সুপর্ণ যৌধেয় – কালঃ ৪২০ খৃষ্টাব্দ
আমার ভাগ্যচক্ত যেন কেমন! কখনও এক জায়গায় স্থির থাকতে পারিনি। সংসার মরঙ্গ আমাকে সর্বদা চষ্ণল এবং বিহবল করে রেখেছে। জীবনে মধুর দিনও এসেছে যদিও তিক্ত দিনগুলোর তুলনায় সংখ্যায় কম আর পরিবর্তন তো যেন বর্ষাশেষে বাদলা দিনের মতো, বৃষ্টি আর রৌদ্রে লুকোচুরি । জানি না, এই পরিবর্তনের চক্ত কেন ঘুরছে।
পশ্চিম উত্তরাপথ গাদ্ধারে এখনও মধুপর্কে বাছুরের মাংস দেওয়া হয়। কিন্তু মধ্যদেশে (উত্তপ্রদেশ, বিহার) গোমাংসের নাম করা পাপ, এখানে গো-ব্রাক্ষণ রক্ষা করাই শ্রেষ্ট ধর্ম। আমি বুঝে উঠতে পারি না, একই ধর্মে এত বৈপরীত্য কেন! এক জায়গার অধর্ম কি অপর জায়গায় ধর্ম রুপে চলতে থাকবে; অথবা এক জায়গার পরিবর্তন আগে সাধিত হয়েছে, অন্যত্র পরে তার অনুকরণ করবে?
অবন্তীর (মালবা) এক গ্রামে ক্ষিপ্রা নদীতটে আমি জম্মগ্রহণ করেছি। আমার কুলের লোকের নিজেদের পরিব্রাজক বলে, যদিও এদের আপন ক্ষেত-খামার , ঘর-বাড়ি বয়ে গেছে এবং সেগুলো আপন স্বন্ধে বহন করে স্থানান্তরে নিয়ে যাওয়া চলে না । আমাদের কুলের লোকেদের দেহের গড়ন এবং রঙ ও রুপ গ্রামের অন্যান্য লোকজন থেকে কিছুটা পৃথক। আমরা অধিকতর দীর্ঘ, গৌর এবং সেই সঙ্গে আমাদের উৎকর্ষ অন্যদের কাছে ছিল অসহ্য। আমার মা গ্রামের স্ত্রীলোকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা সুন্দরী ছিলেন, তাঁর সুগৌর মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে-পড়া বাদামী চুলে—বড়ই সুন্দর লাগত। আমাদের পরিবারের লোক নিজেদের ব্রাহ্মণ বলত,কিন্তু আমি লক্ষ্য করতাম গ্রামের লোকের তাতে সন্দেহ রয়ে গেছে। সন্দেহের কারণও ছিল্ এইস্থানে ব্রাহ্মণদের ভিতর সুরাপান মহাপাপ বলে গণ্য হত, কিন্তু আমাদের গ্রহে তা বরাবর তৈরী হত িএবং পান করা হত। উচ্চকুলে স্ত্রী-পুরুষের সম্মিলিত নাচ-গান এখানে অশ্রুতপূর্ব, কিন্তু আমাদের কুলের সাতটি পরিবার—যারা একই বংশজাত, সন্ধ্যা হলেই খোলা জায়গায় এক সঙ্গে মিলিত হতাম। শৈশবে আমি ভাবতাম, সকল জায়গাতেই এই একই নিয়ম,কিন্তু গ্রামের অন্যান্য বালকদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে তাদের বিদ্রুপ বাক্যে বুঝতে পারলাম যে, তারা আমাদের অদ্ভুত ধরনের মানুষ বলে মনে করে এবং আমাদের কৌশীদ্যকে স্বীকার করলেও ব্রাহ্মণত্বকে সন্দেহ করে। আমাদের গ্রামখানা বেশ বড়, দোকান এবং ব্যবসায়ীদের বাড়িঘরও ছিল। গ্রামে কিছু নাগর পরিবার ছিল, লোকে তাদের বেনে বলত, কিন্তু তারা আমাদের মতোই নিজেদের ব্রাহ্মণ বলত। কিছু নাগর-কন্যা বিবাহসুত্রে আমাদের কুলে এসেছিল, গ্রামের লোকদের আমাদের ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার না করবার এটাও একটা কারণ। তাদের ব্ক্তব্য, ব্রাহ্মণের পান-ভোজন-বিবাহ রীতি অবহেরা করে আমরা কি করে ব্রাহ্মণ থাকতে পারি? আমার খেলার সাথী ছেলেদের যদি কখনও আমার ওপর রাগ হত তবে আমাকে ‘জুঝওয়া’ বলে অবজ্ঞায় নাক সিঁটকাত। এ সম্বন্ধে মাকে আমি অনেকবার প্রশ্ন করেছি, কিন্তু তিনি আমার প্রশ্নকে বরাবর এড়িয়ে গিয়েছেন।
দশ বছর বয়স হল আমার, গ্রামের েএক ব্রাহ্মণ গুরুর পাঠশালায় পড়তে যেতে লাগলাম। আমার সহপাঠীরা প্রায় সকলেই ব্রাহ্মণ—লোকের কথা অনুসারে সকলেই খাঁটি ব্রাহ্মণ। এরা ছাড়া আমি এবং অপর দুই নাগর বিদ্যার্থী ছিলাম। সহপাঠীরা আমাদের আধা-ব্রাহ্মণ বলে ডাকত। বিদ্যার্থীগণের মধ্যে আামি সবচেয়ে তীক্ষুধী ছিলাম এবং আমার প্রতি গুরুর বিশেষ স্নেহ ছিল। আামদের কুলে স্বভাব আমার মধ্যেও ছিল, এবং কারও কথা সহ্য না করে তার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করতাম। একদিন আমার এক সহপাঠী বিদ্রুপ করে বলল, “ব্রাহ্মণ হয়েছে, জুঝওয়া কোথাকার!” আমার কাকার বাল্যকপুত্র আমার পক্ষ নিতে এসেছিল, তাকেও বলল,“যবন কোথাকার, নাগর ব্রাহ্মণ হয়েছে!” শৈশবে ছোট ছেলেদের এমনি খোঁটা দিতে শুনেছি, কিন্তু তখনও সে সব আমাকে এত তীব্রভাবে আঘাত করেনি, অথবা ওতে এত কিছু ভাববারও অবকাশ হয়নি! আমরা তিনজন ছাড়া পাঠশালায় আরও ত্রিশজন বিদ্যার্থী এবং চারজন বিদ্যাথিণীও ছিল। এরা দেখতে আমাদের মতো ফর্সা বা দীর্ঘকায় নয়, তবু তারা এমন ভাব দেখাত যেন আমরা তাদের তুলনায় নিন্মশ্রেণীর মানুষ!
সেদিন ঘরে ফিরে এলে আমাকে বড়ই বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। আমার শুষ্ক অধর দেখে মা আমার মুখ-চুম্বন করে বললেন, “আজ এত বিমর্গকেন তুই?”
মা অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করাতে আমি বললাম, “মা, আমাদের কুলে কি এমন দোষ আছে , যে জন্য লোকে আমাদের ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার করতে চায় না?”
“পুত্র, আমরা পরদেশী ব্রাহ্মণ, এ জন্য তারা এ রকম ভাবে।”
“শুধু বাহ্মণ নয় মা, অব্রাহ্মণেরাও আমাদের ব্রাহ্মণত্বে সন্দেহ প্রকাশ করে।”
“ব্রাহ্মণেরা বলে বলেই অন্যরাও বলে।”
“আামাদের যজমানীও নেই; অন্র ব্রাহ্মণেরা পুরোহিতগিরি করে, ব্রাহ্মণ-ভোজনে যায়, আমাদের কুলে তাও দেখা যায় না। এ ছাড়া অন্য ব্রাহ্মণেরা তো আমাদের সঙ্গে পংক্তি ভোজনেও সম্মত হয় না। যদি এর কারণ জানো তবে বল মা।”
মা আমাকে অনেক বোঝাল কিনউত আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। আমার চিত্ত যখন চঞ্চল, সে সময় আমার নাগর সহপাঠী এবং আত্মীয়দের আামার প্রতি সহানুভূতি ছিল। অথবা বলা যায়, আমরা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলাম।
২
আরও কিছুকাল অতিবাহিত হল। আমি তের বছরের হয়ে উঠলাম এবং পাঠশালার শিক্ষা প্রায় সমাপ্ত হয়ে এল। বেদ, ঋগ্বেদ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ব্যাকরণ, নিরুক্ত এবং কিছু কাব্যও আমি পড়েছিলাম। আমার প্রতি গুরুদেবের স্নেহ ক্রমশ বেড়েই চলেছিল। তাঁর কন্যা বিদ্যা আমার চেয়ে বয়সে ছোট ছিল। পাঠ মুখস্থ করতে আমি তাকে সাহায্য করতাম। গুরুদেব এবং গুরুপত্বীর ব্যবহার দেখে বিদ্যাও আমাকে খুব মান্য করত, আমাকে “ভাই-সুর্পণ’ বলে ডাকত। গুরু পরিবারে আমার কখনও দুঃসময় আসেনি, কারণ গুরুপত্নীর স্নেহ আমার কাছে মায়ের সমানই ছিল।
এই সময়ে আবার একদিন এক সহপাঠী আমাকে “জুঝওয়া’ বলে বিদ্রুপ করল সম্পূর্ণ অকারণেই। নিজেকে আমি তখন সকল দিক থেকে দুরে সরিয়ে রেখেছিলাম। লেখা-পড়ায় আমি অত্যন্ত তীক্ষ্ণধী ছিলাম বলে সহপাঠীদের ঈর্ষা হত, এ ছাড়া বিদ্রুপের আর কোনো কারণ ছিল না। আমার প্রকৃতি গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। মন যে উত্তেজিত হত না, তা নয় কিন্তু আমি ধীরে ধীরে নিজেকে সংযত করতে শিখেছিলাম। আমার ঠাকুর্দার বয়স সত্তর বছরের ওপর। বহুবার আমি তাঁর কাছে দেশ-বিদেশের যুদ্ধ-অশান্তির কাহিনী শুনেছি। এত্ত শুনেছিলাম যে, তিনিই প্রথমে, আপন ভাই-এর সঙ্গে এই গ্রামে আসেন। ঠাকুর্দার কাছ থেকে আপন কুল সম্বন্ধে আসল কথা জানতে আমি দৃঢ়সঙ্কল্প হলাম।
গ্রামের পূর্বদিকে আমাদের আমবাগান ছিল। যথেষ্ট আম ফলেছিল সেখানে, যদিও পাকতে তখনও দেরী। সোনাদাসী ইতিমধ্যেই সেখানে নিজের ডেরা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। শুনেছি, আমার ঠাকুর্দা যখন গ্রামে এলেন তকন সোনাকে তিনি কোনো দক্ষিণদেশীয় ব্যাপারীর কাছ থেকে চল্লিশ রৌপ্য মুদ্রা দিয়ে কিনেছিলেন। ঐ সময় দক্ষিণ-দেশ থেকে বহু ব্যবসায়ী বিক্রয় করবার উদ্দেশ্য দাস-দাসীদের সঙ্গে করে নিয়ে আসত। সোনা তখন যুবতী চিল, না হলে দাসীরা কখনেই অত মহার্ঘ হয় না। সোনার দেহের কালো চামড়া ঢিলে হয়ে পড়েছিল, মুখমণ্ডল কুঞ্চিত বলিরেখায় ভরে গিয়েছিল, কিন্তু লোকে বলে, একদিন সে সুন্দরী ছিল। সে ছিল ঠাকুর্দার অ্যন্ত প্রিয়পাত্রী; বিশেষ করে যখন নিরালয় শুধু দু’জনে একত্রে থাকত। লোকে অবশ্য এই ঘনিষ্ঠতার অন্য অর্থ করত। বিপত্নীক স্বাস্থ্যবান এক প্রৌঢ় ব্যক্তির ওপর সে সন্দেহ খুবই স্বাভাবিক। সন্ধ্যাবেলা ঠাকুর্দা বাগানে যেতেন, একদিন আমিও তাঁর সঙ্গে গেলাম। ঠাকুর্দা আপন মেধাবী পৌত্রকে বড়ই স্নেহ করতেন। কথা বলতে বলতে আমি এক সময় বললাম, “দাদু, আমি তোমার কাছ থেকে আমাদের কুল সম্বন্ধে সত্যি কথা জানতে চাই, কেন লোকে আমাদের খাঁটি ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার করে না, কেন‘জুঝওয়া’ বলে বিদ্রুপ করে? মাকে আমি কতবার জিজ্ঞাসা করেছি, কিন্তু তিনি আমাকে এ সম্বন্ধে কিছুই বলতে চান না।”
“এ কথা তুমি কেন জিজ্ঞেস করছ ভাই?”
“বিশেষ প্রয়োজন আছে দাদু। যদি আমি আসল কথা সঠিকভাবে জানতে পারি, তবে নিজ কুলেয় অপমানের প্রতিকার করতে পারব। ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধে আমি এখন অনেক কিছু পড়ে ফেলেছি দাদু। আমার এতখানি বিদ্যাবল আছে যে, নিজের কুল সম্মান আমি অক্ষুণ্ণ রাখতে পারব।”
“সে কথা আমি ও বিশ্বাস করি। কিন্তু ভাই, তোমার মা বেচারীও আামার কুল সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে না। কাজেই, সে যে কিছু বলতে চায় না—এমন ভেব না। পৃথিবীতে আমাদের কুলের স্থিতি এখন নাগদত্তের সঙ্গে সম্বন্ধসুত্রে আবদ্ধ। আমাদের বিবাহ ইত্যাদি ওদের সঙ্গেই হয়। অবন্তী এবং লাট-এ (গুজরাট) ওদের সংখ্যাও অনেক, এ জন্য ওদের সঙ্গেই আামদের ডুবতে-ভাসতে হয়। তোমার বংশ যৌধেয় অপেক্ষা নাগরদের সঙ্গেই অধিক সম্পর্কিত।”
“যৌধেয় কি দাদু?”
“আমাদের কুলের নাম ভাই। এই জন্যেই লোকে আমাদের ‘জুঝওয়া’ বলে।”
“যৌধেয়রা কি ব্রাহ্মণ ছিল না দাদু?”
“ব্রাহ্মণের চেয়েও শুদ্ধ আর্য ছিল।”
“কিন্তু ব্রাহ্মণ তো নয়!”
“এর উত্তরে এক কথায় ‘হ্যাঁ’ কি ‘না’ বলার চেয়ে তোমাকে যৌধেয়দের সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়াই ভাল। যৌধেয়রা শতদ্রু এবং যমুনার মধ্যবর্তী হিমালয় থেকে মরুভূমি পর্যণ্ত বিস্তৃত অঞ্চলের অধিবাসি এবং সমগ্র যৌধেয় পরিবারই এই অঞ্চলের অধিকারী ছিল।”
“সমগ্র যৌধেয় পরিবার?”
“হ্যাঁ, তাদের কোনো একজন রাজা ছিল না, তাদের রাজ্যকে গণরাজ্য বলা হত। গণ বা পঞ্চায়েতই সকল রাজকার্য চালাত। তারা এক রাজার শাসনাধীন রাজত্বের অত্যন্ত বিরোধী ছিল।”
“এমন-রাঝ্যের কথা তো কোনোদিন শুনিনি দাদু?”
“কিন্তু এমন দেশই ছির ভাই। আমার কাছে যৌধেয় গণরাজ্যের তিনটি মুদ্রা আছে, আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলাম। দেশ ছেড়ে আাসবার সময় তাঁর সঙ্গে যে মুদ্রা ছিল, এগুলো তারই এক অংশ।”
“তুমি যৌধেয়দের দেশেই জন্মছিলে দাদু?”
“আমার বাবা-মাকে যখন দেশ ছাড়তে হল, আমি তখন দশ বছরের। আমার দু’জন বড় ভাই ও ছিল, যাদের বংশধরদের তু্মি এখানে দেখছ।”
“দেশ কেন ছাড়তে হল দাদু?”
“পুরকার থেকে ও জায়গা যৌধেয়দেরই ছিল। বহু প্রতাপশালী রাজা-মৌর্ষ, যবন, কেউেই রাজকর আদায় করা ছাড়া আমাদের গণরাজ্যকে কোনো আঘাত করেনি। চন্দ্রগুপ্ত, যিনি নিজেকে বিক্রমাদিত্য বলেন, এবং উজ্জয়িনীতে যাঁর দরবার বসে, সেই চন্দ্রগুপ্তের পূর্বপুরুষ যখন সিংহাসনে বসল, তখন তারা যৌধেয়দের উচ্ছেদ করল। যৌধেয়রা প্রতাপশালী সম্রাটকে কিছু কর দিত, কিন্তু সম্রাট তাতে খুশী হলেন না। তিনি বললেন, ‘আমি এখানে উপরিক (গর্ভনর) নিযুক্ত করব। এখানে আমার নিজের কুমারমাত্য (কমিশনার) থাকবে। আমি আমার সমগ্র রাজ্য যেভাবে শাসন করি, এখানেও তেমনি করব। আমাদের গণ-নায়কগণ অনেক করে বোঝাল যে, যৌধেয়রা অনাদিকাল থেকে গণ-শাসন ছাড়া অপর কোনো-শাসন জানে না; কিন্তু ক্ষমতামদমত্ত রাজা সে কথা মানে কেন? অবশেষে যৌধয়রা আপন ইষ্ট গণদেবীর সামনে শপথ গ্রহণ করে তরবারি ধরল। বহুবার তারা গুপ্ত-সেনানীকে মেরে হঠিয়ে দিল । যৌধেয়দের তুলনায় চার-পাচঁ গুণ বেশী সৈন্যনিয়েও গুপ্তসেনানীরাটি কতে পারত না। বিন্তু ব্রক্ষপুত্র থেকে মরু অষ্ণল পর্যন্ত বিস্তৃত সাম্রাজ্যের সমগ্র সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্দে যৌধেয়রা কতক্ষণ আপনাদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে পারে? গুপ্তদের সৈন্যেরা আমাদের শহর-গ্রাম সমস্ত ধ্বংস করে ুদল, নারীদের নৃশংসভাবে হত্যা করল। আমাদের লোকেরা ত্রিশ বছর পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়েছিল। বেশী রে দিতেও তারা প্রস্তুত ছিল, কিন্তু চেয়েছিল, তাদের গণ-শাসন ব্যবস্থা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে।”
“সৈন্য গণ-শাসন কেমন ছির দাদু?”
“সেই শাসনে প্রত্যেকটি যৌধেয় মাথা উঁচু করে চলত, কারও সমানে দীনতা প্রকাশ করতে তারা জানত না। যুদ্ধ তাদের কাছে একটা খেলাবিশেষ ছিল। এই জন্যই তাদের বংশের নাম যৌধেয় হয়েছে!”
“আমাদের মতো আরও কোনো যৌধেয় পরিবার এমনি রয়ে যায়নি?”
“হ্যাঁ আছে-হাওয়ায় উড়ে-যাওয়া শুকনো পাতার মতো ছড়িয়ে।”
“আর আমাদের মতো কেউ নাগর-বংশের সঙ্গে মিলে-মিশে আত্নবিস্থত হয়ে পড়েনি? তা’ছাড়া আমরা নিজদের ব্রাক্ষণ বলি কেন দাদু?”
“সে আরও প্রাচীন কথা ভাই। প্রথমে সর্বত্রই গণরাজ্য ছিল-রাজা বলে কিছুই ছিল না। সে সময় ব্রাক্ষণ আর ক্ষত্রিয়ের মাঝে কোনো প্রভেদ ছিল না।”
“ব্রক্ষ-ক্ষত্র একই বর্ণ ছিল দাদু?”
“হ্যাঁ, যখন প্রয়োজন হত লোকে পূজা-পাঠ করত, এবং প্রয়োজন মতো অস্ত্র ধরত। কিন্তু পরে বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠ এরা এসে বর্ণবিভাগ সুরু করল।”
“ঠিক কথা, তাই তো এক পিতার দুই পুত্রের মধ্যে কেউ রন্তিদেবের মতো ক্ষত্রিয়, কেউ গৌরিথীতির মতো ব্রাক্ষণ ঋষি হতে লাগলেন।”এমন কথা কোথাও কউ লিখেছে ভাই?”
“হ্যাঁ দাদু, বেদ এবং ইতিহাসে এমন কথা পাওয়া যায়। সংকৃতি ঋষির ঐ দুই পুত্র ছিল। এরও কত বিচিত্র কথা পুরাণে পাওয়া যায়, যে সব কথা আজকালকার লোকে বিশ্বাস করে না। চর্মবতীর (চম্বল) তীরে দশপুর দেখেছ দাদু?”
“হ্যাঁ, অবন্তী (মালবা )কতবার গিয়েছি; ওখানেই তো?সেখানে আত্নীয়-স্বজনের বিয়ে উপলক্ষে কতবার না আমি গিয়েছি। ওখানে অনেক ঘর নাগর আছে, আর তাদের ভিতর অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী আছে!”
“এই দশপুর রস্তিদেবের রাজধানী ছিল। আর চর্মণবতী নাম কি করে হল সে এক আশ্চর্য কাহিনী। ব্রাক্ষণ সংকৃতির পুত্র, কিন্তু নিজে ক্ষত্রিয় রাজা রস্তিদেব অতিথিসেবার জন্য খুব প্রসিদ্ধ ছিল। সত্যযুগের ষোলো জন মহান রাজার মধ্যে একজন। রস্তিদেবের ভোজনশালার জন্য প্রতিদিন দু’হাজার করে গরু মারা হত। তাদের চামড়া রসুইখানায় রাখা হত। তা থেকে যে রস গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ত তাতে এক নদীর সৃষ্টি হয়। চর্ম থেকে উৎপত্তি বলে তার নাম চর্মণবতী।”
“বৎস, এ সব কি সত্যিই পুরাণে লেখা আছে?”
“হ্যাঁ দাদু, মহাভারতে পরিষ্কার লেখা আচে?”
“মহাভারতে ,অর্থাৎ পষ্ণম বেদে? গোমাংস ভক্ষণ!”
“রস্তিদেবের ওখানে অতিথিদের খাওয়ার জন্য এই গোমাংস রন্ধনের কজে দু’হাজার পাচক নিযুক্ত ছিল। সেই সঙ্গে ব্রাক্ষণ অতিথিদের সংখ্যাও এত বেড়ে উঠতে যে, মাংস কম পড়ে যাওয়ার বয়ে পাচকরা, মাংসের বদলে ঝোল বেশী করে নেবার অনুরোধ জানাত। মহাভারতেই আছে-
তত্র ম্ম সৃদাঃ ক্রাশান্তি সুমৃষ্টমণিকুলা
সৃপং ভৃয়িষ্ঠমশ্লীধ্বং নাদ্য মাংসং যথা পুরা”
ব্রাক্ষণেরা গোমাংস খেত, কি বলছ ভাই?”
“মহাভারত হচ্ছে পষ্ণম বেদ-তাতে কি মিথ্যা লেখা হতে পারে দাদু!”
“দুনিয়া কি এত ওলোট-পালোট হয়ে গেল?”
“উল্টে-পাল্টেই যায় দাদু, তবু নিজেদের খাঁটি ব্রাক্ষণ বলা এই সব দিবান্ধরা সকলের চোখেই ধুলো দিতে চায়। আমি ্কন বুঝতে পেরেছি যে, আমাদের পূর্বজ যৌধেয়রা ব্রাক্ষণদের এই ছলাকৌশল ছড়াবার আগের যুগের ধর্ম এবং রীতিনীতি মেনে চলত।”
“হ্যাঁ, আর তারা কখনও ব্রাক্ষণকে নিজেদের চেয়ে উঁচু মনে করত না।”
“এখানে এসে তুমি পুত্র-ভ্রাত্বষ্পত্রের বিয়ে মাননীয় ব্রাক্ষণদের ছেড়ে নাগবদের সঙ্গে দিলে কেন?”
“দুটো কারণ ছিল। এক তো এই সব ব্রাক্ষণেরা আমাদের কুল সম্বন্ধে সন্দেহ করত; কিন্তু তাতে অবশ্য কিছু যেত-আসত না ইচ্ছে করলে আমরা খাঁটি ব্রাক্ষণ কন্যাকেই বিবাহ করতে পারতাম। নাগরদের সঙ্গে আমরা এই জন্যেই বিবাহস্বত্রে আবদ্ধ হলাম
*রাজ্ঞো মহানসে পূর্ব রস্তিদেবস্য বৈ দ্বিজ মহানদী চমারাশরুৎক্লেদাত সংস্বজে যতঃ
অহন্যতনি বধোতে দ্বে সহস্রে গবাং তথা ততশ্চর্ম দ্বতীত্যেবং বিখ্যাতা সা মহানদী”
“কিন্তু উত্তরাপথ (পাজ্ঞাব) এবং কাশ্মীরে এখনও হনেরা আছে, আচার্ষ!”
“বহূ ।ষ্ণল থেকেই তারা বিতাড়িত হয়েছে।”
“এমনিভাবেই ্ক রাজা অপরকে বিতাড়িত করে নিজ রাজ্য বিস্তৃত করে ।”
“কিন্তু গুপ্তবংশ গো-ব্রাক্ষণের রক্ষক।”
“আচার্য, মুঢ় ব্যক্তিদের ধোঁকা দেবার মতো এই সব কথা আমি আপনার মুখ থেকে শুনব আশা করি না। আপনি জানেন, আমাদের পুর্বজ ঋষিরা গো-রক্ষা করতেন গো-ভক্ষনের জন্য। ‘মেঘদুত’-এ আপনিই চর্মণবতীকে গো-হত্যা থেকে উদ্ভৃত রন্তিদেবের কীর্তি বলে বর্ণনা করেছেন-
“ব্যালম্বেথাঃসুরভিতনয়ালস্তজাং মানয়িষ্যন
স্রোতোমুর্ত্তা ডুবি পরিণতাং রস্তিদেবন্য কীর্তিম”
“তুমি ধুষ্ট সুপর্শ, যদিও তুমি আমার প্রিয় শিষ্য “
“আপনার তিরস্কার শুনতে আমি প্রস্তুত, কিন্তু আমি এটা সহ্য করতে রাজী নই যে আমার গুরু গণতন্ত্র হত্যাকারী গুপ্তরাজার সামনে চাটুকারের মতো পড়ে থাকবেন।”
“তুমি ওদের গণতন্ত্র-হত্যাকারী বলছ কেন সুপর্শ?”
“হ্যাঁ নন্দ, মৌর্ষ, শক আর হুনেরাও যে পাপ করেনি এই গুপ্তরা তাও করেছে। ভারতভুমি থেকে এরা, গণ-রাজ্যের নাম মুছে দিয়েছে।”
“গণ-রাজ্য এ যুগের অনুকূল নয় সুপর্ণ। যদি সমুদ্রগুপ্ত এইসব গণ-রাজ্যকে কায়েম রাখতেন, তবে তিনি হুন এবং অপরাপর প্রবল শত্রুদের পরাস্ত করতে পারতেন না।”
“সফলতা! নিজ রাজ্য কায়েম করবার! দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ম্যের্য হবার! কিন্তু চাণক্যের বিশ্ববিশ্রুত বুদ্ধির সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত মেীর্য –সাম্রাজ্যও বেশী দিন টেকেনি। বিক্রমাদিত্য আর কুমাগুপ্তও যাবৎচন্দ্রদিবাকর শাসন করবে না। কিন্তু এরা যে গণ-শাসনের চিহ্ন পর্যন্ত মুছে দিয়েছে তা কোন ধর্মকর্মের জন্য? অনাদিকাল থেকে চলে আসা গণ-রাজ্যের গণ-শাসনকে উচ্ছেদ করা কি অধর্মের কাজ নয়?”
“কিন্তু রাজা বিষ্ণুর অংশবিশেষ।”
“কুমার গুপ্ত নিজের সঙ্গে ময়ুরের চিত্র অস্কিত করবে এবং আগামী দিনের কোনো কবি তাকে কুমারের অবতার বলবে। এই ধোকাবাজী, এই বিকৃতি কিসের জন্যে? সুস্বাদু, দুগ্নধ চাল, আর মধুর মাংসসৃপের জন্যে, রাষ্ট্রের সমস্ত সুন্দরীকে আপন প্রমোদপুরে ঢুকাবার জন্যে, কৃষি আর শিল্পকর্মে নিষ্পেষিত মানুষের কষ্টোপার্জিত অর্থ আপন ভোগসুখে জলের মতো খরচ করবার জন্যে? আর এ জন্য আপনি গুপ্তদের ধর্ম-সংস্থাপক বলছেন!বিষ্ণু? হ্যাঁ, গুপ্তরা নিজেদের বৈষ্ণব বলে প্রচার করছে। ব্রাক্ষণেরা তাদের বিষ্ণুর অংশ বানাচ্ছে। মুদ্রার ওপর লক্ষীর মুর্তি অস্কিত করা হচ্ছে। বিষ্ণুর মুর্তি আর মন্দির তৈরীর জন্যে প্রজাদের তাতে মেরে, তাদের সর্বস্ব লুট করে প্রচুর টাকা খরচ করা হচ্ছে এই আশায় যে, গুপ্তবংশের রাজ্বত্ত অন্তকাল ধরে কয়েম থাকবে।”
“এ সব তুমি কি বলছ সুপর্শ! রাজার বিরুদ্ধে এত কঠোর কথা কেন বলছ?”
“হ্যাঁ আচার্য আজ আপনার সামনে বলছি, কোনোদিন পরমভট্টারক সহারাজের সামনেও বলব। জীবিতবস্থায় আমার পক্ষে এই ধোঁকাবাজী বরদাস্ত করা মুস্কিল। তবে এ ভবিষ্যতের কথা, কিন্তু আমি চাই আপনিও অশ্বঘোষের পদাস্ক ানসরণ করুন।”
“আমি নিছক কবি; অশ্বঘোষ কবি এবং মহাপুরুষ দুই-ই ছিলেন। তাঁর কাছে সংসারের সুখভোগের কোনো মূল্য ছিল না, আমি চাই বিক্রমাদিত্যের প্রমোদশালায় সুন্দরীদের মতো সুন্দরী, চাই রক্তবর্ণ দ্রাক্ষাসুরা, চাই প্রাসাদ এবং পরিচারক। আমি কেমন করে অশ্বঘোষ হতে পারি? আমি ‘রঘুবংশ’—এ ছদ্মনামে আমি গুপ্তবংশেরই প্রশংসা করেছি, যাতে প্রসন্ন হয়ে বিক্রমাদিত্য এই প্রসাদ দিয়েছেন, কাঞ্চনমালার মতো যবনসুন্দরী আমাকে প্রদান করেছেন—পনেরো বছর আমার সঙ্গে থেকে ও যে আমাকে তার সোনালী কেশ-পাশে বেঁধে রেখেছে। আমি এখন ‘কুমারসম্ভব’ রচনা করছি, দেখ এ কাব্য আরও কত কি এনে দেয় আমার হাতে।”
“আমি বিশ্বাস করি না আচার্য, আপনি যদি ‘বুদ্ধ-চরিত’ সৌন্দরান্দ’ লিতেন তবে আপনাকে বভুক্ষায় মরতে হত বা সর্বোতোভাবে ভোগসুখ থেকে বঞ্চিত হতেন। এ আপনার ভুল ধারণা, যে রাজার ক্ষতি না করলে আপনার জীবন সম্পূর্ণ রিস হয়ে যাবে। আগামী দিনের কবিদের জন্য আপনি অত্যন্ত কু-উদাহরণ রেখে যাচ্ছেন। সকলেই কবি কালিদাসকে অণুকরনের নামে নিজেদের দোষ ঢাকতে চাইবে।”
“মহৎ কাব্যও আমি রচনা করব।”
“কিন্তু এমন কিছুই লিখবেন না যাতে গুপ্তদের ভ্রষ্টাচার লোকে জানতে পারে।”
‘সে আমার দ্বারা হবে না সুপর্ণ, আমি বড় নরম হয়ে পড়েছি।”
“রাজানুষ্ঠি সকল পাপের সপক্ষে ধর্মের দোহাই তো দেবেন?”
“তারও প্রয়োজন আছে। এ ছাড়া রাজশক্তি দৃঢ় হতে পারে না, বশিষ্ঠ আর বিশ্বামিত্রও এ ধরনের কাজ করা প্রয়োজন মনে করেছিলেন।”
“বশিষ্ঠ আর বিশ্বামিত্রও কবি কালিদাসের মতো প্রাসাদ এবং সুন্দরীর লোভে এই পাপ-পথে পা বাড়িয়েছিলেন।”
“সুপর্ণ, পুথিগত বিদ্যা ছাড়াও শুনলাম, যুদ্ধবিদ্যাও তুমি আয়ত্ত করেছ, যদি তোমার সম্মতি থাকে তবে মহারাজাধিরাজকে বলি। তোমাকে কুমারামাত্য বা সেনানায়কের পদে অভিষিক্ত দেখলে খুশী হব আমি, মহারাজাও খুশী হবেন।”
“আমি কারও কাছেই নিজেকে বিক্রয় করব না আচার্য।”
“আচ্ছা, রাজপুরোহিতের মধ্যে একটা স্থান যদি পাও?”
“ ব্রাহ্মণদের স্বার্থপরতায় আমার ঘৃণা ধরে গেছে।”
“কি করবে তা’হলে?”
“আপাতত আরও বিদ্রঅর্জনের আমার বাসনা।”
৪
উচ্চয়িনীতে অবস্থানকালে আমি শুধু নিজের জ্ঞান-পিপাসা তৃপ্ত করবার সুযোগই পাইনি, সেই সঙ্গে বিস্তৃত এই সংসারকে জানবার সুযোগও হয়েছে। সেখানে থাকতে, কাছে থেকে সেই সঙ্গে বিস্তৃত এই সংসারকে জানবার সুযোগও হয়েছে। সেখানে থাকতে, কাছে থেকে আমি দেখেছি, কেমন করে ব্রাহ্মণেরা রাজার কাছে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের বিক্রয় করে দেয়। এমন একটা সময় ছিল যখন অপরে স্বীকার না করলেও ব্রাহ্মণত্বের গর্ব আমার প্রবল ছিল। গ্রাম ছেড়ে আসবার পর আমি খাঁটি যবনদের দেখলাম, যারা প্রায়ই ভরূকচ্ছ থেকে উচ্চয়িনী আসত। সেখানে তাদের বড় বড় পন্যশালা ছিল, আমি বছ শক, আভীর পরিবারে গিয়েছি, যাদের পূর্ব পুরুষেরা এক শতাব্দী আগে উজ্জয়িনী, লাট (গুজরাট) এবং সৌরাষ্ট্রের শাসক মহাক্ষত্রপ ছিল। পাকা নারঙ্গী রঙ-এর গাল, রোমহীন মুখমণ্ডল এবং গোলাকার আঁখিযুক্ত হুনদেরও আমি দেখেছি—যুদ্ধে অত্যন্ত নিপুণ, কিন্তু অন্যদিকে তেমন প্রতিভা নেই। এইসবব রকমারি মানুষজন দেখবার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হল বৌদ্ধবিহার (মঠ), যা একাধিক সংখ্যায় উজ্জয়িনীর বহির্দেশে রয়েছে। আমার মাতুল-কুলের লোকেরা বৌদ্ধ ছিলেন, আর বহু নাগর-ভিক্ষু এইসব মঠে থাকতেন। এ জন্য আমাকে প্রায়ই সেখানে যেতে হত। ভরূকচ্ছতেও আমি একবার গিয়েছিলাম।
পুথি-পাঠ সমাপ্ত করে আমি দেশভ্রমণের সাহায্যে আমার জ্ঞান প্রসারিত করতে চােইলাম। এই সময় আমি জানতে পারলাম যে, বিদৃর্ভে অচিন্ত্যবিহার (অজান্তা) নামে এক প্রসিদ্ধ বিহার আছে সেখানে পৃথিবীর সকল দেশের বৌদ্ধ ভ্ক্ষিুরা এসে থাকেন। আমি সেখানে গেলাম।
এতদিন পর্যন্ত আমি যেখানেই গিয়েছি, আমার সঙ্গে প্রচুর সম্বল এবং সঙ্গী নিয়ে গিয়েছি। এই প্রথম বার আমি নিঃসহায় নিঃসম্বল অবস্থায় বেরিয়ে পড়লাম। পথে চোর-ডাকাতের ভয় ছিল না; গুপ্তদের এই ব্যবস্থার প্রশংসাই করতে হবে। কিন্তু গুপ্তশাসন কি দেশের প্রত্যেক পরিবারকে এতই সমৃদ্ধশালী করে রেখেছে যে, বাটপাড়ি, রাহাজানি সম্পূর্ণ উঠে গেল? গুপ্তরাজেরা কর আদায়ের ব্রাপারে পুর্বতন সকল শাসককেই হার মানিয়েছে। রাজপ্রাসাদ তৈরীর কাজে কখনও এত অর্থ ব্যয়িত হয়নি। পাহাড়, নদী, সরোবর এমন কি সমুদ্রকে সশরীরে উঠিয়ে এনে এরা আপন সুরম্য প্রাসাদের সংলগ্ন করে রাখবার প্রায়স পেয়েছে। এদের ক্রীড়া-উদ্যান সত্যিকারের বনের মতোই মনোরম। এখানে পিঞ্চরে আদ্ধ হিংস্র পশু আর খোলা জায়গায় হরিণের দল গুরে বেড়ায়। ক্রীড়াপর্বতের স্বাভাবিক পার্বত্য বন-উপবন, জলপ্রপাত তৈরী করা হয়েছে। সরোবরের সঙ্গে যুক্ত কৃত্রিম জলস্রোতের ওপর সেতু আর নৌকার বহর দেখা যা। হাতির দাঁত, সোনা, রূপা নানা রকম রেশমী বস্ত্র এবং মহার্ঘ গালিচার প্রাসাদের অন্তদেশে সজ্জিত রয়েছে। প্রাসাদকে সজ্জিত করতে চিত্রকর তার তুলির সৌন্দর্য সবটুকুই ঢেলে দিয়েছে। ভাস্কর তার মর্মর এবং ধাতু-নির্মিত মূর্তি সুন্দর রূপ বিন্যাস করেছে। বিদেশী যাত্রী এবং রাজদূতের মুখে আমি এই সব চিত্র এবং মূর্তির ভুরি ভুরি প্রশংসা শুনেছি, যাতে সত্যিই আমার শির গর্বোন্নত হয়ে উঠেছে। কিন্তু যখন আমি ক্ষুদ্র গ্রামের পর্ণ কুটিরের অবস্থা দেখি, তখন উজ্জয়িনী এই সব প্রাসাদ আমার দেহের রক্ত চঞ্চল করে তোলে! মনে হয়েছে, গ্রামের এই দারিদ্র্যের কারণ এইসব প্রাসাদ।
গ্রামের নিপুণ শিল্পীরা নানা রকমের জিনিস তৈরী করে থাকে। স্ত্রীলোকেরা মিহি সুতা কেটে এবং তস্তুবায়রা তা দিয়ে সুক্ষ্ম বস্ত্র বয়ন করে। স্বর্ণকার, লৌহকার, চর্মকার আপন আপন শিল্প দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকে। রাজপ্রাসাদের কলাচার্তুর্ধময় আসবাবাপত্রের নির্মাতারা এদেরই আত্মীয়স্বজন। কিন্তু যখন আমি এদের দেহ এবং বাসগৃহের অবস্থা দেখেছি তখন বুঝতে পারি, এদেরই আত্মীয়স্বজন। কিন্তু যখন আমি এদের দেহ এবং বাসগৃহের অবস্থা দেখেছি তখন বুঝতে পারি, এদেরেই হস্তনির্মিত দ্রব্যসম্ভার এদের কাছে স্বপ্নময় স্বরূপ। এদের তৈরী শিল্প সামগ্রী গ্রাম থেকে নগর-শহরের সৌধ, প্রাসাদে চলে যায়। আবার সেখান থেকে অনেকে পশ্চিম সমুদ্রতীর ভরূকচ্ছ, আদিতীর্থ হয়ে পারস্য বা মিশররে পথ ধরে, অথবা পূর্ব সমুদ্রতীরে তাম্রলিপ্ত হয়ে যবদ্বীপ, সুবর্নদ্বীপ পৌঁছে যায়। ভাতরে সামুদ্রিক বাণিজ্য এত শক্তিশালী কোনোদিনই হয়নি, এবং আপন পণ্যের বিনিময়ে সমুদ্রপারের লক্ষ্মীও এত বেশী কখনও ভারতে আসেনি, কিন্তু এতে লাভ কার? সকলে চেয়ে বেশী গুপ্তরাজাদের, তারা সকল পণ্যের ওপর অত্যধিক শুল্ক আদায় করে; তাপরপ সামন্ত প্রভুদের মধ্যে যারা বড় বড় রাজপদ বা জায়গীরের অধিকারী, তার কারিগর এবং ব্যবসাদার দু’য়ের কাছে থেকেই লাভের অঙ্ক লোটে। ব্যবসাদারদের নাম সবশেষে করলেও এই তারাও লণ্ঠন-কর্মে নেহাত ছোট অংশীদার নয়। এদের সবাইকে দেখে আমার কাছে এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে, গ্রামের কৃষক এবং কারিগরেরা এত গরীব কেন, এবং ছোট-বড় রাজপথ সমূহকে সুরক্ষিত রাখবার জন্য গুপ্তরাজাদের এত তৎপরতাই বা কেন? গ্রামে দারিদ্র্য আছে ঠিকই, তবে শহরের মতো হৃদয়-বিদারক দৃশ্য গ্রামে কমই দেখা যায়। এখানে পশুর মতো ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য দাসদাসিদের হাট বসে না, ওদের নয় শরীরে চাবুকের দাগ চোখে পড়ে না। আমার গুরু কালিদাস কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, পূর্বজন্মের কর্মফলস্বরূপ লোকে দাস হয়। যেদিন তাঁর মুখে আমি এই কথা শুনি সেইদিনই পূর্বজন্ম সম্বন্ধে আমার সমস্ত বিশ্বাস উবে গেল। গুপ্তরাজারা যেভাবে ধর্মকে সকল রকমে আপন অস্তিত্ব দৃঢ় করবার কাজে লাগিয়েছে , তাতে এখন সকল চিন্তাশীল লোকেই মনেই এই অবিশ্বাস আসা স্বাভাবিক। কিন্তু যখন আমি সাধারণ প্রজাদের দেখতাম, তাদের এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন মনে হত—কেন? সম্ভবত তারা নিজেদের অসহায় মনে করত। গ্রামবাসীরা শুধু আপন গ্রামের খোঁজ-খবরটুকু রাখত—গ্রামের অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ জমির জন্য তারা যে ভাবে লড়াই করত সম্ভবত কুমারগুপ্তও নিজের কোনো প্রদেশের জন্য এত বিক্রমের সঙ্গে লড়তে পারত না। কিন্তু গ্রামের সীমার বাইরে যাই ঘটে থাক, িএরা তার কোনো খাঁজ রাখত না। একিট গ্রামের ঘটনা আমার মনে আছে। সেখানে প্রায় চল্লিশটি কুটির ছিল, সবই খড়ের ছাউনি। গরমের দিনে উনুন থেকে একটা ঘরে আগুন লেগে যায়। সারা গ্রামের লোক জল নিয়ে সেই ঘরের দিকে দৌড়ে গেল। কিন্তু একটি ঘরের এক দম্পতি ঘড়ায় জল ভরে আপন ঘরের কাছে বসে রইল। সৌভাগ্য-বশত গ্রামে এম গ্রত ঐ একটিই ছিল, না হলে গ্রামের একটা ঘরও সেদিন রক্ষা পেত না। সে সময় আমার যৌধেয় গণ-রাজ্যের কথা মনে পড়ে গেল, যেখানে রাষ্ট্রের সকল লোক আপন রাষ্ট্রের জন্য জীবন-মরণ পণ করতে কুণ্ঠিত হত না। এমনিতেই তো সমুদ্র গুপ্ত, চন্দ্রগুপ্ত, কুমারগুপ্তের দিগ্বিজয়ের জন্য লক্ষ লক্ষ লোক প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু সে শুধু দাসের মতো অপরের লাভের জন্য—স্বাধীন মানুষের মতো নিজের এবং নিজ নিজ জনগণের হিতার্থে নয়।
জনসাধারণের মধ্যে মাত্র একশ’ বছরের এই ুপ্তশাসনের প্রভাব লক্ষ্য করে আমার সমস্ত শরীর শিউরে উঠল । আমি ভেবে দেখলাম, ুদি এমন শাসন-ব্যবস্থা কয়েক শতাবঈ ধরে চলে, তবে এই দেশ সম্পূর্ণভাবে দাসের দেশে পরিণত হবে। যারা শুধু আপন রাজার জন্যই রড়তে-মরতে জানবে, যাদের মন থেকে এ চিন্তা বিলুপ্ত হবে যাবে যে, সব মানুষেরই কিছেু অধিকার আছে।
অচিন্ত্যবিহার বড়ই রমণীয়্ অর্ধচন্দুাকার নদীপ্রবাহ হরিৎবসনা পাহাড়ী উপত্যকার পাশ কেটে বয়ে চলেছে। এই ক্ষুদ্র অথচ সদানীরনা পাহাড়ী নদীর বামসতটে অবস্থিত পাহাড় কেটে শিল্পীরা কত গুহাময় সুন্দর মন্দির, নিবাসস্থল এবং সভাগৃহ রৈী করেছে। এই সব গুহাভ্যন্তরেও রাজপ্রাসাদের মতো চিত্র মুর্তি ইত্যাদি সজ্জিত-যদিও তা বহু পুরুষের পরিশ্রমের ফলে এবং সম্ববত আগামী কয়েক শত পুরুষের জন্য্। চিন্ত্য-বিহারের ভিত্তি-চিত্র সুন্দর, মর্মর-শিল্প সুন্দর । কিন্তু এগুলো গুপ্ত রাজপ্রাসাদের প্রতিদ্বন্দী হয়ে দাঁড়াতে পারে না, আর সে জন্য আমাকে তত আকর্ষণও করে না। হ্যাঁ, আমার কাছে আকর্ষণ ছিল এখানকার ভিক্ষুমন্ডুলী। দেশ-দেশান্তরের লোক প্রেমভাবে এক হয়ে এক পরিবারের মতো বাস করছে এখানে আমি সুদুর চীনের ভিক্ষুদের দেখেছি, পারসিক এবং যবন ভিক্ষুদের দেখেছি, সিংহল, যব এবং সুবর্ণদ্বীপের লোকও এখানে যথেষ্ট রয়েছে। চম্পাদ্বীপ, কম্বোজদ্বীপের নাম আমি এখানে এসেই শুনলাম এবং তাদের প্রাণবান অধিবাসীরে স্বচক্ষে দেখলাম; কপিসা, উদ্যান, তুষার এবং কুচা-র কাষায়ধারী পীতকায় ভিক্ষুদেরও এখানে দেখলাম; বাহিরের দেশগুলো সম্বন্ধে জানবার আমার প্রবল আকাঙ্কা ছিল। যদি এই সব বিদেশী ভিক্ষুদের পৃথক পৃথক সময়ে পেতাম, তবে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমি এক একটি বছর কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু এক সঙ্গে এত অধিক সংখ্যায় সমবেত ভিক্ষুমন্ডলীর মধ্যে –বিপুল ভৈবববের মাঝে পড়া দরিদ্রনিধির মতোই আমি নিজেকে অসহায় মনে করতে লাগলাম!
আমি দিঙনাগের নাম শুনেছিলাম। কালিদাস নিজে গুপ্তরাজ, রাজতন্ত্র এবং তাদের পরম-সহায়ক ব্রাক্ষণ্য ধর্মের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। আর কি অভিপ্রায় থেকে তা ছিলেন, সে কথা আগেই বলেছি। দিঙনাগকে তিনি তাঁর পরাক্রান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করতেন। করতেন বলতেন, ‘ এই দ্রাবিড় নাস্তিকের সমনে শুধু বিষ্ণু নয়, তেত্রিশকোটি দেবতারই সিনংহাসন টলে ওটে । রাজা ও ব্রাক্ষণের স্বার্থরক্ষার জন্য ধর্মের নামে আমি যা কিছু কুটকৌশল বের করি, তার রহস্য তার কাছে অজ্ঞাত থাকে না। মুস্কিল এই যে, বৃদ্ব বসুবন্ধুর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজধানী অযোধ্যায় বছর কয়েক কাটিয়েছিলেন- রাজদরবারী হয়ে নয়, স্বাধীন, সম্মানিত শুরুর মর্যাদা নিয়ে। পরে গুপ্তদের নীচতায় নিরাশ হয়ে আপন জম্নভুমি পুরুষপুরে চলে যান।
লৌহ-তীর অথবা খড়গ নয়, তার চেয়েও তীক্ষ্ণ জ্ঞান এবং তর্কের অস্ত্র বিতরণ করবার ব্রত দিঙরাগ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করলেই চোখের সামনে ব্রাক্ষণত্বের সমস্ত মায়াজাল তাসের ঘরের মতো ধ্বসে পড়ে। আমি ছয় মাস অচিন্ত্যবিহারে ছিলাম। প্রতিদিন দিঙনাগের মুখ থেকে তাঁর সর্বব্যাপী উপদেশাবলী শুনতাম। দিঙরাগের মতো শুরু পাওয়ায় আমার গর্বের শেষ ছির না। তাঁর জ্ঞান অত্যন্ত গভীর, আর বাক্য ছিল জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো। সংসারের বিস্তীর্ণ মায়াজাল দেখে আমার মতোই তিনিও ক্রোধোম্নত্ত হয়ে উঠতেন।
একদিন তিনি বলেছিলেন “সুপর্ণ প্রজাশক্তির সহায়তায় হয়ত কিছু করা যেত, কিন্তু জনসাধারণ এখন পথভ্রষ্ট হয়ে বহু দুর চলে গেছ্ তথাগত জাতিবর্ণ-ভেদ উঠিয়ে দেওয়ার জন্য অতীব প্রয়াস করেছিলেন দেশের বাইরে থেকে যবন, শক, গুর্জর আভীর –যারাই আসত, ব্রাক্ষণরা তাদের ম্নেচ্ছ বলে ঘৃণা করত। কিন্তু তথাগতের সঙ্ঘ তাদের মানুষ বলেই স্বীকার করে নিত।কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত মনে হয়েছিল. এ দেশ থেকে জাতিভেদ প্রথা মুছে যাবে কিন্তু ভারতের দুর্ভাগ্য যে গুপ্ত সম্রাটরা এখন ব্রাক্ষণদের খপ্পরে এসে গেছে। গুপ্তরা যখন প্রথম ক্ষমতায় এল, তখন ব্রাক্ষণরা তাদের ম্নেচ্ছ বলত। কিন্তু কালিদাস তাদের গৌরব বর্ধনের জন্য ‘রঘুবংশ’এবং ‘কুমারসম্ভব’ লিখলেন। গুপ্তরা আপন রাজবংশকে অনন্তকাল কায়েম রাখবার চিন্তায় পাগল হয়ে উঠেছে। ব্রাক্ষণরা তাদের এই আশায় ইন্ধন যোগাচ্ছে কিন্তু ভদন্ত বসুবন্ধু এমন কোনো আশা তাদের দিলেন না। তিনি লিচ্ছবী গণতন্ত্রের আদর্শে ভিক্ষুসঙ্ঘের অনুগামী ছিলেন। ব্রাক্ষণরা বৌদ্ধদের প্রবল পরাক্রান্ত প্রতিদ্বন্ধী বলে মনে করে। তারা জনে, সারা দেশের বৌদ্ধরা গোমাংস খায়। এই জন্য ব্রাক্ষনরা ভারতে গোমাংস বর্জন, গো-ব্রাক্ষণ রক্ষার আন্দোলন সুরু করে। বৌদ্ধরা জাতিবর্ণ ভেদ তুলে দিতে চায়। ব্রাক্ষণরা তাই বর্ণবহির্ভুত যবন, শক ইত্যাদিকে উচ্চবর্ণে অভিষিক্ত করতে থাকে। এই ফাঁদ এত জটিল যে , অনেক বৌদ্ধ-গৃহস্থ এতে জড়িয়ে আছে। এইভাবে প্রজাদের শক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে তারা রাজশক্তি এবং ব্রাক্ষণ-শক্তিকে দৃঢ় করতে চায়। কিন্তু এর পরিণাম আম্নঘাতী হবে সুপর্শ, কারণ দাসেদের শক্তির ওপর ভিত্তি করে কোনো রাষ্ট্র শক্তিশালী হতে পারে না।”
আমি আপন যৌধেয়কুলের আত্নোৎসর্গের কাহিনী বলাতে আেোর্ষের হুদয় অভিভুত হয়ে গেল। যখন আমি য্যেধেয় গণকে পুরনুজ্জীবিত করবার আপন ইচ্ছা তাঁর সামনে প্রকাশ করলাম, তখন তিনি বললেন, “আমার শুভেচ্ছা এব আশীর্বাদ তোমার সঙ্গে রইল। উদ্যোগী প্ররুষসিংহের কোনো বিস্ন-বাধাকে ভয় করা উচিত নয়।”
তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে আমি চলছি যেধেয় রাজ্যাভিসুখে। তাদের মৃত গণ-রাজ্যকে গুনরায় উদ্ধার করব, না হলে বালুতটে অস্কিত পদচিহ্নের মতো মিলিয়ে যাব।