আমি ভাবছি চিঠিগুলো বড় বড় হয়ে যাচ্ছে। আর তুমি লিখেছি আরো অনেক বড় করে লিখতে। অথবা কদিন ছুটি নিয়ে কলকাতায় গিয়ে মুখোমুখি সব কিছু বলতে প্ৰস্তাব করেছ। প্রথম কথা, এখন পার্লামেন্টের বাজেট সেসন চলছে। ছুটি নিয়ে কলকাতা যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া নিজের মুখে তোমাকে এ কাহিনী আমি শোনাতে পারব না। মেমসাহেব আমাকে কত ভালবাসত, কত আদর করত, কত রকম করে আদর করত, কেমন করে দুজনে রাত জেগেছি, সে সব কথা তোমাকে বলব কেমন করে? লজায় আমার গলা দিয়ে স্বর বেরুবে না। ভগবান সবাইকে কণ্ঠস্বর দিয়েছেন। কিন্তু সবার কণ্ঠেই কি সুর আছে? আছে মিষ্টত্ব? নেই। কণ্ঠ থাকলেই কি সব কথা বলা যায়? সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার সব অনুভূতিই কি বলা যায়? হয়ত অন্যেরা বলতে পারে। কিন্তু আমার সে ক্ষমতা নেই। তুমি আমাকে ক্ষমা করো।
সময় থাকলে চিঠিগুলো হয়ত আরো দীর্ঘ হতো। তাছাড়া চিঠি লিখতে বসেও কলম থেমে যায় মাঝে মাঝেই। আমাকে ফাঁকি দিয়ে মনটা কখন যে অতীত দিনের স্মরণীয় স্মৃতির অরণ্যে লুকিয়ে পড়ে, বুঝতে পারি না। অনেকক্ষণ ধরে খোঁজাখুজির পরে দেখি মেমসাহেৰোঁর আঁচলের তলায় মন লুকিয়ে আছে। তোমাকে এই চিঠিগুলো লিখতে বসে বার বার মনে পড়ে সেসব দিনের স্মৃতি। আপন মনে কখনো হাসি, কখনো লাজ পাই। কখনো আবার মনে হয়। মেমসাহেব গান গাইছে এবং বেসুরো গলায় আমি কোরাস গাইতে চেষ্টা করছি। এই চিঠি লিখতে বসেই আবার মনে রিভলবিং স্টেজ ঘুরে যায়, দৃশ্য বদলে যায়। আমার চোখটা ঝাপসা হয়ে ওঠে। কলমটা থেমে যায়। একটু পরে দু’চোখ বেয়ে জল নেমে আসে।
দোলাবৌদি, তোমাকে চিঠি লিখতে বসে এমনি করে প্রতি পদক্ষেপে নিজেকে হায়িয়ে ফেলি। নিজেকেই নিজে হারিয়ে ফেলি। কিন্তু তবুও অনেক কষ্ট্রে ফিরে যাই অতীতে এবং আবার তোমাকে চিঠি লিখতে বসি।
আগে থেকে তোমাকে দুঃখ দেবার ইচ্ছা আমার নেই। যথাসময়ে তুমি আমার চোখের জলের ইতিহাস জানবে। তবে জেনে রেখো, আজ সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত আমার নেই। হাঁটবার সাহস নেই, কোনমতে যেন হামাগুড়ি দিয়ে গড়িয়ে চলেছি।
তোমার নিশ্চয়ই এসব পড়তে ভাল লাগছে না। মনটা ছটফট করছে আমাদের প্রথম অ্যাপয়েণ্টমেণ্টের কথা শুনতে। তাই না? শুধু প্ৰথম দিনের কথাই নয়, আরো অনেক কিছুই তোমাকে বলব। তবে অনেক দিন হয়ে গেল। কিছু কথা, কিছু স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
সেদিন দুপুরের দিকে অফিসে গিয়ে কিছুক্ষণ কাজ করে জরুরী কাজেয় অছিলায় বাসায় চলে এলাম। ভাল করে সাবান দিয়ে স্নান করলাম। ধোপাবাড়ির কাচানো ধুতি-পাঞ্জাবি পারলাম। বোধহয় মুখে একটু পাউডারও বুলিয়েছিলাম। তারপর মা কালীর ফটোয় বার কয়েক প্ৰণাম করে বেরিয়ে পড়লাম। দেরি হয়ে যাবার ভয়ে আগে আগেই বেরিয়ে পড়লাম।
সাড়ে পাচটার মধ্যেই এসপ্ল্যানেড পৌঁছে গেলাম। অফিস ছুটির সময় অনেক পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা। তাই চৌরঙ্গী ছেড়ে রক্সী সিনেমার পাশ দিয়ে ঘুরে ফিরে নিউ মার্কেট চলে গেলাম। মার্কেটের সামনের কিছু স্টলের সামনে কয়েক মিনিট ঘোরাঘুরি করে এলাম। লিণ্ডসে স্ট্রীটের মোড়ে।
দেরি করতে হলো না। মেমসাহেবও প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই এলো। একঝলক দেখে নিলাম। চমৎকার লাগল। বড় পবিত্ৰ মনে হলে আমার মেমসাহেবকে। খুব সাধারণ সাজগোছ করে এসেছিল। . ঐ বিরাট গোছা-ভরা চুলগুলোকে দিয়ে নিছকই একটা সাধারণ খোঁপা বেঁধেছিল। মুখে কোথাও প্রসাধনের ছোওয়া ছিল না। পরনে সাদা খোলের একটা মাঝারি ধরনের তাঁতের শাড়ী। গায়ে একটা লক্ষ্মেী চিকানের ব্লাউজ। ডান হাতে একটা কঙ্কণ, বাঁ হাতে স্টেনলেস স্টিলের ব্যাণ্ড দিয়ে বাধা একটা ঘড়ি। হাতে দু’টো-একটা খাতা বই আর ছোট্ট একটা পার্স।
প্ৰথমে কে কথা বলেছিল, তা আর আজ মনে নেই। ঠিক কি কথা হয়েছিল, তাও মনে নেই। তবে মনে আছে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, চা খাবেন?
মেমসাহেব বলেছিল, না, চা আর খাব না। তার চাইতে চলুন। একটু বসা যাক।
রাস্ত পার হয়ে ময়দানের দিকে এলাম। তারপর কিছুদূর ময়দানের এক কোণায় বসলাম দুজনে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলাম দুজনেই। মাঝে মাঝে একবার ওর দিকে তাকিয়েছি আর তৃপ্তিতে ভরে গেছে মন। মেমসাহেবও মাঝে মাঝে আমাকে দেখছিল। কয়েকবার দুজনের দৃষ্টিতে ধাক্কা লেগেছে। হেসেছি দুজনেই।
এক সেকেণ্ড পরে আবার আমি তাকিয়েছি মেমসাহেবের দিকে। এবার আর মেমসাহেব চুপ করে থাকতে পারে না। প্রশ্ন করে, কি দেখছেন?
প্ৰথমে আমি উত্তর দিতে পারিনি। লাজ করেছে, দ্বিধা এসেছে।
মেমসাহেব একটু পরে আবার প্রশ্ন করে, কি হলো? উত্তর দিচ্ছেন না যে!
সব সময় কি সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়, না দেবার ক্ষমতা থাকে?
আমার প্রশ্নটা কি খুব কঠিন?
কদিন বাদে হয়ত এ প্রশ্ন কঠিন থাকবে না, তবে আজ বেশ কঠিন মনে হচ্ছে।
দুজনেয় দৃষ্টিই চারপাশ ঘুরে যায়। আমি আবার চুরি করে। মেমসাহেবকে দেখে নিই। ধরা পড়লাম না। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলাম না, ধরা পড়ে গেলাম।
একটু হাসতে হাসতে মেমসাহেব। আবার জানতে চায়, অমন করে কি দেখছেন?
আমি কয়েকবার আজেবাজে অপ্ৰয়োজনীয় কথা বলে ওর প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না।
আমি বললাম, আপনি জানেন না। আমি কি দেখছি?
না।
সত্যি?
মেমসাহেব। আবার হাসে। বলে, প্ৰথম দিনেই কিভাবে বুঝলেন আমি মিথ্যে কথা বলি।
না, তা ঠিক না।
তবে বলুন কি দেখছেন। মেমসাহেব যেন দাবী জানাল।
আমি আর দেরি করি না। মেমসাহেবকে দেখতে দেখতেই বললাম, আপনার চোখ দুটি বড় সুন্দর-
ঠোঁটটা কামড়াতে কামড়াতে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। মেমসাহেব। একটু নীচু গলায় বলল, ঘোড়ার ডিম সুন্দর।
আবার কয়েক মুহুর্ত দুজনেই চুপচাপ থাকি। তারপর মেমসাহেব আবার বলে, আমি কালো কুচ্ছিৎ বলে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছেন?
