১৯৫১। বয়স ৫২ বছর

১৯৫১। বয়স ৫২ বছর 

ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজের বিটি পড়বার জন্যে ভর্তির অনুমতি চাইলেন লাবণ্য দাশ স্বামী জীবনানন্দের কাছে। জীবনানন্দ রাজি হলেন না। তবু সাংসারিক অসচ্ছলতা দূর হবে বিবেচনায় লাবণ্য ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হলেন। কোর্স (১৯৫০-৫১) শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে এনজাইনা রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন লাবণ্য। ১৯৫১-এর জানুয়ারির শেষের দিকে খড়গপুর কলেজের একটা ছুটিতে কলকাতায় এলেন জীবনানন্দ। তখন স্ত্রীর অসুস্থতার বাড়াবাড়ি। আরো কিছুদিন থেকে গেলেন ছুটির আবেদন করে। সে ছুটির মধ্যে লাবণ্য ভালো হলেন না। এ জন্যে আরও কিছুদিনের ছুটি চাইলে খড়গপুর কলেজ তা মঞ্জুর করেনি। উপরন্তু, ১৫ ফেব্রুয়ারিতে কলেজ থেকে জীবনানন্দকে বরখাস্ত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, ছাত্রসংখ্যা কমে যাওয়ায় এবং কলেজের আর্থিক অসুবিধার কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ জীবনানন্দের পদটি বাতিল করে। 

খড়গপুর কলেজের চাকরি থেকে বরখাস্ত হলেও কলেজ-কর্তৃপক্ষ কিন্তু তাঁর প্রাপ্য বেতন পুরোপুরি মিটিয়ে দেয়নি। ওই কলেজে তাঁর সহকর্মী ছিলেন পুলিনবিহারী পাল। ৩১.৫.৫১ তারিখে জীবনানন্দ তাঁকে একটি পত্র লিখেন। পত্রের কিছু অংশ এ রকম— 

‘আপনার চিঠি পেয়ে খুশি হলাম। বড়ই বিপদের ভিতরে আছি। খড়গপুর কলেজ থেকে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মোট ত্রিশ টাকা মাত্র পেয়েছিলাম। ফেব্রুয়ারি মাসে যে কাজ করেছিলাম, সে-পাওনা আজ পর্যন্ত পাইনি। আমার পদটি বাতিল হলে—খড়গপুর কলেজ থেকে কয়েক মাসের অন্ততঃ পুবের মাইনে না পেলে এ দুর্দিনে কিছুতেই টিকে থাকতে পারব না। গত আগস্ট মাসে আমি দিল্লি কলেজের পাকা কাজ ও কলকাতার নানা সুযোগ-সম্ভাবনা ছেড়ে দিয়ে খড়গপুর কলেজের চাকরি ভালো ও স্থায়ী এই পূর্ণ বিশ্বাসে এই কলেজে যোগ দেব স্থির করে সেপ্টেম্বরের প্রথমেই যোগ দিয়েছিলাম।’ [‘যে কবি দেখেছিলেন বাংলার মুখ’, দীপক কর, ‘ধানসিঁড়ি’, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১৩৮০]। 

কর্মহীন বেকার জীবন চলছে জীবনানন্দের। এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কিছুদিন ব্যবসা করেন। ব্যবসার উদ্দেশ্যে ছোটভাই অশোকানন্দের কাছ থেকে কিছু টাকা ধারও করেছিলেন। ব্যবসাসংক্রান্ত নানা উদ্যোগের মধ্যে ছাতার ডাঁটের জন্যে বেত আমদানির চিন্তাও ছিল। এই সময় ঊষারঞ্জন দাশগুপ্ত (জন্ম. ১৯০৯) জীবনানন্দকে একটা অর্থকরী ব্যবস্থায় থিতু করবার জন্যে ইন্সিয়োরেন্সের দালাল বানাতে চেয়েছিলেন। ঊষারঞ্জন ছিলেন জীবনানন্দের মামাতো বোন লাবণ্যপ্রভার দেবর। ইনি ‘বরিশাল সেবা সমিতি’র প্রথম সেক্রেটারি ছিলেন। লাইফ ইন্সিয়োরেন্সের বিশিষ্ট এজেন্ট ছিলেন তিনি। তিনি জীবনানন্দকে ইন্সিয়োরেন্সের দালাল বানাতে নরমে গরমে চেষ্টার ত্রুটি করেননি। কিন্তু জীবনানন্দ ব্যর্থ ছাত্র হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিলেন 1 

দুঃসহ বেকার জীবন। অর্থলাভের আশায় বাসা sublet দিয়েছেন সুরুচি মজুমদার নামক এক বিধবাকে। নিতান্তই আর্থিক সুরাহার জন্যে মহিলাটিকে তিনি sublet দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই মহিলার ঘরেই রাত্রির বিশেষ প্রহরে মদ্যপান, গান-বাজনা, হই-হল্লা হতো। এতে জীবনানন্দের বাসস্থানের শান্তি বিঘ্নিত হওয়ায় তিনি অত্যন্ত মানসিক অশান্তি ভোগ করেন। 

চারুচন্দ্র কলেজে মর্নিং সেকশনে অধ্যাপকের চাকরির জন্যে আবেদন করলেন। সুযোগ পেলেই যে কোনো পরিচিত ব্যক্তিকে একটা চাকরির জন্যে অনুরোধ করেন। প্রাক্তন ছাত্র- তখনকার সিটি কলেজের অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে সেই কলেজে একটা চাকরি করে দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করেন; এও বলেন—নারায়ণের চেয়ে তাঁর বেতন ৫ টাকা অন্তত যাতে বেশি হয়। কিন্তু নারায়ণের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ বলে তিনি জীবনানন্দকে চাকরির ক্ষেত্রে কোনো সাহায্য করতে পারেননি। 

ব্রজমোহন কলেজের প্রাক্তন সহকর্মী, দমদম মতিঝিল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলিকে তাঁর কলেজে একটা চাকরি দেওয়ার জন্যে বিনীত অনুরোধ জানান জীবনানন্দ। সে-সময়ে পুরনো সহকর্মীকে এ কথাও বলেছিলেন, যে আত্মজীবনীটি জীবনানন্দ এখন লিখছেন, তাতে তাঁকে অমর করে রাখবেন। তা সত্ত্বেও এ কলেজে তাঁর চাকরি হয়নি। 

মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দী মহকুমার কমিউনিটি ডেভলপমেন্টের ডেপুটি সেক্রেটারি অনিল বিশ্বাসকে একটি পত্রে (২৩.১১.৫১) লিখলেন— 

‘আমি আজকাল মুস্কিলের ভেতরে আছি, কাজ খুঁজছি। কলকাতায় কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি কিছু Suggest করতে পারেন? কালকের কাগজে দেখলাম Jangipur College-এ (Murshidabad) একজন ইংরেজির লেকচারার চায়। আমার বর্তমান অবস্থা এমন হয়েছে যে ওসব জায়গায় এ ধরনের কাজেও যেতে দ্বিধা করলে চলবে না। আপনি তো মুর্শিদাবাদে আছেন। হয়তো কিছু করতে পারেন।’ [‘জীবনানন্দ দাশ : বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত’]। 

এ রকম বেকার জীবনপর্বে রেভিনিউ বোর্ডের সদস্য সত্যেন ব্যানার্জী আইসিএস-এর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে রাইটার্স বিল্ডিং-এ অবনীমোহন কুশারীর ঘরে অচৈতন্য হয়ে পড়েন জীবনানন্দ। 

বুদ্ধদেব বসু লেখক হিসেবে পেশাদারিত্বে বিশ্বাস করতেন। অন্যদিকে কঠোর দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করেও জীবনানন্দ সাহিত্যের সঙ্গে অর্থপ্রাপ্তির চিন্তা জড়াতে দ্বিধা করতেন। সুরজিৎ দাশগুপ্ত (জন্ম. ১৯৩৬) ‘জলার্ক’ পত্রিকার জন্যে বুদ্ধদেব বসুর কাছে লেখা চাইতে গেলে তিনি প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত লেখার জন্যে পৃথক দর উল্লেখ করেন। জীবনানন্দের কাছে তাঁর লেখার সম্মানীর পরিমাণ জানতে চাইলে জীবনানন্দ ২.১১.৫১ তারিখে সুরজিৎ দাশগুপ্তকে লেখেন— 

‘একটি কবিতার জন্যে সম্মানমূল্য আমি সাধারণত ২৫/৩০ থেকে ৫০ পর্যন্ত পাই। তোমরা ২০ দাও না, আমি সময় করে ভালোভাবে নতুন কবিতা লিখে পাঠাই। লেখার জন্যে সময় ও সাধনা দরকার, গদ্যের চেয়ে কবিতায় বেশি।’ [জীবনানন্দ দাশের অপ্রকাশিত পত্রগুচ্ছ’, পৃ. ৬৩] 

পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হলেন গোলাম মুহম্মদ, মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। কুমিল্লায় শিক্ষক সম্মেলনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঘোষণা করলেন— 

‘বাংলাভাষা অবহেলিত হইলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ করিব।’ 

‘দৈনিক সংবাদ’-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। জমিদারি প্রথার বিলোপ হয়। আততায়ীর গুলিতে লিয়াকত আলী খান নিহত হন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন। 

এ বছর জন্মালেন বীতশোক ভট্টাচার্য, মুনতাসীর মামুন। 

আর মারা গেলেন আঁদ্রে জিদ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথেশ বড়ুয়া, লেডি অবলা বসু, এস. ওয়াজেদ আলি, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, কায়কোবাদ, ১৯৩০ সালে নোবেলজয়ী সিনক্লেয়ার লিউইস। 

এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন পার লাগেরকিস্ট (১৮৯১– ১৯৭৪)। কবি ও কথা সাহিত্যিক। সুইডেনের অধিবাসী। 

পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি লেখেন— 

‘For the artistic vigour and true independence of mind with which he endeavours in his poetry to find answer to the eternal questions connecting mankind.’ 

তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হল— ‘The Art of Words and the Pictorial Arts’, ‘Motifs’, ‘Verbal Art and Pictorial Art’. ‘On the Decadence of Modern Literature’. 

এ বছর ‘ইছামতী’র জন্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ‘Ancient Indian Life’ গ্রন্থের জন্যে আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়বিদ্যানিধি ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ পান। 

প্রকাশিত গ্রন্থ : বের হয় সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘মিঠেকড়া’, অজিত দত্তের ‘ছায়ার আলপনা’, দিনেশ দাসের ‘দিনেশ দাসের কবিতা’, মনীন্দ্র রায়ের ‘অন্যপথ’, নরেশ গুহের ‘দুরন্ত দুপুর’, জসীম উদ্দীনের ‘মাটির কান্না’, বনফুলের ‘স্থাবর’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢেঁাঁড়াই চরিতমানস-২য় খণ্ড, মনোজ বসুর ‘জলজঙ্গল’, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘কল্লোল যুগ’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নাগিনীকন্যার কাহিনী’। প্রকাশিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারটি উপন্যাস ‘পেশা’ (পূর্বনাম: ‘নবীন ডাক্তারবাবু’), ‘সোনার চেয়ে দামী’ (প্রথমখণ্ড: ‘বেকার’), ‘স্বাধীনতার স্বাদ’ (পূর্বনাম: ‘নগরবাসী’) এবং ‘ছন্দপতন’ (পূর্বনাম: ‘কবির জবানবন্দী’)। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *