১৯. কালিদাস নাগ ও জলধর সেন

ঘর ছোট কিন্তু হৃদয় অসীমব্যাপ্ত। প্রচেষ্টা সংকীর্ণ কিন্তু কল্পনা অকুতোভয়। লেখনীতে কুণ্ঠা কিন্তু অন্তরে অকাপট্যের তেজ।

যেহেতু আমরা সাহিত্যিক সেহেতু আমরা সমগ্র বিশ্বজনের আত্মজন এমনি একটা গর্ব ছিল মনে-মনে। সমস্ত রসপিপাসু মনের আমরা প্রতিবেশী। আমাদের জন্যে দেশের ব্যবধান নেই, ভাষার অন্তরায় নেই। আমাদের গতিবিধি পরিধিহীন। সকলের মনের নির্জনে আমাদের নিত্যকালের নিমন্ত্রণ পৃথিবীর সমস্ত কবি ও লেখকের সঙ্গে আমরা সমবেত হয়েছি একই মন্দিরে, সম্মিলিত হয়েছি একই উপাসনায়। আসনের তারতম্য আছে, আছে ভাষণের গুণভেদ—কিন্তু সন্দেহ কি, সত্যের দেবালয়ে সুন্দরের বন্দনায় একত্র হয়েছি সকলে, এক সামমন্ত্রে! সমস্ত পৃথিবী আমাদের স্বদেশ, সমস্ত মানুষ আমাদের ভাই—সেই অব্যর্থ প্রতিশ্রুতিতে।

সুদূর বাঙলার নবীন লেখক বিশ্বের দরবারে কীর্তিমানদের সঙ্গে সমানধর্মিতা দাবি করছে—সাহস আছে বটে। কিন্তু কল্লোলের সে যুগটাই সাহসের যুগ, যে সাহসে রোমাণ্টিসিজমের মোহ মাখানো। শুধু সূত্রপাতের সাহস নয়, সম্পূরণের সাহস। সেই সাহসে একদিন আমরা বিশ্বের প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের মিত্রতা দাবি করে বসলাম, নিমন্ত্রণ করলাম আমাদের যজ্ঞসভায়। আমাদের এই শুপুরি-নারকেল ধান-পাটের দেশকে যিনি বিশ্বের মানচিত্রে চিত্রিত করেছেন সেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের পরিচায়ক। ভাষায় উত্তাপ ছিল, ছিল ভাবের আন্তরিকতা, অনেকেই প্রত্যভিবাদন করলেন কল্লোলকে।

ইতঃপূর্বে ডক্টর কালিদাস নাগ গোকুলের সঙ্গে জাঁ ক্রিসতফ অনুবাদ শুরু করেছেন। গোকুল মারা যাবার পর শান্তা দেবী হাত মেলালেন অনুবাদে। কালিদাসবাবুই রলাঁর আত্মিক দীপ্তির প্রথম চাক্ষুষ পরিচয় নিয়ে এলেন কল্লোলে। ফ্রান্সে ছিলেন শিক্ষাসূত্রে, আর ছিলেন রলাঁর সঙ্গসান্নিধ্যের স্নেহচ্ছায়ায়। তাই প্রথম আমরা যাকে চিঠি লিখলাম। চিঠির ইতিতে প্রথমে সই করল দীনেশরঞ্জন–যজ্ঞের পুরোধা, পরে আমরা-যজ্ঞভাগীরা।

মহাপ্রাণ রলাঁ মহামানবের ভাষায় সে চিঠির উত্তর দিলেন। ফরাসীতে লেখা সেই চিঠি ইংরিজিতে তর্জমা করেছেন কালিদাসবাবু।

February 8, 1925

Dear Sir,

I have received two of your kind letters-the letter which you collectively addressed to me with your collaborators and that of 15th January accompanying the parcel of your Review. I beg to thank you cordially for that.

I am happy that my dear friend Dr. Kalidas Nag presents my Jean Christophes to the readers of Kallol and that my vagabond child–Christobbe starts exploring the routes of India after having traversed through the heart of Europe. He carries in his sack a double secret which seems contradictory: Revolt and Harmony. He learnt the first quite early. The second came to him only after years from the hands of Grazia. May every one of my friends meet Grazia (real or symbolical)!

I have sent to you & few days ago one of my photographs as you have asked and I have written on the back of it a few lines in French : for I don’t write English. And it is absolutely necessary that you should learn a little French or one of the Latin languages which are much nearer to your language (Bengali) by the warm and musical sonority than the English language.

