ইতিহাসের সে এক প্রাগৈতিহাসিক অধ্যায়ে কক্ষচ্যুত গ্রহের আকারে পৃথিবী মহাশূন্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। উদ্দেশ্যহীন হয়ে পৃথিবী কতদিন ঘুরপাক খেয়েছিল, তা আমার জানা নেই। জানা নেই কতদিন পর সে সূৰ্যকে কেন্দ্র করে আপনি কক্ষপথ আবিষ্কার করেছিল। তবে জানি প্রতিটি মানুষকেও এমনি উদ্দেশ্যহীন হয়ে মহাশূন্যে ঘুরপাক খেতে হয়। সময় কম-বেশী হতে পারে। কিন্তু কালের এই নির্মম রসিকতার হাত থেকে কেউ মুক্তি পায় না। আমিও পাই নি। তোমরাও তো পাও নি।
মেমসাহেবকে পাবার পর আমার সে অকারণ ঘুরপাক খাওয়া বন্ধ হল। ঠিকানাহীন চলার শেষ হলো। আপনি কক্ষপথ দেখতে পেলাম। দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়া বন্ধ হলো; দুনিয়াটাকে, জীবনটাকে বড় ভাল লাগল। তুমি তো জান আমি সব কিছু পারি; পারি না। শুধু কবিতা লিখতে। তাই কাব্য করে ঠিক বোঝাতে পারছি না।
বড়বাজার বা চিৎপুরের মোড়ের ফুলের দোকান দেখেছ? দেখেছ তো কত অজস্র সুন্দর সুন্দর ফুল বোঝাই করা থাকে দোকানগুলিতে? ঐ ভিড়ের মধ্যে এক একটি ফুলের সৌন্দৰ্য, বৈশিষ্ট্য যেন খুজে পাওয়া যায় না। কিন্তু ঐ দোকান থেকে সামান্য কটি ফুল কিনে একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে ফ্লাওয়ার-ভাস-এ রাখলে সারা ড্রইংরুমটা যেন আলোয় ভরে যায়। তাই না? হাওড়া ব্রীজের তলায়, জগন্নাথ ঘাটের পাশে মণ দরে বুড়ি বোঝাই করে রজনীগন্ধা বিক্ৰী হয়। কিন্তু সে দৃশ্য দেখা যায় না। তার চাইতে অর্গানের ওপর একটা লম্বা ফ্লাওয়ার-ভাসের মধ্যে মাত্র দু-চারটি স্টিক দেখতে অনেক ভাল লাগে, অনেক তৃপ্তি পাওয়া যায় মনে।
জগন্নাথ ঘাটের রজনীগন্ধার পাইকারী বাজার দেখে নিশ্চয়ই কোন কবির কাব্যচেতনা জাগবে না। কিন্তু প্ৰেয়সীরা অঙ্গে একটু রজনীগন্ধার সজ্জা অনেকের মনেই দোলা দেবে।
আমি রজনীগন্ধা না হতে পারি। কিন্তু ক্যাকটাস তো হতে পারি? মেমসাহেব সেই ক্যাকটাস দিয়ে জাপানীদের ঢং-এ চমৎকার গৃহসজা করেছিল। আমি আমিই থেকে গেলাম। শুধু পরিবেশ পরিবর্তনে আমার জীবন-সৌন্দর্যের প্রকাশ পেলে।,
ইডেন গার্ডেনের ধার দিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে আমরা দুজনে গঙ্গার ধারে হারিয়ে গেলাম। কয়েকটা বড় বড় জাহাজ পৃথিবীর নানা প্রান্ত ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গঙ্গাবক্ষে বিশ্রাম করছিল। ক্লান্ত আমিও নানা প্ৰান্ত ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গঙ্গাবক্ষে বিশ্রাম করছিল। ক্লান্ত আমিও মেমসাহেবের কাঁধে মাথা রেখে একটু বিশ্রাম করছিলাম।
মেমসাহেব আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করল, এমনি করে কতদিন কাটাবে?
তুমি কি ঘর বাঁধার কথা বলছ?
সব সময় স্বাৰ্থপরের মত শুধু ঐ এক চিন্তা, মেমসাহেব মিহি সুরে আমাকে একটু টিল্পনি কাটল।
তুমি কি অন্য কিছু বলছ? আমি জানতে চাইলাম।
এবার মেমসাহেবের পালা। তুমি কি নিজের জীবন সম্পর্কে একটুও ভাববে না? শুধু মেমসাহেবকে ভালবাসলেই কি জীবনের সবকিছু মিটবে?
নিজের কথা ভাবতে ভাবতে কিছু হদিশ না পেয়েই তো তোমার ঘাটে এই ডিঙি ভিড়িয়েছি। এখন তো তোমার দায়িত্ব।
তাই বুঝি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
অন্ধকারটা একটু গাঢ় হলো। আমরা আর একটু নিবিড় হলাম। ঠিক সেই মুহুর্তে কোথা থেকে একটা চীনেবাদামওয়ালা হাজির হলো আমাদের পাশে। লজায় একটু সঙ্কোচবোধ করলাম দুজনেই। বাদাম চিবুবার কোন ইচ্ছা না থাকলেও ওর উপস্থিতিটা অসন্থ মনে হচ্ছিল বলে তাড়াতাড়ি দু’ প্যাকেট বাদাম কিনলাম।
আমি আবার একটু নিবিড় হলাম। বললাম, মেমসাহেব একটা গান শোনাবো?
এখানে নয়।
এখানে নয় তো তোমার কলেজের কমনরুমে বসে গান শোনাবো?
নির্বিকার হয়ে মেমসাহেব বলে, যখন আমরা কলকাতার বাইরে যাব, তখন তোমাকে অনেক গান শোনাব।
সেদিন মেমসাহেবের এই কথার কোন গুরুত্ব দিই নি। তেবেছিলাম এড়িয়ে যাবার জন্য ঐ কথা বলছে।
সপ্তাহ খানেক পরের কথা। দুজনে সন্ধ্যার পর বেলভেডিয়ারের ধার দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। মেমসাহেব হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করল, বেড়াতে যাবে?
কোথায়?
কলকাতার বাইরে?
কার সঙ্গে?
আমার সঙ্গে।।
সত্যি?
সত্যি।
আমি আর ধৈর্য ধরতে পারি না। সঙ্গে সঙ্গে জানতে চাইলাম, আজই যাবে?
তুমি কি কোনদিন সিরিয়াস হবে না?
তুমি কি চাও? আমি তোমার সঙ্গে ডিয়ারনেস এলাউন্স বা বাড়িভাড়া নিয়ে আলোচনা করি?
মেমসাহেব হাসে। দুজনে হাত ধরে হাটতে হাঁটতে আরো এগিয়ে যাই।
সেইদিন সন্ধ্যান্তেই আমার প্ল্যান হয়ে গেল। মেমসাহেবের কলেজ থেকে তিন-চার দল ছাত্রী আর অধ্যাপিকা তিন-চার দিকে যাবেন এডুকেশন্সাল টুরে। মেমসাহেবের যাবার কথা ঠিক থাকবে কিন্তু যাখে না। বাড়িতে জানবে মেমসাহেব কলেজের ছাত্রী আর সহকর্মীদের সঙ্গে বাইরে গেছে কিন্তু আসলে–
মেমবাহেব শুধু ইলাদিকে একটু টিপে দেবে। ইলাদি আবার মেজদির ক্লাশ ফ্রেণ্ড। সুতরাং ভবিষ্যতের জন্য একটু সতর্ক থাকাই ভাল।
কবে, কখন, কোথায় আমরা গিয়েছিলাম, সেসব কথা খুলে না। বলাই ভাল। জেনে রাখ, আমরা বাইরে গিয়েছিলাম। নগর কলকাতার লক্ষ লক্ষ মানুষের তিড়ের বাইরে মেমসাহেবকে পেয়ে আমি প্ৰায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিলাম।
তুমি হয়ত ভাবছ ফাস্ট ক্লাশ কম্পার্টমেন্টের কুপেতে করে আমরা দুজনে হনিমুন করতে বেরিয়েছিলাম। তা নয়। অত টাকা কোথায়? আমি তো মাত্র পনের টাকা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। তবে আমার মেমসাহেব করুণাসাগর বিদ্যাসাগরের চাইতেও উদার ছিল। সেকেণ্ড ক্লাশেরই টিকিট কেটেছিল। গেস্টহাউসে দু’টো ঘর ভাড়া নিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, অযথা কেন খরচ করছি? একটা ঘর নিলেই তো হয়।
মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে মেমসাহেব বলেছিল, তুমি কি লাউঞ্জে রাত কাটাবে?
লাউঞ্জে?-না। তার চাইতে বরং ডাইনিং রুমের টেবিলে রাত কাটাব। কি বল?
আচ্ছা ওসব পরে বলব। ট্রেনের কম্পার্টমেণ্টে মেমসাহেবকে পাশে পেয়ে আমি যেন আর স্থির থাকতে পারছিলাম না। ইচ্ছা! করছিল, জড়িয়ে ধরি, আদর করি। তা সম্ভব ছিল না। যাত্রীদের সতর্ক দৃষ্টিকে যতদূর সম্ভব ফাঁকি দিয়ে মেমসাহেবকে পাশে পাবার দুর্লভ সুযোগ উপভোগ করার চেষ্টা করেছি। ও কখনো হোসেছে, কখনও চোখ টিপে ইশারা করেছে।
যখন একটু বাড়াবাড়ি করেছি, তখন বলেছে, আঃ। কি করছ?
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছি, এক্সকিউজ মী, আপনি আমাকে কিছু বলছেন?
আজ্ঞে আপনাকে? না, না, আপনাকে কি বলব?
থ্যাঙ্ক ইউ।
নো মেনশন।
আশপাশের ঘর-বাড়ি, বন-জঙ্গল, নদী-নালা পিছনে ফেলে। ট্রেনটা ছুটে চলে সামনের দিকে। আমাদের দুজনের মনটাও দৌড়তে থাকে ভবিষ্যতের দিকে। কত শত অসংখ্য স্বপ্ন উকি দেয় মনের মধ্যে। কত আশা, কত আকাঙ্ক্ষা রূপ নিতে চায়। ভবিষ্যতের সেই সব স্বপ্নকে ঘিরে।
নতুন কোন স্বপ্ন, নতুন কোন আশা আমার মনে আসে নি। চিরকাল মানুষ যা স্বপ্ন দেখেছে, যা আশা করেছে, আমি তার বেশী একটুও ভাবিনি। ভাবছিলাম, একদিন অনিশ্চয়তা নিশ্চয়ই শেষ হবে। মেমসাহেব কল্যাণীরূপে আমার ঘরে আসবে, আলো জ্বলে উঠবে আমার অন্ধকার ঘরে।
তারপর?
উপভোগ?
নিশ্চয়ই।
সম্ভোগ?
নিশ্চয়ই।
তবে ঐ সম্ভোগের মধ্যেই দ্বৈত জীবনের যবনিকা টানব না। দুজনে হাত ধরে এগিয়ে যাব। অনেক অনেক এগিয়ে যাব। দশজনের কল্যাণের মধ্য দিয়ে নিজেদের কল্যাণ করব। দশজনের আশীৰ্বাদ কুড়িয়ে আমরা ধন্য হবে।
ময়নার মত সুর করে মেমসাহেব ডাক দিল, শোন।
আমি ওর ডাক শুনেছিলাম। কিন্তু উত্তর দিলাম না। কেন? ওর ঐ শোন ডাকটা আমার বড্ড ভাল লাগত, বড্ড মিষ্টি লাগত। আমি মুখটা ঘুরিয়ে অন্যদিকে চাইলাম।
আবার সেই ময়নার ডাক, শোন।
ডাকছ?
হ্যাঁ।
মেমসাহেব কি যেন ভাবে, দৃষ্টিটা যেন একটু ভেসে বেড়ায় ভবিষ্ণুতের মহাকাশে। আমি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসি আমার কাছে। ডাক দিই, মেমসাহেব!
মেমসাহেব সংক্ষিপ্ত সাড়া দেয়, কি?
আমাকে কিছু বলবে?
মেমসাহেব এবার ফিরে তাকায় আমার দিকে। ঘন গভীর মিষ্টি দৃষ্টি দিয়ে দেখে আমাকে।
আবার দু-চার মিনিট কেটে যায়। শুধু দুজনে দুজনকে দেখি।
একটা সত্যি কথা বলবে? মেমসাহেব এতক্ষণে প্রশ্ন করে।
বলব।
আবার মুহুর্তের জন্য মেমসাহেব চুপ করে। দৃষ্টিটা একটু সরিয়ে দিয়ে জানতে চায়, একদিন যখন আমরা দুজনে এক হবো, সংসার করব, তখনও তুমি আমাকে আজকের মত ভালবাসবে?
ইচ্ছা করল মেমসাহেবকে টেনে নিই বুকের মধ্যে। ইচ্ছা! করল। আদর ভালবাসায় ওকে স্নান করিয়ে দিয়ে বলি, সেদিন তোমাকে হাজার গুণ বেশি ভালোবাসব। কিন্তু পারলাম না। কম্পার্টমেন্টে আরো ক’জন যাত্রী ছিলেন। তাই শুধু মেমসাহেবের হাতটা টেনে নিয়ে বললাম, আমাকে নিয়ে কি আজও তোমার দুশ্চিন্তা হয়?
মেমসাহেব তাড়াতাড়ি দু’হাত দিয়ে আমার হাতটা চেপে ধরে। বলল, না, না। আমি জানি তুমি আমাকে অনেক অনেক বেশী ভালবাসবে। আমি জানি তুমি আমাকে সুখী করবে।
সত্যি?
সত্যি।
দোলাবৌদি, সে কদিনের কাহিনী আমার জীবনের আবিস্মরণীয় স্মৃতি। সে স্মৃতি শুধু অনুভবের জন্য, লেখার জন্য নয়। তাছাড়া অনেক দিন হয়ে গেছে। প্রতিটি দিনের প্রতিটি মুহুর্তের ইতিহাস মনে নেই। মনে আছে–
হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। কিসের যেন আওয়াজ ভেসে এলো কানে। প্ৰথমে ঠিক বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম মেমসাহেব দরজা নক করে ডাকছে, শোন। সেই ময়না পাখীর ডাক, শোন।
আমি শুনি কিন্তু জবাব দিই না। বেশ লাগে ঐ ডাকটা। কেমন যেন আদর-ভালবাসা আবেদন-নিবেদন, দাবী ইত্যাদি ইত্যাদির ককটেল থাকত ঐ ডাকে। তাই তো আমি তণ্ডামী করে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকি। বেশ বুঝতে পারছি ঘুমুবার সময় একলাই ঘুমিয়েছে কিন্তু আর পারছে না। এবার একটু ছুটে আসতে চাইছে আমার কাছে। হয়ত একটু আদর করতে চায়, হয়ত একটু আদর পেতে চায়। হয়ত আমার পাশে শুয়ে আমার হৃদয়ের একটু নিবিড় উষ্ণতা উপভোগ করতে চায়। হয়ত…
আবার দরজায় আওয়াজ! সঙ্গে সঙ্গে,…শোন…শুনছ?
আমি চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করি, কে?
আমি। দরজা খোল।
বেশ জড়িয়ে জড়িয়ে উত্তর দিলাম, খুলছি।
একটু পরে গায় চাদরটা জড়িয়ে চোখ দু’টো প্ৰায় বন্ধ করা অবস্থায় দরজাটা খুলে দিলাম। চোখ দু’টো বন্ধ করা অবস্থাতেই আবার এসে ব্যপাং করে থাটের ওপর শুয়ে পড়লাম।
মেমসাহেব দরজাটায় পর্দাটা বেশ ভাল করে টেনে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, বাপরে বাপ! কি ঘুম ঘুঘুতে পার তুমি।
আমি ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকায় উত্তর দিলাম না। দেখলাম মেমসাহেব আস্তে আস্তে আমার কাছে এগিয়ে এলো। আমার চোখ দু’টো বন্ধ ছিল। কিন্তু ওর নিশ্বাস পড়া দেখে বেশ বুঝতে পারছিলাম যে কত নিবিড় হয়ে আমাকে দেখছিল। মুখে, কপালে হাত দিয়ে আদর করতে করতে জিজ্ঞাসা করল, ঘুমুচ্ছ?
আমি তবুও নিরুত্তর রইলাম। সজোরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরে শুলাম। মেমসাহেব আমার পাশে বসে বসে। অনেকক্ষণ আমাকে আদর করল। আমি আবার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরে ডান হাত দিয়ে মেমসাহেবকে জড়িয়ে ধরলাম। একটু অস্পষ্টভাবে ডাক দিলাম, মেমসাহেব।
এইত।
আমি আর কোন কথা বলি না।
মেমসাহেব বলে, শুনছ? কিছু বলবে?
আমি তবুও কোন জবাব দিই না। এমনি করে আরো কিছুক্ষণ কেটে যায়। তারপর মেমসাহেব একটু অভিমান করে বলে, তুমি কি জাগবে না? উঠবে না?
আমি হঠাৎ চোখ দু’টো খুলে স্বাভাবিকভাবে বলি, জাগব কিন্তু উঠব না!
মেমসাহেব আমার গালে একটা চড় মেরে বলে, অসভ্য কোথাকার। জেগে থেকেও কথার উত্তর দেয় না।
আমি শুধু বলি, আমি জেগে আছি জানলে কি অমন করে তুমি আমাকে আদর করতে? আবার অসভ্যতা? আমি আস্তে আস্তে মেমসাহেবকে কাছে আনি, বুকের মধ্যে টেনে নিই। একটু আদর করি, একটু ভালবাসি। মেমসাহেবকে একটু দেখে নিই। আদর-ভালবাসায় ওর চোখ দু’টো যেন আরো উজ্জ্বল হয়, গাল দু’টো যেন আরো একটু ফুলে উঠে, ঠোঁট দু’টো যেন কথা বলে।
তারপর?
বলতে পার দোলাবৌদি, তারপর কি হলো? দুষ্টুমি? হ্যাঁ, একটু করেছিলাম। বেশী নয়। শুধু ওর দুটি ওষ্ঠের ভাষা, ইঙ্গিত জেনেছিলাম, আর কিছু নয়। মেমসাহেব? মুখে কিছু বলে নি। চোখ বুজে। মুখ টিপে টিপে হাসছিল।
তারপর?
তারপর মেমসাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করল, গান শুনবে?
আমি বললাম, না।
বেশ করব আমি গান গাইব, তোমায় শুনতে হবে না।
মেমসাহেব ঘুরে বসল। কনুই-এ ভর দিয়ে হাতের ওপর মুখটা রেখে প্ৰায় আমার মুখের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তারপর খুব আস্তে আস্তে গাইল-মন যে কেমন করে মনে মনে, তাহা মনই জানে।
এমনি করেই শুরু হতো আমাদের সকাল। স্নান সেরে নটার মধ্যে ডাইনিং হলে গিয়ে মেমসাহেব ব্রেকফাস্ট খেয়ে আসত। কিন্তু আমি তখনও উঠতাম না। দুইনিং হল থেকে ফিরে এসে মেমসাহেব আমাকে একটা দাবড় দিত, ছি, ছি, তুমি এখনও ওঠনি?
একবার কাছে এস, তবে উঠব।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে মেমসাহেব বলে, না। আমি আর কাছে আসব না।
কেন?
কাছে গেলেই তুমি—
মেমসাহেব আর বলে না। আমি জিজ্ঞাসা করি, তুমি কি?
কি আবার? কাছে গেলেই তো আবার দুষ্টুমি করবে।
তাতে কি হলো?
ঐ টানা টানা ভ্রূ দুটো উপরে উঠিয়ে ও বলে, কি হলো? তোমার ঐ দাড়ির খোঁচা খেয়ে আমার সারা মুখটা এখনো জ্বলে যাচ্ছে।
আমি তিড়িং করে এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে মেমসাহেবকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরি। বলি, জ্বলে যাচ্ছে?
তবে কি!
বিষ দিয়ে বিষক্ষয় করে দিচ্ছি।
আবার অসভ্যতা?
আমি বাথরুম থেকে বেরুতে বেরুতেই মেমসাহেব আমার ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসে। আমি বলি, কি আশ্চৰ্য! একটা বেয়ারাকে বলতে পারলে না?
আজ্ঞে বেয়ারারা আপনার চাকর নয়। ন’টার পর ওরা ব্রেকফাস্ট সার্ভ করে না।
তাই বলে তুমি? যারা দেখল, তারা কি ভাবল বল তো?
ট্রে-টা নামিয়ে রেখে টোস্টে মাখন মাখাতে মাখাতে বলল, ভাবল আমার কপালে একটা অপদাৰ্থ কুঁড়ে জুটেছে।
বল দোলাবৌদি, এ কথার কি জবাব দেব? আমি জবাব দিতাম না। চুপটি করে ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিতাম।
তারপর বারান্দায় দু’টো সোফায় বসে আমরা গল্প করতাম কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণের জন্য একটু ঘুরে ফিরেও আসতাম। দুপুরবেলায় লাঞ্চ খাবার পর মেমসাহেব জিজ্ঞাসা করত, এখন একটু ঘুমোও।
কেন আজকে কি রাত্ৰি জাগবে?
আবার সেই গালে একটা চড়। আবার সেই মন্তব্য, অসভ্য কোথাকার।
দুপুরে ঘুমুতাম না। শুয়ে থাকতাম। আমার হাতটা ভুল করে একটু অবাধ্যতা করলে মেমসাহেব বলত, দয়া করে তোমার। হাতটাকে একটু সংযত কর।
কেন? আমি কি না বলিয়া পরের দ্রব্যে হাত দিতেছি?
পরের দ্রব্য না হইলেও আমি এখনও আপনার দ্রব্য হই নাই বলিয়া আপনি হাত দিবেন না। =
আমি চট করে উঠে পড়ে গায় জামাটা চাপিয়ে বেরুতে যাই। মেমসাহেব জানতে চায়, কোথায় যাচ্ছ?
বাজারে। কেন? মালা কিনতে, টোপর কিনতে।
মেমসাহেব হাসতে হাসতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তাই বলে এই দুপুরে যেও না।
ও আমাকে টেনে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। আমার পাশে কাত হয়ে শুয়ে শুয়ে বলে, এখনই যদি আমার জন্য এত পাগলামি কর, তবে ভবিষ্যতে কি করবে?
দেখ মেমসাহেব, রেশনের হিসাব মত চাল-গম বিক্ৰী করা চলতে পারে। কিন্তু ভালবাসা চলতে পারে না।
আমার কথা শুনে ও মুচকি মুচকি হাসে।
জান দোলাবৌদি, সমাজ-সংসার থেকে কটি দিনের জন্য আমরা দূরে চলে গিয়েছিলাম। ইচ্ছা করলে মুক্ত বিহঙ্গের মত সম্ভোগের মহাকাশে আমরা উড়ে বেড়াতে পারতাম। কিন্তু তা করিনি। মেমসাহেবকে অত কাছে পেয়ে, নিবিড় করে পেয়ে, স্বাধীনভাবে পেয়ে মাঝে মাঝে আমার চিত্ত চঞ্চল হয়েছে, শিরার মধ্যে দিয়ে উত্তেজনার বন্যা বয়ে গেছে, ন্যায়-অন্যায়ের সূক্ষ্ম বিচার-বুদ্ধি কখনও কখনও হারিয়ে গেছে কিন্তু তবুও শান্ত-স্নিন্ধ ভালবাসার ছোয়ায় মেমসাহেব আমাকে সংযত করে রেখেছে। প্রথম, কদিন ওকে কাছে পাবার সময় ওর এই সংযম, সংযত আচরণ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমি হয়ত ওকে শ্রদ্ধাও করতে আরম্ভ করেছিলাম।
ভবিষ্যতের জন্য আমরা অনেক কিছু গচ্ছিত রাখলেও এই কটি দিনে অনেক কিছু পেয়েছিলাম। দেহের ক্ষুধা মিটাইনি। কিন্তু চোখের তৃষ্ণা, প্ৰাণের হাহাকার, মনের দৈন্য দূর হয়েছিল। আর? আর দূর হয়েছিল চিত্ত-চাঞ্চল্য ও মানসিক অস্থিরতা। আমার চোখের সামনে একটা সুন্দর শান্ত ভবিষ্যৎ জীবনের ছবি ফুটে উঠেছিল।
আর মেমসাহেব? আমার অনেক দুর্বলতার মধ্যেও মেমসাহেব আমার ভালবাসার গভীরতা উপলব্ধি করেছিল। অন্ধের যষ্টির মত আমার জীবনে তার অনন্য গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল। শিক্ষিতাই হোক আর সুন্দরীই হোক, গরীব হোক বা ধনী হোক, মেয়েদের জীবনে এর চাইতে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে?
তাইতো হাসি, খেলা, গান ও রাত্ৰি জাগরণের মধ্য দিয়েও আমরা ভবিষ্যতের রাস্তা ঠিক করে নিয়েছিলাম। দুজনে মিলে প্ৰতিজ্ঞা করেছিলাম। শুধু কিছু হাসি আর খেলা করে জীবনটাকে নষ্ট করব না।
কলকাতা ফেরার আগের দিন রাত্ৰিতে মেমসাহেব সেই আমার দেওয়া শাড়ীটা পরেছিল। তারপর মাথায় কাপড় দিয়ে গলায় আঁচল জড়িয়ে আমাকে প্ৰণাম করেছিল। সেদিন আমার জীবনউৎসবের পরম মুহুর্তে কোন পুরোহিত মন্ত্র পড়েন নি, কোন কুলবধু শাখ বাজান নি, আত্মীয়-বন্ধু সাক্ষী রেখে মালা বদল করিনি। কিন্তু তবুও আমরা দুজনে জেনেছিলাম আমাদের দুটি জীবনের গ্ৰন্থিতে অচ্ছেদ্য বন্ধন পড়ল।