২০. সুমের (কাল : ১৯৪২ খৃষ্টাব্দ)

সুমের (কাল : ১৯৪২ খৃষ্টাব্দ)

১৯৪২ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট মাস। এক নাগারে বর্ষা চলছে এবং কয়েকদিন হল সূর্যের সাক্ষাৎই মিলছে না। পাটনা শহরে গঙ্গা উজিয়ে আসছে-যে কোনো সময় বাঁধ ভেঙে শহরে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা। এমন আশঙ্কাজনক অবস্থায় বাঁধের ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখা বিশেষ জরুরী। শহরের যুবক ও ছাত্ররা গঙ্গার বাঁধ দেখা-শোনার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়েছে। সুমের পাটনা কলেজের এম.এ. ক্লাসের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সে দীপাঘাটের পাশে বাঁধি দেখা-শোনার দায়িত্বে রয়েছে। মাঝরাতে তার মনে হয়েছিল গঙ্গা ভীষণভাবে ফুলে উঠছে। সকালেও গঙ্গার বিশাল জলরাশিকে আটকাবার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় নি–বঁধ থেকে বিঘৎখানেক নিচ দিয়ে গঙ্গার জলরাশি প্রবাহিত হচ্ছিল। শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যে আশু-বিপর্যয়ের এক গভীর আতঙ্ক। ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে হাজার হাজার মানুষ তৈরি কিন্তু সকলের মনেই গভীর সন্দেহ-গঙ্গার বাঁধকে আর এক ইঞ্চিও উঁচু করা সম্ভব। কিনা। সকাল থেকেই সুমের ব্যাকুল চিন্তা নিয়ে টহল দিচ্ছিল, দুপুরে জল কিছুটা কমতে দেখে সে স্বস্তি পেল। তার নজরে পড়ল, বাঁধের যে এলাকাটুকু সে টহল দিচ্ছিল সেখানে। এক সৌম্যমূর্তি ভদ্রলোক তার মতোই ঐ অঞ্চলে তদারকির কাজ করছিলেন। সুমেরের বেশ কয়েকবার, ইচ্ছে হয়েছিল ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করার কিন্তু আশু-বিপর্যয়ের দুর্ভাবনা ক্লিষ্ট মন সাড়া দেয় নি। এখন জল নামছে, মেঘ সরছে, সুমেরের বাসি ইচ্ছেটা আবার জাগিয়ে উঠল।

সুমের একুশ বছরের তরুণ, উঁচু নাক, ফর্সা রঙ, আর ঐ ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশের মতো, কিছুটা শিথিল স্কুল দেহ গায়ের রঙ কালো। সুমেরের পরণে খাকি প্যান্ট, হাফসার্ট, কাঁধে বর্ষাতি, পায়ে রবারের জুতো আর ঐ ভদ্রলোকের সাদা খদ্দরের পোশাক, মাথায় গান্ধী-টুপি এবং খালি পী। সুমের কয়েক পা এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল, ‘নমস্কার। জল এবার নামছে।’

‘আর বাদলা আবহাওয়াও কেটে যাচ্ছে।’

‘ক’দিন কি যে দুর্ভাবনা গেছে! এক জায়গায় পড়েছিলাম, আড়াই হাজার বছর আগে যখন পাটলিপুত্র নগরের পত্তন হয় তখন গৌতম বুদ্ধ ও তংরহের কথোপকথনে পাটলিপুত্রে। প্লাবনের কথা জানা যায়। বুদ্ধ, আগুন জল ও গৃহ-বিবাদ এই তিনটি জিনিসকে নগরের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন।’

‘মনে হচ্ছে আপনি ইতিহাসের ছাত্র?’

‘না, আমি রাজনীতির ছাত্র তবে ইতিহাসের মূল গ্রন্থগুলি অনুবাদের মাধ্যমে পড়তে আমি ভালোবাসি।’

‘হ্যাঁ, জল গত কয়েকদিন ধরেই আমাদের শত্রু হিসাবেই হানা দিয়েছিল।‘

‘আগুনের ভয় তখন ছিল, যখন পাটলিপুত্রের অধিকাংশ বাড়ি-ঘর ছিল কাঠের আর ছিল শহরের আশপাশে বিপুল শালবন। অগ্নিকাণ্ড তখন প্রায়ই হত।’

‘আচ্ছা, আপনার নামটা জানতে পারি?’

‘আমার নাম সুমের, আমি পাটনা কলেজের ফিফথ ইয়ারের ছাত্র।’

‘আর আমার নাম হল রামবালক ওঝা। প্রায় কুড়ি বছর আগে আমি পাটনা কলেজের ছাত্র ছিলাম। এক বন্ধুর প্রভাবে এম, এ, ডিগ্ৰী না নিয়েই অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। অবশ্য সৌজন্য আমার কোনো অনুশোচনা নেই কারণ আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি স্কুল কলেজের শিক্ষা একটা অনৰ্থকারী ব্যাপার।’

‘তবে আপনার অধীত বিদ্যা সব ভুলে গেছেন?’

‘কখনো কখনো বেমালুম ভুলে যাই। যদি একেবারে সাদা শ্লেট হয়ে যেতে পারতাম তাহলে খুবই ভালো হত-সত্যকে সুদৃঢ়ভাবে ধরে থাকা সম্ভব হত।’

‘অৰ্থাৎ আপনি বুদ্ধিমাৰ্গ ত্যাগ করে ভক্তির পথে চোখ বুজে চলতে চান?’

‘সুমেরবাবু আপনি কি ভক্তির পথকে নিন্দনীয় মনে করেন?’

‘ওঝাজী আমি বাবু নই, এক অভাজন মুচির ছেলে। জমিদারের জবরদস্তিতে বাস্তুভিটে হারিয়েছি। আমার মা কায়ক্লেশে বেঁচে আছেন মাত্র। এক সজ্জনের কৃপায় এইটুকু লেখাপড়া করতে পারছি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, বাবু হবার কোনো যোগ্যতা আমার নেই।‘

‘সুমেরজী, আপনার শিষ্টাচারের এখন পর্যন্ত যে পরিচয় পেয়েছি তাতে আমি খুব খুশী। জানেন কি, গান্ধীজি তাঁর এক হরিজন শিষ্যকে আপনার মতো জীবনসংগ্রামে ব্ৰতী দেখে কি আনন্দই না পেয়েছিলেন!’

‘ওঝাজী আপনার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে কথা বলতে চাই, সেজন্যে মনে হয় আমার মতামত আগেই জানিয়ে রাখা ভালো। হরিজন ‘শব্দটিকে আমি ঘৃণা করি আর ‘হরিজন’ পত্রিকাটি আমার মতে স্থিতস্বার্থের সংরক্ষক। ভারতে অন্ধকারকে স্থায়িত্ব দেওয়াই ঐ পত্রিকাটির কাজ। আর গান্ধীজিও আমার মতে জাতির ভয়ঙ্কর শত্রু।’

‘গান্ধীজি জাতির কোনো উপকার করেছেন বলে আপনি মনে করেন না?’

‘মজুরের ক্ষেত্রে কারখানার মালিক যে উপকার করে কারখানা খুলে, সেই ধরনের উপকার গান্ধীজিও করেছেন!’

‘গান্ধীজি কি শুধু মালিকদের স্বার্থেই কাজ করেছেন?’

‘জমিদার, পুঁজিপতি, দেশীয় রাজাদের ‘অভিভাবক’ বলার মানে অন্য কিছু কি হয়? আমাদের ওপর গান্ধীজির প্রীতি এই কারণেই যাতে আমরা হিন্দুসমাজের বাইরে চলে না যাই। পূণায় তিনি আমরণ অনশন করলেন–যাতে আমরা হিন্দুসমাজ ত্যাগ করে নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা গড়ে না তুলি। হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দুদের সস্তা দাসের চাহিদা আমাদের জাতের লোকরাই যোগান দিয়েছে। আগে আমাদের দাস বলা হত, গান্ধীজি এখন ‘হরিজন’ বলে আমাদের উদ্ধার করতে চাইছেন। উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের বাদ দিলে ‘হরি’ আমাদের এক বড় দুশমন। এখন ভেবে দেখুন, সেই ‘হরি’-র জন হবার বাসনা আমাদের কেন হবে!’

‘তাহলে আপনি ঈশ্বরেও বিশ্বাস করেন না?’

‘কি দরকার? হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট, অচ্ছুৎ বলে মনে করা হচ্ছে এবং সে সব চলছে ইশ্বরের নাম নিয়েই। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা কথায় কথায় অবতারের জন্ম দিয়ে রথ হাঁকিয়ে চলে আর আমাদের ঘরের মেয়েদের ইজ্জৎ লুণ্ঠিত হয়। শোনপুরের মেলায় জীবজন্তু কেনাবেচার মতো আমাদের নিয়েও বেচাকেনা হয়েছে। গালাগাল, প্রহার, অনাহারে মৃত্যু-আমাদের এসব কিছুকেই বলা হয়েছে ঈশ্বরের করুণা। কিন্তু হাজার হাজার বছরের এত অত্যাচার এত দুৰ্দশা যে ঈশ্বর দেখতে পায় না-তাকে মানতে যাব কোন যুক্তিতে।’

‘আপনি কি ডাঃ আম্বেদকরের পথ পছন্দ করেন?’

‘না, তবে ডাঃ আম্বেদকরও ভুক্তভোগী। কলেজ-জীবনের প্রথম-দ্বিতীয় বর্ষে আমাকেও হিন্দু ছাত্রদের হোষ্টেলে থাকতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু আম্বেদকরের পথ আর কংগ্রেসের অচ্ছুৎ-নেতাদের পথের মধ্যে আমি কোনো ফারাক দেখতে পাই না। উভয়ের পথই গান্ধী-বিড়লা-বাজাজদের পথের সঙ্গে মিশে গেছে। ওঁরা এখন চাইছেন কিছু অচ্ছুৎ পাঁচ-ছ’হাজারি তনুখাওয়ালা বানিয়ে দিতে। আছুৎদের মধ্যে থেকে বিড়লা-বাজাজ না হোক, অন্তত দু-চারজন হাজারীলাল হোক। কিন্তু দু-একজন অচ্ছুৎ যদি ছোটখাট জমিদার বনে যায় তা হলেও ভারতের দশ কোটি অচ্ছুৎদের শোচনীয় অবস্থার কিছুমাত্র পরিবর্তন হবে না।’

‘আপনি চান যাতে শোষণ বন্ধ হয়–তাই না।’

‘অবশ্যই। গরীবদের শ্রমে ফুলে-ফেপে ওঠা কিছুসংখ্যক মানুষের কর্তৃত্ব কেড়ে নিলেই আমাদের সমস্যার সমাধান সহজেই হতে পারে।’

‘সেই জন্যেই তো গান্ধীজি হাতে-তৈরি কাপড়, গুড় এবং হাতে-তৈরি সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।’

‘বটে! বিড়লা আর বাজাজের টাকার জোরে? খাদি-সংঘের দু’এক লাখ টাকা ঘাটতি পড়লেই কোনো না কোনো শেঠ এসে চেক কেটে দেয় কেন? যদি গান্ধীর চরকার দাপটে ওদের কাপড়ের কল বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হত, মুনাফায় টান ধরত কিম্বা রেশমী শাড়ির চাহিদা কমে যেত তাহলে কোনো শেঠ-শেঠানী গান্ধী-ভজনা করতে এগিয়ে আসত না–বুঝলেন ওঝাজী! এ ব্যাপারে আমার কোনো মোহ নেই।’

‘জাপানীরা থাবা বাড়িয়েছে। আপনি কি চান, তারা এ দেশের কল-কারখানা ধ্বংস করে দিয়ে যাক? কত পরিশ্রম, কত বিঘ্ন-বাধা অতিক্রম করে ভারতীয়রা এইসব গড়ে তুলেছেন-এ ব্যাপারগুলোও বিবেচনা করুন, সুমেরজী।’

‘পরিশ্রম, বিঘ্ন-বাধা এগুলো অবশ্যই বিবেচনাযোগ্য। কিন্তু ব্যাপারটা কি, একদিকে গান্ধীবাদীদের বক্তব্য যে তারা কল-কারখানার অস্তিত্ব এক মুহূর্তের জন্যেও মানতে রাজী নয় অন্যদিকে এ দেশের মালিকশ্রেণী বিশ্বাস করে জাপানীরা এলেও তাদের কল কারখানার মালিকানা সুরক্ষিত থাকবে। জাপানের বেতারভাষ্য শুনে এ সম্পর্কে তাদের আস্থা বেড়ে গেছে।’

‘তারা দেশের অর্জিত সম্পদ রক্ষা করতে চায়।’

‘কটা ঘায়ে নুন দেবেন না ওঝাজী। দেশের সম্পদ না নিজেদের সম্পদের দিকে তাদের নজর? তাদের মুনাফা লুণ্ঠনের সুব্যবস্থা থাকলে ও সব কল-কারখানা ধ্বংস হয়ে গেলেও কিছু আসে যায় না তাদের।’

‘মালিকদের সম্পর্কে যদি আপনার কথা মেনেও নেওয়া যায় তা হলেও গান্ধীজির সততা সম্পর্কে সন্দেহ করা আপনার উচিত নয়।’ ‘

‘কথা এবং কাজের মিল কিম্বা অমিল এর দ্বারাই আমি ব্যক্তির সততা যাচাই করি। আমি গান্ধীর দুগ্ধপোষ্য শিশু নই। এগুরুজ-ফাণ্ডের জন্য গান্ধীর পাঁচ লাখ টাকা দরকার ছিল আর বোম্বাই-এর শেঠেরা। পাঁচ দিনের মধ্যেই সাত লাখ টাকা এনে গান্ধীর চরণে সমৰ্পণ করেছিল। পুঁজিপতিশ্রেণীর জন্য তিনি যা করেছেন তাতে ইংল্যাণ্ড আমেরিকার ব্যবসায়িরা দরকার হলে সাত কোটি টাকার থলি উপুড় করে দিতে দ্বিধা করবে না!’

‘এর কারণ ব্যবসায়ী শ্রেণীর আস্থা অর্জন করেছেন তিনি।’

‘ব্যবসায়ীরা ভগবানকেও ঘুষ দেয়, তাই মন্দিরের দরজায় লিখে রাখে ‘শুভ-লাভ’।’

‘চরকা-খাদিকে এই শোষণ-ব্যবস্থার শত্রু বলে আপনার মনে হয় না?’

‘আমি চরকা-খাদি এইসব ব্যাপারগুলোকে শোষণ-ব্যবস্থা কায়েম রাখার কূটকৌশল বলেই মনে করি।’

‘তাহলে কল-কারখানাকেই শোষণ-প্রক্রিয়ার শত্রু মনে করা উচিত।’

‘তবে শুনুন, এ সম্পর্কে আমার বক্তব্য। পাথরের হাতিয়ার নিয়ে যে সভ্যতা শুরু হয়েছিল আজকের মানুষ সেখান থেকে অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। চরকা-র্তত সভ্যতার কোনো এক পর্যায়ে মানুষের অগ্রগতির সহায়ক হলেও আজ ওগুলো ব্যবহারিক যৌক্তিকতা হারিয়েছে। পাটনার যাদুঘরে দেখেছি। তালপাতায় লেখা পুথি। নালন্দার বিদ্যার্থীদের জন্য বইপত্তর লেখা হত তালপাতায়। ‘ফিরে চলো তালপাতার যুগে’-সাত জন্ম ধরে হেঁকে চলুন গান্ধীজি, দুনিয়া কিন্তু কলের কাগজ, মোনো টাইপ, রোটারি মেসিনে ছাপার যুগ থেকে তালপাতার যুগে ফিরে যাবে না। আর এই না যাওয়াটাই মঙ্গল। এ যেন ফ্যাসিস্ট হানাদারকদের ট্যাঙ্ক, বিমান, ডুবোজাহাজ ইত্যাদির বিরুদ্ধে পাথরের হাতিয়ার নিয়ে মোকাবিলা করতে বলছেন গান্ধীজি!’

‘আপনি দেখছি অহিংসার মহানূ সিদ্ধান্তও মানেন না!’

‘গান্ধীজির অহিংসা? ঈশ্বর রক্ষা করুন! যে অহিংসার মন্ত্রে কৃষক-মজুরদের ওপর সরকারের গুলি চালানোকে সমর্থন করা যায় আর ফ্যাসিষ্ট গুণ্ডাদের সামনে বৈষ্ণব বনে যেতে হয় তেমন অহিংসাকে বুঝে ওঠা আমার পক্ষে অসম্ভব। চরকা-খাদির ব্যাপারে আমার বক্তব্য শুনুন ওঝাজী, মিল মালিকেরা ভালোভাবেই জানে তাদের উৎপন্ন দ্রব্য সামগ্ৰীর সঙ্গে চরকা-তাঁতের উৎপাদন কোনো দিক থেকেই প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারে না। তাই তারা মুক্তহস্তে খাদি-ফাণ্ডে খয়রাতি দিয়ে যাচ্ছে। চরকা-খাদি এই ব্যাপারগুলো হল শোষণমুখী সমাজ-ব্যবস্থার সত্যিকার শত্রু সাম্যবাদের পথে একটা বড় বাধা! কত লোক যে ভুলভাবে বুঝে বসে আছে-সাম্যবাদ এবং কল-কারখানার ওপর শ্রমিকশ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠার চেয়ে খাদি-উদ্যোগ পন্থাই ভালো। এই ভ্ৰান্তি যাতে সহজে নষ্ট না হয় সে জন্যে মিল-মালিকেরা সব খাদি-ভক্ত হয়ে উঠেছে।’

‘আপনার বক্তব্য গান্ধী নীতির ওপর প্রত্যক্ষ আক্রমণ।’

‘গান্ধীবাদী আদর্শের প্রতিটি বক্তব্য আমাদের মতো কোটি কোটি শোষিত মানুষের কাছে মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর। মানুষকে গোলাম বানিয়ে রাখার, চিরস্থায়ী শোষণ-ব্যবস্থা চালু রাখার দালালদের গুদাম ঘরে আমরা চাই চিরকালের জন্যে তালা ঝুলিয়ে দিতে। আর গান্ধীজীর চেষ্টা-হল আমাদের ঠকিয়ে স্থিতস্বার্থের সেবা করা। ধনিকশ্রেণীর উচ্ছিষ্টজীবীদের যদি আমরা জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দিতে পারতাম তাহলে খুবই ভালো হত; আর তা না পারলেও তাদের রাস্তা আমরা আটকে দিতে চাই। একদিকে জাতিভেদ প্রথা অন্যদিকে শোষণ-ব্যবস্থা এই দুইয়ে মিলে ভারতবর্ষে আমাদের অস্তিত্ব বিলোপ করে দিতে চাইছে! আর গান্ধীজি উদ্ভট দার্শনিকতার সাহায্যে এ সব কিছুর ব্যাখ্যা করছেন। এই সব সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে ‘হরিজন-উদ্ধার’ নিছক ধোঁকাবাজী ছাড়া আর কি? অবশ্য এর ফলে উচ্চবর্ণের কিছু লোকের জীবিকার ভালোই ব্যবস্থা হচ্ছে।’

‘আপনি কি চান না বর্ণহিন্দু এবং অচ্ছুতেরা এক হয়ে যাক?’

‘যুগের দাবীতেই আমরা হয়ত এক হব, কিন্তু গান্ধীজির প্রিয়-ধর্ম, ঈশ্বর, সনাতন পন্থা আমাদের ঐক্যের পথে প্রতিবন্ধক। ওঝাজী, আমাকে দেখুন-আমার গায়ের রঙ পাকা গমের মতো, পাতলা উন্নত নাক। আর আপনার রঙ কালো, নাক চ্যাপ্টা। এর তাৎপৰ্য, আমার শরীরে আপনার তুলনায় আর্য রক্তের পরিমাণ বেশি। আপনার পূর্ব পুরুষরা বর্ণবিভাগের লৌহপ্রাচীর তুলে ভেবেছিলেন যে, রক্তের সংমিশ্রণ ঘটতে দেবেন না, কিন্তু তাঁদের সে আশা পূর্ণ হয়নি। এর জ্বলন্ত উদাহরণ আপনি এবং আমি–ভোলগা আর গঙ্গা তটের রক্তধারা সময়ের প্রবহমান গতিতে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তাই গায়ের রঙ নিয়ে ঝগড়া আর নেই। সব কিছুই ঠিক হয়ে যেত যদি ধর্ম, ঈশ্বর এবং সনাতনপন্থীরা এ–পথে বাধা হয়ে না থাকত। আর এখন শোষকশ্রেণী এবং তাদের প্রতিনিধি গান্ধীজি এসে আমাদের মিলনের পথকে আরও দুৰ্গম করে তুলেছেন।’

‘আচ্ছা, আপনি যখন চরকা-খাদি এ সবের ওপর আস্থা রাখেন না তখন কি মনে করছেন, বিদেশী সাম্যবাদ। ভারতের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে?’

‘যা কিছু শোষকশ্রেণীর স্বার্থের প্রতিকূল তাকেই তারা বলে বিদেশী, বলে অসম্ভব। চিনির কারখানা, বাষ্পীয় জাহাজ, মোটর, কাচ, ফাউন্টেন পেন ইত্যাদি জিনিসগুলো কোটি কোটি টাকা মুনাফা নিয়ে আসে। সুতরাং ওগুলো আর বিদেশী নয়। বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার, চলচ্চিত্র, রেডিও এ সবই তো বিদেশের জিনিস কিন্তু এখন স্বদেশী হয়ে গেছে যেহেতু ও সবের সাহায্যে এ দেশের মানুষকে খুব ভালোভাবে শোষণ করা যাচ্ছে। অর্থাৎ শোষণের তাবৎ উপকরণ বিদেশী হলেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু সাম্যবাদ যেহেতু শোষণমুখী সমাজ-ব্যবস্থা ধ্বংসকারী এক অমোস শক্তি তাই এ দেশের শাসকবৃন্দরা সব সময়েইসাম্যবাদ বিদেশী ভাবধারা এ দেশের মাটিতে চলতে পারে না–এমন একটা প্রচার তার স্বরে চালিয়ে যাচ্ছে। ওঝাজী এর নাম কি সততা!’

‘সাম্যবাদ। ধর্ম-বিরোধী আর ভারত চিরকালই ধর্মপ্রাণ-এটা ভেবে দেখেছেন?’

‘স্কুল-কলেজের শিক্ষা। আপনি বেমালুম ভুলে গেছেন ওঝাজী-আপনাকে কি করে। বোঝাতে পারি! ধর্মের কথা যখন আপনারা বলেন তখন আপনাদের মনে কেবল হিন্দুধর্মের ব্যাপারটাই থাকে। গো-সেবা মণ্ডল সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাংস ছাড়া গরুর সব কিছু খাওয়া চলবে এমন কি গোমূত্র গোবর পর্যন্ত। গান্ধীজি এই গো-সেবা মণ্ডলকে আশীৰ্বাদ জানিয়েছেন। ভারতে যদি গো-খাদক এবং গো-খাদক বিরোধীদের মধ্যে ভেদরেখা টানা হয় তবে দেখা যাবে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই গো-খাদক। আপনি তো জানেন আমাদের সম্প্রদায় গরু খায়, এর সঙ্গে যোগ করুন ভারতের সমগ্র জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ মুসলমানদের, কোটিখানেক খৃষ্টানদের এবং কয়েক লক্ষ বৌদ্ধকে। যদি গরু খাওয়া আর না-খাওয়া এতেই ধর্মধর্মের মীমাংসা হয়ে যেত তাহলে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বাদ দিয়ে দুনিয়ার অন্যান্য সব ধর্মাবলম্বীরা অধাৰ্মিক? গান্ধীজির ভূতপূর্ব বন্ধু লর্ড হ্যালিফ্যাক্স ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হিসেবে খ্যাতিমান। ধর্মের জিগীর তুলে তিনি সকলকে সাম্যবাদ থেকে দূরে থাকার জন্য প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। ওঝাজী, শোষকশ্রেণীর সবাই দারুণ রকম ধর্মপ্রাণ এবং শোষণ-বিরোধী যে-কোনো চিন্তাধারাকেই ধর্মের শত্রু হিসাবে ঘোষণা করা হয়।  হ্যাঁ, মেনে নিলাম সাম্যবাদী চিন্তাধারার জন্ম বিদেশে, কিন্তু খৃষ্টধর্ম, ইসলাম ধর্ম, রেল-তার-উড়োজাহাজ-কারখানা প্রভৃতি বিদেশ-জাত বস্তু আমাদের চোখের সামনে কেমন স্বদেশী হয়ে গেছে! সাম্যবাদও অদূর ভবিষ্যতে আমাদের কাছে বিদেশী ভাবধারা থাকবে না, যার প্রমাণ ইতিমধ্যেই পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠছে।’

 

২.

পাটনায় সান্ধ্যভ্রমণের দু’টি জায়গা-বাঁকীপুর ময়দান এবং হার্ডিঞ্জ পার্ক। দুটোর অবস্থাই এমন শোচনীয় যে কাউকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা তাদের আর নেই। তবু কিছু লোক আসে, যাদের পায়ের তলায় সর্ষে অথবা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কিছুটা আড্ডা দিতে হয়। অন্ধকার ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে-তিন বন্ধুর কথা এখনও ফুরোয়নি। তিনজনে বাঁকীপুর ময়দানে চলে এসেছে। ওদেরই একজন বলল, ‘ভাই সুমের, আবার বলছি-আর একবার ভেবে দেখ। বড় ভয়ঙ্কর গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে চলেছ।’

‘মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে যাচ্ছি। তাই হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। কথাটা দেখ রূপ, এটা কোনো দ্বিধাজড়িত পদক্ষেপ নয়।’

‘তুমি হাওয়ায় ভাসবে ভাই। আমার কিন্তু ঘরের ছাদের কিনারায় দাঁড়ালেই বুক ঢিবঢিব করে।‘

‘কত লোকের সাইকেল চড়তেই ভয় লাগে, আর তুমি দিব্যি চলন্ত সাইকেলে দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়।’

‘একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, মজুরশ্রেণীর জন্য লড়াকু সুমের কেন এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জীবনপণ করছে!’

‘ ‘কারণ একটাই। মজুরশ্রেণীর স্বাৰ্থ এবং এই মহাযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণাম এক বিন্দুতে এসে মিলিত হচ্ছে। এই যুদ্ধ শুধু সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের টানা-পোড়েন নয়, শোষকশোষিতের দ্বন্দ্বের এক নতুন অধ্যায় সূচনা করবে।’

‘এই যুদ্ধের জন্য সব চেয়ে বড় অপরাধী ইংরেজ পুঁজিপতিরা–এ কথাটা তুমি অস্বীকার করতে পার?’

‘বল্ডইউন, চেম্বারলেন যাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে তারাই যে দায়ী, এ ব্যাপারে আম তোমার সঙ্গে এক মত। কিন্তু সাম্যবাদের প্রসারকে রুখবার জন্যে ওরাই তো হিটলার মুসোলিনীকে মদত দিয়েছে, শক্তিশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। ভস্মাসুর শিবের বলে বলীয়ান হয়ে প্রথমে শিবের ওপরেই চড়াও হয়। এই মহাযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে সেই ধরনের তামাসা ঘটতে আমরা দেখলাম। কিন্তু এখন ভস্মাসুর শিবকে ছেড়ে আমাদের দিকে থাবা বাড়িয়েছে।’

‘আমি তো কোনো তফাৎ দেখছি না যুদ্ধের প্রথম অবস্থার সঙ্গে বর্তমানের।’

‘তফাৎ তো দেখতেই পাবে না-বেনিয়াগোষ্ঠীর লোক যে তোমরা। ফ্যাসিষ্ট শাসনেও বেনিয়াগোষ্ঠীর লোকের ঘি-মশলায় হাত পড়ে না। সোভিয়েত পরাজিত হলে মজুর কিষাণের সমস্ত আশা-ভরসা ধ্বংস হয়ে যাবে। ফ্যাসিষ্ট রাজত্বে মজুর-কৃষকরা তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবী তুলবারই সুযোগ পায় না; তাদের অবস্থা ক্রীতদাসদের মতো হয়ে ওঠে। আমাদের কাছে সোভিয়েত রাশিয়া অনেকগুলি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি রাষ্ট্র নয়–একমাত্র রাষ্ট্র। সারা বিশ্বের মেহনতী জনসাধারণের বন্ধন-মুক্তির একমাত্র আমার প্রদীপ। ঐ প্রদীপের শিখা নিভে গেলে সারা দুনিয়ায় ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে। তাই আমাদের দেহে যতক্ষণ প্ৰাণ আছে ততক্ষণ ঐ ফ্যাসিষ্ট স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাব।’

‘কিন্তু সুমের, দেশে আরও অনেক সমাজবাদী রয়েছে, তারাও তো চায় জগৎকে শোষণমুক্ত করতে।’

‘সেবাগ্রাম থেকে প্ৰলম্বিত অন্ধকারে যে-সব সমাজবাদীদের অস্তিত্ব তাদের অভিভাবক শয়তান। হিটলারও নিজেকে সমাজবাদী বলে, গান্ধীর চেলারাও। কিন্তু সমাজবাদী বলে নিজেকে জাহির করলেই কি সমাজবাদী হওয়া যায়!–ভারতবর্ষ হিটলার-তোজের শাসনাধীনে এলে এ দেশ থেকে পুঁজিপতিরা খতম হবে না। বরং আরও বেশি শক্তিশালী হবে। ফ্যাসিষ্ট শাসনে সাম্যবাদীদের কি হাল হয় সেটা ইতালী ও জার্মানীর সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে তাকালেই বুঝতে পারবে। শুধু তাই বা কেন, ফ্রান্সে প্রতিদিন বহু কমিউনিস্টকে গুলি করে মারা হচ্ছে। যে নিজেকে মার্কসৃবাদী মনে করে ও এই যুদ্ধ থেকে। নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চায় সে একই সঙ্গে নিজেকে এবং অপরকে প্রতারিত করে।’

‘তার মানে তুমি বলতে চাও, এ যুদ্ধে কেউ নিরপেক্ষ থাকতে পারে না?’

‘ঠিক তাই। যার মস্তিষ্ক যথাযথভাবে কাজ করছে তাকে একটা না একটা পক্ষ। অবলম্বন করতেই হবে। এই যুদ্ধের পরিণতিতে হয়। সাম্যবাদী শক্তি খতম হয়ে যাবে না। হলে এমন শক্তিশালী হয়ে উঠবে যে, হিটলার-মুসোলিনী-তোজো এমন কি তাদের পিতৃপুরুষগণ-বন্ডউইন, চেম্বারলেন, হ্যালিফ্যাক্সদের পর রাখার মতো জমি দুনিয়ায় থাকবে না। যাদের তোমরা নিরপেক্ষ ভাবিছ তাদের নিরপেক্ষতা একটা লোক-দেখানো ব্যাপার।

‘আমাদের এখানকার ইংরেজদের মনোভাব তুমি কি লক্ষ্য করছ?’

‘ওরা অন্ধ-ত্রিশ বছর আগেকার জমানার গাড্ডায় পড়ে আছে এবং থাকতে চাইছে ওদের ধারণা যুদ্ধের শেষে দুনিয়ার হাল থাকবে যথা পূর্বম। এটাই স্বাভাবিক, যারা আমাদের প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রতি পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তারা পুরনোকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইবেই। দেখতেই পাচ্ছ, এ দেশের শাসক ইংরেজরা এখন সভামঞ্চ থেকে. ‘ জনগণকে আত্মত্যাগের উপদেশামৃত বিতরণ করছেন। অথচ গভর্নর, গভর্নর জেনারেলদের খরচের বহর দেখলে মাথা ঘুরে যায়। এ দেশের একজন মজুরের আয়ের সঙ্গে ঐ সব রাজপুরুষদের গত ২৫ বছরের আয়ের একটা তুলনা করলেই অসাম্যের আশমান-জমিন ফারাকটা খুব সহজেই বোঝা যায়। যেমন–

ভাইসরায়ের আয় ২,৫০,৮০০ টাকা, দেশীয় মজুরের তুলনায় ১০,০০০ গুণ।
বাংলার গভর্নরের আয় ১,২০,০০০ টাকা, দেশীয় মজুরের তুলনায় ৪,৮০০ গুণ।

যুক্ত প্রদেশের গভর্ণরের আয় ১,২০,০০০ টাকা, দেশীয় মজুরের তুলনায় ৪,৮০০ গুণ।

বিহারের গভর্নরের আয় ১,০০,০০০ টাকা, দেশীয় মজুরের তুলনায় ৪,০০০ গুণ।

এর সঙ্গে রাহা-খরচ, ছুটির বেতন এ সব ধরলে দেখা যাবে বাংলার গভর্নরের আয় একজন দেশীয় মজুরের তুলনায় ৪২,২৩১ গুণ বেশি। এর পাশপাশি ইংল্যাণ্ডের অবস্থাটা দেখ, সেখানে কয়লাখনির একজন মজুরের সাপ্তাহিক বেতন আমাদের হিসাবে ৩৫ টাকার মতো। ক্ষেত মজুরের সাপ্তাহিক আয় ৪৫ টাকার কাছাকাছি। এর সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রীর বেতনের যদি তুলনা করা যায় তাহলে তিনি স্বদেশের মজুরশ্রেণীর তুলনায় ৩৬ গুণ বেশি পান। আর সোভিয়েত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বেতন সে দেশের সর্বনিম্ন মজুরীর মাত্র ৬ গুণ বেশি। আমাদের শেঠগোষ্ঠীর আয়ের অঙ্ক হিসাব করলে তো মাথা খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়।

‘এ দেখছি লুটতরাজের চাইতেও বেশি।’

‘অপরিণামদর্শী ইংরেজদের কাছ থেকে আমরা সামান্য কিছুও আশা করি না কিম্বা; তাদের বাঁচাবার জন্যে আমরা এ যুদ্ধে সামিল হইনি। আমাদের লড়াই আগামী দিনের পৃথিবীতে সব মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য-যেখানে শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থায় মানবতা সুউচ্চ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবে।’

সমদ এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এ বার জিজ্ঞেস করল, ‘সুমের, তোমার অনেক কথার সঙ্গে আমি এক মত আবার কিছু ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করি। কিন্তু তোমার আদর্শকে আমি কি পরিমাণে শ্রদ্ধা করি সেটা তো তুমি জানো। এটা আমিও স্বীকার করি যে, এই বিশ্বযুদ্ধে আমরা কেউই নিরপেক্ষ থাকতে পারি না। কিন্তু তুমি বিমানবাহিনীতে ভর্তি হবার পর খবরটা আমাদের দিলে কেন?’

‘হ্যাঁ আগে খবর দিই, আর বাছাই-পর্বে ছাঁটাই হয়ে যাই! ভর্তি হয়ে ২৪ ঘণ্টা আকাশে। উড়ে তবেই তোমাদের জানিয়েছি। এখন জানাজানি হলে কোনো ক্ষতি নেই কারণ পরশু। আম্বালায় বিমান-চালনা প্ৰশিক্ষণ কেন্দ্রে চলে যাচ্ছি।’

‘তোমার মাকে খবর দিয়েছ?’

মা’র কাছে পাটনাও যা, আম্বালাও তাই। যতক্ষণ পরিষ্কারভাবে তাকে জানাতে না পারছি-আমি যুদ্ধের সৈনিক হিসাবে মৃত্যুর মুখে চলেছি ততক্ষণ তাঁর কাছে সবই এক। মাকে এখনই সব কথা খোলাখুলি লেখার অর্থ তাঁর সর্বক্ষণের ঘুম কেড়ে নেওয়া। আমি ঠিক করেছি, যতদিন বেঁচে থাকিব ততদিন তাঁকে নিয়মিত চিঠি দিয়ে যাব, আর এতেই তিনি শান্তি পাবেন।’

‘বারবার তোমার সাহসের কথাটাই ভাবছি।’

‘মানুষ হয়ে জন্মানোর মূল্য শোধ দেবার জন্য সদা-প্রস্তুত থাকতে হয় সমদ, তাছাড়া, যে আদর্শে আমি বিশ্বাসী তাতে আমার দায়িত্ব অনেক বেশি।’

‘তোমার ধারণা এই যুদ্ধের পরিণতিতে বিশ্বে বিরাট পরিবর্তন সূচনা করবো?’

আগের মহাযুদ্ধ পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটিয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার সাম্যবাদী শক্তির উত্থান, পৃথিবীর এক ষষ্ঠাংশ মেহনতী মানুষের রাজ্য কায়েম করা বড় কম কথা নয়। তাই বর্তমান মহাযুদ্ধের শেষে-আমার বিশ্বাস, এই আকাশের নিচে এক নতুন পৃথিবী জেগে উঠবে। আমাদের সঙ্গে রয়েছে মহান সোভিয়েত, রয়েছে তার লালফৌজ, চীন, ইংলণ্ড আমেরিকার জনগণ সর্বস্ব পণ করে এই যুদ্ধে লড়ছে, তাই জয় আমাদের সুনিশ্চিত।’

সমদ ও রূপাকিশোরদের তল্লাটে পাকিস্তানের দাবী নিয়ে আলোড়ন উঠেছে। রূপকিশোর সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলল, ‘গান্ধীবাদী স্বরাজ আসুক অথবা সাম্যবাদী স্বরাজ প্রতিষ্ঠা হোক, সেটা হবে গোটা ভারতবর্ষের জন্যে। মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে অখণ্ড ভারতে—আর এতে কি কোনো দ্বিমত থাকতে পারে সুমেরবাবু?

‘রূপকিশোর, ভারতবর্ষ শব্দটি একটি জটিল ধারণা মাত্র। স্বাধীনতা আমরা চাই কিন্তু এই দেশের জনগণই ঠিক করবে তাদের স্বাধীনতার স্বরূপ। স্বাধীনতা আকাশ থেকে টুপ। করে এ দেশের পুঁজিপতিদের মুঠোর মধ্যে পড়লে সেটা তো আর দেশের জনসাধারণের স্বাধীনতা হবে না!’

রূপ, ‘তোমার আদর্শ মতো স্বাধীনতা না-হয় এল, কিন্তু সেই স্বাধীনতার জন্য অখণ্ড ভারতকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করা চলতে পারে না।’

সুমের, ‘রূপকিশোর, তুমি শব্দের গোলকধাঁধায় পড়ে গেছ। ভারত খণ্ডিত হওয়া বা অখণ্ডিত থাকা নির্ভর করছে সম্পূর্ণভাবে ভারতবাসীদের ওপর। একদা হিন্দুকুশ পার হয়ে আমুদরিয়া পর্যন্ত ভারত রাষ্ট্রের সীমা ছিল এবং ভাষা, রীতি-রেওয়াজ ও ইতিহাসের দিক থেকে আফগান জাতি ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দশম শতাব্দী পর্যন্ত কাবুল হিন্দুরাজ্য ছিল—অখণ্ড হিন্দুস্থানওয়ালারা হিন্দুকুশ পর্যন্ত থাবা বাড়াতে রাজি আছে?

সিন্দু নদীর পশ্চিমে বসবাদকারী আফগানদের যদি ইচ্ছার বিরুদ্ধে অখণ্ড ভারতরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা না যায় তাহলে সিন্ধু, পশ্চিম পাঞ্জাব, কাশ্মীর, ও পূর্ববাংলার জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেন তাদের অখণ্ড ভারতরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে?’

রূপ, ‘তাহলে ওদের ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে দিতে হবে!’

সুমের, ‘নিশ্চয়ই। আমরা জনগণের জন্যে লড়াই করছি, এর অর্থ হল যে, সমগ্র দেশের জনগণের কোনো একটি অংশকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পরাধীনতায় রাখা চলবে না। পাকিস্তানের দাবীর মীমাংসা করা হিন্দু নেতাদের কাজ নয়, ঐ প্রশ্নের সমাধানের দায়িত্ব মুসলমান–প্রধান প্রদেশগুলি জনসাধারণের। যদি আমরা জনগণের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারি। তবে পুঁজিপতি-রাজ কায়েম হবে এবং স্বতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রও গড়ে উঠবে। যদি কায়িক ও মানসিক শ্রমজীবী মানুষের রাজত্ব কায়েম করতে পারি। তবে এই ভারতবর্ষের বহু স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীর এক অখণ্ড রাষ্ট্র গড়ে উঠবে। কিন্তু তার আগেই ভাষাগতভাবে পৃথক আশীটির বেশি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব যে এই বিশাল দেশে রয়েছে সেটা স্বীকার করে নিতে হবে।

‘আশীর বেশী? তুমি যে পাকিস্তানের দাবীকেও হার মানালে!’

‘যা বাস্তব তাকে অস্বীকার করি কি করে? আর মাতৃভাষা তাকেই বলে, যে ভাষায় কথা বলতে একটি বালকও ব্যাকরণে ভুল করে না। সোভিয়েত দেশ হল সত্তরটি জাতির সম্মেলনে এক বহুজাতিক রাষ্ট্র। সোভিয়েত দেশের দ্বিগুণ জনসংখ্যা অধুষিত ভারতবর্ষে যদি আশীটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা থাকে।তবে অবাক হওয়ার কি আছে?’

‘তবে কি তুমি পাকিস্তানের দাবীর পক্ষে?’

‘যতদিন এ দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মুসলমান ঐ দাবী করবেন, ততদিন পর্যন্ত। এটা তো দেখাই যাচ্ছে সমস্ত মুসলিম নেতারা ঐ দাবীতে অনড়। অমুসলমানদের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের দাবীর বিরোধিতা করা ন্যায়সঙ্গত নয়। যদি মুসলমান-প্রধান প্রদেশের অধিকাংশ মানুষ অখণ্ড ভারতরাষ্ট্র থেকে পৃথক হয়ে যেতে চান তবে তাঁদের সে অধিকার মেনে নেওয়া উচিত।’

 

৩.

নিচে কালো সমুদ্রের জলরাশি যেন প্রাণহীন, সামনে সাদা মেঘের বিশাল পাহাড়। চলন্ত বিমানে বসে এমনিতে গতিবেগ অনুভব করা যায় না। অবশ্য সুমের তার সামনের গতি-পরিমাপক যন্ত্রে দেখল, সে ৩০০ মাইল বেগে উড়ে চলেছে। সুমের ভাবছিল, সুদূর অতীতে মানুষ যখন পাথরের অমসৃণ হাতিয়ার আবিষ্কার করেছিল সেই সময়ের কথা। নিশ্চয়ই সেদিনের মানুষ ঐ পাথরের অস্ত্ৰ হাতে নিয়েই নিজেকে প্রচণ্ড শক্তিধর মনে করেছিল। আর আজ মানুষ আকাশের অধীশ্বর। মানুষের অগ্রযাত্রার গতিবেগও কি প্রবল। সহসা তার মনে পড়ে-মানবতার ঘৃণ্যতম শত্রু ফ্যাসিষ্টদের কথা। যাদের চেষ্টা, মানব প্রগতির অবদানগুলির সাহায্য নিয়ে সমগ্র মানবজাতিকে গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা। ঘৃণায় সুমেরের দেহমন রি-রি করে ওঠে, তার খেয়াল হল প্রতিবেশী ব্ৰহ্মদেশ জাপানী ফ্যাসিষ্টদের কবলে। ভাবনার গতিমুখ ঘুরে চলে স্বদেশের মাটিতে… কদমকুঁয়ার ঘর-বাড়ি, মানুষজন, সেখানে একটি মেয়ে যে তার প্রিয়া। তার বৃদ্ধা মা, যে অচ্ছুৎসমাজের মধ্যে আজন্ম বন্দী হয়ে থেকে তার মতো একটি ছেলেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে।

এই সব নিকট-দূর স্বদেশের মানুষের জন্য ভাবনা ও ভালোবাসা থেকেই তার মনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণার আগুন প্রচণ্ড তেজে জ্বলতে আরম্ভ করে। আর ঠিক সেই সময়েই সে সামনে দেখতে পেল সূর্য-চিহ্নিত তিনটি জাপানী বিমান। সুমের বেতারে খবর পাঠিয়ে দিল, ‘দুমিনিটের মধ্যেই জাপানী বিমানের মোকাবিলা করতে হবে।’ কথা-বলতে সময় লাগে, তার চেয়েও বেশি লাগে লিখতে কিন্তু চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে সুমেরের মেশিনগানের কার্যকরী আওতায় চলে এল জাপানী বিমান তিনটি।

ট্ট..ট্ট..ট্ট-নিখুঁত নিশানায় সুমেরের মেশিনগানের এক ঝাক গুলী বাতাস কেটে জাপানী বিমানগুলিকে বিদ্ধ করল আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফ্যাসিষ্ট দস্যুদের বিমান তিনটি সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়ল।

সুমেরের নিজের নৈপুণ্য প্রকাশ করার এটাই ছিল প্রথম সুযোগ। এই সাফল্যে সে খুব খুশী হল। ফিরতি পথে অন্য এক বৈমানিক শরীফকে বলল, ‘আমার নিজের দাম উশুল করে নিয়েছি। এই ভাবে আমরা প্ৰত্যেকে যদি তিনটি করে ফ্যাসিষ্ট বিমান ধ্বংস করতে পারি তা হলে আর কোনো ভাবনা নেই। এর পর যদি আমি মারাও যাই তবু সান্ত্বনা থাকবে যে, মৃত্যুর আগে আমার কর্তব্য কিছুটা পালন করতে পেরেছি।’

সুমের আরও ২০০ বার বিমান-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং প্রায় ১০০ জাপানী বিমান তার হাতে ধ্বংস হয়েছিল। জীবনের শেষ দিনে একটি বিরাট জাপানী বোমারু বিমান ধ্বংস করে সে বিরল কৃতিত্ব অর্জন করে। বোমারু বিমানটির পাহারাদার জঙ্গী বিমানগুলিকে ফাঁকি দিয়ে সে বোমারু বিমানটিকে ধ্বংস করে দেয়। সেই সঙ্গে সুমের ও তার–সঙ্গী বিমানচালকটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *