বন্ধুল মল্ল (কাল : ৪৯০ খৃষ্টপূর্ব)
পূর্ণ বসন্ত কাল। গাছগুলির পাতা ঝরে গিয়ে নবপল্লবিত হয়েছে। শাল বৃক্ষগুলি তার শ্বেতপুষ্পের সুগন্ধ ছড়িয়ে বনভূমি আমোদিত করছে। সূর্য-কিরণ প্রখর তেজে দীপ্ত হতে এখনও দেরী আছে। শালের গহন বনে শুকনো পাতার ওপর মানুষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। দু’জন তরুণ-তরুণী পথ চলতে চলতে থমকে দাঁড়িয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগল একটি বড় বলীক (উই টিপি)। তরুণীর গৌরকান্তি মুখের ওপর কুঞ্চিত পিঙ্গল কেশরাশি চারিদিকে বেপরোয়ার মতো ছড়িয়ে থাকার সৌন্দর্য যেন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তরুণ তার বলিষ্ঠ হাতখনি তরুণীর কাঁধের ওপর রেখে বলল, ‘মল্লিকা! এই বলীক দেখে এত তন্ময় হলে কেন?’
‘দেখ এটা কত উঁচু, প্রায় দুই মানুষ সমান হবে।’
‘হ্যাঁ, ঠিকই, এটা সাধারণ উই টিপির চেয়ে বড়, কিন্তু বলীকের উচ্চতা এর চেয়ে বেশি দেখা যায়। তোমার হয়ত মনে হতে পারে বর্ষা শুরু হলে এর থেকে কি সত্যিই আগুন ও ধোঁয়া বেরোয়?’
‘না, ওটা বোধহয় কিংবদন্তী মাত্র। কিন্তু এই পিঁপড়ের মতো ছোট এবং কোমল রক্তমূখী সাদা পোকাগুলি কেমন করে এত বড় বল্মীক তৈরি করল?’
‘মানুষের শরীরের উচ্চতার সঙ্গে যদি তার হাতে-গড়া বাসস্থান মাপা যায় তাহলে তাও এই রকমই কয়েক গুণ বড় হবে। এ একটা উইপোকার কাজ নয়। শত সহস্ৰ উইপোকা মিলিতভাবে এই কাজ সম্পন্ন করেছে। মানুষও এইভাবেই মিলিত হয়ে নিজের কাজ করে।’
‘তাই আমিও ঔৎসুক্যের সঙ্গে লক্ষ্য করছিলাম যে, এদের নিজের মধ্যে কতই না মিল। এদের আমরা কত ক্ষুদ্র প্রাণী ভেবে থাকি, এরাও শত সহস্ৰ এক সঙ্গে মিলে নিজেদের জন্যে প্রাসাদোপম বাসস্থান নির্মাণ করেছে। আমার দুঃখ হয়, আমাদের মন্ত্ররা এই উইয়ের কাছে থেকে কোনো শিক্ষাই গ্ৰহণ করেনি।’
‘মানুষ মিলে-মিশে থাকতে কারুর চাইতে কম যায় না, বরং মানুষ যে আজ শ্ৰেষ্ঠ প্রাণী হতে পেরেছে তারও কারণ হচ্ছে একতা। আর এই জন্যেই মানুষ আজ এত বড় বড় নগর ও গ্রাম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে; তাই তাদের জলযান দিগন্তহীন সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দ্বীপ-দ্বীপান্তরের ধনরত্বে সংগ্রহ করেছে; আর এই জন্যেই হাতী-গণ্ডার-সিংহ মানুষের কাছে হার মানতে বাধ্য হচ্ছে।’
‘কিন্তু মানুষের ঈর্ষা? এই ঈর্ষা যদি মানুষের না থাকত–কত ভালো হত।’
‘তুমি মল্লদের ঈর্ষার কথা মনে করে বলছ?’
‘হ্যাঁ, তারা যে তোমায় ঈর্ষা করে। আমি কখনো তোমাকে অন্যের নিন্দা বা অপকার করতে দেখিনি, তোমার মধুর ব্যবহারে দাস ও কর্মকাররা পর্যন্ত কত খুশী–তবু বহু সন্ত্রান্ত মন্ত্র তোমার প্রতি প্ৰতিহিংসা পোষণ করে।’
‘কারণ, তারা আমায় দেখছে সর্বজনপ্রিয়া হতে। আর গণে (প্রজাতন্ত্রে) সর্বজনপ্রিয়কেই লোকে হিংসা করে, সর্বজন-প্রিয়রাই তো গণ-প্রধান বলে গণ্য হয়।’
‘কিন্তু তোমার গুণাবলী দেখে তাদের প্রসন্ন হওয়া উচিত। মন্ত্রদের মধ্যে কেউ তক্ষশিলায় এত সম্মান পেয়েছে বলে আজ পর্যন্ত শোনা যায় নি। তারা কি জানে না যে, কৌশলরাজ প্রসেনজিৎ পত্রের পর পত্র পাঠাচ্ছেন তোমাকে আহবান করে?’
‘আমরা এক সঙ্গে দশ বছর তক্ষশিলায় পড়াশুনা করেছি, তিনি তাই আমাকে স্নেহ করেন এবং আমার গুণগ্রাহী।’
‘কুসীনারার মন্ত্ররা নিশ্চয়ই সেটা জানে। মহালিচ্ছবি যখন এখানে এসে তোমার সঙ্গে ছিল তখন কুসীনারার অনেক লোকই তোমার গুণকীর্তন শুনেছে তার কাছে।’
‘কিন্তু মল্লিকা! আমার প্রতি তারাই ঈৰ্ষা করে, যারা আমার গুণের কথা জানে। গুণী এবং সর্বপ্ৰিয়া হওয়াটাই হল প্রজাতন্ত্রের ঈর্ষার বড় কারণ। আমি নিজের জন্যে মোটেই ভাবি না, কিন্তু আমার দুঃখ এই জন্যে যে, এত কষ্ট করে মন্ত্রদের সেবার জন্যে তক্ষশিলাতে অস্ত্ৰ-বিদ্যা শিখেছিলাম, তা কোনো কাজে লাগাতে পারলাম না। আজ যেমন বৈশালীর লিচ্ছবীিদের কৌশল এবং মগধ নিজেদের সমতুল্য মনে করে, তখন কিন্তু কুসীনারা কোশলরাজকে নিজেদের চেয়ে বড় বলে স্বীকার করত না। আমি ভেবেছিলাম যে, পাবা অনুপিয়া ও কুসীনারাদি ন’টি মল্লকে আমরা স্নেহবন্ধনে বেঁধে লিচ্ছবিদের মতো নিজেদের একটি সম্মিলিত সুদৃঢ় মল্ল প্রজাতন্ত্র গঠন করব। ন’টি মল্ল যদি পরস্পর মিলিত হত তাহলে প্ৰসেনজিৎ আমাদের দিকে চোখ তুলে চাইতেও সাহস করত না। তা আর হল না, এটাই আমার দুঃখ।’
বন্ধুলের গৌরকান্তি স্নান হওয়াতে মল্লিকার দুঃখ হল, সে তার মনকে বিষয়ান্তরে নিয়ে যাবার জন্যে বলল, ‘প্রিয়তম, তোমার বন্ধুরা শিকারে যাবার জন্যে হয়ত তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে, আর আমিও যেতে চাই। ঘোড়ায় চড়ে যাবে–না পায়ে হেঁটে?’
‘গবয় (নীলগাই) শিকার ঘোড়ায় চড়ে হয় না মল্লিকা, আর হাঁটু পর্যন্ত অন্তর্বােস পরে তিন্ন হাত লম্বা এলোমেলো উত্তরাসঙ্গ উড়িয়ে আর এই রকম নীটস্কো খুস্কো কাল-নাগিনীর মতো চুল দুলিয়ে কেউ শিকার করতে যায়?’
‘এ-সব বুঝি তোমার ভালো লাগে না?’
‘খারাপ!’ বলার সঙ্গে সঙ্গে মল্লিকার টুকটুকে ঠোঁটে চুম্বন করে বন্ধুল বলতে লাগল, ‘মল্লিকা নামের সঙ্গেও যার মিল আছে তাকেও আমার খারাপ লাগতে পারে না, কিন্তু শিকার করতে গেলে জঙ্গলে ঝোঁপের মধ্যে ছুটোছুটি করতে হয় যে।’
‘আচ্ছা, তাহলে তোমার সামনেই বেঁধে ফেলি।’ এই বলে মল্লিকা অন্তর্বাস কষে পরল, আর চুলগুলি সামনে খোঁপা বেঁধে বলল, ‘আমার চাদর দিয়ে পাগড়ী বেঁধে দাও, বন্ধুল!’
পাগড়ী বেঁধে দিয়ে বন্ধুল তার কাচুলির ভেতর থেকে উন্নত ক্ষুদ্র-বিল্ব-স্পর্ধী স্তন অর্ধালিঙ্গন করে বলল, ‘আর এ স্তন?’
‘সব মল্লকুমারীদেরই স্তন হয়।’
‘কিন্তু এ কত সুন্দর?’
‘তাতে কি! কেউ কি এ জিনিস কেড়ে নেবে?’
‘এ যে বন্ধুলের তা তারা জানে।’
‘না, মল্লিকা! তোমার আপত্তি না থাকলে আমি চাদর দিয়ে বেঁধে দি।’
‘কাপড়ের বাইরে থেকে দেখে কি তোমার তৃপ্তি হচ্ছে না?—মল্লিকা মুচকি হেসে বন্ধুলের মুখে চুম্বন করে বলল। বন্ধুল তার কাচুলিটা সরিয়ে দিয়ে শুভ্ৰ স্ফটিকশিলার মতো বুকের ওপর সেই আরক্ত সুডৌল স্তন চাদর দিয়ে বেঁধে দিল। মল্লিকা আবার কাচুলিটি পরে বলল, ‘এখন তো তোমার বিপদ কেটে গেছে বন্ধুল?’
‘বন্ধুলের নিজের জিনিসের জন্যে কোনো ভয় নেই প্রিয়ে! তুমি এখন খুব দ্রুত ছুটলেও ও দুটো বেশি দুলবে না।’
‘সমস্ত মল্ল তরুণ-তরুণীরা শিকারী বেশে সজ্জিত হয়ে এই তরুণ-যুগলের প্রতীক্ষা করছিল। তারা আসতেই সবাই ধনুক, খড়গ, ভল্ল বাগিয়ে রওনা হল। নীলগাই-এর মধ্যাহ্ন। বিশ্রামের জায়গা তাদের মধ্যে কারো কারো জানা ছিল। তাদের প্রদর্শিত পথ ধরেই মল্লরা চলল। বড় বড় গাছের অল্প পত্ৰহীন ছায়ার নিচে নীলগাইয়ের একটি দল বসে রোমন্থন করছিল। যুথপতি একটি বড় নীলগাই, খাড়া কান আগু পিছু করে পাহাড় দিচ্ছিল। মন্ত্ররা দু’দলে ভাগ হয়ে গেল—এক দল হাতিয়ার বাগিয়ে একটি গাছের আড়ালে গিয়ে বসল। অন্য দলটি আবার দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে জায়গাটি ঘিরবার জন্যে এগোতে লাগল। যেদিক থেকে এই দু’দল মিলাবার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল সে ধার থেকেই বাতাস আসছিল। নীলগাইটি তখনও তার হরিণের মতো ছোট লেজটি নাড়ছিল, দল দুটি মিলাবার আগেই অন্যান্য গাইগুলিও উঠে দাঁড়িয়ে নাক ফুলিয়ে কান সামনের দিক করে চঞ্চল হয়ে সেদিকে দেখতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই বুঝতে পারল যে, তারা বিপদগ্ৰস্ত হয়ে পড়েছে, তাই বাতাসের গতির সঙ্গে তারাও ছুটতে লাগল। তখনও পর্যন্ত বিপদ স্বচক্ষে দেখেনি। তাই মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে দেখছিল।
লুকিয়ে থাকা শিকারীদের কাছে এসে একবার তারা পেছন দিকে তাকিয়ে, এমন সময় ধনুকের টঙ্কার শোনা গেল। যুথপতি নীলগাইটির ঠিক কলিজা লক্ষ্য করে বন্ধুল অব্যৰ্থ শরসন্ধান করল। সঙ্গে সঙ্গে মল্লিকা এবং আরও অনেক বাণ ছুড়ল। কিন্তু বন্ধুলের বাণ ব্যর্থ হলে শিকার যে পালাত–সে কথা নিশ্চিত। নীলগাইটি সেখানেই পড়ে গেল। দলের অন্যান্য গরুগুলি ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিকে সেদিক ছুটিল, বন্ধুল কাছে গিয়ে দেখল শিকার শেষ নিশ্বাস নিচ্ছে। রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করে চলতে চলতে এক ক্রোশ দূরে আর একটি গবয়কে মাটিতে লুটানো অবস্থায় পাওয়া গেল এই সাফল্যের জন্যে আজকের বনভোজনে আনন্দ-উচ্ছাস বেশি।
কিছু লোক নিধুম আগুন প্ৰজলিত করতে লেগে গেল, আর মন্ত্র স্ত্রীলোকেরা রান্নার জন্য হাঁড়িপাত্র প্রস্তুত করল। কিছু পুরুষ নীলগাই-এর চামড়া খুলে মাংসখণ্ড কাটতে লাগল। সর্ব প্রথম আগুনে পোড়ানো কলিজা ও সুরা-চষক (মদের পাত্র) সকলের সামনে। পরিবেশন করা হল। মাংস কাটতে বন্ধুলের দু’হাত আটকা ছিল, তাই মল্লিকা নিজের হাতে ওর মুখে মাংস ও মদের পেয়ালা তুলে দিল।
সন্ধ্যা হয়ে এল, তখনও মাংস রান্না শেষ হয় নি। অগ্নিকুণ্ডের পোড়া-কাঠ স্কন্ধাগ্নি (কাঠের গুড়ির আগুন) তখনও নিভে যায় নি, তার লাল আভা যথেষ্ট ছিল। সেই রক্তিম সন্ধ্যায় মল্লরা নাচতে ও গাইতে শুরু করল। মল্লিকা, কুসীনারার সুন্দরতম তরুণী, শিকারীবেশে পূর্ণ সাফল্যের সঙ্গে স্বীয় নৃত্যকৌশল প্রদর্শন করল।
কুসীনারার সংস্থাগার (প্রজাতন্ত্রভবনের সভাগৃহ) আজ জনাকীর্ণ। গণসংস্থার (প্রতিনিধি পরিষদের) সকল সদস্য সদস্যশালার মধ্যে উপবিষ্ট। অনেক দর্শনেছু নর-নারী বাইরের মাঠে দাঁড়িয়েছিল। সদস্যশালার মাথার দিকের একটি উঁচু বেদীতে সভাপতি বসেছিল এসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভন্তেগণ! (পূজ্যগণ) শোন, আজ যে কাজের জন্যে আমরা এই সভায় উপস্থিত হয়েছি, তা আমি সকলের কাছে বলছি। আয়ুম্মান বন্ধুল তক্ষশিলা থেকে যুদ্ধবিদ্যা অর্জন করে মল্লদের গৌরব-বর্ধন করে ফিরে এসেছে। তার অস্ত্ৰনৈপুণ্যের কথা কুসীনারার বাইরের লোকও জানে। চার বছর হল সে এখানে এসেছে। আমি গণসংস্থার ছোটখাটো কাজগুলি তাকে করতে দিয়েছি, এবং সে প্রত্যেকটি কাজই খুব তৎপরতার ও সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেছে। গণের এখন উচিত তাকে একটা স্থায়ী পদে। নিযুক্ত করা-উপসেনাপতির পদের জন্য আমি তার নাম প্রস্তাব করছি। ভন্তে গণ! শোন, গণের পক্ষ থেকে আয়ুষ্মান বন্ধুলকে উপসেনাপতির পদে নিযুক্ত করার প্রস্তাব হচ্ছে। যে এ প্রস্তাবের পক্ষে সে নীরব থাক, আর যে বিরুদ্ধে–সে বলতে পোর। ভন্তে গণ! আবার বলছি, আয়ুষ্মান্য বন্ধুলকে গণের পক্ষ থেকে উপসেনাপতির পদ প্ৰদান করার প্রস্তাব করছি। যে এতে রাজী আছে সে নীরব থাক। আর যার আপত্তি আছে সে বলতে পার। ভন্তে গণ! আমি তৃতীয়বার বলছি, আয়ুষ্মান্য বন্ধুলকে গণসংস্থা সহকারী সেনাপতি নিযুক্ত করার প্রস্তাব। করছি। যে আয়ুষ্মান এতে রাজী আছে সে নীরব থাক আর যে রাজী নয়। সে তার বক্তব্য বলতে পার।‘
এমন সময় একজন সদস্য, রোজ মল্ল–চাদর সরিয়ে দিয়ে ডান কাঁধ খালি করে উঠে দাঁড়াল! সভাপতি জিজ্ঞাসা করল, ‘আয়ুষ্মান তুমি কিছু বলতে চাও? ঠিক আছে, তোমার বক্তব্য বল।’
রোজ মন্ত্র সকলকে সম্বোধন করে বলল, ‘ভন্তে গণ! আমি আয়ুষ্মান বন্ধুলের যোগ্যতা? সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ পোষণ করি না। তবে, আমি বিশেষ কোনো কারণে তাকে সহকারী ; সেনাপতি করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করছি। আমাদের গণের নিয়ম আছে যদি কাউকে। উচ্চপদে নিযুক্ত করা হয় তবে তার পরীক্ষা গ্ৰহণ করতে হবে। আমি তাই মনে করি আয়ুষ্মান বন্ধুলের বেলায়ও সে নিয়ম প্রয়োগ করা হোক।’
রোজ মন্ত্র বসার পরে আরও দু’তিন জন সদস্যও একই কথা বলল। আবার কিছু সদস্য পরীক্ষা গ্রহণের যে কোনো প্রয়োজন নেই তার ওপর বিশেষ জোর দিল। অবশেষে গণপতি বলল, ‘ভন্তে গণ! শোন, আয়ুষ্মান্য বন্ধুলকে সহকারী সেনাপতি নিযুক্ত করতে গণের মধ্যে কিছুটা মতভেদ দেখা দিয়েছে। তাই ছন্দ (ভোট) নেওয়া প্রয়োজন। শলাকা-গ্ৰহাপক (শলাকা বিতরণকারী) ছন্দ-শলাকা (ভোট গুণবার কাঠি) নিয়ে তোমাদের কাছে যাচ্ছে। তার এক হাতের ডালিতে লাল কাঠি এবং অন্য হাতের ডালিতে কালো কাঠি। লাল কাঠি হল প্রস্তাবের পক্ষে আর কালো কাঠি হল প্রস্তাবের বিপক্ষে। সে আয়ুম্মান রোজ মল্লের পক্ষে অর্থাৎ মূল জ্ঞপ্তির (প্রস্তাব)। বিরোধী, সে কালো কাঠি, এবং মূল জ্ঞপ্তির যে পক্ষেসে লাল কাঠি নেবে।’
শলাকা-গ্ৰহাপক ছন্দ-শলাকাগুলি নিয়ে একে এক প্রত্যেক সদস্যের কাছে গেল। সকলেই নিজ নিজ ইচ্ছানুসারে একটি করে শলাকা নিল; শলাকা-গ্ৰহাপক ফিরে এলে গণপতি বাকি শলাকাগুলি গণনা করল। দেখা গেল, লাল শলাকা বেশি আর কালো কম। তার অর্থ হল, সদস্যগণ কালো শলাকাই বেশি নিয়েছে।
গণপতি ঘোষণা করল, ‘ভন্তে গণ! শোন, কালো শলাকা অধিক সংখ্যক সদস্য নিয়েছে। তাই আমি ঘোষণা করছি যে গণ আয়ুষ্মান্য রোজ মল্লের সঙ্গে একমত। এখন তোমরা ঠিক কর আয়ুষ্মান বন্ধুলের কিভাবে পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে!’
ছন্দ-শলাকা ওঠবার পরে অনেকক্ষণ ধরে তর্ক-বিতর্ক চলল, শেষে ঠিক হল যে, বন্ধুল মলুকে কাঠের সাতটা খোটা এক সঙ্গে তরবারী দিয়ে কাটতে হবে।
নির্দিষ্ট দিনে কুসীনারার স্ত্রী-পুরুষের সমাগমে মাঠ ভরে গেল। মন্ত্রিকাও সেখানে উপস্থিত। সাতটি শক্ত কাঠের খোঁটা পাশাপাশি পুঁতে দেওয়া হল। গণপতি আদেশ করার পর বন্ধুল তরবারি বাগিয়ে নিল। সমস্ত জনমণ্ডলী রুদ্ধ নিশ্বাসে দেখতে লাগল। বন্ধুল মল্লের। সুদৃঢ় হাতে সেই ঋজু, দীণু খ দেখে লোকে তার সাফল্য সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত ছিল। বিদ্যুতের মতো উজ্জ্বল বন্ধুলের তরবারী লোকে উঠতে নামতে দেখল—প্রথম খোটা কাটল, তারপর দ্বিতীয়, তৃতীয় এইভাবে ষষ্ঠ খোটা কাটবার সময় বন্ধুলের কানে একটা ধাতব শব্দ ভেসে এল। তাঁর ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠল এবং হতাশায় তার তরবারি থেমে রইল। বন্ধুল তাড়াতাড়ি একবার সবগুলো খোঁটার মাথা দেখে নিল। রাগে তাঁর শরীর কাঁপছিল, মুখ লাল হয়ে গেল, কিন্তু সে একদম চুপ করে রইল।’
গণপতি ঘোষণা করল যে, সপ্তম-খোঁটার মাথা খণ্ডিত হয় নি। কিন্তু তবু লোকের সহানুভূতি বন্ধুল মল্লের প্রতিই ছিল।
ঘরে ফিরে মল্লিকা বন্ধুলের রক্তিম এবং গভীর চেহারা লক্ষ্য করে তাকে সান্ত্বনা দিতে চাইল। বন্ধুল বলল, ‘মল্লিকা! আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। এ রকম যে করা হবে তা আমি আশা করিনি।’
‘প্রত্যেকটা খোঁটার মধ্যে লোহার শলাকা ছিল। পঞ্চম খোঁটাটা কাটা পর্যন্ত আমি জানতে পারিনি। ষষ্ঠ খোটা কাটার পর আমি ঝিন্-করে ওঠা পরিষ্কার একটা শব্দ শুনতে পাই আমি ধোঁকাবাজী বুঝতে পারলাম। যদি শব্দটা শুনতে না পেতাম তাহলে সপ্তম খোটাও নিশ্চয় কাটতে পারতাম। কিন্তু শব্দ শোনার পর আমার মন বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ল।’
‘এ রকম বিশ্বাসঘাতকতা যারা করেছে তারা খুবই নীচ!’
’কে এ রকম করেছে তা আমি জানতে পারিনি। রোজ মল্লের ওপর আমার কোনো রাগ নেই। কেননা সে উচিত কথাই বলেছিল, আর তার মতের সঙ্গে গণের বেশির ভাগ সদস্য একমত ছিল। কিন্তু আমার দুঃখ ও রাগ হচ্ছে এই জন্যে যে, কুসীনারায় আমাকে স্নেহ করার লোকের এত অভাব!’
‘তা’ হলে বন্ধুল তুমি কুসীনারার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছ?’
‘কুসীনারা আমার মাতৃতুল্য, এ দেশ আমাকে লালন-পালন করে বড় করেছে। কিন্তু এখন আমি আর কুসীনারায় থাকব না।’
‘কুসীনারা ছেড়ে চলে যেতে চাও?’
‘হ্যাঁ! কারণ, কুসীনারায় এখন বন্ধুল মল্লের কোনো প্রয়োজন নেই।’
‘তাহলে কোথায় যাবে?’
’মল্লিকা, তুমি আমার সঙ্গী হবে?’ – উদ্বিগ্ন মুখে বন্ধুল জিজ্ঞাসা করল।
’আমি তোমার ছায়ার মতো, বন্ধুল!’ মল্লিকা বন্ধুলের লাল চোখ দুটিতে চুম্বন করল আর মুহূর্তের মধ্যে তার রুক্ষতা বিলীন হয়ে গেল।
‘মল্লিকা! তোমার হাত আমাকে দাও।’ মল্লিকার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বন্ধুল বলল, ‘তোমার এ হাত আমার শক্তির উৎস, এ হাত পেলে বন্ধুল যে কোনো জায়গায়। নিৰ্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে।’
‘প্রিয়তমা! তবে কোথায় যাবে ঠিক করলে এবং কবেই বা যাবে?’
‘মুহূর্তকালও আর দেরী করতে চাই না, কেননা খোঁটার মধ্যে লৌহশিলাকার খবর গণপতি পাবেই এবং তারপর আবার সে আমার পরীক্ষার দিন ঠিক করবে। কাজেই লোকের উৎসাহ প্ৰকাশ পাবার আগেই আমাদের যাত্রা করা চাই।’
‘অন্যায়ের বিচার হতে কেন দিচ্ছ না?’
‘কুসীনারা আমার সম্বন্ধে তার মত প্ৰকাশ করেছে, মল্লিকা! এখানে আমার প্রয়োজন নেই-অন্তত এ সময়। কুসীনারায় যখন আমার প্রয়োজন হবে, তখন আবার ফিরে আসব।’
সঙ্গে নিয়ে চলার উপযোগী প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বন্ধুল এবং মল্লিকা সেই রাতেই কুসীনারা ছেড়ে চলে গেল। দ্বিতীয় দিন অচিরাবতীর (রান্তী নদীর) তীরে অবস্থিত ব্ৰাহ্মণদের মল্লগ্রামে। (মলীও, গোরখপুর) পৌঁছাল। সেখানে বন্ধুলের একজন বন্ধুও ছিল, কিন্তু বন্ধুল তার সঙ্গে দেখা করল না। সে গ্রামে গিয়েছিল। এই ভেবে যে, সেখান থেকে নৌকাযোগে শ্রাবন্তী (সহেট-মহেট, গোঞ্জ জিলা) চলে যাবে। মল্লগ্রামে শ্ৰেষ্ঠী সুন্দত্তের লোক বাস করত; তার সাহায্যে নৌকা যোগাড় করা সহজ হল।
২.
শ্ৰাবস্তীর রাজধানীতে কৌশলরাজ প্রসেনজিৎ নিজ সহপাষ্ঠী বন্ধুল মল্লকে স্বাগত জানোল। তক্ষশিলায় থাকতেই প্ৰসেনজিৎ ইচ্ছা প্ৰকাশ করেছিল যে, ‘আমি রাজা হলে, বন্ধুল তোমাকে আমার সেনাপতি হতে হবে।’ রাজা হওয়ার পর সে অনেকবার এর জন্যে বন্ধুলকে লিখে জানিয়েছিল, কিন্তু বন্ধুল কোশল-কাশীর মতো সমৃদ্ধশালী এবং বিশাল রাজ্যের সেনাপতি হওয়ার চাইতে স্বীয় জন্মভূমি কুসীনারার গণের একজন সাধারণ উপসেনাপতির মর্যাদাকেই ওপরে স্থান দিয়েছিল। কিন্তু এখন কুসীনারাই তাকে বিতাড়িত < করল, তাই প্ৰসেনজিতের প্রস্তাব শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করতে সে রাজী হল।
বলল, ‘আমি তোমার প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজী। কিন্তু কয়েকটি শর্ত থাকবে।’
‘সানন্দে তা বলতে পার বন্ধু।’
‘আমি মল্লপুত্র বোধহয় তা তুমি জানি।’
‘হ্যাঁ জানি, এবং আমি তোমাকে কখনও মল্লদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলব না।’
‘আচ্ছা, আর আমার কোনো শর্ত নেই।’
‘মল্লদের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক আছে আমি তা সর্বদাই বজায় রাখতে চাই, বন্ধু! তুমি বোধহয় জান যে, আমার কোনো রাজ্য-বিস্তারের বাসনা নেই। তবে যদি কোনো কারণে মল্লদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, তাহলে তুমি স্বাধীনভাবে যে কোনো একপক্ষ গ্ৰহণ করতে পারবে বন্ধু। আমি তোমার জন্যে আর কি করতে পারি?’
‘না, মহারাজ! এই যথেষ্ট।’
৩.
বন্ধুল মল্ল কৌশল সেনাপতি নিযুক্ত হল। প্রসেনজি যে রকম নম্র ও উদ্যমহীন রাজা তাতে তার এ রকম একজন সেনাপতিরই প্রয়োজন ছিল। বাস্তবিকই যদি বন্ধুল মল্লকে সে না পেত তাহলে হয়ত মগধ এবং ‘বৎস’ তার রাজ্যের বেশ কিছুটা অংশ অধিকার করে নিত।
শ্রাবস্তী নগরে পৌঁছাবার কিছুকাল পরে মল্লিকার গর্ভলক্ষণ প্রকাশ পেল। বন্ধুল একদিন জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রিয়ে তোমার কোনো জিনিসের দোহদ (সাধ) হলে বল।’
‘হ্যাঁ, দোহদ হয় প্রিয়তমা! কিন্তু সেটা বড় দুষ্কর।’
‘বন্ধুল মল্লের পক্ষে কিছুই দুষ্কর নয় মন্ত্রিকা! বল, তোমার কিসের দোহদ।’
‘মল্লদের?’
‘না বৈশালীর লিচ্ছবিদের।’
‘ঠিকই বলেছ। মল্লিকা! তোমার দোহদ খুবই দুষ্কর। কিন্তু যত দুষ্করই হোক বন্ধুল মন্ত্র। সেটা পূর্ণ করবেই। কাল সকালে প্রস্তুত থেক, আমরা দু’জনেই রথে যাব।’
পরের দিন পাথেয় নিয়ে, খড়গ, ধনুক ইত্যাদিতে সজ্জিত হয়ে দু’জনেই রথে যাত্রা করল। কয়েক সপ্তাহ ধরে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একদিন বন্ধুলের রথ বৈশালীর দ্বারে গিয়ে প্রবেশ করল, যেখানে একদল লিচ্ছবির ঈর্ষার জন্যে বন্ধুলের সহপাঠী মহালি বন্ধ হয়েছিল। মহালি ছিল সেখানকার একজন অধ্যক্ষ। বন্ধুল একবার ভাবল যে মহালির সঙ্গে দেখা করবে, কিন্তু তাতে মল্লিকার দোহন্দু-এ বিঘ্ন ঘটতে পারে ভেবে সে নিজের ইচ্ছা দমন করল।
অভিষেক পুষ্করিণীর ঘাটে কড়া পাহারা। সেখানে লিচ্ছবি পুত্রদের জীবনে মাত্র একবারই স্নান করবার (অভিষেক পাবার) সৌভাগ্য ঘটত-তাও আবার যখন তাকে লিচ্ছবি প্রজাতন্ত্রের ৯৯৯ জন সদস্যের কোনো একটি শূন্যস্থানে নির্বাচিত করা হত তখনই। প্রহরীগণ বাধা দিলে বন্ধুল তাদের চাবুক মেরে তাড়িয়ে দিল এবং মল্লিকাকে স্নান করিয়ে রথে তুলে খুব তাড়াতাড়ি বৈশালী থেকে বেরিয়ে পড়ল। খবর পেয়ে পাঁচ শ’ লিচ্ছবি রথী বন্ধুলের পিছু ধাওয়া করল। মহালি তা শুনে তাদের নিষেধ করল, কিন্তু গর্বিত লিচ্ছবিরা কারুর নিষেধ শোনবার পাত্র ছিল না।
দূরে রথের চাকার শব্দ শুনে মল্লিকা পেছনে ফিরে দেখে বলল, ‘প্রিয়তম! অনেকগুলি রথ পেছনে তাড়া করে আসছে।’
‘প্রিয়ে! রথগুলি যখন একটি রেখার মতো সোজা আসবে তখন আমাকে বলবে।’
মল্লিকা ঠিক সময় মতোই বলল। প্রাচীন ঐতিহাসিকরা বলেন যে, বন্ধুল তখন সজোরে একটি তাঁর নিক্ষেপ করেছিল। আর সে তাঁর না-কি পাঁচ শ’ লিচ্ছবির কোমরবন্ধ। ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। লিচ্ছবিগণ বন্ধুলের কাছে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধ করতে আহ্বান জানাল। বন্ধুল তখন বিনীতভাবে বলল, ‘আমি তোমাদের মতো মৃত লোকদের সঙ্গে যুদ্ধ করি না।’
‘আচ্ছা, অন্তত একবার পরীক্ষা করে দেখা যে আমরা কি রকম মৃত।’
‘আমি দু’বার কখনও তাঁর ব্যয় করি না! যাও, ঘরে ফিরে গিয়ে প্রথমেই প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ কর এবং তারপর কোমরন্ধ খুলো’–বলে বন্ধুল মল্ল মল্লিকার হাত থেকে রথের রশি নিল এবং তীরবেগে রুথ চালিয়ে লিচ্ছবিদের চোখের আড়ালে চলে গেল।
ঘরে ফিরে কোমরবন্ধ খোলার পর সত্যি-সত্যিই পাঁচ শ’ লিচ্ছবি যোদ্ধা মারা গেল।
৪.
শ্ৰাবস্তী জম্বু-দ্বীপের মধ্যে তখন সব চাইতে বড় নগরী ছিল। প্রসেনজিতের রাজ্যে শ্রাবন্তী ছাড়াও সাকেত এবং বারাণসী নামে দুটি মহানগরী ছিল। শ্রাবন্তীর সুদত্ত (অনাথপিণ্ডদ), মৃগার এবং সাকেতের অর্জনের মতো আরও অনেক কোটিপতি ব্যবসায়ী কাশী কৌশলের সম্মিলিত রাজ্যে বাস করত। তারা ব্যবসায়ের জন্যে তামলিপ্ত হতে আরম্ভ করে পূর্ব সমুদ্র (বঙ্গোপসাগর) এবং ভরুকচ্ছ (ভরোঁচি) ও সুপ্পারক (সোপারা) হয়ে পশ্চিম সমুদ্র (আরব সাগর) দিয়ে সুদূর দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত যেত। ব্ৰাহ্মণ সামন্তরা (মহাশালেরা) ক্ষত্রিয়, সামন্তদের সমতুল্য ছিল না বটে, কিন্তু তবুও সমাজের মধ্যে তারা উচ্চস্থান অধিকার করে ছিল। ঐশ্বর্যে সামন্তরা তাদের কাছে খুবই নগণ্য ছিল। সুদত্ত জেত রাজকুমারের উদ্যান।’জেতবন’ অজস্র কার্যাপণ (মুদ্রা) দিয়ে ক্রয় করেছিল এবং গৌতম বুদ্ধের জন্যে সেখানে জেতবন বিহার তৈরি করেছিল। মৃগারের পুত্র পুন্নবর্ধনের বিবাহে প্রসেনজি নিজে সদলবলে সাকেতে গিয়ে কন্যার পিতা অৰ্জ্জুন শ্ৰেষ্ঠীর অতিথি হয়েছিল। অৰ্জ্জুনের কন্যা তথা মৃগারের পুত্রবধূ বিশাখা নিজের হারের মূল্য দিয়ে সহস্র প্রকোষ্ঠের একটি সাততলা বিশাল বিহার নির্মাণ করে তার নাম রেখেছিল ‘পূর্বারাম মৃগার মাতা প্রাসাদ’। দেশ-দেশান্তরের ধন-রত্ন জড় হয়ে এইসব শ্ৰেষ্ঠীর কাছে আসত।
জৈবলী, উদালক এবং যাজ্ঞবল্কা ঋষিগণ যজ্ঞবাদকে গৌণ, দ্বিতীয় স্থান দিয়েও বাস্তবিক নিস্তারের জন্যে ব্ৰহ্মবাদের সুদৃঢ় নৌকা নির্মাণ করেছিল। জনকের মতো নৃপতিগণও বড় রকমের পুরস্কার দিয়ে ব্ৰহ্মসম্বন্ধনীয় শাস্ত্রার্থ-পরিষদ আহবান করতে লাগল, আর এগুলির মধ্যে থেকেই বেদের বাইরে চলার পথ প্রশস্ত হল। তখন দেশের মধ্যে স্বতন্ত্র চিন্তাধারার জোয়ার এসেছিল। আর বিচারক (তীর্থঙ্কর) বিচার (মতবাদ) সাধারণ সভায় লোকের নিকট উপস্থিত করত। কোথাও তার স্বরূপ মামুলি উপদেশ (অববাদ সূক্ত) রূপে হত, কোথাও কোনো বাদের আহ্বান ঘোষণা রূপে জম্বুর (জাম্) শাখা পুঁতে বেড়াত। প্রবাহণ ছাপ্পান্ন পুরুষকে ভুলিয়ে রাখার জন্যে ব্ৰহ্ম-সাক্ষাৎকারের অনেকগুলি উপায় উদ্ভাবন করেছিল, যেমন প্ৰব্ৰজা (সন্ন্যাস), ধ্যান তপ ইত্যাদি। তখন উপনিষদের শিক্ষার বাইরের আচাৰ্যও নিজ স্বতন্ত্র বিচারের সঙ্গে প্ৰব্ৰজ্যা (সন্ন্যাস) ও ব্রহ্মচর্যের ওপর বিশেষ জোর দিত। অজিত কেশকম্বল একেবারেই জড়বাদী ছিল। সে ভৌতিক (জড়) পদার্থ ছাড়া আত্মা, ঈশ্বরভক্তি, নিত্য-তত্ত্ব অথবা স্বৰ্গ-নরক-পুর্নজন্মবাদ মানত না; তবুও সে নিজে গৃহত্যাগী ব্ৰহ্মচারী ছিল। তখনকার সামন্ত শাসনকর্তার সহানুভূতির পাত্র তো সে ছিলই না; বরং তাদের রোষানলের হাত থেকে বাঁচবার জন্যেও নিজের জড়বাদকে ধর্মের রূপ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেছিল। ব্ৰাহ্মণ-সামন্ত, লৌহিত্য-ও পায়াসীর মতো রাজন্য সামন্তগণ কিন্তু জড়বাদী ছিল। আর তারা তাদের মতবাদের জন্যে এতই প্রসিদ্ধ ছিল যে, জড়বাদকে পরিত্যাগ করা লজ্জাজনক কাজ মনে করত। তবুও তাদের জড়বাদ সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর ছিল না।
জড়বাদের প্রচার সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয় সামন্তগণের ও ধনুকের ব্যবসায়ীদের বেশি। আস্থা ছিল গৌতম বুদ্ধের অনাত্মবাদের ওপর-বিশেষত কৌশলের। এর বিশেষ একটি কারণ হল যে, গৌতম নিজে কৌশলের অন্তর্গত শাক্য গণের (শাক্য-প্রজাতন্ত্র) অধিবাসী ছিল। সেও জড়বাদীদের মতো বলত-আত্মা, ঈশ্বর ইত্যাদি নিত্যবস্তু পৃথিবীতে নেই, সর্ব বস্তুই উৎপন্ন হয় এবং অচিরেই বিলীন হয়ে যায়। সংসার কতকগুলি বস্তুর প্রবাহ নয়, বরং ঘটনাবলীর স্রোত। তার প্রচারিত মতবাদ জ্ঞানীরা খুবই যুক্তিসঙ্গত ও হৃদয়গ্রাহী বলে মনে করত। কিন্তু ওই অনাদিবাদে লোক-মর্যাদা, ধনী-গরীব, দাস-স্বামীর প্রভেদ নষ্ট হয়, তাই অজিতের জড়বাদ সামন্ত ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর মধ্যে প্রিয় হতে পারল না। গৌতম বুদ্ধ নিজের অনাত্মবাদ ও জড়বাদের মধ্যে আর কিছু যোগ করে তার তিক্ততা কিছুটা দূর করল। তার মতে আত্মা নিত্য না হলেও চেতনা-প্রবাহ স্বৰ্গ কিংবা নরকের মানুষের মধ্যে এক দেহ হতে আর এক দেহে-এক শরীর-প্রবাহ হতে আর এক শরীর প্রবাহে সঞ্চারিত হয়। এ বিচার অনুযায়ী প্রবাহণ রাজার আবিষ্কৃত হাতিয়ার ছিল, আর তার জন্যেই পুনর্জন্মবাদের পুরোপুরি স্থিতির জায়গা হল। যদি গৌতম বুদ্ধ নিছক জড়বাদেরই প্রচার করত তা’ হলে নিশ্চয়ই শ্রাবস্তী, সাকেত, কৌশাম্বী, রাজগৃহ, ভদ্রকার শ্ৰেষ্ঠীরা অজস্র টাকা ব্যয় করত না এবং ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় সামন্তরা ও রাজারা তার পায়ের ধূলি সেবার জন্যে ভীড় করত না। শ্রাবস্তীর উচ্চশ্রেণীর স্ত্রীলোকদের গৌতমবুদ্ধের মতবাদে অগাধ বিশ্বাস ছিল। প্রসেনজিতের পাটরাণী মল্লিকা দেবী বৌদ্ধধর্মের প্রতি খুব অনুরক্ত ছিল। তার নগরস্থিত শ্ৰেষ্ঠীর, পুত্রবধু তার সখী বিশাখা বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন-স্বরূপ পূর্বারামের মতো একটি মহা-বিহার নির্মাণ করে বুদ্ধদেবকে দান করেছিল। সেনাপতি বন্ধুল মল্লের স্ত্রী পাটরাণী মল্লিকার অত্যন্ত প্রিয় সখী ছিল, তার অনুপ্রেরণায় সেও বুদ্ধের উপদেশাবলী শুনে কিছুদিন পরে বুদ্ধের উপাসিকা হয়ে পড়ল।
মল্লিকার অবস্থা খুবই সমৃদ্ধশালী ছিল। কৌশলের মতো রাজ্যের সেনাপতির ঘর সমৃদ্ধ হওয়াটা স্বাভাবিক। মল্লিকার দশটি বীরপুত্র। তারা প্রত্যেকেই রাজসেনা বাহিনীর উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিল। বন্ধুল মল্ল এক যুগ পর্যন্ত রাজার ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করেছিল। এর মধ্যে অনেকেই তার শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্য জনপদের কোনো লোককে এত উচ্চপদে কাজ করতে দেখে তারা পছন্দ করত না। ঈৰ্ষাপরায়ণ লোকেরা রাজার কাছে তার নামে অপবাদ রটাতে শুরু করল। রাজাও কিছুটা বোকাবুদ্ধির লোক ছিল। তারা রাজার কাছে গিয়ে এই বলে উসূকাল যে, বন্ধুল মল্ল রাজাকে নির্বোধ বলে প্রচার করছে। শেষটায় রাজার কাছে এমন কথাও বলল যে, সেনাপতি রাজ্য কেড়ে নিতে চেষ্টা করছে। প্ৰসেনজিতেরও সেটা ঠিক বলে মনে হল। তখন রাজা ও বন্ধুল মল্ল তাদের নিজ নিজ শক্ৰদের হাতে। খেলতে লাগল।
চিন্তাক্লিষ্ট বন্ধুলকে একদিন মল্লিকা জিজ্ঞেস করল, ‘প্রিয়! তুমি এত কি ভাবছ?’
‘রাজা আমার ওপর সন্দেহ করতে শুরু করেছে।’
‘তাহলে সেনাপতির পদে ইস্তফা দিয়ে চল না কুসীনারা চলে যাই। সেখানে আমাদের জীবিকার্জনের জন্যে কর্মান্ত (ক্ষেত্র) আছে।’
‘এর অর্থ হল রাজাকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দেওয়া। দেখছি না, মগধরাজ অজাতশত্রু। কতবার কাশী আক্রমণ করল। আমরা একবার তাকে বন্দী করেছিলাম। মহারাজ উদারতা দেখিয়ে রাজকন্যা বজ্রার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তাকে ছেড়ে দিল। কিন্তু অজাতশত্রু সমগ্র জম্বু দ্বীপের রাজচক্রবর্তী হতে চায়, সে এ বিয়েতে চুপ হওয়ার পাত্র নয়। তার গুপ্তচরে রাজধানী ছেয়ে গেছে। আমাদের জন্য প্ৰতিবেশী অবন্তিরাজার জামাতা বৎসরাজ উদয়নের উদ্দেশ্যও ভালো নয়-সেও সীমান্তে প্রস্তুত হচ্ছে। এ সময়ে শ্রাবন্তী ছেড়ে চলে যাওয়াটা খুবই কাপুরুষের কাজ মল্লিকা!’
‘আর এটা মিত্রদোহের কাজও বটে।’
‘মল্লিকা! আমি নিজের কথা চিন্তা করি না। যুদ্ধে অনেক বার আমি মৃত্যু কবলিত হয়েও বেঁচে গিয়েছি। তাই কখনও যদি মৃত্যু আমাকে গ্রাস করে, তা হলেও সেটা আমার কাছে বড় কথা হবে না।’
পাটরানী মল্লিকা ছিল মালীর কন্যা। সাধারণ এক মালীর মেয়ে হয়েও নিজের গুণে প্রসেনজিতের পাটরাণী হয়েছিল-কিন্তু সে বেঁচে নেই। থাকলে লোকের কথায় রাজার কান এতটা ভারী হত না। একদিন রাজা সীমান্তে বিদ্রোহ দমনের নাম করে বন্ধুল মল্লের পুত্রদের পাঠিয়ে দিল। তারা জয়লাভ করে যখন ফিরছিল তখন উল্টো খবর দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বন্ধুল মল্লকে পাঠাল। এই চক্রান্তে বন্ধুল আর তার দশ পুত্রই এক জায়গায় প্রাণ দিল। যখন এ ঘটনার সংবাদ মল্লিকার কাছে পৌঁছাল। তখন সে বুদ্ধ ও তার ভিক্ষুসংঘকে ভোজন করাতে যাচ্ছিল। তার তরুণী পুত্রবধুরা খুব ভক্তি সহকারে নানা রকম খাবার তৈরি করেছিল। মল্লিকার হৃদয় দগ্ধ হতে লাগল। কিন্তু সে নিজেকে এতদূর সংযত করল যে, তার চোখ দিয়ে এতটুকু অশ্রুকণা গলিত হওয়া তো দূরের কথা, মুখ পর্যন্ত স্নান হল না! : সে চিঠিটা নিজের আঁচলে বেঁধে সমস্ত সংঘকে ভোজন করাল। ভোজনের পরে বুদ্ধের উপদেশাবলী শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনল। তারপর চিঠিটা পড়ে শোনাল। বন্ধুলের পরিবারে যেন বজ্ৰপাত হল। মল্লিকার খুবই ধৈৰ্য কিন্তু সেই তরুণী বিধবাদের সান্ত্বনা দেওয়া বুদ্ধের পক্ষেও সহজ কাজ ছিল না।
কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর প্রসেনজিৎ সত্য ঘটনা জানতে পেরে খুবই শোকার্তা হলেন। কিন্তু তখন আর কিছু করবার উপায় ছিল না। প্রসেনজিতের মনের সান্ত্বনার জন্য বন্ধুলের ভাগিনেয় দীর্ঘকারায়ণকে নিজের সেনাপতি নিযুক্ত করল।
৫.
শীতকাল, কপিলাবাস্তুর আশেপাশের ক্ষেতে গম, ভুট্টা ও হলুদ রঙ-এর সরষে ফলেছে। আজ নগর খুবই সাজানো হয়েছে, কোনো কোনো জায়গায় তোরণ তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে সংস্থাগারটিকে বেশি করে সাজানো। তিন দিন কঠোর পরিশ্রমের পরে আজ একটুখানি অবসর পেয়ে কয়েকজন দাস একটি ঘরের কোণে বসে গল্প করছিল।
কাকু বলল, ‘আমাদের দাসদের জীবন কি কোনো মানুষের জীবন? আমরা মানুষ না হয়ে যদি গরু হয়ে জন্মাতাম তা হলেও ভালো ছিল। তখন তো আর আমাদের মানুষের মতো অনুভূতি থাকত না।’
‘ঠিকই বলেছ কাকু!’ কাল আমার প্রভু দণ্ডপাণি লোহা লাল করে আমার স্ত্রীকে ছ্যাকা দিয়েছে।’
‘কেন ছ্যাঁকা দিল?’
‘কেন করল, সে কথা তার কাছে কে জিজ্ঞাসা করবে? তারা তো দাসদের পতি-পত্নী সম্বন্ধও মানতে রাজি নয়। এ সত্ত্বেও এই দণ্ডপাণি নিজেকে নিগংঠক শ্রাবক (জৈন) বলে। সে এমনি নিগংঠক যে মাটির কীট সরাবার জন্যে নিজের কাছে ময়ুরের পাখনা রাখে। দোষের মধ্যে হল যে, আমার মেয়ে কিছুদিন ধরে কঠিন অসুখে ভুগে অজ্ঞান হয়ে পড়লে আমার স্ত্রী সেই সংবাদ আমাকে দিতে এসেছিল। হতভাগী মেয়ে শেষ পর্যন্ত বাঁচল না। তা মরে গিয়ে ভালোই হয়েছে। সংসারে আমাদের মতোই তো ওকেও বাঁচতে হত! সত্যিই কাকু, আমাদের দাসদের কোনো জীবনই নয়! শুধু এই নয়, আমার মনিব বলছিলেন যে, এ ধুমধাম শেষ হলেই আমার স্ত্রীকে বেচে দেবে।’
‘তবে ওই কষাই দণ্ডপাণি লোহা দিয়ে দাগিয়েও কি তৃপ্তি পেল না?’
‘না ভাই। বার বছর পরে মেয়েটিকে পঞ্চাশ নিষ্কে (স্বর্ণমুদ্রা) বেচে দেওয়ার কথা ছিল। বিশ্বাস কর, আমরা জেনেশুনেই না-কি তার পঞ্চাশ নিষ্ক নষ্ট করে দিয়েছি।’
‘এ কথাও স্বীকার করতে হবে, আমাদের দাসদের বাপ মায়ের হৃদয়ও নেই।’
তাদের কথার মাঝে একটি বৃদ্ধ দাস বলল, ‘আর এও একজন দাসীরই পুত্র, যার সম্বর্ধনার জন্যে এতসব তোড়জোড় হচ্ছে।’
‘কে দাদা?’
‘এই কোশল রাজকুমার বিদুডভ।’
‘দাসীর পুত্র?’
‘হ্যাঁ, মহানাম শাক্যের সেই বুড়ি দাসীকে জানো না? আমাদের মতো কেলো নয়–নিশ্চয়ই কোনো শক্যের ঔরস-জাত হবে!’
‘ হ্যাঁ, ঐ দাসীর পেটে মহানামের একটি মেয়ের জন্ম হয়। তার রঙ খুবই ফর্সা আর দেখতেও খুব সুন্দরী; তাকে যেন শাক্যকন্যা বলেই মনে হত।’
‘মনে না হবার কারণ কি? মেয়ে যদি সুন্দরী হয়-তা সে দাসীকন্যা হোক না কেন, মালিক তাদের খুবই যত্নে লালনপালন করে।’
‘কোশলরাজ প্রসেনজিৎ কোনো এক শাক্য কুমারীকে বিয়ে করতে চাইল, কিন্তু শাক্যরা নিজেদের কুলীনশ্রষ্ঠ মনে করে, তাই তারা কেউই নিজ কন্যাকে রাজার সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইল না। কিন্তু পরিষ্কার করে এ কথা বলার জো নেই, পাছে কৌশলরাজ রাগ করেএ ভয়ও ছিল। শেষ পর্যন্ত মহানাম তার দাসী কন্যাকে শাক্যকুমারী বলে পরিচয় দিয়ে প্ৰসেনজিতের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল। সেই বার্ষভ-ক্ষত্রিয়ার পুত্র বিদুডভ রাজকুমার।’
‘কিন্তু এখন তো এও শাক্যদের মতোই আমাদের রক্তপিপাসু হবে!’
***
বাজনা বাজতে লাগল, শাক্যরা কৌশল-রাজকুমারকে মহা ধুমধামের সঙ্গে স্বাগত জানাল, যদিও মনে মনে দাসীপুত্র বলে সকলে তাকে ঘৃণা করত। বিদুডভ নিজ মাতুলকুলের সম্বর্ধনা গ্ৰহণ করে মাতামহ মহানামের আশীৰ্বাদ নিয়ে খুশী মনে কপিলাবাস্তু থেকে বিদায় নিল। দাসীপুত্রের পদার্পণে সংস্থাগার অপবিত্র হয়েছিল, তাই তার শুদ্ধির প্রয়োজনে দাসদাসীরা ধুয়ে মুছে শুদ্ধি করতে লেগেছিল। একজন দাস বিদুডভের উদ্দেশ্যে গালি পাড়ছিল। এদিকে বিদুড়ভের একজন সৈনিক নিজের ভল্ল সংস্থাগারে ফেলে গিয়েছিল, তাই নিতে এসে এই সব কটুক্তি শুনতে পেয়ে সব কথা বিদুডভকে জানোল। সে কপিলাবাস্তু শাক্যহীন করুবার প্রতিজ্ঞা করল, আর তা পরবর্তীকালে করেও ছিল। তার ক্রোধের অনুলক্ষ্য ছিল প্ৰসেনজিৎ, যে তাকে দাসীর গর্ভে জন্ম দিয়েছিল।
দীর্ঘকারায়ণ নিজের মামা ও মামাতো ভাইদের মৃত্যুকে ভুলতে পারল না। অন্য দিকে প্রসেনজিৎ তার সমস্ত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্য অধিক মাত্রায় বিশ্বাস ও মধুরতা। দেখাতে চাইছিল। একদিন মধ্যাহ্ন ভোজনের পর তার বুদ্ধদেবকে স্মরণ হল। কয়েক যোজন দূরে শাক্যদের কোনো এক গ্রামে বুদ্ধদেব অবস্থান করছেন শুনে প্রসেনজিৎ দীর্ঘকারায়ণ সব কিছু সৈন্য নিয়ে সেখানে রওনা হল। বুদ্ধদেবের বাসগৃহে যাবার সময় তার মুকুট, খড়গ ও অন্যান্য রাজ চিহ্নগুলি কারায়ণের হাতে দিয়েছিল। বিদুডভের সঙ্গে কারায়ণের যোগ ছিল। রাণীকে সেখানে ত্যাগ করে রাজ্য মধ্যে গিয়ে বিদুড়ভকে রাজা বলে ঘোষণা করুল; আর নিজে রওনা হল শ্রাবন্তীর পথে।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত বুদ্ধের উপদেশ শুনে প্রসেনজিৎ বাইরে এল। রাণী তাকে সব কথা বলল। সব শুনে সেখান থেকে প্রসেনজিৎ রাজগৃহ (রাজগীর) গিয়ে নিজের আত্মীয় মগধরাজ অজাতশত্রুর কাছ থেকে পরামর্শ ও সাহায্য নেওয়া ঠিক করল। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে দীর্ঘ পথশ্রমে পথিমধ্যেই শরীর অচল হয়ে পড়ল, সন্ধ্যার গোধূলি লগ্নে যখন রাজগৃহে পৌঁছল তখন নগরদ্বার বন্ধ হয়ে গেছে। সেই রাত্র নগর উপান্তে একটি কুটিরে প্রসেনজিতের মৃত্যু হল। সকালে রানীর বিলাপ শুনে অজাতশত্রু ও বজ্রা ছুটে এল, তখন জাঁকজমকের সঙ্গে শবদাহ করা ছাড়া আর কি-ই বা করবার ছিল!
বন্ধুলকে হত্যার এই হল প্রতিশোধ-দাসপ্রথার এই হল পরিণাম। *
————–
* আজ থেকে একশ’ পুরুষ আগেকার একটি ঐতিহাসিক কাহিনী। এই সময় সামাজিক বৈষম্য খুবই বেড়ে গিয়েছিল। ধনী ব্যবসায়ী-শ্রেণী সমাজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। এই সময়ের মধ্যে জন্মেছেন অনেক পথ প্রদর্শক–যারা নরক থেকে মানুষকে উদ্ধার করে পরলোকের পথ দেখান। কিন্তু যে নরকের অগ্নিকুণ্ড গ্রামে দাউদাউ করে জ্বলছিল তার দিকে সবাই চোখ বুজে ছিল।