নমিতা তাহার কাকার কাছে কলিকাতায় চলিয়া আসিল।
নবীন কুণ্ডুর লেনে ছোট একখানা দোতলা বাড়িতে নমিতার কাকা গিরিশবাবু তখন প্রকাণ্ড একটা সংসারের ভার কাঁধে লইয়া হাঁপাইয়া উঠিয়াছেন। নিজের কাচ্চাবাচ্চা লইয়াই তিনি এই ঘোট বাড়িতে কুলাইতে পারিতেছিলেন না, হঠাৎ বৌঠান ও তাহার ঘোট মেয়েটি নিরাশ্রয় অবস্থায় ভাসিয়া আসিল। গিরিশবাবুর এক শ্যালক অজয়, পাটনা হইতে বি-এ পাশ করিয়া কলিকাতায় ল’ পড়িতে আসিয়াছে; পাটনা তাহার ভাল লাগে না বলিয়া আইন-পাঠে বেশি এক বৎসর অযথা নষ্ট করিলেও তাহার কিছু আসিয়া যাইবে না। অজয় প্রথমে একটা মেসে গিয়াই উঠিয়াছিল, কিন্তু একদিন ডালের বাটিতে আরশুলা মরিয়া আছে দেখিতে পাইয়া, বিদ্যাসাগরের দৃষ্টান্ত অনুসরণ না করিয়াই সেই যে দিদির বাড়িতে চড়াও হইয়াছে, আর তাহার গাত্রোত্থান করিবার নাম নাই। নীচের একটা অপরিসর অপরিচ্ছন্ন ঘরে একটা তক্তপোষ টানিয়া অজয় চুপ করিয়া অবরুদ্ধ বন্দী গলিটার দিকে চাহিয়া থাকে, আর আইন-পাঠের নাম করিয়া যে-সব বই অধ্যয়ন করে, তাহারা আইনের চোখে মার্জনীয় কি না কে বলিবে।
এমন সময় সিঁথির সিঁদুর মুছিয়া আবার নমিতা আসিল। এইবার গিরিশবাবু চক্ষে অন্ধকার দেখিলেন। অবশ্য তাহার দাদা মৃত হরিশবাবু যত টাকা রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার স্ত্রী ও নাবালিকা কন্যাটির সুখে-স্বচ্ছন্দেই দিন যাইতে পারি, কিন্তু তাহাতে নমিতার জীবিকানির্বাহের খরচটা ধরা ছিল না। নাবালিকা কন্যাটিকে অবাঞ্ছিত মার্জার-শিশুর মত অন্যত্র পার করিয়া দিবার জন্য গিরিশবাবু তোড়জোড় করিতেছিলেন ও শোকবিধুরা ভ্রাতৃজায় হৃদরোগে আক্রান্ত হইয়া অদূর ভবিষ্যতে মহাপ্রয়াণ করিয়া, বাকি টাকাগুাল দেবরের হস্তেই সমর্পণ করিবেন বলিয়া তাহাকে নীরবে আশ্বাস দিতেছিলেন, এমন সময়ে অপ্রার্থিত অশুভ আশঙ্কা লইয়া নমিতার আবির্ভাব হইল। গিরিশবাবু দাঁতে দাঁত চাপিয়া একটা অব্যক্ত অভিশাপ আওড়াইলেন; তাহার স্ত্রী কমলমণি মুখোনাকে হাঁড়ি করিয়া রহিল।
চারিপাশে এতগুলি বান্ধব লইয়াও নমিতার একাকীত্ব তবু ঘুচিতে চায় না। সূর্যোদয়ের আগে উঠিয়া সে মধ্য রাত্রি পর্যন্ত ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করিয়া চলে—তবু তৃপ্তি পায় না। এত কৰ্ম্মবাহুল্যের মধ্যেও সে তাহার অন্তরের নির্জনতাকে ভরিয়া তুলিতে পারিল না, তাই রাত্রে সকলে ঘুমাইয়া পড়িলে, সে ধীরে ধীরে গলির ধারের সরু বারান্দাটিতে আসিয়া বসে। কি যে ভাবে, বা কি যে সে ভাবিতে