সেই রাত্রি নমিতার আর কাটিতে চাহে না। একে একে বাড়ির সমস্ত বাতি নিভিয়া গেল, কিন্তু তাহার চোখে কিছুতেই ঘুম আসিল না। ঘুম না আসিলে সে দোতলার বারান্দার রেলিঙের কাছে চুপ করিয়া থাকে; কিন্তু আজ যে স্পন্দমান চঞ্চল হৃদয়কে ঘুম পাড়াইয়া সে উদাসীন হইয়া সীমান্যতার ধ্যান করিবে, তাহা অসম্ভব। প্রথমেই মনে পড়িল রাস্তার দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে চক্ষু দিয়া কিছুতেই সে আজ অজয়ের নাগাল পাইবে না। এই উপলব্ধি করিতেই নমিতা বারান্দায় দ্রুতপদে পাইচারি শুরু করিয়া দিল। সকলে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। পাশের বাড়িতে যে-ছাত্রটি রাত জাগিয়া নীরবে পড়া করে, তাহারা টেবিলের মোমবাতিটা নিভিল। সেই ঘনায়মান চতুঃপার্শ্বের নীরবতার মধ্যে নমিতা কি করিবে, কিছুরই কূল খুঁজিয়া পাইল না। খালি নিজের ডান-হাতখানি বারম্বার কপালের উপর রাখিয়া সে অজয়ের জ্বরের উত্তাপ অনুভব করিতেছে।
নমিতা খোলা চুলগুলি আঁট করিয়া খোপা বাঁধিল; পরণের কাপড়ের প্রান্তটাকে পায়ের দিকে আরো একটু প্রসারিত ও বুকের উপর আরো একটু রাশীকৃত করিয়া লইল। চাবির গোছাটা আঁচলের প্রান্ত হইতে খুলিয়া বালিশের তলায় রাখিল ও উত্তুরে হাওয়া জোরে বহিতেছে বলিয়া মা’র পায়ের দিকের জানালাটাও বন্ধ করিতে ভুলিল না। অন্ধকারে পথ ঠাহর করিতে নমিতার বেগ পাইতে হয় না, অতিনিঃশব্দপদে সে সিড়ির প্রথম ধাপে পা নামাইল। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের পাণ্ডুর চাদ যে অনেকক্ষণই বিবর্ণ বেদনায় মৃত্যুর প্রতীক্ষা। করিতেছে, তাহা সে জানিত; এখন সহসা সামনের ভাঙা দেয়ালের ফাঁকে হঠাৎ চাদ দেখিতে পাইয়া তাহার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন লাবণ্যে তরঙ্গিত হইয়া উঠিল। কিন্তু সিড়িতে একবার পা রাখিলে হয় ত’ মাধ্যাকর্ষণের শক্তিতেই নীচে নামিয়া আসিতে হয়। নমিতা শুধু নীচে নামিয়া আসিল না, একেবারে অজয়ের ঘরের বন্ধ দরজার কাছে আসিয়া অবতীর্ণ হইল।
এক মুহূর্তও দেরি হইল না। তর্ক করিতে চাও, নমিতা তাহাতে কান পাতিবে না। তাহার পক্ষ হইতেও নীতি-কথা বলা যায় বৈ কি। রুগ্ন পরনির্ভরকামীকে সেবা করা অধৰ্ম্ম? কিন্তু এত লোক থাকিতে তাহারই বা এমন কোন্ গরজ পড়িল? বচসা করিবার সময় নমিতার আর নাই, কাকিমার মেয়েটার চেঁচাইয়া উঠিবার সময় হইয়াছে।
এক ঠেলা মারিয়া নমিতা বন্ধ দরজা খুলিয়া ফেলিল। যাহা দেখিল, তাহাতে প্রথমে সে কি করিবে বুঝিয়া উঠিতে পারিল না। সে যে কেন অকারণে দেরি করিতেছিল তাহার জন্য সে শতরসনায় নিজেকে ধিকার দিতে লাগিল। দেখিল, সেই শতছিন্ন তোষকটার উপর উবু হইয়া ঝুঁ কিয়া পড়িয়া অজয় গোঙাইতেছে; কবে কি-সব ছাই-ভস্ম গলাধঃকরণ করিয়াছিল, তাহাই বমি করিয়া মেঝেটাকে ভাসাইয়া দিয়াছে। বমির বেগ এখনো প্রশমিত হয় নাই, অন্ধকারেও অজয়ের রোগবিকৃত বীভৎস মুখের ছায়া চোখে পড়িল। নমিতা তাড়াতাড়ি অজয়ের পাশে বসিয়া পড়িয়া তাহার মুখটা