Now I in my turn demand certain things from you. While you do me the honour of translating Jean Christophe in Bengali, some of my European friends desire to be familiar with your modern literature–novels, (romance) short stories, essays etc. from the Indian writers, which may be published gradually by Emil Roninger of Zurio who has already taken the initiative in publishing the works of Gandhi. What is wanted is the translation of your contemporary publications, as for example, we shall be happy to know the works of Saratchandra Chatterjee whose small volume of Srikanta translated by K. C. Sen and Thompson, has struck our imagination by his art and original personality. Is it possible to arrange for the translation of some of the prose works of your most distinguished living authors? That would be a work which will glorify your country, for they would be translated and spread in different countries of the west.

I would request the young writers of India to publish in English the biographies of the great personalities of India: Poets, Artists, Thinkers etc, on the same models as my lives of Bethoven, Michael Angelo, Tolstoy, and Mahatma Gandhi. Nothing is better qualified to inspire the admiration and love for India in the heart of Europe which knows them not: Europe is strongly individualistic, she will always be struck more by a Figure, by a Person than by an Idea. Show her your great men–Sages and your Heroes.

I submit to you these suggestions and I request you dear Dinesh Ranjan Das and your collaborators of Kallol, to believe me to be your cordial and devoted friend.

Romain Rolland

যে ফটোগ্রাফটি পাঠিয়েছিলেন তার পিঠেও ফরাসীতে লিখে দিয়েছিলেন কয়েক লাইন। তার ইংরিজি অনুবাদ এইরূপ

To my Friends of India:

Europe and Asia form one and the same vessel. Of that the prow is Europe. And the chamber of watching is India, Empress of Thought, of innumerable eyes. Light to thee, mine eyes. For thou belongs to me. And mine sprit is Thine. We are nothing but one indivisible Being.

Romain Rolland

রলাঁর বোন কিন্তু ইংরিজিতে চিঠি লিখলেন, আর সব চেয়ে আশ্চর্য, সুদূর বিদেশে থেকেও বাঙলা ভাষা তিনি আয়ত্ত করবার চেষ্টা করছেন–শুধু পড়া নয়, লেখাও। তাঁর চিঠিটা দীনেশরঞ্জনের গল্পের বই মাটির নেশাকে অবলম্বন করে লেখা—কিন্তু, আসলে, বাঙলা সাহিত্যের প্রতি মমত্বপ্রেরিত। মূল চিঠিটাই তুলে দিচ্ছি :

February 10/26.
Villa Olga.

Dear Mr. Dass,

I did not thank you sooner for the books you sent to my brother and to me with such kind massages inscribed on them, because–as I wrote to Dr. Nag last month, I wanted to peruse at least part of their contents before acknowledging your gift.

In spite of my limited knowledge of your language I was able to understand and enjoy fully the stories I read in your মাটির নেশা. Of course I may have missed many a nice shade and I do not pretend to judge the literary merit of the style! But I can appreciate the substance of them. And পার্ব্বতীর piety and motherly love for the foundling. the poor cobbler দুলাল’s misfortunes in the city, the domestic scenes in the story কমল মধু awoke in my a twofold interest: making me once more aware of the oneness of human nature and setting up before my western eyes a vivid picture of Eastern customs of every day life.

I thank you too for Gokulchandra Nag’s works. I was deeply moved by মাধুরী. But I shall write later on to his brother about it.

I want also to tell you in my brother’s name and my own, how much we appreciate the gallant effort of কল্লোল. My wish is to grow more able to follow closely what it publishes (I am still a slave to my dictionary and plod on wasting much precious time) so that I may deserve at last a small part of the praise Dr. Nag gave me in the পৌষ number and of which I am quite unworthy.

Sending you my brother’s best greetings, you, dear Mr. Das, most sincerely.

Yours
Maudline Rolland

চিঠিটার মধ্যে লক্ষিতব্য বিষয় হচ্ছে, বাংলা কথাগুলো ভাঙ-ভাঙা বাংলা হরফে লেখা।

তেমনি চিঠি লিখল জাসিন্তো বেনাভাতে, যোয়ান বোয়ার আর ফ্লুট ফামসুনের পক্ষে তার স্ত্রী। চিঠিগুলি অবিশ্যি মামুলি—সেটা বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে তাঁদের সৌজন্য, তাঁদের মিত্রতার স্বীকৃতি। সেই স্বীকৃতিতেই তারা মূল্যবান।

Mr. Dinash Ranjan Das,

Dear Sir,

Thank you with all my heart for your letter. I send you the photo you ask for. Some of my works are published in America (English translation, but I have not the volumes.

My best salutation to your friends and believe yours.

Jacinto Benavente
Madrid, Spain 6/25

Hvalstad, 2. 4. 25. (Norway)

To

Kalol Publishing House
and my friends in Calcutta

It is with the greatest pleasure I have lately received your greetings. Please accept my best wishes and my fraternal compliments.

Sicerely
Johan Bojer.


Grimstad, Norway

Dear Sir,

My husband asks me to thank you very much for the friendly letter.

Respectfully yours
Mrs. Knut Hamsun.

উপরের তিনটি চিঠিই ইংরিজিতে লেখা–স্বহস্তে। একমাত্র রম্যাঁ রলাঁই পরভাষায় লেখেন না দেখা যাচ্ছে। আর রবার্ট ব্রিজেস-এর পক্ষ থেকে পাওয়া গেল এই চিঠিটা :

Chilswell
Boars Hill
Oxford, July 15

Deer Sir

I write at Mr. Robert Bridges’ request to send you in response to your letter of June 18 a photograph.

He also suggests that I should send you a copy of the latest tract brought out by the Society of Pure English, which he thinks will interest the Group that you write of.

Yours faithfully
M. M. Bridges.

কিন্তু এইচ জি ওয়েলসের চিঠিটা সারবান। সোনার অক্ষরে বাঁধিয়ে রাখার মত।

Easton Globe
Dunmow

Warmest greetings to your friendly band and all good wishes to Kallol. An Englishman should be a good Englishman and a Bengali should be a good Bengali but also each of them should be a good world citizen and both fellow workers in the great Republic of Human Thought and Effort.

Feb. 14th, 1925.
H. G. Wells.

পৃথিবীর প্রায় সমস্ত মান্য-বরেণ্যকেই অভিনন্দন জানানো হয়েছিল। উপরি-উক্তরা ছাড়া অবশিষ্টগণ কেউ হয়ত পাননি চিঠি, কেউ হয়ত বা উপেক্ষা করলেন। কিন্তু সব চেয়ে প্রাণস্পর্শ করল ইয়োন নোগুচি। সোজাসুজি কবিতা পাঠিয়ে দিলে একটা। হৃদয়ের ব্যাকুলতার উত্তরে

 

হৃদয়ের গভীরতা। কবিতাটি ইংরিজিতে লেখা–মূল না অনুবাদ বোঝবার উপায় নেই, কিন্তু কবিতাটি অপরূপ।

I followed the Twilight :
I followed the twilight to find where it wont–
It was lost in the days full light.
I followed the twilight to find where it went–
It was lost in the dark of night.
Last night I wept in & passion of joy
To-night the passion of sorrow came.
O light and darkness, sorrow and joy,
Tell me, are ye the same?

Yone Noguchi.

কালিদাস নাগ কল্লোলের জ্যেষ্ঠতুল্য ছিলেন—শুধু গোকুলের অগ্রজ হবার সম্পর্কেই নয়, নিজের স্নেহবলিষ্ঠ অভিভাবকত্বের গুণে। অনেক বিপদে নিজে বুক এগিয়ে দিয়েছেন। যখনই নৌকো ঘূর্ণির মধ্যে পড়েছে, হাল তুলে নিয়েছেন নিজের হাতে। ঘোরালো মেঘকে কি করে হাওয়া করে দিতে হয় শিখিয়ে দিয়েছেন সেই মধুমন্ত্র। দুঃখের মধ্যে নিজে মানুষ হয়েছেন বলে শিখিয়ে দিয়েছেন সেই কৃচ্ছ্রাতিকৃচ্ছ্র, বাধাকে বশীভূত করার তপঃপ্রতাপ। নিজে লেখনী ধরেছেন কল্লোলের পৃষ্ঠায়—শুধু স্বনামে নয়, দীপঙ্করের ছদ্মনামে। দীপঙ্করের কবিতা দীপোজ্জলা।

সব চেয়ে বড় কাজ তিনি কল্লোলের দলকে প্রবাসীতে আসন করে দিলেন। সংকীর্ণ গিরিসঙ্কট থেকে নিয়ে গেলেন প্রশস্ত রাজপথে। তখনকার দিনে প্রবাসী বাংলা সাহিত্যের কুলীন পত্রিকা, তাতে জায়গা পাওয়া মানেই জাতে-ওঠা, সঙ্গে-সঙ্গে কিছু বা দক্ষিণার খুদকণা। আমাদের তখন কলা বেচার চেয়ে রথ দেখাই বড় কাম্য। কিন্তু দেখা গেল রথের বাহকরা আমাদের উপর ভারি খাপ্পা। কিন্তু কালিদাসবাবু দমলেন না—একেবারে রথের উপরে বসিয়ে ছাড়লেন।

ওদিকে সব চেয়ে জনপ্রিয় ছিল ভারতবর্ষ—কাটতির জনশ্রুতি পরিস্ফীত। আশাতীতরূপে সেখানে একদিন ডাক দিলেন জলধর সেন। সর্বকালের সর্ববয়সের চিরন্তন দাদা। অতি-আধুনিক সাহিত্যিক বলে কোনো ভীরু সংস্কার তো নেইই বরং যেখানে শক্তি দেখলেন সেখানেই স্বীকৃতিতে উদার-উচ্ছ্বল হয়ে উঠলেন। শুধু পত্রিকায় জায়গা করে দেয়া নয়, একেবারে হৃদয়ের মধ্যে নিয়ে আসা। মুঠো ভরে শুধু দক্ষিণা দেয়া নয়, হৃদয়ের দাক্ষিণ্য দেয়া। প্রণাম করতে গিয়েছি, দুহাত দিয়ে তুলে ধরে বুকের মধ্যে পিষে ধরেছেন। এ মামুলি কোলাকুলি নয়—এ আত্মার সঙ্গে আত্মার সম্ভাষণ। একজন রায়বাহাদুর, প্রখ্যাত এক পত্রিকার সম্পাদক, সর্বোপরি কৃতার্থম্মত সাহিত্যিক—অথচ অহঙ্কারের অবলেশ নেই। ছোট-বড় কৃতী-অকৃতী–সকলের প্রতি তার অপক্ষপাত পক্ষপাতিত্ব। বাংলা সাহিত্যের সংসারে একমাত্র জলধর সেনই অজাতশত্রু।

গ্রীষ্মের দুপুরে ভারতবর্ষের আপিসে খালি গায়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন, মুখে অর্ধদগ্ধ চুরুট, পাশে টেবল-ফ্যান চলছে—এই মূর্তিটিই বেশি করে মনে আসছে। তাকে চুরুট ছাড়া দেখেছি বলে মনে পড়ে না—আর সে চুরুট সর্বদাই অর্ধদগ্ধ। সম্পাদকের লেখা প্রত্যেকটি চিঠি তিনি স্বহস্তে জবাব দিতেন—আর সব চেয়ে আশ্চর্য, ছানিকাটানো চোখেও প্রুফ দেখতেন বর্জাইস টাইপের। কানে খাটো ছিলেন-সে শ্রবণাল্পতার নানারকম মজার গল্প প্রচলিত আছে–কিন্তু প্রাণে খাটো ছিলেন না। প্রাণে অপরিমেয় ছিলেন।

হয়তো গিয়ে বললাম, আমার গল্পটা পড়েছেন?

জলধরদাদা উত্তর দিলেন : কাল লালগোলায় গিয়েছিলুম।

কেমন লাগল গল্পটা?

হরিদাসবাবু? নিচেই আছেন–দেখলে না উঠে আসতে?

যদি টাকাটা—

ভারতবর্ষ? কাল বেরুবে।

চেঁচিয়ে বলছিলুম এতক্ষণ যাতে সহজে শোনেন। হঠাৎ গলা নামালুম, কণ্ঠস্বর ক্ষীণ করলুম, আর, আশ্চর্য, অমনি শুনতে পেলেন সহজে। খবর পেলুম গল্প পড়া ছাড়া ছাপা শেষ হয়ে গেছে। কাল কাগজ বেরুবে তা বেরোক, আজ যখন এসেছ আজকেই টাকাটা নিয়ে যাও।

জলধরের মতই শ্যামস্নিগ্ধ। বর্ষার জল শুধু সমুদ্র-নদীতেই পড়েনা, দরিদ্রের খানা-ডোবাতেও পড়ে। অকিঞ্চনতমও নিমন্ত্রণ করলে বয়সের শত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে জলধরাদাদা সর্বাগ্রে এসে উপস্থিত হয়েছেন–সে কসবাতেই হোক বা কাশীপুরেই হোক। মনে আছে, বেহালায়, ভবানী মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে রবিবারের সন্ধ্যায় জলধরদাদা এসেছেন। সেখানে হঠাৎ এক প্রতিবেশী ভদ্রলোক এসে উপস্থিত–জলধরদাদাকে মাস্টারমশাই সম্বোধন করে এক শ্রদ্ধাপ্লুত প্রণাম। কোন সুদূর অতীতে শিক্ষকতা করেছিলেন, তবু জলধরাদা প্রাক্তন ছাত্রকে চিনতে পারলেন। চিনতে পারল তাঁর চক্ষু তত নয় যত তাঁর প্রাণ। পরের বাড়িতে বসে ছাত্রের সঙ্গে আলাপ করে তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না জলধরদাদা। তাই পরদিন আবার বেহালায় সেই ছাত্রের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন নিরিবিলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *