ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দুনিয়ায় আস্তে আস্তে বেশ জল ঘোলা হতে শুরু করল। সীমান্ত নিয়ে মাঝে মাঝেই অস্বস্তিকর খবর ছাপা হতে লাগল পত্র-পত্রিকায়। সঙ্গে সঙ্গে পার্লামেন্টে ঝড় বয়ে যেত–সর্ট নোটিশ, কলিং অ্যাটেনশান, অ্যাডজর্নমেণ্ট মোশান। সরকার আর বিরোধী পক্ষের লড়াই নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। শুধু তাই নয়। কংগ্রেস পার্টির মধ্যেও সরকারী নীতির সমালোচনা শুরু হল গোপনে গোপনে। সরকারী নীতির গোপন সমালোচনার এসব খবর কংগ্রেসীরাই নেমন্তন্ন করে আমাদের পরিবেশন করতেন। তবে সবাইকে নয়, অনেককে। যমুনার জল আরো গড়িয়ে গেল। কংগ্রেস পার্লামেণ্টারী পার্টির সাধারণ সভায় সরকারী নীতির সমালোচনার গুঞ্জন শোনা যেতে লাগল। মাঝে মাঝে। তবে নিয়মিত নয়। সমষ্টিগতভাবেও নয়। পাঁচশ-সাড়ে পাঁচশ জন কংগ্রেসী এম-পির মধ্যে মাত্র দু-চারজন সরকারী নীতির প্রশংসা করতে করতে শেষের দিকে ভুল করে সরকারের সমালোচনা করছিলেন।
রাজনৈতিক দুনিয়ার জল আরো ঘোলা হল। যমুনার জল আরো গড়িয়ে গেল। কংগ্রেস পার্লামেণ্টারী পার্টিতে সরকারী নীতির সমালোচকদের সংখ্যা বাড়ল, সমালোচনা তীক্ষ্ম থেকে তীক্ষ্ণতর হল। মাঝে মাঝে নয়, প্ৰতি মিটিংয়েই সমালোচনা শুরু হল। এখন আর গোপনে নয়, প্ৰকাশ্যে সর্বজনসমক্ষে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে কংগ্রেস পার্লামেণ্টারী পার্টির সেক্রেটারীরা এই সব সমালোচনার খবর দিতেন করসপনডেন্টদের। ভারতবর্ষের প্রতিটি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় মোটা মোটা বড় বড় হরফে এসব খবর ছাপা হত।
ওদিকে উত্তর সীমান্তের নানা দিক থেকে নানা খবর আসছিল। মাঝে মাঝেই। কখনো নেফার জঙ্গল থেকে, কখনো লাডাকের পাৰ্বত্য মরুভূমি থেকে, কখনো ওয়ালঙ থেকে, কখনো দৌলত-বেগওলডি বা চুণ্ডল, মাগার, ডেমচক থেকে গুলীর আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। ঐসব গুলীর আওয়াজ নিউজ এজেন্সীর টেলিপ্রিন্টার মারফত দিল্লী পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গেই মিস্টার স্পীকার, স্যার-এর টেবিলে জমা হত। কলিং অ্যাটেনশন-অ্যাডজর্নমেণ্ট মোশানের নোটিশ। এয়ার-কণ্ডিসনড লোকসভা চেম্বার রাজনৈতিক উত্তেজনায় দাউ দাউ করে জ্বলত সারা দিন।
ডিফেন্স মিনিস্ট্রি-এক্সটারন্যাল অ্যাফেয়ার্স মিনিষ্টিতেও চাঞ্চল্য বেড়ে গেল অনেক। মিটিং-কনফারেন্স প্রেসনোট-প্রটেস্ট নোটের ঠেলায় আমাদের কাজের চাপ সহস্ৰ গুণ বেড়ে গেল।
তারতবর্ষের ইতিহাসের সে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। তখন ভারতবর্ষের ইতিহাস আর একবার মোড় ঘুরছিল। আমরা দিল্লীপ্রবাসী, করসপনডেন্টের দল প্ৰতিদিন সেই ইতিহাসের টুকরো টুকরো সংগ্রহ করে পরিবেশন করছিলাম অসংখ্য পাঠক-পাঠিকার জন্য।
এই বাজারে দিল্লীর গুরুত্ব আরো বেশী বেড়ে গেল। এক দল ফরেন করসপনডেন্ট আগেও ছিলেন। কিন্তু এই বাজারে আরো অনেকে এলেন সানফ্রান্সিসকো-নিউইয়র্ক-ওয়াশিংটন-অটোয়া-লগুনপ্যারিস–ব্রাসেলস–মস্কো–প্ৰাগ-কায়রো–করাচী–সিডনি-টোকিও থেকে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকেও আরো অনেক করসপনডেন্ট এলেন দিল্লী। ইউনাইটেড নেশনস-লণ্ডন-প্যারিসমস্কো-কায়রো-টোকিওর সঙ্গে সঙ্গে দিল্লীও পৃথিবীর অন্যতম প্ৰধান নিউজ সেণ্টার হল।
আমার কাগজের ডাইরেক্টর ও সম্পাদক এবার উপলব্ধি করলেন আমাকে শুধু মাইনে দিলেই চলবে না, দিল্লী থেকে গরম গরম খবর পাবার জন্য আরো কিছু করতে হবে। সাধারণত দিল্লীর বিষয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য এতদিন আমাকেই কতাঁরা ডেকে পাঠাতেন। এবার সম্পাদক স্বয়ং দিল্লী এলেন আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা করার অছিলায় সম্পাদক সাহেব আরো কয়েকটি অফিস ঘুরে ফিরে তাদের কাজকর্ম ও অফিসের বিধিব্যবস্থা দেখে নিলেন। তারপর আর আমাকে বলতে হল না, নিজেই উপলব্ধি করলেন আমার কাছ থেকে আরো বেশী ও ভাল কাজ পেতে হলে আমাকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
এডিটর সাহেব নিজেই বললেন, বাচ্চু, সব চাইতে আগে তোমার একটা গাড়ি চাই। গাড়ি ছাড়া এখানে কাজ করা রিয়েলি মুশকিল।
আমি বললাম, এখন প্ৰায় সব করসপনডেন্টদেরই গাড়ি আছে। গাড়ি না হলে ঠিক স্বাধীনভাবে ইচ্ছামত ঘোরাঘুরি করা অসম্ভব।
এডিটর সাহেব বললেন, তাছাড়া আমাদের একটা অফিস দরকার।
শেষে বললেন, তুমি এবার ওয়েস্টার্ন কোর্ট ছেড়ে গ্ৰীন পার্কে চলে যাও। বাড়িতে একটা টেলিফোন নাও। গাড়ি আর টেলিফোন থাকলে বিশেষ কোন অসুবিধা হবে না।
আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম, তা ঠিক। তবে ভাবছিলাম। ফাল্গুন মাসের পরেই গ্রীন পার্ক যাব।
কেন তুমি কি ফাল্গুনে বিয়ে করর?
আমি মাথা নীচু করে বললাম, তাইতো ঠিক হয়েছে। দু’টো এসট্যাবলিসমেন্ট মেনটেন করতে অযথা তোমার কিছু খরচ হচ্ছে। যাই হোক এই ক? মাস তাহলে এখানেই থেকে যাও। কিন্তু গেট এ টেলিফোন ইমিডিয়েটলি।
একটু পরে বললেন, আমাদের নিউজ পেপার সোসাইটি বিল্ডিংএ হয়ত একটা ঘর পাব। কিছুকালের মধ্যেই। যতদিন না পাওয়া যায়। ততদিন তুমি একটা পার্ট-টাইম স্টেনো রেখে দাও।
একটা মাস ঘুরতে না ঘুরতেই সত্যি সত্যিই অফিসের পয়সায় আমি একটা গাড়ি কিনলাম। স্ট্যাণ্ডার্ড হেরল্ড! টু-ডোর। টেলিফোনও হল। একশ টাকা দিয়ে এক’জন পার্ট-টাইম মাদ্রাজী স্টেনোও রাখলাম।
ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক চরম সঙ্কটের দিনে আমার ভাগ্যাকাশে এমনভাবে সৌভাগ্যের সুৰ্যোদয়, কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি। দিল্লীর যদি এতটা গুরুত্ব না বাড়ত, যদি কাগজে কাগজে প্ৰতিযোগিতা এত তীব্র না হত, তাহলে আমার ইতিহাসও অন্যরকম হত। কিন্তু বিধাতাপুরুষের নির্দেশ কি ব্যর্থ হতে পারে?
তিলে তিলে বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে অজস্র দিনের পরিশ্রম দিয়ে, অসংখ্য দিনের অনাহার। আর অনিদ্রার বিনিময়ে সেদিন যখন আমি কর্মজীবনে এতবড় স্বীকৃতি, এতবড় মৰ্যাদা, এতবড় সাফল্য অর্জন করলাম, তখন আমি নিজেই চমকে গিয়েছিলাম। কলকাতায় যে আমি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস একবেলা এক আনার ছোলার ছাতু আর দু পয়সায় ভেলী গুড় খেয়ে কাটিয়েছি, যে আমি শুধু এক মুষ্টি অন্ন আর ভদ্রভাবে বাঁচার দাবী নিয়ে কলকাতার পথে পথে ভিখারীর মত অসংখ্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি, সেই আমি গাড়ি চড়ব? বিধাতাপুরুষের কি বিচিত্র খামখেয়ালি! আগে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু অসংখ্যা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চায়ের পর আজ বিশ্বাস করি এই দুনিয়ায় সবকিছু সম্ভব। ভগবানের আশীৰ্বাদ পেলে পঙ্গু সত্যি সত্যিই গিরি-পৰ্বত–লঙ্ঘন করতে পারে।
দোলাবৌদি, আজ বুঝেছি ভগবান বড় বিচিত্র। কখনো নির্মম, কখনো করুণাময়। তিনি সবাইকে কিছুতেই সবকিছু দেন না। যে কর্মজীবনে সাফল্য অর্জন করবে, বৃহত্তর সমাজে প্ৰতিষ্ঠা পাবে, অগণিত মানুষের হৃদয়ে যার আসন, সে ব্যক্তিগত জীবনে কিছুতেই সুখী হতে পারে না। নিজের জীবনের চরম অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি এই সত্য উপলব্ধি করেছি।
আমার এই মেমসাহেবের কাহিনীর শেষ হতে আর বেশী বাকী নেই। তুমি আর একটু পরেই বুঝবে আমার এই সাফল্য সার্থকতার মধ্যেও বেদনা কোথায়। বুঝবে কেন আমি এত কিছু পেয়েও আজি লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল ফেলি। বুঝবে এত মানুষের সংস্পর্শে থেকেও কেন আমি নিঃসঙ্গ। আর একটু জানলেই বুঝবে কেন আমি ক্লান্ত।
যাই হোক ভারতবর্ষের বিচিত্র রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আমার সম্পাদকের দয়ায় আমার এই অভাবনীয় সাফল্যের পর মেমসাহেবকে লিখলাম, তুমি কি কোনদিন তন্ত্রসাধনা করেছিলে? তুমি যদি জ্যোতিষী হতে তাহলে আমার সাহায্য ও সহযোগিতা। ছাড়া তোমার পক্ষে আমার ভূত-ভবিষ্যৎ জানা সম্ভব ছিল না। একমাত্র তন্ত্রসাধনা করলেই কিছু না জেনেও অপরের ভবিষ্যৎ বলা যায়। আমার সম্পর্কে তুমি যা যা বলেছিলে, যা যা আশা করেছিলে তার প্রায় সবই তো সত্য হয়ে গেল। তাই আজ আমার মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে, তুমি হয়ত তন্ত্রসাধনা করেছ।
গজানন রোজ গাড়িটাকে দু-দুবার করে পরিষ্কার করে। ড্রাইভারের গাড়ি চালান ওর একটুও পছন্দ ছিল না। বলত, না, না, ছোটোসাব, ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে দেবেন না। ওরা যা তা করে গাড়ি চালায়। আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর রাখতে হবে, কোনদিন ভাবিনি। তাই গাড়ি চালান আগে শিখিনি। তোমাকে নিয়ে এই গাড়িতে ঘুরে বেড়াবার আগে নিশ্চয়ই ড্রাইভিং শিখতাম, না। কিন্তু গজানন রাজী হল না। বাধ্য হয়েই আমি গাড়ি চালাচ্ছি। কিন্তু তবুও পিছনে বসে বসে গজানন আমাকে বলে, ছোটোসাব, আস্তে আস্তে গিয়ার দাও।
পরশু দিন সন্ধ্যাবেলায় গ্রীন পার্কে তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম। কথায় কথায় গজানন হতচ্ছাড়া কি বলল জান? বলল, বিবিজির কিসমৎ খুব ভাল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন রে? ও বলল, বিবিজির কিসমৎ-এর জন্যই তো আপনার সবকিছু হচ্ছে। আমি ওকে দাবড় দিয়ে বললাম, বাজে বকিস না। হতচ্ছাড়া বলল, ছোটোসাব, বিবিজি না থাকলে তোমার কিছুই হত না। ওর কথাটা আমার ভালই লেগেছিল। কিন্তু মুখে বললাম, তুই তোর বিবিজির কাছে যা, আমার কাছে থাকতে হবে না।
ভাল কথা, সেদিন তোমার কলেজে ট্রাঙ্ককল করলে তুমি ঐ রকম চমকে উঠলে কেন? তুমি যত অস্বস্তি বোধ করছিলে আমার তত মজা লাগছিল। ঠিক করেছি। প্ৰতি সপ্তাহেই তোমাকে ট্রাঙ্ককল করব।
শেষে কি লিখেছিলাম জান দোলাবৌদি? লিখেছিলাম, ফাঙ্কন মাস তো প্ৰায় এসে গেল। এবার বল বিয়েতে তোমার কি চাই? লজ্জা কর না। তোমার যা ইচ্ছা, আমাকে লিখো। আমি নিশ্চয়ই তোমার আশা পূর্ণ করব।
মেমসাহেব লিখল, তোমার প্রত্যেকটা চিঠির মত এই চিঠিটাও অনেকবার পড়লাম। পড়তে ভারী মজা লাগল। তোমার এডিটর যে এমন অপ্ৰত্যাশিতভাবে আমাদের স্বপ্ন বাস্তব করে তুলবেন, আমি সত্যি ভাবতে পারিনি। ভগবানকে শত-কোটি প্ৰণাম না। জানিয়ে পারছি না। তারই ইচ্ছায় সবকিছু হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। ইঙ্গিত দেখে মনে হয়। ভগবান নিশ্চয়ই আমাদের সুখী করবেন।
তুমি আমার গাড়ি নিয়ে খুব মজা করে ঘুরে বেড়াচ্ছ। ভাবতেও আমার হিংসা হচ্ছে। আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছে, তুমি গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তুমি যখন গাড়ি চালাও তখন তোমাকে দেখতে নিশ্চয়ই খুব ভাল লাগে। খুব স্মার্ট? খুব স্থাপ্তিসাম?–খুব সাবধানে গাড়ি চালাবে। তোমাদের দিল্লীতে বড় বেশী অ্যাকসিডেন্ট হয়। তুমি গাড়ি চালােচ্ছ জানার পর আর একটা নতুন চিন্তা বাড়ল। সব সময় মনে রেখে আজ আর তুমি একলা নও। মনে রেখে তোমার জীবনের সঙ্গে আমার জীবনও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। সুতরাং তোমার ক্ষতি হওয়া মানে আমারও সর্বনাশ! ভুলে যেও না যেন, কেমন?
আচ্ছা সেদিন তুমি হঠাৎ ট্রাঙ্ককল করলে কেন বলত? কলেজের অফিসে তখন লোকজনে ভর্তি ছিল। প্ৰথমে প্রিন্সিপ্যালই টেলিফোন ধরেন। তারপর যেই শুনলেন দিল্লী থেকে আমার ট্রাঙ্ককল এসেছে তখন তার আর বুঝতে বাকি রইল না যে তুমিই ট্রাঙ্ককাল করছি। কারণ তোমার সঙ্গে যে আমার বিয়ে হবে, একথা কলেজের সবাই জানেন। প্রিন্সিপ্যালও শুনেছেন। তাছাড়া বেরুটি থেকে কেনা জার্মান ফোলডিং ছাতাটা দু-একদিন ব্যবহার করায় উনি একথাও জানতে পেরেছেন যে তুমিই এনে দিয়েছ। তাই তো প্রিন্সিপ্যাল লাইনটা অফিসে দিয়েছিলেন এই ভেবে যে, আমি ওঁর সামনে তোমার সঙ্গে ঠিকমত কথা বলতে পারব না। কিন্তু কলেজের অফিস কি ফাঁকা থাকে? আমি তোমার কোন কথারই জবাব দিতে পারছিলাম না। তাছাড়া ওসব কি যা তা প্রশ্ন করছিলে? কলেজের অফিসে বসে বসে ঐসব প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায়? তাছাড়া আমার এই সব একান্ত ব্যক্তিগত ও গোপনীয় খবর জানার যদি এতই গরজ হয়, তাহলে একবার চলে এসে। আসবে দু-এক দিনের জন্য? এলে খুব খুশি হব।
বিয়ের সময় তুমি আমাকে কিছু উপহার দিতে চেয়েছ। শাড়িগহনার কথা বলছ? ওসব কিছু আমার চাই না। আজ আমার শুধু একটাই কামনা–সে কামনা তোমাকে পাওয়ার। মন-প্ৰাণ দিয়ে তোমাকে আমি পেতে চাই। তাহলেই আমি খুশি। স্ত্রী হয়ে আর কি কামনা, আর কি প্ৰত্যাশা থাকতে পারে? সত্যি বলছি তুমি আমাকে কিছু উপহার দিও না। আমি শুধু তোমাকেই উপহার চাই। দেবে তো?
মেজদি থাকতে ওকে ম্যানেজ করে নানা রকম ধোকা দিয়ে তোমার কাছে গেছি কবার। এখন আর তা সম্ভব নয়। তাই বলছিলাম তুমি যদি আসতে। তবে ভাল হত। তোমাকে না দেখে আমি থাকতে পারি না। তুমি কি আমার সে কষ্ট উপলব্ধি করতে পার? যদি পাের। তবে দয়া করে অন্তত একটি দিনের জন্য দেখা দিয়ে যেও।
ভাল কথা, মেজদির বাচ্চা হবে। এইত কমাস আগে বিয়ে হলো! এরই মধ্যেই বাচ্চা? না জানি আমার অদৃষ্ট কি আছে?
মেমসাহেবের এই চিঠির উত্তর তো পোস্টকার্ডে দেওয়া যায় না। কর্মব্যস্ততার জন্য তাই কদিন চিঠি দিতে পারিনি। তাছাড়া কদিনের জন্য সৌরাষ্ট্র গিয়েছিলাম। এমনি করে উত্তর দিতে বেশ দেরী হয়ে গেল। ইতিমধ্যে মেমসাহেবের আবার একটা চিঠি পেলাম। জানলাম, ইতিমধ্যে একদিন ভোর পাঁচটার সময় পুলিস এসে খোকনদের ফ্ল্যাট সার্চ করে গেছে। খোকনকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল। বিকেলবেলা ছেড়ে দিয়েছিল।
কলকাতার কাগজগুলো পড়ে বেশ বুঝতে পারছিলাম। বাংলা দেশের রাজনৈতিক আকাশের ঈশান কোণে ঘন কালো মেঘা জমতে শুরু করেছে। দামামা আবার বেজে উঠবে। সভা-সমিতির পালা এবার শেষ হবে, শুরু হবে মিছিল, বিক্ষোভ, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ। তারপর লাঠি, কাঁদুনে গ্যাস, গুলী। আবার বিক্ষোত, আবার মিছিল হবে। আবার চলবে লাঠি, গুলী। কিছু মানুষ হারাবে তাদের প্ৰিয়জনকে। তার কাঁদবে, সারা জীবন ধরে কাঁদবে।
খোকন যে বেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে, সেকথা বুঝতে আমার কষ্ট হল না। এ নেশার ঘোর ওর এখন কাটবে না। কিছু খেসারৎ না দিলে এ নেশা। কাটে না। অনেকের কোন কালেই কাটে না। খোকনেরও কাটবে। কিনা ঠিক নেই।
মেমসাহেব অবশ্য ভাবছিল আমি কলকাতা গিয়ে খোকনকে বুঝিয়ে-সুবিয়ে একটা কিছু করি। কিন্তু কি করব? কি বোঝাব ‘ খোকনকে? বোঝাতে চাইলেই কি সে বুঝবে? আমারও মেমসাহেবকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছিল। ভেবেছিলাম দু-তিন দিনের জন্য ঘুরে আসব। কিন্তু মেমসাহেবের পরের চিঠিতে খোকনের খবর পাবার পর ঠিক করলাম, না যাব না। মেমসাহেবকে লিখে দিলাম, সত্যি ভাষণ ব্যস্ত। এখন কোনমতেই যেতে পারছি না। যদি এর মধ্যে সময় পাই তাহলে নিশ্চয়ই তোমাকে দেখে আসব। শেষে লিখলাম রাজনীতি অনেকেই করে, খোকনও করছে। তার জন্য অত চিন্তা বা ঘাবড়াবার কি কারণ আছে? তাছাড়া খোকন তো আর শিশু নয়। সুতরাং তুমি অত ভাববে না।
খোকন সম্পর্কে আমার এই ধরনের মন্তব্য মেমসাহেব ঠিক পছন্দ করত না, তা আমি জানতাম। কিন্তু কি করব? আমি স্থির জানতাম খোকন আমার কথা শুনবে না। মেমসাহেবের কথাও তার পক্ষে শোনা তখন সম্ভব ছিল না। সুতরাং আমি আর কি লিখব?
আমার চিঠি পাবার সঙ্গে সঙ্গেই মেমসাহেব উত্তর দিল, যে কোন কারণেই হোক তুমি খোকন সম্পর্কে বেশ উদাসীন। হয়ত ওকে ঠিক পছন্দ করো না। জানি না কি ব্যাপার। তোমার সঙ্গে এ বিষয়ে তর্ক করব না। তবে জেনে রাখা খোকন সম্পর্কে আমার ও আমাদের পরিবারের ভীষণ দুর্বলতা।
আমি সত্যি কোন তর্ক করিনি। তর্ক করব কেন? মানুষের স্নেহ-ভালবাসা নিয়ে কি তর্ক করা উচিত? কখনই নয়। তাছাড়া যুক্তি-তর্ক ন্যায়-অন্যায় বাচ-বিচার করে কি মানুষ তালবাসতে পারে? না। তা আমি জানি। সুতরাং এই বিষয়ে মেমসাহেবকে কিছু না লিখে এবার খোকনকেই একটা চিঠি দিলাম। লিখলাম, তোমার মত ভাগ্যবান ছেলে এই পৃথিবীতে খুব কম পাওয়া যাবে। তার কারণ এই পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর, বড় কৃপণ। আপনজনের কাছ থেকেই ভালবাসা পাওয়া এই পৃথিবীতে একটা দুর্লভ ব্যাপার। সুতরাং অন্যের কাছ থেকে স্নেহভালবাসা সত্যি সৌভাগ্যের কথা। তুমি সেই অনন্য ভাগ্যশালীদের অন্যতম। অনেক সুখ, অনেক আনন্দ ত্যাগ করে, অনেক কষ্ট, অনেক দুঃখ সহ্য করে, অনেক আত্মত্যাগ স্বীকার করে তোমার বড়মা ও দিদিরা তোমাকে মানুষ। করেছেন। তোমাকে নিয়ে ওঁদের অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন। তোমার গায় একটু আঁচড় লাগলে ওদের পাজরার একটা হাড় ভেঙে যায়। হয়ত এতটা স্নেহ-ভালবাসার কোন অর্থ হয় না। কিন্তু তুমি তো জান ভাই এই স্নেহ-ভালবাসা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। তোমার বড়মা ও দিদিদেরও তাই অন্ধ করে দিয়েছে। তুমি ওদের এই অমূল্য স্নেহ-ভালবাসার অমর্যাদা কোনদিন করবে না, তা আমি জানি। কিন্তু তোমার জন্য আজকাল ওঁরা বড় চিন্তিত, বড় উদ্বিগ্ন। তুমি কি এর থেকে ওঁদের মুক্তি দিতে পার না? আমার মনে হয় তুমি ইচ্ছা করলেই পার। যাঁরা তোমার জন্য দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর রাত্রি জেগে কাটিয়েছেন, যাঁরা তোমার কল্যাণে ব্ৰত-উপবাস করেছেন, কালীঘাটে পূজা দিয়েছেন, তারকেশ্বরে ছুটে গিয়েছেন, তুমি কি তাদের উৎকণ্ঠ দূর করতে পার না? পার না। ওঁদের চোখের জল বন্ধ করতে? একটু স্থির হয়ে ভেবে দেখা।
আমি এক’জন সাংবাদিক হয়ে তোমাকে রাজনীতি করতে মানা করব না। তবে আগে লেখাপড়াটা শেষ করলে ভাল হয় না? লেখাপড়া শিখে সমাজের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে দশজনের এক’জন হয়ে রাজনীতি করা ভাল না? রাজনীতি নিশ্চয়ই করবে, একশবার করবে। স্বাধীন দেশের নাগরিকরা নিশ্চয়ই রাজনীতি করবে। কিন্তু তার আগে নিজে প্ৰস্তুত হও, তৈরী হও, উপযুক্ত হও।
তোমার ফাইন্যাল পরীক্ষা এসে গেছে। তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। একটু মন দিয়ে লেখাপড়া করলেই চমৎকার রেজাল্ট করবে। তুমি তো জান তোমার বড়মার শরীর ভাল না, ছোড়দিও বড় একলা। ওঁদের একটু দেখো। আর ভুলে যেও না তোমার বাবার কথা যিনি শুধু তোমারই মুখ চেয়ে উদয়-অস্ত পরিশ্রম করছেন। একটু তাড়াতাড়ি মানুষ হয়ে ঐ বৃদ্ধ মানুষটাকে একটু শান্তি দেবার চেষ্টা করো।
শেষে জানালাম, এ চিঠির উত্তর না দিলেও চলবে। তোমার বক্তব্য তোমার ছোড়দিকে জানিও। সেই আমাকে সবকিছু জানাবে। আর হ্যাঁ, তুমি যদি চাও তাহলে দিল্লী আসতে পাের। যেদিন ইচ্ছা সেদিনই এসে। এবং এখানে এলে তোমার পড়াশুনা ভালই হবে। তাছাড়া আমিও তোমার সাহচৰ্য পেতাম।
এই চিঠি লেখার পরই আমি আবার বাইরে গেলাম। উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেসের ঘরোয় কোন্দল প্ৰায় চরমে উঠেছিল। প্ৰদেশ কংগ্রেস কমিটির নির্বাচন নিয়ে দুই দলে প্ৰায় কুরুক্ষেত্রের লড়াই শুরু করেছিলেন। এডিটরের নির্দেশে সেই কুরুক্ষেত্রের লড়াই কভার করতে আমি লক্ষ্মেী চলে গেলাম। যাবার আগে মেমসাহেবকে জানাতে পারিনি। লক্ষ্মেী পৌঁছেও প্ৰথম দুদিন সময় পাইনি। তার পরদিন ওকে জানালাম যে, আমি দিল্লীতে নেই, লক্ষ্মৌ এসেছি।
এক সপ্তাহ লক্ষ্মৌ থাকায় পর লক্ষ্মেীবাসী এক সাংবাদিক বন্ধু ও এক’জন এম-পির পাল্লায় পড়ে দিল্লী আসার পরিবর্তে চলে গেলাম নৈনীতাল। ঠিক ছিল দুদিন থাকব। কিন্তু ওদের পাল্লায় দিল্লী ফিরলাম এক সপ্তাহ পরে।
দিল্লী ফিরে অনেকগুলো চিঠি পেলাম। মেজদির চিঠিতে জানলাম ন্যাতাল অফিসার কোচিনে বদলী হয়েছেন। ওখানে এখন কোয়ার্টার পাওয়া যাবে না। তাই মেজদি কলকাতা যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে কোয়ার্টার পেলেও কোচিন যাবেন না, একেবারে আমাদের বিয়ে দেখে তবে ফিরবেন। মনে মনে ভাবলাম চমৎকার। আমি মেজদিকে লিখলাম, ছি, ছি, আত তাড়াতাড়ি কেউ কো-চিন যায়? আরো এই আকশাই চীনের বাজারে? একেবারে খোকনকে পেরাম্বুলেটারে চড়িয়ে বঙ্গোপসাগরের ধার দিয়ে বেড়াতে বেড়াতে ভুবনেশ্বরে চা খেয়ে, কোনারকে কফি খেয়ে, ওয়ালটেয়ারএ কাজু খেয়ে, মাদ্রাজে দোস খেয়ে, কন্যাকুমারিকায় ভারত মহাসাগরের জলে সাঁতার কেটে, ত্ৰিবান্দ্ৰমে নারকেল খেয়ে কো-চিন যাবেন। কেমন? দরকার হয় আমিই পেরাস্কুলেটার দেব। কারণ পরে ওটা তো আমাদেরও কাজে লাগবে, তাই না?
খোকনকে চিঠি লেখার জন্য মেমসাহেব খুব খুশি হয়েছিল। এ-কথাও জানিয়েছিল যে খোকনের একটু পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।
এবার ঠিক করলাম দুতিন দিনের জন্য কলকাতা যাব। এডিটরকে চিঠি লিখে এক সপ্তাহের ছুটি নিলাম। কলকাতা যাবার কথা মেমসাহেবকে কিছু লিখলাম না। মেজদিকে লিখলাম, কতকাল আপনাকে দেখিনি। মনে হচ্ছে যেন কত যুগে আগে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমি আপনাকে না দেখে আর থাকতে পারছি না। কাজকর্মে মন বসছে না। রিপোর্ট লিখতে গিয়ে বার বার ভুল করছি। মুখে কিছু ভাল লাগছে না। এমন কি মধুবালা-সোফিয়া লরেনের ফিল্ম দেখতেও ইচ্ছা করছে না। আমাকে মাপ করবেন, তাই আমি আগামী সোমবার সকালে দিল্লী মেলে কলকাতা যাচ্ছি। আপনাকে দেখার জন্য।