মঙ্গল সিংহ (কাল : ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দ)
এরা দু’জনে আজ টাওয়ার দেখতে গিয়েছিল। সেখানে এরা সেই কুঠুরীগুলো দেখল। যার ভিতর সারা জীবন বন্দী থেকে রাজদ্রোহীরা পচে মরত। বন্দীদের দেহ টানা দিয়ে রাখবার যন্ত্র, কুড়াল এবং অন্যান্য সেই হাতিয়ারগুলো দেখল-যার সাহায্যে রাজা প্রমাণ করত, প্রজার জীবন-মরণ তারই হাতের মুঠোয় এবং পৃথিবীতে সে-ই সত্যিকারের ঈশ্বর–প্রেরিত যুবরাজ কিম্বা যমরাজ। কিন্তু সবচেয়ে যা আকর্ষণ করল। এদের, তা হল সেই স্থান, যেখানে ইংলেণ্ডের অনেক রাজরাণীর ছিন্নশির ধূলিলুষ্ঠিত হয়েছিল। এ্যানি রাসেল আজও তার কোমল হাত মঙ্গীর হাতে রেখেছিল। কিন্তু আজ সেই কোমলতা ভিন্ন রূপে প্রতীয়মান হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এগারো বছর আগে (১৮৪৫) বৈজ্ঞানিক ফ্যারাডের আবিষ্কৃত ইলেক্ট্রসিটির মতো এক শক্তি এ্যানির হাত থেকে সারা শরীরে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। মঙ্গল সিংহ বলল, ‘এ্যানি, তুমি ব্যাটারী না-কি?’
‘এমন কথা কেন বলছি মঙ্গী?’
‘আমি যে সেই রকমই অনুভব করছি! ষোলো বছর আগে যখন আমি ইংলেণ্ডে পদার্পণ করি, তখন মনে হয়েছিল, অন্ধকার থেকে আলোতে এলাম। পৃথিবী এখানে বিশাল-লম্বাচওড়ায় বড় নয়, কিন্তু দূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিরাট জগৎ আমার চোখে পড়ল। চুকন্দরের চিনি (১৮০৮), বাষ্পীয় জাহাজ (১৮১৯), রেলওয়ে (১৮২৫), তার (১৮৩৩), দিয়াশলাই (১৮৩৮), ফোঁটো (১৮৩৯), বিজলী আলো (১৮৪৫)-এ-সব নতুন এবং আশ্চর্যজনক দেখবার জিনিস তো ছিলই কিন্তু যখন আমি কেন্ত্রিজে এ সম্বন্ধে পড়াশুনা এবং রসায়নাগারে এগুলোকে প্রত্যক্ষ প্রয়োগ করবার সুযোগ পেলাম, তখন বুঝতে পারলাম। পৃথিবীর অদৃষ্ট কি বিরাট এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে!’
‘ইংলণ্ডে এসে সত্যিই তোমার মনে হয়েছিল যে, অন্ধকার থেকে আলোতে এলে?’
‘সেই অর্থে, যার কথা আমি এখনই বললাম। ভারত ছাড়বার সময় আমার মনে শুধু দুটো উদ্দেশ্য ছিল। এক আমার প্রিয় ইষ্টদেব যিশুখৃষ্টর ভক্তবৃন্দের দেশ দর্শন করব। দ্বিতীয়ত, আমাদের কূলের হারিয়ে রাজলক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব।’
‘কতবার আমি ভেবেছি, তোমার মুখে তোমার কথা শুনিব, কিন্তু বারম্বার কথায় কথায়। ভুলে গিয়েছি। আজ তোমার কথাই বল মঙ্গী।’
‘যে আমার জীবনের গতিকেই বদলে দিয়েছে তার কাছে বলতে আপত্তি কি! এ্যানি প্রিয়তমা, চল শান্ত টেমসের পারে। আমাদের গঙ্গার মতো অত বিরাট, অত সুন্দর নয় টেম্স, তবুও যখনই আমি টেম্সকে দেখি, তখনই গঙ্গার মধুর স্মৃতি আমাকে বিহ্বল করে তোলে। তুমি তো জানো এ্যানি, খৃষ্টানরা ভগবান যিশুখৃষ্ট ছাড়া আর কারও পূজাকে বিধর্ম বলে মনে করে এবং ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু টেম্স আমাকে খৃষ্টান থেকে বিধর্ম করে দিয়েছে। আমি আমার মাকে অত্যন্ত ভক্তির সঙ্গে ফুল দিয়ে গঙ্গাকে প্ৰণাম করতে দেখেছি।’
দু’জন টেম্সের ধারে এসে পৌঁছাল। টেম্সের দিকে মুখ ঘুরিয়ে পাথরের চত্বরের ওপর ওরা বসল। সাদা টুপির ভেতর থেকে বেরিয়ে গালের ওপর এসে-পড়া এ্যানির সোনালী কেশগুচ্ছ হাওয়ায় উড়তে লাগল। মঙ্গল তাকে চুমু দিয়ে কথা আরম্ভ করল, ‘এই টেমসের পার থেকে বহুবার আমি গঙ্গাকে আমার মানস-তৰ্পণ নিবেদন করেছি।’
‘তোমার মা গঙ্গাকে পুষ্পার্য দিতেন?’
‘হ্যাঁ, খুব ভক্তিসহকারে, যেমন খৃষ্টানেরা প্ৰভু যিশুকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে। তখন আমি প্রথম খৃষ্টান হয়েছি, আমার কাছে এটা ঘূর্ণিত প্রথা বলে মনে হত। কিন্তু এখন আমি গঙ্গাকে অপমান করার পাপের জন্য অনুতপ্ত হচ্ছি।’
‘খৃষ্ট ধর্ম যে আদর্শকে নষ্ট করতে চেয়েছে, আমাদের কবিরা তাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। তুমি জানো, আমরা টেম্সকে পিতা বলে অভিহিত করি?’
‘আর আমরা বলি মা গঙ্গা…’
‘তোমাদের কল্পনা আরও মধুর মঙ্গী! তোমরা কথা বল আমাকে।’
‘বেনারস আর রামনগর গঙ্গার এপার আর ওপার-উভয়ের দূরত্ব সামান্যই। ষোলো বছর পর্যন্ত আমি গঙ্গাকে দেখেছি। বেনারসে একেবারে গঙ্গার ওপরেই আমাদের বাড়ি। তার নিচ থেকে ষাট ধাপ সিঁড়ি গঙ্গার জল পর্যন্ত নেমে গেছে। সম্ভবত যখন আমি প্রথম চোখ মেলি, তখনই মা আমাকে কোলো নিয়ে গঙ্গা দেখিয়েছেন। কেন জানি না, আমার মনে হয়, আমার রক্তে গঙ্গা বয়ে চলেছে। রামনগরে আমার ঠাকুর্দার কেল্লা, কিন্তু সেটা আমি একবার মাত্র দেখেছি।-নৌকা করে গঙ্গায় বেড়াবার সময়। ওর ভিতরে গিয়ে দেখবার ইচ্ছা আমার হত না, মা তো আরও যেতে চাইতেন না। বুঝতেই পারছি এ্যানি-যে একদিন ঐ কেল্লার যুবরাজ্ঞী ছিল আর আজ যে ইংরেজদের ভয়ে নাম বদলে বেনারসের এক। বাড়িতে জীবন কাটাচ্ছে, সে কেমন করে ঐ কেল্লার দিকে তাকাতে সাহস করবে? আমার ঠাকুর্দা চেৎসিংহকে দস্য ওয়ারেন হেষ্টিংস নাজেহাল করেছে–ইংলেণ্ডে হেষ্টিংস আপন কৃতকর্মের ফলও পেয়েছে কিছুটা, কিন্তু আমার ঠাকুর্দার প্রতি কিছুমাত্র ন্যায়-বিচার হয়নি, লুষ্ঠিত রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া বড় সহজ ন্যায়ের কাজ ছিল না, এ্যানি।’
‘তোমার মা কি এখনও বেঁচে আছেন?’
‘বেনারস থেকে প্রায়ই আমাদের পাদ্রীর চিঠি আসে, আমি তাঁর মারফৎ মাকে চিঠি লিখি। পাঁচ মাস আগেও তিনি জীবিত ছিলেন এ্যানি।’
‘ঐ আন্দোলনের সময় আমি ততটা সচেতন ছিলাম না, ওগুলোর স্মৃতি সামান্যই মনে আছে আমার। আমার কাকা রাসেল মন্ত্রীসভায় চাৰ্টিস্টদের ঘোরতর শত্রু ছিলেন। তাঁর মুখে বহুবার আমি ঐ বিপদজ্জনক আন্দোলনের কথা শুনেছি।’
‘প্রথমে তুমি খৃষ্টান ছিলে না তাহলে?’
‘না, আমার মা এখনও হিন্দু। আমি প্রথম প্রথম তাঁকেও খৃষ্টান করতে চাইতাম, কিন্তু এখন…’
‘এখন তুমিও তোমার মা’র সঙ্গে একত্রে মা গঙ্গাকে ফুল দিয়ে প্রণাম করবে?’
‘আর পাদ্রীরা বলবে, এ খৃষ্ট ধর্ম ছেড়ে দিয়েছে।’
‘তুমি খৃষ্টান হলে কি করে?’
‘অন্তরের প্রেরণা কিছুই ছিল না, বেনারসের ইংরেজ পান্ধী এবং পাদ্রিনীরা খৃষ্টান ধর্ম প্রচার করে বেড়ায়। কিন্তু বেনারস হল হিন্দুদের রোম। এ জন্য সেখানে তেমন সুবিধে করতে পারত না। একবার এক পাস্ত্রী ডাক্তার আমার মা’র অসুখের সময় চিকিৎসা করেন। তারপর তাঁর স্ত্রী আমাদের বাড়িতে যাতায়াত আরম্ভ করলেন। আমার মা’র সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। আমি তখন খুব ছোট ছিলাম এবং তিনি আমাকে প্রায়ই কোলে। তুলে নিতেন………’
‘ছেলেবেলায় তুমি বোধহয় খুব সুন্দর ছিলে-তাই না মঙ্গী?’
‘তারপর সেই পাদ্রী মাকে বোঝালেন যে, ছেলেকে ইংরেজি পাড়াও। পাঁচ-ছ বছর। বয়স থেকেই পাস্ত্রী আমাকে ইংরেজি পড়াতে শুরু করলেন। মা নিজের পরিবারের অতীত বৈভবের কথা ভাবতেন এবং আশা করতেন, হয়ত ইংরেজি পড়ে ছেলে কুললক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনবার জন্য কিছু করতে পারবে। আমার বাবা আমার তিন বছর বয়সেই মারা গিয়েছিলেন। এ জন্য আমার মাকেই সব কিছু করতে হত। আমাদের সব সম্পত্তি ও রাজ্য চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেদখল হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মা’র কাছে তাঁর শাশুড়ীর দেওয়া। প্রচুর মণিমুক্তা ছিল। আর আমার মামাও মাকে সাহায্য করতেন। আট বছর বয়স থেকে আমি বেশি করে সেই পাদ্ৰী দম্পতির বাড়িতে থাকতে লাগলাম। হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে জানবার সুযোগ আমার খুব কমই মিলত আর যদি কিছু মিলত তো সেই পাদ্রিনীর মুখ থেকে। তিনি বলতেন, এ তোমার ভাগ্য যে তোমার মা বেঁচে গিয়েছেন। না হলে তোমার বাবা মরে যাওয়ার পর লোকে তোমার মাকে জীবন্ত দগ্ধ করে সতী বানাতে চাইত।’ আমার মাকে জীবন্ত দগ্ধ করার সঙ্গে হিন্দুধর্মকে এক মনে করার পর–তুমিই বুঝতে পার এ্যানি, আমার হৃদয়ে ঐ ধর্মের প্রতি অপরিসীম। ঘৃণা ছাড়া আর কোনো ভাবের উদ্রেক হতে পারে? এই সময় সতীদাহ প্ৰথা বন্ধ হতে দু’বছর (১৮২৯) বাকী ছিল। আমার মঙ্গলের কথা ভেবে পাদ্রিনীর কথা মা মেনে নিলেন এবং পড়ার জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন। কলকাতায় যখন পড়ছিলাম, তখন মা’র মনে সন্দেহ হল যে, আমাকে খৃষ্টান বানাবার জন্যেই পাদ্ৰিনী এই সব করছে। মা প্ৰথমে কিছু বুঝতে না পারায় ভালোই হয়েছিল, নইলে নিজের চোখ খুলবার সুযোগ পেতাম না।’
‘ভারতবর্ষে শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর কথা কেউ কি ভাবে না?’
‘তেরশ বছর আগে যে বিদ্যা পড়লে লাভ ছিল এখনো সেই বিদ্যাই শেখানো হয়।’
‘তারপর ইংলণ্ডে আসবার জন্যে মার’ অনুমতি কি করে পেলে?’
‘অনুমতি! পাদ্রীর সাহায্যে আমি মাকে না বলেই চলে এলাম। কেম্বিজে পড়বার ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি। এখান থেকে যখন আমি মাকে কুশল-সংবাদ পাঠালাম, তখন তিনি আশীৰ্বাদ জানালেন। তাঁর বয়স তখন পঞ্চান্ন। প্রত্যেক চিঠিতেই আমাকে দেশে চলে যেতে লিখতেন। তিনি।’
‘তুমি কি জবাব দিতে?’
‘জবাব আর কি দেব? তিনি ভাবতেন, আমি রাজধানীতে আছি, ইংলেণ্ডের রাণীর সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছে এবং এক সময় আমি চেৎসিংহের সিংহাসনের অধিপতি হয়ে দেশে ফিরব।’
‘ঐ গঙ্গা-পূজারিণী বেচারী কি করে জানবেন যে, রাণী ভিক্টেরিয়ার সঙ্গে তোমার। দেখা না হয়ে হয়েছে সমগ্র দুনিয়ার যত মুকুট-শোভিত-শিরের ভয়ঙ্কর শক্র কার্ল মার্কস আর ফ্রিডরিশ এঙ্গেলসের সঙ্গে!’
‘যে সময় সমগ্ৰ ভারতবর্ষ পুঁজিবাদী দুনিয়া এবং তার শক্তি সম্বন্ধেই অজ্ঞ, তখন মার্কসের সাম্যবাদকে কি করে বুঝবেন তিনি!’
‘মার্কসের সঙ্গে ভারত সম্বন্ধে কখনও কিছু কথা হয়েছে তোমোর?’
‘বহুবার। আমার অবাক লেগেছে যে, এখানে বসে বসে ভারতের জীবন-প্রবাহ সম্বন্ধে কি অসাধারণ জ্ঞান তাঁর! কিন্তু এ কোনো ভানুমতীর খেলা নয়, গত তিনশ’ বছরের বিভিন্ন ইংরেজ ভারত সম্বন্ধে যতটা জ্ঞানার্জন করে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছে, সবই এই লণ্ডনে মজুত রয়েছে। আবর্জনার মতো পড়ে থাকা এই পুস্তকাবলী গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়েছেন। মার্কস। আর যখনই কোনো ভারতীয়ের এখানে দেখা পেতেন, তাকে জিজ্ঞাসা করে তাঁর অধীত জ্ঞান যাচাই করে দেখতেন।’
‘ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে মার্কসের কি অভিমত?’
‘ভারতের যোদ্ধাদের খুবই প্রশংসা করেন—আমাদের বুদ্ধিরও প্রশংসা করেন। কিন্তু আমাদের প্রাচীনপন্থীদের, ভারতের সব চেয়ে বড় শত্রু বলে তিনি মনে করেন। আমাদের গ্রামগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোট-ছোট প্রজাতন্ত্র বলে মনে করেন।’
‘প্রজাতন্ত্র?’
‘সমগ্ৰ দেশ নয়, দেশের একটা জেলা, এমন কি এক সঙ্গে দুটো গ্রামও নয়, শুধু একটি একক গ্রাম। কিন্তু সব জায়গাতে নয়, যেখানে লর্ড কর্নওয়ালিস ইংরেজি ছাচে জমিদারী প্রথা কায়েম করেছে, সেখানকার প্রজাতন্ত্র প্রথমেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় গ্রামীণ প্রজাতন্ত্রকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পরিচালনা করে থাকে। পুলিশ আইন, সেচ, শিক্ষা, ধর্ম ইত্যাদি সমস্ত বিভাগই সে পরিচালনা করে, এবং অত্যন্ত বিবেচনা, বুদ্ধিমত্তা, ন্যায় এবং নিৰ্ভয়তার সঙ্গে। গ্রামের এক অঙ্গুলি পরিমাণ জমি বা দুর্বলতম মানুষের ইজ্জত রক্ষার জন্যেও আপন পঞ্চায়েতের হুকুমে গ্রামের শিশু-বৃদ্ধ সর্বদা প্রাণ দেবার জন্য প্রস্তুত থাকে। যখন দিল্লীর আশপাশে অল্প দূর পর্যন্তই মুসলমান শাসকদের রাজত্ব ছিল, এবং তারা নিজেদের মুসাফির বলে মনে করত, সেই সময়ে প্রথম প্রথম তারা পঞ্চায়েতের ক্ষতি করতে চাইত। পরে তারা পঞ্চায়েতের স্বায়ত্ব শাসনকে মেনে নিল। কিন্তু ইংরেজ শাসকবৃন্দ, বিশেষ করে ইংলণ্ডের জমিদার লর্ড কর্নওয়ালিসই গ্রামীণ প্রজাতন্ত্রকে বরবাদ করবার আওয়াজ তুলল, এবং বহুলাংশে সফলও হল। কিন্তু এতেও সম্ভবত ভাঙত না এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। গ্রামের প্রজাতন্ত্র এবং তার অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার ওপর সব চেয়ে বড় আঘাত এল ম্যানচেষ্টার ও ল্যাঙ্কাশায়ারের কাপড়, শেফিল্ডের লোহার জিনিস এবং এখান থেকে রপ্তানী-করা আরও বহু জিনিসপত্রের কাছ থেকে। ১৯২২ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসের ১০ তারিখে কলকাতায় প্রথম বাষ্পীয় পোত জলে নামল। সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামের প্রজাতন্ত্রের অর্থনৈতিক অবশিষ্ট স্বাধীনতাটুকু নিশ্চিত হয়ে গেল। ভারতবর্ষের সূক্ষ্ম মলমল উৎপাদনের স্থান ঢাকা, দুই-তৃতীয়াংশ জনবিরল হয়ে পড়ল। গ্রামের তাঁতীদের অবস্থা হয়ে উঠল অবৰ্ণনীয়। যে ভারতীয় গ্রাম নিজেদের কামার, কুমার, জেলা, তাঁতী নিয়ে নিজেকে স্বাধীন মনে করত, তার এই সমস্ত কারিগর, তখন হাত গুটিয়ে ঘরে বসে অনাহারে মরতে লাগল। আর তাদের জন্যে ল্যাঙ্কাশায়ার, ম্যানচেষ্টার, বার্মিংহাম, শেফিল্ডের মাল পাঠানো হতে লাগল। শুধু কাপড়ের কথাই ধর। ১৮৮৪ খৃষ্ঠাব্দে ভারত থেকে ব্রিটেনে ১৮,৬৬,৬০৮ থান কাপড় এসেছে এবং ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে ৩,৭৬,০৮৬ থান। আর এখন আমাদের ওখানে ৮,১৮,২০,৯৫,১৭,৭৭,২৭৭ গজ বিলাতী কাপড় রপ্তানি হয়েছে। ঢাকাই মলমল বস্ত্র উৎপাদনকারী ভারতবর্ষ নিজেদের তুলা বিলাতে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় কাপড় তৈরি করাচ্ছে! একেবারে হালের হিসাব অনুযায়ী ১৮৪৬-এ ১০,৭৫,৩০৯ পাউণ্ড তুলা ভারত থেকে এখানে এসেছে।’
‘কিন্তু মার্কস বলেন, বিদেশীদের এই অত্যাচারে আমাদের হৃদয় কেঁদে ওঠে, কিন্তু আমাদের বুদ্ধিমত্তা তৃপ্ত হয় প্রাচীনপন্থার এই পতনে।’
‘দুটোর মধ্যে তা হলে দু’ধরনের পরিণতি ঘটছে?’
’হ্যাঁ এ্যানি! সন্তান প্রসবের সময় মা কি ভয়ানক যন্ত্রণা ভোগ করেন, কিন্তু একই সঙ্গে। তিনি সন্তান প্রাপ্তির আনন্দও অনুভব করেন। ধ্বংস বিনা সৃষ্টি অসম্ভব। ছোট-ছেট ঐ সব প্রজাতন্ত্রকে ধ্বংস না করে বিরাট শক্তিশালী এক প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করা যায় না। যতদিন-পর্যন্ত ভারতীয়দের আসক্তি কেবলমাত্র নিজ-নিজ গ্রামীণ প্রজাতন্ত্রের প্রতি সীমাবদ্ধ থাকবে, ততদিন সমগ্ৰ ভারতবর্ষের জন্য তারা আত্মত্যাগ করতে পারবে না। ইংরেজরা। নিজেদের ব্যবসার সুবিধার জন্যেই রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ এই সমস্ত যন্ত্রকে শুধু ভারতে আমদানি করেছ, কিন্তু মার্কসের সিদ্ধান্তই সঠিক যে, রেলগাড়ি তৈরি এবং মেরামতের জন্য যদি ইংরেজ পুঁজিপতি ভারতীয় কয়লা এবং লোহাকে কাজে লাগাতে না পারে, তবে বেশি। দিন তারা সস্তায় এই সব জিনিস চালাতে পারবে না। আর ভারতীয়েরাও বিজ্ঞানের এই চমৎকারিতা চোখের সামনে দেখে কতদিন ঘুমিয়ে থাকবে?’
‘অর্থাৎ ভারতেও শিল্প এবং পুঁজিবাদের বিস্তার অপরিহার্য?’
‘নিশ্চয়ই, ইংলণ্ডে এখন আর সামন্তবাদী প্ৰভুত্ব নেই।’
‘হ্যাঁ সংস্কার আইন (১৮৩২ খৃঃ) ইংলণ্ডের শাসনভার পুঁজিপতিদের হাতেই তুলে দিয়েছে অথবা বলতে পার, পুঁজিপতিদের শাসনারূঢ় হবার সূচনা ঐ আইন।’
‘তুমি ঠিকই বলেছ। আচ্ছা চাৰ্টিস্টদের সভাসমূহ এবং পত্রিকাসমূহ কি তোমার ওপর কোনো রকম প্রভাব বিস্তার করেছিল এ্যানি?’
‘আচ্ছা এ্যানি, এইসব কথা বলার সময় তাঁকে কি তেমনি জোরালো বক্তা রূপে দেখা। যেত। যেমনটি দেখা গিয়েছিল পার্লামেন্টে বারো লক্ষ জনতার সহিযুক্ত সাধারণ দাবী প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সময়?’
‘না প্রিয়, এখনও তিনি ভয় করেন, যদিও এই ১৮৫৬ সালে চাৰ্টিষ্টদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু শোনাই যায় না।‘
‘ভয় কেন পাবেন না, এ্যানি? পুঁজিপতি ব্যবসায়ীরা যেমন সামন্ত-শাসনকে ধ্বংস করে নিজেদের শাসন কায়েম করেছে, তেমনি মজুরেরাও এই পুঁজিপতিদের রাজ্য খতম করে। ছাড়বে এবং মানবতার রাজ্য কায়েম করবে। যেখানে ধনী-দরিদ্র, বড়-ছোট কালো-সাদার ভেদাভেদ ঘুচে যাবে।’
‘স্ত্রী-পুরুষের পার্থক্যও ঘুচাবে মঙ্গী?’
‘হ্যাঁ, স্ত্রীলোকেরাও পুরুষের জুলুমে মারা পড়ছে। আমাদের দেশে সামন্তবাদ এই সেদিন পর্যন্ত ও সতীপ্রথার নামে লক্ষ লক্ষ স্ত্রীলোককে প্রতি বছর আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে আর এখনও তারা যে রকম পর্দার আড়ালে বন্দী হয়ে, সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পুরুষের জুলুম সহ্য করছে—সেটা মানবতার কলঙ্ক।’
‘আমাদের এখানকার স্ত্রীলোকদের তুমি হয়ত স্বাধীন ভেবে থাকবে, কেননা, আমাদের পর্দার আড়ালে বন্দী করে রাখা হয় না।’
‘স্বাধীন বলি না এ্যানি, শুধু এইটুকু বলি যে, তোমরা তোমাদের ভারতীয় বোনদের চেয়ে ঢের ভালো অবস্থায় আছ।’
‘গোলামীর আবার ভালো-মন্দা! পার্লামেন্টে ভোটের অধিকার নেই, বড়-বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চৌকাঠও আমরা পেরুতে পারি না। মুঠোর মধ্যে ধরা যায় এমন আঁট করে কোমর কষে, আর ষাট গজ কাপড় তা থেকে মাটিতে লুটিয়ে এমনি সব ঘাঘরা পরি আমরা-শুধু পুরুষদের খেলার পুতুল হবার জন্যে। সে যাহোক, তাহলে মার্কস এই আশা করেন যে, ভারতে শিল্প এবং পুঁজিবাদের প্রসার হবে, যার ফলে একদিকে জনগণের মধ্যে অধিকতর সাহসের সঞ্চার হবে, অপরদিকে ওখানেও গ্রামের বেকার, কৃষক, এবং কারিগরদের কারখানায় একত্রিত করা যাবে। তারপর তারা আপন শ্রমিক-সমিতি গড়ে লড়তে শিখবে এবং সাম্যবাদের ঝাণ্ডা নিয়ে ইংলণ্ডের মজুরদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানুষের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করবে, এবং পৃথিবীকে পুঁজিপতিদের গোলামী থেকে মুক্ত করে সেখানে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করবে। কিন্তু এ তো কয়েক শত বছরের ব্যাপার মঙ্গী!’
‘মার্কস এ কথাও বলেন, যদিও ইংরেজরা বিজ্ঞানের দান কলকারখানা থেকে ভারতবর্ষকে বঞ্চিত করে রেখেছে, তবুও বিজ্ঞানের অপরাপর দান যুদ্ধের অস্ত্ৰসমূহ দিয়ে ভারতীয় সৈন্যগণকে সুসজ্জিত করেছে। এই ভারতীয় সৈন্যেরা ভারতের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে বড় রকমের সহায়ক হবে।’
‘কিন্তু একি খুব শীঘ্র হতে পারে?’
‘খুব দূরের ব্যাপার নয় এ্যানি, সময় এসেই গেছে। কাগজে পড়নি, ৭ই ফেব্রুয়ারি (১৮৫৬ খৃষ্টাব্দ) অযোধ্যাকে ইংরেজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছে?’।
‘হ্যাঁ, এবং নেওয়া হয়েছে বেইমানী করে।’
‘বেইমানী বা ইমানদারী নিয়ে তর্ক করার কিছু নেই। ইংরেজ ব্যবসায়ীরা সব কিছুই নিজেদের স্বার্থের জন্য করছে। কিন্তু অজ্ঞাতে তারা অনেক কিছু ভালোও করে ফেলেছে। তার গ্রামীণ প্রজাতন্ত্রকে ভেঙে আমাদের সামনে দেশের বিস্তৃত রূপ তুলে ধরেছে। তারা নিজেদের রেল, তার, জাহাজ দিয়ে আমাদের কুপমণ্ডুকতাকে ভেঙে বিশাল জগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্থাপিত করেছে, অযোধ্যা অধিকার করায় কিছু পরিবর্তন আসবে, আর আমি তারই প্রতীক্ষায় আছি এ্যানি।
‘মার্কসের শিষ্যের কাছ থেকে আর কি আশা করা যেতে পারে?’
২.
গঙ্গার প্রশান্ত তট আবার অশান্ত হয়ে উঠতে চাইল। বিঠরের বিশাল প্রাসাদে পেশোয়ার উত্তরাধিকারী নানাসাহেব (ছোট) শুধু সিংহাসন থেকেই নয়, পেন্সন থেকেও বঞ্চিত হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অধিকতর সক্রিয় হয়ে উঠল। তার অনুচরেরা তারই মতো পদচ্যুত অপরাপর সামন্তদের কাছে রাত-দিন ছুটাছুটি করতে লাগল। এই সময় ইংরেজেরা আরও একটি বড় ভুল করে বসল। আর সে ভুল শুধু ভুলই নয়, নিত্য-নতুন পরিস্থিতির মধ্যে এ হল রীতিমতো প্ৰাণ নিয়ে টানাটানি। ইংরেজেরা আগের ছররা বন্দুকের জায়গায় আরও বেশি জোরদার কাতুর্জের বন্দুক তাদের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বণ্টন করল। এই কাতুর্জ বন্দুকে ভরবার সময় দাঁতে কাটতে হত। অদূরদশী ইংরেজের শত্রু এই ব্যাপার থেকেই সুযোগ সংগ্রহ করে নিল। চারদিকে রব তুলে দিল যে, বন্দুকের কাতুর্জের ভিতর গরু এবং শুয়োরের চর্বি আছে, ইংরেজেরা জেনেশুনেই এই কাতুর্জ সিপাইদের দাঁতে কাটতে দিয়েছে, যাতে ভারতবর্ষ থেকে হিন্দু-মুসলমানের ধর্ম উঠে যায়, আর সকলেই খৃষ্টান হয়ে যায়।
কাশীরাজ চেৎসিংহের পৌত্র মঙ্গল সিংহের নাম সৈন্যদের মধ্যে বিদ্যুতের মতো কাজ করছে, এ কথা মঙ্গল সিংহ জানত, কিন্তু সে কখনও এই রহস্যকে উন্মুক্ত হতে দেয়নি। নানাসাহেব এবং অপর বিদ্রোহী নেতারা তার সম্পর্কে এইটুকুই জানত, সে ইংরেজ শাসনের পরম শত্ৰু, বিলেত গিয়ে সে ইংরেজদের বিদ্যা যথেষ্ট অধ্যয়ন করেছে। রাজনীতি সম্বন্ধে তার প্রগাঢ় জ্ঞান। বিলাতে থাকার ফলে তার ধর্ম নষ্ট হয়ে গেছে, যদিও খৃষ্টান ধর্মকেও সে মানে না।
বিদ্রোহী নেতাদের সযত্ন-রক্ষিত মনোভাব বুঝতে মঙ্গল সিংহের দেরী লাগল না। সে দেখল যে, পদচ্যুত সামন্তরা নিজ-নিজ অধিকারকে পুনরুদ্ধার করতে চাইছে এবং তার জন্য সকলের সাধারণ শত্রু ইংরেজকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। তাদের কাছে আত্মত্যাগী সৈন্যরা দাবার খুঁটির বেশি আর কিছুই নয়। ধর্ম নষ্ট হবার ভয়ে সিপাহীরা উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। কাতুর্জের চর্বি যদি দাঁতে কাটতে না হত তাহলে সম্ভবত অনন্তকাল তারা কোম্পানীর জয়-জয়কার করে যেত, নিজেদের প্রাণও বিসর্জন দিত। আর হিন্দু মুসলমানের গ মধ্যে পার্থক্য-সে তো এতটুকুও কমেনি। উপরন্তু যদি বিদ্রোহ সফল হয়, তবে ধর্মের নামে। গর্বিত নিরক্ষর সিপাহী আল্লা এবং ভগবানের কৃপাপাত্র হবার আশায় নিজেদের আরও বেশি কঠোর ধাৰ্মিক বলে প্রমাণিত করবার চেষ্টা করবে। হয়ত গ্রাম এবং শহরগুলো লুণ্ঠন করতেও চাইবে তারা। যদিও এই ধরনের মনোবৃত্তি-সম্পন্ন সিপাহীদের সংখ্যা কমই ছিল এবং কম জায়গাতেই এমনি লুণ্ঠন চলেছিল। তা’হলেও সোরগোল এতটা বেশি হয়েছিল যে, গ্রামের লোকেরা ডাকাত পড়ার মতো আতঙ্কগ্ৰস্ত হয়ে উঠেছিল। দেশের মুক্তিদাতা সেনাবাহিনীর প্রতি এমন মনোভাব ভালো নয়। এ-সব জেনে মঙ্গল সিংহ প্রথমটায় নিরাশ হল। চেৎসিংহের সিংহাসন পুনরুদ্ধারের আশায় সে দেশে ফেরেনি, এসেছিল সাম্য-মৈত্রীস্বাধীনতার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাতে জাত-পাত, হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদ, ইংরেজ পুঁজিপতিদের শাসনের মতোই অবাঞ্ছনীয়। কূপমণ্ডুক তাকে সংরক্ষিত করতে সে চায়নি, ভারতবর্ষের বহু শতাব্দী-ব্যাপী সঙ্কীর্ণ আবেষ্টনীকে ভেঙে তাকে বিশ্বের অভিন্ন অংশ রূপে প্রতিষ্ঠা করতে সে চেয়েছিল। ইংরেজ পুঁজিপতিদের শাসন এবং শোষণকে হঠিয়ে দিয়ে ভারতবর্ষের জনসাধারণকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে এক সুন্দর জগৎ নির্মাণে উদ্ধৃদ্ধ করতে চেয়েছিল। কাতুর্জের চর্বির মিথ্যা প্রচারকে সে সমর্থন করতে পারেনি। কারণ এর দ্বারা ভারতবর্ষে ধর্ম আবার তার শিকড় গেড়ে বসবে।
নানাসাহেব এবং অপরাপর নেতারা দামী বিলাতী মদ ওড়াত এবং সুযোগ পেলেই মদ। আর মাংস খেয়ে গৌরাঙ্গী সুন্দরীদের এঁটো ঠোঁট লেহন করবার জন্য লালায়িত হয়ে পড়ত। মজার ব্যাপার হল, এরাই ধৰ্মরক্ষার পবিত্র কর্তব্য নিয়ে বিক্ষুব্ধ সেনাবাহিনীর নেতৃপদ দখল করে বসল। এই সমস্ত দোষ-ত্রুটির সঙ্গে যখন একটা বিষয় মঙ্গল সিংহ চিন্তা করল, তখন আপন কর্তব্য স্থির করে ফেলতে তার দেরী হল না। যুগপৎ ইংরেজ-শাসক এবং ভারতীয় সামন্তদের গোলামীতে পিষ্ট হচ্ছিল ভারতবর্ষ, যার মধ্যে মজবুত এবং সুচতুর শাসন হল ইংরেজের। এদের হঠিয়ে দেবার পর শুধু স্বদেশী সামন্তদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।–ভারতীয় জনসাধারণের পক্ষে যা অধিকতর সহজ কাজ।
জানুয়ারি মাস। রাত্রে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছিল, যদিও লণ্ডনের তুলনায় সেটা কিছুই নয়। বিঠরে চারিদিকে স্তব্ধতা বিরাজ করছিল। কিন্তু পেশোয়ার প্রাসাদের প্রহরীরা স্ব-স্ব স্থানে। প্রহরায় নিযুক্ত। নিজেদের প্রভুর এক বিশ্বস্ত অনুচরের সঙ্গে এক অপরিচিত ব্যক্তিকে তারা মহলের ভিতর ঢুকতে দেখল। তারা আজকাল এমনি অপরিচিতদের প্রতি রাত্ৰেই মহলের ভিতরে ঢুকতে দেখে।
নানাসাহেবের সঙ্গে মঙ্গল সিংহের সাক্ষাৎ এই প্ৰথম নয়, কাজেই তারা একে অন্যকে বেশ ভালোভাবেই জানত। এখানে দিল্লীর বৃত্তিভোগী বাদশাহ, অযোধ্যার নবাব, জগদীশপুরের কুঁঅর সিংহ এবং অন্যান্য বহু সামন্তের প্রতিনিধিকে দেখতে পেল মঙ্গল সিংহ। ব্যারাকপুর (কলকাতা), দানাপুর, কানাপুর, লক্ষ্মৌ, আগ্রা, মীরাট প্রভৃতি ক্যান্টনূমেন্টের সিপাহীদের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব কতদূর প্রাবল্য লাভ করেছে তা শোনাগেল। এটা আশ্চর্যের কথা যে, এত বড় শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে নেমে নিজেদের একটিও সৈন্য না রেখে এই সব সামন্তরা শুধু বিদ্রোহী সৈন্যদের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে বসেছিল। আর যুদ্ধবিদ্যার কথা ধরলে প্রায় সমস্ত নেতারাই ছিল সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তবুও নিজেরা সর্বাধিনায়কের পদ অধিকার করবার জন্য ব্যগ্র ছিল। অত্যন্ত আশাপূর্ণ স্বরে নানাসাহেব বলল, ‘ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্ব নির্ভর করছে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর ওপর। সেই বাহিনী আজ আমাদের হাতে চলে আসছে।’
‘কিন্তু সমস্ত ভারতীয় সৈন্যই কি আমাদের দিকে আসছে নানাসাহেব? পাঞ্জাবী শিখদের বিদ্রোহ করার কোনো খবর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অপর পক্ষে অপরাপর ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ইংরেজের পক্ষে লড়াই করে যেভাবে তাদের পাঞ্জাবকে পরাজিত করেছিল সে কথা স্মরণ করে পাঞ্জাবীরা তার প্রতিশোধই নিতে চাইবে। ইংরেজরাও বড় হাঁশিয়ার নানাসাহেব। না হলে পেশোয়া এবং অযোধ্যার নবাবের মতো দিলীপ সিংহকে যদি তারা কোথাও নজরবন্দী করে রাখত, তবে আজ সমস্ত শিখ পল্টনকে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসা খুবই সহজ হত। যাহোক, আমাদের মনে রাখতে হবে, শিখ এবং নেপালী দেশীয় রাজ্যসমূহের পল্টনেরা আমাদের দিকে নেই। আর দেশের এই স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা আমাদের সঙ্গে নেই, তাদের বিরোধী বলেই ধরতে হবে।’
নানাসাহেব বলল, ‘আপনার কথা ঠিকই ঠাকুরাসাহেব। কিন্তু যদি সূচনাতেই আমরা সাফল্য লাভ করতে পারি, তবে কোনো দেশদ্রোহীরই আমাদের বিরুদ্ধে লড়বার সাহস হবে না।’
‘আরও একটি বিষয়ে আমাদের ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। এখন থেকেই জনসাধারণকে বোঝাতে হবে যে, আমরা দেশের মুক্তিযোদ্ধা।’
পূর্বাঞ্চলের এক প্রতিনিধি বলল, ‘আমরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণ করব-এই ব্যাপারটাই কি এ কথা বোঝাবার পক্ষে যথেষ্ট নয়?’।
মঙ্গল সিংহ, ‘সমস্ত জায়গাতেই তো চব্বিশ ঘণ্টা অস্ত্ৰ ঝনৃঝন করবে না। আমাদের ‘ দেশে বহু কাপুরুষ রয়েছে যারা ইংরেজের অজেয়তা সম্পর্কে বিশ্বাসী। তারা নানা রকমের গুজব রটাবে। আমার মনে হয়, পূর্ব পশ্চিম এবং মধ্য–এই তিন ভাগে ভাগ করে তিনটি হিন্দী এবং উর্দু খবরের কাগজ আমাদের ছাপতে হবে।’
নানাসাহেব, ‘ইংরেজি কায়দা-কানুন আপনার বেশি পছন্দ ঠাকুরুসাহেব। কিন্তু খবরের কাগজ ছাড়াই আমরা কাতুর্জের ব্যাপারটা রটিয়ে কিভাবে জনসাধারণকে তৈরি করেছি তা তো দেখছেন!’
মঙ্গল সিংহ, ‘কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে ইংরেজের চাকরেরা আমাদের বিরুদ্ধে যে সব কথা রটাবে, তার জন্য কিছু একটা করতে হবে নানাসাহেব। একদিনেই তো আমরা ইংরেজের গোটা শাসনযন্ত্রকে অধিকার করে নিতে পারব না। মনে করুন তারা গুজব রটিয়ে দিল যে, বিদ্রোহী সৈন্যরা, মনে রাখবেন আমাদের এই নামেই ডাকবে তারা-গ্রাম এবং শহর লুট করতে, ছোট ছেলেমেয়েদেরকে কেটে ফেলতে আসছে।’
নানাসাহেব, ‘এ কথা কি লোক বিশ্বাস করবে?’
মঙ্গল সিংহ, ‘যে কথা রটানো হবে এবং যে রটনার বিরুদ্ধে অন্য কোনো আওয়াজ উঠবে না। সে কথা লোকে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করবেই।’
নানাসাহেব, ‘মনে হয়, কার্তুজের ব্যাপারে ধর্মবিদ্রোহী বলে ইংরেজদের এত বদনাম করে দিয়েছি যে ওদের কোনো কথাই কেউ বিশ্বাস করবে না।’ ‘
মঙ্গল সিংহ, ‘আমি কিন্তু একে যথেষ্ট মনে করি না। যাইহোক, আমাদের এই লড়াইকে ইংরেজেরা নিছক বিদ্রোহ বলে প্রচার করবে। কিন্তু দুনিয়ায় আমাদের মিত্র এবং ইংরেজের শত্রু অনেক, তারা আমাদের স্বাধীনতা কামনা করে–বিশেষ করে ইউরোপে এ রকম বহু জাতি আছে। এই জন্য আমাদের এই লড়াইকে সমগ্র ইউরোপীয় জনসাধারণের–বিরুদ্ধে জেহাদ রূপে আমরা দাঁড় করাব না এবং শান্তিপূর্ণ ইংরেজ বালবৃদ্ধ নারীদের ওপর হস্তক্ষেপ করব না। তাতে আমাদের কোনো লাভ হবে না, উল্টে দুনিয়া জুড়ে ভারতবর্ষের বদনাম হবে।
নানাসাহেব, ‘এ সব সেনাপতিদের মনে রাখবার কথা। কোন সময়ে কি করতে হবে, সে সম্বন্ধে তারা নিজেরাই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।’
মঙ্গল সিংহ, ‘সবশেষে আমি বলতে চাই, যুদ্ধে যে সৈন্যরা নিজেদের জীবন পণ করছে এবং যে যুদ্ধ জনসাধারণের কাছ থেকেও সাহায্য আশা করছি, তাকে চর্বিযুক্ত কার্তুজের ঝগড়ায় সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। আমাদের বলতে হবে, ইংরেজদের তাড়িয়ে দিয়ে কি ধরনের রাজত্ব কায়েম করব। সেই রাজত্বে সৈন্য এবং যে কৃষকশ্রেণী থেকে সৈন্যরা আসছে সেই কৃষককুল কি পাবে।’
নানাসাহেব, ‘ধর্মদ্রোহীদের শাসন উঠিয়ে দেওয়াই তো তাদের সন্তুষ্ট করবার জন্য পৰ্যাপ্ত।’
‘এ প্রশ্ন যদি আপনাকেই করা যায় তাহলে কি জবাব দেবেন। আপনি? আপনার মনে কি পেশোয়ার রাজধানী পুণাতে ফিরে যাবার ইচ্ছা নেই? নবাবজাদার অন্তরে কি লক্ষ্মেীর তখতের আকর্ষণ নেই? যখন আপনারা কার্তুজ এবং ইংরেজ-শাসন থেকে মুক্ত হবার চেয়েও বড় ইচ্ছা পোষণ করেন-যার জন্য আপনারা জীবনকে বাজী রাখতে চলেছেন, তখন আমি মনে করি, জনসাধারণের সামনেও ভবিষ্যৎ লাভের বিষয়ে কিছু বলে রাখা উচিত। যেমন, গ্রামে গ্রামে আমরা পঞ্চায়েত বানাব, যাতে সমস্ত গ্রামের প্রজাসাধারণ নির্বাচন করবে এবং বাদশাহের ওপরও যার ক্ষমতা থাকবে। জমিদারী প্রথা আমরা উঠিয়ে দেব এবং কৃষক আর সরকারের মাঝে কোনো স্বত্বভোগী থাকবে না। জায়গীর যারা পাবে তারা শুধু সরকারকে দেয় খাজনাই আদায় করতে পারবে। যাতে কেউ–বেকার বসে না থাকে সে জন্যে সেচকার্যের উপযোগী নালা আর বাঁধ তৈরি করব আমরা। তাতে কোটি-কৌটি মজুরের কাজ মিলবে, দেশের মধ্যে বহুগুণ বেশি তরিতরকারী জন্মাবে এবং কৃষি-কাজের জন্য অনেক নতুন জমি পাওয়া যাবে।’
মঙ্গল সিংহের কথাগুলোকে কেউ বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাইল না। সকলের মতে ওগুলো সব রাজত্ব হাতে আসবার পরের কথা।
খাঁটিয়ার ওপর শোবার অনেকক্ষণ পরেও মঙ্গল সিংহের চোখে ঘুম এল না। সে ভাবছিল, এটা বৈজ্ঞানিক যুগ। রেল, তার, স্টিমারের যাদুকে সে স্বচক্ষে দেখছে। দিয়াশলাই, ফটোগ্রাফি এবং বিদ্যুতের যুগে মানব-সমাজে প্রবেশ করছে; কিন্তু এইসব লোক পুরনো যুগের স্বপ্ন দেখছে। তবুও এই ঘোর অন্ধকারের মাঝে একটা কথা স্পষ্ট বুঝতে পারল সে। এই লড়াই শুধু জনসাধারণের শক্তি দিয়েই পরিচালনা করা সম্ভব হবে, ফলে জনগণ আপন শক্তিকে চিনতে পারবে। বিলাতী পুঁজিপতিরা যেমন বিলাতের মজুরশ্রেণীর সাহায্য নিয়ে আপন প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাস্ত করে মজুরদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছে,–এই ভারতীয় সামন্তরাও ভারতীয় জনতা-সৈন্যবাহিনী ও কৃষককুলের সঙ্গে কাজ শেষ হয়ে গেলেই বিশ্বাসঘাতকতা করবে। কিন্তু এরা জনসাধারণের মন থেকে তাদের আত্মবিশ্বাসকে। ছিনিয়ে নিতে পারবে না। বাইরের শত্রুর কাছ থেকে বাঁচাবার জন্যে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারকে কাজে লাগাবেই। রেল-লাইন, টেলিগ্রাফের লাইন, কলকাতায় প্রস্তুত স্টিমার এখন আর ভারত থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে না। মঙ্গল সিংহের আস্থা অবক্ষয়ী সামন্তনায়কদের ওপর ছিল না, ছিল পৃথিবীতে মানব-সমাজের পরিবর্তনকারী শক্তিশালী জনগণের ওপরেই।
৩.
১০ই মে (১৮৫৭ খৃঃ) মঙ্গল সিংহ মীরাটের কাছে ছিল, এই সময় সৈন্যেরা বিদ্রোহের ধ্বজা ওড়াল। বাহাদুর শাহের প্রতিনিধিদের নামে একটা বাহিনীকে সে নিজের অধীনে রাখবার সুযোগ পেল। মঙ্গল সিংহের যোগ্যতা সম্পর্কে কারও কোনো সংশয় ছিল না, কিন্তু তারা জানত যে তার উদ্দেশ্য অন্যান্য নেতৃবর্গ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক, তাই তাকে দিল্লীর দিকে না পাঠিয়ে, পূর্বদিকে পাঠিয়ে দিল। তারা কেউ ভাবতে পারেনি, মীরাটের পূর্ব এবং পশ্চিমের ঐ রাস্তা ভারতবর্ষের মুক্তিযুদ্ধের ভাগ্যে কোনো পৃথক ফল প্রসব করবে না। দিল্লীর দিকে ধাবিত সৈন্যদের মঙ্গল সিংহের মতো নেতার প্রয়োজন ছিল-যে দিল্লীর প্রতিষ্ঠাকে পূর্ণভাবে যুদ্ধজয়ের কাজে লাগাতে পারত। মঙ্গল সিংহের বাহিনীতে এক হাজার সৈন্য ছিল। তারা ভাবত আমরা সকলেই জেনারেল। এদের এই কথাটা বোঝাতেই মঙ্গল সিংহের এক সপ্তাহ লেগে গেল যে, শুধু জেনারেলের বাহিনী কখনও যুদ্ধে জিততে পারে না। সৈন্যবাহিনীতে মঙ্গল সিংহ ছাড়া উচ্চ সৈনিক-বিদ্যা সম্বন্ধে ওয়াকিফয়াল দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি ছিল না। আর এই একই অবস্থা সমগ্ৰ বিদ্রোহী বাহিনীতে। এক জায়গায় থেকে শিক্ষা দেবার সুযোগ মঙ্গল সিংহের ছিল না। তখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, অধিকতর এলাকায় ইংরেজ শাসনকে দ্রুত ধ্বংস করা।
গঙ্গা পার হয়ে রোহেলখণ্ডে প্রবেশ করেই মঙ্গল সিংহ প্রত্যেক রাতে সৈন্যদের কাছে রাজনৈতিক আদর্শের কথা প্রচার করত। সৈন্যদের বুঝতে বেশি সময় লাগত, তাদের মনে নানা রকম সন্দেহ জাগত, মঙ্গল সিংহ সেগুলো দূর করে দিত। এরপর মঙ্গল সিংহ ফ্রান্সেরদুটো বিপ্লবের ইতিহাস (১৭৯২ ও ১৮৪৮ খৃঃ) শোনাল, এও বলল যে, কি করে ওয়েলসের মজুরশ্রেণী ভারত-শাসক এই ইংরেজ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, এবং অসীম কৃতিত্বের সঙ্গে লড়েছিল। সংখ্যাবলের সাহায্যে পুঁজিপতিরা তাদের দমন করতে পেরেছিল। কিন্তু তাদের অর্জিত অধিকারকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি। এইসব শুনে যুদ্ধরত তার সৈন্যদের আচরণ সম্পূর্ণ বদলে গেল।
এদের প্রত্যেকেই স্বাধীনতা-যুদ্ধের সাধক হয়ে উঠল, তারা গ্রাম-শহরে গিয়ে কথায়। এবং ব্যবহারে লোকের মনে বিশ্বাস এবং সম্মানের উদ্রেক করতে লাগল। ইংরেজদের খাজনার প্রতিটি পয়সা ঠিকমতো ব্যয় করা-প্রয়োজন হলে লোকের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা, কিন্তু স্থানীয় পঞ্চায়েত কায়েম করে তার কাছ থেকে এবং লোককে বুঝিয়ে তাদের ইচ্ছা এবং ক্ষমতা অনুসারে-এসব কাজ তারা মঙ্গল সিংহের নির্দেশ অনুযায়ী করেছিল। কোনো জিনিসই বিনামূল্যে না নেওয়া এবং প্রত্যেকটি জায়গায় হাজার হাজার লোকের মধ্যে মঙ্গল সিংহের বক্তৃতা এগুলো এমনই ব্যাপার ছিল যার প্রভাবে দলে দলে তরুণীরা স্বাধীনতার সৈন্যদলে ভর্তি হবার জন্য আসতে লাগল।
মঙ্গল সিংহ সৈনিকদের শিক্ষার ব্যাপারে শুধু প্যারেডই নয়—গুপ্তচর, রসদ-সংগ্ৰহ ইত্যাদি বিষয়েও শিক্ষা দিতে লাগল, হাকিম এবং বৈদ্যের এক বাহিনীও সে সঙ্গে রাখল। সামন্তশাহী লুটতরাজ এবং দুনীতির পঙ্ক পরিষ্কার করবার জন্য শিক্ষিতদের মধ্যে দেশভক্তি জাগানো প্রয়োজন ছিল আর এই সময়ে সেটা সহজ কাজ ছিল না। তবুও দুটো দিন মঙ্গল সিংহের সঙ্গে যে থেকে গেছে, সে তার দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারেনি। সিপাহীদের মধ্যে মঙ্গল সিংহের আচরণ দেখে কেউ বলতে পারত না যে সেই অধিনায়ক। শেষ পর্যন্ত তার সৈন্য সংখ্যা দু’হাজার অবধি পৌঁছেছিল। তার ইঙ্গিতে প্ৰাণ দেবার জন্য পল্টনের প্রত্যেকটি প্ৰাণ সদা প্রস্তুত থাকত। মঙ্গল সিংহ সব সময়েই সিপাহীদের সঙ্গে একত্রে আহার করত, তাদেরই মতো কম্বলে শয়ন করত, আর বিপদের সময় সকলের আগে রপিয়ে পড়ত। বন্দী ইংরেজ স্ত্রী-পুরুষকে সে যথেষ্ট আরামে রেখেছিল। তারাও সেনাপতির ভদ্র আচরণ দেখে বিস্মিত হত, কারণ ঐ সময়ে ইউরোপেও কয়েদীদের সঙ্গে এই ধরনের ভদ্র ব্যবহার করা হত না। মঙ্গল সিংহ রোহেল্যখণ্ডের চারিটি জেলায় গেল এবং সব জায়গাতেই সুশাসন প্ৰতিষ্ঠা করল।
নানাসাহেব ৫ই জুন (১৮৫৭ খৃঃ) ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করল এবং দেড় মাস যেতে না যেতেই ১৮ই জুলাই ইংরেজদের কাছে তাকে পরাজয় স্বীকার করতে হল। হাওয়া ঘুরে গিয়েছে এটা বুঝতে মঙ্গল সিংহের দেরী হল না, তবুও আজাদীর ঝােণ্ডাকে সে জীবিতাবস্থায় ভুলুষ্ঠিত হতে দিল না। ইংরেজদের সৈন্যরা অযোধ্যায় নিরস্ত্র জনসাধারণকে নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করল, স্ত্রীলোকের প্রাণ, মান ইজ্জৎ পায়ের তলায় গুড়িয়ে ফেলল, এ সব শুনেও মঙ্গল সিংহ এবং তার সৈন্যেরা কোনো বন্দী ইংরেজের দেহে হস্তক্ষেপ করল না।
বর্ষাকাল শেষ হতে না হতে সব জায়গাতেই বিদ্রোহীদের হাত থেকে অস্ত্ৰ খসে পড়ল কিন্তু রোহেলখণ্ড এবং পশ্চিম অযোধ্যায় মঙ্গল সিংহ অস্ত্র উঁচিয়ে রাখল। চারিদিক থেকে ইংরেজ, গুর্থ এবং শিখ সৈন্যেরা তার ওপর আক্রমণ চালিয়ে চলেছিল। মুক্তিসেনার সংখ্যা দিনে দিনে কমে যেতে লাগল। ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনেককে বাড়ি পাঠিয়ে দিল মঙ্গল সিংহ, কিন্তু মীরাট থেকে আগত এক হাজার সৈন্যের মধ্যে কেউই তার সঙ্গ ছাড়তে রাজি হল না। অবশেষে মঙ্গল সিংহ এমন এক ব্যাপার দেখল যা তার কাছে মৃত্যুকেও আনন্দময় করে তুলল। উৎসগীকৃত প্ৰাণ, দেশব্রতী তার এই ছোট বাহিনীতে ব্ৰাহ্মণ, রাজপুত, জাঠ, গুর্জর, হিন্দু-মুসলমানের সকল ভেদাভেদ চলে যেতে লাগল। সকলে এক সঙ্গে রুটি বানাতে লাগল এবং এক সঙ্গে খেতে লাগল। এই ভাবে তারা ভারতবর্ষের এক জাতিত্ত্বের উদাহরণ স্থাপন করল।
বিন্দী সিংহ, দেবরাম সদাফল পাণ্ডে, রহিম খাঁ ও গুলাম হোসেন-মীরাটের এই পাঁচজন সিপাহী মঙ্গল সিংহের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত রয়ে গিয়েছিল। যখন গঙ্গার দুদিক থেকে তার নৌকা আক্রান্ত হল, তখন বন্দী ইংরেজ নর-নারীদের অনুরোধে ইংরেজ জেনারেল ক্ষমা ঘোষণা করে শর্ত দিল যে, মঙ্গল সিংহ আত্মসমৰ্পণ করুক, কিন্তু মঙ্গল সিংহ গুলি চালিয়ে ইংরেজদের শর্ত প্রত্যাখ্যান করল। অবশেষে ছটি মৃদতেহ নিয়ে গঙ্গার বুকে ভাসমান মঙ্গল সিংহের নৌকা ইংরেজদের হাতে বন্দী হল। ইংরেজেরা সেদিন ভারতীয় বীরত্বের প্রতি অভিবাদন জানাল।