জান দোলাবৌদি, কোন কারণ ছিল না। কিন্তু তবুও দুজনে মুচুকি হাসতে হাসতে বেশ কিছুক্ষণ তর্ক করলাম। প্ৰথম প্রথম প্ৰেমে পড়লে এমন অকারণ অনেক কিছুই করতে হয়, তাই না? তবে শেষে আমি বলেছিলাম, সত্যি আপনার চোখ দু’টো বড় সুন্দর।
পরে বিদায় নেবার আগে বলেছিলাম, প্ৰথম পরিচয়ের দিনই আপনার সৌন্দৰ্য নিয়ে আলোচনার জন্য যদি কোন অন্যায় হয়ে থাকে তো মাপ করবেন।
তুমি তো মেমসাহেবকে দেখেছ। সত্যি করে বল তো, ওর চোখ দু’টো সুন্দর কিনা। অত কালো টান টানা ঘন গভীর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ আমি তো জীবনে কোথাও দেখিনি। ঐ চোখ দু’টো আমাকে চুম্বকের মত টেনে নিয়েছিল। সেই সেদিন দানাপুর প্যাসেঞ্জারের কামরায় মেমসাহেবের প্রথম দেখা পাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি বেশ উপলব্ধি করেছিলাম। আমার নিঃসঙ্গ জীবনের শেষ হতে চলেছে। ময়দানে মেমসাহেবের পাশে বসে আমার সে উপলব্ধি আরো দৃঢ় হলো। বেশ বুঝতে পারলাম জীবনদেবতা আমাকে জানারণ্যের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেবেন না। নিঃশব্দে নিভৃতে তিনি আমার কাছে মেমসাহেবকে পাঠিয়েছেন আমার জীবনযুদ্ধের সেনাপতিরূপে।
আমার নতুন সেনাপতিও বোধহয় বুঝতে পেরেছিল যে বিধাতাপুরুষ। শুধু একটু হাসি, একটু গান, একটু সুখ, একটু আনন্দ, একটু ভাললাগার জন্য তাকে আমার কাছে টেনে আনেন নি।
দু’চারদিন আরো দেখাশোনা হবার পর একদিন সন্ধ্যায় পার্ক সার্কাস ময়দানের এক কোণায় বসে মেমসাহেবকে আমার জীবনকাহিনী শোনালাম। সব কিছু শুনে মেমসাহেব বলেছিল, ধাতুটা ভাল। তবে খাদ মিশে গেছে। গহনা গড়বার জন্য একটু বেশী পোড়াতে হবে, একটু বেশী পেটাতে হবে।
কাকে পোড়াবেন? কাকে পেটাবেন?
বুঝতে পারছেন না?
বুদ্ধি থাকলে তো বুঝব।
এবার একটু হেসে একটু জোর গলায় বললে, আপনাকে।
আমি অবাক হয়ে বলি, সে কি সর্বনাশের কথা। প্ৰায় তোৎলামী করে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি আমাকে পোড়াবেন, পেটাবেন?
মেমসাহেব গাম্ভীৰ্য আনার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে বলল, তবে কি আপনাকে পূজা করব?
একটু পরে বলেছিল, দেখবেন, আপনাকে কেমন জব্দ করি, কেমন শাসন করি।
সত্যি?
নিশ্চয়ই।
পারবেন? নিশ্চয়ই। বেশ আত্মপ্ৰত্যয়ের সঙ্গে মেমসাহেব জবাব দেয়। পাছে হেরে যান, সেই ভয়ে মা পৰ্যন্ত আগে আগেই পালিয়েছেন, সুতরাং আপনি কি…!
আরো কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। ইতিমধ্যে মেমসাহেব নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল। আমি পরীক্ষা দিয়ে কোনমতে পাশ করেছি। কিন্তু ঠিক লেখাপড়া বিশেষ কিছু করিনি। তাই বলল, রোজ একটু পড়াশুনা করবেন।
সে কি? এই বুড়ে বয়সে আবার পড়াশুনা করব?
সোজা জবাব আসে, বাজে তর্ক করবেন না। নিশ্চয়ই রোজ একটু পড়াশুনা করবেন।
ডজন খানেক খবরের কাগজ আর ডজন খানেক জার্নাল তো রেগুলার পড়ি।
খবরের কাগজে কাজ করতে হলে শুধু খবরের কাগজ পড়লে চলে না, আরো কিছু পড়া দরকার
আমি চুপ করে থাকি। বসে বসে ভাবি মেমসাহেবের কথা।
মেমসাহেব বলে, একটা কথা বলবেন?
বলব।
আপনি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছেন, তাই না?
না, না, বিরক্ত হৰো কেন?
তবে এত গম্ভীর হয়ে ভাবছেন কি?
দৃষ্টিটিা উদাস হয়ে যায়। মনটা উড়ে বেড়ায় অতীত-বৰ্তমানের–সমস্ত আকাশ জুড়ে। শুধু বলি, একটুও বিরক্ত হচ্ছি না। শুধু ভাবছি। কেউ তো আমাকে এসব কথা আগে বলে নি…!
তাতে কি হলো?
এমনি করে এগিয়ে চলে আমাদের কথা। শেষে মেমসাহেব বলে, চিরকালই কি আপনি একটা অর্ডিনারী রিপোর্টার থাকবেন?
মাত্র একশ পঁচিশ টাকা মাইনের সেই রিপোর্টার হবার সুযোগই আজ পর্যন্ত পেলাম না; সুতরাং কল্পনা করে আর কতদূর যাব?
স্পষ্ট জানিয়ে দেয় মেমসাহেব, ওসব কথা বাদ দিন। অতীত আর বর্তমান নিয়েই তো জীবন নয়, ভবিষ্যতই জীবন।
অতীত আর বর্তমানের ক্ষয়রোগে ভুগতে ভুগতে মেরুদণ্ডটা ভেঙে গেছে। তাই ভবিষ্যতে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারব বলে ভরসা পাই না।
কথাটা ঠিক হলো না। অতীত-বৰ্তমান হচ্ছে ক্যানভাস আর ব্যাকগ্ৰাউণ্ড মাত্ৰ, ছবিটা এখনও আঁকা বাকি।
যাই হোক শেষে মেমসাহেব বলল, অতীত-বর্তমান নিয়ে আত মাথা ঘামাবেন না, ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে তৈরি করুন। ক্লাসিকস পড়ুন, ভাল ভাল লিটারেচার পড়ুন।
সাধারণত ছেলেমেয়ের ছাত্রজীবনে পড়াশুনা করে। প্ৰথম কথা, আমাকে গাইড করার কেউ ছিল না। দ্বিতীয়ত ছাত্রজীবনে সে সুযোগ বা অবসরও পাইনি। পরীক্ষায় পাশ করবার জন্য কিছু ইংরেজি-বাংলা সাহিত্য পড়তে বাধ্য হয়েছি। তাছাড়া বঙ্কিমচন্দ্ৰরবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্ৰ ইত্যাদি কোন না কোন কারণে বা উপলক্ষে পড়েছি। কদাচিৎ কখনও কোন দুর্ঘটনার জন্য জনসন বা টি. এস ইলিয়টও হয়ত পড়েছি। কিন্তু ঠিক পড়াশুনা বলতে যা বোঝায়, তা আমি করতে পারিনি। মেমসাহেবের পাল্লায় পড়ে এবার আমি সত্যি সত্যিই একটু পড়াশুনা করা শুরু করলাম।
কোনদিন নিজেদের বাড়ি থেকে কোনদিন আবার ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরী থেকে মেমসাহেব আমার জন্য বই আনা শুরু করল। আমিও ধীরে ধীরে পড়াশুনা শুরু করলাম। ইংরেজি-বাংলা দুইই পড়লাম। বিদ্যাসাগর, হেমচন্দ্ৰ, নবীনচন্দ্ৰ, মাইকেল আবার পড়লাম। রমেশচন্দ্ৰ, শিবনাথ শাস্ত্রী প্ৰভৃতিও বাদ পড়লেন না। তারপর মোহিতলাল থেকে জীবানন্দও মেমসাহেব প্রেসক্রিপশন করল। ওদিকে ডরোখী পার্কারকে পড়লাম, পড়লাম রবার্ট ফ্রস্ট-টি এস ইলিয়ট-এজরা পাউণ্ডের কবিতা। আমার মন ছটফট করে ওঠে। মেমসাহেবকে বললাম, ‘মেমসাহেব, এবার তোমার পাঠশালা বন্ধ কর।
মেমসাহেব কি বলল জান? বলল, বাজে বকো না। কিছু লেখাপড়া না করে জার্নালিজম করতে তোমার লজা করে না? লজ্জা? জার্নালিস্টদের লজ্জা! তুমি হাসালে মেমসাহেব। মেমসাহেবের দাবিড় খেয়ে হাক্সলে, হেনরি গ্রীন, হেমিংওয়ে, লরেন্স ডুরেল, অ্যানি পটার, মেরী ম্যাকার্থির এক গাদা বই পড়লাম।
এর পর একদিন আমাকে গীতবিতান প্ৰেজেণ্ট করল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। ভাবলাম, মেমসাহেব কি এবার আমাকে গানের স্কুলে ভর্তি করবে? জিজ্ঞাসা করলাম, তানপুরা পাব না?
মেমসাহেব রেগে গেল। আমার মুণ্ডু পাবে।
পরে বলেছিল, যখন হাতে কাজ থাকবে না, চুপচাপ গীতবিতানের পাতা উল্টিয়ে যেও। খুব ভাল লাগবে। দেখবে তুমি অনেক কিছু ভাবতে পারছি, কল্পনা করতে পারছ।
ইতিমধ্যে এম. এ. পাশ করে মেমসাহেব একটা গার্লস কলেজে অস্থায়ীভাবে অধ্যাপনা শুরু করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে আরো অনেক কিছু হয়ে গেছে। মেমসাহেব উপলব্ধি করল আমার অন্তরের শূন্যতা, জীবনের ব্যর্থতা, ভবিষ্যতের আশঙ্কা। উপলব্ধি করল আমার জীবন-যজ্ঞে তাঁর অনন্য প্ৰয়োজনীয়তা। আমি নিজেই একদিন বললাম, জান মেমসাহেব, প্ৰথমে শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে এক দুর্বল মুহুর্তে স্বপ্ন দেখলাম আমি এগিয়ে চলেছি। দশজনের মধ্যে এক’জন হবার স্বপ্ন দেখলাম। সেই স্বপ্নের ঘোরে বেশ কিছুকাল কেটে গেল। যখন সম্বিত ফিরে পেলাম, তখন নিজের দুরবস্থা দেখে নিজেই চমকে গেলাম, ঘাবড়ে গেলাম, হতাশ হলাম।
একটু থামি।
আবার বলি, সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষার, স্বপ্ন-সাধনা বিসর্জন দিয়ে নিজেকে তুলে দিলাম। অদৃষ্টের হাতে। কিন্তু তোমাকে দেখে আমার সব হিসাব-নিকাশ ওলট-পালট হয়ে গেল। মুহুর্তের মধ্যে আবার সমস্ত স্বপ্ন উড়ে এসে জড়ো হলো মনের আকাশে।
মেমসাহেবের হাতটা চেপে ধরে বললাম, ভগবানের নামে শপথ করে বলছি, মেমসাহেব। তোমাকে দেখেই যেন মনে হলো তুমি তো আমারই। এই অন্ধকূপ থেকে আমাকে মুক্তি দেবার জন্যই যেন ভগবান তোমাকে পাঠিয়েছেন।
আমার মত মেমসাহেব কোনদিনই বেশী কথা বলত না। শুধু বলল, হয়ত তাই। তা না হলে তোমার সঙ্গে। অমন অপ্রত্যাশিতভাবে পরের দিনই আবার দেখা হবে কেন?
অদৃষ্টর ইঙ্গিত, নিয়তির নির্দেশ মেমসাহেবও বুঝতে পেরেছিল। আমি অনেক কথা বলার পরই দু’হাত তুলে মেমসাহেবের কাছে আত্মসমৰ্পণ করেছিলাম। মেমসাহেবের অনুষ্ঠান অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়েছিল।
প্রতিদিনের মত সেদিন বেলা দেড়টা-দু’টোর সময় অফিস গিয়েছিলাম। টেলিপ্ৰিণ্টারের কয়েকটা লোক্যাল কপি দেখতে দেখতেই টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে অভ্যাস মত বললাম, রিপোর্টার্স।
কখন অফিসে এলে?
এইত একটু আগে।
একটা কথা বলব?
বলো।
শুনবে?
নিশ্চয়ই।
চলো না একটু বেড়িয়ে আসি।
আমি একটু অবাক হয়ে জানতে চাই, এখন?
হ্যাঁ।
কি ব্যাপার বল তো।
বল না যাবে কিনা?
চীফ রিপোর্টার বা নিউজ এডিটর। তখনও অফিসে আসেন নি। কি করব, ভাবছিলাম। মেমসাহেব টেলিফোন ধরে থাকল। আমি ডায়েরীতে দেখে নিলাম দু’টো প্রেস কনফারেন্স ছাড়া আর কিছু নেই। একটা চারটের সময় আর দ্বিতীয়টা সন্ধ্যা সাতটায়।
মেমসাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, সাতটার মধ্যে ফিরতে পারব?
সাতটা? বোধহয় না।
কখন ফিরবে?
আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে নিশ্চয়ই ফিরব।
চীফ রিপোর্টারকে একটা শ্লিপ লিখে রেখে গেলাম, একটা জরুরী নিউজের লোভে বেরিয়ে যাচ্ছি। রাত্রে ফিরে টেলিফোন ডিউটি!
অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। এসপ্ল্যানেডের মোড়ে দুজনে মীট করে সোজা চলে গেলাম দক্ষিণেশ্বর। মন্দিরের দরজা বন্ধ ছিল। তাই এদিক-ওদিক ঘুরে পঞ্চবটী ছাড়িয়ে আরো খানিকটা দক্ষিণে গঙ্গার ধারে একটা গাছের ছায়ায় বসলাম দুজনে।
মেমসাহেব বলল, চোখ বন্ধ করা।
কেন?
আঃ। সব সময় কেন কেন করো না। বলছি চোখ বন্ধ কর।
পুরোটা না অর্ধেকটা বন্ধ করব? তুমি বড্ড তর্ক কর। মেমসাহেব এবার কড়া হুকুম দেয়, আই সে, ক্লোজ ইওর আইজ।
সত্যি সত্যিই চোখ বন্ধ করলাম। মুহুর্তের মধ্যে অনুভব করলাম মেমসাহেব আমার দুটি পায় হাত দিয়ে প্ৰণাম করছে। চমকে গিয়ে চোখ খুলে প্রশ্ন করলাম, একি ব্যাপার?
দেখি মেমসাহেবের মুখে অনিৰ্বাণ আনন্দের বন্যা, দুটি চোখে পরম তৃপ্তির দীপশিখা জ্বলছে। দুটি হাত দিয়ে মেমসাহেবের মুখটা তুলে ধরে আবার প্রশ্ন করলাম, হঠাৎ প্ৰণাম করলে কেন মেমসাহেব?
কোন উত্তর দিল না মেমসাহেব। আত্মসমর্পণের ভাষায় চাইল আমার দিকে। আমিও ওর দিকে চেয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ। তারপর আবার জানতে চাইলাম, বল না প্ৰণাম করলে কেন?
এবার মেমসাহেব কথা বলে, আমি তোমাকে প্ৰণাম করলাম, তুমি আমাকে আশীৰ্বাদ করবে না?
আমি অবাক হয়ে যাই। নিজের দৈন্য এত স্পষ্ট হলো যে নিজেকে বেশ ছোট মনে হলো। মেমসাহেব প্ৰণাম করার পর কৈফিয়ত তলব না করে আমার আশীৰ্বাদ কয়া প্ৰথম কাজ ছিল। যাই হোক তাড়াতাড়ি মেমসাহেবকে কাছে টেনে নিলাম। দুটি হাত দিয়ে ওর মুখখান তুলে ধরে বললাম, ভগবান যেন তোমাকে সুখী করেন।
মেমসাহেব হঠাৎ মাথাটা ছাড়িয়ে নিয়ে দু’হাত দিয়ে আমাকে চেপে ধরে বলল, ভগবান কি করবেন, তা ভগবানই জানেন কিন্তু তুমি কি আমাকে সুখী করবে?
কি মনে হয়?
মনে মনে তো ভয়ই হয়।
কিসের ভয়?
কানে কানে ফিস ফিস করে মেমসাহেব বলল, হাজার হোক খবরের কাগজের রিপোর্টার! কবে, কখন, কোথায় হয়ত কোন সুন্দরী এসে তোমাকে ঝড়ের বেগে উড়িয়ে নিয়ে যাবে…।
তাই নাকি?
তবে আবার কি! পুরুষদের বিশ্বাস নেই…!
জান মেমসাহেব, তোমাকে নিয়ে আমারও অনেক ভয়।
আমার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে আঙুল দিয়ে নিজেকে দেখিয়ে মেমসাহেব অবাক হয়ে বলল, আমাকে নিয়ে তোমার ভয়?
জি, মেমসাহাব।
বাজে বাকো না।
বাজে না মেমসাহেব। জীবনে সুপ্ৰতিষ্ঠিত কোন মানুষের আমন্ত্রণ এলে পঞ্চাশ টাকার এই রিপোর্টারকে নিশ্চয়ই তোমার ভুলে যেতে কষ্ট হবে না।
দপ করে জ্বলে উঠল মেমসাহেব, সব সময় তুমি পঞ্চাশ টাকার রিপোর্টার, পঞ্চাশ টাকার রিপোর্টার বলবে না তো! সারা জীবনই কি তুমি পঞ্চাশ টাকার রিপোর্টার থাকবে?
থাকব না!
না, না, না।
তাহলে কি হবে?
কি আবার হবে? জীবনে মানুষ হবে, বড় হবে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
পারব?
একশবার পারবে। তাছাড়া আমি আছি না।
মেমসাহেব আমাকে একটু কাছে টেনে নেয়। একটু আদর করে। মাথার চুলগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে। আবার বলে, তুমি ভাব কেন যে তুমি হেরে গেছ?
কি করব বল মেমসাহেব? অকুল সমুদ্রে জাহাজ ভেসে বেড়ায়, কিন্তু লাইট হাউসের ঐ ছোট্ট একটা আলোর ইঙ্গিত না পেলে তো সে বন্দরে ভিড়তে পারে না।
আমি তো এসেছি, আর ভয় কি? কিন্তু কথা দিতে পার আমার বন্দর ছেড়ে তুমি তোমার জাহাজ নিয়ে অন্য বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়ায় না?
আচ্ছা দোলাবৌদি, সব মেয়েদের মনেই ঐ এক ভয়, এক সন্দেহ কেন বলতে পার? পৃথিবীর ইতিহাস কি শুধু পুরুষদের বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনীতেই ভরা? যাই হোক মেমসাহেবের কথা আমার বেশ লাগত। অন্তত এই ভেবে আমি তৃপ্তি পেতাম যে সে আমাকে সম্পূর্ণভাবে কামনা করে।
সেদিন কথায় কথায় সন্ধ্যা নেমে এলো। মন্দিরের মঙ্গলদীপের আলোর প্রতিবিম্ব পড়ল। গঙ্গায়। স্রোতস্বিনী গঙ্গা সে আলো ভাসিয়ে নিয়ে গেল দূর-দূরান্তরে, শহরে, নগরে, জনপদে আর অসংখ্য মানুষের মনের অন্ধকার গহন অরণ্যে।
মেমসাহেব শেষকালে প্রশ্ন করল, কই তুমি তো জানতে চাইলে না তোমাকে আজ এখানে নিয়ে এলাম কেন? তুমি তো জানতে চাইলোচনা তোমাকে প্ৰণাম করে আশীৰ্বাদ চাইলাম কেন?
কোন বিশেষ কারণ আছে নাকি? তবে কি, এই বলে মেমসাহেব ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে আমাকে পড়তে দিল।
পড়ে দেখি হাওড়া গার্লস কলেজের অ্যাপিয়েণ্টমেণ্ট লেটার। মেমসাহেবের দুটি হাত ধরে বললাম, কনগ্ৰাচুলেশনস। এইত অয়মারম্ভ, আনন্দে ঐশ্বৰ্যে ভগবান নিশ্চয়ই তোমাকে ভরিয়ে তুলবেন।
একটু থেমে প্রশ্ন করি, মাসে মাসে আড়াইশ টাকা দিয়ে কি করবে। মেমসাহেব?
কেন? দুজনে মিলেও ওড়াতে পারব না?
দুজনেই হেসে উঠি।
মেমসাহেব অধ্যাপনা করা শুরু করায় গৰ্বে আমার বুকটা ভরে উঠল। কদিন পরে অফিস থেকে পাঁচিশটা টাকা অ্যাডভান্স নিলাম। চিত্তরঞ্জন এভিন্নুর সেলস এম্পোরিয়াম থেকে আঠারো টাকা দিয়ে একটা তীতের শাড়ী। কিনলাম। বিকেল বেলায় মেমসাহেবকে প্যাকেটটা দিয়ে বললাম, এই শাড়ীটা পরে কালকে কলেজে যেও।
পরের দিন ঐ শাড়ীটা পরে কলেজে গিয়েছিল, কিন্তু তারপর আর পরত না। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, শাড়ীটা বুঝি তোমার পছন্দ হয় নি?
খুব পছন্দ হয়েছে।
সেইজন্যই বুঝি পরতে লজ্জা করে?
কানে কানে বলল, না, গো, না। ওটা তোমার প্রথম প্ৰেজেনটেশন। যখন তখন পড়ে নষ্ট করব নাকি?
প্ৰথম মাসে মাইনে পাবার পর মেমসাহেব আমাকে কি দিয়েছিল জান? একটা গারদের পাঞ্জাবি আর একটা চমৎ তাঁতের ধুতি।
ধুতিটা কেনার সময় ভারী মজা হয়েছিল।
মেমসাহেব জিজ্ঞাসা করল, জরিপাড় নেবে? নাকি প্লেন পাড় নেবে?
দোকানের আর কেউ শুনতে না পারে। তাই কানে কানে বললাম, যদি টোপরটাও কিনে দাও তাহলে জরিপাড় ধুতি কেন; আর যদি এখন টোপর না কিনতে চাও তবে প্লেন পাড়ই…।
অসভ্য কোথাকার।
ধুতি কিনে দোকান থেকে বেরুতে বেরুতে মেমসাহেব বলল, তুমি ভারী অসভ্য।
কি আশ্চর্য! তোমার সঙ্গেও ফ্রাঙ্কলি কথা বলব না?
এই তোমার ফ্রাঙ্কলি বলার ঢং?
সেসব দিনের কথা আজ তোমাকে লিখতে বসে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। কি কারণে ও কেমন করে আমরা দুজনে এত দ্রুততালে এগিয়ে চলেছিলাম, তা আমি জানি না। কোন যুক্তিতর্ক দিয়ে এসব বোঝান সম্ভব নয়। মানুষের মন লজিকের প্রফেসর বা বিচারকদের পরামর্শ বা উপদেশ মেনে চলে না। মুক্ত বিহঙ্গের মত সে আপন গতিতে উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়। মানুষের মন যদি বিচার-বিবেচনা মেনে চলতে জানত তাহলে শুধু আমার বা মেমসাহেবের কাহিনী নয়, পৃথিবীর ইতিহাসও একেবারে অন্যরকম হতো।
মাতৃগৰ্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই মানুষ এক’জনকে অবলম্বন করে বড় হয়, ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে চলে। একটি মুখের হাসি, দুটি চোখের জলের জন্য মানুষ কত কি করে! আমি বড় হয়েছি, ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে গেছি নিতান্তই প্রকৃতির নিয়মে। মায়ের মুখের হাসি বা প্রিয়জনের চোখের জলের কোন ভূমিকা ছিল না আমার জীবনে। তাইতো আমি মেমসাহেবকে সমস্ত মন, প্ৰাণ, সত্তা দিয়ে চেয়েছিলাম। এই চাওয়ার মধ্যে একটুও ফাঁকি ছিল না। তাইতো মেমসাহেবকেও পাওয়ার মধ্যেও কোন ফাঁকি থাকতে পারে নি। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির বাইশটি বসন্ত অতিক্রম করতে মেমসাহেবের জীবনে নিশ্চয়ই কিছু কিছু মাছি বা মৌমাছি তিনভন করেছে চারপাশে। হয়ত বা কারুর গুজন মনে একটু রং লাগিয়েছে কিন্তু ঠিক আমার মত কেউ সমস্ত জীবনের দাবী নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে নি। তাইতো মেমসাহেবের জীবনের সব বাঁধন খুলে গিয়েছিল, সংযম আর সংস্কার ভেসে গিয়েছিল।
আমার মত মেমসাহেবের জীবনেও অনেক অনেক পরিবর্তন এলো। আমার পছন্দ-অপছন্দ মতামত ছাড়া কোনকিছুই করতে পারত না। আমি সঙ্গে গিয়ে পছন্দ না করলে শাড়ী-ব্লাউজ পর্যন্ত কেনা হত না। আমি জিজ্ঞাসা করতাম, এত দিন কার পছন্দ মত কিনতে?
মা বা দিদির…।
এখন কি ওঁদের রুচি খারাপ হয়ে গেছে?
না তা হবে কেন? তাই বলে কি ওঁরা চিরকালই পছন্দ করবে?
তা তো বটেই!
মেমসাহেব অভিমান করত। বেশ ত আমার সঙ্গে দোকানে যেতে অপমান হলে যেও না।
আমি কথার মোড় ঘুড়িয়ে দিই। না জানি এরপর আরো কত কি কিনে দিতে বলবে।
মেমসাহেব আমার ইঙ্গিত বোঝে। প্ৰথমে বলে, আবার অসভ্যতা করছ!
একটু পরে একটু কাছে এসে, একটু আস্তে বলে, দরকার হলে নিশ্চয়ই কিনবে। তুমি ছাড়া কে কিনে দেবে বল?
দোলাবৌদি, ভাবতে পায়াছ আমাদের অবস্থা?
নিত্য কর্মপদ্ধতির বাইরে এক ধাপ নিভৃতে-চড়তে গেলেই মেমসাহেব আমার কাছে আবেদনপত্র নিয়ে হাজির হতো।
জান, রবিবার কলেজের একদল প্রফেসর শান্তিনিকেতন যাচ্ছেন। আমাকেও ভীষণ ধরেছেন। কি করি বল তো?
কি আবার করবে, যাবে। তারপর জেনে নিই, কবে ফিরবে?
সোমবার রাত্ৰেই। মঙ্গলবার তো কলেজ আছে।
কোন দিন আবার দেখা হবার সঙ্গে সঙ্গেই বলতো, দেখ, কালকে ভ্ৰমরের জন্মদিন। কি দেব বল তো।
আমি মেমসাহেবের কথা শুনে মনে মনে হাসাতাম। ভ্ৰমর ওর বাল্যবন্ধু, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি একসঙ্গে পার হয়েছে। প্ৰতিবছরই জন্মদিনে যেতে হয়েছে, কিছু না কিছু প্রেজেনটেশনও দিয়েছে। আজ এই সামান্য ব্যাপারটা এত বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিল যে, মেমসাহেব নিজের বুদ্ধি দিয়ে কোন কুলকিনারা পেল না। ডাক পড়ল আমার।
আমার ওপর মেমসাহেবের নির্ভরতার খবর আমাদের আশেপাশের সবাই জানত। মেমসাহেবের মেজদি হয়ত সিনেমার টিকিট কেটেছে কিন্তু তবুও ছোটবোনের সঙ্গে মজা করবার জন্য জিজ্ঞাসা করত, হ্যারে, রিপোর্টারকে জিজ্ঞাসা করিস তুই রবিবার ম্যাটিনীতে সিনেমা যেতে পারবি কিনা।
মেমসাহেব দৌড়ে গিয়ে মেজদির মুখটা চেপে ধরে বলত, ভাল হচ্ছে না কিন্তু!
মুচকি হাসি লুকাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে মেজদি বলত, আচ্ছা ঠিক আছে। আমিই রিপোর্টারকে ফোন করে জেনে নেব।
মেমসাহেব হুঙ্কার দিত, মা! মেজদি কি করছে!
কোনদিন আবার মেজদি মেমসাহেবকে বলত, হ্যাঁরে, রিপোর্টারকে একবার ফোন করবি?
কেন? জিজ্ঞাসা কর তা তুই আজকে মাছের ঝোল খাবি না ঝাল খাবি।
মেমষাহেব মেজদিকে ধরতে যেত। আর মেজদি দৌড়ে পালিয়ে যেত।
অনেক রাত হয়ে গেছে। কত রাত জান? পৌনে তিনটে বাজে। চারপাশের সব বাড়ির সবাই সারাদিন কাজকর্ম করে কত নিশ্চিন্তে, কত শান্তিতে এখন ঘুমোচ্ছে। আর আমি?
মখমুর দেহলভির একটা ‘শের’ মনে পড়ছে–
মহব্বত জিসকো দেতে হ্যায়,
উসে ফির কুচ নেই দেতে,
উসে সব কুচ দিয়া হ্যায়,
জিসকে ইস্ কাবিল নেহি সমঝা।
–জীবনে যে ভালবাসা পায়, সে আর কিছু পায় না; যে জীবনে আর সব কিছু পায়, সে ভালবাসা পায় না।
তোমাদের জীবনে নয়, কিন্তু আমার জীবনে কথাটা বর্ণে বর্ণে মিলে গেছে।
আমার জীবনে কিছুই পাই নাই
মহব্বত জিসকো দেতে হ্যায়,
উসে ফির কুচ নেই দেতে,
উসে সব কুচ দিয়া হ্যায়,
জিসকে ইস্ কাবিল নেহি সমঝা।
–জীবনে যে ভালবাসা পায়, সে আর কিছু পায় না; যে জীবনে আর সব কিছু পায়, সে ভালবাসা পায় না।