অবনীবাবু সহজে পরাস্ত হইবার লোক নহেন। বুঝিতে তাহার আর বাকি ছিল না যে নমিতার এই উদ্ধত আচরণের আড়ালে কাহার অঙ্গুলিনির্দেশ ছিল! সেইদিন দুপুর বেলায়ই প্রদীপ চলিয়া গেলে অবনীবাবু যখন বকিয়া-ঝকিয়া নমিতাকে একেবারে নাকাল করিয়া ছাড়িয়াছিলেন, যখন এমন পৰ্যন্ত বলিতে দ্বিধা করেন নাই : ঘরের বার হয়ে যেতে পার না ঐ গুণ্ডাটার সঙ্গে, এখানে বসে’ ঢলাঢলি করে’ আমাদের মুখে আর চুণ-কালি মাখাও কেন? তখন নমিতা নিজেকে আর দমন করিতে না পারিয়া বলিয়া বসিয়াছিল; যাবই ত’ বেরিয়ে। কার সাধ্য আমাকে আটকায়! তাই তোর হইলে অবনীবাবুর মনে আর লেশমাত্র সন্দেহ রহিল না যে, ঐ প্রদীপের সঙ্গেই ষড়যন্ত্র করিয়া চরিত্রহীন মেয়েটা কুল ডিঙাইয়াছে। এত সহজে প্রদীপকে ছাড়িয়া দিবার পাত্র তিনি নন। ফল যাহাই হোক, ঐ গুণ্ডাটাকে একবার দেখিয়া লইতে হইবে। তিনি পুলিশে খবর দিলেন।
গাড়ি আবার কলিকাতার দিকে গড়াইল। রাত্রিকাল। একই গাড়িতে সকলে উঠিয়াছে—দু-পাশের বেঞ্চি দুইটাতে নমিতা আর প্রদীপ; মাঝেরটাতে পুলিশের কয়েকজন লোক। অপরিমেয় স্তব্ধতা— কাহারো চোখে ঘুম নাই। অনেক পরে প্রদীপ ইনস্পেক্টারকে জিজ্ঞাসা করিল,—“জবানবন্দি ত’ টোকা হয়েছে, ওঁর সঙ্গে দুটো কথা বলতে পারি?”
ইনস্পেক্টার নমিতার অনুমতি চাহিলেন—সে কিন্তু অতি সহজেই রাজি হইয়া গেল। হাসিয়া কহিল,—“আসুন।”
প্রদীপ ধীরে উঠিয়া আসিল। দূরে বেঞ্চির এক পাশে সরিয়া বসিয়া কহিল,—“জবানবন্দিতে কি বল্লে?”
পুলিশকে শুনাইয়া স্পষ্ট করিয়া নমিতা কহিল,—“সত্য কথাই বলেছি। আপনি আমাকে ছল করে ওখানে নিয়ে গিয়েছিলেন আর নিতান্ত নির্লজ্জের মতো দৈহিক বলপ্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। বলেছি বৈ কি।”
প্রদীপ স্তব্ধ হইয়া রহিল। গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে কহিল, “জানতাম তুমি তা বলবে। এর চেয়ে সত্য করে কোনো নারী কোনো গুরুষকে দেখতে শেখেনি। কিন্তু কথাটাকে আরো একটু মার্জিত করে বল্লে না কেন?”
প্রদীপের মুখের দিকে অপলক চোখে চাহিয়া থাকিয়া নমিতা বলিল,-“অমন একটা নিদারুণ কথার আরেকটা মার্জিত সংস্করণ আছে নাকি?”
—“আছে বৈ কি।” কণ্ঠস্বর হঠাৎ গাঢ় ও আর্দ্র করিয়া প্রদীপ কহিল,—“বল্লেই পারতে আমার ভালোবাসার আকর্ষণে তোমাকে সমস্ত প্রাচীন প্রথা ও শাসনের প্রাচীর থেকে মুক্ত করে’ উদার আকাশের নীচে নিয়ে এসেছি—যেখানে বিস্তৃত জীবন, বিচিত্র তার উৎসব। বল্লেই পারতে, সহজ অধিকারের দাবিতে তোমাকে কামনা করেছিলাম, নমিতা।”
অন্ধকারের মধ্যে নমিতা হাসিয়া উঠিল। কহিল,—“অত কথা পুলিশ বুঝত না যে—”
প্রদীপের মুখে আর কথা আসিল না। চুপ করিয়া একদৃষ্টে বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল।
খানিক পরে নমিতা একেবারে ছেলেমানুষের মত তরল সুরে বলিয়া উঠিল : “কেমন মজা! শেষকালে কি না ফুলিয়ে ঘরের বউকে বার করার জন্যে জেল খাটবেন। অদৃষ্টে দুর্গতি থাকলে এমনিই হয়— হাতীও শেষে কাঁটা ফুটে মারা পড়ে।” হঠাৎ কথার মাঝখানে প্রদীপের অত্যন্ত কাছে সরিয়া আসিয়া কানের কাছে মুখ আনিয়া ক্ষীণ। অনুচ্চকণ্ঠে নমিতা কহিল,—“আরো এমনি মজা যে আপনার হাতে এমন কোনো সম্বলও আজ নেই যে আত্মহত্যা করে’ এ কলঙ্ক থেকে ত্রাণ পেতে পারেন। আপনার বন্ধু এ কথা শুনলে কী ভাববেন বলুন দিকি?”
কথা কয়টা কর্ণকুহরে নিক্ষেপ করিয়াই নমিতা আবার দূরে সরিয়া বসিল। প্রদীপ বলিল,-“বন্ধু কী ভাববেন তা তিনিই ভাবুন। জেলে যদি আমি যাই-ও, তবু মনে এমন কোনো গ্লানি থাকবে না যে, আত্মহত্যার উপকরণ হাতে নেই বলে অনুতাপ করতে হবে। ব্যাখ্যা একটা মনের মধ্যে কখন থেকেই গড়ে উঠেছে—তোমার জন্যেই জেলে গেলাম।”
—“আমার জন্যেই বৈ কি।” নমিতা ইনস্পেক্টারের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল,-“একজন অসহায় বিধবা-মেয়েকে কৌশল করে’ ঘরের বাইরে এনে তার ওপর পশুর মত উৎপীড়ন করতে চান আপনাকে লোকে জেলে না পাঠিয়ে ফুলচন্দন দিয়ে পূজো কবে, আপনার ফোটো সামনে রেখে নিশান উড়িয়ে মিছিল করবে, না?”
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া প্রদীপ কহিল,—“যা খুসি বল। কিন্তু তুমি মনে-মনে ত’ জান আমি পশুও নই, দেবতাও হ’তে চাই না। তোমাকে আমি কামনা করেছিলাম বৈ কি, সে-কামনা কবিতার মতই সুন্দর। তোমাকে পাইনি, পাওয়ার পেছনে যে প্রচুর তপস্যার প্রয়োজন হয় সে শিক্ষাই না-হয় জেলে বসে’ লাভ করা যাবে।”
—“যা যা, আর বক্তৃতা করতে হবে না, এখন ঘুমুন গে।” বলিয়া নমিতা বেঞ্চির কিনারে কাঠের দেয়ালে হেলান্ দিয়া পা দুইটা সামনে একটু প্রসারিত করিয়া শুইবার ভঙ্গি করিল, এবং তাহারই ইঙ্গিতে ইনস্পেক্টর আসামীর হাত ধরিয়া অন্য বেঞ্চিটাতে সরাইয়া আনিলেন।
কলিকাতা পৌঁছিয়া পুলিশ প্রদীপকে থানায় লইয়া গেল এবং নমিতাকে অবনীবাবুর জিম্মায় রাখিয়া বলিয়া দিল যেন ঠিক এগোরোটার সময় তাহাকে চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্টে হাজির করানো হয়।
তোর বেলা—উমা ছাড়া সবাইরই ঘুম ভাঙিয়াছে। আত্মীয়-পরিজনের শাসন-প্রখর দৃষ্টির সম্মুখে নমিতার মুখ একটুও ম্লান হইল না, তার দৃষ্টিতে না একটু কুণ্ঠা, পদক্ষেপে না একটু জড়তা। চাদরটা গায়ের উপর ভালো করিয়া টানিয়া সে সিড়ি দিয়া সোজা তাহার দোতলার পূজার ঘরের দিকে অগ্রসর হইল। নির্ভীক বীরাঙ্গনা, অটল ঋজু মেরুদণ্ড, আকাশের অরুণ-রশ্মির মত তাহার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হইতে যেন একটা দুঃসহ তেজ বিকীর্ণ হইতেছে। আত্মীয়-পরিজনরা মূঢ়দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল, কেহ একটা কথা কহিতে পারিল না, না বা পারিল উহাকে বাধা দিয়া উহার মুখ হইতে এই জঘন্য আচরণের একটা অর্থ বাহির করিতে। অবনী বাবু উৎফুল্ল হইয়া ফোনে শচীপ্রসাদকে প্রদীপের গ্রেপ্তারের সংবাদ দিতে ব্যস্ত হইলেন, আর অরুণা তাড়াতাড়ি উপরে উঠিয়া উমাকে জাগাইয়া কহিলেন,—“ওই শিগগির, দেখবি আয়-পোড়ারমুখি ফিরে এসেছে—”
একলা বিছানায় পশ্চিমের বিধুর দিগন্তলেখাটির মত উমা ঘুমাইয়া ছিল। সুরের মাঝে অনুচ্চারিত বাণীর যে সুষমা, ঘুমন্ত উমার দেহে তেমনি একটি অনির্বচনীয় কান্তি। মায়ের হাতের ঠেলা খাইয়া সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল : “কে ফিরে এসেছে মা? বৌদি? আর, দীপ-দা?”
অরুণা মুখ বিকৃত করিয়া কহিলেন,—“আর দীপ-দা! সে পাজিটা পুলিশের হাতে-হাতে তার হাতকড়া। এবার ঘানি ঘোরাবেন আর কি।”
উমার ঠোঁট দুইটি সহসা পার হইয়া উঠিল : “ঘানি ঘোরাবেন মানে? উনি কি করলেন? যদি কেউ পথ ভুল করে বাইরে বেরিয়ে আসে তবে তাকে আশ্রয় দেওয়া পাপ না মহত্ত্ব? ওঁর মহত্ত্ব স্বীকার করে আমাদেরই বরং উচিত মা, ওঁকে একদিন নেমন্তন্ন করে’ খাইয়ে দেওয়া?”
কোথায় উমা জাগিয়া উঠিয়া মা’র সঙ্গে নিভৃতে একটুখানি। নমিতার চরিত্রালোচনা করিবে, না, একেবারে মোড় ফিরিয়া প্রদীপের প্রশংসায় মুখর হইয়া উঠিল। অরুণা ধমক দিয়া কহিলেন,—“এক ফোটা মেয়ে, তুই তার কী বুঝবি? যা, ওঠ, এখন। খালি পড়ে। পড়ে ঘুমুনো। মুখ ধুয়ে পড়তে বোস এসে।”
উঠিতে হইল। ব্যাপারটার আদ্যোপান্ত তলাইয়া বুঝিতে তাহার আর বাকি নাই। নমিতা নিতান্ত নমিতা বলিয়াই তাহার জীবনে এমন একটা আচরণের উপকারিতা সম্বন্ধে সন্দেহ-সঙ্কুল প্রশ্ন উঠে, উমার জীবনে এমন একটা সমস্যার আবির্ভাব হইতে পারে এমন কথা সে নিজে ভাবিতেই পারে না। ঘর সে ছাড়িবে কি না, এবং ছাড়িলে কোথায় বা কাহার সঙ্গে সে আবার ঘর বাধিবে—এই সব প্রশ্ন তাহার ব্যক্তিগত নির্ধারণের বিষয়। ইহার জন্য পাড়ার পাঁচজনের মুখ চাহিতে হইবে নাকি? উমা হইলে কখনই ফিরিয়া আসিত না, এমন ভাবে হয় ত’ নিজেকে বন্দিনী করিয়া ফেলিত যে দীপ-দাকে তাহার কাছ হইতে সরাইয়া নেয় কাহার সাধ্য!!
নমিতার ঘরের গোড়ায় আসিয়া দেখিল সেখানে ছোটখাটো একটি ভিড় জমিয়া উঠিয়াছে। শচীপ্রসাদ পৰ্যন্ত হাজির। সবাইরই মুখ প্রসন্ন, নমিতার প্রতি কাহারো ভাষায় স্বাভাবিক রূঢ়তা নাই। ব্যাপারটা উমা চট করিয়া আয়ত্ত করিতে পারিল না।
শচীপ্রসাদ হাসিয়া কহিতেছে : “যাক্, ও ছোটলোক গুণ্ডাটা যে গ্রেপ্তার হয়েছে তাই ঢের। একেবারে সেসাস কেস,—ছ’টি বচ্ছর শ্রীঘরে। খবর শুনে ফুর্তিতে আমার চা-ও খাওয়া হ’ল না।’ এই যে উমা, চা করে দাও দিকিন একটু।”
অবনীবাবু ঘরের মধ্যে নমিতাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “পুলিশের কাছে যে সত্য কথা বলেছ বৌমা, তাতেই তোমার বুদ্ধির তারিফ করছি। ঐ পাজির পা-ঝাড়া স্কাউণ্ডে লটাকে এবার আমি দেখাবো—”
—“নিশ্চয়।” শচীপ্রসাদ সায় দিল : “মেয়েছেলে যতই কেন না বেয়াড়া হোতূ, বাড়ির বাইরে যেতে হলে পুরুষমানুষের হেলপ্ তাদের চাইই। তার ওপর উনি হিন্দু-বিধবা, পুরস্ত্রী। তা ছাড়া, কলকাতায় নয়—একেবারে ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে পিটটান। ও স্কাউণ্ড্রেলটাকে যদি বলেও যে বৌদি ইচ্ছে করে বেরিয়ে এসেছেন, ম্যাজিষ্ট্রেট তা কখনো বিশ্বাস করবেন না।”
অবনীবাবু বলিলেন,—“ও বল্লেই হ’ল? বৌমা ত’ জবানবন্দিতে স্পষ্ট বলেই দিয়েছেন যে প্রদীপই ওকে ছলে-বলে ফুসলিয়ে বাড়ির বা’র করেছে। কোর্টেও তোমাকে সে-কথাই বলতে হবে বৌমা, বুঝেছ?”
নমিতা অল্প একটু হাসিয়া সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িল।
—“বাস, তা হলে আর আডিউ ইনফ্লুয়েন্স-এর কথাও উঠতে পাবে না। পুলিশের কাছে ওটুকু না বলে’ এলেই মুস্কিল হ’ত।”
শচীপ্রসাদ কহিল,—“বৌদি আমাদের অত বোকা নন্। মেয়েমানুষদের অমন এক-আধটু ভুল হয়েই থাকে, কিন্তু যারা সেই সব ভুল খুঁচিয়ে তাদের বিপথে চালিয়ে নেয় তাদেরকে ছেড়ে দিতে নেই। ফঁদ পেতে ডাকাতটাকে ধরতে পেরেছেন, তাতে আপনাকে বাহবা দিচ্ছি, বৌদি।”
নমিতা আবার একটু হাসিল; চোখ তুলিল না, কথা কহিল না।
কথা কহিল উমা: “ফাঁদে যদি ডাকাত আজ ধরা না পড়ত তবে যাদুকরীকে আপনারা আর আস্ত রাখতেন না। ইদুর আজ সিংহকে ধরে’ দিতে পেরেছে বলেই ছুটি পেলো—নইলে সে একা ফিরে এলে তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতেন।”
অবনীবাবু ধমক দিয়া উঠিলেন: “যা যা, তোকে আর ফর্-ফর্ করতে হবে না। বৌমাকে শিগগির দুটো বেঁধে দে দিকি, এগারোটায় কোর্টে হাজিরা দিতে হবে।”
শচীপ্রসাদ কহিল,-“আর আমার চা।”
ঘর খালি হইয়া গেলে উমা রুক্ষ হইয়া প্রশ্ন করিল,—“বৌদি, এ তোমার কী নির্লজ্জতা?”
নমিতা চকাইয়া উঠিল। উমার মুখের উপর দুইটি জিজ্ঞাসু চক্ষু তুলিয়া সে চুপ করিয়া রহিল।
—“ফিরে এসেছ তার জন্যে তোমাকে তিরস্কার করি না, কিন্তু নিজের ঠুনকো খ্যাতি বাঁচাবার জন্যে এ তুমি কী করে বসলে?”
—“কী করে’ বস্লাম?” নমিতা দৃঢ়স্বরে জিজ্ঞাসা করিল।
—“টের ন্যাকামি করেছ। কেই বা তোমাকে ঘটা করে বাড়ির বা’র হতে বলেছিলো, আর কেনই বা তুমি নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করলে? ও-মুখ লুকোবার জন্যে এ-বাড়ির বাইরে কি আর তোমার জায়গা ছিল না?”
নমিতা ধীরে কহিল,—লুকোবার কথা বোল না, ঠাকুর-ঝি। এ-মুখ দেখাবো বলেই ত’ এ-বাড়িতে ফের ফিরে এসেছি।”
উমা তবুও শান্ত হইল না : “কেন ফিরে এলে? যখন বেরুলে ত’ হার স্বীকার করলে কেন? আবার এসে তুমি হবিষি আর ফোটো-পূজা শুরু করবে? তবে এই অভিনয় করবার কি দরকার ছিল?”
নমিতা হাসিয়া কহিল,—“পুলিশে ধরলে আর কি করা যায় বল।”
—“কি করা যায়? স্পষ্ট কণ্ঠে বলা যায় : আমি নিজের ইচ্ছায় বেরিয়ে এসেছি, যাকে তোমরা নারীহর্তা বলে’ ধরতে এসেছ, সে আমার নবজীবনের প্রভু, তাকে আমি ভালোবাসি। বলে না কেন, বৌদি?”
মুখ গম্ভীর করিয়া নমিতা কহিল,—“মিথ্যা কথা বলব কি করে?”
—“ভারি তুমি সত্যবাদী মেয়ে এসেছ। তাই কিনা দীপ-দার সর্বাঙ্গে কালি ছিটোতে তুমি দ্বিধা করলে না। যে-ভদ্রলোক স্নেহ করে’ এক নিরাশ্রয় মেয়েকে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করবার জন্য এগিয়ে এলেন, তার মাথায় কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে সত্যের গৌরব করতে তোমার লজ্জা করলো না, বৌদি? এই জঘন্য আত্মরক্ষার চেয়ে আত্মহত্যাও ভালো ছিল।”
নমিতা ক্ষীণ একটু হাসিল; কহিল,—“কা’র সত্য কোন পথে এসে দেখা দেয় তুমি সহসা তা বুঝবে না, উমা। বরং শচীপ্রসাদের জন্যে চা কর গে। সুসংবাদ পেয়ে উত্তেজনায় বেচারার দারুণ তেষ্টা পেয়েছে নিশ্চয়।”
উমা রুখিয়া উঠিল : “কার জন্যে চা করতে হবে সে-পরামর্শ তোমার কাছ থেকে নিতে চাই না। নিজের খেলে মান বাঁচাতে গিয়ে ভীরু অপদার্থের মত তুমি যে আরেকজনকে সমাজের চোখে লাঞ্ছিত করবেএ অত্যাচার আমরা সইবো না। মনে রেখো।”
নমিতা স্নিগ্ধ কণ্ঠে কহিল,—“কী আর করবে বল। আইনের কাছে আবদার খাটে কৈ।”
—“খাটেই না ত’। সত্য বলে যা নিয়ে তুমি আস্ফালন করছ সেই তোমার অসতীত্ব। স্থান তোমার সংসারের সেই বাইরেই। তবু তুমি এত স্বার্থপর হবে যে—ছি!”
দারুণ ঘৃণায় উমার চোখমুখ বিষাক্ত হইয়া উঠিল। বহুক্ষণ কেহ কোন কথা কহিল না; উমা যখন চলিয়া যাইবার জন্য পা বাড়াইয়াছে, নমিতা তাহাকে বাধা দিল : “শোেন। সংসারের প্রাচীরের বাইরে চলে এসে আমারো এ দুটি দিনে কম শিক্ষা হয়নি, উমা। আমি বুঝেছি, তোমাদের ঐ সতীত্ব-বোধটা মানুষের ব্যক্তিত্ব-বিকাশের পক্ষে প্রকাণ্ড একটা বাধা। সে-বাধা আমি খণ্ডন করব—আপন শক্তিতে, আপন স্বাতন্ত্রে।”
উমা ফিরিয়া দাঁড়াইল : “তাই যদি হয় তবে নিজের সতীত্বের ওপর মুখোস্ টানবার জন্যে আরেকজনের মুখে কালি ছিটোতে তোমার বিবেক সায় দেয়?”
উমার মুখের কথা কাড়িয়া নিয়া নমিতা হাসিয়া কহিল,—“আরেকজনের জন্যে যে তোমার ভারি দরদ।”
উমা গাঢ়কণ্ঠে কহিল,—“সে-দরদের এক কণা তোমার থাকলে এমন নির্লজ্জের মত নির্দোষ সেজে সমাজের চোখে সস্তা বাহবা নিতে চাইতে না। কে তোমাকে দীপ-দার সঙ্গে বেরিয়ে যেতে বলেছিলো?”
—“ভাগ্য, উমাযে-ভাগ্য মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে হিজিবিজি ছবি আঁকে। আমার সঙ্গে আর বেশি তর্ক করো না, লক্ষ্মী—আমি ভারি শ্রান্ত হয়েছি। কাল সারা রাত ঘুমুতে পারি নি।”
হঠাৎ উমা নমিতার পায়ের কাছে বসিয়া পড়িয়া কহিল,—“কিন্তু দীপ-দাকে তুমি জেল থেকে বাঁচাবে—আমাকে কথা দাও, বৌদি! তিনি ত’ তোমাকে জোর করে বাবা-মা’র কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন নি, তুমিই বরং পথে বেরিয়ে তাকে কুড়িয়ে পেলে। তুমিই বরং তাকে জখম করলে, তিনি তোমার কোনো ক্ষতিই করেন নি। কপালের সেই ঘা-টা তার কেমন আছে, বৌদি?”
নমিতা মুগ্ধ দৃষ্টিতে উমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, কখন তাহার পায়ের উপর উমার হাত দুইটি নামিয়া আসিয়াছে তাহাও লক্ষ্য করিতে ভুলিল না। ধীরে কহিল,—“তিনি আমার কোনো ক্ষতিই করেন নি, এ তুমি কী করে বুঝলে, উমা?”
—“ক্ষতি করেছেন! কী তিনি করতে পারেন শুনি?”
—“যদি বলি উমা, তিনি প্রমত্ত পুরুষত্বের লালসায় আমাকে অধিকার করতে চেয়েছিলেন, তাঁকে শাসন করা দরকার—”
উমা দাঁড়াইয়া পড়িল : “মিথ্যা কথা।”
নমিতা বলিল,—“মিথ্যা কথা নয়, উমা।”
—“তবু নারীর কাছে তার ক্ষমা আছে;-যে-নারী তাঁকে সঙ্গী হ’তে আহ্বান করে, সে-আহ্বান তিনি যদি নিমন্ত্রণ বলে মনে করেন তার মধ্যে কপটতা কৈ, বৌদি। বেশ, তঁাকে তুমি বর্জন কর, কিন্তু মুক্তির যে-দায়িত্ব তুমি অর্জন করলে সে তোমারই থাক্।”
কথা শুনিয়া নমিতা হাসিয়া ফেলিল। ঠাট্টা করিয়া কহিল, “তাকে ত্যাগ করলেই যে তুমি তার নাগাল পাবে এমন কথা বিশ্বাস হয় না, উমা।”
উমার চক্ষু ভিজিয়া উঠিয়াছিল, প্রাণপণে সে চোখের দৃষ্টিকে প্রখর করিয়া রাখিল, কহিল—“আমি কেন, কোন মেয়েই তার নাগাল পাবে না, বৌদি। এই বিশ্বাসই যদি তোমার হয়ে থাকে, তবে কেনই বা তাকে ত্যাগ করতে যাবে?”
উমা আর দাঁড়াইতে পারিল না; মা’র কথা শুনিয়া মুখ ধুইতে নীচে নামিয়া গেল।