দুইটা-কুড়ির গাড়িতে প্রদীপ যখন কলিকাতা হইতে ডাক্তার লইয়া ফিরিল, তখনো সে ভাল করিয়া বুঝিতে পারে নাই যে সুধী মরিয়া গিয়াছে। ডাক্তার আনিয়া সে ভালই করিয়াছিল, নতুবা অরুণাকেও আর ফিরানো যাইত না।
ষ্টেশনে সোফার গাড়ি নিয়া অপেক্ষা করিতেছিল। প্রদীপ ডাক্তারকে সঙ্গে করিয়া প্লাটফর্মের বাহির হইতেই ড্রাইভার ডাকিল, “এই যে।”
প্রদীপ ডাক্তারের ব্যাগটা মোটরে তুলিয়া দিবার আগেই ভয়-ব্যাকুল স্বরে প্রশ্ন করিল,—“কেমন আছে এখন?”
মোটরে স্টার্ট দিয়া সোফার কহিল,—“তেমনি।”
কপালের উপর চুলগুলি ঝুলিয়া পড়িতেছিল, বাঁ-হাত দিয়া কানের পিঠের কাছে তুলিয়া দিতে দিতে প্রদীপ কহিল,—“খুব হাঁকিয়ে চল, হরেন। দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছনো চাই।”
হরেন গাড়ি ছাড়িল। ডাক্তার যেন একটু ভয় পাইয়া বলিলেন,–“পথে য়্যাসিডেন্ট করে রোগীর সংখ্যা বাড়ালে বিশেষ সুবিধে হবে না। যে পথ-ঘাট,—আস্তেই চল হে।”
সরু, আঁকাবাঁকা পথ—নির্জন, নিস্তব্ধ, যেন একেবারে মরিয়া রহিয়াছে। দুই ধারে বড় বড় গাছ যেন নিশ্বাসরোধ করিয়া অন্ধকার আকাশের অনুচ্চারিত রোদন শুনিতেছে—একটিও পাতা নড়িতেছে না। প্রদীপ অনেকদিন ঘরের বাতি নিভাইয়া সুধী-র সঙ্গে সাহিত্যালোচনার অবকাশে গভীর রাত্রে মাঠে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে,—সে-রাত্রির স্তব্ধতা যেন একটি অনাস্বাদিতপূৰ্ব বেদনার লাবণ্যে মণ্ডিত ছিল, কিন্তু আজিকার এই নির্মম নিঃশব্দতা প্রদীপ সহ কবিতে পারিতেছে না। ডাক্তারের দিকে মুখ ফিরাইয়া কহিল,—“একবার শেষ চেষ্টা করে’ দেখবেন। ছোট কচি-বৌ,—সানে ওর বিশাল ভবিষ্যৎ! চমৎকার ছেলে, কী দারুণ স্বাস্থ্য ছিল।”
ডাক্তার কহিলেন,—“ছোট একটু হৃৎস্পন্দন নিয়েই মানুষের এই সুদৃঢ় দেহ, সুদীর্ঘ জীবন। এই স্পন্দনটুকু বন্ধ হলে বিজ্ঞানও বোব হয়ে গেল। আমাদের সাধ্য আর কতটুকু, ভগবান ভবসা। বাড়ি আর কতদুর হে? তোমাদের হবেন যে এবোপ্লে চালিয়েছে! দেখো।”
ডাক্তারের মুখে ভগবানেব নাম শুনিয়া প্রদীপ সুখী হইল না বটে, কিন্তু একবার অসহায় অন্ধবিশ্বাসে ভগবানের কাছে মনে-মনে প্রার্থনা করিয়া লইতে পারিলে যেন গভীর স্বস্তিলাভ করিত। এই প্রগাঢ় প্রস্তুপ্তির মধ্যে মনে-মনে ঐ প্রকার একটা স্বীকারোক্তি যেন অসঙ্গত হইত না। যে-অবিশ্বাসী সমস্ত জীবন নাস্তিকতা প্রচার করিয়া মৃত্যুশয্যায় অনুমিত ভগবানের কাছে অনুতপ্ত কণ্ঠে ক্ষমা চাহিয়াছিল, তাহাকে মনে-মনে ধিক্কার দিয়া প্রদীপ সহসা বলিয়া উঠিল : “এই এসে পড়েছি, ডাক্তারবাবু। আপনি ঘুমুচ্ছেন নাকি? আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম।”
এই মাঠটুকু পার হইলেই বাড়ির দরজায় গাড়ি থামিবে। ডাক্তারবাবু এই সামান্য সময়টুকুর মধ্যেই ঝিমোননা সুরু করিয়াছেন দেখিয়া প্রদীপের এত রাগ হইল যে, উপকার পাইবার আশা না থাকিলে হয়ত মুখের উপর দুইটা ঘুসি মারিয়া বসিত। কোন নামজাদা বড় ডাক্তারই এত রাতে এই অসময়ে দূরে আসিতে রাজি হয় নাই, তাই এই চার-টাকার ডাক্তাবকে সে ধরিয়া আনিয়াছে; তাও কত সাধ্যসাধনা করিয়া। রোগীর আত্মীয়বর্গকে আশ্বাস দিবার মিথ্যা কলাকৌশলটা ভাল করিয়া আয়ত্ত করিয়াছিলেন বলিয়াই ডাক্তারবাবু এই যাত্রা সারিয়া গেলেন।
গাড়ি আসিয়া দরজায় দাঁড়াইল। হরেন হর্ণ বাজাইতে যাইতেছিল, প্রদীপ বাধা দিল। বাড়িতে কোনো ঘরে একটাও আলো জ্বলিতেছে না,সুধী-র ঘরেও না। ব্যাপার কি? সুধী বুঝি একটু ঘুমাইয়াছে। আঃ, প্রদীপ সুখে নিশ্বাস ফেলিল। সকাল বেলা যখন ডাক্তার আনিতে কলিকাতা যায়, তখনো সুধী যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট, বিবর্ণ হইয়া ছটফট করিতেছিল,—এখন যদি তার চোখে তরল একটি তন্দ্রা। নামিয়া থাকে, তাহা হর্ণের শব্দে ভাঙিয়া যাইতে পারে। প্রদীপ ডাক্তারকে লইয়া নিঃশব্দে নামিয়া যাইবে। পার্শ্ববর্তী কোন-এক গ্রামের কে-এক সন্ন্যাসী কি-একটা শিকড় বাটিয়া খাওয়াইয়া সুধীকে নিরাময় করিয়া তুলিবে—এমন একটা কথা প্রদীপ শুনিয়া গিয়াছিল। হয়ত সেই সন্ন্যাসীর ওষুধ খাইয়া, সুধী শরীরের সকল ক্লেশ ভুলিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। হয়ত এই ডাক্তারকে আর দরকারেই লাগিবে না; টাকাগুলি গুনিয়া-গুনিয়া ডাক্তারের হাতে গুঁজিয়া দিয়া, উহাকে বিদায় দিতে তাহার যে কী ভাল লাগিবে বলা যায় না। ডাক্তারকে বরখাস্ত করিয়া একটা সন্ন্যাসীর অলৌকিক ওষুধের অসম্ভবপর সাফল্যে সে হঠাৎ বিশ্বাস করিতেছে ভাবিয়া তাহার হাসি পাইল না। সে যাহাকে প্রত্যক্ষরূপে লাভ করে নাই বলিয়া অস্বীকার করে, পৃথিবীতে তাহার অস্তিত্বই থাকিবে না এমন যুক্তি সে আজ গ্রহণ না-ই বা করিল। প্রদীপ কান খাড়া করিয়া রহিল। একটিও শব্দ আসিতেছে না, সমস্ত নীরবতা যেন গভীর তৃপ্তিতে ভরিয়া উঠিয়াছে। সুধী-কে ঘুমাইতে দেখিয়া সবাই হয় ত’ সাময়িক অনুদ্বেগে একটু বিশ্রাম করিতেছে; নিভৃত ঘরে খালি নমিতা-ই হয়ত জাগিয়া শিয়রে বসিয়া আছে নির্নিমেষ চোখে; হয়ত লজ্জিত ভীরু কতখানি স্বামীর কপালের উপর রাখি: ভগবানকে সুধী ভাবিয়া-ই মনে মনে তাহার কাছে অসংখ্য অবদার করিতেছে। তাহা হইলে প্রদীপও আজ আঠারো রাত্রির বিনিদ্র তার শোধ লইবে; কিম্বা, নমিতা যদি তাহার উপস্থিতিতে কুষ্ঠিত না হয়, তবে সেই ঘরে বসিয়াই ম্লান দীপালোকে তাহার ও সুধী-ব অসমাপ্ত উপন্যাসখানির কিয়দংশ আবার লিখিতে চেষ্টা করবে। উপন্যাসের নায়ককে মারিয়া ফেলিয়া তাহার সমস্যার সমাধান করিতে চাহিয়াছিল; তাহা হইলে, উপন্যাসকে অত সহজ করিয়া, সমস্যাকে অযথা খর্ব করিয়া তুলিবে না।
কে যেন বাড়ির সদর দরজা ঠেলিয়া বাহিরে আসিতেছে। প্রদীপ চাহিয়া দেখিল,—এ কি, সুধী! প্রদীপ চমকিয়া উঠিল,সুধী যে দিব্যি হাটিতে পারিতেছে! সন্ন্যাসীদের এবার হইতে দেখা পাইলেই প্রদীপ পায়ের ধূলা মাথায় ঠেকাইবে; চোদ্দ ঘণ্টার মধ্যে একটা কঙ্কালের কাহিল চেহারা এমন বলশালী হইয়া উঠিল! সুধী দরজাটা। বাহির হইতে ভেজাইয়া দিয়া সিড়ির উপর দাঁড়াইয়া রিষ্ট-ওয়াচে সময় দেখিয়া লইল, যেন তাহাকে এখুনি ট্রেন ধরিতে হইবে। হঠাৎ প্রদীপের সঙ্গে চোখোচাখি হইতেই সুধী অল্প-একটু হাসিল—সেই পরিচিত নিৰ্ম্মল হাসি, কতদিন এই হাসি সে দেখে নাই—তারপর ডান-হাতটা একটু তুলিয়া স্পষ্ট কহিল,—“চললাম, কথা বলবার এখন আর সময় নেই।” বলিয়াই সিড়ি হইতে নামিবার জন্য পা বাড়াইল। প্রদীপ বলিতে চাহিল : এই রাত করে কোথায় যাচ্ছি, ঠাণ্ডা লাগবে যে। কিন্তু সুধী-কে আর দেখা গেল না,ঐ রাস্তা ধবিয়া চলিয়াছে!
প্রদীপ চোখ কচলাইয়া চীৎকার করিয়া উঠিল : “বাড়ির ভেতর থেকে কে বেরুল রে হরেন? দেখলি নে? মোটর নিয়ে ফের ষ্টেশনে চল। ও কি হেঁটেই যাবে নাকি?”
হরেন একটা লণ্ঠন জ্বালাইতে-আলাইতে কহিল,-“কে আবার গেল? পথের একটা কুকুর।”
ডাক্তারবাবু সিট-এ ঠেসান দিয়া তখনো ঝিমাইতেছেন; প্রদীপ তাহার হাত ধরিয়া এক ঝাঁকুনি দিয়া বলিয়া উঠিল : “আপনার ঘুমুবার জন্য খাট পেতে রেখেছি, উঠে আসুন দিকি।”
কথাটা ডাক্তারের কানে গেল না, কিন্তু ঝাঁকুনি খাইয়া উঠিয়া বসিলেন, এবং “এত রাতে জেগে থাকার অভ্যেস নেই” বলিয়া তাড়াতাড়ি গাড়ি হইতে নামিয়া পড়িলেন।
অতিনিঃশব্দপদে উঠান পার হইয়া প্রদীপ বারান্দাতে উঠিল। বারান্দার কিনারায় দুইটি অপরিচিত লোক চুপ করিয়া বসিয়াছিল, প্রদীপকে দেখিয়া তাহারা চঞ্চল হইল না পর্যন্ত; প্রদীপ-ও তাহাদের কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিল না, জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন-ও বোধ করিল না। এই গহন নীরবতা তাহার সকল উদ্বেগের উপশম করিয়াছে; সুধী এখন একটু ঘুমাইয়াছে বলিয়াই কেহ একটিও শব্দ করিতেছে না;-বাতি নিভাইয়া সবাই তাহার ক্লান্তিমুক্ত নব-জাগরণের প্রতীক্ষা করিতেছে। প্রদীপ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া ডাক্তারকে লক্ষ্য করিয়া বলিল,—“এই, বয়ে আসুন্। আলোটা একটু এদিকে, হরেন।”
চৌকাঠ ছাড়াইয়া ঘরে পা দিতেই প্রদীপ একেবারে বসিয়া পড়িল। যে-শোক প্রথম অভাবিত বিস্ময়ের আবেগে স্তব্ধ হইয়া ছিল তাহা আর সম্বরণ কব গেল না। প্রদীপ যেন মূর্তিমান ব্যর্থতাব মত আসিয়া দেখা দিযাছে,—নিরুদ্ধ শোক দিকে-দিকে অবারিত ও অজস্র হইয়া উঠিল! হরেন লণ্ঠনটা নামাইয়া রাখিয়া ছোট ছেলের মত কাদিয়া ফেলিল,—আর, প্রদীপ অঞলেশহীন শুষ্ক কঠোর চোখে সুধী-র মৃত্যু কলঙ্কিত মুখের দিকে চাহিয়া চোখের পলক আর ফেলিতে পারিল না।
ইঁদুরের মত নিঃশব্দে ডাক্তার সরিয়া পড়িতেছিলেন, অবনীবাবু স্বাভাবিক সংযতকণ্ঠে কহিলেন,—“অমন বোকার মতো কাঁদে না, হরেন। যা, ডাক্তারবাবুকে ষ্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আয় গে—চারটাচুয়ান্নতে একটা গাড়ি আছে। ভদ্রলোকের এতটা কষ্ট হ’ল। অমন হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকো না, প্রদীপ। ওঁর ভিজিটের টাকা দিয়ে দাও, এই নাও দেরাজের চাবি।”
ডাক্তারবাবু বারান্দায় আসিয়া কাহাকে বলিতেছিলেন,—“মফঃস্বলে আমরা সচরাচর বত্রিশ টাকা নিয়ে থাকি। কৰ্ত্তাকে বলবেন, ফেরুবার ভাড়াটা যেন সেকেণ্ড, ক্লাশের হয়।”
অবনীবাবু প্রদীপের হাতে তাহার দেরাজের চাবিটা গুঁজিয়া দিলেন বটে, কিন্তু প্রদীপ নড়িতে পারিতেছিল না। সে ব্যথিত হইবে না বিস্মিত হইবে, কঁদিবে না সান্ত্বনা দিবে, কিছুই বুঝিতে না পারিয়া হতচেতন হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এই পৃথিবী, যাহার বিপুল মানুষের নির্ধারণের নহে, সেই পৃথিবীর কোথাও সুধী-র চিহ্ন রহিল না,-এই প্রকাণ্ড আকাশ হইতে সুধী-র দিবাস্বপ্নগুলি বিলুপ্ত হইয়া গেল,—একাকী সুধী কত দূরপথে যাত্রা করিয়াছে, তিমিরগহন রুক্ষপথে অনির্ণীতের সন্ধানে—ভাবিতে-ভাবিতে কি করিবে কিছুই ঠিক করিতে না পারিয়া, পকেট হইতে বাক্স বাহির করিয়া সে সিগারেট ধরাইল।