চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
শীতের সকাল। বারান্দায় রোদ্দুরে বসিয়া কাজল খবরের কাগজ পড়িতেছে, এমন সময় হাসিমুখে নন্দলাল আসিয়া উপস্থিত হইল।
–এসো নন্দলাল। ভালো আছ? সত্যিই এলে তাহলে?
নন্দলালের সাজ একই। পরনে খাটো ধুতি, খালি গায়ের উপর নামাবলী জড়ানো, পায়ে সস্তা দামের চটি, হাতে পূজার উপকরণসহ পিতলের সাজিখানি। বারান্দার নিচে চটি ছাড়িয়া সে উপরে উঠিল এবং নিষেধ না শুনিয়া কাজলের পায়ের ধুলা লইল।
-তারপর খবর কী বলে?
নন্দলাল আকর্ণ হাসিয়া বলিল—আমাদের আর খবর কী থাকবে দাদা? ওই কেটে যাচ্ছে একরকম। সত্য খুব বাড়িয়েছে, বুঝলেন? বাবার সেই সেবাদাসী! গত জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন বাবা ডেকে বলল—নন্দ, আজ পুজোর দিনটা তুই বাড়িতেই খাবি। ইদানীং আর বাড়িতে খাই না, জানেন তো? তা খেতে খেতে দুটো ভাত চেয়েছি, সত্য বলল—আর ভাত নেই। তখনও আমার অর্ধেক খাওয়া হয়নি। বললুম—মানুষকে খেতে বললে একটু বেশি করেও তো চাল নিতে হয়। উত্তরে সৎমা কী বললে জানেন? বললে—তোমার ওই হাতির খোরাক জোগানো সম্ভব নয়। আরও চাল নিলে আরও চাল সেঁদিয়ে যেত। শুনে কেমন যেন রাগ হয়ে গেল, বললুম—আমার বাবার বাড়িতে বসে আমি ভাত খাচ্ছি, তুমি ফোপরদালালি করবার কে? তাতে সৎমা তেড়ে এসে লোহাব খুন্তি দিয়ে—এই দেখুন না, সামনের দাঁতের আধখানা ভেঙে গিয়েছে
কথা শেষ করিয়া নন্দ আবার হাসিল। হাসিটা তাহার স্বভাব। মনের বিষাদ বা হর্ষের সহিত ইহার কোনো সম্পর্ক নাই।
কাজল বলিল—বোসোনন্দ, মাকে তোমার কথা বলে আসি। দুপুবে আমার এখানেই খেযে যাবে, কেমন?
—জানি দাদা এই কথা বলবেন—সেজন্যেই তো সকাল সকাল এলুম। আপনাদের রান্না হয়ে গেলে অসুবিধে হত। কিছু জলখাবার হবে কী দাদা?
কাজল হাসিয়া বলিল–পরোটা আর কুমড়োর তরকারি চলবে?
-খুব, খুব! তবে দু-খানা বেশি করে বলবেন। আমরা গাঁয়ের মানুষ, বুঝলেন তো?
হৈমন্তী বরাবরই লোকজনকে খাওয়াইতে ভালোবাসে। নন্দলালের অন্নলোপ সারল্য, অর্থহীন আকর্ণ হাসি এবং অগোছালো চালচলন তাহার মাতৃত্বের কাছে গভীর আবেদন লইয়া উপস্থিত হইল। ভিতরের বারান্দায় আসন পাতিয়া হৈমন্তী নন্দলালকে যত্ন করিয়া জলখাবার খাওয়াইল। নন্দলালও সেই যত্নের উপযুক্ত মর্যাদা দিতে কুণ্ঠা প্রকাশ করিল না। তরকারি সহযোগে বাবোখানি বড়োবড়ো পরোটা খাইয়া ফেলিবার পর হৈমন্তীর প্রশ্নের উত্তরে সে বলিল—আরও দেবেন মা? আচ্ছা আপনি বলছেন যখন দিন গোটাচারেক, তবে তার বেশি নয়—সকালে একগাদা খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলা কোনো কাজের কথা না। তরকারি আর দেবেন না, বরং গুড় যদি থাকে–
সামান্য জলযোগ করিয়া নন্দলাল বাহিরের বারান্দায় রৌদ্রে পিঠ দিয়া বিশ্রাম করিতে গেল।
হৈমন্তী কাজলকে ডাকিয়া বলিল—হারে, লোকটা দুপুরে খাবে তো বললি এখনই ও যোলোখানা পরোটা খেল, আবার দুপুরে যেতে পারবে?
বুঝাইয়া বলিতে গেলে অনেক কথা বলিতে হয়। কাজল সংক্ষেপে বলিল–পারবে।
–পেট-টেট খারাপ করবে না তো?
কাজল হাসিয়া বলিল—কিচ্ছু হবে না মা, তুমি ওকে চেনো না–
বাস্তবিকই দুপুরে খাইবার সময় নন্দলাল ভেলকি দেখাইল। মাত্র ঘণ্টাদুই আগে খাওয়া যোলোখানি পরোটা সে জঠরের কোন দুর্গম গহনে পাচার করিল কে জানে! প্রথমদিকে হিং দেওয়া কলাইয়ের ডাল, পালংশাকের চচ্চড়ি আর পোস্তর বড়া দিয়া সে দুই থালা ভাত খাইয়া ফেলিল। কালোজিরা-কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়া ট্যাংরা মাছের ঝোল হইয়াছিল। মাছের ঝোল দিয়া আরও দুই থালা ভাত। মুখে পরিতৃপ্তির ছাপ লইয়া সে উঠিতেছিল, হৈমন্তী তাহাকে বলিল—একটু দুধ খাবে? ভালো পাটালি গুড় আছে, তাই দিয়ে খাও—
নন্দলাল আবার বসিয়া পড়িল। বলিল—দুধের মধ্যে অমনি দুটো ভাতও ফেলে দেবেন মা, শুধু দুধ যেন কেমন লাগে–
সন্ধ্যাবেলা যখন ঘরের ভিতর অন্ধকার ঘনাইয়া উঠিল, তখনও বারান্দার বেঞ্চির উপর শুইয়া নন্দলাল নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতেছে। সাড়ে-ছয়টা নাগাদ সে ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়া অপ্রতিভমুখে বলিল—এঃ, বড্ড অন্ধকার হয়ে গেল। ডেকে দিলেন না কেন দাদা?
–তাই কী ডাকা যায়? একটা মানুষ ঘুমোচ্ছে—তুমি বরং আজকের রাতটা আমার এখানে থেকেই যাও, কেমন?
মাথা চুলকাইয়া নন্দলাল বলিল—আজ্ঞে তা যখন বলছেন—এত রাত্তিরে যাওয়াটাও–
-এবেলা মাংস খাবে নন্দ?
উৎসাহে নন্দলাল যেন কেমন হইয়া গেল। বলিল–মাংস? নিশ্চয়। আপনি খেলে আমিও একটু-মাংস খেতে আমি খুবই–বাবা প্রায়ই আনতেন। মধ্যে অনেকদিন—ওই সৎমা, বুঝলেন না?
মাংস কিনিতে হইলে চৌমাথার মোড়ের বাজারে যাইতে হয়। নন্দও কাজলের সঙ্গী হইল, ফিরিবার সময় তাহার বারণ না শুনিয়া বাজারের থলি বহিয়া দিল। বাড়ি ঢুকিবার সময় চুপিচুপি বলিল–দাদা, একটা কথা বলবো?
—কী?
—আপনারা কী রাত্তিরে রুটি খান? শহরের দিকে সবাই তাই খায়—
–কেন বলো তো? তুমি কী বুটি খাও না?
–খাবো না কেন দাদ? আমার এখন যা অবস্থা, সবই খাওয়া অভ্যেস করতে হয়েছে। তবে কী জানেন, রুটি জিনিসটা ঠিক পোষায় না। মাকে বলে দেবেন দুটো ভাত করতে?
কাজল বলিল—আচ্ছা, তুমি ভাতই খেয়ো–
রাত্রে একসের মাংসের মধ্যে কাজল দুই টুকরা মাংস এবং এক টুকরা আলু খাইয়াছিল। কিন্তু নন্দলাল থাকিতে বাকি এককড়াই রানা ফেলা যাইবে তাহা হইতেই পারে না। নিজের উপর সমস্ত ঝুঁকি লইয়া নন্দ অপচয়ের হাত হইতে গৃহস্থকে রক্ষা করিল।
পরদিন সকালে নন্দলাল বিদায় লইল বটে, কিন্তু হৈমন্তীর আদর্য তাহার উপর যাদুপ্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। দুই-তিনমাস পরপরই সে বিশ্বের ক্ষুধা লইয়া আসিয়া হাজির হইত।
উপন্যাস শুরু করিয়া কাজল বুঝিয়াছিল সাহিত্যের ক্ষেত্রে কোনো শিক্ষানবিশীর ব্যবস্থা নাই। ভাস্কর গুরুর কাছে হাতুড়ি-বাটালি ধরিয়া প্রস্তরখণ্ড হইতে মূর্তি বাহির করিবার কৌশল শেখে, চিত্রশিল্পীও হাতেকলমে কাজ শেখে, গায়ক ওস্তাদের কাছে তালিম নেয়। কিন্তু যাহারা লেখক হইতে চায়, তাহাদের জন্য তেমন কোনো নিয়ম নাই। পূর্বসুরীদের রচনাপাঠ কিছুটা সাহায্য করে মাত্র, নিজের জীবনে লব্ধ অভিজ্ঞতা সম্বল করিয়া বাকি পথটা হাঁটিতে হয়।
লিখিতে আরম্ভ করিবার পর প্রথমটা কাজল কী নিয়া লিখিবে ঠিক করিতে পারিল না। উপন্যাসে কী একটানা একটি গল্প থাকে, নাকি ছোটোছোটো ঘটনার টুকরা দিয়া একটি অখণ্ড সম্পূর্ণতা গড়িয়া ওঠে? বলিবার কথা কী কিছু একটা থাকিতেই হইবে, নাকি কেবল গল্প বলিলেও চলে? জীবনদর্শনের কথা ছাড়িয়াই দেওয়া যাক, শুধুমাত্র একটি নিটোল গল্প জমাইয়া তোলাও যে কত কঠিন, তাহা কাজল মর্মে মর্মে টের পাইল। অথচ কলেজে বা ইউনিভার্সিটিতে পড়িবার সময় সহপাঠীদের কাছে বুদ্ধিজীবী বলিয়া পরিচিত হইবার লোভে যাঁহারা নিটোল গল্প লিখিয়াছেন, সেইসব লেখকদের সে কত তাচ্ছিল্য করিয়াছে। প্রভাতকুমার-শরৎচন্ত্রের ভক্ত হওয়া একটা লজ্জার কথা বলিয়া পরিগণিত হইত। এখন নিজে লিখিবার সময় পূর্বসূরীদের শ্রেষ্ঠত্ব সে অনুভব করিতে পারিল।
কিন্তু গল্প তো জীবন হইতেই উঠিয়া আসে। তাহার জীবনে কী কিছুই ঘটে নাই? নিশ্চিন্দিপুরে ফিরিয়া যাইবার জন্য তাহার মনে যে আকাঙ্ক্ষা রহিয়াছে, একটু একটু করিয়া বড়ো হইবার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে পৃথিবীর রূপটা যেভাবে বদলাইতেছে, গভীর রাতে আকাশের দিকে তাকাইয়া অস্তিত্ব সম্বন্ধে মনে যে প্রশ্ন জাগিয়াছে—সেসব লইয়া কী গল্প হয় না?
লেখা ছাড়া আর কোন বিষয়ে তাহার দক্ষতা নাই। সে আর কিছু জানে না। কেই পড়ক বা পড়ক, তাহাকে লিখিতেই হইবে। সততার সহিত নিজের অনুভূতিগুলিকে সে লিপিবদ্ধ করিয়া যাইবে। পুরস্কৃত হওয়া-না-হওয়া ভাগ্যের হাতে। সে অন্তত ফাঁকি দিবে না।
উপন্যাস ধীরে ধীরে শেষ হইতে চলিল।
ফাল্গুনের ঈষত্তপ্ত বাতাস নিমগাছের পাতায় ঝিরঝির শব্দ তোলে। ঋতু পরিবর্তনের এই মনোরম অলৌকিক মুহূর্তে আজকাল কাজলের মন ছটফট করিতে থাকে। সময় চলিয়া যাইতেছে। পত্রমর্মরে যেন মহাকালের অদৃশ্য ঘটিকাযন্ত্র হইতে বালি ঝরিয়া পড়িবার শব্দ। জীবন ক্রমেই ফুরাইয়া আসিতেছে। কিছুই ঠিকঠাক করা হইল না।
কিন্তু কী করিবার ছিল? কতদুর পরিপূর্ণতা আসিলে তাহাকে সার্থকতা বলে?
এসব প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর নাই।
কেবল সময়ের ঘড়ি হইতে বালি ঝরিয়া যায়।
নিজের মনের কথাটা ঠিকমতো বুঝাইতে না পারাও ভয়ানক কষ্ট। অধিকাংশ মানুষের জীবনেই কোনো প্রশ্ন নাই। পিপাসাও যেটুকু আছে তাহা আরও ভালো খাইবার-পবিবার কিংবা আরও বেশি টাকা রোজগার করিবার।
এই মানসিক অবস্থায় সে পরপর বিভিন্ন পত্রিকায় কয়েকটি গল্প লিখিল। কেহ বলিল—খুব ভালো হইয়াছে। জীবনের দার্শনিক ব্যাখ্যা খুঁজিবার জন্য লেখকের প্রচেষ্টা আছে। কেহ বলিলঅনেক গালভরা কথা বলা হইয়াছে বটে, কিন্তু গল্পটা কই? আবার কেহ বলিল–ওরিজিনালিটি নেই। একদম অপূর্ব রায়ের নকল-বাপের নাম ভাঙিয়ে নাম করিতে চাহিতেছে। কেবল দ্বিজেনবাবু একদিন বলিলেন—কারও কথায় কান দেবে না। তোমার হাতে ভালো বাংলা গদ্য আছে। কিছুর পরোয়া না করে অনেস্টলি লিখে যাও। তোমার বাবা বলতেন—মশায়, যদি লেখায় নিজেকে ফাঁকি না দিয়ে থাকেন, তাহলে গ্যাট হয়ে বসে থাকুন। আপনার লেখা শাশ্বত হবে।
একান্ত মুহূর্তে কাজল নিজে ভাবিয়া দেখিল-সে কেন লেখে? কেহ প্রশংসা করিলে ভালো লাগে সত্য, কিন্তু কেবলমাত্র সেজন্যই কী দিনরাত এত পরিশ্রম করা? চব্বিশ ঘণ্টাই যে সে লিখিতেছে এমন নহে, কিন্তু সবসময়েই লেখার কথা ভাবিতেছে একথা সত্য। নিজের বলিবার কথাগুলির একটা নিজস্ব তাগিদ আছে, সেই শক্তিই ভিতর হইতে ধাক্কা দেয়। পাঠক পড়িয়া কী বলিবে এ কথা ভাবিয়া সে অদ্ভুত লেখে না।
পাঠকে যাহাই বলুক, ক্রমাগত লিখিতে থাকিলে নিজের রচনা সম্বন্ধে একধরনের আত্মপ্রত্যয় জন্মায়। কাজলও তাহার ব্যতিক্রম নহে। কিন্তু একটা ঘটনা অকস্মাৎ তাহাকে রীতিমতো বিষণ্ণ করিয়া দিল।
‘খুশি ও খেলা’ নামে প্রখ্যাত কিশোর পত্রিকায় সে একটি গল্প দিয়া আসিয়াছিল। নিষ্পাপ শৈশব চলিয়া যাইবার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনের যে এক অমূল্য ঐশ্বর্য চিরতরে অন্তর্হিত হয়তাহাই গল্পের বিষয়বস্তু। একজন অল্পবয়েসী কল্পনাপ্রবণ কিশোর স্কুল পালাইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে নির্জন দুপুরবেলা একটি ভাঙা পাঁচিলের ফোকর গলিয়া ওপারে এক আশ্চর্য দেশে গিয়া হাজির হইল। সেখানে রুপকথা ও লোকায়ত কাহিনীর বিখ্যাত চরিত্রগণ বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। সারাবেলা পান্তাবুড়ি, ডালিমকুমার, মন্ত্রীপুত্র-কোটালপুত্র, পক্ষীরাজ ও মধুসুদনদাদার সঙ্গে মেলামেশা করিয়া, স্বয়ং ঈশপের কুটিরের বারান্দায় বসিয়া তাহার মুখে গল্প শুনিয়া সন্ধ্যাবেলা মায়ের জন্য মন-কেমন করায় সে বাড়ি ফিরিয়া গেল। বড়ো হইয়া কলেজে পড়িবার সময় ছেলেটি একদিন সেই আশ্চর্য রাজ্যে আর একবার যাইবার চেষ্টা করিয়াছিল—কিন্তু পাঁচিলের ফোকরটা কিছুতেই খুঁজিয়া পায় নাই। এই গল্প।
গল্পটা লিখিয়া কাজলের ভালো লাগিয়াছিল। সে ভাবিয়াছিল সম্পাদক পড়িয়া নিশ্চয় অবাক হইয়া যাইবেন এবং অবিলম্বে প্রেসে দিবেন। গল্প দিতে যাওয়ার দিন সম্পাদক ছিলেন না। দপ্তরের একজন কর্মচারী লেখাঁটি রাখিয়া বলিয়াছিল-মাসখানেক বাদে খোঁজ করবেন
কাজল একটু আশাহত হইল। খ্যাতনামা কাগজগুলিতে গল্প প্রকাশ হওয়ায় অন্তত পত্রিকার অফিসগুলিতে লোকে তাহার নামটা চিনিতে পারে। কিন্তু এই ভদ্রলোক তাহার পাণ্ডুলিপি ডানদিকের একটা দেরাজে রাখিয়া গম্ভীরভাবে প্রফ সংশোধন করিতে লাগিলেন। একটু ইতস্তত করিয়া সে বলিল—তাহলে–
ভদ্রলোক কিছুটা বিরক্ত হইয়া মুখ তুলিয়া বলিলেন–বললাম যে, মাসখানেক পর!
বাহিরে আসিয়া কাজলের ভারি দুঃখ হইল। মানুষ তো একটু বসিতেও বলে! আহত মর্যাদাবোধ বড়ো খারাপ জিনিস। সারা দিনরাত কাজল বিষণ্ণ হইয়া রহিল। তারপর ভাবিয়া ভাবিয়া ঠিক করিল—লোকটা আমার লেখাটা নিয়েই ড্রয়ারে ঢুকিয়ে ফেলল, নাম-টাম কিছুই পড়বার সুযোগ পায়নি। নাম দেখলে কী আর চিনতে পারত না? ও বেচারীর আর দোষ কী? ওদের অফিসে সারাক্ষণ লোকে বিরক্ত করছে, আমাকে তো আর চিনে রাখেনি
মাসখানেক কাটিবার পর একদিন কাজল খুশি ও খেলা-র দপ্তরে খোঁজ করিতে গেল। বাহিরের ঘবে পূর্বদিনের সেই ভদ্রলোক আজ নাই। একজন বেয়ারাকে জিজ্ঞাসা করিয়া
জানিতে পারিল সম্পাদক মহাশয় নিজের ঘরে কাজ করিতেছেন। সে বলিল—একটু দেখা করা যায় না?
–কী দরকার বলুন?
–এমনি একটু প্রয়োজন ছিল—
লোকটি সামান্য ভাবিয়া বলিল—আচ্ছা যান। ওই যে, ওই ঘর–
নির্দেশ দিবার দরকার ছিল না, কারণ সুইং ডোরের ঘষা কাঁচের গায়ে সম্পাদক লেখা কাগজ সাঁটা আছে। সে দরজা ঠেলিয়া জিজ্ঞাসা করিল—আসতে পারি?
ধুতি এবং খন্দরের পাঞ্জাবি পরা সম্পাদক, মাথায় কাঁচাপাকা লম্বা চুল, বিশাল টেবিলের অপর প্রান্তে বসিয়া কী লিখিতেছিলেন। দেখামাত্র কাজল তাহাকে চিনিতে পারিল। ইনি বর্তমান বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব—আধুনিক কবি হিসাবেও খুব নাম করিয়াছেন। সম্প্রতি ছোকরা কবিযশঃপ্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই ইঁহার অনুকরণে লম্বা চুল রাখিতেছে এবং কাঁধে ঝোলা লইয়া ঘুরিতেছে। জলদমন্দ্র কণ্ঠে সম্পাদক জিজ্ঞাসা করিলেন-কী চাই?
কাজল ঘরের ভিতর কিছুটা অগ্রসর হইয়া বলিল—আজ্ঞে, আমি একটা গল্প দিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে বলা হয়েছিল মাসখানেক বাদে খবর নিতে–
–তা। এখানে কী?
ভদ্রলোকের আচরণে হৃদ্যতার লেশমাত্র নাই। কাজল বলিল—লেখাটার বিষয়ে জানতে–
—যাঁকে দিয়েছিলেন তার কাছেই খোঁজ করা নিয়ম। এখানে কেন?
—বাইরে কাউকে দেখলাম না, তাই—
—তাই ঢুকে পড়লেন?
বিরক্তমুখে সম্পাদক ঘন্টি বাজাইতেই বেয়ারাটি আসিয়া হাজির হইল।
—এঁকে ভেতরে ঢুকতে দিয়েছে কে? রবিবাবু কোথায়?
–আজ্ঞে, উনি টিফিন করতে গিয়েছেন—
–তার টেবিলে বসালে না কেন? যাও, গল্পেব ফাইলটা নিয়ে এস–
সম্পাদক আবার কী লিখিতে লাগিলেন। কাজল দাঁড়াইয়াই রহিল। এই অফিসে কেহ অতিথিকে বসিতে বলে না দেখা যাইতেছে।
বেয়ারা ফাইল আনিয়া দিল। বক্স ফাইলের ঢাকনা খুলিয়া সম্পাদক জিজ্ঞাসা করিলেন— গল্পের নাম কী?
কাজল নাম বলিল। এইবাব গল্প বাহির করিয়া সম্পাদক তাহার নাম দেখিবেন—এবং নিশ্চয় চিনিতে পারিবেন। চিনিতে পারিলেও সম্পাদক মহাশয়ের ব্যবহারে তাহার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না। ফাইল হইতে লেখাঁটি বাহির করিয়া বলিলেন—ও, এই গল্প! নিয়ে যান।
কাজল অবাক হইয়া বলিল—নিয়ে যাব?
-হ্যাঁ। এটা কোনো গল্পই হয়নি। আমি নিজে পড়ে দেখেছি। তাছাড়া বাংলা ভাষার আপনি কিছুই জানেন না। আপাতত লেখা বন্ধ রেখে ভাষার ব্যবহার শিখুন
কিছুটা যেন ছুঁড়িবার ভঙ্গিতে সম্পাদক পাণ্ডুলিপিটি টেবিলের এ প্রান্তে কাজলের সামনে ফেলিয়া দিলেন।
মানুষটির আচরণে এক ধরনের রূঢ় ঔদ্ধত্য আছে যাহা কাজল আগে কখনও দেখে নাই। লজ্জায় অপমানে তাহার কান গরম হইয়া উঠিল। কাগজগুলি হাতে লইয়া সে কোনোরকমে বাহির হইয়া আসিল।
রাস্তায় সবাই যেন তাহার দিকেই তাকাইয়া মুচকি মুচকি হাসিতেছে। সবাই কী করিয়া জানিয়া ফেলিয়াছে এইমাত্র সে পত্রিকার দপ্তর হইতে অপমানিত হইয়া বাহির হইল! বাড়ি ফিরিবার সময় ট্রেনে জানালার ধারে বসিয়া সে মান-অপমানের নিরর্থকতা এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে অবিচল থাকিয়া নিজের কর্তব্য করিবার বিষয়ে মহাপুরুষদের অনেক ভালো ভালো কথা স্মরণ করিল। কিন্তু দেখিল তাহাতে অপমানের জ্বালা কমে না।
ভদ্রলোক নিজে একজন কবি। কবিদের সম্বন্ধে কাজলের মনে বিস্ময়মিশ্রিত শ্রদ্ধার আসন ছিল। তাহারা কী সবাই এমন হয় নাকি? অকারণে তাহার সহিত এরূপ ব্যবহারের কারণ কী? লেখা পছন্দ না হইলে সে কথাটা মধুর করিয়াও তো বলা যাইত।
অনেকদিন পরে বাট্রান্তু রাসেলের প্রবন্ধ পড়িতে গিয়া কাজল ইহার উত্তর পাইয়াছিল। রাসেল বলিয়াছেন ক্ষমতার ব্যবহারেই ক্ষমতা অর্জনের সুখ। দুইটা মাথাই যদি না কাটিতে পারিলাম তাহা হইলে ধারালো তলোয়ারের মালিক হইয়া কী লাভ? মানবসভ্যতা নামক ব্যাপারটি এই ক্ষমতা দখলেরই ইতিহাস। নিতান্ত উচ্চকোটির মহাপুরুষ না হইলে এ প্রলোভন এড়ানো কঠিন।
সম্পাদকগণ সকলেই কিছু মহাপুরুষ নহেন।
ঘটনার দার্শনিক এবং মনস্তাত্তিক ব্যাখ্যা যাহাই হোক, কাজল পরিষ্কার বুঝিতে পারিল, লিখিয়া খ্যাতি অর্জন করা খুব সহজ কাজ হইবে না।
কোনো না কোনো ঘটনা অবলম্বন করিয়া মানুষের জীবনে পরিবর্তন সূচিত হয়। দিদিমার মৃত্যুতে কাজলের জীবনে সেই পরিবর্তন শুরু হইল। দিদিমা অনেকদিন ধরিয়াই ভুগিতেছিলেন, বিশেষ করিয়া দাদুর মৃত্যুর পর তাহার বাঁচিবার ইচ্ছাটাই চলিয়া গিয়াছিল। একদিন অনেক রাত্রে কাজল শুইয়া বই পড়িতেছে, দরজায় কে কড়া নাড়িল। দরজা খুলিয়া কাজল দেখিল প্রতাপ আসিয়াছে।
-কী ব্যাপার মামা? এত রাত্তিরে?
-মায়ের শরীর খুব খারাপ হয়েছে, রাত কাটে কিনা সন্দেহ। তাই মেজদিকে নিয়ে যেতে এসেছি—
হৈমন্তী চট করিয়া তৈয়ারি হইয়া লইল। কাজল বলিল—আমিও সঙ্গে যাই মা? যদি ওষুধপত্র বা ডাক্তারের দরকার হয়—
প্ৰতাপ বলিল—তুই থাক। বাড়ি খালি রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। সকালে উঠে চলে যাস এখন। তার মধ্যে দরকার হলে কাউকে দিয়ে খবর দেব–
দিদিমা মারা গেলেন পরদিন বিকাল পাঁচটা নাগাদ।
পাড়ার লোকজন এবং কাজলের বন্ধু-বান্ধবরা আসিয়া রাত আটটার মধ্যে সব ব্যবস্থা করিযা ফেলিল। পাড়ার মাতব্বর বৈদ্যনাথ সরকার বলিলেন—আর দেরি কিসের? চল, চল-ওদিকে অনেক সময় লেগে যাবে
কেষ্ট মুখুজ্যের ঘাটে ল্যাম্পপোস্টের মাথায় মিটমিট করিয়া একটা ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলিতেছে। তাহারই ঘোলাটে আলোয় দিদিমার শেষ শয্যা প্রস্তুত হইল। ঊনসত্তর বছর বাঁচিয়া এইমাত্র এক প্রিয়জন পঞ্চভূতে বিলীন হইয়া যাইবে। মুখাগ্নি করিবার জন্য ওই ধারে প্রতাপ প্রস্তুত হইতেছে। পুৰােহিত মহাশয় ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসিয়া নাকে চশমা লাগাইয়া অনুচ্চস্বরে গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় পড়িতেছেন। শ্মশানবন্ধুদের কয়েকজন নিজেদের মধ্যে গতকাল পাড়ায় ঘটিয়া যাওয়া কী একটা মুখরোচক ব্যাপার লইয়া আলোচনা করিতেছে। এ সমস্তই থাকিবে, আগামীকাল সকাল হইলেই পৃথিবী আবার আপন কর্মের স্রোতে ভাসিয়া যাইবে। মেঘ গোয়ালা যথাসময়ে দুধ দিতে আসিবে, গলির মুখে খোঁড়া নাপিত ইটের উপর বসাইয়া ব্রিজনাথ ভরতের দাড়ি কামাইয়া দিবে। তাহার দিদিমা হেলেন কেলার, মাদাম কুরি বা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ছিলেন না, কেহ তাহাকে মনে করিয়া রাখিবে না। এমন কী আত্মীয়স্বজনেরাও প্রথমে কিছুদিন শোক করিবে তারপর ভুলিয়া যাইবে।
অথচ দিদিমা কী স্নেহপ্রবণই ছিলেন, সবাইকে লইয়া বাঁচিতে ভালোবাসিতেন। তাহারও আলো-বাতাস সকাল-সন্ধ্যা হাসিকান্না লইয়া একটা আস্ত জীবন ছিল। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সবই যদি এমনভাবে মুছিয়া যাইবে তাহলে বাচিবার সার্থকতা কী?
কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, দিদিমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শৈশবের সহিত তাহার যোগসূত্র প্রায় সবটাই ছিন্ন হইয়া গেল। এইভাবেই বোধহয় যুগ শেষ হইয়া যায়।
ঘাট হইতে ফিরিতে রাত প্রায় আড়াইটা বাজিয়া গেল। ঝুমুর বেড়ালটা পাঁচিলের উপর লম্বা হইয়া ঘুমাইতেছে। বাহিরের দরজা খোলা, ভূষণ সেখানে একটা ভাজ করা শতরঞ্চির উপর বসিয়া ঝিমাইতেছে। সবকিছু কেমন স্বাভাবিক, কেবল দিদিমা নাই।
দিদিমার ঘরের কাছে গিয়া কাজল হঠাৎ চমকইয়া উঠিল। চিরপরিচিত খাটটা আর নাই, এরই মধ্যে তুলিয়া ফেলা হইয়াছে। ওইখানে দিদিমা দরজার দিকে মাথা দিয়া শুইয়া থাকিতেন। কে জানে পুনর্জন্ম আছে কিনা, এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষের আত্মা আর ফিরিয়া আসে কিনা। দিদিমার সঙ্গে সত্যই চিরকালের মতো ছাড়াছাড়ি হইয়া গেল।
দিনরাত পরিশ্রম করিয়া সে উপন্যাস প্রায় শেষ করিয়া আনিল। একদিন সে উপন্যাসের প্রথমদিকের শখানেক পাতা সইয়া দুরু দুরু বক্ষে বসু ও গুহ-এর দোকানে গিয়া হাজিব হইল।
দ্বিজেনবাবু কেদারায় হেলান দিয়া উদ্বোধন পত্রিকা পড়িতেছিলেন। তাহাকে দেখিয়া বলিলেন–কী খবর? অনেকদিন তোমায় দেখিনি, ভালো আছ তো? মা কেমন আছেন?
প্রণাম করিয়া কাজল বসিল। কিছুক্ষণ নানা বিষয়ে কথাবার্তা বলিবার পর ইতস্তত করিয়া কাজল বলিল—আমি একটা বড়ো লেখায় হাত দিয়েছি, প্রায় শেষও হয়ে এসেছে। আপনি যদি একটু পড়ে দেখেন–
–বড় লেখা? কী ধরনের বড়লেখা উপন্যাস?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–কী বিষয় নিয়ে লিখছো?
কাজল বলিল–বাবার প্রথম উপন্যাসখানা ওঁর আত্মজীবনীমূলক। উনি যেখানে শেষ করেছেন, সেখান থেকে আমি ধরেছি। বাবা নিশ্চিন্দিপুরে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন ওঁর জীবনদর্শন ছেলের মধ্যে সঞ্চারিত হোক। সে আশা কতখানি সফল হল তাই নিয়ে আমার লেখা।
দ্বিজেনবাবু বলিলেন—মানে তোমার নিজের জীবন?
কাজল দৃঢ়গলায় বলিল–না। গ্রামের মাটিতে যার উৎস, অথচ শহরের জটিলতায় যে বড়ো হয়ে উঠেছে—এমন একজন বাঙালি ছেলেব জীবন।
দ্বিজেনবাবু কিছুক্ষণ কাজলের দিকে তাকাইয়া থাকিলেন, তারপর হাত বাড়াইয়া বলিলেন–লেখাটা দাও। চার-পাঁচদিন পর আমার সঙ্গে দেখা করবে–
পাণ্ডুলিপি দিয়া কাজল চলিয়া আসিতেছিল, দ্বিজেনবাবু ডাকিলেন—শোন।
-আজ্ঞে?
-আমি কিন্তু তোমাকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি না। লেখাটা পড়ে মতামত জানাবো, এটুকু কেবল জানালাম। লেখা যেমনই হোক, আমি ছাপিয়ে দিতে পারি, কিন্তু তাতে তোমার সর্বনাশ করা হবে–
কাজল হাসিয়া বলিল—ঠিক আছে। মোপাসা আর ফ্লোবেয়ারের গল্প আমি জানি।
হপ্তাখানেক বাদে কাজল দ্বিজেনবাবুর মতামত জানিতে গেল। তিনি বলিলেন—পড়লাম তোমার লেখা। আর কতদূর বাকি আছে?
–আজ্ঞে দশ-পনেরো দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
-লেখা ভালো হয়েছে। তোমার গদ্য সুন্দর তা তো আগেই বলেছি। অপূর্ববাবুর বইখানা জনপ্রিয়। তাঁর উপন্যাসের পরবর্তী পর্ব তারই পুত্র লিখেছে—এতে পাঠকদের মনে আগ্রহ জাগা স্বাভাবিক। আমার বিশ্বাস-এ বই পড়ে তারা নিরাশ হবে না।
কাজল যেন কিছুটা অবিশ্বাসের সুরে বলিল—তার মানে আপনি–
-বইখানা আমি ছাপাবো। যত তাড়াতাড়ি পাররা শেষ করে আমাকে কপি দাও—
ঝুঁকিয়া দ্বিজেনবাবুকে প্রণাম করিতে গিয়া কাজল কাঁদিয়া ফেলিল।
বাহিরে আসিয়া কাজল দেখিল হ্যারিসন রোডে ট্রাম চলিতেছে। অফিস-ফেরত লোকের ভিড় চলিয়াহে শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে। জ্ঞানবাবুর চায়ের দোকানে চা-রস-প্রত্যাশীদের সান্ধ্য সমাগম আরম্ভ হইয়াছে। ফুটপাথের উপর কাপড় বিছাইয়া একজন খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা লোক যশোরের চিরুনি বিক্রি করিতেছে। সবই অবিকল ঠিক অন্য অন্য দিনের মতো। কেবল তাহার জীবনে অনতিদূর ভবিষ্যতে এক আশ্চর্য পরিবর্তন আসিতেছে। সবাইকে কথাটা জানাইয়া দিলে হয় না?
বই বাহির হইবার দশ-বাবোদিন আগে বিখ্যাত সাময়িক পত্রগুলিতে তাহার উপন্যাসের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হইল। হৈমন্তী দেখিয়া ভারি খুশি। বলিল–সেকালে বাণভট্টের ছেলে ভূষণভট্ট বাবার আরব্ধ কাজ শেষ করেছিলেন, তুইও তাই করলি–
কিন্তু রাত্রে শুইয়া কাজলের মনে হইল—বাবার কাজ আমি শেষ করিনি, ও কাজ তো শেষ হয় না। বাবা বিশ্বাস করতেন জীবন অনন্ত, পথের কোন আরম্ভও নেই, শেষও নেই। তিনি যেখানে থেমেছিলেন, আমি সেখান থেকে শুরু করে কিছু পথ হাঁটলাম মাত্র। পথ তো পড়ে রইল সামনে–হয়তো ভবিষ্যতে এখান থেকে কেউ আরম্ভ করবে–
বই প্রকাশিত হইবার পর পাঠকমহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। কেহ বলিল—চমৎকার হয়েছে। অপূর্ববাবুর ফিলজফির সঙ্গে অদ্ভুতভাবে সঙ্গতি রেখে লিখেছেন লেখক। অথচ নকলনবিশী নয়—ভাষায় স্পষ্ট স্বকীয়তা আছে। কেহ বলিল–প্রথম থেকেই লক্ষ করা যাচ্ছিল লেখক বাবার নাম ভাঙিয়ে খেতে চান, এই উপন্যাস রচনা সে পথেই আর একটি পদক্ষেপ।
সমালোচনা যেমনই হোক, প্রথম মাসে উপন্যাসটির পাঁচশত কপি বিক্রয় হইয়া গেল। তাহার পর বিক্রি কিছুটা কমিলেও মোটামুটি কাটতি বজায় রহিল। দ্বিজেনবাবু বলিলেন—বিরূপ সমালোচনায় ভেঙে পড়বে না। মনে রেখ, বিরূপ সমালোচনাও একটা প্রচার। আসল মতামত দেবে পাঠকেরা—দেখা যাক তারা কী বলে?
প্রথমদিকের দ্রুত বিক্রিব কাছাকাছি আর না পৌঁছাইলেও বইখানা একেবারে গুদামে পড়িয়া রহিল না, কিছু কিছু বিক্রি হইতেই লাগিল।
এইসময় ডাকে তাহার নামে একদিন একখানা খাম আসিল।
কলিকাতা হইতে একটি মেয়ে চিঠি লিখিয়াছে। তাহার পরিবাবের সকলে কাজলের বই পড়িয়া অবাক হইয়া গিয়াছে। ভূমিকার শেষে যে ঠিকানা ছিল সেই ঠিকানা ব্যবহাব করিয়া চিঠি লিখিতেছে। তাহারা কী একবার বাড়িতে আসিয়া লেখকের সহিত আলাপ করিতে পারে?
পারে বইকি, নিশ্চয় পারে। ব্যস্ত হইয়া কাজল স্নান-খাওয়া না সারিয়াই বাহির হইয়া পোস্ট অফিসে গেল এবং সেখানে দাঁড়াইয়াই পত্রের উত্তর দিযা আসিল।
দিনদশেক বাদে এক রবিবার সকালে একজন মধ্যবয়স্ক সৌম্যমূর্তি ভদ্রলোক দুই মেয়ে লইয়া আসিয়া হাজির হইলেন। মেয়েরা স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ে, তাহাদের আচরণ সহজ ও সপ্রতিভ। ভদ্রলোক সরকারি চাকরি হইতে সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করিয়াছেন। তাহারা সকলেই অপুর্বকুমার রায়ের লেখার পরম ভক্ত। বিজ্ঞাপন দেখিয়া প্রথমে বিশ্বাস করেন নাই যে অপূর্ব রায়ের ছেলের উপন্যাস বিশেষ কাজের কিছু হইবে। যাহা হৌক, কৌতূহল হওয়ায় কিনিয়া পড়িয়াছেন এবং আশ্চর্য হইয়া গিয়াছেন।
মেয়ে দুটি মুগ্ধ চোখে কাজলের দিকে তাকাইয়া ছিল। ভদ্রলোক থামিতে তাহাদের মধ্যে বড়োজন বলিল—আমাদের দুইবোনে ঝগড়া হত আপনার বইখানা কে আগে পড়বে তাই নিয়ে। তারপর ঠিক করে নিলাম—একঘণ্টা আমি পড়বো, একঘণ্টা বোন পড়বে—
ছোটজন বলিল—আমরা আগে কখনও এত কাছে থেকে লেখক দেখিনি, জানেন? বাবা দেখেছেনবাবার সঙ্গে শরৎচন্দ্রের আলাপ ছিল–
ভদ্রলোক সবিনয়ে বলিলেন–না না, আলাপ নয়। আমার এক বন্ধুর বাবা নামকরা কবিরাজ ছিলেন। তিনি শরৎচন্দ্রের চিকিৎসা করতেন। তার সঙ্গে একবার শরৎবাবুর বাড়ি গিয়েছিলাম। তখন তিনি বেশ অসুস্থ, বসে গল্প করার মতো অবস্থা ছিল না। তবে হ্যাঁ, কাছে বসে ছিলাম ঘণ্টাখানেক। সেটাও কম কথা নয়, বলুন–
—তা তো বটেই, বড়ো মানুষের কাছে বসে থাকাই আনন্দ
—আমার তো মনে হয় শরৎবাবুর পর আপনার বাবার মতো সাহিত্যিক বাংলা ভাষায় আর আসেন নি। তার ছেলে আপনি-বইখানা পড়ে সত্যিই আমরা–
ছোটমেয়ে তাহার বইখানি এককপি লইয়া আসিয়াছিল। সেটি বাড়াইয়া ধরিয়া বলিল–আমাদের দুজনের জন্য এতে কিছু লিখে আপনার সই দেবেন দয়া করে?
অটোগ্রাফ! জীবনে ইহাও সম্ভব হইল!
অপুর প্রথম উপন্যাসের শেষপাতা হইতে দুইটি প্রিয় লাইন লিখিয়া নিচে কাজল নিজের নাম স্বাক্ষর করিল। জীবনের প্রথম অটোগ্রাফ।
জলখাবার খাইয়া পিতা-পুত্রীরা চলিয়া গেল বটে, কিন্তু ব্যাপারটার অনুরণন সারাদিন কাজলের মনের মধ্যে বাজিতে লাগিল।
আরও অনেক লিখিতে হইবে। অনেক–অনেক ভালো লেখা।
তাহার সময় হঠাৎ খুব কমিয়া গেল। স্কুল তো আছেই, তার উপর অপুর বইগুলির ব্যাপারে নানা কাজে ব্যস্ত থাকিতে হয়। নিজের লেখার জন্য যতখানি সময় দেওয়া প্রয়োজন তত সময় হাতে পাওয়া কঠিন হইয়া পড়িতে লাগিল। প্রায় প্রতিদিনই কয়েকজন করিয়া লোক আসে সাহিত্যিক অপূর্ব রায়ের স্ত্রী-পুত্রের সহিত আলাপ করিতে। ছুটির দিনে তাহার সংখ্যা বাড়ে। লিখিতে লিখিতে মাঝপথে উঠিয়া অতিথিসৎকার করিতে হয়। দেড়ঘণ্টা বাদে আবার লিখিতে বসিয়া সে আবিষ্কার করে গল্পটা মাথা হইতে অতিথিদের সহিত বিদায় লইয়াছে। অনেক প্রচেষ্টায় সেটিকে ফিরাইয়া আনিয়া দশলাইন লিখিতে না লিখিতে আবার দরজাব কড়া নড়িয়া ওঠে।
কিছুদিন আগে একদল ফিলমের লোক আসিয়াছিল। তাহারা অপুর প্রথম উপন্যাসখানি অবলম্বনে একটি ফিল্ম তুলিতে চায়। একজন মধ্যবয়স্ক বিরলকেশ সতর্ক চেহারার মানুষ তাহাদের দলপতি। তিনিই নাকি ডিরেকশন দিবেন। ভদ্রলোক মাথা চুলকাইয়া কিঞ্চিৎ ইতস্তত করিয়া বলিলেন—অপূর্ববাবুর লেখা তো এখন খুবই পপুলার। তবে কিনা, জানেন তো—সাহিত্যের ভাষা আর ফিল্মের ভাষায় কিছুটা পার্থক্য আছে। অপূর্ববাবু ছিলেন খাঁটি সাহিত্যিক, উনি তো আর ওঁব গল্প ফিল্ম হবে এ ভেবে লেখেন নিকাজেই ছবির খাতিরে গল্পের কয়েকটা জায়গা—মানে খুব সামান্যই—অদলবদল করতে হতে পারে। আমি এইরকম ভাবে ভেবেছি।
পরের পনেরো মিনিট ধরিয়া ভদ্রলোক কাজল ও হৈমন্তীকে যে কাহিনী শোনাইলেন, তাহা তাহার নিজের অপ্রকাশিত রচনা হইতে পারে, আজারবাইজানের উপকথা হইতে পারে কিন্তু কোনোমতেই অপুর উপন্যাস নহে।
হৈমন্তী নরম স্বভাবের হইলেও প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তেজ প্রকাশ করিতে পারে। সে দৃঢ়স্বরে বলিল—এ একেবারে অন্যরকম গল্প বলে মনে হচ্ছে, আমি এতে মত দিতে পারি না। তাছাড়া আমার স্বামীর ধারণা ছিল ওঁর এই লেখাঁটির চলচ্চিত্র হতে পারে না। তবু আপনারা অতিথি, কষ্ট করে এসেছেন, তাই আপনাদের কথা শুনলাম। কিন্তু ছবি করবার অনুমতি আমি দেব না।
পরিচালক বলিলেন—আমরা কিন্তু ভালো টাকা দেব–
হৈমন্তী বলিল—আপনার একথা অত্যন্ত অপমানজনক। আমার স্বামী তার বইগুলিকে নিজের সন্তান বলে মনে করতেন। আমিও তাই। টাকার জন্য কেউ নিজের সন্তানকে বিক্রি করে না। আচ্ছা নমস্কার—আমি ভেতরে যাচ্ছি। ডাল বসিয়ে এসেছিলাম, পুড়ে যাবে–
ভিতরের ঘরে যাইবার মুখে দরজার কাছে ফিরিয়া হৈমন্তী কাজলকে বলিল—তুমি এঁদের মিষ্টি আর চা দেবার ব্যবস্থা করো–
পরিচালক রুমাল দিয়া কপালের ঘাম মুছিয়া বলিলেন—আপনি যদি দয়া করে আপনার মাকে একটু বুঝিয়ে বলতেন—
কাজল বলিল–কিছু মনে করবেন না, মায়ের কথাই শেষ কথা। তাছাড়া আমিও মায়ের সঙ্গে একমত। আমার কিছু করবার নেই।
ফিমের দল একপ্রকার রাগ করিয়াই জলখাবারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিয়া চলিয়া গেল।