১২. রবীন্দ্রনাথকে প্রথম কবে দেখি?

রবীন্দ্রনাথকে প্রথম কবে দেখি?

প্রথম দেখি আঠারোই ফান, শনিবার, ১৩৩০ সাল। সেবার বি-এর বছর, ঢুকিনি তখন কল্লোলে। রবীন্দ্রনাথ সেনেট হলে কমলা-লেকচার্স দিচ্ছেন। ভবানীপুরের ছেলে, কলকাতার কলেজে গতিবিধি নেই, কোণঠাসা হয়ে থাকবার কথা। কিন্তু গুরুবলে ভিড় ঠেলে একেবারে মঞ্চের উপর এসে বসেছি।

সেদিনকার সেই দৈবত আবির্ভাব যেন চোখের সামনে আজও স্পষ্ট ধরা আছে। সুষুপ্তিগত অন্ধকারে সহসোখিত দিবাকরের মত! ধ্যানে সে-মূর্তি ধারণ করলে দেহ-মন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। বাঙ্মমনশ্চশ্রোত্রঘ্রাণপ্রাণ নতুন করে প্রাণ পায়। সে কি রূপ, কি বিভা, কি ঐশ্বর্য! মানুষ এত সুন্দর হতে পারে, বিশেষত বাংলা দেশের মানুষ, কল্পনাও করতে পারতুম না। রূপকথার রাজপুত্রের চেয়েও সুন্দর। সুন্দর হয়ত দুর্লভদৰ্শন দেবতার চেয়েও।

বাংলা দেশে এক ধরনের কবিয়ানাকে ববিয়ানা বলত। সে আখ্যাটা কাব্য ছেড়ে কাব্যকারের চেহারায়ও আরোপিত হত। যাদের লম্বা চুল, হিলহিলে চেহারা, উড়ুউড়ু ভাব, তাদের সম্পর্কেই বলা হত এই কথাটা। রবীন্দ্রনাথকে দেখে মনে হল ওরা রবীন্দ্রনাথকে দেখেনি কোনোদিন। রবীন্দ্রনাথের চেহারায় কোথাও এতটুকু দুর্বলতা বা রুগ্নতার ইঙ্গিত নেই। তার চেহারায় লালিত্যের চেয়ে বলশালিতাই বেশি দীপ্যমান। হাতের কবজি কি চওড়া, কি সাহসবিস্তৃত বিশাল বক্ষপট! শ্লথপ্রাণ দুর্বলের স্পর্ধা আমি কভু সহিব না এ শুধু রবীন্দ্রনাথের মুখেই ভালো মানায়। যিনি সাঁতরে নদী পার হয়েছেন, দিনের বেলায় ঘুমুননি কোনোদিন, ফ্যান চালাননি গ্রীষ্মকালের দুপুরে।

পরনে গরদের ধুতি, গায়ে গরদের পাঞ্জাবি, কাঁধে গরদের চাদর, শুভ্র কেশ আর শ্বেত শ্মশ্রু–ব্যক্তমূর্তি রবীন্দ্রনাথকে দেখলাম। এত দিন তার রচনায় তিনি অব্যক্তমূর্তিতে ব্যাপ্ত হয়ে ছিলেন, আজ চোখের সামনে। তার বাস্তবমূর্তি অভিদ্যোতিত হল। কথা আছে, যার লেখার তুমি ভক্ত কদাচ তাকে তুমি দেখতে চেও না। দেখেছ কি তোমার ভক্তি চটে গিয়েছে। দেখে যদি না চটো, চটবে কথা শুনে। নির্জন ঘরে নিশব্দ মূর্তিতে আছেন, তাই থাকুন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বেলায় উলটো। সংসারে রবীন্দ্রনাথই একমাত্র ব্যতিক্রম, যার বেলায় তোমার কল্পনাই পরাস্ত হবে, চূড়ান্ততম চূড়ায় উঠেও তাঁর নাগাল পাবে না। আর কথা—কণ্ঠস্বর? এমন কণ্ঠস্বর আর কোথায় শুনবে?

যত দূর মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথ মুখে-মুখে বক্তৃতা দিয়েছিলেন—পর-পর তিন দিন ধরে। পরে সে বক্তৃতা লিপিবদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। ভাবছিলুম, যে ভালো লেখে সে ভালো বলতে পারে না-যেমন শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বেলায় কিছুই অনিয়ম নয়। অলোকসম্ভব তাঁর সাধনা, অপারমিতা তার প্রতিভা। প্রথম দিন তিনি কি বলেছিলেন তা আবছা-আবছা এখনো মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, মানুষের তিনটি স্পৃহা আছে—এক, টিকে থাকা, I exist; দুই, জানা, I know, তিন, প্রকাশ করা, I express। অদম্য এই আকাঙ্ক্ষা মানুষের। নিজের স্বার্থের জন্যে শুধু টিকে থেকেই তার শেষ নেই; তার মধ্যে আছে ভূমা,বহুলতা। যো বৈ ভূমা তদমৃতং, অথ যদল্পং তৎ মর্তং। যেখানে অন্ত সেখানেই কৃপণতা, যেখানে ঐশ্বর্য সেখানেই সৃষ্টি। ভগবান তো শক্তিতে এই ধরিত্রীকে চালনা করছেন না, একে সৃষ্টি করেছেন আনন্দে। এই আন একটি অসীম আকুতি হয়ে আমাদের অন্তর স্পর্শ করছে। বলছে, আমাকে প্রকাশ করে, আমাকে রূপ দাও। আকাশ ও পৃথিবীর আলো এক নাম নোদসী। তারা কাঁদছে, প্রকাশের আকুলতায় কাদছে।

রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের বক্তৃতার সারাংশ আমার ডায়রিতে লেখা আছে এমনি : বিধাতা দূত পাঠালেন প্রভাতের সূৰ্য্যালোকে। বললে দূত, নিমন্ত্রণ আছে। দ্বিপ্রহরে দূত এসে বললে রুদ্র তপস্বীর কঠে, নিমন্ত্রণ আছে। সন্ধ্যায় সূৰ্যাস্তচ্ছটায় গেরুয়াবাস উদাস দূত বললে, তোমার যে নিমন্ত্রণ আছে। তারপর দেখি নীরব নিশীথিনীতে তারায়-তারায় সেই লিপির অক্ষর ফুটে উঠেছে। চিঠি তো পেলাম, কিন্তু সে-চিঠির জবাব দিতে হবে না? কিন্তু কি দিয়ে দেব? রস দিয়ে বেদনা দিয়ে-যা সব মিলে হল সাহিত্য, কলা, সঙ্গীত। বলব, তোমার নিমন্ত্রণ তো নিলাম, এবার আমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে।

নিভৃত ঘরের জানলা থেকে দেখা অচেনা আকাশের নিঃসঙ্গ একটি তারার মতই দূর রবীন্দ্রনাথ। তখন ঐ মঞ্চের উপর বসে তার বক্তৃতা শুনতে-শুনতে একবারও কি ঘূণাক্ষরে ভেবেছি, কোনদিন ক্ষণকালের জন্তে হলেও তাঁর সঙ্গে পরিচিত হবার যোগ্যতা হবে? আর, কে না জানে, তার সঙ্গে ক্ষণকালের পরিচয়ই একটা অনন্তকালের ঘটনা।

ভাবছিলুম, কত বিচিত্রগুণান্বিত রবীন্দ্রনাথ। যেখানে হাত রেখেছেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। সাহিত্যের কথা ছেড়ে দিই, হেন দিক নেই যেদিকে তিনি যাননি আর স্থাপন করেননি তার প্রভুত্ব। যে কোনো একটা বিভাগে তাঁর সাফল্য তাকে অমরত্ব এনে দিতে পারত। পৃথিবীতে এমন কেউ লেখক জন্মায়নি যার প্রতিভা রবীন্দ্রনাথের মত সর্বদিঙমুখী। তা ছাড়া, যেখানে মেঘলেশ নেই সেখানে বৃষ্টি এনেছেন তিনি, যেখানে কুসুমলেশ নেই সেখানে পর্যাপ্তফল। অপমেঘোদয়ং বং, অদৃষ্টকুসুমং ফলং। অচ্ছিন্নপ্রবাহ। গঙ্গার মত তার কবিতা—তার কথা ছেড়ে দিই, কেননা কবি হিসেবেই তো তিনি সর্বাগ্রগণ্য। ধরুন, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রহসন। ধন, প্রবন্ধ। কত, বিচিত্র ও বিস্তীর্ণক্ষেত্রে তার প্রসার-ব্যাকরণ থেকে রাজনীতি। অনেকে তো শুধু ভ্রমণকাহিনী লিখেই নাম করেন। রবীন্দ্রনাথ এ অঞ্চলেও একচ্ছত্র। তারপর, চিঠি। পত্রসাহিত্যেও রবীন্দ্রনাথ অতিথ। কত শত বিষয়ে কত সহস্র চিঠি, কিন্তু প্রত্যেকটি সজ্ঞানসৃজন সাহিত্য। আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা বলতে চান? তাতেও রবীন্দ্রনাথ পিছিয়ে নেই। তার জীবন স্মৃতি আর ছেলেবেলা অতুলনীয় রচনা। কোথায় তিনি নেই? যেখানেই স্পর্শ করেছেন, পুষ্পপূর্ণ করেছেন। আলটপকা অটোগ্রাফ লিখে দিয়েছেন দুটকো-ছাটক—তাই চিরকালের কবিতা হয়ে রয়েছে। তবু তো এখনো গানের কথা বলিনি। প্রায় তিন হাজার গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, আর প্রত্যেক গানে নিজস্ব সুরসংযোগ করেছেন। এটা যে কত বড় ব্যাপার, স্তব্ধ হয়ে উপলব্ধি করা যায় না। মানুষের সুখ-দুঃখের এমন কোনো অনুভূতি নেই যা এই গানে সুরসুমধুর হয়নি। প্রকৃতির এমন কোনো হাবভাব নেই যা রাগরঞ্জিত হয়নি। শুধু তাই? এই গানের মধ্য দিয়েই তিনি ধরতে চেয়েছেন সেই অতীন্দ্রিয়কে, সে শ্রোতস্য শ্রোত্রং, মনসা মনঃ, চক্ষুষ চক্ষুঃ। যে সর্বেন্দ্রিয়গুণাভাস অথচ সর্বেন্দ্ৰিয়বিবর্জিত। এই গানের মধ্য দিয়েই উদঘাটিত করেছেন ভারতবর্ষের পোমূর্তি। এই গানের মধ্য দিয়ে জাগাতে চেয়েছেন পরপদানত দেশকে।

ঢেউ গুনে-গুনে কি সমুদ্র পার হতে পারব? তবু ঢেউ গোনা না হোক, সমুদ্রস্পৰ্শ তো হবে।

সাহিত্যে শিশুসাহিত্য বলে একটা শাখা আছে। সেখানেও রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়রহিত। তারপর, ভাবুন, নিদেশীর পক্ষে ইংরেজের ইংরিজি লেখা সহজসাধ্য নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অতিমর্ত্য। ইংরিজিতে তিনি শুধু তাঁর বাংলা রচনাই অনুবাদ করেন নি, মৌলিক প্রবন্ধ লিখেছেন এবং দেশে-দেশে বক্তৃতা দিয়ে এসেছেন বহুবার। সে ইংরিজি একটা প্রদীপ্ত বিস্ময়। তার নিজের হাতে বাজানো বাজনার সুর।

যে লেখক, সে লেখার বাইরে শুধু বক্তৃতাই দিচ্ছে না, গান গাইছে। আর যার সাহিত্য হল, সঙ্গীত হল, তার চিত্র হবে না? রবীন্দ্রনাথ পট ও তুলি তুলে নিলেন। নতুন রূপে প্রকাশ করতে হবে সেই অব্যক্তরূপকে। সর্বাঙ্গসুন্দর রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখাঁটি ও সুন্দর। কবিতা লিখতে কাটাকুটি করেছেন, তার মধ্য থেকে ব্যঞ্জনাপূর্ণ ছবি ফুটে উঠেছে—তার কাটাকুটি ও সুন্দর। আর এমন কণ্ঠেব যিনি অধিকারী তিনি কি শুধু গানই করবেন, আবৃত্তি করবেন না, অভিনয় কববেন না? অভিনয়ে-আবৃত্তিতে রবীন্দ্রনাথ অসামান্য।

বক্তৃতা শুনতে শুনতে এই সব ভাবতুম বসে বসে। ভাবতুম, রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যের শেষ, তার পরে আব পথ নেই, সংকেত নেই। তিনিই সব-কিছুর চরম পরিপূর্ণতা। কিন্তু কল্লোলে এসে আস্তে আস্তে সে-ভাব কেটে যেতে লাগল। বিদ্রোহের বহ্নিতে সবাই দেখতে পেলুম যেন নতুন পথ, নতুন পৃথিবী। আরো মানুষ আছে, আরো ভাষা আছে, আছে আরো ইতিহাস। সৃষ্টিতে সমাপ্তর রেখা টানেননি রবীন্দ্রনাথ–তখনকার সাহিত্য শুধু তারই বহুকৃত লেখনের হীন অনুকৃতি হলে চলবে না। পত্তন করতে হবে জীবনেব আরেক পরিচ্ছেদ। সেদিনকার কল্লোলের সেই বিদ্রোহ-বাণী উদ্ধতকণ্ঠে ঘোষণা কবেছিলুম কবিতা :

এ মোর অত্যুক্তি নয়, এ মোর যথার্থ অহঙ্কার,
যদি পাই দীর্ঘ আয়ু, হাতে যদি থাকে এ লেখনী,
কারেও ডরি না কভু; সুকঠোর হউক সংসার,
বন্ধুর বিচ্ছেদ তুচ্ছ, তুচ্ছতর বন্ধুর সরণি।
পশ্চাতে শত্রুরা শর অগণন হানুক ধারালো,
সম্মুখে থাকুন বসে পথ রুধি ববীন্দ্র ঠাকুর,
আপন চক্ষের থেকে আলিব যে তীব্র তীক্ষ্ণ আলো
যুগ-সূৰ্য্য ম্লান তার কাছে। মোর পথ আরো দূর!
গভীর আহোপলব্ধি-এ আমার দুর্দান্ত সাহস,
উচ্চকয়ে ঘোষিতেছি নব-নর-জন্ম-সম্ভাবনা;
অক্ষরতুলিকা মোন হস্তে যেন নহে অনলস,
ভবিষ্যৎ বৎসরের শঙ্খ আমি–নবীন প্রেরণা!
শক্তির বিলাস নহে, তপস্যায় শক্তি আবিষ্কার,
শুনিয়াছি সীমান্ত মহা-কাল-সমুদ্রের ধ্বনি
আপন বক্ষের তলে; আপনারে তাই নমস্কার!
চক্ষে থাক আয়ু-ঊর্মি, হস্তে থাক অক্ষয় লেখনী।।

সেই কমলা-লেকচার্সের সভায় আরেকজন বাঙালি দেখেছিলাম। তিনি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। চলতি কথায়, বাংলার বাঘ, শূর-শার্দুল। ধী, ধূতি আর দার্ঢ্যের প্রতিমূর্তি। রবীন্দ্রনাথ যদি সৌন্দর্য, আশুতোষ শক্তি। প্রতিভা আর প্রতিজ্ঞা। এই দুই প্রতিনিধি—অন্তত চেহারার দিক থেকে—আর পাওয়া যাবে না ভবিষ্যতে। কাব্য ও কর্মের প্রকাশাত্মা।.

সাউথ সুবার্বন ইস্কুলে যখন পড়ি, তখন সরস্বতী পূজার চাঁদার খাতা নিয়ে কয়েকজন ছাত্র মিলে একদিন গিয়েছিলাম আশুতোষের বাড়ি। দোতলায় উঠে দেখি সামনের ঘরেই আশুতোষ জলচৌকির উপর বসে স্নানের আগে গায়ে তেল মাখাচ্ছেন। ভয়েভয়ে গুটি-গুটি এগিয়ে এসে চাঁদার খাতা তার সামনে বাড়িয়ে ধরলাম। আমাদের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়ে তিনি হুঙ্কার করে উঠলেন : পেন্নাম করলিনে? আমরা খাতাটাতা ফেলে ঝুপঝুপ করে প্রণাম করতে লাগলাম তাকে।

তেরোশ বত্রিশ সাল-কল্লোলের তৃতীয় বছর-বাংলা দেশ আর কল্লোল দুয়ের পক্ষেই দুর্বৎসর। দোসরা আষাঢ় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন মারা যান দার্জিলিঙে। আর আটই আশ্বিন মারা যায় আমাদের গোকুল, সেই দাজিলিঙেই। শুধু গোকুলই নয়, পর-পর মারা গেল বিজয় সেন গুপ্ত আর সুকুমার ভাদুড়ি।

মঙ্গলবার, বিকেল ছটার সময়, খবর আসে কলকতায়-চিত্তরঞ্জন নেই। আমরা তখন কল্লোল-আপিসে তুমুল আড্ডা দিচ্ছি, খবর শুনে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। দেখি সমস্ত কলকাতা যেন বেরিয়ে পড়েছে সর্বস্বহারার মত। কেউ কারু দিকে তাকাচ্ছে না, কার মুখে কোনো কথা নেই, শুধু লক্ষ্যহীন বেদনায় এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরদিন শোনা গেল, বৃহস্পতিবার ভোরে স্পেশ্যাল ট্রেনে চিত্তরঞ্জনের মৃতদেহ নিয়ে আসা হবে কলকাতায়। অত ভোরে ভবানীপুর থেকে যাই কি করে ইষ্টিশানে? ট্রাম-বাস তো সব বন্ধ থাকবে। সমবায় ম্যানসনসের ইঞ্জিনিয়র সুকুমার চক্রবর্তীর ঘরে রাত কাটালাম। আমি, সুকুমারবাবু আর দীনেশদা। সুকুমারবাবু দীনেশদার বন্ধু, অতএব কল্লোলের বন্ধু, সেই সুবাদে আমাদের সকলের আত্মজন। দরদী আর পরোপকারী। জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত হচ্ছেন পদে-পদে, অথচ মুখের নির্মল হাসিটি অস্ত যেতে দিচ্ছেন না। বিদেশিনী মেয়ে ফ্রেডাকে বিয়ে করেন কিন্তু অকালেই সে-মিলনে ছেদ পড়ল। এসে পড়লেন। একেবারে দৈন্য ও শূন্যতার মুখোমুখি। ক্ষমাহীন সংগ্রামের মাঝখানে। তাই তো বেনামী বন্দরে, ভাঙা জাহাজের ভিড়ে, কল্লোলে তিনি বাসা নিলেন। এমনি অনেকে সাহিত্যিক না হয়েও শুধু আদর্শবাদের খাতিরে এসেছে সেই যৌবনের মুক্ততীর্থে। সেই বাসা ভেঙে গিয়েছে, আর তিনিও বিদায় নিয়েছেন এক ফাঁকে।

রাত থাকতেই উঠে পড়লাম তিন জনে। হাঁটা ধরলাম শেয়ালদার দিকে। সে কি বিশাল জনতা, কি বিরাট শোভাযাত্রা—তা বর্ণনা সুরু করলে শেষ করা যাবেনা। কৃষানের বেশে কে ও কৃশতনু কৃশানু পুণ্যছবি—স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী একজন শববাহী। আট ঘণ্টার উপর সে শোভাযাত্রার অনুগমন করেছিলাম আমরা-নৃপেন সহ আরো অনেক বন্ধু, নাম মনে পড়ছে না-দিনের ও শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত। কলকাতা শহরে আরো অনেক শোভাযাত্রা হয়েছে কিন্তু এমন আর একটাও নয়। অন্তত আর কোনো শোভাযাত্রায় এত জল আর পাখা বৃষ্টি হয়নি!

শ্রবণ সংখ্যায় কল্লোলে চিত্তরঞ্জনের উপর অনেক লেখা বেরোয়, তার মধ্যে অতুল গুপ্তের দেশবন্ধু প্রবন্ধটা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি:

জুলাই মাসের মডার্‌ন্‌ রিভিউতে অধ্যাপক যদুনাথ সরকার চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যু সম্বন্ধে যা লিখেছেন তার মোটা কথা এই যে, চিত্তরঞ্জনের প্রভাবের কারণ তার দেশবাসীরা হচ্ছে কৰ্ত্তা-ভজার জাত। তাদের গুরু একজন চাইই যার হাতে নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনা তুলে দিয়ে তারা নিশ্চিন্ত হতে পারে। অধ্যাপক মহাশয়ের মতে দেশের লোকের উপর চিত্তরঞ্জন দাসের প্রভাবের স্বরূপ আমাদের জাতীয় দুর্বলতার প্রমাণ। কারণ সে প্রভাবের একমাত্র কারণ ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ, ইউরোপের মত কাটা-ছাঁটা অপৌরুষেয় প্রচারের ফল নয়।…

লোকচিত্তের উপর চিত্তরঞ্জনের যে প্রভাব তা কোনও নিগূঢ় তত্বের বিষয় নয়। তা সূর্যের মত প্রকাশ। চোখ না বুজে থাকলেই দেখা যায়। পরাধীন ভারতবর্ষে মুক্তির আকাজা জগছে। আমাদের এই মুক্তির আকাঙ্ক্ষা চিত্তরঞ্জনে মূর্ত হয়ে প্রকাশ হয়েছিল। সেই মুক্তির জন্যে যে নির্ভীকতা, যে ত্যাগ, যে সৰ্বস্বপণ আমরা অন্তরে-অন্তরে প্রয়োজন বলে জানছি, কিন্তু ভয়ে ও স্বার্থে জীবনে প্রকাশ করতে পারছি না, সেই নিভীকতা, সেই ত্যাগ ও সেই পণ সমস্ত বাধামুক্ত হয়ে চিত্তরঞ্জনে ফুটে উঠেছিল। চিত্তরঞ্জনের ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ ও জনসাধারণের উপর তার প্রভাব দু-এয়ই এই মূল। আইন-সভায় যারা চিত্তরঞ্জন উপস্থিত না থাকলে একরকম ভোট দিত, তার উপস্থিতিতে অন্য রকম দিত, তারা দেশের মুক্তিকামী এই ত্যাগ ও নির্ভীকতার মূর্তির কাছেই মাথা নোয়ত। চিত্তরঞ্জনের সম্মুখে দেড়শ বছরের ব্রিটিশ শান্তির ফল প্রভু-ভয় ও স্বার্থভীতি ক্ষণেকের জন্য হলেও মাথা তুলতে পারত না। এই যদি কর্তাভজা হয়, তবে ভগবান যেন এ দেশের সকলকেই কর্তাভজা করেন, অধ্যাপক যদুনাথ সরকারের অপৌরুষের তত্ত্বের ভাবুক না করেন।…

ডেমোক্রেটিক শাসন অর্থাৎ গুরুদের শাসন। তার ফল ভাল হবে কি মন্দ হবে তা নির্ভর করে কোন ডেমস কাকে গুরু মানে তায় উপর। ভারতবর্ষের ডেম যে গুরুর খোঁজে শবরমতীর আশ্রমে কি দেশবন্ধুর বিম-আবাসেই যায়, দৈনিক কাগজের সম্পাদকের অফিসে নয়, এটা আশার কথা, মোটেই ভয়ের কথা নয়। অধ্যাপক সরকার যাকে ডেমক্রেটিক বলে চালাতে চাচ্ছেন সে হচ্ছে সেই aristocratic শাসন, যা ইউরোপের শাসকসম্প্রদায় এতকাল ডেমক্রেটিক বলে চালিয়ে আসছে।

পণ্ডিতে না চিনুক দেশের জনসাধারণ চিত্তরনকে যথার্থ চিনেছিল। তারা তাই তার নাম দিয়েছিল দেশবন্ধু। ঐ নাম দিয়ে তারা জানিয়েছে তাদের মনের উপরে চিত্তরঞ্জনের প্রভাবের উৎস কোথায়। পণ্ডিতের চোখে এটা না পড়তে পারে, কারণ এক শ্রেণীর পাণ্ডিত্য পৃথিবীর কোনও যুগে কোনও দেশেই সমসাময়িক কোনও মহত্বকে চিনতে পারে নাই, কেন না তার কথা পুঁথিতে লেখা থাকেনা।

তেরোশ একত্রিশ সালের শেষ দিকেই গোকুলের জ্বর শুরু হয়। ছবি এঁকে আয়ের সুবিধে বিশেষ করতে পারেনি—অথচ আয় না করলেও নয়। প্রত্নতত্ত্বের রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধীনে চাকরি নিয়ে একবার পুনাতে চলে যায়। বছর খানেক চাকরি করবার পর বম্বেতে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে—দিন-রাত একটুও ঘুমুতে পারত না। বম্বের সলিসিটর কথঙ্কর ও তার স্ত্রী গোকুলকে তাদের বাড়িতে নিয়ে এসে সেবা-যত্ন করে সুস্থ করে তোলেন, কিন্তু চাকরি করার মত সক্ষম আর হল না। কলকাতায় ফিরে আসে গোকুল। কথঙ্কর ও তার স্ত্রী মালিনীর প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার তার শেষ ছিল না। মালিনী গোকুলকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন ও গোকুলের জন্মদিনে বয়ে থেকে কোনো না-কোনো উপহার পাঠাতেন। তারই দেওয়া কালো ডায়েলের ওমেগা রিস্টওয়াচ গোকুলের হাতে শেষ পর্যন্ত বাঁধা ছিল।

গোকুল তার মামার বাড়িতে ছিল, অনেক বিধি-বাধার মাঝখানে। শরীর-মন দুর্বল, তার উপরে অর্থাগম নেই। না একে না লিখে কিছুতেই স্বাধীনভাবে জীবিকার্জন হবার নয়। এমন অবস্থায় গোকুলের দিদিমণি (বড় বোন) বিধবা হয়ে চারটি ছোট-ছোট নাবালক ছেলে নিয়ে গোকুলের আশ্রয়ে এসে পড়েন। কালিদাস নাগ গোকুলের দাদা, তখন ইউরোপে। অনেক বাধা-বিপদ ঠেলে অনেক ঝড়-জল মাথায় করে বিদেশে গিয়েছেন উপযুক্ত হয়ে আসতে। কালিদাসবাবুর অনুপস্থিতিতে গোকুল বিষম বিব্রত হয়ে পড়ে, কিন্তু অভাবের বিরুদ্ধে লড়তে মোটেই তার অসম্মতি নেই। ভবানীপুরে কুণ্ডু রোডে ঘোট একটি বাড়ি ভাড়া করে দিদি ও ভাগ্নেদের নিয়ে চলে আসে। এই ভাগ্নেদের মধ্যেই জগৎ মিত্র কথাশিল্পীর ছাড়পত্র নিয়ে পরে এসে ভিড়েছিল কভোলে। শিবপুরের একটা বাড়িতে দিদিমণির অংশ ছিল। দিদিমণির বামীর মৃত্যুর পর, যা সচরাচর হয়, দিদিমণির শরিকরা তা দখল করে বসে। অনেক ঝগড়া-বিবাদের পর শরিকদের কবল থেকে দিদিমণির সে-অংশ উদ্ধার করে গোল। সে-বাড়িতে দখল নিতে গোলকে কত ভাবে যে অপমানিত হতে হয়েছে তার আর সীমা সংখ্যা নেই। সেই অংশটা ভাড়া দিয়ে দিদিমণির কিছু আয়ের ব্যবস্থা হয়, কিন্তু পুরোপুরি সংসার চলে না। মামার বাড়িতে থাকতে পাবলিক স্টেজে থিয়েটার দেখার সাহস করতে পারত না গোকুল। সেই গোকুল ভয়ে-ভয়ে অহীন্দ্র চৌধুরীদের Photoplay syndicateএ এসে যোগ দেয়। তখনকার দিনে ফিল্মে যোগ দেওয়া মানেই একেবারে বকে যাওয়া। কিন্তু একেবারে না খেতে পাওয়ার চেয়ে সেটা মন্দ কি? স্টুডিয়োতে আর্টিস্টের কাজ, মইয়ের উপরে উঠে সিন আঁকা, স্টেজ সাজানো-নানারকম শারীরিক ক্লেশের কাজ করতে হত তাকে। শরীর ভেঙে পড়ত, কিন্তু ঘুম হত রাত্রে। বলত, আর কিছু উপকার না হোক, ঘুমিয়ে বাচছি।

কালিদাসবাবু ডক্টরেট নিয়ে ফিরলেন বিদেশ থেকে। গোকুল যেন হাতে সঁদ কপালে সুয্যি পেয়ে গেল। মা-বাপ হারা ভাইয়ে-ভাইয়ে জীবনের নানা সুখ-দুঃখ ও ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অপূর্ব বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। বিদেশে দাদার জন্যে তার উদ্বেগের অন্ত ছিল না। যেমন ভালবাসত দাদাকে তেমনি নীরবে পূজা করত। দাদা ফিরে এলে যেন হাঁপ ছেড়ে বাচল। দাদাকে কুণ্ডু লেনের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে সে দিদিমণি ও তার ছেলেদের নিয়ে চলে এল তাদের শিবপুরের বাড়িতে। সেই শিবপুরের বাড়িতে এসেই সে অসুখে পড়ল।

জরের সঙ্গে পিঠে প্রবল ব্যথা। সেই জ্বর ও ব্যথা নিয়েই সে পথিকের কিস্তি লিখেছে, করেছে জ। ক্রিফের অনুবাদ। কদিন পরেই রক্তবমি করলে, ডাক্তার পরীক্ষা করে বলে দিলে, যক্ষ্মা।

শিবপুরের বাড়িতে আমরা, কল্লোলের বন্ধুরা, প্রায় রোজই যেতাম গোকুলকে দেখতে, তাকে সঙ্গ দিতে, সাধ্যমত পরিচর্যা করতে। অনেক শোকশীতল বিষণ্ণ সন্ধ্যা আমরা কলহাস্যমুখর করে দিয়ে এসেছি। গোকুলকে এক মুহূর্তের জন্যেও আমরা বুঝতে দিই নাই যে আমরা তাকে ছেড়ে দেব। কতদিন দিদিমণির হাতের ডাল-ভাত খেয়ে এসেছি তৃপ্তি করে। দিদিমণি বুঝতে পেরেছেন ঐ একজনই তাঁর ভাই নয়।

একদিন গোকুল আমাকে বললে, আর সব যাক, আর কিছু হোক থোক, স্বাস্থ্যটাকে রেখো, স্বাস্থ্যটাকে ছেড়ে দিও না।

তার স্নেহকরুণ মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

যার স্বাস্থ্য আছে তার আশা আছে। নিশ্বাস ফেলল গোকুল : আর যার আশা আছে তার সব আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *