১৯৫০। বয়স ৫১ বছর
১৯৫০ সালের ২ সেপ্টেম্বর জীবনানন্দ দাশ খড়গপুর কলেজে যোগদান করেন। তাঁর বেতন ছিল ৫০-৬০ টাকা। সিলভার জুবিলি ইন্সটিটিউটের পাশের ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে জীবনানন্দের থাকার ব্যবস্থা হয়। জীবনানন্দ সকাল ও রাতের ক্লাসের সময় ছাড়া সারাক্ষণ নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকতেন। ওই ছাত্রাবাসের পরিচালক ছিলেন কলেজের সংস্কৃত ও বাংলার অধ্যাপক পুলিনবিহারী পাল। পুলিনবাবু ছাড়া সাধারণত আর কারো ডাকে জীবনানন্দ দরজা খুলতেন না। কলকাতা থেকে আসা যাওয়া করতেন জীবনানন্দ। ক্লাসের জন্যে একটানা কয়েকদিন থাকতেন খড়গপুরে। মঞ্জুশ্রী তখন তমলুকে, কলকাতায় থাকেন লাবণ্য আর সমরানন্দ। সুতরাং প্রতি সপ্তাহের শেষে জীবনানন্দকে কলকাতায় আসতেই হয়। কিন্তু এই সময়েও জীবনানন্দের আর্থিক অবস্থা সুবিধের ছিল না। এ অবস্থায় সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে অকপটে হাত পাতেন তিনি। সঞ্জয় ভট্টাচার্য জীবনানন্দকে ‘জীবনবাবু’ বলে সম্বোধন করতেন। ১৬.৬.৫০ তারিখে জীবনানন্দ সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে লেখেন-
‘আশা করি ভাল আছেন। বেশি ঠেকে পড়েছি, সেজন্য বিরক্ত করতে হল আপনাকে। এখুনি চার/পাঁচশ টাকা দরকার, দয়া করে ব্যবস্থা করুন। লেখা দিয়ে আপনার সব টাকা শোধ করে দেব, না হয় ক্যাশে। ক্যাশে শোধ করতে গেলে ছ’সাত মাস (তার বেশি নয়) দেরি হতে পারে।’ [‘পূর্ব্বাচলের পানে তাকাই’, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ‘পূৰ্ব্বাশা’, ফাল্গুন ১৩৯২]।
দুভাগের বিষয় সঞ্জয় ভট্টাচার্য জীবনানন্দকে কোনোরূপ সাহায্য করতে পারেননি। কারণ, তখন তিনি নিজেই কঠিন অর্থসংকটে ছিলেন।
১৯৫০-এ কলকাতায় ‘সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্র’ নামে একটি সংস্থা স্থাপিত হয়। সভাপতি আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬–১৯৮২)। সহ-সভাপতি দু’জন – জীবনানন্দ দাশ ও নরেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯১৬—১৯৭৫)। ২২ জানুয়ারি এই প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় সিনেট হলে। উদ্বোধন করেন সোশ্যালিস্ট নেতা আচার্য নরেন দেও। প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য ছিল শিল্পী সাহিত্যিকদের মধ্যে স্বাধীন চর্চার একটা বাতাবরণ গড়ে তোলা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জীবনানন্দ উপস্থিত ছিলেন না। বাণী পাঠিয়েছিলেন। বাণীটির কিয়দংশ একরম-
‘সমকালীন সাহিত্য কেন্দ্র’ একদিকে সমাজ ও জনতার বিমূঢ় উপেক্ষা ও অন্যদিকে রাষ্ট্র ইত্যাদির অন্যায় ও অবোধ কর্তৃত্বের হাত থেকে সাহিত্যকে যথাসম্ভব মুক্ত করবার কাজে ধৈর্য, জ্ঞান ও বিনয়ের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। আপনাদের পরিপূর্ণ সাফল্য কামনা করি।’ [‘সমকালীন সাহিত্য কেন্দ্ৰ’ : বৰ্ষ পরিক্রমা, ‘দ্বন্দ্ব’, চতুর্থ বর্ষ, শারদীয় ১৩৫৭, পৃ. ২৭২]।
এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আর যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তাঁরা হলেন দিনেশ দাস (১৯১৫-১৯৮৫), অম্লান দত্ত (জন্ম. ১৯২৪), নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (জন্ম. ১৯২৪), নারায়ণ চৌধুরী (১৯১২-১৯৯১), সন্তোষকুমার ঘোষ (১৯২০–১৯৮৫) প্রমুখ।
প্রতিষ্ঠানটির আদর্শ জনমানসে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে দ্বন্দ্ব’ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন এঁরা। ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ থেকে এই পত্রিকা বিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছিল। নবপরিকল্পিত পত্রিকাটির সম্পাদনা পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন তিনজন- জীবনানন্দ দাশ, আবু সয়ীদ আইয়ুব ও নরেন্দ্রনাথ মিত্র। প্রথম দুটি সংখ্যায় আইয়ুব-এর নাম সম্পাদকের মধ্যে প্রথম এবং মাঝে জীবনানন্দের নাম প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দ এই ক্রমোল্লেখে সন্তুষ্ট ছিলেন না বলে তৃতীয় সংখ্যা থেকে সর্বপ্রথমে জীবনানন্দের নাম মুদ্রিত হয়।
‘দ্বন্দ্বে’র শারদীয় সংখ্যায় (চতুর্থ বর্ষ, ১৩৫৭ বঙ্গাব্দ) জীবনানন্দের ‘আধুনিক কবিতা’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ সময় জীবনানন্দ আঁদ্রে জিদ্ (১৮৬৯–১৯৫১), টমাস মান (১৮৭৫–১৯৫৫), এলিয়ট (১৮৮৮–১৯৬৫), অল্ডাস হাক্সলি (১৮৯৪- ১৯৬৩)-এর মতো বিদেশি সাহিত্যিকদের গ্রন্থের পাশাপাশি নিরঞ্জন মজুমদার (১৯২০- ১৯৭৫) ও কৃষ্ণধর (জন্ম ১৯২৮)-এর বইয়ের আলোচনা লিখেছেন ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায়। ‘দি স্টেটস্ম্যান’, ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকার রবিবাসরীয় সাহিত্য সংস্করণে সমকালীন বাংলা কবিতা ও উপন্যাস নিয়ে নিবন্ধ লিখেছেন তিনি।
প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের আত্মপ্রকাশ।
শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইলা মিত্রের নেতৃত্বে নাচোলে সাঁওতাল বিদ্রোহ হয়। ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহের স্বার্থরক্ষার্থে ‘নেহরু-লিয়াকত চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় দিল্লিতে। রাজশাহী জেলে রাজবন্দীদের ওপর গুলি চালালে ৭ জন নিহত ও ৩১ জন আহত হয়।
কমিউনিস্টদের ওপর সরকারি পীড়নের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। মানিকের কমিউনিস্ট- সংশ্লিষ্টতার কারণে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা ও পত্রিকা তাঁর লেখা ছাপা বন্ধ করে দেয়। ফলে লেখালেখির আয়ের ওপর নির্ভরশীল মানিক দারুণ অর্থকষ্টের শিকার হন।
সতীনাথ ভাদুড়ী ‘জাগরী’ উপন্যাসের জন্যে ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ পান। ড. নীহার রঞ্জন রায়ও ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব’-এর জন্যে ‘রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন।
এ বছর উল্লেখনীয় জন্মগ্রহণকারীরা হলেন রনজিৎ দাশ, নিশীথ ভড়, সৈয়দ কওসার জামাল, অলোকনাথ মুখোপাধ্যায়, অরণি বসু, শাহরিয়ার কবির।
পরলোক গমন করলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ, ১৯২৫ সালে নোবেল জয়ী জর্জ বার্নার্ড শ’, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন বারট্রান্ড রাসেল (১৮৭২ – ১৯৭০)। দার্শনিক। ইংল্যান্ডের অধিবাসী।
পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে কমিটি লেখেন—
‘In recognition of his varied and significant writings in which he champions humanitarian ideals and freedom of thought.’
রাসেলের বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হল— ‘Principles of Mathematics’, ‘An Introduction of Mathematical Philosopy’, ‘Road of Freedom’.
প্রকাশিত গ্রন্থ : প্রকাশ পায় বিষ্ণু দে’র ‘অধিষ্ট’, ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’, অলোক সরকারের ‘উতল নির্জন’, আকবর হোসেনের ‘অবাঞ্চিত’, আসহাব উদ্দীন আহমদের ‘ধার’, গোপাল হালদারের ‘অন্যদিন’ এবং ‘আর একদিন’। জুলাই মাসে প্রকাশ পায় মানিকের ‘জীয়ন্ত’ উপন্যাস। জগদীশ ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় বের হয় ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প’, বসুমতী সাহিত্য মন্দির বের করে ‘মানিক গ্রন্থাবলী ১ম ভাগ।