১৮. রিজবানের বাগিচা

ফল-কো দেখ-কে করতা হূঁ য়াদ উসকো, অসদ;
জফা-্মেঁ উস-কে হৈ আন্দাজ কার্ফর্মাঁ-কা।।
(আকাশের দিকে তাকালে তার কথাই মনে আসে,
আসাদ; তার নিষ্ঠুরতায় আমি যে দেখেছি বিধাতার নিষ্ঠুরতার আদল।)

রিজবানের বাগিচা। না, মির্জাসাব, স্বর্গের বাগানে ঢোকার অধিকার আমার ছিল না, এমনকী সেই বাগানের খুশবুটুকুও আমার কাছে এসে কোনওদিন পৌঁছয়নি। তবু আল্লার কাছে আমি প্রার্থনা জানিয়েছিলাম, এই কালো আত্মা, সাদাত হাসান মান্টোকে দুনিয়া থেকে নিয়ে যাও, সুগন্ধ ছেড়ে সে কেবল বদবুর পেছনেই দৌড়য়। জ্বলন্ত সূর্যকে সে ঘৃণা করে আর ঢুকে পড়ে। অন্ধকার গোলকধাঁধায়। যা কিছু ভদ্র-সভ্য, তার মুখে লাথি ঝেড়ে সে ল্যাংটো সত্যকে জড়িয়ে ধরে। তেতো ফল খেতেই ভালবাসে সে। বাড়ির বেগমদের প্রতি কোনও টান নেই, বেশ্যাদের নিয়ে আনন্দের সপ্তম স্বর্গে পৌঁছতে চায়। সবাই যখন কাঁদে, সে হাসে; আর অন্যরা যখন হাসে, সে কাঁদে। নোংরায় যে মুখ কালো হয়ে গেছে তাকে ধুয়েমুছে, পুরনো মুখটা খুঁজে পেতে চায় মান্টো। খোদা, এই শয়তানকে, ভ্রষ্ট ফরিস্তাকে তুমি একবার বাঁচাও।

না, ভাইজানেরা, খোদা আমার ডাকে সাড়া দেননি। আমি তখন কী করি? কিস্সার পর কিস্সা জমা করতে লাগলাম জামার পকেটে। সবার কিস্স মাথায় থাকে, আর আমার পকেটে। কেন জানেন? কিস্সা লেখার জন্য আগাম টাকা নিতাম যে। টাকা যেমন পকেটে ঢোকে, কিস্সাও তেমনই পকেট থেকে বেরোয়। লোকে ভাবত, জাদুকর। এত কিস্সা পায় কোথা থেকে? আরে ভাই, কিস্সার কী অভাব আছে? তোমার চোখে যদি ঠুলি না পরানো থাকে, তবে তুমি সব জায়গাতেই কিস্সা খুঁজে পাবে। তোমার হাতে যদি কোনও গজফিতে না থাকে, তা হলে সব মানুষের কিস্সাই তোমার কিস্সা। প্রগতিশীলেরা আর মোল্লারা এইজন্য আমাকে সহ্য করতে পারত না, ওদের হাতে তো গজফিতে থাকত, সেই মাপে মিললে গপ্পো লেখা যাবে, না হলে সে গপ্পোকে জীবন থেকে বাদ দাও। ওদের কীভাবে বোঝাব বলুন, মান্টো কখনও নিজেকে লেখক হিসেবে দেখাতে চায়নি। একটা ভেঙেপড়া দেওয়াল, প্লাস্টার খসে পড়ছে, আর মাটিতে কত অজানা নকশা তৈরি হচ্ছে-আমি ওইরকম একটা দেওয়াল। গাড়ির পেছনে যে পাঁচ নম্বর চাকাটা আটকানো থাকে, কাজে লাগতে পারে, নাও লাগতে পারে, আমি সেই চাকাটা। বিশ্বাস করুন, কখনও শান্তি পাইনি আমি, কোনও কিছু পেয়ে মনে হয়নি, এবার পূর্ণ হলাম। কী এক অভাববোধ, ভাইজানেরা, একটা কিছু আমার মধ্যে নেই, আমি অসম্পূর্ণ, সবসময় এমনটাই মনে হত। আমার শরীরের তাপমাত্রা সবসময় স্বাভাবিকের থেকে এক ডিগ্রি ওপরে থাকত। সবসময় যেন এক ঘূর্ণিস্রোত আমার ভিতরে পাক খেয়ে চলেছে। আপনারা হয়ত হাসবেন, তবু আমার মনে হয়, যাদের শরীরের তাপমাত্রা সবসময় স্বাভাবিক থাকে, কবিতা-কিস্সা লেখা তো বাদ দিন, তারা একটা গাছ বা নদীকেও ভালোবাসতে পারে না। আমি বলছি, ভাইজানেরা, শুনে রাখুন, পাগলামি ছাড়া, অস্বাভাবিকতা ছাড়া কোনও সৃষ্টি, ভালবাসার জন্ম হয় না, ভালবাসা মাপজোক করে হয় না; তুমি আমাকে এতটুকু দেবে তো, আমি তোমাকে এতটুকু দেব, এর। নাম সংসার, ভালবাসা নয়, মজার কথা, এইরকম হিসেবনিকেশকে মানুষ ভালবাসা মনে করে। সত্যিকারের মহব্বৎ আমি দেখেছি হিরামান্ডিতে, ফরাস রোডে-সব লালবাতির মহল্লা-ভালবাসার জন্য ফতুর হয়ে যেতে পারে, খুন করতেও পারে। কিন্তু বাবুদের চোখে ওরা তো সব রেন্ডি, শরীর নিয়ে ব্যবসা করে, মহব্বতের ওরা কী জানে? না, না, মির্জাসাব, অমন অসহায় চোখে। আপনি তাকিয়ে থাকবেন না, আমি তো জানি, আপনি, একমাত্র আপনিই তবায়েফদের দিলমঞ্জিলে পৌঁছতে পেরেছিলেন। আমিও তো তাই দেখলাম, কোঠায় কোঠায় মাংস বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, আর মাংসের ভেতরের নূর- সৌগন্ধীদের দি-ইকের জন্য নিজেকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।

বারিসাবের সঙ্গে লাহোরে কাজ করতে গিয়ে হিরামান্ডিতে আমার যাতায়াত শুরু। তখন থেকেই ওদের আমি দেখতে শুরু করেছিলাম, ঘর শব্দটা যাদের কাছে সারা জীবন স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। ওরা সবাই আলাদা আলাদা, সকলের ভিন্ন ভিন্ন গল্প। টলস্টয় বলেছিলেন, সব সুখী পরিবার একরকম, দুঃখী পরিবারদের গল্পগুলো নানা রঙের। হিরামান্ডির ওই রংদার দুনিয়ায় ঢুকে পড়লে মনে হত, আমার হাতের ভেতরে কতরকমের হৃৎপিণ্ড যে ধকধক করছে, কেউ মালকোষ তো, কেউ বেহাগ, কেউ ভৈরবী তো অন্যজন পূরবী; রাগ-রাগিণীর কতরকম যে খেলা। রাগের ভেতরেই অশ্রু, রক্ত, আর্তনাদ,ছুরি শানানোর শব্দ। বারিসাবের সঙ্গে তো যেতামই, তা বাদে একা একা ঢু মারতাম হিরামান্ডিতে। রেন্ডিরা তো আছেই, দালাল, ফুলওয়ালা, পানওয়ালাদের সঙ্গে গল্প করতাম, আমাকে দেখলেই ওরা হই হই করে উঠত, মান্টোভাই আ গিয়া, অব মজা জমেগা। তা, ভাইজানেরা, আপনাদের দয়ায়, মজা জমাতে আমার জুড়ি ছিল না, মজা শেষ হওয়ার পর দেখতে পেতাম, মান্টোর ভিতরের ন্যাড়া জমিটা যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে, একটাও ঘাস গজায় নি। আরে ভাই, আমি তো জানতামই, ওই নাবাল জমিতে। কখনও ঘাস জন্মাবে না, যতদিন বেঁচে আছ, দেখে নাও, যা দেখছ কিছু তো লিখে রাখো, সেই লেখার ভেতরে মরুদ্যান তৈরি হলেও হতে পারে, তবে সব কাঁটাগাছে ভরা, এই যা।

হিরামান্ডিতে আমরা যেতাম একেবারে বাদশার মতো। একদিনের গল্প বলি। সেদিন আমি আর বারিসাব বলবন্ত গার্গীকে পাকড়াও করেছি। বলবন্ত নিপাট ভালো মানুষ লেখক, তাই কোথায় যাচ্ছি, আগে তা বলিনি। একটা পেশোয়ারি টাঙ্গা ভাড়া নিলাম। বলবন্ত বার বার জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবে মান্টোভাই?

বারিসাব মিটিমিটি হাসেন। আমি বলি, শুধু খবরের কাগজের অফিসে বসে থাকলে লেখক হওয়া যায় না বলবন্ত। চলো, আজ একটু পাপ করে আসি।

-মতলব?

-বলবন্ত, মান্টোর কথাই না হয় আজ শোনো। দোজখে তো আর নিয়ে যেতে পারবে না। তার একটু ওপরেই থাকবে। বারিসাব হা-হা করে হাসতে লাগলেন।

শাহি মসজিদের সামনে গিয়ে আমাদের টাঙ্গা থামল, পাশেই তো জ্যান্ত মাংসের বাজার। তখন সন্ধে হয়েছে; রাস্তায় রেন্ডি, দালাল, ফুলওয়ালা, কুলফিওয়ালাদের ভিড়, টিক্কা কাবাবের গন্ধে চারদিক ম ম করছে, হাওয়ায় ভাসছে সারেঙ্গির সুর, ঠুংরির দুএকটা কলি; বলবন্ত আমার হাত চেপে ধরে বলল, কোথায় নিয়ে এলে, মান্টোভাই?

-হিরামান্ডি। নাম শোননি?

সে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

-ভয় পেলে নাকি?

-না। বলবন্ত ঢোঁক গিলে বলল, তুমি তো আছ।

-ভরসা রাখো বন্ধু, মান্টোর ওপর ভরসা রাখো।

এদিকে দেখি, বারিসাব এক পাঠান দালালের সঙ্গে দরদাম শুরু করে দিয়েছেন। আশ্চর্য স্বভাব লোকটার। মস্তি করতে এসেও দরদাম করবেই। শালা আরামকেদারার বিপ্লবী তো, সবকিছু নিক্তি মেপে করবে। কমিউনিস্ট হারামিদের আমার এই জন্য সহ্য হয় না, ফুর্তি মারার ইচ্ছে ষোলো আনা, লুকিয়ে-চুরিয়ে মজাও মারবে, কিন্তু সবসময় কপালে কাস্তে-হাতুড়ির তিলক এঁকে বসে আছে, আর সব কিছু নিয়ে দরদাম করবেই। ওদের হিসেবের বাইরে পা রাখলেই আপনি প্রতিক্রিয়াশীল। বিপ্লব মারাচ্ছে! কে তোদের ওপর দায় দিয়েছে রে সবাইকে সমান করার? সে শুধু সুফি সাধনাতেই সম্ভব, সে পথ ফকির-দরবেশের, কমিউনিজমে তার কোনও রাস্তা নেই। ক্ষমতা দখল যার লক্ষ্য, সবাইকে সমান দেখার সাধনার পথ তার জন্য নয়। মাফ করবেন। ভাইজানেরা, আবার বাথোয়াশি করে ফেলেছি; আধুনিক মানুষ তো, একটা গল্পও সহজভাবে বলতে পারি না, জ্ঞান দেওয়ার ভূতটা সবসময় ঘাড়ে চেপে আছে।

বারিসাবকে বললাম, কত দিন বলেছি, দরদাম করতে হয় আপনি একা কোনও কোঠায় যান।

-আরে এ শুয়োরের বাচ্চারা-

-আপনি, আমি, কম শুয়োরের বাচ্চা? মনে থাকে না?

আমার এইরকম খিস্তি শুনলে বারিসাব একেবারে গুম মেরে যান। আমার কথা শুনে পাঠান দালাল চনমনে হয়ে বলে ওঠে,  ওপর চলুন সাব। দারুন লেড়কি আছে, একদম দম্পুখত্‌।

ওই কোঠায় সেদিন আমরা প্রথম গেছি। দোতলার একটা ঘরে ঢুকে দেখলাম, বছর পঁয়ত্রিশের এক পাঠান মহিলা বসে আছে, মালকিন আর কী। মোটাসোটা চেহারা, খোঁপায় মোটা উঁইফুলের মালা জড়ানো, পান-রাঙানো ঠোঁট। বেশ দিলখোশই বলতে হবে।

কী দেখছেন মিঞা? সে কপট রাগের ভঙ্গিতে বলে।

আমিও কম বদমাইস না, খেলে দিলাম, মির্জাসাবের একটা বায়েৎ বলে উঠলাম।

ইশক মুঝকো নহী, বশত্ হী সহী
মেরী বশত, তেরী শোহরত হী সহী

-কেয়া বাত, কেয়া বাত। জব্বার-জব্বার মিঞা-

-জি, মালকিন। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে।

-মেহমান হাজির। গ্লাস লে আও।

গ্লাস আসে। জব্বার মিঞাকে আমি সোডা, টিক্কা কাবাব আনতে বলি। বলবন্ত আবার তখন গোস্ত খায় না, তার জন্য ওমলেট। দশ মিনিটের মধ্যেই জব্বার সব ব্যবস্থা করে ফেলে। জনি ওয়াকার সঙ্গেই নিয়ে এসেছিলেন বারিসাব। তিনটে গ্লাসে হুইস্কি, সোডা ঢালা হল। সঙ্গে বরফ। আমি জানতাম, বলবন্ত খাবে না। একটা গ্লাস মালকিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে তার উরুতে চাপড় মেরে বললাম, পিজিয়ে, মেরি জান।

ছুরির ফলার মতো তার দৃষ্টি আমকে বিধল, আমার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে মালকিন বলল, মেরি জান কা মতলব জানতে হো জনাব?

-জি।

-বাতাইয়ে।

-সুরৎ আঈনহ্মে টুক দেখ তো কেয়া সুরৎ হয়!

বদজবানী তুজে উস মুহপে সজাবার নহীঁ।

-মীরসাব; হ্যায় না?

-জি, মেরি জান।

-বহ তো কল দের তলক দেখতা ইধর কো রহা
হমসে হী হাল-এ তবাহ্ অপনা দিখায়ে নহ্ গয়া।

মাশআল্লা। আমি ঝুঁকে পড়ে তার পায়ে চুম্বন করি।

-এ কী করছেন, মিঞা?

-মহব্বত থাকে পায়ে। আমি হেসে বলি।

-কিঁউ?

-দেখেননি, মীরার গিরিধরলাল কেমন শ্রীরাধার পদসেবা করেন? আমরা, মানুষেরা নামি ওপর থেকে, ওষ্ঠচুম্বন করতে করতে, আর মোহনজি শ্রীরাধার পদচুম্বন করতে করতে ওপরে ওঠেন।

আমাদের প্রেম তাই একদিন হারিয়ে যায়, তাঁর প্রেম লীলা হয়ে ফুটে ওঠে।

-শোভানাল্লা, হিরামান্ডিমে এ কৌন ফরিস্তা আয়া আজ!

বারিসাব হা-হা করে হেসে ওঠেন। -দ্যাখো বলবন্ত, কাণ্ড দ্যাখো, হিরামান্ডিতে এসে ইবলিশ হয়ে গেল ফরিস্তা।

পয়ত্রিশ বছরের রেন্ডিটা তখন আমার হাত চেপে ধরেছে, তার দুই চোখে কুয়াশা, যেন আমিই মীরার গিরিধরলাল। গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, মাল কোথায়?

সে কথা বলতে পারে না তার চোখে ফুটে ওঠে অবিশ্বাস।

-মাল তো দিখাইয়ে। রাত এইসি গুজর জায়েগা? আমি এক চুমুকে গ্লাস শেষ করে বলি।

মালকিন পাঠান দালালের দিকে তাকাতেই সে উঠে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে গোলাপী জর্জেট শাড়ি পরা একটা মেয়ে নিয়ে এল। আমি তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। লক্ষ করলাম, বলবন্তও আড়চোখে মেয়েটাকে দেখছে। মেয়েটা বেশ রোগা, মুখে বহুৎ রং মেখে এসেছে, চোখে গাঢ় কাজল। আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে জিজ্ঞেস করল, কিছু একটা বলতে হবে তো, তাই বলল, কোথা থেকে আসছেন?

-তোমার আম্মিজানের গাঁও থেকে।

-জি? সে চোখ বড় বড় করে তাকাল।

-তুমি কোত্থেকে এসেছে?

-জি-

এইসব মেয়ের সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা, শোওয়াও যায় না। আমি বাতিল করে দিলাম। পাঠান দালাল পরপর বেশ কয়েকজনকে নিয়ে এল, কাউকেই পছন্দ হল না আমার। বারিসাব এজন্য প্রতিবারই আমার ওপর রেগে যেতেন। -ব্যাপার কী মান্টো, বিছানায় গিয়ে তো শোবো, তার জন্য এত কথার কী আছে?

-আপনি যান না কাউকে নিয়ে।

কিন্তু আমি মত না দিলে বারিসাবও যে বিছানায় যাবেন না তা আমি জানতাম। এরপর যে-মেয়েটা এল, সে বেশ লম্বা, ঝকঝকে, তার মুখের হাসিটি উত্তেজকই বলা যায়। তবে তার দুচোখ কালো কাচের চশমায় ঢাকা। নামাজ আদায়ের ভঙ্গিতে সে এসে আমাদের সামনে বসল। আমার বেশ পছন্দই হয়েছিল তাকে। এর আগে যাদের আনা হয়েছিল, তাদের সবাইকে কিছু না কিছু প্রশ্ন করেছি, উত্তর দিতে পারেনি, সব মাথামোটার দল। মনে হল, এ মেয়েটা পারবে। জিজ্ঞেস করলাম। একটা ধাঁধার উত্তর দিতে পারবে?

-জি বলুন।

-ভুরান নামে এক বাই ছিল। তার মেজাজ মর্জি সবার থেকেই আলাদা। একদিন সে মির্জা মজহর জান-ই জন্নকে খত্ পাঠাল, আপনার জন্য আমি বেচায়েন হয়ে আছি। কিন্তু আপনি চারজনকে ভালবাসেন। আমি কখনও তেমন হতে পারি না। চারজনকে ভালবাসা মেয়েদের উচিৎ নয়। বলো তো, মির্জাসাব কী উত্তর দিয়েছিলেন?

-বারোজনের বদলে চারজনকে যে ভালবাসে, সে অনেক বেশী ধার্মিক।

উত্তর শুনে আমি চমকে গেলাম। -কী করে জানলে?

মেয়েটি হেসে বলল, চারজনকে যে ভালবাসে, সে সুন্নি-চারজন খলিফাঁকে সে মান্য করে। আর বারোজনকে যে ভালবাসে সে শিয়া-বারোজন ইমাম তাকে পথ দেখান।

-এ কিস্সাটা জানলে কোত্থেকে?

মেয়েটি হাসে উত্তর দেয় না। আমার তাকে পছন্দ হয়ে যায়। কথা বলতে পারব না, এমন কোন রেন্ডির সাথে সারা রাত কাটানো যায়? কিন্তু মেয়াটা সন্ধেবেলা চোখে কালো চশমা পরে আছে কেন? কথাটা জিজ্ঞেসও করলাম।

বেশ চোস্ত মেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, আপনার খুবসুরতি আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে জনাব।

-কেয়া বাত। তোমার সঙ্গে শুলে তো বেহস্তে যাব মনে হচ্ছে, মেরি জান।

-আমি তবে আগে যাই। বারিসাব চেঁচিয়ে ওঠেন। মান্টোভাই, তোমার আগে জন্নতে যাওয়ার সুযোগটুকু আমাকে দাও।

-দেবো, দেবো, আর আগে সত্যিটা দেখি। বলতে বলতে আমি মেয়েটির চোখ থেকে কালো চশমা টেনে খুলে দিই। ট্যারা, এক্কেবারে ট্যারা একটা মেয়ে। আমি চশমাটা তার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, চশমা না পরে এলে, ট্যারা হলেও আমি তোমার সঙ্গে শুতে যেতে পারতাম। কিন্তু মিথ্যে আমি সহ্য করতে পারি না, মেরি জান। কাটো, এবার কেটে পড়ো দেখি। চালিয়াতি আমি বরদাস্ত করি না।

সে মেয়েটিও চলে গেল। রাত প্রায় এগারোটা বাজতে চলেছে। আবার নানারকম ভাজাভুজি, কাবাব এল। পাঁচ পেগ খতম হয়ে গেছে। ছ নম্বর গ্লাসে ঢালতে যাওয়ার সময় মালকিন আমার হাত চেপে ধরল, আর খাবেন না জনাব।

-কেন?

-মান্টোভাই, কথা শোনো। বলবন্ত বলল। – উনি তোমার ভালর জন্যই বলছেন।

-আমার ভালর জন্য? বলবন্ত তুমি এদের চেনো না। বাকি মালটা ও দালালের জন্য রাখতে চায়। আরে বাবা, দালালের জন্য চাই তো বলো, পুরো বোতল আনিয়ে দিচ্ছি। এসব হারামজাদিকে তুমি চেনো না।

আমি গ্লাসে চুমুক দিতেই মালকিন আবার হাত চেপে ধরল।-আল্লা কসম, আর খাবেন না, জনাব। আপনার মতো মানুষ আমি আগে কাউকে দেখিনি।

-তাই? আমার মতো খুবসুরতও এই দুনিয়াতে আর কেউ নেই। আমি তার পেটে হাত বোলাতে লাগলাম, সে একবারও বাধা দিল না। আমি তার গলায় চুমু খেতে খেতে বললাম, তুমি ক্লিওপেট্রা, তুমি জানো? জানো না। মান্টোর কাছে শুনে রাখো।

আমি সে-রাতে কোঠাতেই থেকে গিয়েছিলাম। বারিসাব, বলবন্ত কখন চলে গিয়েছিল, কে জানে। মালকিন আমাকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল; নেশার ঘোরে আমি, তার কান্না একটা মরা নদীর মতো আঁকড়ে ধরছিল আমাকে। ভোরের দিকে যখন আমার নেশা কাটল, দেখলাম, তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি, আর তার চোখ দুটো আমার মুখের ওপর স্থির হয়ে আছে। কেন, কেন যে আমার কান্না পেল জানি না, আমি তার পেটে মুখ ডুবিয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলাম। সে আমার মাথায় হাত রেখে বসে থাকল, একটি কথাও জিজ্ঞেস করল না।

আমি তার কোঠাতেই স্নান করলাম। সে আমার জন্য চা-নাস্তা নিয়ে এল। সকালের আলোয় প্রথম আমি তাকে ভাল দেখলাম। বিবর্ণ, তবু বোঝা যায়, একসময় তার শরীর শ্বেতচন্দনের রঙে উদ্ভাসিত ছিল; চোখের নীচে কালি, কিন্তু একসময় এই চোখ মরকতমণির মতই উজ্জ্বল ছিল; তার শরীর, এখন অনেক ভাঙচুর, একসময় চিনারের মতোই সুঠাম ছিল।

-তোমার নাম কী? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

-কান্তা।

-কবে এসেছিলে এখানে?

– মনে নেই।

-কী মনে আছে, তোমার কান্তা?

-কিছু না, জনাব।

-কাউকে মনে পড়ে না?

কান্তা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, খুশিয়াকে মনে পড়ে মাঝে মাঝে।

-কে খুশিয়া?

-দালাল। আমার জন্য খদ্দর নিয়ে আসত।

-খুশিয়া মরে গেছে?

-জানি না।

-খুশিয়া কোথায় জানো না?

-না।

-তা হলে খুশিয়ার কথা বলো। আমি তার হাত ধরি।

-খুশিয়া আমাকে ভুল বুঝেছিল।

-কেন?

-খুশিয়ার সামনে আমি লজ্জা পাইনি। কেন পাবো, বলুন? ও তো খুশিয়া, আমার কোঠার খুশিয়া।

-কী করেছিল খুশিয়া?

-জনাব, এবার আপনি যান, সকালবেলায় এ-মহল্লায় আপনাদের থাকতে নেই। আমিও তো একটু ঘুমোতে যাব।

-খুশিয়ার কথা একদিন বলবে?

-বলব। আপনি আসবেন। তবে একা। এত লোক নিয়ে নয়।

-কেন?

কান্তা শুনে হেসে ওঠে। -রেন্ডির আবার কথা কী? সে তো কাপড় তুলবে, আপনি যা করার করবেন। কেউ কেউ আসল নাম জিজ্ঞেস করে, কেন লাইনে এসেছি জানতে চায়। মাফ করবেন জনাব, এই কুত্তাগুলোর মুখে মুতে দিতে ইচ্ছে করে। মারাতে এসেছিস, মারা। আমাকে জানার কেন ইচ্ছে হয় তোর? ঘন্টাখানেকের মামলা, গতর দ্যাখ, যা করার কর, ফুটে যা। কিন্তু, আপনি আবার আসবেন তো? খুশিয়া যে কেন এমন করল, আমি আজও বুঝতে পারিনা, জনাব।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *