১৯৫২। বয়স ৫৩ বছর
১৯৪৩-এর ৩০ অক্টোবর সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩)-এর জন্মতিথি উদযাপনের মধ্যদিয়ে ‘সিগনেট প্রেসের’ সূচনা হয়। ১৯৫২ সালে প্রধানত নরেশ গুহ (জন্ম ১৯২৩)-এর উদ্যোগে জীবনানন্দের পুরনো কাব্যগ্রন্থগুলি যা দীর্ঘকাল বাক্সবন্দি হয়ে পড়েছিল, সিগনেটের মাধ্যমে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। পুরাতন কবিতার বইগুলো দ্রুত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে দেখে জীবনানন্দ অভিভূত হয়ে পড়েন।
জীবনানন্দ দিলীপকুমারকে লিখেছিলেন—
‘অনেকদিন থেকেই ভেবেছি সিগনেট প্রেস আমার একটি নতুন কবিতার বই বার করলে ভালো হয়; আপনারা এখন হয়তো নানা কাজ নিয়ে ব্যস্ত, পরে— অবসর মতো বার করলে আনন্দিত হবো।’ [‘চিঠির ফাইল’, ‘বিভাব’, দিলীপকুমার গুপ্ত, শীত ১৩৮৬, পৃ. ৪৮]।
নরেশ গুহ তখন সিগনেটের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর সঙ্গে জীবনানন্দের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। নরেশ গুহের তত্ত্বাবধানে এবং নির্বাচনে ‘বনলতা সেন’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ নিল সিগনেট প্রেস। কবিতা নির্বাচনে জীবনানন্দও নরেশ গুহকে সহায়তা করেছিলেন। এই প্রেস থেকে ‘বনলতা সেন’ বহু পরিবর্তিত আকারে প্রকাশিত হল (শ্রাবণ ১৩৫৯)।
‘বনলতা সেন’ : দ্বিতীয় সংস্করণ [প্রথম সিগনেট সংস্করণ], শ্রাবণ ১৩৫৯ (১৯৫২)। প্রকাশক : দিলীপকুমার গুপ্ত, সিগনেট প্রেস, ১০/২ এলগিন রোড, কলকাতা-২০। মুদ্রাকর : প্রভাতচন্দ্র রায়, শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেস লিঃ, ৫ চিন্তামণি দাস লেন। প্রচ্ছদপট : সত্যজিৎ রায়। প্রচ্ছদপট মুদ্রক : গণেশ অ্যান্ড কোম্পানি, ৭/১ গ্রান্ট লেন। বোর্ড বাঁধাই। মূল্য : দুই টাকা। ডিমাই ৮ পেজি, পৃ. ৮৩। কবিতার সংখ্যা : ৩০।
কবিতার শিরোনাম :
১. বনলতা সেন, ২. কুড়ি বছর পরে, ৩. হাওয়ার রাত, ৪. আমি যদি হতাম, ৫. ঘাস, ৬. হায় চিল, ৭. বুনো হাঁস, ৮. শঙ্খমালা, ৯. নগ্ন নির্জন হাত, ১০. শিকার, ১১. হরিণেরা, ১২. বিড়াল, ১৩. সুদর্শনা, ১৪. অন্ধকার, ১৫. কমলালেবু, ১৬. শ্যামলী, ১৭. দুজন, ১৮. অবশেষে, ১৯. স্বপ্নের ধ্বনিরা, ২০. আমাকে তুমি, ২১. তুমি, ২২. ধান কাটা হয়ে গেছে, ২৩. শিরীষের ডালপালা, ২৪. হাজার বছর শুধু খেলা করে, ২৫. সুরঞ্জনা, ২৬. মিতভাষণ, ২৭. সবিতা, ২৮. সুচেতনা, ২৯. অঘ্রাণ প্রান্তরে ৩০. পথহাঁটা।
কবিতাগুলোর রচনা কাল : ১৩৩২ থেকে ১৩৪৬ বঙ্গাব্দ। ১৯২৫ থেকে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ। সিগনেট প্রেস কর্তৃক প্রচারিত টুকরো কথা’য় ‘বনলতা সেন’ কাব্যের বিজ্ঞাপন লেখা হয় এভাবে—
‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’। আধুনিক বিখ্যাতদের মধ্যে নির্জনতম কবি জীবনানন্দ দাশ এবং ‘বনলতা সেন’ই তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলন। প্রায় দশ বছর আগে বারোটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত এই বই বৃহত্তর পাঠক মহলে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তাঁকে। এবার ত্রিশটি কবিতা নিয়ে বর্ধিত কলেবরে সিগনেট সংস্করণ ছাপা হল।’ [‘পূৰ্ব্বাশা’য় প্রকাশিত সিগনেট প্রেসের বিজ্ঞাপন ]।
বইটি হাতে পেয়ে জীবনানন্দ আনন্দিত হয়েছিলেন। সে কথাই জানিয়েছিলেন তিনি প্রকাশক দিলীপকুমার গুপ্তকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বইটির প্রচ্ছদটি তাঁর একেবারেই ভালো লাগেনি। বইটি হাতে পেয়ে বোন সুচরিতাকে বলেছিলেন—
‘এই বই-এর প্রচ্ছদটা কেমন হয়েছে বলত? আমার কিন্তু একেবারেই ভাল লাগেনি। আমি রাজকুমারী অমৃতকুমারীকে ভেবে এই সব কবিতা লিখেছিলাম নাকি?’ [কাছের জীবনানন্দ, পৃ. ১৭৯]।
নভেম্বর মাসে জীবনানন্দ বরিষা কলেজে (বর্তমানে বরিষা বিবেকানন্দ কলেজ) অধ্যাপনার কাজে যোগদান করেন। মাত্র চার মাস লিভ ভ্যাকেন্সিতে অধ্যাপনার কাজ। ভ্রাতৃবধূ নলিনীর সহপাঠিনী লেখিকা বাণী রায়ের দাদা সুশীলকুমার রায় তখন বরিষা কলেজের অধ্যক্ষ। মূলত, তিনিই জীবনানন্দকে এ কাজে নিযুক্ত করেছিলেন।
নভেম্বর থেকে লাবণ্য দাশ পার্ক সার্কাসের কাছে শিশু বিদ্যাপীঠে (বর্তমানে শ্রীমতী জহর নন্দী স্কুল) শিক্ষিকা পদে যোগদান করেন। লাবণ্যের এই চাকরির সুবাদে সংসারের আর্থিক অনটন কিছুটা কমে আসে।
সাগরময় ঘোষ সম্পাদিত ‘দেশ’ পত্রিকায় জীবনানন্দের দুটো প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধ দু’টো হল— ‘শিক্ষার কথা’ (১৪ ভাদ্র ১৩৫৯) ও ‘শিক্ষা দীক্ষা’ (২১ ভাদ্র ১৩৫৯)। ১৯৫২ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা-আন্দোলন হয়। জীবনানন্দ তার দ্বারা উদ্বোধিত ও আন্দোলিত হয়েছিলেন। লিখেছিলেন এক অসাধারণ প্রবন্ধ—’বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’। ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল।
সুচরিতা দাশের মাধ্যমে তরুণ ডাক্তার ছাত্র ভূমেন্দ্র গুহের সঙ্গে জীবনানন্দের পরিচয় ঘটে। এ বছর জীবনানন্দ বিষয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা প্রকাশিত হয়, তা এ রকম—
মণীন্দ্র রায় (জন্ম. ১৯১৯)
‘এরই অন্য চেহারা দেখি আমরা অজিত দত্তের রূপকথা-আবহাওয়ার কবিতাগুলিতে এবং জীবনানন্দ দাশের গ্রাম্য পরিবেশের কাব্যরূপে। প্রথমোক্ত কবির ক্ষেত্রে প্রেম ও প্রেমিকাকে নিয়ে যে কাল্পনিক জগৎ তৈরি হয় তা ভবিষ্যতের প্রতীক নয়, অতীতের দীর্ঘশ্বাস। জীবনানন্দ দাশের গ্রামীণ পটভূমিতে আশ্রয় নেওয়ার মূলেও আসলে বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়ার তাগিদই বর্তমান।’ [‘প্রগতিশীল বাংলাকবিতার ঐতিহ্য ও দায়িত্ব’, মণীন্দ্র রায়, ‘সীমান্ত’, চৈত্র ১৩৫৯, পৃ. ৩৭]
অরুণ ভট্টাচার্য (জন্ম ১৯২৫)
‘বাস্তববাদী অথবা ভাববাদী, রোমান্টিক অথবা ক্লাসিক, জীবনানন্দ দাশ মূলতঃ কোন জাতের কবি, এ তর্ক উপস্থাপিত না করে একথা স্বীকার করে নেওয়া যুক্তিসঙ্গত যে কাব্যের রূপ যদি ছবি ও গানের যথার্থ সমন্বয় সাধনে প্ৰকাশ পায়, তবে তিনি কবি।’ [‘পুস্তক পরিচয়’, অরুণ ভট্টাচার্য, ‘উত্তরসূরী’, আশ্বিন ১৩৫৯, পৃ. ৩১২]।
সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় (জন্ম ১৯২৬)
‘বস্তুতঃ তাঁকে(জীবনানন্দ দাশ), বুদ্ধদেবকে অনুসরণ করে হেমন্তের কবিই বলা চলে। যে বিষণ্ণতা তাঁর মূলধন, যে স্তিমিত নিদ্রাচ্ছন্নতায় তিনি ভ্রান্তিবিলাসী, হেমন্তের আধ-আধ কুয়াশা এবং শ্রান্ত প্রকৃতিই তার যোগ্য প্রতীক। শীত, বসন্ত, হেমন্ত, পাতার বিবর্ণতা, হলুদ খড় শুধু অনিবার্য অবসানের নয়, একটা কালের রিক্ততার চিত্রবহ হয়ে এল আমাদের কাছে। তাৎকালিক পৃথিবীর গতিপ্রকৃতি ও যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর সংকটকে না বুঝে এবং শ্রেণীশক্তির পারস্পরিকতার দিকে পিছু ফিরে দেখেও না দেখে তিনি এক স্বেচ্ছাচারী আলস্যের গায়ক হয়ে থাকলেন।’ [‘জীবনানন্দ দাশ প্রসঙ্গে’, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘সীমান্ত’, চৈত্র ১৩৫৯, পৃ. ৩৭]
কলকাতায় কাজী আবদুল ওদুদের সাধারণ সম্পাদকত্বে ‘নজরুল সমিতি’ গঠিত হয়। এই সমিতির উদ্যোগে চিকিৎসার জন্যে নজরুলকে রাঁচি মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। চারমাস পর যথাপূর্বং অবস্থায় সেখান থেকে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়।
ঢাকায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সমর্থন ঘোষিত হয়। ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগাম কমিটি’ গঠিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনরত রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার ও অহিউল্লা গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। ২২ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশ আবার গুলি চালায়, তাতে সফিকুর রহমান শহীদ হন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়। হায়দ্রাবাদে সোহ্রাওয়ার্দীর ঘোষণা—
‘যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তদনুসারে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’
প্রথম শহীদ মিনার ধ্বংস করে পুলিশ। পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এ বছর জন্মালেন দেবাশিস বসু, একরাম আলী, বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী, বিশ্বনাথ দাশ, সন দে, মাসুদুজ্জামান, আবিদ আজাদ, দাউদ হায়দার, বিমল গুহ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, শিহাব সরকার।
আর পরলোকে গেলেন মোহিতলাল মজুমদার, বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ, পণ্ডিত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯২০ সালে সাহিত্যে নোবেল জয়ী ন্যুট হ্যামসুন।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ফ্রাঁসোয়া মোরিয়াক (১৮৮৫–১৯৭০)। ঔপন্যাসিক। ফ্রান্সের অধিবাসী 1
তাঁকে পুরস্কার দেওয়ার পক্ষে নোবেল কমিটি লেখেন—
‘For the deep spiritual insight and the artistic intensity with which he has in his novels penetrated the drama of human life.’
তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হল… Flesh and Blood’, ‘Questions of Precedence’, ‘The Desert of Love’, ‘The End of the Night’, ‘The River of Fire’.
এ বছর ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ পান ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ এবং ড. কালীপদ বিশ্বাস ও এককড়ি ঘোষ ‘ভারতের বনৌষধি’ গ্রন্থের জন্যে।
প্রকাশিত গ্রন্থ : প্রকাশ পায় শাহেদ আলীর ‘জিবরাইলের ডানা’, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘অপ্রেম ও প্রেম’, ফররুখ আহমদের ‘সিরাজাম মুনিরা’, ক্ষিতিমোহন সেনের ‘বলাকাকাব্য পরিক্রমা’, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র জীবনী-৩য় খণ্ড’ [১৯৫৬ সালে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনী ৪র্থ খণ্ড বের হয়], শশিভূষণ দাশগুপ্তের শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ : দর্শনে ও সাহিত্যে’, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘চাচাকাহিনী’, ‘ময়ূর কণ্ঠী’, তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তার’। বিষ্ণু দে’র ‘সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’ প্রবন্ধ গ্রন্থের প্রকাশ। [প্রবন্ধের সংখ্যা : ১৮, উৎসর্গ : সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, প্রকাশ : দিলীপকুমার গুপ্ত, কলকাতা]।
বের হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘সোনার চেয়ে দামী’ (দ্বিতীয় খণ্ড : ‘আপোষ’), ‘ইতিকথার পরের কথা’, ‘পাশাপাশি’ এবং সার্বজনীন’। বসুমতী সাহিত্য মন্দির বের করে ‘মানিক গ্রন্থাবলী ২য় খণ্ড’।