১৬. সুরৈয়া (কাল : ১৬০০ খৃষ্টাব্দ)

সুরৈয়া (কাল : ১৬০০ খৃষ্টাব্দ)

বর্ষর কর্দমাক্ত বারিধারা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সমতলভূমির ওপর দিয়ে মন্থরগতিতে জলের ধারা গড়িয়ে চলেছে, বেগে ছুটে চলেছে ঢালু জমির ওপর দিয়ে, আর উচ্ছল আবেগে ফুলে উঠে বিস্তৃত পাহাড়ী জলস্রোতের রূপ ধারণ করছে নদী-নালাগুলোর বুকে। বৃক্ষগুলি যেন এখনও পর্যন্ত জলভরা মেঘ ধরে রেখেছে, ওগুলো থেকে এখনও বড়-বড় ফোঁটা ঝরে পড়ছে টুপ্‌টাপ শব্দে। প্রবল বর্ষা এখন গুড়ি-গুড়ি বর্ষণ ধারায় রূপান্তরিত হয়েছে।

এক শমীবৃক্ষ থেকে কিছুটা দূরে শ্বেতবসনা এক তরুনী দাঁড়িয়েছিল। তার মাথার ওপর থেকে সাদা চাদর খসে পড়েছে এবং দ্বিধাবিভক্ত ভ্রমরকৃষ্ণ কেশের মধ্য দিয়ে। হিমালয়ের গভীর অরণ্যানীতে প্রবাহিত গঙ্গার রূপালী ধারার মতোই সিঁথির সরল রেখা দেখা যাচ্ছে। কানের পাশে কুঞ্চিত কালো কুন্তল থেকে এখনও দু-এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে। তরুণী তুষার শুভ্ৰ গন্তীর মুখমণ্ডল থেকে বড়-বড় কালো চোখ দুটো যেন দূরস্থিত কোনো চিত্রপট নিরীক্ষণ করছে। আজানুলম্বিত রেশমী পোশাক জলে ভিজে বুকের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে, যার নিচে লাল কীচুলীতে বাধা সুগোল স্তনযুগল স্পষ্টভাবে উপচে পড়ছে মনোরম ভঙ্গিমায়। সরু কোমর থেকে গোড়ালি পর্যন্ত পায়জামা-তাঁর আঁটোসাটো নিম্নাং জঙ্ঘা প্রদেশের সুডৌল আকৃতি পরিস্ফুট হয়ে রয়েছে। কৰ্দমাক্ত সাদা মোজার ওপর লাল রঙ-এর জুতো। জলে ভিজে সে দুটো আরও নরম এবং সম্ভবত হেঁটে চলারই অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।

একটি তরুণকে তরুণীর দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। তার পাগড়ী, আচকান সবই সাদা এবং ভিজে। কাছে এসে সে লক্ষ্য করল তরুণীর দৃষ্টি দূরে নিবদ্ধ। পায়ের শব্দ না করেই তরুণীর পাশে দু’হাত দূরত্বের মধ্যে এসে গেল সে। কিছু দূরে প্রবাহিত নালার কৰ্দমাক্ত জলধারা তরুণী স্থির দৃষ্টিতে দেখছিল। তরুণ ভেবেছিল, তার সহচরী এ-বারে তাঁর দিকে ফিরে তাকাবে। কিন্তু এক-এক মিনিটে এক একটা যুগ অতিবাহিত হয়ে চলল, তরুণীর দৃষ্টি তবুও নিশ্চল। কপালের ওপর থেকে গুঁড়ি-গুঁড়ি জলকণাগুলো মুছে ফেলবারও অবকাশ হল না তার। আর অপেক্ষা করতে না পেরে ; ধীরে ধীরে তরুণীর কাঁধের ওপর তার হাতটি রাখল। তরুণী মুখ ফেরাল, দূর-নিবদ্ধ দৃষ্টি ফিরে এল তার, উজ্জল হয়ে উঠল বড়-বড় কালো চোখ দুটো, রক্ত অধরপুটে মৃদু হাদির রেখা ফুটে বেরুল এবং ভিতর থেকে চিক্‌চিক করে উঠল সুসজ্জিত দন্তরাজি। তরুণের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে সে বলল, ‘ ‘তুমি কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছ কমল?’

‘বহুযুগ থেকে-সেই তখন থেকে, স্ৰষ্ট যখন সবেমাত্র জলের ভিতর থেকে বিশ্বসৃষ্টি শুরু করেছেন, পৃথিবী যখন তরল্যাবস্থায় ছিল এবং পর্বত বৃক্ষ বা প্ৰাণীসমূহের ভর বহন

‘থাম, কমল! তুমি তো সব সময়ই কাব্য কর।’

‘হায় সুরৈয়া, সত্যি কথাই তুমি বলেছ, মনে হচ্ছে আমার অদৃষ্ট কবিতা নেই।’

‘সুরৈয়া অন্য কোনো রমণীকে সঙ্গে রাখা পছন্দ করে না।’

‘এই হৃদয়ও তো ঐ কথা বলে। কিন্তু, তুমি অমন তন্ময় হয়ে কি ভাবছিলে?’

‘সবচেয়ে কাছে হল সুরাট, এখান থেকে মাত্র এক মাসের রাস্তা।’

‘আর এই জল কোথায় যায়?’

‘বাঙলার দিকে। সে আরও অনেক দূর, সম্ভবত দু’মাসের পথ।’

‘বেচারা, এই কাদাগোলা জলকে এতটা পথ চলতে হবে! আচ্ছা কমল, তুমি সমুদ্র দেখেছ?’

‘বাবার সঙ্গে একবার উড়িষ্যা গিয়েছিলাম আমি, তখন দেখেছি প্রিয়ে!’

‘কি রকম দেখতে?

‘দিগন্ত-বিস্তৃত এক কালো মেঘ যেন পড়ে রয়েছে সামনে।’

‘এই জলধারার অদৃষ্টও সমুদ্র সন্দর্শন রয়েছে! আচ্ছা ওখানে গিয়েও এর ঘোলা রঙ এমনটিই থাকবে?’

‘না। সুরৈয়া ওখানে একটি মাত্র রঙই দেখা যায়-ঘন নীল বা কালো।’

‘তুমি যদি নিয়ে যাও তো আমিও একদিন সমুদ্র দেখতে পাই।’

‘সুরৈয়া, তুমি আজ্ঞা করলে এই জলের সঙ্গেই যাত্রা করতে আমি প্রস্তুত।’

দুহাত দিয়ে কমলের গলা জড়িয়ে ধরে তার ভেজা গালে নিজের সিক্ত গাল চেপে ধরল। সুরৈয়া, তারপর কমলের উৎফুল্ল চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সমুদ্রে আমাকে যেতেই হবে, কিন্তু এই জলের সঙ্গে নয় কমল।’

‘মলিন জলধারার সঙ্গে নয়-তাই না প্রিয়তম?’

‘মলিন বলছি কেন কমল, আকাশ থেকে যখন পড়ে তখন কি এ মলিন ছিল?’

‘না। সুরৈয়া, চন্দ্ৰসূর্যের চেয়েও তখন নির্মল ছিল। তোমার ঐ সুন্দর অলকগুচ্ছ কেমন উজ্জল করে তুলেছে এই জলের ধারা। চাঁদের মতো শুভ্ৰ তোমার দুটো গাল কেমন মনোরম করে তুলেছে! আকাশ থেকে সোজা তোমার যে-সব অঙ্গে পড়েছে, সে সমস্ত স্থানেই তোমার সৌন্দর্যকে উজ্জ্বলতর করে তুলেছে।’

‘তাহলে তো এর এই মলিনতা নিজস্ব নয়। সাগর সঙ্গমের যাত্ৰাপথ রোধ করে। দীড়িয়েছে যে, তারই সঙ্গে সংঘর্ষে এই মলিনতা প্রাপ্ত হয়েছে। সোজা সাগরের জলে ঝরেপড়া ফোঁটাগুলোও কি এমনি হয় কমল?’

‘না প্রিয়তমা।’

‘এই জন্যেই তো এই মলিনতাকে আমি এর দোষ মনে না করে ভূষণ বলেই মনে করি। তুমি কি বল কমল?’

তোমার অধর আমার মনের কথাকেই ব্যক্ত করছে। সুরৈয়া।’

 

২.

আকাশের নীলিমার ছায়া সরোবরের অতল জলরাশিকে আরও নীল করে তুলেছে। অমল-ধবল শ্বেত পাথরের ঘাট আরও যেন সাদা হয়ে উঠেছে এই নীলিমার পটভূমিকায়। সবুজ দুর্ব ঘাসের মধ্যে সূক্ষ্মপত্রযুক্ত সবুজ বৃক্ষরাজি বড়ই সুন্দর দেখাচ্ছিল। বিশেষ করে এই বসন্তের মধ্যাহ্নবেলায়। বহু দূর প্রসারী বৃক্ষশ্রেণীর লতা-মণ্ডপ এবং ঝর্ণাধারায় সুসজ্জিত মনোরম উদ্যান। শাহীবাগ আজ তরুণ-তরুণীদের বসন্তোৎসবের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে এবং উন্মুক্ত এই উদ্যানে স্বর্গবিহারীদের মতো তারাও পরমানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

পুস্করিণী থেকে দূরে বাগানের ধারে লালপাথরের ছাউনীর বাইরে চার ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে। সকলের মাথায়ই এক ধাঁচের পাগড়ী-সামনের দিকে কিছুটা প্রসারিত; হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একই রকমের গলাবন্ধ জামা, একই রকমের সাদা কোমরবন্ধনী। সকলের একই রকমের গোফ, অধিকাংশই সাদা হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ এরা বাগানের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর এগিয়ে এসে চারিদিক-খোলা ছাউনীর নিচে গদীর ওপর বসে পড়ল। চারিদিকে এক অখণ্ড নিঃস্তব্ধতা বিরাজ করছিল, এই বৃদ্ধের দল ছাড়া আর কেউই সেখানে নেই।

নীরবতা ভঙ্গ করে একজন বলে উঠল, ‘বাদশাহ সালামত!…’

‘কি ব্যাপার ফজল, এখনও কি আমি দরবারে অধিষ্ঠিত রয়েছি? আমি কি কখনও সাধারণ মানুষের মতো সহজভাবে থাকতে পারি না?’

‘ভুলে যাই…’

‘নাম ধরে ডাকো-বল জালাল বা আকবর, না হয়। শুধু বন্ধু বল!’

‘এ বড় মস্কিল বন্ধু জালাল, দু’রকমের জীবনযাপন করতে হয় আমাদের।’

‘দু’রকম নয়, চার রকম ভাই ফজলু!’

‘ভাই বীরু! তোর তারিফ করি আমি, সব সময়েই যেন সমস্ত কিছুর জন্য তৈরি থাকিস তুই, আমি তো যখন এক দুনিয়া থেকে অন্য দুনিয়ায় চলে আসি তখন মনটাকে। তৈরি করে নিতে অনেক সময় লেগে যায়। কি ভাই টোডর, ঠিক বলিনি?’

‘হ্যাঁ ভাই ফজলু, আমিও তাজব বনে যাই, কি অদ্ভুত মগজ ওর…’

‘বীরবলকেই হিন্দুস্থানের সমস্ত লোক ভারতের প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্ণধার বলে জানে!’

‘কিন্তু টোডরমলও তো তাই! সেও কি সব জায়গায় পর্যবেক্ষণ চালায়নি?’

বীরবল, ‘চালাক বা না-চালাক, দুনিয়া আমার কথাই জানে, আর আমার এই মগজের প্রশংসা আমাদের জালুও করে।’

আকবর, ‘নিশ্চয়ই আর এ ব্যাপার শুধু সেই সব কাহিনীতেই শেষ নয়, বাদশাহ জালালুদ্দিন আকবরের বিভিন্ন বেশে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো সম্বন্ধে যা প্রচলিত।’

বীরবল, ‘এ এক চমৎকার স্মৃতি মনে করিয়ে দিলে জল্লু ভাই। ঐ কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে আমিও মারা যেতে বসেছি। বীরবল এবং আকবরের নামে যে কোনো রকমের কাহিনী রচনা করে বলে বেড়ানো এক সখের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন বহু কাহিনী আমি জমিয়ে ফেলেছি-প্ৰত্যেকটির জন্য আমি এক-এক আশরাফি মূল্য ধার্য করেছি।’

আকবর, ‘এই আশরাফির জন্যে কাহিনীগুলো তোমার মগজ থেকেই সোজা বেরিয়ে আসে না তো?’

বীরবল, ‘হতে পারে, কিন্তু তাতে কোনো তফাৎ নেই। সে ক্ষেত্রেও তো এ কথা বোঝা যাবে যে, কি রকম সব অর্থহীন কাহিনী আমাদের দু’জনের নামে রটানো হচ্ছে। রাগ করিস না ফজলু ভাই, শেঠ ছদামীমলের মতো আমি কঞ্জুষ নই।’

আবুল ফজল, ‘না রে বীরু, আমার ওপর মিছামিছি। রাগ করিস না, তোর গল্পগুলোকে তাই বড় ভয় করি আমি।’

বীরবল, ‘ হ্যাঁ, আমিই আইন-ই-আকবরীর মতো পুথি লিখে রেখে দিয়েছি কিনা!’

আবুল ফজল, ‘আইন-ই-আকবরী পড়ার মতে ক’টা লোক পাওয়া যাবে, আর বীরবলের গল্পগুলোকে মুখে মুখে ছড়াবার লোকই বা কত হবে?’

টোডরমল, ‘এ তো বীরু নিজেও জানে।’

আবুল ফজল, ‘যাহোক। তোমার আশবৃফিওয়ালা গল্প শোনাও বীরু!’

বীরবল, কিন্তু তোমরা সকলে তো প্রথমেই ধরে নিয়েছ যে, এ গল্প আশবৃফি দিয়ে কিনিনি আমি, আমার নিজের মগজ থেকেই বেরিয়েছে।’

‘আকবর, ‘কোনটা আসল আর কোনটা জাল সে আমরা বুঝতে পারি।’

বীরবল, ‘যেন আমার সব গল্পের ওপরেই ছাপ মারা আছে! বেশ, যা তোমাদের মর্জি। গল্প তো শুনিয়ে দিই। আমি। তবে গল্পের সারাংশটুকুই বলব শুধু–

‘আকবরের একবার খুব সখা হল হিন্দু হবার। বীরবলকে সে এই কথা জানাল; বীরবল বড়ই বিপদের মধ্যে পড়ল। বাদশাহকে সে না করতেও পারে না, অথচ তাকে হিন্দু বানাবার ক্ষমতাই বা তার কোথায়? দিন কয়েক গা ঢাকা দিয়ে থাকল। একদিন সন্ধ্যায় বাদশাহ-মঞ্জিলের খিড়কির কাছে ‘হিছ-ছো-ও’, ‘হিছ-ছো-’ করে জোর আওয়াজ হতে লাগল। বাদশাহ-মঞ্জিলের এই দিকটাতে এমন সময় কখনও কাপড় কাঁচার শব্দ শোনা যায় না। কৌতূহল বেড়ে গেলবাদশাহর। এক মজুরের পোশাক পরে যমুনাতীরে এল। পোশাক যতই বদলাক, বীরুর চোখে ধরা না পড়ে পারল না। সে যাহোক। ওখানে কাপড় আছড়ানো হচ্ছিল না, মোটাসোটা এক গাধাকে সোডা-সাবান দিয়ে রগুড়ে ধোয়া হচ্ছিল।’

‘মুচকি হাসিটুকু লুকিয়ে গলার আওয়াজ বদলে বাদশাহ জিজ্ঞেস করল, ‘কি করছ হে চৌধুরী?’

‘নিজের কাজ করছি ভাই, তোর কি দরকার তা দিয়ে?’

‘বড় অসময়ে ঠাণ্ডায় হাওয়ার মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চৌধুরী-অসুখ করবে।’

‘কি করা যাবে, এই হল বাদশাহের হুকুম!’

বাদশাহ এবার হেসে উঠে স্বাভাবিক স্বরে বলল, চল বীরবল, আমি বুঝতে পেরেছি যে, মুসলমানের হিন্দু হওয়া গাধার ঘোড়া হবারই সামিল’।’

‘ভাই ফজল, এই গল্প শুনে মনে হয়, যেন আমার দেহের ভেতর সাপ ঢুকেছে।’

‘আকবর, ‘জীবন সায়াহ্নে, এসে আমাদের এইসব গল্প শুনতে হচ্ছে! আমাদের সারা জীবনের একাগ্র সাধনার পরিণাম কি শেষে এই দাঁড়াবো!’

আবুল ফজল, ‘আমরা শুধু আমাদের কালের ঝক্কিই বহন করতে পারি, কিন্তু আমাদের এই প্রচেষ্টার সাফল্য-অসাফল্য নির্ভর করছে বসন্তোৎসবরত ঐ সব যুবক যুবতীদের ওপর।’

টোডরমল, ‘কিন্তু আমরা মুসলমানকে হিন্দু বা হিন্দুকে মুসলমান বানাতে চাইনি।’

আবুল ফজল, ‘আমরা দু’জনকেই এক করে দেখতে চেয়েছি-এক জাতি এক প্রাণ বানাতে চেয়েছি।’

বীরবল, ‘মোল্লা আর পণ্ডিতেরা কিন্তু আমাদের ধারায় চিন্তা করে না। আমরা চাই ভারতবর্ষকে শক্তিশালিরূপে দেখতে। ভারতের অস্ত্ৰে তীক্ষ্ণতা আছে, ভারতীয় মস্তিষ্কে প্রতিভা রয়েছে, যুবকদের রয়েছে সাহস। কিন্তু ভারতবর্ষের দোষ, ভারতের দুর্বলতা হল তার ভিতরকার অনৈক্য, তার বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার প্রবণতা।’

আকবর, ‘এই তো আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল বন্ধু, এতদিন পর্যন্ত আমরা এরই জন্যে সংগ্ৰাম করে এসেছি। আমরা যে সময় কাজ আরম্ভ করি।-চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন তখন, কিন্তু এখন তো আর তা বলা চলে না। এক পুরুষে যতটা করা সম্ভব আমরা সেটা যথাযথভাবে করেছি। কিন্তু এই গাধা-ঘোড়ার গল্প আজ পাথরের মতো চেপে বসেছে আমার অন্তরে।’

আবুল ফজল, ‘ভাই জালাল, নিরাশ হওয়াও আমাদের উচিত নয়। বৈরাম খায়ের সময়ের সঙ্গে তুলনা কর আজকের। সে সময় কি যোধাবাই তোমার স্ত্রী হয়ে হারেমে বসে বিষ্ণুর মূর্তি পূজা করতে পারত?’

আকবর, ‘তফাৎ সত্যিই আছে ফজল, কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এখনও বহু দূর যেতে হবে আমাদের। ফিরিঙ্গি পাদরীদের কাছে আমি শুনেছি, তাদের দেশে সবচেয়ে বড় বাদশাহও একটির বেশি স্ত্রীলোককে বিয়ে করতে পারে না। এই প্রথা আমার কত ভালো লেগেছে, তা সেই সময়ের আমার কথাবার্তা থেকে তুমি বুঝে থাকবে টোডর। আমিও যদি এ দেশে এমন ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারতাম! কিন্তু এ বড় বিড়ম্বনার কথা যে, মন্দ কাজ করবার স্বাধীনতা বাদশাহের যতটা আছে, ভালো কাজের সময় ততটা নেই। যদি সম্ভব হত তবে সেলিমের মা ছাড়া আর কাউকে আমার হারেমে রাখতাম না। এ ব্যবস্থা যদি সেলিমের জন্য করতে পারতাম আজ!’

বীরবল, ‘প্রেম কেবল একজনের সঙ্গেই হতে পারে জালাল। মনোহর হংস-দম্পতি যখন দেখি, তখন বুঝতে পারি তাদের জীবন কত সুন্দর। আনন্দের দিনে যেমন পরস্পরের সাখী ওরা, বিপদের দিনেও ঠিক তেমনি।’

আকবুর, ‘আমার চোখ থেকেও একবার জল ঝরেছিল বীরু ভাই! সে-বার সিংহ। শিকারে গুজরাট গিয়েছিলাম। হাতীর পিঠে চড়ে বন্দুকের সাহায্যে সিংহ মারা কোনো বাহাদুরীর কাজ নয়। এ কথা আমি নিশ্চয়ই স্বীকার করব–সিংহের মতো থাবা এবং নখ যখন তোমার নেই, তখন ঢাল-তলোয়ার নিয়ে তার সামনে এগোতে পার তুমি, এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী অস্ত্র নেওয়া বীরত্বের পরিচায়ক নয়। আমি কিন্তু বন্দুকের সাহায্যেই সিংহটিকে মারলাম। গুলি ওর মাথায় গিয়ে লাগল, আৰ্তনাদ করে সেখানেই পড়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে ঝোঁপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। তার সিংহিনী। অপরিসীম। ঘৃণার দৃষ্টিতে সে একবার আমার দিকে তাকাল, পরীক্ষণেই মৃত সিংহের গলা চাটতে লাগল। তৎক্ষণাৎ আমি শিকারীদের গুলি ছোড়া বন্ধ করতে বললাম এবং হাতী ফিরিয়ে আনলাম। আমার মনে সেদিন এত বড় আঘাত লেগেছিল যে, সিংহিনী যদি হামলাও করত। আমার ওপর তবু হয়ত বন্দুক তুলতাম না। আমি। বহুদিন পর্যন্ত বেদনাভিভূত হয়ে পড়েছিলাম আমি এবং সেই সময়েই বুঝতে পেরেছি যে, ঐ সিংহের যদি হাজার-পাঁচশ’ সিংহী থাকত, তবে অমান করে সেদিন গাল চাটত না কেউ।’

আবুল ফজল, ‘আমাদের দেশকে কত দূর পথ অতিক্রম করতে হবে, অথচ আমাদের গতি কি মন্থর! তাছাড়া এও তো আমাদের জানা নেই যে, আমরা অসমর্থ হয়ে পড়লে আমাদের ভার বহন করবার মতো কেউ রয়েছে কিনা!’

আকবর, ‘আমি চেয়েছিলাম হিন্দু, মুসলমান দুই জাতির মধ্যে রক্তের সম্পর্ক স্থাপিত হোক। এই সম্পর্কের কথা স্মরণে রেখেই প্ৰয়াগে ত্ৰিবেণী তটে কেল্লা তৈরি করিয়েছি আমি। গঙ্গা-যমুনা ধারার এই সঙ্গম আমার অন্তরেও এক বিরাট মিলনের স্পৃহা জাগ্রত করে তুলেছে। কিন্তু কত সামান্য সফলতা লাভ করেছি তা এখনও দেখতে পাচ্ছি না। বস্তুত যে কাজ শুধু বংশ পরম্পরাই অনুষ্ঠিত হতে পারে, এক পুরুষের মধ্যে তাকে গড়ে তোলা যায় না। একটা বিষয়ে চিরকালই আমার গর্ব থেকে যাবে যে, আমি যেমন বন্ধু পেয়েছি, তেমন বন্ধু খুব কম লোকের ভাগ্যেই জোটে। আকবর আর যোধাবাই মেহেরুন্নিসার মতো মিশ্র। বিবাহ ঘরে ঘরে দেখতে চাই আমি। অথচ এমন আর একটিও দেখতে পেলাম না।’

টোডরমল, ‘হিন্দুরাই এ বিষয়ে বেশি পশ্চাৎপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে।’

বীরবল, ‘আর এখন তারা গাধাকে ঘষে-মেজে ঘোড়া বানাবার গল্প তৈরি করছে। কিন্তু, হিন্দু মুসলমানের যদি এতই তফাৎ থাকবে, তো ঘোড়া গাধা হয়ে যাচ্ছে কি করে! হাজার হাজার হিন্দুকে মুসলমান হয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে না কি?’

আকবর, ‘আমি তো সব সময়েই এটা দেখব বলে অপেক্ষা করে আছি যে, হিন্দু তরুণীরা নাম এবং ধর্ম ত্যাগ না করেই মুসলমান তরুণীদের বিয়ে করুক।’

আবুল ফজল, ‘এখানে আমি তবে একটা সুসংবাদ শোনাই জালাল! আমরা যে কাজ করে উঠতে পারিনি, আমার সুরৈয়া সে কাজ করেছে।’

সকলে উৎসুক নয়নে আবুল ফজলের দিকে তাকাল।’

তোমরা আরও কিছু শোনবার জন্যে উদ্‌গ্ৰীব হয়ে উঠেছ তো? আমাকে একটু বাইরে। থেকে আসতে দাও’–বলে আবুল ফজল বাইরে গিয়ে থামের পাশে দাঁড়িয়ে কি দেখল, তারপর ফিরে এসে বলল, ‘শোনার চেয়ে চোখে দেখাই ভালো, এস আমার সঙ্গে।’ সকলে থামের কাছে গেল। অশোক গাছের নিচে পাথরের ওপর উপবিষ্ট যুগল মূর্তির দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে আবুল ফজল বলল, ‘ঐ দেখ আমার সুরৈয়াকে।’

টোডরমল ‘আর ঐ আমার কমল! দুনিয়া আর আমাদের কাছে অন্ধকার নয়। ফজলু ভাই’–বলে টোডরমল দুহাতে আবুল ফজলকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করল।

এরা দু’জন যখন আলিঙ্গন-মুক্ত হল, তখন চার জনেরই চোখে জল। আকবর মৌনতা ভঙ্গ করে বলল, ‘তরুণদের এই বসন্তোৎসবের ব্যবস্থা অনেক বছর হতেই আমি করেছি।’ কিন্তু এত বছর পরে আজই প্রথম আসল বসন্তোৎসবের অনুষ্ঠান হল। আমার মন চাইছে,–ওদের দু’জনকে ডেকে কপালে আশিস-চুম্বন দিয়ে দিই। আমি। ওরা যদি জানে যে, গঙ্গাযমুনার সঙ্গমের মতো। ওদের ঐ মধুর মিলনকেও অন্তরের সঙ্গেই সমর্থন করি আমরা, তবে খুবই ভালো হয়।’

আবুল ফজল, ‘সুরৈয়া জানে, তার বাপ-মা এই প্রণয়কে সুখের বলে মনে করে।’

টোডরমল, ‘কমল সেটা জানে না। কিন্তু তুমি বড় ভাগ্যবান ফজলু। কারণ সুরৈয়ার মা তোমার সঙ্গে একমত। কমলের মা এবং সুরৈয়ার মা-দু’জনে যদিও অন্তরঙ্গ সখি, তবুও কমলের মা কিন্তু-কিছুটা প্রাচীনপন্থী, যাহোক, তাতে ক্ষতি নেই। কমল আর সুরৈয়াকে আমি প্ৰাণভরে আশীৰ্বাদ করব।’

আকবর, ‘সবচেয়ে আগে আমাকেই আশীৰ্বাদ করতে দেওয়া উচিত।’

বীরবল, ‘আর আমাকে তোমার সঙ্গে নেবে না জল্লু?’

আকবর, ‘নিশ্চয়ই, এমন ধোবী কোথায় পাওয়া যাবে?’

বীরবল, ‘আর এমন ঘোড়া বনে যাওয়া গাধাই বা কোথায়!’

আকবর, ‘আমাদের এই মিলন আজ কত মধুর। মাসে একদিনও যদি এমন আনন্দ লাভ করা যেত।’

 

৩.

ছাদের ওপর চারিদিকে দরজাযুক্ত এক সুসজ্জিত কামরা। কামরার ভেতরের দিকটায় ছাদ থেকে লাল, সবুজ সাদা, ঝাড় টাঙানো। দরজাগুলোতে দু’পাল্লা করে পর্দা দেওয়া। ভেতরের দিককার পর্দাগুলো বুটিদার গোলাপী রেশমের। মেঝের ওপরও সুন্দর ইরানী গালিচা পাতা। কামরার মাঝখানে সাদা গদির ওপর অনেকগুলো তাকিয়া বালিশ। গদির ওপর বসে দুটি তরুণী দাবা খেলছে। এদের মধ্যে একজন আমাদের পূর্ব পরিচিত। সুরৈয়া। আর লাল ঘাঘরা, সবুজ চেলী এবং হলদে ওড়না পরা অপর তরুণীটি বীরবলের তের বছরের কন্যা ফুলমতী। তারা খেলার চাল দেবার চিন্তায় এত মগ্ন হয়ে আছে যে, গন্দিরওপর এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ শুনতে পেল না।’সুরৈয়া!–ডাক শুনে দু’জনেই চোখ তুলে তাকাল এবং তারপর উঠে দাঁড়াল।’কাকিম।’–বলে উঠে দাঁড়াল সুরৈয়া, আর কমলের মা তার গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিল। সুরৈয়ার মা বলল, ‘তোর জন্যে রঙিন মাছ নিয়ে এসেছে কমল-যা পুকুরে ছেড়ে আয়। ততক্ষণ আমি মুনীর সঙ্গে খেলছি।’

‘মুন্নী বড় হুঁসিয়ার মা, আমাকে দু’বার মাত করে দিয়েছে। ছোট মেয়ে বলে ওকে উড়িয়ে দিয়ে না’ –এই বলে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সুরৈয়া।

প্রাসাদের পিছনের দিককার বাগানে পুকুরের ধারে কমল দাঁড়িয়ে ছিল। তার সামনে নতুন এক মাটির হাঁড়ি। কাছে এসে নিজের হাতের মধ্যে কমলের হাত নিয়ে সুরৈয়া বলল, ‘লাল আর গোলাপী মাছ নিয়ে এসেছি কমল?’

‘ হ্যাঁ, সোনালী রঙেরও এনেছি।’

‘দেখি একবার’–বলে সুরৈয়া সামনে ঝুঁকে হাঁড়িটা ঝাকাতে লাগল।

‘এগুলোকে আমি পুকুরে ছেড়ে দিচ্ছি, সেখানে থাকলে দেখতে আরও সুন্দর লাগবে। পুকুরের স্বচ্ছ জলের মধ্যে ওগুলোকে দেখ সুরৈয়া।’

ঠোঁটে এবং চোখে হাসি ফুটিয়ে পুকুরের কাছে এসে দাঁড়াল সুরৈয়া। কমল হাঁড়ি উপুড় করে মাছগুলো পুকুরে ছেড়ে দিল। পুকুরের স্বচ্ছ জলে তাদের লাল, গোলাপী, সোনালী রঙ সত্যিই বড় সুন্দর মনে হতে লাগল। কমল গম্ভীর স্বরে, বোঝাতে লাগল, ‘এগুলোকে আমি পুকুরে ছেড়ে দিলাম, এখানে দেখতে আরও সুন্দর লাগবে। এখনও এগুলো ছোট সুরৈয়া, কিন্তু বয়স হলেও ছয় আঙ্গুলের বড় হবে না।’

‘কিন্তু দেখতে বড় সুন্দর কমল।’

‘এই দেখ সুরৈয়া-এটার কি রং বলতে পার?’

‘গোলাপী।’

‘ঠিক যেমন তোমার দুটি গাল।’

‘ছোটবেলায় তুমি এমনি করেই বলতে, কমল।’

‘ছোটবেলোয় সুরৈয়াও যে ঠিক এমনিই ছিল।’

‘ছোটবেলায় তোমাকে বেশ মিষ্টি লাগত কমল।’

‘আর এখন?’

‘এখন খু-উ-ব মিষ্টি।’

‘আগের চেয়ে বেশি! কেন?’

‘কেন জানি না, যখন থেকে তোমার গলার স্বর বদলাতে লাগল, তোমার ঠোঁটের ওপর সূক্ষ্ম কালো গোঁফের রেখা দেখা দিতে লাগল, মনে হয় তখন থেকেই আমার প্রেম গম্ভীর হয়ে উঠল আরও।’

‘আর তখন থেকেই কমলকে দূরে-দূরে রাখতে আরম্ভ করলে তুমি।’

‘দূরে? দূরে রাখতে?’

‘নয় কেন-আগে আগে কেমন লাফিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলতে।’

‘ও সব নালিশের ফিরিস্তি কমল, তার চেয়ে নতুন কোনো খবর বল।’ ‘

‘নতুন খবর হল, আমাদের প্রেমের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেছে।’

‘কোথায়?’

‘দু’জনের বাড়িতে! আলি হজরৎ বাদশাহ সলামত পর্যন্ত জেনেছেন!’

‘বাদশাহ সালামত পর্যন্ত!’

‘ভয় পেলে না-কি সুরৈয়া?’

‘না, প্রেমের কথা তো একদিন প্রকাশিত হবেই। কিন্তু এখনই কি করে হল?’

‘এত কথা আমিও জানতাম না, কিন্তু শুনেছি কাকা-কাকিমাই একে প্রথম সমর্থন জানিয়েছেন, তারপর বাবা এবং বাদশাহ সলামত এবং সকলের শেষে মা।’

’মা?’

‘মা’র সম্বন্ধে সকলের ভয় ছিল। জানো তো, মা বড় প্রাচীনপন্থী?’

‘কিন্তু এখনও আমার গালের ওপর থেকে,কাকিমার চুমুর দাগ মোছেনি!’

‘হ্যাঁ, সকলের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে! বাবা যখন তার কাছে বললেন তখন মা

‘তাহলে আমাদের প্রেম সকলের সদর-সমর্থন পেয়েছে?’

’আমাদের আপনজন সবার কাছেই পেয়েছে কিন্তু বাইরের দুনিয়া একে মানতে হয়ত রাজি নয়!’

‘এই বাইরের দুনিয়ার তুমি পরোয়া কর, কমল?’

‘একেবারেই নয়। সুরৈয়া, পরোয়া করি আমি শুধু ভবিষ্যৎ দুনিয়ার-যার জন্য এ পথ প্রদর্শন করতে যাচ্ছি আমরা আজ!’

‘বৌদিও সব কথা জানে কমল, রাত্রে তার ঘরে গিয়েছিলাম, ঠাট্টা করে আমায় বলল, ‘ঠাকুরঝি, আমি যে নন্দাইয়ের আশায় বসেছিলাম–আজ আমার সে সাধ পূর্ণ হতে চলেছে–তোমার নাম অবশ্য করেনি।’

‘এর মানে দাদাই বলেছেন বৌদিকে, আর ওদের দু’জনেরও বেশ সমর্থন রয়েছে আমাদের প্রেমে।’

‘তাহলে তোমার শ্বশুরকুলের সবাই তোমার অনুকুলেই কমল?’

’তোমারও বাহাদুরি-তুমি আমার মায়ের সমর্থন আদায় করেছ।’

‘কাকিমার পূজা-পাঠের কথাই তোমরা চিন্তা করেছ কমল, কিন্তু যদি জানতে যে আমাকে তিনি কত ভালোবাসেন, তবে সম্ভবত তাঁর সম্বন্ধে কোনো রকম সন্দেহই পোষণ করতে না।’

‘আমরা জানতাম বলেই তো তাঁর ওপর প্রয়োগ করার জন্য তোমাকেই চরম অস্ত্র রূপে ঠিক করে রেখেছিলেন বাবা। কিন্তু সে অস্ত্র প্রয়োগ করবার আগেই কেল্লা-ফাতে হয়ে গেল। এখন তো আমাদের বিয়েই হতে চলেছে।’

‘কোথায়?’

‘পণ্ডিতের কাছে নয়, মোল্লার কাছেও নয়। আমাদের আপনি পয়গম্বরের কাছে, যিনি ভারতবর্ষে নতুন ত্রিবেণীর দুর্গ নির্মাণ করেছেন।’

‘যিনি খাল, বিল, নদীনালাকে পবিত্র সমুদ্র পরিণত করতে চান! কিন্তু কবে কমল?’

‘পরশু, রবিবার সুরৈয়া।’

‘পরশু!’ সুরৈয়ার চোখের জল শিশির বিন্দুর মতো টলটল করে উঠল। তা মুছে দিয়ে তার চোখে চুমু দিল কমল। ওদের দু’জনের কেউই তখন জানতে পারল না, আরও চারটি চোখে তাদের মতো লুকিয়ে আনন্দাশ্রু বর্ষণ করেছ।

 

৪.

বসন্তের হাল্কা হাওয়া, প্রাক-সন্ধ্যার অস্তগামী সূর্যকিরণের লাল আভায় অগ্নিবৰ্ণ সাগরসব মিলিয়ে অপূর্ব এক দৃশ্য! সমুদ্রের বালুকাবেলায় বসে দুটি তরুণ হৃদয় এই দৃশ্য উপভোগ করছিল। উপভোগের এমনি এক পরম মুহূর্তে একজন বলল, ‘কি সুন্দর এই সমুদ্র।’

‘আমরা সকলেই যে সমুদ্রের সন্তান তাতে কোনো সন্দেহ আছে প্রিয়ে?’

‘না গো আমার কমলবরণ কমল, আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি যে এমন এক স্বৰ্গলোককে সমুদ্র আপন গর্ভে লুকিয়ে রেখেছিল।’

‘পরিপূর্ণভাবে না হলেও ভেনিসকে মানুষ স্বর্গে পরিণত করে ফেলেছে, এতেও কোনো সন্দেহ নেই।’

‘সাধুজী যখন বলতেন যে, আমাদের দেশের কুলবধুরা এবং কুলকন্যারা পুরুষের মতোই অবগুণ্ঠনহীন স্বাচ্ছন্দ্যে একদা ঘুরে বেড়াত, তখন তাঁর কথা আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। আজ দু’বছর হয়ে গেল আমরা এই স্বৰ্গরাজ্যে বাস করছি, এই ভেনিসের সঙ্গে দিল্লীর তুলনা করত। প্রিয়।’

‘যদি কেউ বলে যে, ফ্লোরেন্সের মতো সমৃদ্ধ রাজা রাজাহীন অবস্থায় টিকে থাকতে পারে। তবে আমরা সে কথা বিশ্বাস করতাম। কখনও!’

‘আর ভেনিসের মতো-নগরীকে কোনো রাণী কি পরিচালনা করতে পারে!’

‘দিল্লীতে কি আমরা এমন স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে পারতাম, সুরৈয়া!’

‘বোরখা ছাড়া? না প্ৰিয়তম, পাল্কির ভিতর আবরু রেখে সেখানে চলাফেরা করতে হয়। আর এখানে-হাত-ধরাধরি করে চললেও কেউ আমাদের দিকে তেমন দৃষ্টি দেয় না।’

‘গুজরাটে কিছু অনাবৃতমুখী কুলাঙ্গনাদের আমি দেখেছি। শুনেছি। দক্ষিণেও পর্দা প্রথা নেই।’

‘এ থেকেই বোঝা যায়, ভারত-ললনারাও একটা সময়ে পর্দামুক্ত ছিল। আমাদের দেশ আবার কখনও কি আমন হতে পারবে কমল?’

‘আমাদের পিতৃপিতামহরা তো আজীবন চেষ্টা করছেন। এই ছোট্ট দেশ ফ্লোরেন্স, মাত্র তিন দিনেই যাকে অতিক্রম করা যায়, তার দিকে একবার চেয়ে দেখ সুরৈয়া! এখানকার লোক কেমন গর্বের সঙ্গে মাথা উচিয়ে চলে। কারও সামনে মাথা নত করা বা কুর্নিশ করা এদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।’রাজা’ শব্দটা শুনলে তারা থুথু ফেলে, রাজা এদের কাছে এক শয়তান অথবা অগ্নিশ্বাসনিক্ষেপকারী এক দৈত্য বিশেষ।’

‘কিন্তু কমল এ-সবের মধ্যে সত্যতাও কি কিছু নেই। ফ্লোরেন্সের কৃষকের সঙ্গে তুলনা কর ভারতবর্ষের কৃষকের, এখানে কি সেই নগ্ন-জীর্ণ কঙ্কালসার চেহারা কোথাও দেখা যায়?’

‘না প্রিয়ে, আর তার কারণ হল এই যে, এখানে শাহী শান্য-শোকতে কোটি-কোটি টাকা ব্যয় করা হয় না।’

‘ভেনিসের ধনকুবেররা অনেকেই আমাদের কোটিপতিদের হার মানায়।’

‘আমাদের কোটিপতিরা এক লাখের ওপর এক নিশান ওড়ায়! আমি ভাবতাম। চৌবাচ্চা-ভরা এত টাকা আর মোহর অন্ধকারে পড়ে থেকে কি লাভ হয়? টাকা তো এক হাত থেকে আর এক হাতে ঘোরা উচিত। এই গতিশূণ্যতার কারণে মিঠাঁই-মণ্ডা নিজের জায়গায় পড়ে শুকোয়, ফল নিজের জায়গায় পড়ে থেকে পাঁচে। গুদামের কাপড় পোকায় কাটতে থাকে। অথচ এইসব পুঁতে রেখে আমাদের শেঠেরা তার ওপর লাল নিশান ওড়ায়। লোকে বলে, এর যখন একশ’ নিশান রয়েছে, তখনও শেঠ ক্রোড়মল।’

সূর্যের রক্তিম আভা কিছুক্ষণ হল মিলিয়ে গেছে। চারিদিকে এখন অন্ধকারের ছায়া, সমুদ্রলহরী পাথরের গায়ে আছাড় খেয়ে একটানা শব্দ করে চলেছে, তরুণ-তরুণীরা এখনও বালুতটে ছেড়ে উঠতে চাইছে না। সমুদ্রকে সূরৈয়া ও কমল সত্যিকারের সঙ্গী বলে গ্রহণ করে নিয়েছে। যদিও তারা শুধু জলপথেই ভ্ৰমণ করেনি, তবু জানত, তাদের সম্মুখে অবস্থিত এই সমুদ্রের একাংশ ভারতের মাটি স্পর্শ করে আছে। তাই কখনও কখনও তাদের মনে প্রশ্ন উঠত, এপারের সঙ্গে মিলন ঘটানো যায় কি! অনেক রাতে ফিরতি পথ ধরল তারা। অন্ধকার এই রাত এবং সেই সঙ্গে নিজের অবস্থা উপলব্ধি করে। সুরৈয়া বলল, ‘আমাদের বাদশাহ নিজ রাজ্যে শান্তি স্থাপনের জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন, এবং তাতে বহুলাংশে সফলতাও লাভ করেছেন। কিন্তু সেখানে কি এমন নিঃশঙ্ক হয়ে বেড়াতে পারি আমরা!–কেন পারি না কমল?’

‘এখানে সকলের অবস্থাই ভালো। কৃষকের ক্ষেতে আঙ্গুর, গম এবং অন্যান্য ফসল যথেষ্ট উৎপন্ন হয়।’

‘আমাদের দেশের জমিতেও তো সোনা ফলে!’

’কিন্তু সেই সোনা লুটবার লোকও যে আমাদের দেশে অনেক!’

‘আর একটা জিনিস দেখছ তো কমল, এখানে কারও বাড়ি গেলে সঙ্গে সঙ্গে কেমন মদের বোতল-গ্লাস এনে হাজির করে টেবিলে।‘

‘ভারতবর্ষে কিন্তু আমার বাবার এই জন্যেই বদনাম ছিল যে, তিনি বাদশাহর সঙ্গে বসে মদ্যপান করে থাকেন।’

‘আর আমার বির-রা আমাকে কি শেখাত জান! বলত ‘রাজপুতানীরা বড় নোংরা, তাদের ঘরে শুয়োর রান্না হয়।’ এখন আমার মনে হয়, ওখানকার অন্ধরা এখানে এলে বুঝত যে, দুনিয়ায় ছোট-বড় জাত বলে কিছু নেই।’

‘পান-ভোজনে জাত-পাতের বালাই নেই এখানকার দুনিয়ায়।’

‘ফ্লোরেন্স বেশ একুতাবদ্ধ দেশ, একদিন হয়ত ভারতবর্ষও এমনি একতাবদ্ধ হবে।’

‘সেটা তখনই হবে, যখন আমরা সবাই সমুদ্রকে জয় করতে পারব।’

‘সমুদ্র-বিজয়!’

‘ভেনিস সাগর-বিজয়িনী নগরী, সুরৈয়া। ভেনিসের এই খালের পথ, এই সুউচ্চ প্রাসাদসমূহ ঐ সমুদ্র-বিজয়েরই প্রাসাদ। সমুদ্র-বিজয়ে ভেনিস আজ আর একা নয়,–বহু প্রতিদ্বন্দ্বী তার রয়েছে। আমার কিন্তু এ কথাই মনে হয় যে, পৃথিবীতে এখন সমুদ্রজয়ীদের শাসনই প্রতিষ্ঠিত হবে। আমার নিজের মনও ঐ সমৃদ্ৰ-বিজয়ের দিকেই আকৃষ্ট হয়েছে বলে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করি আমি।’

‘তুমি কি সব অত বই নিয়ে রাতের পর রাত পড়াশুনা কর প্রিয়তম? তাছাড়া বইপত্র পাওয়া কত সহজ এখানে!’

‘আমাদের দেশেও সীসা রয়েছে, কাগজ এবং সুদক্ষ কারিগরও রয়েছে। কিন্তু আমরা এখনও ছাপার কাজ শিখিনি। আমাদের দেশে যদি ছাপাখানা খোলা হয়, তবে জ্ঞানার্জন অনেক সুলভ হয়ে উঠবে। এই যে এত বই পড়ছি, সপ্তাহের পর সপ্তাহ নাবিকদের মধ্যে কাটিয়ে দিচ্ছি, এর ফলে আমি ক্রমেই স্থির নিশ্চিত হয়ে উঠছি যে, সমুদ্র বিজয়ী দেশই বিশ্বজয়ী শক্তিরূপে বিরাজ করবে। প্রত্যহ স্নান না করার জন্য এই সব ফিরিদীদের আমাদের দেশের লোকেরা নোংরা বলে, কিন্তু এদের অনুসন্ধিৎসার প্রশংসা না করে থাকতে পারি না। ঘরে বসে ভূগোলের গল্প রচনা না করে এরা সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়ে সম্যক জ্ঞানার্জন করে। এদের তৈরি মানচিত্র তো আমি তোমাকে দেখিয়েছি সুরৈয়া।’

‘সমূদ্র আমার বড় ভাল লাগে কমল!’

‘শুধু ভালো লাগা নয়। সুরৈয়া, সমুদ্রের ওপরই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এই কাঠের জাহাজের ওপর রক্ষিত কামানটিকে দেখছ তো? এই সব জাহাজ বল এক একটা ভাসমান দুর্গ। মোঙ্গলরা তাদের জয়যাত্রার জন্য ঘোড়া এবং বারুদের কাছে সম্পূর্ণ ঋণী। আর এখন পৃথিবীতে যাদের কাছেই এইসব যুদ্ধজাহাজ থাকবে তারাই জয়ী হবে। এই জন্যই আমি এ বিদ্যা অর্জনের সঙ্কল্প করেছি।’

কমল এবং সুরৈয়ার সাধ পূর্ণ হল না। জলপথে ভারতবর্ষের দিকে যাত্রা করেছিল তারা, কিন্তু সেটা ছিল জলদস্যুদের যুগ। সুরাটে পৌঁছাবার মুখে জলদস্যুরা তাদের আক্রমণ করল। সঙ্গীদের নিয়ে কমল তার বন্দুক এবং কামান চালিয়ে যেতে লাগল দস্যুদের ওপর। দস্যুরা ছিল সংখ্যায় অনেক বেশি। কমলের জাহাজ গোলাবিদ্ধ হয়ে জলে ড়ুবে যেতে। লাগল। সুরৈয়া তার কাছেই ছিল, তার ঠোঁটে মৃদুহাসি ফুটে উঠল, তার মুখের শেষ কথা হল—‘সমুদ্র-বিজয়’!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *