সময়টা মাকে ডাকে না।
একমুহূর্ত দ্বিধা করিয়া কাজল অপালাকে নিজের ঘরেই আনিয়া বসাইল।
অপালা আঁচল দিয়া গলার ঘাম মুছিয়া ঘরের চারিদিকে তাকাইয়া দেখিল। বলিল—পড়ুয়া লোকের ঘর যে সেটা বোঝা যায়–
-কী করে বুঝলে? বই দেখে?
-না, বই অনেকের বাড়িতেই থাকে, সবাই কী পড়ে? ও সাজানোই থাকে। আসলে যারা সত্যি বই পড়ে তাদের বইপত্ৰ অগোছালো হয়। এইরকমই ভালো—আপনি যেন আবার গোছাতে গিয়ে ঘরের শ্রী নষ্ট করবেন না। আপনার মা কই? আজ কিন্তু মায়ের সঙ্গে আলাপ করবো বলেই আসা–
কাজলের বিস্ময়ের ঘোরটা তখনও ঠিকঠাক কাটে নাই। নির্জন দুপুরে একজন সুন্দর তরুণী তাহার ঘরে বসিয়া গল্প করিতেছে—এ অভিজ্ঞতা তাহার জীবনে একেবারেই নতুন। সে বলিল—মা শুয়ে আছেন, বোধহয় ঘুমোচ্ছন। মার শরীর কিছুদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। একটু পরে উঠলে তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। তুমি আমার বাড়ি চিনলে কী করে? অনেক খুঁজতে হয়েছে?
অপালা কাজলের দিকে তাকাইয়া বলিল—ভালো।
অবাক হইয়া কাজল বলিল—কী ভালো?
নিজেদের খ্যাতি সম্বন্ধে উদাসীন থাকা ভালো। একমাত্র মহতেরাই পারে—
–কী বলছে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।
অপালা বলিল–আপনার বাবার নাম কত জানেন? সমস্ত দেশের লোক আজ তাকে পুজো করছে। স্টেশনে নেমে একজনকে জিজ্ঞাসা করতে সে একেবারে বাড়ির দরজায় এনে পৌঁছে দিয়ে গেল।
অপালা দেখিতে আরও সুন্দর হইয়াছে। আগে শুধুই সুন্দর ছিল, এখন সৌন্দর্যের সহিত নবোমেষিত ব্যক্তিত্ব মিশিয়া তাহাকে একটি দুর্লভ মহিমা দান করিয়াছে। চোখে চোখ পড়িলে
লজ্জিত হইবে জানিয়াও কাজল মুগ্ধচোখে অপালাকে দেখিতেছিল।
বাতাসে জানালার বাহিরে গাছের পাতায় মর্মরশব্দ উঠিল। অপালা জানালার কাছে গিয়া দাঁড়াইল।
—এটা কী গাছ, টগর না?
কাজল বলিল—হ্যাঁ। খুব ফুল ফোটে, জ্যোৎস্নারাত্তিরে ঘরের আলো নিভিয়ে গাছটার দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে ভারি ভালো লাগে।
—আপনার লেখার খবর শোনান, নতুন কিছু লিখছেন না?
নিজের লেখা সম্বন্ধে কাজল সাধারণত কাহারও সঙ্গে আলোচনা করে না। কিন্তু অপালার সামনে তাহার সমস্ত সংকোচ কাটিয়া গেল, বলিল—একটা উপন্যাস লিখছি। সবে ধরেছি, শেষ হতে দেরি আছে—
অপালা আগ্রহের সহিত বলিল—কী নিয়ে লিখছেন? বলবেন গল্পটা?
—গল্পটা বলা কঠিন, কারণ সেই অর্থে এতে কোন নাটকীয়তা নেই। একজন ছেলের একটু একটু করে বড়ো হয়ে ওঠার গল্প। কেউ ছাপবে কিনা, ছাপলেও পাঠকরা পড়বে কিনা তা জানি না। তবে তুমি দেখতে পারো ইচ্ছে করলে–
পাণ্ডুলিপিটি আনিয়া অপালার হাতে দিতে সে গভীর মনোযোগের সহিত পড়িতে শুরু করিল। কাজল হাসিয়া বলিল–চল্লিশ-পঞ্চাশ পাতা লেখা হয়েছে, সবটাই এখন বসে পড়বে নাকি? কথা বলবে না?
অপালার মুখে বিভিন্ন আবেগ স্পষ্ট হইয়া ফোটে। সে সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের সঙ্গে বলিল—আমি এর আগে কখনও কোন লেখকের পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে দেখিনি, জানেন? এই প্রথম। তাও আবার অপ্রকাশিত রচনা, কেউ দেখার আগেই আমি পড়ছি! অদ্ভুত লাগছে। এই দেখুন, আমার গায়ে কাঁটা দিয়েছে—
-তোমার চেয়ে আমার অদ্ভুত লাগছে বেশি। আমি এখনও একটা লেখকই নই, গুটি চারপাঁচ গল্প এখানে-ওখানে ছাপা হয়েছে মাত্র, আমার লেখা কেউ আগ্রহ করে পড়ছে, এটা আমার কাছে একটা নতুনত্ব। তুমি বোসো, আমি আসছি একটু।
হৈমন্তীর সবে ঘুম ভাঙিয়াছে। কাজল আসিয়া খাটের ধারে বসিয়া বলিল—মুখে-চোখে জল দিয়ে একবার আমার ঘরে চলো মা, একটি মেয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে
অবাক হইয়া হৈমন্তী বলিল–মেয়ে? কে এসেছে রে?
-তুমি চিনবে না মা। আমার এক বন্ধুর বোন–
এরপরে যে দুই-তিনটি প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই আসিয়া পড়ে সেগুলি হৈমন্তী চাপিয়া গেল। কাজল নিজেই যেন কিছুটা কৈফিয়তের সুরে বলিল—একবার পিকনিক করতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল। বাংলাদেশে থাকেনা মা–বাইরে মানুষ হয়েছে বলে একা একা চলাফেরা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। বাবার লেখার খুব ভক্ত, তাই আর কি
হৈমন্তী বলিল–এসেছে সে তত ভালোই। তুই গল্প কর গিয়ে, আমি কাপড়টা বদলে আসছি–
ঘরে ফিরিয়া কাজল দেখিল জানালার ধারে হাতলওয়ালা চেয়ারটা টানিয়া বসিয়া অপালা একমনে তাহার লেখা পড়িতেছে। তাহাকে দেখিয়া মুখ তুলিয়া একবার হাসিল, তারপর আবার পড়িতে লাগিল।
মায়ের আসিতে অদ্ভুত মিনিট দশ-পনেরো দেরি আছে। কাজল একটা সিগারেট ধরাইয়া সামনের সরু বারান্দায় গিয়া দাঁড়াইল। এখান হইতে অপালাকে স্পষ্ট দেখা যায়। টগর গাছের পাতায় বৈকালী রৌদ্র পড়িয়াছে, পাঠিকার মুখে তাহার আভা। এক-একটা এমন চমৎকার বিকালও আসে জীবনে!
হৈমন্তীর সহিত অপালা অনেক গল্প করিল। কলেজে পড়া মেয়ে, যে একা একা ট্রেনে চড়িয়া পরিচিত মানুষের বাড়ি বেড়াইতে আসিতে পারে, তাহার সম্বন্ধে হৈমন্তী একধরনের মিশ্র মনোভাব লইয়া কাজলের ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। কিন্তু তাহাকে দেখিয়াই অপালা যেভাবে পায়ে হাত দিয়া প্রণাম করিল এবং পরে তাহার একখানা হাত নিজের কোলে লইয়া পাশে বসিয়া কথা বলিতে লাগিল, তাহাতে শিক্ষিতা এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে এমন মেয়েদের সম্বন্ধে হৈমন্তীর ধারনা আমূল বদলাইয়া গেল। বিশেষ করিয়া অপালা যখন অপুর রচনা হইতে পংক্তির পর পংক্তি মুখস্ত বলিয়া যাইতে লাগিল, তখন হৈমন্তী মুগ্ধ বিস্ময়ে তাহার দিকে তাকাইয়া রহিল।
অনেকক্ষণ গল্প করিবার পর হৈমন্তী বলিল—ঐ যাঃ, কথা বলতে বলতে তোমাকে কিছু খেতে দেবার কথা মনেই নেই। দাঁড়াও, তোমাকে কখানা লুচি ভেজে দিই–
অপালা সংকুচিত হইয়া বলিল—কিছু দরকার নেই মা, আমার ফিরতেও দেরি হয়ে যাবে–
কাজল বলিল—এমন কিছু দেরি হবে না। সন্ধের আগেই তোমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবোখন। সাড়ে ছটার মধ্যে শেয়ালদায় পৌছে যাবে।
অপালা সেই বিরল মেয়েদের মধ্যে একজন, যাহাদের কোন বিষয়ে রাজি করাইতে দীর্ঘসময় ধরিয়া অনুরোধ করিতে হয় না। সে বলিল—ঠিক আছে, আমার সাতটায় পৌঁছলেও চলবে। তাছাড়া খিদেও পেয়েছে সত্যি। চলুন মা, রান্নাঘরে বসে আপনার সঙ্গে গল্প করি
কিছুক্ষণ বাদে কাজল দেখিল রান্নাঘরের চৌকাঠের উপর বসিয়া অপালা গভীর মনোযোগের সহিত লুচি বেলিয়া দিতেছে, তাহার মা তোলা উনুনে ছোট অ্যালুমিনিয়ামের কড়াইতে আলুর চচ্চড়ি রাঁধিতেছে। সমগ্র দৃশ্যটায় বেশ একটা তৃপ্তিদায়ক সংসার-সংসার গন্ধ।
স্টেশনে যাইবার পথে অপালা বলিল—সেই কোন্ ছোটবেলার পর আর বাংলাদেশে পুজো দেখিনি। এবার আমার জন্যই বাবা এলেন। বাইরে বাইরে থাকলে কী হবে, বাবা মনেপ্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি। আপনি পুজোয় কী করছেন?
–কিছুই না। শুয়ে শুয়ে কুঁড়েমি করবো আর বই পড়বো—
–এক কাজ করুন না, আপনি আমাদের কাছে একটা দিন কাটান।
–তোমাদের কাছে? কোথায়?
অপালা বলিল–বুগলির নারায়ণশিলা গ্রামে বাবার মামাবাড়ি। পুজোর চারদিন আমরা সেইখানে থাকব। তাঁদের বনেদি পরিবার, প্রায় দুশো বছরের পুরোনো দুর্গাপূজা হয় বাড়িতে। আপনি অষ্টমী কি নবমীর দিন আসুন না, ঠিকানা বলে দিচ্ছি-খুব ভালো লাগবে।
কাজল বলিল–শুনে তো যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সেখানে কেউ আমাকে চেনে না–
—সে চিন্তা করবেন না। তারা তোক খুব ভালো, চট করে এমন আপন করে নেবেন যে আপনার মনেই হবে না আপনি নতুন লোক। তাছাড়া–
অপালা চুপ করিয়া গেল। কাজল বলিল—তাছাড়া কী?
অপালা তাহার দিকে তাকাইয়া বলিল–তাছাড়া আমি তো আপনাকে চিনি। আমি আপনার সঙ্গে থাকবো।
বাড়ি ফিরিবার পথে চৌমাথার মোড়ের দোকান হইতে কাজল এক প্যাকেট সিগারেট কিনিল। পথে আজ কী কারণে যেন লোজন কম। বাতাসে কিসের নেশা, প্রতিদিনকার সাধারণ দৃশ্যই চোখে অপূর্ব ঠেকিতেছে। অনেক কিছু যেন বলিবার আছে, এখুনি কাছাকাছি কোন বন্ধুকে পাইলে তাহাকে সমস্ত কথা খুলিয়া বলা চলিত। কিন্তু কী যে বলিত কাজল তাহা অনেক ভাবিয়াও স্থির করিতে পারিল না।
একটা সিগারেট ধরাইয়া কাজল হাঁটতে শুরু করিবে, পিছন হইতে দোকানী ডাকিল-বাবু, খুচরা পয়সা তো লেকে যাইয়ে
-ওঃ, হা–পয়সা ফেরত লইতে হইবে বটে।
নদীর ধারে সন্ধ্যার অন্ধকার নামিয়াছে। বাড়ি যাইতে গিয়া কাজল কেন যে এখানে আসিল তাহা সে নিজেই জানে না। বৈকালী বায়ুসেবনকারীর দল বেশ কিছুক্ষণ হইল চলিয়া গিয়াছে। আরছা অন্ধকারে বাবলাগাছের সারি বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া আছে। নদীর ওপারে পশ্চিম দিগন্তে সন্ধ্যাতারার অগ্নিময় ইশারা। পাড়ের কাছে ছলাৎ ছলাৎ করিয়া ঢেউ আসিয়া লাগিতেছে। কাজল বেশ বুঝিতে পারিল জীবন বদলাইয়া যাইতেছে, নতুন দিকে বাঁক নিতেছে। এতদিন যেমন চলিতেছিল তেমন আর চলিবে না। তাহার পছন্দ-অপছন্দ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস আর এতদিন যাপন কৰা একক জীবনের বিভিন্ন ছোট-বড় ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়া একটা বিশেষ ধরনের পরিবর্তনের সুর জাগিয়া উঠিতেছে। নদীর জলের শব্দে, এই সান্ধ্য নির্জনতায় আর পশ্চিমাকাশের নক্ষত্রের দীপ্তিতে যেন আসন্ন সেই পরিবর্তনের সুস্পষ্ট সংকেত।
রাত্রে খাইবার সময়ে হৈমন্তী বলিল—অপালার কথা শুনে মনে হল তোর সঙ্গে ওর অনেকদিনের যোগাযোগ। অথচ তুই বললি এই নাকি তোদর দ্বিতীয়বার দেখা। ব্যাপারটা কী?
কাজল আমতা আমতা করিয়া বলিল–না, মানে-মাঝে-মধ্যে চিঠিপত্র দিত আর কি
-তুই দিতিস না?
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিবার পর কাজল বলিল—দিতাম।
হৈমন্তী বলিল—আমি একটা কথা বুঝতে পেরেছি। মেয়েটা তোকে পছন্দ করে। তোর কথা আমি জানিনে—এসব নিয়ে খেলা নয়, ভালো করে নিজের মন বুঝে দেখতেমন বুঝলে সময় থাকতে সরে আসা ভালো। নইলে তোর চেয়ে মেয়েটা কষ্ট পাবে বেশি। সবদিক বিচার করে দেখার আগে বেশি ঘনিষ্ঠতা করে ফেলিস না।
জীবনে এই প্রথম মা তাহার সহিত বড়োদের মতো সমানে সমানে কথা বলিল।