বৈষ্ণব-কবিদের পূর্ব্ব-রাগের একটা বড় অধ্যায় কৃষ্ণের বাঁশীটিকে লইয়া। জগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাঁহার বাঁশী বাজিতেছে। কোন বৈষ্ণব কবি লিকিয়াছিলেন, বাঁশীর এক রন্ধ্রের সুরে বনে উপবনে কুসুমের কূঁড়ি ফুটিয়া উঠে, কোনও রন্ধ্রের সুরে বসন্তাগম হয়, কোন রন্ধ্রের সুরে ফুলফল মণ্ডিত হইয়া একত্র ষড় ঋতু দেখা দেয় এবং সকলের উপরে এক রন্ধ্রের সুর অবিরত জীবকে ‘রাধা’-‘রাধা’ বলিয়া ডাকিতে থাকে। (পদকল্পতরু, জ্ঞানদাসের পদ)। আমাদের কাছে সে ডাক পৌঁছায় না, কারণ ইন্দ্রিয়ের কলরবে আমাদের কাণ বধির করিয়া রাখিয়াছে। সেক্ষপীয়র নীলাম্বরের নিস্তব্ধতার মধ্যে মানবাত্মার গভীরতম প্রদেশে শ্রুত সেই পরমগীতি আভাষে শুনিয়া লিখিয়াছিলেন, “Such harmony is in immortal souls; But whilst this muddy vesture of decay doth grossly close it in we cannot hear it.”
বাঙ্গালা দেশে এক সময়ে এই বাঁশের বাঁশী মানুষের মনে সমস্ত সংগীতের সার সংগীত শুনাইয়াছিল। বাঙ্গালার রাখালেরা বিনা কড়িতে এই সুরের যন্ত্রটি পাইত, এখানে পথে বাঁশের ঝাড়, একটা মোটা কঞ্চি বা বাঁশের ডগা কাটিয়া বাঁশী তৈরী করিতে জানিত না, এরূপ রাখাল বাঙ্গলা দেশে ছিল না।
অবারিত সবুজ ক্ষেত্র, গোচারণের মাঠ, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, ধলেশ্বরীর ন্যায় বিশালতোয়া নদ-নদী, উর্দ্ধে অনন্ত আকাশ–এই উদার ও মহান প্রাকৃতিক রাজ্যে বাঁশের বাঁশীর যে মর্ম্মান্তিক সুর উঠিত, তাহা শুনিয়ায় কুল-বধু আঁচলে চোখ মুছিত, সন্তান-হারা জননীর মর্ম্মে মর্ম্মে বিলাপের উচ্ছ্বাস বহিত, সাধকের মন দেবতার পায়ের নূপুর-ধ্বনি শুনিতে পাইত। সেই সুরের মর্ম্মান্তিক করুণা ও বিলাপ শুনিয়া মায়ের কোলে থাকিয়া শিশু রাত্রে ঘুমাইতে চাহিত না। এখনকার হারমোনিয়াম, ক্লারিওনেট এবং পিয়ানোর সুর খাঁটি বাঙ্গালীর কাণে তেমন লাগিবে না। পথে যাইতে যাইতে বাঁশীর সুর শুনিয়া পথিক থমকিয়া দাঁড়াইত–পথ ভুলিয়া যাইত, কলসীর জল ফেলিয়া কুলবধু আবার জল আনিতে যাইত, সূর্য পশ্চিম গগনে ডুবিয়াও পুনরায় উঁকি মারিয়া মাঠের দিকে তাকাইতেন। বাঙ্গালার খাঁটি কবিরা বহুস্থানে এই বাঁশের বাঁশীর উল্লেখ করিয়াছেন। অর্ফিয়সের গানে পাহাড় টলিত, নদীর তুফান থামিয়া যাইত,–বাঙ্গালার বাঁশী ও সারেঙ্গের সম্বন্ধেও সেইরূপ অত্যুক্তি আছে। “নুরনেহার ও কবর” নামক পল্লী-গীতিকায় সারেঙ্গের সুরের যে উচ্ছ্বসিত বর্ণনা আছে, তাহা ঠিক বাঙ্গালা দেশেরই সুর-ভাণ্ডারের–এই অত্যুক্তির মধ্যে প্রাণে সাড়া দেওয়ার অনেক কথা আছে।
বাঁশের বাঁশীর সুর শুনিয়া ‘মহিষাল বঁধু’র নায়িকা রাখাল বালকের রূপ নূতন করিয়া দেখিতে শিখিয়াছিলঃ–
“আর দিন বাজে বাঁশী না লাগে এমন।
আজিকার বাঁশীতে কেন কাড়ি লয় মন।।
লাজেতে হইল কন্যার রক্তজবা মুখ।
প্রথম যৌবন কন্যার এই প্রথম সুখ।।”
‘আঁধা বঁধু’তে সেই সুরের মহিমা নন্দনকাননজাত ফুল-ফলের শ্রী লইয়া অপূর্ব্ব হইয়া আত্মপ্রকাশ করিয়াছেঃ–
“বনের বাঁশী নয়ত ইহা মনের বাঁশী হয়।
ছোটকালের যত কথা জাগায়ে তোলয়।।
ভুলিতে না পারি বঁধু কেবলি অভাগা।
তোমার বাঁশী দিল বঁধু বুকে বড় দাগা।।
কি করিব রাজ্য ধনে কুলে আর মানে।
সরম ভরম ছাড়লাম বঁধু তোমার বাঁশীর গানে।।
ভুলি নাই, ভুলি নাই বঁধু তোমার চাঁদ মুখ।
বনে গিয়া দেখাইব ছিঁড়িয়া সে বুক।।”
বঙ্গদেশের কবিরা সুরের আনন্দদায়িনী শক্তির কথা গাহিয়াছেন, কিন্তু বাঙ্গালাদেশে বাঁশীর যে বর্ণনা আছে–উহা মর্ম্মের নিভৃত স্থান হইতে মর্ম্মোচ্ছ্বাসকে টানিয়া হিঁচড়াইয়া অশ্রু ও দীর্ঘশ্বাসের তুফান বহাইয়া দিয়াছে,–অন্য দেশের কথা থাকুক, এই ভারতবর্ষেরও অন্য কোথায়ও সেরূপ দৃষ্টান্ত আছে কিনা জানি না। পাঠককে আমি অনুরোধ করিতেছি, তিনি এই খাঁটি বঙ্গীয় সুরের মহিমা বুঝিবার জন্য যেন “মহিষাল বঁধু”, “নুরনেহা ও করবরের কথা” এবং “আঁধা বঁধু” এই তিনটি পল্লী-গীতিকা পাঠ করেন।
চণ্ডীদাস এই বাঁশীর সুরে আধ্যাত্মিক আনন্দ যোগ দিয়াছেন। যে সুরে পূর্ব্ব হইতেই সুধারস সঞ্চিত ছিল, তিনি ভগীরথের ন্যায় বাঙ্গালা দেশে তাহার জন্য একটা গঙ্গার খাদ তৈরী করিলেন। এ পর্য্যন্ত ব্রহ্মপুত্র, কংস, ভৈরব, সরস্বতী প্রভৃতি ছিল, গঙ্গার সঙ্গে ইহাদের কি প্রভেদ তাহা জানি না। তথাপি গঙ্গা গঙ্গা-ই, তাহার স্থান স্বতন্ত্র। সেইরূপ ‘মহিষাল বঁধু’ ও আঁধা বঁধু’র বাঁশী ও সারেঙ্গ সকল বিষয়ে সমকক্ষতা করিয়াও চণ্ডীদাসের বাঁশীর সঙ্গে তাহাদের এক পংক্তিতে স্থান পাইবার দাবী কেহ কেহ মানিয়া লইবেন না–ইঁহাদের আইন-কানুন স্বতন্ত্র। আপনারা তাহাদের খেয়ালের সঙ্গে একমত না হইতে পারেন, কিন্তু সরল বিশ্বাসে হানা দেওয়ার অধিকার কাহারও নাই।
চণ্ডীদাস কাহিলেন–
“সবার বাঁশী কাণে বাজে,
বাঁশী বাজে আমার হিয়ার মাঝে।”
সে সুর বন্যার মত, দস্যুর মত ঘর-দোর ভাঙ্গিয়া প্রবেশ করে। আমি রান্না-ঘরে রাঁধিবার আয়োজন লইয়া বসিয়াছি–
“বাশীর সুরেতে মোর এলাইল রন্ধন।” (চ)
তখন হলুদ দিতে যাইয়া ধ’নে দিয়া ফেলিলাম, সর্ষে দিতে যাইয়া নুন দিলাম, সব ভ্যাস্তা হইয়া গেল।
বাঁশী আর বেজ না–
“খল-সংহতি সরলা–তা কি জান না বাঁশী
আমি একে নারী, তায় অবলা” (চ)
আমি সরলা, খলের সঙ্গে আমার বাস, তোমার পাগল-করা সুরে আমার সকল কাজেই ভুল হয়,–চারিদিক হইতে নিন্দা ও বিদ্রুপের বাণ বর্ষিত হয়।
কে সে যিনি বাঁশী বাজাইতেছেন?
“কে না বাঁশী বায় সখি, সে বা কোন জনা।”
সুর আমায় পাগল করে, তিনি যিনিই হউন, আমার সাধ হয়, তার পায়ে নিজকে বিকাইয়া ফেলি।
কে সে তিনি “মনের হরষে” বাঁশী বাজাইতেছেন, আনন্দ-স্বরূপ স্বয়ং পরমানন্দে বাঁশী বাজাইতেছেন, কিন্তু তাঁর পায়ে আমি কি অপরাধ করিয়াছি, সেই সুরে যে আমার সংসার ভাসিয়া যায়! চোখের জলে পথ দেখিতে পাই না,–
“অধোরে ঝয়ে মোর নয়নের পাণি,
বাঁশীর শবদে মুঞি হারাইলো পরাণী।” (চ)
বাঁশীর সুরে সংসার টুটিয়া পড়িতেছে। আনন্দময়ের আনন্দের আহ্বান, যে একবার শুনিয়াছে, সে ঘর করিবে কিরূপে?
“অন্তরে কুটিল বাঁশী, বাহিরে সরল।
পিবই অধর-সুধা উগারে গরল।” (চ)
বাঁশী কৃষ্ণ-মুখামৃত পান করিয়া বিষ উদ্গীরণ করিতেছে–সংসার হইতে আমাকে টানিয়া বাহির করিতেছে। এই ব্রজপুরে তো আরও অনেক রমণী আছে, কিন্তু বাঁশী কেন শুধু ‘রাধা’ ‘রাধা’ বলিয়া আমাকেই ডাকে?
“ব্রজে কত নারী আছে, তারা কে না পড়িল বাঁধা।
নিরমল কুলখানি যতনে রেখেছি আমি,
বাঁশী কেন বলে “রাধা-রাধা”! (চ)
শুধু আমারই নাম ধরিয়া ডাকে, আমার কুল–রাজার মেয়ে আমি, আমার যে আকাশ-স্পর্শী উচ্চ কুল, আর তো তাহা থাকে না।
চারিদিকে আনন্দের ডাক পড়িয়াছে–সে ডাক নামের একটা “বেড়া-জালে”র সৃষ্টি করিয়াছে, মন-শফরী সেই জানে পড়িয়াছে। ডাহিনে, বামে, সম্মুখে, পশ্চাতে শুনিতেছি ‘রাধা’, ‘রাধা’। কে যেন আনন্দের বেড়া-জাল আমাকে দিয়া ঘিরিয়াছে, আমি পলাইতে পথে পাইতেছি না।
এই বাঁশীর সুরের কথা শত শত পল্লী-গীতিকায় আছে, বাঙ্গলা দেশের মেঠো হাওয়ায়–সুরের আকাশে তাহা প্রতিধ্বনির মত অবিরত ধ্বনিত হইতেছে। মাঝে নৌকা বাহিরে বাহিরে দূর সিকতা-ভূমি হইতে তাহা শুনিয়া বৈঠা-হাতে মুগ্ধ হইয়া দাঁড়ায়। কিন্তু চণ্ডীদাসের কবিতায় উহা উর্দ্ধলোকের সংবাদ। এই সংসারের সাজানো বাগান ভাঙ্গিয়া–শত রাগ-রাগিণীর অন্ধি-সন্ধিম তাল-মানের কর্তপ এড়াইয়া উহা সুরের ব্রহ্মলোকে পৌঁছিয়া দেয়–তাই কবি “বাঁশের বাঁশী”কে “নামের বেড়াজাল” বলিয়াছেন।
“সরল বাঁশের বাঁশী নামের বেড়াজাল।
সবাই শোনয়ে বাঁশী–রাধার হ’ল কাল। (চ)
রাধার সংসার-বদ্ধ ছেদন করিতে উহা অধ্যাত্মলোক হইতে আসিয়াছে।
নাম-জপ দ্বারা রাখা ইহলোক হইতে প্রেমলোকে আকৃষ্ট হইয়াছেন, এই জপের পরিবেষ্টনী অতিক্রম করিয়া অমৃতের অধিকারী হইয়াছেন, তার পরে বাঁশী–অশিষ্ট বাঁশী–ঘরের বউকে নাম ধরিয়া ডাকিয়াছে। অন্য এক কবি লিখিয়াছেন–আমার সুখের গৃহের উপর “বংশীরব বজ্রাঘাত, পড়ে’ গেল অকস্মাৎ”; অপর কোন কবি বংশীরবকে বজ্রাঘাতের সঙ্গে তুলনা দিয়াছেন কি না জানি না, কিন্তু শ্যামানন্দ তাঁহার চিরসুহৃৎ নরোত্তমের চিত্র স্মরণ করিতে করিতে রাধার সম্বন্ধে এই গানটি লিখিয়াছেন। রাজকুমার নরোত্তমের তরুণ বয়সে সে আহ্বান,–প্রাণেশ্বরের বংশীধ্বনি–বজ্রাঘাতের মতই পড়িয়া, তাঁহাকে রাজপ্রসাদ হইতে আনিয়া পথের ভিখারী করিয়া দিয়াছিল। রাধার কাছে এই আনন্দের আহ্বান বজ্রাঘাতের মতই নিদারুণ হইয়াছিল। তিনি ঘর-করণা করিতে সমস্ত আয়োজন গুছাইয়া লইয়াছিলেন, এমন সময়ে ডাক পড়িল, তখন সব ফেলিয়া না যাইয়া উপায় নাই, প্রাণ-বন্ধু ডাকিতেছেন।