দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
সময় কাটিতে থাকে। যে জীবনে নাটকীয়তা থাকে, দুর্যোগ, উত্থান-পতন কিংবা তীব্র গতি থাকে, তেমন জীবন কাজল বাছিয়া লয় নাই। এই বিশ্বকে সে ভালোবাসিয়াছে, দুর্বোধ্য রহস্যে ভরা এই বিশ্বজগৎটার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টি লইয়া তাকাইয়াছে, তাহাতেই সে তৃপ্ত। লোকে অবশ্য কবির ভাষায় তাহার সম্বন্ধে বলিতে পারে—অল্প একটু হেসে-খেলেই ভরে যায় এর মনের জঠর, বলুক—তাতে কিছু আসে যায় না। বিশুদ্ধ আনন্দলাভ জীবনের পরম উদ্দেশ্য, বিস্ময় মনের সবচেয়ে পুষ্টিকর খাদ্য।
র্যান্ডম হাউস প্রকাশিত একখানি প্রবন্ধের সংকলন পড়িতে পড়িতে চার্লস ল্যাম-এর জীবনীর এক জায়গায় তাহার চোখ আটকাইয়া গেল। নিজের জীবনের সাদামাটা অকিঞ্চিৎকর সম্বন্ধে বলিতে গিয়া ল্যাম লিখিতেছেন যে, উল্লেখ করিবার মতো কিছুই তাঁহার জীবনে ঘটে নাই। কেবলমাত্র একবার এক পার্কে বসিয়া থাকিবার সময় খপ করিয়া হাত বাড়াইয়া একটি উড়ন্ত চড়াই পাখি ধরিয়া ফেলিয়াছিলেন। ইহাকে যদি ঘটনা বা সাফল্য বলা যায়, বলা যাইতে পারে।
সুন্দর কথা। মনের মতো কথা। ভূমাতে আনন্দ নাই, সারল্যেই আনন্দ।
খোকা বড়ো হইতেছে। এখন সে গুট গুট করিয়া সারাবাড়ি হাঁটিয়া বেড়ায়, ঠাকুমার কোলে হেলান দিয়ে রূপকথার গল্প শোনে। রাত্রিতে বিছানায় বসিয়া বই পড়িতে পড়িতে কাজল ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকাইয়া দেখে। ঠিক যেন তুলির মুখের আদল। ঠোঁটের চমৎকার ভঙ্গি, রেশমের মত চুল, বড়ো বড়ো চোখের নিষ্পাপ দৃষ্টি। শেক্সপীয়ারের সনেটগুলির কথা মনে পড়িল, সন্তানের ভিতর দিয়াই তো জীবনের প্রবাহ আর ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন থাকে। আজ হইতে অর্ধশতাব্দী পরে সে থাকিবে না, খোকা থাকিবে।
প্রথম যৌবনের তারল্য কাটিয়া তাহার জীবনে একটা সুসংবদ্ধ স্থিতির ভাব আসিতেছে। এখন মনে হয় হৈ চৈ, আনন্দ, অর্থ, খ্যাতি কিংবা ক্ষমতাই সার্থকতার নামান্তর নয়। নাটক-নভেল আর পড়িতে ভালো লাগে না, ইতিহাস, ভূতত্ত্ব, জ্যোতির্বিজ্ঞান বা মহাপুরুষদের স্মৃতিকথা পড়িতে ইচ্ছা করে। সে মধ্যবয়সে পৌঁছাইল নাকি?
একটা ভয়ের ব্যাপার হইয়াছে।
আগে সে নদীর ধারে গিয়া বসিলে জলের শব্দের মধ্যে অনন্তের বাঁশি শুনিতে পাইত, তারাভরা আকাশের দিকে তাকাইলে অসীম শূন্যের পথহীন গভীরতায় সে কবিতার পংক্তি খুঁজিয়া পাইত। এখন জল শুধুই জল, রাত্রির কালো আকাশ কেবলমাত্রই খানিকটা আলোকহীনতা। জীবনের দম ফুরাইয়া গেল নাকি?
কিছুই জানা হইল না। ইস্কুল জীবনের শেষের দিকে বা কলেজে পড়ার সময় যখন জীবন আর অস্তিত্ব সম্বন্ধে যাবতীয় প্রশ্ন ধীরে ধীরে জন্ম লইতেছিল, সে সময় মনে হইয়াছিল বিশ্বপ্রকৃতির সমস্ত রহস্য সে ভেদ করিয়া ফেলিবে। সামনে এত বড়ো জীবনটা পড়িয়া আছে, সে কত পড়িবে, জানিবে, হয়তো তাহারই জন্য সবকিছু অপেক্ষা করিয়া আছে। এখন সে বুঝিতে পারিয়াছে খুব জোরে দৌড়াইলেই দিগন্তকে স্পর্শ করা যায় না।
কাজল ভূতের গল্প পড়িতে ভালোবাসে। অ্যালজারনন ব্ল্যাকউডের লেখা তাহার খুব প্রিয়। ব্ল্যাকউডের একটি গল্প পড়িতে গিয়া একজায়গায় লেখকের বক্তব্য তাহার মনে হ এক শিক্ষকের মুখ দিয়া লেখক বলাইতেছেন—What was the use of al this? What in the world was the good of all the labour and drudgery one goes through? Wherein lay the value of so much uncertain toil when the ultimate secrets of life were hidden and no one knew the final goal? How foolish was effort, discipline, work! How vain was pleasure! How trivial the noblest life!
অদ্ভুত ব্যাপার। আজ কয়েকদিন ধরিয়া যে অনির্দেশ্যতা তাহাকে কষ্ট দিতেছে, তাহারই নির্যাস যেন ব্ল্যাকউড চোখের সামনে তুলিয়া ধরিলেন। সত্যই তো, কী লাভ পরিশ্রম করিয়া? কী লাভ খ্যাতিতে, প্রতিষ্ঠায়, অধ্যয়নে? সব তো অন্ধকারই থাকিয়া যাবে। মৃত্যু সমস্ত উদ্যোগের অবশ্যম্ভাবী সমাপ্তি।
নদীর স্রোতে আর কোনো গান নাই। দিগন্তের ওপারে কোনো দেশ নাই।
বছরখানেক আগে পুরানো বইয়ের দোকান হইতে নীটশের দাস স্পেক জরথুস্ট পাঁচসিকা দামে কিনিয়াছিল। ভালো লাগে নাই বলিয়া পড়া বেশিদূর অগ্রসর হয় নাই। একদিন রাত্রিবেলা বইখানা লইয়া বিছানায় শুইল। পাশে তুলি ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। ওপাশে থোকা। মধ্যরাত্রির জীবন্ত স্তব্ধতা থমথম করিতেছে। তাহারই ভিতরে নীটশে আসিয়া বিছানার পাশে বসিলেন। বলিলেন, সুপারম্যান থিয়োরির কথা, ঈশ্বরের অনস্তিত্বের কথা। কোনো উদ্যোগেরই কোনো মূল্য নাই, কারণ পৃথিবীতে কিছুই নতুন ঘটিতেছে না। ইতিহাস নিজের পুনরাবৃত্তি করিতেছে মাত্র। বিশ্বে মানুষের অস্তিত্ব, দেশ ও কালের মধ্যে বস্তুবিশ্বের অস্তিত্ব, সমস্ত অর্থহীন। তাৎপর্যহীন বিশ্বে সে একটা তাৎপর্যহীন, ক্লান্তিকর জীবন বহন করিয়া চলিতেছে।
নীটশে পড়িতে পড়িতে রাগ হয়, আজন্মলালিত বিশ্বাস এবং সংস্কার একেবারে ভাঙিয়া পড়িবার উপক্রম হইতেছে দেখিয়া মনে ত্রাসের সঞ্চার হয়, কিন্তু ন্যায়শাস্ত্রের নিরেট যুক্তির বিরুদ্ধে কিছুই করিবার থাকে না। পণ্ডিতের প্রলাপ বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যায় না বলিয়াই ভয়টা আরও চাপিয়া বসে।
অন্ধকারে ডুবিয়া যাইবার অসহায় মুহূর্তে একটি তুচ্ছ ঘটনা তাহাকে রক্ষা করিল।
একদিন বিকালে তুলির ঘরে ঢুকিয়া কাজল দেখিল কোলের কাছে একরাশ বকুল ফুল লইয়া তুলি মালা গাঁথিতেছে। কাজল বলিল–কী ব্যাপার, হঠাৎ মালা গাঁথছো যে?
তুলি হাসিয়া বলিল—উষার মা দিয়ে গিয়েছে। সকালে মেয়েকে দেখতে এসেছিল, বলল–বৌমা, এই নাও, আমাদের উঠোনের গাছের ফুল—তোমার জন্য এনেছি। বাবা বকুলফুল খুব ভালোবাসতেন, তাই না? মালা গেঁথে বাবার ছবিতে পরিয়ে দেব
তুলি একটি একটি করিয়া ফুল লইয়া ছুঁচের মাথায় গাথিয়া সূতায় পরাইতেছে। তাহার মুখে নিবিষ্ট মনোযোগ। কাজল কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া দেখিল।
এমনিতে বেশ সুন্দর পরিচিত একটি গার্হস্থ্য দৃশ্য। একজন গৃহবধু আপনমনে বসিয়া ফুলের মালা গাঁথিতেছে। এই দৃশ্য লইয়া কত কবিতা লেখা হইয়াছে, কত শিল্পী ছবি আঁকিয়াছে, কত তরুণ এই দৃশ্য দেখিয়া অজানা নায়িকাকে প্রাণমন সমর্পণ করিযাছে।
কিন্তু রোম্যান্টিক অস্বচ্ছতা সরাইয়া ভিতরে তাকাও। সব মিথ্যা। অর্থহীন।
চরাচরব্যাপী কিছু না-র মধ্যে কেন বস্তুর আবির্ভাব? ঈশ্বরের পরিকল্পনা? বেশ, কে ঈশ্বরের সৃষ্টিকর্তা? কারণ অনুপস্থিত, কিন্তু কার্য ঘটিতেছে এমন তো মানা যায় না।
তুলি মুখ তুলিয়া কাজলকে দেখিতে পাইয়া বলিল—একটু এসো না, এইখানে বসে আমাকে একটা করে ফুল এগিয়ে দাও।
কাজল অন্যমনস্কভাবে খাটের একপাশে বসিল। একটি করিয়া বকুলফুল সে তুলির হাতে দেয়, তুলি সেটিকে ছুঁচে গাঁথিয়া আবার হাত বাড়ায়। দেখিতে দেখিতে সুন্দর একটি মালা গড়িয়া উঠিতে লাগিল।
একটু পরে কাজল অবাক হইয়া দেখিল বসিয়া বসিয়া ফুল হাতে তুলিয়া দেওয়ার মতো আপাত নীরস এবং একঘেয়ে কাজও তেমন খারাপ লাগিতেছে না। বরং মালাটি ক্রমে বড়ো হইয়া উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের নিবিড় তৃপ্তি চেতনার মধ্যে ছড়াইয়া পড়িতেছে। ফুল ছিল, ছুঁচ ও সূতা ছিল, কিন্তু মালাটি এই বিশ্বে কোথাও ছিল না। সেটি মানুষের নির্মাণ, রিক্তহস্ত মানুষের সবচেয়ে বড়ো গৌরব।
যখন আলো কমিয়া আসিয়াছে, তখনও দুজনে বসিয়া শেষ কয়েকটি ফুল সূতায় পরাইতেছে। দুজনের মাথা প্রায় এক হইয়া গিয়াছে।
অজস্র বকুলের বেশ বড়ো একটা মালা হইল। তুলি বলিল—চল তো, চেয়ারে দাঁড়িয়ে বাবার ছবিতে পরিয়ে দেবে। আমি হাত পাই নে—
রাত্রিতে খাওয়া-দাওয়া মিটিলে হৈমন্তী খোকাকে তাহার কাছে লইয়া গেল। তুলি মশারির একটা কোণ খুলিয়া ওদিকে সরাইয়া দিয়া বলিল—আজ কিন্তু এখনি ঘুমোব না। এসো, দুজনে মিলে সুডো খেলি–
লুডো জিনিসটা কাজল মোটই ভালোবাসে না, কিন্তু তুলির আগ্রহ দেখিয়া সে রাজি হইল। তুলির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা তাহার পক্ষে কঠিন।
খেলা আরম্ভ হইল। তুলির লাল খুঁটি, তাহার সবুজ। কাজল তুলির হইয়া তাহার খুঁটি চালিয়া দিতে লাগিল। তুলি কৌটা নাড়িয়া চাল দেয়, কতর দান পড়িয়াছে দেখিয়া কাজল তুলির খুঁটি আগাইয়া দেয়। তুলি সরল ও সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, দান চালিয়া সে স্বামীর দিকে তাকাইয়া বসিয়া থাকে, কতক্ষণে সে খুঁটি চালিবে।
একবার কাজলের ছয় পড়িল, আর একবার চালিতেই দুই। মোট আট। কাজল দেখিল যে খুঁটি তাহার মধ্যপথে আছে তাহা আটঘর অগ্রসর হইলে তুলির প্রায় পাকা একটি খুঁটি মারা পড়ে। সে দ্রুত ভাবিয়া নতুন একটি খুঁটি ঘর হইতে ছযেব দানে বাহিব করিয়া মধ্যপথে থাকা খুঁটিখানা দুইঘর আগাইয়া দিল। তুলির খেলা কি নষ্ট করা যায়?
তুলি এই সূক্ষ্ম আত্মদানের মহিমা কিছুই বুঝিল না, বলিল–যাক, তোমার একটা খুঁটি বের হল। তোমার এত কম ছয় পড়ে কেন বল তো?
কয়েকদান পরে তুলির পাঁচ পড়িল। ছয় পড়িলে একটি খুঁটি ঘবে উঠিতে পারিত। কাজল খুঁটি হাতে লইয়া একঘর আগাইয়া সুনিল-এক, দুই, দুই, তিন, চাব আর এই হল পাঁচ। বাঃ উঠে গেল।
তুলি ভারি খুশি হইল। পরক্ষণেই তাহার মনে হইল সে জিতিতেছে মানেই স্বামী হারিতেছে। স্বামীব পবাজয়ে এতটা খুশি হওয়া বোধহয় ভালো দেখাইতেছে না। সে বলিল—লুডো খুব সোজা খেলা। তুমি একটু মনোযোগ দিয়ে খেললেই জিততে পারবে—
গভীর রাত্রিতে একবার ঘুম ভাঙিযা কাজল দেখিল মাথাব কাছের জানালা দিযা বিছানায় মৃদু জ্যোৎস্না আসিয়া পড়িয়াছে। খোকা ঘুমের মধ্যে একবার হাসিয়া উঠিল। তুলির নিঃশ্বাসের শব্দ।
বিশ্ব নিবৰ্থক, দেশ-কাল স্বপ্নমাত্র, বাঁচা মানে বুদ্ধিহীন কালযাপন। কিন্তু তাহারই ভিতর মানুষ খেলা করে। খেলাই আসল। মানুষের নিজস্ব নির্মাণ। বকুলফুলের মালাটির মতো।
মমতাহীন যান্ত্রিক বিশ্বের উদ্দেশে প্রতিস্পর্ধী মানুষের নান্দনিক উত্তর।
সেদিন কলিকাতায় কলেজ স্ট্রীটের মোড়ে স্কুলজীবনের এক বন্ধুর সহিত কাজলের দেখা হইয়া গেল। বন্ধু সামনে ঝুঁকিয়া ফুটপাতের এক পুস্তক-বিক্রেতার সাজাইয়া রাখা বইয়ের স্তূপের মধ্যে কী খুঁজিতেছিল। কাজল তাহার পিঠে চাপড় মারিয়া বলিল—কী রে রাখাল, কী খবর? আর যাতায়াত করিস না, এক্কেবারে ডুব দিয়ে বসে আছিস কেন?
রাখাল চাপড় খাইয়া প্রথমে অবাক হইয়া পেছন ফিরিয়া তাকাইল, তাহার পর খুশি হইয়া বলিল—আরে অমিতাভ! কেমন আছিস? এখানে কী করছিস?
-বাবার পাবলিশারের কাছে এসেছিলাম। মাঝে মাঝে আসি। তুই?
-ছেলের বই কিনছি রে ভাই। সব নতুন বই কেনার রেস্ত নেই, আমার উপার্জন তো জানিস।
–ছেলে কোন ক্লাসে পড়ে?
—এইটে। আর মেয়ে থ্রি-তে।
–মেয়েও আছে বুঝি?
রাখাল অবাক হইয়া তাকাইল, বলিল—তুই তো শালা দেখছি বুধূই রয়ে গেলি। মেয়ে না থাকলে সে ক্লাস থ্রি-তে পড়ছে কী করে?
যুক্তির সারবত্তা কাজলকে স্বীকার করিতে হইল।
রাখালের চরিত্র বিশেষ বদলায় নাই। সে এখনও হৈ-হৈ করিয়া কথা বলে, অনর্গল ভুল ইংরাজিতে নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেল সে এখনও বড়ো লেখক হইবার আসা পোষণ করে, রোজ একটি করিয়া কবিতা লেখে এবং তিন-চারপাতা করিয়া গদ্যরচনা করে। একখানি উপন্যাস নাকি শেষ হইয়া আসিল বলিয়া।
কাজল বলিল—বাঃ, সাহিত্যসাধনা চালিয়ে যাচ্ছিস শুনে ভালো লাগছে–
রাখাল উৎসাহ পাইয়া বলিল—ভালো না? তুই বন্ধু মানুষ তাই অ্যাপ্রিসিয়েট করলি। পাড়ার লোক আমাকে পাগল বলে। অন্তত পনেরো কুড়িটা ভালো গল্প লেখা হয়ে গিয়েছে। এবার সেগুলো এক এক করে কাগজে পাঠাতে আরম্ভ করব। ওরা গল্প ছাপলে টাকা দেয়, জানিস? টাকাটা জমিয়ে রাখব, বিপদের সময় হ্যান্ডস ফাইভ থাকবে।
হা ঈশ্বর! সরল বন্ধুকে সে বাস্তব পৃথিবীর জটিলতা কী বোঝাইবে? লেখা ছাপানো কি অত সহজ? নাকি লিখিয়া উপার্জন করা কেবলমাত্র লেখকের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে? কিন্তু যুক্তির আঘাতে রাখালের স্বপ্নের স্বর্গ ভাঙিয়া দিতে তাহার ইচ্ছা করিল না।
সে বলিল–চল, কিছু খাওয়া যাক। অনেকদিন একসঙ্গে বসে খাওয়া হয়নি–
বন্ধুকে লইয়া কাজল মির্জাপুর স্ট্রীটের পুঁটিরামের দোকানে ঢুকিল। ভিতরের রান্নাঘর হইতে রাধাবল্পভি ভাজিবার সুঘ্রাণ ভাসিয়া আসিতেছে। কাজল চারখানা করিয়া রাধাবল্লভি দিতে বলিযা কোণের একটা টেবিলে বসিল। রাখাল হুসহাস্ শব্দ করিয়া গরম রাধাবল্পভি নিমেষে খাইয়া ফেলিল, দুইবার বাড়তি ডাল চাহিয়া লইল।
কাজল বলিল—তোকে আর চারখানা দিক?
রাখাল সাগ্রহে সম্মতি জানাইল। বলিল—একেবারে হাতে গরম, যাকে বলে খোলা টু নোেলা। বেশ লাগছে খেতে। আসলে এ সময়ে কোনোদিন এত জমিয়ে খাওয়া হয় না, বুঝলি? কাজ থেকে ফেরবার সময় সামান্য মুড়ি আর সস্কুইটো-ব্যস!
কাজল অবাক হইয়া বলিল—সকুইটো আবার কী?
–বাঃ, তুই যেন কী! মশা মসকুইটো হলে শশা সসকুইটো নয়?
এ যুক্তিও কাজল বিনা আপত্তিতে মানিয়া লইল।
পুঁটিরাম হইতে বাহির হইয়া রাখাল বলিল—তুই এত ভালো খাওয়ালি, আমার তো কিছু প্রতিদান দেওয়া উচিত। চল, গোলদীঘির বেঞ্চিতে বসে, তোকে কবিতা শোনাই–
সর্বনাশ! কাজল ব্যস্ত হইয়া রাখালকে বোঝাইতে লাগিল যে, বন্ধুত্বের নিঃস্বার্থ শুভ্রতার মধ্যে দান-প্রতিদানের কালিমা ডাকিয়া আনা কোনো কাজের কথা নহে, রাখালের কিছুমাত্র সংকোচের কারণ নাই। বিশেষ করিয়া তাহাকে পৌনে পাঁচটার লোকাল ধরিতেই হইবে।
দেখা গেল রাখাল সরল বাংলা বোঝে না। কাজলের আপত্তিতে কিছুমাত্র কান না দিয়া সে তাহার হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে গোলদীঘিতে আনিয়া বসাইল। জীর্ণ ব্যাগ খুলিয়া মার্বেল কাগজ দিয়া বাঁধানো একটা খাতা বাহির করিয়া একের পর এক কবিতা পড়িয়া যাইতে লাগিল। কবিতাগুলির ভাব বাম্পবৎ, বিষয়ের মাথামুণ্ড কিছুই নাই, ছন্দ তদব। একটি কবিতা স্বদেশপ্রেম দিয়া শুরু হইয়া দুর্গাপূজা দিয়া শেষ হইয়াছে। পর্যদস্ত, হতাশ কাজল মুখে একধরনের স্থায়ী উদ্ভাস ফুটাইয়া মনে মনে অন্য কথা ভাবিতে লাগিল।
দশ-বারোটা কবিতা পড়িবার পর রাখাল থামিল। বলিল—আজ এই পর্যন্ত থাক। আজ সঙ্গে গল্প নেই বলে শোনাতে পারলাম না। তুই দুঃখ করিস না, একদিন তোর বাড়িতে গিয়ে সকাল থেকে—বেশ হবে, না?
কাজলের মুখের ভাব অত্যন্ত করুণ হইয়া আসিয়াছিল, আরছা গলায় সে কী বলিল ভালো বোঝা গেল না। তাহাকেই সম্মতি ধরিয়া লইয়া রাখাল বলিল—তাহলে ওই কথাই ঠিক থাকল। যাব শিগগীরই, বিলম্বে আর দেরি কেন, বল? চলি ভাই, গিয়ে লিখতে বসব
যাইবার আগে হঠাৎ থামিয়া রাখাল কাজলের দিকে তাকাইয়া একটা অদ্ভুত কথা বলিল। রোগা, অনটনে ভোগা, সামান্য মানুষ রাখাল বলিল–জানিস অমিতাভ, খুব আনন্দে আছি, খুব মজায়। এমনিতে আমি কেমনভাবে বেঁচে আছি তা তো দেখছিস, টেনেটুনে সেলাই করে চালাই। সবার কাছে ছোট হয়ে থাকি। কিন্তু যখন লিখি, কিংবা লেখার কথা ভাবি—তখন মনের ভেতর কেমন যে একটা ভালো লাগা-সে তোকে বোেঝাতে পারব না। তখন কে মনে রাখে কাল বাজার খরচ কোথা থেকে আসবে। বাড়িওয়ালা ভাড়ার তাগাদায় এলে তাকে কী বলব, এসব লেখা সত্যিই কোনদিন ছাপা হবে কী না, হলেও নাম হবে কী না। দূর! তখন শুধু লিখতেই ভালো লাগে, কী লিখব তাই ভাবতে ভালো লাগে। নইলে কী করে যে বাঁচতাম!
পিছন ফিরিয়া রাখাল ওই হাঁটিয়া চলিয়া যাইতেছে। কাজল তাকাইয়া রহিল। অনেক তথাকথিত বড়োমানুষ অপেক্ষা, দাম্ভিক ধনী অপেক্ষা বড়ো তাহার বন্ধু। আহা, রাখাল ভালো থাকুক, তাহার স্বপ্ন আর শান্তি চিরজীবী হউক।
পৃথিবীতে মানুষ বড়ো কষ্টে আছে। বাসনার আগুনে ইন্ধন নিক্ষেপ করিয়া সে শান্তিব আশা করিতেছে। কাজল নিজের শরীরের ভিতর টের পায় নাই চারিদিকে দুনিয়া বদলাইয়া যাইতেছে। হাসিমুখে মানুষ বন্দীত্বের খাঁচার দিকে অগ্রসরমান। খাঁচাটা সোনার, তবু খাঁচাই।
আহা মানুষ! প্রিয় মানুষ, বোকা মানুষ!
পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জন্য শান্তি চিরজীবী হউক।