‘‘ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার, তিল তিল আসে-যায়,
মন উচাটন নিশাস-সঘন কদম্বকাননে চায়।
রাই এমন কেন বা হ’ল। সদাই চঞ্চল বসন-অঞ্চল সম্বরণ নাহি করে।
বসি থাকি থাকি উঠই চমকি ভূষণ খসিয়া পড়ে।’’
সুতরাং দেখা যাইতেছে চণ্ডীদাসের কবিতায় রাধিকার যে অবস্থা বর্ণিত হইয়াছে, গৌর-চন্দ্রিকায় গৌরাঙ্গের সেই ভাবই সূচিত হইয়াছে। গৌরাঙ্গ করতলে বদন স্থাপনপূর্ব্বক মৌনাবলম্বন করিয়াছেন, রাধিকাও চণ্ডীদাসের পদে ‘বসিয়া বিয়লে থাকয়ে একলে না শোনে কাহারো কথা’। গৌরাঙ্গ ‘পুনঃ পুনঃ যাতায়াত করু ঘরপস্থ’ রাধিকাও ঘরের বাহিরের দণ্ডে শতবার ‘তিল তিল আসে যায়’। গৌরাঙ্গ ক্ষণে ক্ষণে ‘চলই পূলবসন্ত কান্ত’ এবং রাধিকাও ‘মন উচাটন নিশাস-যঘন কদম্বকাননে চায়।’ ইহা একই চিত্রের এপিঠ ওপিঠ। গৌর-চন্দ্রিকার দ্বারা আসরের আবহাওয়া একেবারে নির্ম্মল হইয়া যায়, তারপর রাধকৃষ্ণ লীলার অধ্যাত্মিক অর্থ ও ভাব পরিগ্রহ করিতে শ্রোতার কোনরূপই অসুবিধা হয় না। এই জন্যেই গৌরচন্দ্রিকা না গাহিয়া গায়েন কখনই রাধাকৃষ্ণ লীলা আরম্ব করেন না–পাছে লোকে লালসার কথা দিয়া এই লীলার ভাষ্য প্রস্তুত করে। মান, মাখুর, খণ্ডিতা, গোষ্ঠ প্রভৃতি প্রত্যেক পালা গাহিবার পূর্ব্বে গৌর চন্দ্রিকাটি এইরূপ–
‘‘আজি না গৌরাঙ্গচাঁদের কি ভাব হইল,
ধবলী শ্যমলী বলি ডাকিতে লাগিল।
বেণু বিনা বাঁশী করিয়া সিঙ্গাধ্বনি,
হৈ হৈ রবেতে গোরা ঘোরায় পাঁচনি।’’
এইখানে অদ্ভূত ব্যাপার এই, গোরা কেন ধবলী, শ্যামলী, প্রভৃতি নাম ধরিয়া গাভীগুলিকে ডাকিতে যাইবেন? তিনিও ব্রজের রাখাল নহেন। তিনি কেন পাচন বাড়ি ঘুরাইয়তে যাইবেন নন্দের ধেনুপাল চরাইবার জন্য তিনি ত নিযুক্ত নহেন! গায়েন ছোট ছোট গানের মধ্য দিয়া এই প্রশ্নের সমাধান করেন। কলির জীব বহির্ম্মূখ, তাহারা ইন্দ্রিয়াধীন পশু। তিনি আসিয়াছিলেন হরিনাম দিয়া মানুষের পশুপ্রকৃতি ফিরাইতে। তাঁহার মুখের অবিরল হরি হরি ধ্বনি, বেণুবর, এবং তিনি যে হাতখানি উচ্চদিকে হেলাইয়া মানুষের প্রকৃত গম্যস্থান নির্দ্দেশ করিতেন–তাহাই পাচন-বাড়ির সঙ্কেত। একটু কষ্ট কল্পনা করিয়া নদীয়ার তরুণ ব্রাহ্মণটিকে ব্রজের রাখালে পরিণত করিতে হয় বটে, তথাপি অবিরত হরি হরি রবে–গায়েনের ভক্তিগদগদ কণ্ঠের ধ্বনিতে করতাল, মন্দিরা ও মৃদঙ্গের শব্দে এবং গৌরহরির নাম পুনঃ পুনঃ কীর্ত্তন দ্বারা আসরের বিশুদ্ধি সাধিত হয় এবং কৃষ্ণের গোচারণ-পর্ব্বের আধ্যাত্মিকতা উপলব্ধি করিবার জন্য শ্রোতৃবর্গের মনে তৎকালোচিত একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। কিন্তু মাথুর সম্ভোগমিলন ও রূপাভিসার প্রভৃতি পালায় চৈতন্য ভাবের সঙ্গে রাধা ভাবের এতটা স্বাভাবিক ঐক্য আছে যে, সেই সেই পালা গৌরচন্দ্রিকার সহিত একবারে মিলাইয়া যায়। গৌর-চন্দ্রিকায় “গৌর কেন এমন হৈল? স্বরূপ দে’খে যা রে–গৌর বুঝি প্রাণে মৈল!” এবং মাথুরের “রাই কেন এমন হৈল? ও বিশাখা, তোরা দেখে যা, রাই বুঝি প্রাণে মৈল” উভয়ের একবারে পার্থক্যহীন মিলনের ছন্দ রেখায় রেখায় মিল পড়িয়া যায়। সেখানে আর ওস্তাদ গায়নের উভয়কে মিলাইবার জন্য কোন রিপুকর্ম্ম করিতে হয় না।