১৮. শনিবারের চিঠি ও সজনীকান্ত দাস

কোন এক গোরা টিমকে ছ-ছটা গোল দিলে মোহনবাগান। রবি বোস নামে নতুন এক খেলোয়াড় এসেছে ঢাকা থেকে-এ তারই কারুকার্য। সেইবার কি? না, যেবার মনা দত্ত পর পর তিনটে কর্নারশট থেকে হেড করে পর-পর তিনটে গোল দিলে ভি-সি-এল-আইকে? মোটকথা, ঢাকার লোক যখন এমন একটা অসাধ্যসাধন করল তখন মাঠ থেকে সিধে ঢাকায় চলে না যাওয়ার কোনো মানে হয় না। যে দেশে এমন খেলোয়াড় পাওয়া যায় সে দেশটা কেমন দেখে আসা দরকার।

সুতরাং খেলার মাঠ থেকে সোজা শেয়ালদা এসে ঢাকার ট্রেন ধরল তিনজন। দীনেশরঞ্জন, নজরুল আর নৃপেন। সোজা বুদ্ধদেবের বাড়ি। সেইখানে অতিরিক্ত আকর্ষণ, আমি বসে আছি আগে থেকে।

দে গরুর গা ধুইয়ে—মোহনবাগান-মাঠের সেই চীৎকার বুদ্ধদেবের ঘরের মধ্যে ফেটে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে প্রতিনিনাদ।

সেই সব ছন্নছাড়ারা আজ গেল কোথায়? যারা বলত সমস্বরে–

আমরা সুখের স্ফীত বুকের ছায়ার তলে নাহি চরি
আমরা দুখের বক্র মুখের চক্র দেখে ভয় না করি।
ভগ্ন ঢাকে যথাসাধ্য বাজিয়ে যাব জয়বাদ্য
ছিন্ন আশার ধ্বজা তুলে ভিন্ন করব নীলাকাশ,
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।

ছিল ভৃগুকুমার গুহ। স্বাস্থ্য নেই স্বাচ্ছন্দ্য নেই, অথচ মধুবর্ষী হাসির প্রস্রবণ। বিমর্ষ হবার অজস্র কারণ থাকলেও যে সদানন্দ। যদি বলতাম, ভৃগু, একটু হাসো তো, অমনি হাসতে সুরু করত। আর সে-হাসি একবার সুরু হলে সহজে থামতে চাইত না। প্রবন্ধ লেখবার ঝকঝকে কলম ছিল হাতে, কিন্তু যা সবচেয়ে বেশি টানত তা তার হৃদয়ের চাকচিক্য। ছিল অনিল ভটচাজ। নিজের কল্পনার কৌশলে যে দুস্থতাকেও শিল্পমণ্ডিত করে তুলেছে! বাঁশি বাজায় আর সিগারেটের ধোঁয়ায় থেকে-থেকে চক্ররচনা করে। মনোঞ্জ-মধুর সঙ্গস্পর্শের সুধা বিলোয়। ছিল সুধীশ ঘটক। যেন কোন স্বপ্নলোকে নিরুদ্দেশের অভিযাত্রী। সব যেন লক্ষ্মীছাড়ার সিংহাসনের যুবরাজ।

যৌবরাজ্যে বসিয়ে দে মা লক্ষ্মীছাড়ার সিংহাসনে
ভাঙা কুলোয় করুক পাখা তোমার যত ভৃত্যগণে।
দগ্ধভালে প্রলয়শিখা দিক না এঁকে তোমার টীকা
পরাও সজ্জা লজ্জাহারা জীর্ণক ছিন্নবাস;
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।

ভাই অচিন্ত্য, বহুকাল পরে আজ বিকেলে তোমার চিঠি পেলাম! আজ সকালেই তোমাকে এক কার্ড লিখেছি, তবু আবার না লিখে পারলাম না।

প্রগতি নিশ্চয়ই পেয়েছ—আগাগোড়া কেমন লাগল জানিয়ো। তোমার কাছ থেকে প্রগতি যে স্নেহ ও সহায়তা পেল তার তুলনা নেই। এই ব্যাপারে আমরা কত নিঃস্ব ও নিঃসহায়—ভেবে ভেবে এক-এক সময় আশ্চর্য লাগে। লাভের মধ্যে আমাদের নিরবচ্ছিন্ন দুশ্চিন্তা, প্রচুর আর্থিক ক্ষতি ও আরো প্রচুর লোকনিন্দা—একটি লোক নেই যে সত্যিসত্যি আমাদের আদর্শের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। তবু কেন চালাচ্ছি? আমাদের মধ্যে যে surplus energy আছে, তা এইভাবে একটা outlet খুঁজে নিয়েছে। খেয়ে-পরে-ঘুমিয়ে নিশ্চিন্তচিত্তে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে পারব না, বিধাতা আমাদের এ অভিশাপ দিয়েছেন। তাই একটা কিছু করতে হয়, কোনো একটা নেশায় নিজেদের ডুবিয়ে রাখতে হয়। আমার তো মনে হয় আমাদের জীবনে প্রগতির প্রয়োজন ছিল। যে শক্তি আমাদের ভিতর আছে তার যথোপযুক্ত ব্যবহার না করলেই অন্যায় হত। তবে অর্থসংকটটাই বিশেষ করে পীড়াদায়ক। হাত একেবারে বিক্ত—কি করে চলবে জানিনে। তবু আশা করতে ছাড়িনে। তবু দমে যাই না। কেমন যেন বিশ্বাস জন্মেছে যে প্রগতি চলবেই—যেহেতু চলাটা আমাদের পক্ষে দরকার।

তুমি যদি বিচিত্রায় চাকরি পাও, তাহলে খুবই সুখের কথা। অর্থের দিকটাই সবচেয়ে বিবেচনা করবার। পঞ্চাশ টাকা এমন মন্দই বা কি। তার উপর টিউশনি তো আছেই। তবে বিচিত্রায় একটা anti-আধুনিক feeling আছে, কিন্তু তাতে কতটুকুইবা যাবে আসবে? তোমার ল final কবে? ওটা পাশ করলে পর স্থায়ী ভাবে একটা কিছু কাজ করলেই নিশ্চিন্ত হতে পারো।

তোমার চিঠিটা পড়ে অবধি আমার মন কেমন যেন ভারি হয়ে আছে-কিছু ভালো লাগছে না। শুধু ভাবছি, এও কি করে সম্ভব হয়? তুমি যেসব কথা লিখেছ তা যেন কোনো নিতান্ত conventional বাঙলা উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদ। জীবনটাও কি এমনি মামুলি ভাবে চলে? আমাদের গুরুজনেরা আমাদের যা বলে উপহাস করেন, তাঁদের সেই সংস্কারাচ্ছন্ন যুক্তিই কি টিকে থাকবে? আমাদের সমস্ত idealism সব স্বপ্নই কি মিথ্যা? দান্তে কি পাগল ছিল? আর শেলি বোকা? পৃথিবীতে কি কোথাও কবিতা নেই? কবিতা যারা লেখে তারা কি এমনি ভিন্ন জাতের লোক যে তারা সবাইকে শুধু ভুলই বুঝবে? কবির চোখে পরমসুন্দরের যে ছায়া পড়েছে আর কেউ কি তা দেখতে পাবে না। পৃথিবীর সব লোকই কি অন্ধ?

কী প্রচুর বিশ্বাস নিয়ে আমরা চলি, এর জন্য কত ত্যাগস্বীকার করি, কত দুঃখবরণ করে নিই। এ কথা কি কখনো ভাবার বে এর প্রতিদান এই হতে পারে। আমরা যে নিজেকে একান্ত ভাবে ঢেলে দিয়ে ফতুর হয়ে থাকি সে দেয়ার কোনো কূলকিনারা থাকে না। সেই গান যদি অগ্রাহ্য হয়, তাহলে আবার নতুন করে জীবন গড়ে তুলতে পারি এমন ক্ষমতা আমাদের থাকে না। এটা কি আমাদের প্রতি মস্ত অবিচার করা হয় না—অন্যের জীবনকে এমন ভাবে নিষ্ফল করে দেয়ার কি অধিকার আছে? ইতি তোমাদের বুদ্ধদেব

 

একবার একসঙ্গে ফিরলাম দুজনে ঢাকা থেকে বুদ্ধদেব আর আমি। ইস্টিমারে সাধারণ ডেকের যাত্রী—সে ডেকে পাশে বাক্স-তোরঙ্গ রেখে সতরঞ্চি বিছিয়ে হয় ঘুম, নয় তো তাসখেলাই একমাত্র সুকাজ। কিন্তু শুদ্ধ গল্প করেই যে রাশি-রাশি মুগ্ধ মুহূর্ত অপব্যয় করা যায় তা কে জানত। সে গল্পের বিষয় লাগে না, প্রস্তুতি লাগে না। পরিবেশ লাগেনা। যা ছিল আজেবাজে, অর্থাৎ আজ-বাদে কাল যা বাজে হয়ে যাবে, তাতেই ছিল চিরকালের বাজনা।

একটানা জলের শব্দ—আমাদের কথার তোড়ে তা আর লক্ষ্যের মধ্যে আসছে না। কিন্তু স্টিমার যখন-ভোঁ দিয়ে উঠত, তখন একটা গম্ভীর চমক লাগত বুকের মধ্যে। যতক্ষণ না ধ্বনিটা শেষ হত কথা বন্ধ করে থাকতাম। কোনো স্টেশনের কাছাকাছি এলে বা ছেড়ে যাবার উপক্রম করলেই স্টিমার বাঁশি দিত। কিন্তু যখনই বাঁশি বাজত, মনে হত এটা যেন চলে যাবার সুর, ছেড়ে যাবার ইসারা। ট্রেনের সিটির মধ্যে কি-রকম একটা কর্কশ উল্লাস আছে, কিন্তু স্টিমারের বাঁশির মধ্যে কেমন একটা প্রচ্ছন্ন বিষাদ। স্থির স্থলকে লক্ষ্য করে চঞ্চল জলের যে কান্না, এ যেন তারই প্রতীক।

আমার বাসা তখন তিরিশ নম্বর গিরিশ মুখার্জি রোড। সংক্ষেপে তিরিশ গিরিশ। তারই এক তলার এক ছোট্ট কুঠুরিতে আমি সর্বময়। সেই কৃশ-কৃপণ ঘরেই উদার হৃদ্যতায় আতিথ্য নিয়েছে বন্ধুরা। বুদ্ধদেব আর অজিত, কখনো বা অনিল আর অমলেন্দু। সেই ছোট বন্ধ ঘরের দেওয়ার যে কি করে সরে-সরে মিলিয়ে যেত দিগন্তে, কি করে সামান্য শূন্য বিশাল আকাশ হয়ে উঠত, আজ তা স্বপ্নের মত মনে হয়। হৃদয় যে পৃথিবীর সমস্ত স্থানের চেয়ে বিস্তারময় তা কে না জানে।

 

ভাই অচিন্ত্য,

নারায়ণগঞ্জে কয়েক ঘণ্টা halt করে আজ সন্ধ্যায় বাড়ি এসে পৌঁচেছি। টুনু আগেই এসেছিল। মা আমার সঙ্গে এলেন না, আপাতত তিনি দিনকতক নারায়ণগঞ্জেই কাটাবেন। এতে আমারই হল মুস্কিল। মা না থাকলে এ বাড়ি আমার কাছে শূন্য, অর্থহীন। শারীরিক অসুবিধে, আয়াস ইত্যাদি ছাড়াও মা-র অভাব আমার কাছে অনেকখানি। মা না থাকলে মনে হয় না যে এ বাড়িতে আমার সত্যিকার স্থান আছে। ছুটির বাকি কটা দিন খুব যে সুখে কাটবে এমন মনে হচ্ছে না। এখন আপশোষ হচ্ছে এত শিগগির চলে এলাম বলে। ভাবছি, আরো কয়েকটা দিন কাটিয়ে এলে কারুর কিছু ক্ষতি হত না। এক তোমার ছাড়া;–তা তোমার ওপর জোর কি আবদার চলে বই কি। কলকাতায় এই দিনগুলি যে কি ভরপুর আনন্দে কেটেছে এখন বুঝতে পারছি। তোমাদের প্রত্যেকের কথা কী গভীর স্নেহের সঙ্গেই না স্মরণ করছি। বিশেষ করে সুধীশকে মনে পড়ছে। আসবার সময় স্টেশনে ওব মুখোনা ভারি মলিন দেখেছিলাম।

ঢাকা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে—পথঘাট নির্জন। পরিমল বাড়ি চলে গেছে, থাকবার মধ্যে অমল আর অনিল। সন্ধ্যেবেলায় ওদের সঙ্গে খানিকক্ষণ ঘুরলাম—টুনুও ছিলো। এখানে এখন কিছুই যেন করার নেই। আমার ঘরটা নোঙরা, অগোছাল হয়ে আছে—মার হাত না পড়লে শোধরাবে না। এখন পর্যন্ত জিনিসপত্রও খুলিনি–ভারি ক্লান্ত লাগছে অথচ ঘুম আসছে না। কাল দিনের বেলায় সব সিজিলমিছিল করে গুছিয়ে বসতে হবে। তারপর একবার কাজের মধ্যে ডুব দিতে পারলেই হু-হু করে দিন কেটে যাবে।

কল্লোলের সবাইকে আমাদের কথা বলো। তোমাদের সঙ্গে আবার যে কবে দেখা হবে তারি দিন গুনছি। ইতি। চিরানুরক্ত বুদ্ধদেব

 

ভাই অচিন্ত্য,

  1. R, স্বদেশী-বাজারের গল্প পড়ে আমাকে চিঠি লিখেছেন গল্প চেয়ে। প্রত্যুত্তরে আমি একটি গল্প পাঠিয়ে দিয়েছি। টাকার কথা খোলাখুলি লিখেছি—সেটাই ভালো। লেখাটা in itself আর আমার life-এর কোন point নয়; অর্থাগমের সম্ভাবনা না দেখলে আর লিখবো না-লিখতে ইচ্ছা করে না। এই জন্যই মাসখানেকের মধ্যে এক লাইনও কবিতা লিখিনি। আত্মসমর্থনকল্পে D. R.-কে অনেক কথা লিখতে হয়েছে। আশা করি সে চিঠি ও গল্প তুমি পড়েছ।

এখন পর্যন্ত যে ব্যবস্থা আছে তাতে ২০শে ডিসেম্বরের মধ্যেই কলকাতায় গিয়ে উপস্থিত হতে পারবো, আশা করি। কলেজে ছুটি হবার আগেই পালাবো; কারণ তা না হলে অসম্ভব ভিড়ে পথিমধ্যেই প্রাণনাশের আশঙ্কা আছে। ক্যাপটেন ঘোষ নেবুতলায় বাসা নিয়েছেন, তাঁর ওখানে এবার উঠবে। তোমার ল-র কথা আমিও ভেবে রেখেছি। রোজ বিকালে দেখা হলেই চলবে। ভৃগুও কলকাতায় আসবে। টুনুর ঠিক নেই, ওর first class পাওয়া এখন সব চেয়ে দরকার। শীতের ছোট দিন–মিষ্টি রোদ—দুচারজন বন্ধু, সময়ের আবার ডানা গজাবে, ছোটখাট জিনিস নিয়ে খুশির আর অন্ত থাকবে না।

প্রগতি তুলে দিলাম। অসম্ভব–অসম্ভব–আর চালানো একেবারে অসম্ভব। আমার ইহকাল-পরকালে, অন্তরে-বাহিরে, বাক্যে-মনে আর আপনার বলে কিছু বইলো না। কত আশা নিয়েই যে সুরু করেছিলাম, কত উচ্চাভিলাষ, স্নেন, আনন্দ—কী প্রকাণ্ড idealismই যে এর পেছনে ছিলো! যাক, এখন বাজারে যা কিছু ধার আছে তা একটু-একটু করে শোধ করে উঠতে পারলেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচি। অত্যন্ত প্রিয়জনও দীর্ঘকাল বিষম রোগে ভুগলে যেমন তার মৃত্যুই বাঞ্ছনীয় হয়ে ওঠে, প্রগতিও শেষের দিকে তেমনি অসহ্য হয়ে উঠেছিল। প্রগতির মৃত্যুসংবাদ কলকাতার ব্রডকাস্ট করে দিয়ো। তুমি আমার প্রাণপূর্ণ ভালোবাসা নাও। ইতি। তোমার বুদ্ধদেব

 

অচিন্ত্য,

শেষ পর্যন্ত প্রগতি বোধহয় উঠে গেলো না। তুমি বলবে অমন প্রাণান্ত করে চালিয়ে লাভ কি? লাভ আছে।

পরিমলবাবুর (ঘোষ) সঙ্গে আজ কথা কয়ে এলাম। তিনি পঁচিশ টাকার মত মাসিক সাহায্য জুটিয়ে দিতে পারবেন, আশ্বাস দিলেন। আমি কলকাতায় দশের ব্যবস্থা করেছি। সবসুদ্ধ পঞ্চাশ টাকার মত দেখা যাচ্ছে। আরো কিছু পাব আশা করা যাচ্ছে। তার ওপর বিজ্ঞাপনে দুটো-পাঁচটা টাকা কি আর না উঠবে। উপস্থিত ঋণ শোধ করবার মত উপায়ও পরিমলবাবু বাংলে দিলেন। এবং কাগজ যদি চলেই, কিছু ঋণ থাকলে যায় আসে না।

তোমার কাছে কিছু সাহায্য চাই। পাঁচটা টাকা তুমি সহজেই spare করতে পারো। সম্পূর্ণ নিজেদের একটা কাগজ থাকা-সেটা কি কম সুখের? আধুনিক সাহিত্যের আন্দোলনটা আমরা কয়েকজনে মিলে control করছি, এ কথা ভাবতে পারার luxury কি কম? কি তোমার সঙ্গে argue করেই বা কি লাভ? তোমার কাছে শুধু মিনতি করতে পারি।

মনে হচ্ছে কাকে যেন হারাতে বসেছিলাম, ফিরে পেতে চলেছি। শরীর যদিও অত্যন্ত খারাপ, মন ভালো লাগছে। কিন্তু তুমি আমাকে নিরাশ করে না। With love, B.।

 

কল্লোল থেকে ক্কচিৎ যেতাম আমরা চীনে পাড়ার রেস্তোরাঁতে। তখন নানকিন ক্যাণ্টন আর চাঙোয়া তিনটেই চীনে-পাড়ার মধ্যেই ছিল, একটাও বেরিয়ে আসেনি কুলচ্যুত হয়ে। ব্ল্যাক আর বার্ন দুটো কথাই কদাকার, কি ব্ল্যাকবার্ন একত্র হয়ে যখন একটা গলির সঙ্কেত আনে তখন স্বপ্নে-দেখা একটা রূপকথার রাজ্য বলে মনে হয়।

শহরের কৃত্রিম একঘেয়েমির মধ্যে থেকে হঠাৎ যেন একটা ছুটির সংবাদ। রুক্ষ রুটিনের পর হঠাৎ যেন একটু সুন্দর অসম্বদ্ধতা—সুন্দর অযত্নবিন্যাল। দেশের মধ্যে বিদেশ–কর্তব্যের মধ্যখানে হঠাৎ একটু দিবাস্বপ্ন।

এলেই চট করে মনে হয় আর কোথাও যেন এসেছি। শুধু আলাদা নয়, বেশ একটু অচেনা-অচেনা। সমস্ত শহরের ছুটোছুটির ছন্দের সছে এখানকার কোনো মিল নেই। এখানে সব যেন ঢিলে-ঢালা, ঢিমে-তেতালা। খাটো-খাটো পোশাকে বেঁটে-বেঁটে কতকগুলি লোক, আর পুতুলের মত অগুনতি শিশু। ভাসা-ভাসা চোখে হাসি-হাসি মুখ! একেকটা হরফে একেকটা ছবি এমনি সব চিত্রিত সাইনবোর্ডে বিচিত্র দোকান। ভিতরের দিকটা অন্ধকার, যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন, কারা হয়ত ঠকঠাক কাজ করছে আপন মনে, কারা হয়তো বা চুপচাপ জুয়ো খেলছে গুম হয়ে আর দীর্ঘ নলে প্রচণ্ড ধূমপান করছে। যারা চলেছে তারা যেন ঠিক চলে যাচ্ছে না, ঘোরাফেরা করছে। ভিড়ে-ভাড়ে যতটা গোলমাল হওয়া দরকার তার চেয়ে অনেক নিঃশব্দ। হয়ত কখনো একটা রিকশার টুং-টাং, কিংবা একটা ফিটনের খুঁটখাট। সবই যেন আস্তে-সুস্থে গড়িমসি করে চলেছে। এদের চোখের মত গ্যাসপোস্টের আলোও যেন কেমন ঘোলাটে, মিটিমিটি। ভয়ে পা-টা যেন একটু ছমছম করে। আর ছমছম করে বলেই সব সময়ই এত নতুন নতুন মনে হয়। কোনো জিনিসের নতুনত্ব বজায় রাখতে পারে শুধু দুটো জিনিস—এক ভয়, দুই ভালোবাসা।

সরু গলি, আবছা আলো, অকুলীন পাড়া,অথচ এরি মধ্যে জাঁকালো রেস্তরাঁ, সাজসজ্জার ঢালাচালি। হাতির দাঁতের কাঠিতে চাউ-চাউ খাবে, না সপ-সুই? না কি আস্ত-সমস্ত একটি পক্ষীনীড়? এ এমন একটা জায়গা যেখানে শুধু জঠরেরই খিদে মেটে না, চিত্তের উপবাস মেটে—বে চিত্ত একটু সুন্দর কবিতা, সুন্দর বন্ধুতা, আর সুন্দর পরিবেশের জন্যে সমুৎসুক।

তখন একটা বাগভঙ্গি চলেছে আধুনিকদের লেখায়। সেটা হচ্ছে গল্পে-উপন্যাসে ক্রিয়াপদে বর্তমানকালের ব্যবহার। এ পর্যন্ত রাম বললে, রাম খেল, রাম হাসল ছিল—এখন সুরু হল রাম বলে, রাম খায়, রাম হাসে। সর্বনাশ, প্রচলিত প্রথার ব্যতিক্রম যে, শনিবারের চিঠি ব্যঙ্গ শুরু করল। অথচ সজনীকান্তর প্রথম উপন্যাস অজয়ে এই বর্তমান কালের ক্রিয়াপদ। একবার এক ডাক্তার বসন্তের প্রতিষেধকরূপে টিকে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন চালায়। সভা করে-করে সকলকে জ্ঞান বিলোয়, টিকের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলে। এমনি এক টিকাবর্জন সভায় বক্তৃতা দিচ্ছে ডাক্তার, অমনি ভিড়ের মধ্যে থেকে কে চেঁচিয়ে উঠল। তুমি তোমার আস্তিন গুটোও দেখি। আন্তিন গুটিয়ে দেখা গেল ডাক্তারের নিজের হাতে টিকে দেওয়া।

তেমনি আরেকটা চলেছিল বানানভঙ্গি। সংস্কৃত শব্দের বানানকে বিশুদ্ধ রেখে বাংলা বা দেশজ শব্দের বানানকে সরল করে আনা। নীচ যে অর্থে নিকৃষ্ট তাকে নীচই রাখা আর যে অর্থে নিম্ন তাকে নিচে ফেলা। বাংলা বানানের ক্ষেত্রে ণত্ব-ষত্ব বিধানকে উড়িয়ে দেওয়া—তিনটে স-কে একীভূত করার সূত্র খোঁজা। রবীন্দ্রনাথ যে কেন চষমা বা জিনিষ বা পূষতূ লিখবেন তা তো বুঝে ওঠা যায় না। রানি বলতেই বা মূর্ধন্য ণ লোপ করবেন তো দীর্ঘ ঈ-কার কেন লোপ করবেন না তা কে বলবে। কিন্তু সব চেয়ে পীড়াদায়ক হয়ে উঠল মূর্ধন্য ষ-এর সঙ্গে ট-এর সন্মিলন। নষ্ট-ভ্রষ্ট স্পষ্ট করে লেখ, আপত্তি নেই, কিন্তু স্টিমার স্টেশন অগাস্ট ক্রিস্টমাসের বেলায় মূর্ধন্য ষ-এ ট দেবার যুক্তি কি? একমাত্র যুক্তি দন্ত্য স-এ ট-র টাইপ নেই ছাপাখানায়—যেটা কোনো যুক্তিই নয়। টাইপ নেই তো দন্ত স-য় হসন্ত দিয়ে লেখা যাক। যথা স্‌টিমার, স্‌টেশন স্‌ট্যাম্প আর স্‌টেথিসকোপ। নিন্দুকেরা ভাবলে এ আবার কী নতুন রকম সুরু করলে। লাগো হসন্তের পিছনে। হসন্ত খসিয়ে দিয়ে তারা কথাগুলোকে নতুন রূপসজ্জা দিলে—সটিমার আর সটেশন—আহা, কি সটাইল রে বাবা!

সজনীকান্ত একদিন কল্লোল-আপিসে এসে উপস্থিত হল। আড্ডা জমাতে নয় অবিশ্যি, কখানা পুরানো কাগজ কিনতে নগদ দামে। উদ্দেশ্য মহৎ, সাধ্যমত প্রচার করতে কাউকে। ভাবখানা এমন একটু প্রশ্রয় পেলেই যেন আড্ডার ভোজে পাত পেড়ে বসে পড়ে। আসলে সজনীকান্ত তো কল্লোলেরই লোক, ভুল করে অন্য পাড়ায় ঘর নিয়েছে। এই বোয়াকে না বসে বসেছে অন্য রোয়াকে। তেমনি দীনেশরঞ্জনও শনিবারের চিঠির হেড পিয়াদা! শনিবারের চিঠির প্রথম হেডপিস, বেত্রহন্ত ষণ্ডামার্কের ছবিটি তারই আঁকা। সবই এক ঝাঁকের কই, এক সানকির ইয়ার, শুধু টাকার এপিঠ আর ওপিঠ। নইলে একই কর্মনিষ্ঠা। একই তেজ। একই পুরুষকার।

প্রেমেন শুয়ে ছিল তক্তপোষে। বললুম, আলাপ করিয়ে দিই—

টানা একটু প্রশ্রয় দিলেই সজনীকান্তকে অনায়াসে চেয়ার থেকে টেনে এনে শুইয়ে দেয়া যেত তক্তপোষে–অঢেল আড্ডার ঢিলেমিতে। কিন্তু কলির ভীমের মত প্ৰেমেন হঠাৎ হুমকে উঠল কে সজনী দাস?

এ একেবারে দরজায় খিল চেপে ঘর বন্ধ করে দেয়া। আলো নিবিয়ে মাথার উপরে লেপ টেনে দিয়ে ঘুমুনো। প্রশ্নের উত্তর থাকলেও প্রশ্নকর্তার কান নেই। আবার শুয়ে পড়ল প্রেমেন।

সজনীকান্ত হাসল হয়তো মনে মনে। ভাবখানা, কে সজনী দাস, দেখাচ্ছি তোমাকে।

টেকনিক বদলাল সজনীকান্ত। অত্যল্পকালের মধ্যে প্রেমেনকে বন্ধু করে ফেলল।

সঙ্গে-সঙ্গে শৈলজা। ক্রমে-ক্রমে নজরুল। পিছু-পিছু নৃপেন।

শক্তিধর সজনীকান্ত! লেখনীতে তো বটেই, ব্যক্তিত্বেও।

পুরীতে বেড়াতে গিয়েছি, সঙ্গে বুদ্ধদেব আর অজিত। একদিন দেখি সমুদ্র থেকে কে উঠে আসছে। পুরাণে-মহাভারতে দেখেছি কেউ কেউ অমনি উদ্ভূত হয়েছে সমুদ্র থেকে। তাদের কারুর হাতে বিষভাণ্ডও হয়তো ছিল। কিন্তু এমনটি কাউকে দেখব তা কল্পনাও করতে পারিনি। আর কেউ নয়, স্বয়ং সজনীকান্ত।

একই হোটেলে আছি। প্রায় একই ভোজনভ্রমণের গণ্ডীর মধ্যে। একই হাস্যপরিহাসের পরিমণ্ডলে।

সজনীকান্ত বললে, শুধু বিষভাণ্ড নয়, সুধাপাত্রও আছে। অর্থাৎ বন্ধু হবারও গুণ আছে আমার মধ্যে।

তাতে সন্দেহ কি, কিন্তু আমরাও যদি বন্ধু হয়ে যাই তবে ব্যবসা চলবে কি দিয়ে? কাকে নিয়ে থাকবে? গালাগালের মধ্যে ব্যক্তিবিদ্বেষ একটু মেশাতে হবে তো? বন্ধু করে ফেললে ঐটুকু ঝাঁজ আনবে কোত্থেকে? তোমার ব্যবসায় মন্দা পড়বে যে।

কথাটা ঠিকই বলেছ। তোমাদের সাহিত্য, আমাদের ব্যবসা। সাহিত্যিকরা রাজহাঁস আর ব্যবসায়ীরা পাতিহাঁস! পাতিহাঁসের খাদ্য জল-কাদা, রাজহাঁসের খাদ্য দুধ। কিন্তু গালাগাল সইতে পারবে তো?

গালাগাল দিচ্ছ কে বলছে? দস্যু রত্নাকরও প্রথমে মরা মরা বলেছিল। মরার বাড়া গাল নেই। সবাই ভেবেছিল বুঝি গাল দিচ্ছে। কিন্তু, জানো তো, ম মানে ঈশ্বর, আর রা মানে জগৎ–আগে ঈশ্বর পরে জগৎ। তরে গেল রত্নাকর। অর্জুন যখন শ্রীকৃষ্ণের স্তব করলেন, প্রথমেই বললেন, অচিন্ত্যং অব্যক্তং অনন্তং অব্যয়ং! আর বুদ্ধদেব–তিনি তো ভগবান তথাগত-নামোচ্চারণভেষজৎ তুমিও পার হয়ে যাবে দেখো।

আর তোমরা?

আমরা তো ভালো দলেই আছি। রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী থেকে সুরু করে নজরুল ইসলাম পর্যন্ত সবাইর সঙ্গে আমরাও নিন্দার এক পঙক্তিতে বসেছি—আমাদের ভয় নেই।

তথাস্তু! তবে একটা নব সাহিত্য-বন্দনা শোন :

জয় নবসাহিত্য জয় হে
জয় শাশ্বত, জয় নিত্যসাহিত্য জয় হে।
জয়, অধুনা-প্রবর্তিত বঙ্গে
রহ চিরপ্রচলিত রঙ্গে
শ্রমিকের, ধনিকের, গণিকার, বণিকের
সাম্যের কামের, শাশ্বত ক্ষণিকের–
জড় ও পাষাণের ভস্ম ও শ্মশানের
আঁস্তাকুড়ে যাহা ফেলি উদ্বৃত্ত হে
সকল অভিনব-সাহিত্য জয় হে।
প্রগতি-কল্লোল-কালিকলম
অন্তর ক্ষতেতে লেপিলে মলম
রসের নব নব অভিব্যক্তি
উত্তরা ধূপছায়া আত্মশক্তি–
প্রেম ও পীরিতের নিত্য গদ্‌গদ সলিলে অভিষিক্ত
জয় নব সাহিত্য জয় হে
জয় হে জয় হে জয় হে
প্রাচীন হইল রসাতলগত, তরুণ হল নির্ভয় হে
জয় হে জয় হে জয় হে।

 

হেম বাগচির সঙ্গে আলাপ হয় বলাই সিঙ্গি লেন-এর মেসে। জীবনানন্দের বেলায় যেমন, ওর বেলায়ও ওর ঠিকানা খুঁজে নিয়ে ওকে বার করি। নতুন-লেখক বা শিল্পী খুঁজে নিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করাতে দারুণ উৎসাহ, বিশেষত সে যদি মর্মজ্ঞ হয়। হেম হচ্ছে তেমন কবি যার সান্নিধ্যে এসে বসলে মনে হয় নিবিড়স্নিগ্ধ বৃক্ষছায়াতলে এসে বসেছি। সবল-বিশাল চেহারা, চোখ দুটি দীর্ঘ ও শীতল—স্বপ্নময়। তীব্রতার চেয়ে প্রশান্তি, গাঢ়তার চেয়ে গভীরতার দিকে দৃষ্টি বেশি। প্রথম যখন ওকে পাই তখন ওর জীবনে সদ্য মাতৃবিয়োগব্যথার ছায়া পড়েছে—সেই ছায়ায় ওর জীবনের সমস্ত ভঙ্গিটি কমনীয়। সেই লাবণ্যটি সমস্ত জীবনে সে মেহ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে লালন করেছে, তাই তার কবিতায় এই শুচিতা এই স্নিগ্ধতা। হাডিঞ্জ হস্টেলে থেকে হেম যখন ল পড়ে তখন প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় চারতলার উপরে তার ঘরে আড্ডা দিতে গিয়েছি, দ্বৈত কলকূজন ছেড়ে পরে চলে এসেছি বহুস্বননের কল্লোলে। কোনো উদ্দামতায় হেম নেই, সে আছে নির্মল স্থৈর্যে, কোনো তর্কতীক্ষ্ণতায় সে নেই; সে আছে উত্তপ্ত উপলব্ধিতে। নিকষকষিত সোনার মতই সে মহার্ঘ।

কিন্তু প্রবোধকুমার সান্যাল অন্য জাতের মানুষ। ক্ষিতি-অপ-তেজ হয়তো ঠিকই আছে, কিন্তু মরুৎ আর ব্যোম যেন অন্য জগতের। মুক্ত হাওয়ার মুক্ত আকাশের মানুষ সে, আর সেই হাওয়া আর আকাশ আমাদের এই বদ্ধ জলার জীবনে অল্পদৃষ্ট। তাকে খুঁজে নিতে হয় না, সে আপনা থেকেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। কল্লোলে প্রথম বছরেই তার গল্প বেরোয়, কিন্তু সশরীরে সে দেখা দেয় চতুর্থ বর্ষে। আর দেখা দেওয়া মাত্রই তার সঙ্গে রক্তের রাখিবন্ধন হয়ে গেল। প্রবোধের চরিত্রে একটা প্রবল বন্যতা ছিল, সেই সঙ্গে ছিল একটি আশ্চর্য স্থৈর্য ও দৃঢ়তার প্রতিশ্রুতি। বাসা ভেঙে দিতে পারে প্রবোধ, কিন্তু কোনোদিন আশ্রয় তুলে দেবে না কিছুতেই। বিচ্ছেদ আছে প্রবোধের কাছে, কিন্তু বিয়োগ নেই। সমস্ত চাঞ্চল্য-চাপল্য সত্ত্বেও তার হৃদয়ে একটা বলিষ্ঠ ঔদার্য আছে, সমস্ত উত্থানে-পতনে তার মধ্যে জেগে আছে ঘরছাড়া সদাতৃপ্ত সন্ন্যাসী। দুর্বিপাকে পড়েও তার এই উদারতা ঘোচ না। শত ঝড়েও মুছে যায় না তার মনের নীলাকাশ। আর সকলের সঙ্গে বুদ্ধির ও বিদ্যার যোগাযোগ, প্রবোধের সঙ্গে একেবারে অন্তরের সংস্পর্শ। ওর মাঝে মেঘ এলেও মলিনতা আসে না। রমতা সাধু আর বহতা জল, মানে যে সাধু ঘুরে বেড়ায় আর যে জলে নিরন্তর স্রোত বয়, তা কখনো মলিন হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *