একটা বাজিবার বহু আগে হইতেই প্রদীপ গলির মোড়ে প্রতীক্ষা করিতেছে। চিঠি পাইবার পর অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল, তবু এখনো যেন সে ভালো করিয়া কিছুই ধারণা করিতে পারিতেছে না। যে নির্মম ঘৃণায় আঘাত করিতে পারে, সেই আবার কালবিলম্ব না করিয়া সহযাত্রিণী হয় এমন একটা চেতনায় প্রদীপ একেবারে অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল। মানুষের মনে এমন কি পারস্পরিক বৃত্তিবৈষম্য ঘটিতে পারে, ভাবিয়া প্রদীপের বিস্ময়ের আর অন্ত ছিল না। ভয়ও করিতেছিল না এমন নয়। যতক্ষণ নমিতা শ্বশুরালয়ে স্থাণুর মত অচল হইয়া বসিয়া ছিল ততক্ষণ তাহাকে সংস্কার ও বুদ্ধি দিয়া আয়ত্ত করা যাইত, কিন্তু যখন সে সেই পরিচিত ঘর-বাড়ি ছাড়িয়া একেবারে কূলপ্লাবিনী নদীর মত নামিয়া আসিল তখন তাহাকে যেন আর সীমার মধ্যে খণ্ডিত ও লাঞ্ছিত করিয়া দেখিবার উপায় নাই। কোথায় একটা অস্বাভাবিক অসামঞ্জস্যের বেসুর বাজিতেছে, অথচ এমন একটা খবরুদ্র বিদ্রোহাচরণের মাঝেই ত’ সে তাহাকে আহ্বান করিয়াছিল! কিন্তু এমন আকস্মিকতার সঙ্গে হয় ত’ নয়। এই নিদারুণ অসহিষ্ণুতার মাঝে সেন কুশ্রী নির্লজ্জতা আছে। যে-বিদ্রোহ আযোপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত নয় তাহাতে সুষমা কোথায়?
অজয় হইলে হয় ত’ লাফাইয়া উঠিত,নমিতাকে সঙ্গে নিয়া হয় ত’ তখনই গলবস্ত্র হইয়া সমাজের উদ্যত খড়ের নীচে মাথা পাতিত! কিন্তু প্রদীপ নমিতাকে পরিপূর্ণ ও প্রগলভ জীবননাৎসবের মাঝখানেই নিমন্ত্রণ করিতে চাহিয়াছে। নমিতাকে নিয়া তাহার তৃপ্তির তপস্যা, সৃষ্টির সমারোহ। সে তাহাকে নিয়া মরণের হলি খেলিতে চাহে নাই। কিন্তু যে-প্রেম দীর্ঘ প্রতীক্ষার অশ্রুসিঞ্চনে সঞ্জীবিত হইল না, সে-প্রেম শরীরের একটা স্নায়বিক উত্তেজনা মাত্র, তাহার কোথায় বা লাবণ্য, কী-বা তার ঐশ্বৰ্য্য! সাহসিকা অভিসারিকার চেয়ে একটি সাশ্রলেখাননা বাতায়নবর্তিনী বন্দিনী মেয়ের মাঝে হয় ত’ বেশি মাধুরী। কিন্তু এখন ইহা নিয়া অনুতাপ করিবার কোন অর্থ নাই। কেন যে সে কী আঘাত পাইয়া হঠাৎ উজ্জ্বল ঝড়ের আকারে নমিতা গিয়াছিল, কেনই বা যে নমিতা সেই আক্রমণ প্রতিরোধ করিয়াও পুনরায় পরাভূত হইল—ইহার কারণ নির্ণয় করিবারও সময় ফুরাইয়াছে।
রিক্স ছাড়িয়া নানা অলি-গলিতে ঘুরিয়া-ঘুরিয়া প্রদীপ অত্যন্ত শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছে। স্নায়ুগুলি শিথিল হইয়া আসিতেই সে নমিতার এই অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবের মধ্যে আর মাদকতার স্বাদ পাইল না’। তবু এখন রাস্তার মাঝখানে নমিতাকে একলা ফেলিয়া সরিয়া পড়িবার মার্জনা নাই। যখন পথে একবার পা দিয়াছে তখন তাহার পার খুঁজিয়া দেখিতে হইবে।
রাস্তা ক্রমে-ক্রমে পাতলা হইয়া আসিল। রাত্রির কলিকাতার স্তব্ধতার মাঝে উন্মুক্ততাব একটা প্রাণান্তকর বিশালতা আছে—এত বড় মুক্তির কথা ভাবিয়া প্রদীপের হাঁপ ধরিল। গলির মোড় হইতে অবনী বাবুর বাড়ির একটা হলদে দেয়াল অস্পষ্টাকারে চোখে পড়ে, তাহারই দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিয়া প্রদীপ চক্ষুকে ক্ষয় করিয়া ফেলিতে লাগিল। এ কী—নমিতাই ত’, সমস্ত গায়ে চাদর মুড়িয়া এদিকে অগ্রসর হইতেছে। আশ্চৰ্য, তাহা হইলে চিঠিটার মধ্যে এতটুকু অসত্য ছিল না? নমিতা তাহা হইলে নিতান্তই কলঙ্কের ডালা মাথায় লইয়া কূল ডিঙাইল! সে প্রদীপকে এতখানি বিশ্বাস করে! সে একবারো কি এই কথা ভাবে নাই যে, যে অমিতচারী উচ্ছঙ্খলস্বভাব প্রদীপ অন্তঃপুরে ঢুকিয়া নির্লজ্জ ও কদর্য্য অভিনয় করিয়া আসিতে পারে, তাহার বিশ্বাস ঘাতক হইতেও দেরি লাগে না? কে জানে হয় ত’ সে এই কথাই ভাবিয়াছিল : তাহার উপর যাহার এমন দুর্দমনীয় লুব্ধতা, সে নিশ্চয়ই এমন সোনার সুযোগ সহজে ফসকাইতে দিবে না, দুই লোলুপ বাহু মেলিয়া গলির মোড়ে ঠিক দাঁড়াইয়া থাকিবে। হয় ত’ সে প্রদীপের আগ্রহকে এমনি একটা কদৰ্থ করিয়া নিশ্চিন্ত ছিল। পরস্পাপহরণই কি তাহার ব্যবসা নাকি? নমিতা তাহাকে কেন সন্দেহ করিল না? কে জানে, নমিতার না আসিলেই বুঝি ভালো হইত। একটা চিঠি লিখিয়া তাহার প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন না করিলে হয় ত’ তাহার স্বর্গচ্যুতি ঘটিত না।
নমিতা সরাসরি প্রদীপের সম্মুখে হাঁটিয়া আসিল; কহিল, “কোথায় নিয়ে যাবেন, চলুন। গাড়ি ঠিক রেখেছেন?”
প্রদীপ ভালো করিয়া নমিতার মুখেব দিকে চাহিতে পারিতেছিল, তবু ক্ষণিক দৃষ্টিপতে যেটুকু আভাস পাইল তাহাতে সে স্পষ্ট বুঝিল যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে-মুখ নিদারুণ বলাইয়া গিয়াছে। দিনের বেলাকার সেই প্রশান্ত ও গাম্ভীৰ্য্যগদগদ মুখোনি এখন নিরানন্দ শুষ্কতায় কুটিল ও কৃশ হইয়া গিয়াছে। কথায় পৰ্যন্ত সেই কুণ্ঠিত মাধুর্যের কণা নাই। সে আমতা আমতা করিয়া কহিল,—“গাড়ি-টাড়ি ঠিক নেই।”
নমিতা সামান্য বিদ্রুপ করিয়া কহিল,—“ভাবছিলেন বুঝি চিঠিতে আপনাকে একটা ধোকা দিয়েছি। মিথ্যা কথা সহজে আমি বলি না। চলুন, গাড়ি একটা পাওয়া যাবে হয় ত’।”
ক্লান্তস্বরে প্রদীপ কহিল,—“কিন্তু কোথায়ই বা যাবে?”
—“বাঃ, সে ত’ আপনি জানেন। আমাকে আপনি কোথায় নিয়ে যাবেন তার আমি কী জানি?”
প্ৰদীপ ম্লান চক্ষু দুইটি নমিতার মুখের উপর নিবদ্ধ করিয়া কহিল, “সত্যি, কোথায় যাব তার আমি কিছু জানি না।”
নমিতা চঞ্চল হইয়া উঠিল : “কিছুই জানেন না? এখন এ-কথা বলতে আপনার লজ্জা করে না? তখন ঘটা করে আমার ঘরে গিয়ে যাত্রা-দলের ভীমের পার্ট করে এসে এখন শকুনি সাজলে চলবে কেন? চলুন, এগোই। এখানে দাঁড়িয়ে গবেষণা করবার সময় নেই। খানিক বাদেই বাড়িতে তুফান লেগে যাবে। তখন মরবাররা আর মুখ থাকবে না। চলুন।” বলিয়া নমিতাই বড় রাস্তা ধরিয়া আগাইতে লাগিল।
পিছে পিছে দুই পা চলিতে চলিতে প্রদীপ কহিল,—“আমাকে ক্ষমা কর, নমিতা। তুমি বাড়িতেই ফিরে যাও।”
নমিতা ফিরিয়া দাঁড়াইল। সামনেই গ্যাম্পােসটটা, তাহার আলোতে সে-মুখের সব ক’টা রেখা নিমেষে দৃঢ় ও দৃপ্ত হইয়া উঠিল : “আপনি এত বড় কাপুরুষ? বাড়ির বাইরে টেনে এনে আবার তাকে বাড়িমুখো হবার পরামর্শ দেন কোন লজ্জায়? আর, ফেরবার পথ অত সহজ নয়। কিন্তু ঐ দেখুন, একটা গাড়ি যাচ্ছে। বোধ হয় খালি—ডাকুন না, দেখা যাক্।”
গাড়িতে উঠিলে গাড়োয়ান জিজ্ঞাসা করিল,—“কোথায় যাব?”,
প্রদীপ নমিতাকে প্রশ্ন করিল,—“কোথায় যেতে বলব ওকে? তোমার বাপের বাড়ি?”
—“বাপের বাড়ি! আপনাকে সঙ্গে নিয়ে এত রাত্রে ওখানে ফিরে গেলে বাপের বাড়ির এয়োরা সব বরণডালা নিয়ে আসবে না। কোথায় যেতে বলবেন আমি কি জানি?”
এক মুহূর্ত কি ভাবিয়া প্রদীপ বলিল,—“চল শেয়ালদা।”
দুই জনে মুখোমুখি বসিয়াছে। নমিতা জালা দিয়া রাস্তার উপরে চলমান গাড়ির ছায়াটাই বোধ করি লক্ষ্য করিতেছিল, প্রদীপ একেবারে মূঢ়, স্পন্দহীন। শেয়ালদা হইতেই যে কোথায় যাওয়া যাইতে পারে তাহার কোনো কিনারাই সে খুঁজিয়া পাইতেছিল না। এসময় অজয়ের দেখা পাইলে মন্দ হইত না। সে সমস্ত সমস্যাই খুব তাড়াতাড়ি সমাধান করিতে পারে, হয় ত’ ভোর হইলেই সে নমিতাকে নিয়া একটা প্রকাণ্ড শশাভাযাত্রার আয়োজন করিয়া ফেলিত। কিন্তু নমিতা যদি আসিলই, তবে রূঢ় কোলাহলে সে যেন নিজেকে ব্যয় না করে, আকাশের দর্পণে সে তার আত্মার প্রতিবিম্ব দেখুকু।
প্রদীপ অনেকক্ষণ পরে কথা কহিল,—“তুমি এমন করে হঠাৎ বেরিয়ে পড়বে, এ ভাবতেও পারিনি, নমিতা।”
নমিতা জানলা হইতে মুখ ফিরাইল না, কহিল,—“তবে কি ভাবতে পেরেছিলেন শুনি?”
একটু দম নিয়া প্রদীপ কহিল,—“ভেবেছিলাম মেরুদণ্ডের অভাবে চিরকাল তোমাকে সমাজের অচলায়তনে কুকড়েই থাকতে হবে।”
নমিতা ভিতরে মুখ আনিয়া ঠাট্টা করিয়া কহিল,-“এখন আমার মেরুদণ্ডটা বুঝি আপনার কাছে প্রকাণ্ড দণ্ড হয়ে উঠেছে, তাই আবার শ্বশুরবাড়ি ফিরে যেতে বলছেন। কিন্তু আমার জন্যে আপনাকে ভাবতে হবে না।” বলিয়া আবার সে জানালার বাহিরে মুখ বাড়াইয়া দিল।
প্রদীপ কহিল,—“সংসারে কার জন্য কা’র ভাবনা করতে হয় কিছু লেখা থাকে না, নমিতা। তুমি আমার সঙ্গেই ত’ চলেছ। এ-যাত্রায় পৃথক্ ফল যখন কোনদিক থেকেই নেই, তখন ভাবনার অংশটা আমাকেও ত’ খানিকটা নিতে হবে।”
নমিতা সোজা হইয়া বসিল। ঘোমটার তলা হইতে কতকগুলি রুক্ষ চুর্ণকুন্তল মুখের উপর শুইয়া পড়িয়াছে। সে দুইটি ঠোঁট ঈষৎ চাপিয়া কি-একটা কঠিন কথা সংযত করিয়া নিল। পরে স্পষ্ট করিয়া কহিল,—“আপনার সঙ্গে চলছি বটে, কিন্তু আপনার জন্যেই বেরিয়ে আসিনি, দয়া করে তা মনে রাখবেন।”
ম্লান একটু হাসিয়া প্রদীপ কহিল,—“সে-কথা আমাকে মনে না করিয়ে দিলেও চলত, নমিতা। বেরিয়ে যে এসেছ এইটেই আজকের রাতের পক্ষে সত্য, কিসের জন্য এসেছ সেইটে অবান্তর। আমার জন্য বেরিয়ে আসবে এমন একটা অন্যায্য অভিলাষের কলুষে তোমার এ বিজয়গৰ্ব্বকে আমি ছোট করতে চাইনে। কিন্তু এ যখন তোমার একারই দায়িত্ব তখন আমাকে আর গাড়ি করে কোথায় টেনে নিয়ে চলেছ?”
নমিতা চোখের সম্মুখে বিপদ দেখিল। প্রদীপকে এত সহজে মোহমুক্ত করাটা ঠিক হয় নাই। সে হাসিয়া কহিল,—“আমি টেনে নিয়ে চলেছি মানে? আজকে সকালবেলা আমার পূজোর ঘরে কে ঘটোৎকচবধের পালা শেষ করে এলো? বক্তৃতায় পটু, কাজে কপট— এমন লোক দেশের কল্যাণ সাধন করবার অহঙ্কার করে কোন হিসাবে? কোনো রমণীকে কুলের বার করে এনে মাঝপথে তাকে ফেলে চলে যাওয়াটা বীরধৰ্ম্ম নয়। আপনি যেখানে যাবেন আমাকেও সেখানেই যেতে হবে।”
প্রদীপ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। এক রাতে সেই নিৰ্বাককুণ্ঠিতা নমিতা মুখরভাষিণী হইয়া উঠিয়াছে। চোখে চটুলতা, কথায় বিদ্রুপ, ব্যবহারে পরম সাহস। তাহার সেই ধ্যানময় প্রেমগরিমা কোথায় অন্তর্হিত হইল! সেই তেজোদীপ্ত দৃঢ়তার বদলে এ কিসের তরলচাপল্য! তাহার বিদ্রোহাচরণে এমন একটা অপরিচ্ছন্নতা থাকিবে ইহা প্রদীপ কোনদিন বিশ্বাস করে নাই।
প্রদীপ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল,—“আমি ত’ মৃত্যু-অভিসারিক।”
নমিতা হাসিয়া বলিল,—“কবির ভাষায় আমিও তা হলে মৃত্যু স্বয়ংবরা।”
প্রদীপ গম্ভীর হইয়া কহিল,—“সত্যিই আমি মৃত্যুকে জীবনের মূল্য-নির্ধারক বলে স্বীকার করি না। আমি বাঁচতে চাই, পরিপূর্ণ ও প্রচুর করে’ বাঁচা।”
নমিতা হাসিয়া কহিল,—“এ আপনারই যোগ্য বটে। বিসংবাদী মনোভাব নিয়েই আপনি কারবার করেন দেখছি। একবার বলেন : বেরোও; বেরুলে বলেন : ফের। মন খারাপ হ’লে বলেন : মরব; মরবার সময় এলে গল্পের কাঠুরের মত বলেন : বাঁচাও। আমার উপায় নেই, আপনার কথায় সায় আমাকে দিতেই হবে। আপনি যদি বাঁচান, ত বাচব বৈ কি। বাঁচতে চাই বলেই ত’ বেরিয়ে এলুম। মরলুম আর কৈ!”
নমিতার এতগুলি কথার মধ্যে একটি কথামাত্র প্রদীপ কুড়াইয়া লইল : “আমার সঙ্গে সায় দিতে হবে তোমার এমন কোনো চুক্তি আছে নাকি, নমিতা?”
—“না থেকে আর উপায় কি? আপনার সঙ্গেই যখন যেতে হচ্ছে।”
—“আমার সঙ্গে যাবার জন্যে ত’ তোমার দিক থেকে কোনো আয়োজনই হয় নি, নমিতা। আমি তোমার সঙ্গে আছি এ তোমার জীবনের আকস্মিক একটা দুর্ঘটনা মাত্র। তুমি ত’ আর সত্যি আমার জন্যেই পথে নাম নি।”
নমিতা কহিল,—“তা ত’ নয়ই। সে-কথা বার বার বললে মানে উলটে যাবে না কখনই। আমি একলাই বেরুতুম, কিন্তু পুরুষ একজন সঙ্গে থাকলে কিছুটা আমার সুবিধে হবে ভেবেই আপনাকে চিঠি লিখেছি। আপনি আমার পথের অবলম্বন মাত্র, বিশ্রামের আশ্রয় নয়। সত্যভাষণের দীপ্তি যদি সইতে না পারেন, তবে নেমে যান গাড়ি থেকে, আমার আপত্তি নেই। যে-দেবতা আমাকে ডাক দিলেন, রাখতে হয় তিনিই আমাকে রাখবেন। মিছিমিছি আপনাকে ব্যস্ত করলুম হয় ত’।”
নমিতা জানার উপরে বাহুর মাঝে মুখ লুকাইল।
প্রদীপ কহিল, “তোমার মাঝে আমি মুক্তির মহিমা দেখছি, নমিতা—”
নমিতা মুখ না তুলিয়াই কহিল,—“এটা কবিত্ব করবার সময় নয়।”
—“জানি। নানা রকম বিপদের সঙ্গে আমাদের বুঝতে হবে, নানারকম সমস্যা। সমাজ, আইন, হৃদয়। সে-সবের মীমাংসা অহিংসামূলকই করে তুলব আমরা। দাঁড়াও, কথা আমাকে শেষ করতে দাও। তোমার চিঠি পেয়ে এ-কথা যদি একবার ভেবে থাকি যে, বেরুলেই তুমি আমার হৃদয়ের নিকটবর্তী হবে সেটা নেহাৎই আমার অন্ধতা। দুটো দেহের স্থানিক সান্নিধ্যই মিলন নয়, নমিতা। সেলুব্ধতা আমার ছিল কি ছিল না তেমন বিচার আগে থেকে করতে গিয়ে তুমি আমোক লাঞ্ছিত হ’য়ো না। ধরে’ নাও আমি তোমার বন্ধু। তবে এখন বলতে তোমার দ্বিধা করা উচিত নয়—কেন তুমি এমন বিস্ময়কর কাজ করে ফেললে?”
নমিতা মুখ তুলিল। অন্ধকারেও স্পষ্ট মনে হইল সে কঁদিতেছে। চাদরের খুঁটে চোখ মুছিয়া সে কহিল,—“বিস্মিত আমিও নিজে কম হইনি, প্রদীপবাবু। কিন্তু বেরিয়ে না এসে সেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে বসে’ থাকবার মত অমানুষিক সতীত্ব আমার সইলো না। কুরুসতায় দ্রৌপদীও এতদূর লাঞ্ছিত হয়েছিলেন কি না মহাভারত লেখে না। আমার এতদিনকার স্বামিধ্যান কৃচ্ছ্বপালন সমস্তই আমার বৈধব্যের মতই নিস্ফল হ’ল। ভাবলুম, আপনার সেই হৃদয়হীন দস্যুতাই যখন আমার সকল অত্যাচারের মূল, তখন দায়িত্বও আপনারই। তাই আপনাকে চিঠি লিখলুম। যত বড় অমানুষই হোন না কেন, একজন ভদ্রনারীর করুণ আবেদন হয় ত’ অগ্রাহ্য না-ও করতে পারতেন। তবু যদি রাস্তায় এসে আপনাকে না পেতুম, আমাকে সামনেই চলতে হ’ত, এগোবার সময় ফেরবার সমস্ত গতি নিবৃত্ত করেই বেরিয়েছি।” বলিয়া নমিতা ঝর ঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।
প্রদীপ কহিল,—“হৃদয়হীন সত্যিই আমি ছিলাম না, নমিতা। তবু যদি সন্দেহ কর এই বিদ্রোহাচরণে কোনো কল্যাণ নেই, তবে বল, গাড়ি ফিরতে বলি।”
কান্নার মধ্যেই কর্কশ স্বরে নমিতা কহিল,–“না।”
প্রদীপ কহিল,—“দায়িত্ব আমারই। ভেবেছিলাম, যাকে চাওয়া যায় তাকে পাওয়া যায় না, এ নিয়ম ঈশ্বরের মতই অবধারিত। কিন্তু জোর করে’ যদি তাকে ছিনিয়ে নেওয়া যায় তবেও ত’ তাকেই পাওয়া হ’ল। স্তরভেদের সূক্ষ্মতাবিচার ভুলে গিয়েছিলাম, নমিতা। ভুল হয় ত’ আমার ভেঙেছে, কিন্তু সময় যদি একদিন আসে, বুঝবে, সত্যিই আমি হৃদয়হীন ছিলাম না। আমি তোমাকে পাই না পাই, সংসারব্যাপারে এ একটা অতি তুচ্ছ কথা। তুমি তোমাকে পাও এই খালি প্রার্থনা করি। কিন্তু যাক্, গাড়িটা ষ্টেশনে ঢুকছে। বাকি রাতটা প্ল্যাটফর্মেই কাটাতে হবে। ভোর বেলা ট্রেনে চাব।”
ট্রেনে চাপিয়া কোথায় যাইবে এমন একটা কৌতূহলী প্রশ্নও নমিতার মুখ দিয়া বাহির হইল না। তাহার মুখ আবার সহসা রুক্ষ ও বিকৃত হইয়া উঠিয়াছে। মুখের প্রত্যেকটি রেখা একটা আত্মঘাতী প্রতিজ্ঞার সঙ্গে প্রদীপের প্রতি বীভৎস ঘৃণায় প্রখর হইয়া উঠিল। সে কহিল,—“দায়িত্ব থেকে আপনাকে আমি মুক্তি দিলুম—স্বচ্ছন্দে, অতি সহজে। আপনি বাড়ি ফিরে যান। প্ল্যাটফর্মে বা কোথায়। রাত কাটাতে হবে সে-পরামর্শ আমার চাইনে।” বলিয়া নিজেই গাড়ি হইতে নামিয়া আসিয়া গাড়োয়ানকে প্রশ্ন করিল,-“তোমাকে কত দিতে হবে?”
আঁচলের গেরো হইতে পয়সা বাহির করিতে আর হাত উঠিল না, গাড়ির ভিতরে হঠাৎ প্রদীপের আত্তকণ্ঠ শুনিয়া সে জালা দিয়া চাহিয়া দেখিল, তাহার মাথার ব্যাণ্ডেজটা মুখের উপর নামিয়া আসিয়াছে এবং কপালের যে-জায়গাটা কাটিয়া গিয়াছিল সেই ক্ষতস্থান হইতে নূতন করিয়া রক্ত ঝরিয়া প্রদীপের জামা-কাপড় ভাসাইয়া দিতেছে। উদ্বিগ্ন হইয়া নমিতা কহিল,—“ঈস! কি করে খুলে গেল ব্যাণ্ডেজ? আসুন, আসুন, নেমে আসুন শিগগির।”
প্রদীপ নড়িল না। নমিত। আবার গাড়িতেই উঠিয়া বসিল। বলিল,-“ঈস! এতটা কেটে গিয়েছিল নাকি? দাঁড়ান, চুপ করে’ থাকুন, আমি বেঁধে দিচ্ছি।”
-“এখানে হবে না। চল, নামি।” বলিয়া প্রদীপ নমিতার বাহুতে ভর দিয়া নামিয়া আসিল।
—“ভাড়াটা আমিই দিচ্ছি।” প্রদীপ ব্যাগ খুলিল।
গাড়োয়ান চলিয়া গেলে প্রদীপ বলিল,-“ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। ভাল করে বেঁধে দাও, নমিতা।”
নমিতা বলিল,-“শুয়ে পড়ুন। কেমন করে’ খুললেন?”
প্রদীপ কপালে নমিতার আঙুল ক’টির স্পর্শ অনুভব করিতে করিতে বলিল,-“কেমন আপনা থেকে খুলে গেল, নমিতা।”
ভোর বেলা দুইজনে চিটাগং-মেইলে চাপিয়া বসিল।
তুচ্ছ দেশ, তুচ্ছ সমাজ-সংস্কার! এতদিন সে বৃথাই অজয়ের সঙ্গে পল্লীর পঙ্কোদ্ধার-ব্রতে মত্ত ছিল। মাইলের পর মাইল হাঁটিয়া চাঁদা কুড়াইয়া গ্রামে স্কুল বসাইয়াছে, এবং সে-স্কুল উঠিয়া গেলে দুই বন্ধু স্বচ্ছন্দে সরিয়া পড়িয়াছে। একটা বঞ্চিত ব্যর্থ বিকৃত জীবনের বোঝ। কাঁধে লইয়া সে এতদিন দেশ হইতে দেশান্তরে ঘুরিয়া মরিতেছিল কেন? নমিতার স্পর্শে তাহার আজ মুক্তিমান হইল। পুরোনো দিনের সেই খোলস তাহার এক নিশ্বাসে খসিয়া পড়িয়াছে, সে আজ কবি, আনন্দ-উদধি! সে নিজেকে সুন্দর করিবে; পৃথিবীকে সমৃদ্ধ, স্বপ্নরঞ্জিত! আজ তাহার নূতন করিয়া জন্মলাভ হইল,-নমিতা সেই বিস্মৃত অতীতের তীর হইতে একটি শুত সঙ্কেত লইয়া তাহার জীবনে আবিভূত হইয়াছে—প্রেমে, মঙ্গলাচরণে, কায়িককল্পনায়।
গাড়িটা নির্জন ছিল—একই বার্থে দুই জানালায় দুই জন ষ্টেশনের দিকে মুখ করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। কিন্তু কিছু একটা কথা না বলিলে এই স্তব্ধতা অতিমাত্রায় কুৎসিত ও দুঃসহ হইয়া উঠিবে। কিন্তু কী-ই বা বলিবার ছিল! নমিতা মুখাবয়ব এমন দৃঢ় করিয়া রাখিয়াছে, দুই চোখে তার এমন কঠিন ঔদাসীন্য, বসিবার ভঙ্গিটিতে এমন একটা দৃপ্ততা যে, কোমল করিয়া তাহার নামোচ্চারণটি পর্যন্ত প্রদীপের মুখে আর মানাইবে না। অথচ এমন একটি স্নিগ্ধ-করোজ্জ্বল প্রভাতের জন্য তাহার প্রার্থনার আর অন্ত ছিল না। সেই দিনটি এমন মৃত্যু-মলিন রাত্রির মুখোদ পরিয়া দেখা দিল কেন?
গাড়ি ছাড়িবার দেরি ছিল। প্রদীপ কহিল,—“তোমাকে একটা বই কিম্বা পত্রিকা কিনে এনে দেব?”
নমিতা অনুদ্বিগ্ন স্পষ্টতায় উত্তর দিল : “ইংরেজি বর্ণমালার পরস্পর সন্নিবেশের কোন মাহাত্ম্যই আমার কাছে নেই। আপনি আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না।”
শেষের কথাটুকুর প্রখরতা প্রদীপের কানে বাজিল : “কিন্তু সারা পথ। তুমি এমনি বোবা হয়ে বসে থাকবে?”
নমিতা চোখ ফিরাইল না, একাগ্র দৃষ্টিতে প্ল্যাটফর্মের উপরকার জনপ্রবাহের দিকে চাহিয়া কহিল,—“কথা বলবার লোক থাকলেই চলে না, কথা চাই। কিন্তু আমার জীবনে আবার কথা কী! সব কথা ফুরিয়ে গেছে।”
—“কিন্তু আমার অনেক কথা ছিলো।” —“কিছু দরকার নেই।”
প্রদীপ এক মুহূর্ত স্তব্ধ হইয়া রহিল। পরে কহিল,—“কোথায়। যাচ্ছ জানতে তোমার একটুও কৌতূহল হচ্ছে না, নমিতা?”
নমিতা এইবার প্রদীপের মুখের দিকে দুই চক্ষু তুলিয়া ধরিল। সেই চক্ষু দুইটি অপ্রত্যাশিতের আশঙ্কায় স্তিমিত নয়, ভাবাবেশে গভীর নয়, উলঙ্গ তরবারির মত প্রখর। তাহার ঠোঁটের প্রান্তে মুমূর্য শশিলেখার মত একটি বিবর্ণ হাসি ভাসিয়া উঠিল। কহিল,—“যাচ্ছি যে সেইটেই বড়ো কথা, কোথায় যাচ্ছি সেইটে নিতান্ত অবান্তর।”
গাড়ি এতক্ষণে ছাড়িল। রাশীকৃত কোলাহল ক্রমে ক্রমে টুকরাটুকরা হইয়া এখানে সেখানে ছিটকাইয়া পড়িতে লাগিল। গাড়ি এখন মাঠের মাঝে আসিয়া পড়িয়াছে। প্রদীপ কহিল,—“কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে ত’ ঠাই নিতে হবে।”
নমিতার স্বরে সেই অনুত্তেজিত ঔদাস্য : “কিন্তু পৃথিবীতে কোনো জায়গাই মানুষের পক্ষে শেষ আশ্রয় নয়। পৃথিবীর আহ্নিক গতির সঙ্গেসঙ্গে জায়গাও বদলে যায়। তাই জায়গা সম্বন্ধে আমার কৌতূহলও নেই, আশঙ্কাও নেই। আমি সকল আশা-আশঙ্কার বাইরে। সেই আমার ভরসা।”
প্রদীপ কাছে সরিয়া আসিল : “তুমি এ-সব কী বলছ, নমিতা?”
নমিতা একটুও ব্যস্ত হইল না : “বলছি, আপনি যে-জায়গায় আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন সেখান থেকে ফের সরে পড়তে আমার দ্বিধা থাকবে না। আসবার যাবার দু’দিকের পথই আমার জন্য খোলা আছে। বুঝেছেন?”
জিজ্ঞাসাটুকুর মধ্যে শ্লেষ আছে। প্রদীপও ব্যঙ্গ করিয়া কহিল, “কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকেই অবলম্বন করে আশ্রয় খুঁজতে বেরুলে; এটার মধ্যেও ত’ দ্বিধা থাকা উচিত ছিল।”
—“উচিত অনেক কিছুই ত’ ছিল। উচিত ছিল স্বামী না মরা, উচিত ছিল স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে যৌবন উবে যাওয়া। তার জন্যে আমার ভাবনা নেই। মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি বলে আমার আর অনুশোচনা হয় না। আপনার সঙ্গে কেন বেরুলুম সেটা আপনিই ভেবে দেখুন না একবার।”
প্রদীপ কহিল,—“আমার ভেবে দেখাতে ত’ কিছু এসে যাবে না। কিন্তু পাঁচ জনের মুখের দিকে ঘোমটা তুলে চাইতে পারবে ত’, নমিতা?”
—“আপনার সঙ্গে কেন বেরুলুম সেইটে আপনি ভাল করে ভেবে। দেখেন নি বলে’ই পাঁচজনকে টেনে এনে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। আমি ত’ আর আপনার জন্যে বেরিয়ে আসিনি।”
ম্লান হাসিয়া প্রদীপ বলিল,-“সে-কথা মুখ ফুটে না বললেও আমি ঠিক বুঝেছিলাম, নমিতা। আমার জন্যেই যদি বেরিয়ে আসতে, তা হলে তোমার তপস্যার তাপে পাঁচ জনের তৎক্ষণাৎ পঞ্চত্ব ঘটতে। তখন তুমি আপন সত্যে স্থির, আপন অধিকারে প্রতিষ্ঠিত থাকতে। আমার জন্যেও বেরুলে না, অথচ আমারই সঙ্গ নিলে, তোমার বাড়ির অভিভাবকরা এর সূক্ষ্ম রসটা আবিষ্কার করতে পারবে কি?”
নমিতা চোখের দৃষ্টিকে কুটিল করিয়া কহিল,—“বাড়ির অভিভাবকের রসবোধের অপেক্ষা রেখে ঘর ছাড়িনি—একথা ভুলে গিয়ে আমার চরিত্রের ওপর কটাক্ষ করবেন না। তারা বুঝুন না বুঝুন, আপনি বুঝলেই যথেষ্ট। রাত একটার সময় সদর দরজা খুলে গুটিসুটি বেরিয়ে এসে পথের মাঝখানে আপনারই হাত ধরলাম, সংবাদটার মধ্যে যথেষ্ট মাদকতা আছে। সে-মাদকতায় আপনিই যাতে আচ্ছন্ন না হন সেই বিষয়ে আপনাকে সাবধান করে দেওয়া দরকার। কোনো দুর্বল মুহূর্তেই যেন এ ভেবে গর্ব অনুভব না করেন যে, আমি আপনার ব্যক্তিত্বে অভিভূত হয়েই আপনার বশ্যতা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। আমি বেরিয়েছি নিজের প্রেরণায়, নিজের দায়িত্বে—আপনি আমার পক্ষে একটা উপকরণ মাত্র, লক্ষ্য নয়। দয়া করে এ কথা মনে রেখে চলবেন আশা করি।” বলিয়া নমিতা একটা ঢোঁক গিলিল। তাহার উত্তেজনা এখনো শান্ত হয় নাই। জিত, দিয়া ঠোঁট দুইটা ভিজাইয়া আবার সে কহিল,—“আমার স্বামীর ফোটোটা আপনি ভেঙে দিয়ে এসে। আমার বিপ্লবের সমস্ত মাহাত্ম্য নষ্ট করে দিয়েছেন। ভেবেছিলাম আমিই একদিন ওটাকে ভেঙে-চুরে ছিড়ে-ছিড়ে কুটি-কুটি করে’ ফেব। মিথ্যাচারকে আর কত দিন প্রশ্রয় দেওয়া চলে?”
প্রদীপের মুখ দিয়া বিস্ময়সূচক একটা ধ্বনি বাহির হইবার আগেই নমিতা কহিল,—“হাঁ, মিথ্যাচারই ত। সত্যকে পাব ভেবে যে-নিষ্ঠাকে যত মহৎ করেই দেখি না কেন, তার মধ্যে নিত্যের দেখা না পেলেই দারুণ ঘৃণা ধরে যায়। সেই ঘৃণা প্রকাশ করবার দিনের নাগাল আজ পেয়েছি আমি।”
ঘোমটার তলা হইতে বিপর্যস্ত চুলগুলি দুই হাতে তুলিয়া লইয়া নমিতা খোপা বাধিতে বসিল।
গাঢ়স্বরে প্রদীপ কহিল,—“তোমার সান্নিধ্যের মাদকতায় আমি অবিচল থাকবে, আমার ওপর তোমার এ-বিশ্বাস এলো কি করে? তুমি সাবধান করে দিলেই যে আমার স্নায়ুমণ্ডলী মন্ত্রমুগ্ধ সাপের মত নিস্তেজ হয়ে থাকবে আমার ভালবাসাকে তুমি এতটা হীন ও দুর্বল করে দেখবার সাহস কোথা থেকে পেলে, নমিতা?”
অথচ কথার সুরে মিনতি ঝরিতেছে। নমিতা স্তম্ভিত বিস্ময়ে প্রদীপের মুখের দিকে চাহিল। সে-মুখে সহসা উষাভাসের লাবণ্য আসিয়াছে, নমিতা চোখ ফিরাইতে পারিল না। প্রদীপ আবার কহিল,—“তার চেয়ে তুমি বাড়ি ফিরে যাও। কিম্বা তোমার যদি আর কোনো আত্মীয়-স্বজন থাকে, ঠিকানা বল, তোমাকে সেখানে রেখে আসি। আমার সঙ্গে তুমি এসো না। আমি নিষ্ঠুর বলে’ বলছি না, আমি লোভী; আমার রক্ত খালি তপ্ত নয়, পিপাসিত। সমাজের কলঙ্কভাজন হতে আমার অশ্রদ্ধা নেই, কিন্তু তোমার কাছে আমি কালো হতে পারবো না। আমাকে তুমি বিশ্বাস করো না, নমিতা।”
নমিতা স্থির শান্ত কণ্ঠে কহিল,—“আমি আপনাকে খুব বিশ্বাস করি।”
—“না, আমার ললাভের সীমা নেই, নমিতা। না না, সে তুমি বুঝবে না।”
—“আমি খুব বুঝি।”
—“বোঝ না। তোমাকে পাবার জন্যেই আমি দস্যু সেজেছিলাম। খালি প্রার্থনার মধ্যে পেতে হবে কেন, সংগ্রামের মধ্যেও লাভ করা যায়। তোমাকে আমি কেড়ে ছিনিয়ে নেব এই প্রতিজ্ঞায় আমার হাতের মুঠো দু’টো কঠিন হয়েছিল। কিন্তু তোমাকে কোনোদিন পাব না জানলে এমন পিপাসাকে প্রশ্রয় দিতাম না।”
নমিতা ধীরে কহিল,—“আপনার এ-অস্থিরতা দেখে আমারই ভারি লজ্জা করছে। কোনো মেয়ের কাছে পুরুষের এই নাকি-কান্নার মত বীভৎসতা পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। আপনি যা বলেন বলুন, আমি আপনারই সঙ্গে যাব। যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানে, অপ্রতিবাদে, যে কোনো সৰ্ব্বনাশে। নিন, ধরুন আমার হাত।” বলিয়া নমিতা তাহার আঁচলের তলা হইতে একটি শুভ্র শীৰ্ণ হাত বাড়াইয়া দিল।
প্রদীপ তাহা ছুইতেও পারিল না। যেন আগামী জন্মে চলিয়া আসিয়াছে এমনই একটা অভাবনীয়ের চেতনায় সে খানিকক্ষণ বিমূঢ় হইয়া রহিল। সেই অতটুকু নমিতা এত শীঘ্র এমন করিয়া বলাইল
কিসে? তাহার মেরুদণ্ড কয়েকদিনেই কঠিন দুর্নমনীয় হইয়া উঠিয়াছে। হাত বাড়াইয়া দিবার ভঙ্গিটিতে কী তেজস্বিতা! এত নিভৃতে নিকটে রহিয়াও তাহার স্বাতন্ত্রের মৰ্যাদাটুকুকে সে সন্দেহে দুৰ্বল, আশঙ্কায় নিষ্প্রভ করিয়া তুলে নাই। হাসিয়া কহিল,—“আপনি ত’ আমার বন্ধু, দেখি, আপনার হাত দিন।”
প্রদীপ একটিও কথা কহিতে পারিল না, আস্তে তাহার হাতখানি অসীম ভীরুতায় প্রসারিত করিয়া দিল। নমিতা তাহা স্পর্শ করিয়াই ছাড়িয়া দিল না; কহিল,—“এক দিনেই আমার জন্মদিন আবার ঘুরে এল, এবং এ-জন্ম মনে হচ্ছে পৃথিবীতে নয়, আকাশে। আপনার লোভকে আমি ভয় করব ভাবছেন? কেন, আমি জয় করতে পারি না?” একটুখানি হাসিয়া আবার কহিল,—“আপনার লোভ আছে, আমার দুর্গম দুর্গ নেই? আপনি আক্রমণ করতে পারেন আর আমি আত্মরক্ষা করতে পারি না?”
না, পার না—প্রদীপ ইচ্ছা করিলেই ত’ ঐ তপঃশীর্ণা দেহলতাকে তাহার বুকের উপর দলিত করিয়া ফেলিতে পারে। ঐ ভুরু, নাক, ঠোঁট —আভরণহীন দু’খানি রিক্ত বাহু,—সমস্ত কিছু সে অজস্র অজস্র চুম্বনে সোনা করিয়া দিবে। কিন্তু নমিতার চারিদিকে এমন একটা অব্যাহত কাঠিন্য, এত কাছে বসিয়াও চতুর্দিকে সে একটা দুরতিক্রম্য দূরত্ব বিস্তার করিয়া আছে যে, প্রদীপ একটি আঙুলও নাড়িতে পারিল না। নমিতা কহিল,-“তা হলে আপনি যে ঘটা করে’ অতসব বক্তৃতা দিয়ে এলেন তা শুধু আমাকেই লাভ করতে, আমাকে মুক্ত করতে নয়?”
প্রদীপ হাত সরাইয়া নিয়া কহিল,—“তার মানে?”
—“তার মানে, আপনার সঙ্গে আমার যদি আইনানুমোদনে বিধবাবিবাহ হত, তা হলে স্বচ্ছন্দে আবার আমাকে দাসী বানিয়ে ফেলতেন। অর্থাৎ, আমি যদি কোনোদিন কোনো ছুতোয় খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়তে পারি, বিশ্রামের জন্য আবার যেন আপনারই শাখায় এসে বসি—এই আপনার কামনা ছিল?”
প্রদীপ কহিল,—“ছিল, নমিতা। কিন্তু অমন রূঢ় উপমা প্রয়োগ করো না। একদিন এই সব নিষ্ফল পূজোপচার দু’হাতে ছড়িয়ে দিয়ে তুমি ব্যক্তিত্ব-পূজায় বরণীয় হয়ে উঠবে এই কামনা করে তোমার জন্য আমি একটি প্রতীক্ষার বাতি জ্বেলে রেখেছিলাম। যে অসীম-শূন্যচারী পাখী চলার বেগে খালি চলে, থামে না, তার বেগের মাঝে একটা ক্লান্তির কদৰ্যতা আছে।”
নমিতা হাসিয়া কহিল,—“এও আপনার রূঢ় উপমা। জানেনই ত’ বড় বড় কথা আমি বুঝি না। দুর্বোধ্য হবার জন্যেই যেসব কথা বড় বলে’ বড়াই করে সেগুলোকে আমার অত্যন্ত বাজে মনে হয়।”
দুই জনে আবার চুপ করিয়া গেল। দিগন্তবিস্তীর্ণ মাঠের শেষে অবনত আকাশের অজস্র প্রসারের পানে চাহিতে-চাহিতে নমিতার দুই চক্ষু উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। আবার অসঙ্কোচে ভাবগগদ স্বরে কহিল, —“কী সঙ্কীর্ণ সংসার থেকে এই প্রচণ্ড পৃথিবীতে এসে উত্তীর্ণ হলাম, তার জন্যে আপনাকে আমার বহু ধন্যবাদ।
প্রদীপের বিস্ময়ের অবধি নাই : “আমাকে?”
–“এই উন্মুক্ততার স্বপ্ন আমাকে আরেকজন দেখিয়েছিলেন, কিন্তু আপনার বিদ্রোহ একটা ঝড়ের আকারে আমার ঘরে ঢুকে আমার আরাম ও আলস্য, স্থিরতা ও স্থবিরতা সমস্ত লণ্ডভণ্ড করে দিলে। আপনার আচরণে যতই কেন না একটা অপরিচ্ছন্নতা থাক্, সেঅসহিষ্ণুতার মাঝে শক্তি ছিল, তেজ ছিল। তাই আপনাকেই সঙ্গী করলাম।”
খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া নমিতা আবার কহিল,—“আমি যে সমাজের প্রতি কী অমানুষিক বিদ্রোহাচরণ করলাম তা আপনিও বুঝবেন না।”
প্রদীপ অনিমেষ চোখে তাহার দিকে চাহিয়া রহিল।
নমিতা কহিল,-“ঐহিক বা পারত্রিক কোনো লোভের বশবর্তী হ’য়েই এই বিরুদ্ধাচরণ করিনি। লোকে যতই কলঙ্ক দিক্, আমার ভগবান তা শুনবেন না। আর, আমি তারই সঙ্গ নিলাম, যার দুর্ধর্ষ আচরণে সমস্ত সংসারের কাছে আমার মুখ অপমানে ও লজ্জায় কালো হয়ে উঠল।”
–“মানুষের মনোরাজ্যের এমন একটা অস্বাভাবিক বিশৃঙ্খলা আমার কাছেও ভারি অদ্ভুত ঠেছে, নমিতা। যার প্রতি তোমার বিদ্বেষ ও রাগের অন্ত থাকা উচিত নয়, এবং এখনো যার প্রতি তুমি মৌখিক শিষ্টাচারের একটা কৃত্রিম আবরণ মাত্র মেনে চলুছ, তোমার এই দুর্দিনে তাকেই তুমি সাথী নিলে, এটার রহস্য সত্যিই রোমাঞ্চকর, নমিতা।”
নমিতা দৃঢ় হইয়া কহিল,—“না, এটার মাঝে অবাস্তব উপন্যাসের কোনো ইন্দ্রজালই নেই কিন্তু। আমার আচরণটা কোষমুক্ত অসির মতই স্পষ্ট। আপনাকে আগেই বলেছি বেরিয়ে আসাটাই আমার কীৰ্ত্তি, তার নিমিত্তটা অশরীরী। কিন্তু সংসারে আপনাকে নিয়েই আমার দুর্নাম, আপনাকে দিয়েই আমার উৎপীড়ন,—ভাবলাম এমন কীর্তিসঞ্চয়ের দিনে আপনিই আমার উপযুক্ত সহচর। শুধু সমাজ নামে ঐ বধির শাসনস্তুপটা নিজের দাহে নিজেই পুড়ে ছাই হয়ে যাক্, সেই আনন্দেই আপনার সাথী হলাম, আপনার কামনার আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে ছাই করবার জন্যে নয়।”
মুগ্ধ হইয়া প্রদীপ কহিল,—“এত কথা তুমি শিখলে কোথা থেকে?”
নমিতা হাসিয়া কহিল,—“এ সব ভাবলেশহীন অসার বক্তৃতা নয় যে, বই বা খবরের কাগজ থেকে মুখস্ত করে এসে চেচিয়ে লাফিয়ে সবাইকে চমকে দেব। এ আপন আত্মার কাছ থেকে গভীর করে জানা, আপন অন্তরের খনি খুঁড়ে এ-মণি আবিষ্কার করতে হয়। তাই এশিক্ষা পেতে দিন-ক্ষণ পাজি-পুথি লাগে না, একটি মুহূর্তস্থায়ী বিদ্যুৎ বিকাশে সমস্ত আকাশ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আপনাকে বাহন করার উদ্দেশ্যই হচ্ছে আমার সমাজকে শাসন করা। তদতিরিক্ত কোনো মূল্য আপনাকে আমি দিতে পারছি না।”
প্রদীপ তাহাকে বিরত করিয়া কহিল,—“মুক্তি তুমিই খালি লাভ করনি, নমিতা, আমিও। তুমি তোমার আচরণের মুক্তি, আমি আমার অন্তরের স্বাধীনতা। আপন আত্মার কাছ থেকে আমিও গভীর করে সত্য শিখে নিলাম, নমিতা, এক মুহূর্তে, চোখের একটি দ্রুত পলক-পতনের আগে। সঙ্কীর্ণ অচলায়তন ছেড়ে আজ আত্মোপলব্ধির পথ পেলাম।”
নমিতা বিস্মিত হইয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিল। পরে ধীরে কহিল,-“আপনার জীবনের এই সব উত্তেজিত মুহূর্তগুলিকে আমি ভয়ানক সন্দেহ করি। এই অন্ধ উত্তেজনাই হচ্ছে সত্যিকারের ম্রিয়মাণ।”
—“নয়, নয়, তা নয় নমিতা। আমি খালি সংগ্রাম করব এউত্তেজনা যেদিন লাভ করেছিলাম সেদিন আমার কবিত্বের, আমার আত্মবিকাশের সমস্ত বাতায়ন রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেটা একটা উগ্র নেশা মাত্র ছিল, হোলি-খেলার উৎসব জমাতে গিয়ে হিন্দুস্থানিরা যেমন মদ খায়। সেটাতে সৃষ্টির উত্তেজনা ছিল না, স্নায়ুকে সে সহিষ্ণু করে না, সেতারের তারের মত সঙ্গীতময় করে তোলে না। কিন্তু আমিও যে একদিন রাত্রির আকাশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অপিন অস্তিত্বের প্রসারতা বোধ করেছিলাম সৃষ্টির প্রেরণায়, সে-সত্য আজ আবার তোমাকে কাছে পেয়ে উদঘাটিত হ’লনমিতা। সমস্ত ভুল আমার ফুল হয়ে বিকশিত হ’ল। আর আমি সৈনিক নই, স্রষ্টা। বুঝলাম, জোর খাটালেই লাভ করা যায় না, তপস্যা চাই। যে-জিনিস সাধ করে হাতে আসে না নমিতা, তার মধ্যে স্বাদ কই?” বলিয়া প্রদীপ হঠাৎ নমিতার দুই হাত চাপিয়া ধরিল।
নমিতা হাত সরাইয়া নিল না। তেমনি উদাসীন নির্লিপ্তের মত কহিল,—“আপনার এমন স্নায়ুদৌর্বল্যের খবর পেয়ে আপনার বন্ধু নিশ্চয়ই আর আপনাকে ক্ষমা করবেন না।”
প্রদীপ ব্যস্ত হইয়া প্রশ্ন করিল,-“কে? অজয়?”
নমিতা অস্ফুট স্বরে কহিল,-“হাঁ; তিনি আপনাকে ভাববিলাসী, অকর্মণ্য বলে’ ঘৃণা করবেন।”
তাড়াতাড়ি নমিতার হাত ছাড়িয়া দিয়া প্রদীপ উত্তেজিত হইয়া কহিল,-“কেন, পদে পদে আমি ওর প্রতিবিম্ব হয়ে থাকূব আমাকে সৃষ্টি করবার সময় বিধাতা এমন চুক্তি করেছিলেন নাকি? মানুষের বিশ্বাসেরও সীমা থাকা উচিত। তার জন্যে সমস্ত বিশ্বকে সঙ্কীর্ণ করে’ রাখতে হবে আত্মার এমন খৰ্ব্বত। আমি সহ্য করবো না। নতুন সত্যের আলোকে পুরাননাকে পরিষ্কৃত করে নেব না, আমার এমন অন্ধ অনেদাৰ্য নেই। বহু-বৈচিত্র্যের আস্বাদে যে বদলায় না, তাকে আমি জীবন্মত বলি, নমিতা। অজয়ের ক্ষমা না-ক্ষমায় আমার কিছু এসে যায় না। তার সত্য তার, আমার আমার। তার পথ থেকে আমি সরে এলাম। আমি একা, আমি নবীন।”
নমিতার ঠোঁটের কিনাবে সামান্য একটি ধারালো হাসি ফুটিয়া উঠিতেই প্রদীপ কথা থামাইল। নমিতা কহিল,—“বদলানোতে আপনার বাহাদুরি আছে। কিন্তু সে-কথা থাক্। আমাকে নিয়ে এখন কি করতে চান?”
প্রদীপ খুসি হইয়া উঠিল : “আমাকে নিয়ে তুমি কি করতে চাও বল?”
নমিতার মুখ গম্ভীর; একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “দেখা যাক।”
একটা ষ্টেশনে গাড়ি থামিল। প্রদীপ উঠিয়া পড়িয়া কহিল, “তখন থেকে খালি বাজে কথা বলে চলেছি। তোমার মুখ শুকিয়ে। গেছে একেবারে। দেখি ষ্টেশনে কিছু ফল-টল কিনতে পাই কি না।”
নমিতা বাধা দিয়া কহিল,—“আমার জন্যে অকারণে ব্যস্ত হবেন না। শরীরকে আমি স্বচ্ছন্দে শাসন করতে পারি।
কথায় এমন একটা তেজোদীপ্ত দৃঢ়তা যে প্রদীপের পা দুইটা অচল হইয়া রহিল।
গাড়ি আবার চলিয়াছে।