দুই হাতের অঞ্জলিতে ভরিয়া। একেবারে তাহার কোলের উপর তুলিয়া পাঞ্জাবির তলায় পিঠের উপর অল্প একটুখানি হাত রাখিয়া দেখিল, জ্বরে অজয় দগ্ধ হইতেছে। কপালের সমুখের যে-চুলগুলি লুটাইয়া পড়িতেছে, তাহা মাথার উপর ধীরে তুলিয়া দিয়া, নিজের আঁচল দিয়া অজয়ের শুনো ঠোঁট দুইটা মুছিয়া দিল। মুহূর্তে যে কি হইয়া গেল জ্বরের ঘোরে মোহাচ্ছন্ন অজয় আনুপূর্বিক কিছুই ধারণা করিতে পারিল না। অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় শুক্লবাসা একটি মেয়েকে তাহার পার্শ্বচারিণীরূপে ভালো করিয়া তখনো চিনিতে না পারলেও, আজ রাত্রেই যে তাহার আসিবার কথা ও এমন করিয়া যে তাহার এই পীড়িত দেহটাকে বুকে টানিয়া নিবার একটা অলৌকিক চুক্তি ছিল, তাহা সে নিমেষে ঠিক করিয়া ফেলল। জড়িতস্বরে সে কহিল,-“শিগগির আমাকে একটু জল এনে দাও, আমার গলা-জিত শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল যে।”
নমিতা অজয়ের মাথাটা ধীরে ধীরে নামাইয়া বাহির হইয়া আসিল। দেয়ালের প্রতিটি ইট ও মেঝের প্রতিটি ধূলিকণা যে তাহাকে নিরীক্ষণ করিতেছে সে বিষয়ে তাহার খেয়াল রহিল না। রান্নাঘরের দরজার শিকল নামাইয়া সে গ্লাসে করিয়া কলসী হইতে জল গড়াইয়া লইল ও বাঁ-হাতে এক বালতি জল লইয়া আবার ঘরে ঢুকিল। বালতিটা দুয়ারের কাছে নামাইয়া তাড়াতাড়ি জলের গ্লাসটা অজয়ের কাছে আনিয়া ধরিল। কহিল,—“আমার হাতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠন, জলটা খেয়ে নিন।”
এইবার নমিতাকে অজয় ভালো করিয়া চিনিয়াছে। পিপাসা তাহার সত্যই পাইয়াছে বলিয়া মনে হইল না। তবু পরিপূর্ণ নির্ভর করিয়া নমিতার অকুষ্ঠিত বাম-বাহুটি অবলম্বন করিয়া সে উঠিল। ঢাকৃ-ঢক্ করিয়া সমস্তটা জল খাইয়া ফেলিয়া সে ধুপ করিয়া শুইয়া পড়িল। নিজেই নমিতার আঁচলের প্রান্তটা টানিয়া লইয়া মুখ মুছিল। বলিল,-“আজ সমস্ত স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল একসঙ্গে ষড়যন্ত্র করেও তোমাকে আমার কাছ থেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারত না। আমার প্রয়োজনের দাবি এত প্রচুর ছিল যে, কোনো প্রাচীরই আর তোমাকে বন্দী রাখতে পাল না, নমিতা। কিন্তু আমার প্রয়োজন যে কি অসামান্য, তা তুমি জান?” বলিয়া অজয় নমিতার একখানা হাত চাপিয়া ধরিল।
নমিতা হাত সরাইয়া নিবার স্বল্প চেষ্টা করিয়া বলিল,-“ছাড়ন, ঘরটা পরিষ্কার করে ফেলি। দেশলাই নেই? আলো জ্বালতে হবে।”
—“না না, আলো জ্বালিয়ে কাজ নেই, নমিতা। আলোতে তোমাকে সম্পূর্ণ করে দেখা হবে না। তোমাকে কি এই বেশ মানায়? আমি মনে মনে তোমার যে মূর্তি এঁকেছি, আলো জ্বেলে তাকে কলঙ্কিত কোরো না।” বার কয়েক ঘনঘন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া অজয় কহিল,—“তোেমার পরনে রক্ত-চেলি, চোখে ক্ষুধা, হাতে কৃপাণচুলগুলি পিঠের উপর আলুলিত হয়ে পড়েছে রুক্ষ সুনিবিড় চুল! বজে তোমার কঙ্কণ, বিদ্যুৎ তোমার কণ্ঠহার! তুমি আমার সঙ্গে যাবে, নমিতা?”
নমিতা ব্যস্ত হইয়া বলিল,-“উত্তেজিত হবেন না। চুপ করে’ ঘুমুবার চেষ্টা করুন, আমি আপনার মাথায় জলপটি দিচ্ছি।”
তাড়াতাড়ি পাশে বসিয়া বালতির জলে ন্যাড়ার অভাবে নিজের আঁচলটাই ভিজাইয়া লইল। কপালের উপর তাহাই স্তুপীকৃত করিয়া রাখিয়া, পাখার অভাবে সামনের দেওয়াল হইতে একটা ক্যালেণ্ডার পাড়িয়া লইয়া ধীরে ধীরে হাওয়া করিতে লাগিল। কহিল, “দেশলাই থাকূলে আলোটা জ্বালাতুম।”
অজয় কহিল,—“আলো জ্বালালেই তোমার আজকের রাতের এই কীর্তিটা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না। তোমার কাকিমার কাছ থেকে দেশলাই চেয়ে আনতে পারবে?” বলিয়া অজয় সেই জ্বরের মধ্যেই ভূতের মত হাসিয়া উঠিল। নমিতার পা-দুইটি তক্তপোষের উপর যেখানে গুটাইয়া রহিয়াছে, তাহার অদুর ব্যবধানে নিজের একটা শিথিল হাত রাখিয়া আস্তে একটা আঙুল বাড়াইয়া দিয়া নমিতার পা এমন আলগোছে একটু ছুইল যে, তাহা টের পাইবার সাধ্য নাই। কহিল, “উত্তেজিত আমি হইনি, নমিতা। যেটুকু চাঞ্চল্য আজ তুমি আমার দেখছ, সেটা আমার জ্বরের বিকার নয়। ওটা আমার স্নায়ুমণ্ডলীর স্বাভাবিক বৃত্তি মাত্র। আমার কথার উত্তর দেবে, নমিতা?”
নমিতাও কপালের গণ্ডী ছাড়াইয়া হাতখানি অজয়ের গালের উপর ভুলক্রমে আনিয়া ফেলিয়াছে। অস্ফুটস্বরে কহিল,—“কি?”
দৃঢ় স্পষ্ট অনুত্তেজিতকণ্ঠে অজিত কহিল,—“তুমি আমার সঙ্গে যাবে?”
নমিতার স্বর ভীত, বিমূঢ় : “কোথায়?”
আবার সেই শীতল স্পষ্ট স্বর : “মরুতে। ময়ূতে তোমার ভয় হয়, নমিতা?”
নমিতা চঞ্চল হইয়া উঠিল : “কি বলছেন আপনি যা-তা? বলছি ঘুমুন, তা না খালি বক্ বক্ করছেন!”
অজয় শান্ত, উদাস-স্বরে বলিল,-“তুমিও যে মরতে ভয় পাও না, তা আমার ঘরে তোমার এই আকস্মিক আবির্ভাবেই আমি বুঝেছি। তা হলে চল আজকের এই রাত্রি শেষ না হতেই একটা গাড়ি ডেকে আমরা বেরিয়ে পড়ি। আমি তোমার খুব বেশি ভার হ’ব না, দেখবে। কাল ভোরেই আবার আমি চাঙ্গা হয়ে উঠব। শুয়ে শুয়ে এই সব বাবুগিরি কি আমাদের পোষায়?”
নমিতা আরো জোরে ক্যালেণ্ডারটা চালাইতে লাগিল, অজয়েব গায়ের চাদরটা আরো ঘন করিয়া টানিয়া দিল; বলিল,—“আপনি এমনি বক বক করুলে আমি চলে যাব ঘর ছেড়ে।”
অজয় কহিল,—“সত্যিই গায়ে চাদর টেনে পাখার হাওয়া খেয়ে জ্বরের ঘোরে এপাশ ওপাশ করবার বিলাসিতা আমার নয়, নমিতা। আমি মরবার পণ করে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছি। রোগে ছাতা ধরে’ দেহ জার্ণ হোক, তবু রোগের হাতে জীবন সমর্পণ করে মৃত্যুকে কলঙ্কিত করব না। তুমি যে-জীবন বহন করছ তা ত’ একটা কলঙ্কিত মৃত্যু, অসতীত্বের চেয়েও লজ্জাকর। সত্যি করে মরে গৌরবান্বিত হতে তোমার ইচ্ছা করে না, নমিতা?” কি ভাবিয়া লইবার জন্য অজয় একটু থামিল, পরে হঠাৎ বিছানার উপর উঠিয়া বসিয়া গা হইতে চাদর সরাইয়া ফেলিল। নমিতার স্তম্ভিত ভাবটা কাটিবার আগেই তক্তপোষের প্রান্তে সরিয়া আসিয়া জুতার জন্য সেই নোংরা মেঝের উপর পা বাড়াইয়া দিল; কহিল,—“তুমি এমনি চুপ করে এখানে বসে থাক। তুমি আমার সঙ্গে যাবে—এই আনন্দে আমি রাস্তায় বেরিয়ে যে করে থোক একটা গাড়ি ধরে আনতে পারবই
অজয়ের আর জুতা পরিবার সময় হইল না। নমিতা ভয় পাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, তাহার পা দুইটা সহসা অবশ হইয়া আসিল বুঝি। দীপ্তকণ্ঠে কহিল,—“আপনি পাগল হয়ে গেলেন নাকি? কোথায় যাব আপনার সঙ্গে?”
অজয় আবার সেই নির্লিপ্ত উদাসীন কণ্ঠে কহিল,—“পাগল আমরা সত্যিই। হঠকারিতাকে আর যারা নিশে করুক, আমরা করিনে। ভেবে-চিন্তে কাজ করতে গেলে সময়ই ফুরোয়, কাজ আর এগোয় না। তুমি কি সত্যিই এই অন্ধকূপের অন্তরালে স্বল্প-পরিমিত জীবন নিয়ে তৃপ্ত থাকতে পারবে? নিশান্তে দুটি ভাত খেয়ে ও দিনান্তে দুঘণ্টা ঘুমিয়েই কি তুমি জীবনকে এমন অনায়াসে ক্ষয় করে ফেলবে? তোমার জীবনের ওপর তোমার একার দায়িত্ব নেই, আমাদেরো ‘লোভ আছে। তুমি একা, সংসারে কারো কাছে তোমার এতটুকু ধার নেই—তোমার কত সুবিধে। তুমি একবার হ্যাঁ বল, দেখবে আমার সমস্ত জ্বর নেমে গেছে। নোংরা মেঝে সাফ অন্যে করলে ক্ষতি হবে না, অনেক বড়ো ও অনেক দুঃখময় কলঙ্ক তোমার নির্মল হাতের স্পর্শে শুচিস্নিগ্ধ হ’বার জন্যে অপেক্ষা করছে। নমিতা,—তুমি এস আমার সঙ্গে বলিয়া অসহায় শিশুর মত অজয় নমিতার দুই হাত ব্যাকুলভাবে চাপিয়া ধরিল।
নমিতা কি ভাবিল কে জানে, সহসা হাত ছাড়াইয়া লইয়া কর্কশস্বরে কহিল,—“আপনি আমাকে কী ভাবেন? আপনার অসুখ দেখে আমি ভালো ভেবে আপনার সেবা কবুতে এলুম, আর আপনি তার এই প্রতিদান দিচ্ছেন? ছি! আপনি যে এত খারাপ তা আমি ভাবিনি।” বলিয়া নমিতা আঁচলে চোখ ঢাকিয়া ফেলিল।
এই কাণ্ড দেখিয়া অজয় প্রথমে একেবারে নিস্পন্দ অসাড় হইয়া গেল, তাহার শরীরে কণামাত্রও আর শক্তি রহিল না। সে যেন একটা পৰ্বতচূড়া আরোহণ করিতে গিয়া একেবারে সমুদ্রের তলায় আসিয়া ডুবিয়াছে। তাড়াতাড়ি বিছানার উপর শুইয়া পড়িয়া যেন ঘূর্ণমান পৃথিবীর প্রান্ত হইতে ছিটুকাইয়া পড়িবার ভয় হইতে সে আত্মরক্ষা করিল। দুই হাত দিয়া মাথার লম্বা চুলগুলি আঁড়াইয়া ধরিয়া সে কান্না রোধ করিল হয় ত’—সে কি না ক্ষীণজীবিনী কোমলকায় বাঙালি মেয়ের মাঝে আকাশের বিদ্যুদ্বতী বাত্যার মূর্তি দেখিতে চাহিয়াছিল। চাপা স্বরে গোঙাইয়া কহিল,—“আমর সত্যিই ভুল হয়েছে, নমিতা, আমাকে ক্ষমা কর। আমি জ্বরের ঘোরে প্রলাপই বকছিলুম হয় ত’। এখন তুমি স্বচ্ছন্দে বাতি জ্বলতে পার, হাত বাড়ালেই তাকের ওপর দেশলাই পাবে। অন্ধকারে আর তোমাকে দেখবার প্রয়োজন নেই।”
বাতি না জ্বালাইয়াই নমিতাকে চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতে দেখিয়া অজয় কহিয়া উঠিল: “একটা কথা স্পষ্ট করে জেনে যাও। তোমার দেহের উপর আমার লোভ ছিল, এ-কথা ঘুণাক্ষরে মনে কোরো না—লোভ ছিল তোমার এই জীবনের ওপর। আমরা যে মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছি তাতে তোমার জীবনকে আহুতিরূপে কামনা করেছিলুম মাত্র। তেমন মরা মরতে পারলে মানুষ হতে পারতে, নমিতা।”
এতটা পা বাড়াইয়া আবার ফিরিয়া যাওয়াটা শোভন হইত না, তা ছাড়া দুইটা দরজার ফাঁক দিয়া ঘরের বাহিরে অন্ধকারে কাহাকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া নমিতার আর নিশ্বাস পড়িল না। ভালো করিয়া চাহিয়া দেখিল, কাকিমা কোলে খুকি। নমিতা ভাবিয়াছিল আজ হয় ত’ খুকি স্বভাবের ব্যতিক্রম করিয়া তাহাকে মুক্তি দিয়াছে। কিন্তু কাকিমার নীচে আসিবার আগে রঙ্গমঞ্চের নেপথ্যে কত যে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটিয়া গেছে, তাহার ইঙ্গিত স্পষ্ট হইয়া উঠিল। তাহার এই আচরণে যেন কিছুই অস্বাভাবিকতা নাই; কণ্ঠস্বর তেমনি সহজ করিয়া নমিতা কহিল,—“অজয় বাবুর জ্বর খুব বেড়ে গেছে, কাকিমা। ডাক্তার ডেকে পাঠানো উচিত।”
এই সব কথার চালাকি করিয়া কাকিমাকে ঠকানো যাইবে না। তিনি ভেঙচাইয়া বলিয়া উঠিলেন,—“অজয় বাবু বুঝি তোমাকে বিনাতারে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল যে লোকলজ্জার মাথা খেয়ে দরজা বন্ধ করে তুমি তার জ্বর নামাচ্ছ?” হঠাৎ তারস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিলেন: “ও দিদি! দেখে যাও তোমার মেয়ের কীর্তি! সামনেই অঘ্রান মাস, নতুন করে মেয়ে-জামাই ঘরে তোলো!”
দরজার বাহিরেই এমন একটা বীভৎস রসের অভিনয় শুনিয়া অজয় বিছানায় আর স্থির থাকিতে পারিল না। টলিতে টলিতে বাহির হইয়া আসিল। কোন রকমে দেওয়ালে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া • কহিল, “রাত-দুপুরে হঠাৎ চেঁচামেচি শুরু করলে কেন? কী এমন কাণ্ড ঘটেছে?”
অজয়ের শরীরের এই অবস্থা দেখিয়া কমলমণির গলায় মন্দা পড়িল না: “এই আমাদের অজয় বাবুর অসুখ! রাত্রিবেলা ক’দিন থেকে এই অসুখ চলছে শুনি?”
এমন সময় উপর হইতে নমিতার মা একটা লণ্ঠন হাতে করিয়া নামিয়া আসিলেন। তাহাকে দেখিয়াই নমিতা তাহাকে দুই বাহু দ্বারা বেষ্টন করিয়া একেবারে অবোধ আত্মহারার মত কাঁদিয়া উঠিল। মেয়েকে তাড়াতাড়ি আড়াল করিয়া দাঁড়াইয়া তিনি কহিলেন,—“কি, কি হ’ল?”
হাত ও মুখের একটা কুৎসিত ভঙ্গি করিয়া কমলমণি কহিলেন, “কি আবার হবে। রাত্রে তোমার মেয়ে অভিসারে বেরিয়েছিলেন! আর ভয় নেই দিদি, মেয়ে তোমার খুব ভালো রোজকারের পথ পেয়েছে।”
নমিতা ফুপাইয়া উঠিল, কিন্তু এই অন্যায় ও কদৰ্য্য কথা শুনিয়া। অজয় আর স্থির থাকিতে পারিল না। আর্তস্বরে কহিল,—“মুখে যা আসে তাই বোলো না, দিদি। নমিতা কেন নীচে এসেছিল জানি না, কিন্তু আমার বমি করবার আওয়াজ শুনেই ঘরে ঢুকেছিল! রোগীর প্রতি ওর এই করুণার এমন কদৰ্য অর্থ কর ত’ ভালো হবে না।”
“কি ভালো হবে না শুনি?” কমলমণি খেকাইয়া উঠিলেন : “আর রাতের পর রাত এই ঢলাঢলিই খুব ভালো, না? পরের বাড়ি বসে এই সব কেলেঙ্কারি চলবে না, অজয়। আমি বাবাকে লিখে দিচ্ছি, তোমার মতন বাদরকে আমি পুষতে পারবো না।” ক্রন্দনরতা মেয়েটার গালে সবেগে এক চিমটি মারিয়া ফের জা-কে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন,—“আর তোমাকেও বলছি দিদি, এই ধুমসো মেয়ে নিয়ে আর কোথাও গিয়ে পথ দেখ। এইখেনে থেকে আর আত্মীয়-স্বজনের মুখ হাসিয়ো না।”
“নমিতা!” অজয়ের ডাক শুনিয়া নমিতা মায়ের বুকের মধ্যে থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। “তুমি তবু এই মিথ্যাচার এই পাপের মধ্যে বেঁচে থাকবে? সব ছেড়ে-ছুঁড়ে এস আমার সঙ্গে।” বলিয়া
হঠাৎ দুর্নিবার আবেগে অজয় হয় ত’ এক-পা আগাইয়া আসিতে চাহিল। সামনেই সিড়ি। টাল সামলাইতে না পারিয়া একেবারে হুড়ি খাইয়া পড়িয়া গেল। লণ্ঠনের অস্পষ্ট আলোতে বেশ বুঝা গেল, কপালের সামনেটা ফাটিয়া গিয়া গল্গল করিয়া রক্ত বাহির হইতেছে। সবাই এক সঙ্গে চীৎকার করিয়া উঠিল। কমলমণি গিরিশ বাবুকে খবর দিতে উপরে ছুটিলেন। গিরিশ বাবু যখন নামিয়া আসিলেন, তখনো অজয়ের জ্ঞান হয় নাই। নমিতার মা’র কোলে মাথা রাখিয়া। সে শুইয়া আছে—আর নমিতা দূরে একেবারে পাথরের মূর্তির মত নিস্পন্দ হইয়া রহিয়াছে।
গিরিশ বাবু আসিয়াই হাঁক দিলেন : “এ-সব কি কাণ্ড বৌদি! তুমিও এসে এই অনাছিষ্টি ব্যাপারে হাত দেবে ভাবিনি। রাখ, রাখ, রক্ত বন্ধ হয়েছে ত’? শুইয়ে দাও বিছানায়।” বলিয়া চাকরকে উঠাইয়া ধরাধরি করিয়া অজয়কে তাহার বিছানায় আনিয়া ফেলিলেন। নমিতা তখনো মূঢ়ের মত দ্বারপ্রান্তে দাঁড়াইয়া ছিল। গিরিশ বাবু তাহাকে দেখিতে পাইয়াই ধমক দিয়া উঠিলেন: “তুই আর এখানে মরতে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা এখান থেকে।”
গিরিশ বাবু পেছন হইতে দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। নমিতার কানে তখনো যেন অজয়ের করুণ গোঙানি লাগিয়া আছে, তবু তাহাকে উপরেই যাইতে হইল। আর বারান্দায় নয়, একেবারে মেঝের উপর লুটাইয়া পড়িল। মা উপরে আসিলে নমিতা একবার চোখ চাহিয়াছিল হয় ত’; মা ঘৃণার সঙ্গে বলিলেন,—“আমাকে আর তুই চুসনে পোড়ামুখি! তোর কপালে কেরোসিন তেল জুটল না? এর আগে ছাত থেকে লাফিয়ে পড়তেও ত’ পারতিস হতভাগী।” বলিয়াই মা পাগলের মত তাহার কপালটা বারে বারে ঘরের দেয়ালে ঠুকিতে লাগিলেন।
পরদিন ভোর হইতেই গিরিশ বাবু দরজার গোড়ায় আসিয়া হাকিলেন: “বৌদি!”
নমিতা সমস্ত রাত্রি আর ঘুমাইতে পারে নাই। কাকার ডাক শুনিয়া মাকে জাগাইয়া দরজা খুলিয়া দিল। নমিতার কুষ্ঠিত মুখে কাছে আসিয়া দাঁড়াইতেই গিরিশ বাবু কহিলেন,—“তোমার মেয়েকে আমার বাড়িতে আর রাখা চল্বে না, বৌঠান। ওর শ্বশুর ত’ এখেনেই আছে, একটা চিঠি লিখে দি, নিয়ে যাক্। অজয়টাকেও আজ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলুম।”
নমিতার মা না বলিয়া পারিলেন না: “এত জ্বরের মধ্যে!”
গিরিশ বাবু একটা ট্রাঙ্কের উপর জায়গা করিয়া বসিলেন, বলিলেন, —“আজ যদি না যায়, সেবা করতে তোমার মেয়েকে ত’ আর সেখানে পাঠানো চলবে না।” বলিয়া নমিতার দিকে একটা ব-দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন।
নমিতা অনেক সহ করিয়াছে, কিন্তু এইবার তাহার দেহের সমস্ত শিরা-উপশিরা এক সঙ্গে মোচড় দিয়া উঠিল। সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া কহিল,—“একজন পরিত্যক্ত রুগীর পরিচর্যা করার মধ্যে আপনারা যতই কেন না পাপ খুঁজে বেড়ান কাকাবাবু, যিনি মানুষের অন্তর পৰ্যন্ত তন্নতন্ন করে দেখছেন, তিনি কিন্তু ক্ষুন্ন হন্ নি।” বলিতে বলিতেই তাহার দুই চক্ষু বাহিয়া জল নামিয়া আসিল।
গিরিশ বাবুকে কোন কথা কহিতে না দিয়াই নমিতার মা কহিলেন,—“চুপ কর বছি। তাই ভাল, ঠাকুরপো, বেয়াইকে খবর দাও। ওখেনেই গিয়ে থাকুক্ কয়েকদিন।”
নমিতা আবার শক্ত হইল। কহিল,—“কেন আমি ওখানে গিয়ে থাববা? আমি কি করেছি? ওটা কি আমার নির্বাসন নাকি?”
গিরিশ বাবু দাঁত খি’চাইলেন : “তবে ঐ গুণ্ডাটার গলা ধরে’ বেরিয়ে পড়লেই ত’ পারতিস।”
মাও কাকার কথার সুরে সায় দিলেন : “শ্বশুর বাড়ি না যাবি ত’ যমের বাড়ি যাস।”
নমিতা গোঁ ধরিয়া বসিল : “এমন একটা কাণ্ড’ আমি অবশ্য করিনি যাতে রাতারাতি তোমাদের ঘর-সংসার একেবারে উলটে ছত্রখান হয়ে গেল। আমি শুধু শুধু সেখানে যাবো কেন?”
পাশের ঘর হইতে কমলমণি ছুটিয়া আসিলেন,—“বসে বসে কে তোমাকে এখানে গেলাবে শুনি? মদ্দরও ত’ বেহদ্দ হয়েছ—এবার রোজকার করে’ পয়সা আন, নিজেরটা নিজে জোগাড় কর এবার থেকে। বাবাঃ, কী গলগ্রহই যে জুটেছে।”
নমিতা আর কথা না কহিয়া বারান্দায় চলিয়া আসিল। এত বড় পৃথিবীতে কোথাও একটুও বদল হয় নাই, রাস্তার ধূলার উপরে তেমনিই রোদের গুড়া পড়িয়াছে। সকাল হইতেই যে কুঠে বুড়োটা বহুলোচ্চারিত ঈশ্বরের নামটাকে একটা বিকৃত-ধ্বনিতে পর্যবসিত করিয়া ফেলিয়াছে, সে লাঠি ভর করিয়া গলির মোড়ে আসিয়া বসিল। কিন্তু কালকের রাত পোহাইতেই নমিতা যেন এক নব-প্রভাতের তীরে আসিয়া উত্তীর্ণ হইয়াছে। হয় ত’ এখন অজয় আরেকবার ডাকিলে সে বাহির হইয়া পড়িতে পারিত। কোথায় যাইত তাহা সে জানে না, কিন্তু এমন করিয়া মরিতে হয় ত’ নয়।
রেলিঙে ঝুঁকিয়া খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিতেই তাহার নজর পড়িল একটা ছ্যাড়া গাড়ি এক-রাজ্যের মাল-বোঝাই হইয়া গলি পার হইতেছে। গাড়ির ভিতরে নজর পড়িতেই বাহির হইয়া পড়া দূরের কথা, নমিতার নিশ্বাস পর্যন্ত বন্ধ হইয়া আসিল। পেছনের সিটুটাতে হেলান দিয়া অজয় অতি কষ্টে সামনের জায়গাটায় পা দুইটা ছড়াইয়া শুইবার মতন করিয়া বসিয়া আছে—মাথায় তাহার ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। দেখিয়া নমিতা সম্বিৎ হারাইল কিনা কে জানে, সে সহসা হাতছানি দিয়া গাড়োয়ানকে থামিবার জন্য সঙ্কেত করিল। গাড়োয়ান তাহা লক্ষ্য করিল না, ভিতরে যে-ব্যক্তি যন্ত্রণায় মুহমান হইয়া পড়িয়াছিল, এই ইঙ্গিতটি তাহারও অগোচর রহিয়া গেল।
গাড়ি অবশ্য অজয় থামাইত না। গাড়ি মোড় পার হইয়া গেলে সে একবার পেছনে বাড়িটা দেখিবার জন্য মুখ বাড়াইল—যাহাকে দেখা গেল না, তাহাকে উদ্দেশ করিয়া মনে মনে বলিতে লাগিল : আমার সঙ্গে না এসে ভালোই করেছ, নমিতা। একদিন যাতে নিজেরই পায়ের জোরে পথের ওপর নেমে আসতে পার, তোমার ওপর ততটা লাঞ্ছনা হোক। আমি সুখী হ’ব।