পারিলে শান্তি পাইত তাহা খুজিতে গিয়া সে বারে বারে হাঁপাইয়া উঠে, তবু রাত্রির সেই নিস্তব্ধ গভীর স্পর্শ হইতে নিজেকে সরাইয়া নিতে তাহার ইচ্ছা হয় না, চুপ করিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়া থাকে, কখনন সেইখানেই মেঝের উপর ঘুমাইয়া পড়ে। মা টের পাইয়া তিরস্কার করিলেই নমিতা ধীরে-ধীরে বিছানায় আসিয়া শোয়, কিন্তু চোখ ভরিয়া ঘুমাইতে পারে না। উহার হাতের সমস্ত কাজ যেন এক নিশ্বাসে ফুরাইয়া গেছে। হয়তো উহাকে অনেক দিন বাঁচিতে হইবে, কিন্তু এমনি করিয়াই চিরকাল পরপ্রত্যাশিনী হইয়া: নতনেত্রে লাঞ্জনা সহিয়াসহিয়া জীবনধারণের লজ্জা বহন করিবে ভাবিতে তাহার ভয় করিতে থাকে। কিন্তু ইহা ছাড়া আর পথই বা কোথায়? এক জনের মৃত্যুতে আরেকজনকে অযথা এমনি জীবন্মত থাকিতে হইবে, এমন একটা রীতির মাঝে কোথায় কল্যাণকরতা আছে, তাহা নমিতা তাহার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে ধরিতে পারি না। কিন্তু এই পঙ্গুতা বা বন্ধ্যাত্ব হইতে উদ্ধার পাইবারও যে কোনো উপায় নাই, সে সম্বন্ধেও সে স্থিরনিশ্চয় ছিল। তাহার এই বেদনাময় ঔদাসীন্য বা বৈরাগ্যভাবটি যে তাহার স্বামী-বিরহেরই একটা উজ্জ্বল অভিব্যক্তি, এই বিশ্বাস এই সংসাবের সকলেব মনে বদ্ধমূল আছে। বলিয়া নমিতা স্বস্তি পাইত বটে, কিন্তু তাহার এই অপরিমেয় দুঃখ যেন উপযুক্ত মৰ্য্যাদা লাভ কবিত না। কোনো ব্যক্তিবিশেষ হইতে সম্পর্কচ্যুত হইয়াছে বলিয়াই যদি সে তপশ্চাবিণী হইতে পারিত, তাহা হইলে তাহার তৃপ্তির অবধি থাকিত না, কিন্তু এই নামহীন অকারণ দুঃখ তাহাকে কেন যে বহন করিতে হইবে, মনে-মনে তাহার একটা বোধগম্য মীমাংসা করিতে গিয়াই সে আর কূল পায় না।
সেদিন ববিবার, দুপুর বেলা; তাহার ছোট বোন সুমিতা একখানা, বই তাহার কোলে ফেলিয়া হঠাৎ ছুটিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল,-ইখানি তুলিয়া দেখিল, আয়ল্য কত দীর্ঘ বৎসর ধরিয়া সংগ্রাম করিয়া স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছে, তাহারই বাঙলা ইতিহাস। এই বই সুমিতা কোথা থেকে পাইল মনে-মনে তাহারই একটা দিশা খুঁজিতেছে, হঠাৎ সেইখানে গিরিশবাবু আসিয়া হাজির হইলেন এবং নমিতাকে বই পড়িতে দেখিয়া কাছে আসিয়া ঝুঁকিয়া কহিলেন,—“কি পড়ছিস ওটা?”
নমিতা সঙ্কুচিত হইয়া বইটা কাকাবাবুর হাতে তুলিয়া দিল।
গিরিশবাবু বইটার নাম দেখিয়া অর্থ হয়তো সম্যক উপলব্ধি করিতে চাহিলেন না, রাগিয়া কহিলেন,—“বাঙলা উপন্যাস পড়া হচ্ছে কেন?”
বইটা বাঙলা না হইয়া ইংরাজি হইলেই হয়তো তাহার জাত যাইত; কিন্তু ইংরাজি নমিতা তেমন ভাল করিয়া জানে না, এ-জন্মে শিখিবার সাধ তাহার খুব ভালো করিয়াই মিটিয়াছে। নমিতা গিরিশবাবুর কথার কোনো উত্তর দিল না, বইটা যে উপন্যাস নয়, সেটুকু মুখ ফুটিয়া বলা পর্যন্ত কাছে অবিনয় মনে হইল, নিতান্ত অপরাধীর মত হেঁট হইয়া সে বসিয়া রহিল।
গিরিশবাবু পুনরায় কহিলেন,—“এ-সব বাজে বই না পড়ে’ গীতা মুখস্ত কবি, বুঝলি?”
নমিতা সুশীলা ছাত্রীর মত ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল, একবার মুখ ফুটিয়া বলিতে পৰ্যন্ত সাহস হইল না যে, গীতার বাংলা অনুবাদ পৰ্যন্ত সে বুঝিবে না। যেহেতু সে বিধবা, তাহাকে গীতা পড়িতে হইবে, কবিতা বা উপন্যাস পড়িলে তাহার ব্রহ্মচর্য আর রক্ষা পাইবে না। কিন্তু বিরোধ করিয়া কিছু বলা বা করা নমিতা ভাবিতেও পারে না, পাছে কাকাবাবু অসন্তুষ্ট হন্ ও পারিবারিক শান্তি একটুও আহত হয়, এই ভয়ে নমিতা সেই বইখানির একটি পৃষ্ঠাও আর উল্টায় নাই, বরং এমন একটা লোভ যে দমন করিতে পারিয়াছে, সেই গর্বে সে একটি পরম আত্মতৃপ্তি অনুভব করিতে লাগিল। ‘ তাহার ব্যবহারে একটু ব্যতিক্রম বা কর্মে একটু শৈথিল্য দেখিলে মা অপ্রসন্ন হন, কারণ পরের সংসারে তাহারা পরগাছা বই আর কিছুই নন, অতএব যতই কেন না নিরানন্দ ও রুক্ষ হোক্, এই কৰ্তব্যসাধনে পরাজুখ হইলে তাহাদের চলিবে না। নমিতার আসার পর হইতে ছোট চাকরটাকে বিদায় দেওয়া হইয়াছে, দোতলার তিনটা ঘরের সমস্ত খুঁটিনাটি কাজ তাহাকে সম্পন্ন করিতে হয়—বিছানা পাতা থেকে সুরু করিয়া ঝাট দেওয়া, কাকাবাবুর তামাক সাজা পর্যন্ত। সপ্তাহে দুইবার করিয়া কাকাবাবুর জুতায় কালি লাগাইতে হয়, পূর্ণিমাঅমাবস্যায় ক্রমান্বয়ে কাকিমার দুই হাঁটুতে বাতের ব্যথা হইলে কাকিমা না ঘুমাইয়া পড়া পৰ্যন্ত তাহাব পরিচৰ্য্যায় ক্ষান্ত হওয়ার নাম করা যাইত না; তাহার পর কখনো কখনো কাকিমার কোলের মেয়েটা মাঝরাতে হঠাৎ চেচাইতে আরম্ভ করিলে, নমিতাকেই আসিয়া ধরিতে হয়, অবাধ্য মেয়েটাকে শান্ত করিবার জন্য বুকে ফেলিয়া বারান্দায় সে সেই থেকে পায়চারি করিতে থাকে। এত বড় পৃথিবীতে এই স্বল্পায়তন বারান্দাটিই নমিতার তীর্থস্থান, গভীররাত্রে এখানে বসিয়াই সে মহামৌনী আকাশের সঙ্গে একটি অনির্বচনীয় আত্মীয়তা লাভ করে। তাহার চিন্তাগুলি বুদ্ধি দ্বারা উজ্জীবিত নয়, ভারি অস্পষ্ট ও প্রচ্ছন্ন—তবু নমিতা তাহার জীবনের চতুর্দিকে একটা প্রকাশহীন প্রকাণ্ড অসীমতা অনুভব করে, তাহা তাহার এই নিঃসঙ্গতার মতই প্রগাঢ়। রাত্রির আকাশের দিকে চাহিয়া সে তাহারই মত বাক্যহারা হইয়া বসিয়া থাকে। সব চেয়ে আশ্চৰ্য, সে এক ফোটা চোখের জল পৰ্যন্ত ফেলিতে পারে না। মাঝে-মাঝে তাহার সরমার কথা মনে পড়ে। সে নমিতার চেয়ে বয়সে কিছু বড়, একটি ছেলে লইয়া বিধবা হইয়াছে। বিধবা হইয়াও সে আরসবায়ের মত হাসিয়া খেলিয়া দিন কাটায়, কোনো কিছু একটা আয়ত্তাতীত অথচ অভিলষিতের অভাববোধ তাহাকে অধীর উদ্ব্যস্ত করিয়া তোলে নাই। একটি সন্তান পাইলে নমিতার অন্তরের সমস্ত নিঃশব্দতা হয়তো মুখর হইয়া উঠিত—এমন করিয়া দুরপনেয় ব্যর্থতার সঙ্গে তাহার দিনরাত্রি মিথ্যা বন্ধু তা পাইতে হইত না। একটি সন্তান পাইলে নমিতা তাহাকে মনের মত করিয়া মানুষ করিত, তাহার সীমাবদ্ধ জ্ঞানের পরিধিতে যতগুলি মহামানবের পদচিহ্ন পড়িয়াছে, তাহাদের সকলের চেয়ে মহীয়ান, সকলের চেয়ে বরেণ্য— তাহা হইলে এত কাজের মধ্যেও সব কিছু তাহার এমন শুন্য ও অসার্থক মনে হইত না। সঙ্গোপনে একটি স্বল্পায়ু স্বপ্ন লালন করিবে, নমিতার সেই আশাটুকুও অস্তমিত হইয়াছে। স্বামীর প্রতি তাহার প্রেম এত গভীর ও সত্য হইয়া উঠে নাই যে, এই ক্লেশকর কৃচ্ছসাধনার মধ্যে সে আনন্দ উপভোগ করিবে। কিন্তু স্বামী যদি তাহাকে একটি সন্তান উপহার দিতে এমন অমানুষিক কৃপণতা না করিতেন, তাহা হইলে হয় তো সেই অনাগত শিশুর মুখ চাহিয়া সে স্বামীর পূজা করিতে পারিত। বারান্দায় বসিয়া বা কখনো-কখনো কাকিমার ছোট মেয়েটিকে কোলে লইয়া ঘুম পাড়াইবার অবকাশে সে এই চিন্তাগুলিই নির্ভয়ে মনে-মনে নাড়াচাড়া করে, নিজের এই অকৃতার্থতার অতিরিক্ত আর কোনো চিন্তার অস্তিত্ব সে কল্পনাই করিতে পারে না।
নমিতার আসার পর হইতেই এ সংসারে যে কিছু পরিবর্তন ঘটিয়াছে ইহা অজয় লক্ষ্য করিয়াছিল। ছোট চাকরটাকে বিড়ি খাইতে কালেভদ্রে দুয়েকটা পয়সা দিলেই, সে পরম আপ্যায়িত হইয়া কুঁজোয় জল ভরিয়া, টেবিল সাফ করিয়া, বিছানাটা তকৃতকে করিয়া তুলিত। ইদানিং টের পাইল, চাকরটা অন্তর্হিত হইয়াছে; এবং দিদি হুকুম দিয়াছেন যে, এ-সব কাজ অজয়কে নিজ হাতেই সম্পন্ন করিতে হইবে। গৃঢ় কারণটার মর্মার্থ সুমি-ই এক সমরে অজয়কে জানাইয়া দিয়া গেল। অজয় বুঝিল, তাহার পরিচর্যা করিবার জন্যই চাকরটাকে রাখা হয় নাই এবং উপরের ঘরকরনা করিবার জন্য যখন নমিতার শুভাগমন হইয়াছে, তখন চাকরটার জন্য বাহুল্য খরচ করা সমীচীন হইবে না। নমিতার যে নীচে নামা বারণ, তাহাও সুমি অনুচ্চকণ্ঠে অজয়ের কানে বলিয়া ফেলিল; তাই তাহার ঘর-দোরের স্ত্রী ফিরিবার আর কোনই আশা রহিল না। তবু ছেলেটা এমন অকেজো ও অলস যে, নিজের বিছানাটা গুছাইয়া লইবে। তাহাতে পর্যন্ত তাহার হাত উঠিল না; সুপীকৃত অপরিচ্ছন্নতার মাঝে সে দিন কাটাইতে লাগিল। নমিতাকে সে চোখে এখনও দেখে নাই, তবু সংসারের আবহাওয়ায় যে একটা মাধুৰ্য সঞ্চারিত হইতেছে, তাহা সে প্রতিনিয়ত অনুভব করে। নমিতার কাজে হাজার রকম ত্রুটির উল্লেখ করিয়া তাহার দিদি সৰ্ব্বদাই কর্কশ কথা বলিয়া চলিয়াছেন, আত্মীয়তার ক্ষেত্রেও যে শিষ্টাচার মানুষে প্রত্যাশা করে কখনো কখনো তাহার কথাগুলি সেই ভব্যতার সীমা লঙ্ঘন করিতেছে —অজয় মনে-মনে একটু পীড়িত হয় বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ উদাসীন থাকিয়া দিদির অশিক্ষাজনিত এই অসৌজন্যকে ক্ষমা করিতে চেষ্টা করে। সব চেয়ে আশ্চর্য এই, সব নিষ্ঠুর গালিগালাজের প্রতিবাদে নমিতা আত্মরক্ষা করিতে একটিও কথা কহে না, তাহার এই নীরব উপেক্ষাটি অজয়ের বড় ভালো লাগে। অজয়ের উপরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল না, কিন্তু পাছে তাহার অযাচিত সান্নিধ্যে একটি নিঃশব্দচারিণী নিৰ্বাককুষ্ঠিত মেয়ে অকারণে সঙ্কুচিত ও পীড়িত হয়, সেই ভয়েই সে তাহার ছোট ঘরটিতেই রহিয়া গেছে—নমিতাকে উঁকি মারিয়া দেখিবার অন্যায় কৌতূহল তাহার নাই।
সেদিন রাত্রে কিছুতেই অজয়ের ঘুম আসিতেছিল না, পাশের নর্দামা হইতে মশারা দলবদ্ধ হইয়া তাহাকে আক্রমণ করিয়াছে। আত্মরক্ষা করিবার জন্য সে আলমারির মাথা হইতে বহুদিনের অব্যবহৃত মশারিটা নামাইল, কিন্তু প্রসারিত করিয়া দেখিল, সেটার সাহায্যে বংশানুক্রমে ইদুর গুলির ভূরিভোজন চলিয়া আসিতেছে। অগত্যা নিদ্রাদেবীকে তালাক দিয়া সে রাস্তায় নামিয়া আসিল। গলিটুকু পার হইয়া হারিস রোডে পড়িবে, বাঁক নিবার সময় সে স্পষ্ট দেখিতে পাইল, তাহাদের দোতলার বারান্দায় একটি মেয়ে রেলিঙে ভর দিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। অজয় থামিল; বুঝিল, ইনিই নমিতা, নিদ্রাহীনা। স্তম্ভিত হইয়া কতক্ষণ সে দাঁড়াইয়া রহিল খেয়াল নাই, সে যেন তাহার চোখের সম্মুখে একটা নৈর্ব্যক্তিক আবির্ভাব দেখিতেছে। রাত্রির এই গাঢ় স্তব্ধতা যদি কোনো কবির কল্পনাস্বর্গ হইতে অবতরণ করিয়া আকার নিতে পারিত, তবে এই পবিত্র সমাহিত সুগন্তীর নারীমূর্তিই সে গ্রহণ করিত হয়ত। মুহূর্তে অজয়ের হৃদয়ে বেদনার বাষ্প পুঞ্জিত হইয়া উঠিল। এত বড় সৃষ্টি হইতে সম্পর্কহীন এমন একটি একাকিনী মূর্তি দেখিয়া বিস্ময়ের প্রাবল্যে যেন চলিবার শক্তিটুকুও সে হারাইয়া বসিয়াছে। চরিতার্থতাহীনতার এমন একটা সুস্পষ্ট ছবি সে ইহার আগে কোনো দিন কল্পনাও করিতে পারিত না।
পরের দিন রাত্রেও আবার সে বাহির হইয়া আসিয়া দেখিল, নমিতা তেমনি চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া যেন এই বিশ্ব-প্রকৃতির সঙ্গে বিলীন হইয়া গেছে। আজ হঠাৎ কেন জানি না নমিতাকে দেখিয়া তাহার মনে নূতন আশা-সঞ্চার হইল, নমিতা যেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার একটি সুস্পষ্ট সহজ সঙ্কেত। এই নমিতাকে তাহাদের দলে লইতে হইবে। কৃত্রিম সংসাবের গণ্ডীতে জন্মান্ধ কূপমণ্ডুকের মত সঙ্কীর্ণ স্বার্থ লইয়া দিনযাপন করিলে তাহার চলিবে না; কর্মে, শিক্ষায়, চরিত্রমাধুর্যে তাহাকে বলশালিনী হইতে হইবে। সেই সুষুপ্ত মধ্যরাত্রিতে অবারিত আকাশের নীচে নমিতার প্রতি অজয় এমন একটি সুদূববিস্তৃত সহানুভূতি অনুভব করিল যে, যদি তাহার শক্তিতে কুলাইত, তখনি তাহাকে ঐ অবরোধের শাসন হইতে মুক্ত করিয়া দৃপ্ত বিদ্রোহিনীর বেশে পথের প্রান্তে নামাইয়া আনিত।
ছোট মেয়েটা যথারীতি চেঁচাইতে সুরু করিয়াছে। নমিতা ছুটিয়া গিয়া যথাপূৰ্ব্ব মেয়েটাকে কোলে নিয়া প্রবোধচেষ্টায় পাইচারি আরম্ভ করিল। নমিতা যে সামান্য সংসার কর্তব্যসাধিকা এই সত্যটি অজয়ের চোখে এখন সহসা উদঘাটিত হইল দেখিয়া তাহার চমক ভাঙিল। তুচ্ছ সন্তানপালন কি তাহাকে মানায়? বাঙলাদেশে তাহার জন্য ঝাঁকেঝকে মেয়ে আছে। নমিতা সর্ববন্ধনমুক্তা সর্বদায়িত্বহীনা বিজয়িনী।
তাহার পরদিন অজয় সুমিতাকে নিয়া পড়িল। নমিতা কিছু পড়াশুনা করে কি না, এইটুকু জানিতেই তাহার প্রবল ঔৎসুক্য হইয়াছে—সুমি ইহার উত্তরে যাহা বলিল তাহা স্বীকার করিতে গেলে তাহার দিদিকে কালিদাসের চেয়েও বড় পণ্ডিত বলিতে হয়, কিন্তু দিদির প্রতি সুমির এই প্রশংসমান পক্ষপাতিত্বে অজয় বিশ্বাস করিল না।
আলমারি হইতে একখানা বই বাহির করিয়া বলিল,-“এ বইখানা তোমার দিদিকে পড়তে দিয়ে এসো, কেমন?”
সুমি ঘাড় নাড়িয়া কহিল,—“দিদি আমার মত বানান করে পড়ে না, একনাগাড়ে পড়তে পারে। আমি যাচ্ছি এখুনি।”
অজয় সুমিকে ডাক দিয়া ফিরাইল, প্রায় কানে কানে কহিবার মত করিয়া বলিল,-“বইটা কে দিয়েছে বলে না যেন, বুঝলে?”